৩
পোস্টমর্টেম, পুলিশ এবং তার
যাবতীয় নিয়ম কানুন সব সামলেছিল মহাজন সাঁপুই। হলধর পোল্লের অন্তিম ক্রিয়াকর্ম থেকে
শ্রাদ্ধশান্তি পর্যন্ত সবকিছুরই দায় সামলে দিয়েছিল মহাজন সাঁপুই। বার বার প্রতিশ্রুতি
দিয়েছিল অফিসে মালতীর জন্যে একটা কাজ দেবে আর তার মেয়ের স্কুলে লেখাপড়া চালিয়ে
যাওয়ার সমস্ত ব্যয় সে বহন করবে। তাছাড়াও নগদ দুলাখ টাকা দেবে তাদের ভবিষ্যতের
সুরাহার জন্যে।
জাগতিক নিয়মে সব শোক সন্তাপই
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে থিতিয়ে আসে। তাৎক্ষণিক আর্দ্র আবেগ ও মেঘমেদুর সহানুভূতি,
বাস্তবের রৌদ্রে শুকিয়ে আসে যত দিন যায়।
মহাজন সাঁপুইয়ের অফিসে কাজের জন্যে ঘুরতে ঘুরতে মালতী হতাশ হতে থাকল দিনকে
দিন। আজ নয় কাল। কাল নয় পরশু। এ হপ্তা নয় সামনের হপ্তা। এ মাস নয় পরের মাস।
স্কুলের ফিস বাবদ টাকাটা অবিশ্যি দিয়ে দিত ওদের অফিস থেকে। প্রায় সাত আট মাস এভাবে
চলার পর একদিন মহাজন সাঁপুইয়ের অফিস থেকে মালতীকে ডেকে একটা পঞ্চাশ হাজার টাকার
চেক তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। সেইসঙ্গে খুবই স্পষ্ট ভাষায় তারা বলে দিয়েছিল, আর নয়,
এই শেষ। মালতী তাও একবার দেখা করতে চেয়েছিল মহাজন সাঁপুইয়ের সঙ্গে, বেশ ঝাঁঝালো
উত্তর পেয়েছিল, “ওঁনার কি কাজ-কাম নাই নাকি? বসে বসে তোমার নাকে কান্না শুনলেই
ওঁনার দিন চলবে? ফালতু নোকের ব্যাজব্যাজানি শুনার টাইম নেই ওঁনার। তুমি এখন আসো তো। যা পেয়েচো যতেস্ট – আর কত
দোয়ানি করবে বলো দিকি? এদিকে আর আসবে নি কোনোদিন, এ বাবদে কোন লাভ হবে নি আর – এই
বলে দিলোম”।
ভিতরে ভিতরে ভয়ংকর একটা লড়াই
চলছিলই, কিন্তু তার ওপরে ছিল একটা আশার প্রলেপ। একটা চাকরি, যেমন তেমন হলেও মাস
গেলে কিছু টাকার নিয়মিত সংস্থান। মেয়েটার লেখাপড়াটা তো চালুই থাকল। আর দুলাখ পাওয়া
গেলে, ব্যাংকে জমা করে দেবে, সুদে আসলে ওর বিয়ের সুরাহাটাও হয়ে যাবে। কতদিন আর। এই তো, এই বোশেখ মাসেই
মেয়ে এগারো পার হয়ে বারোয় পা দেবে। তার মানে বড় জোর আর বছর সাত কি আট। ব্যস, মেয়েটার একটা ভালো ঘরে
আর মনোমত বরে চারহাত এক করে দিতে পারলেই - মালতী ঝাড়া হাত পা। নিজেরটা বুঝে দেখবে
তখন যা হোক।
এই আশার প্রলেপটাও সেদিন মুছে
গিয়েছিল মালতীর জীবন থেকে। যেভাবে মালতীর জীবন থেকে মুছে গিয়েছিল সুখ, আহ্লাদ আর
স্বপ্ন। সুলক্ষণা এয়োতির সমস্ত ভূষণ। ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল তার শাড়ির পাড়ের রং। মালতীর বাবা চলে গেছেন
কয়েক বছর হলো। মা আছেন, কিন্তু তিনিও একান্তই অসহায়, তার দুই ভাইয়ের জ্বলন্ত
সংসারে। উপরন্তু, তার দুই ভাইয়ের কেউই এতটাও স্বচ্ছল নয়, আর্থিক বা মানসিক কোন দিক
দিয়েই, যে বিধবা বোন এবং তার মেয়ের বাড়তি বোঝার দায় বহন করবে। কাজেই মালতীর সামনে
ধূ ধূ ঊষরতা ছাড়া, কিছুই অবশিষ্ট রইল না। ঘাড়ের ওপর লড়াইটা এসেই পড়ল,
ধারাল নখ দাঁত শানিয়ে - হিংস্র পশুর মতো।
মহাজন সাঁপুইয়ের অফিস থেকে ফিরে,
ঘরে দোর দিয়ে মালতী হিসেব নিয়ে বসল। ট্রাংক থেকে বের করল তার আর হলধর পোল্লের
জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের পাস বই। জমা টাকার অংক ছ হাজার তিনশ বত্রিশ। শাড়ির ভাঁজে রাখা
নগদ আটশো পঞ্চাশ টাকা। আর তার ব্লাউজে বুকের মধ্যে ছোট্ট পার্সে রাখা আটষট্টি টাকা
– নোট আর খুচরো পয়সা মিলিয়ে। এই তার জমা। আর খরচের মধ্যে আছে বাড়ি ভাড়া, মেয়ের
স্কুলের ফিস, খাতা-বই, খাওয়া দাওয়া, তেলটা, সাবানটা, রোগ-বিপদ, দায়-ঝক্কি ...শেষ
নেই যেন – খরচ, খরচ আর খরচ। আর এই খরচের কোনটাই এককালীন নয় –
মাসে মাসে আসবে – আসবে বছরের পর বছর – এ খরচ কখনও কমবে তো না বরং বেড়েই চলবে।
এত হিসেবপত্র কোনদিন তাকে করতে হয়নি, একে তো সে চাষী ঘরের মেয়ে। তার ওপর, বিয়ের পর হলধর পোল্লেও এসব ব্যাপারে তার গায়ে আঁচ লাগতে দেয়নি কোনদিন। কিন্তু মালতী এতটুকুও দিশাহারা হল না। নির্দিষ্ট লক্ষ্য তার ছিলই, মেয়েকে বড়ো করা আর তার বিয়ে দেওয়া। তার জন্যে এখন দরকার নিয়মিত উপার্জন আর সম্ভব হলে কিছু সঞ্চয়, ভবিষ্যতের জন্যে। খোলা ট্রাংকের সামনে স্থির হয়ে সে বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর সবকিছু গুছিয়ে রেখে ট্রাংক বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, বসে বসে হা হুতাশ করে কপাল চাপড়ানোর সময় আর নেই। চোয়াল শক্ত করে লড়ার দিন এসে গেছে এবং জীবনের এই যুদ্ধ তাকে জিততে হবেই।
...পরের পর্ব আসবে সামনের শনিবার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন