৪
বিতান যখন ছোট্ট। তাকে ঘিরে
উজ্জ্বল সম্ভাবনার স্বপ্নে শুভময়ী দেবী ভেবে রেখেছিলেন, তিনি স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে
দেবেন। বিতানের লেখাপড়া ও জীবনচর্চার পূর্ণ দায়িত্ব নিতে তিনি মানসিক প্রস্তুতি
নিচ্ছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল তাঁর এই চাকরি আর সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে
তোলা, একসঙ্গে চলতে পারে না। তাঁর এই চাকরির জন্যে বিতানের প্রতি এতটুকু অবহেলাও
যদি ঘটে যায়, আর তার জন্যে যদি বিতান এক অসফল, মধ্যমানের জীবনে গিয়ে পৌঁছয়, নিজেকে
তিনি ক্ষমা করতে পারবেন না। কাজেই তিনি স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলেন চাকরিটা
ছেড়ে দেবেন।
কিন্তু বিতানের বাবা, শুভময়ী
দেবীর শাশুড়ি কেউই মেনে নিতে
পারেননি, তাঁর এই অদ্ভূত সিদ্ধান্ত। তাঁদের মনে হয়েছিল এটা বাড়াবাড়ি। ছেলেকে মানুষ
করার জন্যে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে – কেন? যাদের বাবা-মা দুজনেই কর্মরত, তাদের
ছেলেমেয়েরা কি মানুষ হয় না? বিস্তর হয়, অজস্র উদাহরণ আছে আশেপাশে, চেনা-জানা
পরিবারে। আবার এমনও অনেক পরিবার আছে, যেখানে মা চাকরি করেন না, সর্বদা ঘর সংসার
সামলান, কিন্তু তাঁদের ছেলে-মেয়েরা একদমই মানুষ হয়নি। শুভময়ীদেবী এ যুক্তি মেনে
নিয়েছিলেন, সত্যি এরকম কোন সহজ-সরল নিয়ম হয় না - হতে পারে না, কিন্তু তবুও তিনি
ঠিকই করে ফেলেছিলেন, বিতানের লেখাপড়া শুরু হলেই চাকরিতে ইস্তফা দেবেন।
কিন্তু তার আগেই বিতানের মারাত্মক
অসুখটা ধরা পড়ল, ব্যর্থ চিকিৎসা পদ্ধতি চলতে লাগল দীর্ঘদিন। কলকাতা থেকে চেন্নাই,
চেন্নাই থেকে ভেলোর - ডাক্তার, হাসপাতাল, চেকআপের শিডিউলড ডেটস মেনটেন করতে
করতে তাঁরা জেরবার। বছর পাঁচেক এরকম টানাপোড়েন, আর দুশ্চিন্তার বিনিদ্র রজনী পার
করে, একসময় সব ডাক্তারই অসহায় মুখে স্বীকার করে নিল এ ব্যাধি দুরারোগ্য – নিরাময়ের
একমাত্র আশা ঈশ্বর এবং তাঁর অলৌকিক মহিমা। এই ব্যাপারটা জানার পর দুশ্চিন্তা দূর হল। কারণ
বুকের মধ্যে যে আশার আলো এতদিন ধরে জ্বলছিল, সেটা নিভে যাওয়ার পর এখন সমস্তই
অন্ধকার। এখন শুধু নিশ্ছিদ্র আঁধারে পথচলা। এ পথের শেষ কোথায় জানা নেই। পথের শেষে
লক্ষ্যপূরণের কোন দিশা নেই।
অসুস্থ ছেলেকে কে দেখভাল করবে, মা
ছাড়া? আপন মায়ের মতো মরমী সেবা কে দিতে পারে আর? কাজেই এইবার শুভময়ী দেবীকে সকলেই
চাকরিটা ছেড়ে দেবার প্রস্তাব দিল। তাঁর স্বামী, তাঁর শাশুড়ি, পাড়া-পড়শী, আত্মীয়-স্বজন।
শুভময়ী দেবীর সঙ্গে এইখানেই আবার মতবিরোধ ঘটল সকলের। শুভময়ী দেবী স্কুলের চাকরিটা
প্রাণ গেলেও আর ছাড়তে পারবেন না। কারণ তাঁর নিজের জন্যে দিনে কিছুটা সময় অন্ততঃ
দরকার, যখন তিনি ভুলে থাকতে পারবেন চঞ্চল এক শিশুর এই নিদারুণ পরিণতির মানসিক
যন্ত্রণা। ভুলতেও কি পারবেন - পারবেন না, অন্ততঃ আনমনা থাকতে পারবেন স্কুলের কাজ
নিয়ে, ক্লাসভরা নানান বয়সী মেয়েদের সাহচর্যে। না, কোন মতেই আর তাঁর পক্ষে স্কুলের
কাজ ছাড়া সম্ভব নয়।
ছেলেকে মানুষ করার তাগিদে তাঁর
চাকরি ছেড়ে দেবার পূর্বসিদ্ধান্ত যেমন কেউ মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। এবার অসুস্থ
ছেলের নিত্যসেবা করার গুরু দায়িত্ব এড়িয়ে, চাকরি না ছাড়ার সিদ্ধান্তও কেউ মেনে নিল
না। তাঁর মাতৃত্বের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলির সঠিক মূল্যায়ন সেবারও কেউ করেনি, এবারও
কেউ করার চেষ্টা করল না। কাজেই সকলেই বিরক্ত হল। তাঁর স্বামীও বিদ্রূপ করতে
ছাড়েননি, বলেছিলেন এটা নাকি শুভময়ী দেবীর পলায়নবৃত্তি মানসিকতা, নিষ্ঠুর সত্যের
মুখোমুখি না হয়ে, এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন তো হতেও পারে মায়ের
নিরন্তর সেবায় বিতান আরোগ্য হতে থাকল – ডাক্তাররা যে বলেছিলেন ঈশ্বরের মহিমা - মায়ের সেবাতে
সেই মহিমা অধরা নাও তো থাকতে পারে!
শুভময়ী দেবীর চাকরি না ছাড়ার অটল
সিদ্ধান্তের জেরে একটি প্রাইভেট সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল – যারা
প্রফেশন্যাল অ্যাটেন্ডেন্টস অ্যারেঞ্জ করে দেয়। সেই সংস্থা থেকেই নার্স পাঠিয়ে
দিয়েছিল বিতানকে দেখা শোনার জন্য। কথা হয়েছিল, বারো ঘন্টার
একটিমাত্র শিফ্টের জন্যে – সকাল আটটা থেকে রাত আটটা। পনেরদিন পর পর ডিউটি চেঞ্জ
হয়ে অন্য নার্স আসত। প্রথম বছর দেড়েক কোন অসুবিধে হয়নি, কারণ দুজন নার্সই পনের
দিনের অল্টারনেট রোটেশনে আসত। তারা বুঝে গিয়েছিল বিতানের সমস্যাগুলো আর তার
প্রয়োজন। এভাবেই সব কিছু চলছিল রুটিন মাফিক। রাত্রিটা শুভময়ী দেবী নিজেই সামলে
নিতেন। কতটুকু আর, রাত্রে সাড়ে নটা-দশটা পর্যন্ত - তারপর তো বিতান অঘোরে ঘুমোয়
ট্রাঙ্কুইলাইজারের এফেক্টে। আর সকালে সাতটায় ঘুম থেকে ডেকে তুলে বেডপ্যান দিয়ে,
মুখটুখ ধুইয়ে দেওয়ার কাজটা তিনিই করতেন। সকাল আটটায় নার্স এসে ব্রেকফাস্ট আর ওষুধ
দিয়ে শুরু করত তার ডিউটি।
নিয়মমাফিক যেমন চলার চলছিল ঠিকঠাক।
যে দুজন নার্স প্রথম দিকে নিয়মিত আসছিল, তারা হঠাৎ আসা বন্ধ করে দেওয়াতে, ঝামেলাটা
শুরু হল। নতুন নতুন নার্স আসত আর তাকে আদ্যন্ত বোঝাতে হত – চার পাঁচ দিনে সে কাজ
কিছুটা বুঝে যাওয়ার পরই আবার আসত নতুন নার্স। বহুবার বলা সত্ত্বেও সেই
সংস্থা থেকে প্রতিশ্রুতি ছাড়া কোন সুরাহা পাওয়া যায়নি। উপরন্তু এই নতুন নার্সরা
আদৌ কেউ নার্স ছিল না, সাধারণ কাজের মেয়েকেই ওই সংস্থা পাঠাতে শুরু করেছিল। তাঁরা ঐ সংস্থাকে মাস
গেলে চারশো টাকা রোজ হিসেব বারোহাজার টাকা পেমেন্ট করতেন, কিন্তু ওই মেয়েদের মুখে
শুনেছিলেন ওরা নাকি মেরে কেটে মাসে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার পায়।
মাস চার-পাঁচেক এভাবে চলার পর ঠিক
হল, কোন নার্স আর নয়, কোন সাধারণ কাজের মেয়েকেই সারাদিনের জন্যে রাখা হবে। সন্ধান
চলতে লাগল। দু-একজন আসছিল, কিন্তু পছন্দ হচ্ছিল না। শুভময়ী দেবীর কোন প্রফেশনাল ঝি
নয়, প্রয়োজন ছিল একটি মেয়ের, যে সহজ মনে কাজটা শিখে নেবে। আর একটু আন্তরিকতা যদি
থাকে তাহলে তো কথাই নেই।
চলবে...