Powered By Blogger
প্রবাসিনীর আত্মকথা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
প্রবাসিনীর আত্মকথা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ২৭ জুন, ২০২৫

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)-র আত্মকথন - বিশ্বলোকের সাড়া - পর্ব ২

 

বিশ্বলোকের সাড়া - দ্বিতীয় পর্ব 

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)


এলেম নতুন দেশে

 

আমি নিজিতে পৌঁছাই ১৯৯৫ এর জুলাই মাসে, স্বামী কাজল আর ৪ বছরে পুত্র আবীর কে নিয়ে। কয়েকমাস অকল্যান্ডে থাকার পর কাজল চাকরি পায় তৌরঙায়। শুরু হলো আমাদের তৌরঙা নিবাস। ১৯৯৭ এ আমাদের মেয়ে, অনাহিতা এলো এই পৃথিবীতে; সম্পূর্ণ হল আমার মাতৃত্ব। 

আমরা যখন সপরিবারে নিজিতে মাইগ্রেট করি তখন সত্যি বলতে এই দেশ, এখানকার মানুষ বা এখানকার রকমসকম সম্বন্ধে একদমই কোন ধারণা ছিলনা।  নব্বইএর দশকে ডঃ গুগল ছিলেন না, সব প্রশ্নের উত্তরের জন্য।

আমরা যখন ধীরে ধীরে সেট্‌ল্‌ করার চেষ্টা করছি সম্পূর্ণ এক অজানা দেশে; আমরা একটা অর্গানাইজেশনের নাম শুনলাম - তৌরঙা এথনিক কাউন্সিল (Tauranga Ethnic Council)এই প্রতিষ্ঠানের মূল কর্মকাণ্ড ছিল নতুন ইমিগ্র্যান্ট মানুষদের নিউজিল্যান্ড-সমাজের মূল স্রোতে মিশতে শেখানো, ওঁরা সব ধরনের সাহায্যের হাত ওঁরা বাড়িয়ে ধরেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নিয়মিত ছোটখাট গেট-টুগেদারের আয়োজন করা হতো, যেখানে নানান দেশের লোকেরা আসতো, নিজেদের দেশের পোষাকে। বিভিন্ন ভাষাভাষী অন্য অনেক মানুষজনের সাথে আলাপ হত, বন্ধুত্ব হত। সেই সময়ে খুঁজে পাওয়া কিছু বন্ধু এখন পরিবারের মতো হয়ে গেছেন। আমাদের যোগাযোগ এত সুদৃঢ় হয়েছে তার কারণ আমরা সকলেই নিজিতে মাইগ্রেট করে এসেছি। এক স্বজনবিহীন পরিবারের কাছে, নতুন দেশে, হঠাৎই স্বদেশী এবং স্বভাষী মানুষকে খুঁজে পাওয়া যে কি আনন্দের বলে বোঝানো যাবে না। খবর পেয়েই আমরা ওই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলাম 

আনন্দের কথা আজও আমরা এই প্রতিষ্ঠান এর সাথে যুক্ত। আমাদের জীবনে এই প্রতিষ্ঠান এবং এখানে পাওয়া বন্ধুদের অবদান প্রভূত। ২৫ বছর পরেও আজও চোখের সামনে ভাসে যেদিন নীনা পেন আমাদের প্রথম স্বাগত-সম্ভাষণ করেছিলেন। আমাদের সেই সহৃদয় প্রগাঢ় বন্ধুত্ব আজও অটুট। আমি আর কাজল দুজনেই জড়িয়ে পড়লাম এই প্রতিষ্ঠানের নানান কাজে কর্মে। নতুন দেশকে আপন করার জন্য শুরু হল আমাদের পথচলা।    

 

পরবাসী, চলে এস ঘরে...

 

১৯৯৫-এ নিউজিল্যান্ডে এসেই অকল্যান্ডের ছোট্ট বাঙালী মহলে আবার গান শুরু করেছিলাম। এবং তখনই আমার মনের মধ্যে বাসা বাঁধল নিজের গানে এলবাম বানাবার।  

এই সূত্রে একটা বিশেষ ঘটনা ঘটল, যা ছিল আমার কাছে স্বপ্নেরও অতীত। অকল্যান্ডে আলাপ হয়েছিল বিশ্ব বিখ্যাত শিল্পী বাংলাদেশের রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সাথে। তিনি নিউজিল্যাণ্ডে এসেছিলেন গানের অনুষ্ঠান করতে। শিল্পীর ঔদার্য আর আমার সৌভাগ্য যে যোগাযোগটা তারপরেও বজায় ছিল। 

বছর খানেক পরে আমি আমার এলবাম রেকর্ড করতে ভারতে যাবার প্ল্যান করছি শুনে উনি এক কথায় আমায় তালিম দিতে রাজি হলেন। কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি আমি বন্যাদির কাছে থেকে; মানে ঢাকায় ওঁনার বাড়িতে থেকে ওঁনার কাছে গানের প্রশিক্ষণ নেবো। কি সুন্দর গল্পের ছলে গানের খুঁটিনাটি শিখিয়েছেন; কি অপূর্ব সুন্দর প্রাঞ্জল করে বুঝিয়েছেন, শিখিয়েছেন গানের পরিবেশনা কিভাবে করতে হয়। এই সব কিছুর জন্যে আমি ভীষণভাবে ঋণী বন্যাদির কাছে। 

তবে ভগবানের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ যে আমার স্বামী প্রতি মুহূর্তে আমার পাশে থেকেছে, সাহায্য করেছে। আজ আমি যেখানে পৌঁছাতে পেরেছি, তার পেছনে আমার স্বামী, আমার নিজের পরিবারের অবদান অসামান্য। সত্যি বলতে, “যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই”।

নিউজিল্যণ্ডে এসে অচিরেই এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমি দায়িত্ব নিলাম শিল্প-সংস্কৃতির। বিভিন্ন দেশের নাচ-গান-বাজনা নিয়ে, নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে শুরু করলাম। এই অনুষ্ঠানে শুধু যে ইমিগ্র‍্যান্টরাই শিল্পী, শ্রোতা বা দর্শক হতেন তা নয়, ধীরে ধীরে নিজির স্থানীয় মানুষেরাও খুবই আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তাঁরা নিশ্চয়ই বিশ্বের বহু দেশের বিভিন্ন সংস্কৃতির বৈচিত্র্য উপভোগ করতে আসতেন। তাঁরা যে কেউই হতাশ হননি, সে কথা স্বীকার করতে আজ আর দ্বিধা নেই। 

আর আমরাও তো চাইতাম যে আমরা যারা এদেশে সেট্‌ল্‌ করতে এসেছি, সে দেশের মানুষরাও আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠুন। তাতে দুপক্ষেরই সম্পর্ক নিবিড় হয়ে উঠবে, যদি কিছু বিরূপ মনোভাব থেকেও থাকে কোন পক্ষে, সে সব দূর হয়ে যাক চিরতরে। এই অনুষ্ঠানগুলোর আরেকটা প্রধান আকর্ষণ ছিল নানা দেশের নানান স্বাদের, অসাধারণ সব খাবার। সরকারি সাহায্য এবং পৃষ্ঠপোষকতা তখনও ছিল এবং এখনও আছে প্রচুর। 

আজও মনে পড়ে, একটা বেশ বড়সড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম আমরা। আমি ছিলাম মূল উদ্যোক্তা। এখানকার একটি বড় অডিটোরিয়ামে হয়েছিল আমাদের অনুষ্ঠান। সেখানে আমি প্রথম বিদেশী বা ভিন্ন-ভাষীদের সামনে রবীন্দ্রসঙ্গীত পেশ করেছিলাম। গর্বের সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিয়েছিলাম নোবেল জয়ী বাঙালী কবি বলে। তদানীন্তন মেয়র, নোয়েল পোপ ছিলেন আমাদের প্রধান অতিথি। আমার গান শুনে তিনি এসে বলেছিলেন, "although I did not understand the lyrics, but the tune touched my heart and your voice is like a Nightingale "  সেদিন আমার এক দারুন রোমহষর্ক আনন্দের অনুভব হয়েছিল। এক ভিন্নভাষী, ভিন্নকৃষ্টির মানুষের কাছ থেকে এইরকম প্রশংসা পেয়ে আমি আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম, ধন্য হয়েছিল আমার সঙ্গীতচর্চা। নোয়েল পোপের সেই প্রশংসা শুনে আমার মনে হয়েছিল, সত্যিই তো রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি, তাঁর সৃষ্টির কদর সর্বত্র; সমস্ত মানুষের, দেশ-ভাষা নির্বিশেষে, মন ছুঁতে পারে। এমনকি তাঁর সুরের জাদুতেও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উঠতে পারেন, বাংলা না-জানা গুণী মানুষেরাও। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই দেশে,  মূল স্রোতের মানুষের সামনে নিয়ে আসবো রবীন্দ্রনাথের গান, তাঁর মন্ত্র, তাঁর দর্শন।

সেই হল শুরু,  ১৯৯৮ থেকে আমি নিজির বহু শহরে বহু অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছি, বহু ক্ষেত্রে গানের অনুবাদ লেখা কাগজ দিয়েছি শ্রোতাদের হাতে। আজও করে চলেছি। 

রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নিজির ভারতীয় হাইকমিশনের উদ্যোগে এক অনুষ্ঠানে আমায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কিছু পরিবেশনার জন্য। সেই অনুষ্ঠানে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপরে রবীন্দ্রনৃত্য এবং ক্ল্যাসিক্যাল ব্যালে মিশিয়ে নৃত্যানুষ্ঠান করিয়েছিলাম। এই পরিবেশনায়, আমার মেয়ে এবং তার ব্যালে স্কুলের সহপাঠীরাও অংশ নিয়েছিল।

১৯৯৭-এ আরও একটি সংগঠনের সাথে আমার পরিচিতি হয়। সেটা হয়েওছিল এক মাল্টিকালচারাল ফেস্টিভ্যালের সময়। ESOL (English for Speakers of Other Languages) সরকারি অনুদানপুষ্ট এই সংগঠনের কাজ ছিল, ভিন্ন ভাষাভাষী নবাগত ইমিগ্র্যান্ট বা রিফিউজিদের ইংরাজি শেখানো। ইরানে থাকার সময় আমি অনুভব করেছিলাম, একটা দেশের ভাষা না জানলে, সে দেশে বাস করা এবং স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে পরিচয় গড়ে তোলা কত কঠিন। আর ঠিক এইখানেই ESOL তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। নতুন অভিবাসী বা রিফিউজি পরিবারের বহু মহিলা বা বয়স্ক মানুষের ইংরেজির জ্ঞান প্রায় নেই বললেই চলে। অনেকে হয়তো ইংরাজি জানেন, কিন্তু বলতে আড়ষ্ট বোধ করেন। তাঁদের ইংরেজিতে কথা বলা শেখানোর মাধ্যমে সমাজের বাকী সবার সাথে মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়াটাই এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য। এখানেও যোগ দিলাম আমি, কারণ আমি চাইতাম আমার ইরান-বাসের প্রথম কিছু মাসের মতো কেউ যেন ভুক্তভোগী না হয়। আমাকে অবশ্যই ট্রেনিং নিতে হয়েছিল, কারণ প্রাপ্তবয়স্কদের ভাষা শেখানোর নিয়ম সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি ইংরেজি শেখাতে শুরু করলাম বাংলাদেশ, ভারত (মূলত পাঞ্জাবী), আফগানিস্তান আর ইরান থেকে আসা অভিবাসী বা শরণার্থী মহিলাদের। অনেকে ক্লাসে আসতেন, আবার বহু ক্ষেত্রে আমি যেতাম আমার থেকেও বয়স্কা এবং শ্রদ্ধেয়া ছাত্রীদের বাড়িতে, কখনো কখনো তাঁদের অন্দরমহলেও। এই সংগঠনের সাথে কাজ করতে গিয়ে আমার এক নতুন মূল্যবোধের উপলব্ধি এল। এই সংস্থা আমার মধ্যে এনে দিল সহানুভূতিশীল এক সত্ত্বা এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস, যে বিশ্বাস অন্য মানুষের মধ্যেও সঞ্চার করা যায়। 

 

[ব্লগার কিশোরের মন্তব্যঃ সুদীর্ঘ ৩৪ বছরের প্রবাস-জীবন কাটিয়েও শ্রীমতী প্রদীপ্তার গাওয়া গানগুলি শুনলে অবাক হতে হয় - এমন সুস্পষ্ট উচ্চারণ এবং সূক্ষ্ম রাবীন্দ্রিক গায়কী কিভাবে তিনি অন্তরে এতদিন ধরে বহন করে চলেছেন! ইউ-টিউবে তাঁর অনেক গানের থেকে আমার প্রিয় দুটি গানের সুত্র নীচেয় দিলাম।] 

আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা

তোমায় গান শোনাবো


চলবে...


শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)-র আত্মকথন - বিশ্বলোকের সাড়া - পর্ব ১

 

[ব্লগার কিশোরের মন্তব্যঃ আমার স্কুল জীবনের বন্ধু কাজল মুখার্জি - অধুনা নিউজিল্যাণ্ডের তোরঙ্গা নিবাসী। বন্ধুপত্নী কুটু (ভালো নাম প্রদীপ্তা মুখার্জি) গৃহবধূ - কিন্তু চারদেয়ালের ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে কোনদিন থাকেননি। কুটু সমাজসেবী, সমাজ সংগঠক এবং যথেষ্ট প্রতিভাময়ী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। সত্যি বলতে সমগ্র নিউজিল্যাণ্ডে বিশেষ করে নিউজিল্যাণ্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বঙ্গ সমাজে কুটু অবিসংবাদিত একজন সাংস্কৃতিক মানুষ। তাঁর রচিত আত্মকথন "বিশ্বলোকের সাড়া" আমার এই ব্লগে প্রকাশ করার অনুমতি পেয়ে আমি সম্মানিত।]

 

 

বিশ্বলোকের সাড়া - প্রথম পর্ব 

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)

তুমি মোর পাও নাই পরিচয়

 আমি প্রদীপ্তা, প্রদীপ্তা মুখার্জি; ডাক নাম কুটু, এনামেই আমায় সবাই চেনে। পূর্ব ভারতের কোলকাতা শহর নিবাসী এক মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম।

বাবা ছিলেন পেশায় শিক্ষক, মা ঘর-সংসার সামলাতেন। চার ভাই আর চার বোনের মধ্যে আমিই ছিলাম সবার ছোট। বড় হয়েছি খুব হৈচৈ করা আনন্দে এবং স্নেহময় শাসনের মিশেলে। 

ছোটবেলা থেকেই কেন জানি না সঙ্গীত আমাকে টানতো। পড়াশোনার থেকে গান, নাচ, নাটক এই সবই অনেক বেশী পছন্দের। কিন্তু মধ্যবিত্ত সংসারে লেখাপড়ার দিকেই অনুরাগ ছিল বেশি, অতএব পড়াশোনা করাতেই অনেক বেশী সময় দিতে হত। কিন্তু পরবর্তী কালে উচ্চশিক্ষার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়  সুযোগ পাওয়া মাত্র সঙ্গীতকেই বেছে নিলাম। ব্যাচেলর অফ মিউজিক। এটাই আমার মনোমত বিষয় ছিল বলেই হয়তো, পরীক্ষাগুলোও ভালোভাবে উৎরেও গেলাম।

ছোটবেলাটা কেটেছে মা, বাবা, দাদা, দিদিদের যুগপৎ আদর ও শাসনে। যদিও বাড়িতে নিয়ম-কানুন মানানোর যথেষ্ট প্রচেষ্টা ছিল - রোজ ভোরে উঠে পড়তে বসতে হত, এমনকি ছুটির দিনেও, তার অন্যথা করার অনুমতি মিলত না।

তবে মজাদার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলিও নিয়মিত পালন করা হত। বছরের প্রথম দিকে হত সরস্বতীপুজো। এই পুজো যেমন বাড়িতে হত, তেমনই হত স্কুল এবং বড়ো হওয়ার পর কলেজেও। ছোট্টবেলায় যখন আমরা প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী, বছরে ওই এই একটি দিনই, শাড়ি পরার সুযোগ পেতাম। বড়োসড়ো শাড়ির পুঁটলি শরীরে জড়িয়ে, আঁচল-টাঁচল সামলে, নানান স্কুলে ঘুরে ঘুরে প্রসাদ খাওয়া আর নতুন বন্ধু পাতানোর মজা আর আনন্দের স্মৃতি আজও মধুর। সে দিনগুলি ছিল বিরাট উত্তেজনার, পুজোটা যেন গৌণ, মুখ্য ছিল ওই আনন্দ আর মজাটাই।

তার পরেই আসত মার্চ মাস বসন্তের উতল হাওয়া নিয়ে, মনে ধরত নানান রঙ ও গান, কারণ দোল আসছে। ওই দিন মা পুজোর ঘরে পায়েস বানাতেন, তারপরে রাধা-কৃষ্ণের পুজো করতেন, ঠাকুরকে আবীর দেওয়া হতো। তারপর আমরা ছোটরা বাবা, মা ও গুরুজনদের আবীর দিতাম। তারপরেই শুরু হতো আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে আর পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে রঙিন হয়ে ওঠা এবং অন্যকে রঙিন করে তোলার উচ্চকিত আনন্দ আর মজা।

এপ্রিলে আসতো ১লা বৈশাখ, বাঙালীদের নববর্ষ। সেও এক মহানন্দের উৎসব। নতুন নতুন পোষাকনানান রান্না বান্না, খাওয়া দাওয়া, তার সাথে গান বাজনা ও নাচ, হৈচৈ নিয়ে একশ মজা।

অক্টোবর বা নভেম্বরে আসতো বাঙালির বহু আকাঙ্ক্ষিত মহোৎসব দুর্গাপুজো, সঙ্গে নিয়ে আসত কালীপুজো, দীপাবলি, ভাইফোঁটার অনেক ছুটি আর হাজার মজার সম্ভার নিয়ে। 

 

স্বপন যদি মধুর এমন

 খুব মনে পড়ে আমার প্রাইমারী স্কুলের দিন গুলো। বাড়ি থেকে অল্প হেঁটেই স্কুল। বিরাট জমি নিয়ে ইংরেজি আমলের তৈরি মস্ত স্কুল বাড়ি; কলকাতার নাকতলাতে, আনন্দ আশ্রম বালিকা বিদ্যালয়। পড়াশুনো করতে হত ঠিকই কিন্তু ছোট্টবেলা থেকেই সঙ্গীতই ছিল আমার সব থেকে প্রিয়।

বাড়িতে রেকর্ডে গান শুনতাম। রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরেছিলাম সেই ছোটবেলা থেকে। প্রথমে তাঁর গান, তারপর বড় হয়ে তাঁর গল্প, উপন্যাস, নাটক এর প্রেমে পড়ি। নিজের ভালো লাগার জন্যই রেকর্ড শুনে শুনে গান তুলতাম সাত আট বছর বয়েস থেকে। নয় বছর বয়েসে আকাশবাণী থেকে ডাক পেলাম, শিশুদের অনুষ্ঠানে গান গাইবার জন্য।

আমার বড় দিদি, আমায় ভর্তি করে দিয়েছিলেন গানের স্কুলে। এরই মধ্যে আমাদের পাড়ায় বা পাশের পাড়ায় প্রায়ই আমার ডাক পড়ত গান শোনাবার জন্য। ওই বয়েসেই রবীন্দ্রসঙ্গীতে এতই ডুবে ছিলাম যে পড়াশোনায় ফাঁক পড়ত প্রায়ই। স্কুলের দিদিমণিরা বাবার কাছে নালিশ করেছিলেন যে আমি পড়াশোনা না করে গানের পেছনে বেশী সময় দিই।

আমার স্বপ্ন ছিল সঙ্গীত নিয়ে পড়া। তাই যখন পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পেলাম তখন ভীষণ খুশী হয়েছিলাম, গর্বিত বোধ করেছিলাম। মনে হয়েছিল আমার গানের পাখি এতদিনে খুঁজে পেল ওড়ার মতো মুক্ত আকাশ।  কলেজে পড়ার সময় তখনকার দিনের বহু নামী শিল্পীর সান্নিধ্যে আসতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেছি। ওঁদের কাছ থেকে অনেক যত্নে গান শিখেছি, ওঁদের পরিচালনায় অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে গর্বিত বোধ করেছি।

এর মধ্যেই কোন একদিন বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়লাম। আমার স্বামী ছিলেন আমার বহুদিনের মনের মানুষ, কাজেই আমাদের মনের অমিলটুকুও মধুর হয়ে উঠল আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কে।

আমার পুত্র আবীরের বয়েস যখন সবে এক, তখন আমার প্রথম বিদেশ যাত্রার সূত্রপাত। দিল্লীর চাকরি ছেড়ে একটি ইতালীয় কোম্পানিতে চার বছরের চুক্তিতে কাজল জয়েন করল, আর ইরানে একটি পাওয়ার প্ল্যাণ্ট নির্মাণের জন্যে ওর সঙ্গে আমরা রওনা দিলাম ইরান। আমরা ইরান পৌঁছলাম ১৯৯২ সালে।

দিল্লী থেকে দুবাই হয়ে তেহরান পৌঁছলাম এমিরেটসের বিমানে। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে আমাদের বেজায় উত্তেজনা ছিল, এবং ভীষণ ভালো লেগেছিল বিমান সেবিকাদের, যেমন সুন্দরী, তেমনি আন্তরিক ব্যবহার।

ইরান সম্পর্কে তখন তেমন কিছুই জানতাম না, শুধু জানতাম ওখানকার গোলাপ বিখ্যাত, পড়েছিলাম রবিঠাকুরের “পারস্যে” প্রবন্ধে। ওই প্রবন্ধেই জেনেছিলাম ওদেশের সঙ্গীতের কথা, মানুষজনের কথা। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩২-এর মে মাসে পারস্যে ছিলেন তাঁর জন্মদিনের সময়, উনি লিখেছেন, “আমার পারসি বন্ধুরা সকাল থেকে পুষ্পবৃষ্টি করেছেন, নানা বর্ণের ফুল, বিশেষতঃ গোলাপ”। আর জানতাম পারস্যের বিখ্যাত কবি, আমার ভীষণ প্রিয় কবি হাফেজের কথা। হাফেজের শহর সিরাজ ও ইস্পাহান; আমরা পরে ইস্পাহানে কবি হাফেজের স্মৃতি সৌধ দেখতে গিয়েছিলাম, ওঁনার সমাধিতে ফুল ছড়িয়ে আমার মন ভরে গিয়েছিল।

তেহরানে প্লেন নামলো। প্লেন থেকে নামার আগে আমায় পরতে হল, “মান্টো” আর “রুসেরি”। মান্টো হল প্রায় গোড়ালি অব্দি ঝুলওয়ালা ওভারকোটের মতো পোষাক, তবে সাধারণ কাপড়ের। আর রুসেরি হলো স্কার্ফ, মাথা ঢাকা দেওয়ার জন্যে। তবে মুখ ঢাকার কোন প্রয়োজন হয়নি। এই পোষাক আমরা ভারত থেকেই বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম।

তেহরান এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমেই যেটা চোখে পড়েছিল সেটা হল Temperature Board – বাইরের তাপমান তখন শূণ্যের পাঁচ ডিগ্রি নিচে। যদিও আমরা প্রস্তুত ছিলাম, পর্যাপ্ত গরম পোষাক ছিল সাথে, তবুও জীবনের প্রথম মাইনাস তাপমানের সম্যক মুখোমুখি হওয়ার আগে ওই লেখাটা দেখেই যেন শীতের শিহরণ টের পেলাম শরীরে।

তেহরান থেকে প্রায় ন/দশ ঘণ্টার ড্রাইভে আমাদের গন্তব্য কেরমানশাহ, কাজলের কর্মস্থল। অধিকাংশ রাস্তাই তখন বরফে ঢাকা, রাস্তার দুপাশ ঘুমিয়ে আছে সাদা বরফের চাদর মুড়ি দিয়ে। প্রায় শেষ বিকেলে আমরা পৌঁছলা, কেরমানশাহ। ছোট্ট সুন্দর জনপদ, তার চারদিক ঘিরে রয়েছে বরফে মোড়া ছোট ছোট পাহাড়।

সবার জীবনে “প্রথম” যে কোন ব্যাপারই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, এবং আনন্দের তো বটেই। ইরান আমার কাছে সেই প্রথম বিদেশ যাত্রা। পরে বহু দেশ গিয়েছি, এখন যেমন দীর্ঘ প্রবাসী রয়েছি নিউজিল্যাণ্ডে, কিন্তু প্রথম বিদেশ যাত্রার আনন্দ ও উত্তেজনার অভিজ্ঞতা অতুলনীয়। ইরান এমন একটি দেশ, যেখানে আমি সবদিক থেকেই বিদেশিনী, তাদের ভাষা জানি না, বুঝি না। তাদের জীবনযাত্রা, পোষাক-আষাক, সামাজিক চালচলন, রূপ, সঙ্গীত, সবকিছুই আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

খুব সুন্দর একটা তিনতলা বাড়িতে আমাদের প্রবাসের নীড় গড়ে উঠল। নিচের তলায় থাকতেন আমাদের বাড়িওয়ালা, সপরিবারে মহম্মদ আমিনী। আমাদের ফ্ল্যাটের প্রায় প্রতিটি ঘরের জানালা থেকেই দূরের বরফে ঢাকা পাহাড় দেখা যেত। ভোরের আলোয় সোনালী রঙে রঙীন হয়ে সেজে উঠতো তারা। ঘরের ভেতরে সেন্ট্রাল হিটিং থাকায় সাধারণ পোষাকেই থাকা যেত, কিন্তু বাইরে তখন অসম্ভব ঠাণ্ডা। আমাদের ওই ইরান বাসের কয়েক বছরে, আমরা সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পেয়েছিলাম মাইনাস বাইশ ডিগ্রি! ওরই মধ্যে ছোট্ট আবীরকে নিয়ে শুক্রবারের সপ্তাহান্তে চলত আমাদের বরফ নিয়ে খেলা, বরফের পুতুল বানানোর নানান মজা।

ইরানে গিয়ে বাধ্য হয়েছিলাম ফারসী ভাষা শিখতে। প্রথমে বেজায় অসুবিধে হয়েছিল, কারণ আমাদের আশেপাশের প্রতিবেশী ও পড়শিদের কেউই হিন্দি তো বটেই, এমনকি কাজচলা গোছের ইংরিজিও জানত না। হাত-পা নেড়ে, নানান অঙ্গভঙ্গী করে নিজের বক্তব্য পেশ করার প্রচেষ্টা যাঁরা করেছেন, একমাত্র তাঁরাই বুঝবেন, সে সময় আমি কতখানি অসহায় বোধ করতাম।  অতএব আমাকেই ওদের ভাষা শেখার উদ্যোগ নিতে হল। নিজের এই অভিজ্ঞতার জন্যে, পরবর্তী জীবনে নিউজিল্যাণ্ডে বাস করার সময় যখন শরণার্থীদের সঙ্গে মিশেছি এবং তাঁদের নিয়ে কাজ করেছি, তখন ভাষা নিয়ে অসহায়তার বিষয়টা আমাকে নতুন করে বুঝতে হয়নি।

