রম্য রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রম্য রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রবিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৫

বকের মৃত্যু

 

[এর আগের পর্ব পড়া যাবে এই সূত্রে 👉 "বাংলাদেশের হৃদয় হতে"]

 

শীতের এক ছুটির দুপুরে, পাড়ার গলিতে ক্রিকেট খেলার সময় শেখরদা এসে একদিন বলল, অ্যাই আমিও খেলব তোদের সঙ্গে, আমায় খেলতে নিবি? কিছুদিন ধরেই আমরা শেখরদাকে দেখছিলাম। পাড়ার কেউ না হলেও, এ পাড়ায় শেখরদার অনেক বন্ধু আছেতাদের বাড়িতেই শেখরদা থাকে। ওর বাড়ি কোথায়, বাড়িতে কে কে আছে, কিছুই জানতাম না। শুধু জানতাম শেখরদা প্রেসিডেন্সিতে পড়ত, এখন আর পড়ে না। পড়া ছেড়ে দিয়েছে, কারণ প্রেসিডেন্সি কলেজ, বুর্জোয়াদের কলেজ। এই বুর্জোয়ারা কে, তাদের খায় না মাথায় মাখে তখন বুঝিনি। বেশ কদিন আলাপের পর আরও জেনেছিলাম, আমরাও যে সব স্কুলে পড়ি, পরীক্ষা দিই সে সবও বুর্জোয়াদের শিক্ষা।

ক্লাস সেভেনের ছাত্র হলেও, এইসব তথ্য জেনে যেমন আশ্চর্য হয়েছিলাম তেমন বিচলিতও হয়েছিলাম। তার মানে আমরা এতদিন যা কিছু পড়লাম, শিখলাম, সব ভুল? শেখরদা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেছিল, ভুল। তাহলে সঠিক লেখাপড়া কবে শুরু করব? আমার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে শেখরদা হেসে বলেছিল, তোদের জন্যেই তো আমরা লড়ছি, আমাদের ভুলটা যেন তোরা শুধরে নিতে পারিস। এখন যা, বল কর দেখি, মনের সুখে তোকে একটু পেটাই।

এর কয়েকদিন পরে সক্কালবেলা পল্টু এসে চুপিচুপি খবর দিল শেখরদার লাশ পড়ে গেছে বড়ো রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানের সামনে রাস্তায় পড়ে আছে শেখরদার লাশ

কে মারল শেখরদাকে, কেন?

তুই জানিস না, শেখরদা তো নকশাল ছিল।

নকশাল? শেখরদা নকশাল ছিল?

পল্টু আমার অজ্ঞতায় বিরক্ত হয়ে বলল, “হ্যাঁরে বাবা, নকশাল। রোজই ভোরে শেখরদা যেমন চা খেতে যায়, হারাণদার চায়ের দোকানে, আজও গিয়েছিল। বিশাল বস্তা নিয়ে একটা কাগজকুড়ুনে লোক শেখরদার পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা কাগজ তোলার জন্যে আচমকা নীচু হওয়াতে, শেখরদা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। লোকটা কাগজ কুড়িয়ে যখন সোজা হয়ে দাঁড়াল, তার হাতে গুলিভরা রিভলভার। দুটো গুলি, ঢিচিকাঁউ ঢিচিকাঁউ, ব্যস শেখরদা পড়ে গেল রাস্তায়, সব শেষ।

কাগজকুড়ুনে লোকটা কেন মারল শেখরদাকে?

তুই একটা আস্ত গাধা, ও কি আর সত্যি সত্যি কাগজকুড়ুনে? ও নিশ্চয়ই ছদ্মবেশে খোচর ছিল। 

খোচর?

তুই দেখছি কিছুই জানিস না, প্লেন ড্রেসের পুলিশের ডিটেকটিভকে খোচর বলে। আমাকে দাদা বলেছে। শেখরদার বাড়ি নাকি কসবার দিকে, এখানে লুকিয়ে ছিলপুলিশের খোচর অনেকদিন ধরেই ওকে খুঁজছিল। আজ পেয়ে যেতেই, শেষ করে দিল। 

শেখরদাও নকশাল! নকশালরা তো পুলিশ মারে, স্কুলের টিচারদের মারে। গ্রামের বড়োলোকদের মারে। আমাদের স্কুলের সামনে কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর আর আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মূর্তির মাথা ভেঙে দেয়আবার অনেক নকশাল জেলে বসে হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষা দিয়ে, খুব ভালো রেজাল্টও করে। শেখরদার চেহারা, তার হাসি, আমাদের সঙ্গে তার কয়েকদিন ক্রিকেট খেলার কথা সব মনে পড়ে গেল।  মনে পড়ল, শেখরদার সেই কথা “তোদের জন্যেই তো আমরা লড়ছি, আমাদের ভুলটা যেন তোরা শুধরে নিতে পারিস”শেখরদাও অন্য নকশালদের মতো পুলিশ মেরেছে? স্কুলের টিচার মেরেছে? সেটাই কি তাহলে আমাদের জন্যে লড়াই? পুলিশদের মেরে ফেলতে পারলেই বুঝি আমাদের ভুল বুর্জোয়া শিক্ষা ঠিকঠাক হয়ে যেতে পারত? 

আরো অবাক হয়েছিলাম আমার প্রিয় বন্ধু পল্টুর ব্যবহারে এবং কথাবার্তায়। আমাদের খেলার সঙ্গী হিসেবে শেখরদা পল্টুরও খুব প্রিয় ছিল, সেই শেখরদার আচমকা এই মার্ডার হওয়াটা পল্টু কি ভাবে বলতে পারল ‘লাশ পড়ে যাওয়া’, যেন জলভাত ব্যাপার! আসলে সে সময় আমাদের আশেপাশে এরকম মৃত্যুর ঘটনা এত ঘটতে থাকত, শেখরদার মার্ডারটা সেই সংখ্যায় আরেকটা সংযোজন ছাড়া যেন কিছুই নয়। আমার চেয়ে অনেক বেশী বাস্তববোধ সম্পন্ন পল্টুর মনে এই ঘটনা কোন আঁচড়টুকুও কাটতে পারেনি। যদিও শেখরদার হত্যা আমার বালকমনে বেশ ধাক্কা দিয়ে গেল। অজস্র প্রশ্নের উত্তর আজও সঠিক জানা হয়ে উঠল নানকশাল হয়ে যাওয়া এবং খোচরের গুলিতে মৃত শেখরদা ছাড়া আর কে দিতে পারে এই সব প্রশ্নের সঠিক জবাব?   

সেই সময় রাজনৈতিক পালাবদলের সমস্ত ঘটনা যে ঠিকঠাক বুঝতাম তা নয়। কিন্তু আমাদের জীবন যাত্রায় তার প্রভাব ছিল নিরন্তর। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৭ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাস ভাঙনের ইতিহাস। অস্থিরতা আর নীতিহীন রাজনৈতিক ক্ষমতাদখল আর স্বার্থের ইতিহাস। হরতাল, বাংলাবন্ধ ছিল নিত্য সঙ্গী। আমাদের স্কুলের জানালা থেকে কলেজস্ট্রিটের ওপর কতদিন যে ট্রাম বাস জ্বলতে দেখেছি তার হিসেব বলা মুশকিল। সত্তরের শেষ আর একাত্তরের প্রথমদিকে প্রায় তিনমাস আমাদের স্কুল বন্ধ ছিল সে কথা আগেই বলেছি। সেবার আমাদের স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষাও বাতিল হয়ে গিয়েছিল। আমরা ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে প্রমোশন পেয়েছিলাম বিনা পরীক্ষায়।

সেই সময় বছর খানেকের জন্যে আমরা শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের বাসা বদল করে, বাসা নিয়েছিলাম ব্রজনাথ দত্ত লেনের এক বাড়িতে। আমাদের বাড়িটা ছিল ছোট্ট এক কানাগলির মুখে। ওই সময়ে মা ছিলেন অসুস্থ শয্যাশায়ী। ঠিক কি কারণে আজ আর মনে নেই, স্কুল ছিল না, আমি বাড়িতেই ছিলাম। একঘেয়ে অসহ্য দুপুরে আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ ব্রজনাথ দত্ত লেনের গলির মুখ থেকে কানে এল, অনেক লোক দৌড়ে আসার আর চেঁচামেচির আওয়াজ। একজন লোক উন্মত্তের মতো দৌড়ে এসে ঢুকল আমাদের কানাগলির ভিতরে। পথহীন বদ্ধ গলির মধ্যে ঢুকে দিশাহারা লোকটি অসহায় চোখে তাকাল চারদিকে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হল ক্ষণেকের জন্যে, তার চোখে বীভৎস আতঙ্কের ছায়া। আমাদের কানাগলি থেকে বেরিয়ে সে আবার বেরিয়ে গেল ব্রজনাথের রাস্তায়, দৌড়ে চলে গেল যেদিক থেকে এসেছিল তার উল্টোদিকে। পিছনে তাড়া করে আসা লোকগুলো আবার চিৎকার করে উঠল। ‘ওই তো, ওই তো...’। আমাদের বাড়ির একতলার দেওয়ালে, আর সামনের রাস্তায় এসে ফাটল দুটি বোমা। তারপর একদল লোক, হাতে তাদের উদ্যত অস্ত্রশস্ত্র, দৌড়ে গেল পালিয়ে যাওয়া লোকটির পিছনেমৃত্যুসাক্ষী করা সেই লোকটির ক্ষণিকের দৃষ্টি, আজও মনে পড়লে শিউরে উঠি আতঙ্কে।

বোমার তীব্র বিস্ফোরণ এবং আওয়াজে আমাদের গোটা বাড়িটা কেঁপে উঠেছিল, অসুস্থা মা দৌড়ে এসে আমাকে টেনে নিলেন ঘরের মধ্যে, মায়েরও দু চোখে বিস্ফারিত আতঙ্ক।

-‘পাগল হয়ে গেছিস, নাকি তুই, বাইরে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস এই সময়’? পাড়ার সমস্ত বাড়ির দরজা, জানালা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। সমস্ত পাড়া জুড়ে নেমে এল থমথমে নিস্তব্ধতা।

কংগ্রেস দল ভেঙে গেল। নতুন সবল কংগ্রেস দল হল ইন্দিরাপন্থী কংগ্রেস। গাইবাছুর হল এই কংগ্রেসের ভোটের চিহ্ন। কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে গেল, এক দল হল মার্ক্সবাদী, অন্যদল মার্ক্স ও লেনিনবাদীদ্বিতীয় দলটির অন্য নাম হয়ে গেল নকশাল। শুরু হল ক্ষমতা দখল আর আধিপত্য কায়েমের নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা। হত্যা, গণহত্যা আর নৃশংসতার নিত্য নতুন সংবাদে ভরে উঠল সংস্কৃতিসম্পন্ন বঙ্গ সমাজ।  রাজ্য শাসনেও চরম অস্থিরতা। স্বল্পমেয়াদি দুর্বল সরকার ও রাষ্ট্রপতির শাসনের দোলাচলে দুলতে লাগল রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা। রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে গেল আতঙ্ক আর সন্ত্রাস। সত্যি বলতে, সেইসময় থেকেই রাজনীতির সমার্থক হয়ে উঠল সন্ত্রাস। 

