প্রবাসিনীর আত্মকথা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
প্রবাসিনীর আত্মকথা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ১৮ জুলাই, ২০২৫

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)-র আত্মকথন - বিশ্বলোকের সাড়া - শেষ পর্ব

 বিশ্বলোকের সাড়া - শেষ পর্ব 

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)


আছ অন্তরে চিরদিন

 লিখতে বসলে কত কিছুই মনে পড়ে যায়। স্মৃতির দরজাগুলো যেন খুলে যায় একে একে—সেই পুরনো দিনের আলো-আঁধারি, হারিয়ে যাওয়া মুখ, চেনা গন্ধ। তবে সব স্মৃতি যে শুধুই সুখের, তা নয়। কিছু কিছু স্মৃতি থাকে, যেগুলোর রেশ মনে থেকে যায় গভীর এক ক্ষত হয়ে, চির বিষণ্ণতার সুরে বাঁধা পড়ে যায় মনের গহনে।

আমার প্রথম এলবাম রেকর্ড করার অনুপ্রেরণাটা যার কাছে থেকে পেয়েছিলাম—তা্র কথা না বললে আমার এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি আমার প্রিয় এক বন্ধু রাহুল।

রাহুল আমার গান দারুণ ভালোবাসত। ওর সেই চোখের উজ্জ্বলতা, যখন কোনো গান শুনে বলত—‘এই তো, এটাই তুমি' -- আজও যেন কানে বাজে। রাহুল আর ওর স্ত্রী, মৌসুমি, দুজনেই আমার খুব ঘনিষ্ঠ। এমনকি, আমাদের দুই পরিবারও যেন একে অপরের আত্মীয় হয়ে উঠেছিল। ওর মা, যাকে আমি ‘মাসিমা’ বলে ডাকি, আমাকে নিজের সন্তানের মতোই স্নেহ করেন।

একবার আমি কলকাতায় গিয়ে, ওদের বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছি। জমিয়ে আড্ডা – খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে। হঠাৎই রাহুল বলে উঠলো “তুমি সিরিয়াসলি গানের জন্য পারফর্ম করো না কেন? তোমাকে তো মঞ্চে দেখার কথা, তোমার তো আরও অনেকদূর যাওয়া উচিত”।

মনের অন্দরে শিহরণ জাগানো সেই কথাগুলো আমি আজও ভুলতে পারিনি, কখনও পারবও না। কারণ সেই মুহূর্ত থেকেই আমার অন্তরে শুরু হয়েছিল ভাঙন – এতদিন যত দ্বিধা ছিল, ছিল সংকোচ ও কুন্ঠা। সাগর সৈকতে বানানো বালির বাঁধের মতোই ধুয়ে মুছে গিয়েছিল রাহুলের ওই আত্মবিশ্বাসী প্রশ্নে এবং আদেশে! ওই কথাগুলোই আমাকে ঠেলে দিয়েছিল মঞ্চের দিকে — নিজেকে প্রকাশ করার এবং নিজের কথা সঙ্গীতের মাধ্যমে সকলের কাছে পৌঁছে দিতে যে সাহস প্রয়োজন – সেই সাহসটাই যুগিয়ে ছিল রাহুল।

আজ যখন পেছনে তাকাই, বুঝি — রাহুল শুধু একজন বন্ধু নয় - ও ছিল আমার গানের সবচেয়ে বড়ো ভক্ত।

আরেকটা ট্রিপে আমি কলকাতায় গিয়েছি, হঠাৎ রাহুল বলল, “তোমায় অ্যালবাম রিলিজ করতে হবে"। ওর কথার মধ্যে ফুটে উঠল শুধু নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নয়, তার সঙ্গে ছিল অলঙ্ঘনীয় এক আদেশ এবং আগুনের মতো উৎসাহ। বলল, “কুটু, তুমি রাজি হয়ে যাও। বাকি সব আয়োজন আমি করে দিচ্ছি।” 

রাহুল আমায় একরকম জোর করেই নিয়ে গেল স্বনামধন্য শিল্পী অর্ঘ্য সেনের কাছ – উনি ছিলেন রাহুলের পূর্ব পরিচিত। অর্ঘ্যদা আমার গান শুনতে চাইলেন।

আমি বেশ আড়ষ্ট হয়ে গাইলাম - একটু ভয় ভয়ও করছিল। স্বাভাবিক, এত বড় একজন নামকরা শিল্পীর সামনে হঠাৎ, একেবারে বিনা প্রস্তুতিতে গান পরিবেশন করতে হয়েছিল! কিন্তু একটা গান শুনে উনি খুশি হয়ে আরও গাইতে বললেন। তারপর বললেন, রেকর্ডিংয়ের জন্য ওঁনার মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।  

এইভাবেই, একরকম রাহুলের প্রবল উৎসাহেই আমার প্রথম অ্যালবাম রিলিজ হলো। সেই অ্যালবামের সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন স্বয়ং অর্ঘ্য সেন। অবশ্য তার পরের অ্যালবামের জন্য আমি পেয়েছিলাম রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাদির আশীর্বাদ ও সাহায্য।

সে এক অন্য গল্প—আমার জীবনের আরেকটা অধ্যায়।

রেকর্ডিং-এর কথা বলতে বলতে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। প্রথম অ্যালবাম রেকর্ডিংয়ের সময় আমরা উঠেছিলাম রাহুলের বাড়িতে। মাসিমা আর মৌসুমীর আদর-যত্ন - কী খাবো, কী পরবো - সব কিছুই ওঁদের উপর। দুজনের আন্তরিক স্নেহের ছায়াতেই কয়েকটা দিন কেটেছিল।

যাই হোক, রেকর্ডিং-এর প্রথম দিন পৌঁছেছি স্টুডিওতে। তিনটা গানের টেক হওয়ার পর ছিল লাঞ্চ-ব্রেক। আমার কানে এল, খুব কাছেই ভালো বিরিয়ানি পাওয়া যায়। আমি তো শুনেই বিরিয়ানি খাওয়ার জন্যে লাফিয়ে উঠলাম! সবার জন্য বিরিয়ানি আনানো হলো, মিউজিশিয়ানরাও ছিলেন, আমার মিউজিক অ্যারেঞ্জার মানবদা, অর্থাৎ স্বনামধন্য মানব মুখার্জি, আমার দাদা–বৌদি, আমার দুই দিদি, তাঁদের একজন এসেছিলেন দিল্লি থেকে, সবাইকে নিয়ে জম্পেশ খাওয়া-দাওয়া আর আনন্দ হল খুব।

কিন্তু বিরিয়ানি খাওয়ার পর, আবার রেকর্ডিং শুরু করতেই দেখি, আমার গলা আর উঠছেই না!

বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর মানবদা হাল ছেড়ে দিয়ে, হেসে বললেন, “আজ আর থাক… ম্যাডাম, বিরিয়ানির ঘিয়ের জন্যে, মনে হচ্ছে, আপনার গলা বসে গেছে – আগামীকাল ঠিক হয়ে যাবে”।

একটা দারুণ শিক্ষা হল সেদিন।

 

পরদিন আবার স্টুডিওর জন্য যখন বেরোচ্ছি, মাসিমা হাতে একটা টিফিন বাক্স দিয়ে বললেন, “আজ আর বিরিয়ানি খেও না যেন… এটায় ভাত আর হালকা মাছের ঝোল দিয়ে দিলাম।”

সেদিন সত্যি বলছি—চোখে জল এসে গিয়েছিল। আজও ভাবলেই চোখ ভিজে আসে। এত স্নেহ, এত মমতা—পাওয়ার যোগ্য হতে পেরেছি কি না জানি না, কিন্তু আজও উনি আমার কাছে এক মাতৃসমা।

সেবার আমরা কলকাতায় গিয়েছিলাম একসঙ্গে, অনেকেই ছিলাম রাহুলের বাড়িতে। হৈচৈ, আড্ডা, গান, গল্প — আমার স্মৃতিতে আজও রঙিন। সবাই মিলে আবার ফিরেও এসেছিলাম নিউজিল্যান্ডে। 

রাহুল তখন প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করত। দারুণ আবৃত্তি করত, দুর্দান্তভাবে উপস্থাপন করত কলকাতা দূরদর্শনে। ফিরে এসে ফোনে ওর সঙ্গে কত কথা হয়েছিল। ওর কিছু নতুন প্রোজেক্টের কথাও বলেছিল। 

কিন্তু, এর ঠিক কিছুদিন পরেই, আমাদের এক কমন বন্ধু ফোন করে জানালো, রাহুল আর নেই। আকস্মিক এই সংবাদের জন্যে আমরা কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। সত্যি বলতে, প্রথম শুনে বিশ্বাসই করিনি। ভাবতেই পারিনি – অত প্রাণোচ্ছল উদার মনের বন্ধুটির সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না। ফোনেও ওর কথা আর আমরা শুনতে পাবো না। এভাবেই আমাদের সবাইকে ছেড়ে, হঠাৎ একদিন চলে গেল রাহুল। খবর পাওয়ার পরেই, আমি ছুটে গিয়েছিলাম কলকাতায়, মৌসুমী আর মাসিমার পাশে দাঁড়াতে।

আজ এখন মনে হয়, আমি যে এত গানের অনুষ্ঠান করছি, নতুন নতুন রেকর্ডিং করছি, ইউটিউবে, স্পটিফাইতে আমার গান পৌঁছে যাচ্ছে কত শত মানুষের কাছে — রাহুল থাকলে কী আনন্দই না পেতো! উচ্ছ্বসিত হত, গর্বিত হত।

আজও মৌসুমীর সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব অটুট। মৌসুমী আর মাসিমা আমাদের পরিবারের অত্যন্ত আপন মানুষ। ভালো লাগার, হৃদয়ের মানুষ।

 

 

লহরীর পরে “লহরী” তুলে...

সাম্প্রতিক কালের কিছু সুন্দর অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করছি আমার এই স্মৃতিকথন।

 “লহরী” - গোবরডাঙার এক শান্ত কোণে গড়ে ওঠা এক সুরের পাঠশালা। ছোট্ট ছোট্ট  ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্করা এখানে শেখে গান, তবলা, হারমোনিয়াম, অন্যান্য যন্ত্র আর সুরে-তালে বাঁধা জীবনের গল্প।

এটা যেন গানের স্কুল নয়। যেন এক পরিবার, যার প্রাণপুরুষ বিশ্বজিত— একাধারে গায়ক, তবলাবাদক, শিক্ষক, আর সবথেকে বড় কথা—এক সুরেলা হৃদয়ের মানুষ।

আমার সঙ্গে বিশ্বজিত আর র‍্যালির পরিচয় হয়েছিল প্রায় তেরো বছর আগে। দেখা হতে হতে কেটে গিয়েছিল বছর পাঁচেক। কলকাতার এক সঙ্গীতানুষ্ঠানে আমি গান গেয়েছিলাম, আর বিশ্বজিত তবলায় সঙ্গত করেছিল। অনুষ্ঠান শেষে আমায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, তার নিজের শহর—গোবরডাঙায়, তাদের বাড়ি, আর লহরী গানের স্কুলে।

প্রথমবার সেই পরিবেশে পা রেখেই মনে হয়েছিল, আমি যেন বহুদিনের চেনা একটা জায়গায় ফিরে এসেছি।

এর পর আমি যতবারই লহরীতে গেছি, ততবারই ওখানকার ছাত্রছাত্রীরা, শিশু থেকে বড়রা— আমাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে, এমনভাবে ভালোবেসেছে — যেন আমি কখনোই বাইরের কেউ ছিলাম না।

 বিশ্বজিত-র‍্যালি আজ আমাকে “দিদিভাই" বলে ডাকে। আমার ছোট ভাই আর ভাইবৌ এর মতো, কিন্তু আমার সংগীত জীবনে ওদের অবদান অনেকখানি।

আমি যখন গানের থেকে একটু একটু করে সরে যাচ্ছিলাম, তখন সেই টান আবার ফিরিয়ে এনেছিল বিশ্বজিৎ।

 এই ২০২৫ সালের মার্চ মাসে, লহরী-র পঞ্চম বার্ষিকী অনুষ্ঠানের বিশেষ আমন্ত্রণে আমি উপস্থিত ছিলাম।

সেই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের গান, নাচ—মঞ্চ যেন বাংলার সুরে তালে ভরে উঠেছিল। সাজসজ্জা, পরিবেশনা, ভালোবাসা—সব মিলিয়ে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

 

আমি আজ বলতে পারি—লহরী আমারও এক ঠিকানা।

বিশ্বজিত, র‍্যালি, ওদের পরিবারের কাছ থেকে আমি পেয়েছি অসীম ভালোবাসা, সম্মান আর যে আতিথেয়তা, তা সত্যিই ভোলার নয়।

প্রতিবার ওদের বাড়ি থেকে ফিরে আসার সময়, মনে হয় — এই জায়গাটা শুধু গানের নয়, আমার মনেরও একটা কোণা দখল করে আছে।


এই স্মরণিকা আপাততঃ এখানেই শেষ করলাম। হয়তো আবার কোনদিন ফিরে আসব, নতুন নানান অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে। যাবার আগে সকলকে জানাই আমার প্রণাম, নমস্কার, আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। তার সঙ্গে রইল দুটি গানের উপহার - 

আমি কেবলই স্বপন করেছি বপন

 যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা



--০০--

শুক্রবার, ১১ জুলাই, ২০২৫

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)-র আত্মকথন - বিশ্বলোকের সাড়া - পর্ব ৪

 

 বিশ্বলোকের সাড়া - চতুর্থ পর্ব 

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)


কেমন করে গান কর, হে গুণী 

সেই কোন মেয়েবেলা থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে – সে কথা ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। বড় হতে হতে তাঁর গান যত শুনেছি, শিখেছি, এবং গেয়েছি, ততই মনে হয়েছে তাঁর অজস্র লেখা – বিশেষতঃ তাঁর প্রতিটি গান কী আশ্চর্য বর্ণময়। প্রতিটি ঋতুর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে – আমাদের মনের যাবতীয় সূক্ষ্ম আবেগকে এমন বাণীময় সুরে আলোকোজ্জ্বল করে তুলেছেন তিনি কোন জাদুতে। মাঝে মাঝে মনে হয় - বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে আমার মননে তাঁর গানের যে পূর্ণতার পরশ পেয়েছি – সে হয়ত একজন্মে সম্পূর্ণ হওয়ার নয়। জন্মান্তর বলে সত্যিই যদি কিছু থেকে থাকে – পার হয়ে যাবে হয়ত আরেক জন্ম –  কে জানে হয়তো আরও অনেক জন্ম।  

 আমার সংগীতসাধনার এই সুদীর্ঘ পথচলায় এমন একটি পূর্ণতার ভাবনা আমার মনে সবে যখন বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল - কবির ভাষাতেই যাকে বলতে হয় –

       “যা দেখেছি যা পেয়েছি

                        তুলনা তার নাই।

         এই জ্যোতিঃসমুদ্র-মাঝে

         যে শতদল পদ্ম রাজে

         তারি মধু পান করেছি

                          ধন্য আমি তাই - ”

বাস্তবিক ঠিক এমন মানসিকতার মধ্যেই শুরু হল আমার নতুন পথ চলা। নিজের গায়কী সত্ত্বার উদ্ভাবন। সেই দিনটি ছিল একান্ত ঘরোয়া, আন্তরিক এক সান্ধ্যসঙ্গীতের আসর। সেখানে আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম। আর সেখানেই ঘটে গেল আমার জীবনের মোড় ঘোরানো এক ঘটনা—প্রথম দর্শন, প্রথম শ্রবণ—এক মহান শিল্পীর সঙ্গে। এমন একটি মুহূর্ত যে আমার সঙ্গীত-জীবনে উদয় হবে, তা কোনোদিন কল্পনাতেও আসেনি। কখনও কখনও জীবন এমন কিছু সৌন্দর্য নিয়ে আসে যা স্বপ্নকেও ছাপিয়ে যায়—এ যেন এক অলৌকিক স্পর্শ, এক অভাবনীয় আশীর্বাদ।

সেই আসরে পরিচয় হল উস্তাদ গুলাম আব্বাস খানজির সঙ্গে। বিশ্ববরেণ্য এই হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় ও গজল শিল্পী, যাঁর কণ্ঠে বহমান এক প্রাচীন ঐতিহ্য—মিয়াঁ তানসেনের উত্তরাধিকারী রামপুর সাহাসওয়ান ঘরানার শ্রেষ্ঠতম রূপ। তাঁর গলায় ছিল যাদু, তাঁর সুরে ছিল এক অন্তর্লীন ব্যঞ্জনা। তাঁর প্রতিটি তান যেন সময়কে থমকে দাঁড় করিয়ে দেয়। তাঁর প্রতিটি আলাপন শ্রোতাকে নিয়ে যায় ঊর্ধলোকের পবিত্র এক জগতে। আমি আপ্লুত হলাম, বিমুগ্ধ হলাম।

এভাবেই জীবনের পটে আঁকা হল এক অনির্বচনীয় অধ্যায়ের শুরু - এক অনন্যসাধারণ শিল্পীর সম্যক সাহচর্য।

এই পরম সৌভাগ্য সামান্য এক পরিচয় নয়, এ এক অন্তর্জাগরণের মুহূর্ত—যেখানে আমার সংগীতসাধনা যেন এক নবজন্ম  খুঁজে পেল। স্বরবিতানের স্বরলিপি অনুসরণ কিংবা অনুকরণ করে এতকাল যে গান আমি চর্চা করেছি – উস্তাদজি মহার্ঘ আসন বিছিয়ে আমাকে বসিয়ে দিলেন সেই সঙ্গীতের খাস দরবারে।  এই যাত্রা শুরু হয়েছে তাঁর আশীর্বাদ ও সান্নিধ্যে, আমি  অন্তরে গভীরভাবে অনুভব করি—এ পথ আমায় নিয়ে চলবে আরও উচ্চতর সাধনার দিকে। সে সাধনায় আমার পাথেয় হোক – আপনাদের সকলের শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক আশীর্বাদ।  তিনটি গানের নৈবেদ্যে এখানে রইল –

ও যে মানে না মানা  - গানটি প্রধানতঃ আমার গাওয়া হলেও, কিছুটা অংশ উস্তাদজীর গাওয়া প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত।

তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র‍্যায়না  - উস্তাদজী ও আমার যৌথ সঙ্গীত। 

দিল সে তেরি নিগাহ্‌ - অষ্টাদশ শতাব্দীর অসাধারণ উর্দু কবি মির্জা গালিবের এই গজলটিতে সুর দিয়েছেন উস্তাদজি।  

অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো

স্মৃতির মণিমুক্তোর ভাণ্ডার হাতড়ে কত কথাই যে মনে পড়ে! তখনই মনে হয়, এসবই আমার ওপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ।

একসময় আমি একজন নামী ফটোগ্রাফারের সঙ্গে কাজ করতাম, তাঁর নাম রস ক্লেটন (Ross Clayton)তাঁর মূল পেশা ছিল মেডিক্যাল ফোটোগ্রাফি, কিন্তু তিনি পোর্ট্রেট আর ল্যাণ্ডস্কেপ স্টাডিতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সেই কাজেই আমি তাঁকে কখনো সখনো সামান্য কিছু সাহায্য করেছি। সেই সূত্রে রস-এর সঙ্গে গিয়েছিলাম পৃথিবীবিখ্যাত ফটোগ্রাফার ব্রায়ান ব্রেক (Brian Brake)-এর প্রদর্শনী দেখতে। সেখানেই প্রথম দেখলাম তাঁর নামকরা ছবি, “Monsoon Girl”, যার সাবজেক্ট আর কেউ নয়, আমাদের অতি পরিচিতা অপর্ণা সেন। ওঁর পিতা শ্রীযুক্ত চিদানন্দ দাশগুপ্তর বন্ধু ব্রায়ানের লেন্সে ধরা পড়েছে কিশোরী অপর্ণার বৃষ্টিস্নাত মুখ, ফটোগ্রাফির জগতে অমর হয়ে গেছে ওই চিত্রপট।

সেই সন্ধ্যায় প্রদর্শনীর workshop জমা হওয়া উপস্থিত অতিথিশিল্পী ও দর্শকরা যখন শুনলেন, আমিও ভারতবর্ষের কলকাতার কন্যা, তাঁরা ধরে নিলেন, আমি নিশ্চয়ই Monsoon Girl-এর পরিচিতা। তাঁরা আমাকে কিছু বলার জন্যে অনুরোধ করলেন। আমি বললাম, ব্যক্তিগতভাবে ওঁকে চিনি না, তবে উনি বাংলা তথা ভারতের একজন প্রখ্যাতা অভিনেতা ও চিত্রপরিচালক। উনি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের নিমন্ত্রিত বিচারক হয়েছিলেন এবং এই সব পরিচয় ছাড়াও তিনি একজন চিন্তাশীল লেখক। সেদিন এসব কথা বলতে বলতে আমি বারবার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিলাম এই গৌরবে যে, কলকাতা বা ভারতের পরিচিতি শুধু শুধু গরিব এবং পিছিয়ে পড়া দেশ হিসেবে নয়, সেখানে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের ইতিহাস ছাড়াও এমন অনেক কিছু আছে, যার স্বীকৃত বিশ্বজোড়া।

বেশ কয়েকবছর আগে কলকাতার এক নামি ব্যাণ্ড “চন্দ্রবিন্দু” এসেছিল অকল্যাণ্ডে অনুষ্ঠান করতে। ব্যাণ্ডের এক গায়কের পুত্র, নিজি-র ক্রিকেট অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের বিরাট ভক্ত, তার আবদার কেনের একটি ছবি তার চাই। উদ্যোক্তাদের সকলেই জানতেন, আমরা তোরঙার বাসিন্দা, আর কেনও তোরাঙার গর্ব। সেই উদ্যোক্তাদের একজন (আমাদের খুবই অন্তরঙ্গ বন্ধু) বাড়ি থেকে ফোনে আমাকে বললেন, “কুটুদি, আমি বলেছি, তোমরা কেনকে চেনো, সেই শুনে একজন তোমার সাথে কথা বলতে উদ্গ্রীব...”। তারপর “চন্দ্রবিন্দু”-র সেই শিল্পীর বিনীত অনুরোধ পেলাম, “দিদি, আমায় একটা ছবি অন্ততঃ দেবেন, না হলে আমার পুত্র আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না, কান্নাকাটি জুড়ে দেবে। বলবে, আমি নিজি ঘুরে গেলাম অথচ কেন-এর একটা ছবিও নিয়ে যেতে পারলাম না?” পুত্রের প্রতি পিতার গভীর এই স্নেহ দেখে আমি খুবই আনন্দ পেলাম।

উইলিয়ামসন পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি ক্রিকেট সূত্রেই। আমাদের পুত্র আবীর কেনের সঙ্গেই ক্রিকেট খেলেছে, পাঁচ-ছ বছর থেকে – স্কুল দলে, আঞ্চলিক ও প্রাদেশিক দলে। সেই দলের কোচ এবং ম্যানেজার ছিল আমার স্বামী কাজল।

আমি সেই রাত্রেই ফোন করলাম কেন-এর বাড়িতে, ওর মা জানালেন, কেন তখন দেশের বাইরে। আমার অনুরোধ শুনে তিনি খুবই খুশি হলেন, পুত্রের খ্যাতি এবং ভক্তজন সুদূর ভারতবর্ষেও ছড়িয়ে রয়েছে শুনলে কোন মা উচ্ছ্বসিত না হবেন?  তার পরের দিনই উনি কাজলের অফিসে পোঁছে দিয়েছিলেন, কেনের সই করা ফটো।

এ ব্যাপারটা আমরা ভারতীয় প্রেক্ষীতে হয়তো ভাবতে পারিনা।  কিন্তু এদেশে এটাই স্বাভাবিক। জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গেলেও তারকারা দূর আকাশের অধরা নক্ষত্র হয়ে যায় না।  কেন শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে নয়, অধিনায়ক হিসেবেও চূড়ান্ত সফল, তার প্রমাণ মিলেছে, গত বিশ্বকাপের এবং টেস্টচ্যাম্পিয়ন্স কাপের ফাইন্যালে। কেন শুধু ক্রিকেটার হিসেবে নয়, খুব বড়ো মনের মানুষ হিসেবেও অত্যন্ত জনপ্রিয়।

এই প্রেক্ষীতে আরেকটি ঘটনার কথাও বলতে চাই, সেবার ভারত নিজি সফরে এসেছিল ওয়ান-ডে সিরিজ খেলতে।  তোরঙার স্টেডিয়ামেও একটা ম্যাচ হয়েছিল, সেখানে আমরাও উপস্থিত হয়েছিলাম খেলা দেখতে। আমরা যখন মাঠে ঢুকে স্টেডিয়ামের দিকে এগোচ্ছি, কেন নেট প্র্যাকটিস সেরে ফিরছিল প্যাভিলিয়নের দিকে। আমাদের দেখতে পেয়ে, কেন এগিয়ে এল, আমাদের সঙ্গে হাত মেলালো, কয়েকটা কথা বলে চলে গেল প্যাভিলিয়নে। বিশ্ববিখ্যাত তারকার এমন সৌজন্য আমাদের অভিভূত করেছিল নিঃসন্দেহে। এর বিপরীতে, কয়েক বছর আগের কোন এক ম্যাচে ভারতীয় টিমের জনৈক বাঙালী খেলোয়াড়কে মাঠে উপস্থিত বেশ কিছু বাঙালী দর্শক বাংলায় ডেকেও কোন সাড়া পাননি। তিনি ফিরেও দেখেননি, সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেছিলেন, ভারতীয় এবং বাঙালী দর্শকদের। হতে পারে ভারতবর্ষে জনপ্রিয়তার উন্মত্ততা, তারকাদের জনস্রোত থেকে দূরে থাকতে শেখায়। অথবা হয়তো তাঁদের অহমিকা গগনচুম্বী। এখানকার সমাজে এমনটা কখনো চোখে পড়েনি, তারকা খেলোয়াড়, বিশ্বজয়ী অ্যাথলিট, এমনকি প্রধানমন্ত্রীকেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে সহৃদয় আলাপে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। খ্যাতি বা ক্ষমতা এখানকার মানুষদের মধ্যে দূরত্ব গড়ে দেয় না। এঁদের সকলেই এই মূল্যবোধে বিশ্বাস করেন যে, তাঁরা নিজেদের গুণেই সাফল্য এবং খ্যাতি অর্জন করেন ঠিকই, কিন্তু জনগণের জন্যেই তাঁদের এই জনপ্রিয়তার গৌরব।  


চলবে...


রবিবার, ৬ জুলাই, ২০২৫

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)-র আত্মকথন - বিশ্বলোকের সাড়া - পর্ব ৩

 বিশ্বলোকের সাড়া - তৃতীয় পর্ব 

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)


বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি, সেই তো স্বর্গভূমি

অভিবাসী পরিবারের অন্দরমহলে এই রকম ঘনিষ্ঠতার জন্যেই কানে আসতে লাগল, ছাত্রীদের দৈনন্দিন জীবনের নানান সমস্যার কথা। তার মধ্যে থাকতো তাদের শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচারের কথাও। এই ঘটনাগুলো আমায় ভীষণ ভাবে নাড়া দিত। আমি একই সঙ্গে চিন্তিত আর ব্যথিত হতাম। ভাবতাম ওঁদের জন্যে কী করে কিছু করা যায়, কারণ কিছু না করে চুপ করে মেনে নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছিল আমার কাছে। কী করে ভুলে যাই রবীন্দ্রনাথের সেই মন্ত্র, “অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে”।  

ESOL এর সমন্বয় আধিকারিক (co-ordinator) Philippa Cairns-কে একদিন বলেই ফেললাম, আমি এঁদের জন্যে এ ব্যাপারে কিছু করতে চাই। ফিলিপা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন, তাঁর সহযোগিতায় আমি পড়াশোনা এবং খোঁজ-খবর শুরু করলাম, পারিবারিক-হিংসা (Family-Violence)-র ব্যাপারে এদেশের আইন-কানুন কতখানি সজাগ।   

এই সময়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ হল এক মহিলা’র তিনি তখন সবে অকল্যান্ডে একটি সামাজিক সংস্থা (Social Organisation) শুরু করেছেন পারিবারিক-হিংসা’র-শিকার মহিলাদের (Domestic Violence victim ) জন্য । আমি সেখানে প্রথম ট্রেনিং নিলাম এই নির্যাতিতাদের সাহায্য করার। ওখানে ছাড়াও আমি আরো কয়েকটি অন্যান্য সামাজিক সংস্থা থেকেও অন্য ট্রেনিংও নিলাম। এইভাবেই আমার কাজের শুরু। আমি যুক্ত হলাম Tauranga Women’s Refuge- বলে একটি সংস্থাইয়। এটি একটি নারী-আবাস, সেখানে পারিবারিক হিংসার শিকার মেয়েদের আশ্রয় দেওয়া হয়। এ ধরনের নারী-আবাস অবশ্য দেশের অন্য অনেক শহরেই আছে। 

এখানে কাজ করতে করতে আমি অনুভব করলাম, একজন ইংরেজি না জানা একা এক অভিবাসী নারীর পক্ষে, যে কিনা এসেছে সম্পূর্ণ অন্য সমাজ এবং ধর্ম থেকে, পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক উঠতে পারে। এই সংগঠন তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়ালেও, তার জীবনে আরও কত যে সমস্যা আছে যার কোন ধারণাই নেই এই সংগঠনের কর্মীদের। ইংরেজি না জানায়, এঁরা এঁদের সমস্যার কথা, মানসিক পীড়ার কথা আলোচনা করতে পারেন না, আর কাউন্সেলরদের পক্ষেও তাদের দৈনন্দিন জীবনের জটিলতার কথাও বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না। এমন অনেক সামাজিক প্রথা, রীতিনীতি, অভ্যাস, সেগুলি সবই না বলা থেকে যায়, যেগুলি উন্নতদেশের বিদেশীদের চোখে মূল্যহীন। 

একদিন অনেক সাহস নিয়ে শুরু করলাম “দিশা” - Ethnic Women's Support Group। যে সংস্থা অসহায় নারীদের দিশা দেখাবে। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল Women Empowerment & womens’ rights। 

আমার সন্তানেরা তখন বেশ ছোট, ছোটটির বয়স দুই আর বড়জন আট। কিন্তু তাও সাহস করে নেমে পড়লাম; অভিবাসী মহিলাদের ওই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারিনি। কাজল গোড়া থেকেই আমার পাশে ছিল, অনেক সাহায্য করেছে। প্রথমে বাড়ি থেকেই কাজ করতাম, তারপরে একটা অফিস শুরু করি।  কয়েক বছর পরে চালু করতে পারলাম সেফ হাউজ। এটি শুধু অভিবাসী মহিলাদের জন্যই। বহু নিপীড়িত মহিলাকে আশ্রয় দিতে পেরেছি। বহু মহিলা এখানে থেকে নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে বা আবার নতুন করে বাঁচতে শিখেছেন। এই কাজের সূত্রে আমি পেয়েছি এক ভালো বন্ধু। Angie Warren-Clarke। এঞ্জি ছিলেন তৌরাঙা রিফুজের কোওর্ডিনেটর। আমরা একসাথে কাজ করেছি। কাজের সূত্রে আমরা দুজনে ভালো বন্ধু হয়ে গেছি। এখন উনি আমাদের পার্লামেন্টের একজন এমপি। 

বাইশ বছর আগে যখন আমি “দিশা” শুরু করি, ওই মহিলাদের সামাজিক মননে ছিল অটল-অহমিকার চূড়ান্ত ভ্রান্তি। আমার কাজের কথা কাউকে বলতে পারতাম না। বহু মানুষের, বিশেষতঃ পুরুষদের ধারণা ছিল, আমার কাজের জন্যে তাঁদের সংসার ভাঙছে। এমনকি আমার মেয়েও যখন আমায় প্রশ্ন করতো 'মা, তুমি কি করো?', আমি মিথ্যে বলতাম, “আমি গান করি, মানুষকে গান শোনাই”! 

এতদিনে সাধারণ মানুষ অনেক সচেতন হয়েছেন। অনেক সামাজিক পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করেছি। বাইশ বছর আগে যখন আমি এই কাজ শুরু করি, আমাদের সঙ্গে যে পুলিশরা আসতেন, তাঁদের সকলেই হতেন পুরুষ। সময় বদলে গেছে, এখন আমাদের সাহায্যের জন্যে আসেন মহিলা পুলিশেরা, তাঁরা ওই অসহায় মহিলাদের প্রতি অনেকটাই সংবেদনশীল এবং সহানুভূতিসম্পন্না।   

এই সমাজ সেবার সাথে সাথেই আমি চালিয়ে গেছি আমার গান আর রবীন্দ্রনাথের প্রচার। অবশ্য তার সাথে ছিল আমার স্বামী-সংসার, ছেলে-মেয়ের স্কুল, খেলা, ব্যালে। আমার ছেলে আবীর,  Earth-Science & Environmental Planning নিয়ে পড়াশোনা করেছে Waikato University থেকে, এখন চাকরি করে স্কটল্যান্ডের এডিনবরা শহরে। হকি খেলে, নিউজিল্যান্ডের হয়ে অনূর্ধ্ব একুশ (Under 21) দলের হয়েও সে খেলেছে। আমার মেয়ে অনাহিতা, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে আইন আর সঙ্গীত নিয়ে পড়াশোনা করেছে। পড়াশোনার সাথে সাথে সে চালিয়ে গেছে তার নিজের সঙ্গীত সাধনা। সে নিজে গান লেখে, সুর দেয় আর performও করে পাশ্চাত্য সঙ্গীত।  আমার কাছে ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিখেছে, ও খব ভালবাসে রবীন্দ্রাসঙ্গীত। আমার সাথে অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছে। ওর জন্ম এইদেশে  কিন্তু আমাদের ছেলে মেয়ে দুজনেই বাংলা বলতে পারে।  Accent অন্যরকম কিন্তু বলতে পারে। মেয়ে আপাতত সুদুর লন্ডন শহরে বাস করে, চাকরী করে সেখানকার আইন-মন্ত্রনালয়ে । আমার স্বামী কাজল পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। গত ৩০ বছর ধরে এখানকার এক নামকরা Consulting Company, BECA তে চাকরি করে। এদের তিন জনকে নিয়েই আমার নিউজিল্যান্ডের সংসার।

অনেক, অনেক কিছু পেয়েছি এদেশে এসে। ভালোবাসা পেয়েছি, মিশতে পেরেছি নানা দেশের মানুষের সাথে, অনেক কিছু শিখতে পেরেছি তাদের সংস্কৃতি থেকে। এদেশের একটা ব্যাপার ভীষণ মন কাড়ে, এখানকার সাধারণ মানুষের সত্যনিষ্ঠা। মানুষ মানুষকে অনেক বেশি মূল্য দেয়, সেটা অবশ্য সরকারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সরকারের স্বচ্ছতাও উল্লেখযোগ্য।

নানা দেশের মানুষকে গান শিখিয়েছি ও এখনো শেখাই।  নানা অনুষ্ঠানে গান করেছি, আমি নিজে অনুষ্ঠান প্রযোজনাও করেছি আর তার সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথের গান ছড়িয়ে দিয়েছি নিউজিল্যান্ডে। আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথের সমস্ত সৃষ্টির বিরাট একটা ভূমিকা আছে। এই অধ্যায় না থাকলে আমার জীবন অপূর্ণ থেকে যেতো।

শিল্পী হিসেবে এই প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমি নানান সঙ্গীত ও শিল্প সংস্থার স্বীকৃতি পেয়েছি। COGS (Community Organisation Grants Scheme) এর প্যানেল মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি। Creative Tauranga-র প্যানেলেও নির্বাচিত হয়েছি। এসবই আমার কাজের ও অনুভূতির স্বীকৃতি, যা এঁদের কাছ থেকে পেয়েছি দুহাত ভরে। 

সমাজসেবা আর সঙ্গীতচর্চার সূত্রে যোগাযোগ হয়েছে বহু মানুষের সাথে, অনেক সাথী পেয়েছি আর পেয়েছি কিছু ভালো বন্ধু, যাঁরা আমাকে সব সময়ে উৎসাহ দিয়েছেন, উদ্দীপনা যুগিয়েছেন। তাদের মধ্যে তিন জন হলেন Angie Warren-Clarke, Jan Tinneti এবং Priyanca Radhakrishnan.

“দিশা” নিয়ে কাজ করা কালীন আরো একজন এর সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল, যার কথা না বললেই নয়। Merrivale Community Centre-এ এক মিটিংয়ে আলাপ হয়েছিল, মেরিভেল প্রাইমারী স্কুলের তখনকার প্রিন্সিপাল Jan Tinetti-র সাথে। তিনি প্রাইমারী স্কুলের প্রিন্সিপাল হওয়া সত্ত্বেও মেরিভেল Community-র সাথে যুক্ত ছিলেন অঙ্গাঙ্গীভাবে। ওঁনার সাথে আলোচনা হলো ইমিগ্র্যান্টদের সমস্যা নিয়ে এবং দিশার নানান কাজ নিয়ে। অনেক সমর্থন পেয়েছিলাম জ্যানের কাছ থেকে। সেই থেকে আমাদের বন্ধুত্বের সূত্রপাত। ২০২০-র নতুন সরকারে জ্যান এখন মন্ত্রীত্বের পদে নিযুক্ত।

একটা ছোট্ট ঘটনার কথা না বললেই নয়, যেটা আমার মনে ভীষণ ভাবে দাগ কেটেছিল। আমাদের নিউজিল্যান্ডে আসার দ্বিতীয় দিন। আমরা তখন একজনের বাড়িতে পেয়িংগেস্ট ছিলাম এবং কাজল সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে গিয়েছিল ভাড়া বাড়ির খোঁজে। কাজল আগের দিন দেখিয়ে দিয়েছিল বাড়ির কাছেই একটা দোকান, যেখানে চাল ডাল এইসব পাওয়া যায়। আমি সকাল বেলা পুত্র ছোট্ট আবীরকে নিয়ে সেখানে গেলাম। চাল, ডাল এই সব সাংসারিক সামগ্রী কেনার পরে দাম দিতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম আমার কাছে নিজি ডলার নেই। আমি তাই দোকানীকে আমেরিকান ডলারই দিলাম। ভদ্রলোক বয়স্ক, পরে জেনেছিলাম পাকিস্তানের অভিবাসী; আমায় উর্দু মিশ্রিত হিন্দীতে জিগ্যেস করলেন, "বেটি কব আয়ি হো?" হাতে আমেরিকান ডলার দেখে উনি বুঝে নিয়েছিলেন যে আমরা সদ্য সদ্য এসেছি। বলেছিলেন, “আমি তো এই টাকা নিতে পারবো না, তবে তোমার খাবার দাবার তুমি নিয়ে যাও, পরে যখন ডলার ভাঙাবে আমায় দিয়ে যেও”।  আমি পরের দিনই টাকা ভাঙিয়ে গিয়ে দিয়েছিলাম আর অনেক ধন্যবাদও জানিয়েছিলাম। ১৯৯৫ সালে ভারত থেকে আসা আমি, ভাবতেও পারি নি, এই ধরনের মনুষ্যত্ব এখনো আছে মানুষের মনে। সম্পূর্ণ অজানা অচেনা এক মানুষকে এই ভাবে বিশ্বাস করা, ভাবা যায় না। ওই ভদ্রলোকের সেদিনের সহানুভূতি আমায় মনুষ্যত্বের এক নতুন পাঠ পড়িয়েছিল সেদিন। 

[নীচের লিংক থেকে প্রদীপ্তার গাওয়া একটি উচ্চাঙ্গ এবং একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে নিন - ব্লগার কিশোর]  


ন্যায়না ভর আয়ে

সেই ভাল সেই ভাল 

চলবে...


শুক্রবার, ২৭ জুন, ২০২৫

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)-র আত্মকথন - বিশ্বলোকের সাড়া - পর্ব ২

 

বিশ্বলোকের সাড়া - দ্বিতীয় পর্ব 

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)


এলেম নতুন দেশে

 

আমি নিজিতে পৌঁছাই ১৯৯৫ এর জুলাই মাসে, স্বামী কাজল আর ৪ বছরে পুত্র আবীর কে নিয়ে। কয়েকমাস অকল্যান্ডে থাকার পর কাজল চাকরি পায় তৌরঙায়। শুরু হলো আমাদের তৌরঙা নিবাস। ১৯৯৭ এ আমাদের মেয়ে, অনাহিতা এলো এই পৃথিবীতে; সম্পূর্ণ হল আমার মাতৃত্ব। 

আমরা যখন সপরিবারে নিজিতে মাইগ্রেট করি তখন সত্যি বলতে এই দেশ, এখানকার মানুষ বা এখানকার রকমসকম সম্বন্ধে একদমই কোন ধারণা ছিলনা।  নব্বইএর দশকে ডঃ গুগল ছিলেন না, সব প্রশ্নের উত্তরের জন্য।

আমরা যখন ধীরে ধীরে সেট্‌ল্‌ করার চেষ্টা করছি সম্পূর্ণ এক অজানা দেশে; আমরা একটা অর্গানাইজেশনের নাম শুনলাম - তৌরঙা এথনিক কাউন্সিল (Tauranga Ethnic Council)এই প্রতিষ্ঠানের মূল কর্মকাণ্ড ছিল নতুন ইমিগ্র্যান্ট মানুষদের নিউজিল্যান্ড-সমাজের মূল স্রোতে মিশতে শেখানো, ওঁরা সব ধরনের সাহায্যের হাত ওঁরা বাড়িয়ে ধরেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নিয়মিত ছোটখাট গেট-টুগেদারের আয়োজন করা হতো, যেখানে নানান দেশের লোকেরা আসতো, নিজেদের দেশের পোষাকে। বিভিন্ন ভাষাভাষী অন্য অনেক মানুষজনের সাথে আলাপ হত, বন্ধুত্ব হত। সেই সময়ে খুঁজে পাওয়া কিছু বন্ধু এখন পরিবারের মতো হয়ে গেছেন। আমাদের যোগাযোগ এত সুদৃঢ় হয়েছে তার কারণ আমরা সকলেই নিজিতে মাইগ্রেট করে এসেছি। এক স্বজনবিহীন পরিবারের কাছে, নতুন দেশে, হঠাৎই স্বদেশী এবং স্বভাষী মানুষকে খুঁজে পাওয়া যে কি আনন্দের বলে বোঝানো যাবে না। খবর পেয়েই আমরা ওই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলাম 

আনন্দের কথা আজও আমরা এই প্রতিষ্ঠান এর সাথে যুক্ত। আমাদের জীবনে এই প্রতিষ্ঠান এবং এখানে পাওয়া বন্ধুদের অবদান প্রভূত। ২৫ বছর পরেও আজও চোখের সামনে ভাসে যেদিন নীনা পেন আমাদের প্রথম স্বাগত-সম্ভাষণ করেছিলেন। আমাদের সেই সহৃদয় প্রগাঢ় বন্ধুত্ব আজও অটুট। আমি আর কাজল দুজনেই জড়িয়ে পড়লাম এই প্রতিষ্ঠানের নানান কাজে কর্মে। নতুন দেশকে আপন করার জন্য শুরু হল আমাদের পথচলা।    

 

পরবাসী, চলে এস ঘরে...

 

১৯৯৫-এ নিউজিল্যান্ডে এসেই অকল্যান্ডের ছোট্ট বাঙালী মহলে আবার গান শুরু করেছিলাম। এবং তখনই আমার মনের মধ্যে বাসা বাঁধল নিজের গানে এলবাম বানাবার।  

এই সূত্রে একটা বিশেষ ঘটনা ঘটল, যা ছিল আমার কাছে স্বপ্নেরও অতীত। অকল্যান্ডে আলাপ হয়েছিল বিশ্ব বিখ্যাত শিল্পী বাংলাদেশের রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সাথে। তিনি নিউজিল্যাণ্ডে এসেছিলেন গানের অনুষ্ঠান করতে। শিল্পীর ঔদার্য আর আমার সৌভাগ্য যে যোগাযোগটা তারপরেও বজায় ছিল। 

বছর খানেক পরে আমি আমার এলবাম রেকর্ড করতে ভারতে যাবার প্ল্যান করছি শুনে উনি এক কথায় আমায় তালিম দিতে রাজি হলেন। কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি আমি বন্যাদির কাছে থেকে; মানে ঢাকায় ওঁনার বাড়িতে থেকে ওঁনার কাছে গানের প্রশিক্ষণ নেবো। কি সুন্দর গল্পের ছলে গানের খুঁটিনাটি শিখিয়েছেন; কি অপূর্ব সুন্দর প্রাঞ্জল করে বুঝিয়েছেন, শিখিয়েছেন গানের পরিবেশনা কিভাবে করতে হয়। এই সব কিছুর জন্যে আমি ভীষণভাবে ঋণী বন্যাদির কাছে। 

তবে ভগবানের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ যে আমার স্বামী প্রতি মুহূর্তে আমার পাশে থেকেছে, সাহায্য করেছে। আজ আমি যেখানে পৌঁছাতে পেরেছি, তার পেছনে আমার স্বামী, আমার নিজের পরিবারের অবদান অসামান্য। সত্যি বলতে, “যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই”।

নিউজিল্যণ্ডে এসে অচিরেই এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমি দায়িত্ব নিলাম শিল্প-সংস্কৃতির। বিভিন্ন দেশের নাচ-গান-বাজনা নিয়ে, নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে শুরু করলাম। এই অনুষ্ঠানে শুধু যে ইমিগ্র‍্যান্টরাই শিল্পী, শ্রোতা বা দর্শক হতেন তা নয়, ধীরে ধীরে নিজির স্থানীয় মানুষেরাও খুবই আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তাঁরা নিশ্চয়ই বিশ্বের বহু দেশের বিভিন্ন সংস্কৃতির বৈচিত্র্য উপভোগ করতে আসতেন। তাঁরা যে কেউই হতাশ হননি, সে কথা স্বীকার করতে আজ আর দ্বিধা নেই। 

আর আমরাও তো চাইতাম যে আমরা যারা এদেশে সেট্‌ল্‌ করতে এসেছি, সে দেশের মানুষরাও আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠুন। তাতে দুপক্ষেরই সম্পর্ক নিবিড় হয়ে উঠবে, যদি কিছু বিরূপ মনোভাব থেকেও থাকে কোন পক্ষে, সে সব দূর হয়ে যাক চিরতরে। এই অনুষ্ঠানগুলোর আরেকটা প্রধান আকর্ষণ ছিল নানা দেশের নানান স্বাদের, অসাধারণ সব খাবার। সরকারি সাহায্য এবং পৃষ্ঠপোষকতা তখনও ছিল এবং এখনও আছে প্রচুর। 

আজও মনে পড়ে, একটা বেশ বড়সড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম আমরা। আমি ছিলাম মূল উদ্যোক্তা। এখানকার একটি বড় অডিটোরিয়ামে হয়েছিল আমাদের অনুষ্ঠান। সেখানে আমি প্রথম বিদেশী বা ভিন্ন-ভাষীদের সামনে রবীন্দ্রসঙ্গীত পেশ করেছিলাম। গর্বের সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিয়েছিলাম নোবেল জয়ী বাঙালী কবি বলে। তদানীন্তন মেয়র, নোয়েল পোপ ছিলেন আমাদের প্রধান অতিথি। আমার গান শুনে তিনি এসে বলেছিলেন, "although I did not understand the lyrics, but the tune touched my heart and your voice is like a Nightingale "  সেদিন আমার এক দারুন রোমহষর্ক আনন্দের অনুভব হয়েছিল। এক ভিন্নভাষী, ভিন্নকৃষ্টির মানুষের কাছ থেকে এইরকম প্রশংসা পেয়ে আমি আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম, ধন্য হয়েছিল আমার সঙ্গীতচর্চা। নোয়েল পোপের সেই প্রশংসা শুনে আমার মনে হয়েছিল, সত্যিই তো রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি, তাঁর সৃষ্টির কদর সর্বত্র; সমস্ত মানুষের, দেশ-ভাষা নির্বিশেষে, মন ছুঁতে পারে। এমনকি তাঁর সুরের জাদুতেও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উঠতে পারেন, বাংলা না-জানা গুণী মানুষেরাও। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই দেশে,  মূল স্রোতের মানুষের সামনে নিয়ে আসবো রবীন্দ্রনাথের গান, তাঁর মন্ত্র, তাঁর দর্শন।

সেই হল শুরু,  ১৯৯৮ থেকে আমি নিজির বহু শহরে বহু অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছি, বহু ক্ষেত্রে গানের অনুবাদ লেখা কাগজ দিয়েছি শ্রোতাদের হাতে। আজও করে চলেছি। 

রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নিজির ভারতীয় হাইকমিশনের উদ্যোগে এক অনুষ্ঠানে আমায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কিছু পরিবেশনার জন্য। সেই অনুষ্ঠানে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপরে রবীন্দ্রনৃত্য এবং ক্ল্যাসিক্যাল ব্যালে মিশিয়ে নৃত্যানুষ্ঠান করিয়েছিলাম। এই পরিবেশনায়, আমার মেয়ে এবং তার ব্যালে স্কুলের সহপাঠীরাও অংশ নিয়েছিল।

১৯৯৭-এ আরও একটি সংগঠনের সাথে আমার পরিচিতি হয়। সেটা হয়েওছিল এক মাল্টিকালচারাল ফেস্টিভ্যালের সময়। ESOL (English for Speakers of Other Languages) সরকারি অনুদানপুষ্ট এই সংগঠনের কাজ ছিল, ভিন্ন ভাষাভাষী নবাগত ইমিগ্র্যান্ট বা রিফিউজিদের ইংরাজি শেখানো। ইরানে থাকার সময় আমি অনুভব করেছিলাম, একটা দেশের ভাষা না জানলে, সে দেশে বাস করা এবং স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে পরিচয় গড়ে তোলা কত কঠিন। আর ঠিক এইখানেই ESOL তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। নতুন অভিবাসী বা রিফিউজি পরিবারের বহু মহিলা বা বয়স্ক মানুষের ইংরেজির জ্ঞান প্রায় নেই বললেই চলে। অনেকে হয়তো ইংরাজি জানেন, কিন্তু বলতে আড়ষ্ট বোধ করেন। তাঁদের ইংরেজিতে কথা বলা শেখানোর মাধ্যমে সমাজের বাকী সবার সাথে মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়াটাই এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য। এখানেও যোগ দিলাম আমি, কারণ আমি চাইতাম আমার ইরান-বাসের প্রথম কিছু মাসের মতো কেউ যেন ভুক্তভোগী না হয়। আমাকে অবশ্যই ট্রেনিং নিতে হয়েছিল, কারণ প্রাপ্তবয়স্কদের ভাষা শেখানোর নিয়ম সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি ইংরেজি শেখাতে শুরু করলাম বাংলাদেশ, ভারত (মূলত পাঞ্জাবী), আফগানিস্তান আর ইরান থেকে আসা অভিবাসী বা শরণার্থী মহিলাদের। অনেকে ক্লাসে আসতেন, আবার বহু ক্ষেত্রে আমি যেতাম আমার থেকেও বয়স্কা এবং শ্রদ্ধেয়া ছাত্রীদের বাড়িতে, কখনো কখনো তাঁদের অন্দরমহলেও। এই সংগঠনের সাথে কাজ করতে গিয়ে আমার এক নতুন মূল্যবোধের উপলব্ধি এল। এই সংস্থা আমার মধ্যে এনে দিল সহানুভূতিশীল এক সত্ত্বা এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস, যে বিশ্বাস অন্য মানুষের মধ্যেও সঞ্চার করা যায়। 

 

[ব্লগার কিশোরের মন্তব্যঃ সুদীর্ঘ ৩৪ বছরের প্রবাস-জীবন কাটিয়েও শ্রীমতী প্রদীপ্তার গাওয়া গানগুলি শুনলে অবাক হতে হয় - এমন সুস্পষ্ট উচ্চারণ এবং সূক্ষ্ম রাবীন্দ্রিক গায়কী কিভাবে তিনি অন্তরে এতদিন ধরে বহন করে চলেছেন! ইউ-টিউবে তাঁর অনেক গানের থেকে আমার প্রিয় দুটি গানের সুত্র নীচেয় দিলাম।] 

আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা

তোমায় গান শোনাবো


চলবে...


শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)-র আত্মকথন - বিশ্বলোকের সাড়া - পর্ব ১

 

[ব্লগার কিশোরের মন্তব্যঃ আমার স্কুল জীবনের বন্ধু কাজল মুখার্জি - অধুনা নিউজিল্যাণ্ডের তোরঙ্গা নিবাসী। বন্ধুপত্নী কুটু (ভালো নাম প্রদীপ্তা মুখার্জি) গৃহবধূ - কিন্তু চারদেয়ালের ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে কোনদিন থাকেননি। কুটু সমাজসেবী, সমাজ সংগঠক এবং যথেষ্ট প্রতিভাময়ী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। সত্যি বলতে সমগ্র নিউজিল্যাণ্ডে বিশেষ করে নিউজিল্যাণ্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বঙ্গ সমাজে কুটু অবিসংবাদিত একজন সাংস্কৃতিক মানুষ। তাঁর রচিত আত্মকথন "বিশ্বলোকের সাড়া" আমার এই ব্লগে প্রকাশ করার অনুমতি পেয়ে আমি সম্মানিত।]

 

 

বিশ্বলোকের সাড়া - প্রথম পর্ব 

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)

তুমি মোর পাও নাই পরিচয়

 আমি প্রদীপ্তা, প্রদীপ্তা মুখার্জি; ডাক নাম কুটু, এনামেই আমায় সবাই চেনে। পূর্ব ভারতের কোলকাতা শহর নিবাসী এক মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম।

বাবা ছিলেন পেশায় শিক্ষক, মা ঘর-সংসার সামলাতেন। চার ভাই আর চার বোনের মধ্যে আমিই ছিলাম সবার ছোট। বড় হয়েছি খুব হৈচৈ করা আনন্দে এবং স্নেহময় শাসনের মিশেলে। 

ছোটবেলা থেকেই কেন জানি না সঙ্গীত আমাকে টানতো। পড়াশোনার থেকে গান, নাচ, নাটক এই সবই অনেক বেশী পছন্দের। কিন্তু মধ্যবিত্ত সংসারে লেখাপড়ার দিকেই অনুরাগ ছিল বেশি, অতএব পড়াশোনা করাতেই অনেক বেশী সময় দিতে হত। কিন্তু পরবর্তী কালে উচ্চশিক্ষার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়  সুযোগ পাওয়া মাত্র সঙ্গীতকেই বেছে নিলাম। ব্যাচেলর অফ মিউজিক। এটাই আমার মনোমত বিষয় ছিল বলেই হয়তো, পরীক্ষাগুলোও ভালোভাবে উৎরেও গেলাম।

ছোটবেলাটা কেটেছে মা, বাবা, দাদা, দিদিদের যুগপৎ আদর ও শাসনে। যদিও বাড়িতে নিয়ম-কানুন মানানোর যথেষ্ট প্রচেষ্টা ছিল - রোজ ভোরে উঠে পড়তে বসতে হত, এমনকি ছুটির দিনেও, তার অন্যথা করার অনুমতি মিলত না।

তবে মজাদার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলিও নিয়মিত পালন করা হত। বছরের প্রথম দিকে হত সরস্বতীপুজো। এই পুজো যেমন বাড়িতে হত, তেমনই হত স্কুল এবং বড়ো হওয়ার পর কলেজেও। ছোট্টবেলায় যখন আমরা প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী, বছরে ওই এই একটি দিনই, শাড়ি পরার সুযোগ পেতাম। বড়োসড়ো শাড়ির পুঁটলি শরীরে জড়িয়ে, আঁচল-টাঁচল সামলে, নানান স্কুলে ঘুরে ঘুরে প্রসাদ খাওয়া আর নতুন বন্ধু পাতানোর মজা আর আনন্দের স্মৃতি আজও মধুর। সে দিনগুলি ছিল বিরাট উত্তেজনার, পুজোটা যেন গৌণ, মুখ্য ছিল ওই আনন্দ আর মজাটাই।

তার পরেই আসত মার্চ মাস বসন্তের উতল হাওয়া নিয়ে, মনে ধরত নানান রঙ ও গান, কারণ দোল আসছে। ওই দিন মা পুজোর ঘরে পায়েস বানাতেন, তারপরে রাধা-কৃষ্ণের পুজো করতেন, ঠাকুরকে আবীর দেওয়া হতো। তারপর আমরা ছোটরা বাবা, মা ও গুরুজনদের আবীর দিতাম। তারপরেই শুরু হতো আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে আর পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে রঙিন হয়ে ওঠা এবং অন্যকে রঙিন করে তোলার উচ্চকিত আনন্দ আর মজা।

এপ্রিলে আসতো ১লা বৈশাখ, বাঙালীদের নববর্ষ। সেও এক মহানন্দের উৎসব। নতুন নতুন পোষাকনানান রান্না বান্না, খাওয়া দাওয়া, তার সাথে গান বাজনা ও নাচ, হৈচৈ নিয়ে একশ মজা।

অক্টোবর বা নভেম্বরে আসতো বাঙালির বহু আকাঙ্ক্ষিত মহোৎসব দুর্গাপুজো, সঙ্গে নিয়ে আসত কালীপুজো, দীপাবলি, ভাইফোঁটার অনেক ছুটি আর হাজার মজার সম্ভার নিয়ে। 

 

স্বপন যদি মধুর এমন

 খুব মনে পড়ে আমার প্রাইমারী স্কুলের দিন গুলো। বাড়ি থেকে অল্প হেঁটেই স্কুল। বিরাট জমি নিয়ে ইংরেজি আমলের তৈরি মস্ত স্কুল বাড়ি; কলকাতার নাকতলাতে, আনন্দ আশ্রম বালিকা বিদ্যালয়। পড়াশুনো করতে হত ঠিকই কিন্তু ছোট্টবেলা থেকেই সঙ্গীতই ছিল আমার সব থেকে প্রিয়।

বাড়িতে রেকর্ডে গান শুনতাম। রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরেছিলাম সেই ছোটবেলা থেকে। প্রথমে তাঁর গান, তারপর বড় হয়ে তাঁর গল্প, উপন্যাস, নাটক এর প্রেমে পড়ি। নিজের ভালো লাগার জন্যই রেকর্ড শুনে শুনে গান তুলতাম সাত আট বছর বয়েস থেকে। নয় বছর বয়েসে আকাশবাণী থেকে ডাক পেলাম, শিশুদের অনুষ্ঠানে গান গাইবার জন্য।

আমার বড় দিদি, আমায় ভর্তি করে দিয়েছিলেন গানের স্কুলে। এরই মধ্যে আমাদের পাড়ায় বা পাশের পাড়ায় প্রায়ই আমার ডাক পড়ত গান শোনাবার জন্য। ওই বয়েসেই রবীন্দ্রসঙ্গীতে এতই ডুবে ছিলাম যে পড়াশোনায় ফাঁক পড়ত প্রায়ই। স্কুলের দিদিমণিরা বাবার কাছে নালিশ করেছিলেন যে আমি পড়াশোনা না করে গানের পেছনে বেশী সময় দিই।

আমার স্বপ্ন ছিল সঙ্গীত নিয়ে পড়া। তাই যখন পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পেলাম তখন ভীষণ খুশী হয়েছিলাম, গর্বিত বোধ করেছিলাম। মনে হয়েছিল আমার গানের পাখি এতদিনে খুঁজে পেল ওড়ার মতো মুক্ত আকাশ।  কলেজে পড়ার সময় তখনকার দিনের বহু নামী শিল্পীর সান্নিধ্যে আসতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেছি। ওঁদের কাছ থেকে অনেক যত্নে গান শিখেছি, ওঁদের পরিচালনায় অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে গর্বিত বোধ করেছি।

এর মধ্যেই কোন একদিন বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়লাম। আমার স্বামী ছিলেন আমার বহুদিনের মনের মানুষ, কাজেই আমাদের মনের অমিলটুকুও মধুর হয়ে উঠল আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কে।

আমার পুত্র আবীরের বয়েস যখন সবে এক, তখন আমার প্রথম বিদেশ যাত্রার সূত্রপাত। দিল্লীর চাকরি ছেড়ে একটি ইতালীয় কোম্পানিতে চার বছরের চুক্তিতে কাজল জয়েন করল, আর ইরানে একটি পাওয়ার প্ল্যাণ্ট নির্মাণের জন্যে ওর সঙ্গে আমরা রওনা দিলাম ইরান। আমরা ইরান পৌঁছলাম ১৯৯২ সালে।

দিল্লী থেকে দুবাই হয়ে তেহরান পৌঁছলাম এমিরেটসের বিমানে। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে আমাদের বেজায় উত্তেজনা ছিল, এবং ভীষণ ভালো লেগেছিল বিমান সেবিকাদের, যেমন সুন্দরী, তেমনি আন্তরিক ব্যবহার।

ইরান সম্পর্কে তখন তেমন কিছুই জানতাম না, শুধু জানতাম ওখানকার গোলাপ বিখ্যাত, পড়েছিলাম রবিঠাকুরের “পারস্যে” প্রবন্ধে। ওই প্রবন্ধেই জেনেছিলাম ওদেশের সঙ্গীতের কথা, মানুষজনের কথা। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩২-এর মে মাসে পারস্যে ছিলেন তাঁর জন্মদিনের সময়, উনি লিখেছেন, “আমার পারসি বন্ধুরা সকাল থেকে পুষ্পবৃষ্টি করেছেন, নানা বর্ণের ফুল, বিশেষতঃ গোলাপ”। আর জানতাম পারস্যের বিখ্যাত কবি, আমার ভীষণ প্রিয় কবি হাফেজের কথা। হাফেজের শহর সিরাজ ও ইস্পাহান; আমরা পরে ইস্পাহানে কবি হাফেজের স্মৃতি সৌধ দেখতে গিয়েছিলাম, ওঁনার সমাধিতে ফুল ছড়িয়ে আমার মন ভরে গিয়েছিল।

তেহরানে প্লেন নামলো। প্লেন থেকে নামার আগে আমায় পরতে হল, “মান্টো” আর “রুসেরি”। মান্টো হল প্রায় গোড়ালি অব্দি ঝুলওয়ালা ওভারকোটের মতো পোষাক, তবে সাধারণ কাপড়ের। আর রুসেরি হলো স্কার্ফ, মাথা ঢাকা দেওয়ার জন্যে। তবে মুখ ঢাকার কোন প্রয়োজন হয়নি। এই পোষাক আমরা ভারত থেকেই বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম।

তেহরান এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমেই যেটা চোখে পড়েছিল সেটা হল Temperature Board – বাইরের তাপমান তখন শূণ্যের পাঁচ ডিগ্রি নিচে। যদিও আমরা প্রস্তুত ছিলাম, পর্যাপ্ত গরম পোষাক ছিল সাথে, তবুও জীবনের প্রথম মাইনাস তাপমানের সম্যক মুখোমুখি হওয়ার আগে ওই লেখাটা দেখেই যেন শীতের শিহরণ টের পেলাম শরীরে।

তেহরান থেকে প্রায় ন/দশ ঘণ্টার ড্রাইভে আমাদের গন্তব্য কেরমানশাহ, কাজলের কর্মস্থল। অধিকাংশ রাস্তাই তখন বরফে ঢাকা, রাস্তার দুপাশ ঘুমিয়ে আছে সাদা বরফের চাদর মুড়ি দিয়ে। প্রায় শেষ বিকেলে আমরা পৌঁছলা, কেরমানশাহ। ছোট্ট সুন্দর জনপদ, তার চারদিক ঘিরে রয়েছে বরফে মোড়া ছোট ছোট পাহাড়।

সবার জীবনে “প্রথম” যে কোন ব্যাপারই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, এবং আনন্দের তো বটেই। ইরান আমার কাছে সেই প্রথম বিদেশ যাত্রা। পরে বহু দেশ গিয়েছি, এখন যেমন দীর্ঘ প্রবাসী রয়েছি নিউজিল্যাণ্ডে, কিন্তু প্রথম বিদেশ যাত্রার আনন্দ ও উত্তেজনার অভিজ্ঞতা অতুলনীয়। ইরান এমন একটি দেশ, যেখানে আমি সবদিক থেকেই বিদেশিনী, তাদের ভাষা জানি না, বুঝি না। তাদের জীবনযাত্রা, পোষাক-আষাক, সামাজিক চালচলন, রূপ, সঙ্গীত, সবকিছুই আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

খুব সুন্দর একটা তিনতলা বাড়িতে আমাদের প্রবাসের নীড় গড়ে উঠল। নিচের তলায় থাকতেন আমাদের বাড়িওয়ালা, সপরিবারে মহম্মদ আমিনী। আমাদের ফ্ল্যাটের প্রায় প্রতিটি ঘরের জানালা থেকেই দূরের বরফে ঢাকা পাহাড় দেখা যেত। ভোরের আলোয় সোনালী রঙে রঙীন হয়ে সেজে উঠতো তারা। ঘরের ভেতরে সেন্ট্রাল হিটিং থাকায় সাধারণ পোষাকেই থাকা যেত, কিন্তু বাইরে তখন অসম্ভব ঠাণ্ডা। আমাদের ওই ইরান বাসের কয়েক বছরে, আমরা সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পেয়েছিলাম মাইনাস বাইশ ডিগ্রি! ওরই মধ্যে ছোট্ট আবীরকে নিয়ে শুক্রবারের সপ্তাহান্তে চলত আমাদের বরফ নিয়ে খেলা, বরফের পুতুল বানানোর নানান মজা।

ইরানে গিয়ে বাধ্য হয়েছিলাম ফারসী ভাষা শিখতে। প্রথমে বেজায় অসুবিধে হয়েছিল, কারণ আমাদের আশেপাশের প্রতিবেশী ও পড়শিদের কেউই হিন্দি তো বটেই, এমনকি কাজচলা গোছের ইংরিজিও জানত না। হাত-পা নেড়ে, নানান অঙ্গভঙ্গী করে নিজের বক্তব্য পেশ করার প্রচেষ্টা যাঁরা করেছেন, একমাত্র তাঁরাই বুঝবেন, সে সময় আমি কতখানি অসহায় বোধ করতাম।  অতএব আমাকেই ওদের ভাষা শেখার উদ্যোগ নিতে হল। নিজের এই অভিজ্ঞতার জন্যে, পরবর্তী জীবনে নিউজিল্যাণ্ডে বাস করার সময় যখন শরণার্থীদের সঙ্গে মিশেছি এবং তাঁদের নিয়ে কাজ করেছি, তখন ভাষা নিয়ে অসহায়তার বিষয়টা আমাকে নতুন করে বুঝতে হয়নি।

যাই হোক, ধীরে ধীরে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে পরিচিতি বাড়ল, কাজলের সহকর্মী ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গেও আলাপ হল। আমার পুত্র আবীরও সমবয়সী বন্ধু পেয়ে গেল অচিরেই। এভাবেই আমার ফারসী জ্ঞানের পরিধি বাড়তে লাগল অত্যন্ত ধীর লয়ে, এবং আবীর আমাকে পেছনে ফেলে, ফারসীতে শিখে ফেলল অতি দ্রুত, এবং ন-দশ মাসের মধ্যেই ও দিব্যি ফারসী বলতে শিখে গেল। আমি কোথাও আটকে গেলে, আমার বালক-গুরুর কাছেই চলত আমার শিক্ষানবিশী। ওইটুকু বয়সেই আবির বাংলা, ইংরিজি এবং ফারসী মোটামুটি একই তালে বলতে পারত। আমার ইরানী বান্ধবীরা আবিরকে বলত, “ডিকশনারি”, কারণ আমাদের বাড়িতে এলে আলাপের সময়, তাঁরাও আবিরেরই সাহায্য নিতেন, interpreter হিসেবে।

কাজল রোজই ভোরে বেড়িয়ে যেত, শহর থেকে অনেকটাই দূরে ছিল ওদের কর্মস্থল, construction siteআমি আর ছোট্ট আবীর আমাদের বিশাল বড় অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম এক্কেবারে একা। সদ্য ভারত থেকে গিয়ে ওই সময়ের প্রত্যেকটি দিন খুবই একঘেয়ে আর বিষণ্ণ লাগত। দেশে থাকতে যেখানে খুশি, যখন খুশি বেরিয়ে পড়ায় কোন বাধা ছিল না। এখানেও বেরিয়ে পড়তে অন্য বাধা কিছু ছিল না, একমাত্র অন্তরায় ছিল ভাষা। বাইরে বেরিয়ে ট্যাক্সিকে কী বলবো? তখনও ইরানে, অন্ততঃ আমাদের ছোট্ট শহরে সুপার মার্কেট গড়ে ওঠেনি। দোকানে কিংবা বাজারে গিয়ে কী বলবো? মাঝে মাঝেই পুত্রকে নিয়ে পার্কে যেতাম, ও অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খুব দৌড়োদৌড়ি করত এবং মিশেও যেত খুব তাড়াতাড়ি। শৈশবের সারল্যে ভাষা কোন অন্তরায় হত না।

পার্ক থেকে ফেরার পথে একদিন একটি দোকানে গিয়েছিলাম, কিছু চকলেট, ড্রাই ফ্রুট্‌স্‌ আর বিস্কিট কিনতে। দোকানে সাজানো জিনিষগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে সংগ্রহ করা গেল। দোকানী ভদ্রলোক সব জিনিষ একটি প্যাকেটে ঢুকিয়ে তুলে দিলেন আবিরের হাতে, আবিরের বয়েস তখন বছর দুয়েক। আমি টাকা দিতে গেলাম, ভদ্রলোক কিছুতেই নেবেন না, আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? উনি স্মিতমুখে বললেন, “শামা মেহমান-এ ইরান” – অর্থাৎ আপনারা ইরানের অতিথি। আপ্লুত হয়েছিলাম ভদ্রলোকের অসাধারণ আপ্যায়নে। অবিশ্যি এমন আপ্যায়ন এরপরেও বেশ কয়েকবার মিলেছিল, নানান মানুষের থেকে - ট্যাক্সিতে, দোকানে, বাজারে। ভারতীয়দের প্রতি সাধারণ ইরানীদের এই ভালোবাসা আমার ইরান বাসের অভিজ্ঞতায় অন্যতম মধুর স্মৃতি।

এভাবেই দিন গড়াতে লাগল। নির্বান্ধব দিনগুলিতে ওই পার্কটিই ছিল আমার ও আমার পুত্রের মুক্ত বাতাস।  একদিন হঠাৎ করেই আলাপ করতে এলেন এক মধ্যবয়স্ক মহিলাতাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর পুত্র ও কন্যা, তাদের বয়েস কুড়ি একুশ তো হবেই। আলাপে দেখা গেল ছেলেটি অল্পবিস্তর ইংরিজি জানে। অতএব সেই দোভাষী হয়ে আমার এবং ওর মায়ের কথাগুলি বলতে লাগল। এখানে আসার পর এতদিনে কেউ আমার কথা শুনছেন, আমিও শুনছি তাঁর কথা। সেদিন কী যে ভালো লেগেছিল, সে কথা আজও মনে পড়লে রোমাঞ্চ অনুভব করি। এমন পরিস্থিতিতে যাঁরা না পড়েছেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন না, এই আনন্দ।

আলাপে জানলাম পরিবারটি “সসজেদি” পরিবার। মহিলা বললেন, আমি তাঁকে ‘আন্টি’ ডাকতে পারিজেনে ভালো লাগলো ইরানেও “মামা”, “মাসি” সম্বোধনে সম্পর্ক গড়ার প্রচলন আছে। আমাকে উনি আশ্বাস দিলেন, প্রয়োজনে ওঁর সঙ্গে এবং ওঁর ছেলের সঙ্গে আমি নির্দ্বিধায় যোগাযোগ করতে পারি। আমরা উভয়েই ফোন নম্বর লিখে রাখলাম।

এর কিছুদিন পরেই পেলাম ওঁদের বাড়ি সান্ধ্যভোজের নিমন্ত্রণ। ততদিনে ওখানকার সামাজিক আদব-কায়দা কিছু কিছু রপ্ত করেছি, কিছু শিখেছি বই পড়ে, টিভি দেখে, এবং কাজলের সহকর্মীদের বাড়ি গিয়ে। আন্টি আমাদের নিতে গাড়ি পাঠিয়েছিলেন, ওঁনার ছেলে “পুয়ান” এসেছিল সঙ্গে। ওঁনার বাড়িতে পৌঁছে দেখি, পুরো পরিবার – তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে গেট অব্দি এগিয়ে এসেছেন, আমাদের অভ্যর্থনা করতে। সংস্কৃতের সংস্কৃতিতে একেই বলে “প্রত্যুদ্গমন”।

বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি, সারা বাড়ি পারস্য কার্পেটে মোড়া। দেওয়ালে সিল্কের কার্পেট ঝোলানো, হাতে আঁকা ছবির মতো সুন্দর কার্পেটগুলি অনবদ্য সুন্দর, এমনটা আগে কোনদিন দেখিনি। পরে জেনেছিলাম শ্রীযুক্ত মসজেদি, ওই শহরের অন্যতম ধনী ও বিখ্যাত মানুষ, স্থানীয় সমাজে তাঁর বিপুল সম্মান।

সারা সন্ধ্যে প্রচুর খাওয়াদাওয়া হল, আড্ডা হল, আমি গান শোনালাম, ওঁরাও গান শোনালেন। এভাবেই ওই পরিবারের সঙ্গে গড়ে উঠল নিবিড় সম্পর্ক, যা আজও অটুট। আজও আন্টির সঙ্গে ফোনে কথা হয়, আন্টি কান্নাকাটি করেন, বলেন, “তোমাদের এ জীবনে আর দেখবো না, ভাবতে পারি না...”।                                     

স্বামীর চাকরি সূত্রে আমরা ভারত ছেড়ে ইরানে পৌঁছে, অপরিচিত পরিবেশের রূঢ় বাস্তবের অভিঘাতে আমার সঙ্গীত চর্চা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎই সেখানে এক পিয়ানো শিল্পীর সাথে আলাপ হয় এবং সামান্য অনুরোধেই তিনি আমায় পিয়ানো শেখাতে রাজী হয়ে গেলেন। নির্বান্ধব পরিবেশের মধ্যে এমন একটা সুযোগ পেয়ে ভীষণ খুশী হয়েছিলাম। ছোটবেলা থেকেই আমি হারমোনিয়াম বাজাতাম, তাই পিয়ানোতে গানের সুর তুলতে পারতাম সহজে।

একটা ফারসি গান আমার খুব ভালো লাগতো। সেটাই আমি পিয়ানোতে তুলে নিয়েছিলাম। একদিন যখন আমি ক্লাসে সেই গানের সুর পিয়ানোতে বাজিয়ে শোনাচ্ছিলাম, আমার শিক্ষক আনন্দে দৌড়ে গিয়ে অন্দরমহল থেকে তাঁর মাকে ডেকে নিয়ে এলেন। তাঁরা দুজনেই অভিভূত হয়েছিলেন, একজন ভারতীয়কে ইরানের অতি প্রচলিত গান পিয়ানোয় বাজিয়ে শোনানোর জন্যে। আমি আজও দেখতে পাই, ফরজাদের মায়ের চোখের সরল বিস্ময় আর আনন্দ। কেন যে মানুষ গান গেয়ে মনের আলাপ না করে, Gun-point-এ মনের প্রলাপ বাধায় আজও বুঝে উঠতে পারিনি।

সে যাই হোক, সুদূর ইরানেই গানের চর্চা আবার শুরু হয়ে গেলো। বেশ কিছু ফার্সী গান শিখেছিপিয়ানো বাজানো শিখেছি ওখানেই। 


চলবে...



নতুন পোস্টগুলি

শ্রীমদ্ভাগবৎ কৃষ্ণ

  ৫.৪.১ শ্রীমদ্ভাগবৎ কৃষ্ণ শ্রীমদ্ভাগবত পূর্ণতঃ বিষ্ণুর মহিমা বর্ণন। তার মধ্যে অবশ্যই সিংহভাগ দখল করেছেন শ্রীকৃষ্ণ। এই পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের ...