২
এইসময় বাইরের উঠোনে, বারান্দায়,
তিনতলা স্কুলবাড়ির ঘরে ঘরে নানান বয়সের মেয়েরা দৌড়োদৌড়ি করে, খেলা করে, হৈ চৈ করে।
খাওয়ার সময়টুকু যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করে নিয়ে ওরা টিফিন ব্রেক থেকে খেলার অবসরটুকু
বাড়িয়ে নেয়। লাগামমুক্ত বাচ্চাগুলো স্কুলটাকে এমন মাতিয়ে রাখে, স্কুল নয়, মনে হয়
যেন বিশাল কোন মেলা বসেছে – আনন্দের হাট।
আর সেই সময় শুভময়ীদেবী টিচার্স
রুমে তাঁর নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে এককাপ লিকার চা আর সঙ্গে চারটে বিস্কুট নেন, ব্যস
আর কিছু নয়। এ তাঁর দীর্ঘদিনের বরাদ্দ। অন্য সহকর্ম্মীরা বাড়ি থেকে আনা ছোট-বড়ো
বক্স বের করে টিফিন সারে। যার যেমন পছন্দ, যার যেমন প্রয়োজন। টিফিনের সঙ্গে সঙ্গে
কথাবার্তাও চলে। সংসারের কথা, এরিয়ার ডিএর কথা, ক্লাস নেওয়ার কথা, অবাধ্য মেয়েদের দুষ্টুমির
কথা। সবচেয়ে বেশি চলে নিজেদের ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠার এবং বড় হয়ে
ওঠার নিত্য চিন্তা আর কাল্পনিক দুশ্চিন্তা নিয়ে কথা – অনুযোগ, অভিযোগ।
“কালকে
কি হয়েছে জানেন, দিদি, কিটু রাতে খাওয়া দাওয়ার আগে পিসিতে ফেসবুক খুলে বসেছে। আর
ওর বাবা গ্যাছে ভীঈষঅণ রেগে। বলে
– “সামনে তোমার ভাইট্যাল পরীক্ষা আর তুমি এখন ফেসবুকে টাইম ওয়েস্ট করছো”? -
ওইটুকুনি ছেলে বাবার সঙ্গে কি তক্কো বাবা, কি তক্কো। শেষে রাগ করে দুজনেই বলে -
রাত্রে কিছু খাবো না। আমার হয়েছে যতো জ্বালা, জানেন দিদি! ছেলেকে সামলাবো নাকি
ছেলের বাবাকে। দুজনকে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে অনেক রাত্রে তারপর আমাদের খাওয়া হল...”।
একটু
পৃথুলা জিয়োগ্রাফির টিচার সীমার ছেলে কিটু - এবার এইচ এস দেবে – সঙ্গে আছে আই আই
টি, মেডিকেল, ইঞ্জিনীয়ারিং এন্ট্রান্সের জয়েন্ট পরীক্ষাসমূহ। কাজেই বাবা মায়ের
দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক।
অনেকটা
কমবয়সী হিস্ট্রির টিচার ছিপছিপে লম্বা সরমারও অভিযোগের শেষ নেই তার কন্যা টুকলিকে
নিয়ে, “তোমার তো তাও ভালো, দিদি। তোমার ছেলে তো জুয়েল – লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট। মাধ্যমিকে কি রেজাল্ট,
বাব্বাঃ, ভাবা যায় না। আর আমার মেয়ে দেখ, এই সবে ক্লাস নাইনেই তার পাখনা গজিয়ে
গেছে। ওর লাস্ট বার্থডেতে, ওর ছোট মামা ২০জিবির আইপড গিফট করেছে। দিন রাত কানে
গুঁজে গান শুনে চলেছে। ওর বাবা ওকে কত বোঝায় “হিয়ারিংএ প্রবলেমস আসবে, টুকলি, অমন
সারাক্ষণ গান শুনতে হয় না”। মেয়ে
শুনলে তো? পড়তে বসেও কানে নিয়ে গান শোনে, আমি বারণ করলে কি বলে জানো, দিদি? বলে,
গান শুনতে শুনতে পড়লে নাকি কনসেনট্রেসান বাড়ে। এই পাকা মেয়েকে নিয়ে কি করি বলো
দেখি?”।
শুভময়ীদেবী
এই টিচার্স রুমে সবচেয়ে সিনিয়র। তিনি ম্যাথস পড়ান - সিনিয়ার টিচার – এই বছরেই হয়তো অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মিস্ট্রেস
হয়ে যাবেন। সেরকমই শোনা যাচ্ছে। তাঁর চেহারায়, ব্যবহারে এবং সদাস্মিত মুখে এক
অনবদ্য ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করছেন এই স্কুলেই। অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার
থেকে আজ তিনি সিনিয়ার টিচার। তাঁর শিক্ষকতা জীবনে কোনদিন উঁচু স্বরে কথা বলেননি।
আজ পর্যন্ত তাঁর কাছে কোন ছাত্রীকেই কানমলা, নীলডাউন তো দূরের কথা – বকুনিও খেতে
হয়নি কোনদিন। অথচ
ছাত্রী এবং সহকর্ম্মী - সকলের থেকে তিনি পেয়েছেন যথোচিত সম্ভ্রম ও ভালোবাসা।
শুভময়ী দেবী
সকলের কথা স্মিতমুখে মন দিয়ে শোনেন। তিনি জানেন, এরা কেউই
