Powered By Blogger

রবিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৫

মহাভারতের কথাঃ- রমণীর চোখে রমণীয়া নারী

 সংসারে অজানা, অচেনা রূপসী এবং যুবতী পরিচারিকা ঢোকালে সংসারের কর্ত্রীর কী কী বিপদ ঘটতে পারে? কোন কোন দিক থেকে নেমে আসতে পারে সাংসারিক জটিলতা? এমনকি কপাল এবং মুখ দুটোই পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও যে অমূলক নয়, সে কথা হাড়ে হাড়ে টের পান কমবেশী সকল সংসারের ওয়াকিবহাল গিন্নীরা। বাড়ির পরিচারিকাকে না হয় তাও এড়িয়ে যাওয়া যায়, দাঁতে ছোপধরা, গালে মেচেতার দাগ, নক্কিমাসি কিংবা পদ্দোমাসিকে দিয়ে, কিন্তু সেই নারী যদি হয় অফিসের সুন্দরী সেক্রেটারি? সেক্ষেত্রে বিপদ আরো বেশী। সপ্তাহের পাঁচ থেকে ছদিন, দিনে আট-নঘন্টা একসঙ্গে ওঠাবসা, কথাবার্তা, চোখাচোখি। লাঞ্চ সারতে সারতে কিংবা বাদলা দিনে হালকা মেজাজে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে, নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের কথা বলতে বলতে, অনেক বেশী বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এবং হয়ও। যে সব গিন্নিরা কত্তাদের চোখে চোখে রাখেন, নিজের মানুষটির চালচলনের চালাকি চটপট ধরে ফেলেন, তাঁদের জন্যে চিন্তা একটু কম। কিন্তু যাঁরা একটু আলবোড্ডে টাইপের, যাঁরা তাঁদের মানুষটিকে প্রাণ ভরে বিশ্বাস করেন, চোখ বন্ধ করে ভরসা করেন এবং স্বামীর প্রতিটি কথাই বেদবাক্য বলে মনে করেন, তাঁরা কী করবেন?

 
তাঁদের জন্যেই সব শাস্ত্রের সার মহাভারত থেকে তুলে আনা একটি ঘটনার বিবরণ দিলে, সেই সব সরলমতি অবলা গৃহিণীরা কিছুটা বুঝতে পারবেন, যুবতী নারী তুলকালাম সুন্দরী হলে, ঘনিষ্ঠ পুরুষের সঙ্গে রসায়নটা কী দাঁড়াতে পারে!
 
অজ্ঞাতবাসের সময়, পাঞ্চালদুহিতা দ্রৌপদী, পাণ্ডব স্বামীদের সঙ্গে বিরাটরাজের অন্দর মহলে ঢুকলেন পরিচারিকার কাজের সন্ধানে। ইচ্ছে একটা বছর নাম পরিচয় লুকিয়ে রাজপ্রাসাদে কাটিয়ে দেবেন। তাঁরা আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলেন তাঁর নাম হবে সৈরিন্ধ্রী, আর বিরাট রাজমহিষীর পরিচারিকা হিসেবেই কাজ করবেন। সেই পরিকল্পনা মতোই প্রস্তুত হয়ে  তিনি এগিয়ে চললেন বিরাট রাজপ্রাসাদের দিকে -

“অসিতলোচনা দ্রৌপদী, মেঘবরণ কেশে সূক্ষ্ম, সুকোমল ও দীর্ঘ বেণী বাঁধলেন, মলিন বসন পরলেন, তারপর সৈরিন্ধ্রী বেশে রাজপ্রাসাদের দিকে হাঁটতে লাগলেন। নগরের পথে স্ত্রী পুরুষেরা দ্রুতপায়ে তাঁর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, “হ্যাঁগা, তুমি কে, গা? কিসের জন্যে এয়েচ এই নগরে?” তারা বারবার এই কথা জিজ্ঞাসা করায়, দ্রৌপদী বললেন, “আমি সৈরিন্ধ্রী, যদি কেউ আমাকে একটা কাজ দেন, সে কাজ আমি খুব সুন্দর ক’রে করে দেব। কাজের খোঁজে এসেছি, গো, কাজের খোঁজে”। কিন্তু তাঁর অসামান্য রূপ- লাবণ্য, মলিন হলেও পরনের বসনবিন্যাস ও এমন মধুর স্বরে সুস্পষ্ট উচ্চারণের কথা শুনে, তাঁকে দু মুঠি অন্নের কাঙালিনী বলে, কেউ বিশ্বাসই করতে পারল না।
বিরাট রাজমহিষী সুদেষ্ণা সেই সময় প্রাসাদের ছাদে উঠে রাজপথের দিকে তাকিয়ে অলস অবসর যাপন করছিলেন। হঠাৎ রাজপথে মরালগমন ভঙ্গিতে পথচলা পাণ্ডবপ্রিয়া দ্রৌপদীতে তাঁর চোখ আটকে গেল। রাজমহিষী তাঁর অসাধারণ রূপ এবং তাঁকে অনাথা, ও এক-বসনা দেখে, ডেকে পাঠালেন। 
 
জিজ্ঞাসা করলেন, “ভদ্রে, তুমি কে? এবং কী অভিলাষে তুমি এখানে এসেছ”? দ্রৌপদী তাঁকেও একই কথা বললেন, “আমি সৈরিন্ধ্রী, যদি কেউ আমাকে একটা কাজ দেন, সে কাজ আমি খুব সুন্দর ক’রে করে দেব। হে মহারাজ্ঞি, আমি কাজের খোঁজেই এখানে এসেছি”।
 
সুদেষ্ণা বললেন, “হে ভাবিনি, তুমি যেভাবে বলছো, তোমার মতো কামিনীদের পক্ষে সেরকম কখনোই সম্ভব নয়। বস্তুতঃ, তোমাকে দেখে মনে হয়, তুমিই অনেক দাসদাসী রাখতে পারো। তোমার গোড়ালি উঁচু নয়, তোমার দুই উরু নিবিড়, তোমার নাভিদেশ অত্যন্ত গভীর, তোমার নাক উন্নত, তোমার নেত্রকোণ, করতল, চরণতল, জিভ ও অধর রক্তিম; তোমার বাক্য রাজহংসীর মতো অস্ফুট গদগদ, কেশবিন্যাস অতি মনোহর, তোমার শ্যামল অঙ্গ, তোমার নিতম্ব ও পয়োধর নিবিড়তম, তোমার আঁখিপক্ষ্ম বক্র, তোমার কটিতট ক্ষীণ, গ্রীবা শঙ্খের মতো, তোমার শরীরের কোন শিরা দেখা যায় না এবং তোমার মুখমণ্ডল পূর্ণিমার চাঁদের মতো রমণীয়। তুমি কাশ্মীরি অশ্বিনীর মতো এবং পদ্মপলাশলোচনা কমলার মতো অপরূপা। হে ভদ্রে, তোমাকে পরিচারিকা বলে মোটেই মনে হচ্ছে না। তুমি যক্ষ রমণী কি দেবকামিনী নও তো? গন্ধর্বী বা অপ্সরা? নাগবনিতা কিংবা এই নগরীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী? বিদ্যাধরী, কিন্নরী কিংবা স্বয়ং রোহিণী? তুমি অলম্বুষা না কি মিশ্রকেশী? পুণ্ডরিকা বা মালিনী? অথবা তুমি কি ইন্দ্রাণী, বারুণী, বিশ্বকর্মার পত্নী, ব্রহ্মাণী কিংবা অন্যান্য দেবকন্যাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতমা? সে যাই হোক, তুমি কে বল”?
দ্রৌপদী বললেন, “হে মহারানি, আমি দেবী, গন্ধর্বী, অসুরী বা রাক্ষসী নই। সত্যি বলছি, আমি সৈরিন্ধ্রী। আমি কেশসংস্কার, রূপচর্চা, কেশসজ্জা, চন্দন ইত্যাদি বিলেপন এবং মল্লিকা, উৎপল, কমল ও চম্পক প্রভৃতি ফুলের বিচিত্র মাল্য গ্রন্থন করে থাকি। প্রথমে আমি কৃষ্ণপ্রিয়তমা সত্যভামা এবং তারপরে কুরুকুলের একমাত্র সুন্দরী দ্রুপদকুমারীর সেবা করেছিলাম। সেই স্থানে আমি সমুচিত অশন ও বসন সহ পরমসুখে কাল কাটাচ্ছিলাম। স্বয়ং দ্রুপদকুমারী ভালোবেসে আমাকে "মালিনী" নামে ডাকতেন। রাজ্যচ্যুত হয়ে ওঁরা কোথায় অজ্ঞাতবাসে চলে গেছেন, জানি না, তাই কর্মহীনা হয়ে, আজ কর্মের সন্ধানে আপনার আশ্রয়ে এসেছি”।
সুদেষ্ণা বললেন, “আমি তোমাকে মাথায় করে রাখতে পারি। কিন্তু ভয় হয়, পাছে আমার রাজা সর্বান্তঃকরণে তোমার জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠেন। পুরুষের কথা দূরে থাক, এই রাজকুল এবং আমার গৃহের যত রমণীরাও মুগ্ধ হয়ে, অনন্যমনে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার প্রাসাদে ও উদ্যানের যত তরু,  তারাও তোমাকে দেখার জন্য মাথা নত করেছে। হে নিবিড়নিতম্বিনি, বিরাটরাজ তোমার অলৌকিক অঙ্গসৌষ্ঠব মন দিয়ে দেখলে, আমাকে ত্যাগ করে, তোমাতেই মন ও প্রাণ সমর্পণ করে দেবেন। হে চঞ্চলায়তলোচনে, অনুরাগের সঙ্গে তুমি যে পুরুষের দিকে দৃষ্টি দেবে অথবা সর্বদা যার চোখের সামনে তুমি থাকবে, সে পুরুষ অবশ্যই অনঙ্গ শরে বশীভূত হবে। মানুষ আত্মহত্যার জন্য যেমন উচ্চ তরুশাখায় চড়ে বসে, আমার পক্ষে তোমাকে রাজপুরীতে স্থান দেওয়াও অনেকটা সেই রকম। ফলে তোমাকে রাজ অন্তঃপুরে স্থান দেওয়া, কাঁকড়ার গর্ভধারণের মতো, আমার পক্ষে মৃত্যুস্বরূপ হয়ে উঠবে”।
দ্রৌপদী বললেন, “হে ভাবিনি, মহারাজ বিরাট বা অন্য কোন পুরুষ আমাকে লাভ করতে সমর্থ হবেন না, কারণ পাঁচজন যুবা গন্ধর্বতনয় আমার স্বামী, তাঁরা মহাসত্ত্ব গন্ধর্বরাজের পুত্র। আমার ঐ পঞ্চ স্বামী আমাকে সর্বদা রক্ষা করে থাকেন। যিনি আমাকে উচ্ছিষ্ট দান না করেন এবং আমাকে দিয়ে পদ প্রক্ষালন ইত্যাদি পদসেবার কাজ না করান, তাঁর প্রতি গন্ধর্বগণ প্রসন্ন হয়ে থাকেন। যে পুরুষ ইতরকামনায় আমার প্রতি লোভপরবশ হয়, সেই রাত্রেই সেই পুরুষকে শমন সদনে যেতে হয়। কোন পুরুষই আমাকে, আমার স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। আমার প্রিয়তম গন্ধর্ব স্বামীগণ, এখন দুঃখসাগরে নিমগ্ন হয়েও, প্রচ্ছন্নভাবে আমার কাছাকাছিই থাকেন এবং আমাকে রক্ষা করে থাকেন”।
বিরাট রাজমহিষী সুদেষ্ণা বললেন, “হে আনন্দবর্ধিনি, তোমাকে তোমার মনের মতোই বসন দেব এবং তোমাকে কারও চর্বিত কিংবা উচ্ছিষ্ট খাবারও দেওয়া হবে না”।



শ্রীকৃষ্ণের পত্নী সত্যভামা এবং পাণ্ডব-পত্নী দ্রৌপদীর রেফারেন্সেই  সৈরিন্ধ্রী - অর্থাৎ বিউটিসিয়ানের কাজটা পেয়ে গেলেন দ্রুপদনন্দিনী । তিনি একবছর রাজমহিষী সুদেষ্ণার পরিচারিকা হিসাবে সাফল্যের সঙ্গেই কাজকম্ম করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে রাজমহলে মারাত্মক এক বিপদও উপস্থিত হয়েছিল। সে বিপদ অবশ্য মহারাজ বিরাটের দিক থেকে নয়, অন্য পক্ষ থেকে। সে আর এক বৃত্তান্ত, অন্য আরেক দিন করা যাবে।
 
এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলা জরুরি, এই সৈরিন্ধ্রী-সুদেষ্ণা বাক্যালাপ কিন্তু কোন মহিলার লেখা নয়, লিখেছেন এক জবরদস্ত মহাপণ্ডিত বেদজ্ঞ পুরুষ, মহর্ষি বেদব্যাস, কুরু রাজ পরিবারের অন্দরমহলে যাঁর ছিল অতি ঘনিষ্ঠ যাতায়াত। সেই সূত্রেই হয়তো কোনদিন এইরকম কোন অভিজ্ঞতা, তিনি পর্যবেক্ষণ করে থাকবেন। নারীর চোখে নারীদেহ বর্ণনার আড়ালে তাঁকে চট করে পুরুষ বলে চিনে ফেলা যায়। কিন্তু সর্বাঙ্গসুন্দরী এক নারী পরিচারিকার জন্য গৃহকর্ত্রীর মানসিক সংশয় ও দ্বিধার বর্ণনাটি বড়ো নিখুঁত ও অনবদ্য এবং আজও প্রাসঙ্গিক। একথা ভুক্তভোগী নারী ও পুরুষ প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও, মনে মনে মেনে নেবেন, সন্দেহ নেই!           

(কৃতজ্ঞতা ও ঋণস্বীকারঃ মহামতি কালিপ্রসন্ন সিংহ বিরচিত সম্পূর্ণ মহাভারতের বাংলা গদ্য অনুবাদ থেকে সংগৃহীত। বিরাটপর্ব।)   
 
--০০--

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

জঙ্গী ব্যবসা

  ১   ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