রম্য রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রম্য রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫

গেলেম নতুন দেশে

 

এতদিন স্কুল আর বাড়ি, বাড়ি আর স্কুল - এই নিয়ে চলছিল আমার রুটিন বদ্ধ জীবনযাত্রা। ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পার করে, টেস্ট হয়ে স্কুল ছুটি হয়ে গেল। মাস দুয়েক পরেই ফাইন্যাল – মাধ্যমিক পরীক্ষা। জীবনের পহেলা পারাও। এবারের পরীক্ষা ক্লাসের তিন সেকশনের নব্বইজন সহপাঠীদের মধ্যে সীমিত নয়। আসমুদ্রহিমাচল বঙ্গবাসী সকল সহপাঠীদের মধ্যে – তার সংখ্যা বেশ কয়েক লক্ষাধিক। এই পরীক্ষা যেন ময়দান – এ – জঙ্গ! কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। নিরপেক্ষ বিচারক – যাঁর সঙ্গে আমাদের কারুর প্রত্যক্ষ কোন পরিচয় নেই। আড়ালে থেকে আমাদের জন্যে কোয়েশ্চেন সেট করবেন, আড়ালে থেকেই আমাদের অ্যানসারশীট দেখে নম্বর বসিয়ে দেবেন। আমাদের নম্বর প্রাপ্তি থেকেই বোঝা যাবে কার কত বিদ্যের দৌড়!

আমাদের মধ্যে যতটা উত্তেজনা ছিল, ততটা দুশ্চিন্তা ছিল না। দুশ্চিন্তা ছিল বাবা মায়ের। বাবা অফিস থেকে নিত্য নতুন ঘটনা শুনে আসতেন – আর সন্ধ্যেবেলায় ঘরে ফিরে রোজ মায়ের কাছে গল্প করতেন –

-‘আজ মল্লিকদা যা বলল না, শুনলে শিউরে উঠবে’!

-‘কি, গো’?

-‘বছর কয়েক আগে, পরীক্ষা শেষ হবার চার-পাঁচ দিন পরেই, এক গাদা পরীক্ষার খাতা সোদপুরের এক মুদির দোকানে নাকি পাওয়া গিয়েছিল’

-‘বলো কি? কি করে ধরা পড়ল’?   

-‘একজন ছেলে ঐ দোকান থেকে চিনি কিনে ফিরছিল, হঠাৎ হাতের ঠোঙায় চোখ পরতে তার সন্দেহ হয়। ঘরে এসে ভাল করে দেখে নিশ্চিত হয়-ওইবারেরই পরীক্ষার খাতার একটা পাতা। কারণ ওই ছেলেটিও মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল সেবার-’।

-‘সর্বনাশ, তারপর কি হল’?

-‘এর আবার কিছু হয় নাকি? ছেলেটার বাবা-মা পাড়ার লোকজন নিয়ে থানায় গিয়েছিল, সেখান থেকে দোকানে। বেশ কিছু খাতা উদ্ধার হয়েছিল – বাকি....ওই আর কি...তদন্ত চলছে’।

-‘আর চিনির ঠোঙা...’?

-‘সে আর কি হবে, কিছু একটা নম্বর পেয়ে পাস হয়ে যাবে...’।

-‘ইস, ছেলেটি যদি ভালো ছেলে হয়, হয়তো আশা করে থাকবে ভালো নম্বরের, শেষে কিনা শুধু পাস নম্বর...ছি ছি...’

-‘তা ঠিক, আর যদি তোমার ঘুনুসোনার অঙ্ক খাতা হয়, তাহলে হাঁফ ছেড়ে বেঁচে যাবে..., কি বলিস রে, পান্না’? বাবার কথার শ্লেষটা শেষমেষ আমার দিকেই এল! আমি কিছু বলার আগেই, মা বলে উঠলেন –

-‘এই তিন সন্ধ্যেবেলায় অলুক্ষণে কথা তোমার মুখে দেখি আটকায় না। যাও, যাও, মুখ হাত ধুয়ে নাও, মুড়ি মাখছি...আমার আবার রাতের রান্না আছে’।

 

বাবা হাসতে হাসতে বাথরুমে চলে যেতে, মা করুণ চোখে, প্রায় চুপিচুপি আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘হ্যারে, ঘুনু, অঙ্কটা খুব শক্ত লাগে, না? কিচ্ছু পারছিস না?’ 

আমি খুব গম্ভীরভাবে মাকে বলেছিলাম, ‘ও নিয়ে তুমি ভেবো না তো, মা। বাবা সবেতেই একটু বাড়িয়ে বলে...’। আমার উত্তর শুনে মা কতটা নিশ্চিন্ত হলেন জানি না, তবে সন্ধ্যাদীপ আর ধূপ জ্বলা ঠাকুরের সিংহাসনের দিকে জোড়হাতে নমস্কার করে বললেন, -‘দুগ্‌গা, দুগ্‌গা, সব ঠিক মতো দেখো, মা’।

 

মা রান্না ঘরে চলে গেলেন জলখাবারের জোগাড় করতে। আমার ওপর বাবার অনাস্থায় আমার মধ্যে কোন ব্যতিক্রম আসে নি, কিন্তু মা আমাকে অগাধ বিশ্বাস করে সেদিন আমাকে বিপন্ন করে দিয়ে গেলেন...।

 সারাদিন পড়া পড়া খেলা খেলতে খেলতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। মায়ের নিরন্তর তাগিদ, বাবার একটা দুটো মন্তব্য – সে সময় পড়তে বসা ছাড়া পরিত্রাণ ছিল না। কিন্তু এও দেখেছিলাম সারাটা সকাল মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের মুখ্য কারণ মুখস্থ করার পর – বেলা বারোটা নাগাদ অওরঙজেবের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে বিন তুঘলকের শাসন ব্যবস্থা গুলিয়ে ফেলেছিমনে হত সারাটা সকাল ধরে পড়া ইতিহাস বইয়ের অক্ষরসমূহ আমার মাথার মধ্যে একটাও নেই, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে আমার চেয়ারের চারপাশে – মেঝেয় এবং ধরা দিচ্ছে না কিছুতেই।

এহেন সময়ে একদিন সকাল সাড়ে নটা নাগাদ স্কুলের এক বন্ধু এসে আমাদের বাসায় উদয় হল। আমাকে বলল, ‘জয়ন্তর বাড়ি যাবো, চ। ওর কাছে অঙ্কের সাজেসান আছে, টুকে আনতে হবে। ওই সাজেসান থেকে নাকি নব্বই ভাগ অঙ্ক আসবেই...কাজেই এমন সুযোগ হাতছাড়া করার কোন মানে হয় না...’।

 

আমার মায়ের দেওয়া মিষ্টি আর জল খেতে খেতে মাকে আমার সম্বন্ধে এমন সব সোনালী মন্তব্য সে করতে লাগল, শুনে মা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। কাজেই আমি যখন বাইরে বেরোনোর জন্য রেডি হলাম, মা আমার হাতে গুঁজে দিলেন পাঁচ টাকার একটি নোট।  

 পথে বেরিয়ে আমার সেই বন্ধুটি বলল জয়ন্তর বাড়ি নয় আমাদের গন্তব্য ধর্মতলা – ‘নিউ এম্পায়ার’ সিনেমা। সেখানে ‘দ্য এক্সরসিস্ট’ চলছে। দারুণ সিনেমা। বীভৎস ভয়ের বই। আমেরিকায়, ইংল্যান্ডে নাকি হলের বাইরে অ্যাম্বুলেন্স রাখা থাকত, এই সিনেমা চলাকালীন – ভয় পেয়ে অসুস্থ লোকেদের হসপিটালে ক্যারি করার জন্যে। আমরা ভারতীয়রা তো খুব ডরপুক, তাই অনেক সিন নাকি কেটে দিয়েছে। কিন্তু তাও যা আছে সেও বড়ো কম নয়।

মাথা নীচু করে আমি শুনতে লাগলাম ওর কথা। দোলাচলে আমার মন তখন বিভ্রান্ত। এক, মায়ের সঙ্গে এহেন মারাত্মক শঠতা আমার এই প্রথম। কোনমতেই এটা উচিৎ কর্ম হলো না। ফিরে যাবো কিনা ভাবছিলাম। অন্যদিকে বাড়ির বন্ধন থেকে মুক্তি। সারাটাদিন পড়া আর পড়া্র একঘেয়েমি থেকে মুক্তি। তার সঙ্গে বাড়ির অজানিতে সিনেমা দেখার অনাস্বাদিত রোমাঞ্চ। কাজেই, ফিরে আসার সিদ্ধান্তটা ঠিক দানা বেঁধে উঠল না, বরং ট্রাম ধরে ধর্মতলার মোড়ে নেমে, বাকিটা হেঁটে, পৌঁছে গেলাম নিউ এম্পায়ারের আঙ্গিনায়। 

 

সেখানে পৌঁছে দেখি আরো দুই বন্ধু আমাদের জন্যে অপেক্ষারত। অর্থাৎ এই প্রথম চারজনে একত্র হওয়া গেল স্কুলের বাইরে, একবারে এই নতুন সাম্রাজ্যের গন্ডিতে। আমাদের এক বন্ধু সিগারেট কিনেছিল, প্যাকেট থেকে একটা নিজে নিয়ে সে খুব মুরুব্বি চালে ‘খাবি নাকি’, বলে আমাদের দিকে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিল। উইল্‌স্‌ ফ্লেকের প্যাকেট – হাতে নিয়ে খুলে দেখলাম তাতে তিনটেই আছে। একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে সকলেই একটা করে সিগারেট নিলাম। তারপর পাশের সিগারেটের দোকানের একটু তফাতে টাঙানো নারকেলের দড়ি থেকে ধরিয়ে নিলাম নিজের নিজের সিগারেট। মোটেই কোন মজা পেলাম না। তামাক আর কাগজের পোড়া গন্ধে নিঃশ্বাস আর মুখের ভিতরটা কেমন অদ্ভূত বিস্বাদ হয়ে উঠল। কিন্তু ছাড়লাম না সিগারেটটা, কারণ স্বাদটা বড় কথা নয়, সেদিন নিউ এম্পায়ারের সামনে, সমস্ত কিছু মিলিয়ে আমরা এক নতুন জীবনের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলামসেই দরজা যেন আলগা ভেজানো - আমাদের হাতের অল্প ছোঁয়ায় উন্মুক্ত হতে যা দেরি।

 

সিগারেট শেষ করে আমরা ঢুকে পড়লাম নিউএম্পায়ারের পঁচাত্তর পয়সার খাঁচার লাইনে। লোহার শক্ত কাঠামো দিয়ে তৈরি সংকীর্ণ পিঞ্জরপথ। একজনের বেশী পাশাপাশি দাঁড়ানো যায় না। পৌনে এগারোটায় আমরা যখন সেই খাঁচায় ঢুকলাম, আমাদের সামনে অন্ততঃ জনা চল্লিশেক সিনেমারসিক ছিলেননুন শোর শুরু বেলা বারোটায়, টিকিট দেওয়া শুরু হবে তার মিনিট পনের কুড়ি আগে। কাজেই ওই আবদ্ধ অবস্থায় অভিজ্ঞ সিনেমা রসিকদের থেকে জ্ঞান আহরণ করা ছাড়া, আমাদের চারজন শিক্ষানবিশের তখন আর কিছুই করার ছিল না।

 

পৃথিবীতে কোন পাণ্ডিত্যই বোধহয় অবিতর্কিত নয়, বিভিন্ন পণ্ডিতের বিপরীত মতামতের জন্যেই যে কোন বিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করা দুরূহ। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। কলকাতার ওই অঞ্চলের বিভিন্ন সিনেমা হলের পঁচাত্তর পয়সার টিকিটে সিট সংখ্যা কত এ নিয়ে সেদিন বিস্তর আলোচনা শুনেছিলাম। নিউ এম্পায়ারের সিট সংখ্যা নিয়ে বেশ কজন সিনেমারসিকদের বাকবিতণ্ডায় আমরা যথোচিত বিভ্রান্ত হতে পেরেছিলামকেউ বলেছিল মেরে কেটে শতখানেক হবে, কেউ বলেছিল আড়াইশ, আরেকজন গম্ভীরভাবে বলেছিল – একশ আটান্ন। যে একশ আটান্ন বলেছিল, সে কতগুলো রো এবং প্রত্যেক রোতে কতগুলো সিট - তার নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে, জটিল অঙ্কের হিসেব কষে দেখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে একশ আটান্ন!

-‘আড়াইশো হোক অথবা শতখানেক, আমরা তো টিকিট পাবোই, কি বলেন - আমাদের আগে তো জনা চল্লিশেক হবে মেরেকেটে’? আমাদের এক বন্ধু, আসন-বিতর্ক থেকে মুক্তি পেতে বলে ফেলেছিলতাতে ফল হয়েছিল একদম উল্টো, আশেপাশের সক্কলে নানান সুরে এবং স্বরে এমন হেসে উঠল, আমরা হতবাক। হাসির গমক কমতে একজন খুব স্নেহমাখা স্বরে আমাদের বলল –

-‘ভাইয়েরা বুঝি এ লাইনে, নতুন? একটু দাঁড়ান - টিকিট কাউন্টার খোলার সময় হলেই দেখবেন মজাটা মাথায় হাঁটু দিয়ে তালতলা আর জানবাজারের ছেলেরা সবাই কেমন সামনে চলে যাবে, তারা যদি সমস্ত টিকিট না নিয়ে নেয়...’ এই অব্দি বলেই সে ভদ্রলোক থেমে গেল। আমরা স্বাভাবিকভাবেই খুব মুষড়ে পড়লাম, বাড়িতে এত মিথ্যে বলে, এতদূর এসেও সিনেমা দেখা হবে না! আমার মনে হল – ঠিকই তো হয়েছে, মাকে মিথ্যে বললে কোন কাজ ভাল হয় না, এই তো তার প্রমাণ! আমি আমার বন্ধুদের বললাম –

-‘এতক্ষণ, বেকার দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে, চল কেটে পড়ি’। আমার কথা শুনে আমাদের পিছনে দাঁড়ানো দু-তিন জন হ্যা হ্যা করে হেসে বলল –

-‘কেটে পড়ব বললেই হবে, পিছনে লাইনটা দেখেছেন, আপনারা বেরোতে পারবেন নাকি’? সত্যি ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের পিছনের সর্পিল পিঞ্জরপথ সদর রাস্তা পর্যন্ত ভরে গেছে – কম করে হলেও শ দুয়েক লোক তো হবেই আমাদের পিছনে...। আর এত সংকীর্ণ খাঁচায় পাশ কাটিয়ে বের হওয়া একরকম অসম্ভব। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে – কি আবার হবে-কপালের লিখন?

 

সেই বদ্ধ খাঁচায় আমরা কতক্ষণ নানান জনের নানান আলাপ শুনতে থাকলাম। বিড়ি, সিগারেটের  ধোঁয়া – মাঝে মাঝে আরেকটি উৎকট ধোঁয়ার গন্ধ (পরে জেনেছিলাম ওটা গঞ্জিকার গন্ধ) শুঁকতে থাকলাম। হঠাৎ মধুচক্রে লোষ্ট্রবৎ - আমাদের সামনে পিছনে সকল মানুষ তৎপর হয়ে উঠল। আর পিছনে শুনতে পেলাম গালাগালির একটা ঢেউ ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে। একদল হিন্দীতে, আরেক দল বাংলাতে অশ্রাব্য গালাগাল দিচ্ছে। হিন্দীর প্রচণ্ড দাপট, বাংলা সে তুলনায় অনেকটাই ক্ষীণ।  অনেকক্ষণ শুধু শোনা যাচ্ছিল, এবার দেখাও গেল। জনা পাঁচ – সাত হবে, হাট্টা কাট্টা নেপালি চেহারার ছেলে খাঁচার ভিতরের দিকে লোহার ফ্রেমে দু হাতে ঝুলতে ঝুলতে খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। কেউ তাদের বাধা দিচ্ছে না, কিন্তু তারা দু পায়ে লাথি ছুঁড়ছে অনবরত আর চিৎকার করে হিন্দীতে গালাগাল দিচ্ছে সক্কলকে। তাদের লাথিতে প্রতীক্ষারত লোকগুলো মাথায় ঘাড়ে চোট খেয়ে বাংলায় গাল পাড়ছে। চট করে ইতিহাস উপলব্ধি হল – যারা পরাজিত তাদের গালাগাল বা অভিশাপে কোনদিনই জোর থাকে না...।

 

শেষমেষ তারা আমাদেরও মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল বৃষ্টিহীন ঝড়ো মেঘের মতো। আমরা বীরত্বে বিশ্বাসী নই, তাই আগে থাকতেই বসে পড়েছিলাম। কাজেই চোট পেলাম না, তবে গালাগাল শিখলাম বিস্তরওরা সামনে চলে গেলআর কি আশ্চর্য ওরা পৌঁছনোমাত্রই যেন সামনের লোহার গেট খুলে গেল – আর টিকিট কাউন্টারও চালু হয়ে গেল। টিকিট পাব কি-পাব না দুশ্চিন্তায় শনৈঃ শনৈঃ এগোতে এগোতে টিকিট কাউন্টারে পৌঁছনো গেল – আর কি অবাক কাণ্ড লটারির টিকিটের মতোই টিকিটও হাতে চলে এলো...

 

মুঠিতে টিকিট নিয়ে এবার দৌড়, সিঁড়ির পর সিঁড়ি পার হয়ে আমরা উঠতেই লাগলাম। বেলা বারোটাতেও সে সিঁড়ি আধো অন্ধকার...। টিকিট তো হয়েছে এবার আসন দখলের পালা। সিট নাম্বার নেই- যে আগে যাবে সেই পাবে ভালো সিটগুলি। কাজেই দৌড়, দৌড়...এ এক নতুন জীবনের পাঠ – এরপর ট্রেনে-বাসে-সিনেমাহলে সর্বত্র অন্যকে ঠেলেঠুলে, ধাক্কা মেরে উঠতে থাকব, উঠতেই থাকব...

--০০--

মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫

মা হওয়া নয় মুখের কথা

 

গতকাল সময় হয়নি, আজ সকালে ঘুম ভাঙার পরেই মণিমাসি আর সুভামাসি পান্নাকে তুলে আনল, নদিদির কোলের কাছ থেকে। পান্না জেগেই ছিল, মায়ের কোলের কাছে শুয়ে হাতপা ছুঁড়ছিল, আর মুখে নানান আওয়াজ করছিল। মণি যখন তাকে হুস করে কোলে তুলে নিল, প্রথমে একটু অবাক হলেও কাঁদল না, মুখের কাছে দু হাত নিয়ে, দেখতে লাগল, মণিমাসির মুখের দিকে। পান্নাকে নিয়ে মণিমাসি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে সুভামাসি খুব আস্তে ভেজিয়ে দিল ঘরের দরজাটা।

কুঠুরি ঘরের লম্বা পিঁড়েয় এসে, পান্নাকে কোলে নিয়ে বসল মণিমাসিসুভামাসিও তার পাশে বসে ঝুঁকে দেখতে লাগল পান্নাকে। তাদের সামনে ওষুধের বাক্স। তার মধ্যে সাদা তুলো, বোরিক তুলো। টিংচার আয়োডিনের ছোট্ট শিশি। ডেটলের শিশি। অ্যান্টিব্যাক্ট্রিনের শিশি। সিবাজল পাউডার। ছোট্ট কাঁচি। ব্যাণ্ডেজের কাপড়। টুকটাক আরো কিছু ওষুধ আর জিনিষপত্র।

মণিমাসি খুব সন্তর্পণে পান্নার বাঁ হাতের অনামিকায় জড়ানো ন্যাকড়ার বাঁধনটা খুলতে চেষ্টা করল। চারদিন আগের বাঁধা মোক্ষম গিঁট খোলা যাচ্ছিল না। সুভামাসি ঝুঁকে দেখতে দেখতে বলল, “কাঁচি দেব? কেটে দে, দিদি। ও গিঁট আর খোলা যাবে না”। বাঁ হাতটা চেপে ধরাতে পান্না বিরক্ত হচ্ছিল, জোর করছিল ছাড়ানোর জন্যে আর মুখে আওয়াজ করছিল, ঠোঁট সরু করে।

“তাই দে”।

কাঁচি দিয়ে গিঁটটা কেটে ফেলার পর, শাড়ির ফালির পরত খুলে আসতে লাগল। দু তিন পাক খোলার পর পান্না টের পেল ব্যথাটা। শুকনো রক্ত আর পুঁজে ক্ষতস্থানে আটকে গিয়েছে ন্যাকড়ার ফালি। টেনে খুলতে গেলেই সে ব্যথা পাচ্ছে।  ডাহাত ছুঁড়ে সে মণিমাসির হাতে ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল এবার। গতকাল দুপুর থেকে যে শিশুর কান্না একবারও শোনা যায়নি, সেই কান্নার আওয়াজে বাড়ির অন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠে, ভোরের ঘুম ভেঙে বেরিয়ে আসতে লাগল, ঘর ছেড়ে।

মণিমাসি পান্নার চোখে চোখ রেখে বলল, “কট্টো দিয়ে ফেলেচি, বাবু? আহারে, মরে যাই। সুভা, এক কাজ কর, এভাবে হবে না, ছোট্ট বাটিতে খানিকটা গরম জল কর। গরম জলে না ভেজালে এ ন্যাকড়া খোলা যাবে না”। সুভা দ্রুতপায়ে অ্যালুমিনিয়মের বাটিতে জল নিয়ে, কেরোসিনের স্টোভ জ্বালতে বসল।

পান্নার বড়োমামা হন্তদন্ত হয়ে, বারান্দায় এসে বললেন, “তোরা ছেলেটাকে নিয়ে কী করছিস বলতো? অ, আঙুলটা? ন্যাকড়াটা খোলা যাচ্ছে না?” তিনিও এসে মণিমাসির পাশে বসলেন। “সুভা গরমজল করছিস? গুড। গরমজলে তুলো ভিজিয়ে, ফোঁটা ফোঁটা ফেললে, ন্যাকড়াটা খুলে আসবে”।

“তাই করবো। সুভা জলটা নিয়ে আসুক”। পান্নার দিদিমা খুব ভোরে উঠে বাইরে যান, তিনি ফিরে এসে পান্নাকে নিয়ে ওদের বসে থাকতে দেখে অবাক হলেন। তারপর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, রান্নাঘরে গিয়ে একটা সাঁড়াশি নিয়ে এলেন। সুভাকে সেটা দিয়ে বললেন, “এই সাঁড়াশি নে, জলে বুড়বুড়ি কাটছে, ওতেই হবে। নামিয়ে ফেল। ফুটন্ত জল কচি হাতে সইতে পারবে কেন? হাঁদা মেয়ে, জল গরম করতে বসেছিস আর সাঁড়াশি নিসনি? জল গরম হলে, হাত দিয়ে ধরতে পারবি? বোনপোর হাত দেখতে গিয়ে, নিজের হাত পোড়াবি?”

গরম জলের মধ্যে বোরিক তুলোর টুকরো ভিজিয়ে, ন্যাকড়ার ওপর টুপ টুপ জল ফেলতে লাগল সুভামাসি, আর মণিমাসি অতি সন্তর্পণে ছাড়াতে লাগল ন্যাকড়ার ফালি। ততক্ষণে কলুমাসিও চলে এসেছে।

বড়োমামা বললেন, “কলু এক কাজ কর দেখি, আমার ঘর থেকে একটা ঝুমঝুমি নিয়ে আয়, চোখের সামনে আওয়াজ করলে, কিছুটা আনমন হবে”। কলুমাসি দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এল, আর উবু হয়ে বসে সে নিজেই বাজাতে লাগল পান্নার চোখের সামনে। পান্না ডানহাত বাড়ালো সেটা ধরার জন্যে, সত্যি বাঁহাতের দিকে এখন আর তার লক্ষ্য নেই।

ন্যাকড়ার ফালি সরাতেই সকলেই চমকে উঠলেন আঙুলের অবস্থা দেখে এবং দুর্গন্ধে! পান্নার মা, বাবা, দাদা হীরুও ততক্ষণে চলে এসেছে।

পান্নার দিদিমা খুব বিরক্ত হলেন মেয়ের ওপর, বললেন, “এ কিন্তু তোর খুব অন্যায়, সোনা। এইটুকু একটা ছেলে, তার হাতটার এই অবস্থা করে রেখেছিস? ছি ছি ছি। দুটি মাত্র ছেলে। তাদের দিকেও তোর চোখ দেবার সময় হয় না?” সোনা নিজেও খুব অপরাধী বোধ করছিলেন, তিনি কোন উত্তর দিলেন না, অপলক তাকিয়ে রইলেন ছেলের মুখের  দিকে।

“বলি, ঘরের কাজ আগে করবি, না ছেলেকে দেখবি? আমিও তো বাছা তোমাদের আটবোন, দুই ভাইকে বিইয়েছি, বড়ো করেছি, আবার ঘরের কাজও সেরেছি। কই এমন তো হয়নি কোনদিন?” কিছুক্ষণ থেমে আবার বললেন, “তোর শাশুড়িকেও বলিহারি। বাবা, অচ্যুত কিছু মনে কোর নাকচি নাতি, সবে এই এক বছর পূরল, তাঁরও কী একবার মনে হয়নি, নাতির হাতটা একবার দেখি। ছি ছি ছি। সংসারে থেকে পুজো, পাব্বণ, ব্রত, উপোস-তাপাস করে কী লাভ? যদি নিজের লোকেদের কোন কাজেই না আসি? তার থেকে সব ছেড়ে ছুড়ে সন্নিসি হয়ে চলে গেলেই হয়”।

বড়োমামা দিদিমাকে বললেন, “মা, চুপ কর, ছেড়ে দাও। যা হবার তো হয়েছে, এখন আর ওসব বলে কী লাভ? মণি, সুভা, গরম জল দিয়ে আলতো মুছে নে জায়গাটা। কাঁচা ডেটল দিয়ে, বেঁধে দিয়েছিলি, না রে, সোনা? চারপাশটা পচে হেজে গেছে। এইটুকু বাচ্চার চামড়ায় কাঁচা ডেটল সহ্য হবে কেন?”

দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন কী করবি? করুণাসিন্ধুকে একবার ডাকবি নাকি? এসে একবার দেখে যাক”।

“করুণামামা তো নেই, গতকাল বর্ধমান গেছেন, ফিরবেন সেই বুধ বা বেষ্পতিবার”করুণাসিন্ধু এলএমএফ ডাক্তার, গ্রামেরই মানুষ। হাতযশ ভালোই, ডাকতে, হাঁকতে পাওয়াও যায়।

“তাহলে?”

“দেখি, একটু বেলায় মহিমকাকাকে বলে হোমিওপ্যাথি যদি কিছু দেন। কাল সকাল অব্দি কেমন থাকে দেখি, সেরকম হলে মাঝের গাঁ নিয়ে যাবো। মণি, এবার খুব হাল্কা করে, এই এতটুকু টিংচার আয়োডিন জলে ফেলে, সেটা দিয়ে জায়গাটা ভিজিয়ে দে। ব্যস ব্যস, দু ফোঁটা আর না। এবার তুলোটা ভিজিয়ে, চিপে নে। হ্যাঁ, এবার থুপ থুপ করেআমি তো বলবো মা, এই ছেলেটাই হাবা। এমন অবস্থা হাতের, ব্যথা লাগছে না? অন্য কোন বাচ্চা হলে, চিল চিৎকার করে পাড়ার লোকের ঘুম ছুটিয়ে দিত। হ্যাঁ, হয়েছে, এবার একটু শুকুতে দে, একদম শুকনো”। সুভোমাসি আর মণিমাসি শুকোনোর কথায় হাল্কা ফুঁ দিতে দুজনেই নীচু হতে গেল, আর তাদের মাথায় মাথায় ঠোক্কর লাগল, ঠক। দুজনেই দুজনের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগল।

বড়মামা হা হা হেসে বললেন, “বোনপোর আঙুল, দুই মাসির মাথায় এবার শিং গজিয়ে ছাড়বে, নে নে আরেকবার ঠুকে নে। তারপর দেখ শুকোলো কিনা”? দুই বোনে আরেকবার হালকা মাথা ঠোকার পর, মণিমাসি বলল, “হ্যাঁ, শুকিয়েছে”।

“গুড এবার কাটা জায়গাটাতে সিবাজল পাউডার ছড়িয়ে দে হালকা করে, তারপর ওখানটা ছোট্ট একটা গজের টুকরোয় চাপা দিয়ে, ব্যাণ্ডেজ করে দে। ব্যাণ্ডেজটা তিন, চার পরতের বেশি যেন না হয়”। মণিমাসি আর সুভামাসী অত্যন্ত মনোযোগে পান্নার আঙুলের সেবা করছিল যখন, তখন পান্না মণিমাসির চুলের একটাগুছি ডান হাতের আঙুলে জড়িয়ে, মুখে নেবার চেষ্টা করছিল বারবার। আর আঙুলে ব্যথা লাগলে চমকে উঠে মুখ বেঁকিয়ে কান্নার ভঙ্গি করছিল।

পুরো ব্যাপারটা হয়ে গেলে, সুভামাসি খুব করুণ মুখ করে বলল, “আমার কোলে একবার দে না, দিদি”।

পান্নার দিদিমা বললেন, “নিবি বাছা, নিবি। পান্না কিছু পালিয়ে যাচ্ছে না। এখন ওকে সোনার কোলে দে, একটু খাক। আর শোন, রোজ সকালে একবার করে, আঙুলটা খুলে দেখবি, কেমন আছে তারপর ওষুধ দিয়ে আবার ব্যাণ্ডেজ করে দিবি। এই সময় করুণাসিন্ধু আবার কোন চুলোয় গেল কে জানে! দরকারের সময়ে কাউকে পাওয়া যায় না”।

এতক্ষণ, সোনা অপরাধীর মতো বসেছিলেন মণিমাসির পিছনে, একটা কথাও বলেননি। সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চাইছিলেন, নিজেই ছেলের এই সেবাটুকু করতে, অথচ সংকোচে বলতে পারছিলেন না। এখন মায়ের কথায়, অধীর আগ্রহে, পান্নাকে নিজের কোলে তুলে নিলেন। বুকের মধ্যে চেপে ধরে, পান্নার গালে গাল ঠেকালেন। হঠাৎ যেন ভারি হয়ে উঠল তাঁর দুই স্তন, আঁচলের মধ্যে পান্নাকে নিয়ে, তার মুখে তুলে দিলেন বৃন্ত। এখন তাঁর পাশে তিন বোন, মা আর বৌদি ছাড়া আর কেউ নেই। সোনা আঁচল সরিয়ে, পান্নার মুখের দিকে তাকালেন। তার রেশমের মতো কোমল চুলে হাত বোলাতে বোলাতে তাকিয়েই রইলেন। উষ্ণ দুধের তৃপ্তিতে শিশুর চোখ বুজে আসছেমাঝে মাঝে শ্বাস নেওয়ার বিরতিতে, সে চোখ মেলে দেখছে মায়ের মায়াবি মুখখানি। তার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে, নিশ্চিন্ত ঘুম। সোনার ঠোঁট কাঁপছে। তিনি মনে মনে বললেন, এভাবে কষ্ট পাচ্ছিস, একবার বলতেও তো পারতিস মাকে। কথা বলতে পারিস না, গলা ছেড়ে কাঁদতেও তো পারতিস, বাবা! এত্তো, এত্তো অভিমান মায়ের ওপর! বোনেদের সামনে তিনি চাইছিলেন না, কিন্তু সামলাতে পারলেন না নিজেকে। তাঁর দুচোখ উপচে নেমে এল অশ্রু

সুভামাসি বলে উঠল, “এ মা, ও ন’দি, কাঁদছিস কেন?”

পান্নার দিদিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, উঠে যাওয়ার সময় বললেন, “কাঁদবে বইকি, বাছা। কাঁদুক, মনটা হাল্কা হোক। মা হওয়া কী মুখের কথা বাছা? সে তোরা এখন বুঝবি না, বুঝবি পরে। তোরা যা, ওষুধপত্র সব যথাস্থানে তুলে রাখ। বৌমা চলো, আমরা চান সেরে আসি, জামাই আছে, তার জলখাবারের যোগাড় করতে হবে। অনেক কাজ সোনা এখন ছেলেকে নিয়ে একলাই থাকুক। হীরু, তুই বাবা বোস, মায়ের কাছে”।

                                                   

..০০..

বৃহস্পতিবার, ৭ আগস্ট, ২০২৫

সংসার সুখের হয়...


সন্ধে হবো হবো সময়ে দাদার সঙ্গে গ্রামে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন অচ্যুত। শিবতলার মন্দিরে প্রণাম সেরে গিয়েছিলেন হাজরাচৌধুরিদের বাড়ি। হাজরাচৌধুরি মশাইয়ের বৈঠকখানায় সন্ধের পর জমাটি মজলিশ বসে। প্রতিবেশীদের নানান কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে চাষবাস, গরুবাছুর, গ্রাম, হাট, সাতগেছে, মেমারি, কালনা, বর্ধমান, কলকাতা মায় সুদূর দিল্লিও। সদা হাস্যমুখ হাজরাচৌধুরি মশাই প্রবীণ মানুষ। তিনি নিজে কথা বলেন কম, শোনেন বেশি। কারো সঙ্গে তর্ক করেন না। ফলতঃ সজ্জন ও সদালাপী হিসেবে তিনি এপাড়ায় জনপ্রিয়। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ বসলেন দাদা ও অচ্যুত। সকলের সঙ্গে আলাপের পর, সকলের কথাবার্তা শুনে অচ্যুতকে নিয়ে দাদা বাড়ি ফিরলেন।

বাড়ি ঢোকার মুখে দাদা বললেন, “আমায় এখন কিছু খাতা দেখার কাজ সারতেই হবে, ভায়া। এই ফাঁকে তুমি বরং সোনার কাছে তোমাদের কলকাতা যাবার প্রস্তাবটা বলে ফেলো। দেরি করো না”।

অচ্যুত হাসলেন, বললেন, “আচ্ছা দেখছি”।    

নতুন ঘরের উঁচু দাওয়ায় উঠতে উঠতে, ঘরের ভেতর থেকে নিজের স্ত্রী, বড়ো পুত্র হীরু আর দুই শ্যালিকা সুভা আর কলুর গলার আওয়াজ পাচ্ছিলেন অচ্যুত। ও বাড়িতে সবাই নিশ্চয়ই রাতের রান্নার কাজে ব্যস্ত। দরজার পাশে চটি খুলতে খুলতে তিনি গলা ঝেড়ে শব্দ করলেন।

ঘরের ভেতর থেকে সুভা বেরিয়ে এল, “ওই তো জাঁইবাবু এসে পড়েছেন। জাঁইবাবু মুড়ি খাবেন? আমতেল মেখে দি? মাকে বলি কটা বেগনি ভাজতে?”

প্রসন্ন হেসে অচ্যুত বললেন, “আনতে পারো, তবে মুড়ি খুব সামান্য, অবেলায় খেয়ে তেমন খিদে হয়নি”। সুভা আর কলু দৌড়ে চলে গেল ওদিকের মহলে, ঘরে এখন শুধু সোনা, হীরু আর সোনার কোলে শুয়ে খেলতে থাকা পান্না। পান্না ছোট্ট ছোট্ট হাত বাড়িয়ে দাদার মুখে, নাকে, চোখে থাবা মারছিল। ভাইয়ের হাতের স্পর্শে হীরু মাঝে মাঝে ব্যথা পাওয়ার মতো ‘আউ’ আওয়াজ করলেই, পান্না হেসে উঠছে খলখল করে।

আর তখনই হীরু ঘাড়মুখ নেড়ে খুব অঙ্গভঙ্গি করে বলছে, “তবে রে? তবে রে? আমার নাক খিমচে দিচ্ছিস? দাঁড়া তো, দাঁড়া তো, দেখাচ্ছি তোর মজা”। পান্না ভয় তো পেলই না, উলটে খলখল হেসে, আনন্দে পা ছুঁড়ল, তার মায়ের বুকে লাগল শিশুর লাথি। ।

“তোদের দুটোর এই দৌরাত্ম্যি আর ভালো লাগে না, বাপু, কবে যে তোরা বড় হবি, তাই ভাবি”। সোনা বললেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর স্বরে এতটুকু বিরক্তি ফুটল না বরং ঝরে পড়ল স্নেহের প্রশ্রয় কারণ সমস্ত মাতৃত্ব নিয়ে তিনি উপভোগ করছিলেন, তাঁকে ঘিরে দুই ভাইয়ের এই ক্রীড়া। অচ্যুত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তাঁর ছোট্ট সুন্দর এই পরিবারের দিকে। তারপর সোনার সামনে বসতে বসতে বললেন, “ভাবছি, এখান থেকে তোমাদের নিয়ে আর দুউরি না গিয়ে, কলকাতায় যাবো”। হীরু লাফিয়ে মায়ের পাশ থেকে দৌড়ে এল বাবার পাশে। বলল, “হ্যাঁ? আমরা ট্রেনে চড়ে যাব, বাবা?”

“হুঁ। ট্রেনে চড়েই তো যাব। মেমারি থেকে ট্রেন ধরে কলকাতা...”

“ট্রেন বুঝি পালিয়ে যায়, তাকে ধরতে হয় কেন?”

“ধুর বোকা, পালাবে কেন? ট্রেন তার নিজের সময় মতো চলে কিনাঠিক সময়ে পৌঁছে ট্রেন ধরতে না পারলে, হুস করে চলে যায়। কারও জন্যে সে বসে থাকে না”।

“মেমারি এখান থেকে কতদূর বাবা, গরুর গাড়িতে যেতে হবে?”

“না রে, এখান থেকে গরুর গাড়িতে মাঝের গাঁ যাব, সেখান থেকে বাসে মেমারি - অনেকটাই দূর। তারপর ট্রেনে চেপে হাওড়া। জানিস তো, কলকাতায় গঙ্গা আছেগঙ্গা পার হওয়ার বিশাল হাওড়ার ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। জাদুঘর। বটানিক গার্ডেন। কত চওড়া চওড়া বাঁধানো রাস্তা সব। সকাল থেকে রাত অব্দি লোকজনের ব্যস্ততা আর ছুটোছুটি। কত বাস, ট্রাম, মোটর গাড়ি। দেখলে অবাক হয়ে যাবি!”

 হীরুর দুচোখে স্বপ্ন। বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, “পান্না যাবে, আমাদের সঙ্গে?”

“যাবে বৈকি”!

“মাও যাবে তো”?

“বা রে, মা না গেলে তোরা থাকবি কী করে?”

“ও বাবা, আমাদের সঙ্গে ঠাকুমা যাবে না?”

কলকাতা যাওয়ার জন্যে উদ্গ্রীব হীরুর এই কথার উত্তর দেওয়ার আগেই সোনা জিজ্ঞাসা করলেন, “হঠাৎ আমাদের নিয়ে তোমার এমন বেড়ানোর শখ হল যে?”

“বেড়ানোর শখ নয়। বাসা নিয়ে কলকাতাতেই থাকবো। হীরুকে লেখাপড়া করতে হবে না? ওখানে স্কুলে ভর্তি করে দেবো”। পুত্রকে হাতের বেড়ে খুব কাছে টেনে এনে অচ্যুত বললেন, “এ ছেলেকে ডাক্তার করতে হবে, সে কী দুউরির স্কুলে লেখাপড়া শিখলে হবে ভাবছো?”

সোনা বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন স্বামীর দিকে, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “মাকে বলেছো”?

“মাকে...মানে, আমার মাকে? না, না। মাকে এখন বললে কুরুক্ষেত্র বাধাবেন। কাউকেই বলিনি। খাওয়াদাওয়ার পর আজ বিকেলে তোমার দাদাকে বললাম, আর বলেছি কলকাতার দু একজন বন্ধুকে। এ কথা চাউর হয়ে গেলে, আর যাওয়াই হবে না”।

হীরু জিজ্ঞাসা করল, “ও বাবা, চাউর মানে কী?”

সোনা চোখ বড়ো বড়ো করে হীরুকে বললেন, “বড়দের কথায় ছোটদের কথা বলতে নেই, বলিনি হীরু? কিন্তু মা কী ভাববেন? তুমি তো আবার মা-অন্ত প্রাণ। মার অনুমতি ছাড়া একদমই চলো না”। শেষের কথাগুলো তিনি স্বামীকে বললেন।

“আঃ, এখন আবার ওসব কথা পাড়ছো কেন?”

সোনা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, বললেন “পাড়বো না? কোন আমোদ নেই, আহ্লাদ নেই। বিয়ের পর থেকে সেই যে তোমাদের ঘরে পা দিয়েছি, কবার বাপের বাড়ি আসতে দিয়েছে, তোমার মা? তোমার ছোটবোন বছরে তিনবার করে এসে, পনেরদিন করে থেকে যেতে পারে। আর আমি বাপের বাড়ি আসার কথা বললেই, তোমার মায়ের অম্বুবাচী, মলমাস, অশ্লেষা, গাজন, বিপত্তারিণী, মনসাপুজোর ফিরিস্তি মনে পড়ে যায়। গাঁয়ের বৌ-মেয়েদের সঙ্গে দুটো কথাও বলা যাবে না। সর্বদা শুধু কাজ আর কাজ। এই যে আমার দু’দুটো ছেলে হল, কোন ডাক্তার নেই, বদ্যি নেই। গাঁয়ের সেই বুড়ি ধাই ভরসা। ওষুধ বলতে ডেটল আর তুলো। ওসব কথা পাড়বো না মানে?”

ছোট্ট কলু মুড়ি-বেগুনি নিয়ে এসে, নদিদির উত্তেজিত কথায় ভয় পেয়ে, দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল। সুভা ঘরের মধ্যে ঢুকে জামাইবাবুর হাতে মুড়ির বাটি দিতে দিতে বলল, “জাঁইবাবু, আপনার মুড়ি। অ্যাই নদি, চুপ কর, বাবা ওপরের ঘরে শুয়ে আছেন, শুনতে পেলে রাগ করবেন”সুভার কথায় সোনা চুপ করলেন। কিন্তু তাঁর মুখে ক্ষোভ আর রাগের রেশ। অচ্যুত মাথা নীচু করে বাটি থেকে মুড়ি নিয়ে মুখে তুললেন। কলুমাসী হীরুর হাতে ছোট্ট বাটিতে মুড়ি দিতে, সেও বাবার দেখাদেখি মুড়ি খেতে শুরু করল, কিন্তু ভয়ে ভয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকাতে লাগল বারবার। পান্না এতক্ষণ খেলছিল মায়ের কোলে, এখন সে শান্ত, অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মায়ের মুখের দিকে।

সোনার পাশে এসে বসল সুভা, বলল, “দিদি, মুড়ি নে। আমাদের একটাই বাটি”।

“তুই খা। আমি খাবো না”

“নে না দিদি, তোর নাম করে আনলাম। দুমুঠো খা। কলু, মা আরো বেগনি ভাজছে, আরেকটা প্লেট নিয়ে এসে বস না, ভাই”। কলু ছোট্ট পায়ে দৌড়ে গেল, ও বাড়ির দিকে।

অচ্যুত বেগুনিতে কামড় দিয়ে বললেন, “মুড়িটা বেশ মাখা হয়েছে, একটু খেয়ে দেখো নাআর বলছিলাম কী, এই সব কারণের জন্যেই তো কলকাতায় গিয়ে থাকতে চাইছিমাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখো, আর পুরোনো কথা ভুলে গিয়ে ছেলে দুটোর কথাও ভাবো”।

“কলকাতায় আমি যাবো না। আমি জানি, কলকাতায় গিয়ে আমরা থাকতে শুরু করলেই, তোমার মা, সেখানে গিয়ে ঠিক নাকে কান্না শুরু করবে। তুমি বাড়ির বড়বৌ, সংসারের লক্ষ্মী, তোমাকে ছাড়া চলবে কী করে, মা? আর তুমিও তখন গলে গিয়ে বলবে, তাহলে ফিরেই চলো, মা যখন এমন করে বলছেন। এসব ধ্যাষ্টামোর মধ্যে আমি নেই। যেতে হয় তুমি তোমার ছেলেদের নিয়ে, কলকাতায় যাও, আমি থাকবো আমার কপাল নিয়ে আর শাশুড়ির সেবা নিয়ে”।

হীরুর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ধ্যাষ্টামোর মানে কী জানার, কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে চুপ করেই রইল।

অচ্যুত বললেন, “কী যে বলো তার ঠিকানা নেই, আমি থাকবো ছেলেদের নিয়ে কলকাতায়, আর তুমি থাকবে গাঁয়ে? এ কখনো হয় নাকি? পরশুদিন আমি কলকাতায় ফিরে বাসা ঠিক করে ফেলবো কদিনের মধ্যেই। তারপর গোছগাছ করে, তোমাদের নিয়ে যাবো মাসখানেকের মধ্যে। জানুয়ারির মধ্যে সব স্কুলে ভর্তি শুরু হয়ে যায় এ বছরে ভর্তি না করতে পারলে এক বছর বসে থাকতে হবে। হীরুর অকারণ একটা বছর নষ্ট হবে। হাতে এখনো মাস দুয়েক সময় আছে ঠিকই, কিন্তু যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে”।

সোনা স্বামীর চোখে চোখ রেখে একমুঠি মুড়ি মুখে তুললেন। হীরু মায়ের মুড়ি নেওয়া দেখে, এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত হল, সে একটুও দেরি না করে বলল, “ও মা, চলো না গো, কলকাতা চলো না”।

হীরুর দিকে তাকিয়ে সোনা বললেন, “কলকাতায় গিয়ে স্কুলে পড়বি”?

মস্ত ঘাড় নেড়ে হীরু বলল, “হ্যাঁ”।

সোনা পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, “সেখানে কিন্তু তেঁতুলতলা নেই, দে’দের পুকুর নেই, সামন্তদের ছেলেদের সঙ্গে ছাগল চড়ানো নেই...”।

হীরু মায়ের কথায় একটু দ্বিধায় পড়ল, কলকাতা জায়গাটা তবে কেমন? সেখানে কী স্কুল ছাড়া আর কিছুই নেই? সোনা ছেলের পিঠে হাত রেখে বললেন, “তা নাই বা থাকল, সেখানে কালীঘাট আছে, জাদুঘর আছে”।

অচ্যুত বললেন, “গড়ের মাঠ আছে, শিবপুর বোটানিক গার্ডেন আছে, যত গাছ চাইবি, সব আছে”।

“সেখানে তেঁতুল গাছ আছে?” হীরু নিশ্চিত হবার জন্যে বাবাকে জিজ্ঞাসা করল।

অচ্যুত বললেন, “আছে বৈকি। তেঁতুল গাছ ছাড়া আবার বাগান হয় নাকি”? হীরুর পিঠের ওপর অচ্যুতও হাত রাখলেন, তাঁর হাতের স্পর্শ লাগল সোনার হাতে। সোনা চোখ তুলে, লাজুক দৃষ্টিতে তাকালেন স্বামীর দিকেঅচ্যুত সোনার উষ্ণ হাতে হাল্কা চাপ দিতে, সোনার অধরে ফুটে উঠল হাল্কা হাসি, তিনি বললেন, “দুউরিতে আমার অনেক জিনিষ রয়ে গেল যে, সেগুলোর কী হবে”?

“কোথায় আছে? তোমার ট্রাঙ্কে তো? সে আমি পরে কোন সময় গিয়ে নিয়ে আসবো, ভেবো না। আগে তো কলকাতার বাসায় গিয়ে থিতু হই”

হীরু এখন নিশ্চিন্ত, কারণ মা আর রেগে নেই, মা এখন প্রসন্নমুড়ি খেতে খেতে সে জিজ্ঞাসা করল, “ও মা, ধ্যাষ্টামো কী?” হীরুর এই কথায় সোনা ছাড়া সবাই হেসে উঠল, অচ্যুত এমন কি সুভা, কলুও!

সোনা অপ্রস্তত হয়ে বললেন, “চুকঃ, পাকা ছেলে। বলেছি না, বড়দের সব কথায় থাকতে নেই? শুনছো, বাসা যে নেবে বলছো, একটা ঠাকুরঘর যেন থাকে। আর ছোট একটা বারান্দা বা উঠোন, সেখানে আমি তুলসী নয়নতারা, সন্ধ্যামণি, বেলিফুলের গাছ লাগাবো”।

স্ত্রীর এই কথায় অচ্যুত একটু হাসলেন, কিছুটা মলিন আর করুণ হাসি, বললেন, “দেখি কী হয়। বড়ো বাসার বেশি ভাড়া সে তো বুঝতেই পারছো। আমি ভেবেছিলাম, একটা বসার ঘর, একটা শোবার ঘর, রান্নাঘর, কলপাইখানা, চানের ঘর। এরই ভাড়া হবে মাসে আশি-একশ টাকা। আর তুমি যেমন বলছো, তেমন হলে দেড়–দুশোর কমে হবে না”।

“আচ্ছা, আচ্ছা সে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, যেমন আমাদের সাধ্যে কুলোয় তেমনই নাও, আমি কিন্তু নিজের মতো করে সাজিয়ে নেবো”।

অচ্যুত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, “নিও। তার আগে সংসারের জিনিষপত্র তোমার কী কী লাগবে, আমায় ফর্দ করে দিও। বাসা ঠিক হয়ে গেলে, আমি কিনেটিনে, গোছগাছ করে সব রেখে আসবো, তোমাদের নিয়ে যাবার আগেই”।

“ফর্দ করার কী আছে? আর অত কেনাকাটা করারই বা...”

বলতে বলতে সোনা থমকে গেলেন। এতক্ষণে তাঁর মনে হল, তাঁকে নতুন করে সংসার পাততে হবে, শুরু করতে হবে শূণ্য থেকে। বিয়ের আগে এ বাড়িতে বাবা-মায়ের সংসারে তাঁকে কোনদিন এসব নিয়ে ভাবতে হয়নি। বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়ি গিয়েও শাশুড়ির সাজানো একটা সংসারই পেয়েছিলেন, সে সংসার তাঁর বাপের বাড়ির থেকে হয়তো একটু আলাদাকিন্তু এখন তাঁকে নিজের হাতেই সব গড়ে নিতে হবে। তাঁর মাথার ওপরে স্নেহময়ী মা কিংবা অভিজ্ঞা শাশুড়ি মায়ের কোন হাত থাকবে না, সে শাশুড়ি মা যতই কটকটি হোন না কেন! তিনি এবার কল্পনা করতে পারলেন। চোখের সামনে যেন স্পষ্ট দেখতে পেলেন, কলকাতার রিক্ত বাসায় তিনি একলা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর একহাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে আছে হীরু, আর তাঁর কোলে পান্না। স্বামী বেরিয়ে গেছেন আপিসে, সন্ধেয় তিনি ফিরে আসবেন ক্লান্ত হয়ে, যেভাবে পাখিরা বাসায় ফেরে নিশ্চিন্ত কুলায়।

কলকাতায় বাসা নিয়ে থাকা, সংসার সামলানো, জ্বরজারি, বিপদআপদ, বড়ো হতে থাকা ছেলেদের বেড়ে ওঠা দৌরাত্ম্য, তাদের লেখাপড়া, ভালো-মন্দ, সব কিছু এখন থেকে তাঁকেই সামলাতে হবে। ওই বাসায় তাঁর পাশে স্বামী ছাড়া থাকবে না আর কেউদুই সন্তানের জননী এই যুবতী, পরিপূর্ণ ‘গিন্নিবান্নি’ হয়ে উঠেছেন ভেবে, নিজের মনে এতদিন বেশ তৃপ্তি পেতেন। আজ এই প্রথম তিনি অনুভব করলেন পরিপূর্ণ গৃহিণীর দায়িত্ব তিনি কোনদিন জানতেই পারেননি। সে দায়িত্ব প্রথম আজ উপলব্ধি করলেন। এই দায়িত্বর কথা ভেবে তিনি ভয় পেলেন না, বরং উদ্গ্রীব হয়ে উঠলেন কলকাতার বাসায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে।

সোনা ছোট বোন কলুকে বললেন, “অ্যাই কলু, যা তো দাদার থেকে একটা কাগজ আর কলম নিয়ে আয়। তোর জাঁইবাবুকে একটা ফর্দ বানিয়ে দি”।

 দিদির আদেশে কলু আবার ছুটল বড়দার ঘরে। বড়দা লন্ঠন জ্বেলে তখন খাতা দেখছিলেন। ছাই ফেলার বাটিতে জমে উঠেছে অনেক পোড়া সিগারেট। ছোট্ট বোনকে আদর করে তিনি বলেন, কলু, পেঁয়াজ কলি। তাকে দৌড়ে আসতে দেখে হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হয়েছে রে, পেঁয়াজ কলি?”

খুব গম্ভীর মুখ করে কলু বলল, “নদিদি একটা কলম আর কাগজ চাইল”।

টেবিলের ড্রয়ার থেকে কলম বের করতে করতে তিনি বললেন, “কেন রে? তোর ন’দিদি কাগজ-কলম নিয়ে কী করবে?”

“বা রে। কলকাতার বাসার জন্যে ফর্দ লিখবে না?” দিস্তা কাগজ থেকে একটা রুলটানা কাগজ আর কলমটা কলুর হাতে দিয়ে দাদা হাসলেন, কলুর নাকটা হালকা টিপে দিয়ে বললেন, “তাই? তুই সব বুঝে গেছিস? পাকা বুড়ি?” কলু আগের মতোই দৌড়ে চলে যেতে তিনি স্বস্তির শ্বাস ফেললেন, মুখে তাঁর মৃদু হাসি।

 

..০০..                                                       

 

পরের পর্ব "মা হওয়া নয় মুখের কথা"

রবিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৫

মুখে নেই রা

 

 ২১/৭/২৫ তারিখে প্রকাশিত "লিটিং লিং - শেষ পর্ব"-এর পরে...


প্রথমেই লেবু চিনির সরবৎ, সঙ্গে দুটো দুটো মণ্ডা আর রসগোল্লা খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে না নিতেই স্নান করার নির্দেশ এল। সোনার দাদা খুব গোপন কোন কথা বলার মতো, ভগ্নীপতি অচ্যুতকে বললেন, “ভায়া, দুপুর গড়িয়ে চলেছে। কলতলায় তোমার চানের জল ধরা আছে। তেল, সাবান, নতুন গামছাও রাখা আছে, আজকে নমো নমো করে চানটা সেরে ফেল। বেলা থেমে থাকে না ভাই, এরপর খেতে খেতে বিকেল হয়ে যাবে”

এ বাড়ির জামাই অচ্যুত মুকুজ্জে, কথাটা মেনে নিলেন, কারণ, তাঁর অপেক্ষায় সকলে অভুক্ত রয়েছেন। শ্বশুরমশাই, দাদা, বাড়ির মেয়েরা সব্বাই।

টিউবওয়েলের বাংলা নাম টেপাকল। শীতকালে টেপাকলের জলের শীতলতা একটু কমই হয়। তারওপর সারা দিনের রোদ্দুর আর সারা পথের ধুলো মাখা অবস্থায়, সদ্য মোড়ক খোলা সুবাসিত গ্লিসারিন সাবান আপাদমস্তক মেখে চান করে বেশ তৃপ্তিই বোধ করলেন অচ্যুত। নতুন গামছায় গা মুছে, বালিকা ছোট শ্যালিকার বাড়িয়ে দেওয়া কাচা ধুতি, বেনিয়ান আর চাদর গায়ে দিয়ে চুল আঁচড়ে যখন আবার দাওয়ায় এসে দাঁড়ালেন, শরীরে তেমন আর কোন ক্লান্তি বোধ হচ্ছিল না।        

ভেতরের ঘরের দাওয়ায় সবাই তাঁর অপেক্ষাতেই ছিলেন। শ্বশুরমশাই অনাদি চাটুজ্জে, জামাইকে দেখে রান্নাঘরের দিকে হাঁক দিলেন, “কই গো, তোমাদের হলো? এসো বাবা, এসো। বাবাজীবন কখন থেকে অপেক্ষা করছে, আর কত বেলা করবে?”

দাওয়ায় তিনটে আসন বিছানো। চটের ওপর রঙীন সুতোয় হাতে বোনা আসনসেই আসনের সামনে দাঁড়িয়ে অচ্যুত বললেন, “বাঃ, এই আসনগুলো বেশ তো! কে বুনেছে, দাদা”?

“আসনগুলো? ও সব আমাদের মণি আর সুভোর বোনা। ভাল বুনেছে না? কলু, কটা আসন সোনাকে দিয়ে দিস তো – জামাইবাবু বসবে”

অচ্যুত কিছু বললেন না, একটু হাসলেন। দেয়ালের দিকে তিনটে আসন পাশাপাশি একটু ফাঁক ফাঁক করে পাতা। মাঝের আসনটাই সব থেকে সুন্দর। নীল জমির মাঝখানে সবুজ গা, লাল ঠোঁটের শুক-সারি পাখি, মুখোমুখি বসে। তাদের মাথার ওপরে হলুদে লেখা “শাসন করা তারই সাজে” আর তাদের পায়ের নীচেয় “সোহাগ করে যে”ওপাশের আসনের মাঝখানে তাজমহলওপরে লেখা “তাজমহলের মর্মরে গাঁথা” আর তার ভিতের পাথরে “কবির অশ্রুজল”এ পাশের আসনেও শুকসারি পাখি, ওপরে লেখা “সংসার সুখের হয়” আর পাখিদের পায়ের নীচে “রমণীর গুণে”

বৌদি দুহাতে ধরে সাজানো ভাতের বিশাল কাঁসার থালা নিয়ে, মাঝের আসনের সামনে রেখে বললেন, “ঠাকুরজামাই বসুন, সেই কোন কাকভোরে বেরিয়েছেন, নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে খুব”

বৌদির পিছনে সুভা আর কলু, কিশোরী আর বালিকা দুই ননদের হাতেও বড়ো বড়ো সাজানো ভাতের থালা। সুভার হাত থেকে থালা নিয়ে ডান দিকের আসনের সামনে রেখে বললেন, “বাবা, বসুন”তারপর বাঁদিকের আসনের সামনে অন্য থালাটি রেখে কিছু বললেন না, চোখ তুলে তাকালেন দাদার দিকে।

সকলেই নির্দিষ্ট আসনে বসলেন। অনাদি জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “শুরু করো বাবা”কাঁসার গেলাসের থেকে হাতে জল নিয়ে গণ্ডুষ করলেন, তারপর বাকি জলে ঘিরে ফেললেন ভোজন পাত্র। অন্ন এবং অন্যান্য ভোজ্যের সামান্য অংশ পাঁচ আঙুলের ডগায় তুলে নিয়ে, মনে মনে মন্ত্র পড়ে থালার ডানদিকে মাটিতে উৎসর্গ করলেন, পঞ্চদেবতা ও পিতৃপুরুষদের। তারপর ভাতের কোল ভেঙে শুরু করলেন আহার।

শাকভাজা মেখে একগ্রাস ভাত মুখে নিয়ে অনাদি বললেন, “এই অবেলায় স্বল্প আহারই ভাল, বুঝেছ বাবা? অনিয়ম হয়ে গেল না? এই তো দেখ না, খেয়ে উঠতে উঠতেই বেলা শেষ হয়ে যাবে। শীতের বেলা, এই আছে এই নেই। আজকাল ডাকের যে কী গণ্ডগোল হয়েছে, কি বলবো বাবা। পাঁচদিন আগে লেখা তোমার চিঠিটা, আমরা হাতে পেলাম সবে কালকে। চিঠিটা পেয়ে কী আনন্দ যে হল, সে আর বলার কথা নয়। কিন্তু চিন্তা করো, চিঠিটা কাল যদি না পেতাম? আজকে তোমাদের কী আতান্তরেই না পড়তে হতো! তোমাদের কী খাওয়াতাম, কী করতাম! কোথায় বসাতাম! যাই বলো আর তাই বলো, বারো-তেরো বছর হতে চলল দেশ স্বাধীন হয়েছে, উন্নতির জায়গায় সবদিকে অবনতিই হয়েছে বলবো। থাকত আজ গোরা সায়েবরা, চাবকে ঠিক সোজা রাখতো আমাদের”।

দাদা এবং অচ্যুত খাচ্ছিলেন, কেউ কোন কথা বললেন না। অনাদি কিছুক্ষণ চুপ করে খাওয়ার পর আবার বললেন, “হ্যারে সুভা, বিকাশ আর তনু কোথায় গেল রে? দেখছি না?” বড়ো থালায় ছটা বাটি - তিনটেয় ভাজা সোনামুগের ডাল, আর তিনটেয় মাছের ঝোল নিয়ে সুভা রান্নাঘর থেকে অতি সন্তর্পণে উঠোন পার হয়ে আসছিল। বাবার ডাকে সাড়া দিয়ে বলল, “ওরা হাজরা পুকুরে নাইতে গেছে, বাবা”অনাদি আদর করে তাঁর কন্যাদের নিজস্ব নামে ডাকেন, মণিদিদিকে তনু, নদিদির ডাকনাম যদিও সোনা, উনি ডাকেন বিকাশ! 

“বাড়িতে টেপাকল থাকতে, এই অবেলায় আবার পুকুরে গেল নাইতে? এদের কাণ্ডকারখানার বোঝা দায়! হীরুকে নিয়ে যায়নি তো?”

“গেছে তো! হীরু খুব বায়না করছিল, তাই মণিদি বলল, চলুক না, কিচ্ছু হবে না”

“কিচ্ছু হবে না কি রে? ছোট ছেলে, অবেলায় পুকুরে চান করে, জ্বরজারি বাধিয়ে বসলে?”

 

এতক্ষণ রান্নাঘরে আড়ালেই ছিলেন, ষোড়শীবালা, অচ্যুত মুখার্জির শাশুড়িমা। প্রৌঢ়া, একটু পৃথুলা গড়ন, ধবধবে ফর্সা রঙ। সমস্ত শরীরে ও মুখশ্রীতে মাতৃভাব। সামনে জামাই রয়েছে, তাই মাথায় বড়ো ঘোমটা টানা। ছোট্ট পান্নাকে কোলে নিয়ে তিনি উঠোন পেরিয়ে এসে দাওয়ায় বসলেন, বললেন, ““অত ব্যস্ত হয়ো না তো! অ সুভা, জামাইবাবুকে দুটো ভাত দিয়ে যা, মা। কলু, জামাইবাবুকে আর এক টুকরো লেবু দে না, মা। ডাল দিয়ে মেখে খেতে ভালো লাগবে”

শাকভাজা শেষ করে, অনাদি ফুলকপির তরকারি দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললেন, “পান্না কি ঘুমোচ্ছে”?

কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমোনো পান্নার মুখের দিকে তাকিয়ে ষোড়শীবালা বললেন, “হ্যাঁ। কেমন অবাক ছেলে বলো দিকি। অচেনা মুখ, অচেনা জায়গা, অচেনা কোল, তবু এতটুকু কান্না নেই গা”? সুভা আর কলুর কাছে, ছোট্ট এই ছেলে যেন জ্যান্ত এক পুতুল।

কলু খুব উত্তেজিত গলায় বলল, “জানো বাবা, পান্না আজকেই প্রথম ঝিনুকে দুধ খেল। গলায় দুধ নিয়ে গলগল করে আওয়াজ তুলছিল, আর ঢোঁক গিলেই সে কি হাসি!”

“তাই নাকি?” পান্নার দাদামশাই হাসলেন ঘুমন্ত পান্নার দিকে চেয়ে। তাঁর দুচোখে ভালোবাসা আর মায়া।

পান্নার দিদিমা মুচকি হেসে নাতির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে, স্নেহার্দ্র স্বরে বললেন, “তাই না তাই, এ যেন সেই “মুখে নেই রা, পব্বতে মারে ঘা”

ফুলকপির তরকারি শেষ করে নতুন ভাত ভাঙলেন অনাদি, তাতে মাছের ঝোল ঢেলে বললেন, “দুটো ভাত দে দেখি সুভা, মা। ঝোলটা বেশি হয়ে গেল। বাবা অচ্যুত, সোনা আমাদের খুব ভেতরবুঝো আর মনটা মায়া-দয়ায় ভরা, জানলে বাবা? তোমার ছেলেদুটি একদম রত্ন হবে, এ আমি তোমায় বলে রাখলাম, পরে মিলিয়ে নিও”বাবাকে বেশ খানিকটা ভাত দিয়ে, সুভা জামাইবাবুকেও ভাত দিতে এসেছিল, জামাইবাবু দু হাতে পাত আড়াল করে হাঁ হাঁ করে উঠলেন, বললেন, “আর একটাও ভাত নিতে পারবো না, সুভা”

কিশোরী সুভা হেসে বলল, “সে কী, জাঁইবাবু? আপনি তো কিছুই খেলেন না”

ষোড়শীবালা পিছন থেকে বললেন, “থাক থাক, এই অবেলায় আর জোর করিসনি, বাছা। বরং চুনো মাছের অম্বল আর পায়েসটা নিয়ে এসো, বৌমা”

“কী সর্বনাশ, এর পরে আবার পায়েস?”

ষোড়শীবালা অচ্যুতের এই কথায় একটু বিরক্ত হলেন, “ও আবার কী কথা, বাবা? খাওয়াতেও সর্বনাশ? তোমাদের আজকালকার ছেলেছোকরাদের কথাবার্তায় কোন ছিরিছাঁদ নেই বাপু”

অপ্রস্তুত অচ্যুত পাশে বসা দাদার দিকে তাকালেনদাদা চোখের ইশারায় মুচকি হেসে খেতে খেতেই বললেন, “পায়েস না খেলে কী আর আয়েস হয়, ভায়া?”

 

 খাওয়া দাওয়ার পর দাদা নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন অচ্যুতকে। বিছানায় বসে জিজ্ঞেস  করলেন, “পান খাবে নাকি? জোয়ান বা সুপুরি-টুপুরি কিছু”?

“নাঃ”

“কাঁচি চলে?” দাদার হাতে সিজার্স সিগারেটের প্যাকেট।

লাজুক হেসে অচ্যুত বললেন, “কলকাতার মেসে দু একদিন টেনে দেখেছি, তেমন মজা পাইনি”

“আরে নাও, নাও। ব্যাটাছেলের এক আধটা নেশাভাং না হলে ঠিক মানায় না”

“আচ্ছা দিন, বলছেন যখন”

দুজনেরই ঠোঁটে সিগারেট। কেরোসিনের লাইটারে খচ খচ চার পাঁচবার ফ্ল্যাশ দেওয়ার পর জ্বলল। অচ্যুতর সিগারেট জ্বালিয়ে, দাদা নিজেরটা ধরালেন। সিগারেট ধরানো আর প্রথম টানেই বোঝা গেল, অচ্যুত নেশার পথে নেহাতই নাবালক।

সিগারেটে দুটো টান দেওয়ার পর অচ্যুত বললেন, “আচ্ছা, আমার কথায় তখন মা খুব বিরক্ত হয়েছেন, না?”

“কিসের কথায়? অ, ওই “সর্বনাশ”? ছাড়ো না ভায়া, আমাদের কথাবার্তার ধরনে বাবা-মায়েরা অমন প্রায়ই বলেন। “আজকালকার ছোকরাদের কথাবার্তায় কোন মাথামুণ্ডু নেই”। “আমাদের সময় বাপু এমন ছিল না”। “কালে কালে কত যে দেখবো”? হা হা হা হা, সব কথায় কান দিলে চলে?”

“আরেকটা কথা কী যেন বললেন, মুখে নেই রা...”

“হা হা হা হা, ওটা একটা কথার কথা - প্রবাদ। আমার মা হচ্ছেন বাংলা পরিভাষা আর প্রবাদের আকরকথাটা হচ্ছে, “মুখে নেই রা, পর্বতে মারে ঘা”কেউ কেউ কথা কম বলে, কিন্তু কাজে হয় খুব দড়, একদম পাহাড়ে গিয়ে যেন ঘা মারে...হা হা হা হা। কদিন থাকো না ভায়া...”, শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা তোবড়ানো শানকির বাটিতে চেপে নিভিয়ে ফেলে দিলেন, তারপর আবার বললেন, “...আরো অমন কত জেনে যাবে! অসিতবাবু, নীহারবাবু, সুকুমারবাবু আর কটা সংগ্রহ করেছেন? তাঁরা যদি আসতেন আমার মায়ের কাছে”!

অচ্যুত হাসলেন, কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, “আপনার সঙ্গে একটা পরামর্শ আছে, দাদা”

অচ্যুতের বলার ভঙ্গিতে দাদা একটু উদ্বিগ্নই হলেন, বললেন, “কী ব্যাপার বলো, তো?”

“আমি ওদের নিয়ে এবার কলকাতায় যাবো ভাবছি”

“কাদের নিয়ে?”

“ওদের, মানে আপনার বোন, আর ছেলেদের নিয়ে”

“তা সে যাও না, পরিবার নিয়ে কলকাতায় যাবে, সে তো খুবই আনন্দের কথা। মাস খানেক থেকে জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, কালীঘাট, ভিক্টোরিয়া, দক্ষিণেশ্বর – সে তো ভালোই হবে। কিন্তু পান্নাটা একেবারেই কচি ছেলে, হীরুই বা কী এমন বড়ো, তোমারও আপিস, সোনা একা সামলাতে পারবে কী”?

“কদিনের জন্যে নয় দাদা। বাসা নিয়ে কলকাতাতেই থাকবো”

দাদা অচ্যুতের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, “সে তো আমার বোনের সৌভাগ্য। কিন্তু হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন? তুমি বাড়ির বড়ো ছেলে, গ্রামের বাড়িতে তোমার বিধবা মা রয়েছেন, ভাইয়েরা রয়েছে, জমিজিরেত, চাষবাস রয়েছেকলকাতার বাসায় থেকে এসব সামলাতে পারবে? তাছাড়া, কিছু মনে কোর না, অচ্যুত, বড়দাদা হিসেবেই বলছি, কলকাতায় বাসা ভাড়া দিয়ে সংসার চালানো, দুটো বাচ্চা, দায়দৈব, জ্বরজারি, তাদের লেখাপড়া, বইখাতা, স্কুল। খরচের ব্যাপারটাও ভেবে দেখেছো তো?”

মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন অচ্যুত, তারপর মুখ তুলে বললেন, “ভেবেছি, দাদা। আমাদের এমন কিছু জমিজিরেত নেই, যার জন্যে সব ভাই মিলে গ্রামে পড়ে থাকতে হবে, সে কথা আপনি জানেন, দাদা। আর কলকাতায় বাসা ভাড়া করে সংসার চালাতে খরচ তো হবেই, ঘাটতি যেটুকু হবে, সেটা সকাল বিকেল টিউশনি করে সামলে নিতে পারবো”

“হুঁ, সব দিক চিন্তাভাবনা করেই ফেলেছো? আমার মা বলেন, তাঁর সকল জামাইয়ের মধ্যে, তুমিই নাকি সব থেকে বিচক্ষণ আর জ্ঞানী”মৃদু হেসে দাদা আরো বললেন, “তা তোমার মাথায় হঠাৎ এমন চিন্তা এল কী করে? আমি তো জানতাম, তুমি বেশ মাতৃভক্ত এবং মাকে বেশ ভয়ও পাও। তাঁকে আড়াল করে, এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে চলেছ! সোনা জানে, সোনাকে বলেছ?”

“না দাদা, কেউই জানে না। কলকাতায় ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে দু’একজন জানে, তাদেরকেই বলে রেখেছি, একটা বাসা দেখে রাখতে। আত্মীয়দের মধ্যে আপনাকেই প্রথম বললাম। এ বিষয়ে আপনার মতামতটা ভীষণ জরুরিকারণ, ভালো মন্দ যাই হোক না কেন, আপনার বোনের ভবিষ্যত আমার সঙ্গেই তো জড়িয়ে? আর এই সিদ্ধান্তটাও হঠাৎ নয় দাদা, বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছি। হীরুর স্কুলে যাবার বয়েস হয়ে এল, দাদা। আমাদের গ্রামের স্কুলে ওকে পড়াতে চাইছি না। কলকাতার ভালো স্কুলে পড়ে, ভালোভাবে মানুষ হয়ে উঠুক, এটাই আমার স্বপ্ন”

“এ কথাটা আমি মানতে পারলাম না, ভায়া। কলকাতায় লেখাপড়ার পরিবেশ ভালো মানছি, কিন্তু গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করে অমানুষ হয়...তুমি আমি কি অমানুষ হয়েছি বলতে চাও”?

অচ্যুত হেসে ফেললেন, মাথা নেড়ে বললেন, “না, না, আমি ওভাবে কথাটা বলিনি, দাদা। আমার স্বপ্ন হীরু ডাক্তার হোক। গ্রামের স্কুল থেকে পড়ে কেউ কোনদিন ডাক্তার হয়নি, তা নয় দাদা। কিন্তু কলকাতার পরিবেশে সেটা অনেক সহজ হয়ে যায়, সেটা তো মানবেন?” দাদা কিছু বললেন না, তাকিয়ে রইলেন অচ্যুতের দিকে, তাঁর মুখে মৃদু হাসির রেশ।

বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা না বলায় অচ্যুত একটু অধৈর্য হয়ে উঠলেন, হাসতে হাসতে বললেন, “কী হল? হাসি হাসি মুখে কী দেখছেন বলুন তো”?

এ কথার উত্তরে দাদা হাসি মুখে বললেন, “দেখছি হে, দেখছি। মুখে নেই রা, পব্বতে মারো ঘা। কথাটা তোমার পক্ষেও দিব্বি খেটে যায়”

“তার মানে?”

হা হা করে হেসে উঠলেন, দাদা। তারপর বললেন, “বেশি কথা-টথা বলো না, কিন্তু নিজে নিজেই বেশ কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ! আজকালকার ছোঁড়ারা এটাকেই বলে চ্যালেঞ্জ! ওই দ্যাখো, আমিও একাল-সেকাল বলতে আরম্ভ করেছি”একটু থেমে থেকে আবার বললেন, “স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি, অচ্যুত। কিন্তু স্বপ্নটাকে সত্যি করে তোলাটা যে একটা চ্যালেঞ্জ, সেটা ভাবি না। যতটুকু সাধ্য, আমার সাহায্য তুমি চিরদিন পাবে। কিন্তু সবার আগে সোনার সঙ্গে তোমার কথা বলা উচিৎ। যত শিগ্‌গির হয়, সম্ভব হলে আজই। তোমার এই কঠিন ব্রতে ওই হবে তোমার একমাত্র নিত্য সঙ্গী, ওর মতামতকে অবহেলা করো না”

 

..০০..

    

  পরের পর্ব "সংসার সুখের হয়"     

  

    

       

 

     

                  

               

নতুন পোস্টগুলি

গেলেম নতুন দেশে

  এতদিন স্কুল আর বাড়ি, বাড়ি আর স্কুল - এই নিয়ে চলছিল আমার রুটিন বদ্ধ জীবনযাত্রা। ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পার করে, টেস্ট হয়ে স্কুল ছুটি ...