তাঁর কাছে কোন সমাধান প্রত্যাশা করছে না। নিজের নিজের সন্তানের জন্যে মাতৃসুলভ
দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ ব্যক্ত করে, ওরা হাল্কা করে নিচ্ছে নিজেদের মানসিক চাপ।
কিন্তু এর চেয়েও তিনি খুব মন দিয়ে শোনেন এই রুমের বাইরে, বারান্দায়, উঠোনে
বাচ্চাদের দাপাদাপি আর হট্টগোলের শব্দ। এতগুলি শিশু, বালিকা এবং কিশোরীর সম্মিলিত
জীবনের উচ্ছল প্রাণশক্তি তাঁকে মুগ্ধ করে রাখে। মাঝে মাঝে জানালায় দাঁড়িয়ে দেখেন
ওদের। স্নেহে আর মায়ায় তাঁর দৃষ্টি নরম হয়ে আসে। তাঁকে জানালায় দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখে মেয়েরা কিছুটা সংযত হয় – শুভময়ীদেবী সরে আসেন। আহা, খেলুক ওরা খেলুক,
আনন্দ করুক। এই তো বয়েস ওদের – ভবিষ্যৎ কার জন্যে কি রেখেছে কে জানে? এই আনন্দটুকুই হয়তো সঞ্চয়
হয়ে থাকবে ওদের সারাজীবনের স্মৃতিতে।
টিফিন ব্রেকের সময় শেষ হয়ে আসে। নীচের
বারান্দায় ফার্স্ট
বেল দেয় সুধাকর। শুভময়ীদেবী লক্ষ্য করেছেন প্রথম বেল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা অনেক
সংযত হয়ে আসে। তাদের সম্মিলিত ধ্বনি কমে আসে। সকলেই কি এক উচ্ছ্বাসে যেন
মেতে ছিল,
এখন আবার সবাই নিজের মধ্যে ফিরে আসতে থাকে। সেকেন্ড বেল পড়ার আগেই অধিকাংশ মেয়ে
ক্লাসে ঢুকে পড়ে, সেকেন্ড বেল পড়ে গেলে একটাও মেয়েকে আর বাইরে দেখা যায় না।
সেকেণ্ড বেল পড়ার পর টিচার্স রুমও
খালি হয়ে যায়। চক–ডাস্টার নিয়ে দিদিমণিরা ক্লাস নিতে বেরিয়ে যান। টিফিন ব্রেকের পর
দুটো পিরিয়ড শুভময়ীদেবীর সাধারণতঃ অফই থাকে। এই সময়টায় তিনি অফিসের বেশ কিছু কাজ
সেরে নেন। সব কাজই তিনি সেরে ফেলেন সময়মতো। আজকের কাজ কালকের জন্যে তুলে রাখা তাঁর
স্বভাব নয়। তাঁর জীবনের প্রত্যেকটা দিন খুব সন্তর্পণে আসে। কারণ আগামীকাল কী হবে
তিনি জানেন না। হয়তো কাল – বেশ কয়েকদিন, সপ্তাহ, মাস...তিনি আসতে পারলেন না। এমন
হতেই পারে। সদাপ্রসন্ন উদাসীন স্বভাবের আড়ালে তিনি চেপে রাখেন দীর্ঘশ্বাস। কাজ -
একমাত্র কাজের মধ্যে ডুবে থাকলেই তিনি স্বস্তি অনুভব করেন – ভুলে থাকতে পারেন এক
আপাত সরল অঙ্ক – যা আজও তিনি সমাধান করতে পারেন নি। প্রতিনিয়ত তিনি নিঃশেষ হয়ে
চলেছেন এই মারাত্মক অঙ্কের দাহে। তত্ত্বনির্ভর অঙ্কের সমাধান তাঁর আয়ত্তে – কিন্তু এ অঙ্ক জীবনের অঙ্ক - এক
জটিল বাস্তব – এর সমাধান তাঁর আয়ত্তের অতীত।
তখন বিতানের বয়েস ছিল মাত্র সাড়ে তিন। হাসিমাখা মুখে সারাদিন দস্যিপনায় ভরিয়ে রেখে দিত ঘরবাড়ি, সংসার, তাঁর জীবন। শুভময়ীদেবী স্কুল থেকে ঘরে ফেরার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকতেন, কতক্ষণে ঘরে ফিরে ওকে কোলে নেবেন। স্কুল থেকে ফিরে দুহাতে জড়িয়ে, ওকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে দীর্ঘ শ্বাসে ভরে নিতেন ওর ঘামে ভেজা চুলের ঘ্রাণ। সারাটা দিনে বিতানের হাজার দস্যিপনার খবর, তিনি মন দিয়ে শুনতেন তাঁর শ্বাশুড়ি আর কাজের মেয়ে ফুলকির থেকে। আর স্কুলছুটির দিনগুলো, সারাটা দিন কোথা দিয়ে যেন কেটে যেত ওর দৌরাত্ম্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে। তখন সমস্ত চেতনা জুড়েই বিরাজ করত আত্মজ বিতান। সেই বিতান বেশ কদিনের জ্বর, গলায় এবং সারা গায়ে ব্যথা, বমি, মাথা ব্যথা, সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণ নিয়ে অসুস্থ হয়েছিল। কিন্তু আর কোন দিনই সে সুস্থ হয়নি। তাঁর বিতান, তাঁর আদরের বিট্টু এখন, আ চাইল্ড উইথ টোটাল স্প্যাসটিসিটি।
...পরের পর্ব আসবে সামনের শনিবার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন