Powered By Blogger
রম্য রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রম্য রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৫

চোত-বোশেখের পালা

 

চৈত্রসংক্রান্তি, ১৩৪৬ বঙ্গাব্দ

    আমাদের ছোটবেলাকার কালের সে সব দিন অন্যরকম ছিল। আমরা কাছাকাছি জেলার গেরাম গঞ্জ থেকে কলকেতায় আসিতাম রুজি রোজগারের আশায় কিংবা আমাদের ছেলে পিলেরা আসিত ভালো নেকাপড়া শিকিয়া দেশের দশের উবগার করার আশায়। মৌমাচির চাকের মতো আমরা বাসা বাঁধিতাম কলকেতার মেসবাড়িগুনোতে। সে সব মেসবাড়িতে দিনরাত ভনভন ভ্যানভ্যান লাগিয়াই থাকিত। আমাদের সংগে কলকেতার তকনো এত মাকামাকি হয়ে ওটেনি, আমারা হপ্তা-পনেরদিন কলকেতায় থাকিতাম ঠিকই, কিন্তু ছুটিছাটা পাইলেই ন্যাজ তুলিয়া গেরামের বাড়িতে পলাইতাম। কলকেতাকে আমরা তকনো পরবাস ভাবিতাম, গেরামের বাড়িতে ফিরিয়া ডাঙ্গার মাচ জলে পড়িয়া যেন পরাণ ফিরিয়া পাইতাম।

    চোত মাসের প্রায় পুরোটাই - বাসন্তীপুজো, রামনবমী, চড়কের মেলা সব মিলিয়ে গেরামে টানা মোচ্ছব চলিত  এই মাসে বাড়িতে কুটুম্বদের আসা-যাওয়া চলিতেই থাকিত। ঘরে ঘরে খাওয়া দাওয়া, বাহিরে ড্যাং ড্যাংআ, ড্যাং ড্যাং ঢাকের বাদ্যি; গেরামের ছেলেপিলের দল আমরা খুব মজিয়া থাকিতাম।  

    বেলা একটু বাড়িলেই, মাঠের দিকে চাহিয়া দেকিতাম চোতের রোদ্দুরে দূরের ঝোপঝাড়, গাছপালা ঝিলিমিলি করিতএলোমেলো শুকনো হাওয়া বহিত শনশন। শীতের ঝরাপাতা, সেই হাওয়ার হাত ধরিয়া ঝরঝর শব্দে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ঘূর্ণী নেত্য করিতআর জলখাবারের বেলা পার হইলেই আমরা সেই ডাক শুনিতাম “বাবা তারকনাতের চরণের সেবা লাগি, বাবা মহাদেএএএব” মাঠের ওধার থেকে ডাক দিয়ে দিয়ে একমাসের ব্রত লইয়া সেই সন্নিসির দল গেরস্তর বাড়ির দুয়োরে দুয়োরে ভিখ মাগিয়া বেড়াইত। আমাদের দোরের সামনে আসার আগেই ঠাকমা বলিতেন “অ বউমা, ওই সন্নিসির দল আসছে, সিধে ঠিক করো, বাছা” সিধে মানে সিদ্ধ করিয়া খাইবার যোগাড়। তাহার মধ্যে থাকিত, আতপ চাল, একটু মুগ, ছোলা কিংবা মটর ডাল, আর টুকটাক কিছু সবজি - আলু, বেগুন, কাঁচকলা কিংবা কুমড়োর ফালি। ছোট বেতের বোনা ধামায় মা সিধে সাজাইয়া তুলিতেনছোট্ট একটি মাটির কটোরায় একটু সরষের তেল, অন্য আরেকটি ভাঁড়ে নুন, কাঁচালংকা। আমাদের দুয়োরের সামনে সেই সন্নিসিদের দল এসে দাঁড়াইত আর বলিত “জয় বাবা তারকনাতের জয়” ঠাকুমা কিংবা মা তাদের ঝোলায় সেই সিধে ঢালিয়া দিত সিধে নেওয়ার পর সন্নিসিরা বলিয়া উঠিত “জয় বাবা মহাদেবের জয়”

    এই ধরনের ব্রত রাখা সন্নিসিরা ছিল একাহারী, দিনের বেলায় একবার মাত্র দুপুরের ভোজন, সূর্যাস্তের পর খাওয়া নিষিদ্ধ। সন্নিসিদের আরো নিয়ম ছিল, তাদের দলের সকলের একবেলার মতো খাবার যোগাড় হইলেই ভিক্ষার সমাপ্তি একেই মাধুকরী বলা হইত। পরের দিনের জন্য খাবার জমাইয়া রাখিলে ব্রতর বিধি ভাঙ্গিয়া যাইত, আর বাড়তি চাল ডাল সবজি বিক্রি করিবার কোন প্রশ্নই ছিল না, সে ছিল মহাপাপ। পর্যাপ্ত সিধে যোগাড় হইয়া গেলে, তারা মাঠের ধারের পায়ে চলা পথ ধরিয়া চলিয়া যাইত চড়ক মেলার মাঠে। খোলা মাঠের মধ্যে কাঠকুটা যোগাড় করিয়া, ইঁট কিংবা পাথরের টুকরোর ওপর মাটির বড়ো মালসার মধ্যে রান্না করিত ফ্যানভাত, সবজিসেদ্ধ, ডালসেদ্ধ। রান্না সারিয়া, পুকুর হইতে ডুবকি স্নান সারিয়া, তাহারা সবাই গোল হইয়া বসিয়া সরিষার তৈল আর নুন মাখিয়া সিদ্ধান্ন সেবা করিত। হাপুস হুপুস শব্দ উঠিত, জিভে কাঁচালংকার ঝাল লাগিলে আওয়াজ করিত সি সি সি সি। খাওয়া সাঙ্গ হইলে মাটির যতো মালসা আর পাত্র ফেলিয়া দিত আস্তাকুঁড়ে। বাসনপত্র, তৈজস সামগ্রী কোন কিচুর প্রতিই লোভ কিংবা মায়া যেন না আসে, তাই এই বিধানযাহাদের এই মায়া থাকে তাহারা তো সন্নিসি নয়, তাহারা গেরস্ত।

    একমাস অবধি এই সন্নিসিব্রতর পর শেষ দিনে এই সন্নিসিরা এবং আশে পাশের অন্য গ্রামের সন্নিসিরাও আসিয়া জড়ো হইত চড়ক মেলার মাঠে। মোটা শালের লম্বা বল্লীর অনেকটা মাটিতে গাড়িয়া খাড়া হইত চড়ক গাছ। তাহার মাথায় লোহার তৈরি মোটা শূল। শক্ত পোক্ত লম্বা একটি বাঁশের ঠিক মাঝখানে গোল ফুটা করিয়া লোহার রিং পড়ানো থাকিতগোল এই ফুটার মধ্যে শালের মাথার শূলের উপর বসাইলে, চড়কগাছ প্রস্তুত, মস্ত এক T-র মতো দেখিতে হইত সেই বাঁশের দুই প্রান্তে থাকিত লোহার মোটা হুক, সেই হুকের মধ্যে লম্বা রশি পড়ানো থাকিত। রশির এক প্রান্ত ধরিয়া থাকিত বয়স্ক আর অভিজ্ঞ কয়েকজন সন্নিসি। আর অন্য প্রান্তে থাকিত পোক্ত লোহার তৈরি বঁড়শির মতো হুক। দুই প্রান্তের দুই হুকে, কোমরে দড়ি বাঁধিয়া এবার দুই সন্নিসি বলিয়া উঠিত “বাবা তারকনাথের সেবা লাগি”সমস্বরে উপস্থিত সমস্ত লোক চিৎকার করিয়া উঠিত “বাবা মহাদেব”এইবার অন্য প্রান্ত ধরিয়া থাকা অভিজ্ঞ সন্ন্যাসীরা, রশিতে টান দিতেই, কোমরে হুক বাঁধা ওই দুই সন্নিসি ঝুলিয়া পড়িত শূণ্যে। রশির টানে তাহারা দুইজন, উঁচুতে আরো উঁচুতে উঠিতে উঠিতে, চড়ক গাছের T-র দুই প্রান্তে  দুলিতে থাকিত ওপর থেকে সন্নিসি দুইজন চিৎকার করিয়া বলিত “বাবা তারকনাথের সেবা লাগি” নিচেয় দাঁড়ানো, অভিজ্ঞ সন্ন্যাসীরা স্বস্তির শ্বাস লইয়া বলিত “বাবা মহাদেব” এই দুই জয়ধ্বনির অর্থ অনেকটা সংকেতের মতো। ওপরের দুই সন্নিসি জয়ধ্বনি দিয়া আসলে বলিল, তাহারা ঠিক আছে, কোনকিচুর অসুবিধে নাই। আর নিচের সন্নিসিরা জয়ধ্বনিতে নিশ্চিন্ত হইয়া যেন বলিল, যাক বাবা, এবার তবে শুরু করচি

    এই শুরু হইবার সময়টাতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসিত। কারণ, নিচের সন্ন্যাসীদের দড়ির টানে তখন চড়ক গাছের মাথা ঘুরিতে শুরু করিয়াছে। ঘুরিবার গতি বাড়িতে বাড়িতে চড়ক গাছের মাথা বন বন করিয়া ঘুরিতে লাগিত সুতোয় বাঁধা ঢিলের মতো, ঝুলিতে থাকা দুই সন্ন্যাসীও মহাশূণ্যে ঘুরিতে থাকিত বন বন করে। সেই দৃশ্যে ভয়ে আমার চোখ বন্ধ করিয়া ফেলিতাম, সর্বদা মনে হইত, যদি কিছু একটা ঘটিয়া যায়, সন্নিসি দুইজনার কি হইবে! আশেপাশের দর্শকরা ভয়াকুল বিস্ময়ে চিৎকার করিয়া উঠিত “জয় বাবা মহাদেবের জয়”

     সেকালে চড়কের মেলায় চড়কগাছের ওই ভয়ংকর খেলা ছাড়াও আরো অনেক খেলা দেখিয়া শিহরিত হইতাম। সন্নিসিরা জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়া নগ্ন পদব্রজ করিতেন। কেহ কেহ জিহ্বায় লৌহ শলাকা বিদ্ধ করাইত; কেহ বা হাতের জ্বলন্ত মশালে মুখ হইতে ক্যারাসিন তৈল নিক্ষেপ করিয়া, আগুনের তীব্র হলকা সৃষ্টি করিত। সন্নিসিদের এইসব ভয়ংকর খেলা দেখিয়া বাল্যকালে আমরা অভিভূত হইতাম। এই সব খেলা দেখিবার পর পিতার হাত ধরিয়া আমরা মেলার নানান পসরা দেখিতাম। পাঁপড় ভাজা, জিভে ছ্যাঁকা দেওয়া জিলিপি, আলুর চপ, বেগুনি সহযোগে মুখের স্বাদ বদল করিতাম। মায়ের জন্যে কিনিতাম লোহার সাঁড়াশি, তেল উঠাইবার পলা, আলতা, সিঁদুর, ভগিনীদের জন্য কাঠের পুতুল, কাঁচের রঙিন চুড়ি আমরা ভ্রাতাগণ মাটির তৈরি কলা ও পেয়ারা, সুভাষ বোস ও রবি ঠাকুর, কাঠের গোশকট, জিভ বের করা তুলার কুকুর লইয়া বাবার সঙ্গে যখন ফিরিতাম, সূর্য তখন পাটে বসিবার যোগাড় করিতেছেন। মেলায় দীর্ঘক্ষণ ঘুরিয়া পরিশ্রান্ত কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে পিতা কাঁধে তুলিয়া লইতেন। পিতার কাঁধে উঠিয়া পথচলার মজাই আলাদা। কনিষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি স্নেহ মিশ্রিত ঈর্ষা লইয়া, পিতার হাত ধরিয়া আমরা আপন গেরামে ফেরার পথ চলিতাম। 

পয়লা বৈশাখ, ১৩৬৬ বঙ্গাব্দ

    সেই কালে মোকাম কলকেতার নানান অঞ্চলে চড়কের মেলা বসিত। আমাদের শৈশবে কিংবা বাল্যে দেখা আমাদের গেরামের মেলার সহিত তাহার বিস্তর ফারাক। কলকেতার মেলায় অনেক বেশি জাঁকজমক। কাঠের নাগরদোলাকাঠের হাতিঘোড়ায় বসিয়া বন বন করিয়া ঘুরিবার মেরি-গো-রাউণ্ড। চোখধাঁধানো মনোহারি পসরা কিংবা খাদ্যসামগ্রী, সব ব্যাপারেই কলকেতার মেলা বিশিষ্টকাঁচের ও চিনামাটির তৈরি সায়েব-মেম পুতুল। রূপার তবক দেওয়া মিঠা পান। নানান রঙের সিরাপ দেওয়া, বরফ শীতল রঙিন সরবৎ। মালাই কুলফি। যুবা বয়েসে বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়িয়া কলকেতার মেলা বেশ কয়েকবার দেখিয়া অবাক হইয়াছিলাম, কিন্তু তাহাতে প্রাণের সাড়া পাই নাই। বরং মজা পাইয়াছিলাম অন্যত্র।

