Powered By Blogger
বড়োদের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
বড়োদের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

মঙ্গলবার, ১ জুলাই, ২০২৫

জঙ্গী ব্যবসা

 

 ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির মুণ্ডপাত করছিল। আজকাল আর তলোয়ারের চল নেই, থাকলে হালাল করে পাঁচরাস্তার মোড়ে ঝুলিয়ে রাখা যেত হতভাগার কাটা মুণ্ডুটা। অকর্মার ঢেঁকি একটা। কতদিন হয়ে গেল বেশ জুতসই খবর তৈরি করতে পারছে না। এমন একটা খবর যা শুনে গোটা হিন্দুস্থান তো বটেই – গোটা কাফের দুনিয়া চমকে উঠবে। রাত্রে ঘুমের মধ্যেও শিউরে উঠবে বারবার। আর গোটা ইসলাম দুনিয়া আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠবে – আহা কিছু ইসলাম ধর্মে এখনও কিছু মুজাহিদ আছে, যারা জেহাদ ভুলে যায়নি।      

বড়োসড়ো ঘটনা বলতে ১১/০৭/২০০৬-এ মুম্বইতে লোকাল ট্রেনের সিরিজ ব্লাস্ট – লোক মরেছিল ২০৯ জন। তাছাড়া মুম্বাইতেই তাজ হোটেল আক্রমণ – ২৬/১১/২০০৮ – ১৭৫ জন মানুষের মৃত্যু।  এছাড়াও অনেক আছে বিগত বছরগুলোতে। কিন্তু সেসব পাতে দেওয়ার যোগ্য নয় – কোথাও ৭০ জন, কোথাও ৪০ জন, কোথাও মোটে চার-পাঁচজন। ছ্যাঃ জলের মতো টাকা যাচ্ছে। বন্দুক, গুলি, আরডিএক্স কেনা হচ্ছে নিয়মিত। কিন্তু  আসল কাজের বেলা লবডঙ্কা। মামুদ ঘোরিকে জরুরি তলব করেছে। হয়তো এসে পড়বে এখনই। এলে আচ্ছা করে তুলোধোনা করবে।

এর মধ্যেই ফোনটা বেজে উঠল আজানের সুরে। মামুদ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠে চেয়ারে সোজা হয়ে বসল এবং কানেক্ট করেই বলল, “জি স্যার”।

কী হচ্ছেটা কি, মামুদ। তুমি আর তোমার লোকজন কি মরে গেছ? নাকি আমার টাকা হাতিয়ে আয়েস করে দিন কাটাচ্ছো”?

“কেন, স্যার? একথা কেন বলছেন? আপনার পবিত্র টাকার প্রতিটি পাই-পয়সা আমরা জিহাদের জন্যে খরচ করছি। আপনার টাকা নিয়ে আয়েস করলে আমাদের যে দোজখেও স্থান হবে না, স্যার?”

“ঘোড়ার ডিম করছো? করলে আজ দেড় বছরের ওপর হয়ে গেল হিন্দুস্থানের গায়ে একটা আঁচড়ও কাটতে পারলে না?”

“ইয়ে, মানে হয়েছে কি স্যার, এলওসির এপারে আর বালোকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে হিন্দুস্থান আমাদের বড্ডো ক্ষতি করে দিয়েছে, স্যার। আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্পগুলো একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। নতুন ক্যাম্প গড়ে, নতুন ছেলে যোগাড় করে, তাদের ট্রেনিং দিয়ে। অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করে- মানে সবদিক আবার গুছিয়ে তুলতে একটু সময় লাগছে আর কি?”

“তোমার বেফিজুল বাহানায় চিঁড়ে ভিজবে না, মামুদ। কড়ি যখন গুনেছি, তেলও আমি মাখবো। তা না হলে মনে রেখো – তোমাদের প্রত্যেকের তেল আমি নিংড়ে নেব। মনে করো না, আমার পয়সা হজম করে তুমি পার পেয়ে যাবে। দুনিয়ার যেখানে তুমি ঘাঁটি গাড়বে – সেখান থেকে বের করে তোমাকে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো”।

“আজ্ঞে সে কথা তো একশবার। আপনি আমাদের পয়গম্বরের মতোই...আপনার নজর এড়িয়ে আমাদের একপাও কোথাও নড়বার জো আছে? তবে বিশ্বাস করুন, স্যার, আমরা সত্যিই বসে নেই...দিন-রাত এক করে তৈরি হচ্ছি হিন্দুস্থানের বুকে মোক্ষম আঘাত দেওয়ার জন্যে...”।

“আরে বাঃ। ২০০৬এর জুলাই মাসের মতো আরেকটা ধামাকা লাগিয়ে দাও দেখি, মামুদ। ওফ্‌ সেবার যা মজা পেয়েছিলাম। টিভিতে হিন্দুস্থানের লোকদের হাহাকার যত শুনেছি – ততই তোমাদের জন্যে আমার গর্বে বুক ফুলে উঠেছে। মনে হয়েছিল হিন্দুস্থানের বরবাদ হতে আর বাকি নেই...হা হা হা হা হা। তারপর তোমরাই করলে তাজ হোটেলের সেই গণহত্যা। সে সব দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। আহা কী আনন্দ, কি আনন্দ...হিন্দুস্থানের মুম্বাই শহর – সারা বিশ্বে তার কম গুরুত্ব? আর সেই শহরের সেরা হোটেল – কি তার শান, শওকত – সেখানে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিলে, হে তোমরা! ওই দেখ আমি আবার গঙ্গা বলে ফেললাম – বলা উচিৎ ছিল রক্তসিন্ধু...”।

“যা বলেছেন স্যার। সবই আল্লা আর আপনার রহমত...”।

“ভেবেছিলাম ওরকম একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে তুমি হিন্দুস্থানের দফারফা করে দেবে...ও মা কোথায় কি? তারপর থেকেই তোমরা কেমন যেন মিইয়ে গেলে...ভেজা বেড়ালের মতো... আঁচড়ে কোন ধার নেই...ছ্যাঃ ছ্যাঃ - এর জন্যে আমি তোমাদের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালছি?”

“একটু ধৈর্য ধরুন, স্যার। আবার হবে। আসলে কী জানেন, স্যার? হিন্দুস্থানের লোকগুলো আর আগের মতো ন্যালাভোলা নেই। সেয়ানা হয়ে উঠেছে খুব। ওদের জালে প্রায়ই আমাদের লোকজন ধরা পড়ে যাচ্ছে...তার মধ্যেও ঘটনা ঘটাইনি তা নয় – যেমন ধরুন ২০০৮-এর জয়পুরের সিরিজ ব্লাস্ট – ৭১ জন মরেছিল, স্যার। আমার সামনে পুরো লিস্ট রয়েছে স্যার। তারপর ধরুন, ওই ২০০৮এই আমদাবাদের সিরিজ ব্লাস্ট – লোক মরেছিল ৫৬ জন। ছোটখাটো ব্লাস্টিংগুলো বাদ দিলেও ২০১৯-এ উরি, পুলওয়ামা, কিংবা তারও আগে সেই ২০০১-এর পার্লামেন্ট হাউস...”।

ফোনের ওপাশ থেকে প্রচণ্ড চিৎকারে উত্তর এল, “রাখো তোমার ওই ছুটকো পটকা ফাটানোর হিসেব...। মিলিটারি, জওয়ান কিংবা পুলিশের লোক মেরে লাভটা কী হয়েছে? হিন্দুস্থানের সাধারণ হিন্দুদের মনে ভয় ঢুকেছে? হিন্দুস্থানের মুসলিমরা প্রকাশ্যে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হতে পেরেছে? গলাবাজি করে এমন বলছো মনে হচ্ছে হিন্দুস্থানের আধখানা জয় করে ফেলেছো? উরি আর পুলওয়ামা কাণ্ডের পর হিন্দুস্থান এমন সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করল – একটু আগেই তো বালাকোটে তোমাদের ট্রেনিং ক্যাম্প ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলে নাকে কাঁদছিলে! লজ্জা করে না, বেশরম? আর বুক বাজিয়ে পার্লামেন্টের কথা বলছ – তোমার সব কটা লোককেই তো কুকুরের মতো গুলি করে মেরে দিয়েছিল, মনে নেই? ওদের মরেছিল, পাঁচজন পুলিশ, একজন নিরাপত্তা কর্মী আর একজন মালী – বেচারা বাগানে কাজ করছিল”।

মামুদ কোন উত্তর দিল না, ওপাশের ঝাড় শুনতে শুনতে তার কান এবং মাথা গরম হয়ে উঠল। বিদেশের এই ব্যক্তিটির সঙ্গে তার যোগাযোগ হট-লাইনে, যখন তখন ফোন করে আর ঝাড়ে। এতদিনে মামুদ টের পেল এ লাইনটাকে কেন হট-লাইন বলা হয় – হারামিটা চেঁচিয়ে মাথা-কান গরম করে তুলল। উপায় নেই, হতভাগার প্রচুর টাকা, ঝাড় শুনতেই হবে। তবে এটাও ঠিক ব্যাটা হাত ঝেড়ে কোটি কোটি টাকাও বের করে দেয়।  

“কী হল? বোবা মেরে গেলে কেন? কানে কথা ঢুকছে না?” ওপাশ থেকে আবার কড়া প্রশ্ন আসাতে সুলতান মামুদ বলল, “না স্যার...মানে হ্যাঁ স্যার – শুনছি স্যার”।

“হুঁ। কী ভাবছো কি? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু একটা করবে- নাকি বসে বসে হিন্দুস্থানের দিকে তাকিয়ে কুকুরের মতো শুধু লেজ নেড়ে ঘেউ ঘেউ করবে?”

“করছি তো স্যার, আমরা কি ছেড়ে দেওয়ার লোক, স্যার? এবার এমন প্ল্যান করেছি না, স্যার, হিন্দুস্থানের সাধারণ হিন্দুরা ভয়ে, আতঙ্কে শিউরে শিউরে উঠবে – আর ভাববে মুসলমান ঘরে জন্ম না হয়ে কেন ওদের জন্ম হিন্দু ঘরে হল...দেখে নেবেন স্যার”।

“আচ্ছা?” ফোনের ওপাশ থেকে খ্যাঁ খ্যাঁ হাসির শব্দ শোনা গেল – অনেকটা হায়নার ডাকের মতো... “তা প্ল্যানটা কী শুনি”?

“না স্যার, প্ল্যানটা এখনই বলব না। তবে কাশ্মীরের বিখ্যাত কোন টুরিস্ট স্পটে হামলা করার একটা প্ল্যান করেছি – ঠিকঠাক লেগে গেলে স্যার – শুধু হিন্দুরা নয় – কাশ্মীরের মুসলমানরাও জব্দ হয়ে যাবে। কাশ্মীরী এই মুসলমানগুলো হিন্দু টুরিস্টদের থেকে ভালই পয়সা কামায় স্যার। সেই জন্যে জিহাদ-টিহাদ ভুলে এখন দু হাত তুলে আনন্দে নাচছে...। ওদের এই ভালো থাকার আনন্দও ফাটা বেলুনের মতো একেবারে ফুস হয়ে যাবে”।

“সত্যি? মাইরি বলছো? আহা তোমার প্ল্যানের কথা শুনেই কী আনন্দ যে হচ্ছে...। ঠিকঠাক করতে পারলে না জানি কী হবে। একটা ব্যাপার মনে রাখবে সব সময় – আমাদের প্রধান লক্ষ্য হিন্দুরা হলেও – হিন্দুস্থানে থাকা মুসলিমরা – যারা জিহাদ ভুলে হিন্দুস্থানি হয়ে উঠছে দিনকে দিন – তাদেরও চমকাতে হবে। তাদেরও বোঝাতে হবে...মুসলমান হয়েছ যখন, আমাদের সঙ্গে বেরাদরি কর। তা না হলে মৃত্যুর পর ওদের ঠাঁই হবে দোজখে। শুধু মুসলমান বলেই মৃত্যুর পর স্বর্গে গিয়ে বাহাত্তর হুরি-পরি নিয়ে ঢালাও ফুর্তির আসরে যোগ দেওয়া যাবে না। যাগ্‌গে কবে নাগাদ করছো হামলাটা?”

“খুব শিগ্‌গিরি স্যার, কাশ্মীরে এখন বেড়াতে আসার ভরপুর মরশুম কিনা, তাই এমাসের শেষ দিকে কিংবা সামনের মাসের মাঝামাঝি”।

“আরে এমাসেই সেরে দাও, ওমাসের জন্যে অপেক্ষা করতে যেও না”।

“অপেক্ষা করতে চাইছি না, স্যার – আটকে যাচ্ছি অন্য একটা ব্যাপারে”।

“কী ব্যাপারে”?

“কী আর বলব স্যার। আপনার মতো মহান ইসলাম দরদী মানুষের কাছে বারবার বলতে লজ্জা করছে স্যার”।

“ন্যাকামি রেখে, কী বলতে চাইছ, বল না ছাই”।

“আজ্ঞে কিছু টাকার খুব দরকার ছিল -  আপাততঃ কোটি দশেক যদি দেন...কাজটা চটপট শুরু করে দিতে পারি”।

“দ-অ-অ-শ কোটি? টাকা কি খোলামকুচি নাকি – কী ভাবো বলো তো?”

“সত্যি বলছি, স্যার। এভাবে আপনার কাছে চাইতে খুব লজ্জা করে। কিন্তু কী করবো স্যার, উপায় নেই। বছর দশ পনের আগেও ছেলেপিলের দল – ছমাসের ট্রেনিং নিয়ে, হাতে বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ত জিহাদিতে। নগদ টাকা-পয়সার দিকে কোন খাঁই ছিল না। ফ্রিতে থাকা খাওয়া টুকটাক হাত খরচা দিলেই চলে যেত। এখন সেই ছেলেদের বাড়ি থেকে বের করতেই, তাদের বাপ-মাকে পনের-বিশ লাখ টাকা গুনে দিতে হয়। তারা বলে, এ ছেলে তো আর ফিরবে কিনা ঠিক নেই – হিন্দুস্থানের জওয়ানদের গুলিতে হয়তো বেঘোরে মরবে। ছেলে যদি ঘরে থাকত – পনের-বিশ লাখ টাকা তো তারা তিন চার বছরেই কামাই করে নিতে পারত – হিন্দুস্থানী টুরিস্টদের সার্ভিস দিয়ে। তারপর ধরুন হিন্দুস্থানে ঢুকে যাদের বাড়িতে কদিন থাকবে, খাবে – তারাও আগে পয়সা নিত না। এখন পারহেড পারডে এক লাখ থেকে দেড় লাখ করে চাইছে – তাদের শেল্টার দেওয়ার জন্যে। বলছে সন্ত্রাসী হানার পর হিন্দুস্থানি মিলিটারিরা খোঁজখবর নিয়ে ঠিক পৌঁছে যায় বাড়িতে – বাড়ির ছেলেদের ধরে নিয়ে জেলে ভরে দেয়, বাড়ির অন্য লোকদেরও জিজ্ঞাসাবাদের নামে বড্ডো হয়রানি করে, স্যার। তাছাড়া বন্দুক আর গোলাগুলির দামও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। চার মাস আগেও আমেরিকান কিংবা চিনের বন্দুকের দাম যা ছিল, এখন তা বেড়েছে দুগুণ, তিনগুণ করে। দালালরা বলছে, বিশ্বের সব দেশই এখন সন্ত্রাসবিরোধী এবং শান্তিকামী হয়ে উঠছে, তাই ওই সব দেশের ভালো বন্দুক যোগাড় করতে আমরা নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি, স্যার”।

ফোনের ওপাশ থেকে অশ্রাব্য একটা গালাগাল উড়ে এল, তারপর উত্তর এল, “আচ্ছা, মুসলমানদের মধ্যে ধর্মভাব কি কমে যাচ্ছে? এমন একটা মহৎ কাজের জন্যে নিজেকে কুরবানি দেওয়ার এমন একটা সুযোগ পাচ্ছিস, তার জন্যে কোথায় কৃতজ্ঞ থাকবি, তা নয় শুধু টাকা-টাকা করছিস? ছিঃ। টাকা কি সঙ্গে যাবে? তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি মামুদ। ঠিক আছে – তোমাকে দশ কোটিই দেব। কিন্তু এখন দেব সাত কোটি। পরে ঠিকঠাক কাজ হলে বাকি তিন দেব। আর সেরকম মোক্ষম কিছু করে যদি আমাকে খুশি করতে পারো...তাহলে হয়তো আরো বেশি। কি খুশি তো?”

“সে কথা আর বলতে, স্যার। আপনাকে খুশি রাখাই আমার জীবনের লক্ষ্য। তা টাকাটা কখন পাবো, স্যার?”

“ধরো, ট্রান্সফার হয়ে গেছে তোমার অ্যাকাউন্টে...ও নিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, মামুদ। তুমি কাজে মন দাও”।

“জি স্যার”।

 

 

ফোনটা রেখে টেবিলের ওপর তবলার ঠেকা দিয়ে সুলতান মামুদ একটা গজলের সুর ভাঁজল কিছুক্ষণ। তারপর ল্যাপটপ খুলতে খুলতে ভাবল, এমন সব বুরবক জিহাদিরা আছে বলেই, ওদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে তার বাপ-ঠাকুরদারা আমীর হয়েছিল। এভাবে চলতে থাকলে তার নাতি-পুতিরাও স্বচ্ছন্দে পায়ের ওপর পা তুলে, রাজার হালে থাকতে পারবে। পাসওয়ার্ড এবং ফেস আইডেন্টিফিকেশন করে, লগইন করে খুলল, ইংল্যাণ্ডের একটি বিখ্যাত ব্যাংকের হোমপেজ। সেখানে লগইন করা মাত্র – একটা নোটিফিকেশন এল সাত কোটি টাকা ক্রেডিট হয়েছে তার অ্যাকাউন্টে। এবং তার অ্যাকাউন্টের প্রেজেন্ট ব্যালান্স সাড়ে পাঁচহাজার কোটির কিছু বেশি। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে – সুলতান মামুদ লগ আউট করল ব্যাংকের সাইট থেকে। তার মুখে মুচকি হাসি।

চেয়ার থেকে উঠে আট তলায় তার এই চেম্বারের কাচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বাইরে ধূসর রঙের আকাশ। অনেক নীচেয় শহরের ঘিঞ্জি রাস্তায় এখন বিশাল জ্যাম। কয়েকশ গাড়ি জ্যামে আটকে আছে। তার ফাঁকে ফাঁকে গোঁজা আছে টাঙ্গা, অটো, স্কুটার, বাইক...আর সেই সব এড়িয়ে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে পিঁপড়ের মতো অজস্র মানুষ। ওদের মধ্যে কত যে বেকার ছোকরা আছে – যারা প্রত্যেকেই ভবিষ্যতের সফল জিহাদি হয়ে উঠতে পারে। আর বয়স্ক মানুষগুলোর মধ্যেই হয়তো কারো ছেলে এখন আজাদ কাশ্মীরের জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে চলেছে হিন্দুস্থান সীমান্তের দিকে। সাত-দশ দিনের মধ্যে হামলা করবে হিন্দুস্থানের সাধারণ মানুষের ওপর – বিশেষ করে যারা হিন্দু। তাদের পড়ে থাকা লাশ ঘিরে হিন্দুস্থানী মহিলাদের হাহাকার সে যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে...।

দরজায় খুট করে আওয়াজ হতে ঘুরে তাকাল সুলতান মামুদ, দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তার পিএ, বলল, “স্যার, মহম্মদ ঘোরি স্যার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে, পাঠাবো”?

একটু চিন্তা করে সুলতান মামুদ বলল, “হুঁ পাঠাবে – কিন্তু তার আগে বলো তো রাজিয়া, তোমার কাছে ক্যাশ কত আছে”?

“বারো”।

“গুড। হতভাগা ঘোরি তো এসেছেই টাকা চাইতে। ওখান থেকে সাত নিয়ে এসো তো। অর্থ দপ্তরে এই খরচের হিসেব পাঠিয়ে, ইমিডিয়েট ক্যাশের জন্যে রিকুইজিসন পাঠাও”।

““কন্টিনজেন্সিস ফর মিলিট্যান্ট অ্যাকশনস” হেডেই খরচটা দেখাবো তো, স্যার?”

“তুমি কি এখানে নতুন নাকি রাজিয়া?” একটু বিরক্ত হয়ে সুলতান মামুদ বলল, “আমরা যে এতিমখানার জন্যে দানত্র খুলিনি, সে কথা কি তুমি জানো না?”  

“জানি, স্যার, কিন্তু তাও একবার কনফার্ম করে নিলাম। কত টাকার জন্যে রিকুইজিসন পাঠাবো স্যার?”

“আপাততঃ কুড়ির জন্যে পাঠাও – তারপর দেখছি...”।

“ওকে স্যার”।

 

সুলতান মামুদ নিজের চেয়ারে বসার একটু পরেই রাজিয়া এল – হাতে বেশ বড়ো একটা সুটকেশ। বেশ ভারি, বয়ে আনতে তার কষ্ট হচ্ছিল। দরজা বন্ধ করে সামনে এসে বলল, “সাত কোটি আছে, স্যার”।

“গুড, মিনিট দশেক পরে ঘোরিকে পাঠিয়ে দিও। আর দেখ এ সময় কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে”।

“ঠিক আছে, স্যার”।

রাজিয়া ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই সুলতান মামুদ হাল্কা দ্রুত পায়ে দরজাটা লক করে এল নিঃশব্দে। তার সিটের ডানদিকের ক্যাবিনেট থেকে বের করল বেশ বড়ো একটা সবুজ রঙের সুটকেশ। দ্রুত হাতে সেটা খুলল, খুলে ফেলল রাজিয়ার রেখে যাওয়া সুটকেশটাও। তারপর রাজিয়ার সুটকেশ থেকে সাড়ে ছ কোটির নোট গুণে ভরে নিল সবুজ রঙের সুটকেশে। সেটাকে লক করে রেখে এল আগের ক্যাবিনেটে। তারপর বাকি টাকা সমেত রাজিয়ার সুটকেশটা বন্ধ করে চেয়ারের পাশে বাঁদিকে রাখল। আগের মতোই হাল্কা পায়ে হেঁটে নিঃশব্দে খুলে দিল তার চেম্বারের লক।

ফিরে এসে স্লিপ মোডে চলে যাওয়া ল্যাপটপের ঘুম ভাঙাল। তারপর চেয়ারে বসে ইন্টারকমে বলল, “রাজিয়া, ঘোরিকে পাঠিয়ে দাও”। এরপর সবুজ রঙের একটা ফোনের রিসিভার নিয়ে গম্ভীর মুখে কিছু শুনতে লাগল, আর মাঝে মাঝে, “হুঁ”, “জি স্যার”... বলতে লাগল। এই সময়েই চেম্বারের দরজা খুলে মুণ্ডু দেখাল ঘোরি। সুলতান মামুদ গম্ভীর চালে তাকে হাতের ইশারায় ভেতরে আসতে বলল।

ঘোরি টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইল। সুলতান মামুদ চেয়ার ঘুরিয়ে ফোনের কাল্পনিক কথা শুনতেই লাগল আর আগের মতোই মাঝে মাঝে “হুঁ”, “জি স্যার” বলতে লাগল। মিনিট পাঁচেক পর ফোন রেখে খুব জোরে নিঃশ্বাস ফেলে, টাইয়ের নট ঢিলে করতে করতে টেবিলে রাখা গেলাস থেকে জল খেল অনেকটা। তারপর হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁটের জল মুছে বলল, “আরেঃ দাঁড়িয়ে কেন, বসো”।

ঘোরি উল্টোদিকের চেয়ারে বসতেই সুলতান মামুদ খুব শ্লেষের সঙ্গে বলল, “অবশ্য বসেই তো আছো সারাদিন – নিশ্চিন্তে, দিব্য আরামে...। এদিকে আমার যে কী অবস্থা – এই মাত্র বিদেশ থেকে ফোন এসেছিল, বলছে, হিন্দুস্থানে ভালো মতো কোন কাণ্ড ঘটাতে না পারলে, আর একটা টাকাও দেবে না। যাচ্ছেতাই কথা শোনালো। বলল, আমরা টাকা দিই কাজের জন্যে – আমাদের বসিয়ে বসিয়ে খাওয়া আর ফূর্তি করার জন্যে নয়...”।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সুলতান মামুদ, আড় চোখে দেখল ঘোরি মাথা নীচু করে গোমড়া মুখে তার কথা শুনছে। তারপর আবার বলল, “বসে বসে শুনতে হল, বুঝেছ? বুক বাজিয়ে উত্তর দেওয়ার মতো কোন কাজ, আমরা করতেই পারলাম না বহুদিন। যাই হোক, তোমার কী বলার আছে বলো, তবে আগেই বলে রাখছি তোমার শুকনো কথায় আর কিন্তু চিঁড়ে ভিজবে না...”।

ঘোরি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, “এবার এমন কাণ্ড ঘটাবো গোটা হিন্দুস্থান চমকে উঠবে!”

“আচ্ছা? বলো কি?” বিদ্রূপের সুরে সুলতান মামুদ বলল, “তোমার কথা শুনে আমিই তো চমকে উঠছি”।

“ঠাট্টা করছেন স্যার? আমাদের পরিকল্পনা শুনলে আপনি আশ্চর্য হয়ে যাবেন, বলবেন এমন সহজ বুদ্ধিটা আমাদের মাথায় আগে আসেনি কেন?” সুলতান মামুদ কিছু বলল না, তাকিয়ে রইল ঘোরির মুখের দিকে। ঘোরি আবার বলল, “পহলগামে এই সময়ে হিন্দুস্থানের নানান প্রান্ত থেকে অনেক টুরিস্ট আসে স্যার – তাদের প্রায় সবাই হিন্দু। এবার ওদের টার্গেট করছি। একথা আপনাকে আগেই বলেছিলাম স্যার। জেহাদিদের ছোট্ট একটা দল অলরেডি ভারতে ঢুকিয়ে দিয়েছি। তার মধ্যে দুজন আমাদের এদিকের, অন্য দুজন হিন্দুস্থানের লোকাল ছেলে - কাশ্মীরী। দু-তিন দিনের মধ্যেই তারা অ্যাকশনে নামবে...”।

মুখের সামনে মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বিরক্তমুখে সুলতান মামুদ বলল, “ফুঃ মোটে চারজন জিহাদি? এতদিন ধরে তোমার পিছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢাললাম, এখন তুমি মোটে চারজন জিহাদির গল্প শোনাচ্ছো?”

“পুরোটা শুনুন না স্যার – বড়ো দল নিয়ে কাজ করার অনেক ঝামেলা – বর্ডার পার করা, ও পাশের গ্রামে ঢুকিয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা...। আজকাল হিন্দুস্থানের মিলিটারিরা খুব সতর্ক হয়ে গেছে স্যার – বড় দলের কয়েকজন ধরা পড়লে পুরো অভিযানটাই ভেস্তে যায়। ওদের মধ্যে দু একজন জিহাদি হিন্দুস্থানের মিলিটারিদের মারের ঠ্যালায় প্রায় সব কথাই বলে দেয়। হিন্দুস্থানি মিলিটারি বড়ো নিষ্ঠুর হয় স্যার, আমাদের মতো থোড়ি তাদের প্রাণে দয়ামায়া আছে!

এবারে তাই চারজনের ছোট্ট দল। বন্দুক নিয়ে টুকটুক করে টুরিস্ট স্পটে যাবে। টুরিস্টদের পরিবারগুলোকে ধরে জিজ্ঞাসা করবে, তুই হিন্দু না মুসলিম। হিন্দু বললেই গুলি...শেষ...। মুসলিম বললেও রেহাই দেওয়া হবে না, বলবে কলমা পড় – না পারলে সেও খতম। তবে সবাই নয়, মরবে শুধু পরিবারের পুরুষটা - মানে স্বামীরা। তাদের বিবিরা চোখের সামনে দেখবে তাদের সোহরের মৃত্যু। ছেলেমেয়েরা দেখবে তাদের বাপ এক গুলিতেই কেমন লটকে পড়ে!”

সুলতান মামুদ অবাক হয়ে বলল, “পরিবারের সবাই নয় কেন? তাতে তো আমাদের লাভ – মরার সংখ্যাটা বেড়ে দুগুণ-তিনগুণ হয়ে যাবে...”।

“তা যাবে স্যার কিন্তু বেঁচে থাকা বউ আর ছেলে-মেয়েদের অবস্থাটা কী হবে চিন্তা করুন, স্যার। রাগ, দুঃখ, শোক, ঘৃণা, হতাশা...হিন্দুস্থানের জনগণ এই দৃশ্য যখন মিডিয়ায় দেখবে স্যার - হিন্দুস্থানের নানান প্রদেশের লোকের মনেও একই প্রভাব পড়বে... ব্যস্‌, হিন্দুরা ঝাঁপিয়ে পড়বে ওদেশের মুসলমানদের ওপর। আর হিন্দুরা মারলে আমাদের কওমের লোকেরাও কী ছেড়ে দেবে স্যার, শুরু হয়ে যাবে দাঙ্গা। আগুন জ্বলে যাবে ভারতের সব প্রান্তে...। আমাদের কিচ্ছু করতে হবে না, স্যার, নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করেই হিন্দুস্থানের কোমর ভেঙে যাবে...। এপার থেকে আমাদের শুধু চিৎকার করে বিশ্বকে জানাতে হবে – হিন্দুস্থানে সংখ্যালঘুদের নিধনযজ্ঞ চলছে...হিউম্যান রাইট্‌স, ইউএন, আমেরিকা, রাশিয়া, সৌদি, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড, অস্ট্রেলিয়া – সর্বত্র ঢিঢি পড়ে যাবে হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে...ঘরে বাইরে, হিন্দুস্থানের দফারফা”।

প্ল্যানটা সুলতান মামুদের মন্দ লাগল না। খরচ কম, হ্যাপা কম, কিন্তু মুনাফা বিস্তর। ঘোরিব্যাটা ভালই ধুরন্ধর তো! কিন্তু মুখে বলল, “আমি কিন্তু অত কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তুমি স্বপ্ন দেখালেই আমিও সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে যাবো, এত বোকা আমি নই, ঘোরি। তবে ব্যাপারটার মধ্যে নতুনত্ব আছে – দেখ কী হয়। কবে করছো – কী করছো, তারপর কী কী ঘটছে সব কিন্তু লক্ষ্য রাখব আমি। এখন এস, আমার এখন অনেক কাজ। তোমার এই প্ল্যানের কথা, আমাদের বিদেশী বন্ধুদের এখনই জানাতে হবে, নইলে টাকা-পয়সা পাবো না। তুমি তো কাজ হলেই টাকার জন্যে আমার কাছে হত্যে দিয়ে পড়বে”।

“কিন্তু আজকে কিছু টাকা তো আমাকে দিতেই হবে, স্যার – আজকে সন্ধের মধ্যে হাওলায় পাঠালে – পরশু সকালের মধ্যে ওরা কাজে নামবে”।

“আমার কাছে সামান্য কয়েক লাখ পড়ে আছে সেটাই তোমাকে দিতে পারি – ওতেই  আপাতত কাজ চালাও। তারপর তো আমি আছিই”।

“লাখ? লাখে কী হবে স্যার? আমার এক কোটি চাইই চাই। না হলে খুব বিপদে পড়ে যাবো। তীরে এসে তরী ডুববে, স্যার। আর একথা চাউর হয়ে গেলে – একটা ছেলেকেও আর জিহাদে নামাতে পারবো না... কেউ আসবে না”।

“টাকা কি গাছে ফলে ঘোরি, যে নাড়া দেব আর ঝর ঝর করে এক কোটি নেমে আসবে? দশ টাকা যোগাড় করতে কত হেনস্থা আমাকে সহ্য করতে হয় কোন ধারণা আছে, তোমার? বললাম তো আমি দেখছি কী করা যায় – এক কোটি তো কোন প্রশ্নই নেই। আচ্ছা একটা কথা বলো তো, জিহাদ তো আমাদের ধর্মে একটা পবিত্র কর্তব্য – তার জন্যে ছেলেরা এত টাকা চায় কেন? বোঝাতে পারো না, টাকার থেকে জন্নত অনেক বড়ো?”

তেঁতো খাওয়া মুখে ঘোরি বলল, “আপনাকে আগেই তো বললাম, সে সব দিন আর নেই স্যার – এখন সবার মুখেই শুধু টাকা আর টাকা। কোটি না হোক, কমসেকম পঞ্চাশ লাখ স্যার দিতেই হবে, না হলে খুব বিপদে পড়ে যাবো, স্যার”।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মামুদ বলল, “টাকা থাকলে কি আমি তোমাকে দিই না, বলো? কোনদিন না করেছি? কিন্তু এখন অবস্থা আগের মতো নেই – আমাদের দেশের অবস্থা তো জানোই – দাল আনতে রুটি ফুরোয়। ফরেন থেকেও আগে যেমন ফান্ডিং হত – আজকাল তেমন আর হচ্ছে না। দেখছ না, পয়সাওয়ালা মুসলিম দেশগুলোও আজকাল হিন্দুস্থানের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। তারা এই জিহাদি-টিহাদি নিয়ে তেমন আর ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে না। তোমার অবস্থাটা আমি বুঝছি, ঘোরি, কিন্তু বিশ্বাস করো আমি নাচার। আপাততঃ বিশ লাখ নিয়ে যাও। তবে তোমাকে কথা দিচ্ছি – হিন্দুস্থানের বুকে একটা জমাটি ঘা মারতে পারলে, তোমাকে এক কোটিই দেব। তেমন তেমন হলে বেশিই দেব”।

ঘোরি হতাশ মুখে বলল, “বিশ নয়, স্যার, ওটা পঁচিশ করুন – নয়তো একদম মারা পড়ে যাবো”।

মামুদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ঘোরির মুখের দিকে, তারপর চেয়ারের বাঁদিকে রাখা রাজিয়ার সুটকেশটা তুলে টেবিলের ওপর রাখল। সুটকেশ খুলে পঁচিশ লাখ বের করে ঘোরির সামনে রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমার কথা আমি যথাসাধ্য রাখলাম, ঘোরি, কিন্তু তুমি যদি তোমার কথা না রাখো...”।

ঘোরি টাকার বাণ্ডিলগুলো চটপট তুলে নিজের ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, স্যার হিন্দুস্থানে আগুন জ্বলবে...আর আপনিও আমায় দু হাত ভরে ইনাম দেবেন। তাহলে আসি, স্যার – টাকাটা এখনই পাঠাতে হবে সীমান্তে”।

“এসো”।

 ঘোরি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে মামুদ ফোনে ডেকে নিল রাজিয়াকে। রাজিয়া ঘরে আসতে তার হাতে সুটকেশ তুলে দিয়ে বলল, “এতে পঁচিশ আছে রাজিয়া – অনেক দরদাম করে ছয়–পঁচাত্তরে রাজি করালাম ঘোরিটাকে...। নিয়ে যাও। আর শোনো, লাঞ্চ পর্যন্ত কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে”।

রাজিয়া মুচকি হেসে উত্তর দিল, “থ্যাংকিউ স্যার” এবং সুটকেশ নিয়ে বেরিয়ে গেল। সে জানে এই পঁচিশ লাখের কোন হিসেব নেই এবং স্যার জেনেশুনেই এই টাকাটা তার হাতে তুলে দিল। ছপ্পর ফেঁড়ে এমন উপরি টাকা মাঝে মাঝেই তার হাতে চলে আসে। স্যার এখান থেকে কত সরাল সে জানে না, জানার দরকারই বা কি? এটুকু সে জেনে গেছে স্যারের সঙ্গে কাজ করার মজাই আলাদা।

 

 রাজিয়া চেম্বার থেকে বেরিয়ে যেতেই মামুদ উঠে গিয়ে আবার জানালার সামনে দাঁড়াল। নীচের শহরের দিকে তাকিয়ে ঘোরির নতুন পরিকল্পনাটা নিয়ে ভাবতে লাগল। মুখে স্বীকার না করলেও, হতভাগা যে বেড়ে প্ল্যান করেছে – এ বিষয়ে তার সন্দেহ নেই। পহলাগামে বেছে বেছে হিন্দুদের কোতল করতে পারলে, হিন্দুস্থান যে উত্তাল হয়ে উঠবে, সেটাও নিশ্চিত। তবে ঘোরি যেটা বলল, হিন্দুস্থান জুড়ে দাঙ্গা-ফাসাদ শুরু হয়ে যাবে – তেমনটা তার মনে হয় না। ওদেশের সাধারণ হিন্দুগুলোও তাদের দেশের জনগণের তুলনায় অনেক বুদ্ধিমান। এমনকি ওখানকার মুসলমানগুলোও। হিন্দুরা গুচ্ছের মূর্তি-দেব-দেবীর পুজো-টুজো করে ঠিকই – কিন্তু তাদের কেউই বিশ্বাস করে না – মরার পরে তারা স্বর্গে যাবে। স্বর্গে ঊর্বশী-টুর্বশী নামের কারা যেন হুরিপরি আছে – তাদের কোলে বসে ফূর্তি করবে, একথা কেউ স্বপ্নেও ভাবে না। আর দীর্ঘদিন হিন্দুদের সঙ্গে থেকে, ওদেশের মুসলমানদের মধ্যেও ক্বচিৎ কেউ বিশ্বাস করে – এন্তেকালের পর জন্নতে গেলেই হুরি-পরিরা লুফে নেবে আমাদের। সেই জন্যে হিন্দুস্থানে জিহাদিতে বিশ্বাস করে চট করে কেউ জঙ্গী হয় না, তারা জঙ্গী হয় শুধুমাত্র প্রচুর টাকার লোভে। এদেশে জিহাদিদের টাকার লোভ নেই, তা নয় - আছে, তবে কম। তাদের বেশি আগ্রহ একটা দুটো জিহাদ নামিয়ে শহীদ হতে পারলেই – জন্নতে গিয়ে হুরিদের সঙ্গে হৈহুল্লোড়ের মজা।        

কাজেই ছোটখাটো দু একটা দাঙ্গা হয়তো বাধবে – কিন্তু অত বড়ো দেশের কাছে সেটা নস্যি। বরং বিপদ আসতে পারে অন্য দিকে। বেছে বেছে সাধারণ হিন্দু নাগরিককে মারলে, ওদেশের জনগণ ক্ষেপে উঠবে – রেগে যাবে ওদেশের প্রশাসন। এর আগেও ওরা দুবার সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে – কিছু জঙ্গী আস্তানা ধ্বংস করেছে। এবারেও হয়তো তাই করবে। হয়তো একটু বেশিই করবে। কিন্তু তাতে মামুদদের কত আর ক্ষতি হবে? বরং লাভ হবে অনেক বেশি। হিন্দুস্থানের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে, প্রত্যাঘাত হানার জন্যে বিদেশী মুসলমানেরা দুহাত ভরে টাকা ঢালবে, মামুদের পকেটে। মুচকি হেসে মামুদ ভাবল, ইংল্যাণ্ডের কান্ট্রি সাইডে অলরেডি তার বিশাল এক বাংলো রয়েছে। হিন্দুস্থান সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করলে, সস্তায় ভালো দ্বীপ কোথায় পাওয়া যায়...তার জন্যে তাকে আবার মাথা ঘামাতে হবে।

জ্ঞান হওয়া থেকে, হিন্দুস্থানের নাম শুনলেই মামুদের গাত্রদাহ হয়। ব্যাটারা একই বছর, আমাদের কয়েক ঘণ্টা পরে স্বাধীন হল। অথচ এই ক বছরে সবদিকেই এমন এগিয়ে গেল – অথচ আমরা রয়ে গেলাম কয়েক শতক পিছনে। হতভাগারা কাফের – কোন ধর্ম নেই – ধর্মের থেকে বেশি মন দেয় লেখাপড়ায়, গবেষণায়, কাজেকর্মে। মামুদরা মুখে স্বীকার না করলেও, মনে মনে জানে – হিন্দুস্থানের লোকগুলো সর্বদা শান্তি-শান্তি করলেও – প্রয়োজনে ভালো যুদ্ধও করে। তিনবার যুদ্ধে তাদের যা নাকানি চোবানি খাইয়েছিল – একাত্তরের যুদ্ধে তো মামুদদের ল্যাজে-গোবরে করে ছেড়েছিল হিন্দুস্থান। তখন মামুদ অবশ্য ছোট ছিল – কিন্তু বড় হতে হতে সে কাহিনী যত শুনেছে মামুদ – তত বেড়েছে তার মনের জ্বালা।

এই সব নানান ভাবনা চিন্তা করতে করতে হঠাৎ একটা কথা মামুদের মনে হল। আজকাল সারা বিশ্বে যা দেখা যাচ্ছে – ট্যাংক আর কামান নিয়ে সরাসরি সেনাযুদ্ধ তেমন আর হচ্ছে না। সবই হচ্ছে দূর থেকে। নিজেদের সীমান্তে বসেই ফাইটার বিমান থেকে কিংবা মাটি থেকে মিসাইল ছুঁড়ছে – ড্রোন পাঠাচ্ছে। সেগুলো উড়ে গিয়ে আঘাত হানছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। হিন্দুস্থান যদি সেভাবেই যুদ্ধে নামে? জঙ্গীঘাঁটিগুলো এবং আমাদের সেনাঘাঁটিতে যদি অমন মিসাইল বা ড্রোন হামলা চালায়? আমাদের কাছেও অমন যুদ্ধ অস্ত্র অনেক আছে। আমরা কিনেছি আমেরিকা, চিন, তুর্কি এবং আরও কয়েকটা দেশ থেকে। অবশ্য সে সব অস্ত্র বেশ কয়েক বছরের পুরোনো। কারণ কোন দেশ কি আর তাদের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম অন্য দেশে বিক্রি করে? তাই হয় নাকি? বাঙ্কারে পড়ে জং ধরতে থাকা বেশ কবছরের পুরোনো সেই সব অস্ত্র, তারা আমাদের মতো দেশকে বেচে বাঙ্কার খালি করার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছেতাই মুনাফাও করে।

মামুদ জানে হিন্দুস্থানও সেরকম কিছু কিনেছে – ফ্রান্স থেকে, রাশিয়া থেকে। কিন্তু সেগুলো কি আমেরিকা বা চিনের অস্ত্রগুলোর থেকেও সরেস নাকি নিরেস? কে জানে? তবে একথাও ঠিক বিগত কয়েক বছরে হিন্দুস্থান যে পরিমাণে রকেট ওড়াচ্ছে – চাঁদে, মঙ্গলে, মহাকাশে। যেভাবে হিন্দুস্থানের সস্তার রকেট বহুদেশের উপগ্রহগুচ্ছ   বগলে নিয়ে ঠিকঠাক পৌঁছে দিচ্ছে তাদের নির্দিষ্ট কক্ষপথে! সে সব কথা সারা বিশ্বই জানে। সেই টেকনোলজিরই একটু এদিক-ওদিক করে কিছু মিসাইল-টিসাইল বানিয়ে ফেলেনি তো? কিছু কিছু খবর যে কানে আসে – আকাশ, ব্রহ্মস, অগ্নি, পৃথ্বী – সেগুলো কি সত্যি? যদি সত্যিও হয়, সেগুলো কাজের সময় কাজ দেবে কিনা কে জানে? আমেরিকা বা চিনের টেকনোলজির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো বিদ্যে-বুদ্ধি কাফেরগুলোর মাথায় আছে বলে, মামুদের মনে হয় না। তবে আরও আশ্চর্য ব্যাপার হল, হিন্দুস্থানের এই উন্নতির পিছনে রয়েছেন একজন মুসলমান, ডঃ এপিজে আব্দুল কালাম। ইসলামিক দেশের কথা এতটুকু চিন্তা না করে, কাফেরের দেশের জন্যেই তিনি কেন যে সারা জীবনটা উৎসর্গ করলেন, খোদায় মালুম।

হিন্দুস্থানের প্রতি তীব্র ঈর্ষার কারণে, তাদের উন্নতির কথা যদিও মামুদের মনে খুব বেশি দাগ কাটল না। সে চিন্তা করল, এসব তেমন কিছু নয় – অধিকাংশই মিথ্যা প্রচার। ও নিয়ে খুব বেশি ভাববার কোন কারণ এখনও ঘটেনি। তবে এটাও ঠিক হিন্দুস্থান যে দুটো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছে – সেখানে ওদের নীতি ছিল অসামরিক কোন মানুষকে অথবা প্রতিষ্ঠানকে ওরা আঘাত হানবে না। শুধু বলা নয় – করেও ছিল তাই। ঠিকঠাক জঙ্গীঘাঁটিগুলোই ধ্বংস করেছিল। যদিও মামুদরা তীব্র গলা ফাটিয়ে মিথ্যে প্রচার করেছিল – ওই দুই হামলায় প্রচুর সাধারণ জনতা, মহিলা ও শিশু মারা গিয়েছে।

মিথ্যে কথা বারবার প্রচার করে সেটাকে সত্য করে তোলা মামুদদের বাঁ হাতের খেলা। সে জানে ওই মিথ্যে প্রচারই তার দেশবাসী বিশ্বাস করেছে এবং গোগ্রাসে গিলেছে। কিন্তু মনে মনে মামুদ জানে, হিন্দুস্থানের কথাগুলো মোটেই মিথ্যে নয়। এবং সেটাই খুব চিন্তার বিষয়। কারণ এই নীতি ঠিকঠাক অনুসরণ করলে, হিন্দুস্থান কোনদিনই হয়তো আর ট্যাংক, কামান নিয়ে স্থলযুদ্ধ কিংবা বিমান যুদ্ধ করবে না। কারণ তাতে বহু গ্রাম, জনপদ ও শহরের সাধারণ মানুষের প্রাণ যাবে। তার মানে দাঁড়ায়, মিসাইল-ড্রোন নিয়ে আধুনিক যুদ্ধের চাবিকাঠি হিন্দুস্থানের পকেটে যথেষ্ট পরিমাণে আছে। যা দিয়ে তারা, সাধারণ গ্রাম-শহর ডিঙিয়ে জঙ্গীঘাঁটি, সেনাঘাঁটি এমনকি এই সেনা সদর-দপ্তর – যেখানে সে দাঁড়িয়ে নতুন একটা দ্বীপ কেনার স্বপ্ন দেখছে – সেখানেও অনায়াসে আঘাত হানতে পারে!

এই ভাবনাটা শীতল স্রোত হয়ে নেমে এল মামুদের শিরদাঁড়া বেয়ে। সে দ্রুত টেবিলে ফিরে গিয়ে ফোন করল বিবিকে।

“হ্যালো, মমতাজ”?

“বলো, তোমার মিটিং-টিটিং হয়ে গেল? কখন আসছ লাঞ্চ করতে?”

“এই একটু পরেই বেরোব। একটা কথা বলো তো – আজ রাত্রেই যদি তুমি-আমি লণ্ডনে রওনা হই, রেডি হতে পারবে?”

“কত দিনের জন্যে”?

একটু চিন্তা করে মামুদ বলল, “ধরো অনেকদিনের জন্যে। হয়তো বছর খানেক, কিংবা তারও বেশি – হয়তো চিরকালের জন্যে”।

“কী বলছো? অতদিনের জন্যে হলে – সব মালপত্র গুছিয়ে, আজকের মধ্যে রেডি হওয়া সম্ভব নাকি?”

“ঠিক আছে, আজ না হলে কাল রাত্রে?”

“তা হয়তো হয়ে যাবে – কোন ফার্নিচার বা গ্যাজেট, কিচেনের ইউটেন্‌সিল কিচ্ছু নেবে না তো? শুধু টাকা-পয়সা, গয়নাগাঁটি, জামাকাপড় এই সব - তাই তো?”

“এক্স্যাক্টলি, গুলি মারো, বাকি জিনিষপত্রে, – ইউকের বাংলোতে আমাদের কোন কিছুর অভাব আছে?”

“কিন্তু কী ব্যাপার বলো তো? দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছ কেন?”

“পালাচ্ছি না, তোমাকে রেখে আমি ফিরে আসব। ছেলেমেয়েদের নিয়ে তুমি ইংল্যাণ্ডেই থেকে যাবে – ওরা ওখনেই লেখাপড়া করবে”।

“কেন? হিন্দুস্থানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাচ্ছো নাকি?”

“মমতাজ, আমাদের ঘরে বাইরে সর্বত্রই এখন শত্রু – একদিকে বালুচ, সিন্ধ, পাখতুনখোওয়া, সেই দেখে আমাদের হাতিয়ে নেওয়া কাশ্মীরও আজকাল ছটফট করছে...। আর হিন্দুস্থান তো আছেই – চিরকালের শত্রু”।

“হিন্দুস্থানকে শত্রু বলছ বটে, কিন্তু ওরা কোনদিন গায়ে পড়ে যুদ্ধ করতে আসেনি – তোমরাই বরং পায়ে পা দিয়ে বারবার যুদ্ধ বাধিয়েছ, এবং প্রতিবারই হেরেছো। এখন আবার লাগাতার জঙ্গী ঢুকিয়ে ওদের জ্বালিয়ে মারছো...”।

মামুদ একটু মজা করে বলল, “সামনাসামনি জঙ্গে হেরে যাই বলেই তো জঙ্গী ঢুকিয়ে ওদের উত্যক্ত করার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, জানেমন। আমাদের লোক মরছে কম, ওদের মরছে বেশি। তার ওপর যুদ্ধের থেকে অনেক কম খরচ”।

“কিন্তু আমাদের দেশের পরিস্থিতি কোথায় নিয়ে গেছ, সেটা ভেবেছো? সাধারণ মানুষের কাজ নেই, ব্যবসা নেই, দুবেলা দুটো রুটি জোটাতে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া লাটে তুলে দিয়েছো...এরপর দেশের লোক তোমাদের ছেড়ে দেবে?”

“আমাদের ছেলেমেয়েরা ইংল্যাণ্ডে্র সেরা স্কুলে-কলেজে পড়ছে। আমরা রাজার হালে নিশ্চিন্তে থাকবো ইংল্যান্ডের বাংলোতে। সাধারণের জন্যে চিন্তা করব পরে। তার আগে ভারতকে যে করে হোক নাকাল করতে হবে, নিজেদের নাক কেটে হলেও”।

“কিন্তু আমাদের চলবে কী করে? আমেরিকা, চিন, তুর্কিদের থেকে ঋণ করে আর ভিক্ষে করে তোমরা দেশ চালাচ্ছো, কিন্তু কতদিন – একদিন তো সবাই মুখ ফেরাবে, তখন?”

“সে গুড়ে বালি, জানেমন। যাদের কথা বললে তারা সবাই জানে আমরা জঙ্গী তৈরী করি, আমাদের দেশে সন্ত্রাসের চাষ হয়। কিন্তু সে কথা জেনেও ওরা আমাদের ঋণ কেন দেয় জানো? ভারত যেন বেশি বাড়তে না পারে। আসল কথাটা কি জানো, ইসলামিক দেশগুলো চায় না, একটা হিন্দু দেশ হুহু করে উন্নতি করুক। আবার আমেরিকা, ইওরোপের মতো সাদা চামড়ার দেশগুলোও চায় না, ভারতের মতো বাদামি চামড়ার দেশ তাদের সঙ্গে টেক্কা দিক। চিন চায় না, তার প্রতিবেশী দেশ ভারত তাকে ডিঙিয়ে যাক।

কাজেই মুখে তারা যতই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলুক, শান্তির বাণী দিক, তারা সবাই চায় ভারতকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখতে। আর সেই কাজটাই আমরা করছি। তার জন্যেই তারা আমাদের ঋণ দেয় – আর সেই ঋণের টাকাতেই আমরা ওদের থেকে পুরোন- জংধরা অস্ত্র প্রচুর দাম দিয়ে কিনি। ওদের দুদিকেই লাভ – আর আমাদের লাভ দুনম্বরি করে প্রচুর কালো টাকা উপার্জন। একটা জঙ্গীর পেছনে আমাদের কত খরচা হয় বলো তো? খুব জোর হলে দশ-পনের লাখ, কিন্তু তার বদলে আমাদের পকেটে আসে কোটি। আমাদের দেশের লোকের কাজ নেই বলছিলে না? প্রচুর জঙ্গীর কাজ রয়েছে। হাতে পেয়ে যাবে পাঁচ-দশ লাখ টাকা, থাকা-খাওয়া ফ্রি...মরে গেলে শহীদের সম্মান। জিহাদে মারা গেলে, হাতের মুঠোয় তারা পেয়ে যাবে জন্নতের সুখ। দেশের যুবকদের আমরা কত বোঝাচ্ছি – আমাদের ডাকে তারা ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে না কেন?          

রাজনীতির এত সব মারপ্যাঁচ তুমি বুঝবে না, জানেমন। আমরা বুঝি, তাই আমাদের মতো সেনাপ্রধানদের আছে অগাধ টাকা। ইউকেতে সম্পত্তি। ইউকের নিরাপত্তা”।

“আচ্ছা, ইউকের ব্যাংকাররা তো নিশ্চয়ই বোঝে তোমাদের যে টাকা ওদের ব্যাংকে রয়েছে – সেটা দুর্নীতির টাকা। এর বিরুদ্ধে ওদেশে কোন আইন নেই?”

হো হো করে হাসল মামুদ, তারপর বলল, “আমাদের মতো লোককে ওরা মাথায় করে রাখে জানেমন। বললাম না, সাদা চামড়াদের যত বাণী সব মুখে, আদতে ওরা চিরকালের ধুরন্ধর স্বার্থপর আর ধান্দাবাজ। আমার সম্পদের লোভে ওরা চোখ বন্ধ করে থাকবে – আর আমাদের কঠোর নিরাপত্তা দেবে। যাই হোক তুমি গোছগাছ করে রেডি হও। আমি ঘন্টা খানেকের মধ্যে আসছি”।

“আগামী কাল যাবে বলছো, এত কম সময়ে ফ্লাইটের বুকিং পাবে?”

হাল্কা হেসে মামুদ বলল, “তুমি সাধারণ নও জানেমন, তুমি এদেশের অসাধারণ এক ভিআইপির বিবি। তোমার জন্যে থাকবে চার্টার্ড প্লেনের ব্যবস্থা। আমরা ছাড়া সে প্লেনে আর কেউ থাকবে না। সাধারণ লোকের চোখের আড়ালে, রাতের অন্ধকারে তোমায় নিয়ে আমি উড়ে যাবো সব পেয়েছির দেশে। উচ্ছন্নে যাক না,  অন্ধকার অভাগা এই দেশ...বেঁচে থাক আমাদের জঙ্গী বাণিজ্য”।                 

                -০-০-

    [সব চরিত্রই কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে কোন মিল নেই।]                   

                    

 

 

     

 

 

 

                          

                      

  

                                     

                       

         

      

সোমবার, ২৩ জুন, ২০২৫

প্রতিবাদের আলো

  'আমাদের দেশে গরমকালটাই বেশ, জানেন বাবু। এই দ্যাকেন না, সাড়ে ছটা পার হয়ে গেল, একনো আকাশে আলো বাজতিচে। সু্য্যি ডুবে গ্যাচে ঠিকই, কিন্তু আলোর রং আর জুলুসে কেমন মাকামাকি হয়ে গিয়েচে আকাশখান। দিব্যি একখান বেনিয়ান গায়ে লদির ধারে হাওয়ার মজা লিচ্ছি আমরা। আর এ যদি হত শীতকাল? বাসরে – এতক্ষণ চারদিক আঁধার। লদির বুক থেকে গুঁড়ি মেরে উঠে আসত চাপ চাপ কুয়াশা। আর এদিকে মানুষগুলান কোতায় পিরেন, কোতায় চাদর, মাথা মুড়ো ঢেকে, কাঠের আগুন জ্বেলে জবুথবু – লদির ধারে বসার সাহস হত কারো? বলেন না, হতো’?

ধীরেন এভাবেই কথা বলে। ওর সব কথাতেই থাকে দর্শনের ছোঁয়া আর জীবনের অদ্ভূত আস্বাদ। এই চায়ের দোকানটা ধীরেনের আর আমি রোজই সন্ধের ঝোঁকে আসি, এখানে চা খেতে। নদীর পাথুরে কিনারায় একটা বেঞ্চি পেতে দেয় ধীরেন, কাঁচের গ্লাস ভরা ঘন দুধের চা খাই আর ওর কথা শুনি। নদীর আওয়াজ শুনি। বাঁদিকে খানিকটা নীচেয় আছে শ্মশান – সেখান থেকে মাঝে মধ্যে শ্মশানযাত্রীদের হরিধ্বনি - তাও শুনি। আর চিন্তার জাল বুনি। সব মিলিয়ে বেশ লাগে। ধীরেনের ভাষায় বললে, বলতে হয় “জেবনের রসে জ্যাবজ্যাবে”। ধীরেন এমনই সব কথা বলে আর সুন্দর হাসে। হাসলে তার চোখ ছোট হয়ে যায়, চোখের কোণের চামড়া কুঁচকে গিয়ে, চামড়ার ভাঁজ থেকে ঝরে পড়ে অভিজ্ঞতার রেণু।

ওর এই কথা, আন্তরিক হাসি ছাড়াও, ওর আছে এক অদ্ভূত মায়ার সম্পর্ক। ওর কাছে একটি মেয়ে থাকে, তার নাম ফুলি। বছর চোদ্দ বয়েস হবে বড় জোর। শামলা রংয়ের ডাগর চোখের মেয়ে। ছটফটে, চঞ্চল আর বাপের মতোই হাসিমুখি। বাপের সবকাজেই সে হাত লাগায় সমান তালে, আর আমি এসে দোকানে বসলে, যদি সে সময় খদ্দেরের চাপ কম থাকে, মেয়ে তার বাপকে আমার কাছে গল্প করার জন্যে পাঠিয়ে দেয়। ফুলি জানে, ওর বাবা কথা বলতে ভালোবাসে আর আমার মতো ভালো শ্রোতা, তার আর কে আছে?

বাবা বললাম বটে। ধীরেন কিন্তু ফুলির জনক বাবা নয়। ফুলির বাবা হয়ে ওঠার পিছনে আছে এক অদ্ভূত ঘটনা। ধীরেনের মুখে সে বৃত্তান্ত শুনে যতটা অবাক হয়েছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি মুগ্ধ হয়েছিলাম ধীরেনের প্রতি।  

‘সেদিন সকাল থিকে টানা ঝড় আর বিষ্টি। মনে হতেচিল বাতাসের ঝাপটে এই বুঝি খুলে গেল মাথার ওপর এ দোকানের চাল। বাঁশের খাঁচায় বারবার মচ মচ শব্দ উঠতেছেল হাওয়ার দাপটে। দোকানে খদ্দের নেই – বিক্রিবাটা নেই সারাটা দিন, একটু বেলার দিকে বিষ্টির ঝাপটে নিভে গেল উনুনটাও – আর জ্বালি নাই। রাধামা্দবের ইচ্চে নয় যখন, তখন তোলাই থাক না আজ, আমার বিকিকিনি। আমার বুকের খাঁচাটাও বাবু, নড়বড় করে উঠেতেচেল সেদিন। এমন দিনেই বাবু, উথাল পাথাল করে মনটা। সঙ্গী নাই সাথি নাই, মনের কথা কইবার লোক নাই, কার সাথে দুটা কথা কয়ে মনটারে হাল্কা করব, কন দেকি? ওই বেঞ্চে বসে বসেই সারাটা দিন কেটে গেল। কেউ আসে না। মনের মানুষ না আসু্‌ক, একজন খদ্দেরও এদিক মাড়ায় নাই সেদিন। খদ্দেরও তো মানুষ, নাকি বলেন। তার সাথে মনের কথা না হোক, কিছু কথা তো কওয়া যায়। চুলার আগুন মরে গেচে, মনের আগুন তো নেভে না বাবু – সে তো জ্বলতেই থাকে। সেদিন বাবু আমি ক্রাসিনের ইস্টোভও রেডি রেকেচিলাম – যদি কেউ আসে তার জন্যি চা বানাবো বলে। কিন্তু কেউ এল না। আমার বিকল মনের পরীক্ষা লিতেই কিনা কে জানে, রাধামাদব সেদিন দিনটা্রেই করে দিলেন ছোট্ট। সন্ধ্যে হবার অনেক আগেই আঁধার ঘনিয়ে এল অসময়ে। আমি দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে ঘরের ভেতর যেয়ে বসলাম। বাসরে, তাতে পকিতি আরো যেন রেগে উঠল। সে কি ঝড় তুফান, আর কি বিষ্টি। আমার দোকানে আমি ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণীও নাই, কিন্তু টিনের চালে, টিনের দেওয়ালে সে কি দাপাদাপি – মনে হয় একশ’ মানুষ হামলে পড়ে ঝাঁকাচ্চে তারে – তাদের গায়ে খ্যাপা হাতির বল। মুখে তাদের বাক্যি নাই, শুধু গর্জন – কিসের আক্রোশ, সে তারাই জানে আর জানেন রাধামাদব।

রাত তখন কত কে জানে। ঘড়ি তো নাই। ক্রাসিনের স্টোভে ভাত চড়ায়েচেলাম, সঙ্গে দুটা আলু পটল। দেওয়ালের ফাঁক ফোকরে আসা হাওয়ায় সে ইস্টোভের আগুনও সেদিন নির্জীবের মতো ভিতু ভিতু। তবু ফুটতেচিল – চাল ফুটে ভাত হওয়ার সময় বাবু – হাঁড়িও খুব কথা কয়। লক্ষ্য করেচেন কি বাবু। সে অনেক কথা। খিদের কথা। তৃপ্তির কথা। ভালোবাসার কথা। খিদের মুখে দুটো অন্নর মতো ভালোবাসা জীবকে আর কে দেয়, কন তো বাবু? আমি বেশ বুঝতে পারি – ওদের কথা। ওদের ঘ্রাণ। আমি খাটিয়ায় বসে, একমনে তাদের কথা শুনতেচিলাম আর দেখতেচেলাম ইস্টোভে নীল আগুনের কাঁপা কাঁপা শিখা। মনের অন্দরে ছিলেন রাধামাদব আর তাঁর অনন্ত লীলা। বাইরে তখন অশৈলী তাণ্ডব আর ঘরে চলতিচে অন্নের যোগাড়, এ কি রাধামাদবের লীলা নয়, কি বলেন বাবু?

সেই সময়ে ঝাঁপ পড়া দরজায় আওয়াজ উঠল ঝমঝমিয়ে। প্রথমটায় বুজিনি বাবু ভেবেচেলাম ঝড়ের বাতাসে অমন হচ্চে। বেশ অনেকক্ষণ পর কান করে যেন শুনতে পেলাম এক মেয়েমানুষের গলা – কেউ আচো, খোল না – দোরটা খোলো না একটিবার। আর তার সঙ্গে ঝমঝম দরজা ঝাঁকানোর আওয়াজ। মনে হল ভুল শোনলাম। এই দুর্যোগের রাত্রে কে আমার এই দোকানে আসতে যাবে। ভয় হল। অশরীরি কেউ নয়তো – শুনেচি এমনি রাতেই তাঁদের আনাগোনা বাড়ে। আবার মনে হল তেনাদের কাছে আমার ওই পলকা দোর কিসেরই বা বাধা? তেনাদের ইচ্চে হলে, অমনিই তো আসতে পারেন। রাধামাদব শক্তি দিলেন, বিবেক দিলেন। দোরটা খুললাম। দামাল ঝোড়ো হাওয়া আর তুমুল বিষ্টির ঝাপটার সঙ্গে ঘরে এসে ঢুকে পড়ল একজন মেয়েমানুষ। এক ঝলক দেখার পর সব অন্ধকার – ঝোড়ো হাওয়ায় আমার ঘরে জ্বলতে থাকা কুপিটা তখন নিভে গেচে।

ঝাঁপ বন্ধ করে, দেশলাই খুঁজে আবার কুপিটা জ্বালালাম আর তার আলোয় দেখলাম সেই মেয়েরে। মাথা থেকে পা অব্দি ভিজে সপসপ করচে, পরনের কাপড় চুপ্পুরি ভেজা আর কাদামাখা। মাটিতে শুয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্চে সেই মেয়ে – তার পায়ের তলার মাটি ভেসে যাচ্চে জলে আর রক্তে। মেয়েটি বাবু ভরা পোয়াতি। আমি দৌড়ে গিয়ে ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে ইস্টোভে জল চাপায়ে দিলাম। এই অসময়ে কার কাচে যাবো, এ অবস্থার মেয়েটারে নিয়েই বা এখন কি করব ভাবতেচেলাম, আর অপেক্ষা করতেচেলাম জল গরমের, ততক্ষণে শুনতে পেলাম বাবু কচি শিশুর কান্না। সেকি জোর বাবু তার গলার। বাইরের এত ঝড়ের গর্জন, বিষ্টির মাতন - সব ছাপিয়ে জেগে উঠল তার কান্না। এ নতুন জেবনের কান্না, তাকে আটকায় এমন সাধ্যি কার। কোনদিন, বাবু, সংসার ধর্ম করি নাই, রাধামাদবের নাম নিয়েই দিব্বি কাল কাটাইতেচেলাম, সেই আমার কাচেই কিনা এসে জুটল এমন ঝক্কি? এমন খেলা রাধামাদব ছাড়া, আর কেই বা খেলতে পারেন বলেন দিকি।

পেথমেই বাচ্চাটার নাড়ি কেটে মুক্ত করে দেলাম তার মায়ের বাঁধন। তারপর গরমজলে সাফসুতরো করে আমার পুরোনো ধুতির পুঁটলিতে জড়িয়ে ফেললাম তাকে। এতক্ষণ তার মাকে লক্ষ্য করি নাই, এখন মায়ের কোলে বাচ্চারে তুলে দিতে গিয়ে দেখি মায়ের অবস্থা সঙ্গীণ। বাচ্চারে কোলে নিতে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করে্চিল একবার – কিন্তু পারল না। তার চোখের দৃষ্টি তখন থির, চোকের কোলে জমে উঠেচে জল, কিন্তু তার ফ্যাকাসে ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা। বাচ্চার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার চোখ বুজে এল বাবু, আর সে চোখ মেলল না।

আচ্ছা, রাধামাদবের এ কেমন লীলা আপনি আমারে বোজান দেকি। আমি কথা বলার জন্যি মানুষ খুঁজতেচিলাম, তা না হয় সত্যি, তাই বলে এমন মানুষ। চেনা নাই, জানা নাই। কোথায় বাড়ি, কাদের মেয়ে। না আমি জানি তার কিছু, না সে আমারে জানে। অথচ দেখেন, সে চলে গেল আমার হাতে এই টুকুন এক জেবন গচ্ছিত রেখে? আমার চাল নাই চুলা নাই, রাধামাদবের ইচ্চেয় আমার দিন চলে যায় কোনমতে, সেখানে একি বিপদ কন দিকি। আজ রাতটুকুন হয়তো কোন পেকারে চলে যাবে – কিন্তু কাল সকালে? লোক আচে, জন আচে, থানা আচে, পুলিশ আচে – তা্রা কি আমারে ছেড়ে দিবে? কি করব কিছুই যখন ভেবে কূল করতে পারতেচি না, আমার কোলের পুঁটলিতে ওই মেয়ে কথা কয়ে উঠল। কি কথা কে জানে – শিশুর ভাষা বোঝার সাধ্যি তো আমার নাই বাবু। আমি ওর মুখের দিকে চাইলাম – দেখি আমার দিকেই তাকিয়ে আচে টালুক টালুক চোখে – সে দৃষ্টিতে কি যে ছেল বাবু, বলতে পারব নি। ভরসা ছেল। বিশ্বাস ছেল। সদ্যজাত শিশু আরেকজন মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে কিসের সন্ধান করে? বাঁচার পেত্যয় ছাড়া? বড়ো মায়া হল বাবু, অর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, অরে আরো জোরে চেপে ধরলাম বুকে। অর ওই ছোট্ট বুকের ধুকধুকুনি আমার বুকে এসে বাজতে থাকল, বাবু। আমি রাধামাদবকে বললাম, এ আমার কি করলে ঠাকুর, আমারে এ কি মায়ার বাঁধনে বেঁধে দিলে অচেনা অজানা কার এক শিশুর সঙ্গে?

দিনকতক বাবু এ ঘটনা নিয়ে খুব টানাপোড়েন, দৌড়ঝাঁপ, কথা চালাচালি চলল। আস্তে আস্তে একদিন থিতিয়ে গেল, মিটেও গেল সব। ও মেয়ে আমার কোলেই বড় হতে লাগল দিন কে দিন। আজ পর্যন্ত কেউ আসে নি বাবু, অর মায়ের কিংবা অর খোঁজ নিতে। ওর মায়ের কোতায় বাড়ি, কাদের মেয়ে, কাদের বউ – কিছুই জানা গেল নি বাবু। মাঝের থিকে আমার সঙ্গে জুড়ে গেল ওর নিবিড় সম্পর্ক। রাধামাদবের এ বিচিত্র লীলা নয়, কি বলেন, বাবু’?

ধীরেনের প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারিনি, কিন্তু সেদিন খুব মন দিয়ে লক্ষ্য করেছিলাম মেয়েটিকে। সপ্রতিভ সুন্দর তার ব্যবহার। একা হাতেই দোকানের প্রায় সব কাজ সামলায়, আবার বাপেরও খেয়াল রাখে পুরোদস্তুর। তার চোখের আলোয় ধরা পড়ে তার পড়ে পাওয়া বাবার প্রতি, তার এই ছোট্ট দোকানদারি দুনিয়ার প্রতি, অসীম মায়া আর ভালোবাসা।

  

 মাঝখানে চাকরি সূত্রে আমায় অন্যত্র চলে যেতে হয়েছিল। প্রায় বছর পাঁচেক পরে আবার এই মফস্বল শহরে যেদিন ফিরে এলাম, দেখলাম অনেক পাল্টে গেছে জায়গাটা। সব জায়গাতেই নিজস্ব নিয়মে লোক সংখ্যা বাড়ে, উন্নতি হয় – যুগের হাওয়া এসে নাড়িয়ে দিয়ে যায় তার সনাতন ভাবগতিক। সেটাই স্বাভাবিক।

ধীরেন আর তার মেয়ে ফুলির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, এই শহরে ফিরে এসে আবার মনে পড়ল। কাজের অবসরে একদিন সন্ধ্যেবেলা সেই নদীর ধারে ধীরেনের দোকানে গেলাম। হদিসই পেলাম না সে দোকানের। অনেক দোকান আর ঝুপড়ি গজিয়ে উঠেছে আশে পাশে। তাদের চারপাঁচজনকে জিগ্যেস করলাম ধীরেনের কথা, তার মেয়ে ফুলির কথা। কেউই জানে না ওদের সম্পর্কে, শুধু একজন আমাকে খুব সন্দেহভরে জিগ্যেস করল, আমি কে? ধীরেনের খোঁজে আমার কি দরকার? আরো সাতপাঁচ অবান্তর প্রশ্ন। আমি নির্বিবাদি ভদ্রলোক, আমি বেশি দূর আর ঘাঁটালাম না, সরে এলাম সেখান থেকে। শ্মশানের কাছেও একবার গেলাম। সিমেন্টের বাঁধানো পরিচ্ছন্ন চাতাল, নদীর ঘাটে নামার জন্যে সুন্দর বাঁধানো সিঁড়ি। আর নীচে নামার পথের ডানদিকে গড়ে উঠেছে একটি ছোট্ট নতুন কালীমন্দির। এসবই নতুন হয়েছে, আর ধীরেনের দোকানটা এই খানেই কোথাও ছিল – প্রগতির ধাক্কায় সে দোকান আজ বিলুপ্ত। মনে রেখেই বা কি লাভ? তাই ভুলেই গিয়েছিলাম ওদের কথা।

সামান্য ঠান্ডা লেগে জ্বর হওয়াতে সেদিন অফিসে বের হইনি, বাড়িতেই ছিলাম। শুয়েছিলাম আমার একলা বাসাবাড়ির বিছানায়। আধো ঘুমে আচ্ছন্ন আমার চেতনায় হঠাৎ যেন শুনলাম খুব চেনা কণ্ঠস্বর। ‘জয় গুরু। জয় রাধামাদবের জয়, কিচু ভিক্ষে পাই মা’। এ স্বর আর ওই বাচন ভঙ্গী আমার খুব চেনা – এ ধীরেন ছাড়া কেউ নয়। আমি বারান্দায় দৌড়ে গেলাম, নীচে তাকিয়ে দেখতে পেলাম ধীরেনকে। জোড় হাতে খুব সংকুচিত ভঙ্গীতে দরজার সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।

আমি ডাকলাম তাকে, ‘ধীরেন, না’? সে মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকাল। আমায় চিনতে পারল কিনা বুঝতে পারলাম না। বললাম, ‘ভেতরে এসো, কথা আছে তোমার সঙ্গে’। আমি নেমে গেলাম, নীচের বসার ঘরে। ধীরেন এসে দাঁড়াল দরজায়। বললাম, ‘দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এসো। আমাকে চিনতে পারছ না’?

‘পারচি বাবু, চিনতে পারচি’।

‘তবে? ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছ কেন, তোমার দোকান কি হল? তোমার সেই মেয়ে ফুলি কি করছে? জান, তোমার দোকানের খোঁজে একদিন গিয়েছিলাম নদীর ধারে, কেউ বলতেই পারল না তোমার খবর’? আমার কৌতূহলে আর আগ্রহে ধীরেন হাসল। তার হাসি আর আগের মতো নেই, এ হাসিতে সেই আগেকার ধীরেনকে আর পেলাম না। এ হাসি ভীষণ করুণ আর কষ্টের হাসি। ধীরেন বলল, ‘সে অনেক কথা, বাবু। যদি অনুমতি করেন, সন্ধ্যের পর এসে আপনারে শোনাতে পারি’।

‘আচ্ছা, তাই এসো’। আমিও এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম তার ভেঙে যাওয়া শরীরি ভাষা। যাবার সময় সে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল,

‘কিচু দেবেন নি, বাবু’? সে ছিল এক দোকানের মালিক, সে দোকান যত ছোটই হোক না কেন। আজ তার এই হাত পেতে ভিক্ষে করার প্রবৃত্তিতে আমি একটু বিরক্তই হলাম, তবুও পার্স খুলে তার হাতে তুলে দিলাম একটা দশ টাকার নোট। উত্তরে সে বলল – ‘জয় রাধামাদবের জয়’।

 

 ‘আমার সে দোকান দেকতে আপনি গেচলেন, বাবু? কেমন দেকলেন জায়গাটা? আমি অনেকদিন যাই না, ওদিকে। গেলে ওরা ধমকায়, চড় থাপ্পড় মারে। আর কেনই বা যাব বলেন তো, গেলেই তো সব মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় সব কথা।

ভয় জিনিষটা বাবু মানুষকে কুরে কুরে খায়। ওপর থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরটা একদম ফোঁপরা হয়ে যায়। সারাদিনে সব কাজই করবেন, কিন্তু মনের ভেতরটাতে সারাক্ষণ টিক টিক করতে থাকবে ভয়। খেয়ে শুয়ে আপনি শান্তি পাবেন নি। আমাদের সেই ভয়টাই ধরিয়ে দিয়েচেল কটা লোক। আমাদের দোকানে আসত। তাদের কুনজর পড়ল ফুলির পরে। পেথম পেথম আজে বাজে কথা বলত, আমরা গায়ে মাকতাম না। তারপর শুরু হল বাবু ওর হাত ধরে টানাটানি আর এমন সব কথা বার্তা, বাপ হয়ে সে কথা কানে তোলা যায় না। প্রতিবাদ করলাম একদিন, আমাকেও যাচ্ছেতাই বললে বাবু, বললে আমি ওর কিসের বাপ? বাপ মায়ের ঠিক নেই যে মেয়ের, সে মেয়েকে নিয়ে আমার এত পীরিত কিসের? এ পীরিত কিসের পীরিত - তারা যে ইঙ্গিত করল বাবু, সে আমি মুখে আনতে পারব নি। তারপর খুব হাসলে বাবু ওই লোকগুলো, হ্যা হ্যা করে – আমাদের ভয় পাওয়া মুখ দেখে। অপমানে আর লজ্জায় ঝলসে যাওয়া আমাদের মুখ দেখে, ওরা খুব হাসলে। দোকানে আরও অনেক লোক ছেল বাবু - কেউ চা খাচ্চিল, কেউ খাবার খাচ্চিল, তারা যেন কেউ শুনতেই পেল না, এমন ভাবে মুখ নামিয়ে রইল। সেই শুরু হল বাবু, আমাদের কোনরকমে বেঁচে থাকা – ভয়কে সঙ্গী করে টিকে থাকা।

দুর্যোগ কি শুধু পকিতি আনতে পারে, বাবু? মানুষও পারে। পকিতির চেয়েও সে দুর্যোগ অনেক নিষ্ঠুর। পকিতি আমাদের শুধু ধ্বংসই করতে পারে, মৃত্যু এনে দিতে পারে, কিন্তু চরম লজ্জা দেয় না কিংবা বীভৎস অপমানও করতে পারে না। মানুষ পারে। এই জন্যেই মানুষ অনেক বড়ো, পকিতির চেয়েও বড়ো। একদিন সেই দুর্যোগ, বাবু, এসেই গেল আমাদের ওপর।

হুলির দিনে মানুষজন বড় বেহিসেবী হয়ে যায়, রংযের নেশায়, মদের নেশায় – আরো নানান নেশায়। আমরা এমনিতেই ভয়ে খুব সিঁটিয়ে থাকতাম, সেদিন তাই সাততাড়াতাড়ি ঝাঁপ ফেলে আমরা ঢুকে পড়েচেলাম দোকানের ঘরে। বাপ মেয়েতে রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে, শুয়েও পড়েচেলাম তাড়াতাড়ি। রাত কত হবে বাবু, জানি না, দোর ভেঙে ঢুকে পড়ল ওরা পাঁচজন। সকলেই নেশায় মত্ত। গায়ে তাদের অসম্ভব শক্তি। আমার ফুলিকে তুলে নে যাচ্চিল ওরা। আমি আটকাতে গেলাম, আমাকে খুব মারল – মেঝেয় ফেলে সে কি ভীষণ মার। পাল্টা মার দেবার শক্তি তো আমার নাই, সহ্য করার শক্তিই বা কতটুকু আমার? ওদের মার খেতে খেতে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

জ্ঞান যখন ফিরল, সব চুপচাপ - নিস্তব্ধ। জ্ঞান ফেরার পর প্রথম কি মনে হয়েচেল বাবু, জানেন? কিচুই যেন হয় নি, সব বুঝি দুঃস্বপ্ন। মানুষের মন কি আশ্চর্য, তাই না বাবু। মেঝেয় উঠে বসে, ঘরের চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম – নাঃ, স্বপ্ন তো নয়, সব কিছু তছনছ, এলোমেলো, ভেঙে চুরে সর্বনাশ। ফুলি কোথায়? এ কথা মনে হতেই আমার শরীলে শেতল স্রোত বয়ে গেল। মাথার ভেতরটা বেবাক শূণ্য। নিজের আড়ষ্ট শরীলের যন্ত্রণা ভুলে, উঠে দাঁড়ালাম। দোকানের একধারে দুটো বেঞ্চ জুড়ে এক করে রাখা - তার ওপরে শুয়ে আচে ফুলি। হাত পা ছড়িয়ে উদাসীন উলঙ্গ - আমার ফুলি মা শুয়ে আছে। কি বীভৎস সে দৃশ্য – একখান শাড়ি দিয়ে তারে ঢেকে দিলাম আর তুলে নিলাম বুকে – তকনো তার প্রাণ ছেল বাবু, আমার বুকের সঙ্গে তার বুকের ধুকধুক তকনো বাজতেচেল।

দোকানের ভাঙা ঝাঁপ সরিয়ে বের হলাম বাইরে। একখান ভ্যান চাই – ফুলিরে হাসপাতাল নে যেতে হবে। তকন শেষ রাত। আমার ডাকাডাকিতে বেরিয়ে আসতেচেল, কিন্তু আমাদের অবস্থা দেখে কেউ রাজি হচ্চিল না। সকলেই জানে কিনা, কে আর বিপদের মধ্যে জড়াতে চায় নিজেরে? অনেক কাকুতি মিনতির পর একজন রাজি হল – তার ভ্যানে যখন তুললাম ফুলিরে, আর কোন সাড়া পেলাম না ফুলির। আর এই প্রথম লক্ষ্য করলাম বাবু, ফুলির দুটো হাতই ভাঙা, ফুলির দুটো হাত যেন ফুলির নয় – এমত ঝুলছেল দুপাশে।

শেষ রাতের হাসপাতালে ঘুম থেকে উঠে এসে ডাক্তার, নার্স খুব বিরক্ত হয়ে চেক করল, ফুলিরে। তারপর খুব নিশ্চিন্তে তারা বলে দিলে ফুলি মারা গেচে – আর কিচু করার নেই। নিয়ম কানুন যা হবে, সকালের বড়ো ডাক্তাররা না এলে হবে না। বসেই রইলাম ফুলির মড়া শরীর কোলে আগলে। সকাল হল। ডাক্তারবাবুরা সব এলেন। তেনারা থানায় খবর দিলেন। পুলিশ এল। আমার বয়ান নিল। ওরা ফুলিরে নিয়ে গেল কাঁটা ছেঁড়া করে রিপোর্ট বানাতে – আরও বাকি ছিল, বাবু, আমার ফুলিরে কাটতে, ছিঁড়তে, ভাঙতে। সারা জেবনে এত টিপ ছাপ দিই নি বাবু – সেদিন আমার ফুলির মড়া শরীরটা ফিরে পেতে এত জায়গায় টিপ লাগাতে হল – বাস্‌ রে, দেশের আইন বাবু এত্ত কড়া? কোত্থাও একটু এদিক সেদিক হবার যেন জো নাই, বলেন? ওই শ্মশানেই বাবু আমার ফুলিরে দাহ করে দোকানে যখন ফিরলাম, সেও রাত প্রায় শেষ।

তারপর আর কি হবে বাবু, খুব কদিন থানায় হাজরি, দৌড়ঝাঁপ - টানাপোড়েন চলল।  খদ্দেররাও তেমন আর দোকানমুখো হচ্ছিল না, সারাটাদিন বসে বসে অনর্থক চিন্তা করতাম আর আমি চমকে চমকে উলুকভুলুক তাকাতাম – মনে হত ফুলি যেন ডাকল, বলল – “বাবা, চারটে চায়ের দাম নাও”। দোকানে মন বসছেল না। এরই মধ্যে একদিন সন্ধ্যে বেলা সেই চারজন আবার এল, খুব গালাগাল, ধমক আর সঙ্গে চড় থাপ্পড় দিয়ে শাসিয়ে গেল আমায়। সেই সন্ধ্যেতেই, বাবু আমি বের হয়ে পড়লাম, সামান্য কিছু টাকা পয়সা ছেল আর সঙ্গে কিছু কাপড় চোপড় নিয়ে। দোকান পড়ে রইল দোকানের মতো।

সরকারি রেল স্টেশনের একধারে থাকার জায়গা জুটে গেল। আর হাতের জমানো পয়সা শেষ হতে, শুরু করে দিলাম ভিক্ষে। এখন বেশ আচি বাবু। যেদিন পয়সা জোটে খাই, যেদিন জোটে না – সেদিন হরিমটর। কমাস আগে, একদিন হোটেলে বসে খাচ্চিলাম। টিভিতে খবর দেকতেচিলাম, শহরের বাবুরা রাস্তায় নেমে মোমবাতি জ্বালাইতেচেন, সক্কলের হাতে জ্বলচে মোমবাতি – কোন এক মেয়েকে অনেকে মিলে রেপ করেচে - তার প্রতিবাদে। আপনিও দেখেচেন নিশ্চয়ই – আপনি জ্বালাননি, বাবু? সেদিন থেকে আমিও আমার ভিক্ষের পয়সা থেকে দুটো তিনটে টাকা বাঁচিয়ে ফেলি, বাবু, আর ওই টাকায় আমিও রোজ একটা করে মোমবাতি কিনে জ্বালিয়ে রাখি শিয়রে। জ্বলন্ত শিখার দিকে তাকিয়ে থাকি – বেশ লাগে, একদম আমার ফুলির মতো, বাবু। একটু ভীতু আর অসহায় - হাল্কা বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে – দমকা বাতাসে নিভে যায়। আচ্ছা বাবু, আমার ফুলিরেও তো ওরা রেপই করেছেল, না’?

ধীরেন মাথা নীচু করে বসে রইল বেশ খানিকক্ষণ। ধীরেনের মনে এখনও অনেক প্রশ্ন, কিন্তু কোন প্রশ্নেরই উত্তরের জন্যে আর ওর মাথাব্যথা নেই। আর সত্যি বলতে আমি কি উত্তর দেব?  এতদিন এ সমস্ত কথা ও কাউকে বলতে পারে নি, মনের মধ্যে গুমরে মরছিল। আজ আমাকে বলে কিছুটা ভারমুক্ত হল। আমার কাছে কিচ্‌ছু প্রত্যাশা করে না ও, কারণ ও জানে - আমিও একজন ভদ্রলোক। যে রাধামাধবের লীলা্রসে ধীরেন আগে মজে থাকত, তাঁর নাম আজ মাত্র একবারই শুনলাম ওর মুখে – সকালবেলায় ভিক্ষের উপকরণ হিসেবে। যেখানে রাধামা্ধবের ওপরই আর ওর ভরসা নেই, সেখানে আমার কি অধিকার আছে ওকে সান্ত্বনা দেবার! আমিও মাথা হেঁট করে বসে রইলাম চেয়ারে।

অনেকক্ষণ পর, ধীরেন উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘অনেক রাত হল, বাবু, আজ আমি চলি। তবে যাবার আগে বাবু একখান কথা কবো’?

‘বলো’।

কাঁধের ঝোলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে ধীরেন একখানা মোমবাতি বের করল, বলল, ‘আপনার দেওয়া সকালের টাকা থেকে একখান মোমবাতি কিনেচিলাম বাবু, যদি জ্বালতে দেন, কে জানে, মেয়েটা হয়তো একটু শান্তি পাবে। ও আপনারেও খুব মান্যি করত, বাবু’।

আমি বললাম, ‘দাও’।

ধীরেন বসার ঘরের টেবিলে মোমবাতিটি জ্বালিয়ে রাখল, আর নিভিয়ে দিল ঘরের বিজলি আলো। তারপর ধীরেন অস্ফুট স্বরে বলল, ‘আজ তবে আসি, বাবু’।

 ও চলে যাবার পরও আমি একলা নির্বাক বসেই রইলাম বহুক্ষণ। আমার ঘরে তখন মোমবাতির কাঁপাকাঁপা দুর্বল শিখার স্নিগ্ধ আলো। এ আলো ধীরেনের প্রতিবাদের আলো এ শিখায় সে নিজে পুড়তে থাকবে প্রতিক্ষণ, কিন্তু কোনদিন কোথাও আগুন ধরাতে পারবে না।

 -০০-


"দশে দশ" গ্রন্থে এই গল্পটি সংকলিত। বইটির প্রকাশক সৃষ্টিসুখ প্রকাশন - নীচের লিংকে ক্লিক করে অর্ডার করলেই ঘরে বসে পাওয়া যাবে বইটি 






নতুন পোস্টগুলি

জঙ্গী ব্যবসা

  ১   ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