যাই হোক, ধীরে ধীরে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে পরিচিতি বাড়ল, কাজলের সহকর্মী ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গেও আলাপ হল। আমার পুত্র আবীরও সমবয়সী বন্ধু পেয়ে গেল অচিরেই। এভাবেই আমার ফারসী জ্ঞানের পরিধি বাড়তে লাগল অত্যন্ত ধীর লয়ে, এবং আবীর আমাকে পেছনে ফেলে, ফারসীতে শিখে ফেলল অতি দ্রুত, এবং ন-দশ মাসের মধ্যেই ও দিব্যি ফারসী বলতে শিখে গেল। আমি কোথাও আটকে গেলে, আমার বালক-গুরুর কাছেই চলত আমার শিক্ষানবিশী। ওইটুকু বয়সেই আবির বাংলা, ইংরিজি এবং ফারসী মোটামুটি একই তালে বলতে পারত। আমার ইরানী বান্ধবীরা আবিরকে বলত, “ডিকশনারি”, কারণ আমাদের বাড়িতে এলে আলাপের সময়, তাঁরাও আবিরেরই সাহায্য নিতেন, interpreter হিসেবে।

কাজল রোজই ভোরে বেড়িয়ে যেত, শহর থেকে অনেকটাই দূরে ছিল ওদের কর্মস্থল, construction siteআমি আর ছোট্ট আবীর আমাদের বিশাল বড় অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম এক্কেবারে একা। সদ্য ভারত থেকে গিয়ে ওই সময়ের প্রত্যেকটি দিন খুবই একঘেয়ে আর বিষণ্ণ লাগত। দেশে থাকতে যেখানে খুশি, যখন খুশি বেরিয়ে পড়ায় কোন বাধা ছিল না। এখানেও বেরিয়ে পড়তে অন্য বাধা কিছু ছিল না, একমাত্র অন্তরায় ছিল ভাষা। বাইরে বেরিয়ে ট্যাক্সিকে কী বলবো? তখনও ইরানে, অন্ততঃ আমাদের ছোট্ট শহরে সুপার মার্কেট গড়ে ওঠেনি। দোকানে কিংবা বাজারে গিয়ে কী বলবো? মাঝে মাঝেই পুত্রকে নিয়ে পার্কে যেতাম, ও অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খুব দৌড়োদৌড়ি করত এবং মিশেও যেত খুব তাড়াতাড়ি। শৈশবের সারল্যে ভাষা কোন অন্তরায় হত না।

পার্ক থেকে ফেরার পথে একদিন একটি দোকানে গিয়েছিলাম, কিছু চকলেট, ড্রাই ফ্রুট্‌স্‌ আর বিস্কিট কিনতে। দোকানে সাজানো জিনিষগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে সংগ্রহ করা গেল। দোকানী ভদ্রলোক সব জিনিষ একটি প্যাকেটে ঢুকিয়ে তুলে দিলেন আবিরের হাতে, আবিরের বয়েস তখন বছর দুয়েক। আমি টাকা দিতে গেলাম, ভদ্রলোক কিছুতেই নেবেন না, আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? উনি স্মিতমুখে বললেন, “শামা মেহমান-এ ইরান” – অর্থাৎ আপনারা ইরানের অতিথি। আপ্লুত হয়েছিলাম ভদ্রলোকের অসাধারণ আপ্যায়নে। অবিশ্যি এমন আপ্যায়ন এরপরেও বেশ কয়েকবার মিলেছিল, নানান মানুষের থেকে - ট্যাক্সিতে, দোকানে, বাজারে। ভারতীয়দের প্রতি সাধারণ ইরানীদের এই ভালোবাসা আমার ইরান বাসের অভিজ্ঞতায় অন্যতম মধুর স্মৃতি।

এভাবেই দিন গড়াতে লাগল। নির্বান্ধব দিনগুলিতে ওই পার্কটিই ছিল আমার ও আমার পুত্রের মুক্ত বাতাস।  একদিন হঠাৎ করেই আলাপ করতে এলেন এক মধ্যবয়স্ক মহিলাতাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর পুত্র ও কন্যা, তাদের বয়েস কুড়ি একুশ তো হবেই। আলাপে দেখা গেল ছেলেটি অল্পবিস্তর ইংরিজি জানে। অতএব সেই দোভাষী হয়ে আমার এবং ওর মায়ের কথাগুলি বলতে লাগল। এখানে আসার পর এতদিনে কেউ আমার কথা শুনছেন, আমিও শুনছি তাঁর কথা। সেদিন কী যে ভালো লেগেছিল, সে কথা আজও মনে পড়লে রোমাঞ্চ অনুভব করি। এমন পরিস্থিতিতে যাঁরা না পড়েছেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন না, এই আনন্দ।