আমাদের স্কুল, আশপাশের স্কুলগুলি, উল্টোদিকের প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং সংলগ্ন এলাকাগুলি হয়ে উঠল নকশাল বিপ্লবের চারণক্ষেত্র। পাড়ায় টহলদারি পুলিশের ভারি বুটের আওয়াজে ভোর রাত্রে ঘুম ভেঙে যেত। ধরা পড়ত লাগল অজস্র নকশাল সমর্থক এবং সম্ভাব্য নকশাল সমর্থকরাতাদের অধিকাংশই আর কোনোদিন ফিরে আসে নি। সকালের খবরের কাগজ ভরা থাকত নিহত যুবকদের সংবাদে। স্কুলে গিয়ে শুনতাম হিন্দু হস্টেল আর হার্ডিঞ্জ হস্টেলে আবাসিক ছাত্রদের উপর রাজনৈতিক অত্যাচারের গোপন কাহিনী এরই মধ্যেই ঘটে গেল বর্ধমানের কংগ্রেস সমর্থক সাঁইবাড়ির হত্যা কাণ্ড। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং তার প্রলম্বিত নিরপেক্ষ তদন্ত ও ন্যায় বিচারের প্রহসন চলতেই থাকল বছরের পর বছর। এই নৃশংসতার নিত্য ছবির মধ্যেই আমার বড়ো হয়ে ওঠা। স্কুলযাওয়া, লেখাপড়া, নিয়মিত পরীক্ষা পাশ করা, খেলাধুলো সবই চলতে লাগল এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যেই। 

‘পুলিশের গু খেয়ে বকের মৃত্যু’ এমন একটি উদ্ভট চুটকি তখন খুব শোনা যেতবকেরা কি গু খায়? আর খেলেও, পুলিশের গুকি এতই বিষাক্ত, যা খেয়ে মাঠচরা বকেদের মৃত্যু হচ্ছে! তা নয়, এটি নিছক কল্পিত একটি মুদ্রণ প্রমাদ। আসল সংবাদটি হচ্ছে, ‘পুলিশের গুলি খেয়ে যুবকের মৃত্যু’। প্রত্যেকদিন সকালের সংবাদপত্রে প্রকাশিত অজস্র যুবকের হত্যার সংবাদ নিয়ে এমন নিষ্ঠুর রসিকতা আমাদের মতো চূড়ান্ত স্বার্থপর ছাড়া কে করতে পারে আর! যদিচ, সেই যুবকদের অনেকেই হয়তো আমাদের পড়শিদের কেউ, চেনা, অল্পচেনা অথবা অচেনা। কিন্তু আমরা তো বেঁচে আছি, কোনমতে টিকে আছি আমাদের পরিবার পরিজন নিয়ে!

সেই সময়ে আমার অসুস্থা মায়ের সংবাদ নেবার জন্যে আমার এক মাসিমা বর্ধমান থেকে, কলেজে পাঠরত তাঁর দেবরকে পাঠিয়েছিলেন। সকাল সাড়ে এগারোটা-বারোটা নাগাদ তিনি আমাদের বাড়িতে এলেন, বিধ্বস্ত আতঙ্কিত মুখ নিয়ে। কী হয়েছে জিগ্যেস করতে তিনি বললেন, আমাদের বাড়ি থেকে অদূরে আর পুলি লেন আর মধু গুপ্ত লেনের সংযোগস্থলে তাঁকে আটক করেছিল বেশ কয়েকজন সশস্ত্র যুবক। প্রায় একঘন্টা ধরে চলেছিল তাঁর প্রশ্নোত্তর পর্ব। কোথা থেকে এসেছেন, কোন বাড়ি যাবেন, কিসের জন্যে এসেছেন, কী করেন, কতদিন থাকবেন এইসব প্রশ্নের পাশাপাশি ছিল হত্যার হুমকি। ‘এতো কতার কি আচে গুরু, মগজে শিসে ভরে দিলেই শ্লা সব ঠাণ্ডা মেরে যাবে।’ এমন মন্তব্যও করেছিল তাঁকে ঘিরে থাকা সেই যুবকদের কেউ কেউ

মাত্র এই কয়েকটা বছরের মধ্যে পাল্টে গেল আমাদের জীবনযাত্রার ধারা। মনে আছে সেই ক’বছর পনেরই আগষ্টে পাড়ার সকলেই বাড়িতে পতাকা তোলার কথা এড়িয়ে যেত। আমাদের বাসার বারান্দায় প্রত্যেকবার ঐ দিনটিতে ছোট্ট একটি পতাকা তুলতাম, ওই কবছর বাবা তুলতে দেননি। ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ নীতিতে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল যদি হামলা করে, এই আতঙ্কে।

ভালোমন্দ মিশিয়ে সুস্থ সামাজিক জীবনযাপনের রংবাহারি চিত্রটার রং বদলে হয়ে গেল একটাই রং, লাল, রক্ত লাল। হত্যা হয়ে উঠল প্রতিবাদের একমাত্র ভাষা, আবার প্রশাসনিক ভাষা হিসেবেও নিরঙ্কুশ আধিপত্য পেয়ে গেল হত্যা। দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সামাজিক নীতি, মূল্যবোধ ও দায়িত্ববোধের কোনো রংই আর ধোপে টিকল না। জীবনের একটাই রং, রাজনৈতিক দলের রং। সমস্ত নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে রাজনীতি হয়ে উঠল সন্ত্রাস এবং আতঙ্কের সমার্থক। এই সন্ত্রাসনীতিই হয়ে উঠল বঙ্গ রাজনীতির অঙ্গ।

--00--

রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৫

বাংলাদেশের হৃদয় হতে

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলেডান দিকের কলামে "ফলো করুন" 👉

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন। এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে ড়লে

স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]

 

তখনও কলকাতাকে যেন ঠিক নিজের জায়গা বলে মনে হত না। কর্মসূত্রে বাবার কলকাতায় থাকাটা সুবিধেজনক। উপরন্তু কলকাতায় লেখাপড়া করার সুযোগসুবিধেও অনেক বেশী। সেই কারণেই যেন আমাদের কলকাতায় থাকা। সেই সময়ে বাবা ও মায়ের পরিকল্পনা ছিল বাবার রিটায়ারমেন্টের পর বর্ধমানেই আবার ফিরে যাবেনগ্রামের বাড়িতে নয়, তবে বর্ধমান শহরেসেই মতো বর্ধমান শহরের নীলপুরে বাবা একফালি বাস্তুজমিও কিনে ফেললেন, আর অবসর সময়ে বাবা ও মা সেই বাড়ির পরিকল্পনা করতে লাগলেন 

মায়ের গা ঘেঁষ্টে বসে আমি বহুদিন দিন শুনেছি মায়ের স্বপ্নসমূহ। কোনখানে তুলসীমঞ্চ বসবেবারান্দায় উঠতে সিঁড়ির দুপাশের দেওয়ালটা হবে ঘোরানো মত, লাল টুকটুকে সিমেন্ট দিয়ে মাজা হবে সেই দেয়াল। সিঁড়ি উঠতে ঘোরানো দেয়ালের মধ্যে মাটি দিয়ে দুপাশে বসানো হবে সাদা আর রক্ত গোলাপের ঝাড়। বাড়িটা হবে এল প্যাটার্নের। একতলায় থাকবে বৈঠকখানা, দুটো শোবার ঘর, রান্নাঘর আর সিঁড়ির ঘর, টানা বারন্দার ওপাশে একটু তফাতে বাথরুম টয়লেট। বাথরুমের সামনে সিমেণ্ট বাঁধানো চত্বরে বাসনমাজা, কাপড়কাচার জায়গা আর টিউবওয়েল। গ্লোব নার্শারি থেকে নিয়ে যাওয়া হবে নারকেল গাছ, যে গাছে পাঁচবছরের মাথায় ফল ধরে। তারমধ্যে অন্ততঃ দুটো থাকবে সোনামুখী নারকেল। বুকউঁচু পাঁচিলের কোল ঘেঁষে থাকবে ফুলগাছের সারি- টগর, কামিনী, কাঞ্চন, জবা, রঙ্গন, চাঁপা, নয়নতারা। মায়ের নিত্যপুজোয় ফুলের অভাব থাকবে না। প্রাঙ্গণের ছোট্ট বেডে ফুটবে মরশুমী ফুল, বেলী, রজনীগন্ধা, দোপাটি, অথবা ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ক্যালেনডুলা।

ওই সময়েই বাবার অফিস কলিগরা অনেকে মিলে যাদবপুর এইটবি বাস স্ট্যান্ডের অনতিদূরে একলপ্তে অনেকটা জমি কিনলেন। বাবাকেও বহুবার তাঁরা অনুরোধ করেছিলেন, ওইখানে কিছুটা জমি নিতে, একসঙ্গে সকলে থাকলে সবদিকেই অনেক সুবিধে হয়। বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না। প্রথমতঃ আগেই বলেছি আমাদের কাছে কলকাতা তখনও ‘আমচি’ শহর হয়ে ওঠে নি। দ্বিতীয়তঃ যাদবপুরের ওই অঞ্চল তখনও ছিল নগর সুবিধের আওতার অনেকটাই বাইরে, অনুন্নত, সেখানে সন্ধের পর শৃগাল ও মশার চরম আধিপত্যতৃতীয়তঃ ওই অঞ্চলের প্রতিবেশি এবং বাবার কলিগদের সকলেই ছিলেন ওপার বাংলার লোক, অর্থাৎ বাঙাল। বাঙাল অধ্যুষিত অঞ্চলে একক ঘটির পক্ষে সারাজীবন বসবাস নাকি আদৌ সুখপ্রদ হতে পারে না। কাজেই যাদবপুরের পরিবর্তে বর্ধমানে ঘটি পরিবেষ্টিত বসবাসের স্বপ্নেই আমাদের দিন কাটতে লাগল।

আমার ক্লাশের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের প্রায় সকলেই ছিল পুরাতনী বাঙাল, এমনকি আমরা যে শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের বিশিষ্ট ঘটি পাড়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতাম, সেখানেও পাড়ার বন্ধুদের অধিকাংশই ছিল ভাড়াটে এবং বাঙাল। ওপাড়ার ক্ষয়িষ্ণু ঘটি পরিবারগুলি অধিকাংশই বাড়ি ভাড়ার টাকার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিলেন, কিন্তু ভাড়াটে হিসেবে আমরা ঘটি-বাঙাল নির্বিশেষে ছিলাম একটু অবজ্ঞার পাত্র! আমাদের মধ্যে বাঙাল-ঘটি সংক্রান্ত ঠাট্টা-ফাজলামোর চলন ছিল ঠিকই, কিন্তু কোন সংকট না আমার মধ্যে ছিল, না পেয়েছি কোনদিন কোন বন্ধুর থেকে।

এই রকম সময়েই, ৭১-এর ২৬শে মার্চ শুরু হল পূর্বপাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধ। ওইদিন ঘোষণা হল, প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। অবিসংবাদিত জননেতা জনাব মুজিবুর রহমান বন্দী হলেন পাকসেনাদের হাতে। কিন্তু রুদ্ধ করা গেল না তাঁর কণ্ঠস্বর, সেই স্বরের বজ্রনির্ঘোষ ওপারের বাঙালী জনগণের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিলএ পারে আমার বন্ধুরাও ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠল এবং আশ্চর্য আমরা, সনাতনী ঘটি হওয়া সত্ত্বেও, সেই উত্তেজনায় সমান সামিল হতে পেরেছিলাম।

রেডিওয় রাত আটটার সংবাদ ও সংবাদ পরিক্রমার একমাত্র আকর্ষণ তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। প্রায় রোজই সংবাদ পরিবেশন করতেন শ্রীযুক্ত বিভূতি চৌধুরি ও শ্রীযুক্ত দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়বিভূতিবাবু গম্ভীর কণ্ঠে যেদিন রাজাকার আর পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর পতনের, মুক্তিযোদ্ধাবাহিনীদের সাফল্যের সংবাদ দিতেন সেদিন অদ্ভূত এক আনন্দ অনুভব করতাম। তাঁর কণ্ঠে জয়ের প্রত্যেকটি সন্দেশ আমাকে রোমাঞ্চিত করে তুলত। আর দেবদুলালবাবু তাঁর রোমান্টিক কাব্যিক কণ্ঠে জাগিয়ে দিতেন আমার আবেগ। সংবাদের পরে প্রচার করা হতো রেডিও কার্টুন। পাকিস্তান সরকারকে বিদ্রূপ করে সেই সব নকশায় থাকত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন। 

সেই সময় ‘সোনার বাংলা’ বলে একটা রেডিও স্টেশনও খুব শুনতাম। সেই স্টেশন প্রচার করা হতো ঢাকা থেকে, যদিও সেটি আদতে ভারত থেকেই গোপনে প্রচার হতো, ঢাকার নাম দিয়ে সেই বেতার কেন্দ্রের শ্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’। আর একটি গান শুনতাম –

“বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ,

জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের যে তার নেই কো শেষ...বাংলাদেশ”।

মাঝে মাঝেই সেখানে প্রচার করা হত বঙ্গবন্ধুর সেই বিপ্লবের ডাক –

“বন্ধুগণ, তোমাদের কাসে যার যা অস্ত্র আসে লইয়া ঝাপায়ে পড়। আমাদের যদি হত্যা করা হয়, আমরাও সেড়ে কতা কইব না...”আর অনুষ্ঠানের শেষে বাজতো বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত – “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”। 

দীর্ঘ ন’ মাস ধরে চলতেই থাকল বীভৎস রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। কলকাতা শহরের আশেপাশে এবং সমস্ত পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলি ভরে উঠল সর্বস্বহারা বাস্তুচ্যুত মানুষে। শোনা যায়, ওই কমাসে এককোটির উপর উদ্বাস্ত আশ্রয় নিয়েছিলেন আমাদের পশ্চিমবঙ্গে। অবশেষে একাত্তরের তেসরা ডিসেম্বর, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল, আক্রমণ হানল পশ্চিম সীমান্তে। এতদিন ছিল পরোক্ষ সমর্থন, এবার প্রত্যক্ষ যুদ্ধে ভারতও জড়িয়ে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে। 

সেই সময়, এই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আমার বালকমনে অদ্ভূত এক আলোড়ন তুলেছিল। তার ওপর এই যুদ্ধে কলকাতার পরিস্থিতিও আমার মনে ভীষণ এক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিলশহরে তখন ব্ল্যাক আউট ঘোষণা হয়েছে। সন্ধের পর ঘরের দরজা, জানালা বন্ধ করে আলো জ্বালতে হত রাস্তার সমস্ত বিজলিবাতিতে ঠুলি লাগানো হয়েছিল আলোর তীব্রতা নিয়ন্ত্রণের জন্যে। সমস্ত গাড়ির হেডলাইটের উপরের অর্ধেকটা কালো রং দিয়ে ঢেকে ফেলতে হয়েছিল, যাতে রাত্রের আলো কোনভাবেই বোমারু বিমানের চোখে না পড়ে। পুরো কলকাতা শহর সতর্ক হয়ে থাকত বোমা পড়ার আশংকায়। আমাদের স্কুলের মেন গেটের সামনে ও ভেতরের বারান্দাগুলি্র সামনে গার্ড ওয়াল তুলে দেওয়া হল পোক্ত ইটের গাঁথনিতে। যদি কোন সময় বোমা পড়েও, স্পিলন্টার যেন বেশী ক্ষতি করতে না পারে। আমাদের নিরাপত্তার কারণে স্কুল ছুটি হয়ে গেল। ছুটির আগের দিন স্কুলের উঠোনে আমাদের বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হল, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে কি করা উচিৎ। বোমা পড়ার সময়, দুই হাঁটু ও কনুইয়ে ভর দিয়ে কিভাবে শুয়ে থাকতে হবে মেঝেয়। বুঝিয়ে দেওয়া হল সাইরেনের বিভিন্ন সংকেতের তাৎপর্য।

সন্ধের পর বাবা অফিস থেকে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত আমরা চরম উৎকণ্ঠায় থাকতামবাবা বাড়ি ফিরলেই সবাই মিলে একসঙ্গে রেডিওর সংবাদ শোনা হতফেরার পথে বাবা নিয়ে আসতেন তাজা সংবাদ নিয়ে সান্ধ্য পত্রিকার সংস্করণ। তখন রেডিওতে বার বার প্রচার করা হতো ‘কোন রকম গুজবে কান দেবেন না’। তা সত্ত্বেও অজস্র গুজব ছড়িয়ে পড়ত পাড়ায় পাড়ায়। শোনা যেত বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানী সেনা ঢুকে পড়ছে। এক ঝাঁক চিলের মতো বোমারু বিমানও নাকি দেখেছে কেউ কেউ। সেই পরিস্থিতিতে কে বলে দেবে কোনটা গুজব আর কোনটা তথ্য! 

এই উত্তেজনার আঁচ অবিশ্যি বেশীদিন রইল না, মাত্র বারোদিনের যুদ্ধে পর্যুদস্ত পাকিস্তানি সেনা সমর্পণ করতে বাধ্য হল বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় সেনা বাহিনীর কাছে। দিনটা ছিল ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১অবসান হল রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। জন্ম নিল একটি স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র - বাংলাদেশ। বিশ্বের মানচিত্রে রচনা হয়ে গেল এক ইতিহাস। আর আমার মনের মধ্যে সঞ্চয় হয়ে রইল দেশ সম্পর্কে অদ্ভূত আবেগময় এক অভিজ্ঞতা।

১৯০৫ সালে অতিধূর্ত বৃটিশরাজ নিজেদের স্বার্থে বাংলাকে ভেঙে দু টুকরো করেছিল । সার্বিক আন্দোলনে ভাঙাবাংলা আবার জোড়া লেগেছিল ১৯১০-এ। ১৯৪৭ সালে দেশীয় নেতাদের ব্যক্তিগত স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে ভারত ভেঙে দুটি রাষ্ট্র হয়েছিল - ভারত আর পাকিস্তান  বাংলাকেও আরেকবার ভেঙে ফেলে গড়ে উঠল পশ্চিমবঙ্গ আর পূর্ব পাকিস্তান। প্রতিবেশী এই দুটি দেশের আম জনগণের ভাষা এক, সংস্কৃতি, চালচলন, আচার ব্যবহারও এক। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে এক ধর্ম ছাড়া অন্য কোন সাযুজ্য না থাকলেও, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেল পাকিস্তানের অংশ! এসব ঘটনা আমরা জানছিলাম ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১, মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে আবার টুকরো হয়ে গেল, ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া একটি নবীন দেশ। তবে কি ধর্ম ধরে রাখতে পারে না মানুষকে? পারে, নিশ্চয়ই পারে, যদি না সেই ধর্মের আড়ালে থাকে আঞ্চলিক স্বার্থ আর ক্ষমতা আয়ত্ত্বে রাখার আগ্রাসী মনোভাব। আর যদি থাকে এক সহমর্মী মানবিক মন।

এবারে আর বইপড়া ইতিহাস নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের তীব্র আঁচ লাগা অভিজ্ঞতায় সাক্ষী হয়ে রইলাম। ১৯৫২-র রক্তে রাঙা একুশে ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলন, সার্থক হল দেশের পূর্ণ স্বাধীনতায়। আর কিছু না পারলেও, আমার আন্তরিক সমর্থনটুকুতো দিতে পেরেছিলাম।   



বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৫

যদি হও স্বজন

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলেডান দিকের কলামে "ফলো করুন" 👉

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন। এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে ড়লে

স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]

 

[এর আগের পর্ব "ধরে রাখাই ধর্ম" - 👈সূত্রটি ক্লিক করলেই পড়া যাবে।] 


মাস দুয়েকের মধ্যে আমাদের উপনয়ন অনুষ্ঠান সমাধা হয়ে গেল, পঞ্জিকা অনুসারে নির্দিষ্ট নির্বাচিত দিনটিতে।

সূর্যোদয় থেকে একের পর এক বিধিসম্মত আচার-অনুষ্ঠান, সুদীর্ঘ শাস্ত্রীয় পদ্ধতি ও একটানা যজ্ঞ শেষে ব্রহ্মচারীত্বে উত্তরণ হল সেই বালকের। সৌম্য ভিক্ষু বালক - মুণ্ডিত মস্তক, সূচ-বিদ্ধ কর্ণপরনে গৈরিক বসন, পায়ে কাঠের পাদুকা, হাতে অদ্ভূত আঁকাবাঁকা বেউল বাঁশের দণ্ড, কাঁধে গেরুয়া কাপড়ে বানানো বিশেষ ঝোলা। ভিক্ষুর বেশ, কিন্তু ভিক্ষা বৃত্তি করতে হবে না বরং একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আর সকলে আসবেন সেই ব্রহ্মচারী বালককে ভিক্ষা দেবার জন্যে। এই ভিক্ষা দান পুণ্যকর্মপ্রথম ভিক্ষা দেবেন মাতৃসমা কোন নারী, পরবর্তী জীবনে তিনিই হবেন ব্রহ্মচারী সেই বালকের সারাজীবনের দ্বিতীয় মা - ভিক্ষুমা। এক নারী জাগতিক জন্ম দিয়েছেন, উদ্ভাসিত করেছেন প্রাণ, আর এক নারীর হাতে দ্বিতীয় জন্ম হয়ে, উদ্ভাসিত হবে আত্মা। প্রথম নারী আমার মা, দ্বিতীয় নারী হলেন ভিক্ষুমা – আমার পূর্বাশ্রমে যিনি ছিলেন আমার বড়োমামীমা। 

“ভবতী ভিক্ষাং দেহি” এবং “ভবান ভিক্ষাং দেহি” বাক্য উচ্চারণ করে ভিক্ষা চেয়েছিল সেই বালক ব্রাহ্মণ, আর কাঁধের ঝোলা ফাঁক করে ভিক্ষা গ্রহণের পর “ওঁ স্বস্তি” উচ্চারণে ও হাতের বিশেষ ভঙ্গীতে সকলের মঙ্গল কামনা করেছিল এই সমগ্র অনুষ্ঠান সুদূর অতীতের বর্ণাশ্রম বিভাজিত সমাজের আনুষ্ঠানিক রীতিপ্রকরণের অনুসরণ। আজকের আধুনিক পরিস্থিতিতে বাস্তব অর্থে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু এই অনুসরণ বারবার ফিরিয়ে আনে আমাদের সনাতন ঐতিহ্যের স্মরণ।

এসব কথা সে সময় আমার মোটেই মনে হয়নি। বরং আমার তীক্ষ্ণ লক্ষ্য ছিল ভরে উঠতে থাকা ভিক্ষার ঝুলির দিকে। চাল, আলু আর কিছু আনাজের সঙ্গে জমে উঠছিল সোনার আংটি আর বেশ কিছু নগদ টাকা। অন্য কিছু নয়, আমি তখন মনে মনে হিসেব করছিলাম কত টাকা জমা হল, আর এই টাকা দিয়ে কতগুলি বই কেনা যাবে।

আসলে প্রত্যেক বছর জন্মদিনে মা আমাদের হাতে টাকা দিতেন একটি করে বই কিনতে, আর সেই টাকা নিয়ে চলে যেতাম বঙ্কিম চাটুজ্জ্যে স্ট্রীটে দেব সাহিত্য কুটিরের দোকানে। যেখানে রয়েছে সুধীন্দ্রনাথ রাহার বাংলা অনুবাদে বিদেশী ক্ল্যাসিক উপন্যাসসমূহএভাবেই দশ-বারো টাকা দরে কিনে ফেলেছিলাম হাঞ্চব্যাক অফ নৎরদাম, ট্রেজার আইল্যান্ড, টয়লার্স অব দি সি... প্রত্যেকটি বইয়ের পিছনে থাকত আরো অনেক অনেক বইয়ের তালিকা, মনে হত বড় হয়ে যখন চাকরি করব, প্রথম মাসের টাকায় সব বই কিনে নেব, সব – থ্রী মাস্কেটিয়ার্স, রাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ, লাস্ট ডেজ অব পম্পেই, দি কানেকটিকাট ইয়াংকি, ডা: জেকিল এন্ড মিঃ হাইড... কাজেই ভিক্ষার ঝুলি ঝেড়ে, হিসেব করে যখন তিনশ ছাপান্ন টাকা পেলাম, তখন আনন্দের সীমা ছিল না, গোটা দেব সাহিত্য কুটিরটিকে কিনে ফেলার আশ্চর্য স্পর্ধায় চনমনে হয়ে উঠেছিলাম সেদিন

সব মিলিয়ে সীমিত সাধ্য আর অপ্রয়োজনীয় বলেই, খুব ধুমধাম-জাঁকজমক হল না ঠিকই, কিন্তু মজার কোনো কমতি, আমি অন্ততঃ অনুভব করিনি। ঘনিষ্ঠ বৃত্তের আত্মীয়স্বজন সকলেই এসেছিলেন। কিন্তু একটু বহির্বৃত্তের স্বজনরা আমাদের বয়কট করে ফেললেন, আমাদের এই অধার্মিক অনাচারের জন্যে। তাঁরা পত্রদ্বারা বাবাকে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন আধুনিক কালের এই হাল্কা চালের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে এমন অপকর্ম চাক্ষুষ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই তাঁরা আসবেন না তাঁদের না আসার কথায় মন খারাপ করে মা ও বাবা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তখন আর নতুন ভাবে ভাবার সময় ছিল না, আর সঙ্গে মেজদাদুর স্থিত আশ্বাস থাকায় নতুন কোন ভাবনাও দানা বাঁধতে পারেনি। 

আমাদের উপনয়ন উপলক্ষে যেদিন প্রীতিভোজ ছিল, শুধু সেদিনই - মাত্র একদিনের জন্যেই রান্নার ঠাকুর ডাকা হয়েছিল। বাকি দিনগুলিতে মামীমা, মাসিমাদের সঙ্গে পিসিমা, কাকিমারা হাতে হাত মিলিয়ে সব কাজ করেছিলেন। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তাঁদের কাজের অন্ত ছিল না, অথচ সারাটাক্ষণ তাঁদের মধ্যে চলছিল একে অন্যের পিছনে লাগা খুনসুটি। হাসি, হাসি আর আনন্দ, কোন ভুল বোঝাবুঝি ছিল না। মাসিমারা বাবার শ্যালিকা, কাজেই তাঁরা জামাইবাবু হিসেবে বাবার পিছনে লাগছিলেন খুব, আর আড়াল থেকে মাসিমাদের এই প্রগলভতা রীতিমতো উপভোগ করতে দেখেছিলাম কাকীমাদের – কারণ ভ্রাতৃবধূ হিসেবে তাঁরা বাবার সামনে আসতেন খুবই কমকোন কোন সময় এমনও দেখেছি কাকীমারাই মাসিমাদের প্ররোচিত করছেন বাবার পিছনে লাগার জন্যে! ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও মেজদাদু ও ঠাকুমা নীরবে উপভোগ করছিলেন সমস্ত পরিস্থিতি, দিদিমার অধরেও লাগাতার মৃদু হাসি – যদিও দু একবার দুর্বলভাবে আপত্তি জানাচ্ছিলেন তাঁর মেয়েদের বাচালতায় এর মধ্যে ভীষণ অভাব অনুভব হচ্ছিল অনুপস্থিত বড়োমামা আর বন্নিদিদির। বড়োমামা কী করে আসবেন, সব্বাই মিলে ঘরবাড়ি ফেলে আসা যায় - গরু-বাছুর, খেতখামার, কাজকর্ম কে সামলাবে? আর বন্নিদিদি চলে এলে বড়োমামার খাওয়াদাওয়া চলবে কী করে? কাজেই, ওরা নাচার, আসতে পারলেন না।

তবু সে যাই হোক, সব মিলিয়ে সে এক অদ্ভূত মধুর আত্মীয়তা। যার প্রতিটি পরতে আনন্দ এবং আনন্দ। তখন মনে হয়েছিল যাঁরা আমাদের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে অনুপস্থিত রইলেন, তাঁরা ধর্মের ধ্বজা হয়তো ধারণ করে রইলেন, কিন্তু অনুভব করতে পারলেন না – আত্মীয়তার অনবদ্য সহজ স্বভাবধর্ম।  

আমরা ছেলেরা ও বড়োরা যখন রাত্রে ম্যারাপ বাঁধা ছাদে শুতে যেতাম, তখন নীচেয় মহিলারা খেতে বসতেনতাঁদের গল্প আর হাসির আওয়াজ শুনতে শুনতে আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম, আবার সকাল সকাল ছোট মাসিমা বড়ো ট্রেতে করে অনেক খালি কাপ আর বিস্কুট আর ঢাউস কেটলিতে চা নিয়ে ছাদে আসতেন – বেড টি দিয়ে বড়োদের ঘুম ভাঙাতে। আর আমাদের তুলে দিতেন মুখ ধুয়ে চটপট রেডি হয়ে নিতে – জল খাবার রেডি। বড়োদের অনেক কাজ – সমস্ত অনুষ্ঠান সুষ্ঠু সম্পন্নের জন্য যোগাড় যন্ত্র করতে হবে - ব্যবস্থা করতে হবে। সক্কাল সক্কাল উঠে সবাই বেরিয়ে পড়লেন বাজার করতেআজ সারাটা দিনে সমস্ত কাঁচা বাজার সেরে রাখতে হবে, কালকে সকালে বেরিয়ে শুধু মাছ, আর একটু বেলায় দই আর মিষ্টিকাজেই সারাটাদিন সকলের চরম ব্যস্ততা, বারবার বাজার যাওয়া আর আসা। বস্তা বস্তা মাল উঠে আসছে বাড়ির ছাদে। আলু থেকে শুরু করে কলাপাতা, মায় মাটির গেলাস পর্যন্ত - থরে থরে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে ছাদের একধারে আর অন্য এক ধারে কয়লা, জ্বালানি কাঠ, ঘুঁটে, কেরোসিন আর বেশ কিছু ইঁট আর মাটি।

রান্নার ঠাকুর বিকেলে এসে ছাদের এক কোণে মাটি আর ইঁটের গাঁথনিতে বানিয়ে তুলল দু-দুটো উনুন, তার ভিতরে লোহার শিক দেওয়া। আজ সারারাতে মাটি শুকিয়ে উনুন রেডি হয়ে থাকবে – কালকে সকালে ঘুঁটে আর কয়লা পেটে নিয়ে, তারা জ্বলে উঠবে প্রায় শদেড়েক লোকের রান্নার আয়োজনে। সারাটা দিনের দৌড়োদৌড়ির পর রাত আটটা নাগাদ বড়োদের মিটিং বসল ছাদে, ফর্দ অনুযায়ী সব মাল এসেছে কি না, না এসে থাকলে এক প্রস্থ হৈ চৈ, নীচে মহিলামহলে চায়ের হুকুম, তারপর আবার নতুন ফর্দ বাকি জিনিষের, কাল সক্কালেই আবার বেরোতে হবে বকেয়া মাল কিনতে।

এদিকে নীচেয় রাত্রে বাড়ির লোকেদের রান্নায় ব্যস্ত মাসিমা আর কাকিমারা। দিদিমা আর মেজ ঠাকুমা পা ছড়িয়ে বসেছেন সবুজ পানপাতার জঙ্গল নিয়েকালকের নিমন্ত্রিতদের জন্যে পান বানাচ্ছেন। চারপাশে চূণের ডাব্বা, সুপুরির স্তূপ আর যাঁতি, তরল খয়েরের পাত্র, ধনের চাল, লাল-নীল রঙীন চিনির মোড়কে মৌরীআমার এক মাস্তুতো দিদি আর এক পিস্তুতো দিদি - খুব ভাব হয়ে গেছে দুজনে – গায়ে গা ঘেঁষে বসে, খোসা ছাড়িয়ে বের করছে ছোট এলাচের দানা। দুজনে নিজেদের মধ্যে নীচু স্বরে কি কথা বলছে কে জানে, ক্ষণে ক্ষণে হেসে গড়িয়ে পড়ছে একে অন্যের গায়ে...। দিদিমা স্নেহ মাখা কণ্ঠে তাদের বলছেন, ‘দ্যাকোদিকি কাণ্ডখানা, এ মেয়েদুটো যে হেসে একেবারে গড়াগড়ি, এত হাসির কি হল, বাছা’? মেয়েদুটি দিদিমার কথায় কিছুক্ষণ চুপচাপ এলাচ ভাঙল ঠিকই, কিন্তু সে আর কতক্ষণ – সামলে থাকা যায় নাকি? তারা আবার হেসে হেসে লুটিয়ে পড়তে লাগল আগের মতোই।

সবাই ব্যস্ত, একমাত্র আমি ছাড়া। একে আমি সদ্য পৈতে হওয়া বামুন – অন্যদিকে খুব একটা বড়োও নই আবার খুব একটা ছোটও নই। কাজেই কিছু কাজ করতে গেলেই কেউ না কেউ দৌড়ে আসছেন আমাকে আটকাতে, ‘এ হে হে হে, তুই কী করছিস এখানে, রাখ রাখ, এই কি তোর কাজ করার সময়’? কাজেই আমি সব মহলেই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম সব কিছু, দেখতে লাগলাম এই আয়োজন। সকলের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ পরিশ্রম, পারষ্পরিক সম্পর্কের অদ্ভূত সংমিশ্রণ   

দুটি মাত্র ঘর, একটি মাত্র টয়লেট, অনেকটা খোলা ছাদে বাঁশ, তেরপল আর কাপড়ের ম্যারাপ আর বেশ কয়েকজন সজ্জন প্রতিবেশীর উদার সাহায্যে প্রায় জনা তিরিশেক স্বজনের দিব্ব্যি সংকুলান হয়ে গেল চার-পাঁচদিনের জন্যে। কিভাবে হয়েছিল ভাবলে আজও আশ্চর্য লাগে, কারণ আজকাল সব শহরেই বাজেট অনুসারি ছোটবড় উৎসববাড়ির অভাব নেই, আর দুঘরের বাসায় এমন অনুষ্ঠান করার কথা আজ আর কেউ স্বপ্নেও ভাবেন না। এসব হতে পেরেছিল কারণ - অনলস কাজের মধ্যে, ছোট বড় সবার প্রতি সমান নজর রাখতে রাখতে, বড়মামীমাকে অনেকবার বলতে শুনেছিলাম – “যদি হও স্বজন, তেঁতুল পাতায় নজন”

ঋণ করে সাধ্যাতীত ব্যয়ে অনেক বড়োসড়ো আয়োজন করাই যেত, কিন্তু সমানুপাতে আনন্দ বেশী হত, এমনটা মনে হয় না। বরং ঋণ পরিশোধের দুশ্চিন্তার পিছুটান একটা থাকত অনুষ্ঠানের প্রতিটি মুহূর্তেই, সেটাতে আনন্দের রং অনেকটাই ফিকে হয়ে যেতে পারত।

মহাভারতে বকবেশী ধর্মরাজ, যুধিষ্ঠিরকে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল – বিশ্বে সবচেয়ে সুখী কারা? স্থিতপ্রজ্ঞ যুধিষ্ঠির জবাবে বলেছিলেন যিনি অঋণী আর যিনি অপ্রবাসী – তাঁরাই সবচেয়ে সুখী। আমাদের মেজদাদু তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রায়োগিক প্রত্যয় দিয়ে আমাদের সুখী এবং বিপন্মুক্ত করেছিলেন। কারণ আমাদের এই উপনয়ন অনুষ্ঠানের প্রায় মাস সাত-আটেক পরেই, কোনদিন অসুস্থ না হওয়া আমার মা, হঠাৎই কঠিন অসুখে প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন এবং সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়েছিলেন সুদীর্ঘ চিকিৎসার পর। কাজেই ঋণ করে আনন্দ অনুষ্ঠান, আমাদের এক চরম অনায়ত্ত বিপদের দিকে টেনে নিতে পারত। তা ঘটেনি, আমরা অঋণী ছিলাম বলে। তখন বারবার মনে হয়েছিল প্রকৃত গুরুজন হয়ে ওঠা বড়ো সহজ কাজ নয় – শুধু বয়েস নয় দরকার আরো অনেক কিছুর – সবচেয়ে বেশী দরকার প্রকৃত স্বজন হয়ে ওঠা।


--০০--

রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৫

ধরে রাখাই ধর্ম

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলেডান দিকের কলামে "ফলো করুন" 👉

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন। এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে ড়লে

স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]



তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়ো, আমার ঠাকুরদাদা ছিলেন ঘোরতর ইংরিজীভাষা বিরোধী, গোঁড়া সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত টোল এবং ভট্টপল্লীর সংস্কৃত শিক্ষা ছাড়া হিন্দুসমাজের যে পরিত্রাণ নেই সে বিষয়ে তিনি ছিলেন দৃঢ বিশ্বাসী। তাঁর ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও তাঁর মেজভাই – আমাদের মেজদাদু এন্ট্র্যান্স পরীক্ষায় বসেছিলেন আর সে পরীক্ষায় অংক আর সংস্কৃতে পাওয়া সোনার মেডেলদুটি দাদার পায়ে উৎসর্গ করে যখন নত মুখে দাদার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, দাদা বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন এবং বলেছিলেন ভাইয়ের সাফল্যে তিনি গর্বিত এবং এই সংস্কৃতর জ্ঞানই যে তাঁর ভাইকে অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করেছে, এ বিষয়ে তিনি স্থির নিশ্চিত

কিন্তু ঘরবাড়ি ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে, দাদুকে গ্রামসমাজে কঠোর শাস্ত্রবিধির প্রসারে সহায়তা না করে, মেজদাদু যখন কলকাতায় এসেছিলেন সরকারি ‘গোলামি’ করতে, তখন তিনি ভীষণ বিরক্ত ও হতাশ হয়েছিলেনএমনকি বিদায়ের সময় মেজদাদু যখন দাদুকে প্রণাম করেছিলেন, দাদু কোন আশীর্বচনও উচ্চারণ করেন নি মেজদাদুর উদ্দেশে। পরে মেজদাদু গ্রামে ফিরে দাদার পায়ে যখন প্রথম মাসের চোদ্দ টাকা ছ আনা বেতন নিবেদন করেছিলেন, তখনো দাদু কোন কথা বলেন নি, গম্ভীরভাবে আমার বালক বাবাকে ডেকে বলেছিলেন টাকাকটা তুলে ঠাকুমার হাতে দিতে।

এসব কথা বাবার মুখে শোনা। বাবার কাছেই শুনেছিলাম পিতৃসম বড়োদাদাকে এতটুকু অসম্মান না করেও, বিনীত অথচ বিদ্রোহী মেজদাদুর এই বাস্তব ও যুগোপযোগী চেতনার কথা। এই মেজদাদুর প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাবাও ইংরিজি শিক্ষার আলোয় আসতে পেরেছিলেন এবং কলকাতায় আসতে পেরেছিলেন উচ্চতর শিক্ষার প্রাঙ্গণে। কলেজে পড়ে বাবার চূড়ান্ত অধঃপাত অবিশ্যি দাদুকে দেখে যেতে হয়নি, কারণ আমার দাদু বিগত হয়েছিলেন বাবা কলেজে পড়ার শেষদিকে।

কাজেই প্রত্যক্ষভাবে আমার বাবার জীবনে এবং পরোক্ষভাবে আমাদের জীবনেও মেজদাদুর ছিল অপরিমিত অবদানএককথায় তাঁরই একক প্রচেষ্টায় আমাদের সমস্ত পরিবারটিই, অন্ধ কূপমান্ডুক্য থেকে মুক্তির আলোর সন্ধান পেয়েছিল

আমাদের ছোটবেলায় তাঁর শিবপুর ট্রামডিপোর কাছাকাছি বাড়ি থেকে মেজদাদু আমাদের শ্রী গোপাল মল্লিক লেনের বাসায় আসতেন অনায়াস পদব্রজে। আমরা অবাক হলে সৌম্য হাসিতে ভরে উঠত তাঁর সদাশিব মুখ, বলতেন, ‘এ আর কি এমন দূর গো। এখন বয়েস হয়েছে, তেমন আর হাঁটতে পারি কই? হাঁটতাম তখন - প্রত্যেক মাসে একবার কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরতাম, দুহাতে থাকত দুটো চটের থলিভরা মাসকাবারি বাজার, পূর্বস্থলী স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে আমাদের শুরু হত হাঁটা। তা প্রায় ধরো আট-ন’ ক্রোশ তো হবেই -’

‘ক্রোশ মানে’?

‘ক্রোশ মানে ধরো প্রায় দু মাইল, তোমাদের এখনকার হিসেবে প্রায় সওয়া তিন কিলোমিটার। তোমাদের বাবাও যখন কলেজের ছুটিতে বাড়ি আসত, ওইভাবেই আসত...’

‘অত্তোটা পথহাঁটা, কষ্ট হত না, দাদু’? আমার প্রশ্নের উত্তরে আমার পিঠে হাত রেখে উনি বলেছিলেন, ‘আসলে কি জান, দাদু, আমরা ওই বয়সে কেউই কলকাতাকে নিজের জায়গা হিসেবে ভাবতেই পারতাম না। কলকাতা ছিল নিছক কর্মস্থল, পরবাস। এখানে কেউ থাকে নাকি? ঘরবাড়িউঠোন, জমিজিরেত, পুকুরপাড়, মন্দিরতলা, ঠাকুর-দালান, পাড়া প্রতিবেশী – সব মিলে মিশে এমনই সে মমত্ব ও মায়া – যার টান, সারাটা মাস আমাদের অনুভবে থাকত। শনিবার বিকেলে বড়বাজারে চটের থলি ভরা জিনিষপত্র কিনে হাওড়ার পন্টুন ব্রীজ পার হয়ে যখন ট্রেনে চাপতাম – নিজেকে মনে হত জেল থেকে ছাড়া পাওয়া কয়েদি। কি প্রবল আকর্ষণই না ছিল আমাদের ছেড়ে আসা ওই গ্রামজীবনের। কষ্ট হতো, ভীষণ কষ্ট হতো, বর্ষার দিনগুলোয় তো বটেই - কিন্তু সহ্যও হয়ে যেত ওই মায়ার অদ্ভূত আরামে...’

দাদুর উচ্চারণে, বলার ভঙ্গীতে এমন কিছু থাকত, আমরাও যেন চোখের সামনে কল্পনা করতে পারতাম সেই পথচলা। ভরা বর্ষায় বেড়ে ওঠা সতেজ ঝোপঝাড়-জঙ্গলে সঙ্কীর্ণ হয়ে আসা পথ নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে জোনাকির নাক্ষত্র্য আলোক। ঝিঁঝিঁর একটানা ডেকে চলা। পুকুর বা জলার ধারে ব্যাঙের কোলাহল। দলবদ্ধ শেয়ালের চকিত ছোটাছুটি আর সমবেত হুউউক্কা হুউউয়া। অথবা পূর্ণিমায় আলোকিত শরতের স্বচ্ছ রাত। কিংবা শীতের ঘন কুয়াশার রহস্যে ঢাকা পরিবেশে ঘরে ফেরা কয়েকটি মানুষের অবিরত সুদীর্ঘ পথ হেঁটে চলা – যা শেষ হত নিজ নিজ গ্রামে এবং প্রায় শেষ রাতে। 

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেজদাদু আবার বললেন, ‘আজকাল সারাদিনে কত ট্রেন, কত বাস – হাঁটতেও হয় না আর তেমন, এখন গ্রাম অব্দিই প্রায় বাস চলে যাচ্ছেকত সুবিধে হয়ে গেছে, দাদুভাই। তবু যাওয়া হয়ে ওঠে না। কতদিন যাইনি, জান – তা প্রায় বছর দশেক তো বটেই। এখন বুঝতে পারবে না দাদুভাই, বড়ো হলে বুঝতে পারবে – কোন দূরত্বই দূর নয়, কোন কষ্টই বেদনা নয়, যদি তার পিছনে থাকে তোমার অন্তরের সাড়া। আর যদি তা না থাকে ঘরের উঠোন পার হতেও মনে হবে অনন্তপথযাত্রা’!       

গৌরবর্ণ, শুভ্রকেশ, শুভ্রভ্রূ বেঁটে-খাটো সেই বৃদ্ধ মানুষটি, এমনই এক সোনালী মায়াময় অথচ বেশ কষ্টকর অতীত জীবনের ঐতিহ্যময় ইতিহাস, আমার বালক হৃদয়ে এঁকে দিতে পেরেছিলেন, যা আজও আমার কাছে অম্লান। 


ক্লাশ সিক্সের মাঝামাঝি, এক রোববারে বাবা খুব বকা খেলেন আমাদের মেজদাদুর কাছে। আমাদের সামনে বকা খেয়ে, মাথা নীচু করে চুপ করে রইলেন বাবা! যেমন আমরা বাবার কাছে বকা খেয়ে মুখ কাঁচুমাচু হয়ে থাকতাম - অবিকল সেরকম। তার আগে পর্যন্ত জানতাম বাবারাই শুধু বকা দেন – তাঁরাও যে বকা খেতে পারেন সেদিন চাক্ষুষ করে খুব মজা পেয়েছিলাম। তবে মেজদাদুর বকা মানে যে চেঁচামেচি - রাগারাগি তাও নয়, সেও এক অদ্ভূত আত্মবিশ্লেষণ।  

সেদিন সকাল থেকে দাদুর কাছে আমার সংস্কৃতচর্চার পর, দ্বিপ্রাহরিক ভোজনে বসেছিলাম আমরা চারজন, মেঝেয় আসন পেতে। সামনে বসে ঘোমটা মাথায় মা পরিবেশন করছিলেন। মায়ের রান্নার একান্ত ভক্ত মেজদাদু, রুই মাছের মুড়ো দেওয়া মুগের ডালে ভাত মেখে কুমড়ো ফুলের বড়া খেতে খেতে কথাটা তুললেন, ‘বৌমা, নারাণকে আমরাই সঠিক মানুষ করে তুলতে পারিনি, ও কোনদিনই আর প্রাপ্তমনস্ক হবে না। তুমি তো মা, এমন না - ছেলেদুটোর পৈতে দেবার কথা, তুমি কি ভাবছ’?

অকস্মাৎ দাদুর এই কথায় মা ও বাবা দুজনেই অপ্রস্তুত। ঘোমটার আড়ালে মা বাবার দিকে তাকালেন, বাস্তবিক এই ব্যাপারে মা অনেকবারই বাবাকে তাগাদা দিয়েছেন, কিন্তু বাবাই এ বছর নয়, পরের বার - সামনের পূজোটা যাক – এই করে করে আর হয়ে ওঠেনি মা কিছু বললেন না, বাবাকে ইশারা করলেন উত্তর দিতে। বাবা গলা ঝেড়ে, একটু কেশে উত্তর দিলেন, ‘না, মানে। ভেবেছি দুভাইয়ের একসঙ্গেই দিয়ে দেব। তা হাজার ঝামেলায় - ওই দোবো দোবো করে আর দেওয়া হচ্ছে না’।

‘আর কতদিন ভাববে? উপনয়ন সংস্কারের নিয়ম বিধি জানা আছে? উপনয়নের একটা বয়স সীমার ব্যাপার আছে, সেটা তো তোমারও না জানার কথা নয়, বৌমা। হীরকের সে বয়স অতিক্রান্ত, পান্নাও সে বয়সের উপান্তে। তোমরা যদি ওদের পৈতে দেবে না ঠিক করে ফেলে থাক, সেক্ষেত্রে আমার কিছু বলার নেই – কারণ তোমরা এখন আধুনিক সংস্কৃতির প্রবাহে ভাসমান...’

‘না, না। ওদের পৈতে হবে না, তা কি করে হয়, কাকামশাই। আসলে কলকাতার এই বাসায় হবে, না গাঁয়ের ভিটেয় হবে – এই এক চিন্তায় আমাদের দিন কাটছে’মা ভীষণ চিন্তিত স্বরে বললেন ‘কলকাতার এতটুকু বাসায়, লোক-জন, আত্মীয়-স্বজন, তারওপর এরমধ্যেই ওদের দুভাইয়ের একঘরে তিনদিন আলাদা থাকা – সব মিলিয়ে মনে হয়, এ বাসায় ও অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। গাঁয়ে গিয়ে করতে পারলে সবচে’ ভালো হতো, পৈতৃক ভিটে বলেও কথা। কিন্তু সেখানেও সবাই মিলে গিয়ে – যোগাড়-যন্ত্র - অন্ততঃ দিন দশেক অফিস-স্কুল-কলেজ কামাই – তার ওপর...মানে...তার ওপর খরচও হবে অনেক বেশি’।

মেজদাদু শুনলেন, কিছু বললেন না। মুগডাল দিয়ে কুমড়োর বড়া শেষ করে নতুন ভাত ভাঙলেন, মা লক্ষ্য রেখেছিলেন – আলু-পটলের তরকারি দিলেন মেজদাদুর পাতে। তরকারি দিয়ে ভাত মেখে মুখে গ্রাস তুলে বললেন, ‘অপূর্ব। বৌমা, এ সময় রোজ পটল খেতে খেতে একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছিল, তোমার হাতে পড়ে কি করে তার এমন স্বাদ হয় বল তো? আরেকটু ঝোল দাও তো মা, ওই দেখ আবার পটল দিলে – তোমার জন্যেও রেখো বৌমা’। 

মা বললেন, ‘আমাদের আছে, আপনি খান না’। 

খুব তৃপ্তির হাসি মুখে নিয়ে মেজদাদু বললেন, ‘ধর্ম মানে কি জানো তো বৌমা – যা ধরে থাকে। কি ধরে থাকে বল তো?’ আরেক গ্রাস ভাত মুখে নিয়ে বললেন, ‘আমাদের সমাজ, আমাদের জীবন, আমাদের সম্পর্ক। এই যে এত যত্নে রান্না করে তুমি আমাদের খাওয়াও – এর সঙ্গে মিশে থাকে তোমার শ্রদ্ধা, ভক্তি – গড়ে ওঠে অটুট সম্পর্ক। বেড়ে ওঠে জীবনের আনন্দ – এই আনন্দটাই ধর্ম। ধর্ম সঠিক অর্থে মানুষকে কোনদিন বিপন্ন করতে পারে না। মানুষ বিপন্ন হয় এবং অন্য মানুষকে বিপন্ন করে অন্ধ বিশ্বাস আর মনগড়া কিছু লোকাচার মানার জিদ থেকে’।

পটলের তরকারি দিয়ে মাখা ভাত শেষ করে আবার নতুন ভাত ভাঙলেন মেজদাদু, সেই দেখে মা মাছের তরকারি দিলেন – বড়ো আংটির মতো রুইমাছের একটা পিস, দুটো লম্বা ফালি করে কাটা আলু আর ঝোল। মেজদাদু আলুদুটো ভেঙে ঝোল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললেন, ‘আসল কথাটা হচ্ছে, হীরক আর পান্নার পৈতে - এটা আমাদের ধর্ম, আমাদের সংস্কারতাতে তোমাদের সাধ আর সাধ্যর মধ্যে ফারাক থেকে যাচ্ছে, তার মানে তোমরা একভাবে বিপন্ন...’। ঝোলমাখা ভাত এক গ্রাস মুখে নিয়ে, মাছের একটা টুকরো মুখে নিলেন, একটা বড় কাঁটা মুখ থেকে টেনে বের করে বললেন, ‘এটা তো ধর্ম হতে পারে না, বৌমা। ধর্ম যদি আমাদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়, সমাজে থেকেও যদি আমরা অসহায় হয়ে পড়ি, তাহলে সে সমাজের, তুমি কি উন্নতি আশা করবে? ধর্ম কি শুধু সর্বস্বান্ত হয়ে পূজোয় ঢাক বাজানো? যদি তাই হয় - সে ধর্ম দিয়েই বা তুমি কি করবে...’?

মেজদাদু চুপ করলেন। খুব মন দিয়ে ভাত খেতে লাগলেন। মা আরেকটু ভাত দেবার চেষ্টা করেছিলেন, নিলেন না। খুব গভীর কোন চিন্তায় আচ্ছন্ন মেজদাদু কাঁসার থালা চেঁটেপুটে পরিষ্কার করে ফেললেন। বাবা মা কেউ কথা বললেন না। মা আলাদা চিনেমাটির প্লেটে আমের চাটনি দিলেন, কারণ কাঁসার থালায় টক জিনিষ নষ্ট হয়ে যায় - বিস্বাদ হয়ে যায়মেজদাদুর মুখে দিব্য হাসি, মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিছুই বাদ রাখো নি, বৌমা। গরমের সময় কাঁচা আমের চাটনি বড় উপাদেয়, তাই না, পান্নাভাই’? তারপর ভীষণ তৃপ্তির সঙ্গে চাটনিও শেষ করলেন। আমাদের তখনো খাওয়া হয় নি। মেজদাদু বসে রইলেন। 

কিছুক্ষণ পরে বললেন, ‘তোমার যদি আপত্তি না থাকে বৌমা, আমি নিজে তোমার দুই পুত্রের উপনয়ন যজ্ঞের হোত্রী হব। পূর্ণ শাস্ত্র বিধান মেনে, সামবেদীয় পদ্ধতিতে। ওদের তিনদিন অসূর্য্যম্পশ্যও থাকতে হবে না। আর কলকাতার এই বাসাকেই এই অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত করো কোন অসুবিধে নয়, কোন ব্যয়বাহুল্যও নয়। কিন্তু বিধিসম্মত ধর্মপালন হওয়া চাই’


-০০-

বুধবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৫

ভাই ফোঁটা

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলেডান দিকের কলামে

"ফলো করুন" 👉

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন।

এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে পড়লেস্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে

ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]


       নিজের দিদি নাই বা থাকল, কিন্তু ভাইফোঁটার দিনে আমার ছোট্ট মাসতুতো দিদিও হঠাৎ বড় হয়ে যেত, আমাকে আচমকা অবাক করে দিয়ে। ওই একটাই দিন – আগে পরে আবার দিদি ফিরে আসত আমার নিত্য দেখা দিদিতেই। আগের দিন রাত্রে ভাইফোঁটার নেমন্তন্নে আমার ডাক পড়ত মাসির বাড়ি।

