Powered By Blogger

বুধবার, ২ এপ্রিল, ২০২৫

মেকি মেডেল

 

 

অশীতিপর নীলিমা দুধে ভেজানো মুড়ির বাটিটা শেষ করে, দাওয়া থেকে উঠোনে নামলেন। চৈত্রের উজ্জ্বল রৌদ্রের ওমমাখা সকালে, কাঁপা-কাঁপা পায়ে উঠোনটা পেরোতে ভালই লাগছিল। সুষি থাকলে তাঁকে এভাবে হাঁটতে দিত না, হয় হাত থেকে এঁটো বাটিটা কেড়ে নিয়ে নিজেই কলতলায় যেত। টেপাকল টিপে বাটিটা ধুয়ে ফেরার সময় বাটি ভরে জল আনত তাঁর মুখটা কুলকুচি করে ধোয়ার জন্যে এবং জলেভেজা হাতে মুখ মুছিয়ে দিত নিজের হাতে। অথবা খুব জোরজার করলে, হাত ধরে পাশে পাশে হেঁটে যেত কলতলা অব্দি।

মাঝে মাঝে একটু বিরক্ত হন নীলিমা, তাঁর বয়েস হয়েছে ঠিকই কিন্তু এতটা অথর্বও তিনি হননি, যে নিজের এইটুকু কাজও তিনি করে উঠতে পারবেন না। কিন্তু এখন উঠোনটুকু পার হতে হতে তাঁর মনে হল, দাওয়া থেকে কলতলা পর্যন্ত উঠোনটা বিস্তর পথতাঁর দুর্বল পায়ের মন্থর গতিতে মনে হচ্ছে যেন অনন্ত পথযাত্রা। গত চল্লিশ বছর ধরে বয়স্ক হয়ে উঠতে উঠতে, তিনি বুঝতেই পারেননি, সেই ছোট্ট উঠোনটাই কোন জাদুতে এমন বিস্তীর্ণ মাঠ হয়ে উঠল!

সুষিটা তাঁকে খুব বকাবকি করে, বেশি হাঁটাচলা করতে দেয় না, তাঁকে কোন কাজই প্রায় করতে দেয় না। এখন এই উঠোন পার হতে হতে মনে হল, সুষি ঠিকই করে। প্রায় বছর তিরিশেক ধরে এই সুষি তাঁর নিত্য ছায়াসঙ্গী। সুষি তাঁকে যতটা বোঝে এবং চেনে, ততটা তিনি নিজেও বোঝেন না – চেনেন না নিজেকে। কলতলায় পৌঁছে তিনি টিউবওয়েল টেপার চেষ্টাও করলেন না। চারটে বালতিতে জল ভরে রেখে গেছে, সুষি। তার একটা থেকে মগে জল তুলে বাটি ধুলেন, কুলকুচি করে মুখ ধুলেন। জলভরা বালতিগুলোর দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হল, এখন চানটাও সেরে নিলে হত। নয়তো আবার এতটা হাঁটতে হবে চান করতে আসার সময়। কিন্তু তিনি তো গামছা, তেল, সাবান, শুকনো কাপড় কিছুই আনেননি...উজ্জ্বল আলো থেকে তিনি ছায়াঢাকা দাওয়ার দিকে তাকালেন একবার – সুষির ভাইঝির আজ পাকাদেখা, না গেলেই নয়, তাই দাদার বাড়ি গেছেতার ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে...হয়তো সন্ধে...। সুষিটা না থাকায় তিনি অসহায়বোধ করলেন খুব। সুষির ব্যবস্থায় অবিশ্যি কোন ফাঁক নেই, পাশের বাড়ির ঊষাকে বলে গেছে, হাতের কাজকম্ম সেরে সে চলে আসবে, যে কোন সময়। এতক্ষণ একলা এই বাড়িতে...সুষিটা তাঁর অভ্যেসটাও খারাপ করে দিয়েছে...একটা কথা বলার লোকও কেউ নেই?

“নীলিমাদেবী, বাড়ি আছেন?”

নিজের নাম শুনে অবাক চোখে তাকালেন নীলিমা, উঠোনের ওই কোণে সদর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে কেউ ডাকছে তাঁর নাম ধরে। তাঁর কাছে অনেকেই আসে, কিন্তু বহুদিন কেউ তো এভাবে তাঁকে ডাকে না। কেউ বলে, মায়ী, কেউ বলে দিদি, কেউ বলে দিদা। নিজের এই নামটা তিনি যেন ভুলেই গেছিলেন। নীলিমা তাকিয়ে রইলেন অচেনা লোকটির দিকে। লোকটি তাঁকে দেখতে পেয়ে জিগ্যেস করল, “নীলিমাদেবী? আপনিই কী নীলিমাদেবী?” নীলিমা ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন, কিছু বললেন না, ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলেন, অপেক্ষায় রইলেন, ভদ্রলোক কেন এসেছেন জানার কৌতূহলে।