আলাপে জানলাম পরিবারটি “সসজেদি” পরিবার। মহিলা বললেন, আমি তাঁকে ‘আন্টি’ ডাকতে পারিজেনে ভালো লাগলো ইরানেও “মামা”, “মাসি” সম্বোধনে সম্পর্ক গড়ার প্রচলন আছে। আমাকে উনি আশ্বাস দিলেন, প্রয়োজনে ওঁর সঙ্গে এবং ওঁর ছেলের সঙ্গে আমি নির্দ্বিধায় যোগাযোগ করতে পারি। আমরা উভয়েই ফোন নম্বর লিখে রাখলাম।

এর কিছুদিন পরেই পেলাম ওঁদের বাড়ি সান্ধ্যভোজের নিমন্ত্রণ। ততদিনে ওখানকার সামাজিক আদব-কায়দা কিছু কিছু রপ্ত করেছি, কিছু শিখেছি বই পড়ে, টিভি দেখে, এবং কাজলের সহকর্মীদের বাড়ি গিয়ে। আন্টি আমাদের নিতে গাড়ি পাঠিয়েছিলেন, ওঁনার ছেলে “পুয়ান” এসেছিল সঙ্গে। ওঁনার বাড়িতে পৌঁছে দেখি, পুরো পরিবার – তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে গেট অব্দি এগিয়ে এসেছেন, আমাদের অভ্যর্থনা করতে। সংস্কৃতের সংস্কৃতিতে একেই বলে “প্রত্যুদ্গমন”।

বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি, সারা বাড়ি পারস্য কার্পেটে মোড়া। দেওয়ালে সিল্কের কার্পেট ঝোলানো, হাতে আঁকা ছবির মতো সুন্দর কার্পেটগুলি অনবদ্য সুন্দর, এমনটা আগে কোনদিন দেখিনি। পরে জেনেছিলাম শ্রীযুক্ত মসজেদি, ওই শহরের অন্যতম ধনী ও বিখ্যাত মানুষ, স্থানীয় সমাজে তাঁর বিপুল সম্মান।

সারা সন্ধ্যে প্রচুর খাওয়াদাওয়া হল, আড্ডা হল, আমি গান শোনালাম, ওঁরাও গান শোনালেন। এভাবেই ওই পরিবারের সঙ্গে গড়ে উঠল নিবিড় সম্পর্ক, যা আজও অটুট। আজও আন্টির সঙ্গে ফোনে কথা হয়, আন্টি কান্নাকাটি করেন, বলেন, “তোমাদের এ জীবনে আর দেখবো না, ভাবতে পারি না...”।                                     

স্বামীর চাকরি সূত্রে আমরা ভারত ছেড়ে ইরানে পৌঁছে, অপরিচিত পরিবেশের রূঢ় বাস্তবের অভিঘাতে আমার সঙ্গীত চর্চা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎই সেখানে এক পিয়ানো শিল্পীর সাথে আলাপ হয় এবং সামান্য অনুরোধেই তিনি আমায় পিয়ানো শেখাতে রাজী হয়ে গেলেন। নির্বান্ধব পরিবেশের মধ্যে এমন একটা সুযোগ পেয়ে ভীষণ খুশী হয়েছিলাম। ছোটবেলা থেকেই আমি হারমোনিয়াম বাজাতাম, তাই পিয়ানোতে গানের সুর তুলতে পারতাম সহজে।

একটা ফারসি গান আমার খুব ভালো লাগতো। সেটাই আমি পিয়ানোতে তুলে নিয়েছিলাম। একদিন যখন আমি ক্লাসে সেই গানের সুর পিয়ানোতে বাজিয়ে শোনাচ্ছিলাম, আমার শিক্ষক আনন্দে দৌড়ে গিয়ে অন্দরমহল থেকে তাঁর মাকে ডেকে নিয়ে এলেন। তাঁরা দুজনেই অভিভূত হয়েছিলেন, একজন ভারতীয়কে ইরানের অতি প্রচলিত গান পিয়ানোয় বাজিয়ে শোনানোর জন্যে। আমি আজও দেখতে পাই, ফরজাদের মায়ের চোখের সরল বিস্ময় আর আনন্দ। কেন যে মানুষ গান গেয়ে মনের আলাপ না করে, Gun-point-এ মনের প্রলাপ বাধায় আজও বুঝে উঠতে পারিনি।

সে যাই হোক, সুদূর ইরানেই গানের চর্চা আবার শুরু হয়ে গেলো। বেশ কিছু ফার্সী গান শিখেছিপিয়ানো বাজানো শিখেছি ওখানেই। 


চলবে...



নতুন পোস্টগুলি

জঙ্গী ব্যবসা

  ১   ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