Powered By Blogger
ধারাবাহিক উপন্যাস (বড়োদের) লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ধারাবাহিক উপন্যাস (বড়োদের) লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫

সুরক্ষিতা - পর্ব ৪

 

 

বিতান যখন ছোট্ট। তাকে ঘিরে উজ্জ্বল সম্ভাবনার স্বপ্নে শুভময়ী দেবী ভেবে রেখেছিলেন, তিনি স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দেবেন। বিতানের লেখাপড়া ও জীবনচর্চার পূর্ণ দায়িত্ব নিতে তিনি মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল তাঁর এই চাকরি আর সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলা, একসঙ্গে চলতে পারে না। তাঁর এই চাকরির জন্যে বিতানের প্রতি এতটুকু অবহেলাও যদি ঘটে যায়, আর তার জন্যে যদি বিতান এক অসফল, মধ্যমানের জীবনে গিয়ে পৌঁছয়, নিজেকে তিনি ক্ষমা করতে পারবেন না। কাজেই তিনি স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলেন চাকরিটা ছেড়ে দেবেন।

কিন্তু বিতানের বাবা, শুভময়ী দেবীর শাশুড়ি কেউই মেনে নিতে পারেননি, তাঁর এই অদ্ভূত সিদ্ধান্ত। তাঁদের মনে হয়েছিল এটা বাড়াবাড়ি। ছেলেকে মানুষ করার জন্যে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে – কেন? যাদের বাবা-মা দুজনেই কর্মরত, তাদের ছেলেমেয়েরা কি মানুষ হয় না? বিস্তর হয়, অজস্র উদাহরণ আছে আশেপাশে, চেনা-জানা পরিবারে। আবার এমনও অনেক পরিবার আছে, যেখানে মা চাকরি করেন না, সর্বদা ঘর সংসার সামলান, কিন্তু তাঁদের ছেলে-মেয়েরা একদমই মানুষ হয়নি। শুভময়ীদেবী এ যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন, সত্যি এরকম কোন সহজ-সরল নিয়ম হয় না - হতে পারে না, কিন্তু তবুও তিনি ঠিকই করে ফেলেছিলেন, বিতানের লেখাপড়া শুরু হলেই চাকরিতে ইস্তফা দেবেন।

কিন্তু তার আগেই বিতানের মারাত্মক অসুখটা ধরা পড়ল, ব্যর্থ চিকিৎসা পদ্ধতি চলতে লাগল দীর্ঘদিন কলকাতা থেকে চেন্নাই, চেন্নাই থেকে ভেলোর - ডাক্তার, হাসপাতাল, চেকআপের শিডিউলড ডেটস মেনটেন করতে করতে তাঁরা জেরবার। বছর পাঁচেক এরকম টানাপোড়েন, আর দুশ্চিন্তার বিনিদ্র রজনী পার করে, একসময় সব ডাক্তারই অসহায় মুখে স্বীকার করে নিল এ ব্যাধি দুরারোগ্য – নিরাময়ের একমাত্র আশা ঈশ্বর এবং তাঁর অলৌকিক মহিমা। এই ব্যাপারটা জানার পর দুশ্চিন্তা দূর হল। কারণ বুকের মধ্যে যে আশার আলো এতদিন ধরে জ্বলছিল, সেটা নিভে যাওয়ার পর এখন সমস্তই অন্ধকার। এখন শুধু নিশ্ছিদ্র আঁধারে পথচলা। এ পথের শেষ কোথায় জানা নেই। পথের শেষে লক্ষ্যপূরণের কোন দিশা নেই।

অসুস্থ ছেলেকে কে দেখভাল করবে, মা ছাড়া? আপন মায়ের মতো মরমী সেবা কে দিতে পারে আর? কাজেই এইবার শুভময়ী দেবীকে সকলেই চাকরিটা ছেড়ে দেবার প্রস্তাব দিল। তাঁর স্বামী, তাঁর শাশুড়ি, পাড়া-পড়শী, আত্মীয়-স্বজন। শুভময়ী দেবীর সঙ্গে এইখানেই আবার মতবিরোধ ঘটল সকলের। শুভময়ী দেবী স্কুলের চাকরিটা প্রাণ গেলেও আর ছাড়তে পারবেন না। কারণ তাঁর নিজের জন্যে দিনে কিছুটা সময় অন্ততঃ দরকার, যখন তিনি ভুলে থাকতে পারবেন চঞ্চল এক শিশুর এই নিদারুণ পরিণতির মানসিক যন্ত্রণা। ভুলতেও কি পারবেন - পারবেন না, অন্ততঃ আনমনা থাকতে পারবেন স্কুলের কাজ নিয়ে, ক্লাসভরা নানান বয়সী মেয়েদের সাহচর্যে। না, কোন মতেই আর তাঁর পক্ষে স্কুলের কাজ ছাড়া সম্ভব নয়।

ছেলেকে মানুষ করার তাগিদে তাঁর চাকরি ছেড়ে দেবার পূর্বসিদ্ধান্ত যেমন কেউ মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। এবার অসুস্থ ছেলের নিত্যসেবা করার গুরু দায়িত্ব এড়িয়ে, চাকরি না ছাড়ার সিদ্ধান্তও কেউ মেনে নিল না। তাঁর মাতৃত্বের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলির সঠিক মূল্যায়ন সেবারও কেউ করেনি, এবারও কেউ করার চেষ্টা করল না। কাজেই সকলেই বিরক্ত হল। তাঁর স্বামীও বিদ্রূপ করতে ছাড়েননি, বলেছিলেন এটা নাকি শুভময়ী দেবীর পলায়নবৃত্তি মানসিকতা, নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি না হয়ে, এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন তো হতেও পারে মায়ের নিরন্তর সেবায় বিতান আরোগ্য হতে থাকল – ডাক্তাররা যে বলেছিলেন ঈশ্বরের মহিমা - মায়ের সেবাতে সেই মহিমা অধরা নাও তো থাকতে পারে!

শুভময়ী দেবীর চাকরি না ছাড়ার অটল সিদ্ধান্তের জেরে একটি প্রাইভেট সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল – যারা প্রফেশন্যাল অ্যাটেন্ডেন্টস অ্যারেঞ্জ করে দেয়। সেই সংস্থা থেকেই নার্স পাঠিয়ে দিয়েছিল বিতানকে দেখা শোনার জন্যকথা হয়েছিল, বারো ঘন্টার একটিমাত্র শিফ্‌টের জন্যে – সকাল আটটা থেকে রাত আটটা। পনেরদিন পর পর ডিউটি চেঞ্জ হয়ে অন্য নার্স আসত। প্রথম বছর দেড়েক কোন অসুবিধে হয়নি, কারণ দুজন নার্সই পনের দিনের অল্টারনেট রোটেশনে আসত। তারা বুঝে গিয়েছিল বিতানের সমস্যাগুলো আর তার প্রয়োজন। এভাবেই সব কিছু চলছিল রুটিন মাফিক। রাত্রিটা শুভময়ী দেবী নিজেই সামলে নিতেন। কতটুকু আর, রাত্রে সাড়ে নটা-দশটা পর্যন্ত - তারপর তো বিতান অঘোরে ঘুমোয় ট্রাঙ্কুইলাইজারের এফেক্টে। আর সকালে সাতটায় ঘুম থেকে ডেকে তুলে বেডপ্যান দিয়ে, মুখটুখ ধুইয়ে দেওয়ার কাজটা তিনিই করতেন। সকাল আটটায় নার্স এসে ব্রেকফাস্ট আর ওষুধ দিয়ে শুরু করত তার ডিউটি।

নিয়মমাফিক যেমন চলার চলছিল ঠিকঠাক। যে দুজন নার্স প্রথম দিকে নিয়মিত আসছিল, তারা হঠাৎ আসা বন্ধ করে দেওয়াতে, ঝামেলাটা শুরু হল। নতুন নতুন নার্স আসত আর তাকে আদ্যন্ত বোঝাতে হত – চার পাঁচ দিনে সে কাজ কিছুটা বুঝে যাওয়ার পরই আবার আসত নতুন নার্সবহুবার বলা সত্ত্বেও সেই সংস্থা থেকে প্রতিশ্রুতি ছাড়া কোন সুরাহা পাওয়া যায়নি। উপরন্তু এই নতুন নার্সরা আদৌ কেউ নার্স ছিল না, সাধারণ কাজের মেয়েকেই ওই সংস্থা পাঠাতে শুরু করেছিলতাঁরা ঐ সংস্থাকে মাস গেলে চারশো টাকা রোজ হিসেব বারোহাজার টাকা পেমেন্ট করতেন, কিন্তু ওই মেয়েদের মুখে শুনেছিলেন ওরা নাকি মেরে কেটে মাসে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার পায়   

মাস চার-পাঁচেক এভাবে চলার পর ঠিক হল, কোন নার্স আর নয়, কোন সাধারণ কাজের মেয়েকেই সারাদিনের জন্যে রাখা হবে। সন্ধান চলতে লাগল। দু-একজন আসছিল, কিন্তু পছন্দ হচ্ছিল না। শুভময়ী দেবীর কোন প্রফেশনাল ঝি নয়, প্রয়োজন ছিল একটি মেয়ের, যে সহজ মনে কাজটা শিখে নেবে। আর একটু আন্তরিকতা যদি থাকে তাহলে তো কথাই নেই।

চলবে...


শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

সুরক্ষিতা পর্ব ৩

 

 

পোস্টমর্টেম, পুলিশ এবং তার যাবতীয় নিয়ম কানুন সব সামলেছিল মহাজন সাঁপুই। হলধর পোল্লের অন্তিম ক্রিয়াকর্ম থেকে শ্রাদ্ধশান্তি পর্যন্ত সবকিছুরই দায় সামলে দিয়েছিল মহাজন সাঁপুইবার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অফিসে মালতীর জন্যে একটা কাজ দেবে আর তার মেয়ের স্কুলে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সমস্ত ব্যয় সে বহন করবে। তাছাড়াও নগদ দুলাখ টাকা দেবে তাদের ভবিষ্যতের সুরাহার জন্যে।

জাগতিক নিয়মে সব শোক সন্তাপই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে থিতিয়ে আসে। তাৎক্ষণিক আর্দ্র আবেগ ও মেঘমেদুর সহানুভূতি, বাস্তবের রৌদ্রে শুকিয়ে আসে যত দিন যায়।  মহাজন সাঁপুইয়ের অফিসে কাজের জন্যে ঘুরতে ঘুরতে মালতী হতাশ হতে থাকল দিনকে দিন। আজ নয় কাল। কাল নয় পরশু। এ হপ্তা নয় সামনের হপ্তা। এ মাস নয় পরের মাস। স্কুলের ফিস বাবদ টাকাটা অবিশ্যি দিয়ে দিত ওদের অফিস থেকে। প্রায় সাত আট মাস এভাবে চলার পর একদিন মহাজন সাঁপুইয়ের অফিস থেকে মালতীকে ডেকে একটা পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। সেইসঙ্গে খুবই স্পষ্ট ভাষায় তারা বলে দিয়েছিল, আর নয়, এই শেষ। মালতী তাও একবার দেখা করতে চেয়েছিল মহাজন সাঁপুইয়ের সঙ্গে, বেশ ঝাঁঝালো উত্তর পেয়েছিল, “ওঁনার কি কাজ-কাম নাই নাকি? বসে বসে তোমার নাকে কান্না শুনলেই ওঁনার দিন চলবে? ফালতু নোকের ব্যাজব্যাজানি শুনার টাইম নেই ওঁনারতুমি এখন আসো তোযা পেয়েচো যতেস্ট – আর কত দোয়ানি করবে বলো দিকি? এদিকে আর আসবে নি কোনোদিন, এ বাবদে কোন লাভ হবে নি আর – এই বলে দিলোম”

 

ভিতরে ভিতরে ভয়ংকর একটা লড়াই চলছিলই, কিন্তু তার ওপরে ছিল একটা আশার প্রলেপ। একটা চাকরি, যেমন তেমন হলেও মাস গেলে কিছু টাকার নিয়মিত সংস্থান। মেয়েটার লেখাপড়াটা তো চালুই থাকল। আর দুলাখ পাওয়া গেলে, ব্যাংকে জমা করে দেবে, সুদে আসলে ওর বিয়ের সুরাহাটাও হয়ে যাবে। কতদিন আরএই তো, এই বোশেখ মাসেই মেয়ে এগারো পার হয়ে বারোয় পা দেবেতার মানে বড় জোর আর বছর সাত কি আটব্যস, মেয়েটার একটা ভালো ঘরে আর মনোমত বরে চারহাত এক করে দিতে পারলেই - মালতী ঝাড়া হাত পা। নিজেরটা বুঝে দেখবে তখন যা হোক।

এই আশার প্রলেপটাও সেদিন মুছে গিয়েছিল মালতীর জীবন থেকে। যেভাবে মালতীর জীবন থেকে মুছে গিয়েছিল সুখ, আহ্লাদ আর স্বপ্ন। সুলক্ষণা এয়োতির সমস্ত ভূষণ। ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল তার শাড়ির পাড়ের রংমালতীর বাবা চলে গেছেন কয়েক বছর হলো। মা আছেন, কিন্তু তিনিও একান্তই অসহায়, তার দুই ভাইয়ের জ্বলন্ত সংসারে। উপরন্তু, তার দুই ভাইয়ের কেউই এতটাও স্বচ্ছল নয়, আর্থিক বা মানসিক কোন দিক দিয়েই, যে বিধবা বোন এবং তার মেয়ের বাড়তি বোঝার দায় বহন করবে। কাজেই মালতীর সামনে ধূ ধূ ঊষরতা ছাড়া, কিছুই অবশিষ্ট রইল না ঘাড়ের ওপর লড়াইটা এসেই পড়ল, ধারাল নখ দাঁত শানিয়ে - হিংস্র পশুর মতো।

 

মহাজন সাঁপুইয়ের অফিস থেকে ফিরে, ঘরে দোর দিয়ে মালতী হিসেব নিয়ে বসল। ট্রাংক থেকে বের করল তার আর হলধর পোল্লের জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের পাস বই। জমা টাকার অংক ছ হাজার তিনশ বত্রিশ। শাড়ির ভাঁজে রাখা নগদ আটশো পঞ্চাশ টাকা। আর তার ব্লাউজে বুকের মধ্যে ছোট্ট পার্সে রাখা আটষট্টি টাকা – নোট আর খুচরো পয়সা মিলিয়ে। এই তার জমা। আর খরচের মধ্যে আছে বাড়ি ভাড়া, মেয়ের স্কুলের ফিস, খাতা-বই, খাওয়া দাওয়া, তেলটা, সাবানটা, রোগ-বিপদ, দায়-ঝক্কি ...শেষ নেই যেন – খরচ, খরচ আর খরচআর এই খরচের কোনটাই এককালীন নয় – মাসে মাসে আসবে – আসবে বছরের পর বছর – এ খরচ কখনও কমবে তো না বরং বেড়েই চলবে।

এত হিসেবপত্র কোনদিন তাকে করতে হয়নি, একে তো সে চাষী ঘরের মেয়ে তার ওপর, বিয়ের পর হলধর পোল্লেও এসব ব্যাপারে তার গায়ে আঁচ লাগতে দেয়নি কোনদিন। কিন্তু মালতী এতটুকুও দিশাহারা হল না নির্দিষ্ট লক্ষ্য তার ছিলই, মেয়েকে বড়ো করা আর তার বিয়ে দেওয়া। তার জন্যে এখন দরকার নিয়মিত উপার্জন আর সম্ভব হলে কিছু সঞ্চয়, ভবিষ্যতের জন্যে। খোলা ট্রাংকের সামনে স্থির হয়ে সে বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর সবকিছু গুছিয়ে রেখে ট্রাংক বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, বসে বসে হা হুতাশ করে কপাল চাপড়ানোর সময় আর নেই। চোয়াল শক্ত করে লড়ার দিন এসে গেছে এবং জীবনের এই যুদ্ধ তাকে জিততে হবেই।

...পরের পর্ব আসবে সামনের শনিবার।       

শনিবার, ৭ জুন, ২০২৫

সুরক্ষিতা - পর্ব ২

 

 

এইসময় বাইরের উঠোনে, বারান্দায়, তিনতলা স্কুলবাড়ির ঘরে ঘরে নানান বয়সের মেয়েরা দৌড়োদৌড়ি করে, খেলা করে, হৈ চৈ করে। খাওয়ার সময়টুকু যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করে নিয়ে ওরা টিফিন ব্রেক থেকে খেলার অবসরটুকু বাড়িয়ে নেয়। লাগামমুক্ত বাচ্চাগুলো স্কুলটাকে এমন মাতিয়ে রাখে, স্কুল নয়, মনে হয় যেন বিশাল কোন মেলা বসেছে – আনন্দের হাট

আর সেই সময় শুভময়ীদেবী টিচার্স রুমে তাঁর নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে এককাপ লিকার চা আর সঙ্গে চারটে বিস্কুট নেন, ব্যস আর কিছু নয়। এ তাঁর দীর্ঘদিনের বরাদ্দ। অন্য সহকর্ম্মীরা বাড়ি থেকে আনা ছোট-বড়ো বক্স বের করে টিফিন সারে। যার যেমন পছন্দ, যার যেমন প্রয়োজন। টিফিনের সঙ্গে সঙ্গে কথাবার্তাও চলে। সংসারের কথা, এরিয়ার ডিএর কথা, ক্লাস নেওয়ার কথা, অবাধ্য মেয়েদের দুষ্টুমির কথা। সবচেয়ে বেশি চলে নিজেদের ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠার এবং বড় হয়ে ওঠার নিত্য চিন্তা আর কাল্পনিক দুশ্চিন্তা নিয়ে কথা – অনুযোগ, অভিযোগ।

“কালকে কি হয়েছে জানেন, দিদি, কিটু রাতে খাওয়া দাওয়ার আগে পিসিতে ফেসবুক খুলে বসেছে। আর ওর বাবা গ্যাছে ভীঈষঅণ রেগেবলে – “সামনে তোমার ভাইট্যাল পরীক্ষা আর তুমি এখন ফেসবুকে টাইম ওয়েস্ট করছো”? - ওইটুকুনি ছেলে বাবার সঙ্গে কি তক্কো বাবা, কি তক্কো। শেষে রাগ করে দুজনেই বলে - রাত্রে কিছু খাবো না। আমার হয়েছে যতো জ্বালা, জানেন দিদি! ছেলেকে সামলাবো নাকি ছেলের বাবাকে। দুজনকে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে অনেক রাত্রে তারপর আমাদের খাওয়া হল...”

একটু পৃথুলা জিয়োগ্রাফির টিচার সীমার ছেলে কিটু - এবার এইচ এস দেবে – সঙ্গে আছে আই আই টি, মেডিকেল, ইঞ্জিনীয়ারিং এন্ট্রান্সের জয়েন্ট পরীক্ষাসমূহ। কাজেই বাবা মায়ের দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক।

অনেকটা কমবয়সী হিস্ট্রির টিচার ছিপছিপে লম্বা সরমারও অভিযোগের শেষ নেই তার কন্যা টুকলিকে নিয়ে, “তোমার তো তাও ভালো, দিদি। তোমার ছেলে তো জুয়েল  – লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট। মাধ্যমিকে কি রেজাল্ট, বাব্বাঃ, ভাবা যায় না। আর আমার মেয়ে দেখ, এই সবে ক্লাস নাইনেই তার পাখনা গজিয়ে গেছে। ওর লাস্ট বার্থডেতে, ওর ছোট মামা ২০জিবির আইপড গিফট করেছে। দিন রাত কানে গুঁজে গান শুনে চলেছে। ওর বাবা ওকে কত বোঝায় “হিয়ারিংএ প্রবলেমস আসবে, টুকলি, অমন সারাক্ষণ গান শুনতে হয় না”মেয়ে শুনলে তো? পড়তে বসেও কানে নিয়ে গান শোনে, আমি বারণ করলে কি বলে জানো, দিদি? বলে, গান শুনতে শুনতে পড়লে নাকি কনসেনট্রেসান বাড়ে। এই পাকা মেয়েকে নিয়ে কি করি বলো দেখি?”। 

শুভময়ীদেবী এই টিচার্স রুমে সবচেয়ে সিনিয়র। তিনি ম্যাথস পড়ান - সিনিয়ার টিচার  – এই বছরেই হয়তো অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মিস্ট্রেস হয়ে যাবেন। সেরকমই শোনা যাচ্ছে। তাঁর চেহারায়, ব্যবহারে এবং সদাস্মিত মুখে এক অনবদ্য ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করছেন এই স্কুলেই। অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার থেকে আজ তিনি সিনিয়ার টিচার। তাঁর শিক্ষকতা জীবনে কোনদিন উঁচু স্বরে কথা বলেননি। আজ পর্যন্ত তাঁর কাছে কোন ছাত্রীকেই কানমলা, নীলডাউন তো দূরের কথা – বকুনিও খেতে হয়নি কোনদিনঅথচ ছাত্রী এবং সহকর্ম্মী - সকলের থেকে তিনি পেয়েছেন যথোচিত সম্ভ্রম ও ভালোবাসা

শুভময়ী দেবী সকলের কথা স্মিতমুখে মন দিয়ে শোনেন। তিনি জানেন, এরা কেউই তাঁর কাছে কোন সমাধান প্রত্যাশা করছে না। নিজের নিজের সন্তানের জন্যে মাতৃসুলভ দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ ব্যক্ত করে, ওরা হাল্কা করে নিচ্ছে নিজেদের মানসিক চাপ  কিন্তু এর চেয়েও তিনি খুব মন দিয়ে শোনেন এই রুমের বাইরে, বারান্দায়, উঠোনে বাচ্চাদের দাপাদাপি আর হট্টগোলের শব্দ। এতগুলি শিশু, বালিকা এবং কিশোরীর সম্মিলিত জীবনের উচ্ছল প্রাণশক্তি তাঁকে মুগ্ধ করে রাখে। মাঝে মাঝে জানালায় দাঁড়িয়ে দেখেন ওদের। স্নেহে আর মায়ায় তাঁর দৃষ্টি নরম হয়ে আসে তাঁকে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়েরা কিছুটা সংযত হয় – শুভময়ীদেবী সরে আসেন। আহা, খেলুক ওরা খেলুক, আনন্দ করুক। এই তো বয়েস ওদের – ভবিষ্য কার জন্যে কি রেখেছে কে জানে? এই আনন্দটুকুই হয়তো সঞ্চয় হয়ে থাকবে ওদের সারাজীবনের স্মৃতিতে।

টিফিন ব্রেকের সময় শেষ হয়ে আসে। নীচের বারান্দায় ফার্স্ট বেল দেয় সুধাকর। শুভময়ীদেবী লক্ষ্য করেছেন প্রথম বেল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা অনেক সংযত হয়ে আসে। তাদের সম্মিলিত ধ্বনি কমে আসে। সকলেই কি এক উচ্ছ্বাসে যেন মেতে ছিল, এখন আবার সবাই নিজের মধ্যে ফিরে আসতে থাকে। সেকেন্ড বেল পড়ার আগেই অধিকাংশ মেয়ে ক্লাসে ঢুকে পড়ে, সেকেন্ড বেল পড়ে গেলে একটাও মেয়েকে আর বাইরে দেখা যায় না।

সেকেণ্ড বেল পড়ার পর টিচার্স রুমও খালি হয়ে যায়। চক–ডাস্টার নিয়ে দিদিমণিরা ক্লাস নিতে বেরিয়ে যান। টিফিন ব্রেকের পর দুটো পিরিয়ড শুভময়ীদেবীর সাধারণতঃ অফই থাকে। এই সময়টায় তিনি অফিসের বেশ কিছু কাজ সেরে নেন। সব কাজই তিনি সেরে ফেলেন সময়মতো। আজকের কাজ কালকের জন্যে তুলে রাখা তাঁর স্বভাব নয়। তাঁর জীবনের প্রত্যেকটা দিন খুব সন্তর্পণে আসে। কারণ আগামীকাল কী হবে তিনি জানেন না। হয়তো কাল – বেশ কয়েকদিন, সপ্তাহ, মাস...তিনি আসতে পারলেন না। এমন হতেই পারে। সদাপ্রসন্ন উদাসীন স্বভাবের আড়ালে তিনি চেপে রাখেন দীর্ঘশ্বাস। কাজ - একমাত্র কাজের মধ্যে ডুবে থাকলেই তিনি স্বস্তি অনুভব করেন – ভুলে থাকতে পারেন এক আপাত সরল অঙ্ক – যা আজও তিনি সমাধান করতে পারেন নি। প্রতিনিয়ত তিনি নিঃশেষ হয়ে চলেছেন এই মারাত্মক অঙ্কের দাহে।  তত্ত্বনির্ভর অঙ্কের সমাধান তাঁর আয়ত্তে – কিন্তু এ অঙ্ক জীবনের অঙ্ক - এক জটিল বাস্তব – এর সমাধান তাঁর আয়ত্তের অতীত।  

তখন বিতানের বয়েস ছিল মাত্র সাড়ে তিন। হাসিমাখা মুখে সারাদিন দস্যিপনায় ভরিয়ে রেখে দিত ঘরবাড়ি, সংসার, তাঁর জীবন। শুভময়ীদেবী স্কুল থেকে ঘরে ফেরার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকতেন, কতক্ষণে ঘরে ফিরে ওকে কোলে নেবেন। স্কুল থেকে ফিরে দুহাতে জড়িয়ে, ওকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে দীর্ঘ শ্বাসে ভরে নিতেন ওর ঘামে ভেজা চুলের ঘ্রাণ। সারাটা দিনে বিতানের হাজার দস্যিপনার খবর, তিনি মন দিয়ে শুনতেন তাঁর শ্বাশুড়ি আর কাজের মেয়ে ফুলকির থেকে। আর স্কুলছুটির দিনগুলো, সারাটা দিন কোথা দিয়ে যেন কেটে যেত ওর দৌরাত্ম্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে।  তখন সমস্ত চেতনা জুড়েই বিরাজ করত আত্মজ বিতান। সেই বিতান বেশ কদিনের জ্বর, গলায় এবং  সারা গায়ে ব্যথা, বমি, মাথা ব্যথা, সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণ নিয়ে অসুস্থ হয়েছিল। কিন্তু আর কোন দিনই সে সুস্থ হয়নি। তাঁর বিতান, তাঁর আদরের বিট্টু এখন, আ চাইল্ড উইথ টোটাল স্প্যাসটিসিটি।

...পরের পর্ব আসবে সামনের শনিবার

শনিবার, ৩১ মে, ২০২৫

সুরক্ষিতা - পর্ব ১

 

 

লক্ষ্মীকান্তপুরের মালতী পোল্লে রোজ সকালের লোকাল ট্রেন ধরে টালিগঞ্জ স্টেশনে নেমে প্রায় দৌড়ে চলে তার গন্তব্যে। মালতী পোল্লে একা নয় তার সঙ্গে থাকে আরো অন্ততঃ জনা পনেরো। একটু এগিয়ে, পিছিয়ে - নানান বয়সের - বুড়ি, মাঝবয়সি, ছুকরি। কেউ মুখরা - সব কথাতেই তেতে ওঠে – কেউ বাচাল – সব কথাতেই হেসে ওঠে। কেউ কেউ একটু আলাদা রকম - চুপচাপ উদাসীন নির্লিপ্তিতে দু একটা মন্তব্য করেই থেমে যায়। দুজন কমবয়সীর পরনে শালোয়ার-কামিজ ছাড়া প্রায় সকলেরই পরনে আটপৌরে সস্তার শাড়ী। পায়ে পেলাস্টিকের স্যান্ডেল – সস্তা কিন্তু বেশ টেকসই।  

 

মালতী পোল্লেদের এই দলটা একসঙ্গেই আসে রোজ। কোনদিন এক আধ জন কেউ বাড়তি কাজের চাপে আটকা না পড়লে, তারা ফিরেও যায় মোটামুটি একই সঙ্গে। এরা সকলেই ঠিকে ঝি। একটু ভাল করে বললে কাজের মাসি – কিংবা কাজের মেয়ে। বাবুদের বাড়ি তারা বাসন ধোয়, ঘর মোছে। কেউ কেউ কাপড়ও কাচে। এরা সকলেই কাজ করে এক বিশাল হাউসিং কমপ্লেক্সে। সে কমপ্লেক্সে কত যে ফ্ল্যাট আর কত যে বাসিন্দা তার হিসেব ওরা রাখে না। কিন্তু তাদের কাজের অভাব হয় না। এক বাড়ি ছাড়িয়ে দিলে অন্য বাড়ি থেকে ডেকে নেয়। তারা অর্থনীতি বোঝে না, বোঝে না মার্কেটের সাপ্লাই - ডিম্যান্ড রেশিও। পরতায় না পোষালে ওরা নিজেরাও এক বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্য বাড়িতে কাজ পেয়ে যায় নিশ্চিন্তে

সাধারণ ভাগচাষী ঘরের মেয়ে মালতীর বিয়ে হয়েছিল হলধর পোল্লের সঙ্গে। হলধর ছিল মহাজন সাঁপুইয়ের গুদামে রাতের সিকিউরিটি। মহাজন সাঁপুই বেশ পছন্দ করতেন হলধরকে আর ভরসাও করতেন। কারণ হলধরের ছিল ডাকাবুকো লম্বাচওড়া চেহারা আর বিস্তর গায়ের জোরডেকে হেঁকে কথাও বলতে পারত বেশ।

বিয়ের পর পরই মালতীর মনে আছে, একদিন শেষ বিকেলে তারা দুজন রথের মেলা থেকে ফিরছিল। হঠাৎ মাঝরাস্তায় কি বৃষ্টি, কি বৃষ্টি। আকাশ জুড়ে একখান বিশাল পাথরের মতো নিরেট মেঘ আর তেমনি জলের ধারা। দুপাশে ফাঁকা ক্ষেতের মধ্যে রাস্তার কোথাও মাথা বাঁচাবার উপায় নেই। ভেজা শাড়িতে ঘোমটাতে মালতীর একে জবুথবু অবস্থা, তার ওপর পেছল কাঁচা রাস্তায় হাঁটা দায়। পিছিয়ে পড়া মালতীর জন্যে বারবার দাঁড়াতে দাঁড়াতে হলধর ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিল।

তারপর আচমকা মালতীকে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিল, “এত হাল্কা তুই, য্যাঃ, য্যান এত্তটুকুন পাকি।...দ্যাক দেকি, এতটুকু গত্তি নেই শরীলে, আমার সঙ্গে পারবি ক্যানে - আজ থিকে আমার সঙ্গেরে খাবি”। মালতী অনেক অনুনয় - বিনয় - ঝটপট করেছিল ছাড়া পেতে, ছাড়েনি হলধর। আরো চেপে ধরে রেখেছিল আর হাসছিল হা হা করে। একসময় সেই বেহায়া ডাকাতটা অঝোর ধারায় নির্জন পথ চলতে চলতে মালতীর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়েছিল। 

কতক্ষণ কেটে গিয়েছিল মনে নেই মালতীর। ভীষণ লজ্জা কিন্তু তার চেয়েও ভীষণ ভালো লাগায় সে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলছাড়া পাওয়ার পরে মালতী বলেছিল, “তুমি একটা ডাকাত, মাঝ স্তায় এমন করতি আচে? কেউ যদি দেকে ফেলে”?

হলধরের পাটার মতো বলিষ্ঠ বুকের মধ্যে সংলিপ্ত মালতী, হলধরের হৃদয়ের শব্দ শুনতে শুনতে অবাক হয়ে দেখছিল তার মানুষটিকে। বড়ো ভালোবেসে ফেলেছিল সেইদিন। বিয়ের পর সেইদিনই প্রথম মালতী হলধরকে “তুমি” ডেকেছিল – তার আগে সে “আপনি” বলতকোন কথা বলছিল না হলধর। মালতী অস্ফুটে বলেছিল, “আমারে ছাড়ি দ্যাও। নামায়ে দ্যাও আমারে”হলধর নামিয়ে দিয়েছিল রাস্তায়দুজনে পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটছিল সেই নির্জন মেঠো পথে – মুষলধারে ঝরতে থাকা বরষার মধ্যে। তীব্র সুখে ডুবে থাকা শরীরি আবেগে মালতীর মনে হয়েছিল সে এক অদ্ভূত পথচলা – শেষ না হলেই বুঝি ভালো হয়।      

সেই দিনের কথা আজও মালতীর মনে আঁকা হয়ে আছে একই রকম জীবন্ত হয়ে। কারণ সেদিন ঘরে ফিরে অস্বস্তির শীতল সিক্ত বসনমুক্ত হতে হতেই ঘটে গিয়েছিল এক পরম আনন্দের মিলন। জোৎস্নাপ্লাবিত সাগরবেলা নয়। মনোরম পর্বত শিখরের মায়াবী পরিবেশও নয়। কিন্তু এক মধুর মধুচন্দ্রিমায় তারা সেদিন ভেসে যেতে পেরেছিল নিটোল ভালোবাসায় সম্পৃক্ত আকুল মিলনে।

কোল আলো করে এসেছিল তাদের মেয়ে। শ্যামল বরণ, ডাগর চোখে দুষ্টু হাসি। ছবির মতোই দেখতে, তারা আদর করে তার নাম দিল ছবি। হলধর যখন নাইট ডিউটি সেরে ভোরে ফিরত - ওই একরত্তি মেয়েটাও ঘুম ভেঙে জেগে বসে থাকত বাপের অপেক্ষায়। এমন বাপ সোহাগী! সেই মেয়েও বড়ো হতে থাকল দ্রুত। মালতীর মনে হয় যেন এই তো সেদিন।

স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে এল ওর বাপ। মেয়ের চুলে বেড়িবিনুনি বেঁধে দিত মালতী। “বুলু” স্কার্ট আর সাদা জামা, পিঠে ইস্কুল ব্যাগ। ডিউটি থেকে ফিরে ওর বাপ মুখ হাত ধুয়ে চা খেয়েই বেরিয়ে যেত মেয়েকে নিয়ে – মেয়ে থাকত কোলে আর বাপের হাতে ব্যাগ। ওইটুকু মেয়ে আবার বোঝা বইবে কি – হোক না কেন সে বিদ্যের বোঝা – এই ছিল হলধরের কথা।

সব চলছিল খুব সুন্দর - একদম মনোমত। কিন্তু এত সুখ সইল না মালতীর। তার সুখের কপাল পুড়ল সে এক গভীর রাত্রে।

 

মহাজন সাঁপুইয়ের পাইকারি ব্যবসা – নানান কারোবার, হরেক এজেন্সি। চারটে গুদাম বোঝাই থাকে মাল। রাত্রে যে মাল লোড হয় না, তা নয়। নিয়মিতই হয়। কিন্তু তার নিয়ম আছে। ডেলিভারি চালান, গেট পাস চলে আসে আগেই। কার গাড়ি, কোন গাড়ি লোড হবে সে সংবাদ সন্ধের আগেই চলে আসে অফিস থেকে। সেই অনুযায়ী মেন গেট খুলে লরি ঢোকে। মাল লোড হয়, চেক হয়ে - চালান সই হয়ে গাড়ি বেরিয়ে যায় নিয়ম মতো। যারা মাল নিতে আসে তারা নিয়মিতই আসে এবং তারা এই নিয়ম কানুন সবই জানে। কাজেই কোনোদিন অসুবিধে হয়নি - চেনা জানা অভ্যস্ত কাস্টমারদের সামলাতে।

সে রাতে ওরা চারজন এসেছিল। তাদের সঙ্গে ছিল খালি ট্রাক আর ট্রাক লোড করার লেবার। তারা কেউই চেনা নয়, সম্পূর্ণ অজানা। অফিস থেকে কোন খবর ছিল না। ওরা দেখাতে পারে নি কোন চালান বা গেট পাস। গেট খোলা হয় নি। হলধর কোনোমতেই অ্যালাউ করে নি তাদের। লোহার গেটের ভিতরে থাকা হলধর আর তার সঙ্গী সিকিউরিটির সঙ্গে বচসা শুরু হয়ে যায় গেটের বাইরে দাঁড়ানো ওই চারজনের। কথা কাটাকাটি, গালাগালি, হুমকি চলতে চলতেই গুলি চালায় ওদের মধ্যে একজন।

গুলির আওয়াজে এবং হলধর মাটিতে পড়ে যাওয়াতে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল সকলেই। হলধরের সঙ্গী সিকিউরিটি চেঁচামেচি করতে করতে সরে গিয়েছিল গেট থেকে – ফোন করে দিয়েছিল অফিসের বাবুদের। যে চারজন এসেছিল তারাও ব্যাপার সুবিধে নয় বুঝে উধাও হয়ে গিয়েছিল তৎক্ষণাৎ। শুধু মালতীর কপাল পুড়িয়ে এবং তার জীবনের সমস্ত রঙ নিকিয়ে নিয়ে, মাটিতে শুয়েই রইল হলধরের বলিষ্ঠ, স্তব্ধ - নিথর শরীরটা। রাত তখন পৌনে একটা।

রাতে মেয়ের লেখা পড়া সারা হলে, মা আর মেয়ে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছিল নিত্যদিনের রুটিন মাফিক। হঠাৎ মাঝ রাত্রে ডাকাডাকি করে তাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিল মহাজন সাঁপুইয়ের লোক। হলধরের শরীর খুব খারাপ, তাকে নাকি সদরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন তারা এসেছে গাড়ি নিয়ে হলধরের মেয়ে বউকে নিয়ে যেতে। দিশাহারা মালতী আর মেয়ে যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থাতেই বেড়িয়ে পড়েছিল। কী হয়েছে। কখন হয়েছে। গাড়িতে যেতে যেতে অনেকবার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও মহাজন সাঁপুইয়ের লোকটি কোন স্পষ্ট উত্তর দিচ্ছিল না।

 যেন এক অনন্ত যাত্রা শেষে তারা সদর হাসপাতালে পৌঁছোলো। তাদের আসতে দেখে অনেক লোকজনসহ মহাজন সাঁপুইও এগিয়ে এসেছিল। ব্যাকুল হয়ে মালতী জিজ্ঞাসা করেছিল, “বাবু, এরা কেউ কিচু বললনি আমারে, কি হয়েচে আমারে বলেন না, মানুষটা বেঁচে আচে তো”? আধো আলো - আধো অন্ধকার হাসপাতাল কম্পাউন্ডে দাঁড়িয়ে মহাজন সাঁপুই অন্ধকার মুখ করে উত্তর দিয়েছিল, “ধৈর্য হারায়ো না, মাশান্ত হও -  তোমার সোয়ামি বীরগতি পেয়েচে – এসো, আমার সঙ্গেরে এসো”।  অবাক মালতী কি বলবে বুঝতে পারল না, “বীরগতি” মানেই বা কি হতে পারে তার বোধে কোন সাড়া দিল না।


হাজন সাঁপুই ওদেরকে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকল। দীর্ঘ করিডর, প্যাসেজ পার হয়ে বারান্দার ধারে রাখা একটা বেডের সামনে তারা দাঁড়াল। সে বেডে মাথা থেকে পা অব্দি ময়লা সাদা চাদরে ঢাকা একটা শব। মহাজন সাঁপুইয়ের ইশারায় কেউ একজন মুখ থেকে সরিয়ে দিল সাদা চাদরের আবরণ। চোখ বুজে শুয়ে আছে হলধর পোল্লে। যেন ঘুমোচ্ছে। মুখে কোন বিকৃতি নেই, কোনো কষ্টের চিহ্ন নেই – শুধু কপালের বাঁদিক ঘেঁষে একটা গভীর ছিদ্র। আর তার পাশে শুকিয়ে যাওয়া অনেকটা রক্তের দাগ। 

(পরের পর্ব নেক্সট শনিবার...)

নতুন পোস্টগুলি

জঙ্গী ব্যবসা

  ১   ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