বিশ্বলোকের সাড়া - দ্বিতীয় পর্ব
প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)
এলেম নতুন দেশে
আমি নিজিতে পৌঁছাই ১৯৯৫ এর জুলাই মাসে, স্বামী
কাজল আর ৪ বছরে পুত্র আবীর কে নিয়ে। কয়েকমাস অকল্যান্ডে থাকার পর কাজল চাকরি পায়
তৌরঙায়। শুরু হলো আমাদের তৌরঙা নিবাস। ১৯৯৭ এ আমাদের মেয়ে, অনাহিতা
এলো এই পৃথিবীতে; সম্পূর্ণ হল আমার মাতৃত্ব।
আমরা যখন সপরিবারে নিজিতে মাইগ্রেট করি তখন সত্যি বলতে এই
দেশ, এখানকার মানুষ বা এখানকার রকমসকম সম্বন্ধে একদমই কোন ধারণা ছিলনা।
নব্বইএর দশকে ডঃ গুগল ছিলেন না, সব প্রশ্নের
উত্তরের জন্য।
আমরা যখন ধীরে ধীরে সেট্ল্ করার চেষ্টা করছি সম্পূর্ণ এক
অজানা দেশে;
আমরা একটা অর্গানাইজেশনের নাম শুনলাম - তৌরঙা এথনিক কাউন্সিল (Tauranga
Ethnic Council)। এই প্রতিষ্ঠানের মূল
কর্মকাণ্ড ছিল নতুন ইমিগ্র্যান্ট মানুষদের নিউজিল্যান্ড-সমাজের মূল স্রোতে মিশতে
শেখানো, ওঁরা সব ধরনের সাহায্যের হাত ওঁরা বাড়িয়ে ধরেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ
থেকে নিয়মিত ছোটখাট গেট-টুগেদারের আয়োজন করা হতো, যেখানে
নানান দেশের লোকেরা আসতো, নিজেদের দেশের পোষাকে। বিভিন্ন
ভাষাভাষী অন্য অনেক মানুষজনের সাথে আলাপ হত, বন্ধুত্ব হত।
সেই সময়ে খুঁজে পাওয়া কিছু বন্ধু এখন পরিবারের মতো হয়ে গেছেন। আমাদের যোগাযোগ এত
সুদৃঢ় হয়েছে তার কারণ আমরা সকলেই নিজিতে মাইগ্রেট করে এসেছি। এক স্বজনবিহীন
পরিবারের কাছে, নতুন দেশে, হঠাৎই
স্বদেশী এবং স্বভাষী মানুষকে খুঁজে পাওয়া যে কি আনন্দের বলে বোঝানো যাবে না। খবর
পেয়েই আমরা ওই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলাম
আনন্দের কথা আজও আমরা এই প্রতিষ্ঠান এর সাথে যুক্ত। আমাদের
জীবনে এই প্রতিষ্ঠান এবং এখানে পাওয়া বন্ধুদের অবদান প্রভূত। ২৫ বছর পরেও আজও
চোখের সামনে ভাসে যেদিন নীনা পেন আমাদের প্রথম স্বাগত-সম্ভাষণ করেছিলেন। আমাদের
সেই সহৃদয় প্রগাঢ় বন্ধুত্ব আজও অটুট। আমি আর কাজল দুজনেই জড়িয়ে পড়লাম এই
প্রতিষ্ঠানের নানান কাজে কর্মে। নতুন দেশকে আপন করার জন্য শুরু হল আমাদের পথচলা।
পরবাসী, চলে এস ঘরে...
১৯৯৫-এ নিউজিল্যান্ডে এসেই অকল্যান্ডের ছোট্ট বাঙালী মহলে
আবার গান শুরু করেছিলাম। এবং তখনই আমার মনের মধ্যে বাসা বাঁধল নিজের গানে এলবাম
বানাবার।
এই সূত্রে একটা বিশেষ ঘটনা ঘটল, যা ছিল
আমার কাছে স্বপ্নেরও অতীত। অকল্যান্ডে আলাপ হয়েছিল বিশ্ব বিখ্যাত শিল্পী
বাংলাদেশের রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সাথে। তিনি নিউজিল্যাণ্ডে এসেছিলেন গানের
অনুষ্ঠান করতে। শিল্পীর ঔদার্য আর আমার সৌভাগ্য যে যোগাযোগটা তারপরেও বজায় ছিল।
বছর খানেক পরে আমি আমার এলবাম রেকর্ড করতে ভারতে যাবার
প্ল্যান করছি শুনে উনি এক কথায় আমায় তালিম দিতে রাজি হলেন। কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি
আমি বন্যাদির কাছে থেকে; মানে ঢাকায় ওঁনার বাড়িতে থেকে ওঁনার কাছে গানের
প্রশিক্ষণ নেবো। কি সুন্দর গল্পের ছলে গানের খুঁটিনাটি শিখিয়েছেন; কি অপূর্ব সুন্দর প্রাঞ্জল করে বুঝিয়েছেন, শিখিয়েছেন
গানের পরিবেশনা কিভাবে করতে হয়। এই সব কিছুর জন্যে আমি ভীষণভাবে ঋণী বন্যাদির
কাছে।
তবে ভগবানের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ যে আমার স্বামী প্রতি
মুহূর্তে আমার পাশে থেকেছে, সাহায্য করেছে। আজ আমি যেখানে পৌঁছাতে
পেরেছি, তার পেছনে আমার স্বামী, আমার
নিজের পরিবারের অবদান অসামান্য। সত্যি বলতে, “যা দেখেছি,
যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই”।
নিউজিল্যণ্ডে এসে অচিরেই এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমি
দায়িত্ব নিলাম শিল্প-সংস্কৃতির। বিভিন্ন দেশের নাচ-গান-বাজনা নিয়ে, নানান
অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে শুরু করলাম। এই অনুষ্ঠানে শুধু যে ইমিগ্র্যান্টরাই শিল্পী,
শ্রোতা বা দর্শক হতেন তা নয়, ধীরে ধীরে নিজির
স্থানীয় মানুষেরাও খুবই আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তাঁরা নিশ্চয়ই বিশ্বের বহু দেশের
বিভিন্ন সংস্কৃতির বৈচিত্র্য উপভোগ করতে আসতেন। তাঁরা যে কেউই হতাশ হননি, সে কথা স্বীকার করতে আজ আর দ্বিধা নেই।
আর আমরাও তো চাইতাম যে আমরা যারা এদেশে সেট্ল্ করতে
এসেছি, সে দেশের মানুষরাও আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠুন। তাতে
দুপক্ষেরই সম্পর্ক নিবিড় হয়ে উঠবে, যদি কিছু বিরূপ মনোভাব
থেকেও থাকে কোন পক্ষে, সে সব দূর হয়ে যাক চিরতরে। এই
অনুষ্ঠানগুলোর আরেকটা প্রধান আকর্ষণ ছিল নানা দেশের নানান স্বাদের, অসাধারণ সব খাবার। সরকারি সাহায্য এবং পৃষ্ঠপোষকতা তখনও ছিল এবং এখনও আছে
প্রচুর।
আজও মনে পড়ে, একটা বেশ বড়সড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম
আমরা। আমি ছিলাম মূল উদ্যোক্তা। এখানকার একটি বড় অডিটোরিয়ামে হয়েছিল আমাদের
অনুষ্ঠান। সেখানে আমি প্রথম বিদেশী বা ভিন্ন-ভাষীদের সামনে রবীন্দ্রসঙ্গীত পেশ
করেছিলাম। গর্বের সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিয়েছিলাম নোবেল জয়ী বাঙালী কবি বলে।
তদানীন্তন মেয়র, নোয়েল পোপ ছিলেন আমাদের প্রধান অতিথি। আমার
গান শুনে তিনি এসে বলেছিলেন, "although I did not understand the
lyrics, but the tune touched my heart and your voice is like a Nightingale
"। সেদিন
আমার এক দারুন রোমহষর্ক আনন্দের অনুভব হয়েছিল। এক ভিন্নভাষী, ভিন্নকৃষ্টির মানুষের কাছ থেকে এইরকম প্রশংসা পেয়ে আমি আপ্লুত হয়ে
গিয়েছিলাম, ধন্য হয়েছিল আমার সঙ্গীতচর্চা। নোয়েল পোপের সেই
প্রশংসা শুনে আমার মনে হয়েছিল, সত্যিই তো রবীন্দ্রনাথ
বিশ্বকবি, তাঁর সৃষ্টির কদর সর্বত্র; সমস্ত
মানুষের, দেশ-ভাষা নির্বিশেষে, মন
ছুঁতে পারে। এমনকি তাঁর সুরের জাদুতেও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উঠতে পারেন, বাংলা না-জানা গুণী মানুষেরাও। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই দেশে,
মূল স্রোতের মানুষের সামনে নিয়ে আসবো রবীন্দ্রনাথের গান, তাঁর মন্ত্র, তাঁর দর্শন।
সেই হল শুরু, ১৯৯৮
থেকে আমি নিজির বহু শহরে বহু অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছি, বহু ক্ষেত্রে গানের অনুবাদ লেখা কাগজ দিয়েছি শ্রোতাদের হাতে। আজও করে
চলেছি।
রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নিজির ভারতীয়
হাইকমিশনের উদ্যোগে এক অনুষ্ঠানে আমায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কিছু পরিবেশনার
জন্য। সেই অনুষ্ঠানে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপরে রবীন্দ্রনৃত্য এবং ক্ল্যাসিক্যাল
ব্যালে মিশিয়ে নৃত্যানুষ্ঠান করিয়েছিলাম। এই পরিবেশনায়, আমার
মেয়ে এবং তার ব্যালে স্কুলের সহপাঠীরাও অংশ নিয়েছিল।
১৯৯৭-এ আরও একটি সংগঠনের সাথে আমার পরিচিতি হয়। সেটা
হয়েওছিল এক মাল্টিকালচারাল ফেস্টিভ্যালের সময়। ESOL (English for Speakers of Other Languages) সরকারি অনুদানপুষ্ট এই সংগঠনের কাজ ছিল, ভিন্ন
ভাষাভাষী নবাগত ইমিগ্র্যান্ট বা রিফিউজিদের ইংরাজি শেখানো। ইরানে থাকার সময় আমি
অনুভব করেছিলাম, একটা দেশের ভাষা না জানলে, সে দেশে বাস করা এবং স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে পরিচয় গড়ে তোলা কত কঠিন। আর
ঠিক এইখানেই ESOL তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। নতুন
অভিবাসী বা রিফিউজি পরিবারের বহু মহিলা বা বয়স্ক মানুষের ইংরেজির জ্ঞান প্রায় নেই
বললেই চলে। অনেকে হয়তো ইংরাজি জানেন, কিন্তু বলতে আড়ষ্ট বোধ
করেন। তাঁদের ইংরেজিতে কথা বলা শেখানোর মাধ্যমে সমাজের বাকী সবার সাথে মেলামেশার
সুযোগ করে দেওয়াটাই এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য। এখানেও যোগ দিলাম আমি, কারণ আমি চাইতাম আমার ইরান-বাসের প্রথম কিছু মাসের মতো কেউ যেন ভুক্তভোগী
না হয়। আমাকে অবশ্যই ট্রেনিং নিতে হয়েছিল, কারণ
প্রাপ্তবয়স্কদের ভাষা শেখানোর নিয়ম সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি ইংরেজি শেখাতে শুরু করলাম
বাংলাদেশ, ভারত (মূলত পাঞ্জাবী), আফগানিস্তান
আর ইরান থেকে আসা অভিবাসী বা শরণার্থী মহিলাদের। অনেকে ক্লাসে আসতেন, আবার বহু ক্ষেত্রে আমি যেতাম আমার থেকেও বয়স্কা এবং শ্রদ্ধেয়া ছাত্রীদের
বাড়িতে, কখনো কখনো তাঁদের অন্দরমহলেও। এই সংগঠনের সাথে কাজ
করতে গিয়ে আমার এক নতুন মূল্যবোধের উপলব্ধি এল। এই সংস্থা আমার মধ্যে এনে দিল
সহানুভূতিশীল এক সত্ত্বা এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস, যে
বিশ্বাস অন্য মানুষের মধ্যেও সঞ্চার করা যায়।
[ব্লগার কিশোরের মন্তব্যঃ সুদীর্ঘ ৩৪ বছরের প্রবাস-জীবন
কাটিয়েও শ্রীমতী প্রদীপ্তার গাওয়া গানগুলি শুনলে অবাক হতে হয় - এমন সুস্পষ্ট
উচ্চারণ এবং সূক্ষ্ম রাবীন্দ্রিক গায়কী কিভাবে তিনি অন্তরে এতদিন ধরে বহন করে চলেছেন!
ইউ-টিউবে তাঁর অনেক গানের থেকে আমার প্রিয় দুটি গানের সুত্র নীচেয় দিলাম।]
চলবে...
লেখাটি পড়ে মন্তব্য করুন - ভালো লাগলে উৎসাহ দিন।
উত্তরমুছুনSokhi , Ador ador… tor lekhao khub, bhalo! Koto guni meye re tui! Dugga.. Dugga.
উত্তরমুছুনSokhi
USA
দুটো পর্বই পড়লাম। অপূর্ব লেখনী। তোমরা যে ইরান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলে, জানা ছিলো না। তুমি তোমার আদর্শের শিখরে পৌঁছাও এই কামনা রইলো। ভালো থেকো। 👍👍👌👌
উত্তরমুছুনKajal da from Kolkata.
Seii chotto kutu,
উত্তরমুছুনJake jonmate dekhechi se ajke bideshe koto kaj kore emon ekta jayegate ese geche. Proud of you kutu. Aro egiye jao. Arr gaaner tho kothaii nei. God bless!
Kutu Kajal: Diptidi, From Naktala, Kolkata.
Keno jani na chokhe jol elo....
উত্তরমুছুনToke chotto bela theke chini, tui maneii sundor gaan, kobita, natok, adda, .... tobe eto sahosher kaj o korbi Newzealand e jana chilo na re bondhu. Tobe❤️ aj porchi taii janlam eto bochor dekha hoyeche koi bolo ni tho?
Durer bondhu.
Kolkata
কুটু, আমি শিবাজী বলছি। তোমার দুটো পর্বের লেখা পড়লাম। খুব ভালো লাগল। এত ঝরঝরে বাংলা লেখা, পড়তে ভীষণ ভালো লাগে। অনেক কিছু জানতেও পারলাম বিশেষ করে তোমাদের ইরানের অভিজ্ঞতা। আর ভালো লাগল জেনে যে তুমি সরাসরি রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাদির কাছে গান শিখেছ ঢাকায় ওনার বাড়িতে থেকে। খুব বিরল অভিজ্ঞতা।
উত্তরমুছুনThank you so much. Bhalo legeche jene khoob khushi holam.🙏 All the comments are very encourageing.
উত্তরমুছুনAmar eii prothom lekha. Kishor da na prokash korle Khatar patateii thakto.