ছোটদের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ছোটদের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শনিবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৫

পেত-ন-তাৎ-তিক

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 

 

 

 ‘অ্যাই যে খুকি, তুমি লিচ্চয় বলতে পারবে। ওই যে পুরাতন বাড়িঘর, মুত্তিটুত্তি, এসব লিয়ে যারা লাড়াচাড়া করে, তাদের কী যেন একটা বলে বেশ’?

টুম্পি, রুনু, ঝুনু মেলার একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে, চোখ বন্ধ করে, সদ্য ভাজা গরম গরম জিলিপি খাচ্ছিল। আচমকা এই প্রশ্নে ওরা ফিরে দেখল, ভেতরের বেঞ্চে দুটো লোক বসে আছে। একজন বকমুখো, অন্যজন শেয়াল মুখো। তাদেরই একজন টুম্পির মুখের দিকে তাকিয়ে, আবার বলল,

‘আরেঃ, বলো না। কী যেন বলে ওদের, ধুত্তেরি কথাটা পেটে আসচে, মুখে আসচে না’।

টুম্পির গাটা জ্বলে গেল, সে এখন ক্লাস টেনে পড়ে। সামনের বার মাধ্যমিক দেবে। তাকে এখন শাড়ি পরে স্কুলে যেতে হয়, মোটেও আর সে খুকি নয়। মুখঝামটা দেবার খুব ইচ্ছে হলেও, লোকদুটোর দিকে তাকিয়ে তার প্রবৃত্তি হল না। তবে ছোট দুই বোনের সামনে, এভাবে প্রেস্টিজ গ্যামাক্সিন করে দেওয়াটা তার একেবারেই মনঃপূত হল না। তাই একটু ঝাঁজের সঙ্গেই প্রশ্ন করল, ‘কিছু বলছেন?’ লোকটা এবার একটু যেন থিতিয়ে, সমীহ করে বলল,

‘ওই যে, যারা ওই ভাঙা মন্দির, রাজাদের ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি এসব লিয়ে দিন কাটায়, তাদের কী যেন বলে?’ টুম্পি একটু চিন্তা করে, ভুরু কুঁচকে বলল,

‘আর্কিওলজিস্ট’?

‘আরে লা রে, বাবা, লাইয়ার্কিলজি লয়, পেত না পোত কী যেন বলে একটা’।

‘প্রত্নতাত্ত্বিক’?

‘অ্যাই, পেত্নতাত্তিক। ওফ আজকাল মাথায় এক্কেরে জং ধরে গেচে, ঠিক সময়, ঠিক কথাটা মনেই পড়ে না’। টুম্পি বিরক্ত হয়ে শুধরে দিতে বলল, ‘পেত্নতাত্তিক নয়, প্রত্নতাত্ত্বিক’। বকমুখো একটু অবাক হয়ে বলল, ‘পেত-ন-তাৎ-তিক, হ্যাঁ আমিও তো তাই বললাম। কিচু কী ভুলভেরান্তি করে ফেললাম বটে?’

টুম্পিদের জিলিপি খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। বকমুখো লোকটার সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে, দাম দিয়ে দোকানের সামনে থেকে সরে গেল। খানিকক্ষণ মেলার এদিক ওদিক ঘুরে রুনু বলল, ‘অ্যাই দিদি, ফুচকা খাবো কিন্তু’। ফুচকা খেতে টুম্পিরও খুব ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু বোনের কথা একবারেই মেনে নিলে, সে আর দিদিগিরি ফলাবে কী করে? তাই গম্ভীর গলায় বলল, ‘এই তো জিলিপি খেলি, আবার ফুচকা কেনো? তার চে চল বেলুন ফাটাই’। 

ঝুনু বলল, ‘দূর, দূর, বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটানোর চে, আলুমাখা পুর দিয়ে ফাটানো ফুচকা অনেক ভালো। বেলুন ফাটিয়ে কী হয়? ফুচকা খেলে গায়ে শক্তি আসে, মনের জোর বাড়ে, আরো কী কী যেন হয়!’

‘হুঁ। আমাশা হয়, অম্বল হয়। পেট ঢিসঢিস করে’। টুম্পি তাও ছাড়ার পাত্রী নয়। রুনু ঠোঁট উলটে বলল, ‘তাই? তোর এসব হয় নাকি, দিদি? তাহলে তুই ফুচকা খাস না। কিন্তু আমাদের খাওয়া’। রুনুর কথায় টুম্পি ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, ‘তোরা বেশ শয়তান হয়েছিস, তো! আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে তোরা ফুচকা খাবি? সে আমি হতে দিচ্ছি না’। 

রুনু মিচকে হেসে বলল, ‘নারে দিদি, তুই খাস না। পেট খারাপ হলে, তোকে তো সারাদিনের বেশির ভাগ সময় দেখতেই পাবো না। বড্ডো মন কেমন করে তখন, জানিস তো?’ অবাক হয়ে রুনুর মুখের দিকে তাকিয়ে টুম্পি বলল, ‘কেন? আমি কোথায় যাবো?’ রুনু রুমালে মুখ ঢেকে বলল, ‘পেট খারাপ হলে লোকে বার বার কোথায় যায়? টয়লেটে সেখানে আবার সবাই মিলে যাওয়া যায় না কিনা’ খুব রেগে গিয়েও হেসে ফেলল টুম্পি, ‘তোর পেটে পেটে এত শয়তানি, রুন্টি। গাঁট্টা খাবি আমার কাছে?’

‘উঁহু, ওটা পরে খাবো। এখন শুধু ফুচকা’  

 ওরা তিনবোন যখন ফুচকাওয়ালাকে ঘিরে ফুচকার রাজ্যে ডুবে রয়েছে, সেই সময়, ওদের পাশ দিয়ে সেই লোকদুটো মন্দিরের দিকে গেল। টুম্পি আড়চোখে দেখছিল ওদুটোকে। যাবার সময় বকমুখো লোকটা শেয়ালমুখো লোকটাকে বলতে বলতে গেল, ‘মেয়েগুলা এই ফুচকা গিলে ক্যানে যে পয়সা লষ্ট করে বুঝি না। ওই পয়সায় সন্দেশ, কি নসোগোল্লা খেলে পয়সার সুসার হয়, বল ফোচে?’   

প্রফুল্লনগর থেকে বাসে আধাঘন্টা মতো লাগে, কাপালীতলা গ্রাম। সেই গ্রামের বিশালাক্ষী মন্দিরের মাঠে, স্নানযাত্রা আর বিপত্তারিণী ব্রত ঘিরে মেলা বসে। ওই মন্দির আর ওই মেলা কতদিনের পুরোনো কেউ জানে না। কেউ বলে, দুশো, কেউ বলে চারশো আবার কেউ বলে ছশো বছরের পুরোনো। সঠিক ইতিহাস কেউ না জানলেও, বিশালাক্ষী মন্দির যে অনেক পুরোনো সে বিষয়ে কারো মনে কোন সন্দেহ নেই। পোড়ামাটির টালি আর চুন সুরকিতে গাঁথা বাংলা ঘরানায় বানানো এই মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ দেখার মতো। যদিও দীর্ঘ দিনের অযত্ন আর সময়ের থাবায়, সে সব অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। তবু যেটুকু আছে, মন দিয়ে দেখলে, চোখ ফেরানো যায় না। মোবাইলে বেশ কিছু ছবি তুলে এনেছিল টুম্পিরা, অনেকগুলো ফটো আর বেশ কিছু সেলফি। দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে বেরিয়েছিল, এখন সন্ধে হওয়ার মুখেই তিনবোন প্রফুল্লনগরে বাড়ি ফিরে এল।

 লেখাপড়া সেরে তিন বোন যখন উঠল, তখন সাড়েনটা বাজে। বাবা অফিস থেকে ফিরে, হাতমুখ ধুয়ে, চা-মুড়ি খেয়ে, বাইরের বারান্দায় বসেছিলেন মায়েরও ঘরের কাজকর্ম, রাতের খাবার বানানো হয়ে গেল। এই সময়টা, দশটা সোয়া দশটা অব্দি বাইরের বারান্দায় বেশ একটা জমাটি পারিবারিক আড্ডা বসে। সেই আড্ডায় যোগ দেয়, দুই যমজ ভাই ভূত। বারান্দার লাগোয়া পেয়ারা গাছের নিচে তারা দাঁড়িয়ে থাকে, তারাও আড্ডায় যোগ দেয়, এই তল্লাটের সকল খবর তাদের নখের ডগায়। 

[এই দুই যমজ ভূত এবং রুনু-ঝুনুর পরিবার সম্পর্কে সব কথা জানতে হলে পড়ুন "ছোট্ট হওয়া"] 

 যে কোন মেলার সবচেয়ে মজা হলো, মেলায় গেলেও যেমন মজা, না গিয়ে তার গল্প শুনলেও তেমনই মজা। বড়োরা কাজের চাপে মেলায় যেতে পারেন না, কিন্তু তাঁদের মন মনে ইচ্ছে থাকে খুব। তাই ছেলেমেয়েরা মেলায় গেলে তাদের মুখে মেলার গল্প শোনেন হাঁ করে। আর মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন, ইস কেন যে ছাই, বড়ো হলাম! না হলে আজ নির্ঘাৎ টুম্পিদের সঙ্গে মেলায় গিয়ে নাগরদোলায় চড়ে, বুড়িরচুল, জিলিপি খেয়ে, মাটির পুতুল কিনে, মজাসে বাড়ি ফেরা যেত। মুকুন্দবাবু জিগ্যেস করলেন, ‘তোরা মেলায় গেলি, আর নাগরদোলায় চড়লি না? কেন?’

‘না, বাবা। আমাদের ভাল্লাগে না। ওপর থেকে নিচেয় যখন হুস হুস করে নামে, পেটের ভেতরটা কেমন হাল্কা হয়ে যায়’। রুকু পেয়ারা গাছের তলা থেকে হাসতে হাসতে বলল, ‘ভয় লাগে, আর কী’? এ কথায় ঝুনু চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘ভয় না কচু। ভয় কেন লাগবে? তোদেরকেই ভয় পাই না, আর নাগরদোলায় চাপতে ভয়?’

মেলার গল্প মোটামুটি সব হয়ে যাওয়ার পর, সুকু বলল, ‘টুম্পিদিদি, তোমরা চলে আসার পর, মেলায় খুব বাজে একটা ঘটনা হয়েছে। একটু আগেই আমরা খবরটা পেলাম’।

‘কী হয়েছে? কারও কোন বিপদ আপদ হয়নি তো’? টুম্পিদের মা উদ্বিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করলেন।

‘না, মাসে সব কিছু নয়। এই আটটা সাড়েআটটা নাগাদ, বিশালাক্ষী মায়ের শেতল দিতে গিয়ে পুরুতঠাকুর লক্ষ্য করেছেন, মায়ের মূর্তিটি চুরি হয়ে গেছে’

‘সে কীরে? কী বলছিস?’ সকলেই একসঙ্গে চমকে উঠলেন। 

রুকু বলল, ‘হ্যাঁ গো, দিদিঠাকুরমশাই রোজ নিজে হাতে পুজো করেন, স্নান করান, ভোগ দেন, আরতি করেন, শেতল দেন। আজও তাই করছিলেন। অন্য সময় লোকজন তেমন যায় না। কিন্তু পার্বণ আর মেলার জন্যে এখন রোজ অনেক লোকের আনাগোনা। ভক্তদের দেওয়া ফুল, বেলপাতা আর মালায়, মায়ের মূর্তি ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। আরতির পর শেতল দিতে গিয়ে, ফুলবেলপাতার স্তূপ সরিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছেন, মূর্তি নেই’। কিছুক্ষণ সকলেই চুপ করে রইলেন, একটু পরে সুকু বলল,  ‘মন্দিরের পুরোহিত ঠাকুর ঝবতারণ উপাধ্যায় ভীষণ ভক্ত মানুষ। তিনি এই ঘটনায় খুব ভেঙে পড়েছেন’।

‘আজকাল কী যে সব নাম হচ্ছে, ঝবতারণ আবার নাম হয় নাকি?’ মুকুন্দবাবু অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন। ঘাড়, মাথা আর কান চুলকে রুকু বলল, ‘আজ্ঞে ওটা আমাদের দোষ, ঠাকুর দেবতাদের নাম উচ্চারণ করতে পারি না। হতেন মা ভবতারিণী কোন অসুবিধে ছিল না। মা হলে, তাঁর নাম বলতে আমাদের কোন অসুবিধে হয় না।’

‘অ, তাই বল, ভবতারণ ঠাকুর।’

‘ওই ওই, উনিই। বিশালাক্ষী মূর্তি বেপাত্তা হয়ে যাওয়ার পর তিনি সেই যে বেদীর সামনে বসে কান্না শুরু করেছেন, তার আর বিরাম নেই। তাঁর শুধু এক কথা, আমার পুজো অর্চনাতে নিশ্চই কোন ত্রুটি হয়েছে, তাই মা অভিমান করে চলে গেছেন। মায়ের প্রতিমা যে কেউ চুরি করতে পারে, এ কথা তিনি কল্পনাও করতে পারেন নাএতই তাঁর সরল মন’

টুম্পি জিগ্যেস করল, ‘তা ওই মূর্তি সোনার না রূপোর? কিসের লোভে চোরেরা চুরি করল?’

‘টুম্পিদিদি, সোনাও না রূপোও না, কষ্টি পাথরের মূর্তি। দাম সেটার জন্যেও নয়। মূর্তিটা নাকি অনেক প্রাচীন কেউ কেউ বলে পাঁচশ-ছশো বছরের পুরোনো। মূর্তির আসল দাম সেই জন্যে’। 

হঠাৎ টুম্পির মাথায় বিদ্যুৎঝলকের মতো একটা কথা মনে এল, বলল, ‘পেত্নতাত্ত্বিক’!! মুকুন্দবাবু খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘সে আবার কী? কি যে সব আবোল তাবোল বকিস বুঝি না।’ 

রুকু একটু ক্ষুণ্ণ মুখে বলল, ‘আমাদের বলছো কী, দিদিভাই। হ্যাঁ, আমাদের মহিলাদের পেত্নী বলে, কিন্তু আমাদের ছেলেদের কেউ পেত্ন বলেছে, এমন কোনদিন কারোর কাছে শুনিনি’।  

টুম্পি একটু অপ্রস্তুত হল, এভাবে কথাটা দুম করে বলা তার উচিৎ হয়নি। টুম্পি বলল, ‘না রে, বাবা। কথাটা হচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিক। আমরা যখন একটা দোকানে দাঁড়িয়ে গরম জিলিপি খাচ্ছিলাম, সে দোকানের ভেতরের বেঞ্চে দুটো লোক বসেছিল। তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ আমায় জিগ্যেস করল, যারা অনেক পুরোন মন্দিরটন্দির, রাজাদের বাড়িটাড়ির দেখভাল করে তাদের কী যেন বেশ বলে? তো আমি বললাম, প্রত্নতাত্ত্বিক। তার উত্তরে লোকটা বলে উঠল ‘পেত্নতাত্তিক’! রুকুর কথায় হঠাৎ সে কথাটা মনে পড়ে গেল। তোদের নিয়ে এমন কথা বলবো ভাবলি কী করে রে, রুকুসুকু?’ 

রুকু বাঁ কান চুলকে বলল, ‘স্যরি, দিদিভাই। ভুল বুঝে ফেলেছিলাম। তা সেই লোকদুটোর হঠাৎ প্রত্নতত্ত্বের ব্যাপারে এত উৎসাহ কেন?’

‘অ্যাই, সেটাই তো আমারও কথা! লোকদুটোর একটা বকের মতো, আরেকটা শেয়ালের মতো দেখতে। একজনের গায়ে ময়লা ধুতি আর ফতুয়া, অন্যজনের গায়ে ঢলঢলে জামা আর পেন্টুলুন। যেমন ময়লা আর তেমনি তেলচিটে। আমাকে আবার খুকি বলছিল, এমন শয়তান!’ 

রুকু চিন্তিত মুখে বলল, ‘শয়তান তো বটেই, একে আমাদের দিদিকে খুকি বলেছে, তার ওপর আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে ওরাই মূর্তিটা হাতিয়েছে। তা নইলে খামোখা তোমাকে ওই পেত্নর কথা জিগ্যেস করবে কেন?’ সুকু বলল, ‘লোক দুটোকে চিনতে পারবে, দিদি? দেখতে কেমন?’

‘বললাম যে, একটা বকের মতো, আর অন্যটা শেয়ালের মতো দেখতে দুজনেরই ছুঁচোলো চিমসানো মুখ। গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি’ সুকু বলল, ‘দিদিভাই, ছুঁচোলো চিমসানো মুখ, খেটে খাওয়া গরিবগুর্বো লোকেদের তো হয়ই। এমন লোক হাজারে হাজারে আছে। আর খোঁচা খোঁচা দাড়ির কথা বলছো? ওতো নাপিতের সামনে বসলে, পাঁচ মিনিটে সাফ। মুখ একদম তেলতেলে হয়ে যাবে? ওভাবে কী আর লোক চেনা যায়?’ 

এর উত্তরে রুকু বলল, ‘ঠিক হিন্দি সিনেমায় বা বাংলা সিনেমায় যেমন নাকের পাশে আঁচিল, কিংবা গালে লম্বা জরুলওয়ালা লোকেরাই নানান বজ্জাতি করে। হাজারজনের মধ্যেও তাদের চিনে ফেলতে কোন অসুবিধে হয় না। সেরকম কোন চিহ্ন দেখেছো কী না?’ মনে করার চেষ্টা করেও টুম্পি তেমন কোন লক্ষণ বা চিহ্নের কথা মনে করতে পারল না, বলল, ‘নাঃ সেরকম তো কিছু চোখে পড়েনি তবে শেয়ালমুখো লোকটার নাম ফোচে’। 

মুকুন্দবাবু বেজার মুখে মেয়েকে বললেন, ‘আজ মেলায় গিয়ে, মেলাই আজেবাজে কথা শিখে এসেছিস! ফোচে আবার কারো নাম হয় নাকি?’

‘বারে, আমি নিজের কানে শুনেছি। বকমুখো লোকটা শিয়ালমুখোকে ওই নামেই ডাকল’। 

টুম্পির এই কথা শুনে রুকু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘টুম্পিদিদি, তুমি কিন্তু যে বর্ণনা দিলে লোকদুটোর, তাতে আমাদের সেই ছুঁচের গাদায় খড় খোঁজার মতো অবস্থা।’ 

রুনু এতক্ষণ কোন কথা বলেনি, এখন বলে উঠল, ‘কিন্তু কথাটা খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা, না?’ তার কথায় সকলেই হেসে ফেলল, আর রুকু ঘাড় চুলকে হাসতে হাসতে বলল, ‘ওই, ওই ঠিক বলেছ রুণুদিদি। উলটো বলে ফেলেছি’।

টুম্পিদিদি চিন্তিত মুখে বলল, ‘যে লোকটা আমাকে খুকি বলেছিল, মনে হচ্ছে, সে লোকটাই পাণ্ডা। তার কান দুটো মনে পড়ছে, খাড়াখাড়া। রান্নার কড়াইয়ের হাতলের মতো। মানে কাত হয়ে শোবার সময় হয় তার কান ভাঁজ হয়ে যায়, নয়তো কানের ওপর ভর দিয়ে মাথাটা দাঁড়িয়ে থাকে।’ দিদির কথায় রুনুঝুনু হেসে ফেলল হি হি করে।

টুম্পিদের মা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন, এখন একটু অধৈর্য হয়ে বললেন, ‘পুলিশে কেউ খবর দেয়নি? পুলিশ কী করছে?’ 

রুকু বলল, ‘হ্যাঁ মা, পুলিশে খবর গেছে। কিন্তু তারাই বা আর কত দিক সামলাবে? কোন কোন দিকে দৌড়বে? ভাঙা মন্দিরের একটা পুরোন মূর্তি চুরি গিয়েছে। তার থেকে কতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাদের থাকে। নেতা মন্ত্রীদের সঙ্গে এদিক সেদিক যাওয়া আসা। তার ওপর মিটিং, মিছিল, মারামারি, খুনোখুনির কোন শেষ আছে আজকাল’? 

টুম্পির মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তার মানে, বিশালাক্ষী মায়ের মূর্তিটা গেল? বিদেশে পাচার হয়ে যাবে?’ 

মুকুন্দবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ। কোথাকার কোন ধনী সায়েবের ড্রয়িংরুমে সাজানো থাকবে!’ 

টুম্পি ফোড়ন কেটে বলল, ‘হুঁ। আর ঘরে গেস্ট এলে, এঁটো হাতে তুলে নিয়ে সবাইকে দেখাবে। তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে বলবে, “দিস ইজ দা সিক্স হ্যাণ্ড্রেড ইয়ারস ওল্ড স্ট্যাচু অফ মাদার ভিশালাক্সি, ব্রট ফ্রম রুরাল বেঙ্গল, ইণ্ডিয়া!” গেস্ট সায়েব-মেমরা মুখে হাত চাপা দিয়ে বলবে, “ওয়াও, ইটস সো কিউট অ্যাণ্ড অসাম, আনবিলিভেবল”’!

‘ছি, ছি, ছিঃ। তাই বলে মায়ের মূর্তিতে এঁটো হাত?’

‘অত চিন্তা করবেন না, মা। আমরা ঠিক খুঁজে বের করে ফেলবো, চোর দুটোকে। একদুদিন সময় দিন। যাবে কোথায় ব্যাটারা।’ টুম্পিদের মা বললেন, ‘কী করে ধরবি, বাবা? তারা কেমন দেখতে তাই তো জানিস না’।

‘বললাম যে, ঠিক বক আর শেয়ালের মতো দেখতেআর সেই বকটার মাথায় খাড়া খাড়া কান’। টুম্পির এই কথার কোন গুরুত্ব না দিয়ে মা বললেন, ‘ধুর ওভাবে চোর ধরা যায় নাকি?’

