ছোটদের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ছোটদের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২৫

বেড়াল

 

শুক্রবার

বেড়ালটাকে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম,  আর তার ফলে, অটোটা ফস্কে গেল। অটোয় একটাই সিট অবশিষ্ট ছিল, আমাকে পাশ কাটিয়ে ডেঁপো এক ছোকরা টুক করে উঠে বসতেই অটোটা ছেড়ে দিল। এর পরেরটা কখন পাবো কে জানে! আমার এখানে অটোস্ট্যাণ্ড নয়, মাঝ-রুটে অটোয় জায়গা পাওয়া যথেষ্ট ভাগ্যের ব্যাপার। কাজেই অটোটা মিস হওয়াতে বেশ আফশোষ হচ্ছিল! তবে পরের অটোর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে, কিছুক্ষণ পরেই যা শুনলাম, তাতে আরো ঘাবড়ে গেলাম। আমাদের গলিটা সোজা গিয়ে যেখানে বাঁদিকে মোড় নিয়েছে, সেখানে উল্টোদিক থেকে আসা একটা বাইক সজোরে ধাক্কা মেরেছে ওই অটোটায়! আর তাতে কাত হয়ে উল্টে গিয়েছে অটো। মারাত্মক কিছু না হলেও, সকলেই চোট পেয়েছে। সব থেকে বেশি চোট পেয়েছে, সেই ছোকরা, যে আমাকে টপকে অটোয় চড়েছিল। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে! বেড়ালটা যেখানে বসেছিল, আমি সেদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। নাঃ, এখন আর নেই। কিন্তু আমার মনটা কেমন দমে গেল। ছোটবেলার স্কুল বয়েসের বন্ধু শ্যামলের বাড়ি যাচ্ছিলাম, ঠিক করলাম, আজ আর যাবো না। অটোর অপেক্ষায় আর না থেকে, আমি বাড়িতে ফিরে এলাম। 



শনিবার

পরেরদিন সাড়ে আটটা নাগাদ বারান্দার চেয়ারে বসে খবরের কাগজ দেখছিলাম, হঠাৎ কলমি এসে বলল,

“ও মামা, তুমি আবার খইনি খাওয়া ধরলে কবে থেকে গো”?

“খইনি? আমি? বড্ডো আবোলতাবোল বকিস তুই, কলমি”।

“বাঃ রে, তাহলে এটা কোত্থেকে এলো শুনি? বসার ঘরে সোফা ঝাড়তে গিয়ে বেরোলো, এই দ্যাখো!” কলমির বাড়ানো হাত থেকে লালরঙের প্লাস্টিকের কৌটোটা হাতে নিয়ে আমিও অবাক হলাম। খইনির ডিব্বাই বটে। দুমুখো ডিব্বে, এ ধরনের ডিব্বার একদিকে তামাকের পাতা থাকে, অন্য দিকে গোলা চুন। ফুটপাথে বিহারি খইনিওয়ালাদের কাছেও বিক্রির জন্যে এমন ডিব্বে দেখেছিকিন্তু আমার এখানে এলো কী করে? আমি বা আমার চেনাশোনা কেউ কস্মিনকালেও খইনি খায় এমনতো মনে পড়ল না। কলমি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে পাকাবুড়ির মতো উপদেশ দিল,

“মামা, তামাকের নেশা করতে নেই গো, ওতে ক্যানসার হয়, শোননি?” আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম,

“যাঃ যাঃ, বেশি বকিসনি। ভালো করে চা কর দেখি, আমি দেখি, এটা কোথা থেকে এল”। কলমি মুখটা গোমড়া করে রান্নাঘরে যেতেই আমি ডিব্বের দুদিকের মুখের ঢাকনা খুলে ফেললাম। খইনি রাখার বড়ো দিকটাতে কিচ্ছু নেই, খালি। আর পিছনের ছোটদিকটা মিহি বালি দিয়ে ভরাট করা। কী মনে হতে বাঁ হাতে ঢেলে নিলাম বালিগুলো, আর তার মধ্যে থেকে যা বেরোলো, দেখে চমকে উঠলাম। কিছুক্ষণ থ মেরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তারপর কলমি এখনই চা নিয়ে আসবে ভেবে, বালিগুলো আবার ডিব্বেয় ভরে রাখলাম, আর অবাক করা জিনিষটা ঢোকালাম পাঞ্জাবির পকেটে!

 কলমি কাজ সেরে, আমার জলখাবার বানিয়ে চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হল। যতক্ষণ ছিল, মেয়েটা কাজের ফাঁকে ঘুরে ফিরেই জিগ্যেস করছিল, “ও মামা। ওটা কার গো? তোমার নয় বলছো, তাহলে কার? যে ফেলে গেছে সে ফিরে আসবে নিশ্চয়ই!” ওর অত্যধিক কৌতূহলে আমি একটু বিরক্ত হলেও - “হুঁ”। “কে জানে কার”। “আসবে বোধহয়” এইরকমই উত্তর দিচ্ছিলাম। কলমিটা এত ভালো মেয়ে, আর আমাকে ভালোওবাসে খুব। তাই বেশি বকাঝকা করতেও পারি না। আসলে ওর মা অন্নদাদিদি আমাদের বাড়িতে কাজ করে আমার ছোট্টবেলা থেকে। আমার মাও খুব ভালোবাসত অন্নদাদিদিকে। আমার ছ’বছর বয়েসে বাবা মারা যান, আর মাও চলে গেলেন আমি যখন বিএসসি থার্ড ইয়ারে পড়ি। আমার মা মারা যাবার বেশ কদিন আগে থেকে, অন্নদাদিদির হাত ধরে অনেকবারই বলেছিলেন, ‘আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না রে, অন্ন, আমি চলে গেলে মুকুলকে একটু দেখিস’। এই সব নানা কারণে অন্নদাদিদি এবং তার মেয়ে কলমি এবাড়ির আলাদা কেউ নয়। অন্নদাদিদির স্নেহ-আদরে সে সময়ে মায়ের চলে যাওয়ার কষ্টটা সামলে উঠতে, বেশ সুবিধেই হয়েছিল! 

সকালে কলমি আসে, ঘরদোর ঝাড়পোঁছা করে, আমার জলখাবার বানিয়ে দিয়ে যায়। একটু বেলায় আসে অন্নদাদিদি। দুপুরের রান্নাবান্না সেরে, আমার খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে বাড়ি ফেরে। অন্নদাদিদির আসতে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি আছে। আমি শোবার ঘরে এসে পাঞ্জাবির পকেট থেকে হলদে রঙের পাথরের মতো জিনিষটা বের করে দেখলাম। আমার যদিও তেমন কিছুই ধারণা নেই, তবু মনে হল এটা হয়তো কোন দামি পাথর। যাকে জেমস্টোন বলে। জানালা দিয়ে একফালি রোদ্দুর আসছিল, সেই আলোয় জিনিষটা ধরতেই, জিনিষটা ঝিলিক দিয়ে উঠলচোখের আরো কাছে এনে দেখলাম, পাথরের ভেতরে বেড়ালের চোখের মতো উজ্জ্বল একটা আলো। বেড়ালের চোখ, যাকে ইংরিজিতে বলে ক্যাটস আই? তার মানে বৈদূর্যমণি? এ জিনিষ খইনি ডিব্বের মধ্যে লুকিয়ে, আমার সোফার কোণায় কে রেখে গেল? নাকি ভুলে ফেলে গেছে কেউ? আমার চেনা পরিচিতর মধ্যে রত্নের কারবার কে করে? কই, তেমন তো জানি না কাউকে!

গতকাল অটোয় উঠতে যাবার আগে সেই বেড়ালটার কথা আবার মনে পড়ল। মহাপ্রভু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ছাদের কার্ণিসে বেড়ালটা বসেছিল। তার “মিঁয়াও” ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে যখন আমি তাকে দেখলাম, বেড়ালটা আমার দিকে তার একটা থাবা তুলে নাড়াল, মনে হল আমাকে যেন সে নিষেধ করছে! যদিও আমি বেড়াল বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু বেড়ালকে ওভাবে থাবা নাড়াতে কোনদিন দেখিনি! এই পাথরটা যদি ক্যাটস্‌ আই হয়, তার সঙ্গে ওই বেড়ালের কোন যোগাযোগ রয়েছে কী? কে বলবে? কাউকে জিগ্যেস করলে, ভাববে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে! 

বিকেলে একটু বেরিয়েছিলাম, একটু হাঁটাও হবে, টুকটাক কিছু জিনিষপত্র কেনার ছিল, সেগুলো কেনাও হবে। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েকটা বাড়ি ছেড়েই রণধীরবাবুর বাড়ি। সেই বাড়ির বারান্দায় গ্রিলের ফ্রেমে বেশ কয়েকটা ফুলগাছের টব আছে। দূর থেকে দেখতে বেশ ভালোই লাগে। ওই বাড়ির নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় আবার সেই বেড়ালটাকে আজ ফুটপাথের ধারে বসে থাকতে দেখলাম। আজও অদ্ভূতভাবে থাবা তুলে বসে আছে, ঠিক যেমন ট্রাফিক পুলিশ হাত তুলে থামতে বলে, সেরকম ভঙ্গী। বেড়ালটাকে দেখে আজও একটু থমকে গেলাম। আর সেই সময়েই আমার দু হাত সামনে ফুলগাছ সমেত একটা টব ওপরের বারান্দা থেকে ধপাস করে ফুটপাথে এসে পড়ল এবং ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আশেপাশে লোকজন হৈচৈ করে উঠল, রণধীরবাবুর নাম ধরে ডাকাডাকি করতে লাগল। আমি চুপ করে দাঁড়িয়েই রইলাম। ভয় পেয়েছিলাম ভীষণ, কয়েক সেকেণ্ড পরেই ওই টবটা আমার মাথায় পড়লে আমার যে ভবলীলা সাঙ্গ হত, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এমন অদ্ভূতভাবে বেঁচে যাওয়াতে আশ্চর্য হলাম অনেক বেশি! আরো আশ্চর্য, সেদিনের মতোই এখন আর বেড়ালটাকে কোথাও দেখতে পেলাম না।

 

রবিবার

প্রত্যেকদিনের মতো আজও সকালে কলমি এসেছে, সঙ্গে ওর মেয়ে ফুটকি। ফুটকি ক্লাস সিক্সে পড়ে, আমার কাছে পড়তে আসে। লেখাপড়ায় বেশ ঝোঁক আছে মেয়েটার, বুদ্ধিশুদ্ধিও ভালোই। স্কুলের ছুটির দিনগুলোয় আমার কাছে সে আসে মায়ের সঙ্গে, আর ফেরে দিদিমার সঙ্গে, আমার সঙ্গে খাওয়াদাওয়া সেরে।

ফুটকিকে আজ বাংলা পড়াতে গিয়ে বেশ মুশকিলে পড়ে গেলাম। ওদের বইতে মাইকেল মধুসূদনের “মেঘনাদবধ কাব্য”-এর একটা অংশ আছে, সেটার অনেকগুলো শব্দের মানে কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। যেমন, ইরম্মদ, আনায়, কোদণ্ড। বাংলায় যে খুব খারাপ নম্বর পেতাম, তা নয়, স্কুলে পড়তে এগুলো জানতাম, কিন্তু এত বছর চর্চার অভাবে সেসব ভুলে গেছি! কিন্তু এখন শব্দগুলোর মানে জানা দরকার। ফুটকিটা বারবার জিগ্যেস করছিল, ও দাদু, ইরম্মদ মানে কী? বলো না, তুমি জানো কিন্তু বলছো না, বলো না, দাদু”। কাচের পাল্লা দেওয়া আলমারির ওপরের তাকে “চলন্তিকা”টা থাকার কথা। বহুদিন খুলেও দেখা হয়নি বইটা। এতদিন মনেও ছিল না বইটার কথা, আজ মনে পড়ল। ওটাকে পাড়তে গেলে চেয়ার বা টুল দরকার একটা।

ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির নিচেয় একটা পুরোনো টুল ছিল, সেটা নিয়ে এলাম। টুলটার অবস্থা খুবই খারাপ। নড়বড় করছে। আশা করি আমার ভার নিতে পারবে। টুলটাকে আলমারির সামনে রেখে সেটায় উঠতে যাবো, চোখ পড়ল জানালার বাইরে। সেই বেড়ালটা ওখানে বসে আছে, আর আমার দিকে তাকিয়ে থাবা নাড়ছে! স্পষ্ট বুঝলাম, আমাকে নিষেধ করছে! বেড়ালটাকে গ্রাহ্য না করে, টুলটায় উঠতে যেতেই বেড়ালের থাবা নাড়া বেড়ে গেল, উপরন্তু বেশ রাগ রাগ গলায় ডাকল, “ম্যাঁয়াও”

অলৌকিক ব্যাপারে আমার একেবারেই বিশ্বাস নেই, আর কাক ডাকলেই তাল পড়বে এমন কাকতালীয় ঘটনাতেও  আমার মোটেই বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু পর পর দু দিনের ঘটনায় সেই বিশ্বাসে মনে হচ্ছে টান পড়েছে! তাই আর জেদ না করে, টুলে চেপে “চলন্তিকা” পাড়ার ব্যাপারটা আপাততঃ স্থগিত রাখলাম। নড়বড়ে টুলটা তুলে নিয়ে সিঁড়ির নিচে যেমন ছিল সেরকমই রেখে এলাম। ফিরে এসে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেই বেড়ালটা যথারীতি আর নেই। আর তখনই আমার ওই সব কটা শব্দের মানে মনে পড়ে গেল! আমার রকমসকম দেখে ফুটকি ফিকফিক করে হেসে গড়িয়ে পড়ল, বলল, 

“ও দাদু, তুমি পাগল হলে নাকি? ভাঙা টুলটা একবার নিয়ে এলে, আবার রেখে এলে, কী ব্যাপার বল তো?” আমি খুব গম্ভীর গলায় বললাম,

“বাজে বকিস না, জানালার ওপাশে হাতনাড়া বেড়ালটাকে দেখলি? একটু আগেই বসেছিল?” তাতে আরো মজা পেয়ে ফুটকি বলল,

“বেড়াল? বেড়াল আবার কোথায় দেখলে? আমি তো সেই থেকে বসে রয়েছি, কই, কোন বেড়াল তো দেখলাম না! তাছাড়া বেড়ালের আবার হাত হয় নাকি? বেড়ালের তো চারটেই পা ! বেড়াল তো চতুষ্পদ প্রাণী”। ফুটকির মাকে আমি ধমক দিলে কথা শোনে, কিন্তু ফুটকি শুনবে কেন? সে তো আমার নাতনী, দাদুদের ধমকে নাতনীরা কবে আর কাবু হয়? আমি ফুটকিকে আর না ঘাঁটিয়ে, গম্ভীর গলায় বললাম,

“বাঃ চতুষ্পদ মানে চারপা যখন জানিস, তখন ইরম্মদ মানে জানিস না কেন?” ফুটকি হার মানার মেয়েই নয়, বলল,

“বারে, আমি তো ছোট্ট, আমি সবই যদি জেনে যাবো, তাহলে তোমরা আমাদের শেখাবে কী? আর তুমি আমার দাদুই বা হয়েছো কেন?” ফুটকির উত্তরে আমি জবাব দিতে পারলাম না, তাই নিরীহ স্বরে বললাম,

“বেশ, পাকু হয়েছিস তুই, খাতা পেন বের কর, লেখ, ইরম্মদ মানে বজ্র”। বাংলা খাতা খুলতে খুলতে ফুটকি বলল,

“বজ্র, মানে বাজ? বর্ষা কালে মেঘের থেকে গুড়ুমগুড়ুম শব্দ করে যা পড়ে?”

“হুঁ”।

“আর কোদণ্ড?”

“ধনুক। ধনুকে বসিয়ে আগেকার দিনে তির ছুঁড়ে যুদ্ধ হত”।

“ও হ্যাঁ, টিভিতে দেখেছি, ভগবান রামচন্দ্র হেব্বি তির ছুঁড়তে পারতেন। আর আনায় মানে?”

“আনায় মানে বড়োসড়ো খাঁচা। যার মধ্যে বাঘ, সিংহকে বন্দী রাখা হয়, চিড়িয়াখানায় দেখিসনি?” ফুটকি কিছু বলল না, ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল, আর খাতার ওপর ঝুঁকে লিখে নিতে লাগল মানেগুলো।

 

 

সোমবার সকাল

বলা নেই কওয়া নেই, আজ সকালে পৌনে আটটা নাগাদ সন্ময় এসে হাজির। অবিশ্যি ও এমন হুট করেই আসে। শ্যামলের মতো সন্ময়ও আমার স্কুলের বন্ধু এবং খুব ভালো বন্ধু। কদিন আগেও সন্ময় এসেছিল, বুধবার, না না বেষ্পতিবারে। ও এলে নিজেই গাড়ি চালিয়ে আসে। আর ঘরে পা দিয়েই হাঁকডাক শুরু করে, যেমন আজও করল,

“অ্যাই কলমি, মামার জন্যে জলখাবারে কী বানাচ্ছিস রে?” কলমিও সন্ময়কে খুব পছন্দ করে, সে মুখ টিপে হেসে উত্তর দিল,

“মামার জন্যে শুকনো রুটি আর কুমড়োর মলম, কিন্তু তুমি ভেবো না সনুমামা, তোমার জন্যে পরোটা আর আলুরদম বানাবো”। হো হো করে হাসতে হাসতে সন্ময় বলল,

“তোর পেটরোগা মামাটা খুব জব্দ হবে, বল কলমি, যখন ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে পরোটা খাব?” কলমি আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ফিক করে হাসল, তারপর রান্নাঘরে ঢুকল। আমার সামনের সোফায় ধপাস করে বসে, সন্ময় ভুরু নাচিয়ে আমায় জিগ্যেস করল,  

“ঠিকঠাক আছিস দেখছি। কটা দিন কেমন কাটালি?”

“কেন বলতো? রিটায়ার করে এখন ঘরে বসে সময় কাটাই, সব দিনই এক রকম, নতুনত্ব কিছুই নেই”!

“কিছুই হয়নি, এ কদিনে? কোন আশ্চর্য ঘটনা”? চোখ ছোট করে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে সন্ময় জিগ্যেস করল। বলব কি বলব না ভেবেও, আমি কিন্তু কিন্তু করে বলেই ফেললাম,

“কই তেমন কিছু তো হয়নি। তবে, তিন-তিনটে দুর্ঘটনা থেকে নির্ঘাৎ বেঁচে গেছি”!

“কী রকম? শুনি!” আমি শুক্র, শণি আর রবিবারের তিনটে ঘটনার কথাই বললাম, অদ্ভূত সেই বেড়ালের হাত নাড়া সমেত। খুব মন দিয়ে শুনেটুনে সন্ময় স্বস্তির শ্বাস ফেলল, তারপর উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

“একবার ওঠ তো!” আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম,

“কেন?” সন্ময় কোন উত্তর তো দিলই না, উল্টে ঝেঁজে উঠে জিগ্যেস করল,

“আঃ, ওঠ না, উঠে দাঁড়াতে তোর কষ্ট হচ্ছে নাকি?” অগত্যা উঠে দাঁড়ালাম। আমি যে সোফাটায় বসেছিলাম,  তার বসার গদির নিচে হাত ঢুকিয়ে কী যেন খুঁজতে লাগল। একবার ডানদিক, তারপর বাঁদিক কোণাদুটো খুঁজে আপনমনেই বলল,

“যাচ্চলে, এই খানেই তো রেখেছিলাম, গেল কোথায়?” আমি কৌতূহলে জিগ্যেস করলাম,

“কী খুঁজছিস বলতো”?

“আরে, প্লাস্টিকের একটা কৌটো। যাতে খইনি আর চুন রাখে”।  আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম,

“ওটা তুই রেখেছিলি? তুই কী আজকাল খইনি খাওয়া ধরেছিস নাকি, এই বয়েসে? সোফা ঝাড়তে গিয়ে কলমি ওটা পেয়ে আমাকে খুব ধমকাচ্ছিল, “মামা তামাক খেও না, ক্যানসার হবে!”” সন্ময় এবার কোমরে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলল,

“অঃ, তার মানে ওটা এখন তোর হাতে? তার মানে ওটা তুই খুলেছিস এবং নিশ্চয়ই মণিটাও পেয়েছিস?”

“তা পেয়েছি, কিন্তু কী ব্যাপার বলতো? হঠাৎ তুই না বলে কয়ে আমার সোফায় ওটা রেখে গেলি কেন?”  সন্ময় ধপাস করে আমার সোফায় বসল, আর আমিও বসলাম, সন্ময়ের সোফাটায়। সন্ময় বলল,

“মাকে তুই তো চিনিস, আমার থেকেও মা কোন কোন সময় তোকে অনেক বেশি ভালোবাসে”! মুখ টিপে হেসে আমি বললাম,

“মায়ের ভালোবাসা নিয়ে হিংসে করছিস? দাঁড়া মাসিমাকে গিয়ে আমি বলবো!” সন্ময় সেকথায় কোন গুরুত্বই দিল না, বলল,

“যাঃ যাঃ বলবি তো বলবি। কদিন আগে, কী করে জানি না, মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছিল, তোর সামনে খুব বিপদ। শুক্র থেকে রবি এই তিনদিন পার করতে পারলেই ব্যস্‌। আমাকে মা বললেন, সনু, শিগ্‌গির যা, মনুর ঘরে কাউকে কিচ্‌ছু না বলে, যেখানে হোক এটা রেখে আসবি। বেষ্পতিবার এসেছিলাম, রেখে গিয়েছিলাম। আজ আবার মা বললেন, যা তো দেখে আয়, মনুটা কেমন আছে! আসার সময় মনুকে সঙ্গে নিয়ে আসবি, আর জিনিষটাও নিয়ে আসবি। তাই আজ আবার চলে এলাম”। এ সময় কলমি এল জলখাবার নিয়ে, দুজনের জন্যেই পরোটা আর আলুরদম। গরম গরম পরোটা খেতে খেতে আমরা ওই বেড়ালটা আর সব ঘটনাগুলো নিয়েই আলোচনা করছিলাম। অলৌকিক ঘটনা যে আজও ঘটে সে বিষয়ে আমাদের মনে কোন সন্দেহ ছিল না। 

সোমবার শেষ দুপুর

আমাদের দুপুরের খাওয়া শেষ হতে অন্নদাদিদি চলে গেলঅন্নদাদিদিকে বলে দিলাম, আমি একটু পরেই সন্ময়ের বাড়ি যাবো, ফিরবো কাল সন্ধে নাগাদ, তার মানে সেই অব্দি কলমি, অন্নদাদিদি দুজনেরই ছুটি।  খইনির ডিব্বে সমেত সেই পাথরটা আমি সন্ময়কে আগেই ফেরত দিয়ে দিয়েছিলাম। সন্ময় বেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল, যাবার সময় বলল,

“আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি, তুই তালা-টালা লাগিয়ে আয়”। সব ঘরের জানালা দরজা বন্ধ করে, সদরের তালা লাগিয়ে, পকেটে চাবি নিয়ে, আমি সন্ময়ের গাড়িতে উঠলাম হাতে ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে। তার মধ্যে আছে পাজামাপাঞ্জাবি, টুথব্রাশ, শেভিংসেট এরকম কিছু টুকটাক। আমি উঠতেই সন্ময় গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল,

“সিটবেল্ট লাগা”। আমি বাঁদিক থেকে সিটবেল্টটা টানতে ঘাড় ঘোরালাম, আর দেখলাম, সেই বেড়ালটা আমার সদর দরজার সামনে বসে হাত নাড়াচ্ছে! দেখেই আমি চমকে উঠলাম। সর্বনাশ, তার মানে আবার কিছু বিপদ ঘটবে! আতঙ্কে আমি সিটবেল্ট বাঁধা বন্ধ করে, সন্ময়কে বললাম,

“আমি যাবো না, সনু। সামনে বিপদ!” সন্ময় স্টার্ট বন্ধ করে বলল,

“বিপদ? কোথায় বিপদ? তোর হঠাৎ আবার কী হল, বলবি তো?” আমি কোন উত্তর না দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। সদর দরজার দিকে এগোনোর সময়ও দেখলাম বেড়ালটা বসে আছে, অন্যদিন এতক্ষণ থাকে না। সন্ময়ও গাড়ি থেকে নেমে এল, আমার কাছে আসতে আসতে বলল,

“কী হল বলতো তোর?” আমি বললাম,

“বেড়াল। দেখছিস না?” সন্ময়ও বলল,

“বেড়ালই তো। তাতে অবাক হবার কী আছে?” আমি ততক্ষণে দরজার সামনে পৌঁছে গেছি, বেড়ালটা একভাবেই বসে আছে, আমাকে এত কাছে যেতে দেখে মুখ তুলে তাকিয়ে লেজটা নাড়ল, মিঁহি সুরে ডাকল “মিঁয়াও”। তারপর টুকটুক করে হেঁটে গিয়ে লাফ দিয়ে উঠল আমাদের পাঁচিলে! সেখান থেকে আরেক লাফে চলে গেল পাশের বাড়ির জানালার কার্নিশে। আর সেখান থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে স্পষ্ট বলল,

“আসল বেড়াল আর নকল বেড়াল চেনেন না, আচ্ছা উজবুক লোক আপনি, মশাই। নিরিবিলি ধাপিতে বসে, আরাম করে একটু কান চুলকোচ্ছিলাম, সামনে চলে এলেন বিরক্ত করতে?” বলেই সে আর দাঁড়াল না, জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে লাফ দিল! আর দেখতে পেলাম না তাকে

 ..০০..

("শুকতারা"য় প্রকাশিত ও "এক কুড়ি কিশোর" গ্রন্থে সংকলিত) 

 

         

   

 

 


শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৫

নতুন গাড়ি

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলেডান দিকের কলামে

"ফলো করুন" 👉

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন।

এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে পড়লেস্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে

ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]

 

 বীরভূম জেলার মুচকুন্দপুরে অজিতেশবাবুর এই পৈতৃক বাড়ির আমেজই আলাদা। হাতপা ছড়ানোর মতো বিস্তর জমি-জায়গা নিয়ে বিশাল এই বাড়িটা শ দেড়েক বছরের পুরোনো অজিতেশবাবু এবং তাঁর স্ত্রী সরযূদেবী সারা জীবন চাকরিসূত্রে কলকাতা আর পাটনায় ছিলেন ঠিকই, কিন্তু এ বাড়ির সঙ্গে তাঁদের সংযোগ কোনদিনই ছিন্ন হতে দেননি। চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর তাঁরা দুজন পাকাপাকিই এ বাড়িতে এসে বসবাস করছেন। যদিও ছেলেমেয়েরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদের কর্মস্থলে। দুই ছেলের মধ্যে বড়োটি থাকে দিল্লিতে, আর ছোটোটি ব্যাঙ্গালুরুতে। একমাত্র মেয়ে থাকে মুম্বাইতে, জামাই ওখানে চাকরি করে।

বিশাল এই বাড়িতে সারা বছর তাঁরা সব মিলিয়ে থাকেন সাতটি প্রাণী। সস্ত্রীক অজিতেশবাবু, সরযূদেবীর এক বোনপো পথিক। রান্নাবান্না করার জন্যে মালতী, ঘরদোর পরিষ্কার রাখার জন্যে লক্ষ্মী পাহারা দেওয়া এবং বাজার হাট করে দেওয়ার জন্যে মাধব আর বাগানের গাছপালা দেখাশোনা করে রামখিলাওন। পথিক ছাড়া অন্য সবাই এ বাড়িতে অনেকদিন ধরেই রয়েছেন, যার ফলে ওঁনারাও এ বাড়ির এবং এই পরিবারেরই সদস্য হয়ে গেছেন বহুদিন।

বড়দিনের ছুটিতে অজিতেশবাবুর নির্জন এই বাড়িটা প্রত্যেকবারই বেশ জমে ওঠে। ওই সময় নাতি-নাতনীদের স্কুলে ছুটি থাকে, দুই ছেলে ও দুই বৌমা এবং মেয়ে-জামাইও এ সময় অফিস থেকে দিন দশেকের ছুটি নেয়। আগের দিন ফ্লাইটে কলকাতা পৌঁছে, সকালের ট্রেন ধরে, হৈচৈ করতে করতে ওরা কলকাতা থেকে এসে উপস্থিত হয়স্টেশন থেকে ওদের আনতে অজিতেশবাবু গাড়ি পাঠান। বাতের ব্যথাটা আয়ত্ত্বে থাকলে কোন কোন বার নিজেই যান গাড়ি নিয়ে। বাড়িতে ঢুকেই বাচ্চা নাতি-নাতনীগুলো এমন আনন্দ আর হৈচৈ শুরু করে, অজিতেশবাবুর মনটা ভরে ওঠে। সারা বছর তিনি এই দিনগুলোর প্রতীক্ষাতেই থাকেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী সরযূদেবী এত খুশী হন, এ কটাদিনের অনভ্যস্ত বাড়তি পরিশ্রমকেও গায়ে মাখেন না।

প্রত্যেকবারই অন্ততঃ দিন তিনেক তাঁরা সব্বাই মিলে, ময়ূরাক্ষীর ধারে পিকনিক করতে যান। সক্কাল সক্কাল খাবার-দাবার বানিয়ে দুটো গাড়ি ভাড়া করে তাঁরা বেরিয়ে পড়েন। নদীর পাড়ে সারাদিন খেলাধুলো, আড্ডা, গল্প করে, বিকেলের দিকে ফিরে আসেন। বেশ মজায় কাটে দিনগুলো, বিশেষ করে ছোটদের ফূর্তি আর আনন্দের কোন সীমা থাকে না। অজিতেশবাবু আর সরযূদেবী ওদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু শতরঞ্চিতে বসে বসে ওদের লাফালাফি আর হৈচৈ করতে দেখে ভারি আনন্দ পান।

তবে প্রতিবারই ভাড়া করা গাড়ির ড্রাইভারগুলো কিছু না কিছু ঝামেলা পাকায়। সকাল থেকে বিকেল অব্দি বসে থাকতে তাদের ভালো লাগে না। তাদের দুপুরের খাবারও পছন্দ হয় না, আর দুপুর থেকেই ফেরার জন্যে তাগাদা দিতে থাকে তাদের কোন না কোন অজুহাতের আর শেষ নেই! চাকায় হাওয়া কম আছে। ঠিকঠাক ব্রেক ধরছে না। বাঁদিকের হেডলাইটটা জ্বলছে না, রাত হয়ে গেলে অন্ধকারে গাড়ি চালাতে অসুবিধে। একটা না একটা কিছু থাকবেই!

এ বছর অজিতেশবাবুর প্ল্যান রয়েছে সব্বাইকে বেশ একটু চমকে দেবেন। তিনি বেশ জব্বর একটা এসইউভি গাড়ি বুক করেছেন। সেটার ডেলিভারি দেওয়ার ডেট ছিল গত পরশু। কিন্তু সে আর হয়নি। যথারীতি তারা দুঃখ-টুঃখ পেয়ে, ক্ষমা-টমা চেয়ে, দুদিন পিছিয়ে আজ শনিবার ডেলিভারি দেবে বলেছে। ওদিকে ছেলেমেয়েরা পৌঁছচ্ছে আগামিকাল, সকাল দশটা, সাড়ে দশটা নাগাদ। তিনি ভেবেছিলেন, পথিককে সঙ্গে নিয়ে, নিজেই শহরে যাবেন গাড়ি ডেলিভারি নিতে। কিন্তু আজ সকালে উঠে দেখলেন, শরীরটা তাঁর ভালো নেই। সারা গায়ে, হাতে-পায়ে ব্যথা, গলাটাও খুসখুস করছে, একটু যেন জ্বর-জ্বর ভাবতিনি তাও হয়তো বেরিয়ে পড়তেন, কিন্তু সরযূদেবী বেরোতে দিলেন না। বললেন, “আজকের দিনটা বিশ্রাম নাও, বরং কাল সকালে গাড়ি নিয়ে ওদের স্টেশনে আনতে যেও। আজ এবং কাল, পরপর দুদিন, এতটা পথ উজিয়ে যাওয়া-আসার ধকলে শরীর খারাপ বাড়লে, সকলের ছুটির মজাটাই মাটি হয়ে যাবে”এই গ্রাম থেকে শহরের দূরত্ব পায় পঞ্চান্ন কিলোমিটার। সেখানেই রেলস্টেশনও। কাজেই তাঁর এই বয়সে পরপর দুদিন এতটা পথ যাওয়া-আসা মোটেই সহজ কাজ নয়। অতএব স্ত্রীর কথাটা অজিতেশবাবু মেনে নিলেন এবং ঠিক হল পথিক একাই যাবে এবং শোরুম থেকে একজন ড্রাইভার নিয়ে গাড়ি চালিয়ে সোজা বাড়ি আসবে। কথা হয়ে আছে শোরুমের ওই ড্রাইভারই এ কটা দিন এ বাড়িতেই থাকবে। 

 

গাড়ির ডেলিভারি নিতে পথিক শোরুমে পৌঁছে গেল সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ। কাগজপত্র সইসাবুদ হয়ে, গাড়িতে হাই-সিকিউরিটি নাম্বার প্লেট লাগিয়ে, গাড়ি রেডি হল প্রায় সাড়ে চারটে নাগাদ। তারপর শোরুমের ড্রাইভার, গোবিন্দবাবু গেল, দিন দশেক বাইরে থাকার মতো, বাড়ি থেকে জামাকাপড় আনতেফিরল প্রায় পৌনে ছটা নাগাদ। সব ঝামেলা মিটিয়ে নতুন গাড়ি রাস্তায় নামল যখন, তখন ঘড়িতে সোয়া ছটা। ডিসেম্বরের শেষে দিন খুবই ছোট, ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে সন্ধে নেমে এসেছে অনেকক্ষণ। শোরুম থেকে বেরিয়েই তারা প্রথমেই পেট্রল পাম্পে ঢুকল। সেখান থেকে ট্যাংকি ফুল করে তেল নিয়ে, গাড়ি মুচকুন্দপুরের দিকে রওনা হল যখন, ঘড়ির কাঁটা তখন পৌনে সাতটা। পেট্রলপাম্প থেকে বেরিয়েই পথিক ফোন করে মেসোমশাইকে জানাল তারা রওনা হয়ে পড়েছে। বাড়ি পৌঁছতে খুব জোর ঘন্টা দুয়েক লাগবে। অজিতেশবাবু স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন, “যাক বাবা, শেষ অব্দি গাড়ি হাতে এসেছে! সাবধানে আয়। তাড়াহুড়ো করিস না, একটু বেশি সময় লাগে তো লাগুক। এদিকের রাস্তাটা তেমন সুবিধের নয়” পথিক বলল, “ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না, মেসোমশাই, আমি সাবধানেই আসব”।

পথিক ফোনটা বন্ধ করার পরেই গোবিন্দবাবু, শহরের ঘিঞ্জি রাস্তায় ধীরে ধীরে গাড়ি চালাতে চালাতে বললেন, “পথিকদা, নতুন গাড়ি কিনলেন পুজো দেবেন না? সবাই দেয় কিন্তু”। পুজোর ব্যাপারটা পথিকের মাথাতেই আসেনি। একটু চিন্তা করে পথিক বলল, “তা ঠিক। কিন্তু সে পরে দেখা যাবে। বাড়ি গিয়ে মাসিমা পুজো-টুজো যা করার করবেন, এখন সোজা বাড়িই চলুন”

গোবিন্দবাবু ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললেন, “আপনাদের যেমন ইচ্ছে”।

শহরের সীমানা থেকে তিন-চার কিলোমিটার রাস্তার দুধারে খাপছাড়া কিছু বসতি রয়েছে, তারপর থেকেই শুরু হল জঙ্গল। রাস্তায় লোকজন কিংবা অটোরিকশ, সাইকেল রিকশ না থাকাতে বেশ ফাঁকা হয়ে গেল রাস্তা। গোবিন্দবাবু এবার গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে তুললেন পঞ্চাশের ওপর। আরো মিনিট কুড়ি পঁচিশ যাওয়ার পর রাস্তা সম্পূর্ণ নির্জন হয়ে গেল, মাঝে মাঝে দু একখানা ট্রাক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সাঁৎ সাঁৎ করে। রাস্তার দুপাশে বেশ গভীর জঙ্গল। হেডলাইটের আলোয় যেটুকু দেখা যাচ্ছে তার বাইরে ঘন অন্ধকার। এ রাস্তায় গোবিন্দবাবু গাড়ির স্পিড তুললেন আশি-নব্বইয়ের কাছাকাছি।

গাড়ির এত স্পিড দেখে পথিক একটু ঘাবড়ে গেল, বলল, “এতটা স্পিডে না চালালে হত না, গোবিন্দবাবু? একটু পরেই বড়ো রাস্তা ছেড়ে, আমাদের ডানদিকে জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকতে হবে। অন্ধকারে জায়গাটা চিনতে ভুল হলে, মুশকিল”।

গোবিন্দবাবু সামনের দিকে স্থির নজর রেখে, হেসে বললেন, “মুচকুন্দপুর আমি অনেকবার গিয়েছি, ও রাস্তা আমার হাতের তালুর মতো চেনা। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন পথিকদা, কিচ্‌ছু ভুল হবে না”।

আরো মিনিট পনের চলার পর গোবিন্দবাবু গাড়ির স্পিড কমিয়ে ডানদিকে সিগ্ন্যাল দিল। তারপর বেশ কিছুটা গিয়েই ডানদিকে ঘুরিয়ে দিল গাড়িটা, তারপর বলল, “কী পথিকদা? ঠিক আছে? ভুল করিনি তো?” ব্যাপারটা এমনই চট করে ঘটে গেল, পথিক ঠিক ঠাহর করতে পারল না।

তার মনে কেমন যেন খটকা লাগল। বলল, “মোড়ের বাঁদিকে একটা বড়ো বটগাছ ছিল? যার তলাটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো?” এই রাস্তাটা বড়ো রাস্তার মতো মসৃণ নয়, পিচের রাস্তাই তবে একটু এবড়ো-খেবড়ো। গাড়ি লাফাচ্ছে, তিরিশের বেশি স্পিডে চালাতে পারছেন না, গোবিন্দবাবু।

তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “বটগাছ তো দেখিনি। আমি তো শুধু রাস্তা দেখছি!”

পথিক বলল, “আমার কিন্তু এ রাস্তাটা চেনা মনে হচ্ছে না, গোবিন্দবাবু। রাস্তা ভুল হয়েছে...”।

“এ রুটে গোবিন্দলাল মিদ্দার রাস্তা ভুল হবে? আপনি হাসালেন, পথিকদা...” বলেই হা হা করে হাসতে লাগলেন খুবএই সময়েই গাড়ির হেডলাইট দুটো নিভে গেল ঝপ করে। সামনে পেছনে এবং দুপাশে গভীর অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না, প্রায়। গোবিন্দবাবু খুব অবাক হয়ে গাড়ি থামালেন। হেডলাইটের লিভারটা কয়েকবার নাড়াচাড়া করলেন, কোন লাভ হল না।

তারপর দরজা খুলে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললেন, “কী ব্যাপার হল?”

পথিক বলল, “তখনই বললাম, এত স্পিডে গাড়ি চালাবেন না, ঝাঁকুনিতে লাইটের তার-টার খুলে গেছে হয়তো”। 

“আনকোরা গাড়ির তার খুলে গেছে, বললেই হল? টিভিতে এ গাড়ির বিজ্ঞাপন দেখেননি? পাহাড়ি রাস্তায় কেমন নাচতে নাচতে দৌড়োয়? একখুনি ঠিক হয়ে যাবে। একটু চেক করে নিই...”গোবিন্দবাবু বনেট খুলে, আলো জ্বেলে মুণ্ডুটা ঢুকিয়ে দিলেন ভেতরে। তারপর কী সব খুটখাট করতে লাগলেন

পথিকও এবার গাড়ি থেকে নামল। বাইরে একটানা ঝিঁঝিঁর শব্দ। কোন একটা পাখি কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর একসুরে ডেকে চলেছে, টুইট, টুইট, টুইট...। পথিকের একটু ভয় ভয় করতে লাগল। হেডলাইট যদি না জ্বলে, কী করে গাড়ি চালানো যাবে? সারারাতই তাদের এই জঙ্গলেই থাকতে হবে নাকি? অসহায় ভাবে সে একবার মুখ তুলে তাকাল, আর তখনই আকাশের এপার থেকে ওপার, ফালাফালা করে দিল বিদ্যুতের সুদীর্ঘ নীল ঝলক। আর সেই সঙ্গে জ্বলে উঠল, গাড়ির হেডলাইট। কয়েক মূহুর্ত পরেই, আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত গড়িয়ে গেল ভীষণ ভারি একটা লোহার গোলা – দেখা গেল না, কিন্তু আওয়াজ পাওয়া গেল গুম, গুম, হুড়ুম, গুড়ুম, গুম, গুম...পথিক কেমন শিউরে উঠল। অসময়ে এসব কী হচ্ছে? আজ সারাদিন মেঘ-টেঘের কোন বালাই ছিল না, সারা দিনটা শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে ঝলমল করছিল। কখনই বা এমন মেঘ জমে উঠল, আর এমন ভয়ংকর গর্জন করতে শুরু করল? গোবিন্দবাবু বনেট ফেলে দিয়ে বললেন, “উঠে পড়ুন, পথিকদা, লাইট ঠিক হয়ে গেছে”। পথিক এবং গোবিন্দবাবু দুজনেই গাড়িতে উঠল, এবং গাড়ি স্টার্ট করতে না করতেই শুরু হল তুমুল বৃষ্টি।  গাড়ি চলতে লাগল, কিন্তু ওয়াইপার চালিয়েও উইণ্ডস্ক্রিন থেকে বৃষ্টির ধারা মোছা যাচ্ছিল না, মনে হচ্ছে কেউ যেন বড় হোসপাইপ থেকে হুড় হুড় করে জল ঢালছে, কাচের ওপর।

পথিকের গলা শুকিয়ে গেল, খসখসে গলায় বলল, “বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ করে এ কী বৃষ্টি রে, বাবা?”

“প্রকৃতির খেয়াল, ও কী আর আমার আপনার হাতে?” খুব ধীরে ধীরে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে গোবিন্দবাবু বললেন। কিছুক্ষণ গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে চলতে গাড়িটা হঠাৎ যেন জোর ধাক্কা খেল কিছুর সঙ্গে। বীভৎস আওয়াজ করে ঝাঁকিয়ে উঠল গোটা গাড়িটা।

পথিক আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল, “কী করছেন কী? ব্রেক করুন, গাড়ি থামান!”

গোবিন্দবাবুও অসহায়ভাবে বলে উঠলেন, “ব্রেক চেপে মেঝেয় ঠেকিয়ে দিয়েছি, গাড়ি দাঁড়াচ্ছেই না। মনে হয় ব্রেক ফেল হয়েছে”এ জায়গায় রাস্তাটা বেশ কিছুটা ঢালু। গাড়ি নিচের দিকে গড়াতে লাগল বেশ জোরেই...এবং তার সঙ্গে মড়মড় কড়কড় ধাতব শব্দে, খুলে গেল গাড়ির ছাদ। কেউ যেন চেঁছে দিল গাড়ির মাথাটা। ওরা গাড়িতে বসে আছে, গাড়ি চলছে, কিন্তু মাথার ওপরে কোন ছাদ নেই। পথিক বিস্ময়ে আর আতঙ্কে মাথায় হাত দিল, বলে উঠল “সর্বনাআআআশ”। ওদিকে গোবিন্দবাবু তখনো গাড়িটাকে থামানোর চেষ্টা করছেন, হ্যান্ডব্রেকটাও টানছেন বারবার, কোন ফল হচ্ছে না। গাড়ি ঢালু রাস্তায় গড়িয়েই চলেছেখানা-খন্দে ভরা রাস্তায় গাড়িটা লাফাচ্ছেও বেশ।

মিনিট পাঁচেক এভাবে গড়িয়ে চলার পর গাড়িটা রাস্তার ধারের একটা বিশাল উইঢিবিতে গিয়ে ধাক্কা মারল, তারপর বিশ্রী একটা ঘ্যাস্‌স্‌স্‌ শব্দ করে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল গাড়ির বাঁদিকের হেডলাইটের উপর ভেঙে পড়ল উইঢিবির মাথাটা, ঝুরঝুরে কাদা মাটিতে ঝাপসা হয়ে গেল, হেড লাইটের আলো।

 

 একটার পর একটা ঘটনা পর পর এমন ঘটছিল, পথিকের মাথা কাজ করছিল না। গাড়িটা থেমে যেতেই, সে দরজা খুলে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল এখন এতটুকুও বৃষ্টি হচ্ছে না। আরো আশ্চর্য, এতক্ষণ ছাদহীন গাড়ির ভেতরে বসেও তারা বৃষ্টিতে এতটুকুও ভেজেনি। গাড়িটার চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতে গিয়ে আরো অবাক হয়ে গেল। চারপাশে বেশ আলো রয়েছে, একটু আবছা হলেও দেখা যাচ্ছে বেশ! চাঁদের আলো! আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ভয়ে শিউরে উঠল, আকাশে কোত্থাও মেঘের লেশমাত্র নেই। বরং সেখানে হালকা কুয়াশা ঢাকা একাদশী বা দ্বাদশীর চাঁদ, ঝলমলে আলো না হলেও, ফ্যাকাসে আলো ছড়াচ্ছে চারদিকে! মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল পথিকের।

সে গোবিন্দবাবুকে জিগ্যেস করল, “কী হচ্ছে বলুন তো?”

গোবিন্দবাবু জিভে চিক শব্দ করে বললেন, “ঝড়ে কোন গাছের ডাল হয়তো বেঁকে নিচু হয়ে এসেছিল। তাতে ধাক্কা খেতেই গাড়ির মাথাটা চেঁছে গেছে। আমার বাইশ বছরের ড্রাইভারি জীবনে এমন কাণ্ড কোনদিন হতে দেখিনি। তার ওপর নতুন গাড়িটাও বার বার কেন যে বিগড়োচ্ছে, তাও আমার ছাতার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না”!

গোবিন্দবাবুর কথায় আরও অবাক হল পথিক। তুমুল বৃষ্টি হল, কিন্তু ছাদভাঙা গাড়িতে বসেও তারা ভিজল না! প্রবল ঝড়ে গাছের ডাল নুয়ে পড়ল, কিন্তু মাথার ওপরে চাঁদের কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নার আকাশ! 

“এ গাড়ি কার?” পেছন থেকে হঠাৎ বাজখাঁই আওয়াজে দুজনেই চমকে উঠে ঘাড় ঘোরালো। পথিকের তো ভিরমি খাওয়ার অবস্থা।

গোবিন্দবাবু কোন ক্রমে তোৎলাতে তোৎলাতে বললেন, “ইয়ে...এ গ্‌-গাড়ি, ম্‌মুচকুন্দপুরের অ-অজিতেশ ক্‌-কুণ্ডু চ্‌-চৌধুরিবাবুর। শোরুম থেকে নতুন নিয়ে বেরিয়েছিলাম, এখন ভাঙাচোরা...”।

“অ, খুদু? খুদুর গাড়ি? খুদু নতুন গাড়ি কিনল? বাঃ বেশ বেশ, আয়, তোরা আমার সঙ্গে আয়”। একথা বলেই বাজখাঁই গলাওয়ালা লোকটি জঙ্গলের ভেতরের দিকে হাঁটা লাগাল। গোবিন্দবাবু পথিকের হাত ধরে টানতে টানতে তার পিছু নিলেনলোকটার মাথায় ঝাঁকড়া সাদা চুল, মুখেও সাদা গোঁফ দাড়ি, চাঁদের আলোয় চিকচিক করছিল। পরনে একটা ছোট্ট ধুতি, সেটা সাদা নয়। হয়তো লাল, আবছা আলোয় ভালো বোঝা যাচ্ছে না। বেশ ঢ্যাঙা আর ডিগডিগে রোগা চেহারা। কিন্তু গলার আওয়াজ গমগমে।  লোকটা কে? কেনই বা তারা ওর কথা মতো পেছন পেছন দৌড়চ্ছে? সে কথা দুজনের কারও মাথাতেই এল না। দুজনেই ভূতে পাওয়া মানুষের মতো জঙ্গলের পায়েচলা সরু পথে লোকটার পেছন পেছন দ্রুত হাঁটতে লাগল।

বেশ কিছুটা যাওয়ার পর তারা একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পৌঁছল। একটু দূরেই দেখতে পেল একটা মন্দিরের আবছা কালো মতো অবয়ব। চাঁদের আলোয় আবছা আবছা বোঝা যাচ্ছে। লোকটা সেই মন্দিরের দিকেই যেন দৌড়চ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মন্দিরের কাছে পৌঁছল। ভাঙ্গাচোরা বহুদিনের পুরোনো কাঠামোর মন্দির। দরজার পাল্লা নেই। ভেতর থেকে হাল্কা আলো আসছে। লোকটা দরজার ভেতরে ঢুকে গেল। ওরা ঢুকল না, বাইরে থেকে উঁকি মেরে দেখল, কুলুঙ্গিতে একটা প্রদীপ জ্বলছে টিমটিম করে। সেই অল্প আলোতেই তারা দেখল ফাটা-চটা পাথরের বেদিতে এক দেবী প্রতিমা। হাত তিনেক উঁচু, কুচকুচে কালো তাঁর গায়ের রং।

গোবিন্দবাবু ফিসফিস করে পথিককে বললেন, “বিশালাক্ষী মা! আমরা তার মানে বিশালাক্ষীতলায় চলে এসেছি”!

পথিক কিছু বলার আগেই লোকটা দরজার সামনে এগিয়ে এল, পথিকের হাতে এক মুঠো তাজা জবাফুল তুলে দিয়ে একই রকম গমগমে গলায় বলল, “বাইরে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? ভেতরে আয়। মায়ের পায়ে ভক্তিভরে পুজো দে, হতভাগা!”

ভয়ে পথিকের পা কাঁপছিল থরথর করেকোনরকমে এগিয়ে গিয়ে মায়ের মূর্তির সামনে হাঁটু মুড়ে বসল। হাতের জবাফুলগুলি দু হাতের অঞ্জলিতে ধরে তাকিয়ে রইল মায়ের মুখের দিকে। কতক্ষণ বসে ছিল তার মনেও নেই।

গোবিন্দবাবু তার কাঁধে হাত রাখতে পথিকের সম্বিৎ ফিরল। গোবিন্দবাবু ফিসফিস করে বললেন, “পথিকদা, মায়ের বেদিতে ফুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে শিগ্‌গির উঠে আসুনতাকিয়ে দেখুন কিচ্‌ছু নেই”পথিক তাকিয়ে দেখল, তার সামনে কোন প্রতিমা নেই। ঘরের মধ্যে জ্বলতে থাকা কোন প্রদীপ নেই। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই লোকটাও নেই। এমনকি মন্দিরের মাথার ওপর ছাদও নেই! চাঁদের ঝাপসা আলোয়, হা হা করছে শূণ্য ভাঙা মন্দির! পাথরের শূণ্য বেদিতে জবাফুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে, গোবিন্দবাবু আর পথিক ঊর্দ্ধশ্বাসে বেরিয়ে এল মন্দিরের বাইরে। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে ফাঁকা জমিটুকু পেরিয়ে দৌড়তে লাগল জঙ্গলের পায়ে চলা পথ দিয়ে।

মুচকুন্দপুরের বাড়িতে গাড়ি নিয়ে পথিক আর গোবিন্দবাবু যখন পৌঁছল তখন রাত সাড়ে এগারোটা। সদরের উঠোনে গাড়িটা রেখে পথিক দোতলায় উঠল। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে সরযূদেবী সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

পথিকের চেহারা দেখে সরযূদেবী রীতিমতো চমকে উঠলেন, চাপা গলায় বললেন, “কী রে? এ কি চেহারা তোর? কী হয়েছে?” 

সে কথার উত্তর না দিয়ে পথিক হাউহাউ করে কেঁদে উঠল, বলল, “মাসিমা, সর্বনাশ হয়ে গেছে”।  

“আঃ কী হয়েছে, বলবি তো? নতুন গাড়ি ওরা দেয়নি? তাহলে নিচেয় গাড়ি আসার শব্দ শুনলাম যে”!

“নতুন গাড়ি তো দিয়েছে, কিন্তু যে গাড়ি নিয়ে এসেছি, সে ভেঙেচুরে একেবারে লজ্‌ঝড় হয়ে গেছে”

“কী বলছিস? কী করে হল? অন্য গাড়িকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে এসেছিস নাকি? দাঁড়া, তোর মেসোকে ডাকি। কী সর্বনাশ। একটা কাজ তোকে দিয়ে ঠিকমতো হয় না।”

“সে সব কিচ্ছু হয়নি, মাসিমা। পুরোটা না শুনলে বুঝতে পারবে না! সে এক অদ্ভূত ব্যাপার”।

“থাম, থাম। কোথায় কী সব সর্বনাশ ঘটিয়ে এসে, এখন অদ্ভূত গল্প শোনাবি?” মাসিমা রাগে থমথমে মুখে বললেন, “তোর মেসোকে খবর দিই। তিনিই যা করার করুন”।

ওঁদের কথাবার্তার মধ্যেই মেসোমশাই ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “কিসের সর্বনাশ হয়েছে? গাড়ি কোথায়, পথিক”?

“গাড়ি তো নিয়ে এসেছি, মেসোমশাই, কিন্তু তার অবস্থা সঙ্গীন। নিচেয় যাবেন? চলুন না। দেখলে বুঝতে পারবেন, কোন সাধারণ দুর্ঘটনা নয়, বেশ ভুতুড়ে ব্যাপার। কি করে যে কী ঘটে গেল, কিছুই বুঝতে পারলাম না আমরা”।

সবার আগে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অজিতেশবাবু বললেন, “আমরা আবার কে কে”?

পথিক বলল, “মানে, আমি আর গোবিন্দবাবু, শোরুমের ড্রাইভার”।      

অজিতেশবাবুর পিছনে নামছিলেন সরযূদেবী, তাঁর পিছনে পথিক। অজিতেশবাবু সরযূদেবীকে খুবই বিরক্তির সুরে বললেন, “তোমাকে বলেছিলাম কিনা, তোমার এই বোনপোটি একেবারে উচ্ছন্নে গিয়েছে? নেশা করে নতুন গাড়িটার বারোটা বাজিয়ে, এখন আমাদের ভূতের গল্প শোনাবে”।

পথিক খুব ব্যাকুল গলায় বলল, “মেসোমশাই, বিশ্বাস করুন, চা ছাড়া কোন নেশা আমি করি না। আর আমাদের আসার পথে যা ঘটেছে, সেটার মাথামুণ্ডু আমরা কিছুই খুঁজে পাইনি”।   

উঠোনের আলোটা খুব জোরদার নয়, তবুও সে আলোয় ঝলমল করছিল গভীর নীল রঙের নতুন গাড়িটা। সরযূদেবী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, “বাঃ, কী সুন্দর রং গো, ঠিক যেন ময়ূরকণ্ঠী। দারুণ হয়েছে। মনে হচ্ছে ময়ূরপঙ্খী নাও, এখনি আমাদের নিয়ে ভেসে পড়বে স্বপ্ন রাজ্যে”।

অজিতেশবাবু খুব তৃপ্তিমাখা সুরে বললেন, “রঙটা তার মানে তোমার পছন্দ হয়েছে, কী বল? অনেকদিনের শখ অ্যাদ্দিনে পূরণ হল। এবার দেখ না, সব্বাই মিলে যখন পিকনিকে যাব, কী মজাটাই না হবে! পিকলু, মুনিয়া, টাবলু আর টিপ খুব আনন্দ পাবে। কাল সকালে ওদের আনতে আমিই স্টেশনে যাব। ওরা যা অবাক হবে না...ওঃ”!

অজিতেশবাবু দু হাত কচলে আনন্দে সামান্য দুলে উঠলেন। সরযূদেবী স্বামীর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে, মুখে আঁচল চাপা দিলেন। দাদু আর তাঁর নাতি-নাতনীদের আনন্দের মধ্যে খুব একটা তফাৎ দেখতে পেলেন না। পিকলু, মুনিয়া, টাবলু আর টিপ ওঁদের নাতি-নাতনীদের নাম।

অজিতেশবাবুর হঠাৎ খেয়াল হল, গম্ভীর গলায় বললেন, “পথিক, তুই যে বললি, গাড়িটার নাকি সঙ্গীন অবস্থা করে ছেড়েছে ভূতেরা? কই কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না”। 

বাস্তবিক মেসোমশাই আর মাসিমার পিছনে দাঁড়িয়ে পথিকও এতক্ষণ সেটাই দেখছিল। কোথাও কোন ভাঙাচোরা দেখা যাচ্ছে না, দেখা যাচ্ছে না একটা আঁচড়ের দাগও! অবাক হয়ে সে তাকিয়েছিল গাড়িটার দিকে। পথিককে দেখে তার পাশে এসে দাঁড়াল গোবিন্দবাবুও।   

মেসোমশাইয়ের প্রশ্নে পথিক থতমত খেয়ে বলে উঠল, “এ কী দেখছি, গোবিন্দবাবু? গাড়িটার কোত্থাও কিছু হয়নি তো, কোত্থাও এতটুকু টোলও খায়নি!” অজিতেশবাবু এবং সরযূদেবী পথিকের কথায় আরও বিরক্ত হলেন।

সরযূদেবী তো ঝংকার দিয়ে বললেন, “নতুন গাড়ি নিয়ে ঢুকে থেকে তোর মুখে যতো অলক্ষুণে কথা শুনছি”। অজিতেশবাবু কিছু বললেন না, কিন্তু কটমট করে তাকিয়ে রইলেন পথিকের দিকে।

পথিক উজবুকের মতো গোবিন্দবাবুর মুখের দিকে তাকাল, মাথা চুলকে বলল, “গতকাল আসার সময় যা বিপদে পড়েছিলাম। যেমন ঝড়, তেমনি বৃষ্টি, তার ওপর মেঘের গর্জন। গাছের ডালে ধাক্কা খেয়ে গাড়ির ছাদটা উড়েই গেছিল...কিন্তু এখন...”। 

অজিতেশবাবু এবার ধমকে উঠে, পথিককে বললেন, “থামোঃ, বেয়াদব ছোকরা”। তারপর গলা নামিয়ে সরযূদেবীকে বললেন, “তোমাকে বললে তুমি আমার কথা তো কানেই নাও না। ছোঁড়াটা যে দিন কে দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছে! এবার মিলিয়ে নাও আমার কথাটা”!

পথিক ছটফট করে বলল, “আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, মেসোমশাই? পুরোটা শুনুন, শুনলে বুঝতে পারবেন”। সেদিন সন্ধ্যেয় নতুন গাড়ি নিয়ে আসার পথে যা যা হয়েছিল, পথিক সব বলল মাসিমা আর মেসোমশাইকে। গোবিন্দবাবুও ঘাড় নেড়ে নেড়ে সায় দিলেন পথিকের কথায়। পথিকের কথা শুনতে শুনতে অজিতেশবাবুর ভুরু কুঁচকে উঠল, আর সরযূদেবী অবাক তো হলেনই, ভয়ও পাচ্ছিলেন খুব।

পথিকের কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর, সরযূদেবী খুব আতঙ্কিত হয়ে জিগ্যেস করলেন, “যে মানুষটা তোদের পেছনে এসে দাঁড়ালেন, যাঁর পেছন পেছন তোরা সেই মন্দিরে ঢুকলি, কেমন দেখতে বল তো, মানুষটা?”

পথিক বলল, “ঝাপসা আলোয় মুখটা তো ভাল করে দেখতে পাইনি, মাসিমা। আর দেখবই বা কী? গোটা মুখটাই সাদা ধপধপে দাড়িগোঁফে ঢাকা। মাথাতেও ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া সাদা চুল। চেহারাটা রোগা, কিন্তু বেশ লম্বা। এই মেসোমশাইয়ের থেকেও অন্ততঃ ফুটখানেক বেশি তো হবেই! আর গলাটাও ভীষণ গমগমে, শুনলেই বুকের ভেতরটা কেমন গুরগুর করে ওঠে”!

সরযূদেবী অজিতেশবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “চিনতে পারলে?”

অজিতেশবাবু রাগে গজগজ করতে করতে বললেন, “কাকে? তোমার এই বোনপোটিকে তো? আমি ওকে বহুদিন থেকে হাড়ে হাড়ে চিনেছি। আজকাল উনি ভালই নেশা করতে শিখেছেন। তা নইলে আমার ডাকনাম ধরে ডাকে?” তারপর কিছুটা ভেংচে বললেন, ““অ, খুদু! খুদুর গাড়ি! খুদু নতুন গাড়ি কিনল”! হতভাগা আমাকে ওর ইয়ার-বন্ধু ঠাউরেছে, আমার নাম ধরেই ডাকছে, তাও আমারই সামনে”! পথিক কিছুই বুঝল না, অবাক হয়ে মেসোমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

কিন্তু সরযূদেবী বিরক্ত হয়ে অজিতেশবাবুকে বললেন, “তুমি কী গো? পথিক কী করে তোমার ওই ডাক নাম জানবে? তোমাকে ওই নামে ডাকার মতো লোক কেউ আর আছে নাকি ইহলোকে, যে ও শুনবে? তোমার বোঝা উচিৎ ছিল। রোগা চেহারা, খুব লম্বা। চুল, দাড়ি, গোঁফ সব সাদা। তোমাকে ভীষণ ভালবাসতেন, আর “খুদু” বলেই তোমাকে ডাকতেন। মনে নেই? তোমার ছোড়দাদু, গো!”

অজিতেশবাবু গভীর চোখে তাকিয়ে রইলেন, স্ত্রীর দিকে।

সরযূদেবী আবার বললেন, “আমার বিয়ের পর বার তিনেক এ বাড়িতে এসেছিলেন, তখন দেখেছি। তুমিই তো গল্প করেছিলে, বিএ পাস করে উনি ঘর ছেড়েছিলেন, সাধু হবার জন্যে কোনদিন তিনি আর সংসার করেননি।  কখনো সখনো হুট করে বাড়ি আসতেন, এক-দুদিন বারবাড়িতে থেকে আবার চলে যেতেন কোথাও। তিনি কী তবে আর বেঁচে নেই ...”! সরযূদেবী কথা শেষ না করে, হাত জোড় করে কপালে ঠেকালেনতারপর গলায় শাড়ির আঁচল জড়িয়ে, হাঁটু গেড়ে মাটিতে গড় হয়ে প্রণাম করে বললেন, “আমাদের নতুন গাড়ি দেখে খুব খুশি হয়েছেন, আর আমাদের আশীর্বাদ করার জন্যেই উনি কাল এত অশৈরণ কাণ্ড ঘটিয়েছেন, গো”!

অজিতেশবাবু বিড়বিড় করে কিছু বললেন, শোনা গেল না! তারপর দু হাত জোড় করে তিনিও কপালে ঠেকালেন। তাঁর দুই চোখ ভরে উঠল জলে, অস্ফুট স্বরে বললেন, “আমাদের ছোড়দাদু, বাবার ছোটকা...ইস্‌স্‌ আমিও যদি গাড়ি আনতে শহরে যেতাম, তাঁর সঙ্গে শেষ দেখাটাও হয়ে যেত”!

                                                    ..০০..                             


শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫

ব্যাটেবলে কারসাজি (ভৌতিক গল্প)

 

[এই ব্লগের প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


 আমি নানু, নয়ন পোল্লে। বিশালাক্ষীতলার মৃন্ময়ীদেবী স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস নাইনে পড়ি। আমাদের স্কুলের ক্রিকেট টিমে আমিই গত দুবছরের ক্যাপ্টেন। আমার আগে আমাদের স্কুলটিমের ক্যাপ্টেন হত ক্লাস টেন-ইলেভেনের দাদারা। আমি স্কুলটিমে জায়গা পেয়েছিলাম যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। এবং ভালো খেলার দৌলতে ক্লাস এইটেই আমাকে টিমের ক্যাপ্টেন নির্বাচিত করা হয়। আমার মতো এত কম বয়েসে ক্যাপ্টেন এর আগে কেউ কোনদিন হয়নি। অতএব, খেলাধুলোটা যে আমার ভালই আসে, সেটা আমার স্কুল অন্ততঃ মেনে নিয়েছে।  

আমাদের স্কুলের খেলাধুলোর ব্যাপারে এই এলাকায় বেশ সুনাম আছে। আমাদের এলাকার চোদ্দটি স্কুল নিয়ে প্রত্যেক বছর যে ক্রিকেট লিগ হয় – তার চ্যাম্পিয়ান’স ট্রোফিটা এবার নিয়ে পরপর পাঁচবার আমরাই জিতে নিলাম। অর্থাৎ আমি ক্যাপ্টেন হবার আগেই আমাদের স্কুল পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল – আমি সেই ধারাটাকেই ধরে রেখেছি মাত্র।

কিন্তু এবারে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এবং আমিই এই লিগের বেস্ট ব্যাটার হওয়া সত্ত্বেও আমার মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করছে। এই ফাইন্যাল ম্যাচটা আমরা সত্যিই কি ভালো খেলে জিতলাম? নাকি কোন কারসাজিতে? ব্যাপারটা এতই গোপনীয়, বন্ধুদের সঙ্গেও আলোচনা করা সম্ভব নয়। এই রহস্যটা জানি আমরা মাত্র তিনজন – আমাদের স্কুলের গেম টিচার পার্বতীস্যার, বাংলা ও সংস্কৃতর মাস্টারমশাই - নিত্যানন্দস্যার আর ক্যাপ্টেন হিসেবে আমি। অন্যান্য বার চ্যাম্পিয়ন হয়ে যে অদ্ভূত আনন্দ পাই – এবার অন্ততঃ আমি সেই আনন্দ অনুভব করতে পারলাম না। যদিও আমাদের টিমের অন্য সবাই – যারা ভেতরের খবর জানে না – তারা প্রতিবারের মতোই আনন্দে মেতে উঠেছে।

আমার খটকার বিষয়টি তাহলে শুরুর থেকেই বলি।

     ফাইন্যালে এবার যে টিমের সঙ্গে আমরা খেললাম, সেটি হল ক্ষেমঙ্করী দেবী শিক্ষায়তনের টিম। তাদের গত দশ বছরে লিগ টেবিলে অবস্থান ছিল পাঁচ থেকে সাত নম্বরের মধ্যে। অর্থাৎ ক্রিকেট টিম হিসেবে ওরা বরাবরই মাঝারি মাপের। সেই টিম এবারে যখন তড়তড়িয়ে একেবারে ফাইন্যালে উঠে এল তাতে আমরা সকলেই অবাক হয়ে গেছিলাম। এমনও নয় যে ওদের টিমে নতুন ভালো ভালো প্লেয়ার এসেছে। বা নতুন কোন গেম টিচার এসেছেন। এবং খুব ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখেছি ওদের সব প্লেয়ারই ক্ষেমঙ্করী শিক্ষায়তনেই পড়ে। আমাদের এই লিগে বাইরের কোন খেলোয়াড়কে ভাড়া করে এনে ‘খেপ’ খেলানো যায় না, সেটা বেআইনি। সেরকম কিছু করে ধরা পড়লে পাঁচ বছরের জন্য সেই স্কুলকে সাসপেণ্ড করে দেওয়ার নিয়মও আছে। তাছাড়া ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত পাঠরত ছাত্রদের মধ্যে থেকে – পনেরজন ক্রিকেট খেলুড়ে ছাত্র যদি না পাওয়া যায় – তাহলে লিগ থেকে সেই স্কুলের নাম তুলে নেওয়াই ভাল।

সে যাই হোক, ওদের খেলার খটকাটা প্রথম চোখে পড়ল লিগের চার নম্বর খেলায়। আমাদের সঙ্গে ক্ষেমঙ্করী টিমের প্রথম খেলাতে। ওই খেলায় টসে জিতে আমরা ফিল্ডিং নিয়েছিলাম, ওদের পাঠিয়েছিলাম প্রথমে ব্যাট করতে। পাওয়ার প্লে রাউণ্ডে ওদের যখন পনের রানে তিন উইকেট পড়ে গেল, তখনই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম, ক্ষেমঙ্করীর টিম আমাদের কাছে কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু তার পরেই খেলাটা আশ্চর্যভাবে ঘুরে গেল। আমাদের টিমে যেন মিসফিল্ডের মহামারি লেগে গেল। ওদের ব্যাটাররা ফ্রন্টফুটে বা ব্যাকফুটে ডিফেন্সিভ খেলেও পরের পর বাউণ্ডারি পেয়ে যেতে লাগল। ব্যাপারটা আরেকটু খোলসা করে বলি। ধরা যাক আমি সিলি মিডঅফে ফিল্ডিং করছি, ব্যাটারের ডিফেন্স করা গড়ানে বল, আমার দিকে আসছে – সে বল হঠাৎ দিক বদল করে বিদ্যুৎগতিতে সীমানার বাইরে চলে গেল লং অফ দিয়ে! অথবা ব্যাটের কানায় লেগে লোপ্পা ক্যাচ হয়ে বলটা নেমে আসছে থার্ডম্যান ফিল্ডারের হাতে – কিন্তু না বলটা নিচেয় নামল না, উল্টে বলটা মাঝ আকাশে বাউন্স করে ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল বাউণ্ডারির বাইরে – ছক্কা! এরকম উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি।  

ওদের ইনিংস শেষে ওদের স্কোর হল আট উইকেটে পঁচানব্বই। খেলা শেষে হিসেব কষে দেখেছিলাম, আমাদের আজেবাজে ফিল্ডিংয়ের জন্যে মোটামুটি তিরিশ-পঁয়ত্রিশ রান ওদের আমরা উপহার দিয়েছিলাম। তা না হলে আমরা ওদের পঁয়ষট্টি – সত্তর রানেই বাণ্ডিল করে দিতে পারতাম। একথা ঠিক আমাদের মধ্যে কেউই ঝন্টি রোড্‌স্‌ বা রবীন্দ্র জাদেজার মতো ফিল্ডার নই – কিন্তু ওরকম বাজে ফিল্ডিংও আমরা কোনদিন করিনি। তা না হলে আমরা আগের লিগগুলিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম কী করে?

এরপর আমরা ছিয়ানব্বই রানের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করতে নামলাম। ওপেনিং জুটিতে ছিলাম আমি আর পলাশ। প্রথম ওভারের তিনটে বল, আমরা দুজনেই সিঙ্গল রান নিয়ে, একটু দেখেশুনে খেললাম। তারপর ব্যাট চালাতে শুরু করলাম। পলু ওই ওভারের শেষ তিন বলে দুটো চার আর একটা ছক্কা হাঁকাল। তিনটে শটই অনবদ্য – উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। পরের দু ওভারেও আমরা ভালই রান তুললাম – প্রথম তিন ওভারে আমাদের রান গিয়ে দাঁড়াল কোন উইকেট না হারিয়ে বত্রিশ। আর তারপরেই শুরু হল অদ্ভূত ব্যাপার-স্যাপার।  আমার এবং পলাশের একটা বলও আর বাউণ্ডারির ধারে কাছে পৌঁছতে পারল না।

কয়েকটা উদাহরণ দিই। চতুর্থ ওভারের প্রথম বলটা এল অফস্টাম্পের ওপর হাঁটুর লেভেলে ফুলটস, আমি নিখুঁত টাইমিংয়ে বলটা লফট করলাম – নিশ্চিত ছক্কা। এতটাই নিশ্চিত ছিলাম, আমি বা পলাশ কেউ রান নেওয়ার জন্যে দৌড়লাম না। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম – লং অফ বাউণ্ডারির দশ পনের ফুট ভেতরে বলটা সোজা নেমে এল। মনে হল মাঝ-শূণ্যে অদৃশ্য কোন দেওয়াল রয়েছে – সেই দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে বলটা – গাছ থেকে পাকা আম পড়ার মতো - টুপ করে মাটিতে নেমে পড়ল। ছ রান তো দূরের কথা – দৌড়ইনি বলে একটা রানও পেলাম না। এরপরে আমাদের একটা বলও বাউণ্ডারি ছুঁতে পারল না। পলাশ এবং আমি যে পাশ দিয়েই মারি - সে মিডঅফ, মিডঅন, এক্সট্রা কভার, স্কোয়্যার লেগ – ব্যাট থেকে বিদ্যুৎ গতিতে বল বাউণ্ডারির দিকে ছুটছে – কিন্তু মাঠের মাঝখানে ধপ করে থেমে যাচ্ছে প্রত্যেকবার। ওখানে বলগুলো যেন কেউ খপ করে ধরে ফেলছে – যে ধরছে তাকে অবিশ্যি দেখা যাচ্ছে না।

এভাবেই লিগের ওই ম্যাচটা আমরা হেরে গিয়েছিলাম, কুড়ি ওভারে আমাদের স্কোর হয়েছিল বিনা উইকেটে চুয়াত্তর। ব্যাটার হিসেবে পলু এবং আমার এই অঞ্চলে যে সুনাম ছিল, সে নাম একদম ধুলোয় মিশে গেল। ক্ষেমঙ্করীর টিম খেলা শেষে জয়ের আনন্দে যখন নাচানাচি করছে, আমাদের দুজনের তখন মুখ লুকোবার জায়গা কোথায়? মুখ কালো করে আমরা দুজন যখন আমাদের তাঁবুতে ফিরলাম, পার্বতীস্যার আমাদের দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, “ভাবিস না, একেই বলে ইন্দ্রপতন”। আগেই বলেছি, পার্বতীস্যার আমাদের গেম টিচার। আমাদের দুজনের চোখেই তখন জল। পলাশ বলল, “এমন কেন হল, স্যার? আমি না হয় পারিনি, নানুও কেন পারল না? এর থেকে, স্যার, আমরা যদি অল আউট হয়ে হেরে ফিরতাম, তাতেও সান্ত্বনা থাকত – খেলায় হারজিৎ তো আছেই! কিন্তু নানু এবং আমি দুজনেই পুরো কুড়ি ওভার খেলেও এই রান তুলতে পারলাম না?”

আমাদের অঙ্কের কুনালস্যার এবং নিত্যানন্দস্যার মাঠে এসেছিলেন খেলা দেখতে, বললেন, “তোরা দুজনেই আমাদের টিমের জুয়েল ব্যাটার – এভাবে ভেঙে পড়িস না। কালকে আমাদের কোন খেলা নেই। আজকের খেলা নিয়ে আগামীকাল টিফিনের পর আমাদের একটা মিটিং ডাকা হয়েছে। নানু সেই মিটিংয়ে তুই থাকবি। এই খেলাটা মনে রাখিস স্বাভাবিক খেলা নয় – এই খেলার স্ট্র্যাটেজি অন্য রকম হবে”। 

 পরের দিন প্রথম দুটো ক্লাস শেষ হতেই আমার ডাক পড়ল হেডস্যারের ঘরে। মিটিংয়ের কথা শুনে গতকাল থেকেই আমার ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এই মিটিংয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে? এই স্কুলটিমের ক্যাপ্টেন হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই? আমাকে কি সরিয়ে দেওয়া হবে? নাকি আমাকে দু-তিনটে ম্যাচে বসিয়ে দেওয়া হবে? বলা হবে “নয়ন তোমার ওপর বেজায় চাপ যাচ্ছে, তুমি কয়েকটা ম্যাচ বিশ্রাম নাও”!

একতলায় হেডস্যারের ঘরের দরজা বন্ধ, দরজার বাইরে টুলে বসে ছিল প্রভাকরদা। প্রভাকরদা আমায় দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যারেরা সবাই চলে এসেছেন, তোমার জন্যেই সকলে অপেক্ষা করছেন। যাও, ভেতরে যাও। কালকের খেলাটা ভুলে যাও, নানু। অমন দু একদিন হয়। দেখবে পরের খেলায় আবার তুমি সবাইকে চমকে দেবে”। আমি মৃদু হাসলাম, মনে মনে ভাবলাম, পরের খেলায় সুযোগ যদি পাই তবেই না...। দরজা খুলে আমি ভেতরে ঢুকলাম, প্রভাকরদা আমার পিছনে দরজাটা ভেজিয়ে দিল।

ঘরে ঢুকে দেখি, হেডস্যার নিজের চেয়ারে বসে আছেন, তাঁর উল্টোদিকের চেয়ারে – পার্বতীস্যার, নিত্যানন্দস্যার, বিজ্ঞানের প্রদীপ্তস্যার, অঙ্কের কুনালস্যার, ভূগোলের প্রশান্তস্যার আর ইতিহাসের সন্দীপস্যার। আমি ঢুকতেই হেডস্যার বললেন, “এস নয়ন, এস, আমার সামনের এই চেয়ারটায় বস”। আমি ভীষণ সংকোচে আর ভয়ে ভয়ে স্যারেদের চেয়ার পার হয়ে, হেডস্যারের সামনের খালি চেয়ারটাতেই বসলাম। আমি বসতেই হেডস্যার বললেন, “কালকের খেলা দেখতে আমি মাঠে যেতে পারিনি। কিন্তু আপনাদের মুখে যা শুনলাম, তাতে আমি স্তম্ভিত। আমাদের নয়ন আর পলাশ নাকি একের পর এক ছক্কা মেরেছে, কিন্তু সেগুলি মাঠের ভেতরেই টুপ-টাপ করে ঝরে পড়েছে। ওরা অনেকবার বাউণ্ডারি মারারও চেষ্টা করেছে – কিন্তু সেগুলিও বাউণ্ডারির একটু আগেই থমকে গেছে। এসব কীভাবে সম্ভব? কুনালবাবু, সুদীপ্তবাবু আপনারা দুজনেই বিজ্ঞানের মানুষ – এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেন?”

সুদীপ্তস্যার কুনালস্যারকে বললেন, “আপনি কাল খেলা দেখেছেন, আপনিই ভাল বোঝাতে পারবেন কুনালদা”।

কুনালস্যার তিন রঙের মার্কার পেন আর ডাস্টার নিয়ে চেয়ার ছেড়ে ঘরের কোণে রাখা হোয়াইট-বোর্ডের সামনে গেলেন। তারপর ইংরিজিতে খসখসিয়ে লিখলেন, Projectiles। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “নয়নরা যে ছক্কাগুলো মারে, মানে বলগুলোকে পিটিয়ে যেভাবে বাউণ্ডারির বাইরে ফেলে – সেই টেকনিকটাকে অংকের ভাষায় বলে প্রজেক্টাইলস”। এই বলে তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে বোর্ডে স্কেচ করতে শুরু করলেন, “এই হচ্ছে নয়ন – আর এই হচ্ছে বাউণ্ডারি। নয়নের ব্যাটের বাড়ি খেয়ে বলগুলো এই পথ ধরে বাউণ্ডারির বাইরে পড়ে। বলের এই উড়ে যাওয়ার পথটাকেই প্রজেক্টাইলস বলে। ব্যাটেবলে ঠিকঠাক কানেক্ট না হলে বাউণ্ডারির বাইরে না গিয়ে বল ভেতরেই পড়বে – এবং ফিল্ডার থাকলে সে ক্যাচ করে নেবে। কিন্তু সে বলও প্রজেক্টাইলস হয়েই পড়বে – অন্যভাবে নয়। কিন্তু গতকাল ওদের ছক্কার বলগুলো - এই যে এই লাল লাইনটা দেখুন, এভাবে আচমকা নীচেয় নেমে এসেছে। আমার অঙ্কের জ্ঞানে এ অসম্ভব। সুদীপ্তবাবু, আপনার ফিজিক্সে কী বলে?”

Projectiles 





                                    কুনাল স্যারের ডায়াগ্রাম 
   
  সুদীপ্তস্যার কিছু বলার আগেই, সন্দীপস্যার বললেন, “ইতিহাসও এই কথাই বলে কুনালবাবু। মহাবীর অর্জুন বা শ্রীরামচন্দ্র তির ছুঁড়ে যে দূরের লক্ষ্য ভেদ করতেন, তাঁদেরকেও এই অংকের হিসেব মানতে হত। কিন্তু সেকালের তিরন্দাজ বা একালের নয়নরা অংকের নিয়ম না জানলেও, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার বলেই এমন লক্ষ্যভেদ করতে পারেন”।

ফিজিক্সের সুদীপ্তস্যারও বললেন, “এটাই বিজ্ঞানের নিয়ম কুনালবাবু। ক্রিকেটের বল, তির, জ্যাভেলিন বা শর্টপাট – সব কিছুতেই এই নিয়মই একমাত্র নিয়ম। অবশ্যই এই দক্ষতার সঙ্গে শক্তি থাকাটাও জরুরি। নয়নের ব্যাট কতটা শক্তি দিয়ে বলটা মারবে তার ওপরেও নির্ভর করবে বলটা কোথায় গিয়ে নামবে। কিন্তু লালরঙের যে পথটা আপনি আঁকলেন, সেভাবে কোন বস্তু নেমে আসতে পারে না – একমাত্র ব্যাডমিন্টনের শাটল-কক ছাড়া”।

হেডস্যার বললেন, “তাহলে, এই ঘটনার ব্যাখ্যা কি? আপনারাই বলছেন, গতকাল এমন ঘটনা একবার নয় বহুবার ঘটেছে – নয়ন এবং পলাশ দুজনের ক্ষেত্রেই!”

কুনালস্যার বোর্ডের সামনে থেকে ফিরে এসে চেয়ারে বসলেন, মাথা নেড়ে বললেন, “আমার জানা নেই, স্যার”।

“সুদীপ্তবাবু?” হেডস্যার জিজ্ঞাসা করলেন।

“না স্যার। আমারও একই অবস্থা – কোন যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছি না”। সুদীপ্তস্যার উত্তর দিলেন।

“তাহলে? পার্বতীবাবু, উপায় কি? আমাদের টিমকে নতুন কিছু প্র্যাক্টিস করাবেন নাকি? এভাবে হারতে থাকলে, আমাদের স্কুলের সম্মান কোথায় দাঁড়াবে?”

পার্বতীস্যার আমতা আমতা করে বললেন, “কী বলি বলুন তো স্যার? আমার ছেলেরা এর আগে তিনটে খেলায় দারুণ খেলে জিতল। আমি নিশ্চিত এর পরের খেলাতেও ওরা নিজেদের সুনাম অনুযায়ীই খেলবে। কিন্তু গতকাল... কী যে হচ্ছিল... কিছুই বুঝলাম না...”।

ঘরের মধ্যে সবাই চুপ করে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। সকলেই চিন্তিত, কোন সুরাহা মিলছে না। এমন সময়  নিত্যানন্দস্যার বললেন, “আমাকে যদি দুদিন ছুটি মঞ্জুর করেন স্যার, তাহলে আমি একটা উপায় দেখতে পারি”।

হেডস্যার অবাক হয়ে বললেন, “আপনি? কী উপায় দেখবেন? আপনি সমস্যাটা বুঝতে পেরেছেন কি?”

“বুঝেছি বৈ কি, স্যার, বিলক্ষণ বুঝেছি। ব্যাপারটা অলৌকিক। সমস্যাটা বিজ্ঞান দিয়ে কিংবা সাধারণ বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা করা যায় না। এ সবই অশরীরীদের কারসাজি”। নিত্যানন্দ স্যার সংস্কৃতের পণ্ডিত, তবে এখন আর আমাদের স্কুলে সংস্কৃত পড়ানো হয় না বলে, আমাদের বাংলা পড়ান।

“তার মানে?” সব স্যারই একসঙ্গে চমকে উঠে বললেন। আমিও হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমরা গতকাল একদল ভূতের বিরুদ্ধে খেলেছি – কী সর্বনাশ!

নিত্যানন্দস্যারের কথায় অন্য স্যাররা হেসে ফেললেন, এমনকি হেডস্যারও। তারপর বললেন, “আর বিশ-তিরিশ বছরের মধ্যে আসানসোল-কলকাতার মতো, চাঁদ বা মঙ্গল থেকে মানুষ পৃথিবীতে ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করার কথা ভাবছে, আর আপনি ক্রিকেট মাঠে ভূতের উপদ্রব দেখতে পাচ্ছেন?”

নিত্যানন্দস্যারও হাসলেন, “আলবাৎ স্যার। আপনারা বিশ্বাস না করতে পারেন। কিন্তু ওরা আছে। আমি বলি কি স্যার, কুনালবাবু, সুদীপ্তবাবু এই সমস্যা সমাধানের যখন কোন উপায় ভেবে বের করতে পারছেন না, তখন আমাকে একটা সুযোগ দিতে দোষ কি? গতকাল ওদের এবং আমাদের – দু পক্ষের ছেলেদের খেলাই আমি মন দিয়ে দেখেছি। নয়নদের অনেক ছক্কা এবং চৌকা যেমন অদ্ভূতভাবে পণ্ড হয়েছে, ওদের ছেলেদের অনেক বল যেগুলো চার-রান হবার নয়, সেগুলো চার হয়েছে। মাঠের ধারে যে বলগুলো আমাদের ছেলেরা অনায়াসে ক্যাচ করতে পারত, সেগুলো আশ্চর্যভাবে ছক্কা হয়েছে। নিজের চোখে না দেখলে আমিও বিশ্বাস করতাম না। কি পার্বতীবাবু? কি রে নয়ন?” নিত্যানন্দবাবু আমাদের সাক্ষী মানলেন।

পার্বতীস্যার এবং আমি নিত্যানন্দবাবুকে সমর্থন করে বললাম, “হ্যাঁ স্যার, তাজ্জব হয়ে গেছি। ক্রিকেট বলের এমন আচরণ কোনদিন দেখিনি”!

কেউ কোন কথা বললেন না। হেডস্যারও কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “ঠিক আছে। অন্য কোন রাস্তা যখন পাওয়া যাচ্ছে না, নিত্যানন্দবাবু আপনার কথা আমরা সকলে মেনে নিলাম। কিন্তু ক্ষেমঙ্করী স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে আমাদের আর কোন খেলার সম্ভাবনা নেই, তাই না, পার্বতীবাবু?”

পার্বতীস্যার কিছু বলার আগেই নিত্যানন্দ স্যার বললেন, “আছে বৈকি, স্যার, ফাইন্যালে আবার দেখা হবে”।

পার্বতীস্যার খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “ক্ষেমঙ্করীর দল ফাইন্যাল অব্দি উঠবে?”

নিত্যানন্দস্যার বললেন, “উঠবে পার্বতীবাবু। আমার ধারণা ক্ষেমঙ্করীর দল এই কারসাজি করেই ফাইন্যালে উঠবে। এবং শুধু উঠবে না – অন্য কোন টিমের কাছে না হেরে – আনডিফিটেড উঠবে। আমাদের দলও ফাইন্যালে উঠবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কিরে নয়ন, পারবি না?” নিত্যানন্দস্যারের কথায় আমি খুব একটা জোর অনুভব করলাম, আমার মনে, সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “উঠবই স্যার”।

নিত্যানন্দবাবু আমাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, “ভেরি গুড। এই তো চাই। সত্যি বলতে, আমি নয়নদের অন্য খেলাগুলির জন্য চিন্তাই করছি না, ওগুলো ওরা নিজেরাই জিতে নিতে পারবে। কিন্তু ক্ষেমঙ্করীদের সঙ্গে খেলাটা একটু মুশকিল – ওটা জিততে হলে বাইরে থেকে আমাদেরও একটু খেলতে হবে...”।

স্যারেরা সকলেই নিত্যানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। হেডস্যারও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “বেশ আপনি দু দিনের ছুটি নিয়ে ঘুরে আসুন, আর কী কী বন্দোবস্ত করবেন, সে সব সেরে ফেলুন। কিন্তু নয়ন, আমি কিন্তু এবারও আমাদের স্কুলকে চ্যাম্পিয়ন দেখতে চাই”।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে গভীর বিশ্বাসে বললাম, “ওই কাপ আমরাই আবার আনব, স্যার”।

“গুড। যাও, এখন ক্লাসে যাও”।  

 নিত্যানন্দস্যারের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। গতবারের রানার্স মহারাজ ভূপতি চাটুজ্জে স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের টিম সহ সকল টিমকে হারিয়ে ক্ষেমঙ্করীর টিম ফাইন্যালে উঠে গেল – এক পয়েন্টও না খুইয়ে! উল্টোদিকে আমরা ওদের টিম ছাড়া সব খেলাতেই জিতে লিগের পয়েন্ট টেবিলে দ্বিতীয় টিম হলাম। এলাকার সকলেই, এবং অন্য স্কুলের ছেলেরাও ধরে নিয়েছিল ক্ষেমঙ্করীই এবার চ্যাম্পিয়ন হবে। আমাদের দলের এবারে আর কোন আশাই নেই। মুখে স্বীকার না করলেও, মনে মনে সে আশঙ্কা আমাদেরও ছিল। নিত্যানন্দস্যার দুদিন বাইরে থেকে কোথায় কী করে এলেন – তাঁর ওপর কতটা ভরসা করা যায় কে জানে?

যাই হোক গতকাল ফাইন্যাল হল। একদম স্বাভাবিক খেলা। কোন অলৌকিক কারসাজির চিহ্নমাত্র ছিল না। আমরা টসে হেরেছিলাম, ক্ষেমঙ্করী আমাদের ব্যাটিং করতে পাঠাল। বিশ ওভারে আমরা স্কোর করলাম, তিন উইকেটে দুশো পঁয়তাল্লিশ। পলাশের রান বাইশ বলে চুয়ান্ন, আর আমি পঞ্চান্ন বলে একশ আট, পান্না বিয়াল্লিশ, তিমির সাতাশ, রমেশ ছয়, আর এক্সট্রা আট। ক্ষেমঙ্করীর টিম বিশ ওভার খেলে আট উইকেটে একশ সাতান্ন করেই থমকে গেল। অতএব এবারেও লিগের ট্রফি আমাদের স্কুলেই হেডস্যারের ঘরে এসে জমা হল। এই নিয়ে বারবার পাঁচবার।

নিত্যানন্দস্যার কী করে ক্ষেমঙ্করী টিমের কারসাজি বন্ধ করলেন, সে কথা উনি কাউকেই বলেননি। আমি জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, “সব কথা তো তোকে বলা যাবে না। বললে বিশ্বাসও করবি না। খুব ছোট্ট করে বলি, ওরা কোন একজন তান্ত্রিক সাধুকে ভাড়া করেছিল। এসব তাঁরই কুকীর্তি। তিনিই যোগ-বলে বেশ কয়েকজন ভূতকে সেদিন মাঠে নামিয়েছিলেন, তোদের বিরুদ্ধে। ভূতের টেকনিক্যাল নাম হচ্ছে অশরীরী আত্মা, জানিস তো? তান্ত্রিক সাধুরা তাঁদের চেলাদের ভূত-প্রেত, পেত্নী-শাঁকচুন্নি বলেন না, কাউকে বলতে শুনলে বেজায় রেগেও যান।

সে যাগ্‌গে, আমি তো ওই অশরীরীদের কাউকেই চোখে দেখতে পাইনি। কিন্তু তাও ব্যাপারটা বুঝতে আমি ভুল করিনি। তাই হেডস্যারের অনুমতি নিয়ে আমি গিয়েছিলাম আমার গ্রামের বাড়িতে। সেখানে আমার এক কাকা আছেন, তিনি বিখ্যাত সাধক, সিদ্ধ যোগী। তাঁকে গিয়ে সব কথা খুলে বলতে খুব রেগে গেলেন। ওই তান্ত্রিক সাধুর সঙ্গে ফোনে কথা বললেন, “ছেলেপুলেদের খেলার মধ্যে তোমরা অশরীরীদেরও মাঠে নামাচ্ছ? ছিছিছি ছিঃ। আমি কিন্তু এসব হতে দেব না”, বলেই উনি ফোন রেখে দিলেন।

তারপর আমাকে বললেন, “তুই ফিরে যা, একদম ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। কেউ তোদের ছেলেদের খেলায় আর কোন বিঘ্ন ঘটাবে না”। একটু চুপ করে থেকে নিত্যানন্দস্যার বললেন, “ওসব খুব গোপন আর ভজকট ব্যাপার, নানু। আমিও কী আর সবটা বুঝি? সব কথা তোর না শোনাই ভালো”। তারপর আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, “তোর কাজ মন দিয়ে খেলা, তার বাইরে আর কোন চিন্তা নয় - তোকে শুধু বেঙ্গল টিমেই নয়, ইণ্ডিয়া টিমেও চান্স পেতে হবে, নানু। কথাটা মনে রাখিস – আমরা সবাই তোর পিছনে আছি”।  

সবই তো ভালোয় ভালোয় মিটল, কিন্তু আমার মনের খটকাটা রয়েই গেল – অশরীরীরা খেলাধুলোতেও নাক গলিয়ে এমন কারসাজি করতে পারে? ভূতেদের অসাধ্য কি কিছুই নেই?  

 --০০--

নতুন পোস্টগুলি

ধর্মাধর্ম - ৩/২

  ["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের প্রথম পর্বাংশ  পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে " ধর্মাধর্ম - ৩/১ " তৃতীয় পর্ব - দ্বিতীয়  পর্...