বড়োদের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
বড়োদের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শনিবার, ৯ আগস্ট, ২০২৫

পরির রূপকথা

 

পরি বাড়িতে ছিল না, অণুদি সদর দরজা খুলে দিতে, ঢুকতে ঢুকতেই সে অণুদিকে জিগ্যেস করল, “দাদা, কোথায় গো?”

অণুদি চোখ উলটে বলল, “আঁদার ঘরে মুখ গুঁজে পড়া করতিসে”। কথাটা শুনেই খুব বিরক্ত হল পরি, জিভে “চুক” আওয়াজ করে, দৌড়ে গেল দাদার ঘরে। অণুদি ঠিকই বলেছে, ঘরের ভেতরটা সত্যিই আধো অন্ধকার। শেষ বিকেলের এই আলোয় বই পড়া চলতে পারে না। অথচ তার মধ্যেই টেবিলে ঘাড় নিচু করে তার দাদা গাব্দা একখানা বই পড়ে চলেছে। পরি খটাস্‌ শব্দে আলোর সুইচ অন করেএকটু রাগত স্বরেই বলল, “তুই কী রে, দাদা?”

পরির ডাকে পরির দাদা, কড়ি জ্ঞানের সমুদ্র থেকে ভুস করে উঠে এল, তারপর শুশুকের মতো মুখ তুলে বলল, “কেন বল তো, অ্যাদ্দিন ঘর করে, আমি কী, সেকথা বুঝতে তোর এখন অসুবিধে হচ্ছে বুঝি?”

বাজে বকিস না তো! আজ তোর জন্মদিন, আর তুই এখনও এই হুলিয়া নিয়ে তিন সন্ধেবেলায় বসে বসে বই পড়ছিস?”

কড়ি বোনের পেছনে লাগার সুরে বলল, “কেন, বইয়ের কোন ছুৎমার্গ আছে এমন তো শুনিনি! বই কোন মন্দিরও নয় বা দামি হোটেলও নয়, যে সেজেগুজে পারফিউম না লাগালে তার দরজা খুলবে না। যদিও মন্দিরের থেকে বই কোন অংশে কম নয়”।

ওফ্‌, আবার তোর কলেজের লেকচার শুরু করলি! লক্ষ্মী দাদা আমার, শোন না, একটু পরেই অনেক লোকজন আসতে শুরু করবে! তার আগেই শেভ-টেভ করে ফ্রেস হয়ে নে, তারপর পাজামা-পাঞ্জাবি পরে রেডি হয়ে নে না”!

কড়ি অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, “লোকজন আসবে? কারা আসবে?”

পরির অনেক কাজ বাকি, সে ঝড়ের বেগে দাদার ঘর গোছাতে গোছাতে বলল, “সে আসবে! মাসিমা সব অ্যারেঞ্জ করেছেন। খাবার দাবার আপ্যায়ন সব। মাসিমা আধঘন্টার মধ্যে এসে পড়বেন। আর তোকে এ অবস্থায় দেখলে কুরুক্ষেত্র বাধাবেন, এ আমি তোকে বলে রাখলাম, দাদা”।

এর পরেও কড়ি পরির কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলে উঠল, “য্যাঃ য্যাঃ মাসিমার চামচেগিরি করিস না। যার জন্মদিন সে কিছুই জানলো না, এদিকে নেমন্তন্ন?”

পরির মাথা এবার গরম হতে শুরু করল, একটু ধমকের সুরেই বলল, “বোকা বোকা কথা বলিস না, দাদা, মাসিমার ইচ্ছে ছিল তোকে সারপ্রাইজ দেবে, তাই আগে থেকে বলেননি”!

অ! তাই? তাহলে জেনে রাখ আমিও সারপ্রাইজ দিতে পারি। তোর মাসিমাকে এমন সারপ্রাইজ দেব... !”

তুই মাসিমাকে সারপ্রাইজ দিবি? তোর মুণ্ডুটা একদম গেছে, দাদা। যা পারিস কর, আমি ওপরে চললাম। তোর সঙ্গে কথা বলে ফালতু মাথা খারাপ করার মানে হয় না”। রাগে অগ্নিশর্মা পরি দুমদুম পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

পরি যে সত্যি রেগে গেছে, সেটা এতক্ষণে বুঝলো কড়ি। আর সেটা বুঝতে পেরে, কড়ি খুব অসহায় বোধ করতে লাগল। তাদের মা যখন মারা যান, পরির বয়েস চোদ্দ আর সে সতেরর কোঠায়। সেই থেকেই পরি সব দিক সামলে চলেছে, এই ঘর, সংসার, বাবার এবং তার খেয়াল রাখা – সব কিছু। বছর দেড়েক আগে বাবা মারা যাবার পর, কড়ি এখন বোনের ওপরেই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। পরি ছোটবোন হলে কী হবে – বড়দিদির মতোই কড়িকে বুকে করে আগলে রাখে! এই সব করতে গিয়ে পরি যে লেখাপড়ায় ধেড়িয়েছে, তাও নয়। হিস্ট্রিতে এমএ করে, সে এখন একটা কলেজের পার্টটাইম লেকচারার, তার সঙ্গে আবার পিএইচডি করছে!

কড়ি বোনকে মানানোর জন্যে ডেকে উঠল, “পরি ও পরি, সব কথায় হুট করে এত রেগে যাস কেন? দুটো কথা বললেই অমন রাগ করতে হয় বুঝি? আমার পাজামা-পাঞ্জাবি কোথায় আছে, বের করে দে”।  পরি সে কথা শুনতে পেল না, সে অণুদিদিকে নিয়ে ততক্ষণে ওপরে চলে গেছে, হলঘর সাজাতে।

অগত্যা কড়ি ওয়াশরুমে ঢুকল, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের মুখটা দেখল। উস্কোখুস্কো চুল, দুদিনের দাড়ি না কাটা গালে, সত্যিই তার হুলিয়াটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। টিউব থেকে ছয় মিলিমিটার শেভিং ক্রিম নিয়ে ভেজা ব্রাশ গালে ঘষতে লাগল! গাল ভর্তি ফেনা বানিয়ে, সবে রেজারটা তুলেছে, দরজায় বেল বাজল ডিংডং! পরিরা কেউই নিচেয় নেই, তাহলে কড়ি এখন কী করবে, এ অবস্থাতেই দরজা খুলতে যাবে? নাকি গামছায় গাল মুছে নেবে? কে আসতে পারে এখন? মাসিমাই হয়তো! আবার বেল বাজল, ডিংডং। নাঃ, দরজা না খুললে, পরি আরও রেগে যাবে, অতএব কড়ি ফেনাভরা গাল নিয়েই দরজাটা খুলে দিল।

ফুলের সুন্দর একটা বোকে নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছিল বিন্দি। সে কড়ির দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল এবং তার গলা থেকে যে আওয়াজটা বেরোল, দেওয়ালে আরশোলা বা টিকটিকি দেখলে মেয়েরা অমন আওয়াজই করে! অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে কড়ি অনেক কষ্টে বলতে পারল, “না...মানে ইয়ে তোমার ...এদিকে দাড়ি...আসলে পরিরা ওপরে... তুমি ভেতরে কেন... তুমি বাইরে এসো... না মানে বাইরে যাও...না না...”।

 কড়ির কথার নমুনা শুনে বিন্দি মুখে হাত চাপা দিয়ে খুকখুক হাসতে লাগল, তারপর কড়ির পাশ কাটিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল দোতলায়! দোতলায় গিয়ে সে চেপে রাখা হাসির ফোয়ারা খুলে দিতেই, পরি জিগ্যেস করল, “অ্যাই বিন্দি, হাসছিস কেন রে? কী হয়েছে?”

কড়ি এতক্ষণে ধাতস্থ হয়ে খুব শান্ত প্রত্যয়ের সুরে মনে মনে বলল, “বাইরে কেন, বিন্দি? ভেতরে এসো...যাও যাও ওপরে যাও, পরিরা ওপরে আছে”। কিন্তু একটু পরেই সে ওপর থেকে পরি এবং বিন্দির সম্মিলিত হাসির আওয়াজ শুনতে পেল, সঙ্গে অণুদিদিরও! কড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, বিন্দিকে দেখলেই সে এমন ন্যাজে-গোবরে হয়ে যায় কেন?

দাড়ি কামানো শেষ করে, কড়ি যখন মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিচ্ছিল, সেই সময় পরি নিচেয় এল, তার হাতে নতুন এক সেট পাজামা-পাঞ্জাবির প্যাকেট। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে, ভয়ে ভয়ে বোনের মুখের দিকে তাকাল কড়ি, দেখে স্বস্তি পেল, পরির মুখটা এখন বেশ হাসি-হাসি!

পরি দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল, বলল, “গুড। এই তো আমার মিষ্টি দাদাটির মতো দেখাচ্ছে! এই পাজামা-পাঞ্জাবিটা চটপট পরে নে দাদা, পাঞ্জাবিতে বোতাম পরিয়ে দিয়েছি!”

কড়ি সামান্য অনুযোগের সুরে বলল, “বিন্দি আসবে বলিসনি তো! তোরা সবাই ওপরে, কী অপ্রস্তুতে যে পড়েছিলাম...”!

পরি ঠোঁট টিপে হেসে বলল, “কেন, বিন্দি আসবে জানলে তুই সাজুগুজু করে, প্রস্তুত হয়ে থাকতিস, বুঝি?”

পরির এই কথার ইঙ্গিতটা বুঝে, কড়ি আরো যেন বিপদে পড়ে গেল, আমতা আমতা করে বলল, “না, তা ওই একটু...ইয়ে মানে...তা নয়...তবে...”।

পরি হাসতে হাসতে বলল, “তুই আবার অপ্রস্তুত হবার আগে, পাজামা-পাঞ্জাবি পরে চটপট রেডি হয়ে নে, দাদা। আমি এখনই আসছি”। বলেই হালকা পায়ে পরি আবার দোতলায় দৌড়ে গেল।

 

 

নিমন্ত্রিত বলতে বিন্দি, বিন্দির বাবা-মা আর বিন্দির দাদা রূপকথা - সবাই চলে এসেছেন! কিন্তু মাসিমারাই এলেন অনেক দেরিতে - সাড়ে সাতটা নাগাদ।

মাসিমা সাজানো হলঘরে পা দিয়েই কথার বন্যা বইয়ে দিলেন, “একটু দেরি হয়ে গেল রে, সোনা, কী করবো বল...ওম্মম্মাআআআ, কী সুন্দর... তুই আর বিন্দি সাজিয়েছিস, সঙ্গে অণুও ছিল? বাঃ ভারি সুন্দর হয়েছে রে। এই সেদিনের পরি...কী কাজের মেয়ে হয়ে উঠেছিস? একা হাতে সব সামলানো...চাট্টিখানি কথা? আমরা মা দুগ্‌গা বলি, কিন্তু তাঁর তো দশ হাত, কিন্তু আমাদের পরি দু হাতেই ঘরের কাজ, লেখাপড়া...আহাহা, তুই আবার এত লজ্জা পাচ্ছিস কবে থেকে, পরি? মেসোমশাই? আসছে তো – বিষাণের সঙ্গে খাবারের প্যাকেটগুলো... একনম্বরের ঢ্যাঁড়স! কে আবার? তোদের মেসোমশাই! ওর জন্যেই তো এত দেরি হল, একটা কাজ যদি ঠিকঠাক করতে পারে। বাবা, রূপ তুমি একটু নিচে যাও না বাবা, তোমাদের মেসোমশাইকে আমার একটুও ভরসা হয় না। দুটো প্যাকেট হয়তো গাড়িতেই ভুলে আসবে। কড়িকেই বলতাম, কিন্তু আজ তো ওরই জন্মদিন... কিছু মনে করলে না তো, রূপ? তুমি তো আমাদের ঘরের ছেলে!” সামান্য বিরতি দিয়েই আবার, “কড়ি তোর যেমন ধনুক ভাঙা পণ, ছোট বোনের বিয়ে না হলে, তুই ছাদনাতলায় পা তুলবি না, সেরকম পণ অন্যেরও যে থাকতে পারে সেটা বুঝতে পারিস না, কেন? তোর এই অবুঝ জেদের ধাতটা পেয়েছিস, জাঁইবাবুর থেকে... তুই চুকঃ পরি... আমি তোদের বাবার শালী... আমি যা খুশি বলতে পারি... আমার অমন লক্ষ্মীপ্রতিমা দিদিটা কম ভুগেছে... জাঁইবাবুর ওই জেদের জন্যে... সে সব তোরা দেখিসনি, তোরা তখন বাচ্চা... দেখলেও বুঝিসনি! পরিকে দেখি আর দিদির কথা মনে পড়ে যায়... পরিটা একদম দিদির ধাত পেয়েছে...সবার জন্যে মায়ামমতা... ঘরবার সবদিক সামলানো...না, না, কড়ি এভাবে এড়িয়ে যাস না, তুই আর পরি দুজনেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছিস, তার ওপর পৈতৃক এই বাড়ি...দিদির গয়নাগাঁটি, জাঁইবাবুর রেখে যাওয়া টাকাপয়সা, সে তোদের দুই ভাইবোনের, তার মধ্যে তো কেউ ভাগ বসাতে যাচ্ছে না? তাহলে এত চিন্তা কিসের? বিয়ের কথা বললেই ছেলেরা এমন ভাব করে, তাদের যেন ধরে বেঁধে বাঘের মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে”!

তা ব্যাপারটা সেরকমই দাঁড়ায় বৈ কি!” ওপরে এসে মেসোমশাই, রূপ আর বিষাণ অনেকগুলো প্যাকেট এনে টেবিলে সাজিয়ে রাখছিলেন, রাখতে রাখতে মেসোমশাই ফোড়ন কাটলেন।

মাসিমা মুখঝামটা দিয়ে বললেন, “চু্প করো তোঃ। তুমি আবার বুড়ো বয়েসে ছোকরাদের তালে তাল মিলিও না। সংসারের তুমি দেখলেটা কী? সারাজীবন তো চিনেছো এক অফিস, আর বড়ো সায়েব। বিষাণ, তুমি গাড়িতেই থেকো দরকার পড়লে ডাকবো, কেমন? তবে ঘুমিও না, বাবা, তোমার তো গাড়িতে বসলেই ঘুম পেয়ে যায়, এত ঘুম কোত্থেকে আসে কে জানে! কড়ি আর কিন্তু ঘুমিয়ে থাকার সময় নয়। পরিরও বয়েস হচ্ছে। এই মাঘ এলে পঁচিশ পূর্ণ হবে, আমাদের সময় মেয়েদের কুড়িতেই বুড়ি বলতো। সে সব দিন আর নেই, দেশের আইনকানুন পালটে গেছে, তা বলে মেয়েদের ধুমসি হয়ে ঘুরে বেড়ানোটাও কোন কাজের কথা নয়। তুই বিয়ে না করলে, পরির যে বিয়ে হতে পারছে না, সে কথা তোর না বোঝার তো কারণ নেই...”।

আমার একটা কথা আছে...সেটা ছোট্ট করে সেরে নিই? তুমি যা শুরু করেছো, সেটা দুশো বাহান্ন এপিসোডের জটিল সিরিয়ালের মতো...কিছুই বোঝা যাচ্ছে না”। কথার প্রবাহে বাধা পড়ায় মাসিমা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন, স্বামীর দিকে। মেসোমশাই আবার বললেন, “আপনাদের, মানে বেয়ান আর বেয়াইমশাইয়ের সম্মতি যখন পাওয়াই গেছে, তখন এই অঘ্রাণে বিন্দি সিঁদুরের টিপ হয়ে কড়ির কপালে পড়ুক, আর পরি উড়ে যাক রূপকথার রাজ্যে!” বলেই মেসোমশাই হো হো হেসে তাকালেন পরি আর বিন্দির দিকে, বিন্দি আর পরি লজ্জায় মুখ নামিয়ে দৌড়ে চলে গেল ঘরের বাইরে। রূপকথা আর বিন্দির বাবা-মা উল্টোদিকের সোফায় বসেছিলেন, তাঁরাও হাসতে লাগলেন খুব!

মাসিমা বললেন, “আমি বেশ গুছিয়ে বলছিলাম, তুমি দিলে সব ভণ্ডুল করে!”

 

রূপকথার পাশেই কড়ি বসেছিল, সে ফিসফিস করে রূপকে জিগ্যেস করল, “ব্যাপারটা ঠিক কী দাঁড়ালো বল তো? এত হাসাহাসিরই বা কী আছে?”

রূপ বলল, “বলছি, পাশের ঘরে চ”। দুজনে চুপচাপ পাশের ঘরে গিয়ে বিছানায় বসল, রূপ কড়ির মাথায় চাঁটি মেরে বলল, “তোকে বেশ ভালো ছেলে বলেই জানতাম, কিন্তু তুই যে বিন্দিকে ইয়ে করিস, সেটা তো কোনদিন বলিসনি, শালা?”

তুই আমায় বলেছিলি, পরি আর তোর মধ্যে একটা ইয়ে চলছে?”

হাসতে হাসতে রূপকথা বলল, “ইয়েটিয়ে আর নয়, এবার বিয়ে!” দুই বন্ধুই হেসে উঠল হো হো করে।

 

.০০.

শুক্রবার, ২৫ জুলাই, ২০২৫

বুনো ওল

 

গতরাত থেকেই অঝোর নিম্নচাপের ধারায় আমাদের এদিকে জলভাসি। সকাল সাড়ে দশটায় অফিস যাওয়ার ইচ্ছেহীন চেষ্টায় ক্ষান্ত দিলাম। কিন্তু ঘরে বসেই বা সারাটাদিন করব কী? এগারোটা নাগাদ রওনা হলাম আমাদের পাড়ার ক্লাবে, কেউ না কেউ নিশ্চই থাকবে। ক্যারাম খেলে আর আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে নিম্নচাপের এই ল্যাদার্ত দিনটা।

 হলও তাই। ক্লাবে গিয়ে দেখি নবা, মিঠু, আর টিটু ক্যারাম বোর্ডে খটখট করছিল, আমাকে দেখেই হৈহৈ করে উঠল ওরা, “অ্যাই ত, শিবে এসে গেছে, ভালই হয়েছে! আরেক পিস ভেজা কাক উড়ে এসে জুটলই যখন জমিয়ে ক্যারাম খেলা যাক”

আমার পরনে ছিল, বারমুডা আর গলাকাটা টিশার্ট। বলাবাহুল্য দুটোই ভিজে গিয়েছিল আসার পথে, কাজেই ভেজা কাক বিশেষণে, আমার যে বিশেষ অসম্মান হল, তেমন নয়। আর হলেই বা কী, এই নিম্ন চাপের দিনে এমনিতেই আমার মিয়োনো মুড়ির মতো অবস্থা। চারজনে ক্যারামে বসে গেলাম তৎক্ষণাৎ। কিন্তু ক্যারামই বা কতক্ষণ খেলা যায়? ঘন্টাখানেক খেলার পর যখন আমরা বোর হয়ে তালগাছ খেলার কথা ভাবছি, ঘরে এসে ঢুকল ভূষিকা ভূষিকা খুব মজার হাঁকডাক করা মানুষ। যেখানে বসেন একেবারে জমিয়ে বসেন, কচিকাঁচা থেকে পাকাবুড়ো সক্কলের সঙ্গেই ওঁনার সমান জমে।

আমরা সব্বাই ক্যারাম খেলা ছেড়ে হামলে পড়লাম, “ওফ, ভূষিকা, আজকের দিনে তুমি ছাড়া আর কাউকে ভাবাই যায় না, মোক্ষম দিনে মোক্ষম সময়ে এসে পড়েছ।”

 

ভূষিকাকার ভাল নাম ব্রজভূষণ সমাদ্দার, তার থেকে ভূষি, আদর করে আমরা ভূষিকা বলি। ভূষিকাকা মেঝেয় পাতা শতরঞ্চিতে বসতে বসতে বলল, “এমন ঘনঘোর বরিষায়, জমিয়ে গল্প বলা যায়...তাই বলছিস তো?”

আমি পাকামি করে, ফোড়ন দিলাম, “ওটা পুরোন এডিশনের গান, নতুন এডিশনে এমন ঘনঘোর নিম্নচাপে, বলা আছে।”

“তার মানে? এটা আবার কবে বের হল?”

ভূষিকাকার এই প্রশ্নে আমি, মাতব্বরের মতো জবাব দিলাম, “বেরোয়নি, খুব শিগ্গিরি বেরোবে। আজকাল বর্ষা আর হয় না। বৃষ্টি হয়, হাল্কা, মাঝারি, ভারি, এমনকি বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিও বিস্তর মেলে, কিন্তু নো বর্ষা। টানা বৃষ্টি মানেই নিম্নচাপ।”

মিঠু বলে উঠল, “ভূষিকা, তুমি শিবের কথায় কান দিও না তো, এতদিন পরে এলে, কোথায় ছিলে, কী করলে সে কথা বলো। অনেকদিন পর এলে, প্রায় ছ-সাত মাস পরে, তাই না?”

মিঠু আমাকে থামিয়ে দিলে কী হবে? আমি থামার পাত্রই নই, বললাম, “ভূষিকা, তোমার গল্পের ঝুলি থেকে ঝুল ঝেড়ে গল্প না বললে, আমরা কিন্তু তোমাকে ঝুলোঝুলি করতেও পিছপা হবো না, এই বলে দিলাম”

ভূষিকা একথায় একটু ত্রস্ত ব্যস্ত হয়ে বলল,  “আরে দাঁড়া, দাঁড়া, আসার পথে বিজুদার সঙ্গে দেখা। কেমন আছো, জিগ্যেস করতেই বিজুদা তার অম্বলের ব্যাখান শুরু করল। অম্বলের থেকে বাঁচতে কোনরকমে ক্লাবে পালিয়ে এলাম। এখানে এসে আবার দেখছি, শিবুর আনকোরা নিম্নচাপের এডিশন!” ভূষিকা অসহায়ের মতো মুখ করে, আমাদের দিকে তাকাল।

আমি বললাম, “ওফ, বিজুকাকার পাল্লায় পড়েছিলে? খুব অল্প সময়ে, পেল্লায় বাঁচা বেঁচে গেছ বলতে হবে। আমরা তো এখন ওঁনাকে দেখলেই পালিয়ে বেড়াই। ওঁনার অম্বলের কথা যতো কম বলা যায় ততই ভালো। বলতে কী আমরা দিন দিন কমবল, মানে হীনবল হয়ে পড়ছি ওঁনার অম্বলের কথা শুনতে শুনতে।”

ভূষিকাকা আমার দিকে খুব সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “শিবু, তোর শরীর খারাপ না কী রে? কেমন সব কথা বলছিস জড়িয়ে মড়িয়ে, মিলিয়ে মিশিয়ে! কী হল কী তোর?”

নবা খুব বিরক্ত মুখে উত্তর দিল, “ভূষিকা, শিবের মাথাটা একদম নষ্ট হয়ে, পচে গেছে। এবার বইমেলা থেকে শিব্রাম সমগ্র কিনে পুরোটা পড়েছে ফলে যা হবার তাই হয়েছে, কথাবার্তার মাথামুণ্ডু ঘুঁচে গেছে।”

ভূষিকা এ কথায় হো হো হাসল খানিক, তারপর বলল, “অ, এই কথা? শিবুর মাথায় শিব্রাম ভর করেছে? তোদের মতো বয়সে আমিও পড়েছিলাম, কিছুদিন আমারও ওই রোগ ধরেছিল, অনেক কষ্টে ছাড়ান পেয়েছি। দাঁড়া আজ বিজুদার অম্বলের ওষুধটা দিই, পরে একদিন শিবুকে নিয়ে পড়ব।”

নবা জিগ্যেস করল, “তুমি কী বিজুকাকাকে ডেকে এলে? উনি আসছেন নাকি, এখন? সেরেছে, আড্ডাটা টকিয়ে ছাড়বে একেবারে।”

ভূষিকাকা মুচকি হেসে বলল, “ঘাবড়াসনি, যা বলার আমিই বলব, তোরা শুধু শুনবি। দেখ না বিজুদার অম্বল যদি না সারাতে পারি, আমার ব্রজভূষণ নামটা তোরা পাল্টে দিস”

আমি বললাম, “আমরা যারা অম্বলে টক নই, এক কথায় যারা না-টক, তারা একদম নো Talk, তাই তো ভূষিকা?”

আমার কথায় সকলেই বিরক্ত হয়ে “ওফ্‌” করে উঠল, শুধু ভূষিকাকা আমার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে বলল, “অসুখটা ভালই বাধিয়েছিস রে, শিবে, সারতে সময় লাগবে। ভাবিয়ে তুললি বেশ।”

 

ভূষিকার কথা শেষ হল কি হল না, বিজুকাকা ক্লাব ঘরে পা রাখলেন এবং ঢুকেই, বিশাল এক ঢেঁকুর তুললেন, “হেউ”

সেই শুনে ভূষিকা বলল, “এ কী করেছ, বিজুদা? শরীরে এতো অম্বল পুষে রেখেছো? এতো ভালো কথা নয়।”

“ভালো কথা নয়ই তো! কি জ্বালায় যে জ্বলছি, সে শুধু আমিই জানি। পেট থেকে গলা অব্দি সারাক্ষণ জ্বলছে। কেউ বুঝতে চায় না, যাকেই বলি, ইয়ার্কি-ফাজলামো করে।” বলেই আবার ঢেঁকুর তুললেন “হেউ”

“হায়, হায়। একদিকে সঙ্গে নেইকো কেউ, ওদিকে ঢেঁকুরের বড়ো বড়ো ঢেউ।” আমি নাtalk থাকতে পারলাম না, বলেই ফেললাম। আমার দিকে বাকিরা কটমট করে তাকাল, কিন্তু ভূষিকার চোখে সহানুভূতি, জ্বরে ভোগা ছেলের দিকে মায়েরা যে চোখে তাকান, অবিকল সেই দৃষ্টি!

ভূষিকা ভীষণ গম্ভীর মুখ করে বলল, “বিজুদা, তোমার এই অম্বল নিয়ে কয়েকটা কথা জিগ্যেস করবো, সত্যি করে বলবে?”

“কী বল তো? যদি কিছু সুরাহা হয় কেন বলবো না? কী জানতে চাস বল না, ভূষি?”

“ফুচকা আর আলুর চপ কতদিন খাওনি?”

“মনে নেই রে, তা প্রায় বছর পাঁচেক তো বটেই, ফুচকা তো তারও বেশি, তা ধর বছর আষ্টেকআগে তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েরা ফুচকা খাচ্ছে দেখলেই বুক আইঢাই করে, চোঁয়া ঢেঁকুর উঠতো। এদান্তিতে সেটা একটু কমেছে। তবে আজ তোর মুখে ওই সব নাম শুনেই গলার কাছটা চিনচিন করছে।”

ভূষিকা খুব উদ্বিগ্ন মুখে বলল, “বলো কী, বিজুদা। এখনই কিছু একটা না করলে তো পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে।”

এই কথায় আমি আর থাকতে না পেরে আবারও বলেই ফেললাম, “গালে দেওয়ার মতো কোন খাদ্যই আর পাওয়া যাবে না, তখন সব খাদ্যই নাগালের বাইরে না-গাল হয়ে, গালের বাইরে পড়ে থাকবে।” কিন্তু আমার কথায় কেউ কানই দিল না।

ভূষিকা একই রকম মুখ করে বিজুকাকাকে আবার জিগ্যেস করল, “সকালে উঠে খালি পেটে জল খেলেও কী অম্বল অম্বল লাগে?”

মেয়েরা তেঁতুলের আচার খেয়ে, চোখ ছোট করে, জিভে যেমন টকাস আওয়াজ তোলে, বিজুকাকা সেরকম আওয়াজ তুলে বলল, “লাগে মানে? জল খাবার পাঁচ মিনিটের মধ্যে মনে হয়, এক পেট কাঁচা আমের সরবৎ গিলেছি। কিংবা পাকা তেঁতুল গোলা জল খেয়েছি। দাঁত ব্রাশ করার সময় দেখি দাঁত টকে গেছে। ছোটবেলায়, নুন ছাড়া কাঁচা আম, গাছ থেকে পেড়ে খেলে, দাঁতের যে অবস্থা হত, সে রকম আর কি!”

ভূষিকা এই কথায় শিউরে উঠল যেন, বলল, “ইসসসস.....তোমার অবস্থা তো বেশ ঘোরালো হয়ে উঠেছে গো, বিজুদা”?

আমি ফুট না কেটে পারলাম না, “ভূষিকা ঘোর আলো কী বলছো, এ তো ঘোর অন্ধকার!”

ভূষিকা আমাকে পাত্তাই দিল না, বলল, “তোমার কথা শুনে, আমার সেই বাঘের কথা মনে পড়ছে গো, বিজুদা, একদম তোমার মতো অবস্থা হয়েছিল। বেচারা, তার কথা মনে পড়লেই...” 

বিজুকাকার কথাটা পছন্দ হল না, বিরক্ত মুখে বলল, “আমার অবস্থা বাঘের মতো, কী বলছিস কি, ভূষি, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

কিন্তু আমরা সবাই হৈ হৈ করে উঠলাম গল্পে বাঘের গন্ধ পেয়ে। আমি তো বলে়ই ফেললাম, “বিজুকাকার এমন ঘোরালো অম্বলকে বাগে আনতে, বাঘের ধারালো সাহায্য তো নিতেই হবেঘোর আলোর থেকে ধারের আলো এমন আর মন্দ কী? সত্যি বলতে এই অম্বল সারাতে ওই পথই একমাত্র সম্বল। ভূষিকা তুমি ব্যাপারটা খুলে বলো।”

এইবার আমার কথায় সক্কলে হৈ হৈ করে বিপুল সমর্থন করল। খুব সিরিয়াস মুখ করে ভূষিকা বলল, “আমরা কথাটা শোন না বিজুদা, তাহলেই বিষয়ের গুরুত্বটা বুঝে যাবে।”

তারপর একটু চুপ করে থেকে ভূষিকা শুরু করল, “ঘটনাটা বছর তিরিশ আগেকার। আমি তখন চব্বিশ-পঁচিশ বছরের জোয়ান ছোকরা। হিস্ট্রিতে বিএ করে বসে আছি, বেকার। কলকাতায় চাকরি-বাকরির অবস্থা এখনকার থেকেও খুব খারাপবাংলার এমএতে, কলকাতা চিড়িয়াখানার[*] খাঁচাগুলো ভরে গেছে! এ আপিসে, সে আপিসে ঘুরে ঘুরে কলকাতায় কোন কিছুই জুটল না। শেষ অব্দি আমার এক বন্ধুর পিসেমশাইয়ের সুপারিশে সোজা চলে গেলাম নয়াগড়। নয়াগড় তখনও দেশি রাজ্য, সেখানে রাজা ছিল, রাজমন্ত্রী, রাজবদ্যি সব ছিল। ছিল না শুধু সেনাপতি আর সৈন্য সামন্ত। তবে কি না সে নামেই রাজ্য আর রাজা, আসলে তালপুকুর – ঘটি ডোবে না। সেই রাজার ঠাকুরদার আমলে বানানো একটা প্রাইভেট চিড়িয়াখানা ছিল। সেই চিড়িয়াখানায় কিছু শালিক, চড়াই, কাক-টাক গোছের ঘরোয়া পাখি, বেশ কিছু শেয়াল, গুচ্ছের বেড়াল আর এক পাল নেড়িকুকুর ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না। বাঘ, সিংহ, ভালুক-টালুক যা ছিল সবই সাজানো!

নবা বলল, “সাজানো বাঘ-ভালুক মানে?”

ভূষিকা হাত তুলে তাকে ধৈর্য ধরার ইঙ্গিত করে বলতে লাগলেন, “বন্ধুর পিসেমশাইয়ের সুপারিশ লেখা চিঠি নিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হলাম নয়াগড়ে। কিছুটা কাঠ-খড় পুড়িয়ে দেখা করলাম বৃদ্ধ রাজমন্ত্রীর সঙ্গে। সেই মন্ত্রীমশাইও ছিলেন প্রবাসী বাঙালী, আর বাঙালী ছোকরাদের তিনি খুব ফেবার করতেন, চেষ্টা করতেন যতটা সম্ভব সাহায্য করার।

তাঁর হাতে পিসেমশাইয়ের চিঠিটা তুলে দিতে, তিনি মন দিয়ে চিঠিটা পড়লেন, তারপর বললেন, “ব্রজভূষণ, কটা দিন দেরি করে ফেললে, বাবা, বাঘ তো আর খালি নেই, একটাই ছিল, এই কদিন আগে সামতাবেড়ের একটা ছেলে, তোমার মতোই সুপারিশ নিয়ে এসেছিল, তাকে ঢুকিয়ে নিয়েছি”।

আমি খুব হতাশ হয়ে, বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছি দেখে, মন্ত্রিমশাইয়ের কী মনে হল কে জানে? বললেন, “তুমি বাঙালী, আমারই দেশের ছেলে, তোমাকে হতাশ করে ফেরাতে ইচ্ছে হচ্ছে নাকিন্তু আমাদের চিড়িয়াখানায় একটা যে পোষ্ট খালি রয়েছে, সেটা বাঙালিদের পক্ষে খুব একটা সম্মানের নয়। ওটা আমি এর আগে কোনদিন কোন বাঙালীকেই দিইনি। সত্যি বলতে, আজ পর্যন্ত বাঘ-সিংহটাই বাঙালিদের জন্যে একচেটিয়া রেখেছিলাম, কিন্তু...”

মন্ত্রীমশাই দ্বিধাগ্রস্ত মুখে থেমে গেলেন। কিন্তু আমার তখন চাকরির খুব দরকার, একদিকে মায়ের শরীর খারাপ, ওদিকে ছোট বোনটা বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠছে, আর ভাইটাও ছোট, তার লেখাপড়া আছে।

আমি রাজমন্ত্রীমশাইয়ের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, বললাম, “আমি কাউকে বাঙালি বলে পরিচয় দেব না, স্যার। আপনি কাজটা আমাকেই দিন, আমার অবস্থা খুব খারাপ, একটা চাকরি না হলে আমি সপরিবারে মারা পড়বো স্যার। ঘরে মা আছেন, ছোট বোন-ভাই আছে। আপনি না রাখলে, তাদের নিয়ে কোথায় যাবো, স্যার?”

 

শেষমেষ চাকরিটা হয়েই গেল। কাজ কম্মো তেমন কিছু নয়। মাইনেপত্র যা পেতাম, প্রায় পুরোটাই বাড়িতে পাঠাতে পারতাম, কারণ থাকা খাওয়াটা ছিল ফ্রি। খাওয়া দাওয়াও মন্দ নয়। সকালে একথালা ভাত, ডাল আর কাঁকরোল ভাজা, যাকে ওরা বলত ঘিয়াকরেলা। আর রাত্রে ছটা ঘি ছিটানো রুটি আর করেলার সবজি। হপ্তায় ছদিন ডিউটি। সোমবার ছুটি, সেদিন দুপুরে হত তিন পিস মাংস দিয়ে ঝোল আর ভাতসবথেকে কাজের চাপ হতো রবিবার আর ছুটির দিনগুলোতে। আবার কোন সোমবার পাব্লিক হলিডে থাকলে আমাদের হপ্তার ছুটিটা মার যেত। এ ছাড়া আর কোন ছুটি ছিল না, শরীর খারাপ হলেও না। ছমাস পরে বাড়ি আসব বলেছিলাম তাও ছুটি দেয়নি ছুটি পেয়েছিলাম প্রায় সাড়ে আট মাস পরে, সেই বর্ষার সময়। ওই সময় কে আর চিড়িয়াখানায় ঘুরতে আসে, ওই সব দেহাতি রাজ্যে? বর্ষার সময় লোক খেতিবাড়ি করবে, না চিড়িয়াখানা দেখবে?”

“বলিস কী, ভূষি? এ তো অত্যাচার। এই নয়াগড়টাই বা কোথায়, আর তার রাজাটাই বা কে”?

“জায়গাটা তখন ছিল এমপিতে, এখন ছত্তিসগড় হয়েছে, নামেই ছত্তিস, আসলে ছিল বাহাত্তরের চার ডবল। এই টুকু টুকু রাজ্য কিন্তু রাজাদের খুব ধুমধাম। এত্তো বড়ো বড়ো রংচঙে পাগড়ি, আর বাহারের পোষাক। তবে সে সব রাজাও আর নেই। রাজ্যও কী আর আছে, বিজুদা, এই স্বাধীন ভারতে”?

“অ। তা তোর কাজটা কী ছিল, সেটা তো বললি না?”

“সে কথায় পরে আসছি। আমার খাঁচা আর বাঘের খাঁচাটা ছিল পাশাপাশি। বাঘের খাঁচাতেই আমাদের সামতাবেড়ের সুনীল মাইতি ছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই তার সঙ্গে আমার বেশ গলায় গলায় ভাবসাবও হয়ে গেল। তার ডাকনাম ছিল নীলু। তার বাড়ির অবস্থা আমার থেকেও খারাপ। দর্শকদের ভিড়ভাড় না থাকলে আমরা নিজের নিজের খাঁচার ধারে এসে গল্পসল্প করতাম। আমাদের থাকার জায়গাও ছিল একই জায়গায়। কাজেই সন্ধেয় বাড়ি ফিরেও আমরা একসঙ্গেই থাকতাম।  

 

বছর দেড়েক বেশ ভালোই চলল। ঝামেলা শুরু হল তারপরে। কোথা থেকে এক ব্রিটিশ সায়েব এসে উপস্থিত হল আমাদের চিড়িয়াখানায়। সে ব্যাটা শখের জীব বিজ্ঞানী,  তার সেই সময়ে কী যে শখ চেপেছিল কে জানে? রাজার বিশেষ অনুমতি নিয়ে সে হাজির হল, বাংলার বাঘের ওপর রিসার্চ করার জন্যে। বোঝ কাণ্ড। আমরা নিজের নিজের নির্দিষ্ট ছালচামড়া পরে খাঁচায় ঢোকার আধাঘন্টার মধ্যে সে রোজ এসে উপস্থিত হত, আর নীলুর খাঁচার সামনে একটা চেয়ার আর টেবিল নিয়ে বসে থাকত সারাদিন, সেই বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। বাংলার বাঘ সারাদিন কী করে, কী খায়, কী ভাবে হাঁটে, কী ভাবে হাঁই তোলে, কী ভাবে শোয় – সেই সায়েব বসে বসে সব দেখত আর মস্ত বড়ো একটা ডাইরিতে পাতার পর পাতা কী সব ছাইপাঁশ লিখত।

সত্যিকারের বাঘ তো আর নয়, ও তো আমাদের সামতাবেড়ের নীলু। তার তো অবস্থা সঙ্গীন। দেহাতি লোকের সামনে কিছুক্ষণ বাঘগিরি করা এক জিনিষ, আর জীব বিজ্ঞানী সায়েবের চোখের সামনে সারাটাদিন বাঘত্ব ফলানো অন্য জিনিষ। দেহাতি লোকেদের সামনে হেঁড়ে গলায় এক আধবার হালুম বললে, তারা খুশি হয়ে বাড়ি চলে যায়, সায়েবের তা হবে কেন? দু একদিন দেখে, তার কেন জানি না মনে হল, চিড়িয়াখানার কর্মচারীরা বাঘকে ভালো খেতে দেয় না। আর সেই কারণেই বাঘটা এমন দুর্বল। সেই সায়েব করলে কী, চিড়িয়াখানার কর্মচারীদের ভরসা না করে, একদিন নিজেই চারপাঁচ কিলো মাংস কিনে এনে, থপ থপ করে ফেলে দিল নীলুর খাঁচার ভেতর  সে এক কাণ্ড, সায়েব তো নিষিদ্ধ মাংস এনে দিয়েছে। ছ্যা ছ্যা, চাকরি করতে এসে কী জাত ধর্ম খোয়াতে হবে নাকি?

কর্মচারীরা সায়েবকে যত বোঝায়, “হিন্দু টাইগার সার, ইট নো বিফ সার। ইট অনলি গোট সার”

সায়েব ততো বলে, হতেই পারে না। বাঘ সব খায়, কখনো কখনো মানুষও খায়। ভারতে মানুষখেকো বাঘের কথা, সায়েব নাকি বিস্তর শুনেছে। বাঘের আবার হিন্দু, মুসলমান কীমানুষখেকো বাঘেরা হিন্দু মুসলমান কাউকেই ছেড়ে কথা বলে না!

যাই হোক শেষমেষ রাজমন্ত্রীমশাই নিজে এসে যখন সায়েবকে বললেন, “নেটিব হিন্দু স্টেট সার। হিন্দু কিং। দিস টাইগার টেক বার্থ ইন জু কেজ সার। ইট ওনলি গোট মিট অ্যাণ্ড ফিস, সার।” তখন সায়েব ক্ষান্ত দিল।

তার পরদিন থেকে চিড়িয়াখানা থেকেই দিনের বেলা কচি কাঁচা পাঁঠার মাংস যোগান দেবার ব্যবস্থা করে দিলেন রাজমন্ত্রীমশাই। আর সন্ধেবেলা তাঁর চেম্বারে আমাদের ডেকে নিয়ে, নীলুর দুটো হাত ধরে বললেন, “নীলু তোমার ওপরেই এই রাজ্যের সম্মান আর ভাগ্য নির্ভর করছে, বাবা। আমি কচি পাঁঠার কাঁচামাংসের কিমায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিতে বলেছি বাবা, কটা দিন একটু উৎরে দাও। সায়েব চলে গেলেই দিন কয়েকের জন্যে ছুটি দিয়ে দেব, বাড়ি গিয়ে মায়ের রান্না বিউলি ডাল, পটলের তরকারি, কলমির শাক আর পোস্ত খেয়ে পেট শুদ্ধু করে নিও”

 

এই কাণ্ডের পরেও সেই সায়েব প্রায় দিন আষ্টেক রোজ আসত চিড়িয়াখানায়, এক সোমবার দিনটা ছাড়া। আর বুঝে দেখো, বিজুদা, সায়েবকে দেখিয়ে দেখিয়ে সেই কিলো দুয়েক কাঁচা মাংসের কিমা নীলুকে রোজ চেঁটেপুটে খেতে হত। হাতও লাগাতে পারত না, বাঘ কী হাত দিয়ে খায়? বেচারা সন্ধেয় ঘরে এসে আর কিছুই খেতে পারত না! ওইদিকের জল-হাওয়ায় শুনেছি লোহা খেলেও নাকি হজম হয়ে যায়! ছাই হয়, তা যদি হত, তাহলে দুকিলো কাঁচা মাংস কী আর হজম হতো না? কয়েক হাজার হজমিগুলি, কয়েকশ বোতল মিল্ক অব ম্যাগনেশিয়া শেষ হয়ে গেল, কিন্তু আমাদের নীলু কাঁচা মাংস সহ্য করতে পারল না। দিন চারেকের মধ্যে তার এমন অম্বল শুরু হল। অবিকল তোমার মতো। সকালে উঠে শুধু জল খেলেও, বেচারার গলা অব্দি টক হয়ে থাকত সারাদিন সে তোমার মতোই বড়ো বড়ো ঢেঁকুর তুলত, হেউ হেউ। আর বাঘের মুখের আড়াল থেকে সেই আওয়াজ বাঘের গর্জনের মতোই গম্ভীর শোনাতো। সেই আওয়াজ যেদিন যত বেশি হত, সায়েব তত খুশি হত। আর ডাইরিতে পাতার পর পাতা নোট লিখত।

 

নীলুর ঘোরালো অবস্থার কথা আমরা রাজমন্ত্রীমশাইকে জানালাম। তিনি সব শুনে চিন্তিত মুখে রাজবৈদ্যকে ডেকে পাঠালেন। থুত্থুড়ে বুড়ো রাজবৈদ্য সব শুনে, নীলুর সব লক্ষণ দেখে বুঝে, গম্ভীর মুখে দেহাতি হিন্দিতে যা বললেন, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, “আমি এবং আমার বাপ চোদ্দপুরুষ কেউ কাঁচা মাংস খাওয়া জীবের চিকিৎসা তো করি নি, বেটা! আমরা মানুষ এমন কি গরু মোষের চিকিৎসাও করেছি। কিন্তু আমাদের বংশে বাঘ-ভালুকের চিকিৎসা কেউ কোনদিন করেছে বলে শুনিওনি। কাজেই ধুলো ঝেড়ে অনেক শাস্ত্র-পুঁথি বের করতে হবে, পড়াশোনা করতে হবে, তারপর দেখি কী করা যায়। তবে এই শেষ, এ চাকরি আর করবো না, বাপু, ছেড়েই দেব। এই বয়েসে এত ধকল সহ্য হয়?”  

তিনি অবিশ্যি করেছিলেন দিন দুয়েক পরে, সন্ধেবেলা তিনি নিজেই এলেন, তাঁর সঙ্গে একজন দেহাতি হাট্টাকাট্টা মানুষ, আর তার কাঁধে বিশাল একখানা ওল”আমাদের  আড্ডার তিনজন একসঙ্গে বলে উঠল,

“ওল?”

“সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে, যে ভূষিকা!” আমিও চুপ করে থাকতে পারলাম না।

বিজুকাকা ভ্রূকুটি কুটিল চোখে আমার দিকে একবার, তারপর ভূষিকাকার দিকে তাকিয়ে বললেন, “শিবু ঠিকই বলেছে, বড্ডো বাড়াবাড়ি করে ফেলছিস, ভূষি”এই বলে বিজুকাকা উঠতে যাচ্ছিলেন।

আমি তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা সামলে নেওয়ার জন্যে বললাম, “বিজুকাকা, আপনার এই তো, পা বাড়ালেই বাড়ি। একটু বসে বাকিটাও শুনেই যান। নীলুবাবুর অম্বলের ওই বাড়াবাড়ির উপশম কীভাবে হল, বাড়ি গেলে আর জানা যাবে না” 

ভূষিকাকাও খুব ক্ষুণ্ণ মুখ করে বলল, “বিজুদা, আমার কথা বিশ্বাস করছো না তো? পুরোটা না শুনেই তুমি তো রেগে যাচ্ছো! পুরোটা শোনো, তারপর বুঝবে, কী মোক্ষম দাওয়াই দিয়েছিল ওই বুড়ো রাজবৈদ্য”

সে কথায় আমিও সায় দিলাম, “এসব আগেকার রাজপুরীর ব্যাপার, পুরো না শুনলে পুরোপুরি বোঝা যাবে না, বিজুকাকা”

বিজুকাকা আবার বসলেন, কিন্তু আর কোন কথা বললেন না, ফ্যালফেলে চোখে ভূষিকাকার দিকে তাকিয়ে রইলেন শুধু। ভূষিকাকা সময় নষ্ট না করে আবার বলতে শুরু করল, “আমি আর নীলুও চমকে উঠেছিলাম। দেহাতি লোকটাকে যখন রাজবদ্যিমশাই, আমাদের ঘরের এক কোণায়, ওই মস্তো ওলটা ভাল করে রাখতে বললেন। আমরা অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। রাজবদ্যিমশাই দেহাতি লোকটিকে বিদায় দিয়ে, আমার চৌকির কোণায় বসলেন। তারপর নীলুর দিকে তাকিয়ে বললেন,

“অবাক হচ্ছো তো? ওটাই তোমার অম্বলের ওষুধ বলো ওষুধ, পথ্যি বলো পথ্যি  রোজ সকালে খেয়েদেয়ে কাজে বেরোনোর আগে, এতটা করে কাঁচা ওলের টুকরো, কচি শসা খাওয়ার মতো চিবিয়ে খাবে”এই বলে তিনি টুকরোর সাইজটা হাতের ভঙ্গি করে দেখালেন।

নীলু করুণ মুখ করে জিগ্যেস করল, “কাঁচা”?

“হুঁ। কাঁচা। কাঁচা মাংসর দাওয়াই, কাঁচা ওল। তবে সন্ধেবেলা বা রাত্রে খেও না। হিতে বিপরীত হবে” আরো কিছু বিধি বিধান দিয়ে তিনি একটু পরে বিদায় নিলেন। আর যাবার সময় পই পই করে, নীলুকে বলে গেলেন, ওলে অম্ল ও পিত্ত বিনাশ হয়, কাজেই ওল ছাড়া নীলুর অন্য বিকল্প নেই।

 

পরের দিন সকালে খাওয়া দাওয়া সেরে বেরোতে একটু দেরিই হয়ে গেছিল, কাজেই খাওয়ার পর বসে বসে কাঁচা ওল খাবার সময় আর হাতে ছিল না। আমি নীলুকে বললাম, হাতে নিয়ে নে, রাস্তায় যাবার পথেই চিবোতে চিবোতে যাবি। নীলু তাই করল। কচর মচর করে কাঁচা ওল চিবোতে চিবোতে নীলু থু থু করতে লাগল, আর আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে চিড়িয়াখানায় পৌঁছে গেলাম। সাজঘরে ঢুকে নিজের নিজের ছালচামড়া পড়তে পড়তেই নীলু বেশ কবার বলল, “ভূষি রে, আমার গলা থেকে পেট অব্দি বেজায় কুটকুট করছে! মনে হচ্ছে গুচ্ছের কাঁকড়া গলা বেয়ে উঠে আসতে চাইছে, কিন্তু হড়কে পড়ে যাচ্ছে বার বার”।

সাঁত্রাগাছির রান্না করা ওল কাসুন্দি আর কাঁচা লংকা মেখে খেয়ে অভ্যস্ত নীলুতার ওই কাঁচা বুনো ওল খেয়ে কী অবস্থা হচ্ছে, বুঝতেই পারছিলাম। ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, “কাঁকড়ার কথা ভুলে যা, অম্বলে আর গলা অব্দি জ্বালা করছে কিনা সেটা বল”।

ব্যাজার মুখ করে নীলু বলল, “কাঁকড়া ধরবো, না, অম্বলে জ্বলবো, সেটাই তো বুঝতে পারছি না”।

আমি বললাম, “ব্যস, আর চিন্তা নেই, ওই বুনো ওল তোর অম্বলকে ঘোল খাইয়ে ছাড়বে, দেখে নিস”।

 

আমাদের হাতে আর বেশি সময় ছিল না, কাজেই আমরা তাড়াতাড়ি নিজের নিজের খাঁচায় গিয়ে ঢুকে পড়লাম। সেদিনও সেই সায়েব ঠিক সময়েই এল এবং টেবিলে ডাইরি মেলে, চেয়ারে বসে হাবিজাবি লিখতে শুরু করল। দেখতে দেখতে নীলুর গাল-গলা ফুলে ঢোল হয়ে উঠল। বাঘের যে মুখটা এতদিন ঢিলে ঢালা পাঞ্জাবীর হাতার মতো ঝুলঝুল করত, সেদিন একদম গোলগাল স্মার্ট ফিটিং! সেদিন বাঘ দেখে তো সায়েব খুব খুশি। রাজমন্ত্রীমশাইকে ডেকে এনে সায়েব ফলাও করে বলল, তার জোর জারিতেই বাঘের স্বাস্থ্য ফিরে গেছে। রাজমন্ত্রীমশাই কী আর উত্তর দেবেন, সায়েবের খুশিতে তিনি আদৌ খুশি হতে পারলেন না। গোমড়া মুখে সায়েবের কথা শুনতে লাগলেন।

অনেক কথা বার্তার পর সায়েব বলল, ওই দিনই তার শেষ দিন, কাল ভোরে বোম্বাই রওনা হবে, সেখান থেকে পরের দিন ফিরে যাবে নিজের দেশ বিলেতে। এই কথা শুনে রাজমন্ত্রীমশাই তো বটেই আমরাও এমন খুশি হলাম, সে আর বলার নয়! নীলু তো দু পায়ে দাঁড়িয়ে আনন্দে গর্জন করে উঠল বেশ কয়েকবার। সেই দেখে সায়েবও তাজ্জব বনে গেল। এই কদিনে সে বাঘকে একবারও দুই পায়ে দাঁড়াতে দেখেনি। রাজমন্ত্রীমশাই কটমট করে নীলুর দিকে তাকাতে, নীলু নিজের ভুলটা বুঝতে পারল, সে আবার বাঘ হয়েই চার পায়ে ঘুরতে লাগল খাঁচার ভেতর।

সায়েব মন্ত্রীমশাইকে জিগ্যেস করল, আপনাদের বাঘ দু পায়ে দাঁড়াতে পারে? এ তো মির‍্যাক্‌ল্‌! মন্ত্রীমশাই হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, “নো টু লেগ স্ট্যাণ্ড স্যার, দে স্ট্যাণ্ড অন ফোর লেগ, লাইক চেয়ার অর টেবিল স্যারমোর মিট দে ইটিং, দে গোয়িং ম্যাড। নাউ হি ইজ ভেরি স্ট্রং, হি ক্যান ব্রেক কেজ। গো হোম সুন, স্যার, ডেঞ্জার মে কাম এনি মোমেন্ট!” মন্ত্রিমশাইয়ের এই কথায় মোক্ষম কাজ হল। সায়েব তখনই ডাইরি বগলে নিয়ে, চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে গেল তাড়াতাড়ি”

 

এই অব্দি বলে ভূষিকা চুপ করে রইল। আমরাও কেউ কিছু বললাম না। ঘটনার ঘনঘটায় আমরাও যেন হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। কিছুক্ষণ পর বিজুকাকা বললেন, “আর অম্বল? সেও কি দু পেয়ে বাঘের ভয়ে পালিয়ে গেল, তোর নীলুকে ছেড়ে?”

“না, না দাদা, তাই হয়? অম্বল কী আর সায়েব নাকি? অম্বল তো তার আগেই পালিয়ে গেছে বুনো ওলের ভয়ে। বুনো ওলের জন্যে চিরকাল বাঘা তেঁতুলের কথা শুনেছি, শোনেননি দাদা, বলুন? এখানে ব্যাপারটা উলটো, বাঘা অম্বলকে জব্দ করল বুনো ওল। ওই শিবুর কথা মতো একটু ওলটপালট ব্যাপার, তাই নয় কি”?

“এই তোর অম্বলের ওষুধ? এই বলার জন্যেই তুই আমায় ডেকে আনলি?” এই কথা বলে বিজুকাকা রাগে গনগনে মুখ করে উঠে দাঁড়ালেন, পায়ে চটি পরতে পরতে আবার বললেন, “তুই ওই চিড়িয়াখানায় কী করতিস, সেটা কিন্তু বললি না। তবে, তুই না বললেও আমি জানি”

ভূষিকা অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, “তাই? কী বলুন তো?”

বিজুকাকা ক্লাব ঘরের দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন, বললেন, “আস্ত একটি মুখপোড়া হনুমান”!

ভূষিকা খুব নিরীহ নিরীহ মুখ গদ্গদ কণ্ঠে বলল, “বিজুদা, আপনি রিয়্যালি গ্রেট। যাবার আগে পায়ের ধুলো একটু দেবেন না, দাদা?” ততক্ষণে বিজুকাকা রাস্তায় নেমে আড়ালে চলে গেছেন।

 

আমরা এতক্ষণ অনেক কষ্টে চেপে ছিলাম, এবার সবাই হো হো করে হাসতে লাগলাম।

ভুষিকা হাসল না, গম্ভীর মুখে বলল, “বিজুদার অম্বল কিন্তু আমি ছাড়িয়ে দিলাম, মিলিয়ে নিস। কিন্তু বৃষ্টিটা ছাড়ার নাম করছে না, কেন বল তো?”  

                   --০০--

   

[*অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তর লেখা “বাংলার এম-এ” গল্পের নায়ক আলিপুর চিড়িয়াখানায় বাঘের চাকরি নিয়েছিল; ইতিহাসের বিএ যে মধ্যপ্রদেশের চিড়িয়াখানায় চাকরি নেবে, সে তো বলাই বাহুল্য।]                

 

                                                 

রবিবার, ২০ জুলাই, ২০২৫

প্রমোশন

 

পরির বাড়িতে একতলার বসার ঘরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকেই নিখিল দেখল অচেনা এক ভদ্রলোক বসে আছেন। নিখিল একটু হকচকিয়ে কী বলবে ভাবছে, কিন্তু তাকে দেখেই ভদ্রলোক এমন দাপটের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে দিলেন, যেন অনেক দিনের চেনা।  

“বসুন, বসুনআরে, এখানে নয়, এখানে নয়, ওই...ওই...চেয়ারটায়”চেয়ারটা সন্তর্পনে একটু দূরে সরিয়ে খুব সাবধানে নিঃশব্দে বসল নিখিল। মনে হল চেয়ারটা যেন ফঙ্গবেনে কাচের, একটু এধার ওধার হলেই ভেঙে চুরচুর হয়ে যাবে। নিখিলের বসাটা মন দিয়ে লক্ষ্য করার পর ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, “হুঁ, হুট করে একেবারে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন, তা কাকে চাই?”

নিখিল খুব আমতা আমতা করে বলল, “আামি নিখিল, ইয়ে মানে... পরি...মানে পরিচিতা নেই?”

ভদ্রলোক একটু অবাক হয়ে গমগমে গলায় বললেন, “খি আশ্চর্য, পরির বাড়িতে পরি থাকবে না তো, কে থাকবে? তা আপনি কী পরিচিতার খুব পরিচিত?”

ভদ্রলোকের আলতো ধমকে নিখিল একটু যেন এলোমেলো হয়ে গেল, বলল, “আজ্ঞে, হ্যাঁ আমি আর পরিচিতা একই কলেজে পড়েছি, সেই থেকেই আমরা পরিচিতা....ইয়ে মানে... ও আমার পরিচিত এবং খুব ভালো বন্ধু”

নারকেলের বাস্‌নার পুরুষ্টু ঝাঁপালো দুই ভুরু কুঁচকে ভদ্রলোক নিখিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “পরি এখন তো আর কলেজে পড়ে না, পাস করে চাকরি করছে। তা আপনি কী এখনো কলেজেই, নাকি কাজ কম্মো কিছু যোগাড় হয়েছে?”

নিখিল ভীষণ বিনীত স্বরে বলল, “না, না পরির সঙ্গেই কলেজ থেকে পাস করে গেছি, আর কাজ বলতে, হ্যাঁ, অকাজ-কাজ দুটোই করি বৈকি!”

নাকমুখ কুঁচকে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, “কাজ বলতে যদি চাকরি ধরে নিই, তাহলে অকাজটা কী?”

নিখিল একটু গর্ব করে বলল, “অকাজ মানে, ওই একটু আধটু লেখালেখি করি”।

ভদ্রলোক বিরক্ত মুখে বললেন, “লেখালেখি করেন? মানে লেখক? তা কী ধরনের ইয়ে লেখা হয় শুনি?”

ভদ্রলোকের কৌতূহলে নিখিল খুব উৎসাহ পেল, বলল, “বেশীর ভাগ ছোট গল্প, স্যার, বড়দের জন্যে, ছোটদের জন্যে। তাছাড়াও দু একটা উপন্যাস...”

“অ, চার্লস ডিকেন্স? ডেভিড কপারফিল্ড, এ টেল অব টু সিটিজ গোছের, নাকি মপাসাঁ গোছের”?

নিখিল অবাক হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল, কিছুক্ষণ। তারপর খুব মৃদুস্বরে বলল, “আমি স্যার বাংলায় লিখি, ইংরিজিতে নয়!”

“বা-আং-লা-আ-য়?” ভদ্রলোক নাক কুঁচকে বললেন, “বঙ্কিম, শরৎ, রবিঠাকুরের পর, বাংলায় কেউ লেখে? চোখে পড়েনি তেমন!”

নিখিল কোন উত্তর দিল না। চোখের সামনে এমন একটি স্পেসিমেন সে দেখতে পাবে কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। ২০২৫-এর এই ভ্যাপসা শ্রাবণে, ইংরিজি সাহিত্য বলতে কেউ চার্লস ডিকেন্সের নাম বলবে, ভাবা যায় না। এমন অঘটন আজও হয়? তার মনে হল, এই পুজোর ছুটিতে তুঙ্গভদ্রা কিংবা নর্মদা বেসিনে টিরানোসোরস খুঁজতে গেলে, কেমন হয়? বলা যায় না, এরকমই দু একপিস সেখানে, এখনো হয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছে! কিছু না বলে, সে তাকিয়ে রইল ভদ্রলোকের দিকে।

নিখিলের কোন উত্তর না পেয়ে ভদ্রলোক আরো উৎসাহী হয়ে বললেন, “ফ্রম শেক্সপিয়ার থেকে আপ টু ডিকেন্স পর্যন্ত, এক্সসেপ্ট ইংলিশ লিট্‌রেচার ছাড়া, ইন দিস প্ল্যানেট, আর কিছু হয় না”তারপর একটু থেমে, করুণাঘন গলায় আরো বললেন, “আমি বাংলাকে মোটেই ডিজহার্টেন করছি না, আফটার অল ইট ইজ মাই মাদার্স ল্যাংগোয়েজ। তবে সাহিত্যের কথা যদি বলতেই হয়, তাহলে বলব, ইন কম্প্যারিজন্‌ উইথ দেম তুলনা করলে, বাংলা ইজ আ মেয়ার ছাইল্ড” “ছাইল্ড” কথাটা বলার সময় দু কাঁধ ঝাকিয়ে যা শ্রাগ করলেন, সে দেখার মতো! অবিকল ষাটের দশকের মার্লন ব্রাণ্ডো টাইপ।  

ভদ্রলোক নিখিলের মুখের দিকে তাকিয়ে তার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করলেন, তারপর বললেন, “আপনাকে “তুমি” বললে কিছু মনে করবে না, নিশ্চয়ই! তুমি যখন পরির বন্ধু, “তুমি” বলতেই পারি”

নিখিল বিনয়ের অবতার হয়ে বলল, “মনে কী করবো, তুমিই বলবেন, স্যার”।

ভদ্রলোক সম্মতির ঘাড় নেড়ে বললেন, “ওয়েল, যে কথা হচ্ছিল, সে কথায় ফিরে আসি। সাহিত্য হিসেবে বাআংলাআ... এই যেমন ধরো, সাগরসঙ্গমে নবকুমার। তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন? ঠিইইক আআছে, চলে যায়। তবে কি না, সেই ইয়েটা ঠিক পাওয়া যায় কী? মানে, কী বলতে চাইছি বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই”

নিখিল ভাবলেশহীন মুখে বলল, “আজ্ঞে, সে তো বটেই! জলের মতো পরিষ্কার। এ আর না বোঝার কী আছে? একটু ইয়েই যদি না পাওয়া যায়, তা হলে আর সাহিত্য লিখে বা পড়ে লাভ কী?”

ভদ্রলোক খুব উজ্জ্বল মুখে নিখিলকে সমর্থন করে বললেন, “এক্স্যাক্টলি। তারপরে যেমন ধরো, রথের মেলা হইতে ঘরে ফিরিয়া রাধারাণী দেখিল টাকায় নাম লেখা আছে রুক্মিণী কুমার রায়। এখানেও কোথায় যেন সেই ইয়েটার একটা অভাব রয়ে গেল। তোমার কী তাই মনে হয় না?”

“আজ্ঞে একশ বার মনে হয়। মনে না হয়ে উপায় আছে? ওই ইয়েটুকু ছাড়া কী আর ইয়ে হয়?”

“তুমি কেমন লিখছো, তা আমি জানি না। আর সে জানার আমার প্রবৃত্তিও হয় না। কারণ আমি আবার কোন কিছুর মুখের ফেস ভ্যালুতে যাই না। সেটা আমার দোষ বা গুণ যাই বলো। আমি আসলে যে কোন বিষয়ের গভীরে না গিয়ে, কোন ধারণা তৈরি করতে পারি না”

নিখিল উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল, “দারুণ বলেছেন, স্যার। অন্য কিছুর ফেস ভ্যালুতে গেলেও, মুখের ফেস ভ্যালুতে কক্‌খনো যেতে নেই”

ভদ্রলোক উজ্জ্বল চোখে নিখিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি বেশ ইন্টেলিজেন্ট। তোমার সাধারণ কমন সেন্স জ্ঞানও খুব পরিষ্কার”

নিখিল গদ্গদ স্বরে বলল, “থ্যাংকিউ স্যার, থ্যাংকিউ”

নিখিলের কথায় পাত্তা না দিয়ে ভদ্রলোক আবার বললেন, “বাংলা সাহিত্য একটা সময় তো গুলে খেয়েছি, হে। সব কথা বলতে গেলে, রাত ভোর হয়ে যাবে”

“তা হোক না, স্যার। আপনার থেকে দু একটা কণাও যদি পাই, আমার কাছে সেটাই সম্পদ হয়ে থাকবে। আমার সময়ের কোন অভাব নেই, স্যার”

“আরে তোমার সময়ের কথা কে ভাবছে, হে? কিন্তু তাই বলে আমার সময়ের কোন মূল্যই নেই বলতে চাও? সাতখানা কোম্পানীর আমি ডিরেক্টর! হতভাগা চেয়ারম্যানগুলো আমাকে ছাড়া একপাও চলতে পারে না। এই অজিত লাহিড়ি ছাড়া কোম্পানীগুলো এতদিনে ডকে উঠে যেত, হে”

নামটা শুনে নিখিল একটু চমকে উঠল। এ নাম তো সে পরির মুখে বহুবারই শুনেছে! পরির প্রবাসী কাকা, দারুণ নাকি পণ্ডিত লোক! এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটির নামকরা প্রফেসর! পরির মুখে এঁনার নামে, সে এত প্রশংসা শুনেছে, নিখিল অনেকবার ঈর্ষাও অনুভব করেছে, এই ভেবে যে, পরি কাকে বেশি ভালোবাসে, তাকে নাকি তার এই কাকাকে? পরির মুখে শুনে এই ভদ্রলোক সম্পর্কে তার ধারণা হয়েছিল মহান, কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে জালিস্য জালি লোক! তার ওপর প্রফেসর-ট্রফেসর কিচ্‌ছু নয়, সাতখানা কোম্পানীর ডিরেক্টর! এযে একেবারে ঢপের চপ, ছ্যাঃ। পরিকে চেপে ধরতে হবে তো!

অজিতবাবু নিখিলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আবার শুরু করলেন, “নাও আয়াম রানিং সিক্সটিসিক্স। আর কতদিন টানতে পারবো হে! মাঝে মাঝে মনে হয় এসব ছেড়ে ছুড়ে, শেষ কটা বছর আরামে ছুটি কাটাই। কিন্তু দায়িত্ব? আমার কলমের একটি খোঁচায় অনেকেরই পেটের ভাত বন্ধ হয়ে যাবে, হে, পেটের ভাত বন্ধ হয়ে যাবে। তা তো আর হতে দিতে পারি না! যতদিন ঈশ্বর ক্ষমতা দেবেন, চালিয়ে দিয়ে যাই সংসারগুলো। আমি চোখ বুজলে, তিনিই যা করার করবেন। তবে হ্যাঁ, তোমাদের ওই ঈশ্বর-টীশ্বরেও আমার তেমন আস্থা নেই”

“আজ্ঞে, আপনিই তো কত লোকের অন্নদাতা, আপনিও তো ঈশ্বরের মতোন”

“আরে না, না। ওসব তেমন কিছু নয়। নিজের কথা অন্যের কাছে ঢাক পিটিয়ে আমি বলি না, বা বলতে পছন্দও করি না। যাক গে, যে কথা বলছিলাম। তোমাদের এই রবিঠাকুরকে ধরো আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে...এভাবে একটা দেশের সর্বনাশ করার কী যুক্তি আমি বুঝে পাই না”

নিখিল আশ্চর্য হয়ে বলল, “দেশের সর্বনাশ?”

“সর্বনাশ নয়, কী বলছ হে? এমনিতেই ইওরোপ, আমেরিকার সাধারণ মানুষ, ভারত সম্বন্ধে খুব ধোঁয়াটে একটা ধারণা নিয়ে থাকে। হাতি, জটাওয়ালা সাধু। কুম্ভমেলা। সাপের খেলা, আগুনে ঝাঁপ, রোপ ট্রিক্সভারতে শিশুমেয়েদের জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বিবেকানন্দ পড়েছ? তিনি এক আমেরিকান ভদ্রলোকের এরকম প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, “হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন, ভারতে পুরুষরাই সন্তান ধারণ করে”! তার মানে আমরা সবাই পুরুষের গর্ভজাত! হা হা হা হা, ব্যাপারখানা বুঝে দেখ একবার। তা এরকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে নদী নিয়ে এমন কবিতা না লিখলেই চলছিল না? ছোট নদী। বোশেখ মাসে হেঁটে লোকজন, গাড়ি পার হয়ে যায়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নাইবার কালে গামছায় জল নিয়ে মাথায় ঢালে, মাছ ধরে। এ সব কেন? উনি একবারও ভেবে দেখলেন না, এর পর, ওই নদীতে ব্রিজ বানানোর জন্যে কিংবা ইরিগেসানের ড্যাম বানানোর জন্যে, কোনো ফরেন ব্যাংক বা ইনভেস্টার আমাদের দেশে আসবে? তারা হাসবে না? বলবে না - ইন সামার ভেরি লিট্‌ল্‌ ফ্লো অফ ওয়াটার ইন রিভার, পিপ্‌ল্‌ ওয়াক অন ইট, নো ব্রিজ ইজ রিকয়ার্ড টু ক্রস দ্য রিভার? বিশ্বকবি হয়ে, এমন একটা কবিতা লেখা অবিমিশ্রতা নয়?”

নিখিল পুলকিত হয়ে বলল, “ছি ছি ছি ছিঃ। একেবারে অবিমিশ্র অবিমৃষ্যতা, বৈকি!”

“তবে? তারপরে ধরো তালগাছ। তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে। ছাড়িয়ে তো ছাড়িয়ে, তাতে হয়েছেটা কী? তালগাছ থেকে কী পাই কি আমরা? তাল? বছরে এক-দুদিন, তালের মাড়ি ঘষে বের করে, কটা ফুরুলি, তালক্ষীর, তালের রুটি। গরমের শুরুতে তালশাঁসলক্ষ্মীপুজোয় তালের ফোঁপোল। তাছাড়া তালপাতার ভেঁপু, তালপাতার সেপাই। ছোটলোকের নেশার জন্যে তাড়ি। আর একটু আধটু তালগুড়! এর জন্যেই এত হইচই, কবিতা? কেন আমগাছকে প্রোমোট করা যেত না? কিংবা নারকেল? আম, নারকেল আর নারকেলের নানান প্রোডাক্ট কম এক্সপোর্ট হয়? এর থেকে আমাদের কম ডলার আমদানি হয়? এর কোন উত্তর আছে তোমার কাছে?” নিখিল কোন উত্তর দিল না। তাকিয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে।  

ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, “নেই, আমি জানি কোন উত্তর নেই। আরেকটা এক্সামপ্ল নমুনা দিই। শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে। সবই যখন ঋণে চলে গেল, তখন বাকি এই দুবিঘে নিয়েই বা এত আদিখ্যেতা কেন? বাবু তো ফ্রিতে জমি নেবেন, কিংবা লেঠেল দিয়ে জমি কেড়ে নেবেন, এমন তো বলেননি। বলেছিলেন, এ জমি লইব কিনে! তা হলে? বাবু একটা বাগান করেছেন, তার সঙ্গে আরো দু বিঘে হলে তাঁর বাগানটা আরো সুন্দর সাজাতে পারবেন। একটা বাগানের প্রোডাকসান জানো? কত ফল-ফুরুলি, কত রকমের ফুল। বাবুরও লাভ, দেশ এবং দশেরও লাভ। তাছাড়া গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান। এক একটা গাছ মানে কতটা অক্সিজেন? পরিবেশের কতটা উন্নতি? সেদিকটা ভেবে দেখবেন না? সে সব দিকে না গিয়ে, উপেনের পেন নিয়ে উনি সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়িওয়ালা কবিতা লিখে ফেললেন? আমি তো বলবো ঘোরতর অন্যায় করলেন। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে যে বিক্ষোভ আর ভুল বোঝাবুঝি সে কী ওই উপেনকে দিয়েই শুরু নয়?”

নিখিলের মনে হল, কথায় কথায় অজিতবাবু বেশ উত্তেজিত এবং রেগে উঠলেন! সে কোন কথা না বলে, চুপ করে শুনতে লাগল। ভদ্রলোক একটু থেমে থেকে, খুব চিন্তা করতে করতে বললেন, “তবেএএএ একটা গল্প বরং বেশ লেগেছিল”

“তাই? আপনার ভাল লেগেছিল? বলেন কী? কোনটা বলুন তো?”

“ভদ্রলোকের মোটামুটি একটা লেখার হাত তো ছিলই, সেটা তো আর অস্বীকার করা যায় না। ছুটি। সেই যে ফটিকের গল্প। বাপ মরা দুরন্ত ছেলেটাকে মামা এসে নিয়ে গেল, নিজের কাছে রেখে মানুষ করবে বলে। তারপর মামীর অবহেলা, মুখঝামটা। তারপর তো কদিনের জ্বরে মারাই গেল ছোঁড়া”

“হুঁ। খুব প্যাথেটিক গল্পটা, এমন প্রাণবন্ত দুরন্ত একটা ছেলে...”

“অ্যাই, তোমাদের ওমনি নাকে কান্না শুরু হয়ে গেল। গল্পটার আসল বিষয়বস্তুটাই তোমরা ধরতে পারোনি...”

নিখিল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “ফটিক মামার বাড়ি যাওয়ার সময় নৌকায় নদী পার হয়েছিল। সে নদী বেশ গভীর...একে বাঁও মেলে না। দুয়ে বাঁও মেলেএএএএ না। বলি কিছু বুঝতে পারলে? এটাই ওই গল্পের সারকথা। ছোট নদীর বর্ণনা দিয়ে যে ভুল হয়েছিল, এই গল্পে তার প্রায়শ্চিত্ত হল!”

নিখিল একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “এই কটা লেখা ছাড়া আপনি রবিঠাকুরের কবিতা-টবিতা, গল্প-টল্প বেশি কিছু পড়ার সময় পাননি মনে হয়!”

অজিতবাবু খুব তাচ্ছিল্যে মুখ বেঁকিয়ে বললেন, “ন্যা, ন্যাঃ, পড়ার প্রবৃত্তিও হয়নি। আমাদের শিক্ষাদপ্তরের মাথা মাথা লোকেরা অনেক মাথা ঘামিয়ে আমাদের পাঠ্য বইয়ের সিলেবাস বানান। তাঁরা বুঝে শুনে বেছেবুছে কয়েকটি স্যাম্পল আমাদের পড়ার জন্যে সিলেক্ট করে থাকেন। বলি, ভাত রাঁধতে গিয়ে তুমি কী হাঁড়ির সব চাল টিপে টিপে দেখ? বলো না, কটা চাল টেপ?”

“আজ্ঞে দু একটা”।

“অ্যাঅ্যাঅ্যাই...তারপর ধরো মাংস রান্নার সময়, সব মাংসের টুকরো কী চেখে চেখে দেখ, সেদ্ধ হল কী না, তেল-মশলা-নুন ঠিকঠাক হল কী না?” নিখিল অসম্মতিতে ঘাড় নাড়তে অজিতবাবু বললেন, “ঠিক সেরকম, ওই স্যাম্পলগুলি মন দিয়ে পড়লেই বোঝা যায় কার কত দৌড়, বুঝলে না? আমার আবার পল্লবগ্রাহীতা ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ নয়, আমি যাই অনেক গভীরে ডিপরুটেড শেকড় পর্যন্ত। আর সেভাবেই পড়ে বুঝতে পেরেছি, আর কিছু পড়ার দরকার নেই! শুনেছি রবিঠাকুর তাঁর সারাজীবনে গাদা-গুচ্ছের লিখেছেন! তিনি অনর্থক খেটেছেন বলেই, আমাকেও সময় নষ্ট করে, সব পড়তে হবে, তুমি কী আমাকে অতই আহাম্মক ঠাউরেছ?”

“আজ্ঞে না, আপনি পাঁচটা কোম্পানির ডিরেক্টর, আপনার কত দায়িত্ব...”।

“রাবিশ। পাঁচটা নয় সাত-সাতখানা কোম্পানির আমি ডিরেক্টর”।

“স্যরি স্যার, ভুল হয়ে গেছে”।

“স্যরি বললেই হয়ে গেল? অবিশ্যি তোমাকেই বা বকাবকি করে লাভ কী? বাঙালী ঘরেই তো তোমার জন্ম, তোমার আর দোষ কী? বাঙালীরা ইংরিজির সব কিছু সরিয়ে, “স্যরি”-টুকুকেই সার মেনেছে! বলি পড়াশুনো কোথায় করেছো, নিশ্চয়ই বাংলা মিডিয়মে”?

“আজ্ঞে হ্যাঁ, প্রমদারঞ্জন মাল্টিপার্পাস হাইস্কুল”।

মুখ টিপে হেসে অজিতবাবু বললেন, “ওই ভুলটা আমি আর করিনি, আমার নেক্সট জেনারেশনকে আমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়েছি। নিজের পুত্র এবং কন্যা বলে গর্ব করছি না, তারা সত্যিই মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। ইংরিজিতে তারা যখন কথা বলে, কে বলবে তারা সায়েবের বাচ্চা নয়! ওরা ভাইবোনে নিজেদের মধ্যে ইংরিজিতেই কথা বলে, আর যখন তারা গল্প করে, আমি যে আমি এত ইংরিজি ভক্ত, সেও কেমন ভ্যাবলা মেরে থাকি। আফটার অল আমারও তো ব্যাকগ্রাউন্ড ওই বাংলা মিডিয়াম কী না? এই বয়েসে এখনও একটা কমপ্লেক্স কাজ করে, আর কী!”

“এই কমপ্লেক্সকে কম বলে ছোট করবেন না, স্যার, বরং বেশিপ্লেক্সই বলুন”!

নিখিলের মন্তব্যে কান না দিয়ে অজিতবাবু বলতেই লাগলেন, “আমার পুত্রকন্যা দুজনেই বাংলা লিখতেও পারে না, পড়তেও পারে না। বলতে পারে, বাট তাতে এত হিন্দি আর ইংরিজি থাকে...তাকে বাংলা না বলাই ভালো। একটা কথা তো স্বীকার করবে, বাংলা হচ্ছে আদতে ছোটলোকের ভাষা। চাষাভুষো, কেরানি-মজুরদের ভাষা, আমজনতার ভাষা! সে ভাষা ভদ্র, অ্যারিস্টোক্র্যাট, ব্লুব্লাড সমাজে একেবারেই অচল”।

এই সময় নিখিলের মোবাইলটা বেজে উঠল, ফোন তুলে পর্দায় দেখল, পরি কলনিখিল অজিতবাবুর থেকে ইশারায় অনুমতি নিয়ে ঘরের বাইরে বারান্দায় এল, অজিতবাবুর ব্যাপারটা খুব যেন মনঃপূত হল না, তাঁর কথা বলার বেশ একটা মুড এসেছিল, তাতে বাধা পড়াতে নাক-মুখ কুঁচকে “হুঁ” বললেন।

ফোন কানেক্ট করে নিখিল বলল, “তুই কোথায় রে? তোদের বাড়িতে কতক্ষণ এসে বসে আছি, আর তোর দেখা নেই”!

“ও মা, তাই? নীচেয় কী করছিস?”

“তোর বাড়িতে এমন একটা জিনিষ আমদানি করেছিস, আগে বলবি তো! ওফ জান কয়লা করে দিল, মাইরি”।

“কেন বল তো?”

“তোদের বসার ঘরে ঢোকামাত্র এক ভদ্রলোকের খপ্পরে পড়েছি, এর চে কোন টেররিস্টের পাল্লায় পড়লেও শান্তিতে থাকতাম”।

“কে? কাকু? এঃ রাম। তোকে তো বলাই হয়নি। তুই এক কাজ কর, সিঁড়ি দিয়ে একদম ছাদে চলে আয়!”

“ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পালানোর থেকে, সামনের সদর দরজা দিয়ে পালানো সহজ নয়?”

“আঃ বাজে বকিস না, যা বলছি শোন। চটপট ছাদে আয় ”।

ফোনটা কেটে দিল পরি। নিখিল আর সময় নষ্ট না করে একবার বসার ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে, জোড়া জোড়া সিঁড়ি টপকে দৌড়ে উঠে গেল ছাদে। পরি দাঁড়িয়েছিল সিঁড়ির মাথায়। নিখিলের হাত ধরে ছাদের এক কোণে নিয়ে গিয়ে বলল, “কাকু কী বলছিলেন, রে তোকে?”

“এই কী তোর সেই কাকু? যার প্রশংসায় তুই একেবারে পঞ্চমুখ!”

“হ্যাঁ। ছোটবেলায় আমাদের বাবা-মা মারা যাবার পর, উনিই আমাদের দুই ভাইবোনকে নিজের ছেলেমেয়ের মতো মানুষ করেছেন। আমাদের জন্যে বিয়ে-থাও করেননি। ভাবা যায়?”

“সে কী? উনি যে বললেন, ওঁনার ছেলে-মেয়েকে ইংরিজি মিডিয়ামে পড়িয়ে চৌখোস সায়েব বানিয়েছেন!”

পরি ভীষণ অবাক হয়ে বলল, “যাঃ, কাকু তোকে তাই বলেছে?” 

“তবে? তার ওপর তুই বলেছিলি উনি নাকি বিরাট পণ্ডিত লোক, প্রচুর পড়াশুনো...কিন্তু এত ভুলভাল ভাঁট বকেন কেন? তুই বলেছিলি, উনি এলাহাবাদ না কোথাকার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর...কিন্তু উনি তো বললেন, উনি সাতটা কোম্পানির ডিরেক্টার!”  

“কোম্পানীর ডিরেক্টার? কাকু বলেছেন? তোকে? কী বলছিস?”

“হ্যাঁরে বাবা, তা নাহলে আমি জানব কী করে? তাছাড়া ওঁনার বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের ওপর এত আক্রোশ কেন বল তো?”

পরি নিখিলের কথা শুনে এত অবাক হল যে, হাঁ করে তাকিয়ে রইল নিখিলের মুখের দিকে। মাথায় হাত দিয়ে বলল, “দাঁড়া দাঁড়া, তুই যা বলছিস কাকুর সম্বন্ধে, তাতে আমার মাথা ঘুরছে...কিছুই বুঝতে পারছি না”!

এই সময় পরির মোবাইলে রিং হল, পরি ফোন তুলে দেখল কাকু কল করেছেনকানেক্ট করে বলল, “হ্যাঁ কাকু, বলো”। তারপর অনেকক্ষণ শুনল, নিখিল পরির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, মনে মনে ঠিক করল, এমন পাগল আর ভণ্ড লোকের হাত থেকে পরিকে বাঁচাতেই হবে!  

“....”

“কাকু, কাকু তুমি যে কী না...” পরির কথায় নিখিল মনে মনে শূণ্যস্থান পূরণ করল, ...যন্তোর জিনিষ একখানা!

“....”

“হা হা হা হা ... সত্যি তুমি পারোও কাকু। আমাকে অব্দি চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে! হা হা হা হা... ” পরির হাসি যেন আর থামতেই চায় না, দেখে নিখিলের গা জ্বলে উঠল। 

“....”  

“আসছি, আসছি। হ্যাঁ গো, দুজনেই আসছি”। ফোনটা অফ করে, পরি নিখিলের মুখের দিকে তাকালো, তারপর আবার হাসতে লাগল খুব...।

নিখিল একটু রেগেই গেল, “কী এত হাসছিস বলতো হ্যা হ্যা করে, এত হাসির কী হল?”

পরি নিখিলের হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল, “কাকু আমাদের এক্‌খুনি নীচেয় ডাকছে...চল...”

নিখিল থমকে গেল, বলল, “না, আমি আর যাবো না ওই মালের কাছে?”

পরি হাসতে হাসতেই বলল, “তুই আমার কাকুকে মাল বললি? নীচেয় চল, তারপর তোর হচ্ছে”।

প্রিয় কাকুকে “মাল” বলা সত্ত্বেও পরিকে হাসতে দেখে নিখিল খুব অবাক হল, তার ওপর পরি তার হাত ধরে টানছিল, তাই নিচেয় নামতে বাধ্য হল।

নীচের বসার ঘরে ঢুকে, পরি বলল, “এই যে কাকু তোমার পালিয়ে যাওয়া আসামী” বলেই হাসতে লাগল ওড়নায় মুখ চেপে। অজিতবাবুও হো হো করে কিছুক্ষণ হাসলেন, তারপর হাসতে হাসতেই বললেন, “আরে বসো, বসো, নিখিল। পুরো ব্যাপারটা তোমায় এখন খুলেই বলি, পরি তো সেই কবে থেকে তোমার প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ...হা হা হা হা ... ওই দেখ, কেমন লজ্জা পাচ্ছে মেয়েটা...হা হা হা ...তুই এখন এ ঘর থেকে যা, নিখিলের জন্যে মিষ্টি-টিষ্টি নিয়ে আয় আর সবার জন্যে চা...বেচারা খুব বিভ্রান্ত... হা হা হা ... ওর সঙ্গে ততক্ষণ আমার প্রাইভেট টকটা সেরে নিই”।

পরি রান্নাঘরে চলে যেতে কাকু, নিখিলের দিকে তাকিয়ে মজা পাওয়া মুখে বললেন, “এই ক’ বছরে, পরির মুখে তোমার এত প্রশংসা শুনেছি, সে আর বলার নয়! তোমার নাকি এত বুদ্ধি, তত বুদ্ধি। লেখাপড়ায় ভালো। তার পরে এই লেখ, সেই লেখ। আমার পরিকে তুমি এই ভালোবাস, সেই ভালোবাসসে সব শুনে আমার খুব হিংসে হত, বুঝলে, ভীষণ হিংসে! ভাবতাম আমার সেই ছোট্ট মেয়েটা তার প্রিয় কাকু ছাড়াও এমন কোন্‌ ছেলে পেল, যে একেবারে তার মাথা ঘুরিয়ে দিল। তাই এবারে ঠিক করেছিলাম, তোমাকে বাজিয়ে দেখবো। তোমাকে আগে থেকে কিছু বলতে, পরিকে আমিই মানা করেছিলাম। পরির সঙ্গে আমার চ্যালেঞ্জ ছিল, তোমাকে বোকা না বানাতে পারলে আমি তোর কাকুই নই”!

অজিতবাবুর গলাটা আবেগে কেমন যেন কেঁপে উঠল, আবেগের সেই সংক্রমণে নিখিলও অভিভূত। সশ্রদ্ধ চোখে সে অজিতবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, কোন কথা বলল না। নিজেকে সামলে নিয়ে অজিতবাবু আবার বললেন, “আজ সকালে ফ্লাইটে আসার সময় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল, বুঝলে? আমার পাশের সিটে বসেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত শিল্পপতি, ভদ্রলোকের নামটা আর বললাম না, সে আর তোমাদের জেনে কাজ নেই! আলাপ হবার পর, একঘন্টার জার্নিতে তিনি যা যা বলেছিলেন, সেই কথাগুলোই আমি একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তোমাকে বলে কেমন চমকে দিলাম, বলো?” তারপর একটু থেমে হাসি হাসি মুখে আবার বললেন, “নিজের মূর্খামিকেও কী ভাবে গভীর পাণ্ডিত্যের অহঙ্কারে মুড়িয়ে বাতেলা দেওয়া যায়, ভদ্রলোকের কাছে শেখার আছে বৈকি!  তবে তোমার সব লেখাই আমি পড়েছি, মানে পরিই পড়িয়েছে... আয়াম প্রাউড অফ ইউ, নিখিল।”

এই সময় পরি একটা ট্রেতে কিছু স্ন্যাক্স আর তিন কাপ চা নিয়ে ঘরে এল। অজিতবাবু তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছ্যাঃ, শুধুই স্ন্যাক্স, মিষ্টি-টিষ্টি কিচ্‌ছু নেই? তোদের দুজনের যে একই সঙ্গে প্রমোশন হচ্ছে, সেই আনন্দে কিছু খাওয়া-দাওয়া হবে না?”

পরি ও নিখিল একসঙ্গে অবাক হয়ে বলে উঠল, “প্রমোশন?”

কাকু দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ঝাঁপালো দুই ভুরু নাচিয়ে বললেন, “তুমি ছিলে বয়ফ্রেণ্ড, আর তুই গার্লফ্রেণ্ড, খুব শিগ্‌গিরি হবি পতি-পত্নী, এটা যদি প্রমোশন না হয়, তাহলে আর কোনটা প্রমোশন?” বলেই হা হা হা হা করে হাসতে লাগলেন প্রাণ খুলে।

নিখিল আর পরি দুজনেই অজিতবাবুকে প্রণাম করল।

নিখিল অস্ফুট গলায় বলল, “কাকু আপনি রিয়্যালি গ্রেট”।

অজিতবাবু নিখিলের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “ইউ টু”!

পরি কাকুর পাশে সোফার হাতলে বসে, কাকুর গলা জড়িয়ে ধরল, অজিতবাবু পরির মাথায় হাত রেখে বললেন, “আমার খেপি মাটা, আমার পাগলি মাটা”, বলতে বলতে আনন্দে তাঁর দুচোখ ঝাপসা হয়ে এল।

 

..০০..      

       

 

      

নতুন পোস্টগুলি

গেলেম নতুন দেশে

  এতদিন স্কুল আর বাড়ি, বাড়ি আর স্কুল - এই নিয়ে চলছিল আমার রুটিন বদ্ধ জীবনযাত্রা। ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পার করে, টেস্ট হয়ে স্কুল ছুটি ...