 মুকুন্দবাবুর এত চিন্তার চাপ সহ্য হচ্ছিল না। সারাদিন আপিসের কাজ সেরে ক্লান্ত, তিনি বড়ো বড়ো হাই তুলতে লাগলেন। সেই দেখে টুম্পিদের মা বললেন, ‘ভেতরে চ, খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে শুয়ে পড়ি। কাল ভোর থেকে উঠেই আবার রাজ্যের কাজ করতে হবে’।

সকলেই উঠে পড়ল, টুম্পি ফিসফিস করে রুকুসুকুকে বলল, ‘তোরা একটু ঘুরে আয় না, খেয়ে এসে আবার কথা হবে। কিছু একটা তো করতেই হবে, না কী’?  

 

খাওয়া দাওয়ার পাট চুকে গেল। মায়ের সঙ্গে হাতে লাগিয়ে, ঘরের সব কাজ সেরে টুম্পি আর রুনুঝুনু আবার যখন বারান্দায় এল, ঘড়িতে তখন এগারোটা দশ বাজে। বাবা ঘুমোচ্ছেন, তাঁর নাক ডাকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ওদের বারান্দায় যেতে দেখে, মাও বিশাল হাই তুলে, বিছানায় বসতে বসতে বললেন, ‘বেশি রাত করিস না যেন। আর শোয়ার সময় দরজা বন্ধ করতে ভুলিস না’। 

রুকুসুকু কাছাকাছিই কোথাও ছিল। তিন বোনকে বারান্দায় আসতে দেখে তারা পেয়ারা গাছের নিচে এসে বসল। রুকু বলল, ‘টুম্পিদিদি, এর মধ্যে আমাদের দুই বন্ধুকে বলেছি, মন্দিরে গিয়ে পাহারা দিতে’। রুণু ফিক করে হেসে বলল, ‘চুরি হয়ে যাওয়ার পর, এখন আর পাহারা দিয়ে হবেটা কী? চোর কী ধরা দেওয়ার জন্যে ফিরে আসবে নাকি?’ 

রুকু বলল, ‘তা নয়। তবে ওই মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার অনেক টালিও আছে। প্রত্নতত্ত্বের জিনিষ নিয়ে যাদের ব্যবসা, তারা শুধু ওই পাথরের মূর্তি নিয়েই খুশী হবে ভাবছো, রুণুদিদি? ওরা এত সহজে পাথরের মূর্তিটা পেয়েছে। ওরা ফিরে আসবেই আর এলে ছেনি হাতুড়ি নিয়ে রাত্রেই আসবে। দুপাঁচখানা ছবি আঁকা টালি খুলে নিতে পারলে, ভালোই দাম পাবে, ব্যাটারা’। 

টুম্পি রুকুর কথায় সায় দিয়ে বলল, ‘কথাটা ঠিকই বলেছিস, রুকু। পাথরের মূর্তি নিয়ে বেশি হৈ চৈ, পুলিশটুলিশ আসার আগেই কাজ সেরে ওরা পালাতে চাইবে। অতএব আরও চুরি যদি করতেই হয়, আজ কিংবা কাল রাত্রের মধ্যে সেরে ফেলতে পারলে, ওরা নিশ্চিন্তে পালাতে পারবে’।

‘আমরাও সেটাই ভেবেছি। তোমাদের সঙ্গে কথা সাঙ্গ হলে, আমরাও যাবো মন্দিরে। দেখি না, কী হয়। এতদিনের প্রাচীন বিশালাক্ষী মূর্তি আমাদের চোখের সামনে থেকে চুরি হয়ে গেল, আমরা কিছুই করতে পারবো না, এ আমাদের ঠিক ভালো ঠেকছে না’।

‘কিন্তু ওদের কীভাবে তোরা ধরবি, সে নিয়ে কিছু ভেবেছিস?’

‘ওইটাই তো, টুম্পিদিদি, আমরা তো আর জাপটে ধরে, পেছন দিকে হাত পা বেঁধে ফেলে রাখতে পারবো না। আর ঘাড় মটকে দিতেও পারবো না। সে সব আগেকার দিনের পালোয়ান ভূতরা পারতো। তেমন ভূত তো আর আমরা নই! কী করে যে ব্যাটাদের জব্দ করবো, সেটাই আমরা বুঝতে পারছি না’।

‘দাঁড়া আমায় একটু ভাবতে দে। কিছু একটা উপায় ঠিক বের করে ফেলবো’

‘এক কাজ করো না, টুম্পিদিদি। সরুদাদাকে ফোন করো না। সরুদাদা ঠিক একটা কিছু উপায় বাৎলে দেবে, দেখো’।

‘কথাটা মন্দ বলিসনি। এই সব ব্যাপারে সরুদার মাথা খুব পরিষ্কার। ইঞ্জিনিয়ার তো! দাঁড়া আমার ফোনটা নিয়ে আসি।’ টুম্পি ফোনটা আনতে ঘরে গেল। রুণু বলল, ‘এ সময় সরুদা আবার ঘুমিয়ে পড়েনি তো? সাড়ে এগারোটা বাজে কিন্তু।’ একগাল হেসে রুকু বলল, ‘না গো দিদি, হস্টেলে যারা থাকে, তাদের তো এখন সবে সন্ধে। এই সবে খাওয়া দাওয়া করে সরুদা পড়তে বসেছে হয়তো। রাত তিনটে অব্দি তো পড়বেই’।

ফোন ডায়াল করে, দুবার রিং হতেই সরুদা উত্তর দিল  স্পিকার মোড অন করা ছিল, তাই সবাই শুনতে পেল সরুদার গলা,  ‘হ্যাঁ টুম্পি, কী হয়েছে বল। হঠাৎ এত রাতে? ভয় পেয়েছিস নাকি? এত ভীতু কেন রে তুই?’

‘আঃ সরুদা, আমি মোটেই ভয় পাইনি। কাজের কথা আছে, বলছি শোনো’।

‘কাজের কথা বলবি, তুই? হাসালি রে, টুম্পি। আমি তো ভাবছিলাম, তোর থেকে ফাঁকি দেওয়া শিখবো’।

‘সরুদা, ভালো হবে না কিন্তু। পিঠে এমন কিল দেব না। বলছি সিরিয়াস ব্যাপার, সেই থেকে চ্যাংড়ামি করছো?’

‘ও বাবা, সিরিয়াস ব্যাপার? তাহলে বল, তাড়াতাড়ি বল’।

এরপর টুম্পি মেলায় যাওয়া থেকে মূর্তি চুরি পর্যন্ত, সব কথাই সরুদাকে বলল। সরুদা খুব মন দিয়ে শুনল এবং অনেক কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করল। তারপর বলল, ‘রুকুসুকু সামনে আছে রে’? রুকুসুকু দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘আছি দাদা, তোমার কথা আমরা সবাই শুনছি। কীভাবে চোরদুটোকে জব্দ করতে পারি, সেই উপায় বলে দাও না, দাদা’।

‘আমারও ধারণা, চোর দুটো আজ রাত্রেই আবার আসবে। তোরা ঠিকই করেছিস। টুম্পি ঘরে কিছুটা কালো রঙের তার আছে? এই ধর ফুট সাত আটেক লম্বা?’

‘আছে তো। কিন্তু আমি হাত দিলে বাবা, কাল সকালে আমাকে বকবে’।

‘কিচ্ছু বকবেন না, বলবি সরুদা বলেছেতাছাড়া আমি মেসোমশাইকেও ফোনে বলে দেব, ভাবিস না। আর কিছু খুব সরু পেরেক আছে’? পেছনে লাগার এমন একটা সুযোগ পেয়ে টুম্পি বলল, ‘সরু তো কানপুরে হস্টেলে আছে, এখানে কোথায় পাবো?’ টুম্পিদিদির কথায় রুণুঝুনু, রুকুসুকু সকলেই হেসে গড়িয়ে গেল। টুম্পিদিদি আর সরুদাদার ঝগড়াঝাঁটি আর খুনসুটি দেখার মতো। হাসতে হাসতে পেট ফেটে যায়।

সরুদা একটু রাগ রাগ গলায় বলল, ‘তোর মাথায় গোবর ছিল জানতাম, এখন দেখছি ঘুঁটে হয়ে গেছে। শেয়ালমুখো ফোচের মতো ফচকেমি করিস না। বল, সরু পেরেক আছে?’

‘আছে, কিন্তু আমাকে তুমি শেয়ালমুখো বললে? তুমি একটা হোঁদল কুতকুতমুখো’। টুম্পির এই কথায় সরুদা ফোনের ওপারে হো হো করে হেসে উঠল, আর এদিকের সবাই, এক টুম্পি ছাড়া। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে সরুদা বলল, ‘যেমন বললাম, রুকুসুকুকে ফুট সাত আটের মতো তার, আর কিছু কাঁটা পেরেক দিয়ে দিবি। তার পর যা বলছি মন দিয়ে শোন। তোরা কে কে আছিস সামনে?’

টুম্পি বলল, ‘আমরা তিনবোন, আর রুকুসুকু’।

‘ভেরি গুডআমাদের কথা আর কেউ যেন না জানতে পারে’

‘ঠিক আছে, তুমি বলো’।

ফোনটা মাঝখানে নিয়ে ওরা পাঁচজনে এমন ঘিরে বসে শুনতে লাগল, বাইরে থেকে আর কিছুই শোনা গেল না।

 

মানুষরা মশা দেখলেই নাজেহাল হয়ে যায়। চটাস পটাস চড় কষাতে থাকে নিজেদের গালে, কপালে, কানে, সারা গায়ে। কিন্তু মশাদের দেখলে রুকুসুকুর খুব দুঃখ হয়, মমতায় চোখ ফেটে জল চলে আসেরুকুসুকুকে দেখতে পেয়ে মশার দল ধেয়ে আসে। খুব আনন্দে পিন পিন করে হুল শানায়। তারপর তাদের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, পটপটিয়ে হুল ফোটায়। কিন্তু ওই হুল ফোটানোই সার। রুকুসুকুরা তো ছায়া। গায়ে রক্তও নেই, মাংসও নেই, নেই কোন ত্বক। মশারা ঝাপসা চোখে সেটা ঠিক ঠাহর করতে পারে নাহুল ফুটিয়ে, স্ট্র দিয়ে দিয়ে কোল্ড ড্রিংক টানার মতো, ভাবে রক্ত টানছি, কিন্তু আসলে টানে হাওয়া। হাওয়াতে পেট ভরে উঠলে, তারা আরো হালকা হয়ে যায়। তারপর ছোট্ট ছোট্ট বেলুনের মতো হাওয়ায় ভাসতে থাকে বোকার মতো। পিনপিনপিন ডানা নেড়েও হালকা শরীরটাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারে না। এলোমেলো হাওয়ায় ভাসতেই থাকে।

রুকুসুকু বিশালাক্ষী মন্দিরে এসে পৌঁচেছিল মোটামুটি রাত সোয়া বারোটা নাগাদ। এখন প্রায় দুটো। এতক্ষণ কারো পাত্তা নেই। পুরোহিত ভবতারণঠাকুর একইভাবে শূণ্য বেদির সামনে শুয়ে আছেন। রুকুসুকু মাঝে মাঝেই গিয়ে, তাঁকে দেখে আসছিলদেখে মনে হচ্ছে কোন সাড় নেই শরীরে। তবে শ্বাস চলছে, খুব মৃদু। ঘরের কোণা থেকে ঠাকুরমশাইয়ের বিছানার চাদরটা তুলে এনে, তারা তাঁর গায়ে ঢাকা দিয়ে দিল। চারদিকে যা মশা ঠাকুর মশাইয়ের রক্ত খেয়ে শেষ করে দেবে। দু’ তিনটে কুকুর মন্দিরের বাইরের চাতালে শুয়েছিল, ওদের দেখে সেই যে তারা লেজ গুটিয়ে, দৌড়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে গেছে, আর এমুখো হয়নি। 

সুকু বলল, ‘কী ব্যাপার বল তো? চোরদুটো কী পাথরের মূর্তিতেই সন্তুষ্ট? আর কিছু চুরির মতলব আঁটছে না?’