ভদ্রলোক আরও ভেতরে ঢুকে এলেন, সঙ্গে আরও তিনজন। হাত তুলে আধো নমস্কার করে বললেন, “আমি সঞ্জয় দত্ত। আমরা ডিএম অফিস থেকে আসছি, আপনার জন্যে একটা সুখবর নিয়ে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এবছরের “শ্রীময়ী” অ্যাওয়ার্ডটা আপনাকেই দেওয়া হবে, কনগ্র্যাচুলেশন্‌স্‌” নীলিমা কিছু বললেন না, টিউবওয়েলের মাথায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভদ্রলোক মুখে হাসি নিয়ে এগিয়ে এলেন, নীলিমার দিকে খাঁকি রঙের একটি লম্বা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এই যে এর মধ্যে আপনার অ্যাওয়ার্ড কনফার্মেশনের চিঠি” হাত বাড়িয়ে নীলিমা খামটা নিলেন, তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলেন, হ্যাঁ তাঁর নামই লেখা আছে, নীলিমা সেনগুপ্ত। খামটাও যে সরকারি, তাতেও বোধহয় সন্দেহ নেই, খামের ওপরেই বড়ো করে ছাপা আছে, অন ইণ্ডিয়া গভর্নমেন্ট সার্ভিস। ভদ্রলোক এবার একটা সাদা কাগজে ছাপানো চিঠি আর একটা পেন এগিয়ে দিলেন নীলিমার দিকে,  বললেন, “এ্‌এই, এখানটায় রিসিভ্‌ড্‌ লিখে একটা সই করে দেবেন প্লিজ। অ্যাকনলেজমেন্ট আর কি, বুঝতেই তো পারছেন, সরকারি ব্যাপার, একটু এদিক-সেদিক হবার জো নেই...!”

নীলিমা পেনটা আর সাদা কাগজের চিঠিটা হাতে নিলেন। চিঠিটা পড়ার চেষ্টা করলেন, পারলেন না, ছোট ছোট অক্ষরগুলো একেবারেই ঝাপসা, চোখে চশমা নেই যে। সুষিটা থাকলে, এখনই ছুট্টে গিয়ে চশমাটা আনতে পারতনীলিমা একটু দ্বিধা নিয়ে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালেন, বললেন, “চোখে চশমাটা নেই তো...ঘরে আছে...ভেতরে আসুন...” নীলিমা দাওয়ার দিকে হাঁটতে শুরু করেই বুঝলেন, ব্যাপারটা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। সরকারি অফিসাররা তাঁর হাঁটা দেখলেই, তাঁর দুর্বলতার কথা বুঝে ফেলবে। অধৈর্য হয়ে উঠবে, বিরক্ত হবে, যেন তাদের সময়ের খুবই অভাব। নীলিমাদেবী আমাদের কত কাজ, আপনার হাতে চিঠি পৌঁছে দেওয়াটাই আমাদের একমাত্র কাজ নয়নীলিমা জানেন, যতদিন শরীরে শক্তি থাকে, মানুষ অশক্তদের অবজ্ঞা মেশানো সহানুভূতি বোঝাতে কসুর করে না। হলও তাই।

চারজনের মধ্যে তিনজন তাদের ঘড়ি দেখল। সঞ্জয়বাবু বললেন, “আপনি বুঝি একলাই থাকেন? সঙ্গে কেউ নেই? এই বয়সে এমন একা, একা...! এই হয়, জানেন? আপনি সারাজীবন কত আর্ত-অসহায়কে সাহায্য করেছেন, এখানকার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন, অসুখ-বিসুখে বুক দিয়ে সেবা করেছেন...আর দেখুন, আজ শেষ বয়সে আপনাকেই দেখার কেউ নেই? এরা এমনই হয়, জানেন?”

নীলিমা দাওয়ায় ওঠার সিঁড়িতে পা রেখে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন সঞ্জয়বাবুর দিকে, বেশ ঝাঁজালো স্বরে বললেন, “এরা কেমন হয়, আপনি কী করে জানলেন? থাকেন তো সদর শহরে, এদের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে।”

“ন্‌না...মানে ইয়ে...কথার কথা...বললাম আর কী?” ভদ্রলোক একটু থতমত খেয়ে বললেন। নীলিমা ততক্ষণে ঘরের ভেতর ঢুকে গেছেন। দাওয়ার সামনে, সঞ্জয়বাবুর সঙ্গী রজতবাবু বললেন, “বাপরে বুড়ি হেভি টেঁটিয়া তো! এই বয়সেও কী তেজ?”। সঞ্জয়বাবু চোখের থেকে চশমাটা হাতে নিয়ে উঠোনের চারদিক দেখতে দেখতে বললেন, “কিছুটা হলেও আমি জানি, সারাটা জীবন এ অঞ্চলের মানুষদের জন্যে নীলিমাদেবী কী করেছেন। আর এই অঞ্চলে ওঁর কতখানি জনপ্রিয়তা! আপনাদের মন্ত্রিমশাইও সে কথা ভালোভাবেই জানেন, রজতবাবু, তা নইলে কি আর রাতারাতি উনি এই প্রাইজ পেয়ে যান? নাকি নিজে এসে ওঁনার হাতে অ্যাওয়ার্ড তুলে দেওয়ার গরজ দেখান?”

রজতবাবু রুলিং পার্টির লোক, স্থানীয় নেতা, তিনি একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনারা মানে প্রশাসনের লোকেরা, সব কিছুই ব্যাঁকা চোখে দেখেন, কিন্তু এসময় আপনার একথাটা এভাবে বলাটা ঠিক হচ্ছে না, স্যার। আমাদের পার্টি সবসময় গুণীজনের সম্মান করে সেটা তো মানবেন?” সঞ্জয়বাবু ঠোঁটে হাসি নিয়ে বললেন, “সে কথা না মেনে উপায় আছে? আপনারা গুণীজনের সম্মানের সঙ্গে ভালোভাবেই জানেন ভোট গুনতে...”।

তাঁর কথা শেষ হবার আগেই নীলিমা ঘর থেকে বেরিয়ে দাওয়ায় এলেন, হাত বাড়িয়ে পেন আর কাগজটা সঞ্জয়বাবুর হাতে ফেরত দিয়ে জিগ্যেস করলেন, “প্রাইজ আনতে কোথায় যেতে হবে? আমার অবস্থা তো দেখছেন, কোথাও যাবার কথা চিন্তা করলেই আজকাল গায়ে জ্বর আসে”। সঞ্জয়বাবু কিছু বলার আগেই, রজতবাবু বলে উঠলেন, “আমরা রয়েছি কী করতে, ঠাক্‌মা? আপনাকে কোত্থাও যেতে হবে না। পরশুদিন সকালে মিনিস্টারস্যার নিজে আসছেন আপনার বাড়ি! তিনি নিজে এসে আপনার হাতে প্রাইজ তুলে দেবেন। আপনার সঙ্গে আলাপ করবেন তিনি নিজে। তিনি বলেছেন, আপনি আমাদের সকলের মায়ের মতন। তিনি নিজেও আপনার ছেলের মতো”। প্রত্যেকবার “তিনি নিজে” কথাটা বলছিলেন বড়ো জোরের সঙ্গে, যেন ওটাই আসল কথা!

খুব অবাক এবং ভয় পাওয়া সুরে নীলিমা বললেন, “আমার এই বাড়িতে আসবেন, মিনিস্টার? কবে?”

সঞ্জয়বাবু বললেন, “হ্যাঁ, নীলিমাদেবী, আমাদের কাছে সেরকমই ইন্সট্রাকশন এসেছে। মিনিস্টারস্যার পরশুদিন আপনার বাড়ি আসবেন। চিন্তা করবেন না, আমরা আছি। তাছাড়া রজতবাবুরা তো আছেনই - যা কিছু করার সব ওঁরাই করবেন”

নীলিমা বললেন, “কী করবেন?”

রজতবাবু বললেন, “ঠাক্‌মা, বুঝতেই তো পারছেন, মিনিস্টার মানে ভিআইপি। তাঁর আসার মতো এই বাড়িটাকে সাজিয়ে তুলতে হবে। তাছাড়া তাঁর সিকিউরিটির ব্যাপার আছে, অনেক বডিগার্ড থাকবে। বাড়ির চারপাশটা ঠিকঠাক করতে হবে...”

নীলিমা আতঙ্কিত সুরে বললেন, “বাড়ির চারপাশ ঠিকঠাক মানে?”

রজতবাবু খুব সাবলীল সুরে বললেন, “আশেপাশের বাড়িগুলো সব খালি করতে হবে যে, ঠাক্‌মা। মিনিস্টার স্যারের নিরাপত্তা নিয়ে তো আর ছেলেখেলা করা যায় না! কার মনে কী আছে, কোন ঝুঁকি নেওয়াটা  ঠিক হবে না! তাছাড়া এই উঠোনটাকেও গুছিয়ে নিতে হবে, ওই, ওই দিকের ঝোপঝাড়গুলো সাফ করতে হবে...”

নীলিমা আরো অবাক হয়ে বললেন, “ওদিকে ঝোপঝাড় কোথায়? ওগুলো তো ফুলগাছ, টগর, কাঞ্চন, জবা, শিউলি...”।

রজতবাবু নিশ্চিন্ত সুরে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ ওই...ওইগুলোই...ওগুলোকে সাফ না করলে মিনিস্টারের সঙ্গে যে সব গেস্ট আসবেন, প্রেসের লোকজন আসবে, আমাদের ছেলেরা আসবে, সিকিউরিটি, পুলিশ, প্রশাসনের লোকজন...তারা সব দাঁড়াবে কোথায়? ও নিয়ে আপনি ভাববেন না, ঠাক্‌মা, যা করার আমি আর আমার ছেলেরা করে নেব...”।

নীলিমা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন দাওয়ার খুঁটি আঁকড়ে, একটা কথাও বলতে পারলেন নাসঞ্জয়বাবু আবার আধা নমস্কার করে বললেন, “আজ আমরা তাহলে চলি, নীলিমাদেবী? হাতে খুব বেশি সময়ও নেই, মাঝে মাত্র একটাই দিন। মিনিস্টারের ভিজিট বলে কথা, এ কী সামান্য ঝক্কি?” নীলিমার উত্তরের অপেক্ষা না  করে চারজনেই বেরিয়ে গেলেন, বাড়ির বাইরে। যাওয়ার সময় টেনে দিয়ে গেলেন সদর দরজাটা।

 

 

ওরা চারজন চলে যাওয়ার পর তিনি দাওয়াতেই বসেছিলেন। ভাবছিলেন, সরকারি অফিসার আর পার্টির নেতার কথাগুলো। তাঁর অ্যাওয়ার্ড পাওয়াটা কী এতই আনন্দের ব্যাপার! যে আনন্দের জন্যে ঘর ছাড়তে হবে তাঁর এতদিনের পড়শীদের? বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ওরা যাবে কোথায়? অনেকেরই আবার তাঁর মতোই বয়স্ক বাপ-মা আছে। তাদের নিয়ে? আর তাঁর নিজের হাতে লাগানো ওই ফুলগাছগুলো? যারা তাঁর সঙ্গে কথা বলে, হাসে। ফুল ফুটিয়ে তোলে অজস্র। ফুটে ওঠা প্রত্যেকটি ফুল কি তাদের ভালোবাসার হাসি নয়?  কত বছর ধরে, ওরা রয়েছে তাঁর সঙ্গেওদের ওরা সাফ করে ফেলবে? কেটে ফেলবে? ভিআইপি মিনিস্টারের পক্ষে ওরা মোটেই নিরাপদ নয়? ওদের সরিয়ে কিছু উটকো লোক এসে ওখানে দাঁড়াবে নিরাপত্তার কারণে?

বহুদিনের পুরোন সেই ভয়ংকর দুর্ঘটনার কথাও এখন তাঁর মনে পড়ে গেল। সেদিন সেই দুর্ঘটনায় তিনি হারিয়েছিলেন তাঁর সন্তান এবং সেই সন্তানের পিতাকে। সেই ভয়ংকর স্মৃতি থেকে পালিয়ে এসেছিলেন বহুদূরের এই নির্বান্ধব জগতে। প্রথমদিকে এই গ্রামে তাঁর হঠাৎ উড়ে এসে বসা এবং গায়ে পড়ে প্রতিবেশীদের খোঁজখবর নেওয়া, এখানকার কেউই ভাল চোখে দেখেনি। তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে সকলেই সন্দিহান ছিল। কিন্তু তিনিও পিছিয়ে যাননি, হাল ছেড়ে ফিরে যাননি তাঁর বাবা-মা দাদার সংসারে। তাঁকে বোঝানোর অনেক চেষ্টাই করেছিলেন তাঁরা – বাবা, মা, দাদা-বৌদি, তাদের ছেলে-মেয়ে। কোন কিছুই তাঁকে আবার শহরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি, না তাঁর মায়ের চোখের জল, না এখানকার মানুষগুলোর সন্দিগ্ধ দৃষ্টি!

ঠিক কী ভাবে এবং কবে থেকে তিনি এই গ্রামেরই একজন হয়ে উঠেছিলেন, সে কথা খেয়াল করে মনে রাখেননি। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি একদিন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, এরা তাঁকে মেনে নিয়েছে। এদের দুঃখেসুখে, আধি-ব্যাধিতে তিনি এদের পাশে থাকবার স্বীকৃতি আদায় করে নিতে পেরেছেন। তাঁর কাছে লেখাপড়া শুরু করে, অনেক ছেলেমেয়েই শহরের স্কুলে, কলেজে গিয়ে এখন উচ্চশিক্ষিত - অনেকেই এখন শহরের শিক্ষিত সমাজে জায়গা করে নিয়েছে সসম্মানে। বেশ কবছর হল, শুধু এই গ্রামেই নয়, আশেপাশের অনেক-অনেক গ্রামের হতদরিদ্র মানুষগুলির সময়ে-অসময়ে অন্যতম তিনিই সহায়।

এই মানুষগুলির সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত তাঁর এই দীর্ঘ সম্পর্কের স্বীকৃতি এই অ্যাওয়ার্ড! তাঁর এই অ্যাওয়ার্ড জয়ের বিরল সম্মানে ঘরছাড়া হবে, তাঁর আশেপাশের এই পড়শি মানুষগুলি? তিনি বরাবর যাদের সহায় থাকতেন চেয়েছেন, তাদের তিনি বিপন্ন করবেন, হঠাৎ কপাল খুলে পেয়ে যাওয়া এই অ্যাওয়ার্ডের জন্যে? কিন্তু এই বয়সে পাওয়া এই অ্যাওয়ার্ড তাঁকে কী দেবে? দেশ জোড়া খ্যাতি? এই অ্যাওয়ার্ডের মেডেল গলায় দুলিয়ে, আর কোন নতুন শক্তি তিনি ফিরে পাবেন, যার বিনিময়ে এতগুলো লোককে অকারণ বিরক্ত করা চলে?

 বেশ শব্দ করে খুলে গেল সদর দরজার পাল্লাটা! নীলিমা চমকে উঠলেন। আবার কে এল? ওরা কী এসে গেল, তাঁর আশেপাশের ঘরগুলি খালি করতে? অথবা তাঁর ফুলের গাছগুলিকে উৎখাত করতে? দরজার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলেন নীলিমা, কে এল? দরজা দিয়ে ঢুকে এল ঊষা, তার পেছনে এপাড়ার অনেকগুলি মেয়ে-বউ। ঊষার আসার কথা ছিল অনেক আগেই। সুষি ব্যবস্থা করে গিয়েছিল, সে দাদার বাড়ি থেকে না ফেরা পর্যন্ত ঊষা এসে থাকবে নীলিমার সঙ্গে। ঘরের কাজ-টাজ সেরে আসতে দেরি করেছে হয়তো। এখন একমুখ হাসি নিয়ে লাফাতে লাফাতে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল নীলিমাকে। বলল, “ও দিদা, তুমারে নাকি সরকার পেরাইজ দিবে! গাঁয়ের সক্কলে বলতিছে! সত্যি বটে গো? তুমার কাছে কারা সব এয়েছিল, তারা নাকি সরকারি লোক?” ঊষার পিছন পিছন এসে দাঁড়ানো মেয়েবউগুলোর চোখেও আনন্দ কৌতূহল। নীলিমা ওদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমাদের ওরা কিছু বলেনি?”

“কারা?”

“ওই যে সরকারি লোক আর পার্টির নেতারা?”

“কই, না তো! আমাদিকে আবার কী কইবে, উয়ারা আমাদিকে মানুষ বলে গণ্যি করে নাকি?”

“বলেনি? পরশু মিনিস্টার আসবে, আমাকে প্রাইজ দিতে?”

সকলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে অবাক আনন্দে, ওদের মধ্যে গণার মা বলল, “বলো কী, মায়ি, মিনস্টর? সেই যে গলায় মালা লিয়ে সভায় খুব বক্তিমে দেয়? হাতজোড় করে বারবার নমস্কার করে? আমি দেকিচি একবার, সেবার গণার বাপের সঙ্গেরে সদরে গেচলম, ওকেনে মিটিং ছ্যালো। আমি দেকিচি। সেই মিনস্টর?”     

নীলিমা ম্লান মুখে বললেন, “মিনিস্টার আসছে বলল, কোন মিনিস্টার সে আর আমি জিগ্যেস করিনি”।

ঊষা ভীষণ খুশি হয়ে বলে উঠল, “সে যাই হোক দিদা, আমাদের গাঁয়ের পেস্টিজটা কোথায় দাঁড়াবে একবার কওদিনি? এ দিগরে কোন গাঁয়ে কোন মিনস্টার এয়েচে, বলো?”

“মিনিস্টার এলে, তোদের সক্কলকে যে ঘর ছেড়ে দিতে হবে, মা। কদিনের জন্যে জানি না, হয়তো দুদিন, অথবা আরও বেশি...”।

গণার মা অবাক হয়ে বলে উঠল, “ক্যানে? তুমি পেরাইজ পেলে, আমাদিগে ঘর ছাড়তি হবে ক্যানে?”

“ওই যে বললি, মিনিস্টার আসছে। সে তো একজন কেউকেটা বটে। তাকে তোরা যদি মেরে ফেলিস?”

উপস্থিত সকলের কণ্ঠ থেকে বের হল আতঙ্কের সুর। ঊষা বলল, “আমরা মেরে ফেলাব? মিনস্টারকে?”

“আহা যদি মেরে ফেলিস? তাইতো ওরা বলল, তোদের ঘর থেকে বের করে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেবে। মিনিস্টারের জীবন নিয়ে তো আর ছেলেখেলা করা যায় না। তার সঙ্গে কত বড়ো বড়ো লোক আসবে, পুলিশ আসবে। ওদের সঙ্গে টিভির লোকেরাও আসবে ছবি তুলতে। সকলেরই জীবনের দাম আছে! আর আমার ওই ফুলগাছগুলোকেও ওরা কেটে ফেলবে”।

গণার মা গলায় ঝাঁজ মিশিয়ে বলল, “ওরাও বুজি মিনিস্টারকে মেরে ফেলতে পারে? মিনস্টারের জেবন এতই ঠুনকো যদি থালে সে আসচে ক্যানে, আমাদের গাঁয়”?

নীলিমা মুখ নিচু করে মাথা নাড়লেন, বললেন, “আমি মানা করে দেব, ওরা আসবে না। আমি প্রাইজ নেব না গণার মা বলল, “পেরাইজ নেবেনি?”

“না, তোদের তাড়িয়ে দিয়ে, আমার কোন প্রাইজের প্রয়োজন নেই”।

 

 

মিনিস্টার সায়েবের বসার ঘরে সকাল সাতটা নাগাদ এসে প্রায় ঘন্টা দুয়েক হতে চলল। রজতবাবু আর সঞ্জয়বাবু ঠায় বসে আছেন। রজতবাবু মাঝে মাঝেই শিউরে উঠছেন, আর চাপা গলায় সঞ্জয়বাবুকে জিগ্যেস করছেন, “কী হবে বলুনতো?” তুমুল ঝাড় যে খেতেই হবে, সেটা নিশ্চিত। কিন্তু কথাটা এখনই না বললেও তো নয়! নীলিমাদেবীকে অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার খবরটা কাল সন্ধ্যে থেকে সবকটা টিভি চ্যানেলে অনবরত দেখিয়ে চলেছে। এক্সক্লুসিভ, ব্রেকিং নিউজ। একই খবর, বারবার, লাগাতার। আজ সকালে সবকটা পেপারের হেডলাইনে এসে গেছে খবরটা। এদিকে গতকাল একটু সন্ধের পর বুড়ি পার্টির দপ্তরে খবর পাঠিয়েছে, তিনি অ্যাওয়ার্ড নেবেন না। খবরটা পেয়েই রজতবাবু আর সঞ্জয়বাবু পড়িমরি দৌড়ে গিয়েছিলেন ওই ধ্যাদ্ধেড়ে ধুলোওড়া গ্রামে। বুড়িটা হঠাৎ খেপে গেল কেন, সেটা জানতে। বলা যায় না, হতভাগা বিরোধীরা কিছু উস্কানি দিয়েছে, ওদেরই চক্রান্ত হয় তো!

রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বুড়ির বাড়ি গিয়ে যা শুনলেন, তাতে দুজনেরই, চক্ষু চড়কগাছ! বুড়ি যে হেব্বি টেঁটিয়া, সেটা রজতবাবু বেশ বুঝেছিলেন, কিন্তু সে যে এতটা, তা বুঝতে পারেননি। বুড়ি অ্যাওয়ার্ড নেবে না! নেব না বললেই হল? মামার বাড়ির আব্দার নাকি? মিনিস্টার ঠিক করেছেন, অ্যাওয়ার্ড দেবেন, তার ওপরে কথা হয়? কেন নেবেন না? পঞ্চাশবার জিগ্যেস করেও তার উওর পাওয়া গেল না। ঘাড়ত্যাড়া বুড়ির একটাই কথা “না”। শেষে অনেক কথা চালাচালি করে বোঝা গেল, বুড়ির পড়শিদের আগামীকালই ঘর খালি করে অন্যত্র যাওয়ার কথা বলাতেই নাকি বুড়ির গোসা! ওরা কেন যাবে, কোথায় যাবে? কোথায় আবার যাবে, জাহান্নমে যাবে। আরে, মিনিস্টার সায়েবের নিরাপত্তা নিয়ে এমন ছেলেমানুষী কথা কেউ কোথাও শুনেছে? বুড়ির ভিমরতি হয়েছে, তা নইলে এমন কথা কেউ বলে? মিনিস্টারের সিকিউরিটির ব্যাপারটা কিছুতেই তার নিরেট মাথায় ঢোকানো গেল না। শুরু থেকে শেষ অব্দি বুড়ির একটাই কথা, “না”!

গতকাল ওখান থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছিল, মিনিস্টার সায়েবকে তখনই খবরটা দেওয়া যায়নি। আজ সকালেই তাই দুজনে এসে উপস্থিত হয়েছে মিনিস্টারের ঘরে। অপেক্ষা করছেমিনিস্টার সায়েবের পিএকে সব বলা হয়েছে, কিন্তু পিএ তো পিএই। ঘরের দেওয়ালের মতো, চুপ করে বসে সব শুনল, কিন্তু কোন তাপ-উত্তাপ বা কোন মন্তব্য করল না। সব শোনার পর ঠোঁট উল্টে, ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, “স্যারকে বলে দেখুন, উনি কী বলেন?” রজতবাবুর রাগ হল খুব, সে তো বলবই, কিন্তু তুমি আছ কী করতে? এই সময়ে তোমার স্যারকে একটু ম্যানেজ করতে পার না? তাহলে আর তুমি কিসের পিএ, হে?

সাড় আটটা নাগাদ মিনিস্টার সায়েব বসার ঘরে এসে বললেন, “জীবন বলছিল, আপনারা অনেকক্ষণ এসে বসে আছেন? কালকের অনুষ্ঠানের অ্যারেঞ্জমেন্ট সব রেডি নাকি?” জীবন মিনিস্টার সায়েবের পিএ-র নাম। সঞ্জয়বাবু বললেন, “ইয়ে...মানে এদিকে একটা মুশকিল দেখা দিয়েছে, নীলিমাদেবী বলেছেন...”।

মিনিস্টার সায়েব উল্টোদিকের সোফায় আরাম করে বসে বললেন, “অ্যাওয়ার্ড নেবেন না, তাই তো? ঠিকই তো বলেছেন? আপনারা মাথামোটা, ওঁনার সঙ্গে গেছেন রাজনীতি করতে?” রজতবাবু অবাক হয়েছিলেন খুব, তাঁর ধারণা ছিল, তাঁর মুখে প্রথম শুনে মিনিস্টারসায়েব বোমার মতো ফেটে পড়বেন। কিন্তু সেসব কিছুই হল না, উল্টে তিনি লক্ষ্য করে দেখলেন, মিনিস্টারসায়েব মোটামুটি খোশমেজাজেই রয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যে থেকে তাঁর মনের মধ্যে অসম্ভব আতঙ্কের যে একটা চাপ ছিল, সেটা অনেক হাল্কা হয়ে এল।

তিনি প্রায় সবকটি দাঁত বের করে বিগলিত হেসে বললেন, “আপনি তো সবই জানেন, স্যার...আমরা জাস্ট ওঁনাকে খবরটা দিতে গিয়েছিলাম...তাতেই উনি একেবারে বিগড়ে গেলেন...”।

মিনিস্টার সায়েব বাঘের মতো গর্জন করে উঠলেন, “ইডিয়েট। খবর দিতে গেছিলেন, নাকি দাদাগিরি করতে গেছিলেন? এতদিন এই লাইনে রয়েছেন, দাদাগিরি ছাড়া অন্য আর কিছু বোঝেন? কে বলেছিল, ওঁনার পাড়ার লোকেদের ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে? কিসের জন্যে?”

এই প্রবল ধমকানিতে রজতবাবুর বুকটা আবার কেঁপে উঠল, কোনরকমে বললেন, “সে তো আপনার সিকিউরিটির জন্যে স্যার। আপনার আর অন্যান্য গেস্টদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। ছোটলোকের গ্রাম তো, স্যার। কার পেটে কী বজ্জাতি লুকিয়ে আছে, বলা তো যায় না, স্যার?”

“রজত, তুমি যে শুধু একটা আস্ত গাধা, তাই নয়, তুমি অত্যন্ত ইতর। দুবেলা ভরপেট খেতে না পাওয়া ওই গ্রামের গরিব মানুষগুলোকে তুমি ছোটলোক বলছো? তোমার মতো ছোটমনের লোককে আমি আমাদের দলে চাই না। কালকের অনুষ্ঠানটা মিটলে, পরশু শহরে গিয়েই আমি তোমার নামে কমপ্লেন করবো। কী ভেবেছো কী? নিজেকে খুব বড়ো নেতা মনে করো?” রাগে আর উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলেন, মিনিস্টার সায়েব। পিএ জীবন একগ্লাস জল এগিয়ে দিলেন, মিনিস্টার সায়েবের দিকে। গেলাস থেকে একচুমুক জল খেয়ে গেলাসটা ফিরিয়ে দিলেন জীবনের হাতে, তারপর বললেন, “সঞ্জয়বাবু, কালরাত্রেই আমার কাছে সব খবর এসেছিল। আমি আমাদের লোকদের স্পেসিফিক্যালি বলে দিয়েছি, কোনরকম বাড়াবাড়ি যেন না হয়। বেশি ভিড়ভাট্টা করে দলবাজিও যেন না হয়। এখানকার দুই কলেজের প্রিন্সিপাল থাকবে, ডিসি, এসি থাকবে। দশ-বারো জনের বেশি পুলিশ ফোর্সের দরকার নেই। আর থাকবে দুটো চ্যানেলের রিপোর্টাররা তাদের সঙ্গে ক্যামেরা-ট্যামেরার তাম্‌ঝাম্‌ নিয়ে, ব্যস্‌আর কেউ না”

সঞ্জয়বাবু খুব বশংবদ স্বরে উত্তর দিলেন, “তাই হবে, স্যার”।

“আপনি এখনই বেরিয়ে পড়ুন, সারাদিন ওখানে থেকে সব ঠিকঠাক অ্যারেঞ্জ করুন, আর লোকাল মানুষদের মনে কোনরকমেই কোন ক্ষোভ, বিরক্তি বা ভয় যেন না আসে, সেটা দেখাও আপনার কর্তব্য”।

সঞ্জয়বাবুর সঙ্গে রজতবাবুও সোফা ছেড়ে উঠছিলেন। মিনিস্টার সায়েব বললেন, “সঞ্জয়বাবু, আপনি বাইরে পাঁচমিনিট ওয়েট করুন, রজতকে দুটো কথা বলেই আমি ছেড়ে দিচ্ছি”।

সঞ্জয়বাবু নিচু হয়ে নমস্কার করে বললেন, “ও কে, স্যার, নো প্রবলেম, স্যার”। সঞ্জয়বাবু ঘর থেকে বের হতেই মিনিস্টার সায়েব আবার ধমকানির সুরে রজতবাবুকে বললেন, “নীলিমাদেবীকে অ্যাওয়ার্ডটা আমরা কেন দিচ্ছি, তোমার কোন আইডিয়া আছে, রজত?”

“মানে...ইয়ে...যদ্দূর জানি, ওই ভোটের হিসেব আর কি?”

“লাস্ট ইলেকশনে ওই দিকের ব্লকগুলোতে আমরা সাড়ে দশ হাজারে পিছিয়েছিলাম, মনে আছে?”

“হ্যাঁ স্যার, ওটা আমাদের দলের সুখেনের কারসাজি ছিল, স্যার। আমাকে বাঁশ দেওয়ার জন্যে হারামজাদা বিশ্বাসঘাত করেছিল...”।

“তুমি গাড়লের থেকেও আজেবাজে কিছু একটা, রজত। সুখেনের পেছনে পঞ্চাশ-একশর বেশি লোক নেই, সেখানে সাড়ে দশহাজার এল কোত্থেকে? আর সুখেন যদি প্রবলেম করে, তাকে সামলানোর দায়িত্ব কার – তোমার না আমার”? রজত মুখচুণ করে বসে রইল সোফায়। মিনিস্টার সায়েব আবার বললেন, “ওদিকের গরীবগুর্বো মানুষদের ওপর নীলিমাদেবীর খুব প্রভাব। ওঁকে ওদিকের গাঁয়ের লোকেরা ভীষণ মান্যি করে, সেটা জানো? নীলিমাদেবীকে এখন অ্যাওয়ার্ডটা দিলে, ভোটের সময় আমরা পাব রিওয়ার্ড! ওখানকার মানুষগুলোর মনের মধ্যে একবার ঢুকে পড়তে পারলেই, বাস্‌, কেল্লা ফতে, সব ভোটে এসে জমা হবে আমাদের বাক্সে! নিরেট মাথায় ঢোকাতে পারলাম?”

“হ্যাঁ, স্যার”।

“শুনলাম তুমি কাল, নীলিমাদেবীকে প্রণাম করোনি, একটা নমস্কারও করোনি? বাজারের ষাঁড়ের মতো গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়েছিলে? এভাবে তুমি রাজনীতি করবে, রজত? নেতা হয়েছো বলে, মানীর মান রাখবে না? এখন যাও যেমন বললাম, সব রেডি কর। বেশি ছেলেপুলে সঙ্গে নিয়ে যাবে না, বাছাবাছা কিছু ছেলে নিয়ে যাবে। তারা যেন মারমুখো না হয়। আরা তারা কী শ্লোগান দেবে ঠিক করেছো?”

মিনিস্টার সায়েবের এমন সহজ প্রশ্নে রজতবাবু বিস্মিত হলেন খুব, বললেন, “আজ্ঞে... ইয়ে...আপনার নামে...আর পার্টির নামে...জিন্দাবাদ...”।

মিনিস্টার সায়েব বিরক্ত হয়ে মুখ ভেংচে বললেন, “তুমি একটি আস্ত ছাগল। এতক্ষণ কী বোঝালাম? আমার নাম, পার্টির নাম ভুলেও উচ্চারণ করবে না। বলবে, “সবার মা, নীলিমা”“নীলিমায়িকি জয়”মনে থাকবে? গোটা অনুষ্ঠানে কোন রাজনৈতিক রং যেন না লাগে...বোঝা গেল? যাও, এবার বিদেয় হও”।

 

 

অনুষ্ঠানটা ভালোয় ভালোয় মিটে গেল সকাল দশটার একটু আগেই। এ একদিকে ভালই হয়েছে, চৈত্রের রোদ একটু বেলা হলেই পিঠ পোড়ায়। আকাশে ধুলো উড়িয়ে গোটা দশেক নানান সাইজের গাড়ি বেরিয়ে গেল গ্রাম থেকে, এখন নিশ্চিন্ত। নীলিমার দাওয়ায় অনেকেই রয়েছে, তাঁকে ঘিরে। সকলের মুখই আনন্দে আর খুশিতে উজ্জ্বল। সব থেকে খুশি হয়েছে ঊষা আর সুষি। সুষি অনেকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখছিল মেডেলটা। মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে দু-তিনবার বলেছিল “ম্যাডেল” – যেন বীজমন্ত্র আওড়াচ্ছে! ঊষাতো মেডেলটা নিজের গলায় পরে সকলকে দেখাচ্ছে, “হ্যাদ্দাখ, কেমন লাগতিছে ম্যাডেল পরে!” ওটা রেপ্লিকা, আসলটা আছে ছোট্ট গয়নার বাক্সে নীলিমার হাতে। যে বিশাল মালাটা ওরা নীলিমার গলায় পরিয়েছিল, সেটা খুব যত্ন করে কেউ ঝুলিয়ে দিয়েছে, ঘরের দরজার ডানদিকের হুকে, ওখানে একটা ক্যালেণ্ডার রয়েছে, সেটা এখন ঢাকা পড়ে গেছে। আজকের এই দিনটা নীলিমার জীবনে এবং এই পিছিয়ে থাকা গ্রামগুলোর জীবনেও, অন্য সব দিনকে যেন ঢেকে দিল!

ধোপভাঙা সরুপাড় সাদা শাড়ি আর জামায়, আজ নীলিমাকে অন্য রকম দেখাচ্ছিল, বেশ স্নিগ্ধ, শুদ্ধ, পবিত্র - যেন দেবী, নীলিমাদেবীএখানকার মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁর এতদিনের এত কাছের সম্পর্ক, কিন্তু কেউ কোনদিন তাঁকে প্রণাম করেছে এমন মনে পড়ে না তাঁর। এদের সকলের চোখের দৃষ্টিতে থাকে কৃতজ্ঞতা, আর মুখের হাসিতে থাকে আন্তরিক ভালোবাসা, সেখানে প্রণামের কথা কারও মনেই আসেনি। গতকাল এবং আজ শহরের ওই লোকগুলো, এমনকি ওই মিনিস্টার সায়েবও নিচু হয়ে পরম ভক্তি ভরে প্রণাম করল তাঁকে!

ঊষা উঠোনময় নেচে নেচে বারবার মেডেলটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল, একসময় হঠাৎ চেঁচিয়ে জিগ্যেস করল,  “ও দিদা, এ ম্যাডেলখান কী সোনার?”

তাঁকে ঘিরে বসে থাকা উঠোনের সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে নীলিমা ম্লান হেসে বললেন, “ধুর ক্ষেপি, সবটাই তো মেকি”!

 

..০০..

            

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

জঙ্গী ব্যবসা

  ১   ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