১
উনুনের
আগুনটা সবে উস্কে উঠেছে কী ওঠেনি, সনৎবাবু চায়ের দোকানের সামনে রাখা বাঁশের
বেঞ্চিতে বসলেন। আধখানা চেরা বাঁশের বেঞ্চি। বেঞ্চিতে বসেই তিনি হাঁক পাড়লেন, “কই
রে পতিত, চা হল?”
ভাঙ্গা
হাতপাখা দিয়ে ফটাফট উনুনে হাওয়া করতে করতে পতিত বলল, “জল চাপিয়েছি অনেকক্ষণ, এই ফুটল বলে”।
“এই
সময়ে কত ফুল ফুটে যায় রে পতিত, তোর জল আর ফুটল না! তোর চায়ের জল ফুটতে ফুটতে আমিই না ফুটে যাই!”
“কী
যে বলেন, বাবু? এই কাকভোরে অমন কথা বলতে আছে? কীই বা বয়েস আপনার”?
“বলিস
কী রে? আটবছর হল রিটায়ার করেছি, বয়েস কম হল বলছিস, তুই?”
এই
সময়েই সেখানে এসে উপস্থিত হলেন কমলবাবু, একই রকম বয়স্ক, বেঞ্চে সনৎবাবুর পাশে বসতে
বসতে বললেন, “বড্ডো
বাজে বকিস তুই, সনৎ। বয়সের কথা দুনিয়ার লোককে ঢাক পিটিয়ে বলার কী দরকার? এর মধ্যে
তোর কী বাহাদুরি আছে বল তো?”
অবাক
হয়ে সনৎবাবু বললেন, “তার
মানে? এর মধ্যে বাহাদুরির কথা আসছে কোত্থেকে?”
“তুই
যে ম্যাট্রিকে জলপানি পেয়েছিলি, তারপর ধর আমাদের মধ্যে তুইই প্রথম চাকরি আর বউ
বাগিয়েছিলি, সে সব কথা বুক ফুলিয়ে গর্ব করে বলিস, সেটা বুঝতে পারি। কিন্তু এই যে
তুই “বয়েস বাড়লো, বয়েস বাড়লো” করে ঢাক বাজাচ্ছিস, এর দরকার কী?”
“বাঃ
রে বয়েস বাড়লে, বয়েস বাড়লো বলবো না?”
“কী
হবে বাড়িয়ে? কিছু লোক আহা-উহু করবে। কিছু লোক গায়ে পড়ে উপদেশ ছাড়বে, “শরতের হিম
মাথায় নিও না, মিষ্টি খেও না, তেলেভাজার দিকে ফিরে দেখো না, রাস্তাঘাটে আড়চোখে
তাকিও না, ধর্মে কর্মে মন দাও...ওফ্ হরিব্ল্”।
“তোর
ইচ্ছে না হয় তুই বয়েস ভাঁড়িয়ে শিং ভেঙে বাছুরের দলে ভিড়ে যা, আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস
কেন?”
সনৎবাবুর
রাগে, কমলবাবু খুব হাসলেন হো হো করে, বললেন, “বোঝো, সামতাবেড়ে শহরে সব্বাই জানে
তুই আর আমি মানিকজোড় বন্ধু। এক ক্লাসের দোস্ত। তুই না কমালে আমি বয়েস কমাই কী করে?
লোকে হাসবে যে! হাঃ হাঃ হাঃ, ও সব এখন ছাড়, বেশ কদিন পর তোর দেখা পাওয়া গেল! কদিন
ধরেই তোর বাড়ি যাবো যাবো করেও যাওয়া হয়নি। তা কী খবর কী? এখানে ছিলি না, মেয়ের
বাড়ি গিয়েছিলি”?
“নাআআআ,
এখানেই ছিলাম। শরীরটা ঠিক জুতে ছিল না। প্রেসারটা গড়বড় করছিল। তার ওপর একটু ঠাণ্ডা
লেগে শরীরটা বেশ কাবু হয়ে গেছিল”।
“অ্যাই,
এটাই বলছিলাম, যত ভাববি বয়েস বাড়ল, ততই বলতে শুরু করবি, “শরীরের আর দোষ কি? এ
হচ্ছে বয়েসের বিড়ম্বনা” – বুজলি হতভাগা? আমারও কদিন বুকটা ধড়ফড় করছিল। গিন্নি
বিধেন দিল কটা দিন বাড়ি থেকে বেরোতে পাবে না। আমি বললাম, আর যা বলো সব শুনবো,
কিন্তু এইটি শুনবো না। ভোরের এই হাওয়াটা না খেলে আমার আবার হজমের গণ্ডগোল হয়।
বুজলি না? পাঁচটা বাজলেই মনটা কেমন পালাই পালাই করে”!
“হ্যাঅ্যাঅ্যা।
আমারও একই দশা। তবে প্রেসারের জন্যে কদিন উঠে দাঁড়ালেই মাতাটা কেমন ঘুরে উঠছিল।
তাছাড়া সিজন্-চেঞ্জের সময় তো, বুকে ঠাণ্ডাটা চেপে বসলে আর রক্ষে পেতাম না। তাই
কদিন বাড়ির বের হইনি”।
“বেশ
করেছিস, কিন্তু এদিকের খবর শুনেছিস?”
“কিসের খবর”?
“শুনিস
নি? আমাদের মংলার কন্যাটি ভেগে পড়েছে!”
“বলিস
কী? কার সঙ্গে কবে?”
“তাই
তো বলছি। গত বুধবার দিন, ভর সন্ধেবেলায়। ওই যে ছোঁড়াটা ওদের বাড়িতে থাকত, আর বাজার
হাট করে দিত, তার সঙ্গে”।
সনৎবাবু মুখ বেঁকিয়ে খুব তাচ্ছিল্যভরে বললেন।
“মংলার
খুব পয়সা হয়েছিল, ব্যাটা ধরাকে সরা দেখছিল”।
কমলবাবু
আরো একটু উস্কে দিয়ে বললেন, “উড়ছিল রে, উড়ছিল। নিজের মেয়েই মুকে ঝামা ঘষে দিল”।
সনৎবাবু
দুলে দুলে সুর করে বললেন, “অতি বাড় বেড়ো নাকো ঝড়ে পড়ে যাবে”।
মিচকি
হেসে কমলবাবু সুরে সুর মেলালেন, “হুঁ হুঁ, অতি ছোট হয়ো না হে, ছাগলে মুড়োবে।
য্যাগ্গে, আমাদের কী দরকার ওসব কথায়!”
“তা
যা বলেছিস, আমরা বাপু ওসব সাতেও নেই পাঁচেও নেই”।
কমলবাবু
তেঁতো খাওয়া মুখ করে বললেন, “হ্যাঅ্যাঅ্যা, পরনিন্দা পরচর্চা একদম সহ্য হয় না”।
“তবে
কথাটা যখন উঠলই, তখন না বলে পারা যায় না”।
সনৎবাবু
হাত রকেটের ভঙ্গিতে উপরের দিকে তুলে বললেন, “মংলার উত্থান একদম হাউয়ের মতো, সাঁ
সাঁ সাঁ...”।
কমলবাবু
হা হা হা হা করে হাসতে হাসতে বললেন, “পতনও হল, হাউইয়ের মতো, ধাঁ ধাঁ ধা...” ওপর
থেকে নিচেয় রকেটের মতো গোঁত্তা খাওয়ার ভঙ্গী দেখালেন হাতে।
সনৎবাবুও
হাসতে হাসতে বললেন, “চার বছরে টাকা ডবল! ধাপ্পা দিয়ে কম টাকা কামিয়েছে? খুব লটর
পটর বারফট্টাই!”
“হ্যাঅ্যাঅ্যা,
বাড়িতে নিত্যি মোচ্ছোব চলছিল। হোমড়া চোমড়া সব লোক আসছে যাচ্ছে। খানা পিনা হুল্লোড়!”
“সেদিনের
মংলা থেকে মঙ্গলবাবু। মঙ্গল সায়েব, মঙ্গল স্যার”!
একথায়
কমলবাবু গম্ভীর মুখে উটের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “য্যগ্গে, আমাদের কী
দরকার ওসব কথায়? আমরা বাপু সাতেও নেই পাঁচেও নেই”।
কমলবাবু
সম্মতির ঘাড় নেড়ে বললেন, “তা যা বলেছিস, পরনিন্দা পরচর্চা, আমার ধাতেই নেই! কই রে,
পতিত, তোর চায়ের জল ফুটল?”
“অনেকক্ষণ”
পতিত কান খাড়া করে এই দুই বাবুর কথা শুনছিল, উত্তর দিল, “চা সেদ্ধ হচ্ছে, এই হয়ে এল
বলে”।
চায়ের
সংবাদ পেয়ে নিশ্চিন্ত কমলবাবু বললেন, “তবু একটা কথা না বললেই নয়! লোকের পাঁজর
নিংড়ানো পয়সা চুরি করে, এত বাড় ভালো নয়”।
“সে
আর বলতে? ও জিনিষ সামলে চলা যায়? সারা গায়ে ফুটে উঠবেই, পারদের ঘায়ের মতো! হাজার
লোকের অভিশাপ, দীর্ঘশ্বাস! ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছ্যা, কাঁচা পয়সায় সংসারটাই বিগড়ে যায়,
পরিবারের বাঁধন ঢোস্কে যায়”।
“তাই
তো হল” কিছুটা উত্তেজিত স্বরে কমলবাবু বললেন, “মংলার একটি রক্ষিতে হল, আর ওদিকে
মংলার বউ, মংলারই এক স্যাঙাতের সঙ্গে আজ মিরিক, কাল মন্দারমণি করে বেড়াচ্ছে! এদিকে
মেয়েটাও উটকো ছোঁড়ার সঙ্গে ভেগে পড়ল”!
আদিরসের
গন্ধ পেয়ে সনৎবাবু উলসে উঠলেন, বললেন, “মংলার এই বয়েসে আবার রক্ষিতে? বলিস কী রে?”
লোকের
হাঁড়ির খবর রাখা কমলবাবু আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন, “আমার কাছে শোন না, আমার কাছে সব
খবর পাবি! ধোপাপুকুরের পশ্চিমপাড় বুজিয়ে যে নতুন তিনটে ফ্ল্যাট বাড়ি উঠল? ঊর্বশী,
মেনকা আর রম্ভা? সেই রম্ভায় দুকামরার ফ্ল্যাটে মংলা তার রম্ভাকে পোষে”।
আবেশে
সনৎবাবু একটা চোখ বন্ধ করে বললেন, “বেশ বলেছিস! রম্ভায় রম্ভা? হি হি হি হি, এ যে
একেবারে অষ্টরম্ভা! অ্যাঁ, ষোলো কলার আদ্ধেক? তা কলাটি দেখতে কেমন?”
এসব
ব্যাপারে একটুও আগ্রহ নেই যেন, সেভাবে কমলবাবু বললেন, “ছ্যা ছ্যা, ছ্যা, সে এক
পাপের প্রতিমূর্তি, চোক তুলে তাকানো যায় না! হাঁটা-চলা, কথা বলায় পাপ ঝরে ঝরে
পড়ছে!”
“তা
তো হবেই, যত্তো সব নষ্টা”। সনৎবাবুও
খুব যেন বিরক্ত এমনভাবে বললেন।
কিন্তু
কমলবাবু আবার উস্কে তুললেন, “তবে হ্যাঁ। গতরখানি খাসা। যাকে বলে ডবকা। ভাদরের ভরা
গাঙ, রসে জলে একেবারে মাখামাখি”!
“মংলার
থালে খুব সুখ বল? ভাদরের ভরা গাঙে ঝাঁপাচ্ছে, সাঁতার কাটছে, ডুব দিয়ে দিয়ে
নাইছে...?” সনৎবাবুর মুখে মিচকে হাসি, একটা চোখ টিপে বললেন।
উত্তরে
কমলবাবু, আবার যেন উদাসীন, বললেন, “সে আর বলতে? তবে যাগ্গে যাক, আমাদের কী দরকার
ওসব কথায়? পরনিন্দা পরচর্চা মোটে সহ্য হয় না”।
“হ্যাঅ্যাঅ্যা।
ঠিক বলেছিস, আমরা বাপু খাই দাই গান গাই, কারো সাতেও নেই, পাঁচেও নেই”।
২
সকাল
হতেই ট্রেনটা যেখানে দাঁড়াল, সেখানেই দুই মক্কেল নেমে পড়ল। দেখে মনে হয়, একজনের
বয়েস মধ্য তিরিশ, অন্যজন একেবারেই ছোকরা। দুজনের কাঁধেই ব্যাগ – ধেড়ে লোকটার কাঁধে
বড়ো, আর ছোটোর কাঁধে ছোট। লোকজন তেমন নেই, স্টেশনটাও তেমন জমজমাট নয়। অচেনা জায়গায়
প্রথম নেমে, চারদিক দেখতে দেখতে তাদের চোখে পড়ল স্টেশনের হাতের বাইরের চায়ের
দোকানটা। শুধু দুই বুড়ো বেঞ্চে বসে আছে, আর কেউ নেই। চায়ের দোকান দেখেই যেন ওদের চায়ের তেষ্টা পেয়ে
গেল। তারা গুটিগুটি পায়ে চায়ের দোকানের কাছে বেশ বড়ো একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল। সেখান
থেকে দুই বুড়োর কথাবার্তা শুনল বেশ খানিকক্ষণ। তারপর এগিয়ে গিয়ে অন্য একটা বেঞ্চে
ব্যাগ রেখে পাশাপাশি বসল। তাদের দেখেই দুই বুড়োর জমাটি আড্ডায় ছেদ পড়ল।
বেঞ্চে
বসে ধেড়ে লোকটা হাঁক পাড়ল, “দাদাভাই, দুটো চা হবে নাকি?”
ভেতর
থেকে পতিত সাড়া দিল, “দু মিনিট বসেন, দিচ্ছি”।
“চায়ের
সঙ্গে আর কিছু হবে?”
“ওই
যে প্যালাস্টিকের বয়েমে বিস্যুট রয়েছে, কোনটা নেবেন, নিন”।
ছোটটা
ধেড়েকে বলল, “খিদেয় তো পেট ঝলসে গেল, দাদা”! তারপর পতিতকে বলল, “ওই লেড়ো? ও ছাড়া
আর কিছু নেই?”
“ডিম-টুচ
হবে। চাটা নামিয়েই করে দিচ্ছি। টুচ-ঘুগনিও হবে, কিন্তু একটু দেরি হবে। আলুমটর
সেদ্ধ আছে, একটু ছুঁকে দিলেই রেডি...”।
সনৎবাবু
আর কমলবাবু এতক্ষণ দুজনকেই ভুরু কুঁচকে নিরীক্ষণ করছিলেন। এই সামতাপুরে তাঁদের
বহুদিনের বাস। দেখেই বুঝলেন, দুই মক্কেল এখানে নতুন, আলাপ করার জন্যে কমলবাবু
বললেন, “আপনাদের এখানে নতুন মনে হচ্ছে! যাওয়া হবে কোথায়?”
ধেড়েটা
উত্তর দিল, “আমাদের বলছেন?” তারপর জোড়হাতে নমস্কার করে বলল, “নমস্কার। তা – হ্যাঁ
নতুন বৈ কি! তবে পুরোনো করে নিতে কতক্ষণ?”
“কোন
কাজে? নাকি বেড়াতে?”
কমলবাবুর
প্রশ্নে ধেড়ে বেশ অবাক হয়ে বলল, “বেড়াতে? এ জায়গাটা বেড়ানোর মতো ট্যুরিস্ট স্পট,
এমন তো জানতাম না”!
“তা
না। তবে বেড়াতে বলতে, কাকার বাড়ি, মামার বাড়ি, মাসির বাড়ি, বন্ধুবান্ধবের বাড়ি –
লোকে বেড়াতে যায় না?”
“এখানেও
মামার বাড়ি, দাদা?”
ছোটটা
ফোড়ন দিতেই ধেড়ে খুব রেগে ধমকে দিল, বলল, “চুপ কর। হ্যাঁ সে রকম বেড়ানো হয়ই তো।
মন্দ বলেননি, আমরা এসেছি কিছুটা কাজ, কিছুটা বেড়ানো, এই আর কি!”
পতিতের
চা হয়ে গেছিল, চার আঙুল চায়ে ডুবিয়ে, চার গ্লাস চা এনে একে একে চারজনকেই দিল, জিগ্গেস
করল, “আপনারা ডিম-টুচ খাবেন তো? দু প্লেট বানাই?”
ধেড়েটা
বলল, “খুব দেরি হবে কী? আমাদের আবার একটু জরুরি কাজ আছে!”
পতিত
ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, “না, না, দেরি হবে কেন? আপনাদের চা খেতে খেতে বানিয়ে দিচ্ছি,
দেখেন না”।
চায়ের
কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে কমলবাবু বললেন, “জরুরি কাজের সঙ্গে শরীরের দিকে নজর
দেওয়াটাও জরুরি। ওই দেখুন, আমি আবার একটু ইয়ে চর্চা করে ফেললাম, বোধ হয়। হে হে হে
হে, কিছু মনে করবেন না”।
ধেড়ে
খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, “ “ইয়ে” মানে, আপনি অনধিকার চর্চার কথা বলছেন কী? একটুও না।
আপনারা আমাদের গুরুজন। গুরুজনের কথা আমরা মাথায় রাখি, কিন্তু মাথা খারাপ করি না।
আমাদের আপনারা “তুমি”ও বলতে পারেন, কাকু”।
সদ্য
অপরিচিত যুবকের মুখে “কাকু” শুনে সনৎবাবু ও কমলবাবু খুশিই হলেন, চায়ে চুমুক দিতে
দিতে সনৎবাবু বললেন, “বাব্বাঃ একেবারে কাকু?”
ধেড়ে
যেন খুব অপ্রতিভ হল, বলল, “এঃ হে, একটু ইয়ে করে ফেললাম কী? “দাদা” বললে ভালো হতো?”
সনৎবাবু
একগাল হেসে বললেন, “আরে না, না। আমাদের অনেকেই এখন “দাদু” বলে, তাই বলছিলাম!”
ধেড়ের
গলায় অবিশ্বাস, সে বলল, “য্যাঃ কী বলছেন? দাদু? আপনাদের বলে? কে? কারা বলে? কিছু
মনে করবেন না, যারা বলে, তারা মোটেই সুবিধের লোক নয়। কী এমন বয়েস হয়েছে আপনাদের?
পঁয়তাল্লিশ - কি বড়জোর আটচল্লিশ, তার বেশি তো নয়?”
চায়ের
গেলাস শেষ করে সনৎবাবু মুচকি হেসে বললেন, “আটান্ন”।
ধেড়ে
খুব নাটকীয় ভঙ্গীতে বলল, “সত্যি? অবিশ্বাস্য। বিশ্বাসই হয় না। আটান্নতে এই চেহারা?
এমন টানটান, ভাবা যায় না, জাস্ট ভাবা যায় না”।
ধেড়ের
কথায় দুজনেই খুব মজা পেলেন, কমলবাবু স্মিতমুখে বললেন, “আমি কমল। ও সনৎ। আমরা একই
বয়সি, একই স্কুলের একই ক্লাসের বন্ধু”।
ছোটটা
ছোট্ট করে ফুট কাটল, “আমরাও একই কলেজের, একই ক্লাসের না হলেও, একই গ্লাসের বন্ধু”।
ধেড়ে
তাকে ধমক দিয়ে বলল, “চুপ কর্। আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে, আপনারা এখানে অনেকদিনের
বাসিন্দা”।
কমলবাবু
বাঁধানো বত্রিশের বেশ কিছু বের করে বললেন, “হে হে হে হে, অনেকদিন কতদিনে হয় জানি
না, তবে এই সামতাপুরে, আমাদের সাত পুরুষের বাস”।
“বাব্বা,
সাত পুরুষ? তাহলে তো আপনারা এখানকার সকলকেই চিনবেন”।
ধেড়ের
এই কথায় কমলবাবু মুচকি হেসে বললেন, “সামতাপুর এমন কিছু বড়ো জায়গা তো নয়, না চেনার
কী আছে?”
“তাহলে
মঙ্গল পোদ্দার স্যারকেও চিনবেন নিশ্চয়ই?”
সনৎবাবু
বললেন, “মঙ্গল পোদ্দার, মানে আমাদের মংলা, তাকে চিনবো না? সামতাপুরে অমন ধনী কজন
আছে?”
কমলবাবু
জিগ্গেস করলেন, “তা মঙ্গলের সঙ্গেই কী আপনাদের জরুরি কাজ?”
ধেড়েলোকটি
বলল, “হুঁ। উনিই আমাদের ডেকেছেন”। চা
শেষ করে মাটিতে গেলাস রেখে ধেড়ে আবার জিগ্গেস করল, “তা উনি লোক কেমন?”
কমলবাবু
একটু উচ্ছ্বসিতভাবেই বললেন, “লোক ভালোই! মানে ওই যেমন হয় আর কী! সজ্জন, তারপর ধরুন
দিলদরিয়া। তার ওপর ইয়ে মানে, বিবেকবান”।
“লগনচাঁদা
লোক মশাই, ধুলিমুঠি থেকে সোনামুঠি – মা লক্ষ্মী ঘরে বাঁধা পড়েছেন”। উত্তেজিত হয়ে সনৎবাবু বললেন।
ধেড়ে
বলল, “তাই? কিন্তু তাহলে... আমাকে ডেকে পাঠালেন...”। এই সময় পতিত দু প্লেট গরম গরম
ডিম-টোস্ট এনে দুজনের হাতে দিয়ে গেল। প্লেট দুটো হাতে নেওয়ার পর ধেড়ে আবার বলল, “আপনারা
কিছু খাবেন না? আপনারা দেখবেন, আর আমরা বসে বসে খাবো?”
“তাতে
কি? তোমরা হচ্ছো এই শহরের অতিথি। অনেকদূর থেকে এসেছো। তোমরা খাও। পতিত দেখিস
অতিথিদের যেন কোন অযত্ন না হয়। তা, মঙ্গলের বাড়িতে কিসের কাজ?”
কমলবাবুর
এই অমায়িক কথার উত্তরে ধেড়ে পাঁউরুটি চিবোতে চিবোতে বলল, “শুনেছি, কিছুদিন আগেও
ওঁনার খুব ভালো অবস্থা ছিল। কিন্তু ইদানীং একটু কষ্টের মধ্যে পড়েছেন, তাই বোধহয়
আমাদের ডাক পড়েছে”!
কমলবাবু
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তা ঠিকই শুনেছো। দিন কী আর সমান যায়? আজ যে রাজা কাল সে
ফকির। এতো হামেশা হয়”।
সনৎবাবুও
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সত্যি কী ছিল আর এখন কী হয়েছে! মঙ্গলের মতো মানুষের
কিন্তু এমন হওয়ার কথা ছিল না। জগতে ভালোমানুষদের কপালেই কি যত দুঃখ লেখা থাকে?”
কমলবাবু
গভীর দুঃখে মাথা নেড়ে বললেন, “যা বলেছিস। কিন্তু মঙ্গলকে এই কষ্ট থেকে তোমরা
কীভাবে উদ্ধার করবে?”
মুখে
পাঁউরুটি নিয়ে ধেড়ে বলল, “ওটাই আমাদের পেশা। এবং নেশাও বলতে পারেন”।
ছোটটাও
আর চুপ থাকতে পারল না, বলল, “আমার দাদার দয়ার শরীর, মানুষের দুঃখ কষ্টে প্রাণ
কাঁদে”।
ছোটকে
আগের মতোই ধমকে ধেড়ে বলল, “চুপ কর! দয়া-টয়া কিছু নয় কাকু, কর্তব্য। যার যা কর্তব্য
সেটা না করলে অধর্ম হয় কি না বলুন?”
সনৎবাবু
জোর সমর্থন করে বললেন, “আলবাৎ হয়...তা সেই কর্তব্যটা কী?”
আশেপাশে
তাকিয়ে খুব নিচু স্বরে ধেড়ে বলল, “হাটের মধ্যে সব কথা কী বলা যায়, কাকু? নাকি যাকে
তাকে সবকথা খুলে বলা যায়? কার মনে কী আছে ঠিক কি? উপকার করতে না পারুক, লোকের
ক্ষতি দেখতে মানুষ খুব আনন্দ পায়”।
কথাটা
কমলবাবুর তেমন মনঃপূত হল না, মুখটা হাঁড়ি করে বললেন, “তাই বুঝি?”
ধেড়ে
ছোট্ট একটা ঢেঁকুর তুলে দুঃখ পাওয়া মুখে বলল, “কাকু রাগ করলেন নাকি? আপনাদের মতো
লোককে বলা যাবে না, সে কথা বলিনি কিন্তু! আপনাদের মতো লোক রোজ রোজ পাবো কোথায় – এক
আধদিনই দর্শন মেলে। আপনাদের সান্নিধ্য পেলে আমাদের মতো লোকেরা বর্তে যাই! আপনাদের
বলবো না? ছ্যা, ছ্যা, এমনটা ভাবলেন কী করে?”
এমন
তৈলমর্দনে সনৎবাবু ও কমলবাবু দুজনেই বেজায় খুশি হলেন, কমলবাবু বললেন, “তাই বলো,
আমরা তোমাকে ভুল বুঝছিলাম”!
ডিম-টোস্ট
সেরে ছোটটা জল খাচ্ছিল, জল খাওয়া থামিয়ে বলল, “ঠিক কি ভুল, সেটা পরে হয়তো টের
পাবেন, কাকু”।
তার
দিকে কটমটে চোখে তাকিয়ে ধেড়ে বলল, “চুপ কর। কী জানেন কাকু, বিশ্বাস জিনিষটা সোনার
পাথরবাটির মতো। যদি বিশ্বাস করেন, তাহলে বাটিটা সোনার, আর যদি না করেন, বাটিটা
পাথরের!”
কমলবাবু
মুগ্ধ নেত্রে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ধেড়ের দিকে, বললেন, “ওফ্ সাংঘাতিক বলেছো,
ভাই! যত দেখছি, শুনছি, ততই অবাক হয়ে
যাচ্ছি! কী বলিস সনৎ, দেখতে সাধারণ কিন্তু কী অসাধারণ কথাবার্তা! কি উঁচু বিচার,
বিশ্লেষণ, কী উচ্চ থাকের ভাবনা!”
সনৎবাবুও
আবেগে আপ্লুত হয়ে গদ্গদ স্বরে বললেন, “যা বলেছিস। তা এত কথা হল, ভাইপোদের নামগুলি
জানা হলো না তো!”
ছোট
এবার চুলবুল করে উত্তর দিল, “দাদার নাম, বিপদতারণ বিশ্বাস। দাদার মা টানা পাঁচবছর
খুব নিষ্ঠা ভরে বিপত্তারিণীর ব্রত করার পর দাদা মায়ের কোলে অব...মানে ওই ইয়ে কী
বেশ যেন একটা হয়েছিলেন!”
কমলবাবু
জিগ্গেস করলেন, “অব...মানে ইয়ে অবতীর্ণ কি?”
ছোট
মাথা নেড়ে আঙুল নেড়ে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছেন কাকু। শক্ত শক্ত বাংলা শব্দগুলো
জিভে আসতেই চায়না”!
বিরক্ত
ধেড়ে, মানে বিপদতারণ বলল, “আঃ গোপাল, তোকে কতবার বলেছি, আমার জন্মের এই অলৌকিক
ঘটনার কথা, যাকে তাকে বলে বেড়াবি না! লোকে বিশ্বাস করবে না, ভাববে বুজরুকি! কী
দরকার কাকু, নিজের কথা ঢাক পিটিয়ে সকলকে বলতে যাওয়ার? আপনারা তেমন আড়বুঝো লোক নন,
জানি, আপনারা বিশ্বাস করবেন, কিন্তু অনেকে উপহাস করে, ঠাট্টা বিদ্রূপ করে। সে এক
বেজায় লজ্জার ব্যাপার হয়ে ওঠে”!
সনৎবাবু
অত্যন্ত অবাক হয়ে বললেন, “কী বিপদ! মূর্খ লোক ঠাট্টা করবে বলে, তোমার জন্ম মহিমা
আমাদের জানতে দেবে না, বিপদ? এ তোমার ভারি অন্যায়। বিপদ থেকে তুমি মানুষকে উদ্ধার
করার ব্রত নিয়েছো বিপদ, তুচ্ছ লোকের ঠাট্টায় তোমার জন্ম রহস্য গোপন থাকবে?”
সনৎবাবুকে
সমর্থন করে কমলবাবু বললেন, “গোপন থাকবেই বা কেন? আর আমরা এসব কথা গোপন রাখবোই বা
কেন? আমরা একবার যখন তোমাকে পেয়েছি বিপদ, আর তো তোমায় ছাড়ছি না! আমাদের বাড়ির সকল
বিপদ তুমি কাটিয়ে দাও, বিপদ”।
ছোট,
যার নাম গোপাল, ওজস্বিনী ভাষায় উথলে উঠল, “সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, তোমার বিপদের হাত
বাড়িয়ে দাও বিপদদা, তোমার নিপুণ হাত-টানে বাড়ন্ত হয়ে উঠুক সকলের বাড়ি! এটুকু
বাড়াবাড়ি তোমাকে করতেই হবে, বিপদদা”।
বিপদতারণ
তথাস্তু ভাবমাখা মুখে বলল, “কিন্তু এই চায়ের দোকান, এত মানুষের হাটে সব কথা তো বলা
যাবে না, কাকু! আপনাদের এখানে কোন নিরিবিলি জায়গা নেই, যেখানে নিশ্চিন্তে বসে দুটো
কথা বলা যায়?”
কমলবাবু
গর্বিত স্বরে বললেন, “বিলক্ষণ, নেই আবার? আমাদের কুমুদিনী উদ্যান! এই তো সামনেই,
হেঁটে গেলে মিনিট পাঁচেক। এই সাত সকালে ওখানে তেমন কেউ থাকেও না, নির্জন, নিরিবিলি”।
বিপদতারণ
বলল, “বাঃ তবে তো ভালই হল! আপনারা এগিয়ে যান, আমরা চায়ের দাম-টাম মিটিয়ে দিয়ে আসছি”।
সনৎবাবু
আন্তরিক আপ্যায়নের সুরে বললেন, “ও কমল, আমরা থাকতে ওরা আবার দাম দেবে কী রে? পতিত,
আমার খাতায় ওদের দুজনের হিসেবটাও লিখে রাখিস”।
সনৎবাবুর
কথায় পতিত তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল যেন, বলল, “আপনার তো হিসেব সাড়ে তিনশোর ওপর হয়ে
গেল, বাবু, এমাসে এখনো পর্যন্ত একটা টাকাও ঠেকাননি...”।
সনৎবাবু
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “আঃ তোর ওই হিসেবের জল নিয়ে পরে নাড়াচাড়া করবো, পতিত।
এখন যা বললাম তাই কর”।
বিপদতারণ
স্বস্তির শ্বাস ফেলে গোপালের দিকে তাকিয়ে বলল, “দামটা আমরাই দিয়ে দিতে পারতাম,
কিন্তু আপনারা গুরুজন, আপনাদের আদেশ অমান্য করার সাহস হয় না। আপনারা তাহলে এগিয়ে
পড়ুন”।
কমলবাবু
অবাক হয়ে জিগ্গেস করলেন, “সে কি? তোমরা কুমুদিনী উদ্যানে যাবে না?”
সান্ত্বনা
দেওয়ার স্বরে বিপদতারণ বলল, “আসছি, আপনারা চলুন। অচেনা লোকের সঙ্গে আপনারা পার্কে
ঢুকলে, লোকের কৌতূহল হবে। আলাদা আলাদা ঢোকাই ভালো”।
সনৎবাবু
সে কথা মেনে নিয়ে বললেন, “তা, বিপদ মন্দ বলেনি, চল আমরা এগিয়ে যাই, কমল। ওরা
পিছনেই আসুক। বেশি লোক জানাজানি হলে, বিপদ বাড়বে! আচ্ছা, তাহলে আমরা আসি, তোমরা
পেছনে এসো”।
সনৎবাবু
আর কমলবাবু একটু দূরে চলে যেতে, বিপদতারণ পতিতকে বলল, “পতিতবাবু, আমাদের সামনে
সনৎবাবুর মতো মানী মানুষের ধারদেনার কথা বলাটা আপনার উচিৎ হয়নি”।
পতিত
খ্যাঁক করে বলে উঠল, “নিকুচি করেছে মানী লোকের। বউনি হবার আগেই দুই মক্কেল, নিত্যি
এসে ধারে চা খেয়ে যায়। তিনমাস ধরে চিৎ হাত উপুড় করছে না, আমি কি দানছত্তর খুলেছি
নাকি? দুটোই সমান সেয়ানা, চারটে শকুনি মরলে, ওইরকম দুই লোক হয় – যেমন কঞ্জুস,
তেমনি বজ্জাত”।
গোপাল
একটু চাপা গলায় বিপদকে বলল, “শকুন তো ভাগাড়েই থাকে, না দাদা? আমরা কী তবে ভাগাড়ে
যাচ্ছি?”
গোপালের
কথার কোন উত্তর না দিয়ে বিপদ বলল, “সে না হয় একটু ধারদেনা করে ফেলেছেন, কিন্তু
দুজনের মন খুব সাদা, তাই না, পতিতবাবু?”
“সাদা
না ছাই! সারাদিন শুধু কূটকচালি, এর কথা তাকে, তার কথা একে। একটু আগেই মঙ্গলের
নিন্দেয় ধুলো ওড়াচ্ছিল, আপনার কথা শুনেই সেই মঙ্গল একেবারে বড়োমানুষ হয়ে উঠল!”
গোপাল
মুরুব্বি চালে বলল, “তাই? আপনার দোকানে ভালো সিগারেট কী আছে? দুটো দিন তো!”
বেশ বিরক্ত হয়েই পতিত বলল, “সেটাও কী ধারে?”
বিপদতারণ
খুবই বিনীত সুরে বলল, “আহা, রাগ করছেন কেন, পতিতবাবু, চা আর ডিমটোস্টের দাম
সনৎবাবুর খাতায়, আর সিগারেট দুটো কমলবাবুর। ধার আবার কোথায় হল?” পতিত দুটো সিগারেট
এনে দিল।
বিপদতারণ
আর গোপাল সিগারেট ধরিয়ে আরামে দুটান দিল, তারপর বিপদতারণ বলল, “আমরা এখন আসি
পতিতবাবু, দেখা হবে আবার। আশা করি আপনার ধারের ওই ধারালো বিপদ খুব শিগ্গির কেটে
যাবে!”
তার
ওপর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মতো গোপাল বলল, “ধার দেনা, টাকা-পয়সা নিয়ে মাথা
গরম করবেন না, পতিতবাবু। টাকা কি চিরকাল থাকবে, নাকি সঙ্গে যাবে? আসি তাহলে?”
দুজনেই পিঠে ব্যাগ ফেলে লম্বা পায়ে হাঁটা দিল কুমুদিনী উদ্যানের দিকে।
পতিত
ওদের যাওয়ার দিকে ফ্যালফেলে চোখে তাকিয়ে দেখে বলল, “যত্তো সব ফেরেব্বাজের দল কি
আমার কপালেই জুটে যায়? এক পয়সা বউনি হল না সকাল থেকে, গুচ্ছের ধার!”
৩
বিপদতারণ
বলল, “আঃ খদ্দের লক্ষ্মী, বুড়ো বলতে নেই। আর “নেপালদা” “নেপালদা বলছিস”, আমি
বিপদতারণ আর তুই গোপাল, ভুলে যাচ্ছিস?”
গোপাল
বলল, “আহা, সে তো ওদের সামনে। এখনতো আর ওরা সামনে নেই”!
“তা
না থাক, তবু আসল নাম ধরে ডাকবি না, ভুল হয়ে যাবে। আমি নেপাল নই, তুইও এখন হরি নোস।
আর তুই প্রথম থেকে কথার মাঝখানে ফুট কাটছিলি কেন রে? সবে চার ধরেছে, ফাৎনা নড়ছে,
তার মধ্যে তোর বুজকুরি, মাছ পালালে?”
“কী
করবো বেরিয়ে যায় যে, আচ্ছা এই কুলুপ দিলাম, আর কথা বলবো না। এখন থেকে চেষ্টা করবো
মিউট মোডে থাকতে”।
বেঞ্চে
বসা সনৎবাবু আর কমলবাবু ওদের দেখতে পেয়ে, হাত নাড়লেন, বিপদতারণও হাত নাড়ল, তারপর
গোপালকে বলল, “মনে থাকে যেন। ওই যে আমাদের দেখতে পেয়েছেন, ওঁরা হাত নাড়ছেন, চল ওই
দিকেই যাই”।
পার্কে
তেমন আর লোকজন নেই। দু একজন জলহস্তী মানুষ, হাঁসফাঁস করে অকারণ হাঁটছে। তিন চারজন
ঘাসে বসে প্রাণায়াম করছে। ওরা দুজনে ইঁট বাঁধানো হাঁটা পথ দিয়ে আস্তে আস্তে
বেঞ্চের দিকে গেল। সনৎবাবুদের সামনে গিয়ে বিপদতারণ বলল, “আপনাদের পার্কটা কিন্তু
বেশ। চারদিকে সাজানো সবুজ, প্রচুর
অক্সিজেনে ভরা বাতাস। মন-টন একদম ঝরঝরে হয়ে যায়”।
গোপাল
মিউট মোড ভুলে বলে উঠল, “ইহকাল ঝরঝরে হয়ে যায়, কিন্তু পরকাল হয় কিনা জানা যায় না”।
বিপদতারণ
কটমট করে গোপালের দিকে তাকাল। কিন্তু কমলবাবু কী বুঝলেন কে জানে, বললেন, “বেশ
বলেছো গোপাল, ইহকাল ঝরঝরে হয়ে যায়...হা হা হা হা...বসো হে, বেঞ্চে এসে বসো, সনৎ
আমার দিকে একটু সরে আয়”!
বিপদতারণ
ঘোর আপত্তি করে বলল, “ছি ছি তা কী করে হয়? আপনাদের সঙ্গে একই আসনে, পাশাপাশি? আমার
আবার লঘুগুরু জ্ঞান খুব টনটনে। আপনারা ওই উঁচুতে বেঞ্চে বসুন, আমরা বসি আপনাদের
পায়ের কাছে, এই ঘাসে”।
সনৎবাবু
হৈ হৈ করে উঠে বললেন, “আরে না না, সেটা আবার কথা হল নাকি? তার থেকে আমরা সবাই
মিলেই ঘাসে বসি। কি বল কমল, তাতে মুখোমুখি বসে কথাবার্তা বলতেও সুবিধে হবে”।
কমলবাবু
বন্ধুকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, “কিন্তু হাঁটু? ঘাসে হাঁটু মুড়ে বসতে পারবি তো?”
বিপদতারণ
লুফে নিল কথাটা, বলল, “এঃহে, আপনাদের হাঁটুতে ব্যথা বুঝি? মোটে আটান্নতেই এই! অবিশ্যি
আজকাল হাঁটুর আর দোষ কী, হাঁটুর আর বয়েস কী? এই আমারই দেখুন না, পূর্ণিমা,
অমাবস্যায় হাঁটুদুটো কেমন কন্কন্ করে। গোপাল তেল মালিশ করে দিলে বেশ আরাম হয়।
গোপাল সেই তেলের শিশিটা তোর ব্যাগে নেই?”
গোপাল
অনর্থক ব্যাগ হাতড়ে দেখে বলল, “না গো, বিপদদা, তাড়াহুড়োতে ভুলে গেছি”।
কমলবাবু
সহানুভূতি মাখা গলায় বললেন, “তোমারও হাঁটুতে ব্যথা? বল কী হে?”
“দোষ
তো হাঁটুর নয় কাকু, দোষ ভেজালের। কোন্ খাঁটি জিনিষটা আমরা খাচ্ছি বলুন? আপনাদের
সময় তাও কিছু পাওয়া যেত। এখন? ভেজালের বিষ পেটে গিয়ে হাঁটু, চোখ, কান, নাক সব
বিগড়োচ্ছে। কদিন পরে দেখবেন, হাঁটুর বয়সী ছেলেমেয়েরাও বাতের ব্যথায় কাতরাচ্ছে!
মাঠে খেলবে কী? হাতে ছড়ি নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা ফেরা করবে!”
“ঠিকই
বলেছ, বিপদ, আমাদের সে সব দিনই ছিল আলাদা, গয়লাদের খাঁটি ঘি, দুধ, কলুদের ঘানির তেল,
পুকুরের টাটকা মাছ তুলে আনত জেলেরা, আর সরল চাষিদের ফলানো ফনফনে সবজি...” অতীতের
স্বপ্নমাখানো সুরে সনৎবাবু বললেন।
বিপদতারণ
সনৎবাবুকে আর বাড়তে না দিয়ে বলল, “আমার তেলটা হাঁটুতে মালিশ করলে খুব আরাম পাবেন।
তেলটা বাড়িতে আপনারাও বানিয়ে নিতে পারেন, কাকু। কাকিমাকে বলবেন বানিয়ে দিতে।
ঘৃতকুমারী, অশ্বগন্ধা, শ্বেতবেড়েলার মূল আর আকন্দপাতা – কুচিকুচি করে কেটে, খাঁটি
সরষের তেলে ভিজিয়ে দিন সাতেক কড়া রোদ্দুরে রাখবেন। ব্যস্ আপনার মালিশের তেল তৈরি!”
কমলবাবু
আহ্লাদে বলে উঠলেন, “বাবা, তোমার আয়ুর্বেদও জানা আছে বুঝি?”
গোপাল
চুপ করে থাকতে পারল না, বলে উঠল, “দাদা, ওই সব নিয়েই তো আছেন। দাদার অনেক বিদ্যা।
আয়ুর্বেদ বিদ্যার কোন সাইড এফেক্ট নেই, কিন্তু অন্য বিদ্যেগুলোর সাংঘাতিক সাইড
এফেক্ট”।
হতাশ
গলায় বিপদতারণ বলল, “গোপাল, কতবার বলবো, বড়দের কথার মধ্যে কথা বলতে নেই?”
সনৎবাবু
একটু প্রশ্রয়ের সুরে বললেন, “আহা, গোপালকে বকছো কেন, বিপদ? ও তো খারাপ কথা কিছু
বলেনি! তোমার গুণের কথা বললেই, তুমি দেখছি রেগে যাও। কী বিনয় আহা, তোমার মা খুবই
পুণ্যবতী মহিলা, তাঁর বিপত্তারিণী ব্রত করা সার্থক। তাঁর সঙ্গে অন্ততঃ একবার দেখা
করতে খুব ইচ্ছে হয়...”।
বিপদতারণ
ক্ষুণ্ণ মুখে বলল, “কিন্তু আমি চাই না, আমার মায়ের সঙ্গে এখনই আপনাদের দেখা হোক”!
এই
কথায় চমকে উঠে দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠলেন, “কেন? কেন? চাও না কেন?”
নেপাল
শোক সন্তপ্ত স্বরে বলল, “আপনাদের এত তাড়াতাড়ি ছাড়তে ইচ্ছে হয় না, আপনাদের স্নেহের
ছায়ায় আমরা আরও বেশ কিছুদিন নিশ্চিন্তে থাকি, এই আমাদের লোভ”!
সনৎবাবু
আরো আশ্চর্য হয়ে বললেন, “সে আবার কী? তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না, বিপদ, বড়ো
বিপদে ফেলছো, তুমি!”
“আমার
মা দেহ রেখেছেন, বহুদিন। ইহকালে তাঁর সঙ্গে আর দেখা করা সম্ভব নয়”।
“ইস্,
চলে গেছেন। দেখা হল না?” কমলবাবু খুব আক্ষেপ নিয়ে বললেন।
সনৎবাবু
বললেন, “আহা রে, মা-মরা ছেলে, বড়ো দুঃখ
কষ্টে মানুষ”।
কমলবাবু
তাঁকে সমর্থন করে বললেন, “কতো বিপদ আপদ সামলে, তবেই তো আজকের বিপদতারণ! ও নিয়ে
দুঃখ করো না, বিপদ, বাপ-মা চিরদিন কারো থাকে? থাকে না”। নেপাল মুখ নিচু করে রইল, তার দু চোখ
ছলছল করছে।
সনৎবাবু
বললেন, “মায়ের কথায় বড়ো দাগা পেয়েছে ছেলেটা। আহা রে, বেচারা! দুঃখ কোরো না, বিপদ,
তাঁর ব্রতের কথা মনে করে, আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করো”।
চোখ
নাক মুছে বিপদতারণ ধরা গলায় বলল, “সে কথা একশ বার কাকাবাবু, বলুন আপনাদের বিপদে
আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি? আমি কিন্তু শুধু টাকার সুরাহা করে দিতে পারি, অন্য
কিছু পারি না”।
সনৎবাবু
একটু যেন হতাশ হলেন, বললেন, “যাচ্চলে! টাকার সুরাহা মানে? কম সুদে লোন? লোন নিয়ে
শুধবো কী করে?”
কমলবাবুও
ঘাড় নেড়ে বললেন, “না, না, তবে আর আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করে লাভ নেই বিপদ, লোন
নিয়ে কি নতুন বিপদ ডেকে আনবো? ব্যাংকের থেকে রোজ দুটো-তিনটে ফোন আসে, আমার জন্যেই
নাকি লোন অ্যাপ্রুভ্ড্ হয়ে পড়ে আছে, “হ্যাঁ” বললেই হয়। ওই রকম লোন নিয়ে ডুববো,
পাগল হয়েছো?”
বিপদতারণ
এবার মুখে ফিকে হাসি নিয়ে বলল, “ওফ্, কাকাবাবু, আপনারা আমার কথা তো শুনলেনই না,
উলটে লোন ভেবে বসলেন। আপনার
যা টাকা আছে, তাকে আমি ডবল করে দিতে পারি”।
সনৎবাবু
আঁতকে উঠলেন, “ওই ফেরেব্বাজ মংলার মতো? ইয়ে...মানে সজ্জন মঙ্গলের মতো? চার বছরে
ডবল? তারপর কোম্পানি উলটে যাবে?”
কমলবাবুও
মাথা নেড়ে আপত্তি করে বললেন, “ওই চক্করে আমরা পড়বো না, বিপদ”।
বিপদতারণ
দমে যাবার পাত্র নয়, বলল, “চার বছরে নয়, মাত্র চব্বিশ ঘন্টায়! আপনাদের চোখের
সামনে। আজকে যা নেবো, আগামীকাল আপনার হাতে ডবল তুলে দেব”।
গোপাল
আরো পরিষ্কার করে বলল, “আজ দশ দিলে কাল বিশ। আজ বিশ দিলে কাল চল্লিশ”!
অবিশ্বাসের
সুরে সনৎবাবু জিগ্গেস করলেন, “সত্যি বলছো?”
এই
কথায় অত্যন্ত হতাশ হয়ে বিপদতারণ বলল, “দেখলি গোপাল, তখনই বললাম, আমার নামে সাতকাহন
করে বলিস না, কেউই বিশ্বাস করবে না। এখন হলো তো?”
একটু
অপ্রস্তুত হয়ে কমলবাবু বললেন, “আহা, তুমি অত উতলা হয়ো না, বিপদ। আমরা সাধারণ
ছাপোষা মানুষ তো! এই সব অলৌকিক ব্যাপার স্যাপার শুনলে চমকে উঠি”।
সনৎবাবুর
এসব কথায় মন নেই, তিনি হিসেবে মজেছিলেন, জিগ্গেস করলেন, “তার মানে, আজকে এখন আমি
যদি তোমাকে দুলাখ দিই, কাল তুমি আমাকে চার লাখ দেবে?”
বিপদতারণ
সম্পূর্ণ আস্থা নিয়ে বলল, “ব্যাপারটা তাই। কিন্তু প্রথমে ছোট করে শুরু করুন না,
আমি লোকটা কেমন আগে সেটা যাচাই করে নিন। আজকে ধরুন পাঁচহাজার দিলেন, আর আপনাদের
চোখে ধুলো দিয়ে রাত্রে আমরা বেপাত্তা হয়ে গেলাম! তখন? আপনার পাঁচহাজারই লস হবে।
সেটুকু আপনারা সামলে নিতে পারবেন। কিন্তু দুলাখের ধাক্কা কি সামলাতে পারবেন?”
“আমরা
যদি চিটিংবাজ, ফেরেব্বাজ হই, আপনাদের আমও যাবে, ছালাও যাবে!”
গোপালের
এই মন্তব্যে বিপদতারণ খুশিই হল, তাকে সমর্থন করে বলল, “ওটা ছাড়াও আরেকটা আছে,
খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে কিনে”।
অন্য
কথায় সনৎবাবুর মন নেই, মনে হল, তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন রয়েছেন, বললেন, “এই চব্বিশ
ঘন্টা কি তুমি আমাদের সঙ্গেই থাকবে?”
বিপদতারণ
একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “তবে? আপনাদের বাড়িতেই তো থাকবো! আজ সিঙ্গল নিয়ে যাবো, কাল
আবার ডবল নিয়ে ফিরে আসবো? আমাদের যাতায়াতের খরচ, ট্রেনভাড়া, বাস ভাড়া...”।
গোপাল
আরো জুড়লো, “খাই খরচও আছে একটা...”।
বিপদতারণ
আরো নিশ্চিত করে বলল, “ঠিক। আমরা আপনাদের বাড়িতেই রইলাম। দুটো শাকভাত যা খাওয়ালেন
খেলাম, রাতটা আপনাদের বাড়িতেই কাটিয়ে, সকালে আপনার হিসেবপত্র বুঝিয়ে তবে আমাদের
ছুটি!”
সনৎবাবুর
মনের সংশয় অনেকটাই ফিকে হয়েছে এতক্ষণে, বন্ধুকে জিগ্গেস করলেন, “কী বলছিস্, কমল?”
কমলবাবু
বললেন, “আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না”।
“আমিও
না, এমন সুযোগ হাত ছাড়া করা কি উচিৎ?”
সনৎবাবুর
এই কথায় কমলবাবু বললেন, “কক্ষণো না, যে ছাড়ে সে আহাম্মক!”
আহাম্মকের
কথায় গোপাল আবার উথলে উঠল, “আহাম্মকের এক, যে পরকে ধার দিয়ে, নিজের খালি রাখে
ট্যাঁক। আহাম্মকের দুই, যে নিজের চালে তুলতে দেয় পড়শী জনের পুঁই”।।
বিপদতারণ
তার বাচালতায় একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “আঃ গোপাল, তুই চুপ করবি? এখানে অত্যন্ত
সিরিয়াস একটা ব্যাপার নিয়ে কথা চলছে, আর তুই চ্যাংড়ামি করছিস?”
কমলবাবু
প্রশ্রয় মাখা গলায় বললেন, “আহা, বিপদ, ছেলেমানুষ একটু বাচালতা করবে বৈকি! আর তোমার
মতো ধীর স্থির গুণী কী আর সবাই হতে পারে?” তাহলে কী ঠিক করলি, সনৎ?”
সনৎবাবু
এখন আবার একটু গম্ভীর, বললেন, “একটা কথা আমার খটকা লাগছে, সেটা বলি, বিপদ?”
কমলবাবু
একটু অবাক হয়ে জিগ্গেস করলেন, “তোর আবার কিসের খটকা রে, সনৎ! আমি তো কিছুই দেখছি
না?”
সনৎবাবু
বললেন, “তুমি অন্যের বিপদ মাথায় নিয়ে অন্যের টাকা ডবল করে বেড়াচ্ছো, বিপদ, অথচ
নিজের টাকা ডবল করে তুমি বড়োলোক হওনি কেন?”
বিপদতারণ
যেন অভিভূত হয়ে গেল একথায়, বলল, “মোক্ষম প্রশ্ন করেছেন, কাকাবাবু। আপনার পায়ের
ধুলো দিন, যাবার সময় আরো নিয়ে যাবো। মাদুলিতে ভরে ঊর্ধ্ববাহুতে বেঁধে রাখবো। আপনি
এ প্রশ্নটা না করলে, আপনার সরলতায় আমি মুগ্ধ হতাম, কিন্তু শ্রদ্ধা করতে পারতাম না।
এখন পারবো, আপনার মতো বিচক্ষণ মানুষকে শ্রদ্ধা না করে, অন্য উপায় আছে?”
কমলবাবু
ঘাড় মাথা চুলকে বললেন, “ঠিকই তো! এ কথাটা আমার মাথায় আসে নি তো! সনৎটা চিরকালই
আমার থেকে ভালো ছাত্র ছিল। অঙ্কে বরাবর আমার থেকে দশবারো নম্বর বেশি পেত”।
বিপদতারণ
বলল, “আমার মন্ত্রের যে শক্তিতে টাকা ডবল হয়, সেটা আমি নিজের জন্যে ব্যবহার করতে
পারি না। সে নিয়ম নেই। মায়ের কঠোর নির্দেশ আছে। নিজের জন্যে কিংবা নিজের কোন
আত্মীয় পরিজনের জন্যে আমি এই মন্ত্র ব্যবহার করতে পারবো না। করলেই মন্ত্রের শক্তি
হাপিস হয়ে যাবে!”
সনৎবাবু
অবাক হয়ে জিগ্গেস করলেন, “তাই? তাহলে তোমাদের স্বার্থ কী?”
“স্বার্থের
জন্যে তো আমরা করি না, কাকাবাবু। আর্তপীড়িতের সেবার জন্যেই এই ব্রত”।
কমলবাবু
চট করে যেন বুঝে ফেললেন, বললেন, “ওসব মন্ত্রের অনেক নিয়ম কানুন আছে রে, সনৎ। আমরা
পাপীতাপী মানুষ ওসবের কী বুঝবো?”
“তাই
তো মনে হচ্ছে রে”। এখন
অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে সনৎবাবু বললেন, তার উত্তরে বিপদতারণ বলল, “তবে একেবারে কোন স্বার্থই
নেই তাও বলবো না”। বিপদতারণের
এই কথায়, সনৎবাবু আর কমলবাবু নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন, তাঁদের ভাবখানা –
এইবার আসল পথে এসো চাঁদু, এতক্ষণ অনেক ধানাই পানাই করেছো!
“কী
স্বার্থ বিপদ?” কমলবাবুর প্রশ্নে বিপদতারণ বলল, “আমি সামান্য কিছু কমিশন নিয়ে
থাকি, মাত্র দশ পার্সেন্ট। মানে যে টাকাটা আপনার বাড়ছে, তার দশ পার্সেন্ট। ধরুন
আপনি পাঁচ হাজার দিলেন, আমি আপনাকে দেব দশ। বাড়তি এই পাঁচের দশ পার্সেন্ট - মানে
পাঁচশো টাকা আমি নেব! ইয়ে, মানে, এটাও না নিতে পারলে ভালো হত, কিন্তু আমাদের জীবন
ধারণের জন্যে, গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যেও তো কিছু অর্থের প্রয়োজন হয়ই! তা ছাড়া
বিপত্তারিণী মায়ের নিয়মিত পুজো দিতে হয়, তারও একটা ব্যয় আছে!”
কমলবাবু
উল্লসিত গলায় বললেন, “আরে, এর জন্যে এত সংকোচ করছো কেন? ওটুকু না পেলে তোমাদের
চলবে কী করে? ওটা তো তোমাদের পাওনা”!
“জিএসটির
কথাটা ভুলে গেলে, দাদা? আঠেরো পার্সেন্ট ওই পাঁচশোটাকার ওপর”। গোপাল মনে করিয়ে দিল।
বিপদতারণ
বলল, “ও হ্যাঁ, এর ওপর আছে জিএসটি। ওটা তো আমারও নয়, আপনাদেরও নয়, সরকারের টাকা।
উন্নয়নের টাকা। জিএসটি জমা করে, চালানের জেরক্স আপনাদের পাঠিয়ে দেব”।
কমলবাবু
এইটুকু শর্তে খুব খুশি, তিনি বললেন, “ঠিক আছে, বাবা, ঠিক আছে। বুঝে গেছি, তোমাকে
আর অত সবিস্তারে না বললেও চলবে”।
কিন্তু
সনৎবাবু খপ করে বিপদতারণের দুই হাত ধরে, অনুনয়ের সুরে বললেন, “আমার একটা অনুরোধ
ছিল বাবা, না করতে পারবে না”।
বিপদতারণ
একটু চমকে উঠে বলল, “ছি ছি এ কী বলছেন, কাকাবাবু। অনুরোধ নয়, আদেশ করুন”।
সনৎবাবু
খুব কাতর মুখে বললেন, “ভাবছি তোমাকে পাঁচলাখ দিয়ে আমি দশলাখ ঘরে তুলবো! সেক্ষেত্রে
তোমার কমিশন হবে পঞ্চাশ হাজার টাকা, তার ওপর আবার আঠের পার্সেন্ট জিএসটি, আমি যে
ধনে প্রাণে মরে যাবো, বাবা! বুড়ো কাকাবাবুর মুখ চেয়ে একটু কনসিডারেশন কী হতে পারে
না, বাবা? এই ধরো পঞ্চাশের জায়গায় পঁচিশ?”
বিপদতারণ
মাথা চুলকে বলল, “আপনাদের মতো শ্রদ্ধেয় গুরুজনের সঙ্গে দরদাম করতে লজ্জা করছে,
কাকাবাবু। আপনি যখন এভাবে বলছেন, তখন না বলি কী করে? তবে পঁচিশ নয় কাকাবাবু, ওটা
চল্লিশ করুন। আমার একটু লস হয়ে যাবে, তা হোক!”
“আচ্ছা
বাবা, তোমার কথাও থাক আমার কথাও থাক, তিরিশের বেশি দিতে পারবো না, বাবা”।
সনৎবাবুর
এই আকুল কথায়, গোপালও বিপদতারণকে অনুরোধ করল, “আর না করো না, দাদা, গুরুজন এত করে
বলছেন?”
“বলছিস?”
“বলছি
দাদা, তোমার ব্রত সকলকে বিপদের থেকে তুলে আনন্দে রাখা! ওটুকু স্যাক্রিফাইস তোমায়
করতেই হবে, দাদা। আমরা না হয় কটাদিন আলুচোখা আর ভাত খেয়েই কাটাবো!”
একটু
চিন্তা করে বিপদতারণ রাজি হয়ে গেল, বলল, “ঠিক আছে, তুইও যখন বলছিস, তখন তাই হোক”।
পুলকিত
গোপাল বলল, “তোমার দয়ার শরীর দাদা, তুমি না দেখলে, আর আছে কে? তবে কাকাবাবু,
জিএসটি কিন্তু পুরোই দিতে হবে। ওই পঞ্চাশের ওপর আঠেরো পার্সেন্ট!”
সনৎবাবু
একটু যেন বেঁকে বসলেন, বললেন, “তা কেন? তিরিশের ওপর হবে”!
গোপাল
বেশ মাতব্বর অ্যাকাউন্ট্যান্টের চালে বলল, “আমাদের কোয়ার্টারলি জিএসটি রিটার্ন সাবমিট
করতে হয় তো, প্রত্যেকবারই আমরা দশ পার্সেন্টের ওপর জিএসটি জমা দিই, এবার তিরিশ
নিয়েছি বললে, ডিপার্টমেন্ট থোড়ি শুনবে? তারা পঞ্চাশের ওপরেই হিসেব করবে, তখন
আমাদের ওই তিরিশ থেকে আবার বকেয়া জিএসটি গুনতে হবে”।
সনৎবাবু
খুব সহজ উপায় বাৎলে দিলেন, “আহা, পুরোটা দেখাবে কেন? তিন লাখ দেখাবে, তাহলেই তো
চুকে যাবে”।
এই
কথায় বিপদতারণ একটু রেগেই গেল, বলল, “মিথ্যের আশ্রয় আমি নিতে পারবো না, কাকাবাবু।
তাহলে আমাদের ছেড়ে দিন। আর ভারতীয় কারেন্সি নোট আসবে রিজার্ভ ব্যাংকের কোষাগার
থেকে। এতো আর জাল নোট নয়, যে তার কোন হিসেব নেই! রিজার্ভ ব্যাংক হিসেব ভুল করবে?
পাঁচলাখ দিয়ে, তারা আমার কথায় তিনলাখ মেনে নেবে?”
সনৎবাবু
এবার একটু ঘাবড়ে গেলেন, বললেন, “ও বাবা, এতো কাণ্ড? ব্যাপার রিজার্ভ ব্যাংক অব্দি
গড়াবে?”
কমলবাবু
বিশাল বোদ্ধার মতো বন্ধুকে ঝাড়লেন, “যা বুঝিস না, তা নিয়ে কথা বলিস কেন? পাঁচলাখ
ডবল করে কি তোকে বিদেশী নোট দেবে? সে নোট তোর কী কাজে আসবে? দেশি নোট রিজার্ভ
ব্যাংক ছাড়া আর কে দেবে? ও বিপদ, তুমি রাগ করো না, বাবা, তুমি যেমন বলছো তেমনই হবে”।
বিপদতারণ
রাগ-রাগ ভাবটা আরো একটু ধরে রেখে সনৎবাবুকে বলল, “কী করবেন, দেখুন ভাবনা চিন্তা
করে। আপনাদের ভালো লেগেছিল বলে, এত কথা বললাম, তা নইলে আমরা তো মঙ্গলস্যারের বাড়িই
যাচ্ছিলাম”।
সনৎবাবু
এমন দাঁও ফস্কে যেতে দিলেন না, বললেন, “বুড়ো মানুষ কী বলতে কী বলে ফেলেছি, ওসব মনে
রাখতে নেই, বাবা। আর ভাবনা চিন্তার কিচ্ছু নেই, আমরা মনস্থির করেই ফেলেছি, আমি
পাঁচলাখ, কমল তুই কত করবি?”
কমলবাবুও
স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন, “আমিও তাই, পাঁচ কিংবা ছয় লাখ। দেখি কতটা তুলতে পারি।
ব্যাংক থেকেই ক্যাশ তুলতে হবে তো। অত কী আর ঘরে থাকে? এখন তো সবে সোয়া সাতটা বাজে,
ব্যাংক খুলবে সেই দশটায়। ততক্ষণ তোমরা কী করবে, বাবা?”
“আমরা
ততক্ষণ এই পার্কেই বসি”।
বিপদতারণের
উত্তরে কমলবাবু বেশ অবাক হলেন, জিগ্গেস করলেন, “মঙ্গলের বাড়ি যাবে না?”
বিপদতারণ
বলল, “তা কী করে হবে? যে বাড়ির কাজ সে বাড়িতে আমাদের থাকতে হবে যে! আপনাদের কাজ
করলে, অন্য বাড়ির কাজ করবো কী করে?”
সনৎবাবু
উচ্ছ্বসিত হলেন আনন্দে, বললেন, “তাই তো! সেই ভালো হবে, বাবা বিপদ তুমি আমার বাড়িতে
চলো। কমল, তুইও আমার বাড়িতেই চলে আয়। আমার বাড়িতে কাজকম্মো সেরে, রাত কাটিয়ে, কাল
সকালে আমাদের হিসেবপত্র চুকিয়ে, তারপর না হয়, মঙ্গলের বাড়ি যেও”।
“আমিও
সেটাই ভাবছি”। খুব চিন্তার ভাব নিয়ে
বিপদতারণ বলল।
সেকথায়
কমলবাবু বললেন, “আর কিচ্ছু ভাবতে হবে না, ওটাই ফাইন্যাল, বিপদ আর গোপাল তোর
বাড়িতেই থাকবে। আমিও টাকা তুলে ব্যাংক থেকে তোর ওখানে সোজা চলে আসবো”।
বিপদতারণ
বলল, “এখন আমরা তাহলে এই পার্কেই থাকি?”
সনৎবাবু
চমকে উঠে বললেন, “সে কি? কেন? আমার সঙ্গেই চলো।”
“না,
না, বলা নেই কওয়া নেই, আমরা দুজন উটকো বিপদ হুম হুম করে ঘরে ঢুকে পড়বো, কাকিমা কী
ভাববেন? আপনি বাড়ি গিয়ে কাকিমাকে সব কথা খুলে বলুন, আমরা আসছি এই ঘন্টা খানেকের
মধ্যেই!”
বিপদতারণের
এই কথায় সনৎবাবু নিজের ক্ষমতা জাহির করার জন্যে বললেন, “বাড়ির কর্তা কে, আমি না
তোমার কাকিমা? ওসব তোমায় চিন্তা করতে হবে না, বাড়িতে আমার কথাই শেষ কথা। তোমার
কাকিমা আমাকে কী বলে জানো? হে হে হে হে, পুরুষসিংহ!”
কমলবাবু
একটু বিরক্ত হলেন বন্ধুর কথায়, বললেন, “যাঃ যাঃ নিজের কথা অত ফলাও করে বলতে হয় না,
বিপদকে দেখে শিখলি না, কেমন বিনয়ী! নিজের কথা বলা তো দূরের কথা, শুনতে অব্দি চায়
না! ওরা যদি কিছুক্ষণ পার্কে থাকতে চায় তো থাক না! বাবা বিপদ, সনতের বাড়ি এখান
থেকে মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ। ইলেক্ট্রিক অফিসের উল্টোদিকে, বললেই যে কেউ দেখিয়ে
দেবে, বিপদ! সনতের বাড়ি খুঁজতে কোন অসুবিধে হয় না”।
বিপদতারণ
বলল, “ওঃ তাহলে তো কোন ব্যাপারই নেই, আমরা ঠিক পৌঁছে যাবো। আপনারা আসুন, ওদিকের
যোগাড়-টোগাড় করে, শুভকাজ যত শিগ্গির শুরু করা যায়, ততই ভালো। তবে ব্যাপারটা পাঁচকান করবেন না।
সবাই তো আপনাদের মতো লোক নয়, কার মনে কী আছে, কে জানে?”
কমলবাবু
আঁতকে উঠে বললেন, “পাগল হয়েছো? এ সব কথা কেউ পাঁচকান করে? পড়শীদের চোখ টাটাবে না?
তাহলে আসি?”
হঠাৎ
গোপাল বলে উঠল, “কাকু, কিছু টাকা অ্যাডভান্স পাওয়া যাবে? হাজার খানেক? একটু দরকার
ছিল”।
সনৎবাবু
একটু আতান্তরে পড়লেন, “হাজার খানেক? না তো বাবা, মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে, অত টাকা
সঙ্গে থাকে কি? আমার কাছে শ দেড়েক হবে। কমল, তোর কাছে?”
কমলবাবু
বললেন, “আমারও তাই, ওই শ দুয়েক”।
“তাই
দিন না, সাড়ে তিনশোতেই চালিয়ে নেবো”।
গোপালের
আব্দার শুনে সনৎবাবু এবং কমলবাবু পকেট ঝেড়ে নিঃস্ব হয়ে সব টাকা দিয়ে দিলেন। গোপাল
টাকা নিয়ে একগাল হেসে বলল, “থ্যাংকিউ, কাকু”।
সনৎবাবুও
হাসলেন, বললেন, “আমরা তাহলে এখন আসি, তোমরা আমার বাড়ি আটটা - সাড়ে আটটার মধ্যে চলে
আসছো!”
“পাক্কা,
কথার খেলাপ হবে না, কাকাবাবু”।
বিপদতারণের
আশ্বাসবাক্যে সনৎবাবু হাসলেন, বললেন, “সে আমি তোমায় প্রথম দেখাতেই বুঝেছি, বাবা”
বিপদতারণ হাসল, কিছু বলল না। দুই বন্ধু নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে কথা বলতে বলতে
এগিয়ে গেলেন পার্কের গেটের দিকে।
কিছুটা
দূরে যেতে বিপদতারণ গোপালকে জিগ্গেস করল, “হঠাৎ ভিখিরির মতো টাকা চেয়ে বসলি কেন?
ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে ভালো লাগে?”
“পকেটে
একটা পয়সা নেই, দাদা! নিজের ইচ্ছেমতো একটু চা সিগারেট খাবো, তারও উপায় ছিল না।
পতিত তোমাকে ধারের খাতায় আবার চা সিগারেট খাওয়াতো বুঝি?”
বিপদতারণ
হাসল, “তা অবশ্য ঠিক। মামার বাড়িতে আদরটুকুই জোটে, যখন ছেড়ে দেয় তখন আমরা
ট্যাঁক-খালির জমিদার। চ’ একটু চা খাই, পতিতের দোকানে নয়, অন্য কোথাও। শালার
ডিম-টুচ খেয়ে অম্বলে গলা জ্বলছে, আর চা তো নয়, যেন ঘোড়ার হিসু!”
গোপাল
বলল, “সেই জন্যেই, বুঝেছো দাদা, পতিতের দোকান ভারে নয়, ধারে কাটে”!
৪
সনৎবাবু
সদরের কলিংবেল বাজাতেই, সনৎবাবুর স্ত্রী পৃথাদেবীর কম্বুকণ্ঠ শোনা গেল, “দরজা খোলা
আছে। বেল বাজিয়ে আর পাড়া মাথায় করতে হবে না”। দরজা খুলে সনৎবাবু ভেতরে ঢুকতে
পৃথাদেবী আবারও ঝলসে উঠলেন, “কী হল আজ এত দেরি যে? পতিতের চায়ে আফিং-টাফিং মেশায়
নাকি বলতো? বাড়ির কথা আর মনেই পড়ে না?”।
সনৎবাবু
আমতা আমতা করে বললেন, “ওই একটু দেরি হয়ে গেল, মিনিট পনেরো মতো”। কাঁসার বাসন হাত থেকে মেঝেয় পড়ে যাওয়ার মতো ঝনঝনে আওয়াজে পৃথাদেবী বললেন, “আমি
কি ঘড়ি দেখতে জানি না, আমাকে টাইম বোঝাচ্ছো? রোজ সাতটায় চা করে তুমি ডাকো। আজ সাড়ে
সাতটা বাজলো, তাও তোমার পাত্তা নেই দেখে, আমিই উঠে চা করলাম”।
সামান্য
ঝাঁজ নিয়ে এবার সনৎবাবু বললেন, “একটা দিন যদি সকালে উঠে চা করেই থাকো, তাতে
হয়েছেটা কী?” আগুনে ঘিয়ের ছিটে দিলে যা হয়, তাই হল।
পৃথাদেবী
দপ করে জ্বলে উঠলেন যেন, বললেন, “তোমার ওই মিচকে পোড়া বুদ্ধি আমি বুঝি না মনে
করেছো? চা বানাতে গেলেই তোমার গায়ে জ্বর চলে আসে। ফাঁকি মারার কিছু না কিছু একটা
ছুতো ঠিক বের করে ফেলবে!”
“ওওওওঃ
ভাষার কী ছিরি – “মিচকে পোড়া বুদ্ধি”! সারারাত কি যত্তো আজেবাজে কথা চিন্তা করে,
খুলির মধ্যে জমা করে রাখো, নাকি? যাতে সকালে ঘুম থেকে উঠেই তোমার বুলি ঝাড়তে পারো!”
এবারে
কাচ ভাঙার শব্দে পৃথাদেবী বললেন, “অ্যাই যেএএএ, এ সব বুলি, তোমাদের বাড়ি থেকেই
শেখা। আমাদের বাড়িতে এরকম ছোটলোকের ভাষা কোনদিন শুনেছো? বিয়ের পর এ বাড়িতে পা
দেওয়া থেকে যেমন শুনেছি, তেমনি শিখেছি!”
“বাজে
কথা ছেড়ে কাজের কথা শোনো, দেখি! আমার চা কোথায়, বানাওনি?”
“তোমাদের
বাড়ির কথা বললেই বাজে কথা হয়ে যায়, না? আর তোমার মতো আমার মন কুচুটে নয়, নিজের চা
করলে তোমারও চা করি। রান্নাঘরে চাপা আছে, নিয়ে এসে গিলে নাও”। সনৎবাবু রান্নাঘর থেকে চায়ের কাপটা
নিয়ে এলেন।
স্ত্রীর
পাশে সোফায় বসে, চায়ের কাপে একবার চুমুক দিয়ে বললেন, “তোমার হাতে জাদু আছে, পিথু,
এমন চা আমি সাতজন্মেও বানাতে পারবো না”।
“ওসব
মন ভুলোনো তেল মাখানো কথায় আমি ভুলছি না। কী কাজের কথা আছে বলছিলে, সেটা ঝেড়ে কাশো”।
“ঠাণ্ডা
মাথায় শুনতে হবে কিন্তু, খুব গোপন কথা! তোমার যা চেঁচামেচি করা স্বভাব, ভয় হয়
পাড়ার লোক জেনে যাবে”।
“আমার
মাথা গরম? আমি চেঁচামেচি করি? আমার গলা পড়শিদের সবাই শুনতে পায়?”
“আঃ,
তাই বললাম বুঝি?”
“বলতে
বাকি কী রাখলে? এসবও তোমাদের বাড়ির শিক্ষা। তোমার মা থাকতে তো বাড়িতে কাগ-চিল বসতে
ভয় পেত! এখন দেখ গে, ছাদের আলসেতে কত কাগ বসে বসে হাগছে! হুস্ হুস্ করলেও ওড়ে না”।
“আচ্ছা,
বাবা, আচ্ছা, তোমার কণ্ঠস্বর কোকিলপোড়া-মধুমাখা, আর এবাড়ির সবার গলা চিরতা মাখা!
কথাটা বলতে দেবে”?
“ছিলই
তো! পাড়ার পাঁচজনকে জিগ্গেস করে এসো না, তোমার মায়ের গলার আওয়াজে পাশের বাড়ির
বাচ্চা ডুকরে কেঁদে উঠতো কিনা? পুকুরের ওপাড় থেকে চৌকিদার পবন সিং দৌড়ে আসেনি, এ
বাড়িতে ডাকাত পড়েছে ভেবে?”
“এখন
আবার নতুন ইতিহাস বানাতে বসলে? বলি, কথাটা শুনবে কি?”
“বললেই
শুনবো। তুমি পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করবে, আর আমি কাটাকাটা উত্তর দিলেই অমনি লেজ গুটিয়ে
কেঁউ কেঁউ...আচ্ছা বলো”।
সনৎবাবু
উত্তেজিত হয়ে বললেন, “মোক্ষম একটা সুযোগ এসেছে, চব্বিশঘণ্টার মধ্যে ঘরে বসে টাকা
ডবল”।
“আজকাল
পতিত চায়ে গ্যাঁজার রসও মেশাচ্ছে নাকি? হতভাগাকে আমি জেলে পাঠাবো!”
একটু
বিরক্ত হয়েই সনৎবাবু বললেন, “আরে, ধ্যাত্তেরি। পুরোটা না শুনেই আবোলতাবোল বকে
চলেছে। এই জন্যেই বলে মেয়েলি বুদ্ধি!”
“মেয়েছেলের
মেয়েলি বুদ্ধি হবে না তো কি, ষাঁড়ের বুদ্ধি হবে? তোমার ধানাইপানাই রেখে আসল কথাটা
কখন বলা হবে শুনি?”
“সেটাই
তো বলার চেষ্টা করছি, তুমিই তো বার বার ব্যাগড়া দিয়ে খেই হারিয়ে দিচ্ছো! পতিতের
দোকানে আজ দুজনের সঙ্গে আলাপ হলো, বিপদতারণ আর গোপাল। দুজনে যাচ্ছিল মংলার বাড়ি
টাকা ডবল করতে”।
“মংলার
বাড়ি? তার টাকার অভাব? তাকেও টাকা ডবল করতে হয়?”
“সেই
কথাই তো ওদের বললাম, আমরা গরিবদুঃখী থাকতে তোমরা মঙ্গলবাবুর বাড়ি যাবে কেন, ভাই?
আমাদের বিপদের হাত থেকে তোমাকেই রক্ষা করতে হবে, বাবা”।
“এই
আমরাটা আবার কে? তোমার সঙ্গে আর কে ছিল?”
“কেন?
কমল ছিল, রোজই তো আমরা একসঙ্গে মর্নিং ওয়াকে যাই”।
“আবার
সেই কমল? তাকেও তুমি এর মধ্যে জোটালে?”
“আরে
বুঝছো না, পুরোনো বন্ধু সঙ্গে থাকলে যুক্তি শলা-পরামর্শ করতে সুবিধে হয়”।
“ছাই
হয়। সব ব্যাপারে ওর তোমাকে টেক্কা দেওয়ার স্বভাব – এ আমি বরাবর দেখে আসছি। কুচুটে
আর হাড়ে বজ্জাত!”
“যাঃ।
এ তোমার রাগের কথা। তারপর কী হল শোনোই না!”
“আর
কী শুনবো, আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। আমাদের টাকা ডবল হলে, ওদের ওপর আমরা একটু ইয়ে
করতে পারতাম! কমলের বউয়ের যা গুমোর! আমার থেকে অন্ততঃ দশ বছরের বড়ো...” মুখ ভেংচে
ব্যাঁকা ব্যাঁকা উচ্চারণে পৃথাদেবী কমলবাবুর স্ত্রীর নকল করে বললেন, “দিদিভ্যাই,
তুমি না থ্যাকলে একা একা বাড়িতে আমি তো ভয়েই মরে যেতাম”। ন্যাক্কাআ! আমি যেন
সাতকেলে বুড়ি, আর উনি কচি খুকি, নাক টিপলে দুধ বেরোয়। আদিখ্যেতা একদম সহ্য হয় না!”
“তুমি
কী এখনই কমলের বউয়ের গুষ্টি উদ্ধার করতে বসলে? এদিকে কত কাজ পড়ে আছে, জানো?”
“আচ্ছা
বলো”।
“ওরা
সাড়ে আটটা নাগাদ আমাদের এখানেই আসবে”।
“কারা
আসবে”?
“বললাম
যে, বিপদতারণ আর গোপাল – ওরাই তো টাকা ডবল করবে!”
“তা
আসে আসুক না, আমি কি তাদের বাড়া ভাতে ছাই ঢালতে যাবো নাকি?”
“ওরা
দুপুরে খাবে। রাত্রে থাকবে, রাত্রেও খাবে। কাল সকালে আমাদের ডবল টাকার হিসেব
বুঝিয়ে তারপর যাবে”।
“তার
মানে? এটা কি সরকারি লঙ্গরখানা, নাকি বিনি পয়সার ভাতের হোটেল! চারবেলা করে শুধু
থাকবে আর খাবে! আমি ওসব পারবো না”।
“ওফ্
কথাটা বুঝছো না! ওদের হাতে টাকা তুলে দেবো, তারপর যদি গা ঢাকা দেয়! আমাদের বাড়িতেই
রাখবো, যতক্ষণ না টাকা ডবলের হিসেব দিচ্ছে, ততক্ষণ ছাড়া হবে না!”
“অ
তাই বুঝি? কদিন আগে টিভিতে দেখাচ্ছিল বটে, চিটিংবাজ কিছু লোক এইভাবে টাকা নিয়ে
গায়েব হয়ে যায়, তারপর আর ফেরে না”।
“তবে?
আমাকে কি অত বোকা পেয়েছো? আমি কড়ার করে নিয়েছি, কোত্থাও বেরোনো হবে না, টাকা ডবল
হলে, পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে তবে মুক্তি!”
“পাওনাগণ্ডা?
ফোকটে থাকবে, খাবে, তারপরেও আবার পাওনা কিসের?”
“বাঃ
রে, ওরা একটা কমিসন নেবে না?”
“সেটা
কত?”
“পাঁচলাখে
পঞ্চাশ চেয়েছিল...”
“তার
মানে?”
“আমি
ওদের পাঁচ লাখ দেব, ওরা আমাকে সাড়ে ন লাখ দেবে!”।
“প-ন-চা-শ?
টাকা কি খোলামকুচি নাকি?”
“আরে
না রে, বাবা, না। আমাকে অত বোকা পেয়েছো নাকি? পঞ্চাশ বললেই অমনি পঞ্চাশেই রাজি হয়ে
যাবো? পঁচিশ দিয়ে শুরু করেছিলাম, অনেক দরদাম, আকচাআকচি করে তিরিশে নামিয়েছি”।
“মাথামোটা,
তুমি আর বুদ্ধির বড়াই করো না। আমি হলে দশ দিয়ে শুরু করে পনেরোয় রফা করে ফেলতাম। তোমরা
ব্যাটাছেলেদের এমন আলবড্ডে-উড়নচণ্ডে স্বভাব কেন বলো তো? হাতে কিছু টাকা আসতে না
আসতেই ওড়াতে শুরু করো? টাকা রোজগার করতে কতো মেহনত করতে হয় জানো?”
“বা
রে সারাজীবন চাকরি করলাম, সংসার পালন করলাম, আমি জানবো না?”
“যাও
যাও আমার কাছে আর ঝাঁপ খুলো না। বাপ কিছু ইঁটকাঠ লোহা যোগাড় করে বাড়িটা রেখে
গেছিলেন, তাই তোমার এত ফোপরদালালি! তারপর আমি এসে সংসারের হাল ধরাতে, এ যাত্রায়
কোনরকমে উৎরে গেলে। অন্য কেউ হলে তোমার নাকের জলে চোখের জলে অবস্থা হতো”।
“আচ্ছা,
আচ্ছা, সে সব কথা পরে শুনবো। আমি পাক্কা দশটায় ব্যাংকে যাবো। তার আগেই সব ঠিকঠাক
করে ফেলতে হবে!”
“ব্যাংকে
কেন?”
“টাকা
তুলতে হবে না? ঘরে আর কত আছে? ভাবছি পাঁচ তুলবো...” । সনৎবাবুর কথা শেষ হবার আগেই সদর
দরজায় বেল বাজল। “ওই ওরা এসে গেল মনে হয়”।
“কারা
আবার এল এই অসময়ে?
“বললাম
যে বিপদতারণ আর গোপাল আসবে, যারা টাকা ডবল করবে। আমাদের এখানে থাকবে”! সনৎবাবু
সোফা থেকে উঠে দরজা খুলতে গেলেন। দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকে পড়ল বিপদতারণ আর গোপাল।
বিপদতারণ পৃথাদেবীকে দেখেই, নিচু হয়ে প্রণাম করল, বলল, “আপনি
নিশ্চয়ই কাকিমা?”
পৃথাদেবীর মতো ভারি ভারিক্কি জাঁদরেল মহিলাও বিপদতারণের এই
আচমকা ভক্তিতে থতমত খেয়ে বললেন, “হ্যাঁ...মানে না, ইয়ে আমিই...”
“ও আমি দেখেই বুঝেছি! সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা দর্শন হল। গোপাল,
প্রণাম কর, এমন সুযোগ বড়ো আসে না, রে!” গোপালও প্রণাম করতে পৃথাদেবী ভক্তের
ভক্তিতে আপ্লুত হলেন, বললেন, “আরে বোসো বোসো, চা খাবে তো? চা করে আনি”।
বিপদতারণ বাধা দিয়ে বলল, “ব্যস্ত হবেন না কাকিমা! বরং
আপনারা দুজনে পাশাপাশি বসুন, দু চোখ ভরে একটু দেখি”! সনৎবাবু বিপদতারণের কথায়
মুগ্ধ হয়ে পৃথাদেবীর পাশে সোফায় বসলেন, উচ্ছ্বসিত বিপদতারণ বলল, “আহা, যেন হরগৌরী,
শিব-পার্বতী! বেশ মানিয়েছে! এবার চট করে
কিছু কাজের কথা সেরে নিই? প্রথমেই জিগ্গেস করি, ওই কাকুটা – কমলকাকু আপনার
স্কুলের বন্ধু বললেন, কেমন লোক?”
সনৎবাবু অবাক হয়ে জিগ্গেস করলেন, “কেন বলো তো?”
“ছোটমুখে বড়ো কথা শুনে রাগ করবেন না যেন, উনি কিন্তু তেমন
সুবিধের লোক নন”।
বিপদতারণের কথাটা পৃথাদেবীর ভীষণ মনঃপূত হল, তিনি উত্তেজিত
হয়ে বললেন, “ওই কথাটাই তো আমি সারাটা জীবন তোমার কাকুকে বলে আসছি। কিন্তু আমার কথা
কানে তুলবে কেন? ওই প্রাণের বন্ধুর জন্যে তোমার কাকুর সংসার-পরিবার সব শত্রু হয়ে
গেছে!”
বিপদতারণ খুব চিন্তান্বিত মুখে বলল, “না, না, কাকাবাবু,
কথাটা হাল্কাভাবে নেবেন না। উনি কিন্তু চান না, আপনার ভালো হোক, আপনার উন্নতি হোক”।
বিপদতারণের কথায়, পৃথাদেবীর মনে বহুদিনের জমানো ক্ষোভ যেন
ফেটে বেরিয়ে এল, বললেন, “যে দেখবে, সেই বলবে! কী জাদুতে যে তোমার কাকুকে ও বশ
করেছে, কে জানে! কিছু বলতে গেলেই একেবারে ফোঁস করে ওঠে। বলে, আমার স্কুলের বন্ধু!”
“কাকাবাবু শিবতুল্য মানুষ। উনি কী করে আন্দাজ পাবেন কোন
লোকের পেটে কী চাল আছে?”
বিপদতারণ এবার সনৎবাবুর হয়ে সাউখুরি করতে গেল, তাতে ফল হল
উলটো, পৃথাদেবী ঝংকার দিয়ে বলে উঠলেন, “শিবতুল্য না ছাই, মাথামোটা আর একলষেঁড়ের
একশেষ! যে পারে এসে মাথায় কাঁঠাল ভাঙে”।
“সে যাই হোক, কমলকাকু আসবেন, আসুন। ওঁনার সঙ্গে যেন কেউ না
আসে, এ কথাটা একটু কড়া করে বলে দেবেন”।
পৃথাদেবী আকাশ থেকে পড়লেন, বললেন, “কমলও আসবে নাকি? কই আমাকে তো বলোনি? সেও এখানে থাকবে, খাবে?”
“বলার আর সুযোগ দিলে কোথায়?” সনৎবাবু আমতা আমতা করলেন।
পৃথাদেবী বললেন, “আমি সুযোগ দিলাম না? এতক্ষণ এত আবোলতাবোল
বকতে পারলে, আর ওই কথাটাই বলা হল না? ভাগ্যিস বিপদ বলল, তা নইলে তো বিপদ আরো
বাড়তো। তোমারই নাম বিপদ তো?”
বিপদতারণ বিনয়ের অবতার হয়ে বলল, “আজ্ঞে, হ্যাঁ। আমিই
বিপদতারণ, কিন্তু পুরো নামটা না বলে, সবাই বিপদ ডেকে আনে”।
বিপদতারণের কথায় পৃথাদেবী মজা পেলেন, বললেন, ““বিপদ ডেকে
আনে”? হি হি হি হি, বেশ বলেছো কথাটা”।
পৃথাদেবী যে হাসতে জানেন, সে কথাটা
সনৎবাবুও ভুলে গেছিলেন। মুগ্ধ নেত্রে তাকিয়ে রইলেন স্ত্রীর মুখের দিকে।
ওদিকে গোপাল বলল, “এ সেই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো! বিপদ
ডেকে বিপদ তাড়ানো”! গোপালের রসিকতায় সনৎবাবুও এবার হাসলেন খুব, সঙ্গে পৃথাদেবী!
হাসি থামলে বিপদতারণ বলল, “আর হাসি ঠাট্টা নয়, কাজের কথা।
আজকের এই যজ্ঞের জন্যে অনেক আয়োজন করতে হবে। আমাদের কিন্তু বেশি সময় নেই,
কাকাবাবু। প্রথমেই আমাদের একটা নির্জন ঘর দরকার, যেখানে টাকা ডবল হবে!”
পৃথাদেবী জিগ্গেস করলেন, “নির্জন মানে?”
“একটু আলাদা, যেখানে আপনারা কয়েকজন, মানে আপনি, কাকাবাবু,
বিমলকাকু ছাড়া, আর কেউ ঢুকবে না”।
“কতক্ষণের জন্যে”?
“মোটামুটি চব্বিশ ঘন্টা ধরে রাখুন। কাকাবাবু ব্যাংক থেকে
কখন আসবেন?”। বিপদতারণের প্রশ্নের উত্তরে সনৎবাবু বললেন,
“ব্যাংকের ব্যাপার তো, কতক্ষণ লাগবে কে জানে? দশটায় ব্যাংক
খুলতেই যাবো, একটা দেড়টা তো হয়েই যাবে”!
গভীর চিন্তা করতে করতে বিপদতারণ বলল, “হুঁ, আজ দেড়টা-দুটোর
মধ্যে যদি শুরু করতে পারি, আশা করি কাল দশটা এগারোটার মধ্যে আপনাদের খুশি করতে
পারবো”।
পৃথাদেবী ব্যাকুল হয়ে বললেন, “তাই? কাল সকালেই ডবল?
বিশ্বাসই হচ্ছে না!”
সনৎবাবুও বললেন, “প্রথম শুনে আমারও বিশ্বাস হয়নি”।
“আজ্ঞে সে কথা একশ বার, বিশ্বাস না হবারই কথা। সবই মা
বিপত্তারিণীর কৃপা। কিছুটা গঙ্গাজল লাগবে। একছড়া কলা লাগবে, হাইব্রিড নয়, দিশি
মর্তমান কিংবা কাঁটালি। কিছু কুচো ফুল, তুলসী, দুব্বো আর বেলপাতা। আর যদি পাঁচটা
ফল দেন, ব্যস্। মা ওতেই সন্তুষ্ট!”
পৃথাদেবী অবাক হয়ে জিগ্গেস করলেন, “কার মা সন্তুষ্ট হবেন?”
গোপাল বলল, “দাদার মা, মা বিপত্তারিণী!”
“বিপত্তারিণী মায়ের পুজো হবে নাকি?”
“পুজোই তো! মা বিপত্তারিণীর পুজো, আমার দাদা যে তাঁর মানস
পুত্র!”
গোপালের কথায় বিরক্ত বিপদতারণ আবার বাধা দিয়ে বলল, “গোপাল
তোকে বলেছি না, আমার কথা নয়, কাজের কথা বল। এ বাড়িতে আপনারা দুজন ছাড়া আর কে আছেন?”
“কেউ না। ছেলে থাকে ব্যাঙ্গালুরু, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে,
দিল্লীতে থাকে। কেন?” পৃথাদেবী জিগ্গেস করলেন।
“কাজের লোক-টোক, মাসি-টাসি?” বিপদতারণ জিগ্গেস করল।
“তা আছে, তবে তারা কাজ সেরে চলে যায়”।
“ভালই হয়েছে, আজ বিকেলে তাদের ছুটি দিয়ে দিন। বলবেন কাল একটু বেলা করে আসতে”!
পৃথাদেবী ভুরু কুঁচকে জিগ্গেস করলেন, “তাহলে ঘরের
কাজকম্মো?”
বিপদতারণ খুব আবদারের গলায় বলল, “একটাই বেলা, একটু সামলাতে
পারবেন না, কাকিমা? আসলে সংসারে সকলেরই টাকাপয়সার খুব দরকার। কিন্তু অর্থ অনর্থের
মূল সেটা তো মানবেন? কার মনে কী আছে, কী থেকে কী হয়, সে কি আর বলা যায়? একটু
সাবধান হওয়াই ভালো!”
সনৎবাবু পূর্ণ সমর্থন করে বললেন, “খুবই সত্যি কথা”।
গোপাল ফোড়ন দিল, “টাকার গন্ধ – কাঁঠালের মতো। ছাড়ালেই মাছির
উপদ্রব শুরু হয়ে যায়”।
বিপদতারণ বলল, “ঠিক কথা। আর টাকাও তো খুব কম নয়, কাকুর দশ
লাখ, কমলকাকুর বারো – মোট বাইশ”।
পৃথাদেবী চমকে উঠে বললেন,
“তার মানে? কমলের বারো কেন? আমাদের কম আর ওর বেলায় বেশি হবে
নাকি?”
সনৎবাবু বললেন, “না, না, কমল বলছিল ও ছয় মতো তুলবে, ডবল
করার জন্যে!”
পৃথাদেবী আবার ঝংকার তুলে বললেন, “দেখেছো, তুমি কেমন
ম্যাদামারা? আমরা সব ঝক্কি পোয়াবো, আর তোমার প্রাণের বন্ধু কমল, গায়ে হাওয়া দিয়ে
বারো লাখ কামিয়ে বগল বাজাবে!”
সনৎবাবু বললেন, “ব্যাপারটা আমাদের হাতের মধ্যে থাকবে, সেটা
বুঝছো না কেন? ওর বাড়িতে হলে আমাকে ছাড়া ওরা আর কাউকে ঢুকতে দিত?”
একথাটা পৃথাদেবী কিছুটা যুক্তিযুক্ত মনে করে বললেন, “তা
বটে। ওর ওই গুণ্ডা ছেলে আর পটেরবিবি ছেলের বৌটাও সারাক্ষণ মাতব্বরি করতো”।
স্ত্রীর সমর্থনে সনৎবাবু কিছুটা জোর পেয়ে বললেন, “তবে?
আমাকে কী এতই বোকা ঠাউরেছো?”
“থাক থাক খুব বাহাদুরি করেছো। তবে আমি এই কিন্তু বলে
রাখলাম, কমল যদি বারো লাখ কামায়, আমার চোদ্দ চাই। আমার অনেকদিনের শখ, ইওরোপ যাবো,
লণ্ডন, প্যারিস, বার্লিন, রোম...”।
পৃথাদেবীর স্বপ্নকথায় সনৎবাবু খুব একটা উৎসাহ পেলেন না,
বললেন, “আচ্ছা, আচ্ছা, সে হবে খন, কিন্তু সাত লাখ তুলতে হলে, এত তাড়াতাড়ি হবে না,
মনে হয়, কেভিপি ভাঙাতে হবে”।
“পরে আবার করা যাবে না? মানে দশ লাখ থেকে বিশ লাখ! তখন
তোমার কমলকে না বললেই হল”।
পৃথাদেবীর সমাধানের উত্তরে বিপদতারণ বলল, “কাকিমা, একই
পরিবারে বছরে একবারের বেশি টাকা ডবল করা যায় না। মায়ের সেরকমই নির্দেশ”।
“কার মায়ের নির্দেশ?”
অবাক হয়ে পৃথাদেবী জিগ্গেস করলেন, উত্তরে গোপাল বলল, “মা
বিপত্তারিণীর, দাদা যে তাঁর বরপুত্র”।
“ও বাবা, খুব জাগ্রত বুঝি? তাহলে শুনছো, এক কাজ করো না,
ফুটিকে বলে দাও, তোমার অ্যাকাউণ্টে তিনলাখ পাঠিয়ে দেবে...বলবে ধার, কাল বা পরশু
আবার ফিরিয়ে দেবে!” ফুটি পৃথাদেবীর মেয়ে, জামাইয়ের সঙ্গে দিল্লিতে থাকে। সনৎবাবু
বললেন, “কথাটা মন্দ বলোনি, কিন্তু মেয়ে-জামাইয়ের থেকে ধার করবো?”
পৃথাদেবী বললেন, “তাতে কী? আজকাল মেয়ে আর ছেলেতে কোন তফাৎ
আছে নাকি? আর ফুটির বরের মতো ছেলে হয়? ও খুশি হয়েই দেবে!”
“তা ঠিক, কিন্তু জামাই তো!”
“জামাই তো কী হয়েছে? অমন জামাই লাখে একটা মেলে, আমার ফুটির
কথায় কেমন ওঠে বসে! তোমার ছেলের মতো নয়, বউ ছাড়া তার এক পা চলার ক্ষমতা আছে?
পোড়ারমুখো বউয়ের আঁচলে বাঁধা, হতভাগা জরু কা গোলাম”।
সনৎবাবু বললেন, “আচ্ছা, ফুটিকেই বলছি”! তারপরই হঠাৎ মহা
আনন্দে উত্তেজিত হয়ে বললেন, “তাহলে আমাদের আটদুগুণে ষোলো হয়ে যাবে গো!”
গোপাল বলল, “আলবাৎ, ষোলো কলা পূর্ণ হবে”।
পৃথাদেবী খুব রাগ রাগ স্বরে বললেন, “তোমার ওই কমলের নাকে
ঝামা না ঘষলে আমার শান্তি নেই, ও করবে বারো, আমাদের ষোলো”।
মহা আনন্দের উচ্ছ্বাসে সনৎবাবু অল্প নাচতে নাচতে বললেন, “ওফ্,
কমলটা দেখবে আর জ্বলবে – লুচির মতো ফুলবে”।
সনৎবাবুর কথায় গোপাল বড়ো দুখি গলায় বলল, “কতদিন কালো জিরে
ফোড়নের আলু চচ্চড়ি দিয়ে ফুলকো লুচি খাইনি, দাদা!”
ভীষণ রেগে গেল বিপদতারণ, বড়ো বড়ো চোখ করে ধমকে উঠল, “বেরিয়ে
যা, আমার চোখের সামনে থেকে তুই, দূর হয়ে যা। ছি ছি, এত্তো লোভ তোর?”
গোপাল খুব কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “ও দাদা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি
দাদা, আর কক্খনো লোভ করবো না, এবারকার মতো ক্ষমা করে দাও”।
পৃথাদেবীর মনটা খুব তরল হয়ে এল দুজনের কথাবার্তায়, তিনি
বললেন, “কি বিপদ, দুখানা লুচি খেতে ইচ্ছে হয়েছে বলে, ওকে অমন ধমকাচ্ছো কেন, ও বিপদ?
তোমার ইচ্ছে হয় না?”
গোপাল ভীষণ আতঙ্কে কান নাক মুলে, এতবড়ো জিভ বের করে বলল, “ইসস্স্স্,
দাদা যে সব কিছুর ঊর্ধ্বে – নির্বিকার, উদাসীন”!
পৃথাদেবী তাও শুনলেন না, বললেন, “তা হোক, কলমির মা আসুক,
আমি ময়দা মাখিয়ে খান কতক লুচি ভেজে দিচ্ছি। ছেলেটা বড়ো মুখ করে খানকতক লুচি খেতে
চাইল...! কিন্তু তুমি কি বসে বসে শুধু লেজ নাড়বে, না বাজারেও যাবে?” শেষ কথাটা
তিনি সনৎবাবুকে বললেন।
সনৎবাবু থতমত খেয়ে বললেন, “লেজ আবার কখন...কী আনতে হবে বলো
না ছাই...”।
“ও মা! বিপদ যে বলল, পুজোর বাজার। তার ওপর তিন তিনজন বাইরের
লোক খাবে, প্লাস আমরা দুজন, কিছু আনবে না? এই মাছ, টাছ...?”
গোপাল আগের মতোই ভীষণ আতঙ্কে যেন শিউরে উঠল, বলল, “ইস্স্স্স্,
দাদা যে শুদ্ধ শাকাহারী। গরম ভাত, একটু ঘি, নুন, কাঁচা সরষের তেল, দুটো কাঁচা
লংকা। সঙ্গে দুটো আলুপটল ভাতের চালের মধ্যে টবাং...ব্যস্”।
সনৎবাবু অবাক হয়ে জিগ্গেস করলেন, “টবাং মানে”?
“হাঁড়িতে জল আর চাল চাপিয়ে, তার মধ্যে একটু ওপর থেকে আলু
ছেড়ে দেখবেন, ওই রকমই আওয়াজ হয়!”। গোপালের কথায় সনৎবাবু খুব হাসলেন, পৃথাদেবীও হাসলেন,
মুখে আঁচল চাপা দিয়ে। বিপদতারণ হাসল না, বরং কড়া চোখে তাকিয়ে রইল গোপালের দিকে।
হাসি থামলে পৃথাদেবী সনৎবাবুকে তাগাদা দিলেন, বললেন, “এই
তোমার দোষ, একবার আড্ডা মারতে বসলে তোমার আর কাজের কথা মনে থাকে না। ফুটিকে ফোন
করো। বাজারে যাও। ততক্ষণে আমি ওদের ওপরে নিয়ে গিয়ে টাকা ডবলের ঘর দেখাই...ওদিকে কলমির
মায়ের আসার সময় হয়ে যাচ্ছে, বসে থাকার সময় আছে? যে দিকটা না দেখবো সেদিকেই সবাই
অনর্থ বাধিয়ে বসবে। তোমরা আমার সঙ্গে ওপরে চলো, বাবা, তোমাদের ঘর দেখাই”।
পৃথাদেবী ওদের নিয়ে ওপরে উঠলেন, সনৎবাবু তিনখানা থলি - একটা
মাছের, একটা পুজোর, আরেকটায় অন্য বাজা্র - নিয়ে বেরিয়ে গেলেন বাজারে।
৫
“অ বুইদি, ওপরের নোক দুটো কে গো? আগে
কোনদিন দেকিনি!” ঘর ঝাঁট দিতে দিতে কলমির
মা, মিতা জিগ্গেস করল পৃথাদেবীকে। পৃথাদেবী ছিলেন রান্নাঘরে। তিনি সামনে না
থাকলেই মিতার ঘর ঝাঁট দেওয়ায়, পরিষ্কার হয় কম, কিন্তু আওয়াজ হয় খুব। মেঝের নোংরা
সবেগে দৌড়ে যায় আলামারির তলা, খাটের তলা কিংবা সোফার তলায়। রান্নাঘর থেকে পৃথাদেবী
উত্তর দিলেন, “কেন রে? কিছু বলছিল?”
“না
তা ক্যানে বলবে? তাই জিগ্গেস করতেছিলাম”। পৃথাদেবী
জানেন কলমির মায়ের কৌতূহল ভীষণ, এবং যে কোন সংবাদ পাড়াময় চাউর করতে ওর জুড়ি মেলা
ভার। গুছিয়ে মিথ্যে বলাটাও একটা শিল্প, মিথ্যেটাকে সত্যির মতো বিশ্বাসজনক করতে না
পারলে, ওরা দুয়ে দুয়ে চার করে নেবে।
তিনি
খুব সাবধানে মিথ্যের প্রথম ধাপে পা দিলেন, “এসেছে, ফুটির শ্বশুরবাড়ির লোক”।
“অ,
আমি ভাবতেছিলাম, কে না কে? তবে যাই বলো বুইদি, নোকগুলোর দিষ্টি ভালো না”।
কলমির
মায়ের গুগলিতে পৃথাদেবী প্রমাদ গুনলেন, খুব সাবধানে কিছুটা হাল্কা অফেন্সের সঙ্গে
ডিফেন্স করলেন, “কার দৃষ্টি কেমন, সেদিকেও তোর নজর?”
“আমাদের
গতর খাটিয়ে খেতে হয়, বুইদি, সবদিকে নজর না দিলে চলে?”
খুব
সতর্ক পা ফেললেন পৃথাদেবী, বললেন, “বাবাঃ, তা কী দেখলি?”
“গিলে
খাবে যেন, এমন নজর”।
পৃথাদেবী
ঝুঁকি না নিয়ে ফ্রন্টফুটে ডিফেন্স করলেন, “যাঃ বাজে বকিস না! খুব ধর্ম-টর্ম,
পুজো-আচ্চা নিয়ে থাকে, মোটেও খারাপ লোক নয়”।
“খারাপ
নোক কী আমি বলিচি, বলিচি দিষ্টিটা ভালো নয়কো”।
পৃথাদেবী
এবার একটু অফেন্সে গিয়ে বললেন, “আমাদের সে খবরে কী দরকার বাপু, কাজে এসেছে, আজকে
থেকে কাল চলে যাবে”।
“অ
তা ভালো, তা কী কাজ?”
পৃথাদেবী
ভেবেছিলেন, কাজের কথা শুনলে কলমির মা, চুপ করে যাবে, কিন্তু তার হঠাৎ প্রশ্নে তিনি
বিপদে পড়ে বললেন, “কাজ? ইয়ে, কাজ, মানে ...তোর এত খবরে কী দরকার রে?”
“আমার
আবার কী দরকার, এমনি জিগ্গেস করতেছিলাম”।
নিরীহ
শোনালেও কলমির মায়ের কথাগুলোতে স্বস্তি পেলেন না পৃথাদেবী, সামলে নিতে বললেন, “চাকরির
ইন্টারভিউ দিতে এসেছে”।
মুখে
আঁচল চাপা দিয়ে হাসল কলমির মা, বলল, “হাসালে গো, বুইদি, সামতাপুরে এয়েচে চাকরির
ইন্টারভিউ দিতে? হি হি হি হি...”।
গা
জ্বলে গেলেও মাথা ঠাণ্ডা রাখলেন পৃথাদেবী, বললেন, “কেন? সামতাপুর এমন কী খারাপ
জায়গা?”
“হি
হি হি, এখানে চাকরি মানে রিকশা চালানো আর চুল্লুর ঠেক চালানো! ওদের কোন চাকরি,
বুইদি”।
পৃথাদেবী
আর ডিফেন্সে না গিয়ে সপাটে অফেন্স করলেন, “আমি অত জানিনা। তুই তাড়াতাড়ি হাত চালা।
ঘর ঝাড়ু দিয়ে ময়দা মাখতে হবে”।
কিন্তু
অফেন্সের উত্তর না দিতে পেরে কলমির মা থেমে যাবে, এটা ভাবা পৃথাদেবীর মস্ত ভুল
হয়েছিল, সে ঝংকার দিয়ে বলল, “আমি কি মেশিন নাকি, আর কত হাত চালাবো? হুড়োতাড়া করলে
তো বলবে, এখানে কুটো পড়ে আছে, ওখানে ময়লা পড়ে আছে, কী ঝাড়ু দিলি, কলমির মা? তুমি আবার
যা ছুঁচিবাই!”
ছুঁচিবাই
শুনেই পৃথাদেবীর মাথায় আগুন চড়ে গেল, তিনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এসে
বললেন, “আমি ছুঁচিবাই? তোর এতবড়ো আস্পদ্দার কথা?”
কলমির
মা পৃথাদেবীর তুলনায় বাক্-যুদ্ধে অনেক দক্ষ, তিনহাত এগিয়ে সে পৃথাদেবীকে আঘাত
করেছে, এখন একহাত পিছিয়ে একটু হাল্কা আঘাত দিয়ে বলল, “আচ্ছা লাও, আর রাগ করতে
হবেনি, ছুঁচিবাই লও, পিটপিটে...”।
একথাটা
কিছুটা সম্মানজনক, পৃথাদেবী আপোষে আসতে, সুর নরম করে বললেন, “কবে আমি তোর সঙ্গে
পিটপিট করি রে, কলমির মা, যে তুই এমন কথা বলছিস?”
মিচকি
হেসে কলমির মা হাল্কা গলায় বলল, “সে বলা শক্ত। তবে কবে করো না, সে বলা খুব সহজ, হি
হি হি হি”।
কলমির
মায়ের একের পর নক আউটে হতাশ পৃথাদেবী আবার রেগে গেলেন, বললেন, “তোর খুব চোপা হয়েছে
কলমির মা, চুপ করে কাজ কর...”।
যতই
হোক মনিব, মাসের শুরুতে হাত পেতে গুণে গুণে টাকাও নেয়, বার বার আঘাত করাটা আর
নিরাপদ নয়, কলমির মা এবার অন্য রাস্তা ধরল, বলল, “দুটো কতা বললেই চোপা? আমি ময়দা
মাকতে পারবোনি, আমার গুড়ুলে ব্যথা!”
“গুড়ুল
মানে?”
“গুড়ুলই
তো! তোমরা কী বলো? এই তো একেনে”। কলমির
মা পায়ের গোড়ালি দেখালো!
“অ
গোড়ালি? তা গোড়ালিতে কী করে ব্যথা হল?”
পৃথাদেবী
সুর নরম করে জিগ্গেস করলেন, গল্প বলার সুযোগ পেয়ে কলমির মা শুরু করল, “কাল কলমির
বাবা একপেট তেল খেয়ে নদ্দমায় পড়ে গেছিল। মুখপোড়া মিনসের তাও হুঁশ ফেরেনি। আমি খপর
পেয়ে দৌড়ে গেলাম। চেহেরা যত চিমড়ে কাটিপানা হোক, ব্যাটাছেলের শরীল, একা তুলতে পারব
ক্যানে? টানা-হেঁচড়াতে গুড়ুলে টান লাগলো! চলতে ফিরতে কী কষ্ট গো, বুইদি, বলে
বুজোতে পারবনি”।
“কলমির
বাবা হঠাৎ তেলই বা খেতে গেল কেন? কী তেল? সরষের নাকি নারকেল?”
এমন
একটা লুজ বলের সুযোগ ছাড়ার লোক কলমির মা নয়, সে দুম করে বলে বসল, “অম্মা, বুইদি
বেশ ন্যাকাবোকা আছো কিন্তু! তেল মানে সে তেল লয় গো, এ তেলে নেশা হয়”।
গরজ
বড়ো বালাই, কথাটা হজম করে নিয়েও পৃথাদেবী বললেন, “অ বুঝলাম, কিন্তু তোর গুড়ুলে
ব্যথা তো ময়দা মাখতে কী হয়েছে? তুই কী পায়ে ময়দা মাখবি নাকি?”
পৃথাদেবীর
নাচার অবস্থা বুঝতে কলমির মায়ের এতটুকুও অসুবিধে হল না, সে আরো একটু টাইট দিতে
বলল, “ও বুইদি গো, শুদু কী গুড়ুলে? সারা গতরে ব্যতা। কাঁদে, কাঁকালে, গুড়ুলে,
বগলে...। কলমির বাপ বলছেল, আজ আর কাজে যাসনি কলমির মা, একটা দিন এস্ট নে...তা আমি
বললাম, বুইদিরা যা গতরখাকী, না গেলে সারাদিন আমায় গাল পাড়বে, আর হুঁচুট খেতে খেতে
আমার ঠ্যাঙ ভাঙবেনে?”
বার
বার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত পৃথাদেবী এখন আর প্রতিবাদের জোরও হারিয়ে ফেলেছেন, শীতল স্বরে
বললেন, “আমি গতরখাকী”?
কলমির
মাও বুঝলো পৃথাদেবী কাবু হয়ে এসেছেন, কাজেই আর আঘাত নয়, মলম লাগানো দরকার, বলল, “লাও
তোমায় বললাম নাকি? সব কতা লিজের গায়ে টেনে লাও ক্যানে? বলতেছিলাম ও বাড়ির বুইদির
কতা। তুমি একটু আলসে কিন্তু গতরখাকী লও”।
পরাস্ত,
পরাভূত পৃথাদেবী একটু সেন্টিমেন্টাল হয়ে উঠে বললেন, “তোর বয়েস আর আমার বয়েস কলমির
মা? তোর বয়েসে আমি এই সংসার একা সামলেছি। তখন তোর দাদাবাবুর মাইনে ছিল কম, কাজের
লোক রাখার সাধ্য ছিল না। একা হাতে এই বাড়ি, ছোট ছোট ছেলে মেয়ে, বরের অফিসের ভাত,
শাশুড়ির সেবা...সব সামলেছি। তখন তুই ছিলি কোথায়? এখন আর পারি না, তাই তোরা আলসে
দেখিস”। আবেগে পৃথাদেবীর গলা কেঁপে উঠল একটু।
বিজয়িনী
কলমির মা, হেরো পৃথাদেবীকে বিদ্রূপ করার এমন সুযোগও হাত ছাড়া করলো না, বলল, “অ
বুইদি, কেঁদে দিওনি গো! দাদাবাবু বাজার থেকে এসে, দেকলে কী ভাববে? ভাববে আমি তোমায়
ঠেইলে দিছি। হিহি হিহি”।
পৃথাদেবী
আত্মসমর্পণ করে নিয়ে বললেন, “তোর ঘর ঝাঁট দেওয়া হল? বলছি না, ময়দা মেখে দে, যাবার
সময় তোর জন্যে খানচারেক লুচি আর আলুচচ্চড়ি দেবো, নিয়ে যাস”।
আর
একটু মোচড়ে পৃথাদেবীকে নক আউট করে কলমির মা বলল, “অ বুইদি, আর চারখান বেশি দিও,
কলমির বাপটা আজ রিকশ নিয়ে বেরোয়নি, ঘরেই আচে”।
“আচ্ছা,
সে হবে খন, তুই কাজ সেরে রান্নাঘরে আয়, আমি ময়দা বের করছি”। পৃথাদেবী রান্নাঘরের আড়ালে চলে যেতেই
কলমির মা ঘরের মেঝেয় পা ছড়িয়ে বসল। ঝাড়ু রেখে আঁচল নাড়িয়ে নিজেকে হাওয়া করতে লাগল।
তারপর গুনগুনিয়ে গান ধরল,
“বাবলা পাতার কষ লেগেচে, ও সে যায়না তো তোলা,
ছুঁচোর
গায়ের গন্ধ কি যায় আতর মাকালে,
ও
ভোলা মন আতর মাকালেএএএ।
মনকলসে
চিড় ধরেচে, ও
জল যায় না তো ভরা
কেলে
সোনা হয় কি ধলা সাবাং মাকালে,
ও
ভোলা মন সাবাং মাকালেএএএ”
রান্নাঘর
থেকে পৃথাদেবী আবার ডাকলেন, “কই রে কলমির মা, তোর কাজ হল?”
কলমির
মা আপনমনে বিড়বিড় করে বলল, “আ মলো যা, গতরখাকীর আর তর সইছে না”, তারপর উত্তর দিল,
“যাই গো বুইদি, যাই, এই দোরের কাচটা ঝাঁট দিয়েই আসতিছি”।
এই
সময়েই সদরে বেল বাজার শব্দ হল, পৃথাদেবী রান্নাঘর থেকেই বললেন, “ওই তোর দাদাবাবু
এসে গেল মনে হচ্ছে, দরজাটা খুলে দেখতো কে?”
কলমির
মা চটপট হাতে ঝাড়ু নিয়ে সদর দরজা খুলতে গেল, তারপর দরজা খুলেই বলল, “অ বুইদি,
দাদাবাবু বাজার নে এয়েচে”।
সনৎবাবু
পুরুষালী উপস্থিতি বোঝাতে গম্ভীরভাবে একটু হাল্কা কাশলেন, বললেন, “কই গো?
কোথায় গেলে? একবার
এসে পুজোর বাজারটা নাও না। মাছে, পেঁয়াজে
ঠেকাঠেকি হয়ে গেলে, তারপর তো বাড়ি মাথায় করবে...”!
পৃথাদেবী
রান্নাঘর থেকেই উত্তর দিলেন, “ওঃ কী আমার সাতকেলে গুরু ঠাকুর এলেন। আমার এখন মরবার
সময় নেই। বাজারের থলি আর মাছটা কলমির
মায়ের হাতে দাও, আর তুমি পুজোর বাজার নিয়ে
একেবারে ওপরের ঘরে রেখে এসো”।
বাজারের থলি হস্তান্তর করে সনৎবাবু ওপরে চলে গেলেন,
আর ক্ষিপ্র হাতে থলি থেকে কিছু কাঁচা আনাজ আর দুপিস মাছ হাত
সাফাই করে নিল কলমির মা, পেট
কাপড়ের প্লাস্টিকে সেগুলো রাখল, তারপর
দু হাতে বাজারের থলি হাতে মদালসা ভঙ্গীতে রান্নাঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ও
বুইদি, এ থলিগুলো কোতায় রাকবো গো,
যা ভারি...দাদাবাবু গোটা বাজারটা তুলে এনেচে মনে হয়।
দাদাবাবুর ক্ষমতা কম লয় গো বুইদি, বাজার
থেকে বলদের মতো এত ভারি ব্যাগগুলো বয়ে আনলো তো!
একটা রিকশা করতে পারলো নি? খুব
কেপ্পন, বাবা!”
সব
শুনেও না শোনার ভান করে পৃথাদেবী রান্নাঘর থেকে বললেন, “কোথায় আবার রাখবি?
রান্নাঘরে নিয়ে আয়। তারপর ময়দাটা মাখ”।
৬
গোপাল
লুচি আলুচচ্চড়ি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলল, “হেএএউ...ওফ্ কতদিন পর এমন আরাম
করে খেলাম বলো তো, দাদা! লুচি কেমন খেতে প্রায় ভুলেই গেছিলাম। এমন জুটবে জানলে, কোন শালা পতিতের “ডিমটুচ” চিবোতো? ওটা না খেলে আরো চারটে লুচি নির্ঘাৎ
পেটে ঢোকাতে পারতাম, দাদা!”
দোতলার
যে ঘরে চব্বিশ ঘন্টায় টাকা ডবল হবে, সেই ঘরেই এখন বিপদতারণ আর গোপালের অস্থায়ী
আস্তানা। এই ঘরেই তারা টাকার প্যাকেট আগলে সারারাত থাকবে, কাল সকালে ডবল টাকা গুনে
দিয়ে, নিজেদের কমিসন হিসেব করে, তারপর তাদের ছুটি। তারা সনৎবাবু ও পৃথাদেবীকে তাই
বুঝিয়েছে! এখন লুচি-আলুচচ্চড়ি দিয়ে সকালের জলযোগ হল। গোপালের কথায় বিপদতারণ পূর্ণ
সমর্থন করে বলল, “তা ঠিক, বেশ তৃপ্তি হল খেয়ে”।
“অথচ
আমি লুচির কথা বলতেই তুমি এমন ধমকে দিলে, ভাবলাম ব্যাপারটা কেঁচেই গেল”।
“বোকা”।
“কে
তুমি তো? তা
ঠিক, কিন্তু
এভাবে নিজেকে ছোট করতে আছে, দাদা? এখন
বোকা আছো তো কী হয়েছে, কালে
কালে তুমিই একদিন দিকপাল বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে, দেখে নিও”।
“মারবো
এক লাথি, ক্যাঁৎ
করে। বোকা আমি না তুই?”
“তা
মারো, কিন্তু
আজে বাজে জায়গায় না মেরে, ওই পাছাতেই মেরো, লাগবে
কম”।
“আমি
যদি তখন ওই নাটকটা না করতাম, ওই গতরখাকী মুটকি তোর জন্যে লুচি ভাজতো? বয়েই গিয়েছিল। একে বলে, রিভার্স সেন্টিমেন্ট প্রসেস। তোকে চাপ দিয়ে এমন একটা পরিস্থিতি
তৈরি করলাম, মুটকির
সেন্টিমেন্টের জল, বন্যার
মতো তোর দিকে ধেয়ে এলো। তা না হলে এতক্ষণ, শুকনো রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁট...কিংবা
শুকনো পাঁউরুটি আর চা জুটত”!
“আরেঃ
এভাবে ভাবিনি তো? মিথ্যেই
তোমার ওপর রাগ করেছিলাম, দাদা”।
“ভাবতে
শেখ, ভাবনাটাকে
চেপে ধরতে চেষ্টা কর”।
“মুটকিটার
হালচাল দেখলে দাদা? ছিঃ।
ইস্ত্রী হয়ে, স্বামীটাকে
গালাগাল দিয়ে একেবারে ভাঁজে ভাঁজে ইস্ত্রি করে রেখে দিয়েছে, অথচ কাজের মেয়ে যা নয় তাই বলে যাচ্ছে, কিন্তু কোন হেলদোল নেই”?
“গভীর
স্বার্থ! কাজের মেয়ে আজ যদি কেটে পড়ে, ওই গতরখাকীর কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছিস? আতান্তরে পড়বে! আতাক্যালানে স্বামী
তো আর ছেড়ে যাওয়ার জিনিষ নয়, তার ওপরেই যত ধোবিপাট”।
গোপাল
হঠাৎ মেঝেয় মাথা ঠেকিয়ে বিপদতারণের পা ছুঁয়ে মাথায় ঠেকাল, বলল, “সারাজীবনের জন্যে
তোমার পায়ের কাছে আমার একটা জায়গা রেখো, দাদা। তা নইলে ভেসে যাবো আঘাটায়, মাইরি!”
বিপদতারণ
হাত উঁচিয়ে থাপ্পড়ের ভঙ্গি নিয়ে বলল, “একটি থাপ্পড়ে... আচ্ছা, আমাকে শুদ্ধ শাকাহারী বলে তোর তখন
নাটক করার কী দরকার ছিল? দুপুরের মাছের ঝোল ভাতটা মিস হয়ে গেল!”
“ওই
যে বললাম, তোমার
ধমকানিতে তখন বেশ রাগ হয়ে গিয়েছিল, তাই দিলাম তোমার লেজটা একটু টেনে। আমার লুচি খাওয়াতে ব্যাগড়া, দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। আমি কী আর জানি
না, তোমার
মতো মাংসাশী প্রাণীর কাছে বাঘও ছেলেমানুষ”!
“হারামজাদা, তুই আমাকে ল্যাং মারলি?”
“আমার
জাবনা ভরা মাথায়, তোমার
সূক্ষ্ম ভাবনা ঢুকবে কী করে? অপরাধ নিও না, দাদা।
তখন কী আর তোমার ওই রিভার্স সেন্টিমেন্টের খেলা বুঝেছিলাম?”
“দুপুরের
খাওয়াটা মাটি করলি, শালা”।
“আমাদের
জন্যে সেদ্ধভাত হচ্ছে, ওরাও
কী তাই খাবে দাদা? ওদের
জন্যে তো মাছের ঝোল-ভাতই হচ্ছে। তোমার প্রসাদ পাওয়ার পর, ওদের ওই ভোগ, ওদের ভোগে লাগবে ভাবছো?”
“হুঁ...তা
ঠিক। কথাটা ভালই বলেছিস। তার মানে মাছের ঝোল-ভাত মিস হবে না বলছিস?”
“আমার
তো মনে হয় আমাদের কপালেই মাছের ঝোল-ভাত নাচছে, কিন্তু সিঁড়িতে পায়ের শব্দ দাদা, কেউ আসছে”।
দুজনেই
সতর্ক হয়ে, গুছিয়ে টানটান হয়ে বসল। বিপদতারণ
গোপালকে হঠাৎ জিগ্গেস করল, “ধুতি দুটো আনিসনি? তখনই পই পই করে বললাম, এখন কী হবে?”
গোপাল
অবাক হয়ে জিগ্গেস করল, “ধুতি? কীসের ধুতি?”
“মায়ের
পুজো কী প্যান্ট-শার্ট পরে করবো, হতভাগা”?
এইসময়
দুকাপ চা নিয়ে কলমির মা ঘরে ঢুকল, ওদের চা দিতে দিতে বলল, “দাদাবাবু, চা। বুইদি জিগ্গেস করল তোমাদের আর
কিচু নাগবে কী না”?
“দুটো
ধুতি...আমাদের দুটো ধুতি দরকার...”!
কলমির
মা নিচু হয়ে এঁটো বাসন তুলছিল, বলল, “অ মা, বুইদি বলছিল, তোমরা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এয়েছেন, সেকেনে ধুতি কোন কাজে লাগবে?”
কলমির
মায়ের কথায় বিপদতারণ ও গোপাল থতমত খেয়ে গেল, চাকরি? সে আবার কোথা থেকে উদয় হল?
বিপদতারণ জিগ্গেস করল, “চাকরির ইন্টারভিউ? কে বলল?”
“ক্যানে, বুইদি বলল। তোমরা ফুটিদিদির শ্বশুর
বাড়ির নোক, চাকরি
খুঁজতে এয়েছো!”
এই
কথা বলে যে পৃথাদেবী কলমির মাকে ম্যানেজ করেছে বুঝতে পারল ওরা দুজন। কাজেই
পরিস্থিতি সামলাতে বিপদতারণ বলল, “ও হ্যাঁ চাকরি...শিল্পীর চাকরি তো, কি রে গোপাল, বল না...এও একধরনের চাকরি নয়তো কী?”
“চাকরি
কী বলা যাবে, দাদা? আসলে আমাদের কাজটা একটু
অন্যরকম...সামতাপুরের উত্তরে ধানজমিতে... শুটিং হবে, জমিদারবাড়ির পুজো, আমরা দুজন পুজো করবে, গ্রামের ব্যাপার স্যাপার আর কি...”।
শুটিংয়ের
কথায় কলমির মা আশ্চর্য এবং উত্তেজিত হয়ে বলল, “শুটিং? সিরিয়াল? টিভিতে দেখাবে? ও হ্যাঁ, ওরম একটা সিরিয়াল তো চলতিছে, “বাঁকিপুরের বাঁকেবাঁকে”। গাঁয়ের
জমিদার মিনসে হেব্বি হারামি, লেঠেল নিয়ে, ঘোড়ার
পিঠে ঘোরে, আর
মা-বুইনদের সব্বোনাশ করে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুব ডেকে হেঁকে কথা কয়...”।
গোপাল
কলমির মার কথায় খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, “ইসসসস্...তাই?”
“হ্যাঁ
গো, তবে ওই মুখপোড়া মিনসেটা, পীতি বলে একটা মেয়ের কাছে খুব জব্দ। পীতির খুব সাহস, হেব্বি লড়তিছে। তার সঙ্গে ভাব আছে
পীতমের...”
গোপাল
ফোড়ন দিল, “হেব্বি ভাব?”
“হ্যাঁগো, পীতমটা একটু ম্যাদামারা টাইপের, কিন্তু হেব্বি ভাব পীতির সঙ্গে”।
“ওদের
বিয়ে হবে তো?”
“ভাব
করলে বে’ হবেনি? ও
আবার কেমন কতা? ওরা
যকোন নদীর ধারে ভাব করতে যায়, পেছনে কারা সব ফুলোট বাজায়, শাঁক বাজায়, উলু
দেয়...ওদের সম্পোক্ক এ জন্মের নাকি...এর আগের জন্মেও ওরা সোয়ামি-ইস্তিরি ছিল যে”!
“তাই? নদীর ধারে গিয়ে ওরা কী করে?”
“অ
মা, কী
আবার করবে? হেসে
হেসে মিস্টি মিস্টি কতা কয়, মোবাইলে একসঙ্গে গান শোনে, কত্তো সেলফি তোলে...! কিন্তু জমিদার মিনসে নিজের ছেলের সঙ্গে পীতির বিয়ে দিতে
চায়”।
গোপাল
এবার সত্যিই অবাক হল। ভিলেনের এমন মতিচ্ছন্ন কেন? সে নিজে কিছু না করে, নায়িকাকে
পুত্রবধূ করতে চায়? এমন তো বড়ো দেখা যায় না! সে জিগ্গেস করল, “সে কি? কেন?”
“ওম্মা, তাতে পীতি ঢিট্ হয়ে যাবে নে? বে হয়ে গেলে, শ্বশুরের বজ্জাতি লিয়ে কিচু বলতে
পারবে আর? হারামজাদা
বারবার চেষ্টা করছে পীতমকে মেরে ফেলার জন্যে...খুব টেনসান দিচ্ছে হতভাগা। ওই
সিরিয়ালের সবাই ধুতি পরে”!
“অ্যাঁ? সবাই? পীতি বলে ওই মেয়েটাও?”
“অঅম্মা, পীতি ধুতি পরবে ক্যানে, ও গাছ কোমরে শাড়ি পরে...
ব্যাটাছেলেরা ধুতি”।
“যাক
বাবা”।
“তা
তোমরা কী সিরিয়াল করবে গো, দাদাভাই”?
বিপদতারণ
এতক্ষণ চুপ করে কলমির মায়ের কথা শুনছিল, এখন বলল, “আমাদের সিরিয়াল কী হবে, আজ সন্ধেবেলা জানতে পারবো। আর তোমরা
জানতে পারবে কাল সকালে... তার আগে কিছু হবে বলে মনে হয় না”।
“ওম্মাআগো, তা কী নাম গো, সিরিয়ালের?”
বিপদতারণ
বলল, “নাম? সেও
এখনো ঠিক হয়নি, ধরো
“সামতাপুরের
নামতা”।
গোপাল
আরেকটা অপশন দিল, “কিংবা “এক দুগুণে শূণ্য””!
“অম্মা, এক দুগুণি তো দুই হয়, শূণ্য হতি যাবে কী দুঃখে?”
“শূণ্য
বলেই তো দুঃখ”।
নিচে
থেকে পৃথাদেবীর গলা পাওয়া গেল, তিনি কলমির মাকে ডাকছেন, “ও কলমির মা, ওপরে এতোক্ষণ কী করছিস রে? নিচেয় রাজ্যের কাজ পড়ে রয়েছে...”।
কলমির
মা বলল, “অই, ডাক
পড়েছে, খুব
হিংসেকুটিল বাবা, আমি
নোকের সঙ্গে দুটো কতা বললেই বুইদির গতরে আগুন ধরে যায়!”
বিপদতারণ
কলমির মাকে বলল, “সিরিয়ালের কতা আজই কাউকে বলবেন না যেন, কাল শুনে সবাই অবাক হয়ে যাবে”।
“আপনেরা
সে চিন্তে করো না, দাদাভাই, কলমির মার পেট থেকে কতা বার করা
...হুঁ হুঁ অত সস্তা না...”।
“বাঃ
খুব ভালো। কাকিমাকে বলবেন তো, আমাদের দুটো কাচা ধুতি লাগবে”।
“আসতিচি...বুইদি
নইলে নিচেয় কুরুখেত্তর বাধাবে...” ।
এঁটো
থালা, আর
খালি চায়ের কাপ নিয়ে কলমির মা বেরিয়ে গেল। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতে, গোপাল
বলল, “ব্যাপারটা কী হল, দাদা? আরেক
দিকের বিপদ বাড়ল? নাকি
কমল? এই
মহিলা তো শহরময় কথা ছড়িয়ে দেবে”!
“তা
হয়তো দেবে, কিন্তু
এতদূর এসে, পালাবার
কোন মানে হয় না। দেখা যাক না কী হয়। চ ছাদে যাই, সিগারেট টেনে আসি”।
“এখানেই
ধরাই না, এখন
আর কেউ আসবে বলে তো মনে হয় না”।
“একদম
না, এটা
এক দুগুণে শূণ্যর ঘর – এখানে
সিগারেটের ধোঁয়া? নৈব
নৈব চ। চ চ ছাদে যাই...বিপদে পড়লে পালাবার অন্য পথগুলোও ভেঁজে রাখা ভালো”।
৭
সনৎবাবু
এবং কমলবাবু ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অনেকক্ষণ ফিরে এসেছেন। পৃথাদেবীর রান্নাও সারা।
একে একে সকলের স্নান হয়ে গেল। সদরে তালা দিয়ে, টানটান উত্তেজনা নিয়ে, সবাই ওপরের
ঘরে গেলেন। আর মাত্র কয়েকঘন্টার ব্যাপার! আট হবে ষোলো, ছয় হবে বারো! ছিল চশমা হয়ে
গেল বেড়াল, এ ঘটনা তার থেকেও সাংঘাতিক! বিপদতারণ আর গোপাল আগে থেকেই পুজোর সব
যোগাড় করে রেখেছিল। ওঁরা সবাই মিলে বসতেই বিপদতারণ আচমন করে, পুজো শুরু করে
দিল।
“ওঁ
বিষ্ণুঃ ওঁ বিষ্ণুঃ ওঁ বিষ্ণুঃ।
ওঁ
বিপত্তারিণৈ নমস্কৃত্যং কাঞ্চনমুদ্রা বৃদ্ধিম্ করিষ্যে। ওঁ বিপত্তারিণৈ নমঃ”। দুর্বাঘাসের গুছিতে জল নিয়ে সকলের
মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিয়ে মন্ত্র পাঠ করতে লাগল বিপদতারণ।
“সারা
দিনে তব নাম যে জপে শতবার।
তাহার
ঘরেতে সম্পদ ঝরে অনিবার।।
শতেক
বিপদ আপদ যায় বহুদূর।
ছাই
লয়ে মুখ ঢাকে যতেক শত্তুর।।
প্রমোশন
ঢেলে দেয় দুষ্ট উপরওয়ালা।
দুধে
জল দিতে ভোলে যতেক গোয়ালা।।
ডেঙ্গু,
নিপা, অজানা জ্বর, চি...”
এই
সময়েই সনৎবাবুর ফোন বেজে উঠল, ফোন ধরে সনৎবাবু বললেন, “ফুটি ফোন করেছে”, তারপর
কানেক্ট করে বললেন, “হ্যালো, ফুটি...পুজো
চলছে রে। হ্যাঁ একটু আগেই শুরু হল। শেষ হলেই
তোকে রিং ব্যাক করছি, হ্যাঁ হ্যাঁ ...রাখছি,
পরে ফোন করবো, মা, ভাবিস না”।
গোপাল
নাক চোখ কুঁচকে সনৎবাবুর দিকে এতক্ষণ দেখছিল, ফোন বন্ধ হতেই বলল, “ফোনটা এই সময়েই
ধরলেন...মা আবার বিরক্ত না হন”।
“কার
মা, বিরক্ত হবেন”?
“মা
বিপত্তারিণী, যিনি টাকা ডবল করবেন”।
“ওঃ,
তাই”?
কমলবাবু
বললেন, “আঃ সনৎ, ফোনটা এখন সুইচ অফ করে রাখ না,
পুজো শেষ হলে ফোন করিস। তীরে এসে তরি না ডোবে!”
গোপাল
বলল, “সেই ভালো, পুজোর সময় ডিস্টার্ব করলে,
মা খুব রুষ্ট হন। দেবতাদের রুষ্ট হতেও বেশি সময় লাগে না,
তুষ্ট হতেও তাই...”
“তুই
থামবি? পুজোর মধ্যে বিঘ্ন এলে,
মহা অনর্থ উপস্থিত হয়... ওঁ বিষ্ণু, ওঁ বিষ্ণুঃ, ওঁ বিষ্ণু”।
তারপর
বাকি মন্ত্র পাঠে মন দিল বিপদতারণ,
“..ডেঙ্গু
নিপা অজানা জ্বর, চিকুনগুনিয়া।
তব
সহায়ে মাতঃ দিব আচ্ছাসে ধুনিয়া।।
মারীতে
মরিনি মোরা, কখনও হারিনি।
জয়
জয় মহা দেবী, মাগো বিপত্তারিণী।।
শ্রাবণধারার
মতো ঢেলে দিও টাকা।
বন
বন ঘুরে যেন মোর ভাগ্যচাকা।।
শত্তুরের
মুখেতে ঝামা ঘষিও ঘস্ঘস্।
পতি-পুত্র-পরিবার
সব হয় যেন বশ।।
এক
টাকা দিলে যেন পাই টাকা দুই।
ডবল
করিও মাগো যাহা পদতলে থুই।।
ট্যাক্সো-ওয়ালা
বাক্স নিয়ে যায় যেন ভেগে।
তাহাদের
‘পরে মাগো তুমি যেও খুব রেগে।।
মিটাইও
যতেক সাধ যাহা সাধিতে পারিনি।
জয়
জয় মহা দেবী, মাগো বিপত্তারিণী”।।
এই
সময় কমলবাবুরও ফোন বেজে উঠল, অপ্রস্তুত
কমলবাবু ফোন অফ করে দিলেন, সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসলেন। এদিকে মন্ত্র
পাঠের পর বিপদতারণ দীর্ঘক্ষণ প্রণাম করল। তারপর সোজা হয়ে বসল, বলল, “এবার অঞ্জলি। কাকিমা,
কাকাবাবু, হাতে
বেলপাতা, তুলসি আর কুচো ফুল নিয়ে জোড় হাতে
বলুন...”
সকলের
হাতে গোপাল উপচার তুলে দেওয়ার পর বিপদতারণ জিগ্গেস করল, “হয়েছে?
সবাই বলুন, মাগো,
আমাদের পুজোয় তুষ্ট হও মা”।
সনৎবাবু,
কমলবাবু এবং পৃথাদেবী পরম ভক্তিভরে অঞ্জলি হাতে একসঙ্গে বললেন, “সবাই বলুন,
মাগো, আমাদের
পুজোয় তুষ্ট হও মা...”।
বিপদতারণ
একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “যাচ্চলে, আপনারা
“সবাই বলুন” বলছেন কেন? ওটা
বলবেন না। “মাগো, আমাদের পুজোয় তুষ্ট হও মা” –
এই কথাটুকুই বলবেন শুধু।
এবার আর ভুল হলো না, সকলে ঠিকঠাক বলতে লাগল, “মাগো, আমাদের পুজোয় তুষ্ট হও মা”।
বিপদতারণ এর পর একএকটা মন্ত্র বলতে লাগল, তারপর সবাই।
“আমাদের
শত্রুদের উপর রুষ্ট হও মা”।
“আমাদের
শত্রুদের উপর রুষ্ট হও মা”।
“আমাদের
দারিদ্য, দৈন্য ঘুঁচিয়ে দাও মা”।
“আমাদের
দারিদ্য, দৈন্য ঘুঁচিয়ে দাও মা”।
“আমাদের
সামান্য অর্থ ডবল করে দাও মা”।
“আমাদের
সামান্য অর্থ ডবল করে দাও মা”।
এবার
পুজো শেষ, বিপদতারণ বলল, “ব্যস, আমাদের
কাজ শেষ, এবার যা কিছু করবেন,
মা বিপত্তারিণী। সকলে মাকে প্রণাম করুন,
যার যা মনের ইচ্ছে, মনের কথা মনে মনে বলুন। মা সবার সব ইচ্ছে পূর্ণ করে দেবেন”।
সকলে
মেঝেয় মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে লাগল, বিপদতারণ
গোপালের দিকে তাকিয়ে কিছু ইশারা করল। প্রণাম শেষ করে উঠতেই, গোপাল নৈবেদ্যর থালা
থেকে, কলার ছোট্ট একটা টুকরো তুলে
পৃথাদেবীর হাতে দিয়ে বলল, “কাকিমা, মায়ের
এই প্রসাদ, একবারে কোঁৎ করে গিলে ফেলতে
হবে। দাঁতে লাগলে, কিংবা চিবিয়ে ফেললেই সর্বনাশ!
মনের ইচ্ছে পূরণও থেঁৎলে যাবে, পাখিতে
খাওয়া ফলের মতো, কানা বেগুনের মতো - নিষ্ফল
হয়ে যাবে... খুব সাবধান”।
পৃথাদেবী
বললেন, “গলায় আটকে যাবে না তো?”
গোপাল
বলল, “কেন কাকিমা, অশোকষষ্ঠীতে অশোকের ফুলসমেত কলার টুকরো, গিলে নেন না?”
“তা
তো নিই”।
“তাহলে?
মায়ের চরণে মন স্থির করে, মায়ের প্রসাদ গিলে ফেলুন...”।
পৃথাদেবী
প্রসাদ মুখে নিয়ে নির্বিঘ্নে গিলে ফেললেন। তিনি আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “হয়েছে,
পেরেছি, মায়ের
প্রসাদ...জয় মা, জয় মা...আর কোন ভয় নেই মা”।
গোপাল
এবার সনৎবাবু আর কমলবাবুকে বললেন, “এবার কাকাবাবু, আপনারা দুজনেও...”!
এসময়
পৃথাদেবী সনৎবাবুকে সতর্ক করে বললেন, “দেখো, তোমার আবার কাকের মতো সবকিছুই ঠুকরে খাওয়ার অভ্যাস। দাঁত না লাগে...তাহলেই
ইওরোপের দফা রফা”। কিন্তু
কোন অঘটন হল না, দুজনেই নির্বিঘ্নে গিলে ফেলল।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল বিপদতারণ ও গোপাল। বিপদতারণ বলল, “এতক্ষণে পুরো অনুষ্ঠানটা
সুসম্পন্ন হল। বাকি প্রসাদ আপনারা সকলেই ভাগ করে নিন। আর কতক্ষণই বা সময় লাগবে?
মা ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার করে দেবেন। আপনারাও সকলে গভীর
স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকবেন”।
গোপাল
বলল, “না ঘুমিয়ে কী স্বপ্ন দেখা উচিৎ হবে, দাদা”?
“ঘুম
তো আসবেই, ঘুম না এসে যাবে কোথায়”?
“তার
আগে খেয়ে নিলে হত না”?
গোপালের
কথায় সনৎবাবুর টনক নড়ল, তিনি খুব ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, “ঠিক কথা,
বেলা অনেক হল, পৌনে
চারটে! শুনছো, চল সবাই একসঙ্গে খেয়ে নিই,
আর বেলা বাড়িয়ে কাজ নেই। কমল, তুই আবার এলিয়ে পড়ছিস কেন? চল
নিচেয় চল, খেয়ে আসি”।
পৃথাদেবীও
আসন থেকে ভারি শরীর তুলতে তুলতে বললেন, “কমলঠাকুরপো, খাবে এসো, নিচেয় গিয়ে আমি ভাত
বাড়ছি...তোমরাও এসো, বিপদ, গোপাল...তুমি আবার সঙ সেজে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? নিচেয় চলো, আমি একা পারবো নাকি?
তুমিও হাতে হাতে ধরে দেবে..” শেষ কথাগুলো তিনি বললেন
সনৎবাবুকে।
সনৎবাবু
ও পৃথাদেবী ঘর থেকে বেরিয়ে নিচেয় গেলেন। কিন্তু কমলবাবুর অবস্থা সঙ্গীন,
তিনি মেঝেয় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছেন, মৃদু মৃদু নাকের আওয়াজ
আসছে। তাই দেখে গোপাল বলল, “ও দাদা, কমলকাকু
এখানেই লটকে পড়ল যে”।
“ভালই
তো, কমলবাবু কমল। চটপট ব্যাগ-ট্যাগ
গুছিয়ে ফেল। ধুতি ছেড়ে, জামা-প্যান্ট...
চটপট”।
টাকার
প্যাকেটগুলো ভাগ হয়ে ঢুকে পড়ল, বিপদতারণ
ও গোপালের ব্যাগে। ধুতি ছেড়ে ওরা দুজন যখন জামা প্যান্ট পরে ফেলল, ততক্ষণে কমলবাবু
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, রীতিমতো নাকের গর্জন শোনা
যাচ্ছে! গোপাল বলল, “এবার?”
বিপদতারণ
চিন্তা করতে করতে বলল, “সদরের চাবিটা খুঁজতে হবে। তারপর সন্ধের জন্যে অপেক্ষা।
সন্ধের আলো আঁধারিতে চটপট চম্পট”!
“কোথায়
যাবে, ঠিক করেছ? কলকাতায় ফিরে যাওয়া কী ঠিক হবে?”
“একদম
না, ভয়ংকর ভুল হবে। পুলিশের হাতে চোদ্দ
লাখ তুলে দিয়ে, এত তাড়াতাড়ি আবার সরকারি
অতিথি হওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই”।
“তাহলে?”
“এখান
থেকে বাস ধরে বিহার...সেখান থেকে নেপাল-টেপাল কোথাও...আরো ভাবতে হবে,
আপাততঃ বঙ্গ থেকে রণে ভঙ্গ দিয়ে বিহার...তারপর চিন্তা করা
যাবে...কিন্তু নিচে থেকে ডাক আসছে না, কেন?
খিদেয় নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাওয়ার যোগাড়,
খেতে টেতে দেবে না, নাকি রে?”
“আমার
মনে হয় দাদা, ওরাও ঘুমোচ্ছে...”
“সে
কি রে? এত তাড়াতাড়ি সবার ওষুধ ধরে যাচ্ছে?
চল তো নিচেয় যাই”।
“বয়স
তো কম হয়নি, দাদা? ঢকঢকে বুড়ো সব, ফুল ডোজ কী আর সহ্য হয়?
শেষে টেঁশে যাবে না তো, দাদা?”
“অলক্ষুণে
কথা বলছিস? বালাই ষাট,
টেঁশে গেলে ডবল টাকায় ইওরোপ যাবার কী হবে”?
“টেঁশে
গেলে তো বিনাপয়সায় ইওরোপ ভ্রমণ হয়ে যাবে দাদা! ভূতেদের ভিসা-পাসপোর্ট লাগে কী?”
“তার
আমি কী জানি? আমি কী ভূত না প্রেত?”
“ব্যাগগুলো
নিচেয় নিয়ে যাই দাদা?”
“না,
এখন এখানেই থাক, যদি না ঘুমিয়ে থাকে,
আমাদের হাতে ব্যাগ দেখলে বুঝে ফেলবে,
আমরা ফেরেব্বাজ...আগে চল, দেখে আসি”।
৮
যা
ভাবা হয়েছিল তাই হয়েছে! নিচেয় বসার ঘরে গিয়ে ওরা দুজন দেখল, পৃথাদেবী সোফায় আর
সনৎবাবু মেঝেয় লম্বা হয়ে শুয়ে, নাক ডাকিয়ে
তোফা ঘুমোচ্ছেন! এই দৃশ্য দেখে বিপদতারণ বলল, “বোঝো কাণ্ড। সবাই যে ঘুমিয়ে কাদা। গোপাল,
চটপট সদরের চাবিটা খোঁজ। ওটা আগে দরকার”।
“কোথায়
খুঁজবো বলো তো?”
“আমি
সনৎবাবুর পকেটে দেখছি, তুই কাকিমার আঁচলে দেখ”।
“শেষ
অব্দি আমার হাতেই নারী শরীর তুলে দিলে, দাদা?
আমার যে আবার কাঁচা বয়েস?”
“বাজে
বকিস না, তাড়াতাড়ি খোঁজ”।
“আঁচলে
নেই, দাদা”।
“কোমরের
খুঁটে?”
“ইস্।
তুমি খুব অশ্লীল দাদা...”।
“ছেড়ে
দে, মনে হচ্ছে পেয়েছি,
বুড়োর কোমরে ঘুন্সি আছে, জানতিস? সেখানে ঝুলিয়েছিল”।
“ওই
চাবিটাই শিওর?”
“হুম্, একবার
চেক করে আসি, দাঁড়া”। বিপদতারণ সদর দরজার দিকে গেল, কিছুক্ষণ
খুটখাট চেষ্টা করে ফিরে এসে বলল, “নাঃ রে, এটা নয়, বুড়োর ভুতের ভয়,
তাই কোমরে লোহার ফালতু চাবি নিয়ে ঘোরে”।
“হা
হা, ঘাড়ে এমন একখানা জাঁদরেল মহিলা ভূত
নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারপরেও ভূতের ভয়? কিন্তু
চাবি?”
“বুড়ির
সব দেখেছিস?”
“কী
যাতা বলছো দাদা, ছোট ভাইয়ের চরিত্রের প্রতি
তোমার এত সন্দেহ? তাই দেখা যায়?”
“মেয়েরা
এমন এমন জায়গায় টুক করে রাখে...”
“ও
দাদা, প্লিজ আর বলো না,
আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি, আমি আর ওসবে নেই... খুব খিদে পেয়েছে..”
“সেই
ভালো... দেখ তো কী রান্না হয়েছে...আমি একটু চিন্তা করি...কোথায় থাকতে পারে?”
গোপাল
রান্নাঘরে গেল, একটু পরেই রান্নাঘর থেকে সে বলতে লাগল, “দাদা, ভাত আছে, আর আছে আলুসেদ্ধ,
মাছের ঝোল”।
“বাঃ
কপালে মাছের ঝোল নাচছে, ঠেকাবে
কে? আমিও যাবো? না বাড়তে পারবি?”
“তা
পারবো... দুটো থালা...পেয়েছি। ভাতের হাতা...পেয়েছি...দুটো আলু সেদ্ধ... সরষের
তেল...নুনের ডাব্বা...দাদা, দাদা,
একটা চাবি! মনে হচ্ছে এটাই...” গোপাল চাবিটা নিয়ে দৌড়ে বসার
ঘরে এল।
“কই
দেখি, দেখি...হতে পারে...দাঁড়া চেক করে আসি”। বিপদতারণ আবার সদর দরজার কাছে গেল,
আবার খুটখাট আওয়াজ। তারপরেই বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, “হয়েছে...খুলেছে,
চিচিং ফাঁক। ওফ্ গোপাল তুই সত্যি জিনিয়াস... তোর খিদে না
পেলে...এতক্ষণে কত কী শ্লীলতাহানি, যৌন
হেনস্থার কেলেংকারি হয়ে যেতে পারতো। চল চটপট খেয়ে নিই। এখনও অব্দি সব ঠিকঠাক চলছে”।
“সবই
মা বিপত্তারিণীর কৃপা”।
দুজনেই
এখন রান্নাঘরে গেল, ভাত বেড়ে আলুসেদ্ধ মেখে, রান্নাঘরের মেঝেতেই খেতে বসল, বিপদতারণ
এক গ্রাস মুখে তুলে বলল, “বাঃ আলুভাতেটা দারুণ মেখেছিস তো, কাঁচা তেলের ঝাঁজ টের পাওয়া যাচ্ছে। একটা কাঁচা লংকা পেলে জমে যেত”।
“আনব?
কোথায় আছে, খুঁজতে
হবে”।
“ছেড়ে
দে, অত তরিবতে কাজ নেই”। বেশ খানিকক্ষণ খাওয়ার পর, বিপদতারণ
খাওয়া থামিয়ে বলল, “আচ্ছা, আমরা
গতকাল যখন জেল থেকে ছাড়া পেলাম, তখন
কী এত টাকার ফেরেব্বাজি করব, ভেবেছিলাম”?
“পাগল?
খুব জোর দশ-পনের হাজার..”।
“কিন্তু
এখন কত করলাম?”
এক
মুখ ভাত নিয়ে গোপাল উত্তর দিল,
“হুঁউউউ...চোদ্দ
লাখ...”।
“এটা
কী ঠিক হচ্ছে?”
“নাঃ
একদমই হচ্ছে না। এত টাকা নিয়ে করবো কী?”
“টাকা
কী সঙ্গে যাবে?”
“না,
না কোত্থাও যাবে না - না জেলে না হেলে!”
“হেলে
মানে?”
“মরার
পর তো হেলেই যাবো, নাকি তুমি আবার স্বর্গে যাবে
বলে স্বপ্ন দেখছো? আর খাবে না?
ভাত আর মাছ পড়ে রইল যে?”
“নাঃ
রে, ভাল লাগছে না”।
“আমি
খেয়ে নিই?”
“নে”।
“যা
নেব অঙ্গে, তাই যাবে সঙ্গে। টাকা যাবে না
দাদা, কিন্তু এই ভাত মাছের ঝোল সঙ্গেই
থাকবে”।
“আমি
একটা কথা ভাবছি, বুঝেছিস?”
বিপদতারণের
থালার বাকি ভাত ও মাছ খেতে খেতে বলল, “তুমি কী ভাবছো আমি জানি দাদা”।
“জানিস?
হ্যাঃ কী জানিস? ওস্তাদি
করে বললেই হলো?”
“তুমি
অত টাকা নিতে চাইছো না। যা রয়, সয়
- এই ধরো বিশ- ত্রিশ হাজার, তার
বেশি নয়”।
“সাবাশ,
কী করে, বুঝলি
হারামজাদা?”
“জেলে
আমরা আড়াই বছর দিনরাত একসঙ্গেই থাকতাম দাদা, তোমাকে চিনতে ভুল হয় নি, বলো?”
“তা
হয় নি, কিন্তু তুই কী বলিস?”
“কী
ব্যাপারে, দাদা?”
“ওই
যে টাকার ব্যাপারে?”
“আমারও
একই মত, বিশ- ত্রিশ, তার বেশী নয়। বলি বিবেক বলেও তো একটা ব্যাপার আছে নাকি?”
“ঠিক
বলেছিস”।
“চলো
দাদা, আঁচিয়ে আসি। তার পর টাকার প্যাকেট
থেকে তিরিশ – আচ্ছা না হয় পঁয়ত্রিশ নিয়ে,
চটপট কেটে পড়ি...।
বাকিটা পড়ে থাক যেমন আছে”!
“পঁয়ত্রিশ
নয়, ভদ্রলোকের এক কথা –
চল্লিশ। তুই আর ও নিয়ে দরদাম করিস না”।
“তোমার
কথার অবাধ্য কোনদিন হয়েছি দাদা?”
হাত
মুখ ধুয়ে, এঁটো থালা দুটো নিয়ে রান্নাঘরে সিংকে ধুতে ধুতেই, সদর দরজার বেল বেজে
উঠল, বার বার তিনবার। দুজনেই চমকে উঠল।
গোপাল ভয়ে ভয়ে বলল, “কে হতে পারে দাদা? আমার
মন কু গাইছে”।
“আমারও।
আমাদের নেমন্তন্ন করে, সরকারি অতিথি শালায় নিয়ে যেতে
এসেছে”। আবারও বেল বাজল,
সঙ্গে দরজায় ধাক্কা।
“দরজাটা
খুলি? নাকি ছাদ দিয়ে পিছনের আমগাছ ধরে
পালাবে?”
“পালানো
যাবে? আটঘাট বেঁধেই এসেছে। খুলে দে। চল আরো
কটা দিন সরকারি অন্ন ধ্বংস করে আসি”।
গোপাল
দরজা খুলতেই, দুজন ভদ্রলোক হুড়মুড় করে ঢুকল। বিকাশ ও প্রদীপ - পুলিশের উর্দি নেই,
কিন্তু চিনতে ভুল হয় না। প্রদীপবাবু গোপালের হাত ধরল খপ
করে। বিকাশবাবু জিগ্গেস করলেন, “আপনারা? সনৎবাবু,
কমলবাবু কোথায়? সনৎবাবুর স্ত্রী?
আপনারা কে?”
বিপদতারণ
বলল, “আমি নেপাল, ও হরি”।
“ও
নাম তো নয়, আমার কাছে খবর আছে একজন
বিপদতারণ, অন্য জন গোপাল। তাহলে আপনারা
আবার কোথা থেকে উদয় হলেন?”
“আমরাই,
আমি বিপদতারণ, ও
গোপাল। অ্যালিয়াস”।
“আচ্ছা।
তোমরাই সেই ঘুঘু, ভেবেছিলে কোনদিন ধরা পড়বে না”।
“আজ্ঞে
না স্যার, আমরা আদত খাঁচার পাখি,
খাঁচার দরজা খুলে দিলেও, বাইরে একটু ফুড়ুৎ-ফাড়াৎ করে, আবার
খাঁচাতেই ফিরে আসি। গতকাল দমদমের খাঁচা থেকে বেরিয়ে, আজ আবার ধরা পড়ার উপায় করলাম”।
“আচ্ছা?
এঁরা দুজন কারা? আপনারা
রয়েছেন, তার ওপর আমরা এলাম, এত লোকের কথাতেও নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন!”
“আজ্ঞে
ইনিই সনৎকাকু, উনি কাকিমা। আর কমলকাকুরও একই
অবস্থা, দোতলায় ঘুমোচ্ছেন”।
“তাই
নাকি? এমন ঘুমের কারণ কী?
ঘুমের ওষুধের কড়া ডোজ? তোমাদের কীর্তি?”
“আজ্ঞে
হ্যাঁ স্যার ঠিকই ধরেছেন”।
বিকাশবাবুর
অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রদীপবাবু বললেন, “পাখি জাস্ট ওড়বার তাল করছিল,
স্যার। আমাদের আসতে আর একটু দেরি হলেই ফুড়ুৎ”।
বিকাশবাবু
বললেন, “হুঁম্, এঁনাদের ঘুম কতক্ষণে ভাঙবে
জানা আছে? নাকি ডাক্তার ডাকতে হবে?
কিছু হয়ে গেলে কিন্তু মার্ডার কেস”!
“ডাক্তার
ডাকতে পারেন স্যার, তবে ভয়ের কিছু নেই...সাড়ে
তিনটে নাগাদ ওষুধ পড়েছে, আরো
কিছুক্ষণ এমন চলবে।
“কী
করবে প্রদীপ, হসপিটালে নিয়ে যাবে,
নাকি অপেক্ষা করবে?”
“কী
দরকার স্যার রিস্ক নিয়ে, ভ্যানটাকে
ডেকে নিই, তুলে হসপিটালে নিয়ে যাক। এদের
দুটোকেও তো লকআপে ভরতে হবে। আর এদিকে আমি কমলবাবুর মিসেসকে ফোন করি”।
বিকাশবাবু
বললেন, “সেই ভালো। এই গোপাল না হরি...এটাকে ছেড়ো না। আমি ধেড়েটাকে দেখছি”।
বিপদতারণ
ম্লান হেসে বলল, “পালাবো না, স্যার।
ইচ্ছে ছিল হাজার চল্লিশ নিয়ে কেটে পড়বো, সে
যখন আর হল না, পালিয়ে কী করবো”?
“হাজার
চল্লিশ? কমলবাবুর ছয় আর সনৎবাবুর আট,
মোট চোদ্দ লাখ হাতিয়েছো? আমাদের কাছে খবর আছে”।
“আজ্ঞে
দোতলায় চলুন, বমাল পেয়ে যাবেন,
দেখবেন কমলবাবু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেমন আগলাচ্ছেন”!
“এ
মক্কেল কঠিন জিনিষ স্যার, এই
অবস্থাতেও আপনার সঙ্গে রসিকতা করছে”! বিপদতারণের কথায় প্রদীপবাবু বললেন।
বিকাশবাবু
বললেন, “মিথ্যে বললে, আমার দাওয়াই কী জানে না তো...
একনম্বর চোদ্দলাখ টাকার ফ্রডারি...”
প্রদীপবাবু
চটপট উত্তর দিলেন, “আই পি সি ৪১৬, ৪২০,
৪৪৭ আর ৩৭৯, স্যার”!
“দুনম্বর
তিনজন সিনিয়ার সিটিজেনকে জোর করে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হত্যার চেষ্টা...”
“আই
পি সি ৩০৭, স্যার...”
“এমন
এমন সব কেস দেব না? বাছাধন যাবজ্জীবন খাঁচায় বসে
থাকবে”!
বিকাশবাবুর
কথায় উচ্ছ্বসিত আনন্দে বিপদতারণ বলল, “থ্যাংকিউ স্যার। অনেক ধন্যবাদ স্যার। কী বলে
যে আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাবো”!
বিকাশবাবু
খুব অবাক হয়ে বললেন, “সে কি? যাবজ্জীবনে এত উচ্ছ্বাস কিসের হে?
সবাই তো হাতে পায়ে ধরে, পালাবার জন্যে ছটফট করে”।
প্রদীপবাবু
বিকাশবাবুর কাছ ঘেঁষে এসে বললেন, “পলিটিক্যাল সাপোর্ট নেই তো স্যার?
লকআপে ভরলেই ফোন আসবে...ছেড়ে দিন...কেস উইথড্র করুন”।
বিপদতারণ
নির্দ্বিধায় বলল, “না স্যার, কোন
ফোন আসবে না, স্যার। নিশ্চিন্তে লকআপে
রাখতে পারবেন স্যার। তবে একটু তদ্বির করে, যদি তাড়াতাড়ি আদালত থেকে পানিশমেন্টটা করিয়ে দেন। একবার যদি কোন জেলে সেটল্
হতে পারি, স্যার,
চিরজীবন আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো, স্যার”।
বিকাশবাবু
বিপদতারণের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “কি বুঝছো,
প্রদীপ?”
“ফিস
অফ ডিপ ওয়াটার, স্যার”।
“যাও
তো প্রদীপ, গোপাল না হরিকে সঙ্গে নিয়ে।
দোতলার কী অবস্থা দেখে এসো। টাকার বান্ডিলগুলোও পেলে নিয়ে এসো। আমি এখানেই থাকছি”।
প্রদীপবাবু
গোপালকে সঙ্গে নিয়ে ওপরে গেল। বিকাশবাবু বিপদতারণকে বললেন, “পালাবার বেকার চেষ্টা
করো না, দেখছো আমার কাছে রিভলভার আছে!”
“দেখেছি
স্যার। ওটা না থাকলেও পালাবার চেষ্টা করতাম না”।
কিছুক্ষণ
নিরীক্ষণ করে, বিকাশবাবু বললেন, “দেখে তো শিক্ষিত ভদ্রলোক বলেই মনে হয়। এই সব করে
বেড়াও কেন? বার বার জেলে যেতে লজ্জা করে
না?”
“আজ্ঞে
স্যার, এক কালে শিক্ষিত ভদ্রলোক ছিলাম,
অস্বীকার করবো না। তবে সে সব এখন আর নই”।
“কেন?
এ সব জাল জোচ্চুরি অভাবে করা হয়? নাকি স্বভাবে?”
“ঠিকই
ধরেছেন স্যার, শুরু করেছিলাম অভাবে,
এখন স্বভাব হয়ে গেছে”।
“লেখাপড়া
কদ্দূর?”
“বললে
বিশ্বাস করবেন না, স্যার। ইঞ্জিনিয়ার। বিশ্বাস
না করলে, দমদম থেকে আমার ফাইলটা আনিয়ে দেখতে
পারেন, স্যার। সার্টিফিকেটের জেরক্স জমা করা
আছে”।
ইঞ্জিনিয়ার
শুনে বিকাশবাবু প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেন, বললেন, “বলেন কী...ইয়ে, মানে বলো কী?
তার পরেও এই চোরচোট্টা লাইনে”?
“হে
হে হে শিক্ষিত ভদ্রলোক হয়ে থাকার জন্যে একটা মিনিমাম মেন্টিন্যন্স কস্ট আছে স্যার,
সেট মানবেন তো? সেই
কস্টটা রোজগার করতে হয়। অনেকে চাকরি করে, কেউ
ব্যবসা করে। যার সে সব না জোটে, সে
ভিক্ষে কর, নয় ফেরেব্বাজি করে”!
“আর
ওই হরি, না গোপাল”?
“ও
আমাদের কলেজেরই ছেলে, স্যার। বছর দুয়েক আগে পাশ
করেছে। আমার থেকে আট বছরের জুনিয়র। একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে আলাপ,
তারপর থেকে সুখে দুঃখে এক সঙ্গে রয়েছি। নাঃ ভুল বললাম,
সুখেই আছি। দুঃখ আর কোথায়?”
“বাজারে
চাকরি-বাকরির অবস্থা খারাপ মানছি, তাই
বলে চেষ্টা করলে দুজন ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি হয় না, এটা মানতে পারলাম না, ভাই।
এ একধরনের আলসেমি কিংবা বজ্জাতি করে বড়োলোক হওয়ার সখ”।
বিপদতারণ
চুপ করে মাথা নিচু করে রইল। বিকাশবাবু ধমকে বললেন, “কী হল, উত্তর দিচ্ছ না যে?”
“আপনি
সরকারি অফিসার স্যার, ঠিক বলবেন,
তাতে আর আশ্চর্য কী? যদি অভয় দেন তবে একটা কথা বলি স্যার”?
“খুব
যে কিছু ভয় পেয়েছো, এমনতো মনে হচ্ছে না, তাও বলো”।
“শহরের
বড়ো বড়ো মলগুলোতে, শপিং প্লাজায় কী রকম ভিড় হয়
দেখেছেন? খেলার মাঠে কী রকম ভিড় হয় সেও
দেখেছেন। সবাই কী সুন্দর রোজগার করছে, তাই
না? আবার অন্যদিকে দেখুন,
স্যার, ক্লাসফোরস্টাফ
আর পিওনের চারটে পোস্টের জন্যে দেড় লাখের বেশি অ্যাপ্লিকেশন পড়েছিল,
জানেন? তাতে
আমিও করেছিলাম। ওভার কোয়ালিফিকেশনের জন্যে ডাক পাইনি। আচ্ছা ওই দেড়লাখ লোক কী ওই সব
মলে যায়, নাকি খেলা দেখতে মাঠে যায়?
কে জানে? আমি
তো যাই না”।
“ওসব
অজুহাত। আমাদের তিনটে হাত, জানো
কী? দুটো কাজ করার জন্যে আর একটা না করার
জন্যে, সেটাই অজুহাত”।
“হে
হে হে, এগুলো চমকদার কথার কারুকাজ,
স্যার। শুনতে ভালো লাগে। ফেসবুক আর হোয়াট্স্ অ্যাপে খুব
শেয়ার হয় স্যার। খুব লাইক পায়”। বিপদতারণ
হাসতে হাসতে বলল। ওপর থেকে ব্যাগ সমেত গোপালকে নিয়ে প্রদীপবাবু নিচেয় নামল। বিকাশ
বাবু জিগ্গেস করলেন, “কী? টাকার
বাণ্ডিল ঠিক আছে”?
“ব্যাংকের
প্যাকেট হিসেবে চোদ্দটাই আছে। তবে প্যাকেটগুলো তো গুনতে পারিনি স্যার, সময় লাগবে।
প্রত্যেকটা প্যাকেট না গুনলে বোঝা যাবে না। আর কমলবাবুও এঁদের মতোই নাক ডাকছেন
খুব। এমন আরামের ঘুম মনে হচ্ছে বহুদিন ঘুমোননি!”
“ভ্যানের
জন্যে থানায় ফোন করেছেন”?
“এই
করছি, স্যার”।
“তাড়াতাড়ি
করুন, আমরা কী সারারাত বসে থাকবো নাকি?
তা বিপদতারণবাবু ওরফে নেপালবাবু, টাকা আগেই হস্তগত হয়ে গেছিল, সাড়ে
তিনটের সময় সবাইকে অঘোরে ঘুম পাড়িয়ে, এতক্ষণ
কী করছিলে বলো তো? আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলে
নাকি? আমরা তো এসেছি এই কিছুক্ষণ হল”।
প্রদীপবাবু
হাসতে হাসতে বললেন, “অতি চালাকের গলায় দড়ি, বলে না, স্যার?
হে হে হে হে”।
“আপনি
আগে ফোনটা করুন তো!” বিকাশবাবু একটু বিরক্ত হয়েই বললেন।
বিপদতারণ
বলল, “খুব খিদে পেয়েছিল স্যার। তাই একটু খাচ্ছিলাম – মাছের ঝোল দিয়ে ভাত। তাছাড়া এতগুলো টাকা নিয়ে কী করবো সেটা নিয়েও একটু চিন্তা
করছিলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম চোদ্দ লাখ হজম করা আমাদের কম্মো নয়”।
“আবার
মিথ্যে কথা? যত্তো সব ঢপের কেত্তন?
হজম করা কম্মো নয় তো করলে কেন? ধরা পড়ে ভালো সাজছো”?
“জানি
আপনি বিশ্বাস করবেন না, স্যার।
আমরা যখন প্রথম টাকা ডবল করার টোপ দিয়েছিলাম, তখন কিন্তু আমরা পাঁচ-দশ হাজারের টোপই দিয়েছিলাম। কিন্তু এঁনারা দুই বন্ধুতে
পাল্লা দিয়ে উঠে গেলেন লাখে। তাও সনৎকাকু বলেছিলেন পাঁচ আর কমলকাকু ছয়,
কাকিমা সেই শুনে মেয়ের থেকে তিনলাখ ধার নিয়ে,
করলেন আট। আমরা কিন্তু লাখের কথা ভাবিওনি,
বলিওনি।
“সনৎবাবুর
মেয়ে দিল্লি থেকে সাড়ে তিনটে থেকে মোবাইলে ট্রাই করে যাচ্ছেন,
আর এদিকে কমলবাবুর স্ত্রী আর ছেলে...ওঁদের ফোনে না পেয়ে,
আমাদের খবর দিয়েছেন”।
“সে
বুঝতে পেরেছি। শিক্ষিত ভদ্রলোকের কথা বলছিলেন না, স্যার? এই দুজনকেই দেখুন না,
নিজের বাড়ি, ব্যাংকে
সঞ্চয়, ছেলে মেয়ে সকলেই প্রতিষ্ঠিত,
তাও আরো আরো টাকার জন্যে কীরকম পাগল হয়ে উঠেছিলেন। অচেনা
অজানা একটা লোকের স্রেফ কথার ফাঁদে পা দিয়ে দিলেন তিনজনে”!
বিকাশবাবু
মুচকি হাসলেন, বললেন, “এখন তো তুমি আর অচেনা অজানা নও, তুমি বমালসমেত ধরাপড়া একজন চোর। নিজের মুখেই সেটা তুমি স্বীকারও করে নিয়েছো।
এত কিছু জেনেও তোমার সঙ্গে পুলিশের মতো আচরণ করতে পারছি না! কেন?”
“কেন,
স্যার”?
“তোমার
ওই চেহারা আর কথাবার্তার জন্যে। এমন একখানা শিক্ষিত-ভদ্রলোকের মুখোশ সেঁটে রেখেছো,
বোঝে কার বাপের সাধ্যি!”
“ওইটাই
একমাত্র পৈতৃক সম্পত্তি, আর
কিছুই যে নেই”!
“প্রদীপ,
এদের দুটোর হাতেই হাতকড়া পরান। আমাদের ভ্যানের সঙ্গে পাড়ার
জনগণও জড়ো হবে। তারা আবার বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে। বলতে পারে তাদের হাতে
অপরাধীদের তুলে দেওয়া হোক”।
প্রদীপবাবুও
সমর্থন করে বললেন, “হ্যাঁ স্যার, পাবলিক
একবার এদের হাতে পেলে কেলিয়ে হাতের সুখ করতে ছাড়বে না”।
দুজনকে
হাতকড়া পরালেন প্রদীপবাবু। বিকাশবাবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “শালা সরলমতি জনগণ,
হঠাৎ বড়লোক হবার লোভে বারবার আহাম্মকি করবে,
আর ভুগতে হবে আমাদের। চোর ধরো, জনগণ সামলাও, জেলে চোরকে জামাই আদরে সুস্থ রাখো। উপযুক্ত প্রমাণ দাখিল করো,
আদালতে তোলো! একটু
উনিশ-বিশ হলেই বিচারকের এবং মানবাধিকারের হুড়কো খাও...সব শালা ওই সরলমতি অবুঝ
জনগণের জন্যে”।
সদর
দরজার বাইরে গাড়ির আওয়াজ, বেশ
কিছু লোকের জটলার আওয়াজ, সদর
দরজায় বেল বেজে উঠল। প্রদীপবাবু দরজা খুলতেই বেশ কয়েকজন পুলিশ এবং তাদের পিছনে এক
মহিলা ও এক ভদ্রলোক ঢুকে পড়ল। মহিলা কমলবাবুর পুত্রবধূ বিশাখা, আর ভদ্রলোক
কমলবাবুর ছেলে বাচ্চু। বিকাশবাবু বললেন, “প্রদীপ, চটপট এ দুজনকে ভ্যানে তোলো...অন্ততঃ দুজন কন্সটেব্ল্ যেন এদের প্রোটেকশনে
থাকে। আর...”।
বিকাশবাবুর
কথার মধ্যেই বিশাখা মেঝেয় শুয়ে থাকা সনৎবাবুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ডুকরে চেঁচিয়ে উঠল,
“ও বাবা, বাবাগো, এ তোমার কী হল বাবা...ও মা, এতো
বাবা নয়, এ যে সনৎজ্যেঠু...বাবা,
কোথায়?”
বাচ্চু
বিকাশবাবুকে জিগ্গেস করল, “অফিসার, আমার
বাবা কোথায়?”
“আপনি
কে? কে আপনার বাবা?”
“আমি
বাচ্চু মাইতি, আমার বাবা কমলকান্তি মাইতি।
আমিই আপনাদের থানায় ফোন করেছিলাম”।
“বাঃ,
আমাদের উদ্ধার করেছিলেন। আমরা কৃতার্থ হয়ে গেছি...”।
বিকাশবাবুর
বিদ্রূপে কান না দিয়ে বাচ্চু বলল, “বাবা কোথায়? প্রশাসন থাকতেও প্রকাশ্য দিনের বেলা এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল”?
বিকাশবাবু
ধমকে বলে উঠলেন, “প্রশাসন কী বাড়ি বাড়ি বসে পাহারা দেবে? আপনার পিতৃদেব গোপনে টাকা ডবল করাচ্ছিলেন, টাকা ডবল হলে কী প্রশাসন জানতে পারতো? আপনার বাবা, কমলবাবু দোতলায় ঘুমোচ্ছেন।
আপনারা তদন্তের কাজে বাধা দেবেন না...আমাদের ডিউটি করতে দিন”।
বাচ্চু
কেটে কেটে প্রশ্ন করল, “এতক্ষণে আপনাদের ডিউটির কথা মনে পড়ল,
চোরদুটো ধরা পড়েছে”?
বিকাশবাবু
বললেন, “ধরা পড়েছে, আমরা ওদের অ্যারেষ্ট করেছি।
আপনি যান বাবাকে দেখে আসুন”।
এতক্ষণের
হৈ চৈ আর হট্টগোলে সনৎবাবু এবং পৃথাদেবীর ঘুম ভাঙলো। দুজনেই উঠে বসে ঘুমজড়ানো চোখে
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন, ঘরের
ভেতর এত লোকজন ও পুলিশ দেখে। বিপদতারণ ও গোপালকে হাতকড়া বাঁধা অবস্থায় পুলিশেরা
বাইরে নিয়ে গেল। ওদের দেখে বাইরের হট্টগোল আরো বেড়ে উঠল। বাচ্চু হাতকড়া পরা
বিপদতারণ আর গোপালকে দেখে বলল, “ব্যাটাদের সাজিয়ে থানায় নিয়ে যাচ্ছেন?
শালা, ঠগবাজ,
জোচ্চোর, ডাকাত!
শুয়োরের বাচ্চাদের কেলিয়ে হাড় ভেঙে দেবো”।
“আইন
নিজের হাতে নেবেন না, আমরা তদন্ত করছি,
অপরাধী শাস্তি পাবেই...” বিকাশবাবু গম্ভীর গলায় বললেন।
বাচ্চু
উত্তেজিত হয়ে বলল, “আইনের নিকুচি করেছে, থানায়
নিয়ে গিয়ে সব শালা গট-আপ খেলে ছেড়ে দেবেন...সে আর জানি না, আমাদের হাতে ওদের তুলে দিন...”।
এবার
বিকাশবাবু উঠে দাঁড়ালেন, খুব কড়া ভাবে বললেন, “আপনি যদি এভাবে পুলিশের কাজে বাধা
দেন, তাহলে কিন্তু আপনাকেও অ্যারেষ্ট করতে
বাধ্য হবো, থানায় চলুন,
আপনাদের যার যা কমপ্লেন থানায় গিয়ে রিপোর্ট করুন...”!
এসময়
ওপর থেকে কমলবাবুর নেমে এলেন, কিছুটা আলুথালু অবস্থা, বিশাখা দৌড়ে গিয়ে কমলবাবুকে ধরল, বলল, “বাবা...কেমন আছো বাবা?
তোমার এ অবস্থা কেন?”
হতভম্ব
কমলবাবু অবাক হয়ে সবাইকে দেখতে দেখতে বললেন, “কী হয়েছে রে, সনৎ? এত চেঁচামেচি কিসের?
ওরা কোথায়?”
সনৎবাবু
খুব আদর করে বন্ধুকে ডাকলেন, বললেন, “আয় এখানে এসে বস, মনে হচ্ছে সব গেল, ওদের পুলিশ ধরেছে...”!
“সে
কী রে? আমাদের টাকা? আমার ছয়..”?
বাচ্চু
হঠাৎ বাবার কথার মধ্যে চেঁচিয়ে উঠে বলল, “ছয় কোথায় বাবা? তোমার কী ভীমরতি হয়েছে? আমাদের
দশ লাখ...”!
বিশাখা
ধরা ধরা গলায় বলল, “ভীমরতি কী বলছো, গো?
বাবাকে ওরা ছাইপাঁশ কীসব খাইয়ে দিয়েছে,
মনে হয় বাবার মাথাটাই গেছে”!
বাচ্চু
বিকাশবাবুকে জিগ্গেস করল, “অফিসার, টাকাগুলোর
কোন হদিশ পাওয়া গেছে?”
“পাওয়া
গেছে, আমাদের কাস্টডিতেই এখন থাকবে। কেস
মিটলে, মহামান্য আদালত যেমন বলবেন,
আপনারা টাকা ফেরত পাবেন”।
“কত
টাকা পাওয়া গেছে?”
“থরো
চেক আপ এখনো করা হয়ে ওঠেনি, চোদ্দটা
নোটের বাণ্ডিল মিলেছে!”
বাচ্চু
বলল, “ওর মধ্যে দশটা আমাদের...”।
বাচ্চুর
কথায় সনৎবাবু বললেন, “ওরে কমল তোর তো ছয় ছিল, আমার ছিল আট...”।
কমলবাবু
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে, বললেন, “তাই তো, কিন্তু এখন বাচ্চু যে বলছে দশ, আমার
কী তবে গুনতে ভুল হয়েছিল?”
বিকাশবাবু
হো হো করে হাসলেন, বললেন, “বাচ্চুবাবু, কাল
থানায় ব্যাংকের স্টেটমেন্ট জমা দেবেন, আদালত
কিন্তু জানতে চাইবে, ক্যাশ দশ লাখ কোথা থেকে পেলেন,
কীভাবে পেলেন...”
বাচ্চু
থতমত খেয়েও উত্তেজিত হয়ে বলল, “কেন? ব্যাংকের
স্টেটমেণ্ট দিতে হবে কেন? টাকা
আমাদের ঘরেই ছিল...”
“সে
কথা আমাদের বলে লাভ নেই, বাচ্চুবাবু।
আদালতে বলবেন, আদালত প্রমাণ চাইবে। চল হে প্রদীপ,
এঁনাদের সকলেরই যখন ঘুম ভেঙেছে, আমাদের কাজ শেষ। পারলে আজ রাত্রে চলে আসুন, নয়তো কাল সকালে সবাই থানায় আসবেন, রিপোর্ট
লিখিয়ে যাবেন... প্রদীপ, সনৎবাবু
আর ম্যাডামকে দিয়ে সিজার লিস্ট সই করাও, বাচ্চুবাবু
আর এঁনারা উইটনেস থাকবেন, ওঁনাদেরও
সবাইকে দিয়ে সই করাবে...”। মুচকি
হেসে আবার বললেন, “যে ভাবে টাকার হিসেব বাড়ছে...বেশিক্ষণ থাকলে আরো বাড়বে...পরে থানা
থেকে না ভরতুকি দিতে হয়! আমি বাইরে ওয়েট করছি, চটপট ফর্ম্যালিটিস শেষ করো”।
বিকাশবাবু
বেরোতে যাচ্ছিলেন, সনৎবাবু ডাকলেন, বললেন, “আপনি কী চলে যাচ্ছেন নাকি?
“হ্যাঁ,
কিছু বলবেন?”
“আপনার
নামটা জানতে পারি?”
“বিকাশ
ঘোষ”।
“ঠিক
ঠিক মনে পড়েছে, আপনার সঙ্গে বেশ কিছুদিন আগে
একবার আলাপ হয়েছিল...আমাদের সমিতির পুজোর ব্যাপারে থানায় গিয়েছিলাম, তখন”।
এই
অবান্তর কথায় বিকাশবাবু একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “বাঃ শুনে খুব আনন্দ পেলাম,
কিন্তু এখন কী কিছু বলবেন”?
“বলব...কিন্তু
ওরা দুজন কোথায়”?
“কারা
দুজন?”
“ওই
যে বিপদ আর গোপাল”।
“ওটা
ওদের আসল নাম নয়, ওদের নাম নেপাল আর হরি”।
“ওরে
বাবা, ওদের অষ্টোত্তর শত নাম থাক,
তারা এখন কোথায়”?
“বললাম
না, ওরা পালাতে পারেনি,
অ্যারেষ্টেড হয়েছে। বাইরে ভ্যানে আছে। আর টাকার প্যাকেটও
উদ্ধার হয়েছে”।
“ধুর
বাবা, পালাবার কথা আসছে কোথা থেকে?
ওরা পালাবার লোকই নয়”!
বিকাশবাবু
সারা পুলিশ জীবনে এমন অবাক আগে কোনদিন হননি, বললেন, “তার মানে”?
“মানে-টানে
পরে হবে, আগে ওদের এখানে আনুন,
ছি ছি, ভদ্রলোকের
এমন হেনস্থা”!
বাচ্চুও
অবাক হয়ে বলল, “কাকে কী বলছো, কাকু?
দুটো চোর, ক্রিমিন্যালকে
ভদ্রলোক বলছো”?
সনৎবাবু
খুব গম্ভীরভাবে ধমক দিলেন বাচ্চুকে, “আঃ বাচ্চু, বড়দের কথায় কথা বলতে নেই, কমল
তোর ছেলেটা আর মানুষ হল না...কই হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বিকাশবাবু?
ওদের ছেড়ে দিন, এখানে
নিয়ে আসুন”।
বিকাশবাবু
সনৎবাবুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, প্রদীপবাবুকে বললেন, “প্রদীপ,
যাও তো ওদের নিয়ে এসো”।
প্রদীপবাবু
বাইরে গেলেন, ভ্যান থেকে বিপদতারণ আর গোপালকে আনতে। পৃথাদেবী এবার মুখ খুললেন, “তোমার
কী ভীমরতি হল? নাকি ঘুমের ওষুধে মাথাটা
বিগড়োলো?”
একথার
উত্তরে সনৎবাবু নাটকীয় ভঙ্গীতে চিৎকার করে ধমকে উঠলেন স্ত্রীকে, বললেন, “স্তব্ধ হও
নারী, তব অসার বাক্যবাণে আর না রহিব অসাড়....”
সকলের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, “বাঃ বেশ একটা ইয়ে অনুভব করছি... মানে তেজ!” মুখে
তৃপ্তির হাসি নিয়ে সনৎবাবু সবার দিকে তাকালেন, তাঁর ভাবখানা কেমন দিলাম!
তাঁর
ব্যাপার স্যাপার দেখে বিশাখা ঘাবড়ে গেল, বাচ্চুকে বলল, “হ্যাঁগো শুনছো,
বাবাকে নিয়ে বাড়ি চলো...শেষে পাগলের পাল্লায়...”! তার কথা
শেষ হবার আগেই বিপদতারণ ও গোপালকে নিয়ে প্রদীপবাবু ঘরে এলেন। দুজনের হাতে হাতকড়ি,
মাথা নিচু।
সনৎবাবু
ওদের দেখে খুব আনন্দ পেলেন, বললেন, “এসেছো বিপদ? ওদের হাতে হাতকড়ি কেন? ছি
ছি ছি, খুলে দিন”।
বিকাশবাবু
বললেন, “ওরা পালালে কিন্তু আপনাকেও অ্যারেষ্ট করতে বাধ্য হবো সনৎবাবু।
ক্রিমিন্যালদের পালাতে সাহায্য করার জন্যে। প্রশাসনিক কাজে বাধা দেওয়ার জন্যে”!
সনৎবাবু
বললেন, “আরে ভালো বিপদ তো, ওরা
চোর না ডাকাত...সেই থেকে পালাবে পালাবে করছেন? খুলুন বলছি”!
বিকাশবাবু
প্রদীপকে বললেন, “খুলে দাও তো, প্রদীপ।
দেখি এখন আবার কী নাটক হয়!” পকেট থেকে চাবি বের করে প্রদীপবাবু দুজনের হাত মুক্ত
করে দিলেন।
সনৎবাবু
খুব খুশি হয়ে বললেন, “এখানে এসো বিপদ, সোফায়
বসো...ওরা তোমায় মারধোর করেনি তো?”
“নাঃ
কাকু। আর আমি বিপদতারণ নই, নেপাল।
ওর নাম গোপাল নয়, হরি”।
“না
না, বিপদ নামটাই তোমাকে বেশি মানায়,
বিপদ নামটাই আমি বলবো”। সনৎবাবুর কথায় কমলবাবুও সমর্থন করে
বললেন, “যা বলেছিস, যা বিপদে আমাদের ফেলেছিল”!
সনৎবাবু
গর্জে উঠে কমলবাবুকে ধমকে বললেন, “একদম ফালতু কথা বলবি না, কমল। ওরা বিপদে ফেলেছিল, না
আমরা বিপদ ডেকেছিলাম?”
বাচ্চু
সনৎবাবুর রকমসকম দেখে বেশ ঘাবড়ে গেল, বাবাকে বলল, “বাবা, তুমি এসবে থেকো না, চলো
বাড়ি যাই”।
সনৎবাবু
আরো জোরে ধমকে উঠে বললেন, “চোপ, একটা
কথা বললে...” কথা শেষ করলেন না, কিন্তু যেভাবে ধমকে উঠলেন, তাতে সকলেই চুপ করে গেল!
কমলবাবু
একটু ভয়ে ভয়েই জিগ্গেস করলেন, “তোর কী হল বল তো? তোকে তো এত হম্বিতম্বি করতে কোনদিন দেখিনি!”
পৃথাদেবীও
এখন মুখ খুললেন, বললেন, “চিরকেলে মেনিমুখো, হঠাৎ আজকে এতো...” তাঁর কথার মধ্যেই সনৎ বাবু আমার ধমকে উঠলেন, “একদম চোওওওপ!
এতদিন তোমাদের মাথায় তুলেছি বলে, ভেবো
না চিরকাল রাখবো। বিকাশবাবু টাকার বাণ্ডিল কোথায়?”
বিকাশবাবু
প্রদীপবাবুর দিকে তাকিয়ে জিগ্গেস করলেন, “কোথায়?”
“আমার
কাছে, এই ব্যাগে”।
গমগমে
স্বরে সনৎবাবু বললেন, “বের করুন”। প্রদীপবাবু
ইতস্ততঃ করছিলেন দেখে সনৎবাবু আবার ধমকে উঠে বললেন, “কথাটা কানে যাচ্ছে না?”
বিকাশবাবুও
বললেন, “বার করো হে, দেখি না কোথাকার তেল কদ্দূর
গড়ায়”। ব্যাগ থেকে টাকার প্যাকেট বের করে
সনৎবাবুর হাতে তুলে দিলেন প্রদীপবাবু। সনৎবাবু একটা প্যাকেট পৃথাদেবীকে দিয়ে
বললেন, “এটাই আমাদের প্যাকেট না? দেখো
তো কটা বাণ্ডিল আছে”। অন্য
প্যাকেটটা কমলবাবুকে দিয়ে বললেন, “তোরটা তুইও চেক করে নে”। পৃথাদেবী প্যাকেট গুনে বললেন, “আটটাই
আছে। ঠাকুরপো তোমার?”
কমলবাবুও
গুনে বললেন, “আমারও ছটাই আছে”।
সনৎবাবু
গম্ভীর গলায় বললেন, “আমি এর থেকে ষোলো দেবো, তুই কত দিবি কমল”?
কমলবাবু
অবাক হয়ে জিগ্গেস করলেন, “কী দেব?”
“টাকা”
“কাকে
দেব?”
“বিপদকে”।
“কী
আশ্চর্য কেন দেবো? চোর...জোচ্চোর চিটিংবাজ...”! কঠিন
দৃষ্টিতে তাকিয়ে, যেভাবে বিচারক ফাঁসির ঘোষণার
আগে অপরাধীর দিকে তাকান, বললেন, “তুই চিরকালই চার অক্ষরের বোকা ছিলি মনে আছে?
ওরা কী আমাদের বাড়ি এসে বলেছিল, হ্যাগো আমায় জোচ্চুরি করতে দেবে?”
“তাতে
কী?”
“তাতে
কী? আমরা ওদের খোশামুদি করে বাড়ি নিয়ে
আসিনি”?
“বা
রে, সে তো টাকা ডবলের লোভে...হতভাগা যা
টোপ ফেলেছিল..”!
“অ্যাই...পথে
এসো বাছাধন। টোপ দিয়ে মাছ কারা ধরে?”
কমলবাবু
ফ্যাক করে হেসে বললেন, “কারা আবার ধরে, আমরা, মানুষরা। কী যে আবোল তাবোল বকছিস...”!
“বাঃ
বুদ্ধি খুলছে...টোপ খেয়ে মাছের কী হয়?”
“তোর
নির্ঘাৎ ভীমরতি হয়েছে সনৎ, হে
হে হে হে, টোপ খাওয়া মাছের আবার কী হবে?
ভাজা হবে, ঝাল
হবে...”
“আমি
আর তুই টোপ গিলেছি, তাহলে আমাদের কী হবে”?
“অ্যাঁ?”
“অ্যাঁ
নয় রে হতভাগা, হ্যাঁ”।
এই
সময় পৃথাদেবী খুব ন্যাকা ন্যাকা গলায় বললেন, “হ্যাঁগো, তোমার কী নিজেকে মাছ মনে হচ্ছে? বাবা
বাচ্চু, ডাক্তার সামন্তকে খবর দেবে বাবা?
বলো এখনই একবার আসতে”।
সনৎবাবু
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে অদ্ভূত হেসে বললেন, “তোমার প্যাকেট থেকে ষোলো বের করো,
মৎস্যকন্যা”। তারপর
পৃথাদেবীর মুখের সামনে হাত নেড়ে নেড়ে গান গাইলেন, “মাছ লয় গো মচ্ছকন্যা...রূপেগুণে অথৈ বন্যা”। টাকা ডবল করে ইওরোপ যাবে না?”
পৃথাদেবী
সকলের মুখের দিকে অসহায় তাকিয়ে, কয়েকটা নোট গুণে বের করে বললেন, “এই নাও ষোলো”।
সনৎবাবু
বিচ্ছিরি একটা মুখের ভঙ্গি করে বললেন, “কাৎলার মুড়ো দেখতেই ঢাউস,
ঘিলু থাকে এক ছিটে। ষোলোশ নয়, ষোলো হাজার”। পৃথাদেবী
আকাশ থেকে পড়লেন যেন, “হা জা র”?
কমলবাবুরও
একই উক্তি, “হা জা র”?
সনৎবাবু
মুখ ভেংচি করে বললেন, “না, হাজার
কেন হবে? ষোলটাকা। আর এই যে তুই বৌদির সুরে
সুর মেলাচ্ছিস্...তুই দিবি বারো হাজার”!
কমলবাবু
রাগ করে বললেন, “তোর মতিচ্ছন্ন হয়েছে, তুই
দিতে হয় দিগে যা, আমি দেবো না,
টাকা কী গাছে ফলে”?
“গাছে
টাকা ফলে না, আগে জানতিস না?
লেজ নেড়ে কেন ওদের ডাকলি”?
“তুইও
তো ডেকেছিলি। আমি একলা নাকি”?
“সেই
জন্যেই তো প্রায়শ্চিত্ত করছি। আহাম্মকির প্রায়শ্চিত্ত। লোভের প্রায়শ্চিত্ত। হতভাগা
কাল সকালে পাড়ার লোক, সামতাপুরের লোক যখন আওয়াজ
দেবে...কী কমলবাবু...টাকা ডবল হলো না? খুব
দাঁও মারতে গেছিলেন...একটুর জন্যে ফস্কে গেল...মুখ দেখাতে পারবি তো”?
কমলবাবু
সত্যি খুব লজ্জিত মুখে বললেন, “সত্যি...খুব গুখুরি হয়ে গেছে...ছেলে বুড়ো সবাই
টিটকিরি দেবে রে...”
“হতভাগা
এখনো সময় আছে...”
“কিসের
সময়?”
“ওদের
দুটোকে কিছু টাকা দিয়ে ছেড়ে দিই। ওরা আজ রাত্রেই সামতাপুর থেকে কেটে পড়ুক”।
“তাতে
লোকে আর টিটকিরি দেবে না?”
“বিকাশবাবুকে
রিকোয়েস্ট করবো কোন কেস না দিয়ে, এই
ঘটনার কথা চেপে যেতে!”
বিকাশবাবু
আপত্তি করলেন, “তা কী করে হবে? আমরা
এলাম, পুলিশের ভ্যান এল”!
“তাতে
কী? মিস আণ্ডারস্ট্যান্ডিং...একটা ভুল
খবর পেয়ে এসেছিলেন!”
বিকাশবাবু
চিন্তা করতে করতে বললেন, “হুঁ”।
কিন্তু
প্রদীপবাবু বললেন, “স্যার, আমরাই
না কেস খেয়ে যাই”!
বিকাশবাবুও গম্ভীরভাবে বললেন, “চোপ! এটা এখন
বিবেকের কেস... প্রতিবেশীর ছিছিক্কার থেকে বাঁচার কেস”!
“কিন্তু
আপনিও চোপ বলছেন, স্যার?”
“হুঁ,
মনে হচ্ছে ওটা ছোঁয়াচে। একটা ব্যাপার ভেবে দেখেছো প্রদীপ,
আদালতে উঠলে এ কেস কতদিনে নিষ্পত্তি হবে কে জানে! কিন্তু
শুনানি শুনতে ভিড় ঠেকানো দায় হবে। আমাদের থানায় কজন কনস্টেবল আছে প্রদীপ?
সে ভিড় সামলাতে পারবে?”
“আদালতে
ভিড় হবে কেন, স্যার?”
“শহরের
মান্যিগণ্যি দুই মাতব্বর চব্বিশ ঘন্টায় টাকা ডবল করতে গেছিল,
এমন দুই খোরাক পিস্ পেলে পাব্লিক ছেড়ে দেবে?
গাঁটের কড়ি খরচ করে লোকে আলিপুর চিড়িয়াখানায় যাবে কেন?
আদালতেই ভিড় জমাবে!”
“তাহলে
উপায়?”
“এঁনারা
যা করছেন করুন। আমরা নীরব সাক্ষী থাকি।
একদম চোপ!”
সনৎবাবু
ছলছল চোখে বিকাশবাবুকে বললেন, “আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেবো,
বিকাশবাবু? কী
রে কমল? এখনো কী ভাবছিস?”
কমলবাবু
অনেক ইতস্ততঃ করেও টাকা বের করে সনৎবাবুর হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, “এই নে,
বারো হাঃ...জার”।
মুচকি
হেসে সনৎবাবু টাকাটা হাতে নিলেন, তারপর বললেন, “হাজার বলতে একেবারে হাহাকার করে
উঠলি যে, কমল! বিপদ, এই টাকা কটা রাখো, বাবা। আজ রাতটুকু কাটিয়েই
যেতে বলতাম, কিন্তু সে উপায় নেই। একেবারে
ঘাড়ে সংক্রান্তি! অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে এখনই সরে পড়ো, বাবা”।
বিপদতারণ
মাথা নিচু করে বলল, “ও টাকা আমি নিতে পারবো না, কাকাবাবু”।
“ন্যাকামি
করে সময় নষ্ট করো না, বাবা। তুমিও মরবে,
আমরাও। তুমি তো আমাদের বলেছিলে, পাঁচ দশ হাজার টাকার স্যাম্পল নিয়ে ট্রায়াল করতে। আমরাই তো লাফিয়ে উঠে
বলেছিলাম, পাঁচলাখ আর ছয় লাখ। মারি তো
গণ্ডার লুটি তো ভাণ্ডার। তোমার কাকিমা আবার তিন লাখ বাড়িয়ে তুলল,
বলল আটলাখ। নাও ধরো”।
বিপদতারণ
টাকাটা নিল, বলল, “আপনাদের কথা কোনদিন ভুলবো না, কাকাবাবু”।
“আমরাও
না। অন্ততঃ আমি তো ভুলবোই না। এই বুড়ো বয়সে কী বোকামি আর কী লোভ –
আজ বাদে কাল খাটিয়ায় চড়বো...তাও ফোকটে টাকা ডবলের কথা শুনে
এমন খেপে উঠলাম! ছি ছি। তুমি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছো বাবা। এসো দুগ্গা,
দুগ্গা। আর দেরি কোর না। আটটা বাহান্নয় একটা ডাউন ট্রেন
আছে না, কমল? ধরতে পারবে তো?”
কমলবাবু
বললেন, “দরকার কী? বাচ্চু,
যা তো একটা রিকশ ডেকে ওদের তুলে দে, ভাড়াটা আমিই দিয়ে দেব...স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে আসুক”!
“ওফ্
কমল, একদম মনের কথা বলেছিস,
সেই ভালো। যা যা, বাচ্চু
ওদের রিকশয় তুলে দিয়ে আয়”।
বিপদতারণ
ও গোপাল নিচু হয়ে সকলকে নমস্কার করল, তারপর
বাচ্চুর সঙ্গে বেরিয়ে গেল।
ওরা
বেরিয়ে যাওয়ার পর কমলবাবু হাসতে হাসতে বললেন, “হ্যারে সনৎ, একটা কথা ভেবে আমি অবাক হচ্ছি”।
“কী?”
“এতদিন
পরে তুই হঠাৎ এমন চেগে উঠলি কী করে? একেবারে
বিবেক-টিবেক ঘাড়ে নিয়ে হুড়মুড় করে”? কমলবাবুর
কথায়, পা দুলিয়ে দুলিয়ে মুচকি মুচকি হেসে সনৎবাবু বললেন, “সে একটা ব্যাপার আছে!”
“ব্যাপার
তো কিছু আছেই, তা নইলে এমন হরণ কালে মরির
নাম আসে কী করে”?
“হতভাগা,
কথাটা মরণকালে হরির নাম...তুই সেই চার অক্ষরেরই রয়ে গেলি! আসল
ব্যাপারটা হল সলিড একটা ঘুম”।
“যাচ্চলে,
কী আবোল তাবোল বকছিস? সলিড ঘুম মানে”?
“বিয়ের
পর থেকে আজ অব্দি তুই ক রাত নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিস”?
“কেন
প্রায় সব রাতই, ট্রেন জার্নি,
বাস জার্নি কিংবা বিয়ে-টিয়ে, শ্মশানযাত্রা – এরকম দু একদিনের ব্যাপার ছাড়া”!
“হতে
পারে তুই তার মানে ভাগ্যবান। আমি কিন্তু বিয়ের পর থেকে এমন নিটোল ঘুম আজ ঘুমোলাম”।
“কী
ছাতার মাথা বকছিস বুঝছি না”। তারপর
পৃথাদেবীর দিকে তাকিয়ে জিগ্গেস করলেন, “সনৎ, কী বলছে গো, বৌঠান?”
পৃথাদেবী
মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, “হুঃ, ছাড়ো
তো ঠাকুরপো, বুড়োর মতিচ্ছন্ন ধরেছে”।
স্ত্রীর
দিকে কটমট করে তাকিয়ে সনৎবাবু বললেন, “বিয়ের পর নতুন বউ নিয়ে মাস দুই-তিন রাত্রে
কেন ঘুম হয় না, সে কথা ছেলেপুলেদের সামনে আর
বলবো না। সে তুইও জানিস”।
পৃথাদেবী
লজ্জা পেয়ে মুখ ঘোরালেন, মুচকি হেসে বললেন, “আ মলো যা, মিনসের এতদিন পর আবার সে সব কথা কেন”?
স্ত্রীর
কথার কোন সাড়া না দিয়ে সনৎবাবু বললেন, “কিন্তু তারপর থেকে নতুন বউ যতো
পুরোনো হয়েছে, রাতের ঘুম রোজ তত চটকে দিয়েছে!
কিন্তু তার সঙ্গে মধুচন্দ্রিমার কোন সম্পর্ক নেই”।
কমলবাবু
বললেন, “সে আবার কী”?
“গরমকালে
মাঝরাত্রে ঠেলে তুলেছে, পাখার
স্পিডটা দেখোতো কমানো আছে কী না! নয়তো জানালাগুলো খুলে দাও তো দমবন্ধ হয়ে আসছে।
শীতকালে, জানলার ফাঁকে গামছা গুঁজে দাও তো,
আদ্যিকালের লজঝড়ে জানালার ফাঁক দিয়ে হিলহিলে ঠাণ্ডা বাতাস
ঢুকছে..”!
“তা
মন্দ বলিস নি...”
“দাঁড়া
আরো আছে। কিচ্ছু না পেলে, মশারিতে
মশা ঢুকেছে...লাইটটা জ্বালিয়ে দেখো তো...। নয়তো নিচের ঘরে একটা আওয়াজ পেলাম না,
হ্যাগো, চোর-টোর
ঢোকেনি তো? যাও না দেখে এসো না একবার”।
“হে
হে হে হে...মোক্ষম বলছিস, চালিয়ে যা!”
“শুনছো,
বিকেলে ছাদের দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছি মনে হচ্ছে,
যাও না, একবার
দেখে এসো না। তা নইলে ভাম ঢুকে হেগে দিয়ে যাবে বাড়িময়...”
কমলবাবু
হাসতে হাসতে বললেন, “সে যাই হোক সে আর কদিন?”
“রোজ
রে ভাই, রোজ। বিয়ের পর আজ এই প্রথম টানা
চার-সাড়েচার ঘন্টা সলিড ঘুমোলাম”।
“আর
তাতেই তুই চেগে উঠলি”?
“আলবাৎ।
ভালো ঘুম মানুষকে চাঙ্গা করে তোলে, আর
আধঘুম-আধজাগা মানুষেরা সর্বদা অবসাদে ভোগে”।
“তুই
পারিসও বটে!”
“তুই
মানিস কিংবা না মানিস...আমার মধ্যে কিন্তু একটা জোর এসেছে... বুদ্ধি-শুদ্ধি,
বিবেক-টিবেকগুলোও ঠিকঠাক সাথ দিচ্ছে। মাইরি বলছি,
অ্যাদ্দিন কেমন যেন ম্যাদামারা হয়ে ছিলাম,
কোন উৎসাহ নেই, সবই
মনে হতো য্যাগ্গে যা হচ্ছে হোক... আজ....”
অধৈর্য
হয়ে বিকাশবাবু উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, “খুবই আনন্দের কথা সনৎবাবু,
খুবই চমৎকার। আরেকদিন এসে আপনার আরো গল্প শুনবো। এখন আমরাও
তাহলে উঠি, সনৎবাবু,
কমলবাবু? ভ্যান নিয়ে এসে অনেক
ভ্যানতাড়া দেখলাম, এবার চলি?” সনৎবাবু একটু লাজুকভাবেই বললেন, “সত্যিই অনেক কষ্ট দিলাম,
ভাই। আজকে চা খাওয়ানোর মতো অবস্থাতেও নেই,
নইলে...একদিন চলে আসবেন, ছুটিছাটার দিনে...হাতে সময় নিয়ে”।
“আচ্ছা
সে হবে না হয় আরেকদিন, এখন চলি। চলো হে প্রদীপ, আমরাও কেটে পড়ি”।
বিকাশবাবু
আর প্রদীপবাবু বেরিয়ে গেলেন, সনৎবাবু আর কমলবাবু দুজনেই সদর দরজায় দাঁড়িয়ে হাত
নাড়লেন। ভ্যান বেরিয়ে যেতে সনৎবাবু বিমলবাবুকে বললেন, “ঘুম
ঘুম ভাবটা পুরো কাটেনি, একটু চা খেলে হতো। তোর বৌমাকে বল না, বেশ কড়া করে একটু চা
করতে। আমার বৌকে বললে এখনই খেঁকিয়ে উঠবে”!
কমলবাবু
হেসে ফেললেন, বললেন, “হতভাগা, তোকে আজকে ঠিক সেই ছোটবেলার সনতের মতো লাগছে!”
..০০..