উপন্যাস (বড়োদের) লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
উপন্যাস (বড়োদের) লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সোমবার, ১১ আগস্ট, ২০২৫

সুরক্ষিতা পর্ব - ১১

 ১১

 প্রতিষ্ঠার মনটা আজ নিজের মনে নেই। গতকাল রাত্রে সম্রাট তার সঙ্গে ভীষণ খারাপ ব্যবহার করেছে। নাইট ডিউটির অবসরে ছেলেদের সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ মাখামাখি তার বেশ লাগে। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠার সতীত্ব-টতীত্ব নিয়ে কোন আদেখলাপনা নেই, তা সত্যি। কিন্তু, এসবের মধ্যেই সম্রাট ওকে এমন একটা গালাগাল দিল! ব্যাপারটা মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছে না বসে গেছে তার মাথার ভিতরে। এইরকম বেজায় মন খারাপের সময় ছবির সাহচর্য তাকে বরাবর শান্তি এনে দিয়েছে। আজও ছবির সঙ্গে সে যতক্ষণ ছিল, বেশ ছিল – মন খারাপের কথা মনেও হয়নি একবারের জন্যেও! কী যে জাদু আছে ছবি বলে অতি সাধারণ মেয়েটার মধ্যে, আজও সম্পূর্ণ করে বুঝে উঠতে পারেনি প্রতিষ্ঠা। তবে এটুকু সে বোঝে, যে ছবি তাকে ভালোবাসে। ও বাড়িতে গেলে ছবির উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি, তার আন্তরিক “মিঠুদিদি” ডাক, তাকে অদ্ভূত এক নিরাপত্তা এবং বিশ্বাসের অনুভূতি এনে দেয়।

কিন্তু একটি মেয়ের এই নিখাদ ভালোবাসার মধ্যে প্রতিষ্ঠা কী করে যেন এনে ফেলেছিল এক শরীরী আবেগ। প্রায় মাস আষ্টেক আগে তারা প্রথম মিলিত হয়েছিল ভালোবাসার উচ্ছ্বাসে। তার জন্যে দায়ি প্রতিষ্ঠা নিজেই। মনে আছে প্রথম দিন ছবি প্রচণ্ড অবাক হয়েছিল তার মিঠুদিদির এই আকস্মিক আচরণে। বুঝেই উঠতে পারেনি, একজন মেয়ে হয়ে মিঠুদিদি তার কাছে ঠিক কী পেতে চাইছে? বাধা দিয়েছিল। অনুরোধ করেছিল বারবার, এমন না করতে। প্রতিষ্ঠা শোনেনি, প্রচণ্ড আবেগে সে নিজেও ভেসে গিয়েছিল - ভাসিয়ে দিয়েছিল ছবির সমস্ত সংকোচ, লজ্জা আর আপত্তি। তার পরে প্রায় নিয়মিত ছবির সঙ্গে শরীরী সম্পর্কে প্রতিষ্ঠা বড়ো তৃপ্তি পায়। আগে থেকে ফোন করে প্রতিষ্ঠাই চলে আসে ছবির কাছে – নির্জন দুপুরেঅনেক সাধ্য সাধনা করে, কাঠ-খড় পুড়িয়ে, ছবিকে মাত্র দুই রাত সে নিয়ে যেতে পেরেছিল নিজের ঘরে। পিছুটান নেই, কোন তাড়া নেই, শুধু দুজনে সারারাত – সে বড় আনন্দের রাত – মনে হয়েছিল প্রতিষ্ঠার।

ছবি তাকে ভালোবাসে এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠা যতটা নিশ্চিত, ততটাই নিশ্চিত, তার এই শরীরী সম্পর্ক ছবি খুব ভালো মনে নেয় না। যে কোন কারণেই হোক মেনে নিয়েছে – আজকাল অভ্যস্ত হয়েও উঠছে দিন কে দিনআগের মতো বাধা দেয় না বা আপত্তি করে না ঠিকই, তাই বলে কোন উৎসাহও দেখায় না। উদ্‌গ্রীব আগ্রহও যেমন নেই, তেমনি উদাসীন শীতলতাও থাকে না তার ব্যবহারে।

প্রতিষ্ঠা জানে বহু স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যও এমনই নিয়মানুবর্তিতার অনুশীলন। সে নিজের ঘনিষ্ঠ জীবনেই দেখেছে এরকম। তার বাবা-মার সম্পর্কটাই আজও এমনতর। তার বাবার ভীষণ সন্দেহবাতিকনিজের স্ত্রীকে সর্বদাই মনে করে কারুর প্রতি আসক্তা। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, এমনকি জামাকাপড় ইস্ত্রির ধোপা, আগে যে ছেলেটা দুধ দিতে আসত, যে কেউ হতে পারে। পুরুষ হলেই হোল, আর সুপুরুষ হলে তো কথাই নেই। আজকাল কেউ আর আসে না তাদের বাড়িতেকারণ উপস্থিত লোকের সামনেই বাবা তার মাকে যে ভাষায় বিদ্রূপ করে, চেঁচামেচি করে, অপমান করে তাতে কেউই আর এ মুখো হয় না।

জ্ঞান হয়ে থেকে প্রতিষ্ঠা এ সবই দেখে আসছে। সে বড়ো হতে হতে বহুবার তার বাবাকে বুঝিয়েছে। ঝগড়া করেছে। বাবাকে প্রস্তাব দিয়েছে কোন সাইকোথেরাপিস্টকে কনসাল্ট করতে। তাতে ফল হয়েছে উল্টো। বাবার এখন ধারণা সেও তার মায়ের এই ব্যাভিচারবৃত্তির পৃষ্ঠপোষক এবং মা-মেয়ে দুজনে মিলে ষড়যন্ত্র করছে, বাবাকে পাগল প্রতিপন্ন করতে। সাইকোথেরাপিস্ট মানে পাগলের ডাক্তার! বাবার এই মানসিক ব্যাধির জন্যে তারা তিনজনেই এক অসুস্থ জীবনের বোঝা টেনে চলেছে নিরন্তরঅথচ অন্য সব ব্যাপারে তার বাবার সব ঠিকঠাক -  কাজকর্ম, অফিস, খাওয়াদাওয়া, জিনিষপত্র তাতে কোন অসামঞ্জস্য নেই। মায়ের জন্যেও প্রায়ই দামি শাড়ি, মাঝে মাঝেই গয়না, এখান সেখান বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, সবই করে।

ছোটবেলায় একবার পনেরই আগস্টের ছুটিতে তারা চিড়িয়াখানা যাবার প্ল্যান করে বেড়িয়েছিল। বাবা সেদিন দারুণ ভালো মুডে ছিল। খুব হাসি-খুশি আর মজার। সকাল থেকে বাজার করে, মায়ের সঙ্গে রান্নায়বান্নায় হাত লাগিয়ে, তাড়াতাড়ি মাংসেরঝোল-ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়েছিল তারা। সকাল থেকেই সেদিন মেঘলা ছিল, বেশ ঠাণ্ডা ওয়েদার – গরমের দিনেও বেড়ানোর পক্ষে আদর্শ ছিল দিনটাধর্মতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে তারা বাসে উঠেছিললেডিজ সিটে তারা দুজনে সিট পেয়ে গিয়েছিল, বাবা পায়নি – কারণ জেন্টস সিট সব ভর্তি ছিল। খুব বেশি ভিড় ছিল না বাসে, তাদের কাছাকাছিই বাবা দাঁড়িয়েছিল।

বাস ছাড়ার একটু পরেই বৃষ্টিটা নামল। প্রচণ্ড বৃষ্টিবাসের কণ্ডাকটার দৌড়ে এসে বাসের জানালার কাঠের পাল্লাগুলো তুলে দিচ্ছিল। প্রতিষ্ঠাদের পিছনের জানালাটায় কোন ডিফেক্ট ছিল বারবার নেমে যাচ্ছিল পাল্লাটা, কণ্ডাকটার তার আর মায়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটু ঝুঁকে চেষ্টা করছিল পাল্লাটাকে ঠিকঠাক লাগাতে...। হঠাৎ বাবা বীভৎস বিকৃত স্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিল, “কী হচ্ছেটা কি? পাশে মেয়েকে বসিয়ে, এই এক বাস লোকের সামনে, বাসের কণ্ডাকটারের সঙ্গে ফস্টিনস্টি না করলে চলছিল না..। এই জন্যে তোর বাইরে বেরোনোর এত টান? লজ্জা, ঘেন্না-পিত্তি সব ঘুঁচে গেছে..”?

সে আর তার মা বসেই রইল পাথরের মূর্তির মতো। অপমানে তার সমস্ত শরীর রী রী করছিল। বছর বাইশ-তেইশের ছোকরা বাসের কণ্ডাকটারটা বলেছিল, “আলফাল কি বলছেন? জানালাটা বন্ধ করছিলাম – ফস্টিনস্টি কি বে?  শালার এতোই যদি, ট্যাক্সিতে যান না ...”

বাবা তাও থামেনি। অনর্গল চেঁচিয়ে চলেছিল, মাকে নিয়ে। সামনের এক ভদ্রলোক কিছু বলতে উঠেছিলেন, বাবাকে সামলাতে, বাবা তাকে নিয়েও শুরু করল, “আপনিও কিছু কম যান না, সেই থেকে দেখছি চোখে চোখে ইশারা চলছে...এখন আবার সাউখুরি করতে এয়েচেন...।”?

বাসের আরো কিছু লোকজন বাবাকে শান্ত করতে চেষ্টা করছিল, বাবা থামছিল না, উল্টে বেড়েই চলেছিল চেঁচামেচি আর মায়ের প্রতি অশ্রাব্য সম্পর্কের টিপ্পনি। শেষে বাস ড্রাইভার রাস্তার ধারে সাইড করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল বাসটা, বলেছিল, “অ্যাই, পরাণ, মালগুলোকে খালাস করত। শালা, এমনিতেই বৃষ্টিতে প্যাসেঞ্জার নেই, তার ওপর ফালতু ক্যাচাল..., হাটা সব কটাকে”।

বাসের দুজন কণ্ডাকটার মিলে তাদের তিনজনকে একরকম জোর করে নামিয়ে দিয়েছিল রাস্তায়। অঝোরে বৃষ্টি ঝরা মধ্যদিনে তারা বাস থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার ধারে। চারিদিকে মাথা বাঁচানোর কোন উপায় ছিল না। জনহীন রাস্তা – গাড়ীগুলো খুব দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছিল – জল ছিটিয়ে ওপারে ফোর্ট উইলিয়ামের মাঠ, এপারে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ড। কিছুটা দূরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর ব্রিগেডের ওপারে আধুনিক শহরের ইমারতের সারি বৃষ্টিধারায় ঝাপসা দৃশ্যপট হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের পিছনে।           

বাবার মুখের দিকে সে তাকায়নি, প্রবৃত্তি হয়নি তার। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। নির্লিপ্ত ভাবলেশহীন পাথরের মতো শক্ত মুখ, চোয়াল শক্ত করে কিছু ভাবছে। মায়ের দৃষ্টিতে যেন কেউ নেই, সে নেই, এই শহরের রাস্তাঘাট, নিবিড় সবুজ গাছপালা, অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ধারাপাত কিচ্ছু নেই। সে মাকে ধরতে গেল। মা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে, ভীষণ কর্কশ গলায় বলেছিল – “ছেড়ে দে, আমায় – ছেড়ে দেদূর হয়ে যা সব -”, আর তারপরেই আচমকা দৌড়তে শুরু করেছিল রাস্তা পার হয়ে। আতঙ্কে প্রতিষ্ঠা চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল, সমস্ত আবেগ দিয়ে প্রাণপণ ডেকে উঠেছিল – “মা.....”।

তীক্ষ্ণ আওয়াজ করে গাড়িটা ব্রেক কষেছিল তাই, নাহলে কি হত ভাবতে আজও প্রতিষ্ঠা শিউরে ওঠে। গাড়ির দরজা খোলার শব্দে প্রতিষ্ঠা চোখ মেলে তাকাল। মায়ের শরীর থেকে এতটুকু দূরত্বে দাঁড়িয়ে গেছে গাড়িটা। দরজা খুলে নেমে এসেছিল এক ভদ্রলোক আর মহিলা। প্রতিষ্ঠা দৌড়ে চলে গিয়েছিল মায়ের কাছে – মাকে জড়িয়ে ধরল। এতক্ষণ যে কাঠিন্য সে দেখছিল মায়ের মধ্যে, আর এখন নেই। নিশ্চিত মৃত্যুর গ্রাস থেকে ফিরে আসা মা,  তার কাঁধে ভর দিয়ে, দুর্বল-শিথিল হয়ে আসা নিজের শরীরটা টেনে আনল রাস্তার ধারে ঘাসের ওপর। মা বসে পড়েছিল, বসতে বসতে বলল, “এ বারেও হল না রে, মিঠু, আমার মরণও হবার নয়...কেন বল তো”?

মায়ের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে প্রতিষ্ঠা বলেছিল, “না মা, না – প্লিজ, আমি কার কাছে থাকব, মা – তুমি মরবে না, মা, কিছুতেই নাঐ জানোয়ারটার হাতে আমাকে ছেড়ে দিয়ে তুমি শান্তি পাবে, মা? প্লিজ মা, প্লিজ, আমার জন্যে তোমাকে বেঁচে থাকতেই হবে, মা”

 

তারা দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। দুজনেই অনেক কিছু বলছিল – কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল না, কান্নায় ভেঙে যাচ্ছিল তাদের উচ্চারণ আর স্বর। গাড়ি থেকে নেমে আসা ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা এতক্ষণ কিছু বলছিল না, শুধু দেখছিল তাদের। এবার ভদ্রলোক খুব উঁচুস্বরে দাঁতে দাঁত চেপে বাবাকে বলেছিল, “চেহারা দেখে তো শালা, ভদ্রলোক বলেই মনে হয় – মেয়ে বউকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে সঙের মতো কী দেখছিস কি, য়্যাঁ...”? সপাটে এক চড় কষিয়েছিল বাবার গালে।

সেই শব্দে প্রতিষ্ঠা এবং তার মাও চমকে উঠে তাকিয়েছিল। প্রতিষ্ঠা দেখেছিল বাবা চোখ নীচু করে তাকিয়ে আছে ঘাসের দিকে... বাবাকে তার মনে হয়েছিল দুইপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক সরীসৃপ বিশেষ - শীতল, আপাত নিরীহ – কিন্তু অদ্ভূত বিষযুক্ত – যে বিষে জর্জরিত তার মা এবং ওদের একমাত্র সন্তান হিসেবে, সেও। এক মারাত্মক বিপদ থেকে ভাগ্যক্রমে বেরিয়ে আসা ক্রুদ্ধ ভদ্রলোক আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, উদ্যত হয়েছিলেন হয়তো আরও মারধোর করতে -। তাই দেখে মা খুব কঠিন স্বরে বলেছিল, “শুনছেন, ওকে ছেড়ে দিন। আপনারা যান, যেখানে যাচ্ছিলেন...আমাদের একা থাকতে দিন, প্লিজ”।

ভদ্রলোক একটু দমে গেলেও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, সঙ্গের ভদ্রমহিলা জোর করে টেনে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন। গাড়িতে উঠে বসলেন ভদ্রমহিলা ওদের দিকে একবারও তাকালেন না, ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ওরা চলে যেতে মা বলল – “চ, মিঠু, ঘরে যাই”।

বৃষ্টিটা তখন অনেকটাই ধরে এসেছিল, পড়ছিল - তবে হাল্কা।   

...চলবে...

শুক্রবার, ১ আগস্ট, ২০২৫

সুরক্ষিতা পর্ব - ১০

 

১০


স্কুলে তাঁর কাজের চাপ বাড়ছে। তিনি এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মিসট্রেস। মাস ছয়েক পরে এখন যিনি হেডমিস্ট্রেস, কণিকাদি, রিটায়ার করবেন। খুব চান্স আছে, কণিকাদির পর শুভময়ীদেবীর হেডমিস্ট্রেস হওয়ার। সেক্ষেত্রে কাজের প্রেসার আরো বাড়বে, বাড়বে দায়িত্ব। বেড়ে যাবে এডুকেশান বোর্ড, কাউন্সিল, স্কুল কমিটির মিটিং সামলানোর টেনসান। এরই মাঝে বেশ কিছুদিন ধরেই একটা কথা শুভময়ীদেবীর বারবার মনে আসছে, বিরক্তিকর মাছির মতো, তাড়িয়ে দিলেও বারবার যেমন ফিরে আসে। কথাটা হল, বিট্টুর কি হবে? কতদিন, আর কতদিন সম্ভব এভাবে বিট্টুকে সামলে চলা এবং তার সঠিক দেখভাল করা? 

বিট্টুর বয়েস বাড়ছে প্রকৃতির সমস্ত নিয়ম মেনেই। আজ সে তার বয়েস প্রায় পনের। তার শরীরে এখন নবীন যৌবনের সূচনা। তার গালে নরম দাড়ি, নাকের নীচে চিকন গোঁফের উন্মেষ। দিন পনের-কুড়ি অন্তর তার মাথার চুলের সঙ্গে তার গোঁফ-দাড়ি বাড়িতেই ছেঁটে দেন শুভময়ী দেবী। এই বয়সের সুস্থ ও স্বাভাবিক ছেলেরা লেখাপড়া, বন্ধু-বান্ধবী, খেলাধুলো, সিনেমা, গান, ফাজলামি নিয়ে চঞ্চল থাকে। বিট্টুর কোন কাজ নেই, বাইরের জগৎ থেকে সে বিচ্ছিন্ন, অচঞ্চল নিয়ন্ত্রণহীন আলাদা এক সত্ত্বা। অথচ নিষ্ঠুর নিষ্ঠার সঙ্গে প্রকৃতি তার শরীরে, তার মনে সাজিয়ে তুলছে যৌবন, জীবধর্ম মেনে তার শরীরে গড়ে উঠছে নতুন জীবন সৃষ্টির সমস্ত সরঞ্জাম ও আয়োজন! বাড়ছে নিত্যনতুন জটিলতা। সে নিজে বিপন্ন হচ্ছে, বিপন্ন করছে ছবিকে, নিজের পরিবারকে। অসুস্থ হয়ে পড়ছে বারবার। কাজেই বিট্টুর এখন দরকার প্রফেসনাল কেয়ার। 

তাছাড়া আজকাল আরও একটা চিন্তা শুভময়ীদেবীর মগজে বাসা বাঁধছে, সেটা হল তাঁদের, তাঁর আর বিট্টুর বাবার মৃত্যুর পর কী হবে বিট্টুর? হয়তো আজই নয় কিন্তু পাঁচ, দশ, বিশ বছর বাদে, ঠিক কবে তাঁরা চলে যাবেন কে বলতে পারবে? সেদিন কার কাছে, কার ভরসায় রেখে যাবেন বিট্টুকে? আজ পর্যন্ত খুব স্বাভাবিক ভাবেই কোন মিরাক্‌ল্‌ ঘটেনি এবং ঘটার কোন সম্ভাবনাও নেই, যাতে বিট্টু স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে। কাজেই কি হবে ওর ভবিষ্যৎ? 

এইসব চিন্তার মধ্যেই বিট্টুর বাবা ট্রান্সফার হয়ে গেলেন চেন্নাই। কোম্পানীর রিজিওনাল ম্যানেজার হিসেবে তাঁর প্রমোশন হওয়াতে, তাঁকে সমস্ত দক্ষিণ ভারতের ব্যবসা সামলাতে হবে এখন থেকে। শুভময়ীদেবী প্রস্তাব করেছিলেন, প্রমোশন অ্যাক্সেপ্ট না করার জন্য, অন্য কেউ যাক না। এই বয়সে কলকাতা ছেড়ে, অতদূরে যাওয়া, কী এমন জরুরি? বিশেষ করে বিট্টুর এইরকম অবস্থায়? বিট্টুর ভালোমন্দ সমস্ত দায়িত্ব এখন থেকে শুভময়ীদেবীর? কেন, বিট্টুর এই অবস্থার জন্যে কি শুভময়ীদেবী দায়ী? মা হয়ে নিজের সন্তানকে তিনি এইভাবে বড়ো হতে দেখছেন, তাঁর এই যন্ত্রণা ভাগ করে নেওয়ার মতো কেউ থাকবে না তাঁর পাশে? বাবা হিসেবে কোন ফিলিংস যদি নাও থাকে, কর্তব্যবোধটুকুও কিভাবে লোপ পেয়ে যায়? এই সব ভেবে দিশাহারা হয়ে যাচ্ছেন শুভময়ীদেবী। এক এক সময় তাঁর মনে হয়, তাঁর স্বামীর এমন আচরণ, শুধু তাঁকেই শাস্তি দেবার জন্যে। তিনি তাঁর স্বামী ও শাশুড়ির নির্দেশ মতো স্কুলের চাকরি ছেড়ে বিট্টু-অন্ত-প্রাণ মা এবং গৃহবধূ হতে চাননি বলেই আজও এতদিন পরেও, এও একধরনের প্রতিশোধ ছাড়া আর কি হতে পারে!

কোন এক বহুজাতিক সংস্থার কোটি কোটি টাকার ব্যবসাকে আর বেশী বেশী কোটিতে দাঁড় করানোটা কি এতই জরুরি! আর তিনি যে ঘরের অধিকাংশ কাজ সামলেও কয়েক হাজার মেয়েকে বড়ো হতে, মানুষ হতে সাহায্য করে চলেছেন, তার কোন মূল্যই নেই কারো কাছে! আজকাল শুভময়ী দেবী নিজেকে ভীষণ একলা অনুভব করেন। কোন ধরনের অ্যাপ্রিসিয়েসনহীন, কোন প্রত্যাশাহীন এমন একটা দীর্ঘ লড়াই, একদম একা একা লড়ে যেতে, তিনি আর যেন পেরে উঠছেন না। কেউ একজন, যদি কেউ একজন থাকত তাঁর পাশে। যার থেকে কোন সাহায্য না পেলেও, তাঁর কাছে দিনের শেষে অন্ততঃ একবার বসলেও যদি পাওয়া যেত একটু শান্ত অবসর। তাহলেই বেঁচে যেতেন তিনি, ফিরে পেতেন লড়ে চলার নতুন শক্তি।  

তিনি কথাবার্তা বলতে লাগলেন নানান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এর আগেও অনেক জায়গা থেকেই তাঁদের কাছে অনেকে এসেছিল। যে ক্লিনিকে বিট্টুর রেগুলার চেকআপ করানো হয়, কোন প্রবলেম হলেই। যেখানে বিট্টুকে নিয়ে দৌড়ে যান ট্রিটমেন্টের জন্যে, তারাও রেফার করেছিল এরকম বেশ কতকগুলি প্রতিষ্ঠানের নাম। তখন আমল দেননি তাঁরা কেউই। মনে হয়েছিল নিজের সন্তান সে যেমনই হোক, তাঁদের কাছেই থাকুক। আজ যতদিন যাচ্ছে শুভময়ীদেবী অসহায় বোধ করছেন, অসম্ভব এক ক্লান্তি তাঁকে ঘিরে থাকছে সারাটাক্ষণ। যে ক্লান্তি থেকে তাঁর আর যেন মুক্তি নেই।

শনিবার, রবিবার, ছুটির দিন করে তিনি একা একাই আজকাল ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি, তাঁর বিতানের মতো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে সারাটা দিন প্রফেসনাল ট্রেনিং দিয়ে চলেছে, ফিজিক্যাল এবং মেন্টাল দুটোই, তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কেয়ার। কেয়ার মানে কিন্তু আদরের প্রশ্রয় নয়। তাঁরা যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এদের মধ্যেও একধরনের আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার। বেশ কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করার পর শুভময়ীদেবীর মনে হল, তিনি হয়তো ভুলই করেছেন, বিতানকে আরো আগেই এ ধরনের কোন প্রতিষ্ঠানে দিয়ে দিলে হয়তো ভালই হত। বিতান তার মতো আরো অনেকের সঙ্গে থাকতে থাকতে, এঁনাদের ট্রেনিং পেয়ে সুস্থ নিশ্চয়ই হয়ে উঠত না, কিন্তু এতটা রিপালসিভ না হয়ে, অনেক সোশাল হয়ে উঠতে পারত ওর নিজের মতো করে। হয়ে উঠতে পারত অনেক বেশি কমিউনিকেটিভ। আজকে বিতানকে নিয়ে যে নিত্যনতুন সমস্যা গড়ে উঠছে, হয়তো সেটা এড়ানো যেত। বেশ কয়েকটি জায়গায় ঘোরাঘুরি করে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রায় মনস্থির করে ফেললেন। পাকা কথা দেবার আগে বিতানের বাবার সঙ্গে কথা বলা জরুরি। এক রবিবার সকালে তিনি ফোন করলেন, “হ্যালো। কেমন আছ, কেমন? শরীর ঠিক আছে তো”?

“হুঁ। ঠিক আছে”।

“খাওয়া দাওয়ার কোন অসুবিধে নেই তো, স্পাইসি ফুড অ্যাভয়েড করবে, পারলে একদম খাবে না, সাবধানে থেক কিন্তু”।         

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। কোন অসুবিধে নেই”।

“ওষুধগুলো রেগুলার নিও, ভুলে যেও না।”।

“হুঁ, নোবো”। এত নিরুত্তাপ, সংক্ষিপ্ত জবাবের পর শুভময়ীদেবী আসল কথাটা কিভাবে বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। একবারের জন্যেও ওর কি জানার ইচ্ছে হয় না, কিংবা সামান্য কৌতূহলও হয় না, বিট্টু কেমন আছে! আমি কেমন আছি? তবুও বলতে তো তাঁকে হবেই। তিনি খুব দ্বিধার সঙ্গে আবার কথা বললেন, “শুনছ”?

“হুঁ”।

“তোমার “একান্ত সহায়” সোসাইটির কথা মনে আছে? ডাক্তার বাগচি যার কথা বার বার বলতেন”?

“আছে, কেন”?

“তুমি তো জান বিট্টুর কি কি প্রবলেম, ও মাঝে মাঝেই খুব অ্যাগ্রেসিভ হয়ে উঠছে। সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে আমাদের পক্ষে। ভাবছি, “একান্ত সহায়”তে বিট্টুকে এবার অ্যাডমিশন করিয়ে দেব।”।

“ভালোই তো”।

“তুমি কি বলছ, ওখানে দেওয়াটা ঠিক হবে”?

“আমার বলায় কি আসে যায়? যা ভালো বোঝো করো”। ব্যস এইটুকুই, ফোনটা কেটে গেল ওপ্রান্ত থেকে।

একজন পিতা কিভাবে এত শীতল হতে পারে, কিভাবেই বা থাকতে পারে এমন দায়িত্বহীন। শুভময়ীদেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মোবাইলের দিকে। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন নেক্সট মান্থের পয়লা তারিখেই তিনি বিট্টুকে অ্যাডমিশান করিয়ে দেবেন “একান্ত সহায়ে”। 



চলবে.....

শনিবার, ২৬ জুলাই, ২০২৫

সুরক্ষিতা - পর্ব ৯

 

 

 

ছবি দেখেছে, ব্যাপারটা হয়ে যাওয়ার পর, প্রত্যেকবারই তার মনে কেমন একটা যেন পাপবোধ আসে। আসলে খুব যে ভাল লাগে ব্যাপারটা তা মোটেই নয় – আবার মন্দও লাগে না। অনেকটা যেন নাছোড় নেশার মতো। নেশা করতে করতে মনে হয় আর কক্‌খনো করব না, কিন্তু আবার সময় এলেই মনে হয় - এইবারটাই শেষবার – এরপরে আর নয়। সত্যি বলতে সে মিঠুদিদিকে ঠিক এড়িয়ে যেতেও পারে না। তার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে এসে, চোখে চোখ রেখে, তার ঠোঁটে যখন মিঠুদিদি ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়, ছবির সব বাঁধন যেন আলগা হয়ে আসে। মিঠুদিদির হাতে নিজেকে তুলে দিয়ে ছবি তার সমস্ত শরীরে অনুভব করে এক অদ্ভূত আলোড়ন। তখন তার আর মনে থাকে না পাপবোধ, সংস্কার অথবা কোন সামাজিক নীতির ভ্রুকুটি।      

ছবি একটা ট্রেতে দুটো চায়ের কাপ আর দুটো বিস্কুট নিয়ে এল। মিঠুদিদির হাতে একটা চায়ের কাপ দিল – সামনে রাখল একটা প্লেটে দুটো বিস্কুট। মিঠুদিদির সামনে বসল নিজের চায়ের কাপটা নিয়ে, এটা অন্য ধরনের কাপ, অনেক সস্তা। সে জানে, যে সম্পর্কই গড়ে উঠুক না কেন মিঠুদিদির সঙ্গে, তাতে তার অবস্থানের কোন পরিবর্তন কোনদিন হবে নাওই সময়টুকু ছাড়া তার আর মিঠুদিদির মধ্যে যে দুস্তর ফারাক, সেটা মুছে যাবার নয়। আর যাই ভুলে যাক, ছবি এ ব্যাপারটা ভুলবে না কিছুতেই।

চায়ে চুমুক দিয়ে মিঠুদিদি আনমনে বলল, “সেই দিনটা আজও আমার ভীষণ মনে পড়ে, জানিস ছবি”?

“কোন দিনটা গো”?

“যেদিন তুই আর তোর মা আমাদের বাড়িতে এলি-সাতসকালে, মনে আছে”?

“বারে মনে থাকবে না কেন? তুমি চান করে স্কুল ড্রেস পরে খেতে বসছিলে আর আমরা ঢুকলাম”।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রতিষ্ঠা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল ছবির দিকে। প্রতিষ্ঠার এইভাবে তাকিয়ে দেখাতে ছবি একটু লজ্জা পেল, বলল, “কি দেকচ বলোতো? আর এত কি ভাবচো, সেই থেকে”?

ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসির একটা রেখা নিয়ে মিঠুদিদি বলল, “এই কলকাতায় তোর কতবছর হল, বলতো ছবিপ্রায় বছর ছয়েক, না? তুই আমাদের বাড়ি এসেছিলি যখন, একটা ছোট্ট পাখির মতো অসহায় ভিতু, আর কি ইনোসেন্ট ছিলি তুই। সো ইনোসেন্ট অ্যান্ড পিওর – আই জাস্ট কান্ট ইম্যাজিন। সে সময়ে আমিও বয়সে খুব একটা বড়ো ছিলাম না তোর থেকে। কিন্তু তবুও ফিল করেছিলাম আমার ক্লাসমেট বা চেনাজানা কোন মেয়ের  মধ্যে এমন ইনোসেন্স দেখিনি। জানিসনা ছবি, আর তোকে বুঝিয়ে বললেও তুই বুঝবি না। তোকে সেই দেখাটা আমার জীবনে কি এক অসম্ভব রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল”।

“বাব্বাঃদিদি, তুমি বরাবরই দেকেচি আমার সঙ্গে এমন শক্ত শক্ত সব কতা বলো - কেন বলো তো? তোমার সব কতার মানে বুজি না বটে - শুনতে কিন্তু বেশ লাগে”।

অধৈর্যে মাথা নাড়ল মিঠুদিদি, তার ছোট করে ছাঁটা বয়কাট চুলে ঝাঁকুনি তুলে বলল, “ওটাই তো তোর গ্রেটেস্ট প্রবলেম, ছবিকিংবা কে জানে ওই জন্যেই আমাকে তোর কাছে বার বার ফিরে আসতে হয় – এরপরেও আসতে হবে বারবার কিছুই বুঝিস না তুই। অথবা সব কিছু বুঝেও কোন এক অদৃশ্য সীমারেখা তুই টেনে রাখতে পারিস তোর চার দিকে। যার বাইরে তুই নিজে কোনদিন বের হবি না। এবং কাউকে ঢুকতেও দিবি না সেই ঘনিষ্ঠ গন্ডীর ভিতরে। না হলে এতদিন কলকাতার জীবনে অভ্যস্ত হতে হতেও, তুই সেই আগের মতোই রয়ে গেলি কী করে? কি করে তুই তোর আদুড় বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পারলি, তোর সেই ফেলে আসা গ্রাম-জীবনের মেঠো গন্ধ! শ্যাম্পু করা চুলের গভীরে শ্বাস নিলে কেন পাওয়া যায় বাসী নারকেল তেলের সোঁদা আঘ্রাণ! একটু থেমে ঘাড় ঝাঁকিয়ে মিঠু বলল, “মাই গড, আজকে জানিনা কেন বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়ছি...। আজ চলি রে, ছবি”

হঠাৎ করেই চেয়ার থেকে উঠে পড়ে, দরজার দিকে এগোলো মিঠুদিদিছবি খুব অবাক হল, মিঠুদিদির এই আকস্মিক ভাব পরিবর্তনে, পিছনে পিছনে দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, “ওই দ্যাকো, চা-টাও শেষ করলে না। একটা বিস্কুটও দাঁতে কাটলে না – দিদি, তুমি না সেই একই রকম খামখেয়ালি রয়ে গেলেআচ্ছা বেশ, সেই আসবেই যকন, “চলি” নয় - বলো “আসি”“ মিঠুদিদি ফিক করে হেসে ফেলল, খোলা দরজার বাইরে থেকে, ভিতরে দাঁড়ানো ছবির গালটা আলগা করে টিপে দিয়ে, বলল, “আদ্যিকালের পান্তি বুড়ি, আসি রে”

উজ্জ্বল হাসিমাখা মুখে ছবি বলল, “এসো। আবার আসবে কিন্তু, সময় পেলে”।


মিঠুদিদি হাসল, বলল, “তুই না ডাকলেও আসব, পুরুষরাই বুঝি আজীবন ডাকাতি করে যাবে মেয়েদের ওপর, আমিই বা কম কিসে, শুনি”? 


চলবে...


শুক্রবার, ১৮ জুলাই, ২০২৫

সুরক্ষিতা - পর্ব ৮

 

 

আজ কাজে যায়নি মালতী। শরীরটা ঠিক যুতে নেই। কাল ফেরার সময় ট্রেন থেকে নেমে গোটা রাস্তাটা বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছিল, আজ সকাল থেকে মাথা ভার, নাক দিয়ে জল ঝরছে, সারা গতরে ব্যথা। এইরকম ব্যথা হয়েছিল প্রথম কাজ করতে যাওয়ার পরদিন সকালে। সেদিনও ঘুম থেকে উঠে সারা শরীরে ভীষণ বেদনা অনুভব করেছিল মালতী। গোটা ডানহাত, বগল, কাঁধের চারপাশ, কোমর আর দাবনা দুটো মনে হচ্ছিল যন্ত্রণায় ভেঙে যাচ্ছে। সেদিন ভেবেছিল কাজে বের হবে না, কিন্তু বিমলামাসি ডাকতে এসে, জোর করে নিয়ে গিয়েছিল বলেছিল এ হল অতিরিক্ত কাজের জন্যে অনভ্যাসের ব্যথা, প্রথম প্রথম কদিন এমন হয়।  ওই ব্যথা নিয়ে ঘরে শুয়ে থাকলে আরো বাড়বে। আজকে কষ্ট হবে কাজ করতে, কিন্তু ব্যথার উপশম হবে তাড়াতাড়ি। সত্যি, সেদিন বিকেলে কাজ সেরে ফেরার পরে তার গতরের ব্যথাটা ছিল, কিন্তু তেমন কিছু নয়।

কিন্তু আজ কাজে বেরোনোর সময় বিমলামাসি তার শরীর খারাপ শুনে বলল, “বাদলার জলে একটু ঠান্ডা লেগেচে, শুয়ে থাক, ভাল হয়ে যাবে। তাছাড়া মাজে মাজে বাবুদের বাড়ি কামাই না দিলে, দাম থাকে না...।”

 

বিমলামাসি বেরিয়ে যাওয়ার পরে, মালতী মুখটুক ধুয়ে এক গেলাস চা বানিয়ে বসল ঘরের দোরগোড়ায়। আজও আকাশ ভারি হয়ে আছে। বৃষ্টি হচ্ছে না, কিন্তু শুরু হতে কতক্ষণ! দিন কয়েক আগের আর কালকের বর্ষাতে বিমলামাসির ঘরের সামনের জমিটুকু সবুজ ফন্‌ফনে সতেজ আগাছায় ভরে উঠেছে।

তার স্বামী হলধর পোল্লের দূর কোন এক সম্পর্কের মাসি হয় এই বিমলামাসিঅল্প বয়সে বিধবা। কমবয়সে এদিক সেদিক নাকি বদনাম রটেছিল। তাই হলধর পোল্লে এক পাড়াতে থাকলেও এই মাসির খোঁজখবর তেমন রাখত না। বিমলামাসিও বোনপোর মন বুঝে, গায়ে পড়ে বেশি মাখামাখি দেখাত না। তবে হলধরের মৃত্যুর খবর পেয়ে যেভাবে দৌড়ে এসেছিল। এবং তারপর থেকে বুকে করে তাকে আর তার মেয়ে ছবিকে যে ভাবে আগলে রেখেছে। সর্বদা সঠিক দিশা দেখিয়েছে। তাতে মালতী ভাবে, যৌবনের এক আধটা ভুল মানুষের চরিত্রকে কিছুতেই পালটে দিতে পারে না। নিঃসন্তান, সঙ্গীহীন মেয়েমানুষটা, তার মতোই – কিংবা তার থেকেও বড়ো দুখী। তার তো তাও একটা অবলম্বন আছে, ছবি। কিন্তু বিমলামাসির? কেউ নেই। বিমলামাসি, তাকে আর তার মেয়েকে সত্যি বড় ভালোবাসে।

বিমলামাসিই তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল, তাদের ভাড়ার বাসাটা ছেড়ে এইখানে চলে আসতে। ছবি নেই। মালতী বেরিয়ে যায় সেই সক্কালবেলায়, ফেরে রাত্রে। কি দরকার মাস মাস বাসার ভাড়া গুণে? বিমলামাসির একটা ঘর তো খালি পড়েই আছে, মালতী চলে এলে ঘরটারও সুরাহা হয়, আর মাস মাস বাসাভাড়ার টাকাটাও সাশ্রয় হয়। মালতী ভেবে দেখেছিল, প্রস্তাবটা মন্দ নয়, বেশ ভালই। তার মনে একটু কিন্তু কিন্তু ছিল, সে বিমলামাসিকে মাসে মাসে কিছু টাকা ভাড়া বাবদ ধরে দেবার কথা বলেছিল, কিন্তু বিমলামাসি আমল দেয়নি। মালতী বার বার বলাতে উত্তর দিয়েছিল- -“তোর যকন এতই সংকোচ, ও টাকাটা আমার নামে রেকারিনে ব্যাংকে ফেলে রাক, ছবির বে’তে ওটাই ধর আমি ওকে দেলাম”।

এই ছয়-সাত বছরে মালতী এখন অনেকটাই থিতু। মহাজনের পঞ্চাশ হাজার বেড়ে চলেছে। যদিও মালতীর নিজের রোজগারের অনেকটাই ব্যয় হয়ে যায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষে, ট্রেনে যাওয়া আসা, খাওয়া দাওয়া, জামা কাপড়, দায়-বিপদ সারতে। তবে সবচেয়ে যেটা নিশ্চিন্তের কথা সেটা হচ্ছে ছবির মাইনে, ছবি এখন সাড়ে পাঁচ হাজার পায়, আর তার পুরোটাই প্রায় সঞ্চয় হয়ে চলেছে ব্যাংকে। ছবির অন্য খরচ মাস্টারদিদিই সব দিয়ে দেন। তেল, সাবান, মুখে মাখার ক্রিম-টিম সব। পুজোর সময় তো বটেই, তা ছাড়াও জামা-কাপড়ও কিনে দেন দরকার মতো।

নিজের মেয়েকে যতো দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে মালতী। বিশ্বাসই হয় না, তার সেই ছোট্ট মেয়েটা কিভাবে এত তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে উঠল, বিশাল বটবৃক্ষের মতো। মাঝে মাঝে মনে হয় তার মেয়েটা কি পাথর হয়ে গেছে? চরম স্বার্থপর আর নিষ্ঠুর? তাদের এই লাইনে অন্যান্য কাজ করা মেয়েদের মতো? মালতী এত দুঃখের মধ্যেও কিছুতেই ভুলতে পারে না, সে চাষী ঘরের মেয়ে। বেঁচে থাকার জন্যে প্রতি নিয়ত লড়তে লড়তেও সে ভুলে যায়নি তার মূল্যবোধ – তার মায়া, মমতা আর আবেগ।

ছবি যেদিন প্রথম মিঠুদের বাড়িতে কাজে লাগল, মালতী আশা করেছিল ছবি খুব কান্নাকাটি করবে। বাড়ি ফেরার জন্যে বায়না করবে। ছবিকে সামলাবে কিভাবে সেই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই মালতী সেদিন বিকেলে বিমলামাসির সঙ্গে ওদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। কিন্তু মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল মালতী। কোন কান্না নেই। মুখখানি একটু ম্লান ঠিকই, কিন্তু ঠোঁটের অদ্ভূত মায়াবী হাসিটুকু তার চোখ এড়ায়নি। তবে কি ছবি তার পর হয়ে গেল? মায়ের ওপর তীব্র অভিমানে? বাবা মারা যাবার কয়েকমাসের মধ্যেই বাপ-সোহাগী মেয়েকে ইস্কুল ছাড়িয়ে, নিজেদের ঘর-বাড়ি ছাড়িয়ে, পরের ঘরে কাজে লাগানোর জন্যে? সেদিন ফেরার সময় সারাটা পথ, ঘরে ফিরে সারাটা রাত কেঁদেছিল মালতী – “আমি কি জেনে শুনে সাধ করে তোরে কাজে লাগিয়েচি, মা রে? কি করব বল দিকি....”?

বিমলামাসি তাকে অনেক বুঝিয়েছিল –“মিঠু প্রায় ওর সমবয়সী - বছর দুয়েকের বড়ো হয়তো, বন্ধুর মতো। মিঠুর মাও লোক খুব ভাল, তবে ওর বাপটা শুনেচি খুব খিটকেল ধরনের - সন্দেহবাতিক মেনিমুখো ব্যাটাছেলে। কারোর সঙ্গেই তার বনে না। তা ওর বাবা তো সারাটা দিন থাকেও না বাড়িতে। কাজেই ছবিমার যদি ওখানে মন বসেই যায়, তার জন্যে এত দুক্কু করছিস কেন, বল দিকি মালতী”? মনকে বুঝিয়েছিল মালতী, সত্যি তাই যেন হয়, তার সেই এক রত্তি মেয়েটা যেন মায়া মমতা সব খুইয়ে স্বার্থপর হয়ে পাথর না বনে যায়।

মাস্টারদিদির বাড়িতেই মালতী প্রথম কাজে লেগেছিল, ঘরদোর মোছা, থালা-বাসন ধোওয়া। মাস্টারদিদি মানুষ ভাল। শান্ত মানুষ। কোন রাগারাগি, চেঁচামেচি নেই। তবে বড় দুঃখী। মালতী ভাবে নানান মানুষের নানান দুঃখ। তার নিজের একরকম দুঃখ। মিঠুর মায়ের একরকম দুঃখ। আবার দেখ, এই মাস্টারদিদি, কত বড় ইস্কুলে কত কত মেয়েকে ন্যাকাপড়া শেকায়, তারও কি না দুঃখ? অমন সোনার মতো দেখতে একমাত্র ছেলে, সে কেমন যেন ব্যাঁকাট্যারা, অষ্টাবক্রকথা বলতে পারে না। চলতে পারে না। বিছানায় উঠে বসতে পারে না। এক গেলাস জল খাবারও তার সাধ্যি নেই। মাস্টারদিদি মালতীকে অনেকবারই বলেছিল একটা ভাল মেয়ে দেখে দেবার জন্যে, যে সারাক্ষণ ও বাড়িতেই থাকবে আর ওঁর ছেলে বিট্টুর দেখাশোনা করবে। ছবির কথা যে মালতীর মনে হয়নি তা নয়, কিন্তু সে কথা মনে স্থান দেয়নি মালতী। কারণ ছবি তার মিঠুদিদির সঙ্গে ভালোই আছে। তাছাড়া তার মনে হয়েছিল, এই বাড়িতে থেকে সারাক্ষণ ওই ছেলের সেবা করতে করতে আর তার হাগা-মোতা সামলাতে সামলাতে, তার ছবির মনটাও পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। মালতী কোনভাবেই চায় না, তার ছবি সারাটা জীবন পরের বাড়ি খেটে খাক। একটু টাকাকড়ি জমলেই, ভালো চাকরি-বাকরি করা ছেলে দেখে ছবির বিয়ে দিয়ে দেবে মালতী। ব্যস, তারপর ছবি আর সব ছেড়ে নিজের সংসার করুক গুছিয়ে। যেমনটা মালতী নিজে পেয়েছিল, কিন্তু ভাগ্য তাকে ভোগ করতে দেয়নি!

মালতী ভেবেছিল একরকম, কিন্তু হয়ে গেল অন্যরকম। মিঠুর সঙ্গে এক বিকেলে ছবি গিয়ে কি জাদু দেখাল কে জানে, মাস্টারদিদি একদম নাছোড় হয়ে গেলেন। মাস্টারদিদি প্রথমে কথা বলেছিল মালতীর সঙ্গেই। মালতী এড়িয়ে গিয়েছিল। মাস্টারদিদি হাল ছাড়েননি, নিজে গিয়ে মিঠুর মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। মিঠুর মা নিমরাজি হয়েছিলেন। মালতীর মতোই তাঁরও দৃঢ় ধারণা ছিল, তাঁর সঙ্গে এবং বিশেষ করে মিঠুর সঙ্গে ছবির যা সম্পর্ক তাতে ছবি নিশ্চয়ই যেতে চাইবে না

কিন্তু ছবির কাছে কথাটা যখন বলা হল, সবাইকে অবাক করে দিল ছবি, এক কথায় রাজি হয়ে গেল কাজটা করতে। সে কি শুধু টাকার জন্যে? মিঠুদের বাড়িতে ছবির মাইনে ছিল বারোশ টাকা, থাকা-খাওয়া ফ্রি আর পুজোয় জামা কাপড়। মাস্টারদিদি বলেছিল সাড়ে তিন হাজার, থাকা-খাওয়া, তেল সাবান ফ্রি, পুজোয় জামাকাপড়। বাড়তি তেইশশ’ টাকার জন্যেই কি ছবি এমনটা করল? মাসে মাসে এতগুলো টাকা বেড়ে যাওয়া তাদের জীবনে ভীষণ বড় ব্যাপার, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবু মালতীর পছন্দ হয়নি ব্যাপারটা। ছবি টাকাটাই দেখল? একবারও ভাবল না, মিঠু আর মিঠুর মায়ের ভালোবাসার কথা? একবারও ভাবল না, তার কাজটা কি হবে, একটা অসুস্থ – বিকলাঙ্গ ছেলের সর্বদা সেবা করে যাওয়া সারাটা দিন। কোন সঙ্গী নেই - সাথী নেই, কোন বৈচিত্র্য নেই, একঘেয়ে বিরক্তিকর কাজ।

ছবির এই সিদ্ধান্ত মালতীকে ভীষণ দ্বিধায় রেখেছে আজও। একদিকে বাড়তি এতগুলি টাকার সঞ্চয়, তাদের দিয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা। সেদিক থেকে ভাবলে ছবি হয়তো ঠিক করেছেকিন্তু অন্যদিকে মিঠুদের আন্তরিক ভালোবাসা আর সুস্থ জীবন ছেড়ে, অসুস্থ জীবনের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া, মালতীর মনে হয় মিঠুদের সঙ্গে ভীষণ বড়ো অবিশ্বাসের কাজ হয়েছে এটা। মিঠু এতদিন পরে আজও, প্রায়ই আসে ছবির কাছে। বেশ কয়েকবার দেখাও হয়েছে মালতীর সঙ্গে মাস্টারদিদির বাড়িতে। সে তো শুধু ভালোবাসার টানেই না কি? ছবি কি কিছুটা হলেও অকৃতজ্ঞ নয়, মিঠুদের কাছে?

ঘরের ভেতর থেকে মোবাইলটা বেজে উঠল। ফোনটা কিনে দিয়েছিল ছবি। ফুরিয়ে যাওয়া চায়ের গ্লাসের কানায় বসে থাকা মাছিদের তাড়িয়ে মালতী উঠল। মেঘলা দিনে বেলা বোঝা যাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে আকাশ-পাতাল ভাবনায়। ফোনটা হাতে নিয়ে, পর্দার আঁকিবুকি দেখে সে বুঝল ছবির ফোন, সবুজ সুইচ টিপে কানে নিল ফোনটা, “বল”।

“মা, কোথায় তুমি? আজ কাজে আসনি”?

“না রে সকালে শরীর খারাপ লাগতেসিল – তাই আর যাইনি”

“কি হয়েছে? জ্বর”?

“জ্বর নয়, তবে ওরকমই, জ্বর-জ্বর ভাব, মাথা ভার, গায়ে ব্যাতা”

“তুমি দিদুর সাথে চলে এলে না কেন, আমার কাছে? বিশ্রাম হতো। দরকার হলে ডাক্তারও দেখিয়ে নেওয়া যেত”

    “ধুর, তেমন কিছু নয় রে, আজ একটু আরাম করলেই সেরে যাবে”

“কিছু খেয়েছ, সকাল থেকে? রান্নাবান্না কিছু করেছ”?

“চা খেয়েচি। আর এই তো রান্না চাপাব ...”

“আমি জানি তো। এখন কটা বাজছে বলো তো, পৌনে একটা। সকাল থেকে কিছু খাওনি, এখনো রান্না করোনি...নিশ্চই দরজায় বসে আবোল-তাবোল ভাবছিলে। এর জন্যেই তোমাকে বলছিলাম, মা, তুমি আমার কাছে চলে এলে না কেন? না খেলে শরীর খারাপ তো আরো বাড়বে ...মা, শুনচ?

“শুনচি রে, মা শুনচি। তুই কি আমাকে দেখতে পাচ্চিস নাকি, বলতো? এতক্ষণ কি করচি না করচি সব তুই বুজে ফেললি...”

“আমি কি তোমায় চিনি না ভাবচো? একা একা ঘরে তুমি কী করবে আমি জানি না? শরীর খারাপ বলে চুপচাপ শুয়ে কাটাবে তুমি? ওসব কতা রাকো, তুমি এখন উটে যা হোক কিচু একটু ফুটিয়ে নাও। আবার পুকুরে নাইতে যেও না যেন। বাদলার জলে শরীর আরো ধরে নেবে। বালতির তোলা জলে গাটা ধুয়ে নিও...এই অবেলায় মাতা ভিজিও না মোটেই, চুল শুকোবে না, বিপদ আরো বাড়বে”

“বেশি বকিস না, ছবি। অবাক করলি বটে, আমি তোকে পেটে ধরেছিলাম, না তুই আমাকে? এমন করচিস, জ্বর যেন আর কারো হয় না। তোর সব কাজ হয়ে গেচে? খাওয়াদাওয়া সেরেচিস”?

“হুঁ, কাজ সেরে, বিট্টুকে খাবার খাইয়ে এই ওষুধ খাওয়ালাম, ও ঘুমোচ্চে। আজ তুমি এলে না দেকে, তোমাকে ফোন করলাম। তোমার জন্যে একটু সুজির হালুয়া আর হরলিক্স বানিয়ে রেকেচিলাম, সেটা আমাকেই একন গিলতে হবে, দুপুরে ওই খেয়ে নোব, ব্যস। কাল কিন্তু শরীর খারাপ লাগলেও চলে আসবে দিদুর সঙ্গেবুজেচ? একন যাও যা বললাম করো, উটে কিচু মুকে দাও”।

“আমাকে উপদেশ ঝাড়ছিস আর নিজে খাবি সুজি আর হরলিক, সোমত্ত মেয়ে ওই খেয়ে তোর পেট পুরবে?

“আচ্ছা, আচ্ছা, এ পোড়া পেট কিসে পুরবে আমার চে তুমি না হয় ঢের বেশীই জান, আমি কিন্তু আবার ফোন করব, আর মিচে কতা বললে ঠিক ধরে ফেলব...হাসল ছবি...একন রাকচি”।

মালতীর ঠোঁটে হাল্কা হাসি, দুচোখে মায়ার আলো, মালতীর খুব ইচ্ছে হচ্ছে এই মূহুর্তে ছবির চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেতে, মালতীর চোখে জল ভরে উঠলমালতী শব্দহীন মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল – চান খাওয়া না করলে এই মেয়ে তাকে ছাড়বে না


চলবে...

শুক্রবার, ১১ জুলাই, ২০২৫

সুরক্ষিতা - পর্ব ৭

 

শুভময়ীদেবী নজর রাখছিলেন প্রতিষ্ঠার ওপর। কারণ হাফইয়ার্লিতে অংকের খাতা দেখতে গিয়েই তিনি টের পেয়েছিলেন, এই মেয়ে অংকে ডুববে। অন্যান্য সাবজেক্টের ডিটেল নম্বর তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, নেহাত মন্দ নয়, ভালোভাবেই উৎরে যাবে। কিন্তু অংকে বেশ বিপদ আছে। একই আবাসনে থাকার দরুণ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর স্কুলের বাইরেও দেখা হয় মাঝে মধ্যেই, তাতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি না হলেও, সৌজন্য সম্পর্ক একটা তৈরি হয়েইছিল। কাজেই, হাফইয়ার্লির পরে তিনি প্রতিষ্ঠাকে নিজের ঘরে ডেকে বলেছিলেন, “প্রতিষ্ঠা, তোমাকে ডেকেছিলাম, তোমার অংকের নাম্বারের জন্যে”।

প্রতিষ্ঠা শ্রাগ করে বলেছিল, “হ্যাঁ, ম্যাম, আপনার হাত থেকে নম্বর বের করতে পারিনি”। হেসে ফেলে শুভময়ীদেবী বলেছিলেন, “কী বলছ কি প্রতিষ্ঠা, তোমার কি ধারণা, আমি ইচ্ছে করে তোমায় নাম্বার দিইনি? সিলি মিস্টেকস, স্টেপ-জাম্পস, লট অফ আনঅ্যাটেম্পটেড সাম্‌স্‌, তোমাকে নম্বরটা দিই কোথায় বলো তো? বি সিরিয়াস, প্রতিষ্ঠা, আর ক’মাস পর মাধ্যমিক পরীক্ষার এক্সটার্নাল এক্সামিনার কিন্তু তোমাকে পার্সোনালি চিনবেন না। আমি যেটুকু মার্কস দিয়েছি, সেটাও পাবে কিনা আমার সন্দেহ আছে”একটু থেমে আবার বললেন, “আমি কিন্তু তোমাকে ভয় দেখাতে বা ওয়ার্ন করার জন্যে ডাকিনি, প্রতিষ্ঠা। আমি বলতে চাইছি, অন্য সাবজেক্টে তুমি মাচ বেটার পজিসনে আছ, মে বি, অংকটা ইজ নট ইয়োর কাপ অফ টি, বাট, অংকর জন্যে টোটাল রেজাল্টটা খুব খারাপ করে ফেলাটাও কিন্তু কোন কাজের কথা নয়”

“ম্যাম, আমি কিন্তু চা খাই না”। প্রতিষ্ঠা মিচকে হেসে উত্তর দিয়েছিল। শুভময়ীদেবী অবাক হয়েছিলেন, তাঁর সিরিয়াস কথার উত্তরে প্রতিষ্ঠার এরকম বাচাল উত্তরে আর হাসিতে।

তিনি ধৈর্য হারাননি, মৃদু হেসে বলেছিলেন, “এনিওয়ে, প্রতিষ্ঠা, আমার উপদেশ তোমার ভাল নাও লাগতে পারেবাট অ্যাজ ইয়োর টিচার, আই কান্ট শ্রাগ অফ মাই রেসপনসিবিলিটি। তাই বলছিলাম, বি সিরিয়াস অ্যাবাউট ইট, অ্যান্ড ট্রাই হার্ড টু ইমপ্রুভ ইয়োরসেল্‌ফ। ইফ ইউ থিংক ইউ নিড মাই হেল্প, এনি টাইম, ইন দি স্কুল অর অ্যাট মাই হোম, ইউ আর ওয়েলকাম। আমি কিন্তু খুব সিরিয়াসলি বলছি, প্রতিষ্ঠা, আমি রিয়্যালি উইলিং টু হেল্প ইউ আউট -”

প্রতিষ্ঠা মুখ নীচু করে কথাগুলো শুনছিল, শুভময়ীদেবীর কথা শেষ হতে বলল, “ঠিক আছে, ম্যাম, থ্যাংকস আ লট। আমি আরেকবার চেষ্টা করে দেখি, আদারওয়াইজ আই ডেফিনিটলি উইল কামডাউন টু ইউ। লেট মি হ্যাভ অ্যানাদার চ্যান্স, ম্যাম”।

“ওকে, প্রতিষ্ঠা, আই রিয়্যালি লাইক ইয়োর স্পিরিট। বাট, আরেকটা কথা বলে দিই, অংকের দিকে একটু বেশি নজর দাও, কিন্তু এতটাও বেশি কন্‌সেন্‌ট্রেট করে ফেল না, যাতে অন্য সাবজেক্টগুলোর প্রিপেরেসান অ্যাফেক্টেড হয়। কি বলতে চাইছি, আশা করি বুঝেছ, আর খুব বেশি সময় নেই, নাউ ইউ নিড এ ব্যালান্স্‌ড্‌ স্টাডি”। কোন কথা বলেনি প্রতিষ্ঠা, মাথা নেড়ে উঠে পড়েছিল, শুভময়ী আন্টির সামনে থেকে।

প্রতিষ্ঠা চেষ্টা যে করেনি, তা নয়, কিন্তু অংকে খুব একটা উন্নতি করতে পারল না এবং সেটা ধরা পড়ল টেস্টের রেজাল্টে। আর তিন-সাড়ে তিন মাস পরেই ফাইন্যাল, প্রতিষ্ঠা এবার সত্যি খুব নার্ভাস ফিল করল, কারণ এই সাবজেক্টটা কিছুতেই তার আয়ত্তে আসছে না। পরীক্ষা হলের বাইরে সে কন্‌ফিডেন্ট, কিন্তু কোয়েশ্চেনস পাওয়ার পর, খাতায় অংক শুরু করলেই মনে হচ্ছে, ঠিক করছি তো? এ অংকটা এভাবেই সল্‌ভ্‌ করেছিলাম কি? কনফিউস্‌ড্‌ হয়ে যাচ্ছে বারবার, অংক মিলছে না, সময় নষ্ট হচ্ছে, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আরো বেশী ভুল হচ্ছে প্রসিডিয়রে। কাজেই এবার আর সে জিদ করল না, শুভময়ীদেবীর পরামর্শে শুভময়ীদেবীর ফ্ল্যাটে যাওয়া শুরু করল।

শুভময়ীদেবীর স্কুল শনিবারে হাফ আর রোববার পুরো ছুটি থাকে। প্রথমদিন শনিবার বিকেলে প্রতিষ্ঠা শুভময়ীদেবীর ফ্ল্যাটে গেল, সঙ্গে ছিল ছবি। ছবিকে সঙ্গী করার কোন দরকার ছিল না, প্রতিষ্ঠা চায়ওনি ছবি তার সঙ্গী হোক। কিন্তু প্রতিষ্ঠার মা একরকম জোর করেই ছবিকে সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন। সেদিন বসার ঘরের সোফায় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে বসে শুভময়ীদেবী বললেন, “প্রতিষ্ঠা, আমরা কিন্তু এখন নতুন আর কিচ্ছু শিখব না। তার আর সময় নেই। বরং আমরা যেটুকু জানি, সেটুকুই বারবার প্র্যাকটিস করব। বারবার। যাতে তার মধ্যে কোন ভুল আর না হয়। ব্যস্‌, এইটুকু যদি তুমি খুব সিনসিয়ারলি করো, তুমি লেটার পাবে না ঠিকই, কিন্তু যথেষ্ট ভাল মার্কস পেয়ে যাবে, সেটুকুই এখন আমাদের লক্ষ্য, তাই না?

প্রতিষ্ঠা ঘাড় নেড়ে সায় জানাতে, শুভময়ীদেবী আবার বললেন, “ভেরি গুড। আমার কাজ হচ্ছে, তোমাকে গাইড করা, আর তোমার প্র্যাকটিসটাকে মনিটর করা। আমি বলছি তোমাকে প্রতিষ্ঠা, যে কটা দিন এখনো বাকি আছে ফাইন্যালের, একটু খাটলে আমরা ভালই রেজাল্ট করব। সো নাউ লেট আস স্টার্ট অ্যাফ্রেস, ফরগেটিং দ্য পাস্ট”

ছবি এতক্ষণ খুব মন দিয়ে শুনছিল শুভময়ীদেবীর কথা। তাঁর সবকথা না বুঝলেও, তাঁর চেহারা, ব্যক্তিত্ব আর সহৃদয় ব্যবহার ছবির ভীষণ ভালো লাগল। সে বসার ঘরের মেঝেয় বসে ভাবতে লাগল তার ফেলে আসা অসম্পূর্ণ ইস্কুল জীবনের কথা, আর দেখতে লাগল এই ঘর, তার সাজ-সজ্জা।                 

মিঠুদিদিদের থেকে এই ফ্ল্যাটটা বেশ অন্যরকম। সদর দিয়ে ঢুকেই এই বসার ঘর। তার বাঁদিকে সামনের সোফায় বসে ছোট টেবিলে নিচু হয়ে মিঠুদিদি অংক কষছে। মিঠুদিদির দিদিমণি বসে আছেন মিঠুদিদির পাশেই। ছবি যেদিকে বসে আছে তার ডানদিকে একটা পর্দা ঢাকা দরজা। পাখার হাওয়ায় অল্প দুলছে। দরজার পরে ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত বইয়ে ভরা কাঠের দেওয়াল আলমারি। কাঁচের পাল্লা দিয়ে ঢাকা। কত বই, কত বই। এই সঅঅব বই পড়ে ফেলেছেন মিঠুদিদির দিদিমণি! এত বই না পড়লে বুঝি দিদিমণি হওয়া যায় না? খাওয়ার টেবিলের পিছনে আরেকটা খোলা দরজা, বাইরে বারান্দা। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে ছবির একঘেয়ে লাগছিল, ভাবছিল বারান্দায় যাবে কিনা। মিঠুদিদির দিদিমণি কি কিছু বলবেন, সে যদি উঠে এখন বারান্দায় যায়? ছবি একবার তাকাল ওদের দিকে, দুজনেরই খুব গম্ভীর মুখ, মিঠুদিদি লিখছে আর দিদিমণি দেখছেন খাতার দিকে।

বারান্দার দিকে যাওয়ার জন্যে ছবি নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াতে, কেউ একজন অদ্ভূত স্বরে চেঁচাল, কি বলল বোঝা গেল না। ভয় পেয়ে ছবি মিঠুদিদি আর দিদিমণির দিকে তাকাল। নাঃ, ওরা তো তাকে লক্ষ্যও করেনি, আর আওয়াজটা এসেছে তার ডান দিকের ঘর থেকে, যার দরজায় পর্দা দুলছে। ভয় পেয়ে ছবি আবার একই জায়গায় বসে পড়লকিন্তু বসার পরেও আওয়াজটা আবার এল,

“অ্যা...ও...ও....ও..অ্যা...ও...ও....ও..। অ্যা...ও...ও....ও..”।

ছবি ভয় পেল ঠিকই, কিন্তু কৌতূহলও হল, কে এভাবে চেঁচাচ্ছে? সে আবার তাকাল, মিঠুদিদি আর দিদিমণি একইভাবে খাতার ওপর ঝুঁকে আছে, ওরা শুনতে পায়নি। ছবি ঝুঁকে বসে পর্দাটা একটু ফাঁক করে ঘরের ভিতরে তাকাল। একটা ছেলে খাটে শুয়ে, ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকেই তাকিয়ে আছে। ছবির সঙ্গে চোখাচোখি হতে, ছেলেটা বীভৎস মুখ করল। তারপর খুব চেষ্টা করতে লাগল উঠে বসার। পারছিল না, হাতে ভর দিয়ে কোমর থেকে ওপরের শরীরটা একটু তুলছিল, কিন্তু বারবার হড়কে যাচ্ছিল হাতদুটো। ছবি লক্ষ্য করল, ছেলেটার হাত আর পা দুটো ভীষণ সরু, শক্তিহীন, কেমন যেন নিয়ন্ত্রণহীন এলোমেলো। উঠে বসার চেষ্টায় ছেলেটার মুখ আরো বিকৃত আর বীভৎস হয়ে উঠছিল বারবার।

ছবি এমন কোনদিন দেখেনি। কিন্তু এটুকু বুঝল ছেলেটা অসহায়। কথা বলতে পারে না। বিছানায় উঠে বসার সাধ্যটুকুও নেইহাত-পা-মুখ চোখ কোন কিছুই তার স্বাভাবিক নয়। কত বয়েস হবে ছেলেটার? এটা কী অসুখ? কোনদিন কি এ অসুখ সারবে? এই ছেলেটা কি কোনদিন পারবে স্বাভাবিক হেঁটে চলে বেড়াতে, কথা বলতে? ছবি উঠে দাঁড়াল, পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল, ছেলেটার একটা হাত আর পিঠে সাপোর্ট দিয়ে বসিয়ে দিল বিছানায়। ছেলেটা আগের মতোই মুখ বিকৃত করল, যেন মুখ ভেঙাল। কিন্তু ছবি বুঝতে পারল, ছেলেটা মোটেই মুখ ভেঙাচ্ছে না, তার মুখটা ওরকমই বেঁকে যায়। বসে থাকতে থাকতেই ছেলেটা আবার পিছন দিকে হেলে পড়ছিল, অসহায় হাতে ভর দিয়ে বসে থাকতে চাইছিল ছেলেটা, কিন্তু পারছিল না। ছবি আবার সোজা করে বসিয়ে দিল, তারপর ছেলেটার পিছনে দুটো বালিশ সাজিয়ে দিল, যাতে আর পড়ে না যায়।

ছেলেটাকে বসানোর সময় একটা হাত ধরেছিল ছবি, কি কঠিন সেই হাত। বিছানায় বসিয়ে দেওয়ার পর, ছেলেটা ছবির হাতে হাত রেখেছিল, তার হাতের তালুটাও অসম্ভব শক্ত আর নিষ্ঠুর মনে হল তার। এই হাত এই শরীর কোন মানুষের নয় যেন। প্রত্যেকটি মানুষেরই শরীরের স্পর্শে কোন না কোন ভাষা সঞ্চারিত হয় অন্য শরীরে। সে ভাষা ভাল হতে পারে, মন্দ হতে পারে। ভালবাসার হতে পারে, হতে পারে ঘৃণার বা ক্রোধের। কিন্তু এ ছেলের শরীর একদম বোবা, নির্বিকার, পাথরের মতো কঠিন, ভাবলেশহীন। ছবি ছেলেটাকে খুব মন দিয়ে দেখছিল, হঠাৎ ছেলেটা আগের মতোই আওয়াজ করল, “অ্যা...ও...ও....ও..”।

ছবি ওর মুখের দিকে তাকাল। হাত, ঘাড়, চোখ ঘুরিয়ে কিছু একটা বোঝাতে চাইছে তাকে, কি? কী চাইছে ছেলেটা? আশেপাশে তাকা ছবি, বিছানার মাথার দিকে একটা ছোট টেবিলে জলের বোতল আর গ্লাস। একটা খেলনা, ট্যামটেমি, ঘোরালে আওয়াজ করে। বেশ কিছু ওষুধের ফয়েল, দুটো শিশি। একটা রুমালের মতো কাপড়...।

ছবি ট্যামটেমিটা বাজাল। ক্যারক্যারক্যার...। ছেলেটা খুব জোরে ঘাড় ঝাঁকাল, বলল, “অ্যা...ও...ও....ও..”।

তার মানে এটা চাইছে না। ছবি জলের গ্লাস আর বোতল দেখাল, ছেলেটা বলল, “অ্যা...ও....অ্যা...ও...”

ছবির মনে হল, জল খেতেই চাইছে। গেলাসে জল ঢালল- আদ্দেকটা, গেলাসটা নিয়ে কাছে যেতে ছেলেটা হাত বাড়াল না, গলা বাড়িয়ে ঠোঁটের এমন একটা ভঙ্গি করল, ছবি বুঝতে পারল, জলটা খাইয়ে দিতে হবে। গেলাসটা ঠোঁটের কাছে ধরতে ছেলেটা গেলাসে মুখ নিয়ে জল খেতে লাগল। জলে চুমুক দিতে আওয়াজ হচ্ছিল, ঢোঁক গিলতেও আওয়াজ হচ্ছিল, আর গলার হাড়টা বারবার ওঠানামা করছিল জল ঢোঁক গেলার সময়। ওইটুকু জল খেতে কতক্ষণ সময় নিল ছেলেটা! ছবি একদৃষ্টিতে দেখছিল ছেলেটাকে, কি অসহায় এই ছোট্ট জীবনটা। ভীষণ মায়ায় তার চোখে জল এসে গেল, জল খাওয়া হতে রুমালটা দিয়ে ছেলেটার মুখ মুছে দিল ছবি। ছেলেটা আবার মুখ বেঁকিয়ে ভীষণ করে তুলল নিজেকে, এটাই কি ছেলেটার হাসি?

বাঃ, কি সুন্দর ওকে বসিয়ে দিয়েছিস, জলও খাওয়ালি! তোর নাম কি রে”?

ছবির পিছনে দিদিমণি কথা বললেন, ট্যামটেমির আওয়াজ পেয়ে তিনি এ ঘরে ঢুকেছিলেন, কিছু বলেননি। দেখছিলেন ছবিকে। সংকোচে আর ভয়ে ছবি সরে এল, বলল, “ছবি, ছবি পোল্লে”।

“পোল্লে? তুই কি মালতীর মেয়ে নাকি”? ছবি ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

“তোর কথা তোর মা খুব বলে, তুই নাকি সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিস? তুই প্রতিষ্ঠাদের বাড়িতে থাকিস”? ছবি মুখ নীচু করে রইল।

“বিট্টু হাসছে বিট্টু কতদিন পরে হাসছে, তুই জানিস না রে, ছবি...”! সদাশান্ত শুভময়ীদেবীরও কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল।


চলবে...

রবিবার, ৬ জুলাই, ২০২৫

সুরক্ষিতা - পর্ব ৬

 

প্রতিষ্ঠা স্কুল যাবে বলে রেডি হচ্ছিল, তাই ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিল। বিমলামাসি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল মালতী আর ছবিকে নিয়ে। মালতীর হাতে একটা পুরোনো ব্যাগ। বিমলামাসি ঘরে ঢুকে বলল, “অ বউদি, এই লাও, তোমারে বলেচিলাম, এই সেই মেয়ে, আর এই হতেচে মেয়ের মা, মালতী বুজে শুনে লাও, বউদি, আমারে তাড়াতাড়ি ছাড়, আমারে আবার ওর মারে লয়ে যেতে হবে কাজের বাড়ি চেনাতে...”।

প্রতিষ্ঠা টেবিলে বসে খাচ্ছিল আর প্রতিষ্ঠার মা পাশের চেয়ারে বসেছিলেন। তাঁকে খুব সুস্থ নয় মনে হল, ম্লান হেসে বললেন, “ওমা, বেশ মেয়ে তো। কি নাম রে তোর”?

“ছবি, ছবি পোল্লে”। ছবি দেখছিল ঘরদোর। খাবার টেবিল। টিভি। সোফা। আর বার বার দেখছিল প্রতিষ্ঠাকে। প্রতিষ্ঠাও খেতে খেতে দেখছিল ছবিকে।

প্রতিষ্ঠা বলে উঠল, “তোমার নাম ছবি? আমার নাম প্রতিষ্ঠা, ডাক নাম মিঠু। আমাকে মিঠুদিদি বলতে পারোকি কিউট আর ইনোসেণ্ট, না, মা”?

“ঠিক আছে, ছবি থাক, বেলার দিকে তোমরা এসে খবর নিয়ে যেও। হ্যাঁরে, কান্নাকাটি করবি না তো? এর আগে যে মেয়েটি এসেছিল, বাপ রে তার কি কান্না! দুদিন রইল, তারপর আর থাকতে পারল না। মন খারাপ তো লাগবেই, মা”।

বিমলামাসি দরজার দিকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল, “সেই ভাল বউদি, আমরা দুজনেই বিকেলের দিকে আসব খন, তুমি ততক্কণ বুঝে শুনে লাও”

বিমলামাসি দরজার দিকে এগিয়ে গেল, মালতী ছবিকে বুকে জড়িয়ে ধরল, কান্নামাখা ধরা গলায় বলল, “ভালভাবে থাকিস মা। আমি বিকেলে আসব, তোকে দেকে যাব। মন খারাপ করিস নি। কোন ভয় নেই, এই তো দিদি আছে, মামীমা আছে”।

মালতী কাঁদলেও ছবি কিন্তু কাঁদল না, বরং তার মুখে অদ্ভূত এক ম্লান হাসি। আর মায়ের সব কথায় সে ঘাড় নেড়ে সায় দিচ্ছিল। ছবিকে ছেড়ে মালতী প্রতিষ্ঠার মাকে বলল, “বৌদি, ছবি আমার একটিমাত্র মেয়ে, বেধবার সম্বল। তোমার হাতে তুলে দিলাম, বড়ো ভাল মেয়ে, একটুকুন দেকো...”

প্রতিষ্ঠার মা বললেন, “মালতী, তুমি চিন্তা করো নাআমার কাছে ও আমার আরেকটি মেয়ের মতোই থাকবে, ভেবো না। মন খারাপ করো না”

ওরা চলে গেল। প্রতিষ্ঠার খাওয়া হয়ে গেছে, ওরাও বেরোবে এবার। প্রতিষ্ঠার স্কুলের বাস গলির ভিতর ঢোকে না, তাই প্রতিষ্ঠাকে ওর মা রোজ গলির মোড় অব্দি ছেড়ে দিয়ে আসেনআজ তিনজনেই বের হল। আজ প্রথমদিন ছবিকে সঙ্গে নিলেন প্রতিষ্ঠার মা, সব চিনিয়ে দিতে এবং বুঝিয়ে দিতে।

 স্কুলবাস কোথায় এসে রোজ দাঁড়ায় ছবি চিনে নিল। ফেরার পথে প্রতিষ্ঠার মা তাকে চিনিয়ে দিলেন, বাজার কোথায় বসে, মুদির দোকান, স্টেশনারী দোকান, দুধের স্টল – যেখান থেকে তিনি এতদিন বাজার করেন, মাসকাবারি, নিত্যপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করেন। কারণ প্রতিষ্ঠার বাবা রোজ সকাল ছটায় বের হয়ে যায় আর ফেরে রাত সাড়ে নটা-দশটার আগে নয়। রিষড়ার যে কারখানায় কাজ করে, সে কারখানায় কাজের নাকি খুব চাপ, রবিবারেও প্রায়ই কাজ পড়ে যায়। কিসের এতো কাজ, প্রতিষ্ঠার মায়ের কৌতূহল যে জাগেনি কোনদিন, তা নয় তবে জিজ্ঞাসা করতেও প্রবৃত্তি হয়নি কোনদিন, কারণ তাঁর মনে হয় লোকটা যতক্ষণ বাড়িতে না থাকে – তিনি বেশ নিশ্চিন্তে থাকেন, ঘরে ফিরলেই একধরনের ভয় বাসা বাঁধে তাঁর মনে। এতদিন তিনি ঘরের কাজ, বাইরের কাজ সবই একলা হাতে সামলাচ্ছিলেন, কিন্তু ইদানীং তিনি আর যেন পেরে উঠছেন না মানসিক অবসাদ থেকেই কিনা কে জানে, ভীষণ ক্লান্তি অনুভব করেন শরীরে মুখ বুজে একা একা এই সমস্ত কাজ সারার মানসিক জোর তিনি হারিয়ে ফেলছেন দিন দিন।

বিকেল চারটের সময় প্রতিষ্ঠার স্কুলবাস ফেরার সময় একা একা ঠিক জায়গাতেই দাঁড়িয়েছিল ছবি। প্রতিষ্ঠা যখন বাস থেকে নামল, হাল্কা হাসি মুখে নিয়ে ছবি এগিয়ে গেল তার হাত থেকে ব্যাগ নিতে। প্রতিষ্ঠা খুশি হল ছবিকে দেখে, কিন্তু ব্যাগ দিল না, বলল, “অ্যাই, বেশী পাকামি করো না তো। আফটার অল তুমি আমার চেয়ে বয়েসে ছোট। সো ইউ আর নট মাই গার্জেন, অ্যাণ্ড নর মাই এসকর্ট। ইউ আর মাই সঙ্গী”।

হাসিমুখে ছবি বলল, “কি বললে তার আদ্দেক কথার তো মানেই বুঝলাম না, মিঠুদিদি, তবে সারাটাদিন স্কুলে লেখাপড়া করে তুমি নিশ্চই খুব ক্লান্ত, সেইজন্যেই বলছিলাম, ব্যাগটা দাও না”।

“না, যতদিন স্কুলে যাচ্ছি, আমি আমার ব্যাগ নিজেই বয়েছি, কাজেই আজও বইব”।  

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ছবি অস্ফুট স্বরে বলল, “ঠিক বলেছ, মিঠুদিদি, শেষমেষ সকলকেই বোধহয়, কোন একটা সময়, নিজের ব্যাগ নিজেকেই বইতে হয়”

এত গভীর চিন্তা থেকে ছবি কথাটা বলল, প্রতিষ্ঠা অবাক হয়ে তাকাল ছবির মুখের দিকে, দেখল, ছবির মুখে এখন কোন হাসি নেই।

একটু সময় নিয়ে প্রতিষ্ঠা বলল, “এভাবে ভাবতে তোমায় কে শেখাল, ছবি”?

ছবির মুখের হাসি আবার ফিরে এসেছে, স্বাভাবিক স্বরে বলল, “কি যে বলো, না, মিঠুদিদি। আমাদের আবার ভাবনা-চিন্তা, আমরা কি আর লেখাপড়া শিখেছি তোমাদের মতো? একে গ্রামের স্কুল তার ওপর আবার ক্লাস সিক্সের বিদ্যে, মনে এল, বলে ফেললাম। ওসব ছাড়ো, টিফিন খেয়েছিলে? এখন তোমার খুব খিদে পেয়েছে, না”? এইটুকু সঙ্গে আসতে আসতে প্রতিষ্ঠা রীতিমত আশ্চর্য হতে থাকল, ছবির কথায় আর আচরণে। প্রতিষ্ঠা একটা হাত ধরল ছবির, তারপর খুব আবেগের সঙ্গে, বলল “তুই ঠিক কী বলতো, ছবি, তুই মোটেই আর পাঁচজনের মতো না, একদম অন্যরকম”

ছবির মুখে হাল্কা হাসি। দুজনে হাত ধরেই বাড়ি ফিরল, কেউ আর কোন কথা বলল না রাস্তায়।

 

ওরা দুজনে ফ্ল্যাটে এসে দেখল, দরজা খোলা, বিমলামাসি আর মালতী বসার ঘরের মেঝেয় বসে আছে। আর প্রতিষ্ঠার মা বসে আছেন চেয়ারে। ওদের দুজনকে দেখে প্রতিষ্ঠার মা বলে উঠলেন, “ওই তো, ওরা চলে এসেছে। ছবি, দ্যাখ, তোর মা বিশ্বাসই করছিল না, যে তুই একদম কাঁদিসনি – মন খারাপ করিসনি। সকাল থেকে সারাটাক্ষণ আমার সঙ্গে সঙ্গে থেকে, আমার কত কাজ করে দিল, ছবি। সারাটা দুপুর কত কি গল্প করলাম। সাড়ে তিনটে নাগাদ আমার জন্যে এককাপ চা করে দিয়ে ছবি মিঠুকে আনতে গেল”।

মালতীর সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছিল না। অবাক হয়ে যাচ্ছিল ছবিকে দেখে। ছবির পরনে বেশ ভালো একটা ফ্রক, নিশ্চয়ই দিদিমণির পুরোনো ফ্রক। যদিও ছবির চেহারার তুলনায় একটু বড়োসড়ো, কিন্তু মানিয়েছে বেশ। সবচেয়ে অবাক হল ছবির মুখে হাল্কা হাসি দেখে।

ছবি হাঁটু গেড়ে বসল মায়ের কাছে, জিজ্ঞাসা করল, “কী দেখচ কি, অমন করে? আমি ভালো আছি, মা, আমার জন্যে একটুও চিন্তা করো না। মামীমা, মিঠুদিদি খুব ভালো, মা। সত্যি আমি ভালো আছিতুমি সাবধানে থেকো মাতিন তিনটে বাড়ির বাসন মাজা, ঘর মোছা, এত পরিশ্রম তুমি কোনদিন করনি। তুমি আর দেরি করো না, বাড়ি যাও, ফিরতে ফিরতে তোমাদের সেই রাত হয়ে যাবে, কাল আবার ভোরে উঠে বেরিয়ে পরতে হবে। তুমি এখন এসো, মা”।

মালতীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল নিঃশব্দে, মেয়ের কথায় অবাক হওয়া ছাড়া, তার আর কিছু বলার ছিল না মালতী উঠে পড়ল, সঙ্গে বিমলামাসিও। প্রথমে সিঁড়ি দিয়ে, তারপর ব্যালকনি থেকে ছবি দুচোখ ভরে দেখতে লাগল তার মায়ের চলে যাওয়াএই প্রথম ছবির মুখে কোন হাসি নেই, এখন তার দুচোখে গভীর মায়া আর বেদনা জমাট হয়ে রইল অনেকক্ষণ। প্রতিষ্ঠা দেখছিল, তার মাও দেখলেন সব, কিছু বললেন না। ছবির আচরণে তাঁদের মধ্যেও এক অদ্ভূত মায়ার সংক্রমণ ঘটে যাচ্ছিল।

চলবে...

শনিবার, ২৮ জুন, ২০২৫

সুরক্ষিতা পর্ব ৫

 

বড়ো রাস্তা থেকে ঢুকে যে পিচঢাকা গলিতে মালতীদের বাসা, সেটা ধরে আরো অনেকটা ভেতরে চলে গিয়ে গলিটা শেষ হয়ে গেছে এক পুকুরের পাড়েতারপরে আর রাস্তা নেই, পুকুরের পাড় ধরে লোকজনের চলাচলে তৈরি হয়েছে মেঠো পথ। সে পথে বেশ কিছুটা গিয়ে পুকুরের পশ্চিম পাড়ে বিমলামাসির বাড়ি। কাদার গাঁথুনি দিয়ে ইঁটের দেওয়াল, মাথায় টিনের চালদুটো ঘর, একটা রান্নার চালা। ঘরের সামনে ছোট্ট টানা বারান্দা মতো – সিমেন্ট বাঁধানোসামনে, চারপাশে কিছুটা জমি, আগাছায় ভরে আছে। তার মধ্যেও চোখে পড়ে ইঁটের ভাঙাচোরা তুলসীমঞ্চ, তুলসীগাছেরই ঝাড় ঘিরে ফেলেছে পাশের অনেকটা জায়গা। আর ডানদিকের কোণায় জঙ্গুলে লঙ্কাজবার ঝোপ, ঝাঁপিয়ে ফুল এসে রক্তারক্তি করে দিয়েছে জায়গাটাকে।     

রাত্রি সাড়ে আটটা নাগাদ মালতী তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল বিমলামাসির বাড়িতে। ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে ভাঙা ইঁট বিছোনো পথে এসে দুজনে যখন ঘরের বারান্দায় উঠল, ঘরের ভেতর থেকে কেরোসিনের বার্নার স্টোভের আওয়াজ আসছিল। ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে মালতী ডাকল, “ও মাসি, কি রাঁধতেচ, গো”?

মালতীর গলা পেয়ে টেমি তুলে এগিয়ে এল বিমলামাসি, বলল, “কে এলি রে, এত রাতে? অ মালতী, আয় মা আয়, হঠাৎ কী মনে করে? কোন বিপদ-আপদ নয় তো”?

“না, না, বিপদ আপদ নয় কো, বিপদের আর বাকি কী আচে বলো, মাসি। তোমার কাচে এসেচি দুটো পরামর্শ করতে”। বিমলামাসি ছবির হাত ধরে ঘরে এনে মেঝেয় বসলসামনে জ্বলতে থাকা স্টোভে ছোট্ট হাঁড়ি চাপানো,  ভাত রান্না হচ্ছে, হাঁড়ির জল সবে ফুটব ফুটব করছে।

মালতী সামনাসামনি মেঝেতে বসে জিজ্ঞাসা করল, “কি রাঁধতেচ, ভাত?”

“হ্যাঅ্যাঅ্যা, দুটো ভাত একন ফুটিয়ে নি, রাতে চাট্টি খাই, খেয়ে হাঁড়িতে জল ঢেলে দি। বাকিটা কাল সকালের পান্তা” বিমলামাসি কথা শেষ করে চুপ করে অপেক্ষায় থাকল মালতী কি বলতে চায় শোনার জন্যে, মালতীও কিছুক্ষণ চুপ করে কিছু ভাবল। মনের কথাগুলো কিভাবে বলবে সেটাই চিন্তা করল হয়তো। তারপর বার্নারের নীলচে শিখার দিকে তাকিয়ে মালতী খুব গম্ভীর আর চিন্তিত স্বরে বলল, “মাসি, আমি কাজ করব, আমারে কাজ দ্যাও”

বিমলামাসি একটুও আশ্চর্য হল না, শুধু মালতীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ক্যান, মহাজন সাঁপুইয়ের গদি তে কিচু করল নি? তোরে কতা দে ছেল - কাজ দিবে”? মাথা নেড়ে জবাব দিল মালতী। তারপর বিমলামাসির কাছে মালতী সব কথা বলল – মহাজন সাঁপুইয়ের অফিসের কথা, তার সিদ্ধান্তের কথাবলা শেষ করে মালতী অপেক্ষা করতে লাগল বিমলামাসির উত্তরের জন্যবিমলামাসির ভাত কিছুক্ষণ আগেই ফুটে উঠেছিল, হাঁড়ির ঢাকনা ঠেলে উঠে আসছিল বাষ্প আর ফোঁটা ফোঁটা ভাতের ফ্যান, দ্রুত আঙুলের টানে বিমলামাসি তপ্ত ঢাকনাটা খুলে নিতেই, গরম ভাতের মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগল।

বিমলামাসি বলল, “কাজ তো হয়ে যাবে, বাছা, কাজের অভাব হবেনি, দুটো তিনটে দিন টাইন দে কাজ পেয়ে যাবিকিন্তু ছবি কি করবে?”

“ক্যানো? ঘরে থাকবে – ইস্কুল যাবে...”।  ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িতে একটা খুন্তি ডুবিয়ে বিমলামাসি দু-চারটে ভাত তুলে টেমির সামনে নিয়ে দেখল, আবার হাঁড়ির মধ্যে ডুবিয়ে দিল খুন্তিটা, তারপর বলল, “বলিস কি, মালতী? একলা ছেড়ে যাবি মেয়েডারে, সারাটা দিন? তা হয় না কি! দেশে কুলোকের অভাব নাই রে মালতী, সে হয় না। একন ছোটটি আচে, আজ বাদ কাল বড়ো হতে কতদিন? কতোয় পড়ল ছবি – বারোয় না? তবে? ভাত তো হয়েই এয়েচে, শুধু নামায়ে ফ্যান গালানো বাকি...”।

বিমলামাসি শাড়ির আঁচল দিয়ে হাঁড়ির কানা ধরে নামিয়ে নিল ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িবার্নার স্টোভ নিভিয়ে, হাঁড়ির মুখে ঢাকনা চাপিয়ে, বাইরে গেল ফ্যান গালতে। স্টোভের আওয়াজ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে শব্দহীন হয়ে গেল ঘরটা, বাইরে থেকে রাত্রির শব্দ কানে আসতে লাগল। ঝিঁঝিঁর ডাক, কুকুরের ডাক, গাছের পাতায়-পাতায় হাওয়ার মর্মর মালতী দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল, তার মুখে টেমির কালচে আলো খেলে বেড়াতে লাগল, নতুন চিন্তায় তার কপালে নতুন ভাঁজ।

মায়ের নজরে তার মেয়ে ছবি এখনো ছোটই, কিন্তু জগতের চোখে? ভাবনার এ দিকটা তার মাথায় আসেনি। ফ্যান গালিয়ে বিমলামাসি ভাতের হাঁড়ি শাড়ির আঁচলে নিয়ে আবার ঘরে এল, ভাতের হাঁড়ি মেঝেয় নামিয়ে, টেমিটা সামনে এনে একটা থালায় দুহাতা ভাত তুলল, সঙ্গে একটা সেদ্ধ আলু। পাশেই মেঝেয় রাখা হরেক প্লাসটিকের কৌটো থেকে একটু সরষের তেল আর নুন রাখল থালার একপাশে, তারপর ছবির দিকে থালাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “দিদুর ঘরে এলি, দুটো গরম-গরম ভাত মুখে দে, মা। তেল আর লুন দে’ মেকে নে আলুটা। কাঁচা নংকা নিবি? দিচ্ছি ডাঁড়া, শুরু কর। পেঁয়াজ কুচিয়ে দিই ডাঁড়া, গরম ভাতে ভাল লাগবে”

টেমির স্বল্প আলোয় বিমলামাসি পাতবঁটি বার করে পেঁয়াজ কাটতে বসল। মালতি এতক্ষণ দেখছিল বিমলামাসিকে, অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “মাসি, কী উপায় থালে বল না”?

“বোস না, বাছা, বোস। এসব কি হুটোপাটা করার কাজ, বাছা? ডাঁড়া মেয়েটা দিদুর বাড়ি এল, কিচু খেতে দিই।” ডুমো ডুমো কুচোনো পেঁয়াজ ছবির পাতে রাখল বিমলামাসি। তারপর টেমিটা ছবির থালার সামনে রেখে বলল, “ন্যাকাপড়া করে কী হবে বল দিনি? মেয়েকে কি ডাকতারের ঘরে বে’ দিবি, নাকি মোক্তারের ঘরে? আমি বলি, ছবিকেও কোন কাজে লাগিয়ে দে”

মালতী চমকে ওঠে, “কী বলচ, মাসি? এইটুকু বয়েসে”? মালতীর চোখ থেকে উষ্ণ অশ্রুধারা নেমে এল, টেমির আধো অন্ধকারে দেখা গেল না।

বিমলামাসি উদাসীন গলায় বলল, “এত উতলা হস নি, বাছা। আমি কি বলচি, অরে এঁটো থালাবাসন ধোওয়ার কাজে লাগাতে, অন্য রকম কাজ। হাত নুরকুত, গিন্নীরা চায়। একটু চা করে দেওয়া। ঘরটা ঝাড় দিয়ে দেওয়া। ছেলে-মেয়েকে বড় রাস্তার মোড়ে ইস্কুলের বাসে সকালে তুলে দিয়ে আসা, বিকেলে আবার ফিরিয়ে আনাদোকান থেকে টুকটাক জিনিষ এনে দেওয়া। মানে ফাইফরমাশ খাটা আর কি...তেমন ভারি, কষ্টের কাজ কিছু নয়। তা পরে ধর, পারলে রান্নার যোগাড় করে দেওয়া, এইসব আর কি...”।

মালতী কোন কথা বলল না। মেয়েসোহাগি হলধর পোল্লে মেয়েকে কোনদিন নিজের ইস্কুলব্যাগও বইতে দেয়নি। বাপমরা মেয়েকে পেটের দায়ে এখন অন্য লোকের সংসারের বোঝা বইতে হবে? ভীষণ অবুঝ এক আক্রোশ তার বুকের ভিতর নাড়া দিতে থাকে। কী দরকার ছিল হলধর পোল্লের, নিজের প্রাণ দিয়ে মহাজনের গুদাম সামলানোর। কত ক্ষতি হত, গুদাম থেকে চুরি হলে? মহাজনের গুদাম রক্ষা করে “বীরগতি” পাওয়া হলধর পোল্লের মেয়ে বউ এখন বাড়ি বাড়ি ঝি গিরি করে পেটের সংস্থান করবে! হলধর পোল্লের ভালোমানুষীর জন্যে মালতীর যে গর্ব ছিল মনের মাঝখানে, সেই ভিত আজ নড়ে উঠল। আসলে হলধর পোল্লে কি আহাম্মক নয়?

ছবির খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। বিমলামাসির দেওয়া নুন তার সেদ্ধ-আলু মাখতে একটুও লাগেনি। কারণ তার চোখের জলে লোনা হয়ে যাচ্ছিল ভাতের গ্রাস। তার অসহায় শূণ্য বুকের মধ্যে বাবার হাসিমুখটি মনে পড়ছিল বারবারআর মনে পড়ছিল তার বাবাকে শেষ দেখা, কপালে গভীর ছিদ্র নিয়ে বাবা ঘুমিয়ে আছে। “এত ঘুম তোমার কী করে আসে, বাবা? শুনচো বিমলাদিদু কি বলচে? মাকে, আমাকে কলকাতা যেতে হবে নোকের বাড়ি কাজ করতে। তাও তুমি ঘুমোচ্চো”?

 খাওয়া শেষ করে ছবি এঁটো থালা নিয়ে বাইরে চলে গেলবিমলামাসি পেছন থেকে বলল, “বাইরের বালতিতে দ্যাক, জল আছে, মুক-হাত ধুয়ে নে, থাল আমি ধুয়ে নোব খন তুই একে দে”। জলভরা বালতি খুঁজে নিল ছবি, উবু হয়ে বসে এঁটো থালাটা ধুয়ে নিল, মুখ-হাত ধুলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে কেঁদে উঠল – “বাবা...”।


মেয়ের কান্নায় ব্যাকুল মালতী ব্যস্ত হয়ে উঠতে যাচ্ছিল, বিমলামাসি মালতীর মাথায় হাত রেখে বলল, “কাঁদতে দে, মালতী, কাঁদতে দে। বুকটা হাল্কা হবে...। নিজের অবস্থাটা বুঝতে শিখবে”রুদ্ধ হয়ে এল বিমলামাসিরও গলা, আঁচলে চোখ ঢাকল। মেঝেয় রাখা টেমিটা কিছুটা আলো আর অনেকটা কালো ছড়িয়ে জ্বলতেই লাগল কেঁপে কেঁপে।


চলবে... 

নতুন পোস্টগুলি

গেলেম নতুন দেশে

  এতদিন স্কুল আর বাড়ি, বাড়ি আর স্কুল - এই নিয়ে চলছিল আমার রুটিন বদ্ধ জীবনযাত্রা। ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পার করে, টেস্ট হয়ে স্কুল ছুটি ...