    কলকেতার চেতলার হাট মশারি আর মাছের জালের জন্যে বহুদিন হইতেই বিখ্যাত। কিন্তু আমি চেতলার যে মোহজালে মুগ্ধ হইলাম তাহা সংয়ের সাজ। পয়লা বোশেখের আগে ও পয়লা বোশেখের দিন চেতলার সং দেখিতে জন সমাগম হইত বিস্তর। কার্বাইড গ্যাসের চোখধাঁধানো উজ্জ্বল আলোয় বিচিত্র বেশে বেশ কিছু লোক সাজিয়া উঠিত কলকেতার বাবুদের নষ্টামি, আখড়ার মহারাজদের ধ্যাষ্টামি, কূলবধুদের গোপন ভ্রষ্টামি, মোহান্ত এলোকেশী সম্বাদ; এসব নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ তো ছিলই। তাহার উপর আরো থাকিত নির্ভেজাল হাসির উপস্থাপন। বুকফাটা কান্না, দমফাটা হাসি, আহ্লাদে আটখানা, কাজের ভারে কুঁজো। সন্ধ্যার পর জেলেপাড়ার সঙদের সেই মিছিল সমাবেশ, উপস্থিত জনগণের সহিত আমরাও অত্যন্ত উপভোগ করিতাম।

    পয়লা বোশেখের দিন সকালে ভৃত্যের মাথায় বেতের ধামায় লাল শালুমোড়া জাব্দা খাতা, শ্রীগণেশ ও শ্রীলক্ষ্মীর মূর্তি, লক্ষ্মীদেবীর ঝাঁপি লইয়া বাবুদের কেরানীরা দলে দলে আসিতেন কালীঘাটের কালী মন্দিরে। মন্দিরে পুজার ভিড়ে রীতিমতো হট্টগোল উপস্থিত হইত। দাপুটে বাবুদের কেরানীরা অর্থের দাপট দেখাইতে কসুর করিতেন না, তাঁহাদের উৎকোচে মন্দিরের পুরোহিতগণের মধ্যে হুড়াহুড়ি পড়িয়া যাইত। এই পুরোহিতগণ মাকালীর সহিত সরাসরি যোগাযোগ ঘটাইয়া সম্বৎসরের ব্যবসার সুবন্দোবস্ত করিয়া দিবার আশ্বাস দিতেন। পুজার পর তাঁহারা জাব্দা খাতায় আলতাকালিতে উপরে ‘ওঁমা’, তাহার নিচে ‘শ্রীশ্রীকালিমাতা সহায়’ লিখাইয়া লইতেন। তাহার নিচে স্বস্তিকা চিহ্ন আর একদম নিচের দুই কোণায় আলতায় ডোবানো রৌপ্যমুদ্রার দুই পিঠের মোহর।

    কলকেতা শহরে সে সব মেলা আজিকালি আর তেমন দেখি না। লোকে আজিকালি অন্ধকার ঘরে টিকিট কাটিয়া বায়োস্কোপ দেখে। তাহারা নায়ক নায়িকাদের গান আর মেকি হাসিকান্নায় মজিয়া থাকে। শুনিয়াছি কলকাতার নব্য বাবুরা এখন চড়কের মেলা, সং ইত্যাদির আনন্দকে “ছোটলোকি” বলে। বলে এসব সেকেলে ফক্কুড়ি দেখিয়া সময় নষ্ট করিবার মতো সময় তাহাদের নাই। হবে হয়তো। আমাদের যৌবনে আমরা তো এসব খুবই উপভোগ করিতাম। আজিকালি বয়স হইয়াছে, এ যুগের ছোকরাদের মতিগতি আর বোধগম্য হয় না।  

    আমার গিন্নি পয়লা বোশেকের ছুটির দুপুরে বড়োই তরিবতে রন্ধন করেন। সজনে ডাঁটার শুক্ত, রুই মাছের মুড়ো দেওয়া ভাজা মুগের ডাল, ঝিরিঝিরি আলুভাজা, পটল-আলুর মাখোমাখো তরকারি, রক্তরাঙা ঝোলের মধ্যে দুইখানি অর্ধগোলক আলু সহ অনেকটা কচিপাঁঠা, কাঁচা আমের পাতলা অম্বল। সবার শেষে মিঠে দধি। এইরূপ আকণ্ঠ মধ্যাহ্ন ভোজের পর, গালে গিন্নির হাতের পান লইয়া, পয়লা বোশেখের দুপুরটি দিবানিদ্রায় অতিবাহিত করি, জানালা দরোজা বন্ধ প্রায় অন্ধকার ঘরে।

    দিবানিদ্রা সারিয়া বারান্দায় যখন বসি, পথের আলো জ্বালাইবার জন্য পুরসভার কর্মচারিরা লম্বা আঁকশি হাতে দৌড়াইয়া চলে। পাড়ার যতো বাড়ির দরোজায় দরোজায় বেলফুলের মালা লইয়া ফিরিওয়ালা ডাক পাড়ে “বেইলফুউউল”। তাহার চিকন কণ্ঠের সুরে ও বেলফুলের সৌরভে প্রথম বৈশাখের সন্ধ্যাটি বড়ো মধুর হইয়া উঠে। তাহার পশ্চাতে আসে মালাইবরফ এবং কুলফি মালাইয়ের ফিরিওয়ালা। পাড়ার বখাটে ছোকরার দল তাহাকে আড়ালে ডাকিয়া সিদ্ধি মিশ্রিত কুলফি মালাই খাইয়া অকারণ হাসিতে পাড়া মাতায় তোলে।

    সন্ধ্যা একটু গড়াইলে, পাটভাঙা ধুতি আর গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি পড়িয়া রাশভারি মুখে বাহির হই। পায়ের পাম্পশুতে মচ মচ ধ্বনি তুলিয়া যখন হাঁটি নিজের ভারিক্কি চালে নিজেই অবাক হই। গেরামে থাকিতে যাহারা আমাকে ‘আত্তাঁ’ বলিয়া চিনিত, তাহারা আমার এই ‘আত্মারামবাবু’ মার্কা চেহারা দেখিলে কিরূপ ভিমরি খাইত কল্পনা করিয়া, বড়ো আল্লাদ পাই।

    কালেজ স্ট্রিটের মেডিক্যাল কলেজের বিপরীতে কল পাইপের বিপণিগুলির অধিকাংশই আমাদের দেশজ সুহৃদদের মালিকানা। হালখাতা উপলক্ষে এই সব বিপণির উদার হৃদয় মালিকেরা অতিথি আপ্যায়নের বিপুল আয়োজন করিয়া থাকে।

    দোকানের প্রবেশ পথেই একজন কর্মচারী পিচকারি হইতে মাথায় মুখে গায়ে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করিয়া গোলাপজল ছিটাইয়া দেয়। সদ্য গ্রাম হইতে আসিয়া কলকেতা নিবাসী হইবার পর যেবার প্রথম হালখাতা অনুষ্ঠানে আসিয়াছিলাম, এই ঘটনায় অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াছিলাম। বলা নাই কওয়া নাই, খামোখা আমার গাত্রে জল ছিটাইয়া দেওয়া, এ কী ধরনের রসিকতা? সৌভাগ্যক্রমে সেই ক্ষণে বিপণির মালিকপুত্র “আসুন খুড়ামহাশয়” বলিয়া আমার হাতে ঝাউপাতায় মোড়া গোলাপকলি উপহার দিয়া ভিতরে বসাইয়াছিল। নচেৎ সেদিন হয়তো কুরুক্ষেত্র বাধাইয়া নিজেকেই হাস্যাস্পদ করিতাম। বসিবার পর দেখিয়াছিলাম ওই কর্মচারি সকলকেই ওই জল ছিটাইতেছে, ও তাহাতে গোলাপের সুবাস। ক্রোধ প্রশমিত হইলে, নিজ গাত্রেও ওই গোলাপজলের সুবাস উপলব্ধি করিয়া চমকিত হইয়াছিলাম।

    বিপণির ভিতরের প্রাত্যহিক ব্যবসায়িক পরিবেশ আজ নাই উজ্জ্বল আলোর নিচে ফরাস পাতা, তাহাতে ধবধবে চাদর বিছানোফরাসে বসিয়া অশীতিপর এক মুসলিম বৃদ্ধ সানাই বাজাইতেছেন। তাঁহার সহিত তবলায় একজন সঙ্গত করিতেছেনসেই সানাইয়ের মাঙ্গলিক সুর যেন নতুন বর্ষের শুভদিনের সূচনা করিতেছে। কিন্তু আশ্চর্য, সেই সুরের প্রতি উপস্থিত কাহারো মনোযোগ নাই। সকলেই নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপে ব্যস্ত। সকলের হাতেই কি এক পানীয়ের বোতল, তাহাতে সরু পাইপ বসানো। সেই পাইপে ঠোঁট লাগাইয়া হাল্কা চুমুকে সকলে পানীয়ের মজা লইতেছে। এই পানীয় কি সুরা জাতীয় কিছু? কলকেতার বাবুরা কি প্রকাশ্য সন্ধ্যালোকে নির্লজ্জের মতো মদ্যপান করিয়া থাকে?

    এই সব ভাবিতে ভাবিতে বিপণির মালিক অমিয়ভূষণ মহাশয়, আমার কাছে আসিয়া নমস্কার করিয়া বলিলেন, ‘সব ভালো তো আত্তাঁ, কোন রকম সংকোচ করবা না। আরে একি, তোমাকে কোল্ডিংক দেয় নি? অ্যাই ব্যাচা, এদিকে একটা কোল্ডিংক নে আয়। বাড়ির সব খপর ভালো? বাচ্চা পরিবার, সবাই? হে হে হে, খুব ভালো। আরে আসুন আসুন বিপত্তারণবাবু, আজকাল আপনার আর দ্যাকাই পাওয়া যায় না, আমি ওদিকটা একবার দেকে আসি, যেদিকটা না দেকবো, সেকানেই ...বোয়লে না?” অমিয়ভূষণবাবু অন্যদিকে যাইবার পরেই ব্যাচা নামের ছোকরাটি আমার হাতে এক বোতল শীতল পানীয়ের মধ্যে সরু পাইপ ডুবাইয়া দিয়া গেল। অন্যদের দেখাদেখি কায়দা করিয়া আমিও পাইপে অধর চাপিয়া পানীয় টানিয়া লইলাম। স্বাদ মন্দ নয়। স্বাদ ও গন্ধে মদ বলিয়াও মনে হইল না, কারণ ইহার পূর্বে ছোকরাকালে কুসঙ্গে পড়িয়া দু একদিন ব্রান্ডির স্বাদ লইয়াছিলাম।    

    কিন্তু ও কী ও, আমার এ কী হইল? পানীয় গলাধঃকরণের পরই পেটের মধ্যে বিশাল উদ্গারের উদ্গম হইল। আমি রোধ করিতে পারিলাম না, আমার কণ্ঠ হইতে অদ্ভূত এক শব্দ নির্গত হইল। মনে হইল আমার উদরের অজ বালক পুনর্জীবন পাইয়া তাহার মাতার সন্ধানে ডাকিতেছে। আমার আশেপাশে উপবিষ্ট, বিশিষ্ট জনের দুই চারিজন আমার বাণীতে চমকিত হইলেন, ঘাড় ফিরাইয়া আমার আপাদমস্তক মাপিয়া লইলেন। ইহার পর ওই ভুল আর করি নাই, পাইপে হাল্কা টানে অল্প পানীয় পান করিতে লাগিলাম। তাহাতেও ছোট ছোট উদ্গার উঠিতেছিল, কিন্তু আমি সেগুলিকে নাসিকা পথে ছাড়িতে লাগিলাম। তাহাতে নাসিকা জ্বলিতে লাগিল, কিন্তু সম্মান রক্ষা হইল। এমন পানীয় মনুষ্যজাতির সভ্যতায় কোন মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত করিবে, বলিতে পারি না।

    অমিয়ভূষণবাবুর বিপণি হইতে দুইখানি বাঙ্গালা ক্যালেণ্ডার ও দুই বাস্কো মিষ্টান্ন লইয়া বিদায় লইলাম। তাহার পর আরো ছয়খানি পরিচিত বিপণিতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিয়া টানা রিকশয় গৃহে ফিরিলাম। আমার বগলে তখন পাঁচখানি বাঙ্গালা ক্যালেণ্ডার ও দুই হাতে নয় বাস্কো মিষ্টান্নআরো দুইখানি হাত থাকিলে, আরো কয়েকটি বিপণিতে যাইতে পারিতাম ভাবিয়া আক্ষেপ হইল। কিন্তু বিধির বিধানে হাত মাত্র দুইখানি!

    রাত্রের রন্ধন হইতে মুক্তি পাইয়া আমার গৃহিণী আনন্দিতা হইলেন। দুই পুত্র ও দুই কন্যা সহ আমরা সকলে নয়খানি বাস্কো উদরসাৎ করিয়া পরিতৃপ্ত হইলাম। গৃহিণীর বানানো একখানি পান গালে লইয়া বাহিরের বারান্দায় দাঁড়াইলাম। ভাবিলাম পয়লা বোশেখের মঙ্গলরাত্রি বড়ো আনন্দে যাপিত হইল।

    জানি না কেন এই সময় মনে পড়িল সেই শীর্ণ বৃদ্ধ সানাইশিল্পীর কথা। তাঁহার সানাইবাদনের প্রতি আমাদের কাহারো বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। একদল শূকরের সম্মুখে ছড়ানো মুকুতার মতো তাঁহার শিল্প প্রয়াস তিনি বিতরণ করিতেছিলেন, শুধুমাত্র তাঁহার নিজের ও পরিবারের উদরপূর্তির প্রত্যাশায়। একজন শিল্পীর, নামজাদা নাই বা হইলেন, এ হেন অবহেলা আমরা না করিলেও পারিতাম।

    পয়লা বৈশাখে নববর্ষের এই শুভ দিনটিতে তাঁহার সানাইয়ের সেই মাঙ্গলিক সুর কলকেতার স্বার্থ সন্ধানী মানুষের অন্তরে এতটুকুও দাগ রাখিতে পারিল না। আগামী কল্য দোসরা বৈশাখ, আর পাঁচটা সাধারণ কর্মব্যস্ত দিনের সহিত এতটুকুও ফারাক থাকিবে না। সকালে গৃহিণীর প্রস্তুত মৎস্যের ঝোল-ভাত নাকে মুখে গুঁজিয়া দপ্তরে যাইব। দিনগত পাপক্ষয় করিতে করিতে আরও একটি বৎসর পার হইয়া জীবনে আরও এক পয়লা বৈশাখ আসিবে, ভাবিতে ভাবিতে কখন ঘুমাইয়া পড়িলাম মনেও নাই।

-   ০০ –

[আত্মারাম বাগচি মহাশয়ের জন্ম প্রাক-স্বাধীনতা যুগে, কর্ম উত্তর-স্বাধীনতার দিনগুলিতে। তাঁর স্মৃতিকথার আংশিক পরিমার্জিত রূপ “চোত-বোশেখের পালা”; বানান ও শব্দ ব্যবহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।]

বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০২৫

রোববার - ২

 

রোববার -২

হিন্দী সিনেমায় প্রায়ই এমন হয়। ভিলেনের সাংঘাতিক ডেরায় এক হিরো ভারি ভারি শিকলে বন্দী, পায়ের তলায় প্লাস্টিকের ভুখা কুমীর ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্য হিরো ঝনঝনিয়ে কাচের জানালা ভেঙে ঢুকে পড়ল অকুস্থলে। ঢুকেই দেখল খেলনা বন্দুক হাতে ঝুড়ি ঝুড়ি কাতিল ভিলেনের সাঙ্গপাঙ্গ সবসেও পড়ে গেল ভিলেনের খপ্পরে। দুই হিরোকে বন্দী করে ভিলেন এবার শুরু করল তার সাত পাতার ডায়ালগ। তার আজীবন করে আসা কুকীর্তির বিশাল ফর্দ। লাস্টে মিচকে হাসি হেসে ঘোষণা করল দুই হিরো আসলে বচপনমে বিখরে হুয়ে দুই ভাই। ভেইয়া চোখে চোখে কথা শুরু দুই ভাইয়ে। তারপর যা হয় সেটা সিনেমায় দেখে নেবেন সবটা বললে আড়াই ঘন্টার হিন্দী সিনেমার জমাট রহস্যটাই মাটি।

কিন্তু সাড়ে চার ঘন্টা উইথ চড় চাপড় চর্চার পর যে ছেলেটি ওখানে দাঁড়িয়ে আছে সে আমার ভাই হয় শুনে আমি মোটেই আনন্দ পাইনি। মনে হয়েছিল ভাইটা খামোকা ওখানে দাঁড়াল কেন? আর দাঁড়ালই যদি তো আমার ভাই হতে কে ওকে মাথার দিব্বি দিয়েছিল। কারণ ওটাই ছিল আমার ট্রানস্লেসানের লাইন। The boy who stands there is my brother.

লখী বাবুকা সোনা চাঁদি গহনাকা দুকান। আসলি শব্দটা ভিন্ন ভিন্ন শব্দের সামনে বসিয়ে একসময় বেশ কিছু দোকান চালু ছিল। যেমন আসলি লখী বাবুকা..., লখী বাবুকা আসলি সোনা..., লখী বাবুকা সোনা আসলি চাঁদিকা..., লখী বাবুকা সোনা চাঁদিকা আসলি গহনাকা...ইত্যাদি। ঠিক সেই রকম বয়, হু, স্ট্যান্ডস আর ইজ এই চারটে শব্দ স্থানে অস্থানে সামনে পিছনে বহুবার বসিয়েও বাবাকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি সেদিন। যেমন   দি ব্রাদার ইজ মাই বয় হু স্ট্যান্ডস দেয়ার, দি হু ইজ মাই দেয়ার স্ট্যান্ডস ব্রাদার বয়... এই রকম সবসত্যি বলতে সেদিন থেকেই আমি সকল বেরাদরির ওপর বিশ্বাস হারিয়েছি।

এরকম আরো কিছু ছিল। স্টেসনে পৌঁছানোর আগেই ট্রেন ছেড়ে দিল। আর ডাক্তার পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই রোগী মারা গেল। কোনটা আগের আর কোনটা পরের অতীত। আরো সহজে বললে পুরোনো ভূত আর আনকোরা ভূত খুঁজে বের করার সেই একই বিড়ম্বনা নো সুনার হ্যাড ... । নাঃ - এটা আর ট্রাই করব না। এই বয়সেও ভুল করলে বেইজ্জতের একশেষ হবো।

তখন আমাদের বাড়িতে চিকেনের চল একদম ছিল না। আর হরহপ্তায় মাংসও হতো না এখনকার মতো। মাসের প্রথম রোববারে মাংস হত পাঁঠা বা খাসি সামনের রাঙ বা গর্দান। পাড়ায় সব বাড়ি থেকেই ওই দিনে মাংস রান্নার গন্ধ উঠত।  আরো বড় হয়ে যখন প্রেসার কুকার চালু হল, তখন রবিবারে বারোটা সাড়ে বারোটার সময় কোরাসে কুকারের সিটি বহুবার শুনেছি পাড়ায় সব বাড়ি থেকে।

বিশেষ এই মাংস হওয়ার রবিবারেই পড়ার চাপটা পড়ত বেশী। মাংস কষার সময় থেকে মায়ের রান্নাঘর থেকে গন্ধ এসে ভুলিয়ে দিত ইংরিজির টেনস, ফ্রেজ, ইডিওমস, কগনেট অবজেক্ট, পার্টিসিপল, অ্যাডজেকটিভ, ন্যারেসন, ভয়েস চেঞ্জ... অথবা সংস্কৃত ব্যাকরণ কৌমুদীর শব্দ ও ধাতুরূপ, প্রত্যয়, সমাস, অপিনিহিতি, যোগরূঢি...। সব তালগোল পাকিয়ে একাকার মনে হত।

মাংস সেদ্ধ হয়েছে কিনা আর নুন ঠিক আছে কিনা টেস্ট করে দেখার জন্যে এক এক পিস মাংস সঙ্গে একটু ঝোল আমাদের বরাদ্দ ছিল স্নান করার আগে। এটাকে আজকালকার রেস্তোরাঁর ভাষায় স্টার্টার বা অ্যাপিটাইজার বললেও চলে। ওই স্যাম্পলটা খাওয়ার পর আমার স্নানের সময়টা খুব সংক্ষিপ্ত হয়ে যেত। প্রায়ই মায়ের কাছে বকুনি খেতে হত চান করে বেরিয়ে আসার পরেও কানের পিছনে সাবানের ফেনা আর গোড়ালির পিছনে রাজ্যের ময়লা লেগে থাকার জন্যে।

আমার মাথায় তখন কিচ্ছু ঢুকছে না সে সময় পেরেক ঠুকলেও বেঁকে যেত এমনই নিরেট আমার মাথা। বাবাও ছাড়ার পাত্র নন, জিদ ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন - আমাকে দ্বিতীয় নেসফিল্ড বা পি কে দেসরকার এবং ঈশ্বর চন্দ্র দেবশর্ম্মা বানিয়ে তুলতে। আমার এই চরম দুর্গতির সময় মা স্টেজে অবতীর্ণা হতেন মা দুর্গার মতোই। দশ হাত নিয়ে নয়, দুহাতে দুটি - গরম ঝোলের ধোঁয়া ওঠা কাঁসার বাটি নিয়ে। সুগন্ধে জিভে স্যালাইভার বন্যা বইত আর পাকস্থলী থেকে সব কিসিমের পাচক এনজাইম নিঃসৃত হয়ে আমার মাথার নিরেট ভাবটাও বেশ ফিকে হয়ে আসত।

প্রথমে বাবার হাতে বাটি দিয়ে মা বলতেন, দ্যাখোতো নুন টুন সব ঠিক আছে কিনা..."। 

বাবা সুড়ুৎ শব্দে ঝোলে চুমুক দিয়ে বলতেন, ফাসক্লাস হয়েছে ভেরি গুড। 

আমি তখন উবু জ্বলন্ত গরম মাংসের টুকরো মুখে নিয়ে হিমসিম, জিভে গালে ছেঁকা মুখ হাঁ করে হা হা করছি ঠান্ডা হবার জন্যে। বাবার প্রশংসায় প্রসন্ন মা হাসি হাসি মুখে আমার অবস্থা দেখে বলে উঠতেন, দ্যাখো, দ্যাখো বোকা ছেলের কান্ড দ্যাখো, একটু ঠান্ডা হতে দে - কিরে সেদ্দ হয়েছে? আমি হা হা করা হাঁ মুখেই বড়সড় ঘাড় হেলিয়ে মাকে জানাতাম দারুণ।

এতক্ষণ রান্নাঘরের গরমে থাকার কারণে মায়ের স্বেদসিক্ত মুখে তৃপ্তির হাসি, বাবার প্রশংসা পেয়ে আর আমার অত্যাগ্রহ দেখে। দুচোখে স্নেহের অকূল পারাবার। সেই মুখ আর চোখের তুলনা পেতাম দুর্গা পুজোর সময় কলেজ স্কোয়ারে মা দুগগার ঘাম তেল মাখা মুখ আর চোখে। সে সময় প্রতিমা বানাতেন শ্রী রমেশচন্দ্র পাল।

আমার নেসফিল্ড হবার নিষ্ফল ও নিদারুণ প্রচেষ্টার দুর্গতি থেকে মুক্তি দিয়ে আমার মা, বাবাকে নির্দেশ দিতেন তাড়াতাড়ি চান করে নেবার জন্যে, তা না হলে খাবার দাবার সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। বাবাও চূড়ান্ত হতাশায় আমাকে মুক্তি দিয়ে বলতেন, তোমার এ ছেলের কিসস্যু হবে না, দেখো

আচ্ছা, আচ্ছা, ঘুনু হয়েই থাকবে না হয় চিরটাকাল তুমি এখন যাও তো, চান করে নাও

বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। মায়ের কথাও খেটে গেছে অবিকলবাবা মা কেউই আর নেই এই জীবনে। ঘুনু হয়ে থাকা জীবনের অজস্র দুর্গতির মধ্যেও দুর্গতিনাশিনী সেই দৃষ্টি কিন্তু সঞ্চারিত হয়ে এসেছে পরবর্তী প্রজন্মেও। আজকাল বড় হতে থাকা আত্মজার চোখে মেলে হারিয়ে যাওয়া সেই শান্তির অনুভব - দিনশেষে ঘরে ফেরা হা-ক্লান্ত মনে আর সেই ক্ষণটুকুই হয়ে ওঠে প্রকৃত রোববার।

-- ০০ --

আমার প্রথম গ্রন্থ "বিনিসুতোর মালা"-র একটি অধ্যায়।

বইটি ঘরে বসে অনলাইনে পেয়ে যাবেন "সৃষ্টিসুখ প্রকাশন" এর এই লিংক থেকে - 

https://sristisukh.com/ss_new/product/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BF-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%A4%E0%A7%8B%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BE/



শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

আমরি বাংলা - ১

বসার ঘরে ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে ফল্গু বলল, “দিদু, এই যে আমরা এখন ব্রেকফাস্ট খাচ্ছি তার কোন বাংলা নেই?” দিদু অর্থাৎ ফল্গুর দিদিমা কিছু বলার আগেই ফল্গুর মা নিভাদেবী বিরক্ত হয়ে বললেন, “বাংলা ভাষা নিয়ে পিএইচডি করছিস আর তুই ব্রেকফাস্টের বাংলা জানিস না? থাকবে না কেন? প্রাতরাশ।”

ফল্গু মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বলল, “ধ্যাৎ ওটা তো কলোনিয়াল বাংলা। ব্রেকফাস্টের সঙ্গে মিলিয়ে শব্দটা বানানো হয়েছে সংস্কৃত থেকে ধার করে। ওটা জানি, কিন্তু এই বাংলায় লোকেরা সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ-টুখ ধুয়ে কি কিছু খেত না? নাকি সেটাও আমাদের শিখিয়ে বৃটিশরা আমাদের ধন্য করে দিয়েছিল? যদি তা না হয়, তাহলে এই খাওয়াটাকে তারা নিশ্চয়ই কিছু একটা বলত। সেটা কি? গ্রামের মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির গিন্নিরা নিশ্চয়ই ছেলেমেয়েদের ডেকে বলতেন না, “ওরে খ্যাঁদা, পল্টু, বোঁচা, কুসমি, চম্পা প্রাতরাশ বেড়েছি, খাবি আয়”। অথবা “অ খ্যাঁদা, তোর বাবার প্রাতরাশটা বৈঠকখানা ঘরে দিয়ে আয়”। এটা সম্ভব বলে তোমার মনে হয়, মা?”

নিভাদেবী বললেন, “তোর যতো সব উদ্ভট চিন্তা। ওসব ভেবে আর হবেটা কি? আজ সারা উত্তর ভারত হাইওয়ে দিয়ে ঘুরে আয় – ছোট বড়ো ঢাবায় সর্বত্র – বাইরে টিনের বোর্ডে লেখা থাকে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার। তার মানে কথাগুলো শুধু বাংলা নয় সর্বত্র চালু হয়ে গেছে”।

“তা হয়েছে, মানছি। কিন্তু তার আগে কী বলা হত? দিদু জানো?”

ফল্গুর দিদিমা নাতনি আর মেয়ের কথা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিলেন। নাতনির প্রশ্নের উত্তরে মুচকি হেসে বললেন, “বলতো বই কি। সকালের খাওয়াকে বলত জলখাবার। দুপুরের খাওয়াকে বলত ভাত খাওয়া। আর রাত্রের খাওয়াটাকে রাতের খাবারই বলত। তবে সত্যি বলতে ওরকম পোশাকি মানে তোদের ভাষায় ফর্মাল নাম সত্যিই ছিল না। ওই যে তুই বললি না, মধ্যবিত্ত গিন্নিরা ছেলেমেয়েদের খেতে ডাকতেন, খ্যাঁদা, পল্টু মুড়ি বেড়েছি খাবি আয়। অথবা ছাতু মেখেছি খাবি আয়। দুপুরে ডাকতেন, ভাত বেড়েছি, খাবি আয়। কোন কোন উগ্রচণ্ডী মায়েরা রেগে গেলে বলতেন, “ভাত বেড়ে দিয়েছি, গিলে আমায় উদ্ধার করো”। আবার মায়েদের মুখে শুনেছি, স্বদেশী করা ছেলেদের মায়েরা ভাতের হাঁড়ি কোলে সারারাত জেগে অপেক্ষা করতেন। লাঞ্চ, ডিনার তো দূরের কথা – মধ্যাহ্ন-আহার কিংবা নৈশ-ভোজন এসব কথাও কাউকে কোনদিন বলতে শুনিনি – পড়েছি সাহিত্য-উপন্যাসে। ইংরিজিতে শিক্ষিত সাহিত্যিকরা বাংলা উপন্যাস লিখতে গিয়ে লাঞ্চ বা ডিনারের সমার্থক শব্দ বানিয়েছিলেন তৎসম শব্দ ধার করে।    

তার ওপর ধর, তখন তো আর ঘরেঘরে বা হাতেহাতে ঘড়ি ঘুরত না। লোকে এই খাবারের নামে সময়ও বুঝে যেত। যেমন ধর আমাদের ছোটকা কোথাও যাবে, মাকে বলল, “এই তো জলখাবার খেয়ে বেরোব, বাড়ি ফিরে ভাত খাবো”। সকলেই বুঝে গেল – ছোটকা সকাল সাড়ে আটটা-নটা নাগাদ বেরিয়ে, দুপুর দেড়টা-দুটো নাগাদ ফিরবে। ঘড়ির দরকারই হত না।    

আসলে সে সব দিনে আমাদের বাঙালী ঘরের প্রধান শস্যই ছিল ধান। তার থেকেই তৈরি হত, ভাতের চাল, মুড়ি, খই, চিঁড়ে। ছোলা বা যব গুঁড়ো করে ছাতু। ছোটবেলায় দুধ আর গুড় দিয়ে মাখা যবের ছাতু, আমরা কম খেয়েছি? বেশ আনন্দ করেই খেয়েছি”।

ফল্গু উজ্জ্বল মুখে বললে, “বাঃ বেশ বললে তো, দিদু”।

“বেশ কি বললাম জানি না, বাপু। আজকাল শহরে দেখেছি শনিবার রাত্রে ডিনার করতে করতে লোকে পরের দিন ব্রেকফাস্টে কী খাবে তার প্ল্যান করে। ছেলে বলে সাউথ ইন্ডিয়ান খাবো। মেয়ে বলে চিজ স্যাণ্ডুইচ। বাবা বলে লুচি-আলু চচ্চড়ি। মা বলে ছোলে বাটুরা। সকালে মুখ ধুয়ে ছেলে বা মেয়ে বসে পড়ে ফোন নিয়ে – সবার মনোমতো খাবারের অর্ডার দিয়ে দেয়। আধঘন্টার মধ্যে ঘরে পৌঁছে যায় গরমাগরম খাবার। ব্রেকফাস্ট। আমাদের সময় এমন কল্পনা করতে পারলে, আমাদের নাম আজ জুলে ভার্ন বা এইচ জি ওয়েল্‌সের মতো স্মরণীয় হয়ে থাকত”।

 

ব্রেকফাস্ট সাঙ্গ করে ফল্গু আর নিভাদেবী কফির আর দিদু ব্রজবালা চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। ফল্গুর কৌতূহল শেষ হয়নি, সে বলল, “আমাদের স্কুল লাইফ পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল রবি ঠাকুর ছাড়া বাংলা ভাষায় আর কেউ গান লেখেননি। বাংলা ভাষায় যা কিছু লেখা হয়েছে – কবিতা কিংবা গদ্য -গল্প, উপন্যাস”।

নিভাদেবী বিরক্ত হলেন খুব, “কি যাতা বলছিস? নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদের গান শুনিসনি?”

ফল্গু এতটুকুও বিচলিত না হয়ে বলল, “কোথায় শুনব, বলো। আমাদের স্কুলের যে কোন অনুষ্ঠানে, পাড়ার যে কোন ফাংশানে সর্বত্র শুনেছি রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাড়িতেও তুমি কিংবা বাবা গান চালাতে – বাংলা মানেই রবীন্দ্র সঙ্গীত – হেমন্ত, সুচিত্রা, কণিকা, দেবব্রত, সাগর, ঋতু। তাছাড়া বাবা কিশোরের আর লতার হিন্দি গান শুনতে পছন্দ করতেন। এ ছাড়া আমাদের গান শোনার কোন উপায় ছিল? ও হ্যাঁ আরেকজনের গান শুনতাম, পাড়ায় কালীপুজোর সময় – পান্নালালের শ্যামাসঙ্গীত। আমার ধারণা ছিল, গানগুলি ওঁরই রচনা। বাংলা নিয়ে পড়াশুনো করতে গিয়ে দেখলাম, ওরেব্বাবা, বাংলা গানের অথৈ ভাণ্ডার। আমাদেরকে সে সব শুনতেই দেওয়া হয় না। সে সব গানের এখনও চর্চা হয়, কিন্তু রবি ঠাকুরের ভারে সবাই চ্যাপ্টা হয়ে গেছে”।

ব্রজবালা বললেন, “আমার জন্ম স্বাধীনতার ন-বছর আগে। ছোটবেলায় রবিঠাকুরের গান যে শুনিনি তা নয়। তবে সে সব অধিকাংশই দেশাত্মবোধক – বাংলার মাটি, আমার সোনার বাংলা, সঙ্কোচের বিহ্বলতা, আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে। নজরুলের গানও খুব শুনেছি, কারার ওই লৌহ কপাট, দুর্গম গিরি কান্তার। সে সব গাইত আমাদের স্কুলের দাদা-দিদি, কিংবা মাস্টারমশাইরা। অর্থাৎ শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা। কিন্তু বললে বিশ্বাস করবি না, আমাদের কান জুড়িয়ে দিত চারণকবিদের গান। তাঁদের মধ্যে সবার সেরা ছিলেন মুকুন্দ দাস। সকলে বলত চারণ কবি মুকুন্দ। আহা সে কী গান – গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। ভয় কী মরণে, রাখিতে সন্তানে। আরেকটা গান ছিল, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।  সে গান মা, কাকিমা, ঠাকুরমাদের কানে গেলেই দেখতাম মন দিয়ে শুনতেন, তাঁদের চোখ জলে ভরে উঠত। বড়ো হয়ে, তখন ভারত স্বাধীন হয়ে গেছে, আমিও সে গান শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলেছি কতবার। আমি তো মুকুন্দ দাসের কণ্ঠে এ গান শুনিনি, শুনেছি আমাদের গ্রামে আসা গীতজীবীদের কণ্ঠে”।

নিভা অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালেন, ফল্গু জিজ্ঞাসা করল, “গীতজীবী মানে?”

ব্রজবালা লাজুক হেসে বললেন, “ভিক্ষার জন্যে কেউ কেউ গান গায়, সে গানে আন্তরিকতা থাকে না, এবং সে গানের মর্যাদাও সে বুঝতে পারে না। তার আসল লক্ষ্য ভিক্ষা, ভিক্ষা পেলেই গান থামিয়ে পাশের বাড়ি বা পাশের পাড়ায় হাঁটা দেয়। বাড়ির লোকজনও দেখতাম তাদের ভিক্ষে দিয়ে বিদায় করতে পারলে যেন বেঁচে যায়। অন্যদিকে কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁরা বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালে বাড়িতে সারা পড়ে যেত। ঠাকুমাকে বলতে শুনেছি, “অ কেষ্ট, অনেকদিন পর এদিকে এলি, বাবা। খপর সব ভালো তো”। আজ্ঞে খপর ভালই মা ঠাকরোন, এদিকে ছিলম না, গেছিলাম ঘোষপাড়ার মেলায়। তাই ক’মাস এদিকে...”।  “তা বেশ, একটু ব বাবা, জলখাবার খেয়ে একটু জিরিয়ে নে। হাতের কাজ সেরে গান শুনবো তোর। তা সেই কৃষ্ণপদও নিশ্চিন্তে জলখাবার খেয়ে ছায়ায় বসে টুংটাং করে তার একতারার তার বাঁধত।

দুপুরের রান্নাবান্না-ঘরের কাজ শেষ হলে ঠাকুমা হাঁক পাড়তেন, কই রে কোথায় গেলি সব। সবাই এসে বসলে কৃষ্ণপদ সকলকে প্রণাম জানিয়ে গান ধরত। তার গলা হেমন্ত, মান্না, কিশোরের মতো মেজে-ঘষে পোষ মানানো গলা নয়। গ্রীষ্মের দাহে দগ্ধ হতে থাকা ফুটিফাটা মাঠের মতো উদ্ধত। শরতের শস্য-ভরা ক্ষেতের গন্ধমাখা স্বপ্নময়। হেমন্তের হিমঝরা সন্ধ্যার মতো বিষণ্ণ-বিধুর। উদাত্ত, ব্যাপ্ত সেই কণ্ঠ নিমেষে আমাদের বেঁধে ফেলতে পারত, কথা আর সুরের নিবিড় বন্ধনে। বৈঠকখানা ঘরে বসে দাদু এবং তাঁর প্রতিবেশী বন্ধুরা হুঁকোয় টান দিতে ভুলে যেতেন।

পরপর চার-পাঁচখানা গান শুনে ঠাকুমা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বিরতি ঘোষণা করতেন। বলতেন, “এখন থাক বাবা। বেলা হল। পুকুরে ডুব দিয়ে এসে দুটি ভাত মুখে দিয়ে একটু গড়িয়ে নে। রোদের তাপটা পড়লে বাড়ি যাবি”।

সেই কৃষ্ণপদ বিকেলের দিকে আরও কখানা গান শুনিয়ে, যখন বাড়ি ফিরত, মায়েরা তার ঝোলায় সিধে ভরে দিত। চাল, ডাল, কিছু আনাজ, তেল, নুন, মশলা। আমাদের দাদু দিতেন নগদ দুটাকা কিংবা তিনটাকা। এই রকম গুণী মানুষদের আমি বলি গীতজীবী। গানই ছিল তাঁদের জীবিকা, কিন্তু সেটাকে কেউ ভিক্ষা বলে মনে করত না। সাধারণ মানুষের মন জয় করেই তাঁরা জীবিকা অর্জন করতেন। শুধু কৃষ্ণপদ নয়, আরো অনেকে আসতেন – নাকে-কপালে আঁকা চন্দনের তিলক, গায়ে নামাবলি। তাঁরা গাইতেন – রাধা ও কৃষ্ণের রাসলীলা, মাথুর, মানভঞ্জন…সে সব গানও ছিল অপূর্ব। আমরাও হাঁ করে শুনতাম – আর বড়োরা তো আনন্দে দুঃখে কেঁদে তাঁদের শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে ফেলতেন”।

 

ব্রজবালা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর আবার বললেন, “তোদের তো দোষ নেই দিদিভাই, দোষ তো আমাদের । মাতৃভাষা মায়ের দুধের মতো – এ কথাটা আমাদের মনে আসে একমাত্রে ভাষা দিবসে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এখন আমাদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে মায়ের দুধ ছাড়িয়ে বাচ্চাদের কত দ্রুত সেরেল্যাক খাওয়ানো যায়। ভাষার ক্ষেত্রেও এই সেরেল্যাক আমাদের সেরে দিয়েছে – দেশি ডাল-ভাত-শাকসব্জি-মাছ-মাংস ভুলে আমরা বেড়ে উঠছি ইংরিজি আর মুম্বাইয়ান হিন্দিতে...। দুঃখ করে লাভ কি? বাংলা ভাষা এখন ভেসে চলেছে বেনো জলে – তাকে ফিরিয়ে আনবে  ভবিষ্যতের কোন বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-শরৎ-রবিঠাকুর – কে জানে? 


চলবে...       


নতুন পোস্টগুলি

জঙ্গী ব্যবসা

  ১   ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