[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉
বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন]
১
খুব কিছু কাজের চাপ
এখনো পড়ে নি, যেমনটা তাকে ভয় দেখিয়েছিল বিশু - মানে বিশ্বনাথ নস্কর।
বিশু আর সে এক স্কুলে একই
ক্লাসে পড়েছিল বছর ছয়েক। দুজনেরই জীবনযাপন একই ধরনের ছিল বলেই হয়তো ভীষণ ভাব গড়ে উঠেছিল দুজনের। একইসঙ্গে
স্কুলে যেত আসত, টিফিনে মুড়ি-গুড় বা মুড়ি-পেঁয়াজ ভাগাভাগি করে নিত। দুজনেই পড়া না পাড়ার
জন্যে শাস্তি পেত রোজ এবং সেই অপমান আর লজ্জাটাও তারা ভাগাভাগি করে নিত নিয়মিত। কারণ তাদের বাড়িতে
লেখাপড়ার কোন পরিবেশই ছিল না। বই খাতা পেন্সিল কিছুই জুটত না ঠিকমতো। কাজেই দুজনেরই লেখাপড়ায় কোন মতি ছিল না। অবিশ্যি
স্কুলের মাস্টারদের এতসব বোঝার কোন দায় ছিল না, কাজেই তিতিবিরক্ত হয়ে তাদের দুজনকে বলত ‘মাথামোটা মানিকজোড়’।
বিশুর মা মরে গেছিল সে যখন ছোট্ট।
তার বাবা সংসারটাকে ধরে রাখার জন্যে আর বিশুদের ভাত-জল করার জন্যে আবার বিয়ে করে ফেলেছিল,
তার মা মরার বছর খানেকের মধ্যেই। এবং স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী, সৎমা আর সতীনপোয়ের সম্পর্ক
নিয়ে প্রচলিত হাজার কাহিনীর সঙ্গে আরেকটা কাহিনী সংযোজন হল। বিশু যে তার সৎমার
সংসারে – ‘বুকে বসে শিলনোড়া ডলছে’ এবং বিশুর জন্যে ভূতের বেগার খেটে তার সৎমার যে
মুখে রক্ত উঠছে - একথা দৈনন্দিন চিৎকারে
জেনে যেত পাড়াপড়শি। এই কারণে তাদের বাড়িতে কাক-চিল বসতেও ভরসা পেত না বড় একটা। কাজেই বিশুর
অসহায় বাবা - কিই বা আর করে বেচারা - ঘরের শান্তি আর কিছুটা আর্থিক সুরাহার জন্যে
ঠিকাদার হারানিধি মাইতির হাতে-পায়ে ধরে হঠাৎ করেই কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল বিশুকে। বিশু তখন সবে তেরো –
ক্লাস সিক্সের ড্রপ-আউট।
বিশুর কাজের
খবরটা ফটিকের জানা ছিল না। এমনিতেই তার লেখাপড়া হচ্ছিল না, মাস্টারদের রোজ চড়চাপড় আর
গালাগাল তো ছিলই, তার ওপর দোসর বিশু হঠাৎ স্কুল ছেড়ে দেওয়াতে খুব মনমরা হয়ে
মাসখানেক পরেই সেও স্কুল ছেড়ে দিল।
ফটিকের কাহিনীটা
বিশুর থেকে কিছুটা আলাদা রকম। ফটিকের মা থেকেও নেই। বেশ কবছর হল সে ফটিকের বাবার
সংসার ছেড়ে অন্য গ্রামে গিয়ে আবার সংসার পেতেছে। তার মায়ের কোলে নতুন ভাই এসেছে – এসেছে নতুন বোন, যাদের
বাবা তার নতুন বাবা। তবে তার পোড়ারমুখি মাকে অবিশ্যি দোষও দেওয়া যায় না তেমন। তার বাপটা রোজ রাতে ভরপেট মাল গিলে এসে এমন অত্যাচার
করত, তার আর তার মায়ের
ওপর। নেহাত নাচার না হলে কেউ সহ্য করবে না চিরদিন। তার মাও করে নি। তার মায়ের কেটে
পড়া নিয়ে কদিন পাড়ায় গাঁয়ে খুব ঢি ঢি চলেছিল – আর সেই সময়েই তার কাকা এসে তাকে সদরে নিয়ে এসেছিল নিজের কাছে।
তার কাকার ধরনটা যে বেশ
অদ্ভূত – এটা ফটিক মানে। কারণ আশেপাশের কোন মানুষই তার কাকার মতন নয়। দেবতা কেমন
তা সে কোনদিন চোখে দেখেনি। পৌরাণিক যাত্রাপালায় যা দু একজন দেবতার দেখা মিলেছে
তারা তো সব যাত্রাতেই সম্ভব, কিন্তু তার কাকাতো আর যাত্রার চরিত্র নয়। একদম
জলজ্যান্ত বাস্তব!
ছোট এক
কারখানায় সামান্য কাজ করে তার কাকা। কোনরকমে তারই দিন চলে। সে আবার যেচে পড়ে
ভাইপোকে নিজের কাছে এনে যখন তুললে তার কাকি স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেয়নি ব্যাপারটা।
কাকার ভীষণ জিদ আর রাগের জন্যে কাকি সরাসরি না পারলেও, ফটিকের প্রতি তার বিদ্বেষটা
ঠারে ঠোরে বুঝিয়ে ছাড়ত অহরহ। স্কুল ছেড়ে দেওয়াতে আরো বিপদে পড়ে গেল ফটিক আর তার কাকা।
কাকির গঞ্জনার ঠেলায় কাকার প্রাণ ওষ্ঠাগত – সেই সময়ে কাকাই তাকে
বুঝিয়ে সুঝিয়ে চেনা শোনা এক হোটেলে কাজে ঢুকিয়ে দিল। সারাটাদিন অন্ততঃ কাকির
মুখোমুখি হতে হবে না। তাছাড়াও মাস গেলে শ ছয়েক টাকা হাতে আসবে আর দুপুরের খাওয়াটাও
ফ্রি ওই হোটেলেই। কাজেই কাকার সঙ্গে সে থাকলেও রাতের খাওয়া আর শোবার সময়টুকু ছাড়া
তার সঙ্গে আর তেমন কোনো সংস্রব রইল না। অভাবের সংসারে মাসে মাসে ছশোটা টাকাও কম
কথা নয় – কাজেই কাকির বিদ্বেষের ঝাঁজ অনেকটাই কমে এসেছিল।
বছর তিনেক এই
হোটেলে কাজ করেছিল ফটিক। বাজারের কাছাকাছি বলে বেশ চলত হোটেলটা। সকালে বিকেলে
ঘুগনি, আলুর দম, পাঁউরুটি, অমলেট, সেদ্দ ডিম। দুপুরে ভাত ডাল সব্জি, মাছের ঝোল,
মাংস। কাজেকম্মে তার মন বসে গিয়েছিল বেশ। তিন বছরে তার মাইনেটাও বেড়ে হাজার
ছুঁয়েছিল। তার কাকা কাজ থেকে ফেরার পথে মাঝে মাঝে দেখা করে যেত হোটেলে। ফটিকের কাজের ফাঁকে
ফাঁকে
তাদের
সুখ-দুঃখের
কথা হতো। বাড়িতে কাকির সামনে কথাবার্তা তেমন সম্ভব ছিল না - কারণ
কাকির কাছে সেটা ‘আদিখ্যেতা’ মনে হত। তার নামে ব্যাংকে একটা
একাউন্ট খুলে দিয়েছিল কাকা – হোটেলের মালিককে ধরে করে। কাকার পরামর্শে ফটিক মাসে মাসে একশটা করে টাকা জমাত। তার কাকি
জানে না ব্যাপারটা – জানলে কুরুক্ষেত্র বেধে যেত বাড়িতে। এভাবেই গড়াচ্ছিল ফটিকের দিনগুলো।
বাজারের
কাছাকাছি দোকানগুলোতে মাসকাবারি চা যায় ফটিকের হোটেল থেকে। সেদিন উল্টোদিকের বড়
জামাকাপড়ের দোকানে ফটিক গিয়েছিল চায়ের বিলের তাগাদা করতে। সেখানে বিশুকে দেখে
তাজ্জব হয়ে যায় ফটিক। সেই বিশুই তো, নাকি অন্য কেউ? বিশুও ফটিককে দেখে এগিয়ে আসে। দুজনে
দোকানের বাইরে এসে দাঁড়ায়। আনন্দে ফটিকের মুখে কোন কথা জোগায় না। বিশুই কথা শুরু করল, ‘কিরে, চিনতে
পারচিস না? কতদিন পরে দেখা? তুই একেনে কি করচিস’?
‘তুই কোতায় চলে গেলি
ইস্কুল ছেড়ে ছুড়ে, বলেও গেলি না’।
‘সে অনেক ব্যাপার। চ চা খাই
একটু – কি করচিস তুই একন’?
‘চল, আমার
হোটেলে চল – তোকে ইস্পেসাল চা খাওয়াব’।
দুজনে রাস্তা
পার হয়ে হোটেলে ঢুকল। এ সময়টা খদ্দেরের চাপ থাকে না বললেই চলে। খুচরো চা বিস্কুটের
খদ্দের। সাড়ে বারোটা – একটা থেকে শুরু হবে ভাত খাওয়ার ভিড়। হিমসিম অবস্থা হয়
তখন। এসময়ে মালিকও ঘরে যায় চান খাওয়া করতে। কাজেই ঘন্টা দেড়েক সময় আছে হাতে – নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে
বিশুর সঙ্গে।
বিশুকে একটা
বেঞ্চে বসিয়ে ফটিক ভিতরে গেল। নিজে হাতে স্পেশাল চা বানিয়ে আনল ঘন দুধ আর আদা মশলা
দিয়ে। কাচের গেলাস ভরা চা বিশুকে দিয়ে আর নিজেরটা নিয়ে ফটিক সামনাসামনি বসল উল্টোদিকের
বেঞ্চে।
‘কতদিন ঢুকেচিস
একেনে’? সশব্দে চুমুক
দিতে দিতে বিশু জিজ্ঞেস করল ফটিককে।
‘তা প্রায় বচর
তিনেক তো হলো। তুই দুম করে স্কুল ছেড়ে দিলি। দিন কতক দেকে আমিও ছেড়ে দিলাম। তারপর
বাড়িতে রোজ ক্যাচাল - কাকা আর কাকিতে। কাকাই বলে কয়ে এখানে ঢুকিয়ে দিল – ব্যস চলছে সেই
থেকে-‘।
‘তোর
কাকাটা মানুষ নয়কো, দেবতা-দেবতা। আমার বাপটাকে দ্যাক। থেকেও নাই’।
‘আমার
বাপতো আরো - রোজ রাতে মাল টেনে অতিষ্ঠ করে। কাকি মুখঝামটায় ঠিকই, সে তবু সহ্যি হয়।
আর কাকা? বাপ নয় – তার চে’ও বেশী। তুই জানিস ব্যাংকে পাসবই খুলে দিয়েচে কাকা।
বারোশোর ওপর জমে গেচে পাসবইতে। কাকি আর পাড়ার লোকরা কাকারে কি বলে জানিস? বলে
আহাম্মোক’। ব্যাংকে তার সঞ্চয়ের সংবাদটা দিয়ে ফটিক বেশ শ্লাঘা অনুভব করল।
কথা বলতে বলতে ফটিক লক্ষ্য
করছিল বিশুর আদ্যন্ত পরিবর্তন। বিশুর জামা, প্যান্ট, হাতে মোবাইল ফোন। কব্জিতে
বাঁধা সুন্দর ঘড়ি। বিশুকে বন্ধু ভাবতে তার গর্ব হচ্ছিল রীতিমত। তার এতটুকু ঈর্ষা
হচ্ছে না বিশুর প্রতি এবং বারবার দেখেও তার আশ মিটছিল না। নিজেও তো সে এইভাবেই
বাঁচতে চায় – এইভাবেই, ছোটখাটো শখ মিটিয়ে, নিজেকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তুলে। তার
রংচটা একঘেয়ে জামা, ডোরাকাটা পাৎলুন, পায়ে হাওয়াই। আর তার পাশে এই বিশু! এমনও নয়
যে বিশু বড়লোকের দুলাল। তার মতোই বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো জীবন থেকে তার এই উত্তরণ
ফটিককে মুগ্ধ করল।
চায়ের গেলাস খালি করে, বিশু
পকেট থেকে সিগারেট বের করল, সঙ্গে দেশলাই। প্যাকেট খুলে ফটিকের দিকে একটা বাড়িয়ে
দিয়ে বিশু জিজ্ঞেস করল, ‘ধরেচিস নাকি – বিড়ি-ফিড়ি খাওয়া’? না – ফটিক ঘাড় নেড়ে বলে
এবং আবারও চমকিত হয়। তার আশেপাশে চেনাজানা সকলেই বিড়ি খায়। এমনকি তার এই হোটেলের
স্বচ্ছল মালিককেও কোনদিন সিগারেট খেতে দেখেছে, এমন তার মনে পড়ল না। মুগ্ধ বিস্ময়ে
ফটিক লক্ষ্য করতে লাগল বিশুর চাল চলন, কথাবার্তার ধরণ, সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ার
কায়দা। বিশুর মধ্যেই তার সমস্ত স্বপ্নপূরণের রূপ যেন পরিষ্ফুট হচ্ছে! অদ্ভূত এক
আনন্দ তার মধ্যে সঞ্চারিত হতে থাকে।
‘কিরে কিচু বলচিস না, কী দেকচিস কি সেই
থেকে’? বিশুর মুখে আত্মপ্রসাদের হাসি। ফটিক একটু লজ্জা পেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু হেস
বলল,
‘তোকে
বেশ মানিয়েছে কিন্তু। ভাল আছিস তুই। বাইরে চলে গিয়েচিস - বেশ করেচিস, নইলে আমার
মতো তোকেও হয়তো এঁটো-কাঁটাই ঘাঁটতে হতো। আমার তো সব শুনলি, তুই কী করচিস বললি না -’।
‘মাইতিবাবু - আরে, ওই যে রে,
হারানিধি মাইতি, বাজারের পরেই যার তিনতলা বাড়ি, দুটো মারুতি আচে, তিনটে বাস চলে
রুটে, চারটে লরি বালি চালান দেয় কলকাতায় – চিনিস তো? মাইতিবাবু লেবার কনট্যাকটার।
বড় বড় কোম্পানির থেকে কাজ ধরে আর লেবার চালান দেয়। কারপেন্টার। রড ফিটার। ম্যাসন।
আর এমনি হেল্পার তো আছেই। গোটা ইন্ডিয়ায় পাঁচ-ছ জায়গায় কাজ ধরে। ভালো কামাই। আমার
বাপ এই একটা ভাল কাজ করেছিল – স্কুল ছাড়িয়ে মাইতিবাবুর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল। তকন
হেল্পার হয়ে ঢুকেছিলাম, বছর তিনেক কাজ করার পর কাজ শিখে ফেললাম – আমাকে কারপেন্টার
করে দিয়েচে। এই কবচরে কম দেখে ফেললাম? পাঞ্জাব, ছত্তিসগড়, এমপি। এমপিতে ছিলাম
পাওয়ার পোজেক্টে - এমপির কাজটা শেষ করে বাড়ি এসচি, এরপর যাব হিমাচল। নদীতে বাঁধ
বানানোর কাজ – খুব বড় আর ঝামেলার কাজ নাকি। আর শুনেচি ভীষণ শীত’।
বিশু আবার একটা সিগারেট ধরাতে
কথায় বিরতি দেয়। ফটিক এতক্ষণ শুনছিল – অবাক হতে এতটাও যে বাকি আছে সে কল্পনাও
করেনি। ওইসব জায়গাগুলো কেমন, বিশুর বলা ওই সব প্রজেক্টে আসল কাজটা কি – সে
সম্পর্কে তার মনে কোন ধারণাই তৈরি হল না ঠিকই। কিন্তু ওই জগৎটা যে অন্যরকম - তার
ইশারাটা সে অনুভব করতে পারল মনে মনে। নতুন নতুন দেশ, নতুন লোকজন, নতুন নতুন কাজ – তার
সঙ্গে স্বচ্ছল রোজগার। এইসব মিলিয়ে তার মনে গড়ে উঠতে লাগল স্বপ্নপূরণের সোনালি
চাবিকাঠির স্পষ্ট আকার।
বিশু এতক্ষণ মাথা নিচু করে কিছু ভাবছিল,
হঠাৎ মুখ তুলে বলল, ‘যাবি আমার সঙ্গে? আমি বললে মাইতিবাবু না করবে না মনে হয়’।
ফটিক অবাক হয়। ‘আমি? আমাকে নিবে?
আমি তো কিচুই জানি না হোটেল চালানো ছাড়া’?
‘আমিই বা কি জানতাম পেতম
পেতম? তকোন তো আমিও হেল্পার ছিলাম। তুইও হেল্পার থাকবি। তারপর তো কাজ শিখে যাবি’।
এতটাই সহজ? এত সহজেই পৌঁছে
যাওয়া সম্ভব ওইসব স্বপ্নের কাছাকাছি? ফটিকের বিশ্বাস করতেও ভয় করে। কিন্তু তার বালক
বয়সের একমাত্র বন্ধু বিশুই তো তার সামনে উপস্থিত - উদাহরণ হিসেবে।
একটু দ্বিধা নিয়েও ফটিক বলল, ‘বলে কয়ে দ্যাক, যদি
রাজি হয় আমারে নিতে। কাকাকেও তো জানাতি হবে’।
‘কালই আমি তোরে জানাবো, কি
হয়। যদি কিচু হয়, তোরে একবার দ্যাকা করতে বলবে, কতাবাত্তা করতে – আমি নে যাবো তোরে
- সে তুই ভাবিস না। আর কাকারে একনি কিচু বলিস না। তুই কালই তো কিচু বেড়িয়ে যাচ্চিস
না সব ছেড়ে ছুড়ে - কাল আসি – তারপর বলিস’।
২
কাজে লাগার আগে কোম্পানির এক
বাবু তাদের সকলের নাম, বাপের নাম, বয়েস, ঠিকানা সব লিষ্টি লিখছিল। সেই বাবুটা যখন
তার নাম জিজ্ঞেস করলে, সে বলেছিল, “ফটকে মাইতি”।
শুনে বাবুটা হেসে ফেলে বলেছিল, “ধুর ব্যাটা ফটকে
আবার নাম হয় নাকি, বল ফটিক কুমার মাইতি। বাপের নাম”?
“বলরাম মাইতি”।
“বয়েস”?
“ষোলো”
“অই দেখো, এ ব্যাটা হাতে
হাতকড়ি না পড়িয়ে ছাড়বে না। তোদের ঠিকাদার কোথায় গেল, ডাক দেখি”। ঠিকাদার হারানিধি
মাইতি কাছেই ছিল।
ডাক শুনে দৌড়ে এসে বলল, “কি হয়েচে, নারানদা”?
“কচি ছেলেগুলোকে ধরে ধরে কাজে
নামাচ্চো? জানো না সরকারি নিয়মে আঠেরোর আগে কাজে লাগানো যায় না? লেবার ল। এই
ছোঁড়াটা বলছে ওর বয়েস ষোলো”।
“হাঃ। কে বলেচে ওর বয়েস ষোলো?
ও জানে নাকি কিসু? ওর বয়েস কুড়ির ওপর হবে, আপনি লিখে নেন কুড়ি। অ্যাই ফটকে, তোর
বয়েস কুড়ি। ভুলভাল বললে ঘর পাটিয়ে দোব। হেল্পারি করা ঘুচে যাবে। নারানদা, আপনি
লেখেন না ওর বয়েস কুড়ি, আমি বলচি তো”।
কোম্পানির কেরানিবাবু নারায়ণ
চক্রবর্তী তাই লিখে নিয়ে, বললেন, “পরে ডোবাস না যেন। নেক্সট...”। লিস্টিতে নাম লেখাতে পরের
লোকের ডাক পড়ল। ঠিকানা লিখতে হয় না, কারণ সকলেই একই গ্রামের, কাজেই পোষ্ট অফিস,
থানা সবই এক।
পরের দিনই কাজে লেগে গেল
ফটিক। রড ফিটারের হেল্পার। ষাট টাকা রোজ। তার ওপর ও টি। থাকা, দুবেলা খাওয়া আর
সকালের টিপিন ফ্রি। কাজের জায়গাকে তার সঙ্গের লোকেরা বলছে ‘সাইড’ – ‘কনট্যাকশন সাইড’। সকাল সাড়ে সাতটায় ঘর থেকে বেড়িয়ে, সাইটে আসতে হেঁটে
মিনিট পনের কুড়ি লাগল। পাহাড়ি রাস্তার ঢালে এটুকু হেঁটে আসতে ভালই লাগছিল সকাল
সকাল, কিন্তু কনকনে হিমেল হাওয়ায় হাত পা মুখ সিঁটিয়ে গেল – হাতের চামড়া শুকিয়ে এমন
কুঁচকে গেল
– মনে হচ্ছে কোন
বুড়োর হাত।
তারা দাঁড়িয়ে
আছে একটি নদীর মাঝখানে। এখানে নাকি লোহার গেটওয়ালা মস্ত বাঁধ বনবে – তার ওপর দিয়ে
হবে চওড়া রাস্তা। এখন কাত্তিক মাসের শেষ দিকে, নদীতে তেমন জল থাকে না। যেটুকু আছে
মাটি পাথরের ড্যাম বানিয়ে জলটাকে ঘুরিয়ে দিয়েছে – ডাইভারসেন টানেল দিয়ে
অন্য দিকে। যত ঠান্ডা বাড়বে নদীর জল তত কমবে ততই কাজের সুবিধে হবে। নদীর জল কমবে
কেন? যে পাহাড় থেকে এই নদী নামছে, সেখানে সব তো জমে বরফ – জল আসবে কোত্থেকে? সেই
ফাগুন চোত মাসে গরম পড়া শুরু হলেই আবার জল নামবে হুড় হুড় করে, বোশেখে আর কাজ হবে
না, সব ডুবে যাবে জলের তলায়। মাটি আর পাথরে তৈরি ওই বাঁধ ভেঙে সাফ হয়ে যাবে নদীর তোড়ে। আবার পরের বছর পুজোর পর কাজ শুরু হবে, অন্ততঃ
মাসখানেক লাগবে নদীর পেটের পলি আর পাথর সরাতে আর নতুন করে আবার মাটি-পাথরে বাঁধ
বানাতে। পরের বছর এই সময়েই আবার শুরু হবে কাজ। এই নদীর নাম বিয়াস – বাংলায় বলে
বিপাশা। এ সবই ফটিক শুনল তার সঙ্গীদের কাছে – যাদের অনেকেই গতবার এসে কাজ করে গেছে
এবং আবার এসেছে এই সিজনে।
গ্রামবাংলার
সবুজে মোড়া, রোদে তপ্ত বিস্তীর্ণ মাঠ, ঘাট, প্রান্তর দেখা ফটিকের চোখে সীমাহীন
বিস্ময়। যে নদীর বুকে তাদের কাজ চলবে, তার দুপাশেই, একদম খাড়া বিশাল দুই পাহাড়।
ঘাড় তুলে চূড়ো দেখতে পিঠে ঘাড় লেগে যাওয়ার জোগাড়। ওই পাহাড় ডিঙিয়ে রোদ আসে বেলা
দশটা নাগাদ আর পালিয়ে যায় তিনটের মধ্যে। সারাক্ষণ তীক্ষ্ণ শীতল হাওয়ায় শরীরের
কাঁপুনি থামে না। রোদ্দুরের সময়টুকু তাও হাত পা চলে, অন্য সময় জবুথবু হয়ে আসে হাত
পা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে হাত পা সেঁকে নিতে কাঠের আগুন জ্বালতে হয়।
জ্বালানি কাঠ এনে ঢেলে দিয়ে যায় কোম্পানির গাড়ি - কাজের মানুষগুলো স্বস্তি
পায়।
৩
কংক্রিটের শক্তি বাড়ানোর
জন্যে তার ভিতরে যে লোহার রড লাগাতে হয়, সেই লোহার কাজের হেল্পার ফটিক। এই কমাসেই
তার হাতের তালু লোহার মতোই শক্ত আর কর্কশ হয়ে উঠেছে, কমে গেছে অনুভূতি। হাতের
অনুভূতি কমেছে - সে হোক, কিন্তু সে অনুভব করে পেছনে ফেলে আসা জীবনের থেকে এই
জীবনটা একদম অন্যরকম।
তার চোখের সামনে তিলতিল করে
যে মস্তো সৃজন আকার নিচ্ছে, তার অংশীদার হতে পেরে সে এখন বেশ তৃপ্ত। এ এমনই এক কাজ
যার স্বীকৃতি নিজে এসে ধরা দেয় তার অনুভূতিতে। নিয়মে বাঁধা, হয়তো বেশ একঘেয়ে
কিন্তু তবুও এক যৌথ জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এখানে সে কোনসময়েই একলা নয়। এই
দলবদ্ধ জীবনে তার খুব গুরুত্ব হয়তো নেই, তাই বলে সে যে একদম ফেলনা তাও নয়। সম্মান
কি জিনিষ সে জানে না, কিন্তু ফেলে আসা জীবনে যে নিত্য অপমান তাকে সইতে হত অহরহ,
সেটা যে আর নেই, সেটা অনুভব করে সর্বদা।
লাঞ্চের একটু আগে সাড়ে বারোটা
নাগাদ, ফটিক পাহাড়ের দিকে পিঠ করে বসে লম্বা সাজানো রডে চক দিয়ে মার্কিং করছিল।
তাকে এই মার্কিং দেখিয়ে দিয়েছে নিমাইদা – রড ফিটার। ছোটখাটো মাপজোক – মিলি, সেন্টি,
মিটার সে এখন বুঝতে পারছে – শিখে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ছোট তিন মিটারের মেজারিং টেপ
দিয়ে সে এখন যেখানে যেখানে চকের দাগ দিচ্ছে, সেখান থেকে বেঁকিয়ে ফেলতে হবে রডগুলো।
ছত্রিশের মোটা রডগুলো তুলতে, নাড়াতে তিনজন হেল্পার লাগে – এত ভারি। অথচ একবার
বেন্ডিং মেসিনে বসালে ম্যাজিকের মতো বেঁকে যায় রডগুলো। এইসব কাজ দেখা ও শেখায় সে
বেশ মজা পাচ্ছে, নিজের ওপর বিশ্বাস বাড়ছে দিনকে দিন। সে এখন স্বপ্ন দেখে, সেও
বিশুর মতো অথবা নিমাইদার মতো একদিন হয়ে উঠতে পারবে মাতব্বর এক মিস্ত্রি।
মার্কিং করার কাজ হয়ে গেল।
নীচেয় যেখানে রড বাঁধার কাজ চলছে সেখানে নিমাইদা কিছু করছে, ফটিক দেখতে পেল। সে
চেঁচিয়ে বলল, ‘নিমাইদা,
মারকিন করে দিইইচি’।
নিমাই মুখ তুলে উপরের দিকে
তাকাল। বলল, ‘হয়ে
গ্যাচে?
আসতিসি দাঁড়া’। এবং তার পরেই প্রচন্ড আতঙ্কে দু হাত ছড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল –‘পালা,
পালা, ফটকে, সরে যা, সরে যা...’।
ফটিক লক্ষ্য করল নীচেয় যারা
কাজ করছিল, সবাই এখন উপরের দিকে তাকিয়ে এলোমেলো ছোটাছুটি করে সরে যাচ্ছে যে যেদিকে
পারে। আর সবাই চিৎকার করছে ‘পালা, পালা, সরে যা...সরে যা..আ.আ..আ..’।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিমেষে সব
আলো নিভে গেল - অস্ফুট একটু শব্দ মিশে গেল বাতাসে। এই ঘটনার নির্বিকার সাক্ষী হয়ে
রইল মাথার ওপর নির্দাগ নীল আকাশ, উজ্জ্বল উষ্ণ রোদ, দুপাশের সুউচ্চ পীন পাহাড়,
গাছপালা-লতাগুল্ম। আতঙ্কিত অসহায় মানুষগুলো সন্তর্পণে উঠে আসতে লাগল উপরে,
প্রকৃতির হাতে মার খাওয়া আদিম মানুষের মতো।
৪
পোস্টমর্টেম সেরে ছাড় পাওয়া ফটিকের
লাশ এখন চিতায় সাজানো। গতকাল দুপুর থেকে একটানা কেঁদে চলা বিশুর কাঁধে হাত রেখে
হারানিধি মাইতি ধরা গলায় বলল, ‘চুপ কর, শক্ত হ’, বিশু। একরকম দেকলে তুইই ওর ভাইয়ের মতো।
ক্রিয়েকরম তোকেই করতে হবে। নে চল মুখে আগুনটা ছুঁইয়ে দে, সবাই অপেক্ষা কচছে তোর
তরে – আয় – কাঁদিস নি – আয়’।
কেউ একজন জ্বলন্ত কাঠের একটা
টুকরো তার হাতে ধরিয়ে দিল। অন্য কেউ তাকে নির্দেশ করে গেল তার কি কি কর্তব্য – চিতাকে
তিনবার প্রদক্ষিণ, প্রতি প্রদক্ষিণ শেষে ফটিকের ঠোঁটে অগ্নির স্পর্শ। তারপর চিতায়
অগ্নি স্থাপন।
‘আয়, সরে আয়, তোর কাজ শেষ।
তুই আজ ফটিকের নিজের ভাইয়ের কাজ করলি রে, বিশু। আয় এইকেনে বোস’। হারানিধি মাইতি
দুকাঁধ ধরে বিশুকে সরিয়ে আনল, চিতার সামনে থেকে বেশ একটু তফাতে। সেখানে তাদের গ্রামেরই
আরো চারপাঁচজন বসেছিল, হারানিধি মাইতি তাদের ইশারায় বলল বিশুকে সামলাতে।
একটু দূরে কোম্পানির বড়োসায়েব
দাঁড়িয়েছিলেন একলা আলাদা। আশে পাশে কোম্পানির অন্য লোকেরাও রয়েছে। হারানিধি মাইতি
বড়োসায়েবের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, বলল, ‘আপনি, স্যার, কী করবেন আর দাঁড়িয়ে থেকে? আপনি আপিসে গিয়ে
বরং রেস্ট নিন, স্যার। আমরাতো সবাই রইলাম। আপনি ভাববেন না, স্যার। সব ঠিক সামলে
নেব’।
‘থাকি একটু। বেঘোরে চলে গেল
ছেলেটা’-।
‘কপাল, স্যার, কপাল। আপনিই বা
কি করবেন, আমরাই বা কি করব? একনো স্যার মনে আছে এইতো মাস চারেক আগেই – আমার কাছে
বিশু ওকে নিয়ে এল, কাজের জন্যে। জিজ্ঞেস করলাম-ওখানে কিন্তু খুব ঠান্ডা, টিকতে
পারবি তো? বলল – সবাই তো আমারই গাঁয়ের লোক তারা যদি পারে, আমি কেন পারব নি। তখন কি
আর জানতাম, স্যার, এটাই ওর নিয়তি?
‘হুঁ। কতক্ষণ লাগবে,
মাইতিবাবু, দাহ শেষ হতে’? পূর্ণদাহে জ্বলতে থাকা চিতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
বড়সায়েব।
‘তা স্যার, ঘন্টা দুয়েক তো
বটেই। কমও লাগতে পারে - একে কচি দেহ, তার ওপর আধখানা তো থেঁতলেই গেছে পাথরের তলায়।
পাথরটা, স্যার দেখলে আপনার বিশ্বেস হবে না, এমন ঘাতক। কত আর হবে তিন কি চার কিলো
বড়জোর – এই এতটুকু-’। দু হাতে পাথরের মাপটা দেখাল হারানিধি মাইতি।
‘সাইজের চেয়েও বড় কথা কত উঁচু
থেকে পড়েছে – পাহাড়ের হাইটটা মনে করুন। অত উঁচু থেকে একটা মটরদানা পড়লেও বেশ চোট
লাগবে’।
‘তা বটে। তবে, স্যার, আমাদের
সাইডটাও বলিহারি। মাঝখানে ওইটুকু নদীর খাত, দুপাশে দোত্তির মতো দুই পাহাড়। যখন
বেলাস্টিং করে পাথর ফাটানো হয়, আর দুপাশের পাহাড় থেকে ঝরঝরিয়ে নেমে আসে পাথরের
ঝুরো। আমাদেরও কেমন বুক কাঁপে’।
‘হতে পারে। ব্লাস্টিংয়ের
ভাইব্রেসনে পাথরটা কোথাও লুজ হয়ে ঝুলছিল হয়তো, পাহাড়ের কোন খাঁজে – কোন কারণে নেমে
এসেছে আচমকা...’। ওদের কথার মাঝেই কাছে এল দত্তসায়েব, কোম্পানির পি এন্ড এ অফিসার।
লোকজনের সুখসুবিধে, বিপদআপদ থেকে বিধিসম্মত কার্যপ্রকরণের সকল দায়িত্ব তাঁর।
দত্তসায়েব বললেন, ‘স্যার, এদিকে একটা
সমস্যা তৈরি হয়েছে, ফটিককে নিয়ে। মাইতিবাবু, স্যারকে কিছু বলেননি’?
‘না, এখনো বলে উঠতে পারিনি,
কতো টেনসন আর দোবো স্যারকে...’? বড়োসায়েব কিছু বললেন না, দত্তসায়েবের দিকে
জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকলেন।
দত্তসায়েব বললেন, ‘স্যার, আমাদের রেজিস্টারে
ফটিকের বাবার যে নাম লেখা আছে, সে নাকি ওর বাবা নয় - কাকা’।
‘তার মানে? মাইতিবাবু, এমন কী করে হলো’?
হারানিধি মাইতি অপ্রস্তত মুখে
উত্তর দেয়, ‘কি
বলি, বলেন দেকি। আমি কি আর সব লোকের বাপের নাম জানতি গেচি? যার যার বাপের নাম
নিজেরাই বলে, তাই লেখা হয় রেজিস্টারে...’।
‘হুঁ। তার মানে ওর নামে যে
কমপেনসেসনের টাকা সেটা কে পাবে? কাকাতো লিগ্যাল ওয়ারিশন নয়। ওর বাপ-মা কেউ নেই নাকি?
মাইতিবাবু জানেন, নাকি এটাও জানেন না’?
‘হ্যাঁ স্যার, একন তো সবই জানচি,
স্যার। কালকে ওর গাঁয়ে ফোন করে খবর দিতে গিয়ে জানলাম, স্যার, ওর বাপের নাম মদো
মাইতি, সে একটা বেহেড পাঁড় মাতাল। আর, স্যার, ওর মা বহু বছর আগে ঘর ছেড়ে পাইলে
গেচিল পরপুরুষের সঙ্গে। ছেলেটাকে মানুষ করেছে ওর কাকা – বলরাম মাইতি’।
‘বোঝো। তাহলে কি হবে এখন,
দত্ত’? বড়সায়েব কিছুটা বিভ্রান্ত। তিনি ইঞ্জিনীয়ার মানুষ, এসব আইনি কূটকচালি বেশ
বিরক্তিকর লাগে তাঁর কাছে।
‘কি আর হবে, স্যার, কমপেনসেসন
দপ্তর থেকে যতদিন লিগ্যাল ওয়ারিসান কে, ডিক্লেয়ার না করবে, একটা পয়সাও কাউকে দেওয়া
যাবে না। না ইন্সিওরেন্স টাকা দেবে, না আমরা দিতে পারব, স্যার’।
‘বেশ উটকো ঝামেলা তো, তার
মানে ব্যাপারটা ঝুলে রইল অনেকদিন...। লিগ্যাল ওয়ারিশন কী করে ঠিক হবে’?
‘সে, স্যার কোন ব্যাপার নয়,
একটু টাইম টেকিং, কিন্তু হয়ে যাবে। ওর বাবা লোকাল এমএলএ বা বিডিওর থেকে আর গ্রামের
পঞ্চায়েত থেকে এফিডেবিট করে নিয়ে এলেই হয়ে যাবে, স্যার। তবে স্যার, ওই - আমাদের
দৌড়ঝাঁপ চলতে থাকবে অফিসিয়াল ডিক্লেয়ারেসন না পাওয়া পর্যন্ত...’।
৫
চালিয়াৎ ও
ফেরেব্বাজ হিসেবে এই তল্লাটে অমল হাজরার যথেষ্ট সুনাম আছে। আইন কানুনের ফন্দিফিকির
তার নখের ডগায়, বহু গরিব গৃহস্থ তার প্ররোচনায় মামলা মোকদ্দমার ফাঁদে পা দিয়েছে ও
সবর্স্বান্ত হয়েছে। কারণ একবার মোকদ্দমা চালু হলে তার নিষ্পত্তি করার সদিচ্ছা কোন তরফেই দেখা
যায় না। অর্থবান বিবাদি পক্ষের সঙ্গে আঁতাত বানিয়ে সেই মোকদ্দমাকে বছরের পর বছর টেনে নিয়ে
যাওয়ার কৌশলে সে সিদ্ধহস্ত। অসহায় লিখতে পড়তে না জানা এই গরিব মানুষগুলো সঠিক
বিচারের আশায় সদর আদালতে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায় আর নিজেরা নিঃশেষ হয়ে পরগাছা অমলকে
পুষ্টি জোগায়। এহেন অমলের সঙ্গে মধুসূদন মাইতির আলাপ হয়েছিল পরাণ পালের মদের আড্ডায়। অমল ধান্দা
ছাড়া কোন সম্পর্কেরই দানা বাঁধতে দেয় না। কাজেই মধুহীন মাতাল মধুসূদনের সঙ্গে তার
আলাপটাই যা ঘটেছিল - পরিচয় হয়নি সেভাবে।
নেশা এক অদ্ভূত
প্রতিক্রিয়া – যাতে অনেকেই মত্ত হয়ে মগজের নিয়ন্ত্রণ হারায় আবার কারো কারো মগজের বন্ধ থাকা দু একটা খুপরি খুলে
গিয়ে কাজকম্মের বিস্তর সুবিধে করে দেয়। অমল এই দ্বিতীয় শ্রেণীর। সেদিন ভিজে ছোলা আর কাঁচা লংকার চাট নিয়ে
একা একাই বসেছিল আসরে। উল্টোপাল্টা মাতাল-চাতালের সঙ্গ তার পোষায় না। এক কোণে এক বেঞ্চে
বসে সে আরামে মজা নিচ্ছিল, আর কানে আসছিল আশে পাশের মত্ত রসিকদের নানান প্রলাপ।
এত হৈ চৈ প্রলাপের মধ্যেও একজনের কথায় অমল হঠাৎ সতর্ক হয়ে উঠল।
পরিমিত নেশায় তার সমস্ত ইন্দ্রিয়
তখন সজাগ। কান খাড়া
করে অমল শুনল,
‘আমার ছেলেটা চলে
গেল...স্সালল্লা জানিস?...যাওয়ার আগে চার - চার লাখ টাকা দিয়ে গেল – বুয়েচিস? চলে যাওয়ার আগে আমার
কানে কানে বললে – বাওয়া, এ টাকা কটা রাকো...। একবার টাকাটা হাতে আসতে দে...তোদের মতো দুচারটে লোককে
..জুতো পেটা করে সব সিদে করে যদি না দিয়েচি, তো আমার নাম মোসুদুসন মাইতি নয় - বলে আর মাল
নেই...স্সালল্লা...”! উটের মতো গলা তুলে, অমল খুঁজে পেল লোকটাকে - দরজার
সামনে মেঝেয় লাট খাচ্ছে। আর এই দোকানের দুই
ছোকরা টানাটানি করছে তাকে দোকান থেকে বের করে দেওয়ার জন্যে।
অমল দৃশ্যটা দেখতে দেখতে চিনে
ফেলে লোকটাকে – লোকটাকে সকলে মদো মাইতি বলে, আসলে ওর নাম মধুসূদন। চিনে ফেলার পর
খুব নিশ্চিন্ত মনে এক চুমুক মাল খেয়ে একটা বিড়ি ধরাল। লোকটা এখন চূড়ান্ত মাতাল – কিন্তু
তার ভেতরে নিশ্চই কিছু কথা আছে – যা বুজকুরি মেরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। বাজিয়ে দেখতে
চায় অমল। আজ নয় – তবে খুব শিগগিরি আরেকদিন। মদো মাইতিকে ধাক্কা মেরে দোকানের বাইরে
বের করে দেবার দৃশ্যটা খুব মন দিয়ে অমল লক্ষ্য করতে লাগল।
বখেরা মিটিয়ে ছোকরা দুটো যখন
আবার দোকানে ঢুকল, অমল একজনকে ডাকল, “অ্যাই সুমন্ত, এদিকে শোন”। অমল এ দোকানের নিয়মিত এবং
নির্ঝঞ্ঝাটে খদ্দের। তার কোন ধার বাকি থাকে না, মাল খেয়ে বাওয়ালি করে না। একটেরে
বসে মাল টানে, মৌতাত হলে কেটে পড়ে। তাছাড়াও তার ফেরেব্বাজির সুনামের জন্যে সকলে
তাকে কিছুটা সমঝেও চলে। কাজেই সুমন্ত এসে দাঁড়ায় অমলের সামনে।
“মালটা মদো মাইতি, নারে”?
সুমন্তকে জিজ্ঞেস করে অমল।
“হ্যাঁ - আর বলবেন নি, রোজ
এসে একপেট গিলে হাল্লা করবে। আর আমাদের গাল পেড়ে গুষ্টি উদ্ধার করে দেবে। দাঁড়াতে
পারতিসে না মাল চাই, পয়সা নেই তাও মাল চাই। এ এক রোজকার আপদ, খদ্দের নক্কী – তাই
তাড়ানো যায় না। নইলে -। আপনের কিচু চাই নাকি, দাদা। একটা পাঁপড় সেঁকে দেই”?
“ওর ঘরটা কোনদিকে জানিস”?
“ওর ঘর...পোড়াবটতলার বাঁদিকে
পুকুর পাড় ধরে সোজ্জা গেলে, ময়না মাস্টারের ঘরের তিনটে কি চারটে ঘর পরে। আমি
চিনি না, ওই নেতাই - আমাদের বাবুর নাতিটারে ময়না মাস্টারের কোচিনে রোজ পড়াতে নে
যায় – ও চেনে। ওর সঙ্গে নাকি মাঝে মাঝে দেখাও হয়। নেতাই বলে সকালবেলায় মদো মাইতিরে
চেনা যায় না – অন্য মানুষ”।
“হুঁ”। অমল সাড়া দেয়। এক
চুমুকে সামনের গেলাসটা খালি করে, দুটো ভিজে ছোলা মুখে দিয়ে, বলল, “যা, হাফ গেলাস মাল
নে আয়, আর ওই পাঁপড় একটা”। সুমন্ত খালি গেলাসটা নিয়ে চলে যায়। অমল আবার একটা বিড়ি
ধরিয়ে, খুব জোরে একটা টান মেরে ভাবতে লাগল, সত্যিই কি মদো মাইতির হাতে চার লাখ
টাকা আসছে? এলে কোথা থেকে। কিভাবে?
৬
সকাল সকাল অমল হাজরা তার বাড়ি
থেকে সাইকেল নিয়ে রওনা হল শিকারের উদ্দেশ্যে। কাল রাত্রে অনেক চিন্তা ভাবনা করে সে
মোটামুটি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছিল যে, মদো মাইতির পেটে নিশ্চয়ই কোন রহস্য
আছে। কারণ মদো যে স্তরের লোক তাতে তার মাথায় দু-পাঁচ হাজার টাকার চেয়ে বেশি চিন্তা-ভাবনা আসার কথা নয়।
তার মুখে একেবারে চার লাখ টাকার বুলি খুবই অস্বাভাবিক লাগছে অমলের। অন্য সকলে
এটাকে মাতালের প্রলাপ মনে করতে পারে, কিন্তু তার মনের খটকা যাচ্ছে না।
সুমন্তর নির্দেশমতো, ময়না
মাস্টারের বাড়ি চিনতে তার অসুবিধে হল না। কোচিংযের মাস্টার চেনা যায় - সকাল সকাল
বাড়ির সামনে অনেক সাইকেল আর ছেড়ে রাখা চটির বহর দেখলে। সেখান থেকে দাঁড়িয়ে কখানা
বাড়ি পরেই বেশ কিছুটা নাবাল পোড়ো জমিতে টালির চালওলা দাঁত বের করা ইঁটের ঘরটা তার
নজরে পড়ল। সে এসব লক্ষ্য করছিল, সাইকেলে চেপেই বাঁ পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে। সে কাউকে
জিজ্ঞেস করতে চায় না - মদো মাইতির বাড়ি কোথায়। কারণ তাকে অনেকেই চেনে। আর তার মতো
লোক সাতসকালে মদো মাইতির বাড়ি খুঁজছে এটা কেউ সহজভাবে নেবে না। তাতে তার উদ্দেশ্য
ভেস্তে যেতে পারে – হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে শিকার।
আস্তে আস্তে সে সাইকেল চালু
করে পৌঁছে গেল টালিওলা ঘরের সামনে। বেআব্রু দুখানা ঘর। জীর্ণ দশা, ভাঙা টালি, তার
ওপরে কালো প্লাস্টিক সিটের টুকরো এলোমেলো বাঁধা। হাওয়ায় উড়ছে ধ্বজার মতো। ঘরের
সামনে একটা ভাঙা তুলসীমঞ্চের সারা গায়ে আগাছার ঝাড়। ডানদিক চেপে একটা কুয়ো, কোনকালে সেটার পাড়
বাঁধা ছিল, তার স্মৃতি রয়ে গেছে। কুয়োর পাশে দড়িবাঁধা জল তোলার একটা বালতি।
এসব দেখে বোঝা যায় না এটাই
মদো মাইতির আস্তানা কিনা। অমল দাঁড়িয়ে রইল। লক্ষ্য করতে লাগল চারদিক। যে রাস্তা
ধরে সে আসছিল সেটা এখানেই শেষ। এরপরে মেঠো পায়েচলা পথ নেমে গেছে নাবালজমিটার মধ্যে
দিয়ে। সেই পথের দিকে দেখতে দেখতে অমল কী করা উচিৎ যখন ভাবছে, তখনই সে দেখতে পেল
মদো মাইতিকে। কুঁজো হয়ে, ঘাড় নীচু করে মদো মাইতি এদিকেই আসছে। কালকে মদের ঠেকে
দেখা সেই বীর মদো মাইতিকে আজ এইভাবে দেখে এতটুকু আশ্চর্য হল না অমল। সে জানে মেরুদন্ডহীন,
অপদার্থ এই লোকগুলোর পেটে দুপাত্তর পড়লেই বীরত্ব চেগে ওঠে। অমল শিকারকে মুঠিতে
নেবার আগে একটা বিড়ি ধরাল।
কাছাকাছি এসে মদো মাইতি খেয়াল
করল অমলকে। কস্মিনকালেও তার সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসবে তার বাড়িতে, এ চিন্তা তার
মাথায় নেই। সে নীচু হয়ে নমস্কার করে বলল, ‘পেন্নাম, বাবু। এদিকে কোথায় যেতেচেন? এ ধারেতো রাস্তা
নাই’।
‘রাস্তা নেই না? আমি শটকাট
করতি যেয়ে....। তুমি মদুসূদন না? তা এই তোমার ঘর বুঝি, এখানেই থাকা হয়’?
‘এজ্ঞে। আমার আবার থাকা না
থাকা। আমার আবার ঘর!’
‘তা, অনেকদিন তোমায় দেকিনি
পরাণের দোকানে’।
‘ক্যানে বাবু, রোজই তো যাই।
কালও গেচিলাম, এজ্ঞে। আপনেরেও দেকলাম একটেরে বসে ছিলেন। সাঁজের পর বাবু কিচুতেই আর
বাগ মানাতে পারিনে। আমারে যেন টানতি থাকে ওই দুকান। তার ওফর আমার জোয়ান ছেলেটা,
বাবু, চলে গেল...। আমার পাঁজরখান ভেঙে দে গেছে...’। কথা বলতে বলতে মদো মাইতির গলা
ধরে এল, সে কেঁদে ফেলল।
‘অ। তা তোমার ছেলে কোতায় চলে
গেল’?
‘আর বলবেন নি, বাবু। গেছিল
হিমাচলে না কোথায় কাজ করতে, সেখানে পাথরচাপা পড়ে আমার অমন সোমত্ত ছেলেটা....,বাবু...’।
কথা শেষ করতে পারে না, মদো মাইতি কান্নায় ভেঙে পড়ে...।
অমল হাজরা খুব মন দিয়ে দেখতে লাগল
মদো মাইতিকে। এই কান্নাটা যে এক অসহায় বাপের কান্না - সেটা বুঝতে তার অসুবিধে হল
না। কিন্তু সে কোন সান্ত্বনা দিল না বা কোন সমবেদনার কথাও বলল না। শুধু লক্ষ্য
করতে লাগল, মধুসূদন মাইতির ভাঙাচোরা অসহায় শরীরী ভাষার কান্না। কথা না বললেও তার
মাথা খুব দ্রুত হিসেব কষে নিচ্ছিল – মদোর ছেলে তার মানে বাইরে কাজ করতে গেছিল,
সেখানে অ্যাক্সিডেন্টে মরে গেছে। এই সব ঘটনার জন্যে বড় বড় কোম্পানিগুলোর
ইন্সিওরেন্স করা থাকে – সেখান থেকে ক্ষতিপূরণ পায় যে মরে গেছে তার নমিনি বা
লিগ্যাল ওয়ারিসান। কত বয়েস হবে ওর ছেলের? কতো মাইনে পেত মরার আগে? সে সব থেকেই তো
ক্ষতিপূরণের হিসেব হবে! অমল তার ধুরন্ধর অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে ফেলল – এটা ওয়ার্কম্যানস
কমপেনসেসান অ্যাক্টের কেস - তার মানে সে তো অনেএএএক টাকা! এই ঘরে, এই মদো মাইতি অত
টাকা নিয়ে করবেটা কি? রাখবেই বা কোথায়? কোম্পানিতো চেক দেবে - অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক
– সে চেক মদো মাইতি ভাঙাবে কোন ব্যাংকে? ব্যাটার ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে নাকি যে
সেখানে চেক জমা দেবে?
‘বাবু, আপনি কোন কাজে
যেতেচিলেন, যান। এধারে কোন রাস্তা নাই। রাস্তা ভুল করে আপনি আমার দুখের ব্যাখান
শুনে গেলেন নাহক।’ এতক্ষণে মদো মাইতি কান্না সামলে আবার স্বাভাবিক স্বরে কথা বলল।
তার কথায় অমলের চিন্তায় ছেদ
পড়ল, বলল, ‘এ
তো ভালোই হল, মদুসূদন। তোমার এমন শোকতাপের দিনে কেউ নাই তোমার সাথে। এমন দিনে
মানুষই তো মানুষের কাজে আসে নাকি? থা নইলে আর সমাজের দরকারটা কি বলো দিকি’? এমন
কথা মদো মাইতিকে জীবনে কেউ কোনদিন বলেনি। সে অবাক তাকিয়ে থাকে অমলের দিকে। শিকারী
অমলও অসহায় মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃসংশয় হয়ে যায় তার নিশ্চিত সাফল্যের।
অমল দ্রুত জাল গোটাতে শুরু
করে বলল, ‘দুখের
দিন আসে, দুখের দিন যায় গো, মদুসূদন। ওসব তো অন্য কথা। কিন্তু তোমার অমন ছেলেটা যে
বেঘোরে মারা পড়ল – তার খোঁজখপর তো নেওয়া চাই নাকি’?
‘আমি সে সবের কি জানি, বাবু।
কে আমারে খপর দেবে? কেই বা আমায় চেনে। গতকাল সদর থেকে একজন এসে আমাকে এই বেত্তান্ত
দিয়ে গেল’।
‘কে দিয়ে গেল খপরটা’?
‘নামটা তো মনে নেই, বাবু।
বললে সদরের হারানিধি মাইতির লোক’।
‘হারানিধি মাইতি? অ। সে তো লেবার
কনট্রাক্টার। বুজেচি। ঠিক আছে। মধুসূদন, তুমি ভেবো না। সন্ধ্যেয় পরাণের দোকানে এসো
কতা হবে। আর এদিকে রাস্তা নাই বলচিলে না? তাহলে ফিরেই যাই’।
সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে অমল
প্যাডেলে চাপ দিয়ে বেড়িয়ে গেল। বস্তুত, সঠিক পথের সন্ধান সে পেয়েই গেছে - হারানিধি
মাইতি – যে তাকে পৌঁছে দেবে সঠিক লক্ষ্যে।
৭
এই কদিনে মধুসূদন মাইতির
মধ্যে এক আমূল পরিবর্তন ধরা পড়ল। এতকালের ছন্নছাড়া অর্থহীন এক জীবনযাপনের পর আজকাল
তার মনে হচ্ছে একটু অন্যভাবেও বাঁচা সম্ভব। হারানিধি মাইতির ভগ্নদূত যে চরম অশুভ
সংবাদ তার কাছে বয়ে এনেছিল, তার আড়ালে যে এক সুন্দর স্বপ্ন রয়ে গেছে তার আভাস সে
পেয়েছে অমল হাজরার থেকে। শুধু তাই নয়, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে আকার দেবার জটিল
পদ্ধতির প্রতিটি সোপান তার হাত ধরে পার করিয়েও দিচ্ছে অমল হাজরা।
এই কদিনে তার এই হাত –
বিশেষতঃ বাম হাতের বুড়ো আঙুল আর তার এই ভাঙাচোরা মুখের রঙিন ফটো কত অসম্ভবের দরজা যে
তার সামনে খুলে দিয়েছে, তা ভাবলে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে মধুসূদন। ব্যাংকের ধোপদুরস্ত,
চোখে চশমা গম্ভীর বাবুটি যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মধুসূদনবাবু, আপনার বন্ধু
অমলবাবুর সঙ্গে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলছেন -আপনার আপত্তি নেই তো? তাহলে এই ফর্মে
আপনার কয়েকটা টিপসই লাগবে’।
‘মধুসূদনবাবু’ ডাক শুনে সে চট
করে উত্তর দিতে পারেনি। কারণ তার নাম যে মদো মাইতি নয়, মধুসূদন মাইতি সেটাই সে
ভুলে গেছিল কতদিন। আবেগে তার চোখে জল চলে এসেছিল প্রায়। ব্যাংকের সেই বাবুটি তার
বাঁ হাতটা টেনে নিয়ে দরকার মতো টিপসই লাগিয়ে নিয়েছিল ইংরিজিতে ছাপা সেই কাগজটাতে।
একে তো সেটা দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা তার ওপর জল আসা চোখে সে তখন সবই ঝাপসা দেখছিল।
পরেরদিন আবার ব্যাংকে যেতে সেই বাবুটি নিজে পাসবইটি তার হাতে দিয়েছিল, কি সুন্দর
প্লাস্টিকের মোড়কে ঢাকা ছোট্ট বইখানি – মধুসূদন মুগ্ধ হয়ে দেখছিল সেখানি। ব্যাংক
থেকে বের হবার পর অমল তার হাত থেকে ওটা নিয়ে নিয়েছিল, বলেছিল, ‘তোমার চাল নেই, চুলো
নেই। তোমার ওই ভাঙা ঘরে রাখবে কোথায় এ বই? এ বইয়ের তুমি কদর বুঝবে? তার চেয়ে আমার
কাছে এখন থাক’। মধুসূদন আপত্তি করেনি, সত্যি এই ভাঙা ঘরে কী করে রাখবে ওই অমূল্য
নিধি?
অমল হাজরার সঙ্গে খুব কদিন
ঘর-সদর দৌড়ঝাঁপ করতে হল। নানান অফিসের নানান কাজ সেরে অমল তাকে বলেছিল - এইবার
হিমাচল যেতে হবে। তার জন্যে ট্রেনের টিকিট, গোছগাছ, যোগাড়যন্ত্র করতে হবে। অমলের
নিজেরও কিছু কাজ আছে সেগুলো সব সেরে আবার দেখা করবে ক’দিন পর। জানিয়ে দেবে তাকে
কবে রওনা হতে হবে হিমাচল। সেই অপেক্ষাতে দিন গুনতে গুনতে, চারদিন পর আজ, অমল হাজরা
খবর পাঠিয়েছে সন্ধ্যেয় পরাণের দোকানে দেখা করার জন্যে।
আজ আর কোন কাজের ধান্দায় বের
হয়নি মধুসূদন। গত দুদিন নিকুঞ্জ সাহুর ইটখোলায় ইট বয়ে একশ চল্লিশ টাকা নগদ
পেয়েছিল। সেটা থেকে অনেক টাকাই রয়ে গেছে তার কাছে। কারণ এ কদিন সে পরাণের দোকানে
নিঃস্ব হয়ে মদ্যপান করেনি। এটাও তাকে বুঝিয়েছে অমল হাজরা। দু পাত্তর কি তিন পাত্তর
নাও, নেশা জমে উঠছে মনে হলেই কেটে পড়ো। নয়ত সর্বস্বান্ত হয়ে, দোকানির লাথি ঝ্যাঁটা
খেয়ে বেইজ্জতির একশেষ।
আজ মধুসূদনের সকাল বেলা উঠে
ইচ্ছে হল ঘরদোর গোছগাছ করার। বহুদিন সে এক ছন্নছাড়া জীবন কাটিয়েছে, বাউন্ডুলে
হাভাতে লোকের মতো। আজ তার মনে হল - কাল নয় পরশু সে হিমাচল যাবে, অনেকটাকা
তার নামে সেখানে গচ্ছিত আছে, শুধু তুলে আনার অপেক্ষা। মা লক্ষ্মী যখন নিজে এসে
যেচে তার হাতে ধরা দিচ্ছেনই, তখন তাঁকে বরণ করে নেবার মতো সামান্য উপচার প্রস্তুত
রাখা তার কর্তব্য। নতুন এক সংসারী জীবনের আস্বাদ গ্রহণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার মনে
জাগ্রত হয়ে উঠছে। স্পষ্ট রূপ নিতে এখনো একটু দেরি আছে, কিন্তু তার প্রস্তুতি চলছে
তার অন্তরে।
সকালে পাড়া্র গোপলা বেনের দোকানে
চা-পাঁউরুটি খেয়ে এসে, একটা বিড়ি ধরিয়ে কাজে নেমে পড়ল মধুসূদন। কোদালের নিষ্ঠুর
কোপে উপড়ে ফেলতে লাগল আঙ্গিনার যত অবাঞ্ছিত আগাছা। একই সঙ্গে সে উপড়ে ফেলতে চাইছিল
দীর্ঘ জীবনের অপরিমিত মদ্যাসক্তির ক্লেদ। পলাতকা পত্নীর রেখে যাওয়া অপমান।
প্রতিবেশী ও পরিচিত জনের সমবেদনালিপ্ত বিদ্রূপ। এবং বিগত-সম্পর্ক একমাত্র পুত্রের মৃত্যুশোক।
কি এক আক্রোশ যেন আজ তার কাছে ধরা দিয়েছে। সেই আক্রোশে একটানা প্রচন্ড পরিশ্রমে সে
সাফ করে ফেলতে লাগল তার বাড়ির এবং মনের আঙ্গিনা। এই শেষ শীতের মিঠেকড়া রোদ্দুরে
তার সারা শরীর থেকে যখন ঘাম ঝরছে, শরীরের সমস্ত পেশী যখন অবসন্ন, সে ক্ষান্ত দিল।
সূর্য্য তখন মধ্যগগনে। উঠোনের মাঝখানে কোদাল মাটিতে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল
কিছুক্ষণ। কোমরের গামছা খুলে মুছে নিল ঘাম, কপাল থেকে – বুক ও পিঠ থেকে। বড় বড়
শ্বাস নিতে নিতে কোমরে হাত দিয়ে সে তাকিয়ে দেখতে লাগল চারিপাশ। সে যেন এতক্ষণ এক
অসম যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং দীর্ঘ একক লড়াইয়ের শেষে সে জয়ী। ভীষণ তৃপ্তি পেল সে
অন্তরে। একই সঙ্গে সে অনুভব করল - সে এখন বড় একা। এই বিশাল দুনিয়াতে নিজের বলতে
তার কেউ নেই।
এই যে সে সকাল থেকে কঠোর
শ্রমে পরিচ্ছন্ন করে তুলল আঙ্গিনা। তার ওই ঘরের বারান্দায় এখন কেউ দাঁড়িয়ে নেই –
যার নয়নতারায় থাকতে পারত মুগ্ধতা। যার দৃষ্টি তার শরীরের স্বেদ ও ক্লান্তি মুছিয়ে
দিতে পারত। সারাটা সকাল ঘরের কাজ সেরে, তার জন্যে খাবার রান্না করে অপেক্ষায় উন্মুখ
থাকতে পারত। মধুসূদনের প্রতি তার অনুযোগ থাকতে পারত অবেলা করে ফেলার জন্যে। মধুসূদন
এখন ভীষণ খিদে অনুভব করে – শরীরে এবং মনে। কিন্তু সে ঠিক করে ফেলেছে আজ আর কোন
হোটেলে গিয়ে সে খেয়ে আসবে না। যতই না কেন খিদে পাক। নিজে হাতে সে রান্না করে নেবে
তার এই নিজের ঘরে। যত সামান্যই হোক সে আয়োজন।
কুয়োর জল তুলে খুব আরাম করে
স্নান করল মধুসূদন। ঘষে ঘষে ধুয়ে ফেলল শরীরের ময়লা। চান করে উঠে খুব দ্রুত হাতে
বানিয়ে ফেলল ভাত, আলুচোকা আর ডিমের ঝোল। রান্না খাওয়া সেরে সে আবার বসল তার
সামান্য তৈজসপত্র নিয়ে। তেলকালি মাখা ময়লা বাসন কোসন সব মেজে সাফ করে ফেলল। সব কাজ
সেরে যখন মধুসূদন একটা বিড়ি ধরিয়ে এসে বসল নিজের ঘরের দাওয়ায়, সূর্য তখন পাটে বসতে
আর দেরি নেই। খুব ক্লান্তি লাগছিল তার শরীরে, কিন্তু নির্ভার এক আনন্দে তার মন তখন
তরতাজা। এতদিন সে এক লক্ষ্যহীন অবান্তর জীবন কাটিয়ে এসেছে, আজ যেন সেই রাহুগ্রাস
থেকে তার মুক্তি মিলেছে এবং হিমাচল থেকে ভালোয় ভালোয় সব মিটিয়ে, ফিরে এসে সে আবার
নতুন করে সংসার পাতবে। নতুন করে শুরু করবে সুস্থ এবং স্বাভাবিক এক জীবন।
৮
হাওড়া স্টেসন থেকে কালকা মেল
ছাড়ল মিনিট কুড়ি লেট করে। তা হোক এটুকু লেটে মধুসূদন এবং অমল হাজরার তেমন কিছু
ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। এই ট্রেন তাদের নিয়ে যাবে চন্ডিগড়। সেখান থেকে বাস। সুদীর্ঘ
এই সফরে একই লক্ষ্য দুজনের। কিন্তু উদ্দেশ্য এক নয়। অমল হাজরা খুবই উদ্বিগ্ন, যদিও
প্রকাশ করছে না। কারণ সে ইতিমধ্যেই অনেক অর্থ মধুসূদনের পিছনে বিনিয়োগ করে ফেলেছে,
বড়সড় দাঁও মারার প্রত্যাশায়। এখনও পর্যন্ত সমস্ত অফিস খরচ, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট
খোলা, এই দূর সফরের রাহা খরচ সব সেই বহন করে চলেছে। শেষ অব্দি কত খরচ হবে সে জানে
না। যদি তার উদ্দেশ্য সফল না হয়, মধুসূদনের থেকে এই পরিমাণ অর্থ ফিরে পাওয়া এক
প্রকার অসম্ভব। কিন্তু এটুকু ঝুঁকি সে নিয়েছে অনেক ভেবেচিন্তেই – বড় - অনেক বড়
অর্থলাভের আশায়। এই অর্থ তারও জীবনে এনে দেবে স্বচ্ছল আনন্দ – অনেক স্বপ্নপূরণ। কাজেই তার দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক।
এত সব জটিল অঙ্কের হিসেব
ঘোরপ্যাঁচহীন মধুসূদন বোঝে না, কাজেই তার মনে কোন দুর্ভাবনা নেই। তার একটাই
চিন্তা, কত তাড়াতাড়ি সে পৌঁছে যাবে গন্তব্যে, সেখানে তার জন্যেই যেন অপেক্ষা করে
আছে সক্কলে। কতক্ষণে সে যাবে, আর তার হাতে তুলে দেওয়া হবে অজস্র টাকা, যে টাকায় সে
গড়ে তুলবে তার নতুন সংসার। নতুন জীবন। তার আঙ্গিনায় তুলসীমঞ্চের তুলসীগাছটি আবার
প্রাণ ফিরে পাবে। তার সংসারের নতুন লক্ষ্মী রোজ সন্ধ্যেয় সেখানে জ্বালাবে দীপ আর
ধুপ। বেজে উঠবে শঙ্খ। শ্রী ফিরে আসবে তার জীবনে – তার ঘরে।
পাশাপাশি সিটে বসা তারা দুইজন
যাত্রী। তাদের এই ঘনিষ্ঠতা, এই সফর সবই এক ক্ষতিপূরণের জটিল অঙ্ক। যে মৃত্যু ঘটে
গেছে সেটা এখন উপলক্ষ মাত্র, তার কোন মূল্য নেই কারো কাছে - যেটুকু মূল্য আছে সেটা
ক্ষতিপূরণের। কাজেই কার কি ক্ষতি হল, কতটা হল সে হিসেব কেউ রাখেনি। তারা দুজনেই
নিজের নিজের মতো করে লাভের হিসেবে মগ্ন।
রাত্রের ঘন অন্ধকারে
কালকাগামী ট্রেনটি দ্রুত দৌড়ে চলল তাদের ক্ষতিপূরণের এবং স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে...।
৯
সুদীর্ঘ রেলযাত্রার পর
ভোররাতে চণ্ডিগড় স্টেশানে নেমে অটো করে বাসস্ট্যাণ্ড। সেখান থেকে কুলুগামী বাসে
বসে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল, যখন সবে সকাল হচ্ছে। বাইরে চোখ মেলে মধুসূদন
ভয়মিশ্রিত বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। বাস ছুটে চলেছে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে – একপাশে সুউচ্চ
পাহাড়, অন্যদিকে গভীর খাদ – অনেক নীচে কুয়াশা ঢাকা উপত্যকা – ছোট ছোট লোকালয় – বসত
গ্রাম, তার পাশে এঁকে বেঁকে চলা নদী। এইসব দেখতে দেখতে ভীষণ শীতও অনুভব করল
মধুসূদন – ব্যাগ থেকে চাদর বের করে কান মাথা ঢেকে গায়ে জড়িয়ে নিল চাদরটা আর একমনে
তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। চড়াই-উতরাই বেয়ে মস্ত এক অজগর সাপের মতো আঁকা বাঁকা মসৃণ পথ
তাকে নিয়ে চলেছে কোন এক অজানা, অচেনা দুনিয়ার দিকে।
সারাটা জীবন বাংলার সমতলের
বাসিন্দা মধুসূদন। তার চোখ, তার মস্তিষ্ক দিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠ ঘাট প্রান্তর দেখে অভ্যস্ত। এই গিরিসংকুল
সুদীর্ঘ পথের দুপাশে যতদূর চোখ যায় পাহাড় আর পাহাড়, ছোট-বড়ো, সবুজ-ধূসর নানান
পাহাড়ের সীমাহীন শ্রেণী তার চিন্তাকে অভিভূত করে ফেলতে থাকল। এই দ্রুত দৌড়ে চলা বাস
যেন অনন্তকাল ধরে তাকে বিপুল এক রহস্যের অন্দরে নিয়েই চলেছে। তার মাথার মধ্যে এই
বিশালতা বাসা বাঁধতে থাকে ক্রমশঃ। চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে সে বসে থাকল।
এই পথেই এসেছিল ফটিক। আর
ফিরতে পারল না বেচারা। কতই বা বয়েস হবে? মধুসূদন মনে করার চেষ্টা করল ফটিকের বয়েস
কত হতে পারে। কিছুতেই ঠিক করতে পারল না। ওর মা থাকলে বোধহয় বলে দিতে পারত। বহু বছর
পরে আজ ছেলের মুখটা মনে করার চেষ্টা করল মধুসূদন। সেই কতদিন আগে ওর মাটা পালিয়ে
যাবার কদিন পরে, তার ভাই বলা এসেছিল ফটিককে নিয়ে যেতে, তখন কত বয়েস হবে ফটিকের? বড়
জোর পাঁচ কি ছয়! এসব ঘটনা ঘটে গেছে অন্ততঃ দশ বারো বছর আগে। এই কবছরে সে সদরে গেছে
বহুবার। কিন্তু একবারের জন্যেও তার মনে হয়নি নিজের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার কথা।
অথবা ছেলেটা কেমন আছে সে খবর নেওয়ার কথা। সত্যি বলতে আজ তার সামনে ফটিক যদি এসে
দাঁড়ায়, সে চিনতে পারবে ফটিককে? নিজের মনের আনাচে কানাচে ডুব মেরে দেখল মধুসূদন।
তার মনে আসছে অসহায় সরল একটা বাচ্চার মুখ। যার অদৃশ্য মাকে উঠতে বসতে গাল পাড়ছে
তার মাতাল বাপ, আর পাড়া প্রতিবেশী মুখ টিপে হাসছে তাদের ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়া
সংসারের হাল হকিকত দেখে।
যে ছেলের মুখটাই তার মনে পড়ছে
না, তার মরণে তার অন্তরে কী এমন ক্ষত হয়েছে, যে তা পূরণের জন্যে সে এতো দূরে দৌড়ে এল? তার
গ্রাম থেকে সদরে বলরাম মাইতির ঘরের দূরত্বটুকুও সে কোনদিন পার করে উঠতে পারল না,
অথচ আজ সে এত দূরে চলে এল তার ছেলের মরে যাওয়ার টাকা দিয়ে মহোৎসব সারবে বলে? নড়েচড়ে
সিধে হয়ে বসল মধুসূদন। পাশে বসে অমল হাজরা সিটে মাথা হেলিয়ে ঘুমোচ্ছে। মুখটা হাঁ
করে আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল মধুসূদন অমলের মুখটা। এই লোকটাই বা কেন নিয়ে এসেছে
তাকে এতদূরে? নিজের কাজকর্ম্ম ছেড়ে - অনেক সময় এবং প্রচুর অর্থ সে ব্যয় করে চলেছে।
ঠিক কতটা সেটা মধুসূদন আন্দাজ করতে পারে না – কিন্তু কেন? ক্ষতিপূরণের টাকাটা
মধুসূদন পেল কি না পেল – তাতে কী লাভ অমল হাজরার?
ভাবতে ভাবতে মধুসূদন সিটে
মাথা হেলিয়ে নির্লিপ্ত চোখে আবার বাইরে তাকায়। সকালের রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের
চূড়ায় চূড়ায়। সোনা রঙের আলো আর সঙ্গে উত্তাপ নিয়ে সেই রোদ্দুর গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে
নীচের উপত্যকায়। কুয়াশা ফিকে হয়ে আসছে, চিকমিক করে উঠছে বহু নীচে বহতা নদীর জল।
স্পষ্ট হয়ে উঠছে গাছপালা। আরো আরো দূরের পাহাড় শ্রেণী। কোনো কিছুই আর অস্পষ্ট নয়, জেগে
উঠছে পাখপাখালি – মানুষজন- প্রকৃতি। তার মাথার থেকেও সরে যাচ্ছে সব কুয়াশা। স্পষ্ট
হয়ে উঠছে তার নিষ্ফলা জীবনের ভুলে যাওয়া এবং ভুলে থাকতে চাওয়া ইতিহাস। তার অতীত -
তার বর্তমান।
১০
গতকাল দুপুরে পৌঁছোনোর পর
থেকে মধুসূদন মাইতির ব্যস্ততার বিরাম নেই। হারানিধি মাইতির সুপারভাইজার তাদের থাকা
খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিয়ে বলে গিয়েছিল- ‘আজ নেয়ে খেয়ে জিরিয়ে নাও – কাল থিকতে যা
কিচু হবে’। চান খাওয়া করে একটু শুতে না শুতেই শুরু হয়ে গেল লোকজনের আসা যাওয়া।
মজদুর ইউনিয়ন থেকে চারজন এল।
তারা এসেই খুব সমবেদনা জানাল মধুসূদনের হাতদুটো ধরে। তাদের হিন্দী ভাষা মধুসূদন
একবর্ণও বুঝল না, অমল হাজরা দরকার মতো বাংলা করে বোঝাচ্ছিল তাকে। বেশ খানিকক্ষণ
কথাবার্তা বলে, আবার হাত মিলিয়ে তারা চলে গেল – পূর্ণ মদত দেবার প্রতিশ্রুতি আর
কোন তকলিফ না হতে দেবার অঙ্গীকার করে। এরপর এল হারানিধি মাইতি সঙ্গে কোম্পানীর দুই
সায়েব – দত্ত সায়েব আর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট।
কথাবার্তা চালাচ্ছিল অমল
হাজরাই, মধুসূদন চুপ করেই থাকল সারাটা সময়। প্রথমতঃ, এই ধরনের লোকের সঙ্গে এই
পরিস্থিতিতে কথা বলার মতো সাহস তার কোনদিনই ছিল না। উপরন্তু অমল হাজরা তাকে এই
কদিন পাখি পড়ার মতো যে আদব কায়দা শিখিয়ে তুলছিল – সেসব করতেও তার ভাল লাগছিল না।
সে খুব মন দিয়ে শুনছিল সকলের কথাবার্তা। বুঝতে পারছিল ফটিকের বাবা হিসেবে তার এখন
অপরিসীম গুরুত্ব এইখানে। অথচ এই ফটিককে সে চেনেই না। কোনদিন তার কৌতূহল হয়নি তার
খোঁজখবর নেবার। কোনদিন সে কোন তাগিদ অনুভব করেনি ফটিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার।
মধুসূদনের চিন্তায় ছেদ পড়ে, ‘মধুসূদনবাবু, ফটিক
আপনার ছেলে তো’? দত্তসায়েব তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন।
অমল হাজরা কিছু একটা বলতে
চাইছিল, দত্তসায়েব থামিয়ে দিলেন। বললেন, ‘অমলবাবু, আপনার থেকে নয়, আমরা ওঁনার থেকে শুনতে চাই। বলুন
মধুসূদনবাবু, ফটিক আপনারই ছেলে তো’? মধুসূদন সরাসরি তাকায় দত্তসায়েবের দিকে, বলে, ‘হুঁ, ফটিক আমারই
ছেলে...’।
‘তাহলে, আপনার নাম না বলে
ফটিক তার কাকার নাম বলল কেন। বলরাম মাইতি আপনারই ভাই তো’?
মধুসূদন কিছু বলার আগেই, অমল
হাজরা বলে উঠল, ‘ছেলেমানসী
খেয়াল, স্যার, অর কি কোন ঠিকঠিকানা আচে?’।
দত্তসায়েব বেশ কঠিন স্বরে অমল
হাজরাকে বললেন, ‘অমলবাবু,
আপনাকে বললাম না, আমরা ওঁর মুখ থেকে শুনতে চাই -’।
মধুসূদন একটু সময় নেয়, একটু
কেশে গলাটা সাফ করে নিয়ে বলে, ‘ফটিক আমারই ছেলে, বাবু। কিন্তু বাপ হিসেবে আমার যা করার কতা
তাতো আমি কোনদিনই করে উঠতে পারিনি। সে বরং করেচে বলা - আমার ভাই বলরাম। আসলে ফটিকের
-’। চুপ করে যায় মধুসূদন।
দত্তসায়েব কিছুক্ষণ সময় দিয়ে
আবার জিজ্ঞেস করে, ‘থেমে গেলেন কেন? আসলে ফটিকের কী? বলুন না, কোন ভয় নেই,
আপনি খুলে বলুন....’।
মধুসূদন চুপ করেই থাকল, কোন
কথা আর বলল না। বারবার জিজ্ঞাসার পরেও সে শুধু তাকিয়েই রইল দত্তসায়েবের মুখের
দিকে।
একসময় ধৈর্য হারিয়ে দত্তসায়েব
উঠে পড়লেন। বললেন, ‘মধুসূদনবাবু, এ প্রশ্নের জবাব, আপনি আজ আমায় দিলেন না,
কিন্তু সরকারি অফিসারকে এর উত্তর দিতেই হবে। তিনি সন্তুষ্ট না হলে কিন্তু এ কেসের
সমাধান হবে না, এ কথাটা মনে রাখবেন। সব ডকুমেন্টস নিয়ে, কাল সকালে আমাদের অফিসে
আসুন। সব ঠিকঠাক থাকলে আমরা কমপেনসেসান ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দোব, তারপর যা করার তাঁরাই
বুঝে করবেন । আজ তাহলে, চলি – গুড নাইট’। মধুসূদন কিছু বলল না, শুধু হাত তুলে
নমস্কার করল। হারানিধি মাইতি, দত্তসায়েব ও তাঁর সঙ্গী লোকটি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ওরা বেরিয়ে যেতে না যেতেই,
অমল হাজরা ছিটকিনি তুলে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল, তারপরে চাপা ক্রুদ্ধস্বরে বলল, ‘সকাল থিকতেই তোর রকম
সকম ভালো বোধ হচ্চে না, মদো। গাঁ থেকে পই পই করে তোকে বুজিয়ে দিয়েচি তোকে কী করতে
হবে আর কী বলতে হবে। হারামজাদা, আমার সঙ্গে যেদিন তোর বাড়িতে দেকা, সেদিন তো কেঁদে
ককিয়ে যাচ্ছিলি। এতবার করে বললাম, আজ এত লোক
আসতেচে – তাদের সামনে কানতে পারচিস না? মুকে কুলুপ এঁটে বসে রয়েচিস, ভ্যাবলার মতো,
মুকে তোর বাক্যি হরে গেচে মনে হতেচিল। এদিকে দত্তরে তুই কি বলচিলি – ফটকে তোর
ছেলে, ব্যস। তোরে গুষ্টির ফর্দ কে বলতে বলেচে, রে শুয়োর। আজ যা হবার হয়েচে, কাল
সকাল থিকতে আসল কাজ। কোনরকম বেচাল দেখলে জুতিয়ে তোর ছাল তুলে দোবো, মনে রাখিস। তোর
পেচনে আমি দেদার টাকা ঢালতিচি – দানছত্তর খুলেচি নাকি, রে’?
মধুসূদন কিছু বলল না। কোন
উত্তর দিল না। শুধু তাকিয়ে রইল মুখোস খুলে পড়া অমল হাজরার মুখের দিকে। অমল হাজরাও মধুসূদনের
ভাবলেশহীন পাথরের মতো নির্বিকার মুখভঙ্গী দেখতে দেখতে একসময় হতাশ হয়ে বলল, ‘কি গুখুরিই না
করেছিলাম, রে, তোর উবগার করতে চেয়ে। শালা, ভিজে বেড়াল তুই একখান....’।
১১
সকাল বেলা এসেই তারা সব
ডকুমেন্টস জমা করে দিয়েছিল দত্তসায়েবের কাছে। দত্তসায়েব ফাইল বানিয়ে সমস্ত
কাগজপত্র রেডি করে ফেলেছেন। বেশ কিছুক্ষণ আগে সেই ফাইল নিয়ে দত্তসায়েব, মজদুর
ইউনিয়নের সেক্রেটারি সজ্জন অটওয়াল এবং আরো দুজনকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন বড়োসায়েবের
চেম্বারে। অফিসবয় - নিরাপদ খাবার জল আর পাঁচ কাপ চা দিয়ে এল চেম্বারে। এইমাত্র
চেম্বার থেকে কলিংবেল বাজতে নিরাপদ খালি জলের গ্লাস আর চায়ের খালি কাপ নিয়ে বের হল
আর তাদেরকে খবর দিল বড়োসায়েব ভিতরে ডাকছেন। মধুসূদন মাইতির দিকে কড়া চোখে অমল
হাজরা তাকাল – ইশারায় মনে করিয়ে দিল কালকে রাত্রের হুমকি। তারপর অমল হাজরা ঢুকল
আগে – পিছনে দ্বিধাগ্রস্ত মধুসূদন।
‘আসুন, আসুন, মধুসূদনবাবু,
বসুন -’। সামনে অমলকে দেখে বড়োসায়েব বললেন।
‘স্যার, আমি অমল হাজরা।
মধুসূদন - এই যে, আমার পিছনে’। অমল বসল চেয়ারে, মধুসূদন খুব সঙ্কোচের সঙ্গে
দাঁড়িয়েই রইল।
বড়োসায়েব তার দিকে তাকিয়ে
বললেন, ‘আপনিই
মধুসূদনবাবু তো, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন’। মধুসূদন অনেকটা নীচু হয়ে নমস্কার করল,
তারপর চেয়ার টেনে খুব আলগাভাবে সঙ্কোচ নিয়ে বসল।
বড়োসায়েব লক্ষ্য করতে করতে
বললেন, ‘কাল
রাত্রে থাকার ব্যাপারে কোন অসুবিধে হয় নি তো? এতোটা দূর রাস্তার ধকল-!’
‘না, স্যার। খুব সুন্দর
ব্যবস্থা আপনাদের...কোন আসুবিধে হয়নি -’ অমল হাজরা উত্তর দিল, মধুসূদন মাইতির হয়ে।
বড়োসায়েব একটু বিরক্ত হলেন, জিজ্ঞেস করলেন, ‘মধুসূদনবাবু তো
ফটিকের বাবা, আপনার পরিচয়টা’?
‘ওই যে বললাম, স্যার, অমল
হাজরা। আমি মধুসূদনের বন্ধু। ওর এই শোকতাপের সময় ওকে একলা ছাড়তি ভরসা পেলাম না’।
‘হুঁ। দত্ত,
মাইতিবাবুকেও ডেকে নাও না। আফটার অল, সেই তো কন্ট্রাকটার - তাছাড়া একই জায়গার লোক,
তারও সব কথা জেনে রাখা ভাল’। ইউনিয়নের লোক তিনজন তাদের এই বাংলা সংলাপ কিছুই
বুঝছিল না।
সেটা লক্ষ্য করে বড়োসায়েব
বললেন, ‘অটওয়ালজি,
ইয়ে লোক না হিন্দি সমঝতে হ্যায় না বোল পাতে হ্যায় – দত্তসাব আপকো হিন্দিমে সব সমঝা
দেগা -’। সেক্রেটারি সজ্জন অটওয়ালজির সঙ্গে বড়োসায়েবের ভালই সম্পর্ক, তিনিও সায়
দিয়ে বললেন, ‘কোই
নেহি, জি, কোই নেহি – হাম সমঝ লেঙ্গে, জি, বেফিকর রহিয়ে-’।
‘আমি কিন্তু, স্যার, হিন্দি
জানি -’ অমল হাজরা বলে উঠল।
‘মধুসূদনবাবু, জানেন? আমরা তো
ওঁরই সঙ্গে কথা বলতে চাই, তাই না’? বড়োসায়েব কঠিন চোখে তাকিয়ে অমল হাজরাকে বললেন।
এই সময় হারানিধি মাইতিও ঘরে
ঢুকে দত্তসায়েবের পাশে খালি চেয়ারে বসল। বড়োসায়েব কথা শুরু করলেন, মধুসূদনের দিকে
তাকিয়ে, ‘মধুসূদনবাবু,
আপনাকে আর কি সহানুভূতি জানাবো, বলুন? এই বয়সে জোয়ান ছেলে চলে যাওয়া যে কতবড়ো
ধাক্কা –। কিন্তু পরিস্থিতি এমনই - এটাকে মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের আর কি করার আছে?
এমন একটা দুর্ঘটনা যেটাকে ভাগ্য ছাড়া আর কিছু বলার নেই। শুনেছেন নিশ্চয়ই – ফটিক এই
সামনেই পাহাড়ের নীচে বসে কাজ করছিল – হঠাৎ একটা বড় পাথর গড়িয়ে এসে তার পিঠে পড়ে –
এবং সঙ্গে সঙ্গেই সব শেষ হয়ে যায়’।
ঘরের পরিস্থিতি এখন থমথমে।
সকলেই খুব গম্ভীরভাবে বসে রইল কিছুক্ষণ – সকলেরই দৃষ্টি মধুসূদনের দিকে। শুধু
মধুসূদন ভাঙাচোরা অন্ধকার মুখে বড়োসায়েবের দিকে তাকিয়েই রইল। বড়োসায়েব একটু বিরতি
দিয়ে পরিস্থিতিটা বুঝে নিলেন – তারপর আবার শুরু করলেন, সরাসরি মধুসূদনের দিকে
তাকিয়ে, ‘মধুসূদনবাবু,
আপনার এই যে ক্ষতিটা ঘটে গেল, তা কোনভাবেই পূরণ হবার নয়। আমরা আপনাকে শুধু
সান্ত্বনা দিতে পারি। সমবেদনা জানাতে পারি। সে সব তো রইলই। তাছাড়াও আমরা সবাই মিলে
চেষ্টা করছি আপনার এই চরম বিপদের দিনে সামান্য কিছু অর্থ সাহায্য করে আপনার ক্ষতির
ভার কিছুটা হলেও লাঘব করার। প্রথমেই বলি, আমাদের কোম্পানী আপনাকে দেবে একলাখ টাকা।
ফটিকের সৎকার এবং আপনার আসা যাওয়ার যাবতীয় খরচ আমাদের কোম্পানী বহন করেছে এবং করবে।
আমাদের মধ্যে রয়েছেন মজদুর ইউনিয়নের সেক্রেটারি সজ্জন প্রসাদ অটওয়ালজী - উনি
প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন – ইউনিয়নের তরফ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবেন – মজদুর ত্রাণ
তহবিল থেকে’...।
একথা বলার সময় বড়োসায়েব
অটওয়ালজীর দিকে তাকালেন – অটওয়ালজী সম্মতির সায় দিলেন মধুসূদনের দিকে তাকিয়ে।
...‘এছাড়াও আমাদের কোম্পানীর
নিয়ম অনুযায়ী সকল ওয়ার্কারের নামে যে ইন্সিওরেন্স করা থাকে – সেখান থেকে মোটামুটি
তিনলাখ টাকা পাওয়া যেতে পারে। সে টাকার ফাইন্যাল হিসেব করে দেবেন সরকারি
কমপেনসেসান দপ্তর আর টাকা দেবে ইন্সিওরেন্স কোম্পানী। সব মিলিয়ে আমরা সাড়ে চার লাখ
টাকার মতো জোগাড় করতে পেরেছি, মধুসূদনবাবু। আপনার যে ক্ষতি হয়েছে তার তুলনায় এসব কিছুই
নয় হয়তো...’।
এত অব্দি বলে বড়োসায়েব একটু
বিরতি দিলেন। দত্তসায়েব হিন্দি করে অটওয়ালজিদের বুঝিয়ে দিলেন বড়োসায়েবের বক্তব্যের
সারাংশ। বড়োসায়েব গেলাসের জল খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলেন একটু।
‘স্যার, আপনাদের কোম্পানির এক
আর ইউনিয়নের পঞ্চাশ - এটা স্যার, কবে নাগাদ পাওয়া যেতে পারে? কমপেনসেসানের টাকা তো
স্যার, সময় লাগবে, সরকারি ব্যাপার...।’ অমল হাজরা ব্যস্তভাবে জিজ্ঞেস করল
বড়োসায়েবকে।
বড়োসায়েব একটু বিরক্ত হলেন,
বললেন, ‘সব
কাগজপত্র ঠিক থাকলে আজই। কিঁউ অটওয়ালজী? আজ হি হম পে কর সকতে হ্যায়, কেয়া?’।
বড়োসায়েব জিজ্ঞেস করেন অটওয়ালজীকে।
‘স্যারজী, য্যায়সে আপনে
বতায়া, হম দেনে কে লিয়ে না নেহি কর রহে হ্যাঁয়। আজ হি হম দে সকতে হ্যাঁয়। লেকিন
কিসকো দুঁ। হামকো পাতাতো চলে ফাটিক মাইতি কিঁউ বাপ কা নাম ছোড়কে চাচাকা নাম লিখায়া
থা...’। অটওয়ালজী উত্তর দেন।
একথায় দত্তসায়েব বলেন, ‘মধুসূদনবাবু, আমি
কালকেও আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ফটিক কেন তার বাবার নাম না বলে, কাকা বলরাম
মাইতির নাম লিখিয়েছিল’।
অমল হাজরা খুব রাগত স্বরে বলে, ‘আচ্ছা, স্যার, একটা
ছেলে ক্যান তার বাপের নাম না বলে কাকার নাম বলেচে – এর কি উত্তর বলেন দিকি। বিশেষ
করে সে ছেলেই যকন মরে গেচে। এ নিয়ে কিন্তু আপনারা অন্যায্য জলঘোলা করতিচেন’।
দত্তসায়েব খুব রূঢভাবে অমল
হাজরাকে উওর দিলেন, ‘অমলবাবু, আপনি মধুসূদনবাবুর সঙ্গে এসেছেন – ভালো কথা।
কিন্তু জেনে রাখুন এ ব্যাপারে আপনার কোন রোলই নেই। আপনার সঙ্গে ফটিক মাইতির
কোনভাবেই কোন সম্পর্ক নেই। আর ফটিকের নিজের বলা বাবা – সান অফ বলরাম মাইতির নামেই
– সব রেকর্ড তৈরি হয়ে গেছে – ডেথ সার্টিফিকেট, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, পুলিশ
ভেরিফিকেশন রিপোর্ট সব- সব। বলরাম মাইতি নামে একজন লোকও আছে আমরা জানি – সে বোধহয়
ফটিকের কাকা। আমরা নিশ্চিত নই। আমাদের নিশ্চিত হতে হবে। ফটিক মাইতি অ্যাডাল্ট, সে
কেন তার কাকার নাম বলেছিল বাবার জায়গায় – আমরা জানতে চেষ্টা করছি। অমলবাবু হয় আপনি
চুপ করে বসুন, নয়তো ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যান। আমরা মধুসূদনবাবুর কাছেই জানতে চাই’।
ধমক খেয়ে অমল হাজরা চুপসে
যায়, চুপ করে বসে থাকে চেয়ারে। বড়োসায়েব এতক্ষণ সব শুনছিলেন। এবার মধুসূদনের দিকে
তাকিয়ে কিছু বলার আগেই, মধুসূদন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল – সামান্য নত হয়ে জোড়হাত
করে।
সকলের মুখের দিকে একবার
তাকিয়ে বলতে শুরু করল, ‘ফটিক আমার ছেলেই, বাবু। আমার বে করা বউয়ের ছেলে যকন, তকন
আমারও তো ছেলে, নাকি বলেন, বাবু। তবে বাবু, আমার বউটা ভালো ছিল না। নষ্টা বলেন
নষ্টা, ভষ্টা বলেন ভষ্টা...। নষ্টাই বা বলি কী করে বলেন দিকি। যোবতীর শরীলটাই বাবু
বড় বালাই। সোয়ামির থিকে যদি সে শরীল শান্তি না পায়, পরপুরুষে টান আসবে বৈকি, বাবু।
আমার ভাই বলা – বলরাম – বাবু,
তার পেথম শিকার। বলা ভালোমানুষ, বাবু – সে এইসব কদিন দেকে শুনে পাইলে গেল সদরে –
কামকাজ জুটিয়ে। কোনদিন সে গাঁমুখো হয় নি আর। তো সেই বলাই, বাবু, ফটিকের আসল
জনক-বাপ। এ কথা জানি কেবল বলা, আমি আর আমার বউ। আর কেউ না। তারপর আমার বউ যকন অন্য
লোকের সঙ্গে আমার ঘর ছাড়ল – ঘর বলতি আর কিই বা রইল, বাবু বলেন দিকি, ফটিক পড়ল আকুল
পাথারে – ফটিক তকন সবে বচর পাঁচেকের হবে – তকন বলা আবার গাঁয়ে এসে নে গেল ফটিককে।
আমিও ভাবলোম, ভালই হল – যার ছেলে সেই পালপোষ করুক। আমি ঝাড়া হাত-পা – মদ খেতে
লাগলোম খুব। নেশা স্যার, সেরা জিনিষ - সব ভুলিয়ে দেয়। এর মধ্যে কতবার বাবু, সদরে
গেচি, একবারের জন্যেও মনে হয় নি, ফটিকরে গিয়ে একবার দেকে আসি - বলা কেমন আছে। এই
মাইতিবাবুর লোক গে সেদিন খপর দিল - ফটিকের সব্বোনাশের খপর – এই এতো টাকা পাওয়ার
খপর - সেদিন বাবু, মনটা খুব পাগল পাগল লাগতেচিল – কি জানি কেন। তারপরই এলেন
অমলবাবু – উনি আমারে লোভ ধরালেন – অনেক টাকার – আমিও ভাবতেচিলম – মন্দ কি – যদি
আবার নতুন সব শুরু করা যায়? টাকার নেশা, বাবু, মদের চেয়েও জবর নেশা। কিন্তু তা
হবার নয়, বাবু। এ অন্যায্য। এ টাকার আসল হকদার বাবু, বলরাম - আমার ভাই বলা। বাবু,
ফটিক কেন তার বাপের নাম বলরাম বলেচেল – তার তো এসব জানার কথা না – হয়তো রক্তের টান
-। জানিনা বাবু, এর চে বেশি আমি আর কিচুই আমি জানি না – বিশ্বেস করুন’।
-০০-