সক্কাল সক্কাল দিদি আমার পিছনে লেগে, ঘুম ভাঙিয়ে দৌড়ে চলে যেত চান করতে। সদ্য স্নান সারা দিদিকে নতুন শাড়ি পড়িয়ে মাসিমা সাজিয়ে তুলতেন – যদিও একটু আলুথালু, একটু অপ্রস্তুত, তবু অন্যদিনের চেয়ে একদম অন্য এক দিদি উপস্থিত হত কোন জাদুতে কে জানে। ঘরে ফ্রক পড়া, স্কুলে স্কার্ট পড়া আটপৌরে দিদিকে মাসিমার মতোই রীতিমত গম্ভীর দেখাত। 

ভিজে খোলা এলোচুল থেকে টপকাত ফোঁটা ফোঁটা জল। এ ঘর ও ঘর করতে করতে নানান কাজ সারতে সারতে আমাকে মাঝে মাঝেই শোনাত, ”বাথরুমে গরম জল করা আছে, চান করে নে। চান না করে আমাকে ছুঁয়ে ফেলিস না যেন, তোর সব বাসি আকাচা জামা কাপড়...”।

 পাটায় চন্দন ঘষতে ঘষতে খোলা চুল কতবার চলে আসত মুখের ওপর, ঘাড় ঝাঁকিয়ে বার বার সরিয়ে তুলত পিঠে। কখনো নেমে আসত শাড়ির আঁচল, চন্দনে মাখামাখি। দিদির গায়ে মৃদু চন্দনের গন্ধ ভরে উঠত। সে এক অন্য দিদি। আজ ভাইফোঁটা।

 সেদিন মেসোমশাই মিষ্টি কিনতে বের হচ্ছেন দেখলেই দিদির মুখভার। বাবাকে কিছু বলতে পারত না, মায়ের কাছে ঘুনঘুন করত।

আজকের দিনে ওকে দাও না, পছন্দ করে মিষ্টি নিয়ে আসুক – রোজ তো তুমিই আনো”। মাসিমা  বললেন মেসোমশাইকে। মেসোমশাইয়ের সদাগম্ভীর মুখেও প্রশ্রয়ের উচ্চ হাসি।

হা, হা, হা, হা, তাই তো আমার পাগলি মাটা বড় হয়ে গেছে কতো – বুঝতেই পারিনি”!

দিদি আড় চোখে আমার দিকে তাকাল, ভাবখানা – বাবাকে একটুও ভয় পাই না আমি, উল্টে বাবা আমার কেমন কথা শোনে দেখলি তো?

অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে খুব ভিড়। দিদির মতোই সব খদ্দের, ক্যাচর ম্যাচর, কলর বলর – হরেনকাকুর দম ফেলার অবকাশ নেই। একটু দেরী হলেই দিদিদের অভিমান, ”আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি কাকু, আমাকে ছাড়া সব্বাইকে দিচ্ছ কিন্তু, আমি সেই থেকে দেখছি”।

হরেনকাকুর চটজলদি উত্তর, ”তোমারটাই যে দিচ্ছি, মা”।

বারে, আমি কখন বললাম আমার কি কি চাই”?

বল না, মা বল। আমি শুনছি – সব শুনছি”। হরেনকাকুর হাত থেমে নেই, অবিরত বাকসো ভরে চলেছে ছোট্ট ছোট্ট দিদিদের ফরমাস অনুযায়ী।

 

দিদি বীরদর্পে মিষ্টি কিনে ঘরে ফিরে স্যান্ডালটা পা থেকে এলোমেলো ছেড়ে রাখলো বসার ঘরে। অন্য দিন হলে মেসোমশাই বকাবকি করতেন – আজ নয়। আজ অন্য দিদি। আজ ভাইফোঁটা।

আমার স্নান সারা, হাফ প্যান্ট আর প্যান্টের ভেতর গুঁজে পড়া রঙীন জামা – জামাটা দিদির পছন্দ করে কেনা (আমারও ভীষণ পছন্দ – কিন্তু দিদিকে বলিনি - বরং দিদিকে মুখ বেঁকিয়ে জানিয়েছি আমার মোটেও পছন্দ হয়নি রংটা) মাসিমার সঙ্গে দোকানে গিয়ে। তেল চুকচুকে নিখুঁত আঁচড়ানো পাট পাট চুল। মাসিমা আমার চিবুক আর গাল চেপে আঁচড়ে দিয়েছেন নিজের হাতে। মাসিমার শাড়িতে গোবিন্দভোগ চালের গন্ধ, পায়েস রান্না হয়ে গেছে।

 চটের ওপর রঙীন সুতোয় বোনা আসন। লাল ব্যাকগ্রাউন্ড। তার মধ্যে সবুজ রঙের মুখোমুখি বসা শুক-সারী পাখি। ওপরের দিকে হলুদে লেখা ”সংসার সুখের হয়” আর একদম নীচে ”রমণীর গুণে” আকাশী রঙে। এ আসনটি ছোটমাসিমার হাতে বোনা। 

সেজেগুজে আসনে বসে আছি, লক্ষ্মী ছেলের মতো। সামনে কাঁসার রেকাবি ভরা দিদির আনা মিষ্টি। পাশে পেতলের ছোট্ট পিলসুজ, তার ওপর তেল ভরা পেতলের প্রদীপ। তেলের মধ্যে ডুবে আছে দুটো সলতে – একটা লম্বালম্বি, অন্যটা আড়াআড়ি। লম্বালম্বি সলতের মুখটা ক্যান্টিলিভার বারান্দার মতো সামান্য ঝুলে আছে প্রদীপের বাইরে।

সব যোগাড় সারা। মাসিমা দিদিকে তাড়া লাগাচ্ছেন। আশে পাশের বাড়ি থেকে শাঁখ আর উলুধ্বনি এলেই মাসিমা দিদিকে চাপে ফেলছেন বারবার। মেসোমশাই চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছেন আর মিটি মিটি হাসছেন দিদির কান্ডকারখানা দেখে। মেসোমশাইয়ের চোখে প্রশ্রয় আর স্নেহের হাসি চিকমিক করছে।

দিদি এলো। খোলা চুল। কোমরে শাড়ির আঁচল শক্ত করে গোঁজা। হাতে পেতলের রেকাবিতে সুন্দর করে সাজানো দুর্বা, ধান, চন্দন, চুয়া, পানসুপুরি, এক ছড়া কলা।

 হাঁটু গেড়ে দিদি বসল সামনে। প্রদীপ জ্বালতে দুটো কাঠি নিভে গেল। তিনটে কাঠি ভেঙে গেল বাকসে ঠুকতে গিয়ে। পরেরটায় জ্বলে উঠল প্রদীপ। কাঁপা কাঁপা ছোট্ট শিখা। চারটে ধুপ জ্বালিয়ে নিল প্রদীপের শিখা থেকে। বারবার হাতের ঝাপটা দিয়েও দিদি নেভাতে পারছিল না ধুপগুলো...

 ফুঁ দে না দিদি, নিভে যাবে”।

এ মা, তুই কি বোকা রে? ফুঁ দিয়ে ধুপ নেভাতে নেই, এটাও জানিস না? ওতে ধুপ এঁটো হয়ে যায়”।

দিদির হাতের ঝাপটাতেই হোক অথবা আমার চূড়ান্ত অজ্ঞতার জন্যেই হোক ধুপগুলো নিভে গিয়ে জ্বলতে শুরু করল ধুপের মতোই। চারটে ধোঁয়ার মোটা এলোমেলো ভাঙাচোরা রেখা হয়ে।

মাসিমা এসে বসলেন দিদির ঠিক পাশে, হাতে শাঁখ। দিদি ধান আর দুব্বো নিয়ে রাখলো আমার মাথায় – দিদির আশীর্বাদ! বারবার তিনবার। দিদি ঠোঁটদুটো জড়ো করে জিভের সিম্পল হারমনিক মোশনে উলু দিচ্ছিল প্রত্যেকবার। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছিল মাসিমার শাঁখের আওয়াজ। যে শঙ্খটা রোজ সন্ধ্যেবেলা বাজে সংক্ষিপ্ত দ্রুত লয়ে – আজ সকালে সেটাই বাজল দীর্ঘ বিলম্বিতে। আজ অন্য এক দিন – আজ ভাই ফোঁটা।

 আশীর্বাদের পর্ব শেষে এবার ফোঁটা। অনামিকায় চন্দন আর চুয়া নিয়ে দিদি তিনবার টিপ লাগিয়ে দিল আমার কপালে – সঙ্গে সেই অমোঘ ছড়া – “ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা...”। টিপ পড়ানোর সময় দিদির অন্য আঙুলগুলি স্পর্শ করছিল আমার চোখ আর নাকে।

 দিদিকে প্রণাম কর”, মাসিমা বললেন।

শুনেই দিদি দেখি চট করে বসে পড়ল পায়ের পাতা দুটো মেলে। আমার দ্বিধা দেখে মাসিমা আবার বললেন, ”কি রে, প্রণাম কর। দিদি বড় হয় না”?

সেরেই ফেললাম প্রণামটা। ছোট্ট ছোট্ট চিমটি কেটে দিদির দুই পায়ের পাতায়।

মা দেখলে, কেমন চিমটি কেটে দিল”- চেঁচিয়ে উঠলেও দিদি কিন্তু খুব খুশি। তার মনে তখন জীবনে প্রথম প্রণাম পাওয়ার আনন্দ শিহরণ। আনন্দে আমার চিবুক ধরে চুমো খেয়ে দিদির শান্তি হলো না, আমার গালেও একটা চুমো খেয়ে বসল।

 মেসোমশাই সব দেখছিলেন চেয়ারে বসে। বিশাল শব্দে হেসে উঠলেন, ”হা, হা, হা, হা, ঠিক হয়েছে। খুব ভাল হয়েছে”।

কী ঠিক হয়েছে? কোনটা খুব ভাল হয়েছে বুঝতে পারিনি সেদিন। আজও কি বুঝেছি, সবটা?

সাবান-ক্রিম-ফোম, এক-দুই-তিন ব্লেডে নিত্য শেভ করলেও, কোনভাবেই তোর সেই চুমোটা আজও মুছে যেতে দিইনি, রে দিদি। আজকের অবসর জীবনেও, গাল ভরা অনেকটা পাকা কিছুটা কাঁচা দাড়ির আড়ালে ঠিকঠাক আছে সেদিনের সেই চুমোটা – আমার অনুভবে। পৃথুলা, হাঁটুর ব্যাথায় কাতর তুই থাকিস এখন এক প্রান্তে – আমিও বহু দূরের অন্য প্রান্তে।

কিন্তু আবার যদি সুযোগ পেতাম তোর সেই ছোট্ট ছোট্ট দুই চঞ্চল পায়ের পাতা পরশ করার – নো চিমটি, আই প্রমিস, জাস্ট একটা প্রণাম করব...বিশ্বাস কর, দিদি।

 

-- ০০ --

রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫

নটি বয়

 

[এই ব্লগের প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


ছোটবেলায় আমরা মধ্য কলকাতার কলেজস্ট্রিট পাড়ায় একটি ভাড়ার বাসায় থাকতাম সেখান থেকে আমার স্কুল, দাদার কলেজ ছিল পায়ে হাঁটা রাস্তায়। তখন আমাদের স্কুলজীবন শুরুই হতো ক্লাস ওয়ান থেকে। আর ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত আমাদের স্কুল বসত সকাল বেলায়। বাবার হাত ধরে রোজ সকালে সাদা জামা, সাদা হাফপ্যাণ্ট পড়ে আমরা স্কুলে যেতাম। হাতে থাকত বই খাতা ভরা স্টিলের বা অ্যালুমিনিয়মের বাক্স

আমাদের স্কুলবাড়িটা কলেজস্কোয়ার বা গোলদীঘির উত্তর পশ্চিমদিকে। কাজেই সকাল বেলা স্কুল যাওয়ার পথে আমরা কলেজ স্কোয়ারের ভেতর দিয়েই যেতাম। তাতে রাস্তাটা কম হত, আর মজাও লাগত খুব। গোলদীঘির জলে সাঁতারু ছেলেদের ঝপাং ঝপাং ঝাঁপ মারা দেখতাম। দীঘির চারদিকের রাস্তার ধারের বেঞ্চে বসে থাকতেন হাতে লাঠিওয়ালা অনেক বুড়ো মানুষ। অনেক মোটাসোটা মানুষ আবার দীঘির চারদিক ধরে দৌড়ত। পাশ দিয়ে যাবার সময় তাদের নিশ্বাসের হোঁসফোঁস আওয়াজ পেতাম । অনেকে আবার আমাদের ড্রিল ক্লাসের – এক, দুই তিন, চারের নিয়মে হাত নাড়তে নাড়তে হেঁটে যেত পাশ দিয়ে। আমি হাঁ করে এইসব দেখতাম, আর স্কুল যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে, বকা খেতাম বাবার কাছে।

পনেরই আগষ্টে স্কুলের ছাদে পতাকা তুলতেন আমাদের হেডমাস্টারমশাই। ওই একদিনই আমাদের স্কুলের ছাদে যাওয়ার অনুমতি মিলত। বাকি সারাবছর তালা দেওয়া থাকত ছাদের দরজায়। স্কুলের ছাদে উঠে আমরা অবাক হয়ে দেখতাম, চারদিকে হাজার হাজার বাড়ির ছাদ। আর পশ্চিমদিকে বেশ খানিকটা দূরে হাওড়া ব্রিজ। ছাদের আলসেতে বুক দিয়ে নিচেয় দেখতাম, কলেজস্ট্রিট ধরে গড়িয়ে চলা, ট্রাম, বাস, ট্যাক্সি। ছাদ থেকে দেখে মনে হত যেন, সব ঝুলনের খেলনা। আমাদের পাড়ায় খুব বড়োলোক পল্টুরা বাড়িতে ঝুলন সাজাতো। রঙিন কাঠের গুঁড়ো দিয়ে, আর কাঠের ছোট্ট ছোট্ট রেলগাড়ি, বাস, নৌকো, নানান রকম পুতুল দিয়ে। পল্টুদের বনেদি বিশাল যৌথ পরিবারটি ছিল বৈষ্ণব, কৃষ্ণঠাকুরের যে কোন পুজোতেই ওদের বাড়িতে খুব ধুমধাম হতো।

পনেরই আগষ্টের একটু আগে বা পরে, কলেজ স্কোয়ারে পুজোর মণ্ডপ বানানোর কাজ শুরু হয়ে যেত। খুব অবাক লাগত। গতকাল সকালে যাবার সময় দেখলাম, কিচ্ছু নেই। আজ সকালে স্কুল যাবার সময় দেখলাম, মণ্ডপ বাঁধার জায়গায় বাঁশের পাহাড়, আর মোটামোটা শালের গুঁড়ি। আমি হয়তো বাবাকে জিগ্যেস করলাম, ‘এত বাঁশ এনেছে কেন, গো’? বাবা বলতেন, ‘পুজোর মন্ডপ বানাতে হবে না? এই তো, আর মাস দেড়েক পরেই পুজো। আর সময় কোথায়’? তারপরের দিন স্কুলে যাবার সময় দেখতাম, শালের গুঁড়ির অনেকগুলো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। দু একদিন পরে দেখতাম শালের খুঁটির সঙ্গে বাঁশের কাজও শুরু হয়ে গেছে। আরো কয়েকদিন পর বাঁশের খাঁচা বানানো হয়ে যেত, আর মোটা ত্রিপল দিয়ে ঢাকা পড়ে যেত সেই মস্ত খাঁচা। ত্রিপলে ঢাকার পর শুরু হত আসল কাজ। নানান রংয়ের কাপড়ের কুঁচি বানানো। এই কুঁচি দেওয়া রঙিন কাপড়ে, ধীরে ধীরে অদ্ভূত সুন্দর হয়ে উঠতে থাকত সেই মণ্ডপ।  

কলেজ স্কোয়ারের মণ্ডপে যত রং ধরত, আমার স্কুলে যাবার ইচ্ছের রং তত ফিকে হয়ে আসতো। সারাবছর অনায়াসে হেঁটে যাওয়া স্কুলের রাস্তাটাকে মনে হতো কি কষ্টকর! মণ্ডপের সেজে ওঠা দেখতে দেখতে আমার দুটো  পা পাথরের মতো ভারি হয়ে উঠতো! বাবা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলতেন স্কুলের দিকে, বলতেন, ‘তাড়াতাড়ি পা চালা, হাঁ করা ছেলে। এরপর স্কুলের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে আর ঢুকতে দেবে না’।

আমাদের মাথায় তখন শুধু কি কলেজ স্কোয়ারের পুজো মণ্ডপ ঢুকে থাকত? ঢুকে থাকত পুজোর নতুন জামা প্যান্ট। ঢুকে থাকত সেই নতুন জামা প্যান্টের গন্ধ। স্কুল থেকে ফিরে, দুপুরে ভাত খেয়ে, মায়ের কাছে নতুন জামা প্যান্ট দেখানোর জন্য রোজ একবার বায়না করতাম। হাত বুলোতাম জামার গায়ে, গন্ধ নিতাম। দেখে হেসে ফেলতেন মা, বলতেন, ‘দ্যাখো, পাগল ছেলের কাণ্ড দ্যাখো, রোজ রোজ কী শুঁকিস কি’? জামার বুকে আর হাফ প্যান্টের পায়ের কাছে সুতো দিয়ে সেলাই করা থাকতো দোকানের লেবেল। লেবেলগুলোতে কি সুন্দর লেখা থাকত ‘কমলালয় স্টোর্স’।

একবার মনে আছে, পুজোয় অনেক বন্ধুদের নতুন জুতো কেনা হয়ে গেছে, আমার হয়নি। বাবা বলেছিলেন, আমার জুতোজোড়া নাকি বেশ ভালোই আছে, এবারে আর জুতো কেনার দরকার নেই। ভীষণ রাগ হয়েছিল বাবার ওপর, আর আমার খারাপ না হওয়া বিশ্বাসঘাতক জুতোর ওপর। পরদিন থেকে স্কুল চলার পথে, শুরু হল জুতোর ওপর অমানুষিক অত্যাচার। ফুটপাথে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। পাথরে, ইঁটের টুকরোয় অনেকবার ঠোক্কর খেলাম। কিন্তু জুতোর কিচ্ছু হল না। স্কুলে গিয়ে ডাবের খোলা দিয়ে ফুটবল খেলার বুদ্ধি দিল কয়েকজন বন্ধু। এই উপায়ে আমার অনেক বন্ধুই নাকি সফল হয়েছে। স্কুল শুরু হওয়ার আগে আর টিফিনের সময় চলতে লাগল আমাদের অনলস ফুটবলচর্চা।

ডাব নিয়ে ফুটবল চর্চার দিন তিনেকের মাথায়, আমার জুতো হাল ছেড়ে দিল। আমার ডান পায়ের বিদ্ধস্ত জুতোর তলা থেকে, মস্ত জিভের মতো, সোল খুলে গেল। আমার নিষ্ঠুর হাত থেকে তাও সে পরিত্রাণ পেল না। মায়ের হাত ধরে স্কুল থেকে ফেরার পথে, আমি পা ঘষে ঘষে, বিবর্ণ, বিকৃত করে দিলাম, আমার জুতোর সেই মস্ত জিভ। মা অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, “জুতোর এই দশা কী করে হলো? কী করিস কি স্কুলে গিয়ে”? আমি ঠোঁট উল্টে জবাব দিলাম, “আমি তো বলেইছিলাম, এ জুতো আর চলবে না। তোমরা বললে ভালোই আছে” থমথমে মুখে মা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। সেদিন আমার সারাটা দিন কাটল চাপা আতঙ্কে। মা এখন কিছু বললেন না ঠিকই, কিন্তু সন্ধ্যেবেলা বাবা অফিস থেকে ফিরলে? কী হবে? দিন যত গড়িয়ে চলল সন্ধের দিকে, আমার বুকের ভেতর ঢিব ঢিব ততই বাড়তে লাগল।

 

বাবা ফিরলেন, জল খাবারের পর মা আমার জুতোর করুণ অবস্থার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। বাবা উঠে গিয়ে নিজের চোখে দেখলেন আমার জুতোর দশা। ঘরে ফিরে কিছু বললেন না। আমার দিকে তাকিয়ে একবার দেখলেনও না। মাকে বললেন, “কালকেই আমি ও জুতোর ব্যবস্থা করছি, দাঁড়াও না”

সেই জুতোজোড়া সঙ্গে নিয়ে পরদিন বাবা অফিসে গেলেন, দিন সাতেক পর আবার অফিস থেকে ফেরার সময়েই জুতোজোড়া ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। মেঝেয় ফেলে দিয়ে মাকে বললেন, “কেমন সারিয়েছে, দেখো। একদম নতুন করে দিয়েছে

মা অবাক হয়ে হাসি মুখে বললেন, সত্যি তো, বোঝাই যাচ্ছে না। যা হাল করে নিয়ে এসেছিল, একদম নতুন হয়ে গেছে

“বাটার দোকানে দিয়েছিলাম, ওরাই সারিয়ে দিয়েছে। ওরা বলল, ‘এ জুতো আরো অন্ততঃ দু বছর চলে যাবে। কিছু হলে নিয়ে আসবেন, আবার সারিয়ে দেব। এ জুতোর নাম নটি বয়, খুব টেকসই’”


আমি হিংস্র চোখে তাকিয়ে রইলাম সেরে ওঠা চকচকে মজবুত জুতোজোড়ার দিকে। আমার পাদুটোকে গ্রাস করার জন্যে ওদুটো হাঁ করে হা হা হাসছিল। ওরা যদি নটি বয় না হবে তো, কে হবে, আমি?

--00--


নতুন পোস্টগুলি

ধর্মাধর্ম - ৩/২

  ["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের প্রথম পর্বাংশ  পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে " ধর্মাধর্ম - ৩/১ " তৃতীয় পর্ব - দ্বিতীয়  পর্...