গতরাত
থেকেই অঝোর নিম্নচাপের ধারায় আমাদের এদিকে জলভাসি। সকাল সাড়ে দশটায় অফিস যাওয়ার
ইচ্ছেহীন চেষ্টায় ক্ষান্ত দিলাম। কিন্তু ঘরে বসেই বা সারাটাদিন করব কী? এগারোটা
নাগাদ রওনা হলাম আমাদের পাড়ার ক্লাবে, কেউ না কেউ নিশ্চই থাকবে। ক্যারাম খেলে আর
আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে নিম্নচাপের এই ল্যাদার্ত দিনটা।
হলও তাই।
ক্লাবে গিয়ে দেখি নবা, মিঠু, আর টিটু ক্যারাম বোর্ডে খটখট করছিল, আমাকে দেখেই হৈহৈ
করে উঠল ওরা, “অ্যাই ত, শিবে এসে গেছে, ভালই হয়েছে! আরেক পিস ভেজা কাক উড়ে এসে জুটলই
যখন জমিয়ে ক্যারাম খেলা যাক”।
আমার
পরনে ছিল, বারমুডা আর গলাকাটা টিশার্ট। বলাবাহুল্য দুটোই ভিজে গিয়েছিল আসার পথে,
কাজেই ভেজা কাক বিশেষণে, আমার যে বিশেষ অসম্মান হল, তেমন নয়। আর হলেই বা কী, এই
নিম্ন চাপের দিনে এমনিতেই আমার মিয়োনো মুড়ির মতো অবস্থা। চারজনে ক্যারামে বসে
গেলাম তৎক্ষণাৎ। কিন্তু ক্যারামই বা কতক্ষণ খেলা যায়? ঘন্টাখানেক খেলার পর যখন
আমরা বোর হয়ে তালগাছ খেলার কথা ভাবছি, ঘরে এসে ঢুকল ভূষিকা। ভূষিকা খুব মজার হাঁকডাক করা মানুষ।
যেখানে বসেন একেবারে জমিয়ে বসেন, কচিকাঁচা থেকে পাকাবুড়ো সক্কলের সঙ্গেই ওঁনার
সমান জমে।
আমরা
সব্বাই ক্যারাম খেলা ছেড়ে হামলে পড়লাম, “ওফ, ভূষিকা, আজকের দিনে তুমি ছাড়া আর
কাউকে ভাবাই যায় না, মোক্ষম দিনে মোক্ষম সময়ে এসে পড়েছ।”
ভূষিকাকার
ভাল নাম ব্রজভূষণ সমাদ্দার, তার থেকে ভূষি, আদর করে আমরা ভূষিকা বলি। ভূষিকাকা
মেঝেয় পাতা শতরঞ্চিতে বসতে বসতে বলল, “এমন ঘনঘোর বরিষায়, জমিয়ে গল্প বলা যায়...তাই
বলছিস তো?”
আমি
পাকামি করে, ফোড়ন দিলাম, “ওটা পুরোন এডিশনের গান, নতুন এডিশনে এমন ঘনঘোর
নিম্নচাপে, বলা আছে।”
“তার
মানে? এটা আবার কবে বের হল?”
ভূষিকাকার
এই প্রশ্নে আমি, মাতব্বরের মতো জবাব দিলাম, “বেরোয়নি, খুব শিগ্গিরি বেরোবে। আজকাল
বর্ষা আর হয় না। বৃষ্টি হয়, হাল্কা, মাঝারি, ভারি, এমনকি বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিও বিস্তর
মেলে, কিন্তু নো বর্ষা। টানা বৃষ্টি মানেই নিম্নচাপ।”
মিঠু
বলে উঠল, “ভূষিকা, তুমি শিবের কথায় কান দিও না তো, এতদিন পরে এলে, কোথায় ছিলে, কী
করলে সে কথা বলো। অনেকদিন পর এলে, প্রায় ছ-সাত মাস পরে, তাই না?”
মিঠু
আমাকে থামিয়ে দিলে কী হবে? আমি থামার পাত্রই নই, বললাম, “ভূষিকা, তোমার গল্পের
ঝুলি থেকে ঝুল ঝেড়ে গল্প না বললে, আমরা কিন্তু তোমাকে ঝুলোঝুলি করতেও পিছপা হবো
না, এই বলে দিলাম”।
ভূষিকা
একথায় একটু ত্রস্ত ব্যস্ত হয়ে বলল, “আরে
দাঁড়া, দাঁড়া, আসার পথে বিজুদার সঙ্গে দেখা। কেমন আছো, জিগ্যেস করতেই বিজুদা তার
অম্বলের ব্যাখান শুরু করল। অম্বলের থেকে বাঁচতে কোনরকমে ক্লাবে পালিয়ে এলাম। এখানে
এসে আবার দেখছি, শিবুর আনকোরা নিম্নচাপের এডিশন!” ভূষিকা অসহায়ের মতো মুখ করে,
আমাদের দিকে তাকাল।
আমি
বললাম, “ওফ, বিজুকাকার পাল্লায় পড়েছিলে? খুব অল্প সময়ে, পেল্লায় বাঁচা বেঁচে গেছ
বলতে হবে। আমরা তো এখন ওঁনাকে দেখলেই পালিয়ে বেড়াই। ওঁনার অম্বলের কথা যতো কম বলা
যায় ততই ভালো। বলতে কী আমরা দিন দিন কমবল, মানে হীনবল হয়ে পড়ছি ওঁনার অম্বলের কথা
শুনতে শুনতে।”
ভূষিকাকা
আমার দিকে খুব সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “শিবু, তোর শরীর খারাপ না কী রে?
কেমন সব কথা বলছিস জড়িয়ে মড়িয়ে, মিলিয়ে মিশিয়ে! কী হল কী তোর?”
নবা
খুব বিরক্ত মুখে উত্তর দিল, “ভূষিকা, শিবের মাথাটা একদম নষ্ট হয়ে, পচে গেছে। এবার
বইমেলা থেকে শিব্রাম সমগ্র কিনে পুরোটা পড়েছে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে, কথাবার্তার
মাথামুণ্ডু ঘুঁচে গেছে।”
ভূষিকা
এ কথায় হো হো হাসল খানিক, তারপর বলল, “অ, এই কথা? শিবুর মাথায় শিব্রাম ভর করেছে? তোদের
মতো বয়সে আমিও পড়েছিলাম, কিছুদিন আমারও ওই রোগ ধরেছিল, অনেক কষ্টে ছাড়ান পেয়েছি।
দাঁড়া আজ বিজুদার অম্বলের ওষুধটা দিই, পরে একদিন শিবুকে নিয়ে পড়ব।”
নবা
জিগ্যেস করল, “তুমি কী বিজুকাকাকে ডেকে এলে? উনি আসছেন নাকি, এখন? সেরেছে, আড্ডাটা
টকিয়ে ছাড়বে একেবারে।”
ভূষিকাকা
মুচকি হেসে বলল, “ঘাবড়াসনি, যা বলার আমিই বলব, তোরা শুধু শুনবি। দেখ না বিজুদার
অম্বল যদি না সারাতে পারি, আমার ব্রজভূষণ নামটা তোরা পাল্টে দিস”।
আমি
বললাম, “আমরা যারা অম্বলে টক নই, এক কথায় যারা না-টক, তারা একদম নো Talk, তাই তো ভূষিকা?”
আমার
কথায় সকলেই বিরক্ত হয়ে “ওফ্” করে উঠল, শুধু ভূষিকাকা আমার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে
বলল, “অসুখটা ভালই বাধিয়েছিস রে, শিবে, সারতে সময় লাগবে। ভাবিয়ে তুললি বেশ।”
ভূষিকার
কথা শেষ হল কি হল না, বিজুকাকা ক্লাব ঘরে পা রাখলেন এবং ঢুকেই, বিশাল এক ঢেঁকুর
তুললেন, “হেউ”।
সেই
শুনে ভূষিকা বলল, “এ কী করেছ, বিজুদা? শরীরে এতো অম্বল পুষে রেখেছো? এতো ভালো কথা
নয়।”
“ভালো
কথা নয়ই তো! কি জ্বালায় যে জ্বলছি, সে শুধু আমিই জানি। পেট থেকে গলা অব্দি
সারাক্ষণ জ্বলছে। কেউ বুঝতে চায় না, যাকেই বলি, ইয়ার্কি-ফাজলামো করে।” বলেই আবার
ঢেঁকুর তুললেন “হেউ”।
“হায়,
হায়। একদিকে সঙ্গে নেইকো কেউ, ওদিকে ঢেঁকুরের বড়ো বড়ো ঢেউ।” আমি নাtalk থাকতে পারলাম না, বলেই ফেললাম। আমার দিকে বাকিরা কটমট করে
তাকাল, কিন্তু ভূষিকার চোখে সহানুভূতি, জ্বরে ভোগা ছেলের দিকে মায়েরা যে চোখে
তাকান, অবিকল সেই দৃষ্টি!
ভূষিকা
ভীষণ গম্ভীর মুখ করে বলল, “বিজুদা, তোমার এই অম্বল নিয়ে কয়েকটা কথা জিগ্যেস করবো,
সত্যি করে বলবে?”
“কী
বল তো? যদি কিছু সুরাহা হয় কেন বলবো না? কী জানতে চাস বল না, ভূষি?”
“ফুচকা
আর আলুর চপ কতদিন খাওনি?”
“মনে
নেই রে, তা প্রায় বছর পাঁচেক তো বটেই, ফুচকা তো তারও বেশি, তা ধর বছর আষ্টেক। আগে
তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েরা ফুচকা খাচ্ছে দেখলেই বুক আইঢাই করে, চোঁয়া ঢেঁকুর উঠতো।
এদান্তিতে সেটা একটু কমেছে। তবে আজ তোর মুখে ওই সব নাম শুনেই গলার কাছটা চিনচিন
করছে।”
ভূষিকা
খুব উদ্বিগ্ন মুখে বলল, “বলো কী, বিজুদা। এখনই কিছু একটা না করলে তো পরিস্থিতি
নাগালের বাইরে চলে যাবে।”
এই
কথায় আমি আর থাকতে না পেরে আবারও বলেই ফেললাম, “গালে দেওয়ার মতো কোন খাদ্যই আর
পাওয়া যাবে না, তখন সব খাদ্যই নাগালের বাইরে না-গাল হয়ে, গালের বাইরে পড়ে থাকবে।”
কিন্তু আমার কথায় কেউ কানই দিল না।
ভূষিকা
একই রকম মুখ করে বিজুকাকাকে আবার জিগ্যেস করল, “সকালে উঠে খালি পেটে জল খেলেও কী
অম্বল অম্বল লাগে?”
মেয়েরা
তেঁতুলের আচার খেয়ে, চোখ ছোট করে, জিভে যেমন টকাস আওয়াজ তোলে, বিজুকাকা সেরকম
আওয়াজ তুলে বলল, “লাগে মানে? জল খাবার পাঁচ মিনিটের মধ্যে মনে হয়, এক পেট কাঁচা
আমের সরবৎ গিলেছি। কিংবা পাকা তেঁতুল গোলা জল খেয়েছি। দাঁত ব্রাশ করার সময় দেখি
দাঁত টকে গেছে। ছোটবেলায়, নুন ছাড়া কাঁচা আম, গাছ থেকে পেড়ে খেলে, দাঁতের যে
অবস্থা হত, সে রকম আর কি!”
ভূষিকা
এই কথায় শিউরে উঠল যেন, বলল, “ইসসসস.....তোমার অবস্থা তো বেশ ঘোরালো হয়ে উঠেছে গো,
বিজুদা”?
আমি
ফুট না কেটে পারলাম না, “ভূষিকা ঘোর আলো কী বলছো, এ তো ঘোর অন্ধকার!”
ভূষিকা
আমাকে পাত্তাই দিল না, বলল, “তোমার কথা শুনে, আমার সেই বাঘের কথা মনে পড়ছে গো,
বিজুদা, একদম তোমার মতো অবস্থা হয়েছিল। বেচারা, তার কথা মনে পড়লেই...”।
বিজুকাকার
কথাটা পছন্দ হল না, বিরক্ত মুখে বলল, “আমার অবস্থা বাঘের মতো, কী বলছিস কি, ভূষি,
আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
কিন্তু
আমরা সবাই হৈ হৈ করে উঠলাম গল্পে বাঘের গন্ধ পেয়ে। আমি তো বলে়ই ফেললাম, “বিজুকাকার
এমন ঘোরালো অম্বলকে বাগে আনতে, বাঘের ধারালো সাহায্য তো নিতেই হবে। ঘোর
আলোর থেকে ধারের আলো এমন আর মন্দ কী? সত্যি বলতে এই অম্বল সারাতে ওই পথই একমাত্র
সম্বল। ভূষিকা তুমি ব্যাপারটা খুলে বলো।”
এইবার
আমার কথায় সক্কলে হৈ হৈ করে বিপুল সমর্থন করল। খুব সিরিয়াস মুখ করে ভূষিকা বলল, “আমরা
কথাটা শোন না বিজুদা, তাহলেই বিষয়ের গুরুত্বটা বুঝে যাবে।”
তারপর
একটু চুপ করে থেকে ভূষিকা শুরু করল, “ঘটনাটা বছর তিরিশ আগেকার। আমি তখন
চব্বিশ-পঁচিশ বছরের জোয়ান ছোকরা। হিস্ট্রিতে বিএ করে বসে আছি, বেকার। কলকাতায়
চাকরি-বাকরির অবস্থা এখনকার থেকেও খুব খারাপ। বাংলার
এমএতে, কলকাতা চিড়িয়াখানার[*] খাঁচাগুলো ভরে গেছে! এ আপিসে, সে আপিসে ঘুরে ঘুরে
কলকাতায় কোন কিছুই জুটল না। শেষ অব্দি আমার এক বন্ধুর পিসেমশাইয়ের সুপারিশে সোজা
চলে গেলাম নয়াগড়। নয়াগড় তখনও দেশি রাজ্য, সেখানে রাজা ছিল, রাজমন্ত্রী, রাজবদ্যি
সব ছিল। ছিল না শুধু সেনাপতি আর সৈন্য সামন্ত। তবে কি না সে নামেই রাজ্য আর রাজা,
আসলে তালপুকুর – ঘটি ডোবে না। সেই রাজার ঠাকুরদার আমলে বানানো একটা প্রাইভেট
চিড়িয়াখানা ছিল। সেই চিড়িয়াখানায় কিছু শালিক, চড়াই, কাক-টাক গোছের ঘরোয়া পাখি, বেশ
কিছু শেয়াল, গুচ্ছের বেড়াল আর এক পাল নেড়িকুকুর ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না। বাঘ, সিংহ,
ভালুক-টালুক যা ছিল সবই সাজানো!
নবা
বলল, “সাজানো বাঘ-ভালুক মানে?”
ভূষিকা
হাত তুলে তাকে ধৈর্য ধরার ইঙ্গিত করে বলতে লাগলেন, “বন্ধুর পিসেমশাইয়ের সুপারিশ
লেখা চিঠি নিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হলাম নয়াগড়ে। কিছুটা কাঠ-খড় পুড়িয়ে দেখা করলাম
বৃদ্ধ রাজমন্ত্রীর সঙ্গে। সেই মন্ত্রীমশাইও ছিলেন প্রবাসী বাঙালী, আর বাঙালী
ছোকরাদের তিনি খুব ফেবার করতেন, চেষ্টা করতেন যতটা সম্ভব সাহায্য করার।
তাঁর
হাতে পিসেমশাইয়ের চিঠিটা তুলে দিতে, তিনি মন দিয়ে চিঠিটা পড়লেন, তারপর বললেন, “ব্রজভূষণ,
কটা দিন দেরি করে ফেললে, বাবা, বাঘ তো আর খালি নেই, একটাই ছিল, এই কদিন আগে
সামতাবেড়ের একটা ছেলে, তোমার মতোই সুপারিশ নিয়ে এসেছিল, তাকে ঢুকিয়ে নিয়েছি”।
আমি
খুব হতাশ হয়ে, বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছি দেখে, মন্ত্রিমশাইয়ের কী মনে হল কে জানে?
বললেন, “তুমি বাঙালী, আমারই দেশের ছেলে, তোমাকে হতাশ করে ফেরাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু
আমাদের চিড়িয়াখানায় একটা যে পোষ্ট খালি রয়েছে, সেটা বাঙালিদের পক্ষে খুব একটা
সম্মানের নয়। ওটা আমি এর আগে কোনদিন কোন বাঙালীকেই দিইনি। সত্যি বলতে, আজ পর্যন্ত
বাঘ-সিংহটাই বাঙালিদের জন্যে একচেটিয়া রেখেছিলাম, কিন্তু...”।
মন্ত্রীমশাই
দ্বিধাগ্রস্ত মুখে থেমে গেলেন। কিন্তু আমার তখন চাকরির খুব দরকার, একদিকে মায়ের
শরীর খারাপ, ওদিকে ছোট বোনটা বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠছে, আর ভাইটাও ছোট, তার লেখাপড়া
আছে।
আমি
রাজমন্ত্রীমশাইয়ের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, বললাম, “আমি কাউকে বাঙালি বলে পরিচয় দেব
না, স্যার। আপনি কাজটা আমাকেই দিন, আমার অবস্থা খুব খারাপ, একটা চাকরি না হলে আমি
সপরিবারে মারা পড়বো স্যার। ঘরে মা আছেন, ছোট বোন-ভাই আছে। আপনি না রাখলে, তাদের
নিয়ে কোথায় যাবো, স্যার?”
শেষমেষ
চাকরিটা হয়েই গেল। কাজ কম্মো তেমন কিছু নয়। মাইনেপত্র যা পেতাম, প্রায় পুরোটাই
বাড়িতে পাঠাতে পারতাম, কারণ থাকা খাওয়াটা ছিল ফ্রি। খাওয়া দাওয়াও মন্দ নয়। সকালে
একথালা ভাত, ডাল আর কাঁকরোল ভাজা, যাকে ওরা বলত ঘিয়াকরেলা। আর রাত্রে ছটা ঘি
ছিটানো রুটি আর করেলার সবজি। হপ্তায় ছদিন ডিউটি। সোমবার ছুটি, সেদিন দুপুরে হত তিন
পিস মাংস দিয়ে ঝোল আর ভাত। সবথেকে
কাজের চাপ হতো রবিবার আর ছুটির দিনগুলোতে। আবার কোন সোমবার পাব্লিক হলিডে থাকলে
আমাদের হপ্তার ছুটিটা মার যেত। এ ছাড়া আর কোন ছুটি ছিল না, শরীর খারাপ হলেও না।
ছমাস পরে বাড়ি আসব বলেছিলাম তাও ছুটি দেয়নি। ছুটি পেয়েছিলাম প্রায় সাড়ে আট মাস
পরে, সেই বর্ষার সময়। ওই সময় কে আর চিড়িয়াখানায় ঘুরতে আসে, ওই সব দেহাতি রাজ্যে? বর্ষার
সময় লোক খেতিবাড়ি করবে, না চিড়িয়াখানা দেখবে?”।
“বলিস
কী, ভূষি? এ তো অত্যাচার। এই নয়াগড়টাই বা কোথায়, আর তার রাজাটাই বা কে”?
“জায়গাটা
তখন ছিল এমপিতে, এখন ছত্তিসগড় হয়েছে, নামেই ছত্তিস, আসলে ছিল বাহাত্তরের চার ডবল।
এই টুকু টুকু রাজ্য কিন্তু রাজাদের খুব ধুমধাম। এত্তো বড়ো বড়ো রংচঙে পাগড়ি, আর
বাহারের পোষাক। তবে সে সব রাজাও আর নেই। রাজ্যও কী আর আছে, বিজুদা, এই স্বাধীন
ভারতে”?
“অ।
তা তোর কাজটা কী ছিল, সেটা তো বললি না?”
“সে
কথায় পরে আসছি। আমার খাঁচা আর বাঘের খাঁচাটা ছিল পাশাপাশি। বাঘের খাঁচাতেই আমাদের সামতাবেড়ের
সুনীল মাইতি ছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই তার সঙ্গে আমার বেশ গলায় গলায় ভাবসাবও হয়ে গেল।
তার ডাকনাম ছিল নীলু। তার বাড়ির অবস্থা আমার থেকেও খারাপ। দর্শকদের ভিড়ভাড় না
থাকলে আমরা নিজের নিজের খাঁচার ধারে এসে গল্পসল্প করতাম। আমাদের থাকার জায়গাও ছিল
একই জায়গায়। কাজেই সন্ধেয় বাড়ি ফিরেও আমরা একসঙ্গেই থাকতাম।
বছর
দেড়েক বেশ ভালোই চলল। ঝামেলা শুরু হল তারপরে। কোথা থেকে এক ব্রিটিশ সায়েব এসে
উপস্থিত হল আমাদের চিড়িয়াখানায়। সে ব্যাটা শখের জীব বিজ্ঞানী, তার সেই সময়ে কী যে শখ চেপেছিল কে জানে? রাজার
বিশেষ অনুমতি নিয়ে সে হাজির হল, বাংলার বাঘের ওপর রিসার্চ করার জন্যে। বোঝ কাণ্ড।
আমরা নিজের নিজের নির্দিষ্ট ছালচামড়া পরে খাঁচায় ঢোকার আধাঘন্টার মধ্যে সে রোজ এসে
উপস্থিত হত, আর নীলুর খাঁচার সামনে একটা চেয়ার আর টেবিল নিয়ে বসে থাকত সারাদিন,
সেই বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। বাংলার বাঘ সারাদিন কী করে, কী খায়, কী ভাবে হাঁটে, কী
ভাবে হাঁই তোলে, কী ভাবে শোয় – সেই সায়েব বসে বসে সব দেখত আর মস্ত বড়ো একটা
ডাইরিতে পাতার পর পাতা কী সব ছাইপাঁশ লিখত।
সত্যিকারের
বাঘ তো আর নয়, ও তো আমাদের সামতাবেড়ের নীলু। তার তো অবস্থা সঙ্গীন। দেহাতি লোকের
সামনে কিছুক্ষণ বাঘগিরি করা এক জিনিষ, আর জীব বিজ্ঞানী সায়েবের চোখের সামনে
সারাটাদিন বাঘত্ব ফলানো অন্য জিনিষ। দেহাতি লোকেদের সামনে হেঁড়ে গলায় এক আধবার
হালুম বললে, তারা খুশি হয়ে বাড়ি চলে যায়, সায়েবের তা হবে কেন? দু একদিন দেখে, তার
কেন জানি না মনে হল, চিড়িয়াখানার কর্মচারীরা বাঘকে ভালো খেতে দেয় না। আর সেই
কারণেই বাঘটা এমন দুর্বল। সেই সায়েব করলে কী, চিড়িয়াখানার কর্মচারীদের ভরসা না
করে, একদিন নিজেই চারপাঁচ কিলো মাংস কিনে এনে, থপ থপ করে ফেলে দিল নীলুর খাঁচার
ভেতর। সে এক কাণ্ড, সায়েব তো নিষিদ্ধ মাংস
এনে দিয়েছে। ছ্যা ছ্যা, চাকরি করতে এসে কী জাত ধর্ম খোয়াতে হবে নাকি?
কর্মচারীরা
সায়েবকে যত বোঝায়, “হিন্দু টাইগার সার, ইট নো বিফ সার। ইট অনলি গোট সার”।
সায়েব
ততো বলে, হতেই পারে না। বাঘ সব খায়, কখনো কখনো মানুষও খায়। ভারতে মানুষখেকো বাঘের
কথা, সায়েব নাকি বিস্তর শুনেছে। বাঘের আবার হিন্দু, মুসলমান কী। মানুষখেকো
বাঘেরা হিন্দু মুসলমান কাউকেই ছেড়ে কথা বলে না!
যাই
হোক শেষমেষ রাজমন্ত্রীমশাই নিজে এসে যখন সায়েবকে বললেন, “নেটিব হিন্দু স্টেট সার।
হিন্দু কিং। দিস টাইগার টেক বার্থ ইন জু কেজ সার। ইট ওনলি গোট মিট অ্যাণ্ড ফিস,
সার।” তখন সায়েব ক্ষান্ত দিল।
তার
পরদিন থেকে চিড়িয়াখানা থেকেই দিনের বেলা কচি কাঁচা পাঁঠার মাংস যোগান দেবার
ব্যবস্থা করে দিলেন রাজমন্ত্রীমশাই। আর সন্ধেবেলা তাঁর চেম্বারে আমাদের ডেকে নিয়ে,
নীলুর দুটো হাত ধরে বললেন, “নীলু তোমার ওপরেই এই রাজ্যের সম্মান আর ভাগ্য নির্ভর
করছে, বাবা। আমি কচি পাঁঠার কাঁচামাংসের কিমায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিতে বলেছি বাবা,
কটা দিন একটু উৎরে দাও। সায়েব চলে গেলেই দিন কয়েকের জন্যে ছুটি দিয়ে দেব, বাড়ি
গিয়ে মায়ের রান্না বিউলি ডাল, পটলের তরকারি, কলমির শাক আর পোস্ত খেয়ে পেট শুদ্ধু
করে নিও”।
এই
কাণ্ডের পরেও সেই সায়েব প্রায় দিন আষ্টেক রোজ আসত চিড়িয়াখানায়, এক সোমবার দিনটা
ছাড়া। আর বুঝে দেখো, বিজুদা, সায়েবকে দেখিয়ে দেখিয়ে সেই কিলো দুয়েক কাঁচা মাংসের কিমা নীলুকে রোজ চেঁটেপুটে
খেতে হত। হাতও লাগাতে পারত না, বাঘ কী হাত দিয়ে খায়? বেচারা সন্ধেয় ঘরে এসে আর
কিছুই খেতে পারত না! ওইদিকের জল-হাওয়ায় শুনেছি লোহা খেলেও নাকি হজম হয়ে যায়! ছাই
হয়, তা যদি হত, তাহলে দুকিলো কাঁচা মাংস কী আর হজম হতো না? কয়েক হাজার হজমিগুলি, কয়েকশ
বোতল মিল্ক অব ম্যাগনেশিয়া শেষ হয়ে গেল, কিন্তু আমাদের নীলু কাঁচা মাংস সহ্য করতে
পারল না। দিন চারেকের মধ্যে তার এমন অম্বল শুরু হল। অবিকল তোমার মতো। সকালে উঠে
শুধু জল খেলেও, বেচারার গলা অব্দি টক হয়ে থাকত। সারাদিন
সে তোমার মতোই বড়ো বড়ো ঢেঁকুর তুলত, হেউ হেউ। আর বাঘের মুখের আড়াল থেকে সেই আওয়াজ
বাঘের গর্জনের মতোই গম্ভীর শোনাতো। সেই আওয়াজ যেদিন যত বেশি হত, সায়েব তত খুশি হত।
আর ডাইরিতে পাতার পর পাতা নোট লিখত।
নীলুর
ঘোরালো অবস্থার কথা আমরা রাজমন্ত্রীমশাইকে জানালাম। তিনি সব শুনে চিন্তিত মুখে
রাজবৈদ্যকে ডেকে পাঠালেন। থুত্থুড়ে বুড়ো রাজবৈদ্য সব শুনে, নীলুর সব লক্ষণ দেখে
বুঝে, গম্ভীর মুখে দেহাতি হিন্দিতে যা বললেন, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, “আমি এবং
আমার বাপ চোদ্দপুরুষ কেউ কাঁচা মাংস খাওয়া জীবের চিকিৎসা তো করি নি, বেটা! আমরা
মানুষ এমন কি গরু মোষের চিকিৎসাও করেছি। কিন্তু আমাদের বংশে বাঘ-ভালুকের চিকিৎসা
কেউ কোনদিন করেছে বলে শুনিওনি। কাজেই ধুলো ঝেড়ে অনেক শাস্ত্র-পুঁথি বের করতে হবে, পড়াশোনা
করতে হবে, তারপর দেখি কী করা যায়। তবে এই শেষ, এ চাকরি আর করবো না, বাপু, ছেড়েই
দেব। এই বয়েসে এত ধকল সহ্য হয়?”
তিনি
অবিশ্যি করেছিলেন। দিন দুয়েক পরে, সন্ধেবেলা তিনি নিজেই এলেন, তাঁর
সঙ্গে একজন দেহাতি হাট্টাকাট্টা মানুষ, আর তার কাঁধে বিশাল একখানা ওল”। আমাদের
আড্ডার তিনজন একসঙ্গে বলে উঠল,
“ওল?”
“সব
ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে, যে ভূষিকা!” আমিও চুপ করে থাকতে পারলাম না।
বিজুকাকা
ভ্রূকুটি কুটিল চোখে আমার দিকে একবার, তারপর ভূষিকাকার দিকে তাকিয়ে বললেন, “শিবু
ঠিকই বলেছে, বড্ডো বাড়াবাড়ি করে ফেলছিস, ভূষি”। এই
বলে বিজুকাকা উঠতে যাচ্ছিলেন।
আমি
তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা সামলে নেওয়ার জন্যে বললাম, “বিজুকাকা, আপনার এই তো, পা বাড়ালেই
বাড়ি। একটু বসে বাকিটাও শুনেই যান। নীলুবাবুর অম্বলের ওই বাড়াবাড়ির উপশম কীভাবে
হল, বাড়ি গেলে আর জানা যাবে না”।
ভূষিকাকাও
খুব ক্ষুণ্ণ মুখ করে বলল, “বিজুদা, আমার কথা বিশ্বাস করছো না তো? পুরোটা না শুনেই
তুমি তো রেগে যাচ্ছো! পুরোটা শোনো, তারপর বুঝবে, কী মোক্ষম দাওয়াই দিয়েছিল ওই বুড়ো
রাজবৈদ্য”।
সে
কথায় আমিও সায় দিলাম, “এসব আগেকার রাজপুরীর ব্যাপার, পুরো না শুনলে পুরোপুরি বোঝা
যাবে না, বিজুকাকা”।
বিজুকাকা
আবার বসলেন, কিন্তু আর কোন কথা বললেন না, ফ্যালফেলে চোখে ভূষিকাকার দিকে তাকিয়ে
রইলেন শুধু। ভূষিকাকা সময় নষ্ট না করে আবার বলতে শুরু করল, “আমি আর নীলুও চমকে
উঠেছিলাম। দেহাতি লোকটাকে যখন রাজবদ্যিমশাই, আমাদের ঘরের এক কোণায়, ওই মস্তো ওলটা
ভাল করে রাখতে বললেন। আমরা অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। রাজবদ্যিমশাই দেহাতি
লোকটিকে বিদায় দিয়ে, আমার চৌকির কোণায় বসলেন। তারপর নীলুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“অবাক
হচ্ছো তো? ওটাই তোমার অম্বলের ওষুধ বলো ওষুধ, পথ্যি বলো পথ্যি। রোজ সকালে খেয়েদেয়ে কাজে বেরোনোর
আগে, এতটা করে কাঁচা ওলের টুকরো, কচি শসা খাওয়ার মতো চিবিয়ে খাবে”। এই
বলে তিনি টুকরোর সাইজটা হাতের ভঙ্গি করে দেখালেন।
নীলু
করুণ মুখ করে জিগ্যেস করল, “কাঁচা”?
“হুঁ।
কাঁচা। কাঁচা মাংসর দাওয়াই, কাঁচা ওল। তবে সন্ধেবেলা বা রাত্রে খেও না। হিতে
বিপরীত হবে”। আরো কিছু বিধি বিধান দিয়ে তিনি একটু
পরে বিদায় নিলেন। আর যাবার সময় পই পই করে, নীলুকে বলে গেলেন, ওলে অম্ল ও পিত্ত
বিনাশ হয়, কাজেই ওল ছাড়া নীলুর অন্য বিকল্প নেই।
পরের
দিন সকালে খাওয়া দাওয়া সেরে বেরোতে একটু দেরিই হয়ে গেছিল, কাজেই খাওয়ার পর বসে বসে
কাঁচা ওল খাবার সময় আর হাতে ছিল না। আমি নীলুকে বললাম, হাতে নিয়ে নে, রাস্তায়
যাবার পথেই চিবোতে চিবোতে যাবি। নীলু তাই করল। কচর মচর করে কাঁচা ওল চিবোতে চিবোতে
নীলু থু থু করতে লাগল, আর আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে চিড়িয়াখানায় পৌঁছে গেলাম।
সাজঘরে ঢুকে নিজের নিজের ছালচামড়া পড়তে পড়তেই নীলু বেশ কবার বলল, “ভূষি রে, আমার
গলা থেকে পেট অব্দি বেজায় কুটকুট করছে! মনে হচ্ছে গুচ্ছের কাঁকড়া গলা বেয়ে উঠে
আসতে চাইছে, কিন্তু হড়কে পড়ে যাচ্ছে বার বার”।
সাঁত্রাগাছির
রান্না করা ওল কাসুন্দি আর কাঁচা লংকা মেখে খেয়ে অভ্যস্ত নীলু। তার
ওই কাঁচা বুনো ওল খেয়ে কী অবস্থা হচ্ছে, বুঝতেই পারছিলাম। ওকে সান্ত্বনা দিয়ে
বললাম, “কাঁকড়ার কথা ভুলে যা, অম্বলে আর গলা অব্দি জ্বালা করছে কিনা সেটা বল”।
ব্যাজার
মুখ করে নীলু বলল, “কাঁকড়া ধরবো, না, অম্বলে
জ্বলবো, সেটাই তো বুঝতে পারছি না”।
আমি
বললাম, “ব্যস, আর চিন্তা নেই, ওই বুনো ওল তোর অম্বলকে ঘোল খাইয়ে ছাড়বে, দেখে নিস”।
আমাদের
হাতে আর বেশি সময় ছিল না, কাজেই আমরা তাড়াতাড়ি নিজের নিজের খাঁচায় গিয়ে ঢুকে
পড়লাম। সেদিনও সেই সায়েব ঠিক সময়েই এল এবং টেবিলে ডাইরি মেলে, চেয়ারে বসে হাবিজাবি
লিখতে শুরু করল। দেখতে দেখতে নীলুর গাল-গলা ফুলে ঢোল হয়ে উঠল। বাঘের যে মুখটা
এতদিন ঢিলে ঢালা পাঞ্জাবীর হাতার মতো ঝুলঝুল করত, সেদিন একদম গোলগাল স্মার্ট ফিটিং!
সেদিন বাঘ দেখে তো সায়েব খুব খুশি। রাজমন্ত্রীমশাইকে ডেকে এনে সায়েব ফলাও করে বলল,
তার জোর জারিতেই বাঘের স্বাস্থ্য ফিরে গেছে। রাজমন্ত্রীমশাই কী আর উত্তর দেবেন,
সায়েবের খুশিতে তিনি আদৌ খুশি হতে পারলেন না। গোমড়া মুখে সায়েবের কথা শুনতে
লাগলেন।
অনেক
কথা বার্তার পর সায়েব বলল, ওই দিনই তার শেষ দিন, কাল ভোরে বোম্বাই রওনা হবে, সেখান
থেকে পরের দিন ফিরে যাবে নিজের দেশ বিলেতে। এই কথা শুনে রাজমন্ত্রীমশাই তো বটেই
আমরাও এমন খুশি হলাম, সে আর বলার নয়! নীলু তো দু পায়ে দাঁড়িয়ে আনন্দে গর্জন করে
উঠল বেশ কয়েকবার। সেই দেখে সায়েবও তাজ্জব বনে গেল। এই কদিনে সে বাঘকে একবারও দুই
পায়ে দাঁড়াতে দেখেনি। রাজমন্ত্রীমশাই কটমট করে নীলুর দিকে তাকাতে, নীলু নিজের
ভুলটা বুঝতে পারল, সে আবার বাঘ হয়েই চার পায়ে ঘুরতে লাগল খাঁচার ভেতর।
সায়েব
মন্ত্রীমশাইকে জিগ্যেস করল, আপনাদের বাঘ দু পায়ে দাঁড়াতে পারে? এ তো মির্যাক্ল্!
মন্ত্রীমশাই হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, “নো টু লেগ স্ট্যাণ্ড স্যার, দে স্ট্যাণ্ড
অন ফোর লেগ, লাইক চেয়ার অর টেবিল স্যার। মোর মিট দে ইটিং,
দে গোয়িং ম্যাড। নাউ হি ইজ ভেরি স্ট্রং, হি ক্যান ব্রেক কেজ। গো হোম সুন, স্যার,
ডেঞ্জার মে কাম এনি মোমেন্ট!” মন্ত্রিমশাইয়ের এই কথায় মোক্ষম কাজ হল। সায়েব তখনই
ডাইরি বগলে নিয়ে, চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে গেল তাড়াতাড়ি”।
এই
অব্দি বলে ভূষিকা চুপ করে রইল। আমরাও কেউ কিছু বললাম না। ঘটনার ঘনঘটায় আমরাও যেন
হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। কিছুক্ষণ পর বিজুকাকা বললেন, “আর অম্বল? সেও কি দু পেয়ে বাঘের
ভয়ে পালিয়ে গেল, তোর নীলুকে ছেড়ে?”
“না,
না দাদা, তাই হয়? অম্বল কী আর সায়েব নাকি? অম্বল তো তার আগেই পালিয়ে গেছে বুনো
ওলের ভয়ে। বুনো ওলের জন্যে চিরকাল বাঘা তেঁতুলের কথা শুনেছি, শোনেননি দাদা, বলুন?
এখানে ব্যাপারটা উলটো, বাঘা অম্বলকে জব্দ করল বুনো ওল। ওই শিবুর কথা মতো একটু
ওলটপালট ব্যাপার, তাই নয় কি”?
“এই
তোর অম্বলের ওষুধ? এই বলার জন্যেই তুই আমায় ডেকে আনলি?” এই কথা বলে বিজুকাকা রাগে
গনগনে মুখ করে উঠে দাঁড়ালেন, পায়ে চটি পরতে পরতে আবার বললেন, “তুই ওই চিড়িয়াখানায়
কী করতিস, সেটা কিন্তু বললি না। তবে, তুই না বললেও আমি জানি”।
ভূষিকা
অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, “তাই? কী বলুন তো?”
বিজুকাকা
ক্লাব ঘরের দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন, বললেন, “আস্ত একটি মুখপোড়া হনুমান”!
ভূষিকা
খুব নিরীহ নিরীহ মুখ গদ্গদ কণ্ঠে বলল, “বিজুদা, আপনি রিয়্যালি গ্রেট। যাবার আগে পায়ের ধুলো
একটু দেবেন না, দাদা?” ততক্ষণে বিজুকাকা রাস্তায় নেমে আড়ালে চলে গেছেন।
আমরা
এতক্ষণ অনেক কষ্টে চেপে ছিলাম, এবার সবাই হো হো করে হাসতে লাগলাম।
ভুষিকা
হাসল না, গম্ভীর মুখে বলল, “বিজুদার অম্বল কিন্তু আমি ছাড়িয়ে দিলাম, মিলিয়ে নিস।
কিন্তু বৃষ্টিটা ছাড়ার নাম করছে না, কেন বল তো?”
--০০--
[*অচিন্ত্য
কুমার সেনগুপ্তর লেখা “বাংলার এম-এ” গল্পের নায়ক আলিপুর চিড়িয়াখানায় বাঘের চাকরি
নিয়েছিল; ইতিহাসের বিএ যে মধ্যপ্রদেশের চিড়িয়াখানায় চাকরি নেবে, সে তো বলাই
বাহুল্য।]