বিশ্বলোকের সাড়া - শেষ পর্ব
প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)
আছ অন্তরে চিরদিন
আমার প্রথম এলবাম রেকর্ড করার অনুপ্রেরণাটা যার কাছে থেকে পেয়েছিলাম—তা্র
কথা না বললে আমার এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি আমার প্রিয় এক বন্ধু রাহুল।
রাহুল আমার গান দারুণ ভালোবাসত। ওর সেই চোখের উজ্জ্বলতা, যখন
কোনো গান শুনে বলত—‘এই তো, এটাই তুমি' -- আজও যেন কানে বাজে। রাহুল আর ওর স্ত্রী, মৌসুমি,
দুজনেই আমার খুব ঘনিষ্ঠ। এমনকি, আমাদের দুই
পরিবারও যেন একে অপরের আত্মীয় হয়ে উঠেছিল। ওর মা, যাকে আমি
‘মাসিমা’ বলে ডাকি, আমাকে নিজের সন্তানের মতোই স্নেহ করেন।
একবার আমি কলকাতায় গিয়ে, ওদের বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছি। জমিয়ে
আড্ডা – খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে। হঠাৎই রাহুল বলে উঠলো “তুমি সিরিয়াসলি গানের জন্য
পারফর্ম করো না কেন? তোমাকে তো মঞ্চে দেখার কথা, তোমার তো আরও অনেকদূর যাওয়া উচিত”।
মনের অন্দরে শিহরণ জাগানো সেই কথাগুলো আমি আজও ভুলতে পারিনি, কখনও পারবও না। কারণ সেই মুহূর্ত থেকেই আমার অন্তরে শুরু হয়েছিল ভাঙন – এতদিন যত দ্বিধা ছিল, ছিল সংকোচ ও কুন্ঠা। সাগর সৈকতে বানানো বালির বাঁধের মতোই ধুয়ে মুছে গিয়েছিল রাহুলের ওই আত্মবিশ্বাসী প্রশ্নে এবং আদেশে! ওই কথাগুলোই আমাকে ঠেলে দিয়েছিল মঞ্চের দিকে — নিজেকে প্রকাশ করার এবং নিজের কথা সঙ্গীতের মাধ্যমে সকলের কাছে পৌঁছে দিতে যে সাহস প্রয়োজন – সেই সাহসটাই যুগিয়ে ছিল রাহুল।
আজ যখন পেছনে তাকাই, বুঝি — রাহুল শুধু একজন বন্ধু নয় -
ও ছিল আমার গানের সবচেয়ে বড়ো ভক্ত।
আরেকটা ট্রিপে আমি কলকাতায় গিয়েছি, হঠাৎ রাহুল বলল, “তোমায় অ্যালবাম রিলিজ করতে হবে"। ওর কথার মধ্যে ফুটে উঠল শুধু নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নয়, তার সঙ্গে ছিল অলঙ্ঘনীয় এক আদেশ এবং আগুনের মতো উৎসাহ। বলল, “কুটু, তুমি রাজি হয়ে যাও। বাকি সব আয়োজন আমি করে দিচ্ছি।”
রাহুল আমায় একরকম জোর করেই নিয়ে গেল স্বনামধন্য শিল্পী
অর্ঘ্য সেনের কাছ – উনি ছিলেন রাহুলের পূর্ব পরিচিত। অর্ঘ্যদা আমার গান শুনতে
চাইলেন।
আমি বেশ আড়ষ্ট হয়ে গাইলাম - একটু ভয় ভয়ও করছিল। স্বাভাবিক, এত বড় একজন নামকরা শিল্পীর সামনে হঠাৎ, একেবারে বিনা প্রস্তুতিতে গান পরিবেশন করতে হয়েছিল! কিন্তু একটা গান শুনে উনি খুশি হয়ে আরও গাইতে বললেন। তারপর বললেন, রেকর্ডিংয়ের জন্য ওঁনার মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
এইভাবেই, একরকম রাহুলের প্রবল উৎসাহেই আমার প্রথম
অ্যালবাম রিলিজ হলো। সেই অ্যালবামের সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন স্বয়ং অর্ঘ্য সেন।
অবশ্য তার পরের অ্যালবামের জন্য আমি পেয়েছিলাম রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাদির আশীর্বাদ
ও সাহায্য।
সে এক অন্য গল্প—আমার জীবনের আরেকটা অধ্যায়।
রেকর্ডিং-এর কথা বলতে বলতে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। প্রথম
অ্যালবাম রেকর্ডিংয়ের সময় আমরা উঠেছিলাম রাহুলের বাড়িতে। মাসিমা আর মৌসুমীর
আদর-যত্ন - কী খাবো, কী পরবো - সব কিছুই ওঁদের উপর। দুজনের আন্তরিক স্নেহের
ছায়াতেই কয়েকটা দিন কেটেছিল।
যাই হোক, রেকর্ডিং-এর প্রথম দিন পৌঁছেছি
স্টুডিওতে। তিনটা গানের টেক হওয়ার পর ছিল লাঞ্চ-ব্রেক। আমার কানে এল, খুব কাছেই
ভালো বিরিয়ানি পাওয়া যায়। আমি তো শুনেই বিরিয়ানি খাওয়ার জন্যে লাফিয়ে উঠলাম! সবার
জন্য বিরিয়ানি আনানো হলো, মিউজিশিয়ানরাও ছিলেন, আমার মিউজিক অ্যারেঞ্জার মানবদা, অর্থাৎ স্বনামধন্য
মানব মুখার্জি, আমার দাদা–বৌদি, আমার
দুই দিদি, তাঁদের একজন এসেছিলেন দিল্লি থেকে, সবাইকে নিয়ে জম্পেশ খাওয়া-দাওয়া আর আনন্দ হল খুব।
কিন্তু বিরিয়ানি খাওয়ার পর, আবার রেকর্ডিং শুরু করতেই দেখি, আমার গলা
আর উঠছেই না!
বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর মানবদা হাল ছেড়ে দিয়ে, হেসে বললেন, “আজ আর
থাক… ম্যাডাম, বিরিয়ানির ঘিয়ের জন্যে, মনে হচ্ছে, আপনার গলা
বসে গেছে – আগামীকাল ঠিক হয়ে যাবে”।
একটা দারুণ শিক্ষা হল সেদিন।
পরদিন আবার স্টুডিওর জন্য যখন বেরোচ্ছি, মাসিমা হাতে একটা টিফিন বাক্স দিয়ে বললেন, “আজ আর বিরিয়ানি খেও না যেন… এটায় ভাত আর হালকা মাছের ঝোল দিয়ে দিলাম।”
সেদিন সত্যি বলছি—চোখে জল এসে গিয়েছিল। আজও ভাবলেই চোখ ভিজে আসে। এত স্নেহ, এত মমতা—পাওয়ার যোগ্য হতে পেরেছি কি না জানি না, কিন্তু আজও উনি আমার কাছে এক মাতৃসমা।
সেবার আমরা কলকাতায় গিয়েছিলাম একসঙ্গে, অনেকেই ছিলাম রাহুলের বাড়িতে। হৈচৈ, আড্ডা, গান, গল্প — আমার স্মৃতিতে আজও রঙিন। সবাই মিলে আবার ফিরেও এসেছিলাম নিউজিল্যান্ডে।
রাহুল তখন প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করত। দারুণ আবৃত্তি করত, দুর্দান্তভাবে উপস্থাপন করত কলকাতা দূরদর্শনে। ফিরে এসে ফোনে ওর সঙ্গে কত কথা হয়েছিল। ওর কিছু নতুন প্রোজেক্টের কথাও বলেছিল।
কিন্তু, এর ঠিক কিছুদিন পরেই, আমাদের এক কমন বন্ধু ফোন করে জানালো, রাহুল আর নেই। আকস্মিক এই সংবাদের জন্যে আমরা কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। সত্যি বলতে, প্রথম শুনে বিশ্বাসই করিনি। ভাবতেই পারিনি – অত প্রাণোচ্ছল উদার মনের বন্ধুটির সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না। ফোনেও ওর কথা আর আমরা শুনতে পাবো না। এভাবেই আমাদের সবাইকে ছেড়ে, হঠাৎ একদিন চলে গেল রাহুল। খবর পাওয়ার পরেই, আমি ছুটে গিয়েছিলাম কলকাতায়, মৌসুমী আর মাসিমার পাশে দাঁড়াতে।
আজ এখন মনে হয়, আমি যে এত গানের অনুষ্ঠান করছি,
নতুন নতুন রেকর্ডিং করছি, ইউটিউবে, স্পটিফাইতে আমার গান পৌঁছে যাচ্ছে কত শত মানুষের কাছে — রাহুল থাকলে কী
আনন্দই না পেতো! উচ্ছ্বসিত হত, গর্বিত হত।
আজও মৌসুমীর সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব অটুট। মৌসুমী আর
মাসিমা আমাদের পরিবারের অত্যন্ত আপন মানুষ। ভালো লাগার, হৃদয়ের
মানুষ।
লহরীর পরে “লহরী” তুলে...
সাম্প্রতিক কালের কিছু সুন্দর অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করছি আমার
এই স্মৃতিকথন।
এটা যেন গানের স্কুল নয়। যেন এক পরিবার, যার
প্রাণপুরুষ বিশ্বজিত— একাধারে গায়ক, তবলাবাদক, শিক্ষক, আর সবথেকে বড় কথা—এক সুরেলা হৃদয়ের মানুষ।
আমার সঙ্গে বিশ্বজিত আর র্যালির পরিচয় হয়েছিল প্রায় তেরো বছর আগে। দেখা হতে হতে কেটে গিয়েছিল বছর পাঁচেক। কলকাতার এক সঙ্গীতানুষ্ঠানে আমি গান গেয়েছিলাম, আর বিশ্বজিত তবলায় সঙ্গত করেছিল। অনুষ্ঠান শেষে আমায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, তার নিজের শহর—গোবরডাঙায়, তাদের বাড়ি, আর লহরী গানের স্কুলে।
প্রথমবার সেই পরিবেশে পা রেখেই মনে হয়েছিল, আমি যেন
বহুদিনের চেনা একটা জায়গায় ফিরে এসেছি।
এর পর আমি যতবারই লহরীতে গেছি, ততবারই ওখানকার ছাত্রছাত্রীরা, শিশু থেকে বড়রা— আমাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে, এমনভাবে ভালোবেসেছে — যেন আমি কখনোই বাইরের কেউ ছিলাম না।
আমি যখন গানের থেকে একটু একটু করে সরে যাচ্ছিলাম, তখন সেই
টান আবার ফিরিয়ে এনেছিল বিশ্বজিৎ।
সেই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের গান, নাচ—মঞ্চ
যেন বাংলার সুরে তালে ভরে উঠেছিল। সাজসজ্জা, পরিবেশনা,
ভালোবাসা—সব মিলিয়ে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
আমি আজ বলতে পারি—লহরী আমারও এক ঠিকানা।
বিশ্বজিত, র্যালি, ওদের
পরিবারের কাছ থেকে আমি পেয়েছি অসীম ভালোবাসা, সম্মান আর যে
আতিথেয়তা, তা সত্যিই ভোলার নয়।
প্রতিবার ওদের বাড়ি থেকে ফিরে আসার সময়, মনে হয় — এই জায়গাটা শুধু গানের নয়, আমার মনেরও একটা কোণা দখল করে আছে।
এই স্মরণিকা আপাততঃ এখানেই শেষ করলাম। হয়তো আবার কোনদিন ফিরে আসব, নতুন নানান অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে। যাবার আগে সকলকে জানাই আমার প্রণাম, নমস্কার, আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। তার সঙ্গে রইল দুটি গানের উপহার -