‘উঁহু। আমার মন বলছে, ব্যাটারা আসবেই। এমন সুযোগ ছাড়বে না’।

‘হুঁ, ওরা না এলে কিন্তু ওদের ধরাও যাবে না। খুঁজে বের করা অসম্ভব’।

‘তা ঠিক। তবে চুরি করার এমন লোভ ওরা সামলাতে পারবে কী? তাছাড়া ওরা তো জানেও না, যে আমরা বসে আছি ওদের ধরার জন্যে’।

‘আরেঃ একটা ছোট্ট আলো দেখতে পাচ্ছিস? আর সাইকেলের ঝড়ঝড়ে একটা আওয়াজও শোনা যাচ্ছে না?’

‘কোথায়?’

‘ওই তো, ওইদিকে। দেখতে পাচ্ছিস না?’

‘আরে, হ্যাঁ, তাইতো? এত রাতে কে আসছে, সাইকেলে চড়ে, ছোট্ট টর্চ জ্বেলে?’

 

 পুরোনো লজঝড়ে একটা সাইকেলে প্যাডেল করতে করতে, ফোচে বলল, ‘আমার কিন্তু ভালো ঠেকচে না, বুয়েচিস নোচেআজ সন্ধেতেই, মূর্তিটা হাত সাফাই করলি, এখন আবার বলছিস, তেরেকেটে পেত্নটালি সরাবি। বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্চে, না?’

‘লা রে বাবা, লা। মূর্তিটার দাম পাবো পনের। আর একএকখান টালির জন্যে পাবো হাজার। দশবারোখান টালি সরাতে পারলি, টাকা আর গুনে উঠতে পারবিনি। পারবি? পনের হাজার আর বারো হাজার যোগ করলে কতো হয়, বল দিকি?’

‘কত আর হবে? ঊনিশ-কুড়ি মতো হবে’।

‘তোর মাথা আর মুণ্ডু। বত্রিশ হবে। পাঁচের ঘরের নামতা কোনদিন পড়েচিস, যে পারবি? পাঁচ এক্কে পাঁচ। পাঁচ দুগুনি বারো। তিন পাঁচে আ...আঃ।’

বিশাল হোঁচট খেয়ে, সাইকেল সমেত দুজনেই মুখ থুবড়ে পড়ল দড়াম করে। চোট পেয়েছে বেশ। উঠে বসে, কোমরে আর হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘হাতে টর্চ নিয়ে ফোচকেমি করচিস, ফোচে? চোখে দেকতে পাস না, কানা নাকি’?

‘কিচ্চু নেই রাস্তায়, তাকিয়ে দ্যাক। হোঁচটটা কিসে খেলাম বল তো?’

খুব বিরক্ত হয়ে নোচে উঠে দাঁড়াল, তার পিঠের চটের বস্তাটা, রাস্তায় পড়ে গেছিল। সেটা তুলতে গিয়ে দেখল সেটা নিজে থেকেই সরে সরে যাচ্ছে। যতই হাত বাড়াচ্ছে, ততই সরে যাচ্ছে। এসব হচ্ছেটা কী? ওই বস্তাতেই দুটো ছেনি আছে, আছে একটা হাতুড়ি। পেত্নটালি খোলার জন্যে ওদুটো চাইই চাই। গোল গোল চোখে, সে বস্তাটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ফোচে, বস্তাটা পালাচ্চে, চেপ্পে ধর দিকি’। 

ফোচে ফ্যাক ফ্যাক করে খুব হাসল খানিকটা, তারপর বলল, ‘তোকে পেঁচোয় পেয়েচে, নোচে। তখন খুব পাঁচের নামতা বুজোচ্চিলি আমাকে! পাঁচ দুগুনি বারো? আমায় বোকা পেয়েচিস, লয়? ভাবচিস, কিচু জানি না?’ ফোচে হাত বাড়িয়ে বস্তাটা তুলে নিল, এবার আর বস্তাটা সরল না। নোচে যেমন অবাক হল, তেমনি বোকাও বনে গেল। গুম হয়ে বলল, ‘ক্যানে কিচু ভুল বলেচি? তুই বল না, পাঁচ দুগুনি কতো হয়’? ফোচে খুব বিজ্ঞের মতো বলল, ‘জানি, কিন্তু বলবুনি। যে কাজে এয়েচিস, তাড়াতাড়ি সেরে পালাই চল। আমার কিন্তু ভাল ঠেকছে না, বটে!’

 হাতের টর্চ জ্বালিয়ে, কাঁধে বস্তা নিয়ে সামনে ফোচে, আর পেছনে সিটে বসে নোচে, খুব সাবধানে আবার সাইকেল চালাতে লাগল। মেঠো পথ কিছুটা এবড়ো খেবড়ো, কিন্তু উলটে পড়ে যাওয়ার মতো নয়। তবু কোন ঝুঁকি না নিয়ে ধরে ধরে চলতে লাগল। সামনেই প্রাচীন বিশালাক্ষী মন্দির, রাতের আকাশের গায়ে জমাট বাঁধা অন্ধকার স্মৃতির মতো দাঁড়িয়ে আছে। নোচের মনটা কু ডাকছে। কী যে ঘটে গেল কিছুক্ষণ আগে কিছুই বোঝা গেল না।

‘এ যেন বিনে মেঘে বজ্জোপাত। লীল আকাশের বিষ্টি। ব্যাপার স্যাপার ভালো ঠেকছে না রে, ফোচে’? নোচে আপন মনেই বিড়বিড় করে বলল, ‘এসব তেনাদের কীত্তি নয়তো?’

‘কেনাদের? তোকে তখনই বললাম মূর্তিটা নিয়ে চ, পগার পার হই। শুনলি না, পুকুরের পাঁকে লুকুয়ে রেকে বললি রাতে আবার আসবি, পেত্নটালি তুলতে। অতি নোভে তাঁতি লষ্ট হয়েছিল রে, নোচে’।

‘বাজে বকিসনি। আমরা কী তাঁতি? আর নোভই বা কিসের? নোকে চাকরিতে পোমোসনের জন্যে বেশি কাজ করে না? নোকে ব্যবসার জন্যে একটা দোকান থেকে, দুটো তিনটে দোকান দেয় না? তাকে নোভ বলে? আমরাও দুটো পয়সার জন্যে ওভারটাইমে চুরি করচি। নোভ হতে যাবে কোন দুঃখে?’

ভাঙাচোরা পাঁচিলের মস্ত ফোঁকড় গলে দুজনে মন্দিরের উঠোনে ঢুকতে গিয়েই আবার আছাড় খেল দমাস করে। সাইকেল থেকে ছিটকে ফোচে সামনে পড়েছিল, তার পিঠে গিয়ে আছড়ে পড়ল নোচে। আর কোথা থেকে ঘুরে এসে, ছেনি হাতুড়িওলা বস্তাটা ছিটকে এসে কড়া গাঁট্টা মারল, নোচের মাথায়। আওয়াজ উঠল ঠং। ফোচের হাত থেকে টর্চটা ছিটকে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে পড়েছিল। দুবার টিপ টিপ করে, সেটা নিভে গেল। ঘন অন্ধকারে ভূতের মতো ফোচের পিঠে নোচে শুয়ে শুয়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগল। উলটে পড়া সাইকেলের পিছনের চাকাটা তখনো ঘুরছিল, আওয়াজ উঠছিল কিরকির কিরকির। উঠে বসার মতো সাহসও তাদের আর বাকি ছিল না।

সুকু রুকুকে ফিসফিস করে বলল, ‘সরুদাদার আইডিয়া বটে একখান। অন্ধকারে কালো তার চোখে ঠাহর করা মুশকিল। টানটান করে সাইকেলের সামনে ধরলেই, দমাস, হি হি হি হি’। 

 

    রুকু ঠাকুরমশাই ভবতারণের কাছে গিয়ে ডাকল, ‘ঠাকুরমশাই, ও ঠাকুরমশাই, শুনতে পাচ্ছেন? ও ঠাকুরমশাই’।

 প্রাচীন এই বিশালাক্ষী মন্দিরের পুরোহিত ভবতারণ উপাধ্যায়ের বয়েস হয়েছে বিস্তর। কয়েকশো বছরের পুরোনো এই মন্দিরের এখন ভাঙাচোরা দশা। দেওয়ালে মাকড়সার জালের মতো ফাটল। বেশ কয়েক জায়গায় বট অশ্বত্থের চারা, দেয়াল বেয়ে মোটা মোটা শেকড় নামিয়ে দিয়েছে। ভবতারণঠাকুর ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না, ওই গাছের শেকড়ের চাপেই দেওয়ালে ফাটল এসেছে? নাকি শেকড়ের টানে ফাটা দেওয়ালগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে। শেকড় ছিঁড়ে দিলে, ওই টান যদি আর না থাকে, হুড়মুড়িয়ে একদিন ভেঙেই পড়বে এই মন্দিরের দেওয়াল? উন্মুক্ত হয়ে যাবেন বিশালাক্ষী মায়ের পাথরের প্রতিমা? কালো কষ্টিপাথরের এই প্রতিমাটিকে তিনি কখনো নিজের মেয়ের মতো, কখনো নিজের মায়ের মতো ভালবাসেন। চন্দন, তেল, সিঁদুর মাখা বিবর্ণ প্রতিমাটিকে তিনি প্রতি অমাবস্যা, পূর্ণিমায় ভাল করে স্নান করান। কুচকুচে কালো পাথরের প্রতিমা সেদিন যেন হেসে ওঠেনতুন করে, তেল চন্দন সিঁদুরে প্রতিমাকে সাজিয়ে তোলার সময়, তাঁর শরীর শিরশির করে ওঠে। তাঁর মনে হয়, পাথরের প্রতিমা নয়, তাঁর ছোট্ট কন্যাই যেন সামনে বসে আছেন, তাঁকে আদর করে তিনি সাজিয়ে তুলছেন।

