Powered By Blogger

শুক্রবার, ৬ জুন, ২০২৫

অনমনীয় সাদাত মান্টো

 

বাংলা সাহিত্যের নিবিড় ও একনিষ্ঠ পাঠকদের মধ্যে আজকাল সাদাত হাসান মান্টো নামটা খুব একটা পরিচিত নয়। তার কারণ, তিনটে হতে পারে, এক আমরা বাঙালীরা ভারতীয় সাহিত্য বলতে বাংলাকেই বুঝি, অন্য ভাষাতেও সাহিত্য হয় মেনে নিলেও, বাঙালী তাকে উচ্চ স্তরের এবং পাতে দেওয়ার যোগ্য বিবেচনা করেন না। দুই, মান্টোর লেখার বিষয়ে এবং বর্ণনায় নগ্ন-সত্য এতটাই প্রকট, তাকে পরিপাক করা বাঙালীর তথাকথিত রোমান্টিক হৃদয়ের পক্ষে মোটেই অনুকূল নয়। এবং তিন, তাঁর সাহিত্য চর্চার সময়কাল ও প্রেক্ষাপট, ভারতের প্রাক-স্বাধীনতার রাজনৈতিক ডামাডোল, স্বাধীনতা লাভ এবং ভারত ভাগের চরম হিংস্র অস্থিরতার সমসাময়িক - এখনকার বিচারে যে সময়টা দূর অতীত ।

মান্টোর লেখা বিশেষ কিছু রচনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে এই নিবন্ধ, কিন্তু তার আগে তাঁর জীবনের কথা, খুব ছোট্ট করে বলে নিই, তাতে মান্টোর জীবনদর্শন এবং অনন্য দৃষ্টিভঙ্গীর কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে। 

সাদাত হাসান মান্টোর জন্ম (১১.০৫.১৯১২) অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের লুধিয়ানা জেলার সামারালায়। প্রতিষ্ঠিত উকিল পিতার কর্মসূত্রে মান্টো পরিবার লুধিয়ানায় বসবাস করলেও, তাঁদের আদি নিবাস ছিল কাশ্মির। তাঁর এই কাশ্মিরি শিকড়ের জন্য তিনি বেশ গর্বও অনুভব করতেন, তিনি পণ্ডিত নেহরুকে লেখা এক চিঠিতে লিখেছিলেন, being ‘beautiful’ was the second meaning of being ‘Kashmiri’

১৯৩৩ সালে অমৃতসর শহরে উর্দু সাহিত্যিক ও বিতর্কিত লেখক আব্দুল বারি আলিগ[1]-এর সঙ্গে মান্টোর পরিচয় হওয়াটা, তাঁর জীবনের সন্ধিক্ষণ বলা যায়। আব্দুল বারি আলিগই মান্টোকে প্রথম সঠিক চিনতে পেরেছিলেন এবং তাঁর লেখার প্রতিভাকে উস্কে দিতে, ফরাসি এবং রাশিয়ান সাহিত্য পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারপরেই মান্টো লেখার জগতে এলেন এবং প্রথমেই ভিক্টর হুগোর ‘The Last Days of A Condemned Man’-এর উর্দু অনুবাদ লিখলেন, ‘সরগুজাস্ত-ই-আসির’ (A Prisoner’s Story)বইটি লাহোরের উর্দু বুক স্টল থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এর কিছুদিন পরেই তিনি লুধিয়ানা থেকে প্রকাশিত উর্দু দৈনিক ‘মাসাওয়াত’-এর সম্পাদকীয় দপ্তরে যোগ দেন।

এর পর নিজের উচ্চশিক্ষার দিকে মান্টোর ঝোঁক আসে, তিনি গ্র্যাজুয়েশন করার জন্যে ১৯৩৪ সালে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। আর সেখানেই তাঁর সঙ্গে Indian Progressive Writers’ Association (IPWA)-এর পরিচয় ঘটে। এই অ্যাসোসিয়েসনের সঙ্গে যুক্ত আলি সর্দার জাফরি[2]র সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা থেকেই, তিনি নিজের মধ্যে লেখালেখির জগতে আসার তীব্র একটা টান অনুভব করেন। এই পর্যায়ে তাঁর লেখা একটি মৌলিক গল্প ‘ইনক্লাব পসন্দ’, আলিগড় পত্রিকায় ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, লেখাপড়া শেষ করার আগেই, দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে তাঁকে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়েছিল।

এরপর মোটামুটি ১৯৪৮ সাল অব্দি, তিনি বম্বে শহরে ছিলেন। সে সময় উর্দু পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি তিনি সেখানকার সিনেমার গল্প এবং চিত্রনাট্য রচনাতেও বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। যার ফলে, সে সময় বম্বে সিনেমা জগতের অনেক তারকার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, যেমন, নূরজাহান, নৌশাদ, ইসমত চুঘতাই, অশোককুমার। ১৯৪১ সালে অল ইণ্ডিয়া রেডিওর চাকরি নিয়ে, তিনি উর্দু ভাষায় অনেকগুলি নাটক রচনা করেছিলেন, যদিও কিছুদিন পরে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্যর জন্যে তাঁকে সে চাকরি ছাড়তে হয়।

তাঁর জীবনের এই পর্যায়টিকেই তাঁর জীবনের সব থেকে সৃষ্টিশীল বলা যায়। এই সময়, তাঁর লেখা গল্প, প্রবন্ধ, সমালোচনা এবং বিতর্ক মূলক (Polemic) রচনা তাঁকে একদিকে যেমন জনপ্রিয় করেছিল, তেমনি বিতর্কের দিকেও ঠেলে দিয়েছিল। অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে তাঁকে পাঁচবার আদালতে লড়াই করতে হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার আগে অবিভক্ত ব্রিটিশ-ভারতের ২৯২ ধারায় তিন বার, এবং সদ্য-স্বাধীন হওয়া পাকিস্তানের আদালতে দুবার। যদিও কোন বিচারেই তিনি দোষী সাব্যস্ত হননি এবং একটি মাত্র মামলায় তাঁকে সামান্য ফাইন দিতে হয়েছিল।

তাঁর বিখ্যাত, বিতর্কিত, বহু আলোচিত, গল্পগুলির মধ্যে “টোবা টেক সিং”, “কালি শালোয়ার”, “ঠাণ্ডা গোস্ত”, “ধুঁয়া”, “বু”, “তিথওয়াল কা কুত্তা”, “ঝুমকে”-র অভিঘাত আজও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর প্রায় সমস্ত গল্প এবং রচনার বিষয়বস্তু, স্বাধীনতা নিয়ে স্বার্থপর নেতাদের মিথ্যাচারিতা, তিক্ত হয়ে ওঠা হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময়কার বীভৎস দাঙ্গা, মনুষ্যত্ব ভুলে যাওয়া মানুষের কদর্যতা। ক্ষমতালোভী নেতাদের প্ররোচনায় নিরীহ সাধারণ মানুষ, কী ভাবে অসাধারণ নৃশংস অমানুষ হয়ে উঠতে পারে, তার আশ্চর্য দলিল, তাঁর এই গল্পগুলি। এই গল্পগুলির প্রতিটি শব্দে সোচ্চার হয়ে আছে মনুষ্যত্বের হাহাকার, বিবেকের আপোষহীন ধিক্কার, নগ্নসত্যকে স্পষ্ট করে বলার অনমনীয় স্পর্ধা এবং সমসাময়িক নেতাদের আপাত মহত্বের প্রতি তীব্র বিদ্রূপ !

স্বাধীনতার পর ভারত এবং সদ্যজাত পাকিস্তানের পরিস্থিতি দেখে বিষণ্ণ মান্টো মন্তব্য করেছিলেন,

“Hindustan had become free. Pakistan had become independent soon after its inception, but man was still slave in both the countries…slave of prejudice…slave of religious fanaticism…slave of barbarity and inhumanity.” (হিন্দুস্তান মুক্ত হল। গড়ে ওঠার মূহুর্তেই পাকিস্তান স্বাধীন হল, কিন্তু তাও দু’দেশের মানুষ ক্রীতদাস হয়েই রয়ে গেল... কুসংস্কারের দাস...অন্ধ ধর্মীয় উন্মাদনার দাস... বর্বরতা এবং মনুষ্যত্বহীনতার দাস।) স্বাধীনতার এত বছর পরেও মান্টোর এই আক্ষেপ, কী আমাদেরও আক্ষেপ নয়?

 

আমৃত্যু তিনি দেশবিভাজনের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর প্রিয় শহর বম্বেতেই তিনি থাকতে চেয়েছিলেন আজীবন, কিন্তু পরিস্থিতির চাপে কিছুটা বাধ্য হয়েই তাঁকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীন পাকিস্তানের লাহোরে চলে যেতে হয়েছিল। একজন ভারতীয় থেকে সেখানে তিনি হয়ে উঠলেন “মুহাজির” - ভারতীয় উদ্বাস্তু। তীক্ষ্ণ সংবেদনশীল একজন ব্যক্তি হিসেবে তিনি তখন অবসন্ন, দুই দেশের পরিস্থিতি দেখে তিনি হতাশ এবং বিষণ্ণ। মানসিক অবসাদে মাত্রাধিক মদ্যপানকে দীর্ঘদিন সঙ্গী করেছিলেন, যার ফলে তিনি সিরোসিস অফ লিভারে আক্রান্ত হন এবং মাত্র ৪৩ বছর বয়সে লাহোরেই তাঁর মৃত্যু হয়, দিনটা ছিল ১৮.০১.১৯৫৫।

তাঁর মৃত্যুর পর নিজের সমাধিতে যে এপিটাফ তিনি লিখতে চেয়েছিলেন, সেটির ইংরিজি অনুবাদ হল,

“In the name of God, the Compassionate, the Merciful

Here lies Saadat Hasan Manto and with him lie buried all the secrets and mysteries of the art of short-story writing… Under tons of earth he lies, still wondering who among the two is greater short-story writer: God or He. (হে করুণাময়, দয়ালু ঈশ্বর, এখানে সাদাত হাসান মান্টো, ছোটগল্প লিখনশৈলীর সকল গোপন রহস্য সঙ্গে নিয়ে সমাধিস্থ আছে...মাটির প্রবল চাপের নিচে শুয়ে থেকেও সে ভাবছে, দুজনের মধ্যে কে মহান ছোটগল্প লেখকঃ ঈশ্বর, না সে।)  

 

মান্টোর ছোট গল্পের সংকলনের ইংরিজি অনুবাদ এখনও যথেষ্ট প্রচলিত, কিন্তু বাংলায় তাঁর গল্প সংকলনের অনুবাদ হলেও, এখন আর তেমন সহজপ্রাপ্য নয়।

মান্টোর অনেক গল্প বাংলাতেও পড়েছি, কিন্তু তাঁর essay বা রচনাগুলির বাংলা অনুবাদ, আমার অন্ততঃ চোখে পড়েনি। এই লেখায় সেরকম চারটি রচনার বাংলা অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি। এই লেখাগুলি থেকে মান্টোর এবং তাঁর লেখার মনোভাব সম্পর্কে বেশ সুন্দর একটা ধারণা পাওয়া যায়। আদালতে কোন একবার বিচার চলার সময়, মান্টো স্বপক্ষে বলেছিলেন,

“If you cannot bear these stories then the society is unbearable. Who am I to remove the clothes of this society, which itself is naked. I don’t even try to cover it, because it is not my job, that’s the job of dressmakers. (আপনারা যদি এই গল্পগুলো সহ্য করতে না পারেন, তার মানে এই সমাজও অসহ্য। যে সমাজ নগ্ন হয়েই আছে, তার বস্ত্র হরণ করার আমি কে? আমি একে ঢেকে রাখারও চেষ্টা করি না, কারণ ওটা আমার কাজ নয়, ওটা দরজিদের কাজ”)।

 

মান্টোর নির্বাচিত চারটি রচনার (Essay) বাংলা অনুবাদ

 

[অনুবাদকের মন্তব্যঃ দীর্ঘ আন্দোলনের পর স্বাধীনতা নামক “মেওয়া ফল” লাভ যখন আসন্ন, তখন একটা বিতর্ক চেগে উঠেছিল, ভারতের সরকারি ভাষা কী হওয়া উচিৎ? কেউ কেউ বলল হিন্দি, কারণ ভারতের বেশির ভাগ লোক হিন্দি বলে। আবার অনেকে বলল, উর্দু, কারণ এ ভাষার রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের একটা ইতিহাস আছে। গান্ধিজী আবার নির্দেশ দিলেন, সব ভারতীয়দের দেবনাগরী এবং পারসি লিপিতে হিন্দুস্থানী ভাষা শেখা উচিৎ। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর এই কথার ধর্মীয় বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। মান্টো এই পুরো ব্যাপ্যারটাকেই অর্থহীন প্রলাপ মনে করেছিলেন, যার প্রমাণ পাওয়া যাবে নিচের এই রূপক রচনাটিতে। আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষীতেও, আমার মনে হয়, এই লেখাটি আজও ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক।]  

 

হিন্দি নাকি উর্দু[3] 

 

কিছুদিন ধরেই হিন্দি আর উর্দুর মধ্যে বেশ লড়াই চলছে। মৌলভী আব্দুল হক[4], ডঃ তারাচাঁদজী[5]  এবং মহাত্মা গান্ধী, অর্থহীন এই বিবাদের বিষয়ে নিশ্চয়ই বিস্তারিত বোঝেন, কিন্তু স্বীকার করছি, বিষয়টা আমার আয়ত্তের বাইরে। তাই বলে এমনও নয় যে, আমি বোঝার চেষ্টা করিনি।

হিন্দুরা হিন্দির সমর্থনে কেন তাদের সময় নষ্ট করছে এবং মুসলিমরাই বা উর্দু সংরক্ষণের জন্যে এত চিন্তিত কেন? কোন ভাষাই বানিয়ে তোলা হয়না, ভাষা নিজে নিজেই গড়ে ওঠে এবং একটা প্রচলিত ভাষাকে নষ্ট করে ফেলার সাধ্য কোন মানুষের নেই।

এই বিষয়ে আমি একটা প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু যখনই আমি হাতে পেন তুলে নিলাম, লেখার পরিবর্তে কিছু এঁড়ে তর্ক তৈরি হয়ে উঠল। সেটা এই রকমঃ

 

মুন্সী নারায়ণ প্রসাদঃ ইকবাল সায়েব, আপনি কী এখনও বোতলের সোডাই নেবেন?

মির্জা মোহম্মদ ইকবালঃ হ্যাঁ, আমি তো তাই নেব।

মুন্সীঃ আপনি তার বদলে আমার এই লেমন সফ্‌ট্‌ ড্রিংক নিচ্ছেন না কেন?

মির্জাঃ এমনিই। আমি সোডাই পছন্দ করি। আমাদের পরিবার চিরকাল সোডাই নেয়।

মুন্সীঃ তার মানে আপনি লেমন পছন্দ করেন না?

মির্জাঃ মোটেই না। পছন্দ না করার কী আছে, মুন্সীজি? আমাদের বাড়িতে সবসময় সোডাই থাকে, যার ফলে আমাদের একটা অব্যেস তৈরি হয়ে গেছে। বিশেষ আর কোন কারণ নেই। সত্যি বলতে, একথা বলাই যায়, সোডার থেকে লেমন স্বাদে অনেকটাই ভাল।

মুন্সীঃ আমি খুব অবাক হয়ে যাই, কেন যে আপনি মিষ্টি স্বাদের একটা ড্রিংক ছেড়ে দিয়ে বোদা একটা জিনিষকে পছন্দ করে বসে আছেন? তাছাড়া লেমন কী শুধুই মিষ্টি, এর খুব সুন্দর একটা গন্ধও আছে। আপনার কী মনে হয়?

মির্জাঃ আপনি একদম খাঁটি কথাই বলেছেন। কিন্তু...।

মুন্সীঃ কিন্তু কী?

মির্জাঃ কিছু না। আমি বলতে চাইছি, তবু আমি সোডাতেই থাকব।

মুন্সীঃ আপনি কী ফালতু জেদ করছেন না? অনেকে ভাবতে পারে, আমি বুজকুরি ওঠা লেমন ড্রিংকের বদলে আপনাকে বিষ ঢেলে দিচ্ছি। আরে ভাই, লেমন আর সোডার মধ্যে ফারাকটা কোথায়? দুটোই একই কারখানায় তৈরি হয়। একই মেশিনে দুটো বোতলই ভরা হয়। লেমনের থেকে যদি চিনি আর সুগন্ধটা সরিয়ে ফেলি, তাহলে আর রইলটা কী?

মির্জাঃ সোডা।

মুন্সীঃ তবে? তাহলে আপনার লেমন খেতে সমস্যা হচ্ছে কেন?

মির্জাঃ কোন সমস্যাই নেই।

মুন্সীঃ চমৎকার, তাহলে এই আমারটা আপনি নিন।

মির্জাঃ তাহলে আপনি কী খাবেন?

মুন্সীঃ আমি আরেকটা বোতল আনিয়ে নেব।

মির্জাঃ তার দরকার হবে না। কিন্তু এই সোডার বোতল নিতে আপনারই বা কিসের অসুবিধে?  

মুন্সীঃ অসুবিধে... তেমন কিছু নেই।

মির্জাঃ তবে, এটাই নিন।

মুন্সীঃ তাহলে আপনি কী খাবেন?

মির্জাঃ আমি? আমি আরেকটা বোতল আনতে বলছি।

মুন্সীঃ তার আর দরকার নেই। কিন্তু লেমন নিতে আপনার আপত্তি কিসের?

মির্জাঃ না, না মোটেই আপত্তি নেই। কিন্তু আপনার সোডা নিতেই বা আপত্তি কেন?

মুন্সিঃ কোনই আপত্তি নেই।

মির্জাঃ আসলে সোডাটাই ভাল।

মুন্সীঃ আমার মতে, লেমন আরো ভাল।

মির্জাঃ হতেই পারে। কিন্তু আমি বাবা-কাকাদের মুখে শুনেছি, সোডাই ভাল।

মুন্সীঃ তাতে কী? আমিও তো বাবা-জ্যাঠাদের মুখে শুনেছি, লেমন অনেক ভাল।

মির্জাঃ আপনার ব্যক্তিগত মত কী?

মুন্সীঃ আপনারই বা নিজস্ব অভিমত কী?

মির্জাঃ আমার মতে...আমার মনে হয় যে...কিন্তু আপনার মতটা কী, সেটা আমায় কেন বলছেন না?

মুন্সীঃ আমার ধারণা...আমার মতে বলে...কিন্তু আপনার মতটা আগে খোলসা করছেন না কেন, বলুন তো?

মির্জাঃ এভাবে আমরা কোনদিনই একমত হতে পারব না। তার থেকে এখন আমরা বোতলদুটো ঢেকে রাখি, সাব্যস্ত হলে অবসর মত খাওয়া যাবে।

মুন্সীঃ তা কী করে হয়? দুটো বোতলই খোলা হয়ে গেছে। ওগুলো আমাদের খেতেই হবে। তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলুন, নাহলে বোতলের সব গ্যাস বেরিয়ে যাবে। এই ড্রিংকগুলোর গ্যাসটাই হল আসল মজা।

মির্জাঃ তা ঠিক। কিন্তু আমি তো দেখছি আপনিও মেনে নিচ্ছেন যে, লেমন আর সোডার মধ্যে আহামরি তেমন তফাৎ নেই।

মুন্সীঃ আমি আবার কখন বললাম, লেমন আর সোডার কোন তফাৎ নেই? অনেক পার্থক্য রয়েছে। লেমনে মিষ্টতা আছে, আছে সুগন্ধ আর আছে একটু টক টক স্বাদ। তার মানে এই তিনটি জিনিষই লেমনে বেশি আছে। অন্যদিকে সোডায় কী আছে? শুদ্ধু গ্যাস – আর সে গ্যাস এত বেশি, যে নাক জ্বলে যায়। এর সঙ্গে তুলনা করলে লেমন ভীষণ সুস্বাদু। এক বোতল খেয়ে দেখুন, মজাটা অনেকক্ষণ থাকে। সোডা হচ্ছে অসুস্থদের জন্যে। তাছাড়া আপনিও একটু আগে স্বীকার করেছিলেন, লেমনের স্বাদ, সোডার থেকে অনেক ভাল।

মির্জাঃ ঠিক আছে, কিন্তু আমি সোডার থেকে লেমন ভালো এমন তো বলিনি। খেতে বেশি ভাল হলেই যে, সেটা আমাদের পক্ষে বেশি উপকারি হবে, এমন তো কোন কথা নেই। আচার খেতে খুব ভালো কিন্তু আপনি তো জানেন আচার কতটা ক্ষতি করে।  একটু সুবাস আর খেতে টকটক হলেই কোন জিনিষ ভালো কিংবা খুব ভালো হয়ে যায় না। যে কোন ডাক্তারকে জিগ্যেস করুন, আপনি জানতে পারবেন এই টকটক স্বাদটা বদহজম করায়। কিন্তু সোডা! হজমের পক্ষে দারুণ উপকারি।

মুন্সীঃ এক কাজ করুন, দুটোকে মিশিয়ে আমরা এই বিষয়টাকে ফাইন্যাল করি।

মির্জাঃ তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।

মুন্সীঃ তাহলে গ্লাসের আদ্দেকটা সোডা নিন।

মির্জাঃ আপনি কেন গ্লাসের আদ্দেকটা আগে লেমনে ভরছেন না?

মুন্সীঃ যাচ্চলে, আপনিই বা আগে ঢালতে চাইছেন না কেন?

মির্জাঃ আমি সোডার সঙ্গে লেমন মিশিয়ে খেতে চাই।

মুন্সীঃ আর আমি লেমনের সঙ্গে সোডা মিশিয়ে খেতে চাই।

 

.০০.

 

 

আমার পঞ্চম বিচার (প্রথম পর্ব)

 

[অনুবাদকের মন্তব্যঃ ব্রিটিশের অধীন বিচারালয়গুলির কার্যকারিতা এখনকার থেকে অনেক ভাল ছিল। আমাদের এই সময়ের থেকে সে সব দিন সুদূর অতীত, তবে ব্রিটিশরা এই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মান্টোকে বেশ বিপদেই পড়তে হয়েছিল। সম্পূর্ণ নতুন মরাল কোড এবং অসহিষ্ণু এক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা, নতুন এক দেশ পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থার সামনে তাঁকে বারবার পড়তে হয়েছিল। যদিও এর আগেও মান্টো বেশ কয়েকবার ব্রিটিশ-ভারতের আদালতে অশ্লীলতার দায়ে বিচারাধীন ছিলেন, কিন্তু স্বাধীনতার পর যে আইনী মারপ্যাঁচের মুখোমুখি তাঁকে হতে হয়েছিল, তাতে মান্টো অনেক বেশী হতাশ হয়েছিলেন।  যে লেখার জন্যে তাঁকে সব থেকে বেশি ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল, তার নাম ঠাণ্ডা গোস্ত – দাঙ্গার সময় মৃত দেহের সঙ্গে যৌনাচার (necrophilia) প্রসঙ্গে তিনি এই লেখাটি লিখেছিলেন। এই বিষয়ে দুটি লেখার মধ্যে এই প্রথমটি নিয়েই তাঁর পঞ্চম বিচার শুরু হয়েছিল। এই লেখাটি লাহোর থেকে প্রকাশিত নাকুশ (Naqoosh) পত্রিকার ফেব্রুয়ারি ও মার্চ ১৯৫৩-র একটি বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় হল, “আমার পঞ্চম বিচার” রচনাটির প্রথম পর্বে মান্টো নাকুশ পত্রিকার মালিক-সম্পাদকের সম্পর্কেও কিছু মন্তব্য করেছেন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই লেখার পরবর্তী পর্ব এক সপ্তাহ পরে ওই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল।]

 

আমার লেখার জন্যে আদালতে আমার চারবার বিচার হয়ে গেছে।  এখন আমার পঞ্চম বিচার শুরু হয়েছে, এই বিচারে কী ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে সে কথাই আমি আপনাদের এখন বলব।

আগে যে চারটি গল্পের জন্যে আইনের নজরে পড়েছিলাম, সেগুলি হল,

কালি শালোয়ার

ধুঁয়া (ধোঁয়া)

বু (গন্ধ)

ঠাণ্ডা গোস্ত (শীতল মাংস) এবং এখনকার একটি লেখা, “উপর, নিচে আউর দারমিয়ান[6]"।   

 

কালি শালোয়ার-এর জন্যে, আমাকে তিনবার দিল্লি থেকে লাহোরের আদালতে যেতে হয়েছিল। ধুঁয়া আর বু-র ক্ষেত্রে আমার আরও ঝামেলা হয়েছিল, আমাকে বম্বে থেকে লাহোর যেতে হত। কিন্তু ঠাণ্ডা গোস্ত নিয়ে হয়রানি সবাইকে ছাড়িয়ে গেল, যদিও সেই সময় আমি পাকিস্তানেই ছিলাম এবং আমাকে খুব বেশি দৌড়োদৌড়ি করতে হয়নি। কোন সংবেদনশীল মানুষ, যার মধ্যে আমি নিজেকেও মনে করি, এই অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়লে, কখনোই অক্ষত থাকতে পারে না। আদালত এমনই এক জায়গা, যেখানে প্রত্যেকটি অসম্মান আপনাকে গভীরভাবে আহত করবে, অথচ সেসব আপনাকে মুখ বুজে সহ্য করতে হবে।

আমরা যাকে আইনের দরবার বলি, সেখানেই কাউকেই যেন না যেতে হয়, আমি এই প্রার্থনা করি। এমন উদ্ভট জায়গা আমি আর কোথাও দেখিনি। এবং আমি একথাও বলতে চাই, পুলিশদের আমি মোটেই পছন্দ করি না। তারা জঘন্যতম অপরাধীর সঙ্গে যে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত, আমার সঙ্গেও তেমনই ব্যবহার করত।

যাই হোক, ঘটনাটা শুরু হয়েছিল যেদিন করাচির একটি পত্রিকা পায়াম-ই-মাসরিক, আমার বিনা অনুমতিতে, আমার একটি লেখা “উপর, নিচে, অওর দারমিয়ান” প্রকাশ করল, তার দিন কয়েক পর। এই পত্রিকাটি লাহোরের একটি পত্রিকা “এহ্‌সান” থেকে আমার লেখাটি তুলে নিয়েছিল এবং তার পরেই করাচি সরকার আমার নামে সমন জারি করে ফেলল।

আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না। দুজন সাব-ইন্সপেক্টার এবং চারজন কনস্টেব্‌ল্‌ আমার বাড়িতে হানা দিল। আমার স্ত্রী তাদের বলেছিলেন, “মান্টো বাড়িতে নেই, আপনারা বললে ওকে আমি ডেকে পাঠাচ্ছি”। কিন্তু তারা জোরজার করে বলেই যাচ্ছিল, “আসলে আমি বাড়িতেই লুকিয়ে আছি এবং আমার স্ত্রী মিথ্যা বলছেন”। সে সময় আমি “সবেরা” পত্রিকার মালিক চৌধুরি নাজির আহমেদের অফিসে ছিলাম।

আমি তখন সবে মাত্র এক গল্প নিয়ে কাজ করছিলাম এবং লাইন দশেক মতো এগিয়েছি, এমন সময় চৌধুরি নাজিরের ভাই রশিদ এসে পৌঁছল, আমাকে কয়েক মূহুর্ত দেখে জিগ্যেস করল, “আপনি কী লিখছেন?”

আমি বললাম, “আমি সবে একটা গল্প শুরু করেছি, মনে হচ্ছে গল্পটা বেশ লম্বা হয়ে যাবে। রশিদ বলল, “আমি আপনাকে একটা খারাপ খবর দিতে এসেছি, আপনার বাড়িতে পুলিশ এসেছে, আপনাকে খুঁজছে। ওরা ভাবছে, আপনি বাড়িতেই আছেন এবং বাড়িতে ঢোকার জন্যে জোরজার করছে”।

আমার সঙ্গে ছিলেন আমার দুই বন্ধু আহ্‌মেদ রাহি আর হামিদ আখতার। এই খবর শুনে তারাও খুব বিরক্ত হল এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তিনজন একটা টাঙ্গায় চেপে বেরিয়ে পড়লাম। বেরোবার আগে আমরা চৌধুরি রশিদকে বললাম, “সমস্ত খবরের কাগজে ফোন করে দিন, যাতে কালকের কাগজে এই সব ঘটনার কথা ছাপা হয়”।

আমরা যখন পৌঁছলাম, পুলিশেরা আমাদের ফ্ল্যাটের বাইরেই ছিল। আমার ভাইপো হামিদ জালাল এবং ভগ্নিপতি জাহিরুদ্দিন তাদের গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়েছিল। তারা পুলিশকে বারবার বলছিল, “দেখ তোমাদের যদি বাড়ির ভেতরে সার্চ করতেই হয়, তো কর, কিন্তু বিশ্বাস করো মান্টো বাড়িতে নেই”। আমি সেখানে আবদুল্লা মালিককেও পুলিশদের সঙ্গে কথা বলতে দেখলাম। আবদুল্লা একজন কমিউনিস্ট, কিন্তু ভণ্ড। আমি শুনলাম আমার স্ত্রী ও বোনকে সাব-ইন্সপেকটর হুমকি দিয়েছে, যে তারা জোর করেই বাড়িতে ঢুকবে। এই সময় তারা আমায় কম্পাউণ্ডে ঢুকতে দেখে কিছুটা শান্ত হল।

আমি তাদের ভেতরে ডাকলাম।

অফিসার দুজন তখনও দেখলাম খুব উদ্ধত। আমি যখন তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কী চাইছে, তারা বলল তাদের কাছে করাচি থেকে আমার বাড়ি সার্চ করার শমন এসেছে। আমি অবাক হলাম।

আমি তো কোন গুপ্তচর বা স্মাগলার কিংবা ড্রাগপাচারকারি নই। আমি একজন লেখক। পুলিশের আমার বাড়ি সার্চ করার কী কারণ থাকতে পারে? তারা কী পাওয়ার আশা করছে?

তারা জানতে চাইল, “আপনার লাইব্রেরি কোথায়?”

আমি বললাম, এখানে এই পাকিস্তানে আমার লাইব্রেরি বলতে আছে গোটা কয়েক বই, যার মধ্যে তিনটে ডিকশনারি। বাকি সব বই পড়ে আছে বোম্বাইতে। আমি বললাম, যদি আপনারা বিশেষ কিছু দেখতে চান, আমি আপনাদের বোম্বাইয়ের ঠিকানা দিচ্ছি। অফিসার দুজন আমার কথার কোন গুরুত্বই দিল না, তারা আমার বাড়ি সার্চ করতে শুরু করল। সত্যি বলতে তারা আট-দশটা বিয়ারের খালি বোতল পেয়েছিল, কিন্তু সেগুলো নিয়ে তারা কোন মন্তব্য করল না। ছোট একটা বক্সের মধ্যে কিছু কাগজ ছিল। পুলিশেরা সেই কাগজ এমনকি কাগজের টুকরোগুলোও খুঁজতে লাগল। তার মধ্যে খবরের কাগজের কিছু কাটিং ছিল, সেগুলো তারা সিজ্‌ করল।

এই সময় আমি ওদের করাচি সরকারের জারি করা সমনটা দেখাতে বললাম।

ওরা দেখাতে রাজি হল না, একজন কনস্টেব্‌ল্‌ হাতে ধরে দূর থেকে দেখিয়ে বলল, “এই যে আছে”।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “ওটা কী”?

সে বলল, “এটার জন্যেই আমাদের এখানে আসতে হয়েছে”।

আমি যখন ওটা দেখার জন্যে জোর করলাম, লোকটা দুহাতে শক্ত করে ধরে বলল, “পড়ে নিন”।

আমি কাগজটার ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে বুঝলাম, ওটা শুধু সার্চের সমন নয়, আমাকে গ্রেপ্তার করার পরোয়ানা।

আমি তখনই জামিনদার এবং জামিন পাওয়ার কথা চিন্তা করতে লাগলাম। পুলিশের অফিসার দুজন ভীষণ একবগ্‌গা, তারা উপস্থিত কাউকেই আমার জামিনদার হিসেবে পাত্তা দিল না। আমার ভাইপো এবং ভগ্নিপতি দুজনেই গেজেটেড অফিসার। তাদের বলা হল, তোমরা সরকারি চাকরি কর, এসবের জন্যে তোমাদের চাকরি চলে যেতে পারে।

যা হবার তা হল, আমি গ্রেপ্তার হলাম, তারপর জামিনও পেলাম, এখন আমাকে করাচি গিয়ে আরেকবার আইনের দরবারে হাজিরা দিতে হবে। আগেকার কেসগুলোতে, ‘হাজিরা দেওয়ার ব্যাপারে আমি খুবই অসুস্থ’, ডাক্তারের লেখা এরকম সার্টিফিকেট জমা দিয়ে পার পেয়েছিলাম, কিন্তু সে সব দিন আর নেই।

আমার জামিন হওয়ার জন্যে অনেকের কাছেই চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার বন্ধুদের কেউই সেই সময় তাদের বাড়িতে ছিল না। শেষে আমি মহম্মদ তুফেলের কাছে যাওয়াতে, সেই ভদ্রলোকই আমার জামিন হয়েছিলেন। ভদ্রলোক নাকুশ পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক। তিনি তাঁর স্টোরের সমস্ত বই বিক্রি করে আমার জামিনের পাঁচহাজার টাকা যোগাড় করেছিলেন।

তুফেল সাহেব আমার জামিনের টাকা যোগাড় করলেন, কিন্তু আমি যে আদালতে গিয়ে দাঁড়াবো, এ বিষয়ে তাঁর ভরসা ছিল না। কথাটা সত্যি, কারণ সে সময় আমার হাতে, ইচ্ছে হলে, একটু বিষ খেয়ে মরার মতো পয়সাও ছিল না, করাচি যাওয়ার খরচের কথা বাদই দিলাম। যেদিন ভোর পাঁচটার ট্রেনে আমার করাচি যাওয়ার কথা, তার আগের দিন তুফেল সাহেব আমার কাছে এলেন। তাঁর কাছে দুটো সেকেণ্ড ক্লাসের টিকিট। তিনি আমার সঙ্গে আমার বন্ধু নাসির আনোয়ারকে পাঠাচ্ছেন, যাতে আমি নিশ্চিতভাবেই করাচি পৌঁছতে পারি। তিনি আমাদের স্টেশনে ছাড়তে একটা টাঙ্গা নিয়ে এসেছিলেন এবং ট্রেন না ছাড়া পর্যন্ত প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়েছিলেন।  

এরপর করাচিতে আমার কী হল, সে কথা পরে কোন এক সময় বলব। কারণ এখন এই মূহুর্তে আমি আরও লেখার মতো অবস্থায় নেই।

[পাঁচওয়া মুকদ্দমা (১) নামে প্রথম প্রকাশিত।]   

 

                       

আমার পঞ্চম বিচার (দ্বিতীয় পর্ব)

 

[অনুবাদকের মন্তব্যঃ অশ্লীলতার দায়ে তাঁর পঞ্চম বিচার নিয়ে মান্টো দ্বিতীয় পর্বে এই লেখাটি লিখেছিলেন। তাঁকে হয়রান করার এটাই ছিল রাষ্ট্রের অন্তিম প্রচেষ্টা, কারণ এই বিচারের কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান। এই রচনাটি মান্টোর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছিল।]

 

নাকুশের পূর্ববর্তী সংখ্যায় (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৫৩) আমি এই বিষয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু শেষ করতে পারিনি, কারণ আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। সত্যি বলতে আমি এখনও অসুস্থ এবং আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে বাকি জীবনটা আমি অসুস্থই থেকে যাব। কেউ কেউ বলছেন, এই অসুস্থতাই আমার সংজ্ঞা –  লেখার ব্যাপারে আমার পাগলামির কথাই তাঁরা বোঝাতে চান।

আমার ওই প্রথম রচনাটির পর, মিঃ তুফেল, এই পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক, মিঃ মান্টো নামে একটি লেখা প্রকাশ করেছিলেন। তার ওপরে ভিত্তি করে, আহ্‌মেদ নাদিম কাসমি, যিনি দুর্ভাগ্যবশতঃ “ইমরোজ” পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত, আমার ওপরে একটি লেখা লিখেছেন, নাম “সমালোচক”।

আমার মতে মিঃ তুফেলের লেখাটি আমার বিষয়ে বড্ডো ব্যক্তিগত। কিছু কিছু বিষয়ে তিনি যা লিখেছেন, সেগুলি প্রকাশ্যে আসা উচিৎ ছিল না।  প্রত্যেকটি মানুষেরই নানান দুর্বলতা থাকে, সেগুলোকে প্রকাশ্যে আনার প্রয়োজন কী? একথা সত্যি, লেখক বা শিল্পীদের বিষয়ে ছোটখাটো অবান্তর সংবাদ পড়তে বেশ ভালই লাগে এবং এর থেকে তাদের চরিত্রের কিছুটা পরিচয়ও পাওয়া যায়। কিন্তু সেই পরিচয় প্রকাশ্যে আনার উদ্দেশ্য কী, যা দিয়ে লেখককে আরও অসম্মান করা যায়?

মন দিয়ে পড়ে এটা স্পষ্ট যে, মিঃ তুফেল যাই লিখে থাকুন, তাঁর উদ্দেশ্য এমন কিছু ছিল না। কিন্তু আবেগের বশে তিনি যা লিখেছেন, সেটা এভাবে না লিখলেই ভাল করতেন।

এটা পড়ার পর আমি ওঁকে এই চিঠি লিখেছিলামঃ-

 

বিরাদরম (আমার ভাই) – আস-সালাম-আলেকুম!

কাল রাত্রে সাফিয়া বলছিল, আপনি নাকি “নাকুশ”-এ আমার বিষয়ে কিছু লিখেছেন। আমি ভাল করে পড়তে পারিনি, কারণ তখন আমি একটু মত্ত অবস্থায় ছিলাম। সাফিয়ার লেখাটা ভালো লেগেছিল এবং কিছুটা আমায় পড়ে শোনাচ্ছিল। লেখাটা আমার বেশ আপত্তিকর মনে হয়েছিল। আপনাকে গুচ্ছের গালাগাল দেওয়ার পরে, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

আজ সকালে লেখাটি যখন পড়লাম, আমার বেশ ভালই লাগল। অস্বীকার করব না, যা কিছু আপনি লিখেছেন, সবই সত্যি। আমার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আপনি যে কোন ইতস্ততঃ বোধ করেননি, তাতে আমি খুশি।

আমি কী রকম, সে কথা আপনার লেখা থেকে পাওয়া যেতে পারে, - আবার আপনার লেখায় এমন কিছু আছে, যা আমি হলেও হতে পারি, যদিও আমি এতদিন সেটা বুঝতে পারিনি।

বিনীত,

সাদাত হাসান মান্টো

 

এছাড়া আমি ওই লেখা সম্পর্কে আর কিচ্‌ছু বলতে চাই না। যা সত্যি, তার থেকে আমি পালাতেও পারি না। আমি যদি মদ্য পান করি, আমি অস্বীকার করতে পারি না। আমি যে কারো কারো থেকে টাকা ধার করে থাকি, সেটাও সত্যি। তবে এই সব ব্যাপারের জন্যে আমায় যদি কেউ খারাপ লোক ভাবে, ভালো কথা। যেভাবে আমি জগৎটাকে দেখি, সে কথা লিখে আমি আপনাদের সবাইকে হয়তো বারবার অস্বস্তিতে ফেলেছি – কিন্তু তাও আমি পাইকারি গল্পের লেখক হতে পারবো না।

যাই হোক, আমি ছেড়ে আসা কথাতেই আবার ফিরে আসি। আমার আগের লেখা পড়ে, আপনারা এতদিনে সকলেই জেনে গেছেন, এই নিয়ে পঞ্চমবার আমি অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হলাম।

আমার বন্ধু, নাসির আনোয়ার এবং আমি লাহোর স্টেশনে পৌঁছলাম। মিঃ তুফেল আমাদের টিকিট আগেই কেটে দিয়েছিলেন, এখন বাকি রইল ট্রেনে বসার জায়গা পাওয়া। আমাদের সঙ্গে প্রচুর বিয়ারের বোতল ছিল, আমাদের সমস্যা হল, সেগুলোর জন্যেও কোন বসার জায়গা পাওয়া গেল না।

আমার এক পরিচিতের নাম মনে পড়ল, ইয়াকুব তওফিক, সে এখানকার অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশনমাস্টার। সে সময় সে ডিউটিতেই ছিল এবং সে আমাদের দুজনের জন্যে একজোড়া সিটের ব্যবস্থা করে দিতে, আমরা করাচির দিকে রওনা হলাম।

আমাদের কামরায় একজন মৌলভী ছিলেন। তিনি তস্‌বির মালা জপছিলেন এবং মনে হল যেন পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠতে চলেছে। সমস্যা সমাধানের জন্যে আমি নাসিরকে বললাম, ইয়ার আমাকে একটা বিয়ারের বোতল দে তো।

নাসির সিটের নিচ থেকে একটা বোতল খুলে আমার হাতে দিল। মৌলভী সায়েব পরের স্টেশনেই নেমে গেলেন, তিনি তখনও মালা জপছিলেন। এরপর লাহোর স্টেশনে এক ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রী আমাদের কামরায় উঠেছিলেন। তাঁরা যখন বসার জন্যে এদিক সেদিক আসন খুঁজছিলেন, আমি ভদ্রলোককে বললাম, “দেখুন স্যার, আমরা মদ্যপ। আমরা পনের বোতল বিয়ার নিয়ে চলেছি। আমরা মাতাল হয়ে পড়বো এবং উল্টোপাল্টা বকতে শুরু করব। দেখেই বোঝা যায় আপনি একজন ভদ্রলোক এবং আপনার সঙ্গে স্ত্রী রয়েছেন। আপনারা অন্য কামরায় গেলেই ভাল হবে”।

এখন আমি যখন এই লেখাটা লিখছি, মিঃ তুফেল, যিনি আমাদের ট্রেনে ওঠার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে স্টেশনে এসেছিলেন, তাঁর কিছু কথা মনে পড়েছিল। সেই ভদ্রলোক এবং তাঁর বুরখা চাপা স্ত্রী স্টেশন মাস্টারের কাছে গেলেন এবং বললেন, তাঁদের কামরায় দুজন সাংঘাতিক লোক বসে আছে। স্টেশন মাস্টার অবাক হয়ে ভদ্রলোককে বললেন, “আপনি সাদাত হাসান মান্টোর মতো এক আপাদমস্তক ভদ্রলোক সম্পর্কে এ কী কথা বলছেন”?

ভদ্রলোক বললেন, “না স্যার, লোকটা নিজেই বলছে সে একজন মদ্যপ”। যাই হোক, তাঁদের অন্য কোথাও বসার ব্যবস্থা হল এবং আমরা তাঁদের থেকে পরিত্রাণ পেলাম।

সেকেণ্ড ক্লাসে বসেও করাচি পর্যন্ত যাওয়াটা ভীষণ বিরক্তিকর। গোটা কামরাটা ধুলোয় ভর্তি। আমরা যার জন্যে এই জার্নিটা সহ্য করতে পেরেছিলাম, সেই বিয়ারকে অনেক ধন্যবাদ।

আমরা কোন একটা হোটেলে থাকার জন্যে ঘোরাঘুরি করছিলাম, কিন্তু আমার সচরাচর যেমন হয়ে থাকে, তেমনই, আমার কাছে তেমন টাকা ছিল না। আমরা স্ত্রী বার বার বলেছিলেন, তুমি আমার ভাইয়ের বাড়িতেই থেকো। কিন্তু আমি একটা প্রবাদের কথা ভাবছিলাম, সারি খুদাই এক তরফ, জরু কা ভাই এক তরফ। অতএব আমি সমস্ত দুনিয়াকে একদিকে সরিয়ে, স্ত্রীর ভাইয়ের দিকেই গেলাম।

ভদ্রলোক বেশ রুচিবান, ভালো চাকরি করেন এবং তাঁর ফ্ল্যাটটাও যথেষ্ট বড়। তিনি আমাদের সানন্দেই আপ্যায়ন করলেন এবং নাসির ও আমাকে তাঁর ফ্ল্যাটের পাশের ঘরেই থাকতে দিলেন।

করাচিতে থাকার আমার কোন ইচ্ছেই হচ্ছিল না। বম্বেতে প্রায় পনের বছর থাকার পর, এই করাচিতে নতুন কিছুই আমার দেখার নেই। পরের দিন সকালেই আমরা ম্যজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির হলাম। খুব সাধারণ একটা বাড়ি, তার মধ্যে ঘুপচি একটা ঘরে অ্যাডিশন্যাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বসেন।

আমি আগে লাহোরের আদালতে গিয়েছি, তাদের রীতিনীতি ও আদব কায়দা আমার ভালই জানা ছিল। আমি দেখেছি এই জায়গাগুলো হল সেই জায়গা যেখানে বিন্দুমাত্র রুচিবোধ নেই।

বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে, আমি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দাঁড়ালাম। তিনি আমাকে দেখলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, “কী চান”?

তাঁর নম্র কথায় আমি আশ্চর্য হলাম। আমি বললাম, “স্যার, আমার নাম সাদাত হাসান মান্টো। আমার লেখা “উপর, নিচে অওর দার্মিয়ান”-এর জন্যে অশ্লীলতার অভিযোগে - সেকসন ২৯২ ধারায় - আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন”।

উনি বললেন, “বসুন”। উনি কাকে বসতে বললেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে, আমি দাঁড়িয়েই রইলাম।

তিনি লক্ষ্য করে বললেন, “মান্টো সাহেব, দয়া করে বসুন”। আমি তাঁর উল্টোদিকের চেয়ারে বসলাম।

কিছুক্ষণ পরে তিনি বললেন, “এতদিন আসেননি কেন?”

আমি বললাম, “আমি অসুস্থ ছিলাম”।

আপনি একটা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট পাঠাতে পারতেন”।

আমি মিথ্যে করে বললাম, “আমি এতটাই অসুস্থ ছিলাম, সেটুকু করারও সাধ্য ছিল না”। 

তিনি চুপ করে শুনলেন, তারপর বললেন, “এখানে আপনার এখন কী হলে ভালো হয়”?

বলাই বাহুল্য, আমি তো চাইছিলাম এই উদ্ভট সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে। তাছাড়া আমি আরো চিন্তা করলাম, মিঃ তুফেল যিনি আমার জামিন হয়েছেন, তিনি নিজের সুরক্ষার জন্যে, আমাদের দুটো সেকেণ্ড ক্লাসের টিকিট কেটে দিয়ে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সক্কাল সক্কাল আমাদের ট্রেনে চড়িয়েছেন।

আমি বিচারককে বললাম, “আমাকে ছেড়ে দিন, আমি বাড়ি ফিরতে চাই”।

উনি উত্তর দিলেন, “সেটা এখনই করা যায় না। আমি এখনও আপনার ওই লেখাটা পড়িনি। ইনশাল্লা, আমি আজকেই পড়ব এবং আগামীকাল সিদ্ধান্ত করবো”।

নাসির আর আমি তাঁকে বিদায় জানিয়ে কয়েকটা বিয়ার খেতে বের হলাম। আমরা একটা মোটরসাইকেল-রিকশ নিয়েছিলাম, জিনিষটা আমার বেশ পছন্দ হল। গাড়িটা ফুট-ফুট আওয়াজ করে চলে এবং এক ঘন্টার রাস্তা কয়েক মিনিটে চলে যায়। খরচও তেমন কিছু বেশি নয়।

পরেরদিন আমরা আবার আদালতে ফিরে গেলাম। বিচারক আমার শুভেচ্ছার উত্তরে সাড়া দিয়ে আমাকে বসতে বললেন। এবার আমি একটা বেঞ্চে বসলাম। তিনি একটা কাগজ টেনে নিয়ে বললেন, “আমার রায় আমি লিখে দিয়েছি”।

উনি তাঁর সহকারীর দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, “আজকের তারিখ কত”?

সহকারী উত্তর দিল, “পচ্চিশ”।

আমার শোনায় একটু ভুল হয়েছিল, আমি ভাবলাম, উনি আমাকে পচ্চিশ টাকা জরিমানা করেছেন। এই পঁচিশটাকা ফাইন মানে আমি আর অ্যাপিল করতে পারব না এবং আমার বিরুদ্ধে এই ফাইনের কথাই রায়ে লেখা থাকবে। আমি বলে উঠলাম, “স্যার, পঁচিশ টাকা ফাইন”?

আমার মনে হয় উনি আমাকে প্রকৃতপক্ষে পাঁচশ টাকা ফাইন ধার্য করেছিলেন, কিন্তু আমার গলায় আতঙ্কের সুর শুনে উনি মুচকি হাসলেন, তারপর সেটা পাল্টে পঁচিশ টাকাই ধার্য করলেন।

নাসির পকেট থেকে টাকাটা বের করে বলল, “তুই অল্পের ওপরেই বেঁচে গেলি। অ্যাপিল-ট্যাপিল করতে গেলে আরো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বি। ঠাণ্ডা গোস্ত-এর বিচারের কথা মনে করে দেখ”।

আমার মনে পড়ল এবং শিউরে উঠলাম। আমি আল্লাকে ধন্যবাদ দিলাম, এই কেস থেকে এত সহজে আমার মুক্তির জন্যে।

আমরা যখন বেরিয়ে আসছি, বিচারক জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা কবে ফিরছেন?”

আমি উত্তর দিলাম, “দেখি, হয়তো আজই”।

উনি বললেন, “আজ যাবেন না। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই”। আমি চিন্তিত হয়ে উঠলাম। উনি আবার আমার সঙ্গে দেখা করতে চান কেন?

আমি বললাম, “আমি কাল অব্দি থাকতে পারি”। উনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আজ বিকেল চারটের সময় আমরা কোথায় দেখা করতে পারি”?

আমি কয়েকটা বারের নাম বললাম, যেখানে আমরা ড্রিংক করতে যাই, কিন্তু উনি ড্রিংক করেন না, অতএব ঠিক হল কফি হাউসে। আমাদের ওখানে যেতে পনের মিনিট দেরি হয়েছিল। বিচারক আগেই পৌঁছে গেছিলেন। কিছুক্ষণ পরে, উনি খুব আন্তরিক ভাবে বললেন, “মিঃ মান্টো, আমি মনে করি আপনি আমাদের সময়ে সব থেকে বড়ো লেখক। আমি চাই না, আপনার প্রতি আমার কোন সহানুভূতি নেই, এমন মনে করেন”।

আমি অবাক হয়ে বললাম, “তাহলে আপনি আমায় ফাইন করলেন কেন?”

উনি হেসে বললেন, “সে কথা আপনাকে আমি এক বছর পর বলব”।

 

কয়েক মাস পার হল, আর কয়েকটা মাস বাকি। দেখা যাক সেই ম্যাজিস্ট্রেট, যাঁকে এক কথার মানুষ বলেই মনে হয়েছিল, কী বলেন।

 

..০০..

 

[প্রথম প্রকাশঃ নাকুশ পত্রিকা, মার্চ ১৯৫৩, - পাঁচওয়া মুকদ্দমা (২)]                       

 

 

পাস মানজার[7]

 

[অনুবাদকের মন্তব্যঃ বেশ্যা, বর্বরতা এবং নেক্রোফিলিয়া নিয়ে মান্টোর গল্পগুলি পাকিস্তানের মৌলবাদীদের মোটেই সহ্য হয়নি। মান্টো সেখানে মৌলবাদীদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছিলেন। আদালতে দিনের পর দিন তাঁর প্রতি ঘটতে থাকা দুর্ব্যবহার এবং অশ্লীলতার দায়ে বারবার অভিযুক্ত হওয়ার রাগে তিনি নীতিহীন সমালোচকদের এই লেখায় কঠোর আঘাত করেছেন। মান্টোর পক্ষে খুব অস্বাভাবিক হলেও, এই লেখায় প্রকাশ পেয়েছে তাঁর হতাশা আর তিক্ত বিরক্তি। মান্টো প্রথম থেকেই জিন্নার মুসলিম লিগের কঠোর সমালোচক ছিলেন, এই লেখাতেও সেই কটাক্ষ স্পষ্ট। এই লেখাটি কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানা যায়নি। হয়তো কোন বিষণ্ণ বিকেলে তিনি নিজের জন্যেই এই লেখাটি লিখেছিলেন, পাঠিয়েছিলেন নিজের সংকলনে প্রকাশ করার জন্যে।]  

 

শেষ খবরটা শুনেছেন?

কোরিয়ার?

না না ওসব নয়।

তাহলে জুনাগড়ের বেগমের খবর?

না।

কোন চাঞ্চল্যকর খুনের খবর?

না, অতটা নয় তবে সাদাত হাসান মান্টোর খবর।

কী হয়েছে? লোকটা মরেছে?

নাঃ, গতকাল সে অ্যারেস্টেড হয়েছে।

অশ্লীলতার জন্যে?

হ্যাঁ। ওর বাড়িতেও সার্চ হয়েছে।

ওরা কী কোকেন পেয়েছে? বেআইনি মদ পাচার করছিল মনে হয়?

না। খবরের কাগজে লিখেছে বেআইনি কিছুই পাওয়া যায়নি।

আমার তো মনে হয়, বেজন্মাটার বেঁচে থাকাটাই বেআইনি।

তা ঠিক।

তাহলে সেই অভিযোগেই ওকে ধরছে না কেন?

ও ব্যাপারটা আমাদের সরকারের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। ওরাই জানে এ ধরনের লোককে কেমন করে ঢিট করতে হয়।

নিঃসন্দেহে, ওরাই জানে।

তাহলে কী বলছ? এবার মান্টোকে ওরা নিশ্চয়ই ঝুলিয়ে দেবে।

আশা করি তাই যেন হয়। এভাবেই বেজন্মাটাকে চিরকালের জন্যে জব্দ করা যাবে।

ঠিকই বলেছ। ওর সেই “ঠাণ্ডা গোস্ত” নিয়ে হাইকোর্ট যা বলেছিল, তাতে ওর নিজেরই গলায় দড়ি দেওয়া উচিৎ ছিল।

আর যদি তাতে ব্যর্থ হত...

ব্যাটাকে আত্মহত্যার চেষ্টার অভিযোগে ফেলা যেত এবং গরাদের  ভেতরে ফেলে রাখা যেত।

আমার মনে হয় হতভাগাটা সেই জন্যেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেনি। তা না হলে ব্যাটা বেশ কট্টর লোক।

তার মানে তোমার মনে হয়, লোকটা অনবরত পর্নোগ্রাফিই লিখে যাবে।

ইয়ার, এই নিয়ে এটা ওর বিরুদ্ধে পঞ্চম কেস। যদি শোধরানোর হত, প্রথমবারের পরেই এসব লেখা ছেড়ে, ভদ্রস্থ কোন কাজে হাত দিত।

সত্যিই।  সরকারি চাকরি করতে পারত, বা ঘিয়ের ব্যবসা শুরু করত। অথবা মহল্লা পির গিলানিয়ার গুলাম আহমেদের মতো, ধ্বজভঙ্গদের চিকিৎসা করে চমৎকারি দেখাতে পারত।

হ্যাঁ। ওর সামনে অনেকগুলো ভদ্রস্থ কাজের রাস্তাই খোলা ছিল। কিন্তু লোকটা আস্ত একটা কাফের। আমার কথা মিলিয়ে নিও, যখনই ব্যাটা সময় পাবে, আবার পর্নোগ্রাফিই লিখতে বসে যাবে।

শেষ অব্দি কী হবে, তুমি কী জান?

আমি খুব খারাপ কিছু দেখতে পাচ্ছি।

ওর নামে পাঞ্জাবে ছটা, সিন্ধে দশটা, নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ারে চারটে আর পাকিস্তানে গোটা চারেক কেস জুটবেই। আদালতে লড়তে লড়তে হতভাগা পাগল হয়ে যাবে।

সেদিন কাগজে পড়ছিলাম এর আগে ও নাকি দুবার পাগল হয়ে গেছিল।

দূরদর্শী বলেই ও অমন করেছিল। জাঁতাকলে পড়ে, সত্যিই পাগলা গারদে যাবার কথা ভেবে, আগে থেকেই ও তার রিহার্সাল করছিল, যাতে ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। যাতে ও অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে।

কিন্তু ওখানে গিয়ে ও করবেটা কী?

পাগলদের সুস্থ করার চেষ্টা করবে।

সেটাও কী কোন অপরাধ?

ঠিক জানি না। এই বিষয়ে পাকিস্তানের পেনাল কোডে কোন সেকসন আছে কী না, সেটা কোন উকিলই বলতে পারবে। আমার ধারণায় থাকা উচিৎ। উন্মাদ মানুষকে সুস্থ করা, সেকসন ২৯২ অনুযায়ী, শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

ঠাণ্ডা গোস্ত”-এর রায় দেওয়ার সময় হাইকোর্ট বলেছিলেন, লেখকের উদ্দেশ্য বা তার চরিত্র কেমন – সে বিষয়ে আইনের কিছু করার নেই। ওর লেখায় ঘৃণ্য নোংরামি রয়েছে কী না শুধু সেটাই তাঁদের দেখার বিষয়।

সেটাই তো আমি স্পষ্ট করে বলতে চাইছি, পাগলকে সুস্থ করে তোলার উদ্দেশ্য যাই থাক, গোটা ব্যাপারটার মধ্যে যে একটা অস্বাভাবিক প্রেক্ষিত রয়েছে, সেটা বিবেচনা করা দরকার।

এগুলো সবই আইনের বিষয় – যাকে ওরা সাবজুডিস বলে - আমাদের তার থেকে দূরে থাকা উচিৎ।

হক কথা। আমাকে মনে করিয়ে দিয়ে ভালই করেছেন। ব্যক্তিগত পরিসরেও এ নিয়ে আলোচনা করা অপরাধ।

এবার বল, মান্টো যদি সত্যিই উন্মাদ হয়ে যায়, তার স্ত্রী, সন্তানদের কী হবে?

জাহান্নামে যাবে। এ ব্যাপারে আইনের কী করার আছে?

ঠিক আছে, কিন্তু আপনার কী মনে হয়, সরকার তাদের সাহায্যে কোন ব্যবস্থা নেবে?

সরকারের কিছু একটা করাই উচিৎ। ওরা কাগজে বিবৃতি দেবে যে সরকার বিবেচনা করছে।

এবং এই বিবেচনা করে ওঠার অনেক আগেই, সব কিছু সেরে ফেলা যাবে। চমৎকার।

একদম। এমনটাই তো সর্বদা হয়ে থাকে।

যাগ্‌গে, মান্টো আর তার সংসার জাহান্নমে যাক। কিন্তু একটা কথা বলুন, উর্দু সাহিত্যে হাইকোর্টের রুলিং কতটা প্রভাব ফেলবে?

উর্দু সাহিত্যও জাহান্নমে যাক।

ও কথা বলবেন না। শুনেছি যে সাহিত্য আর সংস্কৃতিকে একটা জাতির সম্পদ বলা হয়।

আমি শুধু টাকাকেই সম্পদ মনে করি – কিছু নগদে থাকবে আর কিছু থাকবে ব্যাংকের ভল্টে।

ওভাবে রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে মোমিন, মির, আহ্‌সান, জওক, সাদি – ওদের সবাইকেই কী সেকসন ২৯২ দিয়ে মুছে ফেলা যাবে?

আমার বিশ্বাস করা যাবে। তা নইলে আর আইন রেখে লাভ কী?

সব কবি এবং লেখককেই সুস্থ চিন্তায় ফিরতে হবে এবং কোন ভদ্র পেশায় যুক্ত হতে হবে।

হয়তো রাজনীতিতে যোগ দেবে।

একমাত্র মুসলিম লিগ, ঠিক আছে?

অবশ্যই! আমি সেটাই বলতে চেয়েছি। অন্য দলে যাওয়া মানেই অশ্লীলতা ছড়ানো।

একশ বার।

তাছাড়াও ওরা অন্য কোন ভদ্র কাজ করতে পারে। ওদের ওই লেখার প্রতিভা নিয়ে ওরা পোস্ট অফিসের বাইরে বসে যাক, অন্য লোকের চিঠি লিখে দিক। স্বাভাবিকভাবেই সে ভাষা যেন অশ্লীল না হয়। অথবা উল্টোপাল্টা বিজ্ঞাপনও লিখতে পারে, দেওয়াল ভর্তি এলোমেলো লেখা, যেমন দেখেন আর কী? এটা একটা সদ্য গড়ে ওঠা নতুন জাতি, যার হাজার হাজার কাজের লোক দরকার। তার কিছুটা তো ওরা পূরণ করতেই পারে।

হ্যাঁ। অনেক খালি জমিও আছে, যেখানে ওরা চাষ-আবাদ করতে পারে।

শুনেছি সরকার রাভি নদীর ধারে এমনই কিছু জায়গা ঠিক করছে, যেখানে সমস্ত বেশ্যা আর নষ্টা মেয়েদের নির্বাসন দেওয়া হবে। শহর থেকে দূরে। এই কবি আর লেখকদেরও পাততাড়ি তুলে, সেখানে পাঠানোর চিন্তা করা হবে না কেন?

দারুণ প্রস্তাব। ওরা ওখানেই বেশ শান্তিতে থাকবে।

আপনার কী মনে হয়, কী হবে?

আর কী হবে? ওরা ওখানেই পচবে। কদর্য নোংরায় গড়াগড়ি খাবে।

দারুণ হবে ব্যাপারটা। আমার মনে হয় মান্টো চারপাশের ওই পরিবেশে আনন্দেই থাকবে।

কিন্তু হতভাগা ওদের সঙ্গে না শুয়ে, বরং বেশ্যাদের নিয়েই লিখবে। ব্যাটা ওদের গল্প শোনাবে আমাদের।

ঠিক।  আমি আজও বুঝতে পারিনি, পৃথিবীতে যা কিছু দুঃসহ, তাকেই কেন ও জোর করে মর্যাদার আসন দেয়। আমরা বাকি সবাই যাদের বিতৃষ্ণা আর ঘৃণার চোখে দেখি। তাদেরই জড়িয়ে ধরে, হতভাগাটা সহ্য করে কী করে?

ওর বোন ইসমত[8] বলে, অন্য লোকে যার থেকে দূরে থাকতে চায়, ও নাকি তাতেই বেশি আগ্রহ অনুভব করে। এটা সত্যি কথা। যেখানে সবাই দাগহীন সাদা পোষাক পরে, ও সেখানেই থকথকে কাদা মেখে নিজেকে নোংরা করে তুলতে চায়।

ওর ভাই মুমতাজ হোসেন বলে, যে লোকটার পেটে কখনো ভালো কিছু পাওয়া সম্ভব নয়, তার থেকেই ও রোজ সকালে সৌন্দর্য খুঁজতে বের হয়।

আমাকে জিজ্ঞাসা করলে বলব, এটা একেবারেই জঘন্য কুরুচিকর। পেটের নাড়িভুঁড়ির মধ্যে ওই সৌন্দর্যের আশা করা।

আর ওই ধবধবে সাদা কাপড় পরা লোকের গায়ে, কাদা ছেটানোর ব্যাপারটা?

ওটাও ঘৃণ্য কুরুচি।

ও এত থকথকে কাদা পায় কোথায়, সে কথা ভেবেছেন?

নাঃ কোন ধারণা নেই, কোথাও একটা পায়।

আসুন আমরা প্রার্থনা করি, এই নির্লজ্জ নোংরামি থেকে ঈশ্বর যেন আমাদের উদ্ধার করেন। হয়তো এতে মান্টোরও কিছু উপকার হবে।

 

প্রার্থনা

হে ঈশ্বর আপনি করুণাময় এবং দয়ালু। আমরা দুজনেই পাপী, কিন্তু আমাদের নিবেদন, গুলাম হাসান মান্টো, যিনি একজন ধার্মিক এবং ভাল মানুষ ছিলেন, তাঁর পুত্র, সাদাত হাসান মান্টোকে এই দুনিয়া থেকেই সরিয়ে নিন।

এই দুনিয়ায় তার কিছুই করার নেই। আপনার জগতের সমস্ত সুগন্ধকে সে ইচ্ছে করে এড়িয়ে চলে এবং দুর্গন্ধের দিকে দৌড়োয়।

আলোর দিকে ফিরে ও চোখ বন্ধ রাখে এবং অন্ধকার কোণগুলো খুঁজতে থাকে। ও সবকিছুর ভেতর কদর্য আর নগ্নতা দেখতে চায়। মিষ্টি জিনিষ অপছন্দ করে,  কিন্তু তিক্ততা থেকে আনন্দ পায়।

গৃহবধূদের কোন গুণই ও দেখতে পায় না এবং বেশ্যাদের সঙ্গ খোঁজে।

ও নোংরা কাদায় স্নান করে। আমরা যখন কাঁদি, ও তখন খিকখিক করে হাসে। যখন কেউ হাসতে যায়, ও জন্তুর মতো চিৎকার করে।

অনৈতিকের কালো মুখের কালি মুছে, সেই মুখটা আমাদের দেখার জন্যে জোর করে।

আপনাকে ছেড়ে, হে ঈশ্বর, ও শয়তানের পুজো করে।

হে বিশ্বপিতা, এই লোকের থেকে আমাদের মুক্ত করুন, যে পাপকে স্বাভাবিক করে তুলতে চায়। লোকটা যে অন্যের ক্ষতি করতে ভালোবাসে – তার প্রমাণ আদালতের নথিতেই পাওয়া যাবে।

আপনার চিরন্তন আদালতে ওর বিচার করুন, যাতে শেষ অব্দি ও উচিৎ বিচার পায়।

কিন্তু, সাবধান হে ঈশ্বর! লোকটা ভীষণ ধূর্ত। ওর ধূর্ততার ফাঁদে যেন পা দেবেন না। অবশ্য আপনি সবই জানেন, তবু একবার মনে করিয়ে দিলাম।

আমাদের একমাত্র নিবেদন, আপনি এই দুনিয়া থেকে ওকে সরিয়ে দিন। আর যদি ওকে এই দুনিয়ায় রাখতেই হয়, তাহলে আমাদের একজন হয়েই থাকুক – আমরা যারা জগতের কদর্যতাকে লুকিয়ে রেখে, সব কিছুই যেন পবিত্র, এইভাবে বেঁচে থাকি।

আমেন!

 .০০.

 


[1] আব্দুল বারি আলিগ (১৯০৬-১৯৪৯) উর্দু ভাষার বিখ্যাত পণ্ডিত, লেখক এবং সমালোচক, তাঁর জন্ম অমৃতসরে এবং পড়াশোনা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

[2] আলি সর্দার জাফরি (১৯১৩-২০০০) জ্ঞানপীঠ ও পদ্মশ্রী পুরষ্কার প্রাপ্ত উর্দু কবি, সাহিত্যিক। উত্তরপ্রদেশের বলরামপুরে জন্ম এবং পড়াশোনা জাকির হোসেন কলেজ, দিল্লি, আলিগড় মুসলিম এবং লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে

[3] Manto Ke Mazameen (1954) থেকে উদ্ধৃত।

[4] মৌলবী আব্দুল হক (১৮৭০-১৯৬১), উর্দু ভাষার বিশিষ্ট পণ্ডিত এবং ভাষাবিদ। কেউ কেউ তাঁকে “বাবা-এ-উর্দু” (ফাদার অফ উর্দু) বলতেন। মিরাট জেলার হাপুরে তাঁর জন্ম, মৃত্যু পাকিস্তানের করাচি শহরে। পড়াশোনা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভারতে উর্দুকে রাষ্ট্রিয় ভাষা করার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত উদ্যোগী ছিলেন, পরবর্তী কালে স্বাধীন পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হয় উর্দু।

[5] তারাচাঁদজিঃ সমসাময়িক বেশ কয়েকজন তারাচাঁদের নাম পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু তাঁদের মধ্যে কে মান্টোর ওই উল্লিখিত তারাচাঁদজি, সেটা নির্দিষ্ট করা গেল না।   

[6] দারমিয়ান – উর্দু এই শব্দটির অর্থ মধ্যে বা মাঝখানে।

[7] এই উর্দু শব্দের অর্থ যবনিকা, কোন দৃশ্যকে আড়াল করার পর্দা।

[8] ইসমত চুঘতাই (১৯১৫-১৯৯১) - উর্দু ভাষায় বিখ্যাত ভারতীয় মহিলা সাহিত্যিক, জন্ম বদায়ুন, ইউপি; কর্মস্থল মুম্বাই।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

জঙ্গী ব্যবসা

  ১   ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