বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য ধর্ম
সনাতন ভারতে প্রচলিত চার বর্ণের সমাজে, জীবনটাকে চার আশ্রমের বাঁধনে
বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। এই চার আশ্রম হল, ব্রহ্মচর্য – নিজের বাড়ি ছেড়ে গুরুর গৃহে
কিছুদিন থেকে লেখাপড়া শেখা। পড়া শেষ করে গুরুর অনুমতি সাপেক্ষে গৃহস্থ ধর্ম -
অর্থাৎ জীবিকার জন্যে কিছু কাজকর্ম করা, বিয়ে থা করে সংসার ধর্ম পালন করা। গৃহস্থ
ধর্ম পালন করতে করতে যখন বয়েস হল, ছেলেপুলেরা সবাই বড় হয়ে গেল, তারাও গৃহস্থ ধর্ম
পালনে মশগুল হয়ে উঠল, তখনই এল বাণপ্রস্থের সময়। কারণ সেই বয়সে সংসারে বৃদ্ধ
বাবা—মায়ের আর তেমন কোন উপযোগীতা নেই, ছেলে মেয়েরা নিজের নিজের সংসার নিয়েই
ব্যস্ত। সংসারে বুড়ো বাবা-মা থাকলে ভালো, না থাকলে আরো ভালো। অতএব সংসারের
ঝুটঝামেলা না বাড়িয়ে, সংসার থেকে বেরিয়ে গিয়ে, বাণপ্রস্থে যাওয়াই শান্তির
ব্যবস্থা। গ্রামের বাইরে বনের ধারে ছোট্ট চালা ঘর বানিয়ে বুড়োবুড়ির নতুন সংসার –
মাঝে মাঝেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, ফেলে আসা যৌবনের নানান দুঃখ-স্মৃতি রোমন্থন করা,
দুজনে মিলে কোনমতে জীবন ধারণ করা। এই পর্যায়ে বেশ কিছু সময় কাটানোর পর, শরীর
অশক্ত-জরাজীর্ণ হয়ে পড়লে অথবা কোন এক সঙ্গীর মৃত্যু ঘটে গেলে জীবনের যে পর্যায় আসে
তার নাম সন্ন্যাস। চার আশ্রমের মধ্যে সন্ন্যাস আশ্রম যেন মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার
পর্যায়। এই সময় গৃহ-আশ্রয় হীন হয়ে, বনে বাদাড়ে, গ্রামের বাইরে গাছতলায় দিন-রাত
কাটানো, করুণা করে কেউ ভিক্ষা দিলে আহার জুটল, নচেৎ অনাহার। তারপর শীর্ণ হতে হতে
একদিন সকলের অগোচরে মৃত্যু।
অতএব ব্রাহ্মণ্যধর্মের চার আশ্রমের যে বিধান, তাতে সন্ন্যাস আশ্রম
মোটেই লোভনীয় কোন অবস্থা নয়। উপরন্তু হাতে গোণা যাঁদের এই চার আশ্রম পালনের কথা
পড়া যায়, তাঁরা অধিকাংশই রাজা বা সমাজের উচ্চস্তরের মানুষ ছিলেন। তাঁদের অনেকেই
সিংহাসনের জন্যে বয়স্ক পুত্রের হাতে হেনস্থা বা নিহত হওয়ার ভয়েও, হয়তো, সংসার
ত্যাগ করতেন! পুরাণে আছে মহারাজ বেণ পিতার সিংহাসনে বসার আগে তাঁর পিতা মহাধার্মিক
রাজা অঙ্গ অকস্মাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিলেন[i]! অথবা ঐতিহাসিক কালে অজাতশত্রু
তাঁর পিতা বিম্বিসারকে বন্দী (অথবা হত্যা – ৪৯৩ বি.সি.) করে পিতার সিংহাসন অধিকার
করেছিলেন[ii]। অতএব, প্রাচীন ভারতের
আমজনগণ এই চার আশ্রমের শেষ দুটি পর্যায় কীভাবে পালন করতেন কিংবা আদৌ গ্রহণ
করেছিলেন কী না, সেটা খুবই অস্পষ্ট।
ভারতীয় সমাজে সন্ন্যাস ব্যাপারটাকে অত্যন্ত মহিমান্বিত করে তুলেছিলেন
জৈন এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায় অথবা আরো স্পষ্ট করে বললে জৈনধর্মের মহান তীর্থঙ্কর
মহাবীর এবং স্বয়ং ভগবান বুদ্ধ। দুজনেই প্রায় সমসাময়িক - খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী[iii]। এঁদের ধর্মচিন্তার
অনেকটাই বেদ-উপনিষদ নির্ভর হলেও, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং তার কঠোর বর্ণাশ্রম আর
বিধিনিষেধের সম্পূর্ণ বিরোধী। সত্যি কথা বলতে এঁরা সন্ন্যাস গ্রহণ এবং সন্ন্যাসী
হওয়াটাকে আধ্যাত্মিকতার মোড়কে অতি উচ্চ স্তরের জীবন যাপনের একটা আদর্শ তৈরি করে
দিলেন। জীবনের পরম সত্য এবং জ্ঞান উপলব্ধি করার জন্যে বার্ধক্য পর্যন্ত অপেক্ষার
প্রয়োজন নেই এবং অব্রাহ্মণরাও যে এই জ্ঞানচর্চার পূর্ণ অধিকারী, সেকথাটা তাঁরা
নিজেদের আচরণ দিয়েই প্রমাণ করেছিলেন। যার ফলে একটা সময়, অসংখ্য যুবক এবং যুবতী এই
দুই ধর্মে – বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মে আস্থা রেখে আনন্দ পেয়েছিলেন। বহু অব্রাহ্মণ -
ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এমনকি শূদ্র এবং মহিলারাও পরম তত্ত্বজ্ঞানের চর্চার জন্যে
সন্ন্যাসী হয়ে বৌদ্ধ সংঘে যোগ দিয়েছিলেন। অথচ ব্রাহ্মণ্যধর্মের কঠোর নিয়মে শূদ্র এবং মহিলাদের
বেদচর্চা একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল।
বৌদ্ধ ধর্মের এই সামাজিক উদারতা, সংঘের পরিশীলিত পরিবেশে, যাগ-যজ্ঞ এবং
স্বার্থী ব্রাহ্মণের নিয়ন্ত্রণহীন ধর্মচর্চা, তখনকার সমাজকে বিপুলভাবে প্রভাবিত
করেছিল। সেই প্রভাবের পালে সবথেকে
বেশি অনুকূল বাতাস যিনি সরবরাহ করেছিলেন, তিনি সম্রাট ধর্মাশোক (২৬৮-২৩১
খ্রীষ্টপূর্ব)[iv] । তাঁর প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী
ধর্মরাজ্যে তিনি এমনই বিস্তৃত ও ব্যাপ্তভাবে বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন যে,
সেই প্রভাব কাটিয়ে সনাতন ব্রাহ্মণ্যধর্মকে নিজের জায়গায় ফিরে আসতে বেশ কয়েকশ বছর
সময় লেগে গিয়েছিল। তাও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক নতুন ভাবনা-চিন্তা করতে হয়েছিল।
রচনা করতে হয়েছিল, নতুন নতুন তত্ত্ব, নতুন নতুন ভাবনা। শুধু তাই নয়, যে
ব্রাহ্মণ্যধর্মের যাগ-যজ্ঞ নির্ভর ধর্মচর্চা সমাজের রাজা এবং উচ্চ স্তরের মধ্যে
মূলতঃ কেন্দ্রীভূত ছিল, সেই যাগযজ্ঞকে নামিয়ে আনতে হল, জনসাধারণের ঘরে ঘরে, তাদের
উপযোগী করে। তাদের জন্যে তাঁরা বেদ-নির্ভর নতুন নতুন শাস্ত্র রচনাও শুরু করলেন,
স্মৃতি এবং আরও পরবর্তীকালে পুরাণ।
বৌদ্ধধর্মের প্রতি জনগণের অনুকূল মনকে সনাতন ধর্মের প্রতি আবার টেনে
আনার এই প্রবল প্রচেষ্টা থেকেই বেদের দেবতারা – ইন্দ্র, অগ্নি, পবন, বরুণ প্রমুখ -
বেশ কিছুটা অবহেলিত হয়ে পড়লেন। তাঁদের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হলেন, ত্রিদেব – ব্রহ্মা,
বিষ্ণু, মহেশ্বর; প্রতিষ্ঠিত হলেন আদ্যাশক্তি মহামায়া। সাংখ্য, পাতঞ্জল, ন্যায়,
বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত – ভারতের এই সনাতন ষড়দর্শনের জটিল তত্ত্বকথার নিরাকার
পুরুষ ও প্রকৃতি, পরবর্তী কালে অজস্র দেব-দেবী রূপে নেমে এলেন সাধারণ জনগণের সহজ
সরল পূজার বেদিতে। বেদের নিরাকার পুরুষই ব্রহ্মা হয়ে জগৎ সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু হয়ে
জগতকে পালন করেন, মহেশ্বর – কখনো শিব হয়ে জগতের মঙ্গল করেন, কখনো রুদ্র হয়ে জগতের
বিনাশ করেন। এই ত্রিদেবের মধ্যে, ভগবান বিষ্ণু জগতকে পালন করার জন্যে, সঠিক বললে
দুর্জনের সংহার এবং সজ্জনের ধর্মরক্ষার জন্যে, অবতার হয়ে এই মাটির ধরণীতে নবার
অবতীর্ণ হলেন - মৎস্য,
বরাহ, নৃসিংহ, কূর্ম,
বামন, শ্রীরাম, পরশুরাম,
শ্রীকৃষ্ণ ও ভগবান বুদ্ধ হয়ে। কলিযুগের সমাপ্তিতে তিনি দশম অবতার
হয়ে আসবেন, কল্কি অবতার হয়ে। অতএব সাধারণ সমাজে সেই সময়েও ভগবান বুদ্ধের এতটাই
প্রভাব ছিল যে, ব্রাহ্মণ্যধর্মের রক্ষকদের ভগবানবুদ্ধকে ভগবানবিষ্ণুর অবতার পদ
দিয়ে অবস্থা সামলাতে হয়েছিল! অন্যদিকে বেদে মহিলা দেবতা অর্থাৎ দেবীর যে অভাব ছিল,
সে অভাবও পূরণ করা গেল প্রকৃতি স্বরূপে। বেদে নিরাকার পুরুষ যে প্রকৃতির সঙ্গে
সংযোগে জগতের প্রতিটি সৃষ্টি এবং প্রত্যেক কার্য-কারণের মূলস্বরূপ এত সব
ক্রিয়াকাণ্ড করেন, সেই প্রকৃতিই আদ্যাশক্তি মহামায়া, তিনি কখনো দুর্গা, কখনো কালী,
কখনো বা চণ্ডী। আরো আশ্চর্য বিষয়, এই দেব-দেবীদের অধিকাংশই প্রাক্-আর্য ভারতীয়
গণসমাজের দেব এবং দেবী রূপে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই পূজিত হয়ে এসেছেন।
বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবকে ধীরে ধীরে খর্ব করে, বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম পরিমার্জিত
(reformed – সংস্কৃত – শুধুমাত্র যে ধর্মই সংস্কৃত হল তা নয়, সেই ধর্মের শাস্ত্রাদি রচনার ভাষাও
হয়ে উঠল সংস্কৃত!) হয়ে নবীন হিন্দুধর্ম গড়ে ওঠার সুবিধে হয়েছিল তৎকালীন
রাজাদের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায়। রাজা, রাষ্ট্র এবং রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা মানেই
ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাফেরা করে ক্ষমতা অর্জন করা ও সেই ক্ষমতাকে রক্ষা করার প্রবল
প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতা থেকে গড়ে
ওঠা নবীন হিন্দুধর্মও দূরে থাকতে পারেনি, যার ফলে অনেক শাখা-প্রশাখার উদ্ভব হয়েছিল
এবং তাদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই নিত্য বিবাদ শুরু হয়ে গিয়েছিল।
কিছুটা বিশৃঙ্খল নবীন এই হিন্দুধর্মকে নির্দিষ্ট নীতি ও সুদৃঢ় তত্ত্ব
দিয়ে শৃঙ্খলার বাঁধনে বেঁধে দিলেন যুগপুরুষ শঙ্করাচার্য (মোটামুটি ৭৮৮-৮২০
খ্রীষ্টাব্দ[v])। অসাধারণ মেধাবী এবং
অপ্রতিদ্বন্দ্বী পণ্ডিত শঙ্করাচার্য বেদ, উপনিষদ এবং বেদান্ত দর্শনের উপর ভিত্তি
করে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের সৃষ্টি করলেন। অদ্বৈত কথার অর্থ “দুই কিন্তু দুই নয়”। অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি
কিংবা ব্রহ্ম ও মায়া, যেভাবেই চিন্তা করা হোক, এই দুইয়ের থেকেই নিখিল জগতের
সৃষ্টি। পুরুষ কিংবা ব্রহ্ম নিরাকার, নির্গুণ, অব্যয়, তাঁকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে
কোনভাবেই অনুভব করা যায় না, মননে কিংবা চেতনায় উপলব্ধি করা যায়। যিনি তা করতে
পারেন তিনি ব্রহ্মত্ব লাভ করেন, তিনি নিজেই ব্রহ্ম হয়ে যান, অথচ ব্রহ্ম বলতে ঠিক
কী, সেকথাও তিনি বর্ণনা করতে পারেন না, কারণ নিরাকার ব্রহ্ম অবর্ণনীয়। যে প্রকৃতি
বা মায়ার সংসর্গে এই জগতের সৃষ্টি, সে সৃষ্টিও মায়া - অলীক স্বপ্নের মত। আমরা আমাদের চারপাশে যা কিছু
দেখছি, সবই যেন ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখার মতো, যেদিন ঘুম ভাঙবে, অর্থাৎ চৈতন্য হবে,
সেদিন উপলব্ধি করব, এসব কিছুই নেই – সবই মায়া! অতএব পুরুষ ও প্রকৃতিকে দুই মনে
হলেও, আসলে দুই নয় - অদ্বৈত।
অনেক পণ্ডিতের মতে, অদ্বৈত তত্ত্বের মূল বেদ, উপনিষদ ও বেদান্ত থেকেই গৃহীত
হয়েছে ঠিকই কিন্ত তার মধ্যে ভগবান বুদ্ধের মতাদর্শের বেশ কিছুটা প্রভাব থাকলেও
থাকতে পারে। তার কারণ আচার্য শঙ্কর নানান দলে বিভক্ত বিবদমান বৌদ্ধ সন্ন্যাসী
গোষ্ঠীদের প্রতি বিরক্ত ছিলেন, কিন্তু ভগবান বুদ্ধকে অত্যন্ত সম্মান করতেন, তা না
হলে ভগবান বুদ্ধকে ভগবান বিষ্ণুর অবতার হিসেবে তিনি মেনে নিতেন না, অথবা কে জানে
হয়তো তিনিই ভগবান বুদ্ধকে ওই আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন! যদিচ শ্রীবিষ্ণুর অন্য আট
অবতারের যে মহিমাগাথা পুরাণ, মহাভারত এবং অন্যান্য শাস্ত্রে বহুবার, বহুভাবে পাওয়া
যায়, তার তুলনায় বুদ্ধ অবতারের কাহিনী হিন্দু শাস্ত্রে অতীব নগণ্য এবং সত্যি বলতে,
তাৎপর্যহীন!
অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের এই জটিল তত্ত্ব সাধারণের বোধগম্য নয় বলেই,
শঙ্করাচার্য নিরাকার ব্রহ্মতত্ত্বের পাশাপাশি সাকার দেবতাদের পূজাও অনুমোদন
করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, নিরাকার পুরুষ অথবা ব্রহ্মের ধারণা করা সাধারণ
মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, বরং কোন দেবতা কিংবা দেবীর প্রতিমার সামনে নিজেকে নিষ্ঠা
ভরে সমর্পণ সাধনায় একটা স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে, তারপর, নিরাকারের ধারণা করা
অনেক সহজসাধ্য। যদিও তিনি নিজেই নির্গুণ,
নিরাকার ব্রহ্মতত্ত্ব অদ্বৈতবাদের প্রবক্তা, কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা
করেই, আচার্য শঙ্কর প্রায় সকল লৌকিক সাকার দেব-দেবীদের পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং
তাঁদের উদ্দেশে তিনি অজস্র স্তব ও প্রণাম মন্ত্র রচনা করেছিলেন। কারণ সারা দেশ ঘুরে তিনি
উপলব্ধি করেছিলেন, সাধারণ জনসমাজ, তত্ত্বকথার দুর্বোধ্য কচকচানির থেকে, নিবিড়
ভক্তি দিয়ে প্রত্যক্ষ সাকার পূজায় অনেক বেশি আস্থাশীল, অতএব তত্ত্ব থাকুক মঠের
সাধুপণ্ডিতদের মস্তিষ্কে এবং পূজা থাকুক মাঠে-ঘাটে, প্রত্যেক মানুষের ঘরে ঘরে। প্রসঙ্গতঃ
আচার্য শঙ্করের এই সাকার মূর্তিপূজার প্রশ্রয়ের পিছনে আরেকটি বড় কারণের উল্লেখ করা
উচিৎ। সেটি হল, মোটামুটি সমসাময়িক কালেই হিন্দু ধর্মের সাধারণ জনগণের মধ্যে
জনপ্রিয় দুটি শাখার প্রভাব খুব প্রবল ছিল - একটি ভাগবত অন্যটি পাশুপত। এই দুই
শাখার প্রথমটি ভগবান বিষ্ণুর এবং দ্বিতীয়টি ভগবান শিবের মাহাত্ম্য প্রচার করত। আগম
শাস্ত্র নামে তাদের আলাদা শাস্ত্রও ছিল – যার কথা পরবর্তী অধ্যায়ে আসবে।
প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে, উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমের চারটি
অতি প্রাচীন দেবক্ষেত্রকে তিনি একই সূত্রে বেঁধে দিয়েছিলেন। যেমন,
উত্তরে যোশীমঠের বদরিকাশ্রমঃ- আদি
মঠাধ্যক্ষ - আচার্য তোটকাচার্য, বেদ - অথর্ব, দেব – নারায়ণ, দেবী – পুন্নাগাধী। সঙ্ঘ
- সরস্বতী, ভারতী ও পুরী; মহাবাক্য – “অয়মাত্মা ব্রহ্ম” (এই আত্মাই ব্রহ্ম)
মন্ত্র।
পূর্বে পুরীর গোবর্ধন মঠঃ- আদি
মঠাধ্যক্ষ - আচার্য হস্তামলক, বেদ – ঋক, দেব – জগন্নাথ, দেবী – বিমলা, সঙ্ঘ – বন ও
অরণ্য; মহাবাক্য – “প্রজ্ঞানমানন্দং ব্রহ্ম”(প্রজ্ঞানের আনন্দই ব্রহ্ম) মন্ত্র।
দক্ষিণে রামেশ্বরের শৃঙ্গেরি মঠঃ-
আদি মঠাধ্যক্ষ – আচার্য মণ্ডনাচার্য, বেদ – যজুঃ, দেব – আদি বরাহ, দেবী – আদি
কামাখ্যা; সঙ্ঘ – গিরি, পর্বত, সাগর। মহাবাক্য – “অহং ব্রহ্মাস্মি” (আমিই ব্রহ্মা)
মন্ত্র।
পশ্চিমে দ্বারকায় সারদা মঠঃ- আদি
মঠাধ্যক্ষ – আচার্য পদ্মপাদ, বেদ – সাম, দেব – সিদ্ধেশ্বর, দেবী – ভদ্রকালী, সঙ্ঘ
– তীর্থ ও আশ্রম, মহাবাক্য – “তত্ত্বমসি” (তুমি সেই তিনি) মন্ত্র[vi]।
তত্ত্বজ্ঞানের চর্চাকে নিরন্তর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আচার্য শঙ্কর
এইভাবে ভারতের চার প্রান্তে চারটি মঠ গড়ে তুলে, তার দায়িত্ব তুলে দিলেন তাঁর নির্বাচিত
শিষ্য আচার্যদের হাতে। প্রত্যেকটি মঠের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিলেন একটি বেদ এবং
অদ্বৈতবাদের এক একটি বীজমন্ত্র। প্রত্যকেটি মঠের সঙ্গে যুক্ত করে দিলেন, নির্দিষ্ট
কিছু সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের সঙ্ঘ। আচার্য শঙ্করের গড়ে তোলা এই সঙ্ঘ সন্ন্যাসীদেরই
একত্রে দশনামী সম্প্রদায় বলা হয়।
এখানে লক্ষণীয় বিষয়, আচার্য শঙ্করের এই মঠের ধারণা এবং প্রতিটি মঠের
জন্যে সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার বিষয়টা ভগবান বুদ্ধের ধর্ম
সংগঠন থেকে অধিগ্রহণ করা, এ কথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়। এই প্রসঙ্গে আরও দুটি
লক্ষণীয় বিষয়, সুপ্রাচীনকাল থেকেই রামেশ্বর শিবক্ষেত্র (রামায়ণে আছে, রাবণবধজনিত
পাপস্খালনের জন্য ভগবানবিষ্ণু-অবতার শ্রীরামচন্দ্র রামেশ্বরে শিবের পূজা করেছিলেন)
হলেও, শৃঙ্গেরি মঠে তিনি বিষ্ণু-অবতার বরাহের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অন্যদিকে অপর ভগবানবিষ্ণু-অবতার
শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র দ্বারকায় তিনি সিদ্ধেশ্বর শিবকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তৎকালীন
শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদ–বিভেদ দূর করে, উভয়ের সম্প্রীতি সৃষ্টি করাই
যে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, সে কথা বলাই বাহুল্য।
২
প্রাক-বৈদিক ধর্ম চিন্তা
এতক্ষণ যা কিছু বললাম তার সবই আর্য এবং তাঁদের বৈদিক তথা
ব্রাহ্মণ্যধর্ম এবং তার ক্রমবিবর্তনের কথা। এবারে আসছি তন্ত্রের কথায়। বৈদিক
ধর্মের তুলনায় তন্ত্র ব্যাপারটা এতটাই প্রাচীন, তার সুনির্দিষ্ট কোন ইতিহাস পাওয়া
যায় না। একথা বলাই যায়, তন্ত্রতত্ত্বের শুরু মানব সভ্যতার হাত ধরে। আরো স্পষ্ট করে
বললে, সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতি নির্ভর মানব যখন অরণ্যে শিকার আর ফল, মূল, কন্দ যোগাড়
করে জীবন ধারণ করতেন, তন্ত্র-তত্ত্বের শুরু সেই সময়ে! যদিও খুব স্বাভাবিক ভাবেই
সেই সময়ে তন্ত্র-তত্ত্বের নির্দিষ্ট কোন তত্ত্ব-কাঠামো ছিল না, ছিল বিভিন্ন
অঞ্চলের লৌকিক আচার ও পূজাবিধি। পশুপতি, পরবর্তী কালে যাঁর ব্রাহ্মণ্যধর্মে দেবাদিদেব, মহেশ্বর এবং শিবরূপে উত্তরণ ঘটেছে,
তিনি আদিম মানবের পশুদের দেবতা ছিলেন। অরণ্যের সমস্ত পশুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল,
অতএব আদিমকাল থেকেই প্রাক-আর্য মানুষদের বিশ্বাস ছিল, তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারলে
অর্থাৎ পূজা করলে, শিকারের অভাবে আদিম মানুষদের অনাহারে থাকতে হবে না এবং
দুর্দান্ত পশুদের আক্রমণে আহত বা নিহত হতে হবে না। পরবর্তীকালে আদিম মানুষ যখন চাষবাস
এবং পশুপালন শিখে ফেললেন, তখন তাঁরা এই পৃথিবীকে নারীর যোনি এবং কোন এক লিঙ্গময়
পুরুষের কল্পনা করেছিলেন, যাঁদের মিলনে ও আশীর্বাদে মাঠ ভরে উঠত গম, ধান, যব, জোয়ারের
মত শস্যে এবং খামার ভরে উঠত সবৎসা গবাদি পশুতে। এই যোনি ও লিঙ্গ পরবর্তী কালে
গৌরীপাট ও শিবলিঙ্গ হয়ে দেবীপার্বতী ও মহাদেবশিবের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
পরবর্তীকালে প্রাক-আর্য মানুষেরা যখন সিন্ধুর অববাহিকায় উন্নত নগর
সভ্যতা গড়ে তুলেছেন, মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সমুদ্রপথে এবং স্থলপথে নিবিড়
বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, তখনও তাঁরা ভগবান পশুপতিকেই যেন দেবতা মেনে নিয়েছেন।
হরপ্পা-মহেঞ্জোদরোর প্রত্নখনন থেকে বেশ কিছু মূর্তি এবং সিল (seal)
পাওয়া গেছে, যাঁর সঙ্গে যোগীরাজ পশুপতির খুব সাদৃশ্য আছে এবং তাঁর সঙ্গে আছে বৃষ
এবং আরো কিছু পশুর মোটিফ
(Motif)। ওই প্রত্নখননে বেশ কিছু
মাতৃকা নারীর মূর্তিও পাওয়া গেছে, পণ্ডিতেরা বলেন, মূর্তিগুলি হয়তো প্রাক-আর্য যুগের
দেবী মূর্তি। এ বিষয়ে অনুমান ছাড়া নিশ্চিত কিছু বলা শক্ত, কারণ সিন্ধু সভ্যতার
লিপির পাঠোদ্ধার এখনও করা সম্ভব হয়নি।
প্রাক-আর্য অত্যন্ত সভ্য মানুষদের (যেমন রাক্ষসরাজ রাবণ, দৈত্যরাজ বলি,
দানবরাজ হিরণ্যকশিপু প্রমুখ) এবং অরণ্যবাসী মানুষদের - রাক্ষস (যেমন হিড়িম্ব, বক),
পিশাচ, শবর, নিষাদ (একলব্য) প্রমুখদের পরাস্ত করে আর্যক্ষত্রিয়রা যেমন যেমন রাজ্য
প্রতিষ্ঠা করতে লাগলেন, আর্য ব্রাহ্মণেরা, ব্রাহ্মণ্যধর্মের নিয়ম অনুযায়ী গড়ে
তুলতে লাগলেন, চতুর্বর্ণভিত্তিক সমাজ এবং বৈদিক যাগযজ্ঞের ধর্মানুষ্ঠান। বিজয়ী
জাতির কাছে বিজিত জাতি সর্বকালেই বর্বর, অসভ্য, কুরুচিপূর্ণ, বেয়াদব, (এই সেদিন
ব্রিটিশ শাসকরাও আমাদের “ব্ল্যাকি নিগার” বলে চাবুক চালাত নির্বিচারে) অতএব
আর্যদের কাছে এদেশীয় প্রাক-আর্যরা যে রাক্ষস, দৈত্য, দানব, পিশাচ হয়ে অতিরঞ্জিত
বীভৎস, কদর্য, পৈশাচিক হয়ে উঠবে তাতে আর আশ্চর্য কী? যদিও রামায়ণ, মহাভারত ও
পুরাণগুলিতে বেশ কয়েকজন রাক্ষস, দানব কিংবা দৈত্যদের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে
তাঁরা আচার-আচরণে, শৌর্য-বীর্যে, ধন-সম্পদে আর্যরাজাদের তুলনায় কোন অংশে কম ছিলেন
না! এঁদের অনেকেই নিবিড় তপস্বী ছিলেন এবং ব্রহ্মা ও শিবের তপস্যা করে অলৌকিক
ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন, একথাও পুরাণে বর্ণনা করা আছে। প্রাক-আর্য এবং অনার্য এই
বীর মানুষদের অনেকেই ব্রহ্মা কিংবা মহাদেবের তপস্যায় অপরিমিত শৌর্যের বর আদায় করে
নিতেন, তারপর তাঁরা যখন দেবতা ও আর্য নরদের অত্যাচার করে অতিষ্ঠ করতেন, তখন ভগবান
বিষ্ণু অবতার হয়ে তাঁদের বিনাশ করতেন, পরিত্রাণ করতেন দেবতা এবং আর্য নরদের। অর্থাৎ ভগবান ব্রহ্মা ও শিব, যে
সব প্রাক-আর্য মানুষদের আগে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, তাঁদেরই পরবর্তীকালে বিনাশ করছেন
ভগবান বিষ্ণু - ব্যাপারটা বেশ আশ্চর্যের
না? আসলে ভগবান ব্রহ্মা এবং শিবকে যদি প্রাক-আর্য মানুষদের দেবতা ধরে নেওয়া যায়,
সেক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্য-ধর্ম সমর্থিত ভগবান বিষ্ণুর দায়িত্ব হয়ে ওঠে তাঁদের প্রভাব
খর্ব করার, তাতে ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের প্রচার, প্রভাব এবং প্রসার বাড়ে বৈকি! অন্যদিকে
নিষাদ রাজপুত্র একলব্য, হস্তিনাপুরের মহিমময় রাজপুত্রদের গুরু ব্রাহ্মণ
দ্রোণাচার্যকে এবং ক্ষত্রিয় মহাবীর অর্জুনকে, মনুষ্যত্বের পরীক্ষায় যে চূড়ান্ত
পরাস্ত করেছিলেন, একথা বর্ণনা করা আছে মহাভারতেই[vii]!
পঞ্চপাণ্ডব এবং তাঁদের স্ত্রী দ্রৌপদী বারো বছর বনবাসের পর, যখন বিরাটরাজ্যে
অজ্ঞাতবাসের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, সে সময়ে তাঁরা অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় ছিলেন।
তাঁদের আশঙ্কা ছিল, অজ্ঞাতবাসের সময় কৌরবপক্ষীয় কেউ যদি তাঁদের চিনে ফেলেন, তাহলে
প্রতিজ্ঞা অনুসারে আবার বারো বছরের বনবাস করতে হবে! এই আশঙ্কা থেকে মুক্তির জন্যে
রাজা যুধিষ্ঠির ত্রিভুবনেশ্বরী মহামায়া দুর্গার স্তব ও আরাধনা করে, তাঁর দর্শন
অভিলাষ করেছিলেন এবং দেবীর কাছে সফল অজ্ঞাতবাসের জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা
করেছিলেন। রাজা যুধিষ্ঠিরের স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী বর দিয়েছিলেন, অজ্ঞাতবাস
নির্বিঘ্নেই ঘটবে এবং তাঁরা অচিরেই হৃত রাজ্য ফিরে পাবেন[viii]। রাজা যুধিষ্ঠিরের স্তবে
দেবীমূর্তির যে বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ওই দুর্গামূর্তি যে তন্ত্রের দেবী, তাতে
কোন সন্দেহই থাকতে পারে না। হতে পারে মহাভারতে এই ঘটনাটি অনেক পরে পৌরাণিক যুগে প্রক্ষিপ্ত
হয়েছে, কিন্তু তাতেও এমন ধারণা করাই যায় যে, ক্ষত্রিয় রাজারা ব্রাহ্মণ্যধর্মের
ছত্রছায়ায় থেকেও, চরম বিপদের মধ্যে অসহায় অবস্থায়, নিরাকার ঈশ্বরের ভরসায় না থেকে,
তন্ত্র-দেবদেবীদের শরণাপন্ন হতে দ্বিধা করতেন না। (একই রকম ভাবে, আজকাল আমরাও, বিপদে বা সংকটে উদ্ধার পেতে
অথবা পরীক্ষা পাসের জন্যে মাকালী, মাদুর্গা, শ্রীশ্রীগোবিন্দ, সরস্বতীমায়ের কাছে
বিনীত ভক্তি নিবেদন রাখার পরেও, কিছু জেমস্টোন, শেকড়, তাবিজ, দধি তিলক, মাদুলিও
ধারণ করি। আসলে মাকালী বা মাসরস্বতী যদি কিছু করে উঠতে না পারেন, তাহলে একটা
স্ট্যাণ্ডবাই নিরাপত্তা রেখে দেওয়া!) রাজা যুধিষ্ঠির হয়তো করেননি, কিন্তু
কোন না কোন ক্ষত্রিয় রাজাকে দেখেই পুরাণকার মহাভারতে এই অধ্যায়টি সংযুক্ত করতে
সাহস করেছিলেন! এ প্রসঙ্গে আরও মনে পড়ে যায় রাবণবধের আগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র
স্বয়ং দেবীদুর্গার অকালবোধন আরাধনা করেছিলেন!
ব্রাহ্মণ্যধর্মের রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক চাপে প্রাক-আর্য ভারতবাসীর
কিছু অংশ, যাঁরা বৈদিক তত্ত্ব এবং যাগ যজ্ঞের ধর্মকে মেনে নিয়েছিলেন অথবা মেনে
নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন পরাজিত রাজা, রাজপরিবারের লোক অথবা
নাগরিক রাজকর্মচারীবৃন্দ। কিন্তু রাজধানীর বাইরে, সারা দেশের গ্রামে-গঞ্জে,
অরণ্য-পাহাড়ে বাস করা সাধারণ জনগণ – কৃষক, কর্মকার, কুম্ভকার প্রমুখ কর্মী, বণিক ও
শিল্পীগোষ্ঠী ব্রাহ্মণ্যধর্মকে মেনে নেননি একথা খুব স্পষ্টভাবেই ধারণা করা যায়।
এমনকি রাজধানীতে বসবাসকারী ধনী শ্রেষ্ঠী বা সম্পন্ন বণিকেরাও যে ব্রাহ্মণ্যধর্ম
মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেকথাও অনায়াসে ধারণা করা যায়। তার কারণ সমাজে চার
বর্ণের মধ্যে তৃতীয় বর্ণের বৈশ্য হয়ে তাঁদের সর্বদাই ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়ের
অধীনে থাকতে হত এবং এভাবেই উচ্চ সমাজে তাঁদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেকটাই খর্ব করে
দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে তাঁদের মনে যে ক্ষোভ ছিল, সে কথার স্পষ্ট সমর্থন মেলে, পরবর্তী
কালে যখন বেদ এবং ব্রাহ্মণ্যধর্ম বিরোধী জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার শুরু হল, সেই
সময় দুই ধর্মেরই প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এই ধনী বণিকেরাই!
সাধারণ জনসমাজে জনপ্রিয় বৌদ্ধধর্ম নিরাকার নির্বাণের হীনযানীয় পথ ছেড়ে,
ক্রমশঃ সাকার বুদ্ধমূর্তি পূজার মহাযানীয় পথে এসে গেল। তারও পরে শুধুমাত্র
বুদ্ধমূর্তিই নয়, আরও অনেক দেব-দেবীর মূর্তিপূজার প্রচলন শুরু হয়ে যেতে বৌদ্ধধর্ম
এবং তন্ত্রধর্ম মিলে, বৌদ্ধধর্মের নতুন এক পথ এল বজ্রযান।
এই প্রসঙ্গে বজ্রযান নিয়ে খুব
সংক্ষেপে দু চার কথা বলে রাখি, কারণ প্রাক-আর্য যুগের অজস্র আঞ্চলিক লোকধর্মের
নির্দিষ্ট তন্ত্রধর্মে দানা বেঁধে ওঠা এবং বৌদ্ধধর্মের মহাযান থেকে হঠাৎ বজ্রযানে
মোড় নেওয়াটা অনেকটাই একে অন্যের পরিপূরক এবং প্রায় সমসাময়িক। পণ্ডিতেরা বলেন
বজ্রযান তত্ত্বের উৎপত্তি পূর্ব ভারতে। সঠিক সময়কাল বলা মুশকিল, তবে মোটামুটি পঞ্চম শতাব্দী এডির
মাঝামাঝি থেকে নির্দিষ্ট তন্ত্র-তত্ত্বের গড়ে ওঠার শুরু এবং বজ্রযানের শুরু
মোটামুটি ষষ্ঠ শতাব্দী এডির শুরুর থেকে। মহাযানীয় মতে ভগবান বুদ্ধের বহু ধরনের মূর্তির সঙ্গে তাঁর
অন্যান্য অনেক সহযোগী মূর্তির, যেমন যক্ষ, যক্ষী, নাগ পূজার প্রচলন হয়েছিল।
বজ্রযানে ভগবান বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্বের মূর্তি পূজার পাশাপাশি, প্রায় সমান গুরত্ব
পেয়ে তাঁর প্রতিরূপ হয়ে উঠলেন এক মহিলা দেবী, নাম তারা। বজ্রযানের এই দেবী তারার
আবির্ভাব যে তন্ত্রধর্মের অন্যতমা প্রধানা দেবী মাকালীর (যাঁকে আমরা মা তারাও বলি)
প্রভাবে সে কথা অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই।
আরও একটা বিষয় মনে রাখা দরকার,
উল্লিখিত সময়কালে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ভারতীয় রাজন্য সমাজে যথেষ্ট ক্ষীণ হয়ে
এসেছিল এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বা পৌরাণিক হিন্দুধর্ম সগৌরবে ফিরে আসছিল তাদের হারানো
আসনে। উপরন্তু বৌদ্ধধর্মের হীনযানীয় ও মহাযানীয় শাখা, বজ্রযানীয় পথকে মোটেই ভালো
চোখে দেখেননি এবং সেই সময়ে আদৌ সমর্থন করেননি। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বা
পৌরাণিক ধর্মের ধ্বজাধারীরা সবল প্রতিদ্বন্দ্বী বৌদ্ধ ধর্মের যে কোন শাখাকেই যে
নিচু চোখে দেখবে এবং অবজ্ঞা করবে সে তো বলাই বাহুল্য। অতএব বজ্রযানী ধর্মের চর্চা
এবং আচরণ তন্ত্রধর্মের মতোই কিছুটা গোপনে পথ চলা শুরু করেছিল, কারণ ভয় ছিল, সবল
প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরাসরি কোপদৃষ্টি পড়লে, সমূলে উচ্ছেদ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
অতএব, রাজা ও রাজধানীকেন্দ্রিক ব্রাহ্মণ্য ও বৈদিক ধর্মের পাশাপাশি,
সাধারণ জনসমাজে প্রাক-আর্য তন্ত্র-ধর্মের প্রচলন সমান্তরালভাবেই চলছিল, যদিও
রাষ্ট্রশক্তির ভয়ে কিছুটা গোপনে। গোপনীয়তার এই বাতিক (obsession) অনেক পরবর্তী কালে, যখন
তন্ত্রশাস্ত্র রচনা করা হচ্ছিল তখনও ছিল, আগমশাস্ত্র ও মহানির্বাণ তন্ত্রে বার বার
বলা হয়েছে, এই শাস্ত্র এবং তন্ত্র সাধনা অত্যন্ত গোপন এক তত্ত্ব! প্রশাসনিক স্তরে এই
তন্ত্র–ধর্মের আঁচ রাজধানীতেও পাওয়া যেত, তাই বৈদিক ধর্মের ব্রাহ্মণেরা
তন্ত্র-ধর্ম আচরণ নিয়ে বিরুদ্ধ প্রচার করে গিয়েছেন নিরন্তর - তন্ত্র চর্চা মানেই
অনাচার, ব্যাভিচার, মদ্যপান, “মাস-মচ্ছি”, কদন্ন ভক্ষণ ইত্যাদি। কিন্তু বিবিধ
অপপ্রচার এবং রাষ্ট্রীয় অসহযোগিতা সত্ত্বেও তন্ত্র-ধর্মের প্রচ্ছন্ন প্রবাহ যথেষ্ট
শক্তিশালী ছিল।
৩
শাস্ত্র হিসেবে তন্ত্র
তন্ত্র শব্দের অর্থ নিয়ে পণ্ডিতদের অনেক মত পড়া যায়। সংস্কৃতে যে শব্দ
থেকে তন্তু বা তাঁত শব্দ এসেছে সেখান থেকেই তন্ত্র শব্দের উৎপত্তি[ix]। সেই অর্থ ধরলে তন্ত্র
মানে অনেক তত্ত্বের টানাপোড়েনে বুনে ওঠা বিস্তৃত একটি ধারণা। অনেক পণ্ডিত বলেন,
তত্ত্ব আর মন্ত্র মিলে তন্ত্র। তত্ত্ব মানে জ্ঞানের কথা, সাংখ্য দর্শনে বলা হয়েছে,
এই বিশ্বপ্রকৃতির সৃষ্টিতে আছেন এক পুরুষ ও চব্বিশটি তত্ত্ব নিয়ে মোট পঁচিশটি
তত্ত্ব। চব্বিশটি তত্ত্ব হল প্রকৃতি, মহৎ-তত্ত্ব, অহঙ্কার-তত্ত্ব, মন এবং পঞ্চ
মহাভূত, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ তন্মাত্র। পাঁচটি মহাভূত হল
মাটি, জল, অগ্নি, বায়ু এবং আকাশ। পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় হল হাত, পা, বাক, পায়ু,
উপস্থ। চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক – এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে
পাঁচটি তন্মাত্র অনুভব করা যায়, সেগুলি হল, রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস এবং স্পর্শ।
মহৎ-তত্ত্ব জীবের বুদ্ধিস্বরূপ, এই বুদ্ধি দিয়ে জীব সকল বিষয়ের কর্তব্য-অকর্তব্য,
ভাল-মন্দ বিচার করে। অহংকার-তত্ত্ব জীবের মনে কর্তৃত্ব অনুভব করায়, যেমন আমিই
করছি, আমার বাড়ি, আমার পুত্র, আমি ধনী, আমিই পণ্ডিত ইত্যাদি অভিমান। এই চব্বিশটি
তত্ত্বের জ্ঞান সম্যক আয়ত্ত্ব করতে পারলে, পঁচিশতম তত্ত্বটি আপনিই উপলব্ধি করা
যায়, সেই জ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান, পরমজ্ঞান[x]।
এই চব্বিশটি তত্ত্বের জ্ঞান অর্জনের জন্যে নিবিড় আধ্যাত্মিক সাধনার
প্রয়োজন, আর সেই সাধনার অন্যতম সহায় হল আধ্যাত্মিক কিছু শব্দের বারবার ব্যবহার –
এই শব্দগুলিকেই বীজমন্ত্র বলে, যেমন, ওঁ, হ্রীং, ক্লীং, বষট্ ইত্যাদি। অতএব
মন্ত্র দিয়ে যে তত্ত্বজ্ঞানের সাধনা, তাকেই তন্ত্র বলে। তন্ত্রদর্শন ছাড়া অন্য
দর্শনে মন্ত্রের ব্যবহার নেই বললেই চলে, কিন্তু মন্ত্র ছাড়া তন্ত্র অচল।
আগেই বলেছি, তন্ত্রের শুরুতে তাত্ত্বিক কোন নির্দিষ্ট শাস্ত্র ছিল না,
সবটাই ছিল প্রচলিত লোকাচার এবং পরম্পরাগত পূজাপদ্ধতি, যার ফলে কিছুটা বিশৃঙ্খল
অবস্থায় ছিল। পরবর্তী কালে যখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রবল জোয়ারে বৈদিক-ব্রাহ্মণ্যধর্ম
কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ল, সেই সময় তন্ত্র তার তাত্ত্বিকদিকটা কিছুটা গুছিয়ে নেওয়ার
সময় পেল। সে সময় তন্ত্র-তাত্ত্বিকদের সামনে বেদ-উপনিষদ এবং বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের
নিবিড় তত্ত্বসম্ভার থাকায়, তন্ত্র–তত্ত্ব বানিয়ে তুলতে সুবিধেও হল। তাছাড়া এই সময়
বেদ-বিরোধী বৌদ্ধধর্ম এবং বেদ-ধিক্কৃত তন্ত্রধর্ম কাছাকাছি চলে আসায় – কারণ শত্রুর
শত্রু সর্বদাই স্বাভাবিক মিত্র হয় – তন্ত্র-তত্ত্ব সুচিন্তিত পরিকাঠামো গড়ে তোলার
নিবিড় অবকাশ পেল।
তন্ত্র-তত্ত্বের মূল কিন্তু বেদ, উপনিষদ এবং সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শন।
বেদের কর্মকাণ্ডে যত যাগ-যজ্ঞের বিধিনিয়ম আছে, তন্ত্র-তাত্ত্বিকেরা নিজেদের মত করে
সে সবই আত্মসাৎ করেছিলেন। উপনিষদের মূল বক্তব্য হল ত্যাগ এবং বিবেক বিচারে “নেতি”
“নেতি” করতে করতে পরমার্থ লাভ। অর্থাৎ পার্থিব সব বিষয়কে ত্যাগ করতে করতে পরমার্থ
সাধনায় প্রবৃত্ত হওয়া। তন্ত্র এই বিষয়টিকেও তাঁদের তত্ত্বে যুক্ত করে নেওয়ায়,
বৈরাগ্যও তন্ত্রের একটি তত্ত্ব হয়ে গেল। রাজযোগের যে দর্শন শরীর ও মনকে পবিত্র
করা, তন্ত্র সেটাও গ্রহণ করেছে। পুরাণের প্রধান
দুটি বৈশিষ্ট্য হল বৈধী ভক্তি এবং পরাভক্তি। বৈধী ভক্তি আনুষ্ঠানিক, যেমন
গঙ্গা স্নান, তুলসী পাতা খাওয়া, চন্দনের তিলক আঁকা, ষোড়শোপচারে পূজা করা, ইত্যাদি।
আর পরাভক্তি হল, ঈশ্বরে পরম আস্থা, অহৈতুকী নিঃশর্ত ভক্তি। তন্ত্র এই দুই ভক্তির
মধ্যে পরাভক্তিকে গ্রহণ করেছে, তন্ত্রের ভক্তি ঈশ্বরকে নিবিড় ভালোবাসা। অবশ্য মোটামুটি
সমসাময়িক কালেই ব্রাহ্মণ্যধর্মের পণ্ডিতেরা পুরাণ রচনা করছিলেন। পুরাণে তান্ত্রিক
দেবদেবীদের মাহাত্ম্য বর্ণনা এবং ব্রহ্মস্বরূপে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের
অন্তর্ভুক্তির সময় তন্ত্রের ভক্তি বিষয়টিকেও তাঁরা পুরাণের বিষয় করে তুলতে পারেন।
সেক্ষেত্রে পুরাণতত্ত্ব ও তন্ত্র-তত্ত্বের পারষ্পরিক আদান-প্রদানের সম্ভাবনা
অস্বীকার করা যায় না। সে যাই হোক, খুব সংক্ষেপে বললে, তন্ত্রতত্ত্ব অনুযায়ী, তন্ত্রসাধককে পার্থিব বিষয়সমূহ ত্যাগ করে সাধনা
করতে হবে, ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে এবং আকুল ভক্তিতে ঈশ্বরের কৃপা
প্রার্থনা করতে হবে।
তন্ত্রমতে জীবনের উদ্দেশ্য ভোগ আর অপবর্গ। ভোগ মানে এই জগতের ভোগ আর
অপবর্গ মানে মুক্তি বা মোক্ষ। এই ব্যাপারেও তন্ত্রের সঙ্গে বেদ বা মহাভারতের কোন
পার্থক্য নেই। বেদ বা মহাভারত বলেছেন, জীবনের উদ্দেশ্য চারটে – ধর্ম, অর্থ, কাম আর
মোক্ষ। তন্ত্র বলছে, মোক্ষ ছাড়া সবকিছুই ভোগ।
তন্ত্রমতে যাঁরা সাধনা করেন, তাঁরা ভোগ এবং অপবর্গ দুটোই পেতে পারেন,
শুধু সংকল্প স্থির করতে হবে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধে হবে।
শ্রীশ্রী চণ্ডীতে রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি একই দৈবীসূক্তম্ মন্ত্র জপ করতে
লাগলেন। দীর্ঘ সাধনার পর দেবী শ্রীচণ্ডী দুজনকেই বর দিতে আবির্ভূতা হলেন। রাজা
সুরথ বললেন, আমি সমগ্র ভূমণ্ডলের রাজা হতে চাই, দেবীর বরে তিনি তাই হলেন, অর্থাৎ রাজা
সুরথের ভোগ লাভ হল। অন্যদিকে বৈশ্য সমাধি বললেন, আমি অন্য কিছু চাই না, শুধু
মুক্তি চাই, দেবী তাঁকে মুক্তিই দিলেন, অর্থাৎ তাঁর অপবর্গ লাভ হল। অতএব তন্ত্রমতে
মন্ত্র এবং সাধনা একই থাকবে, শুধু সংকল্প স্থির করতে হবে। পুরাণের থেকে তন্ত্রের আরেকটি
পার্থক্য হল, পুরাণে অনেক ক্ষেত্রেই বলা আছে, ঈশ্বরের করুণা বা কৃপা হলেও মুক্তি
হয়ে যায়। যেমন অজামিলের কাহিনী আছে, অজামিল জীবনে কোনদিনই সাধনা-টাধনার ধার
ঘেঁষেননি, তিনি শুধু নিজের পুত্রের নাম রেখেছিলেন “হরি”। মৃত্যুকালে তিনি ব্যাকুল
কণ্ঠে হরিকে ডেকেছিলেন, “হরি, ও হরি, আমার পাশটিতে একবার আয়” - তাতেই অজামিলের
মুক্তি হয়ে গিয়েছিল, কারণ তিনি মৃত্যুকালে “হরি” নাম করেছিলেন! তন্ত্র এই ফাঁকি
স্বীকার করে না।
তন্ত্র সাধন তত্ত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রাণবায়ু বা প্রাণ এবং
নাড়ী। উপনিষদ বলছেন, প্রাণ পাঁচটি – অপান, প্রাণ, সমান, ব্যান,
উদান। পায়ু ও উপস্থে যে
প্রাণবায়ু অবস্থান করে, তার নাম অপান। চোখ, কান, নাক ও মুখে প্রাণ অবস্থান করে এবং
দুইয়ের মাঝখানে অর্থাৎ নাভি মণ্ডলে অবস্থান করে সমান। আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি,
তাকে পরিপাক করে, শরীরে শক্তি ও পুষ্টি বিধান করে সমান বায়ু। আমাদের আত্মা অবস্থান করেন আমাদের হৃদয়ে। সেই
হৃদয়ে একশ একটি নাড়ী আছে, সেই নাড়ীর প্রত্যেকটিতে আবার একশটি করে শাখানাড়ী আছে।
প্রত্যেক শাখানাড়ীতে আছে বাহাত্তর হাজার করে প্রতিশাখানাড়ী। তার মানে আমাদের সারা
শরীরে মূলনাড়ী ১০১টি; শাখানাড়ী = ১০১ x
১০০ = ১০,১০০; প্রতিশাখানাড়ী
= ১০,১০০ x ৭২০০০ = ৭২,৭২,০০,০০০। অতএব মোট নাড়ী
সংখ্যা = ৭২,৭২,১০,২০১! এই সমস্ত নাড়ীর মধ্যে অবস্থান করে ব্যানবায়ু অর্থাৎ আমাদের
সারা শরীরেই ব্যানবায়ু ব্যাপ্ত রয়েছে। এর মধ্যে মূলনাড়ীর ঊর্ধমুখী একটি নাড়ীতে
উদান বায়ু অবস্থান করে, এই উদানবায়ুই আমাদের পুণ্যকর্ম থেকে পুণ্যলোক, পাপকর্ম থেকে
পাপলোক এবং উভয়কর্ম থেকে মনুষ্যলোক প্রাপ্ত করায়[xi]। ঊর্ধমুখী ওই নাড়ীকেই তন্ত্রে সুষুম্না বলে।
তন্ত্র সাধন পদ্ধতিতে প্রাণায়াম অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। শরীরের ভিতরে প্রাণবায়ু গ্রহণ অর্থাৎ পুরক, শরীরে তাকে রুদ্ধ করা
অর্থাৎ কুম্ভক এবং শরীর থেকে সেই বায়ু ত্যাগ করা অর্থাৎ রেচকের নিয়মকেই প্রাণায়াম
বলে। তন্ত্রে তিনটি নাড়ী খুব গুরুত্বপূর্ণ – ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না। মেরুদণ্ডের
কেন্দ্রে যে সূক্ষ্মনাড়ী তার নাম সুষুম্না, তার বাঁয়ে থাকে ইড়া আর ডানদিকে
পিঙ্গলা। সুষুম্নার শুরু মূলাধার থেকে – মেরুদণ্ডের শেষ প্রান্তে গুহ্যের কাছাকাছি
জায়গায়। আবার এই মূলাধারেই থাকে কুণ্ডলিনীশক্তি। তাত্ত্বিকদের ধারণায় মানুষের
সাধারণ অবস্থায় এই কুণ্ডলিনীশক্তি সাপের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকে, সেই সময়
মানুষের মন সুখ-দুঃখ-শোক-আনন্দ-কামনা-বাসনায় জর্জরিত থাকে। সাধনা শুরুর সঙ্গে এই
কুণ্ডলিনী জেগে ওঠে এবং সুষুম্না পথে ওপরের দিকে যাত্রা শুরু করে।
সুষুম্নানাড়ীতে ছটি পদ্ম আছে, একদম নিচে
মূলাধার, তারপর ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও
আজ্ঞা। তন্ত্রমতে এই ছটি পদ্মকে বলে চক্র – ষট্চক্র ভেদই তন্ত্র সাধনার মূল
উদ্দেশ্য, বেদে এই ছটি পদ্মকে বলা হয় ভূমি। মূলাধার চক্রের কথা আগেই বলেছি,
স্বাধিষ্ঠান চক্রের অবস্থান উপস্থের, মণিপুর নাভিমণ্ডলের, অনাহত হৃদয়ের, বিশুদ্ধ
কণ্ঠের এবং আজ্ঞা চক্র ভ্রূর সমান্তরালে অবস্থান করে।
সাধনার বিভিন্ন পর্যায়ে সুষুম্নানাড়ী পথে কুণ্ডলিনী শক্তি এক একটি চক্র ভেদ
করে উপরের দিকে উঠতে থাকে। কুণ্ডলিনী যখন হৃদয়ের অনাহত চক্র স্পর্শ করে তখন সাধকের
মন থেকে সমস্ত কামনা বাসনার অবসান হয়, সাধক অদ্ভূত এক জ্যোতি দেখতে পান। এরপর
কুণ্ডলিনী বিশুদ্ধ চক্র স্পর্শ করলে সাধকের মন ঈশ্বর চিন্তায় ব্যাকুল হয়, তখন ঈশ্বরের
বিষয় ছাড়া অন্য কথা বলতে পারেন না, অন্য কথা শুনলেও অসহ্য বোধ হয়। এরপর কুণ্ডলিনী
ষষ্ঠ চক্র আজ্ঞাভূমি স্পর্শ করলে, সাধক ঈশ্বরকে দেখতে পান, কিন্তু একটু আড়াল থাকে –
যেমন লণ্ঠনের আলো, দেখা যায়, কিন্তু কাচের জন্যে স্পর্শ করা যায় না। ষষ্ঠ চক্র
অতিক্রম করে কুণ্ডলিনীশক্তি যদি সপ্তমভূমিতে সহস্রার অর্থাৎ সহস্রদল পদ্মে মিলিত
হয়, তখন সাধকের সমাধি হয়। সমাধিস্থ হলে সাধকের বাহ্যজ্ঞান লোপ পায়, সাধক দেহ রক্ষা
করতে পারেন না, একুশদিনের মধ্যে তাঁর দেহের অবসান হয়। সপ্তমভূমির এই সহস্রদল
পদ্মের অবস্থান, মাথার ব্রহ্মতালুতে। এই সহস্রার পদ্মেই সচ্চিদানন্দ শিব অবস্থান
করেন, সাধকের শক্তি শিবের সঙ্গে মিলিত হন।
শিব-শক্তির এই মিলনই তন্ত্রের পরমার্থ লাভ, উপনিষদের ব্রহ্ম লাভ।
যাঁরা ঈশ্বরকোটি সাধক অর্থাৎ অবতার, তাঁরা লোকশিক্ষার
জন্যে সমাধি অবস্থা থেকেও আবার নেমে আসতে পারেন।
তাঁদের অবস্থান থাকে ষষ্ঠ ও সপ্তমভূমির মাঝখানে। তাঁদের মধ্যে ভক্তভাবের
অথবা দাসভাবের সামান্য অহংটুকু – ভক্ত আমি, দাস আমি - থাকে। যেমন হনুমান ছিলেন,
দাসভাবে; নারদ, সনক, সনন্দ, সনাতন, সনৎকুমার প্রমুখ ছিলেন ভক্তভাবে[xii],
যেমন শ্রীশ্রীচৈতন্য ছিলেন প্রেমভাবে এবং শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন সন্তানভাবে।
তন্ত্র সাধনার নিম্ন স্তরে - মূলাধার থেকে
অনাহত চক্র স্পর্শ করার আগেই সাধকের আটটি দৈব ক্ষমতার সিদ্ধিলাভ ঘটতে থাকে। এই
সিদ্ধিকে বিভূতিও বলে - আটটি সিদ্ধি এরকম,-
প্রথম অণিমাসিদ্ধি – সাধক অণুর মত অতি সূক্ষ্মরূপ ধারণ করে যথেচ্ছ
বিচরণ করতে পারেন।
দ্বিতীয় লঘিমা - এর প্রভাবে সাধক শুকনো তৃণের থেকেও হাল্কা হয়ে যেতে পারেন।
তৃতীয় গরিমা – গরিমা সিদ্ধ সাধক যে কোন ভারের থেকেও ভারবহুল হয়ে উঠতে
পারেন। যেমন রাজা শিবি ও তাঁর
আশ্রয়প্রার্থী পায়রার কাহিনীতে আছে - মহারাজ শিবি নিজের শরীর দান করেও, তুলাদণ্ডে
সামান্য পায়রার সমান হতে পারেননি! কারণ সে পায়রা কোন সাধারণ পায়রা ছিল না, তিনি ছিলেন
ছদ্মবেশী ধর্ম, তিনি সিদ্ধযোগী!
চতুর্থ মহিমা - এর প্রভাবে সাধক পর্বতের মতো বিশাল আকার এবং ভারসম্পন্ন
হয়ে উঠতে পারেন।
পঞ্চম প্রাপ্তি - এর প্রভাবে সাধক বহুদূর থেকেও ইচ্ছামতো বস্তুকে
স্পর্শ ও গ্রহণ করতে সক্ষম হন।
ষষ্ঠ প্রাকাম্য – সাধক এই সিদ্ধি লাভের পর জগতের যে কোন বস্তু ইচ্ছা
মতো অর্জন করিতে পারেন।
সপ্তম বশিত্ব - এর প্রভাবে নিখিল চরাচর যোগীর বশীভূত হয়। তাঁর কথায় সকল
জীব ও জড় পুতুলের মত আচরণ করে।
অষ্টম ঈশিত্ব – এর প্রভাবে সাধক সৃষ্টি বিষয়েও প্রভুত্ব করতে পারেন।
তন্ত্রসাধনায় এই আটটি সিদ্ধিলাভকে খুবই তুচ্ছ এবং অবহেলার চোখে দেখা
হয়েছে। কারণ এই বিভূতিগুলি সাধককে লক্ষ্যভ্রষ্ট করায়। এই বিভূতি দিয়ে আর যাই হোক
পরমার্থ লাভ হতে পারে না। এই বিভূতি দিয়ে সাধারণ মানুষকে অবাক করে, যাঁরা অর্থ, যশ
বা প্রতিপত্তি উপার্জন করেন, তন্ত্রশাস্ত্র তাঁদের খুবই নীচু স্তরের সাধক বলেছেন। এই
ধরনের সাধকদের বারবার সতর্ক করে বলা হয়েছে, এই বিভূতি লাভেই থেমে না থেকে আরও
উচ্চপর্যায়ের সাধনায় প্রবৃত্ত হতে, বলা হয়েছে এই অষ্ট সিদ্ধির বারবার প্রয়োগে
সাধকরা তাঁদের অর্জিত শক্তি ক্ষয় করতে থাকেন।
আজকাল বড়ো, মাঝারি, ছোট শহরে
সিদ্ধ তান্ত্রিকের দর্শন মেলে ভূরিভূরি। তাঁদের প্রায় সকলেই নিজস্ব চেম্বার খুলে,
সাধারণ মানুষকে তাদের দুর্ভাগ্যের গহীন খাদ থেকে তুলে আনার প্রচেষ্টায় সতত নিরত।
আজকের সমাজে প্রতিযোগিতার ইঁদুর-দৌড়ের যুগে, তাঁরা কতখানি ধৈর্য নিয়ে সাধনা করেছেন
এবং সেই সাধনায় অণিমাদি সিদ্ধির কতগুলিতে বাস্তবিক সিদ্ধ হয়েছেন, সে বিষয়ে
সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কিন্তু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সাধারণ মানুষ, যাঁরা বিশ্বাস করতে
সর্বদাই উন্মুখ, তাঁদের সেই বিশ্বাসকে মূলধন করে, ওই তথাকথিত স্বঘোষিত তান্ত্রিকরা
তাঁদের সম্পদ-ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে চলেছেন। আর এমনটা হবে নাই বা কেন, যেখানে যথেষ্ট
শিক্ষিত অজস্র যোগ্য যুবক-যুবতীর কর্ম সংস্থান করা যায় না, সেখানে জীবিকার এমন সহজ
সম্মানীয় উপায় - থাক না তার আড়ালে কিছুটা শঠতা – মন্দ কী? সমাজের অন্য পেশায় শঠতা
ও প্রবঞ্চনা কী কিছু কম আছে?
তন্ত্রের সংক্ষিপ্ত তত্ত্ব ও কিছু মুখ্য বিধিবিধান
তন্ত্রে বেদকে বলা হয় নিগম এবং তন্ত্রশাস্ত্রকে বলা হয় আগম – অনেকটা
পিতা-পুত্রের মত। পুত্র পিতাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে, আবার যুগোপযোগী হতে গিয়ে
পিতার সঙ্গে তার মতের অমিলও হয়। অন্যদিকে পিতা পুত্রের মতকে গ্রাহ্যই করেন না – তাচ্ছিল্যে
বলেন, ওটা জানেটা কী? তন্ত্রশাস্ত্র নিগম অর্থাৎ বেদকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয় কিন্তু
বেদজ্ঞ পণ্ডিতেরা তন্ত্রকে শাস্ত্র বলেই মানতে চান না। অন্যদিকে আগম বলছে, বেদ
আমাদের শিরোধার্য, কিন্তু বেদ সত্যযুগের জন্যে উপযুক্ত ছিল, কলিযুগের উপযুক্ত
আগমশাস্ত্র।
“মহানির্বাণতন্ত্রম্”[xiii] তন্ত্রশাস্ত্রের অন্যতম
আকর গ্রন্থ। এই গ্রন্থের শুরুই হচ্ছে দেবী পার্বতী ও দেবাদিদেব সদাশিবের কথোপকথনের
সূত্রে। প্রথম উল্লাসের শুরুতে দেবী পার্বতী বলছেন, “কিছু বিষয়ে তাঁর মনে সংশয়
দেখা দিয়েছে, হে মহেশ্বর, এই ত্রিভুবনে তুমি ছাড়া আর কে আছে, যে আমার মনের সংশয়
দূর করতে পারবে?” সদাশিব বললেন, “হে মহাপ্রাজ্ঞে, হে প্রাণবল্লভে, তুমি যা জানতে চাইছ,
বল। অত্যন্ত গোপন কথা হলেও আমি তোমাকে বলব।
তুমি সর্বজ্ঞা, ত্রিভুবনে এমন কিছুই নেই তুমি জান না, তাও তুমি কী জানতে
চাইছ, বল”। দেবী পার্বতী শঙ্করকে
বললেন, “হে সর্বভূতেশ, তুমি সকলের অন্তর্যামী, চারবেদ তোমার দ্বারাই প্রকাশিত
হয়েছিল। সেই বেদ থেকেই বর্ণাশ্রমাদি[xiv] প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সত্যযুগে মানুষ সত্যবাদী, ধার্মিক ছিল, তারা অতিলোভী বা কামুক ছিল না, সকলেই
সর্বদা আনন্দে থাকত। সত্যযুগের পরে, মানুষ বেদ অনুসরণ করে, সব কর্ম করতে পারত না,
বৈদিক কর্ম তাদের কাছে কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তবুও তারা বেদ ত্যাগ করেনি। তখন
তুমি পৃথিবীতে বেদার্থযুক্ত স্মৃতিশাস্ত্র প্রকাশ করেছিলে, সেই শাস্ত্র অনুসরণ
করে, মানুষ দুঃখ-শোক-রোগ-তাপ থেকে উদ্ধার পেয়েছিল। তারপর দ্বাপরে মানুষ স্মৃতির
সুকর্মও ত্যাগ করে, মনোকষ্ট এবং ব্যাধিতে আকুল হয়ে উঠেছিল। তখন তুমি ব্যাসাদি ঋষি
হয়ে সংহিতাশাস্ত্র উপদেশ দিয়ে মানুষকে উদ্ধার করেছ। তারপর পাপরূপী, সর্বধর্মবিলোপকারী
কলিযুগ এসে গেল। এখন দেবতারা শক্তিহীন, স্মৃতি এখন স্মৃতিহীন, নানা পথ
প্রদর্শনকারী পুরাণাদির বিনাশ হতে চলেছে। মানুষ মন্দমতি, শঠ, নীচ, পরের সম্পদ চুরি
করে। ব্রাহ্মণেরা সন্ধ্যা-বন্দনাদি
ছেড়ে শূদ্রের মত আচরণ করে। মানুষের মনে কখনো সৎচিন্তা, সৎকথা শোনা যাবে না। এই
নরাধমদের উদ্ধারের জন্যেই তুমি সকল তন্ত্র রচনা করেছ এবং ভোগ ও মুক্তিপ্রদ নিগম –
আগমশাস্ত্র সৃষ্টি করেছ। এই তন্ত্রাদি শাস্ত্র দেব-দেবীদের মন্ত্র–যন্ত্রাদি সাধন,
সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারস্বরূপ বহু ন্যাস ও বদ্ধপদ্মাসন আদি বহু আসনের কথা বলেছ। দেবতা
সকলের মন্ত্রসিদ্ধিপ্রদ পশুভাব, বীরভাব, দিব্যভাবের কথা উল্লেখ করেছ। এই শাস্ত্রে
শবাসন, চিতারোহণ, মুণ্ডসাধন, লতাসাধনাদি অসংখ্য কর্মের কথাও তুমি উল্লেখ করেছ। কিন্তু
তন্ত্রশাস্ত্রে পশুভাব, দিব্যভাব স্বয়ং তুমিই নিবারণ করেছ। কলিতে পশুভাবও নেই,
দিব্যভাব কী প্রকারে হতে পারে? কারণ পশুভাবাপন্নদের কর্তব্য – তারা পত্র, ফল, জল
নিজেই আহরণ করবে, শূদ্র দর্শন করবে না এবং মনে মনেও স্ত্রীকে মনে করবে না।
দিব্যভাবাপন্ন লোক দেবতুল্য, শুদ্ধমনা, বাসনারহিত, সর্বভূতে সমভাব ও ক্ষমাশীল হন।
কিন্তু এখনকার লোক কলির পাপযুক্ত, সর্বদাই অস্থিরমতি, নিদ্রা ও আলস্যে আসক্ত, এদের
ভাবশুদ্ধি কী ভাবে হতে পারে? হে শঙ্কর, তুমি পঞ্চতত্ত্ব সহ বীরসাধনের কথা বলেছ,
তাতে মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুন – এই পঞ্চতত্ত্ব তুমিই বলেছ! কলিকালের
মানুষ লোভী, শিশ্ন-উদর পরায়ণ, তারা লোভে পড়ে এই পঞ্চতত্ত্বে অধঃপাতে যাবে, সাধন
করবে না। তারা ইন্দ্রিয়সুখের জন্যে অত্যধিক মদ্যপান করে উন্মত্ত ও
হিতাহিত-জ্ঞানশূণ্য হবে। মহাপাপী ওই ব্যক্তিরা পরস্ত্রীহরণ করবে, মদ্যপানে অসুস্থ
হয়ে মৃত্যুবরণ করবে। তখন কে যোগসাধন করবে? কে ন্যাস ও আসনসমূহ অভ্যাসে প্রবৃত্ত
হবে? কে স্তব করবে? কে পূজা করবে, কে যন্ত্রধারণ করবে? কলিযুগের প্রভাবে মানুষ
স্বভাবত অতি দুর্জন ও সর্বপাপকারী হবে। হে দীনেশ, কৃপা করে, কলিযুগের এই মানবদের
উদ্ধারের উপায় বল”।
প্রথম উল্লাসে, দেবী পার্বতীর মানবের প্রতি এই মাতৃসুলভ ব্যাকুলতার
উত্তরে সদাশিব দ্বিতীয় উল্লাসে বলেছেন, “হে মহাভাগে, তুমিই জগতের কল্যাণকারিণী,
তুমি খুবই ভাল প্রশ্ন করেছ, এমন প্রশ্ন আগে কেউ করেনি। হে প্রিয়ে, তুমি সর্বজ্ঞা,
অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বিষয়ে তুমি যা যা বললে, সবই যথার্থ। হে প্রিয়ে, আমি সত্য সত্য পুনঃ
সত্য বলছি, কলিকালে আগমোক্ত পথ ছাড়া অন্য পথ নেই। কলিকালে বেদের মন্ত্রসকল বিষহীন সাপের মতো
নির্বীর্য হয়ে পড়েছে, যে মন্ত্র সত্যাদিযুগে ফলদায়ী ছিল, কলিতে তারা সকলেই মৃতের
মত নিষ্ফলা হয়ে গেছে। হে প্রিয়ে, নানান
নামের বহুপ্রকার তন্ত্র আমি বর্ণনা করেছি, সিদ্ধ ও সাধকদের বহু অনুষ্ঠানের কথাও
বলেছি। অধিকারীভেদে নানান দেব ও দেবীর বিষয়েও বলেছি। সে সব কথা অত্যন্ত গোপন। ভৈরব, বেতাল, বটুক, নায়িকা এবং শাক্ত, শৈব,
বৈষ্ণব, সৌর, গাণপত্যদের কথাও বলেছি। নানান মন্ত্র, যন্ত্র এবং সিদ্ধি লাভের নানান
উপায়ের কথাও আমি বলেছি। যে যেমন প্রশ্ন করেছে, আমি তার মঙ্গলের জন্যে তেমনই উত্তর
দিয়েছি। হে দেবেশি, বেদ, আগম, বিশেষতঃ বহু তন্ত্রের সার আমি তোমাকে সংক্ষেপে বলছি।
যেমন, মানুষের মধ্যে তত্ত্বজ্ঞানী শ্রেষ্ঠ, নদীদের মধ্যে গঙ্গা শ্রেষ্ঠ, দেবতাদের
মধ্যে আমি শ্রেষ্ঠ, তেমনি সমস্ত আগম শাস্ত্রের মধ্যে এই মহানির্বাণ তন্ত্রই
শ্রেষ্ঠ। এই মহাতন্ত্র বিশেষ ভাবে জানলে, জীব সর্বসিদ্ধি লাভ করে।
হে পরমেশ্বরি, বিশ্বের হিত
করলে বিশ্বের ঈশ্বর প্রীত হন, কারণ তিনিই বিশ্বের আত্মা, বিশ্ব তাঁকেই আশ্রয় করে
রয়েছে। তিনি এক, অদ্বিতীয়,
সত্য, পরাৎপর, স্বপ্রকাশ, সচ্চিদানন্দস্বরূপ। তিনি নির্বিকার, নির্বিশেষ, গুণাতীত,
সর্বাত্মা, সর্বব্যাপী, সর্বদর্শী, বিভু ও সনাতন। হে মহেশ্বরি, সেই পরমেশ্বরই
সর্বপ্রাণীর একমাত্র কারণ; তাঁর নিযুক্তিতেই ব্রহ্মা জীব সৃষ্টি করে স্রষ্টা পদবী
পেয়েছেন। তাঁর ইচ্ছাতেই বিষ্ণু এই জগৎকে পালন করে, পালয়িতা হয়েছেন। তাঁর ইচ্ছাতেই
সংহারকারী হয়ে, আমি জগতে সংহর্তা আখ্যা পেয়েছি। তুমিই তাঁর পরমা প্রকৃতি, সেহেতু
তুমি ত্রিভুবনে পূজ্যা”।
চতুর্থ উল্লাসে ভগবান সদাশিব বলেছেন, “হে মহাভাগে, হে দেবি, অত্যন্ত
গোপনীয় একটি কথা তোমায় বলছি, তোমার থেকেই এই নিখিল জগৎ উৎপন্ন হয়েছে। হে শিবে,
তুমিই এই নিখিল জগতের জননী। তুমি সকলের আদ্যা অর্থাৎ আদিভূতা। সকল বিদ্যা এবং আমরা
সকলেও তোমার থেকেই উৎপন্ন হয়েছি। তুমি জগতের সকল বিষয় জান, কিন্তু তোমাকে কেউ
জানতে পারে না। তুমি কালী, তুমি তারিণী, তুমি দুর্গা, তুমিই ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী,
ধূমাবতী, তুমিই বগলা, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, তুমিই অন্নপূর্ণা, বাগ্দেবী, তুমিই
কমলালয়া লক্ষ্মী, তুমি সর্বশক্তিস্বরূপা এবং তুমিই সর্বদেবময়ী। তুমি সাকারা হয়েও
নিরাকারা। তুমি মায়া দিয়ে বহুরূপ ধারণ কর, তুমিই সকলের আদি, অনাদি, কর্ত্রী, হর্ত্রী
(হননকারিণী) এবং পালিকা। হে দেবি, এই কারণেই তোমাকে বলছি, ব্রহ্মমন্ত্রে দীক্ষিত
সাধক যে ফল লাভ করে, তোমার সাধনা করেও সে একই ফল লাভ করতে পারে”।
তৃতীয় উল্লাসে দেবীর প্রশ্নের উত্তরে মহাদেব শঙ্কর বলেছেন, “হে দেবি,
কুলাচার বিনা শক্তিমন্ত্র সিদ্ধিপ্রদ হয় না, অতএব কুলাচারে নিরত হয়েই শক্তিসাধন
করতে হবে। হে আদ্যে, শক্তিপূজা বিধানে মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুন এই
পঞ্চতত্ত্বের কথা বলা হয়েছে। পঞ্চতত্ত্ব ছাড়া সাধকের ইষ্টসিদ্ধি হয় না, পদে পদে
বিঘ্ন ঘটে।
এই প্রসঙ্গে আবার ষষ্ঠ উল্লাসে, দেবী পার্বতীর প্রশ্নের উত্তরে মহাদেব
শঙ্কর পঞ্চতত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন, “উত্তম মদ্য বা সুরা তিনপ্রকার –
গৌড়ী, পৈষ্টী এবং মাধ্বী, এই সুরা তাল, খেজুর, মধু থেকে সঞ্জাত। এই সুরা যেভাবেই
তৈরি হোক এবং যেই নিয়ে আসুক, এ বিষয়ে কোন জাতিভেদ নেই, শোধন করলে সর্বসিদ্ধি দান
করে। শুদ্ধি বিনা মদ্যপান, বিষপানের তুল্য – সাধক চিররুগ্ন এবং স্বল্পায়ু হয়।
মাংস – তিন প্রকারের – জলচর, ভূচর, খেচর। এই মাংস যেখান থেকেই আনা হোক
বা যে ব্যক্তিই সে প্রাণীর ঘাতক হোক, শোধনের পর কিছু আসে যায় না। বলিতে পুরুষ-পশু বিহিত, স্ত্রী পশু হত্যা
নিষিদ্ধ।
মৎস্য – শাল, বোয়াল, রুই মাছ – এই তিন মাছ উত্তম। অন্যান্য কাঁটাহীন
মাছ মধ্যম, বেশি কাঁটাযুক্ত মাছ অধম।
মুদ্রা –চাঁদের মতো শুভ্র, যব অথবা গম থেকে তৈরি এবং ঘিয়ে ভাজা, মনোহর
মুদ্রা উত্তম। ধান থেকে তৈরি মুদ্রা মধ্যম। অন্য শস্য (ছোলা, মটর) ভেজে তৈরি
মুদ্রা অধম।
মৈথুন – নিজের দীক্ষিতা পত্নী অথবা শক্তিরূপা দীক্ষিতা পরকীয়া নারী
সঙ্গম”।
সাধারণ জন এই পঞ্চতত্ত্বকেই “পঞ্চ-ম” বলে জানেন এবং বিশেষতঃ এই
পঞ্চ-ময়ের কারণেই তাঁদের মনে তন্ত্র-সাধনা সম্পর্কে একটা বিভীষিকা কাজ করে, তাঁদের
মনে হয়, তন্ত্রসাধনা মানেই যেন এই “পঞ্চ-ম”-এর অনাচার ও ব্যাভিচার। সাধারণের মন
থেকে এই আতঙ্ক ও বিরূপভাব দূর করার জন্যে পরবর্তী অনেক তন্ত্রতত্ত্বে এই পঞ্চতত্ত্বের
যে ব্যাখা করা হয়েছে, তার কথাও এখানে বলে রাখি।
ইড়া ও পিঙ্গলার শ্বাসবায়ুকে একত্র করে, ধীরে ধীরে বায়ু গ্রহণ করতে হয়,
তারপর মূলাধার সংকুচিত করে, “হংসঃ”[xv] মন্ত্র উচ্চারণ করতে
করতে কুম্ভক করলে, মৎস্য সাধনা হয়। মৎস্য এখানে ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্যে
ঊর্ধমুখী কুল-কুণ্ডলিনী শক্তি।
এরপর কুণ্ডলিনী শক্তিকে হৃদয়ের অনাহত-পদ্মে এনে পূজা, জপ ও হোম কার্য
করতে হবে, তারপর সহস্রার মহাপদ্মের ভেতর পারদের মতো উজ্জ্বল বিন্দুরূপ শিবস্থানের
কল্পনা করতে হয়, এরই নাম মুদ্রাসাধনা।
এর পর সাধক কল্পনায় হৃদয়পদ্ম থেকে ষোড়শী, স্থির যৌবনা, পীনপয়োধরা,
সর্বালঙ্কার ভূষিতা, রক্তবর্ণা, সুন্দরদর্শনা, মৃদু হাস্যবদনা ইষ্ট দেবীকে
সহস্রারপদ্মে ভগবান শিবের কাছে উপস্থিত করবেন, সাধক মৌনী হয়ে আরও চিন্তা করবেন, ওই
দেবী ভগবতী ভগবান শিবের কাছে বসে, মুখপদ্ম চুম্বন করছেন। এই চিন্তনই মাংস সাধনা।
এরপর সাধক চিন্তা করবেন, দেবী ভগবতী ভগবান শিবকে আলিঙ্গন করে সঙ্গমে
নিরত রয়েছেন, এই সময় সাধক নিজেকে শক্তির সঙ্গে অভিন্ন চিন্তা করে নিজেকে পরমসুখী ও
আনন্দময় জ্ঞান করবেন, এই সাধনার নাম মৈথুন।
এরপর সাধক তাঁর জিহ্বাগ্র দিয়ে তালু কুহর রোধ করে ধ্যান করবেন যে, শিব
ও শক্তির মিলন ও বিহারে সুধাক্ষরণ হচ্ছে, সে সুধার স্বাদ তিনি জিহ্বাগ্রে যেন
অনুভব করছেন। এই সাধনাই মদ্য সাধনা। এই সময় সাধকের নেশাগ্রস্তের অবস্থা হয়, এই
অবস্থাকেই সমাধি বলে। সমাধি অবস্থার যে আনন্দ – সে আনন্দ শরীর ও মনের অব্যক্ত –
ভাষায় তার বর্ণনা করা যায় না[xvi]।
মহানির্বাণ তন্ত্রের অষ্টম উল্লাসে দেবী পার্বতী প্রশ্ন করলেন, “হে
বিভো, বর্তমানে (কলিকালে) বর্ণ ও আশ্রম কী কী? সেই বর্ণে ও আশ্রমে যে আচার-আচরণ
বিহিত আছে, সে কথাও আমায় বল”। দেবাদিদেব সদাশিব বললেন, “হে সুব্রতে, সত্য প্রভৃতি
চার যুগে চার বর্ণ ও চার আশ্রমের কথা বলা আছে। কিন্তু কলিকালে বর্ণ পাঁচ -
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং সামান্য আর আশ্রম দুই – গার্হস্থ্য ও
ভৈক্ষুক – ব্রহ্মচর্য ও বাণপ্রস্থ নেই। কলিকালে গৃহস্থদের সকল কাজই আগমোক্ত ও
তন্ত্রমতে কর্তব্য। কলিযুগে ভৈক্ষুকাশ্রমেও বেদোক্ত দণ্ডধারণ নেই, কারণ ওটা বৈদিক
সংস্কার। কলিতে শৈব সংস্কার বিধি অনুসারে, অবধূতাশ্রমধারণকেই “সন্ন্যাস গ্রহণ” বলা
হয়। কলিযুগে ব্রাহ্মণ এবং অন্য সকল বর্ণেরই এই দুই আশ্রমে অধিকার থাকবে।
বৃদ্ধ মাতা-পিতা, শিশু পুত্রকন্যা, পতিব্রতা ভার্যা, অসমর্থ বন্ধুজনকে
ত্যাগ করে প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাস গ্রহণ নিষিদ্ধ। সাধক গৃহস্থোচিত কর্তব্য শেষ
করে, আত্মীয়-স্বজন সকলকে পরিতুষ্ট করে, মমতাশূণ্য, কামনাশূণ্য ও জিতেন্দ্রিয় হয়ে
গৃহত্যাগ করতে পারে। গৃহস্থাশ্রম ছেড়ে যদি কেউ সন্ন্যাস গ্রহণে ইচ্ছা করে,
সেক্ষেত্রে তাকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশী এবং গ্রামের সকলের শুভেচ্ছা ও
অনুমতি প্রার্থনা করতে হবে।
সন্ন্যাসীর দেহ কখনও দাহ করা যাবে না, মরদেহ গন্ধপুষ্পে অর্চনা করে,
ভূমিতে সমাধি অথবা জলে নিমগ্ন করতে হবে।
এখানে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই, দশম
উল্লাসের ৭৯ ও ৮০ সংখ্যক শ্লোকে দেবাদিদেব শঙ্কর বলেছেন, “কুলকামিনীকে মৃতা
স্বামীর সঙ্গে দগ্ধ করবে না, যেহেতু ওই রমণী জগতে অপ্রকাশিত শরীরা তোমারই (দেবী
পার্বতীর) স্বরূপ। মোহবশতঃ কোন রমণী স্বামীর
চিতায় উঠলে, সে অবশ্যই নরকগামিনী হবে”। এমন
স্পষ্ট নিষেধ সত্ত্বেও এই সেদিন পর্যন্ত সহমরণ ও সতীদাহের হিড়িক উঠেছিল কেন? সেই
ধর্ম কি, বিধবার সম্পত্তি গ্রাস এবং বিধবাকে পালনের ঝামেলা এড়াতে, ব্রাহ্মণ ও
সমাজপতিদের বানানো স্বার্থ-ধর্ম? কে জানে?
সকল উপাসক বা সাধকের গুরুর কাছে অভিষিক্ত এবং দীক্ষিত হওয়া আবশ্যিক।
গুরু ছাড়া তন্ত্র সাধনা হতে পারে না। কৌলগুরু যে কোন সম্প্রদায়ের গুরুপদের জন্য
প্রশস্ত, কৌলগুরুর অভাবে নিজ সম্প্রদায়ের গুরু গ্রহণই প্রশস্ত, যেমন শাক্তদের
শাক্তগুরু, বৈষ্ণবদের বৈষ্ণবগুরু ইত্যাদি। যিনি সকল বিষয় ব্রহ্মে এবং সকল বিষয়েই
ব্রহ্মকে দেখতে পান, তিনিই জীবন্মুক্ত সৎকৌল।
মহানির্বাণ তন্ত্রের অন্তিম ও চতুর্দশ উল্লাসে মহেশ্বর শিব সাধকের
মুক্তি বিষয়ে বলেছেন, “মানুষ যে কর্ম না করে এক মূহুর্তও থাকতে পারে না, সেই কর্ম
দুই প্রকারের – শুভ এবং অশুভ। অশুভ কর্মের অনুষ্ঠান করে জীব তীব্র যাতনা ভোগ করে।
আবার যারা ফলের আশায় শুভ কর্ম করে, তারা ইহলোক ও পরলোকে বারবার যাওয়া আসা করে,
অর্থাৎ তাদের বারবার জন্ম-মৃত্যুর কষ্ট ভোগ করতে হয়। যে পর্যন্ত না তাদের জ্ঞানলাভ
হয় এবং নিষ্কাম কর্ম অনুষ্ঠান না করে, ততদিন তাদের মোক্ষলাভের কোন আশা নেই। ব্রহ্মা
থেকে সামান্য তৃণ পর্যন্ত সমস্ত জগৎই মায়া এবং মিথ্যা – এক পরমব্রহ্মই সত্য, এই
জ্ঞানই পরমজ্ঞান। এই জ্ঞান অর্জন করতে পারলে সমস্ত কর্মবন্ধন এবং “অহং” জ্ঞান থেকে
মুক্ত হওয়া যায়। যতক্ষণ দেহাদিতে “অহং” জ্ঞান থাকে, ততক্ষণ জপ, হোম, শতশত উপবাস
করলেও মুক্তি হয় না। কিন্তু, “ব্রহ্মই আমি” এই উপলব্ধি হলে, দেহী মুক্ত হয়। “ব্রহ্মই
সত্য, আর সমুদায় মিথ্যা” – এই ভাবই উত্তম। ধ্যানভাব মধ্যম। স্তব ও জপতপ অধম।
বাহ্যপূজা অধমের থেকেও অধম। যাঁর মনে পরম জ্ঞান উপলব্ধি হয়েছে, তাঁর জপ, যজ্ঞ,
তপস্যা, নিয়ম ব্রত প্রভৃতি কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই। মায়ার বশে জ্ঞান, জ্ঞেয়, এবং
জ্ঞাতা – এই তিনকে ভিন্ন স্বরূপ মনে হয়, কিন্তু বিচার করলে দেখা যায়, আত্মাই
অবশিষ্ট থাকেন। চিন্ময় আত্মাই জ্ঞান, চিন্ময় আত্মাই জ্ঞেয় এবং সেই আত্মাই জ্ঞাতা।
যাঁর এই জ্ঞান হয়েছে, তিনিই আত্মবিৎ - এই জ্ঞান চতুর্বিধ অবধূতের পরমধন”।
শ্রীভগবতী বললেন, “একটু আগেই তুমি গৃহস্থ ও ভৈক্ষুক – এই দুই আশ্রমের
কথা বললে, এখন আবার চার অবধূতাশ্রমের কথা বলছ? চার অবধূত কারা, তাঁদের লক্ষণ কী?”
শ্রীসদাশিব বললেন, “হে প্রিয়ে, ব্রহ্মমন্ত্রের উপাসক গৃহস্থাশ্রমে বাস
করলেও, তাঁদের “যতি” বা ব্রাহ্মাবধূত বলে
জানবে। যে সকল মানুষ পূর্ণ অভিষিক্ত হয়ে সংস্কৃত হয়েছেন, তাঁরা শৈবাবধূত। এঁরা
সকলের পূজনীয়। এই অবধূতও দুই প্রকার –
পূর্ণ ও অপূর্ণ। পূর্ণ শৈবাবধূত ও ব্রাহ্মাবধূতের নাম পরমহংস। আর যে অবধূতের
অদ্বৈতভাবের জ্ঞান পূর্ণ হয়নি, তিনি অপূর্ণ অবধূত। তিনি সর্বদা ব্রহ্মনিষ্ঠ থেকে
“ওঁ তৎসৎ” এই মন্ত্র উচ্চারণ করে, “সোঽহমস্মি” এই ধ্যান করতে থাকবেন। “ওঁ তৎসৎ” এই
মন্ত্র সর্ব সুখসাধ্য, এই মন্ত্রে কোন বাহুল্য নেই, কিন্ত এই মন্ত্র অনন্ত ফলদায়ক।
এই মন্ত্র নিগম, আগম ও তন্ত্র সমুদায়ের সারাৎসার”।
মহানির্বাণ তন্ত্রে, বিস্তারিত উল্লেখ না থাকলেও, তন্ত্রতত্ত্বে
শবসাধনাও একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। এই সাধনা বীরভাব-সাধনার অন্তর্গত। বীরভাবের
সাধক নির্জন ঘরে, নদী তীরে, পাহাড়, নির্জন স্থানে, বেলগাছের তলায় অথবা শ্মশানের
কাছকাছি নির্জন বনে শব সাধনা করতে পারেন। শবসাধনার সময়ের নির্দেশে বলা হয়েছে,
কৃষ্ণ কিংবা শুক্ল পক্ষের অষ্টমী ও চতুর্দশী তিথিতে মঙ্গলবারের রাত্রে, এই সাধনা
করলে সাধক উত্তমা সিদ্ধি লাভ করতে পারে।
সাধারণ জনসমাজে তন্ত্রতত্ত্ব নিয়ে যতই বিরূপতা এবং আতঙ্ক থাক, হিন্দু
দেব-দেবীর পূজার সঙ্গে তন্ত্র তার মন্ত্র ও যন্ত্র নিয়ে ওতপ্রোত মিশে আছে। যে কোন
দেবদেবীর পূজার অধিকাংশই আমরা না জেনেই তন্ত্রমতের অনুসরণ করে থাকি। যেমন, সমস্ত
পূজার সাধারণ কর্মানুষ্ঠান যেমন আচমন, স্বস্তিবাচন, গন্ধাদি ও নারায়ণাদির অর্চনা,
সঙ্কল্প, ঘটস্থাপন, সামানার্ঘ্য, জলশুদ্ধি, আসনশুদ্ধি, করশুদ্ধি, পুষ্পশুদ্ধি,
দ্বারদেবতাপূজা, ভূতাপসারণ ও দিগ্বন্ধন, পঞ্চামৃত শোধন, প্রতিমার চক্ষুর্দান,
প্রাণপ্রতিষ্ঠা, আবাহন ইত্যাদির সবই আমরা তন্ত্রমতে করে থাকি। দেব-দেবীর স্তব, পূজা, প্রণাম
মন্ত্রগুলি এসেছে, বেদ থেকে, কিছু আচার্য শঙ্করের রচনা, কিছু মন্ত্রের সৃষ্টি
করেছেন পুরাণ এবং তন্ত্র। তন্ত্রে যন্ত্র বলতে নানান জ্যামিতিক আকারকে বোঝায়। পূজার
যজ্ঞবেদী নির্মাণের অনেক বিধি-নিয়ম বেদ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু তন্ত্রে যজ্ঞ
ছাড়াও প্রায় প্রত্যেকটি পূজা পদ্ধতির মধ্যে সরল ও বক্র রেখা ব্যবহার করে, তার
মধ্যে প্রধানতঃ পাঁচ রঙের চূর্ণ(গুঁড়ি)-র প্রয়োগ আছে। সে আকার ত্রিভুজ, আয়ত, বর্গ,
বৃত্ত, স্বস্তিকা, পদ্ম, মীন ইত্যাদি নানান আকারের হতে পারে। যে কোন পূজায় মেঝে
কিংবা দেওয়ালে আল্পনা আঁকার প্রচলনও তন্ত্র-তত্ত্বের শৈল্পিক পরিবর্তন বলেই মনে
হয়।
ভারতের হিন্দু উপাসক সম্প্রদায়[xvii]
এই পর্যন্ত আলোচনায় আচার্য শঙ্করের প্রবর্তিত দশনামী সম্প্রদায় এবং
তন্ত্রমতে চার অবধূতাশ্রমের সন্ধান পেলাম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত
তত্ত্বেরই অজস্র পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং পরিমার্জন হয়েছে, সেই সঙ্গে বদলে গেছে
সাধনা ও সাধকের সংজ্ঞা। সেই কারণেই আবির্ভাব হয়েছে - শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব তন্ত্রের
অজস্র সাধকগোষ্ঠী। প্রচলিত শৈব সাধকদের কিছু কিছু পরিচয় এখানে দেওয়ার চেষ্টা
করছিঃ-
১. আচার্য শঙ্কর প্রবর্তিত দশনামী সন্ন্যাস সম্প্রদায়ের কথা আগেই
বলেছি।
২. মহানির্বাণ তন্ত্রের চার অবধূত সন্ন্যাস সম্প্রদায়ের উল্লেখ আগেই
করা হয়েছে।
৩. দণ্ডী – যাঁরা দণ্ড (বাঁশের লাঠি) ও কমণ্ডলু নিয়ে দেশে দেশে ঘুরে
বেড়ান, তাঁরা দণ্ডী সাধু। মা, বাবা,
পুত্র, কন্য ও পত্নীহীন ব্রাহ্মণ
ছাড়া কেউ দণ্ডী হতে পারেন না। দণ্ড গ্রহণের সময় শিখা ও সূত্র (যজ্ঞোপবীত) ত্যাগ
করতে হয় এবং পুড়িয়ে ফেলতে হয়। দণ্ডের একটি অংশে পৈতে জড়িয়ে, গেরুয়া কাপড়ে ঢেকে
রাখা হয়, এবং সেখানে মহামায়া অবস্থিতা চিন্তা করে দণ্ডীরা মহাকালীর পূজা করেন।
দণ্ডীদের কাছে দণ্ড পরমপদার্থ বিশেষ। দণ্ডীরা দণ্ডগ্রহণের সময় আগের নাম ছেড়ে
সন্ন্যাস-নাম গ্রহণ করেন, তাঁরা শিবমন্ত্র নিয়ে উপাসনা শুরু করলেও, নির্গুণ উপাসনাই
তাঁদের মুখ্যধর্ম। এঁরা মাথা মুড়িয়ে, গোঁফদাড়ি কামিয়ে গেরুয়া কাপড় পরেন, বিভূতি
তিলক এবং রুদ্রাক্ষের মালা ধারণ করেন। এঁরা ব্রাহ্মণের ঘর থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করেন
এবং দিনে একবার, কখনো কখনো দুবার স্বপাক অন্নগ্রহণ করেন। দণ্ডীদের শবদাহ হয় না,
মাটিতে সমাধি অথবা নদীজলে ভাসিয়ে দেওয়ার নিয়ম। সচরাচর এঁরা কাশীতে অবস্থান করেন।
দণ্ডীদের আরেকটি শাখা আছে, তাঁদের ঘরবারী দণ্ডী বলে, তাঁরা স্ত্রী-পুত্রদের সঙ্গে
সংসার এবং বিষয় কর্ম করলেও অন্যান্য বিধি-বিধান মোটামুটি একই।
৪. কুটীচক, বহূদক, হংস, পরমহংস – কুটীচক ও হংস
সম্প্রদায় শিব-লিঙ্গ পূজা করেন, বহূদক দেবপূজায় প্রবৃত্ত হন এবং পরমহংসেরা প্রণব
মন্ত্রে শিবের জপ করেন। কুটীচক শিখা, যজ্ঞোপবীত ও ত্রিদণ্ড-কমণ্ডলুধারী হন, কাষায়
বস্ত্র পরে থাকেন, কপালে ত্রিপুণ্ড্র ধারণ করেন এবং শুদ্ধাচারী হয়ে সর্বদা গায়ত্রী
জপ করেন। বহূদক সংসার ত্যাগ করে সাত গৃহে ভিক্ষা করবেন, এক গৃহের অন্ন গ্রহণ করবেন
না। ত্রিদণ্ড, শিক, কৌপীন, পবিত্র জলপাত্র, কমণ্ডলু, চাদর, কাঁথা, পাদুকা (খড়ম),
ছাতা, পবিত্র চর্ম (অজিন-হরিণের চামড়া), সূচী, পক্ষিণী (পাখির পালক –সাধারণতঃ
ময়ুরের), রুদ্রাক্ষমালা, যোগপট্ট, খনিত্রী (খুরপি- মাটি খোঁড়ার যন্ত্র) ও কৃপাণ
ধারণ করবেন। হংস বেশবাস কুটীচকের মতোই,
তবে শিখা সহ মাথা মুণ্ডন করবেন। দিনে একবার মাত্র আটগ্রাস অন্ন গ্রহণ করবেন।
সন্ধ্যায় গায়ত্রী জপ এবং দিনে শিব-লিঙ্গের অর্চনা করবেন। কাম, ক্রোধ, শোক, মোহ,
হর্ষ, বিষাদ, লোভ ইত্যাদি পরিত্যাগ না করলে পরমহংস হওয়া যায় না। এঁরা অত্যন্ত
পরিমিত আহার করেন। পরমহংস সন্ন্যাসীর বেশবাসে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এঁরা শুধুমাত্র
প্রণব জপ করেন এবং মোক্ষলাভই এঁদের একমাত্র লক্ষ্য। “অয়মাত্মা ব্রহ্ম” (এই
জীবাত্মা ব্রহ্ম), “অহং ব্রহ্মাস্মি” (আমিই ব্রহ্ম), “তত্তমসি” (তুমিই সেই ব্রহ্ম)
এই তিন মহাবাক্যের কোন একটি নিয়েই পরমহংস সর্বদা চিন্তন ও মনন করতে থাকেন।
৫. নাগা – যে সমস্ত সন্ন্যাসী মাথার জটাগুলি দড়ির
মতো বেঁধে চূড়া করে রাখেন, তাঁদের নাগা বলে।
নাগা শব্দটি এসেছে নাঙ্গা অর্থাৎ
উলঙ্গ থেকে। এঁরা সচরাচর দিগম্বর থাকেন, তবে আজকাল লোকালয়ে এলে এঁরা কৌপীন বা
অন্যান্য বস্ত্র পরেন, এঁদের কৌপীনের নাম নাগফণী। এঁরা অত্যন্ত উগ্র ও বিবাদপ্রিয়
হন। এঁদের কলহপ্রিয়তার জন্যে প্রাচীনকালে কোন কোন হিন্দুরাজা এঁদের সেনাপদে
নিযুক্ত করেছিলেন, তাঁদের নাগাসেনা বলা হত। নাগা সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা আখাড়া –
আশ্রম বা মঠ স্থাপন করে একসঙ্গে থাকেন। আজকাল নির্বাণী ও নিরঞ্জনী আখাড়ার নাগাদেরই
সচরাচর দেখতে পাওয়া যায়। কুম্ভমেলায় পুণ্যস্নানের সময়, প্রায় প্রত্যেকবারই অজস্র
নাগা সন্ন্যাসীদের উপদ্রবে নানান দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। নাগা সন্ন্যাসী সম্পর্কে
জনসাধারণের মনে অত্যধিক কৌতূহল এবং অতিরিক্ত ভক্তির কারণেই এমনটা ঘটে। ভারতবর্ষে
আজকের যুগে যতসংখ্যক নাগা সন্ন্যাসী আছেন, কুম্ভমেলায় তার থেকে অনেক বেশি সংখ্যক
নাগাসন্ন্যাসীর প্রাদুর্ভাব ঘটে। এর কারণ নাগা সম্প্রদায়ের আখাড়াগুলি, কুম্ভমেলার
সময়, দেহাতি গ্রাম থেকে অনেক সাধারণ মানুষকেও তুলে এনে কিছুদিনের জন্য নাগা সন্ন্যাসী
বানিয়ে তোলেন এবং তাদের কুম্ভমেলায় একত্র করেন। উদ্দেশ্য অবশ্যই মোক্ষলাভ নয়, বরং
পার্থিব অর্থসম্পদ লাভ, বলাই বাহুল্য[xviii]।
৬. অঘোরী – পরমহংস সন্ন্যাসীরা সবকিছুই ব্রহ্মময়
উপলব্ধি করেন, সর্ব বিষয়েই সমদৃষ্টি লাভ করেন।
সেই সমদৃষ্টিকে ব্যবহারিক জীবনে
উৎকটভাবে ব্যবহার করাই অঘোরী সন্ন্যাসীদের ব্রত। এঁরা আগেকার দিনে সাধারণতঃ
শ্মশানে থাকতেন এবং শরীরে চিতাভস্ম মাখতেন। এঁরা মৃত মানুষের খুলি, যাকে কপাল বলা
হয়, সেটিকে পানপাত্র হিসাবে ব্যবহার করেন, মানুষের অস্থি দিয়ে অঙ্গসজ্জা করেন।
অঘোরী সম্প্রদায় ভগবান শিবের ভৈরবরূপের সাধনা করেন এবং সংসারের পুনর্জন্ম চক্র
থেকে মুক্তি পেতে মোক্ষের তপস্যা করেন। জগতের সর্ব বিষয়ই ব্রহ্ম, এই দর্শনে
সাধারণের ঘৃণিত বস্তুতেও এঁদের যেন বেশি আগ্রহ, তাই বিষ্ঠা আর চন্দনে এঁরা কোন
প্রভেদ দেখেন না, বিষ্ঠাও গায়ে মাখেন। শোনা যায় সাধন কালে এঁরা পশু মাংসের থেকে নরমাংস
বেশি পছন্দ করে থাকেন।
ভৈরব সাধনায় অষ্টপাশ – কাম,
ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা, ভয়, লজ্জা ও ঘৃণা – থেকে মুক্তি পাওয়াই অঘোরী সাধনার
লক্ষ্য। অঘোরী সম্প্রদায় মনে করেন তাঁদের তন্ত্রের জনক অবধূত দত্তাত্রেয় এবং তাঁর
রচনা অবধূত-গীতা অঘোরী তন্ত্রের শাস্ত্র। পুরাণে ঋষি দত্তাত্রেয়কে ভগবান বিষ্ণুর
অংশ অবতার বলা হয়েছে, আবার কেউ কেউ বলেন তিনি ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের একত্র
অবতার। তন্ত্রসাধনার সব শাখাতেই দত্তাত্রেয়কে আদিগুরুর মান্যতা দেওয়া হয় এবং
তাঁকেই বামাচারী তন্ত্র সাধনার জনক বলা হয়। শ্মশানতারাকে জাগিয়ে তুলতে,
তন্ত্রতত্ত্বে ঋষি দত্তাত্রেয়ই নাকি শবসংস্কার বা শবসাধনার সূত্রপাত করেছিলেন। অঘোরী
সম্প্রদায়ের কুলদেবী হিংলাজ মাতা, অধুনা পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে তাঁর শক্তিপীঠ
মন্দির রয়েছে। এই শক্তিপীঠ একান্ন শক্তিপীঠের একটি, এখানে ছিন্নভিন্ন সতীদেহের
ব্রহ্মতালু পড়েছিল। অবিভক্ত ভারতে অঘোরী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা এই মরুতীর্থ
হিংলাজমাতার মন্দিরে যেতেন, মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা অঘোর নদীতে স্নান করে। অঘোরী
সন্ন্যাসীরা আয়ুর্বেদশাস্ত্রেও পণ্ডিত হতেন, যার জন্যে প্রাচীন ভারতের সাধারণ
গ্রামবাসীরা অঘোরীবাবাদের যেমন ভয় পেতেন, আবার তাঁদের চিকিৎসার জন্যে শ্রদ্ধাও
করতেন। এ প্রসঙ্গে শোনা যায় হিংলাজ শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত “হিঙ্গুলা” শব্দ থেকে,
হিঙ্গুলা একটি আয়ুর্বেদিক ওষুধ, যার ব্যবহার হয় বিষের প্রতিষেধক হিসাবে। অঘোরী
সন্ন্যাসীদের আয়ুর্বেদ চর্চাও হয়তো সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল!
আজকাল বৈদ্যুতিক চুল্লীর জন্যে
সেই শ্মশানও নেই, চিতাভস্মও দুষ্প্রাপ্য, শ্মশানের সেই ভয়াবহ পরিবেশও দেখা যায় না,
অতএব অঘোরী কিংবা কপালী সন্ন্যাসীদের সংখ্যা এখন খুবই ক্ষীণ ও বিচ্ছিন্ন । অতএব সর্ব বস্তুতে
সমদর্শীর, বিষম বাড়াবাড়ি দ্রুত লোপ পাচ্ছে।
হিন্দু ধর্মের অজস্র
শাখা-প্রশাখার, অসংখ্য ধর্মদর্শন ও তত্ত্বের মতো, সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের সংখ্যাও
বড়ো কম নয়। উপরে বলা সন্ন্যাসী সম্প্রদায় ছাড়াও উল্লেখযোগ্য শৈব সন্ন্যাসী
সম্প্রদায়ের মধ্যে আর যাঁদের নাম করা যায়, তাঁরা হলেন,
আলেখিয়া – এঁরাও ভিক্ষাব্রতী, তবে
গৃহস্থের দরজায় দরজায় ভিক্ষা করেন না, পথে চলতে চলতে “অলখ্, অলখ্” মন্ত্র
উচ্চারণ করতে থাকেন। গৃহীর ইচ্ছা হলে এঁদের ডেকে ভিক্ষা দান করে। ভিক্ষা দ্রব্য
বেশি হলে এঁরা সঞ্চয় করেন না, বরং নিজে রান্না করে দরিদ্র মানুষকে ভোজন করান।
ঊর্ধবাহু – যাঁরা এক বা দুই বাহু
ওপরে তুলে তপস্যা করেন।
আকাশমুখী, ঊর্ধমুখী – যাঁরা
সর্বদা আকাশের দিকে লক্ষ্য রেখে তপস্যা করেন।
নখী – হাত বা পায়ের নখ কাটার
বিলাসিতা করেন না যে সন্ন্যাসীরা, তাঁরা নখী।
ঠাড়েশ্বরী – সর্বদা দাঁড়িয়ে থেকে
যাঁরা তপস্যা করেন।
পঞ্চধূনী – গ্রীষ্মের প্রখর সূর্য
মাথায় নিয়ে, নিজের চারদিকে চারটি ধূনি জ্বালিয়ে যাঁরা তপস্যা করেন।
মৌনব্রতী – এঁরা কোন সময়েই ও
কারণেই কথা বলেন না, অঙ্গ ভঙ্গী ও ইশারায় কাজ করেন।
জলশয্যী – সূর্যাস্ত থেকে
সূর্যোদয় পর্যন্ত তিনি জলে শরীর মগ্ন করে শুয়ে থাকেন।
জলধারা তপস্বী – মাথার ওপর
ছিদ্রযুক্ত কলসের জলধারায় সারারাত সিক্ত হওয়ার তপস্যা।
কড়ালিঙ্গী – উলঙ্গ সন্ন্যাসী,
নিজের লিঙ্গে লোহার কুণ্ডল সর্বদা বেঁধে রাখেন।
ফরারী – শুধু মাত্র ফলমূল খেয়ে
সাধনা করেন।
দুধাধারী – শুধু দুধ খেয়ে
শরীররক্ষা করেন।
অলুনা – যাঁরা লবণ বা নুন ছাড়া
খাদ্য খেয়ে জীবনধারণ করেন।
অওঘড় – ব্রহ্মগিরি নামে এক দশনামী
সন্ন্যাসী, যোগীগুরু গোরক্ষনাথের প্রসাদে এই সন্ন্যাসী
সম্প্রদায়ের সূত্রপাত করেন।
অবধূতানী – গঙ্গাগিরি নামে এক
স্ত্রীলোক প্রথম অবধূতানী হয়ে এই সম্প্রদায়ের শুরু করেন।
সন্ন্যাসীরা মহিলাদের সন্ন্যাস-দীক্ষা
দেন না, অতএব অবধূতানীর গুরু অবধূতানী।
ঠিকরনাথ - এঁরা ভৈরবের উপাসক। বহু ছিদ্রবহুল মাটির
পাত্রের নাম ঠিকর, সেই ঠিকর হাতেই
এঁরা ভিক্ষা করেন।
এঁনারা ছাড়াও আর কত যে
সম্প্রদায়ের কথা না বলা থেকে গেল, কে জানে!
উপসংহার
ধর্ম নির্ভর ভারতভূমিতে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে কত ধর্মপথ, ধর্মমত, ধর্মদর্শন যে প্রচলিত হয়েছে, তার স্পষ্ট রূপরেখা রচনা মনে হয় অসম্ভব। এই পরিপ্রেক্ষিতে অন্ধের করস্পর্শে করী দেখার মতোই, আমার এই রচনায় অনেক ভ্রান্তি থাকার সমূহ সম্ভাবনা। তবুও আজকের ধর্মবিলাসী উন্মাদনার প্রেক্ষীতে এরকম আলোচনা অবশ্যই জরুরি। ভারতের জনগণ এমনকি আমাদের মত শহুরে বুদ্ধিজীবিরাও কত যে ভ্রান্ত ধারণা আর বিশ্বাস নিয়ে – বিভিন্ন রাজনৈতিক সুতোর টানে নেচে চলেছি; সাফল্যের শর্টকাট করতে হাতে পায়ে কোমরে বেঁধে চলেছি তাবিজ, রত্ন, মাদুলি, কালোসুতো, লালসুতো! কী অন্ধতায় অসহায় দরিদ্র বৃদ্ধাকে পুড়িয়ে চলেছি ডাইনি নাম দিয়ে! স্কুল-কলেজ কিংবা হসপিটাল না বানিয়ে নির্মাণ করে চলেছি চোখ ধাঁধানো মন্দির। ঈশ্বর যে মন্দিরে থাকেন না – অতীতেও ছিলেন না, আজও নেই – তিনি থাকেন আমাদের প্রত্যেকের দেহমন্দিরে, সে কথা বলেছেন প্রত্যেকটি ধর্মশাস্ত্র, মহাপুরুষরাও বলেছেন বারবার। তবু কেন খুলবো না, আমাদের চোখ ও কানের ঠুলি, আমাদের মস্তিষ্ক থেকে কেন সরাবো না, সংকীর্ণ চিন্তার জঞ্জাল?
--০০--
[এই প্রবন্ধটি - আমার "ধর্মাধর্ম" গ্রন্থের কিছু অধ্যায়ের সংক্ষিপ্তসার। প্রাপ্তিস্থান (বইয়ের দোকান): কলকাতা - দেজ, ধ্যানবিন্দু, উবুদশ, দে বুক স্টোর, ভারতী বুক স্টল / সোদপুর - পাপাঙ্গুল / চূঁচুড়া - বিদ্যার্থী / কৃষ্ণনগর - সংকলন / ঢাকা - উজান, বিদিত, বাতিঘর]
তথ্য ও তত্ত্ব ঋণস্বীকার
[i] শ্রীমদ্ভাগবত
পুরাণ।
[ii] হিস্ট্রি অফ
আরলি ইন্ডিয়া (ফ্রম দি অরিজিন্স্ টু এডি ১৩০০) – শ্রীমতী রোমিলা থাপার।।
[iii] হিস্ট্রি অফ
আরলি ইন্ডিয়া (ফ্রম দি অরিজিন্স্ টু এডি ১৩০০) – শ্রীমতী রোমিলা থাপার।
[iv] হিস্ট্রি অফ
আরলি ইন্ডিয়া (ফ্রম দি অরিজিন্স্ টু এডি ১৩০০) – শ্রীমতী রোমিলা থাপার।
[v] শ্রীমতী রোমিলা থাপারের মতে, শঙ্করাচার্যের এই
আবির্ভাব কাল নিয়েও বিতর্ক আছে।
[vi] সাহিত্যিক ও যুক্তিবাদী বাস্তুবিদ শ্রদ্ধেয় নারায়ণ
সান্যালের “পয়োমুখম” গ্রন্থ থেকে।
[vii] মহামতি কালীপ্রসন্ন সিংহ-কৃত মহাভারতের বঙ্গানুবাদ
থেকে।
[viii] মহামতি কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতের বঙ্গানুবাদ
(সরল বাংলা অনুবাদ – লেখক) - বিরাটপর্বের শুরুতে এরকম বর্ণনা আছেঃ-
রাজা যুধিষ্ঠির মনে মনে ত্রিভুবনেশ্বরী দুর্গার স্তব করতে আরম্ভ করলেন। তিনি মনে মনে জপ করতে লাগলেন, “হে
যশোদাকন্যা, নারায়ণপ্রিয়া, কংসের ধ্বংসকারিণি, অসুরবিনাশিনি, ভগবতি, বরদায়িণি,
আপনাকে নমস্কার। আপনি
ব্রহ্মচর্য্যস্বরূপা, বাসুদেবের ভগিনী। দুর্ধর্ষ কংস আপনাকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে
নিয়ে, শিলাতলে আছাড় মারতে গেলে, আপনি তার হাত থেকে অনায়াসে নিজেকে মুক্ত ক’রে,
আকাশে অদৃশ্য হয়েছিলেন। হে ভুবনেশ্বরি, আপনি দিব্য বস্ত্র ও মালায় সুসজ্জিতা।
আপনার হাতে তীক্ষ্ণ খড়্গ ও ঢাল শোভা পাচ্ছে। হে ত্রৈলোক্যতারিণি, যাঁরা পাপের ভার ক্ষালনের
জন্যে আপনাকে একান্ত ভাবে স্মরণ করেন, আপনি তাঁদের দুস্তর পাপের পঙ্ক থেকে উদ্ধার
করে থাকেন”।
তারপর রাজা যুধিষ্ঠির, সকল ভাই ও স্ত্রী দ্রৌপদী মিলে
দেবীকে দর্শনের ইচ্ছায় আরো অনেকরকম স্তব করতে লাগলেন, “হে নবোদিত সূর্যের মতো
স্নিগ্ধ উজ্জ্বল দেবি, আপনার চার হাত, চার মুখ, আপনি ময়ুরপুচ্ছবলয়ধারিণি, পীনস্তনী,
গুরুনিতম্বিনী, কেয়ুরধারিণি দেবী। আপনি লক্ষ্মীর মতো শোভা লাভ করে থাকেন। আপনার মুখমণ্ডলের
আভায় চাঁদের জ্যোৎস্নাও লজ্জিত হয়। আপনার দুই কান, সোনার কুণ্ডলে অলংকৃত। বিচিত্র
আপনার মাথার মুকুট এবং অত্যন্ত রমণীয় আপনার কেশবন্ধন। হে বিবিধ অস্ত্রধারিণী,
আপনার বিপুল বাহুসমূহ শত্রুধ্বজার মতো। আপনার কটিতটে ভুজঙ্গের অলঙ্কারে, আপনি মহানাগ বেষ্টিত
মন্দরগিরির মতো রূপ ধারণ করেছেন। ময়ুরের পাখায় সাজানো আপনার ধ্বজদণ্ডের কী অপূর্ব শোভা
হয়েছে। হে ত্রিদশেশ্বরি, আপনি কৌমার ব্রতে
সুরলোক পবিত্র করেছিলেন, সেই কারণে ত্রিদশগণ সর্বদা আপনার স্তব ও পূজা করেন। আপনি
ত্রিলোককে রক্ষা করার জন্য মহাসুর মহিষাসুরকেও সংহার করেছিলেন। আপনি জয়া, বিজয়া, বরদা এবং আপনি
সংগ্রামে বিজয় দান করেন, অতএব আমাদের প্রতি এখন প্রসন্ন হোন, কৃপা করে আমাদের বিজয়
দান করুন। হে মদ্য ও পশুমাংসপ্রিয়ে, কামচারিণী, নগেন্দ্র বিন্ধ্যাচল আপনার শাশ্বত
বাসস্থান, প্রলয়কালে নিখিল জীব ও জড় আপনাতেই লীন হয়। হে কালী, হে মহাকালী, যাঁরা
প্রভাতে আপনাকে স্মরণ ও প্রণাম করেন, তাঁদের সকল দুঃখের ভারমুক্তি ঘটে এবং প্রভূত
ধন-পুত্র লাভ সুলভ হয়। হে দুর্গে, আপনি বিপদের দুর্গ থেকে লোককে উদ্ধার করেন বলেই
আপনার নাম দুর্গা। গহন অরণ্যে অবসন্ন, সাগরজলে নিমগ্ন
ও দস্যুকবলে আক্রান্ত জনের আপনিই একমাত্র গতি। হে দেবি, জলপোতে, নির্জনপ্রান্তরে
কিংবা গভীর অরণ্যে বিপন্ন হয়ে, আপনাকে ভক্তিভরে স্মরণ করলেই, আর বিপদের ভয় থাকে
না, বিপদ থেকে তৎক্ষণাৎ উদ্ধার পাওয়া যায়। হে সুরেশ্বরি, আপনি কীর্তি, লক্ষ্মী,
ধৃতি, সিদ্ধি, লজ্জা, বিদ্যা, সন্ততি, বুদ্ধি, সন্ধ্যা, রাত্রি, প্রভা, নিদ্রা,
জ্যোৎস্না, কান্তি, ক্ষমা ও দয়া। আপনার পূজা করলে মানুষের বন্ধন, মোহ, পুত্রনাশ,
ধনক্ষয়, ব্যাধি, মৃত্যুভয় কিছুই থাকে না। হে ভক্তবৎসলে, শরণাগতপালিকে, দুর্গে, আমি
রাজ্যভ্রষ্ট হয়েছি। এখন আপনার শরণাপন্ন হয়েছি, আপনাকে প্রণাম করি, আপনি আমাদের
সকলকে রক্ষা করুন”
রাজা যুধিষ্ঠিরের এই স্তবে দেবী প্রসন্ন হলেন, তাঁদের সামনে
আবির্ভূতা হয়ে বললেন, “হে রাজা, আমার প্রসাদে তোমাদের অচিরকালের মধ্যেই বিজয় লাভ
হবে। তুমি ও তোমার ভ্রাতৃগণ নিখিল কৌরবদের পরাজিত করে, নিষ্কণ্টকে রাজ্যভোগ করবে,
সুখে এবং শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করবে। হে ধর্মরাজ, যে সকল নিষ্পাপ লোকেরা আমার
নামসঙ্কীর্তন করে, আমি তাদের প্রতি প্রসন্ন হই এবং আমি তাদের রাজ্য, আয়ু, সম্পদ,
সুন্দর স্বাস্থ্য ও সন্তান প্রদান করি। প্রবাসে, নগরে, যুদ্ধে, সংগ্রামে, অরণ্যে,
দুর্গম পাহাড়ে ও সাগরের যে কোন দুর্গম স্থানে বিপন্ন হলেই, যারা আমাকে স্মরণ করে,
তাদের আর কিছুই দুর্লভ থাকে না। তোমার এই
স্তব ও স্তোত্র শুনলে অথবা পাঠ করলে তাদের সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন হয়, সকল উদ্দেশ্য
সিদ্ধ হয়। হে পাণ্ডবগণ, আমি প্রসন্ন হয়েই বলছি, তোমরা এই বিরাটনগরে বাস করলে,
এখানকার লোকেরা এবং কৌরবেরাও, কেউ তোমাদের সঠিক পরিচয় জানতে পারবে না”।
দেবী যুধিষ্ঠিরকে এই কথা বলে, পাণ্ডবদের আশীর্বাদ করলেন এবং
সেখানেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
[ix] তন্ত্রদর্শন ও সাধনার সারসংক্ষেপ – স্বামী
সমর্পণানন্দ, রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ ইউনিভার্সিটি, বেলুড় মঠ, ২০১১
[x] ভারতের উপাসক –
শ্রীযুক্ত অক্ষয় কুমার দত্ত।
[xi] প্রশ্নোপনিষদ – তৃতীয় প্রশ্নের ৫ থেকে ৭ সংখ্যক
শ্লোক – অনুবাদঃ লেখক।
[xii] শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত।
[xiii] শ্রীশ্যামাচরণ কবিরত্নের বাংলা অনুবাদ গ্রন্থ
থেকে।
[xiv] এখানে ভগবান শিবকে বলা হয়েছে তিনিই চার বেদ এবং চার বর্ণ
প্রকাশ করেছেন, কিন্তু ভাগবতপুরাণগুলিতে এই কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে ভগবান বিষ্ণুকে।
[xv] “হংসঃ”
মন্ত্রকে তন্ত্রে অজপা জপ বলা হয়, অর্থাৎ যে মন্ত্র আমরা জন্ম থেকে মৃত্যু সর্বদা
না জেনেই জপ করে চলেছি। আমরা প্রতিবার নিঃশ্বাসের শব্দে “হং” এবং প্রশ্বাসের সময়
“সঃ” – দুইয়ে মিলে “হংসঃ” জপ করি।
[xvi] যুক্তিকল্প – নিগমানন্দ পরমহংস।
[xvii] ভারতের
উপাসক – শ্রীযুক্ত অক্ষয় কুমার দত্ত।
[xviii] সাহিত্যিক ও যুক্তিবাদী শ্রদ্ধেয় নারায়ণ
সান্যালের “পয়োমুখম” গ্রন্থ থেকে।