 কিন্তু এই বয়সে এত পরিশ্রম তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। সকাল থেকে ফুল তোলা, পুজোর যোগাড় করা। গ্রামের লোকজন যা কিছু নিবেদন করে, সেই নৈবেদ্য সাজিয়ে পুজো করা। দুপুরের অন্ন ভোগসন্ধ্যার আরতির পর শেতল দিয়ে মা বিশালাক্ষীকে ঘুম পাড়ানো। এসব তো আছেই। তার ওপর মন্দির পরিষ্কার করা, মন্দিরের অঙ্গন থেকে শুকনো পাতা, কাঠকুটো পরিষ্কার করা, এসব না করলেই বা চলবে কেন? এছাড়াও পালা পার্বণে মায়ের বিশেষ পুজো আছে, দূর দূর থেকে ভক্ত সমাগম আছে। পার্বণের দিনগুলোতে সারাদিন দলে দলে ভক্তরা মায়ের কাছে আসে, নানান আশায়, নানান আবদার নিয়ে

আজকাল ধর্মে-টর্মে লোকের আর তেমন ভয়ভক্তি নেই। যেটুকু আছে সেটুকুর পুরোটাই স্বার্থ। ও মা, আমাকে পরীক্ষায় পাস করিয়ে দাও, মা। হে ঠাকুর, আমার চাকরিটা লাগিয়ে দাও। মা গো, আমার ছেলেটা অনেক দূর গেল, ও যেন কোন অসুবিধেয় না পড়ে। ঠাকুর-দেবদেবী যেন পরীক্ষার খাতা দেখেন, চাকরি দেবার কর্মকর্তা, কিংবা ট্রাভেলিং এজেন্ট! কে কোন উদ্দেশে মায়ের পুজো দিতে আসছে, মায়ের কাছে আসছে, সে সব দিকে তিনি আর তেমন নজর দিতে পারেন না। আর সেই ফাঁকেই এমন ঘটনাটা ঘটে গেল।

ফুলে ফুলে ঢাকা মায়ের মূর্তিখানি বেদিতে না পেয়ে ঠাকুরমশাই ভবতারণ ভেঙে পড়েছিলেন। প্রথমে তিনি হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘ও মা। বুড়ো ছেলে সব কাজ এক হাতে সামলাতে পারি না বলে, কখনো সখনো হয়তো অবহেলা করে ফেলেছি, মা। তাই বলে, আমাকে ছেড়ে, এই মন্দির ছেড়ে তুই চলেই যাবি? এ তুই ঠিক করলি, মা? আমাকে শাস্তি দে, বকাঝকা কর, সে সহ্য হয়। কিন্তু এমন চলে যাস না মা। আর যদি যেতেই হয়, আমাকেও নিয়ে চল, মা। সে বরং বেশ হবে। মা ব্যাটায় পালিয়ে গিয়ে বাঁচবো। এ পোড়ার দেশে কেউ আর তোকে দেখে না রে, মা। কিন্তু আমি যে এতোদিন তোর সেবা করলাম – মানছি আমার অনেক ভুল ভ্রান্তি ছিল – কিন্তু মা হয়ে তুই ক্ষমা করতে পারলি না? তুই এতই পাষাণী? তুই যেমন আমাকে ফেলে পালালি, মা, এই আমি বলে রাখলাম, তুই যদি না ফিরিস এইখানেই জীবন শেষ করে দেব। দেখি কেমন করে, তুই পালিয়ে থাকিস?’

এই বলে ঠাকুর ভবতারণ সেই যে শুয়েছেন, বেদী স্পর্শ করে, আর ওঠেননিঅনেকেই সান্ত্বনা দিয়ে তাঁকে ঘরে পাঠাতে চেষ্টা করেছিল। তিনি সাড়াই দেননি। তাঁর বউ নেই, ছেলেমেয়ে নেইকার আর দায় পড়েছে, তাঁকে নিয়ে এত হ্যাপা পোয়ানোর? একসময় সকলেই তাঁকে একলা ফেলে চলে গিয়েছে নিজের নিজের ঘরের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে।

রুকু আবার ডাকল, ‘ঠাকুরমশাই, ও ঠাকুরমশাই, উঠুন। মা যে এসেছেন’।

অনেক দূর থেকে আসা অস্পষ্ট আওয়াজটা ঠাকুরমশাই ভবতারণের মাথার মধ্যে এবার সাড়া দিল‘মা যে এসেছেন’এই কথাটা তাঁর শরীরে যেন শক্তির সঞ্চার করল, হাতে পায়ে জোর পেলেন। আস্তে আস্তে উঠে বসে, ব্যাকুল হয়ে বললেন, ‘মা এসেছেন?’ অন্ধকারে বেদির দিকে তাকিয়ে, হাতড়ে হাতড়ে দেখলেন, ‘মা কোথায়?’

‘মা এসেছেন, একবার বাইরে আসুন। মাকে বরণ করে আনতে হবে না?’

‘মিথ্যে কথা  ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাকে মন্দিরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার তাল করছিস তোরা’

‘না ঠাকুরমশাই, এই মন্দির আপনার মায়ের। আপনাক মায়ের কাছছাড়া করে, এমন সাধ্য কার?’

অন্ধকার মন্দিরের মধ্যে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কে এই কথাগুলো বলছে, কার কথার তিনি উত্তর দিচ্ছেন, এ কথাটা ঠাকুর ভবতারণের একবারও মনে হল না। বরং শেষ কথাটা তাঁর খুব মনে ধরল। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে মন্দিরের বাইরে দাঁড়ালেন। ভোরের আলো ফোটেনি। কিন্তু ভোরের হাওয়া বইছে মন্দিরের বাইরে। সারারাত বদ্ধ মন্দিরের ভেতরে থাকার পর, বাইরে এসে ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় তাঁর মন অনেকটা শান্ত হল।

‘ইচ্ছে-পুকুরঘাটে চলুন, ওখানেই মা অপেক্ষা করছেন’। মন্দিরের পিছনে, কিছুটা দূরে বড়ো একটা পুকুর রয়েছে, তার নাম ইচ্ছে-পুকুর। লোকে বলে ওই পুকুরে মনের যে কোন ইচ্ছে নিয়ে ডুব দিয়ে স্নান করলেই নাকি, সে ইচ্ছে পূরণ হয়ে যায়!          

ঠাকুর ভবতারণ প্রায় দৌড়ে চললেন ইচ্ছে-পুকুরঘাটের দিকে, তাঁর বৃদ্ধ শরীরের কথা আর মনেও রইল না। সেখানে গিয়ে দেখলেন, দুটো শুঁটকো চেহারার লোক ঘাটে বসে আছে। তাদের জামাকাপড় ভেজা। ভয়ে এবং ঠাণ্ডায় তারা ঠক ঠক করে কাঁপছে। তাদের একজনের কোলে, মা বিশালাক্ষীর অপরূপ মূর্তিখানিমা যেন নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন, মায়ের মুখে মৃদু হাসি। ঠাকুরমশাই ভবতারণ ঘাটের পৈঠেতে গিয়ে দাঁড়াতেই, দুজনে উঠে দাঁড়াল। কাঁপতে কাঁপতে ঠাকুরভবতারণের হাতে তুলে দিল মায়ের মূর্তিটিআনন্দে আত্মহারা ভবতারণ কেঁদেই ফেললেন, মায়ের মূর্তি বুকে জড়িয়ে ধরে, কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘এমন অভিমান করে, চলে যেতে হয় রে, পাগলি? খুব হয়েছে, এবার চল, মন্দিরে আবার তোকে প্রতিষ্ঠা করিসারারাত না খেয়ে আছিস, তোর ভোগের ব্যবস্থা করি।’ তিনি মায়ের মূর্তি বুকে জড়িয়ে ধরে, কাঁদতে কাঁদতে দ্রুত চলে গেলেন মন্দিরের দিকে। এই লোকগুলো কে, কোথা থেকে এল, তাদের হাতে বিশালাক্ষী মায়ের মূর্তি কী করে গেল, সে সব কথা তাঁর একবারও মনে এল না।

ঠাকুর ভবতারণের কথায় আর আচরণে, নোচে আর ফোচের চোখেও জল, কাঁপতে কাঁপতে নোচে বলল, ‘ঠাকুরদেবতা লিয়ে এমন ফচকেমি করাটা উচিৎ হয়নি, বুজলি ফোচে?’

‘আমি তো আগেই বলেছিলাম। তুই শুনলি না। একন বোজ। তোর পাল্লায় পড়ে আমিও ডুবলাম’।

 ইচ্ছে-পুকুরের পৈঠে থেকে উঠে এসে ওরা খুব ভয়ে ভয়ে মন্দিরের মাঠের পায়ে চলা রাস্তায় উঠে এল। গাছের ডালে একটা দুটো কাক ঘুম ভেঙে ডাকছেপুবের আকাশে তখন আবছা আলো। চারদিকে কেউ কোত্থাও নেই দেখে, গাছপালার আড়ালে আড়ালে মন্দিরের বড়ো মাঠটা তারা পার হল। পড়ে থাকা সাইকেলটা তুলে, চুপি চুপি পাঁচিলের ফোঁকড় গলে বাইরে পা দিতেই, দুজনেরই পায়ে এক গাদা কাঁটা ফুটল। দুজনেই যন্ত্রণায় কাৎরে উঠল ‘আউ’। তারপর মাটিতে বসে দেখল, তাদের পায়ে ছোট ছোট কাঁটা পেরেক ফুটে আছে বেশ কিছু। একটা একটা করে কাঁটা পেরেকগুলো তুলে ফেলতে বিন্দু বিন্দু রক্ত ফুটে উঠল পায়ের তলায়। ভয়ে আর যন্ত্রণায় দুজনে ভ্যাবলা হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণনড়াচড়া করার মতো সাহসও আর তাদের নেই।

ভোরের বাতাসে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর নোচের মাথাটা একটু খুলল। চারদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে বলল, ‘ফোচে, সাইকেলটা তুলে, আস্তে করে বেরিয়ে পড়ি চ। এখানে আর এক মুহূত্তও থাকা চলবে না’।

‘কাল সারা দিন যা ধকল গেছে, তার ওপর এখন এই ছাঁকনি হয়ে যাওয়া পায়ের ব্যথা! এখান থেকে কুসুমপুর, সাইকেল চালানো চাট্টিখানি কথা নাকি?’

‘কিছুটা তো চ, তারপর না হয় আমিও কিছুক্ষণ চালাবো’   

ফোচে মাটি থেকে সাইকেলটা টেনে তুলল, পেছনে কেউ আসছে কিনা দেখে চেপে বসল সিটে, তারপর প্যাডেলে চাপ দিয়ে, ধমকে উঠে বলল, ‘থালে আর দেরি করচিস কার অপেক্ষায়, উঠে আয়’? নোচে ঝপ করে উঠে বসল ফোচের সামনের রডেআর তারপরেই সাইকেলটা যেন উড়ে চলল তার নিজের খেয়ালে। প্যাডেলে পা রাখতে গিয়ে ফোচে বেমক্কা চোট পেল পায়ে। সে ভয়ে পা তুলে নিল। নিচেয় তাকিয়ে ফোচে দেখল, প্যাডেলটা বনবন করে ঘুরছে, ঠিক যেন টেবিল ফ্যানের পাখা! ভয়ে সিঁটিয়ে বসে রইল চুপটি করে। 

নোচে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী করছিস কি? মারবি নাকি? এত জোরে কেউ সাইকেল...’ ফোচে হাত বাড়িয়ে নোচের মুখটা চেপে ধরে, কানে কানে বলল, ‘যদি প্রাণে বাঁচতে চাস চুপটি করে বসে থাক, হতভাগা। সাইকেল আমি চালাচ্ছি না, চালাচ্ছেন তেঁনারা’। সাইকেলটা সুকুই চালাচ্ছিল ফোচের কথা শুনে, সে রুকুর দিকে তাকাল। রুকু হেসে বুড়ো আঙুল তুলে দেখাল, তারপর ঠোঁট নেড়ে ইশারায় বলল, ‘কুসুমপুর, বড্ডো দূর’? তারপর দুজনেই হাসতে লাগল খুব।   

সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ টুম্পিদের বাবা, মুকুন্দবাবু ফোন করলেন, তাঁর থেকে বেশ জুনিয়ার কোলিগ নেপাল ঘোষকে। নেপাল ঘোষ খুব করিৎকর্মা লোক। ডাকতে হাঁকতে যে কোন প্রতিবেশীর বিপদেআপদে দৌড়ে আসেনতাঁর আরো দুই বন্ধু – প্রভাত পাল আর দেবু নস্কর। তিনজনে হরিহর আত্মা। যা করে‌ন, যেখানে যান, সব একসঙ্গে। বার তিনেক রিং হওয়ার পর নেপাল ফোন ধরলেন, ‘ঘুড্‌ মর্নিং, মুকুন্দদা, সক্কাল সক্কাল কী ব্যাপার’? 

‘গতকাল বিশালাক্ষী মায়ের মন্দিরের মূর্তি চুরি হয়েছিল শুনেছো তো?’

‘শুনেছি দাদা, কী দিনকাল পড়লো, অ্যাঁ! চোরেরা কিছুই আর বাকি রাখবে না’।

‘সে মূর্তি ফিরে পাওয়া গেছে, চোরকেও ধরা গেছে’।

‘বলেন কী, মুকুন্দদা? অ, রুনুঝুনুর বন্ধু, সেই দুই ভূত ভাইয়ের কীর্তি, না’?

মুকুন্দবাবুর সামনে রুকুসুকু দুই ভাই বসেছিল। তিনি তাদের মুখে গোটা রাতের ঘটনা থেকে কুসুমপুরে চোরদের ডেরা অব্দি, সব খবর যেমন শুনেছিলেন; পুরো বর্ণনা করলেন নেপালকে। তারপর বললেন, ‘চোর দুটোকে তোমরা কী করতে চাও? পুলিশে খবর দিয়ে জেল পাঠাবে? নাকি অন্য কিছু’?

‘আমরা সবাই আপনার কোয়ার্টারে পনের-বিশ মিনিটের মধ্যে আসছি। তারপর সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করে ফেলবো’।             

টুম্পিদের মা, দুটো প্লেটে পরোটা আর আলুভাজা নিয়ে রুকু আর সুকুর হাতে দিলেন, বললেন, ‘তোরা খাওয়া শুরু কর। আরো দেবো। সারা রাত যা ধকল গেছে তোদের’।

রুকুসুকুদের খাওয়া শেষ হওয়ার একটু পরেই দুটো বাইক এসে দাঁড়াল মুকুন্দবাবুর কোয়ার্টারের সামনে। ওরা তিনজন - নেপাল, প্রভাত আর দেবু বারান্দায় এসে বসলেন।

‘চা খাবে তো? টুম্পি মাকে বলতো, তিনটে চা পাঠাতে’। তারপর প্রভাত আর দেবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কালকের সব ঘটনা শুনেছো তো, নেপালের কাছে?’ নেপাল বললেন, ‘হ্যাঁ আমি ওদের মোটামুটি সবই বলেছি। আমরা কেউই চোরদুটোকে পুলিশে দিতে চাইছি না’।

‘হ্যাঁ মুকুনদা, পুলিশের হাতে দেওয়া মানেই ওরা পিটিয়ে গারদে ভরে, ব্যাটাদের দাগি চোর বানিয়ে ছাড়বে। দু তিন বছর জেল খেটে বেরিয়ে, আরো পাকা চোর হয়ে, আমাদেরই জ্বালাবে বেশি’। প্রভাত বললেন মুকুন্দবাবু তাঁকে সমর্থন করে বললেন, ‘একদম ঠিক বলেছো, প্রভু। কিন্তু ওদের কিছু একটা স্থায়ী কাজের যোগাড় না করে দিলে, বেচারা লোক দুটো খাবে কী? আর হুট করে, দু-দুটো বদ লোকের জন্যে কাজই বা পাবে কোথায়?’ 

রুকুসুকু এতক্ষণ শুনছিল, এখন বলল, ‘মেসোমশাই, আমরা কিছু বলবো?’ নেপাল, দেবু আর প্রভাত চমকে উঠেছিলেন, তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে, নেপাল বললেন, ‘রুকু সুকু তোরা এখানেই রয়েছিস, আগে বলবি তো! আচমকা কথা বলে এমন চমকে দিস! তা বল না, কী বলছিস, বল?’ 

সুকু খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘আজ্ঞে, আমরা সর্বদা আপনাদের সঙ্গেই রয়েছি, সেটি ভুলে যান বলেই, চমকে ওঠেন। অনেকটা হাওয়ার মতো। আমরা সবাই হাওয়ার মধ্যেই থাকি চব্বিশ ঘন্টা, কিন্তু একটু ঝড়-টড় না হলে, তাকে ঠিক টের পাইনা! সে যাকগে, বলছিলাম কী, লোক দুটোকে মন্দিরের কাজেই লাগিয়ে দিলে হয় না?’

‘চোরকে মন্দিরের কাজে? তাও যে চোর আবার সেই মন্দিরেই চুরি করতে গেছিল?’ দেবু আপত্তি করলেন

‘আজ্ঞে, আমাদের কথাটা হুট করে ফেলে দেবেন না, দেবুকাকু? একটু ভেবে দেখুন, লোক দুটো যা ভয় পেয়েছে কাল, ওরা নিজেরা কোনদিন আর মূর্তির গায়ে হাতই দেবে না’। সুকুর এই কথায় প্রভাত বললেন, ‘তা হয়তো ঠিকই। কিন্তু মন্দিরের কী কাজ ওরা করবে? পুজোআচ্চা তো আর করতে পারবে না’।

‘না না। পুজোআচ্চা তো ঠাকুরমশাইই করবেন। তবে তাঁর তো বয়েস হয়েছে, একা হাতে সব দিক সামলাতে পারেন না, বড়ো আতান্তরে পড়েন। পুজোর যোগাড় করা, মন্দির সাফ সুতরো রাখা। মন্দিরের চারপাশে একটু নজরদারি করা এ কাজগুলো ওরা ভালোই পারবে’। 

চারকাপ চা নিয়ে এসে, টুম্পিদের মা সুকুর কথাগুলো শুনছিলেন। সকলকে চা দিয়ে বললেন, ‘সুকু খুব ভালো প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু। এর থেকে ভালো কিছু আর হয় না। মন্দিরে থাকা খাওয়া ফ্রি। এখন কতো মাইনে দেবে, সে তোমরা ঠিক করে নাও’।

‘আমার মাথাতেও এমনই একটা মতলাব ঘুরছিল, সুকুটা আগেই বলে দিল।’ প্রভাত পাল হাসতে হাসতে বললেন। 

 দুটো বাইকে তিনজন কুসুমপুরের খালধারের বস্তিতে যখন পৌঁছলেন, ঘড়িতে তখন পৌনে নটা। বড়ো রাস্তায় বাইক রেখে, তাঁরা বস্তিতে ঢুকলেন। খুব সরু রাস্তা, দুজন পাশাপাশি হাঁটা যায় না। সেই রাস্তার একদম শেষের ঘরটা এত ছোট, তিনজন ঢোকা অসম্ভব। মাথা নিচু করে দরজা দিয়ে ঢুকে, নেপাল ডাকলেন, ‘নোচেবাবু রয়েছেন নাকি?’ 

বাইরের রোদ্দুর থেকে ভেতরে ঢুকে, প্রথমে কিছুই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ চোখ সয়ে যেতে নেপাল দেখতে পেলেন, ঘরের মেঝেয় ছেঁড়ামাদুর আর চাদর বিছিয়ে, দুটো লোক শুয়ে আছে। দুজনেই নেপালের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, কিন্তু এত ভয় পেয়েছে, উঠে বসা কিংবা সাড়া দেওয়ার কথাও ভুলে গেছে। নেপাল ভরসা দিয়ে বললেন, ‘নোচেবাবু, ফোচেবাবু ভয় পাবেন না। আপনাদের সঙ্গে কথা আছে। চলুন, বাইরে গিয়ে কোথাও বসি’। 

ফোচে হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে নেপালের পায়ে ধরতে এল। নেপাল চমকে সরে আসতে গিয়ে, দরজার চৌকাঠে মাথায় ঠোক্কর খেলেন, একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনার কান্না শোনার সময় আমাদের নেই, চটপট উঠে আসুন। যা হবে ভালই হবে। আর দেরি করলে...’ কথাটা শেষ করলেন না নেপাল। কিন্তু এই কথায় কাজ হল। দেরি করলে কী কী যে হতে পারে, সেটা চিন্তা করে নোচে আর ফোচে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল, আর নেপালের পেছন পেছন বেরিয়ে এল সুড়সুড় করে।

বস্তি থেকে বেরিয়ে পাশের রাস্তা ধরে, সকলে পৌছে গেলেন রেললাইনের ধারে নিমগাছের তলায়। সেখানে একটু ঘাসজমি রয়েছে। বাইকদুটো একধারে দাঁড় করিয়ে, তিনজন বসলেন একদিকে। নেপাল নোচে আর ফোচেকে বললেন, ‘বসুন। কোন রকম শয়তানি করলে কিন্তু...’ ফোচে আর নোচে ধপ করে বসে পড়ল সামনে। নেপালের শেষ না হওয়া এই কথাগুলো, তাদের হাড়ের মধ্যেও ঝনঝন আওয়াজ তুলছে। ফোচে আর নোচে তাকিয়ে রইল তিনজনের মুখের দিকে। 

নেপাল এবার জিগ্যেস করলেন, ‘কাজকম্মো কী করা হয়?’ নোচে বার দুয়েক ঢোঁক গিলে বলল, ‘আজ্ঞে, আমরা শোমিক মানুষ আগে ছিলাম একটা জুটমিলেসেটা বন্ধ হয়ে যেতে এখানে কাজ জোগাড় করে দেবে বলে একটা লোক নিয়ে এসেছিলবন্ধ জুটমিল থেকে আমরা ফাইনেল কিছু পয়সা পেয়েছিলাম। তা সেই লোকটা বললে, বিশ বিশ হাজার দিলে, এখানে রেল কারখানায় কাজ জুটিয়ে দেবে। আমরাও বিশ্বেস করে দিয়ে দিলাম। বাস, টাকাটা পাওয়ার পর সে লোকটা বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল, বাবু। সে আজ ধরেন, ছমাসের ওপর হয়ে গেল, তার আর টিকির সন্ধান পাইনি! এতদিনে বাকি জমানো পয়সাও শেষ। ঘর ভাড়া, খাইখরচ, আমাদের দিন চলে না, বাবু। শোমজীবি মানুষ, যখন যেমন কাজ জোটে, খেটেখুটে খাই।’

