রম্য রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রম্য রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

তুলনা তার নাই...


[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

 বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 





[এর আগের পর্ব পড়তে হলে পাশের সূত্রে যান নীড় ছোট ক্ষতি নেই... ]


 


 ক্লাস ফাইভে যখন পড়ছিলাম, মর্নিং সেসানে আমরা ছিলাম সিনিয়রমোস্ট বাচ্চা। আর ক্লাস সিক্সে উঠে হয়ে গেলাম ডে সেসনের জুনিয়ারমোস্ট বড়।

তবু বড়ো তো হয়েছি। মা ভরসা করে একলা ছেড়ে দিয়েছেন। স্কুলে বেরোনোর সময় হাতে দিয়েছেন একটা সিকি, বলেছেন, ‘টিফিনে খিদে পেলে কিছু কিনে খাস। তাই বলে ছাইপাঁশ খেয়ে যেন পেট খারাপ করিস না’। 

প্যান্টের পকেটে সিকি, জামার বুকপকেটে ফাউন্টেন পেন আর হাতে একটা খাতা নিয়ে প্রথম দিন রওনা দিলাম স্কুলেএতদিন মর্নিং সেসানে সকাল পৌনে সাতটায় বেরোতাম। সকালের কোমল আলো, শান্ত পরিবেশে। ওই সময়ে বড়ো রাস্তায় লোকজন কম থাকত, গাড়ি থাকত আরো কম লোকজনের হৈ হট্টগোলের চেয়ে চড়ুই, কাক, শালিক আর পায়রাদের ব্যস্ততা নজরে আসত বেশী। দোকানপাট সবই থাকত বন্ধ – বেশ নিরিবিলি, নিশ্চিন্ত ছিল পথচলা। সে ছিল একরকম। আর আজ বেলা সাড়ে দশটায় - উজ্জ্বল চোখে লাগা আলো। এই শেষ ফেব্রুয়ারিতে রোদ্দুর তার উষ্ণতার মোড়ক ছাড়িয়ে তপ্ত হয়ে উঠেছেবড়ো রাস্তায় গাড়ির অবিচ্ছিন্ন চলাচল। দোকানপাট সব খোলা। পথে লোকজনের চরম ব্যস্ততা - চারিদিকে হৈচৈ কোলাহল। 

প্রথমতঃ দিদিমা, মাসিমাদের ও বন্নিদিদির অপরিমিত আদর ও যত্নের স্মৃতিতে আচ্ছন্ন মস্তিষ্ক। দ্বিতীয়তঃ, তিনমাসব্যাপী নিয়মছাড়া – লাগামহারা গ্রামজীবনের জমাট হ্যাংওভার তৃতীয়তঃ জীবনে প্রথমবার একা এই পথচলা এবং একা একা বড়ো রাস্তা পার হওয়ার চাপা ভয়মিশ্রিত জিদতারও ওপর মর্নিং সেসনে স্কুলে যাওয়ার মতো অভ্যস্ত পথচলাও এখন আর নেই। সব মিলিয়ে আমার মনটা বেশ ভারি হয়ে উঠছিল পথ চলতে চলতে। পাঁচবছর যে রাস্তা অবহেলায় হেঁটে পার হয়েছি – আজ নিজেকে মনে হচ্ছে অনন্ত পথের সঙ্গীসাথীহীন যাত্রী – ওইটুকু পথও যেন শেষ হচ্ছিল না

সব দুঃখরাত্রির পর যেমন ভোর আসে। প্রবল দুর্যোগের পর যেমন নেমে আসে মেঘভাঙা রোদ। ঠিক সেভাবেই স্কুলে পৌঁছে গেলাম। ভাস্করদা, গেটেই ছিল একগাল হেসে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আসি গলা? তোমারঅ বাপঅ কেত্তে থরে আসিলা আউ, খবরঅ পাঁই... যাও, যাও...নতুন ঘরে গিয়ে বসো’। ক্লাস সিক্সের ঘরে গিয়ে জুটলাম এবং সেখানে একে একে জুটতে লাগল আমাদের ক্লাসের সকলে।

এতদিনের সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে - তিনমাসের সংযোগহীন থমকে থিতিয়ে যাওয়া সম্পর্ক আবার সুসম মিশ্রিত হয়ে উঠল কিছুক্ষণের মধ্যেই। এই কমাসের অনালাপের সঙ্কোচ কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বভাবসুলভ হট্টগোলে পরিণত হল। সকলেই শোনাতে চায় সে কি করেছে এই তিনমাস – কেউ গেছে পাহাড়ে। কেউ সাগরে। রোমাঞ্চে ভরপুর সেই সব ভ্রমণ কাহিনী।

সেইসব ভ্রমণকাহিনীর ভূমিকার হট্টগোলের মধ্যেই সেদিন ক্লাস শুরু হয়ে গেল। নতুন সেসনের নতুন ক্লাস। নতুন মাস্টারমশাই। রেজাল্ট বের হবার কোন দুশ্চিন্তা নেই। কাজেই ভাল রেজাল্টের আনন্দ অথবা খারাপ রেজাল্টের বিমর্ষতাহীন সাদামাটাভাবে শুরু হল ক্লাস সিক্সের সূচনা। কিছুটা কথাবার্তার পর আমাদের বইয়ের তালিকা বোর্ডে লিখে দিলেন মাস্টারমশাই – কারণ এবারে বুকলিস্ট ছাপানো সম্ভব হয়নি। বোর্ডে লিখে দিলেন ক্লাসের রুটিন – আর ঘোষণা করলেন আগামীকাল থেকে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে পুরোদস্তুর রুটিন মাফিক।            

মাস্টারমশাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে আমাদের হট্টগোল আবার শুরু হল। এলোমেলো ভাবে শুনলাম অনেকের ভ্রমণ কাহিনীগুলি। সকলেই ভাগ করে নিতে চাইছিল তাদের রোমাঞ্চ ও উত্তেজনাপূর্ণ অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতা। তার মধ্যে ছিল - সূর্যোদয়ের আভায় মহিমান্বিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখতে পাওয়া না পাওয়ার আনন্দ ও হতাশা। পুরীর সাগরবেলায় সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নুলিয়াদের সাহায্যে লবণাম্বু স্নানে কালো হয়ে ওঠা ফর্সা মুখ। ভাইজ্যাগের সীবীচ, পন্ডিচেরির অরবিন্দ আশ্রম। বোম্বাই শহর - তার জুহু বীচ, মেরিন ড্রাইভ, এলিফ্যান্টা কেভস...নিয়ে ঢুকে পড়ল আমার কল্পনায়। ছোট ছোটো ঝর্ণা, তিরতিরে নদী, ঘন শালের জঙ্গল, হরিণ, ময়ুর, নীলগাই চড়া কুয়াশায় প্রসাধিত পূর্ণিমার রাত। রাতচরা পাখির ডাক। দূর থেকে ভেসে আসা বাঘের গর্জন ... এইসব নিয়ে ভিতরকণিকা, বেতলা, পালামৌ, হাজারিবাগ... হাজির হতে থাকল আমার কল্পনায়... 

আমার বন্ধুদের বিখ্যাত পর্বত-সাগর-অরণ্য জয়ের রম্য রোমাঞ্চের পাশে আমার বাংলার গ্রাম্য অভিজ্ঞতা নিছক পানসে এবং জোলো মনে হচ্ছিল। অনেকেই যখন জিগ্যেস করেছিল – কিরে তুই কোথাও যাসনি – নাকি কোলকাতাতেই ছিলি? খুব উদাসীন উত্তর দিয়েছিলাম – নাঃ, মামার বাড়ি গিয়েছিলাম। ও বয়সে মামারবাড়িতো সকলেই যায় – কাজেই কেউই উৎসাহ দেখায়নি আমার অভিজ্ঞতার অংশভাক হতে। আমারও গ্রাম বাংলায় দীর্ঘদিন থাকার সুবাদে যে সূক্ষ্ম অনুভূতিসমূহ মনে আহৃত হয়েছিল তা ভাষায় বর্ণনা করার সাধ্য আজও অর্জন করতে পারিনি। কাজেই সেদিন  নীরব ও আপাত উদাসীন থাকা ছাড়া আমার কোন গত্যন্তর ছিল না। তাছাড়াও হয়তো একধরনের হীনমন্যতাও কাজ করেছিল আমার বালক মনে – কারণ আমার দর্শনে না ছিল কোন গ্ল্যামার, না ছিল কোন চমক       

স্কুল ছুটির পর, একলা ফেরার পথটা, সকালের আসার পথের মতো আর কোন প্রতিক্রিয়া করল না মনে। সকালের সফল যাত্রার পর বেড়ে গিয়েছিল আত্মবিশ্বাস। দীর্ঘদিন অদেখা সমবয়সী সহপাঠীদের সঙ্গ আমার মনকেও অনেকটা স্থিতাবস্থা এনে দিয়েছিল। মামাবাড়ির স্নেহের আর আদরের জীবনযাত্রা আর স্কুলে আমার এই নিজস্ব জগৎটা খুব স্পষ্টভাবে ধরা দিল আমার মনে - তাদের নিজ নিজ মহিমা নিয়েই। দুটো পরিস্থিতিই যে আলাদা আলাদা ভাবে আমার কাছে ভীষণ প্রয়োজনীয় - সেই বোধ আমার আসছিল ধীরে ধীরে। কাজেই ফেরার পথটা বরং বেশ কেটে গেল বন্ধুদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমার সাদামাটা গ্রাম্য অভিজ্ঞতার তুল্যমূল্য বিচার করতে করতে।

 পুকুরপাড়ে ঝুঁকে মুখ দেখতে থাকা narcissus তালগাছের ছায়ায় সারাটা দিন ভেসে বেড়ান নিশ্চিন্ত হাঁসের পাল। স্বর্গদ্বার অথবা মেরিন ড্রাইভের মহিমা তারা পাবে কোথায়? গলায় বাঁধা ঘন্টার আওয়াজ তুলে ঘরে ফেরা গরুর পাল আর শেষ বিকেলে তাদের পিছনে সধবার মস্ত সিঁদুরের টিপের মতো অস্তগামী সূর্যের আলোমাখা গোধূলি। জুহুর সূর্যাস্তের অপরূপ বৈভবের কাছে সেতো তুচ্ছ! প্রচুর ফসল ফলানোর পর অলস ক্ষেত্রের নিঃস্ব অবসরযাপনের দিগন্ত বিস্তৃত প্রসার, কোথায় পাবে বেতলা বা পালামৌয়ের আরণ্য রহস্য?

প্রথমদিন নিরাপদে বাড়ি এসে পৌঁছতে মাও খুব নিশ্চিন্ত হলেন। আমার মুখে বন্ধুদের নানান দেশ বেড়ানোর কাহিনী শুনতে শুনতে মা কী উপলব্ধি করেছিলেন জানিনা। মা বলেছিলেন – ‘ওসবের জন্যে তো সারাজীবনটাই পড়ে রইল – কিন্তু এই কমাসে তুই যা দেখলি, সঞ্চয় করলি, তা কোনদিনই আর ফিরে পাবি বলে আমার মনে হয় না। কী পেয়েছিস সে বোঝার সাধ্য আজ তোর না হবারই কথা, ধৈর্য ধর - বড় হলে বুঝতে পারবি - যা পেয়েছিস তুলনা তার নেই’।


...চলবে...

বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

তৃপ্তির তর্পণ

 

রবিঠাকুরের এসেছে শরৎ হিমের পরশ... পড়ার পরেও বর্ষার পর শরতের উঁকিঝুঁকি ছোটবেলায় তেমন অনুভবে আসত না। । সকাল সকাল ঘাসের ডগায় শিশিরের রেখা খুঁজে শরতের লক্ষণ মিলিয়ে নেওয়াও কলকাতা শহরে বেশ মুস্কিলের কাজ ছিল। কিন্তু মহালয়ার দিনটি মনে নিশ্চিত এঁকে দিত শরতের অধিষ্ঠান

ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতেন বাবা। মাথার কাছে রেডি থাকত ট্রানজিসটর রেডিওতে কলকাতা-ক। টেবিল ক্লকের আওয়াজে ভোরের ঘুম ভাঙা মেজাজটা বিগড়ে যেত ঠিকই। কিন্তু এটাও ঠিক, ওই আওয়াজই বয়ে আনত আমাদের জীবনে ছোট খাটো স্বাধীনতা আর তার সঙ্গে হাজারো মজার খাজানা। ওই ঘড়ি আমাদের ঘুম থেকে টেনে তুলত মহালয়ার দিনকিংবা ভোরের ট্রেন ধরে দেশের বাড়ি বা মামার বাড়ি যাবার দিন। কলকাতার ছোট্ট বাসা বাড়ির বাঁধন থেকে মুক্তির সূচনাটা ঘোষণা করত ওই টেবিল ক্লকটিই তাই তার কাছে আজও আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

ঘড়ি বেজে উঠলেই মা উঠে পড়ে, রেডিও চালিয়ে দিয়ে বসে থাকতেন বিছানায়। রেডিও চলল কিন্তু আকাশবাণী নয়, খড়খড় আওয়াজ আসছিল ওটা থেকে। মা বাবাকে জিগ্যেস করলেন – ‘কাল রাত্রে ঘড়ি মেলাও নি?বাবা বললেন –“মিলিয়ে তো ছিলাম। মনে হচ্ছে ঘড়িটা ফাস্ট চলছে। পরশু একবার দেখিয়ে নোবো কাত্তিককেআমাদের গলির মোড়ে কাত্তিককাকুর ঘড়ি সারানোর দোকান। এতটুকু একটা দোকানে কাচের শোকেসে হাজারো ঘড়ি এলোমেলো ছড়ানো। দেয়ালে পেন্ডুলাম দোলানো - না দোলানো অনেক ঘড়ি, সব কটাই দশটা দশে থমকে থাকা। বাঁ চোখে লেন্সের ঠুলি পড়া কাত্তিককাকু টেবিল ল্যাম্পের আলোয় মুখ তুলে তাকালে মনে হতো, আমার ভেতরের সব কলকব্জাও উনি দেখে ফেলছেন!

বাবা মার কথোপকথনের মধ্যেও কিন্তু আমার কানে এলো পাশের বাড়িতে পল্টুদের রেডিওর আওয়াজ। বাবাকে বললাম সে কথা। বাবাও এবার উঠে রেডিওর কানটা ধরে একটু নাড়াচাড়া করতেই আমাদের রেডিওও কথা বলে উঠল। টিউনিংয়ের লাল কাঠিটা এদিক ওদিক হয়ে গিয়েই বিপত্তি। বাবার কথায় আমাদের টেবিল ক্লকটা ফাস্ট বদনাম মেটাতে একটু যেন ধীরে চলা শুরু করেছিল। এখন সেও বুক ফুলিয়ে বলতে লাগল ঠিক ঠিক ঠিক ঠিক...

শুরু হয়ে গেল মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান।  গান, কথা আর মন্ত্রের সে এক অদ্ভূত রসায়ন - আমার চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে যেত শরৎকাল, পুজো, মা দুগগা আর তাঁর আশ্চর্য দশভুজা প্রতিমা...।  সব কথা তখন শোনা হয়নি, সব মন্ত্র বোঝার প্রশ্নই ছিল না সেই বয়সে। কিন্তু তাঁর কণ্ঠের রণন রক্তে নিয়ে আসত কি এক দিশাহীন ব্যাকুলতা। রোমাঞ্চিত হয়ে ঠত শরীর - বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আমার অন্তরে গড়ে তুলছিলেন তাঁর চিরস্থায়ী ভদ্রাসনটি। 

শুরুতে একটু শোনার পর মাকে – ‘শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো, শুয়ে শুয়ে শোনো’ – বলে বাবা নিজেই শুয়ে পড়তেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়তেন। আমি বাবার দেখাদেখি বসে শুনতে শুনতে - আধ শোয়া এবং একসময় পুরোই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। কিন্তু ঘুমের রাজ্য থেকেও মাঝে মাঝে কানে আসত মহিষাসুরমর্দিনী। মা ঠায় বসে বসে শুনতেনযখন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন সেই মন্ত্রগুলি –“ইয়া দেবী, সবর্ভুতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা... ঘুম টুটে যেত। একই মন্ত্রের একটি মাত্র শব্দ পাল্টে দেবীর সকলরূপের আরাধনা, এ একমাত্র সংস্কৃতেই বোধহয় সম্ভব। উঠে বসতাম নিজে নিজেই। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখতাম ভোরের আলোময় মায়াবি আকাশ। মা একইভাবে বসে আছেন কিন্তু তাঁর চোখে এখন অশ্রুধারা।

আজ মহালয়া, অমাবস্যা তিথি। পিতৃপক্ষের সমাপ্তি দিন। কাল প্রতিপদে দেবীপক্ষ শুরু। আজ পিতৃপক্ষের শেষদিনে পিতৃপুরুষের উদ্দ্যেশে গঙ্গোদক অর্পণ করে তর্পণ করার দিন। বাবা তর্পণ করবেন – পুজো করবেন নিজের হাতে। আজ ছুটির দিন হলেও কোন আমিষ রান্না আজ হবে না। বিশুদ্ধ নিরামিষ। পঞ্জিকা মতে অমাবস্যার নির্ঘন্ট দেখে গতকালই সময় নির্ধারিত – আজ সকাল নটা ছাব্বিশ গতে তর্পণক্রিয়া বিধেয়।

ওই নির্দিষ্ট সময়ের পর অপেক্ষায় থাকবেন আমাদের পিতৃকূল ও মাতৃকূলের দাদু ও ঠাম্মারা, দা’মশাই ও দিম্মারা। পিতামহ, প্রপিতামহ, বৃদ্ধপিতামহ, প্রবৃদ্ধপিতামহগণ এবং মাতামহ, প্রমাতামহ, বৃদ্ধমাতামহ, প্রবৃদ্ধমাতামহগণ সস্ত্রীক এসে দাঁড়াবেন পরলোকের ব্যালকনিতে। দুচারটে কালোতিল দক্ষিণ করতলে রেখে তার ওপর কুশি থেকে দুবিন্দু গঙ্গাজল। এই সামন্য অর্পণটুকু গ্রহণ করার জন্যে।

‘হে আমার পূর্বপ্রজন্মের পিতা-মাতাগণ আপনারা সকলে আজ এই অমাবস্যা তিথির মাহেন্দ্রক্ষণে আমার নিকট উপনীত হইয়া আমার জলাঞ্জলি গ্রহণ করুন। বাবা, তুমি আমার থেকে এই তিল ও গঙ্গা জল নিয়ে তৃপ্ত হও। মা, তুমিও আমার হাতের এই তিল ও জল নিয়ে তৃপ্তি পাও। হে পিতামহ, আমার প্রদত্ত এই সতিলোদক গ্রহণ করিয়া আপনি তৃপ্ত হউন...পিতামহী আপনি আমার প্রদত্ত এই সতিলোদক গ্রহণ করিয়া তৃপ্ত হউন...’।

পূর্বপ্রজন্মের সকলেই আজ গতায়ু, তাঁরা আজ প্রেতযোনিলোকে বিরাজমান। যাঁদের দেবযোনিলোকে বাস তাঁরা দেবতা – অমর, তাঁদের প্রতি যেভাবে অঞ্জলি প্রদানের বিধি সেই বিধিতে এই অঞ্জলি প্রদান বিধেয় নয়। কাজেই মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে বুড়ো আঙুল ও তর্জনীর ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে দিতে হবে জল – গঙ্গা বা কোন পবিত্র নদীর বুকে অথবা ঘরের তাম্রকুন্ডে। 

বাবা যখন আমাদের পূর্বপুরুষদের এক এক জনের নাম উচ্চারণ করে এই অঞ্জলি অর্পণ করতেন, ছোটবেলায় মনে হত, আমার দাদুরা ঠাকুমারা এসে কেউ কেউ বসেছেন, কেউ বা দাঁড়িয়ে আছে্‌ন - আমার আশে পাশে, পিছনে। আমার কল্পনায় সেই অশরীরী উপস্থিতি কেমন যেন ভয়মিশ্রিত এক বিস্ময় সৃষ্টি করত মনে। পিছনে কারা যেন অস্ফুট কথা বলত – বাবার বিশুদ্ধ উচ্চারণের মন্ত্রের আড়ালে থেকে যেত সেই মৃদু কোলাহল। মাঝে মাঝে খুব প্রাচীন এক বৃদ্ধ কণ্ঠ ধমক দিয়ে উঠতেন শুনতে পেতাম – ‘মূঢ়ের দল প্রগলভতা পরিত্যাগ করিয়া, অঞ্জলিগ্রহণ করতঃ স্ব স্ব স্থানে প্রত্যাবর্তন করো। বিস্মৃত হইও না যে তোমরা মৃত। হে আমার প্রেতপুত্রগণ, আমাদের শ্রীমান পান্নাকুমার বালকমাত্র, তোমাদিগের এই উচ্ছ্বসিত আচরণে সে ভীত হইতে পারে...তাহা নিশ্চিতভাবেই আমাদিগের কাহারও অভিপ্রেত নহে...’।

এই কণ্ঠটি যে আমাদের গোত্রপিতা বৎস ঋষির সে বিষয়ে আমি যেন নিশ্চিত ছিলাম। কোলাহল স্তব্ধ হয়ে আসত। কিন্তু অনেক অনেক স্নেহ ও আশীর্বাদ মাখা নয়নের দৃষ্টি যেন নিঃশব্দে স্পর্শ করত আমার শরীর। আমি জানি সেই দৃষ্টি আমার অতিবৃদ্ধ পিতামহ ও মাতামহীদের।

কিছুটা বড় হয়ে - পল্লবগ্রাহী কিছু লেখাপড়া ও শখের বিজ্ঞানচর্চার ফলে এই সব অঞ্জলি অর্পণ, তর্পণকে মনে হত হাস্যকর এক কুসংস্কার বিশেষ। আমাদের বাপ-ঠাকুদ্দাদের আর খেয়ে দেয়ে কাজ পড়ে নি যে আমাদের দেওয়া ওই দু পাঁচটা কালোতিল আর দু ফোঁটা দূষিত গঙ্গাজল পেয়ে তৃপ্ত হবেন! তাও আবার হয় নাকি!

আজ এই বয়সে পৌঁছে বুঝি, তাঁরা ওই সামান্য জলাঞ্জলিতে তৃপ্ত হলেন কিনা সেটা আদৌ বড় কথা নয়। বড় কথা হল, আমরা তাঁদের স্মরণ করে কৃতার্থ হলাম কিনা। এই বিশাল দেশের ব্যাপ্ত ইতিহাসের যাবতীয় উত্থান পতন - ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় এবং প্রাকৃতিক পালাবদলের নিরন্তর ঝড়ঝঞ্ঝা তাঁরা সামলেছেন। এক প্রদেশ থেকে ভিন্ন প্রদেশে বারবার স্থানান্তরিত হয়েও স্থির প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা দিয়ে তাঁরা নিজেদের মনন ও বিশ্বাস অটুট রেখেছেন। যুগোপযোগী অনিবার্য অভিযোজন মেনে নিয়েও সেই মনন ও বিশ্বাস সঞ্চারিত করতে পেরেছেন তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। বড় কথা হল, আমরা এই অপরিশোধ্য ঋণ সম্বন্ধে সম্যক অবহিত কিনা। 

হে আমার পিতৃ ও মাতৃকূলের প্রত্যক্ষ এবং বিস্মৃত পরোক্ষ পূর্বপুরুষগণ, আজ এই অমাবস্যা তিথির পিতৃপক্ষের ও মাতৃপক্ষের পুণ্যসন্ধিক্ষণে আমার কৃতজ্ঞচিত্তের সতিল-গঙ্গোদক অঞ্জলি গ্রহণ করুন। আমার এই প্রজন্মের বিনম্র ও বিনীত স্মরণে আপনারা তৃপ্ত হোন এই চিন্তায় যে, আমরা আপনাদের ঋণ ভুলিনিআপনারা আশীর্বাদ করুন এই কৃতজ্ঞতাবোধ যেন সঞ্চারিত করতে পারি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মসমূহে। অদূর ভবিষ্যতে যখন আমিও আপনাদের সঙ্গে একাসনে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করব এই অনুষ্ঠান, তখন আমিও যেন সম্যক তৃপ্ত হতে পারি আমার পরবর্তী প্রজন্মের আচরণে - তাদের নিবেদিত সতিলোদক অঞ্জলিতে।

--00--


রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

নীড় ছোট ক্ষতি নেই...

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

 বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 





[এর আগের পর্ব পড়তে হলে পাশের সূত্রে যান ""জীবন -যাত্রা" ]


নীড় ছোট ক্ষতি নেই...

বেশ কদিন ধরেই আর মন বসছিল না। মামাতো দাদাদের, বন্নিদিদিদের স্কুল খুলে গেছে অনেকদিন। সবাই যে যার মতো লেখাপড়ায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। শুধু আমরা দু’ভাইয়ের কোন কাজ নেই। আমি সঙ্গে করে যে বই নিয়ে গিয়েছিলাম, সন্ধ্যেবেলা সবার সঙ্গে সে বই খুলে বসি ঠিকই কিন্তু পড়া হয়ে ওঠে না। সবই পুরোনো পড়া - মোটেই ভাল লাগে না পড়তে। মাকেও দেখতাম মাঝে মাঝেই বিষণ্ণ মুখে দোতলার বারান্দায় কাপড় শুকোতে দিতে গিয়ে বা বিকেলে শুকনো কাপড় তুলে নেওয়ার সময় অনেকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকতেন বাইরের গাছপালা বাঁশবনের দিকে। আমাদের তিনজনের মনেই মন খারাপ বাসা বাঁধতে লাগল ধীরে ধীরে।  

বারবার মনে পড়তে লাগল আমাদের কলকাতার সেই ছোট্ট বাসা। বাবা একলা সেখানে রয়েছেন। রাতে নিজেই রান্না করে খেয়ে নেন, দুপুরের খাওয়া অফিসে। বাবার এই অনিয়মিত খাওয়া দাওয়া আর বাড়তি পরিশ্রমের জন্যে মা খুব চিন্তিত ছিলেন। দিদিমার সঙ্গে মাকে এ নিয়ে কথা বলতে শুনেছি অনেকবার। মায়ের আরো চিন্তা ছিল আমাদের নিয়ে - লেখাপড়াহীন, বাঁধনহারা এই দীর্ঘ অবসর আমাদের কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যে নিয়মে আর শৃঙ্খলায় মা আর বাবা আমাদের বড় করে তুলছিলেন – তাতে বেশ বড়সড় বিঘ্ন যে ঘটছে, তাতেও মা বিশেষ উদ্বিগ্ন ছিলেন।

স্বামী ও দুই পুত্র নিয়ে তাঁর নিজের সংসার, তার আকার, পরিধি ও আয়োজন যত ছোটই হোক না কেন, সে সংসারের একক দায়িত্বে মা অভ্যস্তঅভাব-অভি্যোগ, ব্যস্ততা-দুশ্চিন্তা, ব্যাধি-আরোগ্য, সুখ-দুঃখের জটিল মিশ্রণে জারিত ভীষণ মায়াময় সেই সংসার - তাঁর নিজের হাতে গড়ে তোলা, নিজের হাতে লালিতকলকাতার সেই আপন নীড়ে ফিরে যেতে তিনি ভীষণভাবেই ব্যাকুল হয়ে উঠছিলেন দিন দিন। পিত্রালয়ের সাবলীল, শান্ত এবং সর্বদা স্নেহময় পরিবেশে মা, দাদা ও ভগিনীদের সঙ্গেও তিনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারছিলেন না। রাজ্য যতো ছোটই হোক না কেন, সে রাজ্যের স্বাধীন রাজ্ঞী আমার মা। কাজেই স্বরাজ্যে ফেরার জন্য তিনি উতলা হয়ে উঠছিলেন দিন কে দিন।

সেই সময়েই উপলব্ধি করেছিলাম, সুদীর্ঘ কর্মব্যস্ততা যদিচ সহ্য করা যায় – কিন্তু অলস ও সুখী দীর্ঘ অবসর একেবারেই অসহ্য। আমরাও অধীর হয়ে উঠছিলাম কলকাতায় ফেরার জন্যে  

ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি বাবার একখানি পোস্টকার্ড এল-

“শ্রীচরণকমলেষু বড়দা,

পত্রারম্ভে মাতাঠাকুরাণী, আপনি ও বউঠাকুরাণী আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম লইবেন। আশা করি মঙ্গলময়ের কৃপায় আপনারা সকলে সর্বাঙ্গীন কুশলে আছেন। আপাততঃ কলিকাতা অনেকটাই শান্ত ও স্থিত হইয়াছে। অদ্য সংবাদপত্রে দেখিলাম, আগামী সপ্তাহের প্রথমদিন হইতে শ্রীমান হীরকের কলেজ ও শ্রীমান পান্নার স্কুল খুলিবার সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি হইয়াছে। কাজেকাজেই, আমি মনস্থ করিয়াছি যে, আগামী শনিবার রাত্রে পঁহুছিয়া, রবিবারদিন বৈকালের ট্রেনে সকলকে সঙ্গে লইয়া কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিব। এই কয়মাসে উহাদের পড়াশুনার যে কি পরিমাণ ক্ষতি হইল তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। এই ক্ষতি স্বীকার করিয়া লওয়া ছাড়া অন্য গত্যন্তর নাই, কারণ আমরা কেহই দেশ ও কালের ঊর্ধ্বে নহি। যাহা হউক, ছোটদের সকলকে আমার স্নেহাশীর্বাদ দিবেন। মাতাঠাকুরাণীকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম দিবেন। আপনি ও বউঠাকুরাণী আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম লইবেন। আপনাদের সকলের আন্তরিক কুশল ও মঙ্গলকামনা করতঃ ইতি

প্রণতঃ

নারায়ণ”

এই চিঠি পেয়ে আমরা তিনজনেই হাঁফ ছাড়লাম। আজ বেষ্পতিবার, তার মানে কাল বাদে পরশুদিন বাবা আসছেন আমাদের নিয়ে যেতে। আবার আমরা ফিরে যাবো আমাদের অভ্যস্ত বহুচেনা – ছকবাঁধা কর্মব্যস্ত জীবনযাত্রায়। পুলকে আমার উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু মানুষের কি অদ্ভূত মন, আদৌ আনন্দিত হতে পারলাম না। উল্টে ভীষণ মন খারাপ হতে লাগল এই গ্রাম, এই মামাবাড়ি, এতো লাগামছাড়া আনন্দ ফেলে চলে যেতে হবে কলকাতায়। মাঝে আর মাত্র দুটি দিন!

বাঁশঝাড়ের রহস্য, ঝোপঝাড়, গাছপালা। মাঠ, ঘাট, ক্ষেত, প্রান্তর। শিবতলা, পুকুরপাড়। গোয়ালবাড়ি, খামারবাড়ি, খিড়কি দোরের ডোবা। ঘুঘু ডাকা সকাল ও নির্জন দুপুর। বিকেলে বাঁশবাগানের মাথায় সাদা সাদা ফুলের মতো উড়ে এসে বসা বকের ঝাঁক। গৌরী গাই আর তার সুন্দর ঘন কালো আঁখির বাছুরটি। খুব সকালে কানুমামার মন ভালো করে দেওয়া উদাত্ত কণ্ঠের গান –

‘শ্যামা কখনো পুরুষ, কখনো প্রকৃতি

কখনো শূণ্যাকার

মায়ের সে ভাব ভাবিয়ে, কমলাকান্ত

সহজে পাগল হল, রে

শ্যামা মা কি আমার কালো, রে

কালো রূপে দিগম্বরী

হৃদিপদ্ম করে আলো, রে...’

এত আলো, এত অন্ধকার - সব রইবে ঠিকঠাক। শুধু আমিই আর থাকবো না। কদিনের জন্যে এসেছিলাম বহিরাগত অতিথির মতো। এখন বিদায় আসন্ন। আমার জীবনযাত্রার সঙ্গে এই জীবনযাপনের বিস্তর ফারাক। আমাকে অনেক বড়ো হতে হবে। অনেক বড়ো। আর তার জন্যে আমাকে ছেড়ে থাকতে হবে এই সব আপাততুচ্ছ কিন্তু সনাতন এক জীবনধারা।

শনিবার লাস্ট বাসে বাবা এলেন তখন প্রায় রাত সাড়ে নটা। আমরা সবাই বাসস্ট্যান্ডে গিয়েছিলাম বাবাকে আনতে। মামাতো বড়োদাদার হাতে পাঁচসেলের টর্চ, আমার হাতে হ্যারিকেন। এক হাতে চামড়ার ফোলিও ব্যাগ, অন্য হাতে আমার হাত ধরে বাবা হাঁটছিলেনসেদিন আবছা কুয়াশামাখা সেই রাত্তিরে, পথে বড়ো বড়ো ছায়া ফেলে আমরা হেঁটে আসছিলাম, পিছনে ছিল একফালি ম্লান চাঁদ।

 

 

 

ঘরে ফিরে চলো...

 যারে কও চালভাজা, তারেই কয় মুড়ি। কিন্তু আমাদের রাঢ়বঙ্গে চালভাজার সঙ্গে মুড়ির বিস্তর ফারাক । মুড়ি হয় সাদা – হলুদে মাখা চাল ভেজে বানানো হয় বলে চালভাজা হয় হলুদ তাছাড়াও চালভাজার সঙ্গে মেশানো থাকে ভাজা ছোলা আর মটর। ভাজা কুমড়োর বীজ। দু-একটা গোলমরিচের গোটা দানা। কিন্তু এ সবের চেয়েও যেটা সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং সেটা হল কুসুমবীজ ভাজা। এ জিনিষটা কিসের বীজ জানা নেইএর কোন স্বাদ নেই – কিন্তু দাঁতে চাপলেই সুন্দর গন্ধ। বছর কয়েক আগে বহু অনুসন্ধানের পর লেক মার্কেটের একটিমাত্র দোকানে কুসুমবীজ মিলেছিল। 

দোকানের মালিক অত্যন্ত শ্লাঘার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘অনেক মার্কেট ঘুরেছেন নিশ্চয়ই? আজকাল এসব জিনিষের কদর কেউ জানেই না – একমাত্র আমার এখানেই এসব পাবেন। তা, আপনার বাড়ি কোথায়’?

উত্তরে আমার কলকাতার পাড়ার নাম বলাতে মুচকি হেসে তিনি বলেছিলেন, ‘সে বাড়ি নয়, সে বাড়ি নয়। অরিজিনাল দেশ...’ 

‘বর্ধমান’

‘হ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁ, তাই বলুন’।

 এহেন চালভাজা ভরা টিন। বিশ কিলোর টিন ভরা কাঠের ঘানিতে পেষা খাঁটি সরষের তেল। তেলের মধ্যে নিমজ্জমান কাঁচা আম আর কাঁচা লঙ্কা জারানো আম-তেল – মুড়ি দিয়ে মেখে খাবার জন্যে। এক নাগরি নলেন গুড়। খেজুড় গুড়ের পাটালি। প্রচুর চিনির ও গুড়ের নারকেল নাড়ু। ঢেঁকিতে ছাঁটা নতুন ধানের চাল – কিলো পাঁচেক। অন্যরকম এক বড় বোতলে তখন হরলিক্স পাওয়া যেত – সেই খালি বোতলে ঘি। এতসবের পরেও দিদিমা ভীষণ ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন – ছটা নারকেল, কিলো দশেক আলু, দুটো লাউ, মিটার তিনেক থোড়, দুখানা পাকাকলার মোচা ইত্যাদি বাবা নেন নি বলে। সবশেষে বড়মামা নিজে হাতে যখন বাবার হাতে তুলে দিলেন শালপাতায় ঢাকা এক বিশাল মাটির মালসা – আতঙ্কিত বাবা বড়োমামাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বড়দা, আপনিও ’?

‘এ কিচছু না, কিচছু না – এটা পান্নার জন্যে – দানাদার, ও খুব ভালোবাসে খেতে – তাইসুতলিতে বাঁধা আছে – তোমাকে বইতেও হবে না – হাতে ঝুলিয়ে নিলেই হবে’

 

সুদীর্ঘ শোকাবহ বিদায়পর্বের পর মা আর আমি এই সাজানো মুদির দোকান নিয়ে গরুর গাড়িতে এসেছিলাম বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। মা সারাটা রাস্তা চোখের জল মুচছিলেন, আমিও এক-আধবার। চোখ মোছার চেয়েও আমি বেশী ব্যস্ত ছিলাম মাথায় হাত বোলাতে। এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় সাসপেনসনহীন গরুর গাড়ির ঝাঁকুনিতে সেদিন আমার মাথায় প্রচুর আলু তৈরি হয়ে উঠেছিল। বাসস্ট্যান্ডে আরেকবার সংক্ষিপ্ত বিদায় ও প্রণাম পর্বের পর বাসে উঠে পড়লাম – বাস যখন ছেড়ে দিল - অনুভব করলাম তীব্র বিদায় ব্যথা। বাসের জানালা দিয়ে যতক্ষণ দৃষ্টি যায় তাকিয়ে ছিলাম ফেলে আসা বাসস্ট্যান্ডের দিকে – আর দুগাল বেয়ে নেমে আসছিল অশ্রুধারা – নিঃশব্দ কান্নার সে ছিল একান্ত অনুভূতি।

 এতসব লটবহর নিয়ে মেমারি থেকে হাওড়াগামী ট্রেনে উঠে পড়া গেল বেশ কসরত করে – অন্য সহযাত্রীদের সহায়তায়। সিটও পাওয়া গেল চেপেচুপে একসঙ্গেই। স্টেসানে স্টেসানে স্বল্প বিরাম দিয়ে – ট্রেন দৌড়ে চলেছে কলকাতার দিকে। তিন-চারটে স্টেশানের পর, মা বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্কুল কবে থেকে খুলছে ওদের’?            

-‘কালকেই তো স্কুল চালু হয়ে যাবে। কালকে কি যেতে পারবে? না হয় একদিন...’।

-‘কেন, যেতে পারবে না কেন? এতদিন পর স্কুল খুলছে তারপরে আবার কামাই? একদম নয় কালকেই স্কুলে যাবে’

-‘তোমাদের বলা হয়নি, পান্নার ক্লাস সিক্স হয়ে গেছে’

-‘সে আবার কি? অ্যানুয়াল হবে না? পরীক্ষা ছাড়াই প্রমোশন হয়ে গেল’? মা অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন বাবাকে। বাবা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন – পরীক্ষা ছাড়াই।

‘বাঃ, তাহলে? আর তো মর্নিং সেকসনও নয়, সাড়ে দশটায় ডাল-ভাত খেয়ে বেরিয়ে যাবে। তুমি কামাইয়ের কথা ভাবছিলে কেন’?

‘আমার অফিস - হীরকেরও কলেজ। তুমি কি কালকেই পারবে পান্নাকে নিয়ে স্কুলে দিয়ে আসতে? সেই জন্যেই বলছিলাম – কালকের দিনটা একটু গুছিয়ে নিয়ে – পরশু থেকে ...’

‘কেউ যাবে না সঙ্গে। একা একা যাবে কাল থেকে। কিচ্ছু হবে না। ঘুনু কতো বড়ো হয়ে গেছে, তুমি জান’? বলে মা আমার দিকে তাকালেন ‘কিরে পারবি না’?  খুব গম্ভীরভাবে আমি বললাম – ‘না পারার কি আছে?’ 

বাবা আমার উত্তর শুনে বললেন, ‘ভেরি গুড। তাহলে তো ব্যাপার মিটেই গেল। কাল থেকেই স্কুল শুরু। কাল বোধ হয় এমনিতেও ক্লাস পুরো হবে না। বুক লিস্ট, রুটিন আর ইনট্রোডাকশন দিয়েই হয়তো ছেড়ে দেবে-’একটু থেমে বাবা আবার বললেন – ‘তোমার ঘুনুর কিন্তু ভালই হলো, জানো। পরীক্ষা-টরীক্ষার ঝামেলা যত না থাকে খুব মজা। ফাঁকি দিয়ে কোন এক ফাঁকে প্রমোশন পেয়ে গেলেই হল – কি রে, তাই না?’ 

বাবার কথাটা আমার পছন্দ হল না – কারণ অপ্রিয় সত্যি কথা কবে আর কারই বা পছন্দ হয়? তাই আমি গম্ভীর মুখ করে চুপ করে রইলাম। মা কিন্তু প্রতিবাদ করে উঠলেন, ‘কেন, তুমি এমন কথা বলছ? কত ছেলের তো শুনি পরীক্ষার আগে নাকি জ্বর চলে আসে আতঙ্কেঘুনু তো এরকম করেনি কোনদিন – আর সব্বাই কি পরীক্ষায় ফার্স্ট আসবে নাকি – আমার ঘুনু দেখে নিও অন্যরকম ফার্স্ট হবে...’। 

বাবা হেসে বললেন, ‘হলেই ভাল...আমিও তো তাই চাই’।

সত্যি বলতে বাবার চিঠি পাওয়ার পর থেকে মাঝে মাঝেই আমার মনে একটা ভয় জেগে উঠছিল। এমনিতেই আমার বিস্মরণ শক্তি ছিল ঈর্ষণীয়, সকালের পড়া পাঠ সন্ধ্যাবেলায় মনে হত জীবনে প্রথম শুনলাম। কাজেই প্রায় তিনমাসের ওপর লেখাপড়ার সঙ্গে যোগরহিত আমার মগজ, অধীত সকলবর্ণকে বেশ বিবর্ণ করতে পেরেছিল। এ-বি-সি বা অ-আ-ক-খদেরকে দীর্ঘ প্রবাসী বন্ধুর মতো মনে হত – চেনা চেনা লাগছে কিন্তু নামটা যেন – “পেটে আসছে, কিন্তু মুখে আসছে না”।

কাজেই পরীক্ষা হ’লে আমি যে ল্যাজে গোবরে হতাম সে বিষয়ে মায়ের চেয়ে বাবা আমাকে ঠিকঠাক বুঝেছিলেন। তবুও বাবার ওই কথা আর হাসিটা আমার ভালো লাগেনি সেদিন। কিন্তু মায়ের কথায় আমি কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম এবং সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম – কিছু একটা করতেই হবে, যাতে সক্কলে চমকে উঠবে, বলবে – “এই আমাদের, সেই পান্না”? আর তৃপ্তির হাসিমাখা মুখে মা বলবেন, “আমি তো বলেই ছিলাম, আমার ঘুনু...”অনেকটা রবিঠাকুরের “বীরপুরুষ”-এর ধাঁচে – কিন্তু ওরকম বীরত্ব-টিরত্ব আমার কম্মো নয় – অন্য কিছু।

সেই অন্য কিছুটা আজও আবিষ্কার করা হয়ে উঠল না - যার জন্যে মা হয়তো সত্যিই গর্ব করতে পারতেন।


...চলবে...


মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

জীবন - যাত্রা

 

[এর আগের পর্ব পড়তে পারবেন এই সূত্রে - "লোকশিল্পীর বিলুপ্তি"]


গ্রামের বড়োরা মিলে দুটো যাত্রা করবেন এইবার মকর সংক্রান্তির দিন আর তার পরের দিন। আমাদের মামাবাড়ি ছাড়িয়ে গ্রামের আরো ভিতরে চৌধুরি পাড়া যাবার পথেই শিবমন্দির পড়ে। তার সামনে সিমেন্টের বাঁধানো চাতাল, টিনের চাল দিয়ে ঢাকা। তার ঠিক পাশেই ডালপালা ছড়ানো বিশাল এক ছাতার মতো প্রাচীন বকুলগাছ। ওই চাতালে যাত্রার আসর বসবে দুদিন। গাঁয়ের সবাই জায়গাটাকে শিবতলা বলে।

ওই শিবতলার মন্দিরে একটি শিবলিঙ্গ গৌরীপীঠে বিরাজিত। কুচকুচে কালো পাথরের সেই লিঙ্গ। এর আগে গরমের ছুটিতে এসে দেখেছি, শিকে থেকে ঝোলানো মাটির ফুটো কলসি থেকে সারাটা নির্জন দুপুর ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরে পড়ে শিবঠাকুরের মাথায়। গাঁয়ের মেয়ে-বউরা পুকুর থেকে স্নান সেরে ফেরার পথে কাঁসার বা পিতলের ঘটিতে জল বয়ে আনেন । সেই জল শিবঠাকুরের মাথায় ঢেলে পুজো করেন। আর সকালের দিকে শিবতলায় এসে দাঁড়ালে পুষ্পবৃষ্টির মতো ঝরে পড়ত অজস্র বকুল ফুল – ছোট্ট ছোট্ট মাকড়সার মতো। হাতের অঞ্জলি ভরা বকুল ফুলের অপূর্ব ঘ্রাণে ভালো লাগায় আবিষ্ট হয়ে থাকত মন। 

অভিনয় দক্ষতার জন্যে আমার বড়োমামার গ্রামে খুব সুনাম ছিল গ্রামের যে কোন যাত্রায় তিনিই থাকতেন মুখ্য ভূমিকায়। এবারে ঠিক হয়েছে একটি পৌরাণিক পালা – ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আর একটি ঐতিহাসিক – ‘ধূলার স্বর্গ’। কদিন ধরেই দাদারা সন্ধ্যের পর রিহার্সাল দেখতে যাচ্ছে। আমিও যাবার জন্যে রোজই বায়না করতাম, কিন্তু মা আমাকে বড়োদের মধ্যে যাওয়ার অনুমতি দেননি। একদিন বড়োমামা রিহার্সালে যাবার সময় শুনে ফেললেন আমার বায়না আর মায়ের বকাবকি, বললেন-

-‘রিহার্সাল দেখতে যাবি তো, চ আমার সঙ্গে। এরজন্যে নাকে কাঁদছিস কেন’? মা বললেন-

-‘না, দাদা, ও গিয়ে তোমাদের অসুবিধে করবে, বিরক্ত করবে’। আমি বলে উঠলাম-

-‘মোটেও না, আমি কাউকে বিরক্ত করব না। একটা কথাও বলব না’। বড়োমামা মাকে বললেন

-‘কিচ্ছু অসুবিধে করবে না, চলুক আমার সঙ্গে, ও তো খুব ভালো ছেলে’। এরপর মা আর কিছু বলতে পারলেন না আর আমিও বড়োমামার হাত ধরে ভালো ছেলের মতো চললাম রিহার্সাল দেখতে।

হাজরাবাড়ির বিশাল হলঘরে রিহার্সালের আসর বসেছিলগোটা তিনেক হ্যারিকেনের আলোয় সে ঘরের অন্ধকারই যেন আরো প্রকট হচ্ছিল। যাত্রার রিহার্সাল যে এত বিরক্তিকর ব্যাপার কে জানত? একজন হ্যারিকেনের সামনে বসে বই থেকে ডায়লগ পড়ছিল - সে হচ্ছে প্রম্পটার আর যার যে পার্ট সে সেই ডায়লগটাই রিপিট করছিল নাটকীয় ভঙ্গীতে।

প্রম্পটার-‘বড়দা, এবার আপনার ডায়লগ -“পরাজয়?-(অট্টহাসি)– পরাজয় নাহি জানি কিরূপে বা হয়, বোমভার বরে আমি অজেয়, ত্রিভুবনময়”।

বড়োমামা-‘ওটা, বোমভা নয় রে, জিতেন, ব্রহ্মা। আরেকবার বল দেখি লাইনটা’।

প্রম্পটার-“পরাজয়?-(অট্টহাসি)– পরাজয় নাহি জানি কিরূপে বা হয়, বোমহার বরে আমি অজেয়, ত্রিভুবনময়”।

বড়োমামা-‘পরাআআজয়? হুহুহাহাহাহাহা – পরাআআজয় নাহি জানি কিরূঊঊপে বা হয়ব্রহ্মার বরে আমি অজেএএএয়, ত্রিভুবনমঅঅঅঅয়’।

জলদমামা-‘বিষ্ণু, ওইখানটা তোমার ঠিক জমল না, ওই যে - “ব্রহ্মার বরে”। ওই জায়গায়টায় তোমার গলাটা একটু নামাতে হবে। মানে একটু নম্র আর কি। যতোই হোক তুমি তো ব্রহ্মার ভক্ত আর তাঁর তপস্যা করেই না তোমার এই শক্তি ...বুয়েচ? বাকি সব জায়গায় তোমার ঔদ্ধত্যটা ঠিকঠাক এয়েচে...’ চৌধুরিবাড়ির জলদমামা এই যাত্রাদুটির ডিরেক্টর, বড়োমামার চেয়ে বয়সে ঢের বড়ো।    

মহিষাসুরের ভূমিকায় চাদর মুড়ি-ধুতি পড়া বড়োমামার এহেন অভিনয় চর্চাতে আমি মজা পাচ্ছিলাম না। ডোরাকাটা পাজামা আর চাদরমুড়ি ঝন্টুমামা এরপর মা দুর্গার ভূমিকায় ডায়লগ বলতে শুরু করল অদ্ভূত মেয়েলি কণ্ঠে আর ঢঙে - কি আশ্চর্য যে মনে হচ্ছিল তাকে!

ঝন্টুমামা -‘ওরে মুডহো মইশাসুর, আজি তোরে পাঠাইব শমন সদন...’

জলদমামা- ওটা মুডহো নয় রে, মূঢ় – মূঢ় – এইদ্যাখ জিভটা আলটাগরায় ঘষে বল –ঢ় -ঢ়আর মইশাসুর কিরে –মঅহিইইষাআআসুর – ঠিক মতো উচ্চারণ না হলে অভিনয় হয় রে, বাপ’?

জলদমামা পারফেকসনে বিশ্বাসী। কাজেই এরপর চলতেই লাগল ঝন্টুমামার জিভের আড় ভাঙানোর প্রচেষ্টাহতাশ হয়ে আমি হ্যারিকেনের আলোয় হলঘরের দেয়ালে নড়ে চড়ে বেড়ানো বিশাল বিশাল ছায়াগুলো দেখতে দেখতে একসময় ঘুমিয়েই পড়লাম।

ধান ভেঙে চাল করার হাস্কিং মেসিন তখন চালু হয়ে গেছে। কিন্তু সে মেসিন সেদ্ধ ধান থেকে সেদ্ধ চাল বের করার জন্যে। সেদ্ধ ধান বা চাল মানেই সেটা এঁটো – উচ্ছিষ্ট। কাজেই সে চালে কোন পুজো বা শুভ অনুষ্ঠান হবে না। পুজোপার্বণের জন্যে আতপ চাল বিধেয়। কাজেই কদিন ধরেই ঢেঁকিতে নতুন ধান কোটা চলছিল। নতুন চাল জলে ভিজিয়ে রেখে শিলে বাঁটা চলছিল। সেই বাঁটাচাল পরিষ্কার কাপড়ে বিছিয়ে রোদ্দুরে শুকিয়ে চালের গুঁড়ো হিসেবে যত্ন করে রেখে দেওয়া হচ্ছিল। গাছের থেকে গোটা ত্রিশেক নারকেল পেড়ে ছোবড়া ছাড়িয়ে, ভেঙে, নারকেল কুড়ুনি দিয়ে কুড়ে গুড় দিয়ে রান্না করে নারকেলের ছাঁই বানানো হয়ে গেল। সংক্রান্তিতে নতুন চালের গুঁড়ো দিয়ে বানানো হবে সরুচুকলি, পাটিসাপ্টা, সেদ্ধপিঠে, ভাজাপিঠে, ক্ষীরপুলি। পাটিসাপ্টা, সেদ্ধপিঠে আর ভাজাপিঠের মধ্যে পুর হিসেবে ঢুকে পড়বে নারকেলের ছাঁই। ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া, ভিজে চাল বাঁটা, নারকেল কোড়া - এসব কাজে ভামিমাসি, মোক্ষমাসিদের সাহায্য নেওয়া যায়, কিন্তু এরপরের এন্ড প্রোডাক্ট - পিঠেপুলি বানানোটা একান্তভাবেই বাড়ির মহিলাদের কাজ।

আজ পৌষমাসের সংক্রান্তি - মকর সংক্রান্তি আজই রাত্রে শিবতলায় প্রথম যাত্রা মঞ্চস্থ হবে – ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। একটু আগেই একবার ঘুরে এসেছি শিবতলা থেকে। ছ-ছটা হ্যাজাক জ্বলছে, মঞ্চের মাঝখানে মাথার ওপর ডেলাইট। গোটা শিবতলাটা ঝলমল করছে আলোয়। বকুল গাছের নীচে মঞ্চ সাজানো হয়েছে। দর্শকদের বসার জায়গা টিনের চাল দেওয়া চাতালে এবং মন্দিরের বারান্দায়। শতরঞ্চি বিছিয়ে জায়গা রিজার্ভ করা হয়ে গেছে। আমাদের জায়গা রিজার্ভ করে বসে আছে মামাবাড়ির রাখাল ভুবনমামা আর ভামিমাসি। আমরা রাতের খাওয়া সেরে এসে বসলে ওরা খেতে যাবে। খেয়ে এসে ওরাও বসবে একসঙ্গে।

রান্নাঘরেই একসারিতে সবার সঙ্গে বসে পাল্লা দিয়ে গরম গরম সরুচুকলি, পাটিসাপ্টা, ভাজাপিঠে পরম তৃপ্তির সঙ্গে খেতে খেতে আমাদের যখন হাঁসফাঁস দশা - রাত্রি সাড়ে নটা নাগাদ ঢং করে প্রথম ঘন্টা পড়ল শিবতলায়। আর শুরু হয়ে গেল কনসার্ট – বেহালা, ফ্লুট, হারমোনিয়ম আর তবলার সমবেত বাদ্যধ্বনি আমাদের খাওয়ার পরেই মা-মাসিমারাও বসে পড়লেন। দিদিমা আর মামীমা খাবেন সবার শেষে - ভুবনমামা আর ভামিমাসি এলে। মায়েদের খাওয়া হতে হতে দ্বিতীয় ঘন্টা পড়ল ঢং ঢং।

 আমরা যখন শিবতলায় পৌঁছলাম, শিবতলায় তখন চেঁচামেচি, হট্টগোল, হৈচৈ চলছে। উপস্থিত দর্শকরা নিজেদের মধ্যে নানান কথাবার্তা বলছে, বাচ্চাদের কান্নাকাটি, ছোটদের কলরবলর, তার পিছনে কনসার্টের বাজনা। স্বভাবশান্ত ভাবগম্ভীর শিবতলার চরিত্রই বদলে গেছে। মনে হচ্ছিল শিবঠাকুর বিরক্ত হয়ে মন্দিরের দরজা ঠেলে বেড়িয়ে আসবেন না তো! এইসময়েই তৃতীয় ঘন্টা পড়ল আর কনসার্টের বাজনা খুব দ্রুত লয়ে বেজে উঠে থেমে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই।

 মঞ্চের বাইরে থেকে উদাত্ত গলায় গান গাইতে গাইতে ঢুকল বিবেক। এ গান রিহার্সালেও শুনেছি, সুদীর্ঘ সেই গানে আমার কোন কৌতূহল ছিল না। কিন্তু গেরুয়া বসনে, আর গেরুয়া পাগড়িতে কানুমামাকে কি সুন্দর মানিয়েছে! কানুমামা ডাকপিওনের চাকরি করেন আর করেন শখের তন্ত্রচর্চা  গালভর্তি দাড়িগোঁফ, মাথায় ছোট্ট জটা। ধুতি আর খাঁকি জামা পড়ে চিঠি বিলি করেন দিনে দুবার – আর অন্য সময় রক্তাম্বর পরেনকতবার তাঁকে দেখেছি গান গাইতে গাইতে হেঁটে যেতে – ‘ঘরে ঘরে যাব, ভিক্ষা মেগে খাব/ মা বলে আর কোলে যাবো না/ মা মা বলে আর ডাকবো না...’পথে ঘাটে নিজের খেয়ালে গান গেয়ে বেড়ানো সহজিয়া কানুমামাকে সেদিন সেই মঞ্চে যেন বিরাজ করতে দেখেছিলাম। বড়ো হয়ে যখন ‘রক্তকরবী’ পড়লাম – নন্দিনীর বিশুভাইকে চিনে নিতে খুব অসুবিধে হয়নি, বাল্যকালে কানুমামাকে দেখেছিলাম বলে।

 

ঝকমকে জোব্বা, মাথায় বাহারি উষ্ণীষ, পায়ে সুন্দর নকশা করা জুতো আর কোমরে বাঁধা খাপে ঢাকা তলোয়ার। রিহার্সালে দেখা আমার চেনাজানা সাধারণ মানুষগুলো আমূল বদলে গেছে। পোষাক-পরিচ্ছদ যে একটা মানুষের ব্যক্তিত্বকে এবং শরীরী ভাষাকে কতখানি বদলে দিতে পারে – প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম সেদিন। মহিষাসুরকে আমার বড়োমামা বলে একবারও মনে হল না –  এমনকি প্রহরণ আঁকা আটটা কাঠের হাত পিঠে বেঁধে ঝন্টুমামা যখন বড়মামার বুকে ত্রিশূল ঠেকিয়ে, পা তুলে দিল বড়োমামার গায়ে – একটুও রাগ হয় নি ঝন্টুমামার ওপর। উপস্থিত মহিলাদর্শকরা সমস্বরে উলুধবনি দিতে লাগলেন, বেশ কয়েকটা শাঁখও বেজে উঠল, শেষবারের মতো বিবেক প্রবেশ করল শ্রীশ্রী চন্ডীর শ্লোক আবৃত্তি করতে করতেমহিলারা উপুড় হয়ে প্রণাম করতে লাগলেন – মা দুগ্‌গা কর্তৃক মহিষাসুর নিধনের freezed  দৃশ্যে

 মঞ্চে সব কুশীলব যখন বিদায়ী নমস্কার করতে দাঁড়াল তখন ভোর হয় হয়। দর্শকরা উচ্ছ্বসিত প্রশংসায়। তার মধ্যেও ঝন্টুমামা বড়োমামার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যাচ্ছিল, ‘বড়দা, একে তুমি বয়সে গুরুজন, তাতে আবার বামুন -’।

বড়ো মামা তার হাত ধরে আটকে দিলেন বললেন, ‘ছি ছি ছি, ঝন্টু, কী করছিস কি তুই? এখন তুই ঝন্টু নাকি? তুই এখন মা দুগগা’

‘শিখে নে ঝন্টু, বিষ্ণুর থেকে শিখে নে। এমন ভাবনা না থাকলে অভিনয় হয় না রে...’বললেন জলদমামা।

 

রাজনীতি ছিল, দলাদলি ছিল, ছিল ঈর্ষার রেষারেষি। ভীষণ স্পষ্টভাবে ছিল ধনী-দরিদ্র, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ, হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ও ছোঁয়াছুঁয়ির বাছবিচার। কিন্তু এসব সত্ত্বেও একটা শান্ত পারম্পরিক এবং পরিপূরক সম্পর্কবোধ সাধারণ মানুষের অন্তরে প্রবহমাণ ছিল। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল সামাজিক মূল্যবোধ ও নির্দিষ্ট মাত্রাবোধসম্পন্ন মানসিকতা, যা উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত - এক সনাতন সভ্যতার উত্তরণের ধারাবাহিক ইতিহাস থেকে

আজও ভেদাভেদ রয়ে গেছে অন্য নামে অন্য রূপে - সুভদ্র মুখোশের আড়ালে, কিন্তু উপড়ে গেছে সব সম্পর্কের শিকড় এবং যাবতীয় মূল্যবোধ এসে ঠেকেছে তলানিতে। সর্বহারাদের স্বার্থে যাঁরা বিদেশী আদর্শকে অনুকরণ করছিলেন তাঁরা সব হারিয়ে ফেলে এখন দিশাহারা – উপহার দিয়েছেন একটি হযবরল সমাজ, যেখানে হাতের পেন্সিলটুকুও হারিয়ে গেছে বিপ্লবের দমবন্ধ করা ধোঁয়ায় আর তোলাবাজদের পৈশাচিক হুমকিতে।  

ভাঙনটা শুরু হয়েছিল শহরে এবং ছড়িয়ে পড়ল দেশময় সর্বত্র - টের পাচ্ছিলাম পরবর্তী কয়েক বছরে। যে অরূপরতনের সন্ধান পেয়েছিলাম ওই ক’মাসে, সে সব হারিয়ে গেল বিলুপ্ত প্রজাতির মতো। সেসব অন্য কথা – সে অন্য প্রসঙ্গ।

...০০...

...চলবে...


রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

লোকশিল্পীর বিলুপ্তি

 

                     [এর আগের পর্ব এই সূত্রে পড়া যাবে - চুরি বিদ্যে মহাবিদ্যে... ]



     “হাঁদির মা চাঁদি খেয়ে নাদি নাদি হাগে।

আর  হাঁদি আহা নিশিভোর বাসরঘরে জাগে”।।

লোকটা উঠোনে বসে গলার শির ফুলিয়ে গান গাইছিল। গানের অন্তরায় ঠোঁটের উপর হাত চেপে অদ্ভূত আওয়াজ তুলছিল মিউজিক হিসেবে। আর নিজেরই পিঠে একটা চেরা কঞ্চি পেটাচ্ছিল সঙ্গৎ হিসেবে - তাল উঠছিল চট চটাস - চট চটাস শব্দে। অদ্ভূত এক ছন্দে একটানা দীর্ঘগানটি সে পরিবেশন করেছিল, যার সবটা তখন বুঝিনি, মনেও নেই। মনে রয়ে গেছে শুধু ঐ দুটি মাত্র লাইন – কারণ গানের ধুয়ো ধরে ওই লাইনদুটিতে সে ফিরে আসছিল বারবার। এ ধরনের গানের নাম নাকি ‘হাপু’।

পরনে ধূসর হয়ে যাওয়া ছাপা লুঙ্গি। পোষের কনকনে শীতেও তার খালি গাপিঠের যেখানে কঞ্চির চোট পড়ছিল, সে জায়গায় লম্বা কালশিটের স্থায়ি দাগ। রুক্ষ খড়ি ওঠা তেলহীন হাড় জিরজিরে শরীর। ঠোঁটের দুকোণায় সাদা ফেকো, চোখের কোণায় পিচুটি। তার সারা শরীরে অপুষ্টি আর নিদারুণ খিদের ছাপ।

 পাড়ার বেশ কিছু ছেলেপুলে আর আমরা তাকে গোল হয়ে ঘিরে দেখছিলাম তার রকম সকম আর শুনছিলাম তার গান গাইবার কেরামতিনাম তার এনামুল, পাড়ার ছেলেপুলেরা মাঝে মাঝে তাকে দেখতে অভ্যস্ত ও তাকে চেনে। তারা এনামুলকে ঘিরে - গান শোনার চেয়েও - বিরক্ত আর বিদ্রূপ করছিল বারবার। অসহায় এনামুল আমার অচেনা মুখের দিকে চাইছিল বারবার। কি চাইছিল সে আমার থেকে - কোন সাহায্য, নাকি আমার মতো অচেনা ছেলের সামনেও অপদস্থ হতে থাকার জন্যে বাড়তি লজ্জা?

 এমত সময়ে পুকুর থেকে স্নান সেরে আমার দিদিমা এসে উপস্থিত হলেন। বাড়িতে একদল ছেলেছোকরাদের চ্যাংড়ামি আর হট্টগোলে বিরক্ত দিদিমা, থমকে দাঁড়ালেন – বললেন, ‘এটা কি মেছো হাট নাকি রে, হ্যা হ্যা করছিস সব উঠোনে দাঁড়িয়ে? বের হ’ সব বাড়ি থেকে...’। যারা এতক্ষণ এনামুলের পিছনে লাগছিল তারা দুদ্দাড় করে পালিয়ে গেল। দিদিমা উঠোনে বসা এনামুলকে এবার দেখতে পেলেন, বললেন, ‘অ, এনা, কতবার বারণ করেছি, ছোঁড়াদের সামনে তোর ওই হাবিজাবি গান গাসনি...ও সব গান আজকাল কেউ শোনে? নাহক তোর পেছনে লাগে। তার চেয়ে কাজ কম্ম দ্যাখ – পেট ভরবে বাছা...’। 

দূর থেকেই এনামুল মাটিতে উবু হয়ে বসে দিদিমাকে প্রণাম করল। উঠোনের থেকে সামান্য একটু মাটি আঙুলে নিয়ে জিভে ঠেকাল, তারপর একগাল হেসে বলল, ‘পেনাম, মা ঠাকরেন। কতাটা কয়েচেন এক্কেরে নিজ্জলা সত্তি। তবে কি জানেন, বাপ- পিতেমোর থেকে হাপুগানই শিকেচি – আর তো কিচু জানা নেই কাজকাম। লোকে আর এর কদর করে না, কোতাও দুটো পয়সা হয় - কোতাও হয় না, উল্টে মস্করা করে এ গান লিয়ে, আমাকে লিয়ে...’। 

বলতে বলতে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে যেন। দিদিমা ভিতর বাড়িতে যেতে যেতে বললেন, ‘বোস বাছা, বোস। না খেয়ে যাবি না কিন্তু -’।

 খাবার কথাতেই হোক অথবা দিদিমার সহৃদয় ব্যবহারেই হোক, এনামুলকে অনেক নিশ্চিন্ত এবং সপ্রতিভ দেখাচ্ছিল এখন। তার সামনে একলা আমিই দাঁড়িয়েছিলাম, আমাকে সে তাই জিগ্যেস করল, ‘তোমারে তো চিনলাম না, খোকাবাবু, মা ঠাকরেন তোমার কে বটেন’?

‘দিদিমা’।

‘অ। মামাবাড়ি এয়েচো, তা কোথায় থাকা হয় বা’ঠাকুর’?

‘কলকাতায়’।

‘অ। কলকেতায় – তার মানে তো তুমি আমাদের নদি’ঠাকরেনের ছেলে, বা, বা, বা.... তা তুমি ছোটটি না বড়টি’?

‘ছোট’।

‘বেশ, বেশ খুব ভাল।’ এই বলেই সে আবার উবু হয়ে বসে, দিদিমাকে যেভাবে প্রণাম করেছিল, ঠিক সেইভাবেই আমাকে নমস্কার করে বসল। অস্বস্তিতে আমি ঠিকরে পিছনে সরে এলাম অনেকটা। 

আমাকে অমন চমকে উঠতে দেখে এনামুল বলল, ‘আহা, হা, হা, ভয় পাও কেন? তুমি মা ঠাকরেনের লাতি, আমরা ওঁনারে অন্নপুন্না মানি, সাক্ষাৎ দেবতা গো, দেবতা। তোমাদের পুরাণের সেই গপ্পোটা জানোতো, শিব ঠাকুর যে শিব ঠাকুর - তিনিও অন্ন ভিক্ষে করেছিলেন একবার অন্নপুন্নার কাচে। বুজেচ বা’ঠাকুর যেমন তেমন দেবতা নয় -’। তার কথার মধ্যেই বন্নিদিদি একটা ছোট ধামায় করে মুড়ি এনে ফেলল অনেকটা, সঙ্গে গুড়ের বাটিবন্নিদিদিকে দেখেই এনামুলের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। 

বন্নিদিদি বলল, ‘চাচা, তোমার লেকচার থামিয়ে, যাও একখান কলাপাতা কেটে আনো’। এনামুলচাচা দৌড়ে চলে গেল আমাদেরই বাড়ির খিড়কি দোরের বাইরের কলাগাছ থেকে পাতা আনতে।

বন্নিদিদিকে চেয়ে দুবারে প্রচুর মুড়ি ও গুড়, জল দিয়ে ভিজিয়ে এনামুলচাচা অদ্ভূত তৃপ্তি করে খেল। এত আনন্দ ও যত্ন করে খেতে এর আগে আর কাউকে দেখিনি। একটিও মুড়ি ফেলা গেল না। কলাপাতায় একটুও কিচ্ছু লেগে থাকল না। সেদিন টের পেয়েছিলাম প্রকৃত খিদে কাকে বলে আর সেই খিদে কি, উপলব্ধি না করলে, খাদ্যের প্রতি এমন সমীহ ও সম্মান শেখা যায় না। আমরা সময়মতো অথবা খিদে পাওয়ার আগেই খাবার পেয়ে যাই বলেই খাবারের অপচয় বা অবহেলা করতে দ্বিধা করিনা।

 ঝরঝরে পরিষ্কার এঁটো কলাপাতাটা এনামুলচাচা যখন উঠোন থেকে তুলে নিচ্ছিল বন্নিদিদি তাকে বলল, ‘চাচা, এখন ঘুরে এসো। দুপুরে ঠাম্মা কিন্তু আবার তোমায় আসতে বলেছে’। 

বিশাল ঘাড় নেড়ে এনামুল চাচা বলল, ‘আসব মা, আসব। মাঠাকরেণ ডেকেচেন – না এসে পারি’?

এনামুল চাচা কলাপাতাটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে গেল, আমি বন্নিদিদিকে জিগ্যেস করলাম, ‘দিদিমা আবার কেন ডাকলো ওকে? গান শুনবে বলে?’

‘ধুর বোকা, দুপুরে ও ভাত খাবে না? আমাদের বাড়িতেই খাবে তো...আর গান? গান না ছাই। ওই গান আবার কেউ শোনে নাকি?’

 

আজ মনে হয় বাংলার সেই লোক-সঙ্গীতের পারম্পরিক গায়ককে আমাদের সভ্য সাংস্কৃতিক আঙ্গিনা থেকে অবচেতনে বিদেয় করে দেওয়া হয়েছিল বিদ্রূপ আর অবহেলার কুলোর বাতাস করে অথবা মমতা  দিয়ে আদরের অন্নদাস বানিয়ে।


...চলবে... 


(পরের পর্ব "জীবন যাত্রা")

বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

চুরি বিদ্যে মহাবিদ্যে...

[ এর আগের পর্ব এই সূত্রে পড়া যাবে - সনাতনীর সন্ধানে   ]


আমাদের কলকাতার ছোট্ট বাসা বাড়ির ততোধিক ছোট পরিসরে মায়ের ভান্ডার থেকে হরলিক্স, মাখন এবং বিস্কুট চুরি করে ধরা না পড়াটাই আশ্চর্য ছিল। প্রায় প্রত্যেকবারই ধরা পড়তামপ্রচুর বকাবকি এবং পিঠের ওপর মায়ের চড়টা চাপড়টা বরাদ্দ থাকতচড়চাপড় খেয়ে মুখ গোমড়া করে ওঘরে চলে যেতাম আর দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকতাম বিছানায়। এর মানে আমি খুব রেগে গেছি মায়ের ওপর। একটু পরেই মা আসতেন পাশের ঘরেবিছানার একপাশে বসতেন, পিঠে হাত রাখতেন। আমার রাগ আরো বেড়ে যেত, মায়ের হাত সরিয়ে দিতাম ঝটকা দিয়ে – মা মুখ টিপে হাসতেন, বলতেন –

-‘ইস, ফর্সা পিঠে কেমন লাল লাল দাগ হয়ে গেছে। খুব লেগেছে না? ছি ছি, এমন ঘুনুসোনাকে কেউ এভাবে মারে’? আমার কণ্ঠ তখন আবেগে রুদ্ধ, ভীষণ মমতায় মা আমার পিঠে হাত বোলাতেনরুদ্ধ আবেগ কান্না হয়ে উঠে আসত, আমি ফুঁপিয়ে উঠতাম, পিঠ ফুলে ফুলে উঠতমা আবার বলতেন-

–‘কে মেরেছে, বাবা, তোমাকে? কে এত কষ্ট দিল আমার ঘুনুসোনাকে?’ পিঠ ফিরিয়ে থেকেই শেষ অভিমানটুকু উজাড় করে দিয়ে কান্নাভাঙা গলায় আমি চেঁচিয়ে উঠতাম –

-‘কে আবার, মা - আমার মা, তুমিই তো মারলে আমাকে...’। ভারি গলায় মা বললেন-

-‘উঁহু, তাহলে ও তোমার মা নয়, ও রাক্কুসী। মা এমন মারতেই পারে না ঘুনুসোনাকে...’। নিমেষের মধ্যে সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে যেতাম, আমি লাফিয়ে উঠে বসতাম মায়ের সামনাসামনি, বলতাম-

-‘মোটেও রাক্কুসি নয় - মা। আমার মা...’। কান্না ভেজা চোখে তাকিয়ে দেখি মায়ের চোখেও জল। বুকের কাছে টেনে নিয়ে মা বলতেন-

-‘কেন চুরি করিস বলতো? সব তো তোদেরই জন্যে। আমারও এমন রাগ হয়ে যায়...’

কলকাতায় মায়ের ছোট্ট ভান্ডার পার হয়ে গিয়ে মামাবাড়িতে দিদিমার বৃহত্তর ভান্ডারের সন্ধান দিয়েছিল বন্নিদিদি। সেখানেও বন্নিদিদির পূর্ণসহযোগিতায় চৌর্যবৃত্তির হাতযশ বেড়ে উঠেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু এসবই ছিল নিজস্বাপহারণ - নিজের জিনিষই চুরি করা। কারণ এসব খাদ্যদ্রব্য মা কিংবা দিদিমা আমাদের মনোরঞ্জনের জন্যেই সংগ্রহে রাখতেন। দিদিমার ভান্ডারেও আমাদের চৌর্যবৃত্তি ধরা পড়ে দিদিমার থাবড়ি খেয়েছি অনেক, আর খেদোক্তি শুনেছি বিস্তর – ‘পোড়ারমুখো (আমাকে আর বন্নিদিদির ক্ষেত্রে পোড়ারমুখি), এসব তো তোদের জন্যেই বানানো। তা সে আকাচা কাপড়ে ছোঁয়াছুঁয়ি না করলে চলছিল না’? আচারের বয়াম আকাচা কাপড়ে ছুঁলে, আচার নাকি বিগড়ে যায়। 

সে যাই হোক, এইবার ডাক এল পরস্বাপহরণের।

তখনকার দিনে সম্বৎসরে একবারই ধান হতো। ধান কাটার পর শীতকালে বেবাক নেড়া পড়ে থাকত ধূসর মাঠ কে মাঠ। কেউ কেউ টুকটাক চাষবাস করতেন সর্ষে, আলু, আখ, মুসুরডাল...। খাপছাড়া সবুজের দেখা মিলত এখানে সেখানে। দেখবার মতো ছিল – সর্ষের ক্ষেতগুলি - সবুজ পশমিনার ওপর উজ্জ্বল হলুদের অনবদ্য বুটির কাজ। হিমেল উত্তুরে হাওয়া এসে যখন দোলা দিয়ে যেত সর্ষে ফুলের বৃন্তে - মুগ্ধ হয়ে দেখা ছাড়া অন্য কোন বর্ণনা আসত না মনে। বড়ো হয়ে সেই বর্ণনা শুনেছি কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের মন্মোহিনী কণ্ঠে – ‘...আকাশের লাগে ধাঁধা, রোদের আলো ওই যে বাঁধা। বুঝি ধরার কাছে আপনাকে সে মাগলো – সর্ষে ক্ষেতের ফুল হয়ে তাই জাগলো, নীলদিগন্তে...’। এমন নিখুঁত রূপকল্প রচনা রবি ঠাকুরের পক্ষেই সম্ভব। যতবার গানটি কানে আসে চোখের ওপর দুলতে থাকে উজ্জ্বল হলুদের সেই শামিয়ানা...।

আখের ক্ষেত ছিল মাঠে বেশ কয়েকটি। সবচেয়ে নিরাপদ, লোকালয় থেকে নির্জন দূরত্বে একটি আখের ক্ষেত নির্বাচন করে আমরা পাঁচজন রওনা হলাম এক মধ্যদ্বিপ্রহরে। আমরা দুইভাই, মামাতো দুইভাই, আর মামাতো বড়ো দাদার পাড়ার এক বন্ধু। আমাদের মধ্যে মামাতো বড়ো দাদা আর তার বন্ধু সবার বড়ো, আর আমি সবচেয়ে ছোট। আমি আর পিঠোপিঠি মামাতো দাদা হাফপ্যান্ট পড়া আর বাকিরা ডোরাকাটা পায়জামা। জানিনা কেন, এই পায়জামাগুলোকেই গ্রামে সবাই ফুলপ্যান্ট বলত, আর ফুলপ্যান্টকে বলত সুট। দাদারা ছোট ভাঁজ করা ছুরি নিয়েছিল, আমরা হাফপ্যান্টের বাচ্চা বলে আমাদের ছুরি মেলে নি।

 আমরা যখন আখের সুউচ্চ বহির্বেষ্টনী সাবধানে এড়িয়ে ক্ষেতের অন্দরে ঢুকলাম, দেখলাম সে ক্ষেতের আখ খেতে এমন কিছু আর বাকি নেই। মাঝখানটা বেশ ফাঁকা, আখের চিবোনো ছিবড়ে আর আখের খোসা স্তূপাকারে ছড়ানো যত্র তত্র। অর্থাৎ আমরা এ কাজেও পথিকৃৎ হতে পারলাম না, আমাদের আগেও অনেকেই এই ক্ষেতের রসাস্বাদন করে গেছে। অনুশোচনার অবকাশ ছিল না, তাই ঝপাঝপ গোটা দশেক আখ ছুরির আঘাতে ধরাশায়ী হল এবং টুকরো হয়ে চলে এল সাফসুফ হয়ে। আমরা নিজের নিজের হাত ও দাঁতের সহযোগিতায় নেমে পড়লাম ইক্ষুর রসগ্রহণে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমাদের যা ছিবড়ে জমা হয়ে উঠল তাতে আমরা সকলেই আড়ালে বসে লুকোতে পারতাম অনায়াসে। পেটের মধ্যে আখের রস টলমল করছে, আখের খোসা ছাড়াতে গাল ও ঠোঁটের ভেতর আর মাড়ি ছিঁড়ে জ্বালা করছিল, রসে চ্যাটচ্যাট করছিল কনুই অব্দি হাত আর মুখের চারপাশ। শুনেছি আখের রস নাকি জন্ডিসের অব্যর্থ পথ্য, কিন্তু সেদিন ধরা পড়লে আমাদের কেস যে জন্ডিস হতো - সেটাও ব্যর্থ হতো না নিশ্চিৎ।    

ক্ষেত মালিকের নিশ্চয়ই ইচ্ছে ছিল বাড়িতেই আখের গুড় বানিয়ে নেওয়ার। যে গুড়ের থেকে আমাদের এই বঙ্গভূমির একাংশের প্রাচীন যুগেই নাম হয়েছিল গৌড় এবং গৌড়িয় মাধ্বীর সুখ্যাতি পৌঁছেছিল মহাভারতের সুরারসিকদের কাছেও। কিন্তু যেদিন তাঁর অন্তঃসারহীন আখের খেতের সম্যক হদিশ তিনি পেয়েছিলেন, তাঁর অন্তঃকরণে কি অনুভূতি হয়েছিল এবং আমাদের কি পরিমাণ শাপশাপান্ত করেছিলেন - সে চিন্তা করলে আজও মনের ভিতর অস্বস্তি হয় ভীষণ।

সে দিন রাতে ভাত খাবার সময় কোন তরকারিই মুখে রোচে নি - এমন ঝালআসলে ঝাল-টাল কিচ্ছু না আমার মুখের ভিতরে যা অবস্থা তাতে সামান্য নুনের স্পর্শেও জ্বলে উঠছিল। কেন এবং কি করে হল - মা ও মাসীমাদের জেরার চোটে আমার জেরবার হাল, অবশেষে বড়মামীমার হস্তক্ষেপে মীমাংসা হল দুধ ভাতের প্রেসক্রিপ্সনে। বন্নিদিদি কিন্তু ছাড়েনি - আমার পেট থেকে কথা বের করে নিয়েছিল সেই রাত্রেই এবং ‘বেশ হয়েছে, খুব ভালো হয়েছে, আর যাবি আমাকে না বলে?’ বলেও, আমাকে অনেকখানি মধু এনে দিয়েছিল লুকিয়ে – আঙুলে করে লাগিয়ে দিয়েছিল গালে আর ঠোঁটের ভিতরে।

এই ঘটনার পরে আমার মতো বাচ্চারা ব্রাত্য হয়ে গেলাম দাদাদের দল থেকে। বাস্তবিক আমার জন্যে প্রায় ধরা পড়ার উপক্রম হচ্ছিল সক্কলের। কিন্তু আমরাও হার মানলাম না। আমাদের আলাদা একটা দল তৈরি হয়ে গেল গোপনে এবং আমাদের প্রথম অ্যাকশন প্ল্যান হল আলুপোড়া খাওয়া। কচুপোড়া ব্যাপারটা তাও শুনেছিলাম – উত্তর কলকাতায় ‘কচু পোড়া খেলে যা’ লব্জটা তখন প্রায়ই শোনা যেত – কিন্তু আলুপোড়া কোনদিন শুনিনি। শোনা তো সামান্য কথা, একেবারে চেখে দেখার সুযোগ আসছে জেনে রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠলাম।

 আলুপোড়া অভিযানের দিন সকালে – সাজসাজ রব পড়ে গেল আমাদের মধ্যে - কিন্তু অত্যন্ত গোপনে। আলু পোড়াবার জন্যে ঘুঁটে, কেরোসিন তেল, দেশলাই। টেস্টের জন্যে নুন, লংকা ও গোলমরিচের গুঁড়ো, শিশিতে সামান্য সর্ষের তেল, যদি আলু কাটাকুটি করতে লাগে বলে দুটো ছুরি। এরইমধ্যে আমি বারবার জিগ্যেস করছিলাম – ‘কিরে আসল জিনিষ, আলু নিবি না’? – ‘ধূর, ওতো মাঠে...’। ওদের কথাবার্তার কোন হদিশ পাই না, এসে থেকে তো মাস খানেক হতে চলল মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছি বিস্তর, মাঠে আবার আলু কোথায়? পাছে আমাকে সবাই বোকা ভাবে, এই চিন্তা করে চেপে গেলাম, মনে মনে নিশ্চিত ছিলাম, এ মিশন ব্যর্থ হবে এবং সময়ে আমার দূরদর্শীতায় সকলে মুগ্ধ হতে বাধ্য।

নির্দিষ্ট সময়ে আলাদা আলাদা ভাবে যার যার দায়িত্ব অনুযায়ী জিনিষপত্র নিয়ে আমরা রওনা হলাম। গ্রামের বাইরে একটা জায়গায় আমরা জড়ো হয়ে রওনা হলাম মাঠের দিকে। আমি এতক্ষণ লক্ষ্য করছিলাম কেউ আলু নেয় নি। আসার পথে এত দোকান গেল, সব দোকানেই আলু পাওয়া যায়, সে সব ছেড়ে এই মাঠে আলু নিয়ে কে বসে আছে কে জানে – টেরটি পাবে বাছাধনেরা।  

চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা গিয়ে একটা মাঠে সবাই গিয়ে থেমে গেলাম। সে মাঠে আলুর কোন চিহ্ন নেই। গোটা মাঠে আধা সবজে আধা হলদে হয়ে যাওয়া চারাগাছে ভর্তি, আমার হাঁটুর হাইট হবে বড়ো জোর। একটাই বিশেষত্ব নজরে এল - এর মাটিটা। দুপাশে সামান্য নালি কেটে গাছের গোড়াগুলো উঁচু করে ঝুরো ঝুরো মাটিতে ঢাকা। 

আমাদের দলের একজন একটা গাছ কে নিষ্ঠুর ভাবে টেনে তুলতেই শেকড়ের সঙ্গে বেরিয়ে এল বেশ একমুঠো আলু – ছোট বড় মাঝারি সাইজের। অবাক কান্ড – তার আগে শিব্রাম চকরবরতির লেখায় পড়েছিলাম, আলু হয় বড় বড় গাছে ...টুসকি দিয়ে খুব সাবধানে আলু পাড়তে হয়...আর এইখানে মাটির ভিতরে সেই আলু? 

এহেন অবাক কান্ডে আমি যারপরনাই অভিভূত হলাম এবং আমাদের বাচ্চা দলের সাফল্য সম্পর্কে আমার আর সন্দেহের অবকাশ রইল না। সেই বিকেলে ঘুঁটে ও মাঠের শুকনো আগাছার কাঠকুটো জোগাড় করে আলু পোড়া বানানো হলআধপোড়া, ঝামাপোড়া, আধকাঁচা, দরকচা আলুই ক্যাঁচক্যাঁচ করে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আমরা যখন ফেরার পথ ধরলাম, সূর্য তখন পাটে বসার আগে একটু থমকে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন - এই ছোঁড়াগুলো ফাঁকা মাঠে করছেটা কি? 

আমাদের নিরাপদ ও সাকসেসফুল মেডেন মিশন আমাদের সাহস ও আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিল। 

আমরা যখন বাড়ি পৌঁছলাম, বন্নিদিদি সদর দরজায় সন্ধ্যার প্রদীপ দেখাচ্ছিল। চালধোয়ার ধুচুনির মধ্যে প্রদীপ, তার অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে প্রদীপের বহুধা আলো ঠিকরে পড়ছে চারদিকে। কি একটা মন্ত্র পড়ছিল বিড়বিড় করে, মুখে কথা না বলে ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করল ‘কোন চুলোয় যাওয়া হয়েছিল শুনি’? আমি বললাম ‘এই তো বেড়াতে’বন্নিদিদি তুলসীতলায় প্রদীপটা নামিয়ে মাথা নীচু করে নমস্কার করল তিনবার। আমি প্যান্টের পকেট থেকে দুটো আলুপোড়া বন্নিদিদির দিকে বাড়িয়ে দিতে, বন্নিদিদি বলল, ‘দাঁড়া, দাঁড়া, তোর আকাচা কাপড়, ছুঁয়ে দিস না। আলুপোড়া কোথায় পেলি? মাঠে আলু চুরি করতে গিয়েছিলি? সেদিন আখ চুরি, আজ আলু - কি শুরু করেছিস? তুই এই গ্রামের ছেলে নোস - কলকাতায় থাকিস। ভালো স্কুলে পড়িস। নপিসিমা-পিসেমশাই তোকে এইসব করার জন্যে এখানে নিয়ে এসেছে? তোর এই কাজের জন্যে তোর বাবা-মাকে কেউ যদি পাঁচকথা শোনায় - তোর ভাল লাগবে তো’? 

সেই সন্ধ্যায় তুলসীমঞ্চের সামনে, মুখের ওপর খেলা করা প্রদীপের স্নিগ্ধ আলোয় - বন্নিদিদির কথাগুলো আমাকে এমন এক সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল যার ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। আজ পর্যন্ত জীবনের প্রত্যেকটি বেপথু মুহূর্তে, দীপের সীমিত আলোয় বন্নিদিদির দীপ্ত মুখের সেই কথাগুলি সঠিক পথের দিশারী হয়ে আমার কাছে ফিরে এসেছে বারবার।

 

-০০-

[পরের পর্ব "লোকশিল্পীর বিলুপ্তি"]  

নতুন পোস্টগুলি

পেত-ন-তাৎ-তিক

  [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉  বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার ...