Powered By Blogger

শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৪

গোলমেলে ফুটবল

 

 গত বুধবার যা হল, সে আর বলার কথা নয়। আমাদের ঝিঙেপোতা সবুজ সংঘের সঙ্গে ওপাড়ার সুহৃদ সংঘের ফুটবল ম্যাচ ছিল। তার যা রেজাল্ট হল, তাতে পাড়ায় আমাদের মুখ দেখানোই দায় হয়ে উঠল। খেলায় হার জিত আছে, সে আর কে না জানে? খেললে সব সময় জিততেই হবে, এমনও হয় না। কিন্তু তাই বলে এমন হার? ছ্যাঃ। ক্রিকেট খেলায় ছাব্বিশ রানে দু উইকেট হামেশা হয়, কিন্তু ফুটবলে, ২৬-২ গোলে হারা! আমার এই আট বছরের ফুটবল জীবনে কোনদিন ঘটে নি। সুহৃদ সংঘের ছাব্বিশ গোল, আর আমাদের দু গোল, সে গোল দুটো অবশ্য আমারই দেওয়া! আমিই এই দলের ক্যাপ্টেন বীরু।

আমাদের এই মিলনপল্লীর মাঠে সাত-আটজনের টিম করে আমরা ফুটবল খেলি। ছোট মাঠ তো, দু একবার চেষ্টা করে দেখা গেছে, বাইশজন মাঠে নামলে সেটা আর খেলা থাকে না, মেছো হাট হয়ে যায়। হাতে পায়ে জট লেগে যায়। স্কুলের গরমের ছুটিতে, এই মাঠেই আমাদের পাড়ার যত লিগ ম্যাচগুলো হয়। আর স্কুল খোলার আগে সেমি ফাইন্যাল, ফাইন্যাল হয়ে, লিগ শেষ হয়ে যায়। চ্যাম্পিয়ন ক্লাবের ঘরে ‘ঝিঙেপোতা শ্রীমতীসৌদামিনীদেবী স্মৃতি ফুটবল উন্নয়ন সমিতি’র কাপ ঢুকে পড়ে। ক্লাবঘরে নড়বড়ে টেবিলের ওপর শুকনো ফুলের মালা পড়ে চকচকে কাপ, সারাবছর শোভা পায়।

গতবার এই কাপ আমাদের ক্লাবে ছিল। লিগ শুরু হবার আগে উন্নয়ন সমিতির সেক্রেটারির কাছে সে কাপ ফেরত চলে গেছে। এবারের লিগ শেষে, সেই কাপ কোন ক্লাবের ঘরে যাবে সেটাই এখন দেখার। কিন্তু আমাদের আজকের খেলার যা নমুনা, তাতে এবার আমাদের হাতে যে চা খাবার কাপও জুটবে না, সে কথা বলাই বাহুল্য। আমাদের টিমে সেন্টু আর ভজা পিটোপিঠি দুই ভাই, দুজনেই সেরা খেলোয়াড়। ভজা বড়ো, আর সেন্টু বছর দুয়েকের ছোট। সেন্টু খেলে ফরওয়ার্ডে আর ভজা গোল পোস্ট সামলায়। আমাদের মাঠে গোলপোস্ট একটাই, মাঠের পশ্চিমদিকে, বাঁশের কাঠামো। আর উল্টোদিকে পাইনদের পোড়ো বাড়ির উচুঁ পাঁচিলে হলুদ রঙে আঁকা অন্য গোল পোস্ট

আমাদের সেন্টু পায়ে একবার বল পেলে, সে বল তার পা ছাড়ে না। চুম্বকের সঙ্গে কাঁচা লোহার মতো বলটা তার পায়েই যেন চিপকে থাকেসে বল গোলে ঢোকার আগে সেন্টুর পা ছাড়ে। অথচ আজ তার পা থেকে একটা গোলও পাওয়া গেল না। যে কবার বল পেয়েছে, সুহৃদ সংঘের ছেলেদের পায়ে বল তুলে দিয়ে সে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।  আর যে কটা গোলে শট নিয়েছে, বল উড়ে গেছে গোলপোস্টের অনেক বাইরে দিয়েফুটবলে ভাগ্যিস ওয়াইড বল হয় না, হলে আমাদের হয়তো পেনাল্টি খেতে হত।

ওদিকে আমাদের ভজা তালপাতার সেপাইয়ের মতো ঢ্যাঙা আর হাড্ডিসার চেহারা হলে কি হবে, দারুণ ছটফটে। ডিগবাজি দিয়ে, লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে, গোলমুখি বলকে খপাৎ করে পাকড়াও করে ফেলে। ঠাকুমার মুখে শুনেছি, ছোটবেলায় পবনপুত্র হনুমান নাকি, ভোরের সূর্যকে টুকটুকে ফল ভেবে, আকাশ থেকে টুক করে পেড়ে এনেছিলেন। আমাদের ভজুও সেরকমই শূণ্য থেকে, যখন তখন দু হাতে গোলমুখি বল নামিয়ে আনতে পারে। আজকে পারল না। একটা বলও ধরতে পারল না। মাগুর মাছের মতো গোলমুখি বলগুলো ভজার পায়ের ফাঁক দিয়ে বগলের তলা দিয়ে, আর হাত ফস্কে একের পর এক গোলে ঢুকে গেল। ভজা নিজে এবং আমরা বাকি সবাই অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম তার আজকের এলেম

সেদিন খেলা শেষ হবার মিনিট আটেক আগেই খেলা অবশ্য শেষ হয়ে গিয়েছিল, নাহলে আরও কতো গোল আমাদের কপালে লেখা ছিল কে জানে! হয়েছিল কি, সেকেণ্ড হাফে সুহৃদসংঘ পাইনবাড়ির দেওয়ালের দিকের গোলপোস্ট সামলাচ্ছিল। সেন্টু গোল থেকে সাত ফুট দূর থেকে এমন একটা শট মারল, বল চলে গেল পাইন বাড়ির উঁচু পাঁচিল টপকে ভেতরের আগাছার জঙ্গলে। শেষ বিকেলে ওই আগাছার জঙ্গল থেকে বল খুঁজে আনার মতো বুকের পাটা আমাদের ছিল না। আর বল খুঁজে এনে শেষ আট মিনিটে চব্বিশটা বকেয়া গোল শোধ করে, আমরা খেলায় সমতা আনবো, এমন আশাও ছিল না। কাজেই আমি, আমার দলের ক্যাপ্টেন, সকলের সঙ্গে কথা বলে, হার স্বীকার করে নিলাম আর সিদ্ধান্ত দিলাম, আজকের মতো খেলা এখানেই শেষ। আর পাইনবাড়ির ভেতরে চলে যাওয়া বলটা আমাদেরই ক্লাবের বল। কাজেই ওটা ফিরিয়ে আনার কোন তাড়া নেই, কাল সকালে ধীরেসুস্থে নিয়ে এলেই হবে।

খেলা শেষ ঘোষণা হওয়ার পর রেফারি সুমন্তদা চলে গেলেন। কিছুক্ষণ থেকে, আমাদের কাটা ঘায়ে নুন-টুন ছিটিয়ে চলে গেল সুহৃদসংঘের ছেলেরাও। আমরা আটজন, সাতজন খেলছিলাম, আর হাবু একস্ট্রা, গোল হয়ে বসলাম মাঠের ধারে, পাইনবাড়ির দেওয়ালটা পিছনদিকে রেখে। তেমন কিছুই বলার ছিল না। ছাব্বিশটা গোল খেয়ে আমাদের অবস্থা কাহিল। 

হাবু ঘাসের একটা চিকন ডগা চিবুতে চিবুতে বলল, ‘সেন্টুকে কিছুক্ষণ রেস্ট দিয়ে আমাকে নামাতে পারতিস। বীরু, বরাবর দেকেচি সেন্টুর ব্যাপারে তুই একদম অন্ধ'।

আমি একথার কী আর উত্তর দেব? ক্যাপ্টেন হিসেবে এমন কথা আমাকে এখন শুনতেই হবে। আমি তো জানি হাবুর এলেম, সেন্টুর ধারে কাছেও দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু আজকে যা হল, কিছু বলার মতো আমার আর মুখ নেই। কে জানে, হাবু খেললে, আমি আর ও মিলে হয়তো আরো কয়েকটা গোল শোধ করা যেত। হাবুর কথার উত্তর না দিয়ে আমি সেন্টুর দিকে তাকালাম। জিগ্যেস করলাম, ‘তোর আজ কি হল বলতো, সেন্টু? আজ তোর কিচ্ছু ঠিকঠাক হচ্ছিল না। না পারলি বল পায়ে রাখতে। না পারলি একটাও ঠিকঠাক পাস দিতেনিজে শট নিয়ে গোলে একবারও বল ঢোকাতে পারলি না। এমন তোর কোনদিন দেখিনি’।

আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস আর ব্যাজারমুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেন্টু বলল, ‘আউট অফ ফর্ম। বুঝেছিস বীরু, আজকে একদম আউট অফ ফর্মে ছিলাম। প্রথম থেকেই খুব নার্ভাস লাগছিল। পায়ে বল এলেই মনে হচ্ছিল, এটা কি রে বাবা, গোলমতো বলটাকে কিভাবে সামলাবো। বলের ঠিক কোনখানে মারলে ঠিকঠাক পাস হবে বুঝতে বুঝতেই সুহৃদ সংঘের ঝন্টু নয়তো মিল্টন বলটা কেড়ে নিচ্ছিল।‘

‘সে তো নেবেই, খেলতে নেমে তুই বল নিয়ে গবেষণা করবি, আর অন্য সবাই দাঁড়িয়ে দেখবে তাই হয় নাকি?’ বিরক্ত হয়েই বললাম সেন্টুকে। 

সেন্টু মাথা ঘাড় চুলকে বলল, ‘সেই। সেটাই তো। কিছুতেই বুঝতে পারলাম না, কিভাবে শট মারতে হবে। বলটা এমন গোল না হয়ে একটু ট্যাপা মতো হলে, আমার মনে হয় খেলার সুবিধে হতো’।

সেন্টুর এই কথায় আমাদের দলের সবাই হেসে উঠল হ্যা হ্যা করেআমি আরো বিরক্ত হলাম, আর অবাকও হলাম। আমাদের দলে আমি আর সেন্টু একসঙ্গে খেলছি, প্রায় বছর চারেক হতে চলল। আমাদের রেকর্ড আছে আঠারোটা পর্যন্ত গোল করার। গতবারই আমাদের ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, আর সেন্টু হয়েছিল সবচেয়ে বেশি গোলদাতা। ১৫৮টা গোল দিয়েছিল, কুড়িটা ম্যাচেতার মুখে একথা শুনে আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না। 

হতাশ হয়ে আমি এবার ভজাকে জিগ্যেস করলাম, ‘হ্যাঁরে ভজা, তোর কি মনে হয়, ফুটবলের সাইজটা কেমন হওয়া উচিৎ? তোরা দুই ভাই আজকে বাড়ি থেকে কী খেয়ে এসেছিস বলতো? একটা গোলও সেভ করতে পারলি না? চারটে গোল তো, গড়ানে বলে হল। তোর জায়গায় লালুকে দাঁড় করিয়ে দিলেও, অন্ততঃ ওই চারটে গোল কম খেতে হত’।

লালু আমাদের পাড়ারই কুকুর, আমাদের পায়ে পায়ে ঘোরাঘুরি করে, অন্যদিন আমদের দলের ঠিক পিছনেই সামনের থাবায় মুখ রেখে, চুপচাপ শুয়ে থাকে। আজকেও রয়েছে, কিন্তু বেশ খানিকটা তফাতে। ভয়ে ভয়ে দেখছে আমাদের দিকে, আর মাঝে মাঝেই মুখ তুলে ডাক ছাড়ছে, ‘ওওওউউউউউ’। আমাদের দুর্গতি দেখে লালুও কি হতাশ হয়ে আমাদের সঙ্গ ছাড়ল? কে জানে?

ভজা সেন্টুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, ‘বলটা বড্ডো গোল, এত গোল বলে খেলা যায় নাকি? হাত দিয়ে ধরবো কি করে, খালি ফস্কে যাচ্ছিলতাছাড়া কে যে কখন কোনদিক থেকে ধড়াম ধড়াম করে শট মারছে, বুঝবো কি করে? এই ডান দিক থেকে, এই বাঁদিক থেকে। কখনো ওপরে, কখনো নিচে। এ আবার কি? গোলে শট মারার একটা বাঁধাধরা নিয়ম থাকবে তো! সে সবের কোন বালাই নেই!’

ভজার উত্তর শুনে এবার কিন্তু কেউ হাসল না। সবাই গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। আমিও চুপ করেই রইলাম, এ কথার কি উত্তর আমার জানা নেই। এই সমস্যার সমাধানটাই বা কি? আমার মাথাতে এলো না।  ভজা আমাদের দিকে তাকিয়ে ছোটভাই সেন্টুর দিকে তাকাল। তারপর নিজেদের মধ্যে চোখে চোখে ইশারা করে আমাদের বলল, ‘উঠলাম রে, বীরুকালকে কোন খেলা নেই তো’?

‘না, কাল নেই। পরশু আছে। তবে আমরা আর খেলব না’। আমি গম্ভীর মুখে উত্তর দিলাম।

‘কেন?’ সেন্টু জিগ্যেস করল।

‘কেন, আবার কি? এই খেলা খেলে লোক হাসিয়ে কী হবে’? আমি একটু ঝাঁজিয়ে উত্তর দিলাম। ‘তার ওপর তোরা যা বললি; কথা বলে দেখি বলটাকে ট্যাপা বা চ্যাপ্টা কিংবা চৌকোণা করা যায় কিন!’ ওরা যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছিল,  আমি ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম

‘দ্যাখ কি হয়’। বলে,  ভজা সেন্টুর কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল। আমরা ওদের দিকেই দেখছিলাম। পাইনদের পাঁচিল বরাবর হেঁটে, পাঁচিল যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে বাঁদিকে ঘুরে গেল, আর দেখা গেল না।  

আমরা ছ’জন এবার নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। আমাদের সকলেই প্রায় একসঙ্গে বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। চুপ করে বসেইছিলাম, বুদ্ধ প্রথম কথা বলল, ‘কেসটা কি বলতো, বীরু?’

‘কিছুই বুঝতে পারছি না’। আমি বললাম।

‘এবারের লিগটা মাঠে মারা গেল, মনে হচ্ছে’, দীপু বলল।

‘কুছু হয়নি, আমরা ও দোনোকো ছেড়েই খেলবো। হাবু আছে, নিমাই আছে, জিতেনভি আছে’। ভিকি বলল। ভিকি বছর দুয়েক হল আমাদের পাড়ায় এসেছে, বিহারিবাংলা বোঝে, তবে বাংলা বলে মিলিয়ে মিশিয়ে

‘ভিকি একদম ঠিক বলেছে। সেন্টু আর ভজার মাথা খারাপ হয়ে গেছে বলে, লিগ খেলা ছেড়ে দিতে হবে নাকি? ওদের ছাড়াই আমরা খেলব। তুই কাল সকালেই সবাইকে ডাক, বীরুকাল বিকেলে আমাদের ম্যাচ নেই, কাল বিকেলেই আমরা নিজেদের মধ্যে প্র্যাকটিস খেলা খেলে নেব’। নরেনের এই কথায় সবাই সমস্বরে সায় দিল। 

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, তাই হবে। কাল সকালে ভিকি আর দীপু আমার সংগে চল, নিমাই আর জিতেনের সঙ্গে কথা বলে নেব’। সকলেই আমার কথায় সানন্দে বলে উঠল, ‘ইয়েস, হারি বা জিতি যাই হোক, লিগ খেলা আমরা ছাড়বো না’। আমি চিন্তিত মুখে বললাম,

‘কিন্তু, সেন্টু আর ভজার কি হল, বল তো? এতবছর ধরে দিব্বি ভালো খেলছিল, হঠাৎ আজ এরকম খেলার ছিরি! তার ওপর আবার বলে কিনা, বলের শেপ পাল্টাতে হবে! আমার কিন্তু ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না!’

‘তোর কি মনে হচ্ছে, বল তো?’ হাবু আমাকে জিগ্যেস করল। 

আমি গভীর চিন্তা করতে করতে বললাম, ‘মগজে কিছুই ঢুকছে না’।

এই কথাটা আমি শেষ করেছি কি করিনি, হঠাৎ আমার পিঠে ধাঁই করে এসে নামল, আমাদের হারিয়ে যাওয়া বলটা। আমি পাইনদের পাঁচিলের দিকে পিঠ করে বসেছিলাম। মনে হল, পাঁচিলের ওপার থেকে কেউ বলটা ছুঁড়ে দিল। তবে কি সেন্টু আর ভজা ওপাশে গিয়েছিল বলটা খুঁজতে? আমরা এখানে আছি জেনে, ওরাই ছুঁড়ে দিল বলটা? নিশ্চয়ই তাই। কিন্তু এই আধো সন্ধ্যেবেলায়, সেন্টু আর ভজা পাইনদের ওই পোড়ো বাড়িতে ঢুকল কি করে? ও বাড়ির অনেক বদনাম আছে, দিনের বেলাতেই লোকে ঢুকতে সাহস পায় না, আর এই সন্ধেবেলায়, ওরা দুজনে...! নাঃ, আজ ওরা দুইভাই একটার পর একটা চমক দিয়েই চলেছে!

লালু একটু আগে আমাদের কাছে এসে শুয়েছিল রোজকার মতো। এখন এই বলটা ধুপ করে এসে পড়াতে, দৌড়ে পালিয়ে গেল অনেকটা দূরে, তারপর পাইনদের পোড়ো বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আর্ত স্বরে ডাকল, ‘ওওওউউউউউ’।

 

 সাড়ে আটটার সময় আমার টিউসনের মাস্টারমশাই চলে যাবার পর, পড়ার টেবিলে অংকের খাতা নিয়ে আমি আবার বসলাম। স্কুলে ছুটি বলে লেখাপড়ায় ফাঁকি দিলে মা খুব রেগে যান। এদিকে আমার মনে হয় সারাদিন লেখাপড়া করলেই হবে? খেলাধুলো করতে হবে না? গপ্পের বইও তো পড়তে হবে নাকি? মা সেটা বুঝতে চান না। অতএব, হাতে পেন নিয়ে, অংকের বই খুলে, অংকের লম্বা খাতার নিচেয় রেখে, আমায় টিনটিন পড়তে হয়। ‘আমেরিকায় টিনটিন’এর প্রথম পাতা পড়ে সবে দ্বিতীয় পাতায় যাবো, ঘাড়ের কাছে জানালার বাইরে থেকে সেন্টুর গলা পেলাম,

‘অ্যাই, বীরু, কি করছিস’? আমাকে এমন চমকে দেওয়ার জন্যে খুব রাগ হল আমার, বললাম,

‘দেখছিস তো পড়ছি। জিগ্যেস করছিস কেন’?

‘পড়ছিস? ছাই পড়ছিস। পড়ছিস তো টিনটিন’।

‘বেশ করেছি, তাতে তোর কি’?

‘কাকিমাকে বলে দিলে, বুঝবি আমার কি!’

এবার আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম সেন্টুর দিকে। ভালো জামা-প্যান্ট পড়ে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে কোথাও যাবে, বিয়ে বাড়ি কিংবা কোন নেমন্তন্ন বাড়ি। আমার দিকে তাকিয়ে হতচ্ছাড়া ভুরু নাচাচ্ছে! মাকে বলে দিলে আর রক্ষে নেই। 

আমি একটু নরম সুরে বললাম, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, কি বলবি বল?’

‘আজকে খেলার কি রেজাল্ট, রে? আজকে মা বাবা এমন করল না, কিছুতেই ছাড়ল না –’

আমি রাগে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম প্রায়, সামলে নিলাম। সারাক্ষণ মাঠে খেলে, তারপর এত কাণ্ডের পর এসেছে আমার কাছে খেলার রেজাল্ট জানতে! আমি আবার ঝাঁজালো সুরে বললাম, ‘ইয়ার্কি করিস না, সেন্টু। তুই জানিস না, খেলার কি রেজাল্ট’?

‘কি করে জানবো। আমি আর দাদা তো মা বাবার সঙ্গে জেঠুর বাড়ি গেছিলাম অনন্তপুরে, এই ফিরছি। আমরা কিছুতেই যাব না, মা-বাবাও আমাদের না নিয়ে যাবেন না। তোকে একবার যে এসে বলে যাবো, তাও পারলাম না রে’।

‘তার মানে, বলতে চাস, বিকেলে তুই আর ভজা আমাদের সঙ্গে খেলিস নি’?

‘না। কি করে খেলবো? আমরা তো এই মাত্র ফিরলাম। এখনো জামা কাপড় ছাড়িনি, তার আগেই চলে এলাম তোর সঙ্গে দেখা করতে!’

‘ইয়ার্কির সীমা আছে, সেন্টু। ভাবিস না এই সব কথায় আমি ভুলে গিয়ে তোদেরকে পরশু আবার খেলতে নেব। আমাকে অত বোকা ভাবিস না’।

‘তার মানে? আজ খেলতে পারলাম না বলে, পরশু আমাদের খেলতেই নিবি না? ক্যাপ্টেন বলে তুই যা খুশি করবি নাকি?’

‘আজ তুই একটাও গোল করতে পারলি না। ভজা একটাও গোল সেভ করতে পারল না। গোটা দলটাকে তোরা দুজনে ডুবিয়ে দিলি। আবার তোদের খেলায় নেব?’

‘কি আজেবাজে বকছিস, বীরুআমরা খেলতেই আসতে পারলাম না, তাতে গোল করা, গোল সেভ করার কথা আসছে কি করে?’

‘আমিও তো সেই কথাই বলছি, আজ তো তোরা খেলতেই পারলি না, আমাদের টিম গো হারা হারল’।

‘আরে বাবা, আমিও তো বলছি, আমরা তো ছিলামই না, খেললাম কখন’?

‘সত্যিই তাই, তোরা খেললি কখন, পুরোটাই তো ছেলেখেলা করলি’।

‘দিন-কে-দিন তুই বেশ গাধা হয়ে উঠছিস, বীরু পঞ্চাশবার বলছি, আমরা অনন্তপুর গিয়েছিলাম, জেঠতুতো দিদির ছেলের অন্নপ্রাশনে, ঝিঙেপোতায় আমরা সারাদিনই ছিলাম না। তবু তুই এক কথা বলে চলেছিস’।

‘তোরা আজ সারাটা বিকেল আমাদের সঙ্গে খেলিস নি’?

‘না’।

‘আমরা আজ ২৬-২ গোলে হেরেছি তোরা জানিস না’?         

‘২৬-২? এ রাম। এতটা খারাপ হবে আমরা বুঝিনি রে, বীরু! হাবু খেলেনি? কিংবা নিতাই, জিতেন?’

সেন্টুর এই কথায় আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। বললাম, ‘খেলার শেষে, বলটা গোল না হয়ে, ট্যাপা হলে ভালো হয়, তুই বলিস নি’? আমার কথায় সেন্টু খুব হাসল,

‘হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা, ফুটবল কখনো ট্যাপা হয় নাকি? এ আবার একটা কথা হল’?

‘বাড়ি ফেরার পথে পাইনদের বাড়ির ভেতর থেকে আমাদের বলটা তুই আমার পিঠে ছুঁড়িস নি?’

‘কখন বল তো, আজ’?

‘হ্যাঁ আজ। খেলা শেষ হয়ে যাবার পর আমরা মাঠে বসেছিলাম। তখন সন্ধে হবো হবো করছে’।

‘তুই পাগল হয়েছিস, বীরুতুই জানিস আমি কিরকম ভিতুসন্ধে বেলায় আমি যাবো ওই পাইনদের পোড়ো বাগানে, বল খুঁজতে? আমাকে কি ভূতে পেয়েছে’?

‘ভূত’? এই কথা শুনে আমার মাথাটা কেমন যেন ঘুরে গেল।

‘অ্যাই বীরু, কি হয়েছে, কিসের ভূত’?

‘আমাদের সঙ্গে তোরা, নাকি ওরা যে খেলছিল, ওরা কি তবে... ?’

 

চেয়ার উল্টে পড়ে যেতে যেতে আমি শুনলাম, জানালার বাইরে থেকে সেন্টু ডাকছে, ‘অ্যাই বীরু, বীরু, কি হল কী তোর?’  ওদিকে চেয়ার উল্টে পড়ার বিকট শব্দে, মায়ের গলা শুনতে পেলাম, ‘ও কিরে বীরু, চেয়ার থেকে পড়ে গেলি নাকি রে? কি হয়েছে, বীরু’?

মা দৌড়ে আসছেন আমার কেমন যেন সব অন্ধকার হয়ে গেল।

 -০০-

["তেঁনারা" গ্রন্থে গল্পটি সংকলিত।]

গ্রন্থটির ই-বুক পেতে হলে এই লিংকে গিয়ে অর্ডার করুন - 

https://play.google.com/store/books/details/%E0%A6%A4_%E0%A6%A8_%E0%A6%B0_TENARA_TENARA_JOYDHAK_PRAKASHAN?id=Nvn8EAAAQBAJ&hl=en-US&pli=1

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

জঙ্গী ব্যবসা

  ১   ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