‘শ্রমজীবি মানুষের মতো খেটে খুটে খাও, নাকি বদ লোকেদের মতো চুরিচামারি করে খাও?’ নেপাল একটু ধমকেই বললেনফোচে হাউমাউ করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, নোচে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘চুপ কর, ফোচে। বাবুরা সব জেনেশুনেই এসেচে, বেকার মিথ্যে বললে নোকসান বৈ, লাভ হবে না। কথাটা খুব মন্দ বলেননি, বাবু। কাজের চেষ্টায় আমরা টাকা দিয়েছিলাম, সে তো আপনাদের বললামই। সে কাজের আশা যকন গেল, অন্য কাজের চেষ্টাও কিছু কম করিনি। কিন্তু অচেনা অজানা লোককে হুট করে কেউ কাজ দেয়, বাবু? যাও দু এক জায়গায় পেলাম, কাজ করিয়ে পুরো পয়সা দেয় না। যাও বা দেয় দিনের পর দিন ঘুরিয়ে নাকাল করে। আপনার কাছে নুকিয়ে লাভ নেই, আমাদের বড়ো দুগ্‌গতি বাবু’।

নেপাল, প্রভাত আর দেবু, তিনজনেই মাথা নিচু করে শুনলকথাগুলো এত সত্যি আর বাস্তব, কিছু বলার নেই। পয়সাওয়ালা লোকেরা এই রকম বিপদে পড়া অসহায় লোকেদেরও যে এই ভাবেই ঠকায়, এমন ঘটনা তাঁরাও বিস্তর দেখেছেন জীবনে। কিছুক্ষণ পরে, নেপাল বললেন, ‘সে তো সব বুঝলাম, নোচে ভাই। কিন্তু চুরিচামারির এই মতলবটা কী ভাবে হল?’

‘আজ্ঞে, সেও আমাদের পোড়া কপাল। থা নইলে কী আর এমন নাকাল হই! গত মঙ্গলবার, কোন কাজকাম নেই বলে, বিশালাক্ষীমায়ের মেলায় গেচলাম তখন মেলার সবে শুরু, ভিড়টা তেমন জমেনি। মেলায় দোকানদারদের মালপত্র নামানো তোলার কাজ-টাজ পেয়ে, দুটো পয়সাও কামাই হল। মেলাও দেকা হল। তার ওপর এক ফাঁকে মায়ের প্রণামীর থালা থেকেও কিছু টাকা সরিয়ে উপরিও খুব মন্দ হল না। আর সেইটাই কাল হল।

কলকাতা থেকে মস্তো দুটো গাড়ি নিয়ে সেদিন একদল লোক এসেছিল। পেছনের গাড়িতে ছিল তিনজন লালমুখো সায়েব, আর একজন বাঙালি। আর সামনের গাড়িতে চারজন – দুজন হিন্দি বলছিল, আর অন্য দুজন পকেটে হাত ঢুকিয়ে চুপচাপ ঘুরে বেড়াচ্ছিল, আর বড়ো বড়ো ক্যামেরায় ছবি তুলছিল পটাপট। ওরা কোন কথা বলেনি। মন্দিরের ভেতরে বাইরে তারা ঘুরে ঘুরে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখল অনেকক্ষণ ধরে। সকলেই ফোনে আর ছোট্ট ক্যামেরায় ছবিও তুলল বিস্তর। তাদের মধ্যে একজন, ওই বাঙালিটা আমি যখন প্রণামীর থালা থেকে টাকা সরাচ্ছি, দেকে ফেলেছিল। সে আমার জামার কলার ধরে হিঁচড়ে টানতে টানতে মন্দিরের পেছনের মাঠে, ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গিয়ে, খুব ধমকাল, গালাগাল দিল, বলল, “হতভাগা, জোচ্চর, প্রণামীর টাকা চুরি করছিস? তোকে পুলিশে দেব, চাবকে পিঠের ছাল তুলে নেব। তোদের জন্যে আমাদের দেশের কতো বড় বদনাম, ফর্নারদের সামনে চুরি করছিস? নজ্জা করে না?” ফর্নার ব্যাপারটা ঠিক কী বুঝলাম না, বাবু। তবে নজ্জা পেয়েছিলাম, আর ভয়ও পেয়েছিলাম খুব’। 

নেপাল বললেন, ‘কথাটা ফর্নার নয়, ফরেনার। মানে বিদেশী লোক, সায়েব ছিল বললে না? ওরাই ফরেনার’

‘অ তা হবে, বাবু। বুঝলাম, দিশি লোক দেকে ফেললে, নজ্জা না পেলেও চলে, তবে ফর্নার দেকে ফেললে, খুবই নজ্জা বটে! আমি তো ভয়ে খুব কান্নাকাটি করলাম, হাতে পায়ে ধরলাম, ছেড়ে দেওয়ার জন্যে। তাতে বাঙালিবাবুটা একটু যেন নরম হল। বলল “তোকে ছেড়ে দিতে পারি, যদি আমাদের হয়ে দু একটা কাজ করে দিস। তার জন্যে অবিশ্যি টাকাও পাবি”। কাজের কথায় বুকে এট্টু বল পেলাম, জিগ্যেস করলাম, কী কাজ? বলল, কিছুই না। বিশালাক্ষী মায়ের মূর্তিটা এনে দিলে পনের হাজার আর মন্দিরের গা থেকে তেরেকেটে টালি না-ভেঙে তুলে দিতে পারলে, হাজার টাকা করেআমি তো ভয়ে কাঁটা হয়ে গেলাম। মায়ের মূর্তি চুরি? সে যে ভীষণ পাপ। তবে আমাদের মতো লোকের পক্ষে, পনের-বিশহাজারের নোভও তো কম নয়, বাবু, কী বলেন? একটু দোনামোনা করেও, তাই রাজিই হয়ে গেলাম। বাঙালিটা মিচকে হেসে, ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ভেরি ঘুড চার পাঁচদিন সময় দিলাম। শনিবার দিন, রাত দশটা নাগাদ, কাপালীটোলা হাইওয়ে মোড়ের একটু আগে গাড়ি নিয়ে আমি অপেক্ষা করবো। মূর্তি আর তেরেকেটে টালি দিলেই, নগদ টাকা’। 

নেপাল হেসে ফেললেন, ‘ওফ, নোচেবাবু, ওটা তেরেকেটে টালি নয়, টেরাকোটা-পোড়ামাটির টালি’।

‘অ তা হবে, বাবু। আমরা কী আর অতশত জানি? বাঙালিবাবুকে আমি খুব ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলাম, এসব জিনিষের এত দাম ক্যানে, বাবু? এতো সোনা রূপো লয়? আমায় ধমকে উঠে বলল, ওসব পেত্নতাত্তিক জিনিষ, ওসব তুই বুঝবি না। যা বলছি, তাই কর। আমি আবার বললাম, অ্যাডভান্স কিছু দেবেননি, বাবু? বিপদের কাজ। তা সে এমন ধমকাল, আমার পিলে চমকে গেল, বাবু! বলল, ওই তো প্রণামীর থালা থেকে যেটা তুললি, ধরে নে সেটাই তোর অ্যাডভান্স, হতভাগা!’

প্রভাত বললেন, ‘বোঝো কাণ্ড। চুনোপুঁটি চোরদের তবু ধরা যায়, কিন্তু রাঘব বোয়ালদের ধরা যায় না, তারা গভীর জলের মাছ, না?’ নেপাল বললেন,

‘একশ বার। নোচেবাবু মূর্তি সরিয়ে সেই লোকটার হাতে তুলে দিলে, সে লোকটা এক টাকাও দিত না, উলটে হয়তো মেরেই দিত’। নোচে আবার ভয়ে চমকে উঠল, ‘কী বলছেন, বাবু? টাকাও দিত না, আবার মেরেও দিত?’

‘তা নয়তো কী? আপনি লোকটাকে চিনে ফেলেছেন, ধরা পড়ে আপনি পুলিশকে যদি বলে দেন? আর আপনাকে টাকা না দিলে, ওর তো পুরোটাই লাভ। সেটা বুঝছেন না?’ নোচে মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইল খানিকক্ষণ, তারপর বলল, ‘খুব জোর বেঁচে গেচি, বাবু, তাই না? মানুষ এমনও হয়?’ 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেপাল বললেন, ‘খুব বেশি এমন মানুষ হয় না। কিন্তু যারা হয়, তারা এমনই ভয়ংকর হয়’।

কিছুক্ষণ কেউই কোন কথা বললেন না। একটু পরে নেপাল বললেন, ‘আমরা কিন্তু আপনাদের দুজনকে, শাস্তি নয়, কাজ দেবো বলেই এসেছি। আপনি আর আপনার বন্ধু ফোচেবাবু, বিশালাক্ষী মন্দিরেই কাজ করবেন’। 

অবাক হয়ে নোচে তাকাল নেপালের দিকে, বলল, ‘আমাদের কাজ দেবেন, ওই মন্দিরে? আমরা কোনদিন আর ওই মন্দিরমুখো হবো না, পিতিগ্‌গা করলাম। শনিবার আমরা না গেলে, ওই লোকটা ঠিক ফিরে আসবে। আর আমাদের দেকলে ওরা ছেড়ে দেবে? ওরে বাবা, না না, দরকার নেই আমাদের কাজে। বেঘোরে মরবো নাকি?’

‘অতো ভয় পেলে চলবে নোচেবাবু? আপনাদের দুজনের ভবিষ্যতটাও তো দেখতে হবে’।

ফোচে এতক্ষণ কোন কথা বলেনি। এখন বলল, ‘বাবুরা কী বলছেন, পুরোটা শোন না, নোচে। তা কাজটা কী, বাবু?’

নেপাল বললেন, ‘মন্দিরের কাজ। ওখানকার পুরোহিত ভবতারণঠাকুরকে পুজোর যোগাড়ে সাহায্য করা। মন্দিরের ভেতরবাইরে পরিষ্কার করা। আর উটকো লোকদের থেকে মন্দিরের মূর্তি বা টেরাকোটা টালি পাহারা দেওয়ামন্দিরেই থাকা, খাওয়া, একদম ফ্রিআর মাস মাইনে কতো, আমরা সবাই মিলে বসে ঠিক করে দেবো’। 

ফোচে নোচের পিঠে হাত রেখে বলল, ‘এ তো, ভালোই রে, নোচে। আমাদের কপাল খুলে যাবে। এখানে এই ঘরের ভাড়াই আমরা মাসে দি ষাটটাকা। তাও চারমাস বকেয়া রয়ে গেচে বলে, বস্তির মালিক রোজ গাল দিচ্চেতুই আর না করিস না, নোচে চল, চলেই যাই। রোজগারও হবে, আর যেটুকু পাপটাপ হয়েচে, মায়ের মূর্তি চুরি করতে গিয়ে, আর প্রণামীর টাকা চুরি করে, সেটাও খন্ডে যাবে’।  

 

সেইদিনই ঘন্টা খানেকের মধ্যে বস্তির ঘরের বকেয়া ভাড়া মিটিয়ে, নোচে আর ফোচে, নেপালদের বাইকে চেপে পড়ল, সামান্য যা মালপত্র ছিল সে সব নিয়ে। কীই বা ছিল এমন, একটা পুঁটলিতেই সব এঁটে গেল। ছেঁড়া মাদুরটা আর আনল না, পাশের ঘরের নক্কিমাসীকে দিয়ে এল। নক্কিমাসী নিজে খুব কষ্টের মধ্যে থাকলেও, তিনিই মাঝেমধ্যে ওদের খবরাখবর নিতেন। আসার সময় নক্কিমাসী কেঁদেও ফেললেন। বললেন, ‘যা বাবা, গিয়ে দেখ যদি কিছু হিল্লে হয়’।

এক-দুদিনে মন্দিরের কাজকম্মো বুঝে নিতে তেমন অসুবিধে হল না। তারপর, দাড়িটাড়ি কামিয়ে, মন্দির থেকে দেওয়া নতুন ধুতি আর পিরান গায়ে, যখন তারা ভক্তদের ভিড় সামলাতে লাগল, কে বলবে তারা সেই বকমুখো নোচে আর শেয়ালমুখো ফোচে! অনেকে তো আবার তাদের, ‘মহারাজ’ বলে নমস্কারও করতে লাগল। শুক্রবার কাজ সেরে, অনেক রাতে মায়ের ভোগের প্রসাদ পেয়ে, দুজনে যখন মন্দিরের চাতালে বসল, শীতল হাওয়ায় তাদের মন জুড়িয়ে গেল। নোচে আরাম করে আধ শোয়া হতে হতে বলল, ‘এই কদিনে কী ছিলাম আর কী হয়ে গেলাম রে, ফোচে’?

‘সবই মায়ের দয়া রে, মায়ের দয়া। মা যেমন কেড়ে নেন, আবার দু হাত ভরেও দেন’।

‘ধুর পাগল, করলো তো ওই বাবুগুলা। ওরা ছিল বলেই না এমন হল?’

‘তুই বড়ো হাল্কাবুজো, বুজলি নোচে? সেদিন রাত্রে যে আমাদের নাজেহাল অবস্থা হয়েচিল, কে করাল? মায়ের পাষাণ মূর্তি পুকুরের জল থেকে তুলে, ঠাকুরমশাইয়ের হাতে কে দেওয়াল?’

‘কে?’ নোচে ক্যাবলার মতো জিগ্যেস করল।

‘সেদিন এই বাবুগুলা ছিল? ছিল না। বাবুরা আমাদের বস্তি চিনত? চিনত না। আমাদের নামধাম বাবুদের কে দেকিয়ে দিল? বল না, কে?’

‘মা, মা বিশালাক্ষী। ঠিক বলেছিস রে, ফোচে। সব মায়েরই কাজ। আমরা তার মানে মায়ের চোখে বাঁধা পড়ে গেচি। আর যেন কোন দুষ্কর্ম করে ফেলিসনি, ফোচে। থালে মা আর আস্তো রাকবেন না’।

‘যাক, তোর গোদা মাতায় ঢুকেচে কতাটা। আর এও বলে রাখি, রোববার ওই নোকগুলাও জব্দ হবে’

‘কোন নোকগুলা?’

‘ওই যে রে, যে তোকে বলেছিল, মূর্তি চুরি করে দিলে পনের হাজার টাকা দেবে, তারা’।

‘বলিস কী রে? তারা একানে আসবে না কী?’

‘কাল শনিবার। আমরা যদি কাল রাত্রে ওদের সঙ্গে দেখা করতে না যাই, ওরা রোববার এখানে নিগঘাৎ এসে হাজির হবে’।

‘সর্বনাশ। তাহলে তো এখনই পালাতে হয়। ওই শয়তান নোকগুলা আমাদের এখানে দেকতে পেলে ছেড়ে দেবে, ভেবেচিস?’

‘মামার বাড়ির আবদার আর কী? পালাতে হলে তুই পালা। আমি আর এই জায়গা থেকে নড়ছি না। আমিও শেষ দেকে ছাড়বো, মা কী কী করতে পারেন!’

 ১০

 সামনের মঙ্গলবার মেলা শেষ। আজ রোববার, মেলায় খুব ভিড়। মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন্যে বিশাল লাইন। ভক্তরা মায়ের পুজোর জন্যে ফুল, মিষ্টির বাক্স, কেউ কেউ ফলও এনেছে। ফর্সা ধুতি আর পিরেন পরে, নোচে আর ফোচের ব্যস্ততার সীমা নেই। ভক্তেরা তাদের বারবার ডাকছে, “ও মহারাজ, ভেতরে একটু তাড়া দিন না। লাইন যে এগোচ্ছেই না’। মিষ্টি হেসে নোচে উত্তর দিচ্ছে, ‘একটু ধৈজ্জ ধরেন, বাবাসকল, মা জননীরা, মা সবাইকে দেখা দেবেন। ছেলেমেয়েদের মুখ না দেখে উনিই কী আর শান্তি পাচ্চেন?’।  

‘কী রে? একেবারে মহারাজ হয়ে গেছিস দেখছি? এ কদিনে এত উন্নতি? কাল সাড়ে এগারোটা অব্দি আমরা গাড়িতে বসে রইলাম, গেলি না যে বড়ো? প্রণামীর থালা থেকে টাকা সরিয়েছিস, বলবো নাকি, চেঁচিয়ে? এই ভক্তরা জানতে পারলে, তোকে পায়ের তলায় পিষেই মেরে দেবে, সেটা জানিস?’

ঘাড়ের কাছে ফিসফিস এই কথা শুনে নোচে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, সেই শয়তান লোকটা! নোচে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগল দাঁত বের করে তার চোখ ঘুরছে, ভিড়ের মধ্যে দুজনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বলল, ‘হে হে হে, অপরাধ হয়ে গেছে, স্যার। এই ভিড়ের মধ্যে মূর্তি চুরি কী ছেলের হাতের মোয়া, না কী স্যার? হুট করে তুললাম, আর আপনার হাতে দিয়ে দিলাম? আপনার ফোন নাম্বারটা দিয়ে যান, স্যার। সরাতে পারলেই আপনাকে দিয়ে দেব’। দুজন হাট্টাকাট্টা জোয়ান লোক, শয়তানটার পিছনে এসে, একটু দূরে দাঁড়াল 

বেজায় ভিড়ের জন্যে শয়তানটা বুঝতেও পারল না, বলল, ‘ফোন নম্বর দিয়ে কী করবি? মঙ্গলবার মেলা শেষ। তারপরে আর ভিড় থাকবে না। আমি বেষ্পতিবার আবার আসবো। সেদিন যেন না ফিরতে হয়

‘হে হে হে, আপনারা গণ্যিমান্যি মানুষ, আপনাদের সময়ের কতো দাম। তাই বলচিলাম, ফোন নম্বরটা দিলে, আমি ফোন করে জানিয়ে দিতাম, আজ্ঞে’।

‘বাজে বকিস না। বেষ্পতিবার, রাত সাড়ে দশটা, হাইওয়ে মোড়। নইলে...’।

‘বেষ্পতিবার তো? তা বেশ বেশ’।

 শয়তানটা পিছন ফিরে চলে গেল। ভিড়ের মধ্যেও তার পিছনে ছায়ার মতো লেগে রইল জোয়ান লোক দুটো। মেলার ভিড় ছেড়ে হেঁটেই চলল শয়তানটা, যেদিকে অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। শেষের দিকে একটা এসইউভি গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে ড্রাইভার ছাড়াও আরো দুজন বসেছিল। তারা নেমে এসে কথা বলতে লাগল। নেমে আসা দুজন কিছুটা উত্তেজিত হয়ে লোকটাকে খুব ঝাড়তে লাগল, আর শয়তানটা হাত মাথা নেড়ে ওদের শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। এদিকে ওই দুজনের সঙ্গে আরো তিনজন – মোট পাঁচজন হাট্টাকাট্টা লোক আস্তে আস্তে ঘিরে ধরল ওদেরবোঝা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে তারা যেন নিজেদের গাড়ি খুঁজছে, বা অন্য কিছু খুঁজছেখুব কাছাকাছি গিয়ে, একজন শয়তানটার কাঁধে হাত দিয়ে ডাকল, বলল, ‘এখানে ভালো মূর্তি কোথায় পাওয়া যায়, বলতে পারেন?’

‘মূর্তি? কিসের মূর্তি?

‘খুব পুরোনো পাথরের মূর্তি?’

‘তার আমি কী জানি?’

লোকটার চেহারা দেখে, অন্য লোক দুটোর সন্দেহ হল, তারা তাড়াতাড়ি গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু তার আগেই তিনজনকেই পেছন থেকে শক্ত হাতে চেপে ধরল ওরা। গাড়িতে বসে থাকা ড্রাইভারও বুঝতে পারল ব্যাপার গণ্ডগোল। সে গাড়ি স্টার্ট করল, ফাস্ট গিয়ারে দিয়ে, গাড়ি একটু গড়াতেই, প্রচণ্ড শব্দে সামনের একটা টায়ার বার্স্ট করল, আর গাড়ির বাঁদিকটা কেতরে বসে গেল, বেশ খানিকটা

ওই পাঁচজনই আসলে স্পেশাল পুলিশের লোক সাধারণ পোষাকে মেলায় ভিড়ের মধ্যে মিশে ছিলেন। নোচের সঙ্গে কথা বলাই ছিল, নোচে ইশারা করে শয়তানটাকে চিনিয়ে দিলেই, ওঁরা অ্যাকশন শুরু করবেন। ওঁনাদের একজন গাড়ির ড্রাইভারকে কলার ধরে টেনে নামালেন। তারপর সবাইকে ইশারায় ডেকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন, পুলিশ ভ্যানের দিকে।

টায়ার ফাটার ভীষণ আওয়াজ আর চারজন লোককে ধরে পুলিশের ভ্যানে ওঠানো দেখে, মেলার অনেক লোকই দৌড়ে এসে ভিড় জমালো। পুলিশ অফিসার ভিড় সরিয়ে ভ্যানটাকে এগিয়ে নিয়ে, উঠে বসলেন, সামনের সিটেতারপর গাড়ি বেরিয়ে গেল বড়োরাস্তার দিকে। থানায় নিয়ে গিয়ে জেরা করলে, ওই শয়তানগুলোর পেট থেকে নিশ্চয়ই পুরো দলটার হদিশ মিলবে।  

এসইউভি গাড়িটার ফাটা চাকার নিচে বেশ কয়েকটা কাঁটা পেরেক দেখে মেলার লোক বেশ আশ্চর্য হল। এক মুঠো কাঁটা পেরেক কে ফেলল এখানে? পুলিশের গাড়ির হর্ন দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আওয়াজ পেয়ে, ভক্তদের পুজোর লাইন সামলাতে সামলাতে নোচে চেঁচিয়ে উঠল, ‘বলো বিশালাক্ষী মায়ীকি’।

ফোচে আর ভক্তদের অনেকে গলা মিলিয়ে বলে উঠল, ‘জয়’।

..০০..


নতুন পোস্টগুলি

পেত-ন-তাৎ-তিক

  [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉  বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার ...