[ব্লগার কিশোরের মন্তব্যঃ আমার স্কুল জীবনের বন্ধু কাজল
মুখার্জি - অধুনা নিউজিল্যাণ্ডের তোরঙ্গা নিবাসী। বন্ধুপত্নী কুটু (ভালো নাম
প্রদীপ্তা মুখার্জি) গৃহবধূ - কিন্তু চারদেয়ালের ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে কোনদিন
থাকেননি। কুটু সমাজসেবী,
সমাজ সংগঠক এবং যথেষ্ট প্রতিভাময়ী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। সত্যি
বলতে সমগ্র নিউজিল্যাণ্ডে বিশেষ করে নিউজিল্যাণ্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বঙ্গ সমাজে
কুটু অবিসংবাদিত একজন সাংস্কৃতিক মানুষ। তাঁর রচিত আত্মকথন "বিশ্বলোকের
সাড়া" আমার এই ব্লগে প্রকাশ করার অনুমতি পেয়ে আমি সম্মানিত।]
বিশ্বলোকের সাড়া - প্রথম পর্ব
প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)
তুমি
মোর পাও নাই পরিচয়
আমি প্রদীপ্তা, প্রদীপ্তা মুখার্জি; ডাক নাম কুটু, এনামেই আমায় সবাই চেনে। পূর্ব ভারতের কোলকাতা শহর নিবাসী এক মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম।
বাবা ছিলেন পেশায় শিক্ষক, মা ঘর-সংসার সামলাতেন। চার ভাই আর
চার বোনের মধ্যে আমিই ছিলাম সবার ছোট। বড় হয়েছি খুব হৈচৈ করা আনন্দে এবং স্নেহময়
শাসনের মিশেলে।
ছোটবেলা থেকেই কেন জানি না সঙ্গীত আমাকে টানতো। পড়াশোনার
থেকে গান, নাচ, নাটক এই সবই অনেক বেশী পছন্দের। কিন্তু
মধ্যবিত্ত সংসারে লেখাপড়ার দিকেই অনুরাগ ছিল বেশি, অতএব
পড়াশোনা করাতেই অনেক বেশী সময় দিতে হত। কিন্তু পরবর্তী কালে উচ্চশিক্ষার জন্যে
বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় সুযোগ পাওয়া মাত্র
সঙ্গীতকেই বেছে নিলাম। ব্যাচেলর অফ মিউজিক। এটাই আমার মনোমত বিষয় ছিল বলেই হয়তো,
পরীক্ষাগুলোও ভালোভাবে উৎরেও গেলাম।
ছোটবেলাটা কেটেছে মা, বাবা, দাদা,
দিদিদের যুগপৎ আদর ও শাসনে। যদিও বাড়িতে নিয়ম-কানুন মানানোর যথেষ্ট
প্রচেষ্টা ছিল - রোজ ভোরে উঠে পড়তে বসতে হত, এমনকি ছুটির
দিনেও, তার অন্যথা করার অনুমতি মিলত না।
তবে মজাদার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলিও নিয়মিত পালন করা হত।
বছরের প্রথম দিকে হত সরস্বতীপুজো। এই পুজো যেমন বাড়িতে হত, তেমনই
হত স্কুল এবং বড়ো হওয়ার পর কলেজেও। ছোট্টবেলায় যখন আমরা প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী,
বছরে ওই এই একটি দিনই, শাড়ি পরার সুযোগ পেতাম।
বড়োসড়ো শাড়ির পুঁটলি শরীরে জড়িয়ে, আঁচল-টাঁচল সামলে, নানান স্কুলে ঘুরে ঘুরে প্রসাদ খাওয়া আর নতুন বন্ধু পাতানোর মজা আর
আনন্দের স্মৃতি আজও মধুর। সে দিনগুলি ছিল বিরাট উত্তেজনার, পুজোটা
যেন গৌণ, মুখ্য ছিল ওই আনন্দ আর মজাটাই।
তার পরেই আসত মার্চ মাস বসন্তের উতল হাওয়া নিয়ে, মনে ধরত
নানান রঙ ও গান, কারণ দোল আসছে। ওই দিন মা পুজোর ঘরে পায়েস
বানাতেন, তারপরে রাধা-কৃষ্ণের পুজো করতেন, ঠাকুরকে আবীর দেওয়া হতো। তারপর আমরা ছোটরা বাবা, মা
ও গুরুজনদের আবীর দিতাম। তারপরেই শুরু হতো আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে আর পাড়ার
বন্ধুদের সঙ্গে রঙিন হয়ে ওঠা এবং অন্যকে রঙিন করে তোলার উচ্চকিত আনন্দ আর মজা।
এপ্রিলে আসতো ১লা বৈশাখ, বাঙালীদের নববর্ষ। সেও এক
মহানন্দের উৎসব। নতুন নতুন পোষাক, নানান রান্না বান্না, খাওয়া দাওয়া, তার সাথে গান বাজনা ও নাচ, হৈচৈ নিয়ে একশ মজা।
অক্টোবর বা নভেম্বরে আসতো বাঙালির বহু আকাঙ্ক্ষিত মহোৎসব
দুর্গাপুজো,
সঙ্গে নিয়ে আসত কালীপুজো, দীপাবলি, ভাইফোঁটার অনেক ছুটি আর হাজার মজার সম্ভার নিয়ে।
স্বপন যদি মধুর এমন
খুব মনে পড়ে আমার প্রাইমারী স্কুলের দিন গুলো। বাড়ি থেকে অল্প হেঁটেই স্কুল। বিরাট জমি নিয়ে ইংরেজি আমলের তৈরি মস্ত স্কুল বাড়ি; কলকাতার নাকতলাতে, আনন্দ আশ্রম বালিকা বিদ্যালয়। পড়াশুনো করতে হত ঠিকই কিন্তু ছোট্টবেলা থেকেই সঙ্গীতই ছিল আমার সব থেকে প্রিয়।
বাড়িতে রেকর্ডে গান শুনতাম। রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরেছিলাম
সেই ছোটবেলা থেকে। প্রথমে তাঁর গান, তারপর বড় হয়ে তাঁর গল্প, উপন্যাস, নাটক এর প্রেমে পড়ি। নিজের ভালো লাগার
জন্যই রেকর্ড শুনে শুনে গান তুলতাম সাত আট বছর বয়েস থেকে। নয় বছর বয়েসে আকাশবাণী
থেকে ডাক পেলাম, শিশুদের অনুষ্ঠানে গান গাইবার জন্য।
আমার বড় দিদি, আমায় ভর্তি করে দিয়েছিলেন গানের স্কুলে।
এরই মধ্যে আমাদের পাড়ায় বা পাশের পাড়ায় প্রায়ই আমার ডাক পড়ত গান শোনাবার জন্য। ওই
বয়েসেই রবীন্দ্রসঙ্গীতে এতই ডুবে ছিলাম যে পড়াশোনায় ফাঁক পড়ত প্রায়ই। স্কুলের
দিদিমণিরা বাবার কাছে নালিশ করেছিলেন যে আমি পড়াশোনা না করে গানের পেছনে বেশী সময়
দিই।
আমার স্বপ্ন ছিল সঙ্গীত নিয়ে পড়া। তাই যখন পরীক্ষা দিয়ে
সুযোগ পেলাম তখন ভীষণ খুশী হয়েছিলাম, গর্বিত বোধ করেছিলাম। মনে হয়েছিল আমার
গানের পাখি এতদিনে খুঁজে পেল ওড়ার মতো মুক্ত আকাশ। কলেজে পড়ার সময় তখনকার দিনের বহু নামী শিল্পীর
সান্নিধ্যে আসতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেছি। ওঁদের কাছ থেকে অনেক যত্নে গান
শিখেছি, ওঁদের পরিচালনায় অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে গর্বিত
বোধ করেছি।
এর মধ্যেই কোন একদিন বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়লাম। আমার
স্বামী ছিলেন আমার বহুদিনের মনের মানুষ, কাজেই আমাদের মনের অমিলটুকুও মধুর
হয়ে উঠল আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কে।
আমার পুত্র আবীরের বয়েস যখন সবে এক, তখন আমার প্রথম বিদেশ যাত্রার সূত্রপাত। দিল্লীর চাকরি ছেড়ে একটি ইতালীয় কোম্পানিতে চার বছরের চুক্তিতে কাজল জয়েন করল, আর ইরানে একটি পাওয়ার প্ল্যাণ্ট নির্মাণের জন্যে ওর সঙ্গে আমরা রওনা দিলাম ইরান। আমরা ইরান পৌঁছলাম ১৯৯২ সালে।
দিল্লী থেকে দুবাই হয়ে তেহরান পৌঁছলাম এমিরেটসের বিমানে।
প্রথম বিদেশ ভ্রমণে আমাদের বেজায় উত্তেজনা ছিল, এবং ভীষণ ভালো লেগেছিল বিমান
সেবিকাদের, যেমন সুন্দরী, তেমনি
আন্তরিক ব্যবহার।
ইরান সম্পর্কে তখন তেমন কিছুই জানতাম না, শুধু
জানতাম ওখানকার গোলাপ বিখ্যাত, পড়েছিলাম রবিঠাকুরের
“পারস্যে” প্রবন্ধে। ওই প্রবন্ধেই জেনেছিলাম ওদেশের সঙ্গীতের কথা, মানুষজনের কথা। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩২-এর মে মাসে পারস্যে ছিলেন তাঁর জন্মদিনের
সময়, উনি লিখেছেন, “আমার পারসি বন্ধুরা
সকাল থেকে পুষ্পবৃষ্টি করেছেন, নানা বর্ণের ফুল, বিশেষতঃ গোলাপ”। আর জানতাম পারস্যের বিখ্যাত কবি, আমার
ভীষণ প্রিয় কবি হাফেজের কথা। হাফেজের শহর সিরাজ ও ইস্পাহান; আমরা
পরে ইস্পাহানে কবি হাফেজের স্মৃতি সৌধ দেখতে গিয়েছিলাম, ওঁনার
সমাধিতে ফুল ছড়িয়ে আমার মন ভরে গিয়েছিল।
তেহরানে প্লেন নামলো। প্লেন থেকে নামার আগে আমায় পরতে হল, “মান্টো”
আর “রুসেরি”। মান্টো হল প্রায় গোড়ালি অব্দি ঝুলওয়ালা ওভারকোটের মতো পোষাক, তবে সাধারণ কাপড়ের। আর রুসেরি হলো স্কার্ফ, মাথা
ঢাকা দেওয়ার জন্যে। তবে মুখ ঢাকার কোন প্রয়োজন হয়নি। এই পোষাক আমরা ভারত থেকেই
বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম।
তেহরান এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমেই যেটা চোখে পড়েছিল সেটা হল Temperature Board – বাইরের তাপমান তখন শূণ্যের পাঁচ ডিগ্রি নিচে। যদিও আমরা প্রস্তুত ছিলাম,
পর্যাপ্ত গরম পোষাক ছিল সাথে, তবুও জীবনের
প্রথম মাইনাস তাপমানের সম্যক মুখোমুখি হওয়ার আগে ওই লেখাটা দেখেই যেন শীতের শিহরণ
টের পেলাম শরীরে।
তেহরান থেকে প্রায় ন/দশ ঘণ্টার ড্রাইভে আমাদের গন্তব্য
কেরমানশাহ,
কাজলের কর্মস্থল। অধিকাংশ রাস্তাই তখন বরফে ঢাকা, রাস্তার দুপাশ ঘুমিয়ে আছে সাদা বরফের চাদর মুড়ি দিয়ে। প্রায় শেষ বিকেলে
আমরা পৌঁছলা, কেরমানশাহ। ছোট্ট সুন্দর জনপদ, তার চারদিক ঘিরে রয়েছে বরফে মোড়া ছোট ছোট পাহাড়।
সবার জীবনে “প্রথম” যে কোন ব্যাপারই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, এবং আনন্দের তো বটেই। ইরান আমার কাছে সেই প্রথম বিদেশ
যাত্রা। পরে বহু দেশ গিয়েছি, এখন যেমন দীর্ঘ প্রবাসী রয়েছি
নিউজিল্যাণ্ডে, কিন্তু প্রথম বিদেশ যাত্রার আনন্দ ও
উত্তেজনার অভিজ্ঞতা অতুলনীয়। ইরান এমন একটি দেশ, যেখানে আমি
সবদিক থেকেই বিদেশিনী, তাদের ভাষা জানি না, বুঝি না। তাদের জীবনযাত্রা, পোষাক-আষাক, সামাজিক চালচলন, রূপ, সঙ্গীত,
সবকিছুই আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
খুব সুন্দর একটা তিনতলা বাড়িতে আমাদের প্রবাসের নীড় গড়ে
উঠল। নিচের তলায় থাকতেন আমাদের বাড়িওয়ালা, সপরিবারে মহম্মদ আমিনী। আমাদের
ফ্ল্যাটের প্রায় প্রতিটি ঘরের জানালা থেকেই দূরের বরফে ঢাকা পাহাড় দেখা যেত। ভোরের
আলোয় সোনালী রঙে রঙীন হয়ে সেজে উঠতো তারা। ঘরের ভেতরে সেন্ট্রাল হিটিং থাকায়
সাধারণ পোষাকেই থাকা যেত, কিন্তু বাইরে তখন অসম্ভব ঠাণ্ডা।
আমাদের ওই ইরান বাসের কয়েক বছরে, আমরা সর্বনিম্ন তাপমাত্রা
পেয়েছিলাম মাইনাস বাইশ ডিগ্রি! ওরই মধ্যে ছোট্ট আবীরকে নিয়ে শুক্রবারের
সপ্তাহান্তে চলত আমাদের বরফ নিয়ে খেলা, বরফের পুতুল বানানোর
নানান মজা।
ইরানে গিয়ে বাধ্য হয়েছিলাম ফারসী ভাষা শিখতে। প্রথমে বেজায়
অসুবিধে হয়েছিল,
কারণ আমাদের আশেপাশের প্রতিবেশী ও পড়শিদের কেউই হিন্দি তো বটেই,
এমনকি কাজচলা গোছের ইংরিজিও জানত না। হাত-পা নেড়ে, নানান অঙ্গভঙ্গী করে নিজের বক্তব্য পেশ করার প্রচেষ্টা যাঁরা করেছেন,
একমাত্র তাঁরাই বুঝবেন, সে সময় আমি কতখানি
অসহায় বোধ করতাম। অতএব আমাকেই ওদের ভাষা
শেখার উদ্যোগ নিতে হল। নিজের এই অভিজ্ঞতার জন্যে, পরবর্তী
জীবনে নিউজিল্যাণ্ডে বাস করার সময় যখন শরণার্থীদের সঙ্গে মিশেছি এবং তাঁদের নিয়ে
কাজ করেছি, তখন ভাষা নিয়ে অসহায়তার বিষয়টা আমাকে নতুন করে
বুঝতে হয়নি।
যাই হোক, ধীরে ধীরে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে পরিচিতি
বাড়ল, কাজলের সহকর্মী ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গেও আলাপ হল।
আমার পুত্র আবীরও সমবয়সী বন্ধু পেয়ে গেল অচিরেই। এভাবেই আমার ফারসী জ্ঞানের পরিধি
বাড়তে লাগল অত্যন্ত ধীর লয়ে, এবং আবীর আমাকে পেছনে ফেলে,
ফারসীতে শিখে ফেলল অতি দ্রুত, এবং ন-দশ মাসের
মধ্যেই ও দিব্যি ফারসী বলতে শিখে গেল। আমি কোথাও আটকে গেলে, আমার
বালক-গুরুর কাছেই চলত আমার শিক্ষানবিশী। ওইটুকু বয়সেই আবির বাংলা, ইংরিজি এবং ফারসী মোটামুটি একই তালে বলতে পারত। আমার ইরানী বান্ধবীরা
আবিরকে বলত, “ডিকশনারি”, কারণ আমাদের
বাড়িতে এলে আলাপের সময়, তাঁরাও আবিরেরই সাহায্য নিতেন,
interpreter হিসেবে।
কাজল রোজই ভোরে বেড়িয়ে যেত, শহর থেকে অনেকটাই দূরে ছিল ওদের
কর্মস্থল, construction site। আমি আর ছোট্ট আবীর
আমাদের বিশাল বড় অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম এক্কেবারে একা। সদ্য ভারত থেকে গিয়ে ওই
সময়ের প্রত্যেকটি দিন খুবই একঘেয়ে আর বিষণ্ণ লাগত। দেশে থাকতে যেখানে খুশি, যখন
খুশি বেরিয়ে পড়ায় কোন বাধা ছিল না। এখানেও বেরিয়ে পড়তে অন্য বাধা কিছু ছিল না,
একমাত্র অন্তরায় ছিল ভাষা। বাইরে বেরিয়ে ট্যাক্সিকে কী বলবো?
তখনও ইরানে, অন্ততঃ আমাদের ছোট্ট শহরে সুপার
মার্কেট গড়ে ওঠেনি। দোকানে কিংবা বাজারে গিয়ে কী বলবো? মাঝে
মাঝেই পুত্রকে নিয়ে পার্কে যেতাম, ও অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে
খুব দৌড়োদৌড়ি করত এবং মিশেও যেত খুব তাড়াতাড়ি। শৈশবের সারল্যে ভাষা কোন অন্তরায় হত
না।
পার্ক থেকে ফেরার পথে একদিন একটি দোকানে গিয়েছিলাম, কিছু
চকলেট, ড্রাই ফ্রুট্স্ আর বিস্কিট কিনতে। দোকানে সাজানো
জিনিষগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে সংগ্রহ করা গেল। দোকানী ভদ্রলোক সব জিনিষ একটি
প্যাকেটে ঢুকিয়ে তুলে দিলেন আবিরের হাতে, আবিরের বয়েস তখন
বছর দুয়েক। আমি টাকা দিতে গেলাম, ভদ্রলোক কিছুতেই নেবেন না,
আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?
উনি স্মিতমুখে বললেন, “শামা মেহমান-এ ইরান” –
অর্থাৎ আপনারা ইরানের অতিথি। আপ্লুত হয়েছিলাম ভদ্রলোকের অসাধারণ আপ্যায়নে। অবিশ্যি
এমন আপ্যায়ন এরপরেও বেশ কয়েকবার মিলেছিল, নানান মানুষের থেকে
- ট্যাক্সিতে, দোকানে, বাজারে।
ভারতীয়দের প্রতি সাধারণ ইরানীদের এই ভালোবাসা আমার ইরান বাসের অভিজ্ঞতায় অন্যতম
মধুর স্মৃতি।
এভাবেই দিন গড়াতে লাগল। নির্বান্ধব দিনগুলিতে ওই পার্কটিই
ছিল আমার ও আমার পুত্রের মুক্ত বাতাস।
একদিন হঠাৎ করেই আলাপ করতে এলেন এক মধ্যবয়স্ক মহিলা, তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর পুত্র ও
কন্যা, তাদের বয়েস কুড়ি একুশ তো হবেই। আলাপে দেখা গেল ছেলেটি
অল্পবিস্তর ইংরিজি জানে। অতএব সেই দোভাষী হয়ে আমার এবং ওর মায়ের কথাগুলি বলতে
লাগল। এখানে আসার পর এতদিনে কেউ আমার কথা শুনছেন, আমিও শুনছি
তাঁর কথা। সেদিন কী যে ভালো লেগেছিল, সে কথা আজও মনে পড়লে
রোমাঞ্চ অনুভব করি। এমন পরিস্থিতিতে যাঁরা না পড়েছেন, তাঁরা
বুঝতে পারবেন না, এই আনন্দ।
আলাপে জানলাম পরিবারটি “সসজেদি” পরিবার। মহিলা বললেন, আমি
তাঁকে ‘আন্টি’ ডাকতে পারি, জেনে ভালো লাগলো ইরানেও “মামা”, “মাসি” সম্বোধনে
সম্পর্ক গড়ার প্রচলন আছে। আমাকে উনি আশ্বাস দিলেন, প্রয়োজনে
ওঁর সঙ্গে এবং ওঁর ছেলের সঙ্গে আমি নির্দ্বিধায় যোগাযোগ করতে পারি। আমরা উভয়েই ফোন
নম্বর লিখে রাখলাম।
এর কিছুদিন পরেই পেলাম ওঁদের বাড়ি সান্ধ্যভোজের নিমন্ত্রণ।
ততদিনে ওখানকার সামাজিক আদব-কায়দা কিছু কিছু রপ্ত করেছি, কিছু
শিখেছি বই পড়ে, টিভি দেখে, এবং কাজলের
সহকর্মীদের বাড়ি গিয়ে। আন্টি আমাদের নিতে গাড়ি পাঠিয়েছিলেন, ওঁনার
ছেলে “পুয়ান” এসেছিল সঙ্গে। ওঁনার বাড়িতে পৌঁছে দেখি, পুরো
পরিবার – তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে গেট অব্দি এগিয়ে এসেছেন, আমাদের
অভ্যর্থনা করতে। সংস্কৃতের সংস্কৃতিতে একেই বলে “প্রত্যুদ্গমন”।
বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি, সারা বাড়ি পারস্য কার্পেটে মোড়া।
দেওয়ালে সিল্কের কার্পেট ঝোলানো, হাতে আঁকা ছবির মতো সুন্দর
কার্পেটগুলি অনবদ্য সুন্দর, এমনটা আগে কোনদিন দেখিনি। পরে
জেনেছিলাম শ্রীযুক্ত মসজেদি, ওই শহরের অন্যতম ধনী ও বিখ্যাত
মানুষ, স্থানীয় সমাজে তাঁর বিপুল সম্মান।
সারা সন্ধ্যে প্রচুর খাওয়াদাওয়া হল, আড্ডা
হল, আমি গান শোনালাম, ওঁরাও গান
শোনালেন। এভাবেই ওই পরিবারের সঙ্গে গড়ে উঠল নিবিড় সম্পর্ক, যা
আজও অটুট। আজও আন্টির সঙ্গে ফোনে কথা হয়, আন্টি কান্নাকাটি
করেন, বলেন, “তোমাদের এ জীবনে আর দেখবো
না, ভাবতে পারি না...”।
স্বামীর চাকরি সূত্রে আমরা ভারত ছেড়ে ইরানে পৌঁছে, অপরিচিত পরিবেশের রূঢ় বাস্তবের অভিঘাতে আমার সঙ্গীত চর্চা প্রায় বন্ধই হয়ে
গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎই সেখানে এক পিয়ানো শিল্পীর সাথে আলাপ হয় এবং সামান্য
অনুরোধেই তিনি আমায় পিয়ানো শেখাতে রাজী হয়ে গেলেন। নির্বান্ধব পরিবেশের মধ্যে এমন
একটা সুযোগ পেয়ে ভীষণ খুশী হয়েছিলাম। ছোটবেলা থেকেই আমি হারমোনিয়াম বাজাতাম, তাই
পিয়ানোতে গানের সুর তুলতে পারতাম সহজে।
একটা ফারসি গান আমার খুব ভালো লাগতো। সেটাই আমি পিয়ানোতে
তুলে নিয়েছিলাম। একদিন যখন আমি ক্লাসে সেই গানের সুর পিয়ানোতে বাজিয়ে শোনাচ্ছিলাম, আমার
শিক্ষক আনন্দে দৌড়ে গিয়ে অন্দরমহল থেকে তাঁর মাকে ডেকে নিয়ে এলেন। তাঁরা দুজনেই
অভিভূত হয়েছিলেন, একজন ভারতীয়কে ইরানের অতি প্রচলিত গান
পিয়ানোয় বাজিয়ে শোনানোর জন্যে। আমি আজও দেখতে পাই, ফরজাদের
মায়ের চোখের সরল বিস্ময় আর আনন্দ। কেন যে মানুষ গান গেয়ে মনের আলাপ না করে,
Gun-point-এ মনের প্রলাপ বাধায় আজও বুঝে উঠতে পারিনি।
সে যাই হোক, সুদূর ইরানেই গানের চর্চা আবার শুরু হয়ে
গেলো। বেশ কিছু ফার্সী গান শিখেছি,
পিয়ানো বাজানো শিখেছি ওখানেই।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন