Powered By Blogger
মধুর লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
মধুর লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বুধবার, ২১ মে, ২০২৫

অদ্বিতীয়া

 [দিল্লির "কলমের সাত রঙ" পত্রিকার বৈশাখী সংখ্যায় প্রকাশিত] 

 

চেতলা অহীন্দ্র মঞ্চের উল্টোদিক থেকে রোজকার মতোই “চেপে পড়ো” অ্যাপের নির্দিষ্ট গাড়িতে উঠল মঞ্জরী। গাড়িতে উঠতেই গুরপ্রীত কওর মিষ্টি হেসে তাকাল, বলল, “গুড মর্নিং, মঞ্জু”। মঞ্জরীও উত্তরে বলল, “ভেরি গুড মর্নিং”। মঞ্জরী গাড়ির দরজা বন্ধ করে বেল্ট লাগাতেই, সামনে পাছা বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অটোটাকে পাশ কাটিয়ে গুরপ্রীত গাড়ি চালিয়ে দিল। মঞ্জরীর মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলল, “কীরে, আজ কি মুড অফ নাকি, মুখটা গোমড়া করে রয়েছিশ যে?”

মঞ্জরী হেসে উত্তর দিল “কোথায় মুখ গোমড়া? কিছুই হয়নি”!

গুরপ্রীত থাকে নিউ আলিপুরের বি ব্লকে, আর তার অফিস নিউ টাউনে। এতটা দূরত্ব বাসে-টাসে গুঁতোগুঁতি করে রোজ অফিসে যাওয়া এবং ফেরা তার পোষাচ্ছিল না। তাই বাবার গাড়িটা সে নিজেই ড্রাইভ করে যাওয়া-আসা করছিল। কিন্তু এতটা পথ মুখ বুজে প্রত্যেকদিন গাড়ি চালিয়ে যাতায়াত করাও তো বেশ বিড়ম্বনার ব্যাপার। তাই সে “চেপে পড়” অ্যাপে রেজিস্টার করে তিনজন সহযাত্রিনী যোগাড় করে ফেলেছে। চারজনে গল্প করতে করতে জার্নি-টাইমটা দিব্যি কেটে যায় – আবার তেলের খরচা আর গাড়ি সার্ভিসিংয়ের পয়সাও উঠে আসে। মঞ্জরী ওঠে চেতলায়, সহেলি ওঠে গড়িয়াহাট থেকে, আর সিক্তা ওঠে কসবা মোড় থেকে। গুরপ্রীতের মাতা বঙ্গবালা এবং পিতা শিখ সর্দারজি। ইংরিজি, গুরুমুখী, পাঞ্জাবি, হিন্দী ও বাংলা অনর্গল বলতে পারে। বাংলায় তো অসম্ভব দখল, শুধু একটাই দোষ গুরপ্রীতের – ওর উচ্চারণে স নেই শবই শ।

রাসবিহারী মোড়ের সিগন্যালটা খেয়ে গাড়ি থামাল, তারপর মঞ্জরীর কথার উত্তরে গুরপ্রীত বলল, “কিছুই হয়নি বললে হবে? পতিদেবের সঙ্গে কিংবা শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে কিছু একটা খিটিমিটি তো নিশ্চিত হয়েছে”।

মঞ্জরী বলল, “না রে বাবা, সে সব কিছু না। বাই দা ওয়ে আমি কিন্তু ফেরার সময় তোর সঙ্গে ফিরব না। অফিস থেকেই সোজা মানিকতলা মায়ের কাছে যাব”।

সিগন্যাল খুলে যাওয়াতে, গুরপ্রীত গাড়ি স্টার্ট করে ফার্স্ট গিয়ার ফেলতে ফেলতে জিজ্ঞাসা করল, “এনি থিং রং? বাবা-মার শরীর খারাপ হয়নি তো?”

“না, না। ওঁদের শরীর ঠিক আছে। অনেকদিন যাওয়া হয়নি – তাই ভাবলাম কটা দিন থেকে আসি মায়ের কাছে...”।

“একদম খালি হাতে? কোন ব্যাগ-ট্যাগ নিসনি?”

“টুকটাক কিছু আমার এই ব্যাগেই নিয়ে নিয়েছি...আর কাপড়চোপড় মায়ের কাছে রাখাই থাকে...ও নিয়ে কোন চাপ নেই”।

“ওক্কে। যাই বলিস, তুই কিন্তু আসল ব্যাপারটা চেপে গেলি। আমাকে বললি না”।

মঞ্জরী কিছুক্ষণ চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে রইল, তারপর লেকমলের হাল্কা সিগন্যালটা পার করে বলল, “সকালে ছোট্ট একটা ব্যাপারে মা এমন রিয়্যাক্ট করলেন, জাস্ট ভাবা যায় না”।

“কোন মা, শাশুড়ি মা? তুই যে বলিস তোর শ্বশুর শাশুড়ি খুব ভাল – তোকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন?”

“সেটাই। মেয়ের মতো – আর নিজের মেয়ের মধ্যে কিছুটা ফারাক হয়তো থেকেই যায়। ব্যাপারটা এতই সামান্য, এখনও চিন্তা করলে অবাক লাগছে”। মঞ্জরী একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, “অফিসের জন্যে রেডি হয়ে পথিক আর আমি টেবিলে খেতে বসেছিলাম, মা খাবার সার্ভ করছিলেন। হঠাৎই আমার হাতে লেগে কাচের গেলাসটা টেবিল থেকে পড়ল - ভেঙে চুরমার – মেঝেয় জল থৈ থৈ। তাড়াহুড়োর সময় মেঝেয় ভাঙা কাচ, ছড়িয়ে পড়া জল ... খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার”।

দেশপ্রিয় মোড়ের সিগন্যালটাও খেয়ে গেল গুরপ্রীত, বলল “ধ্যাত্তেরিকা...দুটো সেকেণ্ডের জন্যে... যাগ্‌গে, তারপর?”

“ভাঙা কাচ আর জলটা মুছে নেওয়ার জন্যে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাব...মা রীতিমতো ঝংকার তুলে বললেন, থাক থাক বৌমা, আমি দেখছি... খাওয়া ছেড়ে উঠে তোমাকে আর কাজ দেখাতে হবে না...তারপর প্লেটে ভাত আর তরকারি দিতে দিতে বললেন, কদিনের জন্যে তুমি বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে এস বৌমা। বুঝতে পারছি তুমি খুব প্রেসারে আছ। আজই সন্ধেবেলা অফিস থেকে চলে যাও – কদিন ওখানে থেকে মাথাটা ঠাণ্ডা করে এস”।

“তোকে নাম ধরে ডাকেন আর “তুই” বলেন – বলেছিলি না?”

“হ্যাঁ তাই বলেন, কিন্তু কোন কারণে বিরক্ত হলে বৌমা আর “তুমি” বলেন”।

সিগন্যাল খুলতে গুরপ্রীতের গাড়ি আবার গড়াতে লাগল, গাড়ি থার্ড গিয়ারে তুলে বলল, “হুম। বুঝলাম, তারপর? তুই কিছু বললি না?”

“নারে, ব্যাপারটা এতটাই আচমকা ঘটে গেল, আমি মাথা নিচু করে ভাত নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে, উঠে পড়লাম। ওই সময় আমি যদি কিছু বলতাম, ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে উঠত...”।

“তা ঠিক, পথিকও কিছু বলল না?”

“নাঃ, কিচ্ছু না। আমার দিকে খুব সহানুভূতি মাখা দুঃখীদুঃখী মুখে তাকাচ্ছিল বারবার”। গুরপ্রীতের হাসি পেলেও হাসল না, গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। লেক ভিউ রোডের সিগন্যালটা নির্বিঘ্নে পেরিয়ে – ট্রাঙ্গুলার পার্কের সিগন্যালে আবার আটকে গেল।

মঞ্জরী আবার বলল, “আমরা বাড়ি থেকে বেরোনর সময়ে মা আবার বললেন, অন্যভাবে নিস না, মা। কদিন ও বাড়ি থেকে ঘুরেই আয়। আজ শুক্রবার, মঙ্গলবার ফিরে আসিস - আর ওই দিন অফিসে ছুটি নিয়ে নিস, কিন্তু। যা বললাম, তার যেন নড়চড় না হয়, আমার কথার অবাধ্য হবি না”।

গুরপ্রীত মঞ্জরীর মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে দেখল, তারপর সিগন্যাল খুলতে গাড়ি স্টার্ট করে বলল, “ বেরোনর সময় আবার “তুই” বললেন? আশ্চর্য তো?”

“হ্যাঁ”।

“দেখ মঞ্জু, গড়িয়াহাটে সহেলি ওঠার আগেই আমি এই প্রসঙ্গটা ক্লোজ করতে চাই। ওদের সামনে এসব আলোচনা না করাই ভাল। তবে আমার কেমন খটকা লাগছে, মঞ্জু, উনি তোর ওপর মোটেও বিরক্ত হননি। অন্য কিছু ব্যাপার আছে”।

“কে জানে? জানি না। রাস্তায় বেরিয়ে পথিক বলল, মায়ের কথায় ও খুব বিরক্ত হয়েছে... এ কটা দিন ও আমার সঙ্গেই থাকবে”।

গুরপ্রীত হেসে বলল, “ওয়াও। আমি শিয়র এসবের পেছনে দারুণ একটা প্ল্যান আছে – তোর জন্যে সারপ্রাইজ”।

“তোর তাই মনে হচ্ছে?” মঞ্জরী ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল গুরপ্রীতের দিকে।

“গড়িয়াহাট এসে পড়েছি, এখন এসব কথা থাক। তবে যা বুঝলাম, কাল, সোম আর মঙ্গল তোর সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। দেখা হবে সেই বুধবার...। সহেলি গাড়ির দিকে এগিয়ে এল, গুরপ্রীত এবং মঞ্জরী একই সঙ্গে বলে উঠল, “হাই সহেলি, গুড মর্নিং”।

 

সন্ধে সাড়েসাতটা নাগাদ মঞ্জরী পথিকের সঙ্গে মানিকতলায় তার বাপের বাড়ি পৌঁছল। ওদের দুজনকে একত্রে দেখে মঞ্জরীর মা প্রীতমা একটু আশ্চর্য হয়েই বললেন, “ওমা, কোন খবর না দিয়ে দুটিতে এসে উপস্থিত হলি? আয়, আয় ভেতরে আয়, খবর-টবর সব ভালো তো?”

মঞ্জরী বসার ঘরের সোফায় বসে বলল, “তোমার কাছে থাকতে এলাম। কাজের চাপে আমার হাতপা নাকি বশে নেই। তাই ওবাড়ির মা এখানে পাঠালেন কটা দিন রিল্যাক্স করে যেতে।”

প্রীতমাদেবী আরও অবাক হলেন, “সে আবার কি? নিশ্চয়ই কিছু ঘটিয়েছিস – বাবা পথিক, কী ব্যাপার বলো তো? তোমার মা অকারণে এরকম বলার মানুষ তো নন?”

পথিক মঞ্জরীর পাশেই বসেছিল, বলল “আজ সকালে খাবার টেবিলে মঞ্জুর কনুই লেগে একটা কাচের গ্লাস ভেঙে গেছে... সেই সময়েই...”।

প্রীতমাদেবী কী বলবেন ভেবে পেলেন না, মেয়ে জামাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “যাগ্‌গে, মঞ্জরী পথিককে নিয়ে তোর ঘরে যা, অফিসের জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেস হয়ে আয়, তারপর সব কথা শুনব। এখন তোদের জলখাবারের যোগাড় দেখি। এদিকে তোর বাবা একবার বেরোলে আর ফেরার নাম করে না। জামাই এসেছে... আর তিনি এখন বন্ধুদের সঙ্গে...যা ওঠ - ঘরে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নে”।

মঞ্জরী আর পথিক উঠে ভেতরে গেল, প্রীতমাদেবী ফোন তুলে কর্তাকে ধরলেন, “শুনছো, মঞ্জু আর জামাই এসেছে, আড্ডা ছেড়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি এস – কথা আছে। আর ফেরার সময় কিছু মিষ্টি-টিষ্টি – চিকেন-টিকেন নিয়ে এস”। ফোন বন্ধ করে তিনি রান্নাঘরে গেলেন।

গিন্নির ফোন পাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন অতনুবাবু। ঘরে ঢুকতেই তাঁর নাকে এল লুচিভাজার গন্ধ। ইদানীং তাঁর লিপিড প্রোফাইল আর বিপি সামান্য বিশ্বাসঘাতকতা করায় – ও জিনিষ তাঁর গালের নাগালে আর আসে না। বাইরের ঘরে জুতো ছেড়েই তিনি সরাসরি রান্নাঘরে ঢুকে দেখলেন, গিন্নি বেজায় ব্যস্ত। প্রতিমা লুচি বেলছে আর প্রীতমা গরম তেলে লুচি ছাড়ছেন। পাশে একটা থালায় বড়ো বড়ো বেগুনের টুকরো নুন আর হলুদ মেখে হাসছে। অতনুবাবু অন্ততঃ চারটে লুচি উইথ দুপিস বেগুনভাজার আশায় বুক বেঁধে খুব নরম সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, “মঞ্জুরা এমন হঠাৎ করে চলে এল, তোমায় আগে ফোন করেনি?”

প্রীতমা গরম তেল থেকে লুচি তুলতে তুলতে বললেন, “হাত চালা প্রতিমা, এর পরে আবার বেগুন ভাজতে হবে। একবার ফোন করলে এত হুটোপাটি করতে হত? সব যোগাড় করে রেখে দিতাম”। শেষ কথাগুলি তিনি অতনুবাবুকে বললেন।

“হুঁ। কী ব্যাপার কিছু বুঝলে? মঞ্জু তো এমন করে না!”

“ঠিক বুঝলাম না। জামাই বলল, আজ সকালে খেতে বসে মঞ্জুর হাত লেগে নাকি একটা কাচের গ্লাস ভেঙেছে। তাতেই বিরক্ত হয়ে বেয়ান মঞ্জুকে খুব বকাবকি করেছেন, আর বলেছেন, কটা দিন বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে এস, বৌমা”।

অতনুবাবু মিষ্টির বাক্সদুটো ফ্রিজের মাথায় রেখে, প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে চিকেনটা বের করে একটা বড় বাটিতে ঢালতে ঢালতে বললেন, “তেলের শিশির জায়গায়, জলের গেলাস?”

প্রীতমাদেবী বললেন, “সে আবার কি?”

“কেন শোননি? তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর ওপর রাগ করো? অন্নদাবাবু সেখানে ভারত ভাঙার কথা বলেছিলেন, কিন্তু এখানে যে পরিবার ভাঙার উপক্রম?”

“যাঃ ও আবার কী অলক্ষুণে কথা বলছ? বেয়ান আমাদের তেমন লোকই নন। আমাদের মঞ্জুই কিছু একটা বড়ো গণ্ডগোল বাধিয়েছে”।

“উঁহু, তাহলে পথিককে সঙ্গে নিয়ে এসে পড়ল কেন? ব্যাপারটা অত সহজ আর সিম্পল নয় মনে হচ্ছে”!

“কি জানি বাপু, আমার এখন অত ভাববার সময় নেই। আগে দুজনকে খেতে দিই। ওদের ফ্রেশ হতে বললাম, তুমি দেখ তো ওদের হল কি না?”

অতনুবাবু বাইরে এসে, মঞ্জুদের ঘরের সামনে দাঁড়ালেন, গম্ভীর গলায় একটু বেশ জোরে কাশলেন, তারপর দরজায় টোকা মেরে বললেন, “পথিক, মঞ্জু তোমাদের হল বাবা? খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, তোমাদের মা তাড়া দিচ্ছেন যে”।

খুট শব্দে দরজার ছিটকিনি খুলে প্রথমে পথিক, পিছনে মঞ্জু বের হল। পথিক পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল, দেখাদেখি মঞ্জুও।

অতনুবাবু হাসতে হাসতে বললেন, “আরে ধ্যাৎ কী যে করিস তোরা, খেতে বসার আগে কেউ পায়ের ধুলো নেয়? আবার তো হাত ধুতে হবে”।

পথিক হেসে উত্তর দিল, “ওই তো বেসিন, হাতটা ধুয়ে নিলেই হল”।

অতনুবাবু ডাইনিং টেবিলে বসলেন, বললেন, “আয় আয় বসে পড়, তোর মা এখনই সব নিয়ে আসছে”। বেসিনে হাত ধুয়ে পথিক এবং মঞ্জু টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে বসল। অতনু দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। মঞ্জুটার মুখ কিছুটা গম্ভীর, তবে পথিকের স্বাভাবিক। এর মধ্যেই প্রীতমা দু হাতে দুটি প্লেটে চারটে করে লুচি আর দুটো করে বেগুনভাজা এনে পথিক আর মঞ্জুর সামনে রাখলেন। বললেন, “গরম গরম খেয়ে নাও বাবা, সেই কোন সকালে দুটো ভাত মুখে গুঁজে অফিসে বেরোও... খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। অফিসে কী খাও কে জানে?”

মঞ্জু একটু মনখারাপি সুরে বলল, “মা, লুচি চারটে না, দুটো তুলে দিচ্ছি, আর একটা বেগুনভাজা”।

প্রীতমাদেবী অতনুবাবুর জন্যেও একটা প্লেটে দুটো লুচি আর বেগুনভাজা নিয়ে এসেছিলেন, কর্তাকে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন কী হয়েছে? খিদে হয়নি না মন খারাপ? খেয়ে নে, রাত্তিরে বরং রুটি কম খাস”।

মঞ্জু ঘ্যানঘেনে সুরে বলল, “না মা, প্লিজ। একদম ভাল্লাগছে না। আমি বাবার প্লেটে তুলে দিচ্ছি”।

পথিক মঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বলল, “এত টেনশান কর না, মঞ্জু। বারবার তো তোমাকে বলছি কিচ্ছু হয়নি। মা তোমার ওপর মোটেই রাগ করেননি। যেটুকু করেছেন, আমি বলছি মিলিয়ে নিও, মঙ্গলবার তিনিই সব কিছু ভুলিয়ে দেবেন”।

মঞ্জু কান্নাধরা গলায় বলল, “আমাকে বাচ্চা মেয়ে পেয়েছ? যা বোঝাবে তাই বুঝে যাব?”

মঞ্জুর চোখের জল দেখে বিচলিত হলেন প্রীতমাদেবী এবং অতনুবাবুও। একমাত্র কন্যা। এই বছর খানেক আগে ভালো ঘর-বর দেখে বিয়ে দিয়েছেন। পথিকের মতো জামাই লাখে একটা মেলে। কিন্তু তার থেকেও বড় ব্যাপার পথিকের বাবা-মা। এমন সজ্জন ভালোমানুষ আজকাল বড়ো দেখা যায় না। তাঁরা যতবারই গিয়েছেন, তাঁদের কন্যা মঞ্জুকে ও বাড়িতে বিরাজ করতে দেখেছেন। ও বাড়ি থেকে ফিরে তাঁরা কত্তা-গিন্নিতে মাঝে মাঝে অভিমানও করেছেন, দেখলে, মেয়েটা আমাদের যেন ভুলেই গিয়েছে! মনে হচ্ছে শ্বশুর-শাশুড়িই ওর বাপ-মা, আর আমরা কেউ নই! ওরে মুখপুড়ি তোকে যে দশমাস পেটে ধরেছি, তোর বাপ আর আমি যে তোকে বুকে করে আগলে আগলে এতটি বড় করে তুললাম, সে সব কথা ভুলে গেলি? আবার মনকে সান্ত্বনাও দিয়েছেন, সারাজীবন মেয়েকে আপন করে রাখার জন্যে তো মেয়েদের জন্ম হয় না। তিনিও কি বাবা-মায়ের কম আদরের দুলালি ছিলেন? স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি এবং মঞ্জুকে নিয়ে তিনিও কি তাঁর বাপ-মাকে ভুলে যাননি?

মঞ্জু মুখ নামিয়ে কোনরকমে দুটো লুচি আর বেগুনভাজা খেয়ে উঠে গেল। প্রীতমাদেবী বললেন, “কী রে উঠে পড়লি কেন? বাবা তোদের জন্যে হাতে করে সন্দেশ নিয়ে এল, দুটো মুখে দিবি না?” বেসিনে মুখ হাত ধুয়ে এসে মঞ্জু বলল, “ভাল্লাগছে না, রাত্রে খাবো”, তারপর নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল।

পথিক দেখল কিছু বলল না। খুব মন দিয়ে ছটা লুচি, বেগুনভাজা আর দুটো কড়াপাক সন্দেশ তৃপ্তি করে খেয়ে উঠল। বেসিনে মুখ হাত ধুয়ে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বলল, “আমার মায়ের ব্যবহারে মঞ্জু একটু মুষড়ে পড়েছে, কিন্তু বিশ্বাস করুন মঞ্জুকে নিয়ে মায়ের একটা মজার প্ল্যান আছে। আর তার জন্যেই এত সব নাটক”।

প্রীতমাদেবী স্বামীর মুখের দিকে অসহায় চোখে তাকালেন, তারপর ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “মেয়েটাকে বহুদিন এমন মনমরা থাকতে দেখিনি, তোমার মায়ের কী প্ল্যান, বাবা?”

অতনুবাবু পথিকের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা মঞ্জুকে গোপন করে, ওকে চমকে দেওয়ার জন্যে কিছু একটা মজার প্ল্যান ভেঁজেছ, তাই না? তা তোমরা ফিরছ কবে?”

পথিক ম্লান হাসল, বলল, “মঙ্গলবার। মায়ের সেরকমই আদেশ”।

প্রীতমাদেবী জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার মায়ের প্ল্যানটা কী, বললে না তো?”

পথিক প্রীতমাদেবীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আগামী কাল আমার মা-বাবা আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। আমরা দুজন অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর, সাড়ে এগারোটা-বারোটা নাগাদ। দুপুরে এখানেই খাবেন। এর থেকে বেশি কিছু বলতে আমার মানা আছে। যা বলার মা-বাবাই বলবেন”।

প্রীতমাদেবী অবাক হয়ে পথিকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সঙ্কোচের হাল্কা হাসিমাখা মুখে পথিক বলল, “আগামীকাল আমার বাবা-মা আসার ব্যাপারটাও মঞ্জুকে এখনই বলবেন না, প্লিজ”।

 

 

 

আধুনিক সভ্যতায় কত ট্রেন কত এরোপ্লেন নিত্য দেরি করে চলে। কিন্তু মঞ্জরীর মাথায় গুচ্ছের দুশ্চিন্তা এবং দ্বিধার বোঝা চাপিয়ে, মঙ্গলবার সকালটা ক্যালেণ্ডারের পাতার মতো একেবারে কাঁটায় কাঁটায় এসে পড়ল। গত রাত্রে তার ভাল ঘুম হয়নি। নানান চিন্তায় তার বারবার ঘুম টুটেছেআচ্ছা, সে কি আজ থেকে পঞ্চাশ-একশ বছর আগেকার যুগে ফিরে যাচ্ছে? শাশুড়ি যেমন খুশি নাচাবে সেও মাদারির হাতে বাঁধা বাঁদরীর মতো নেচে চলবে? কাচের একটা গেলাস কনুইয়ের ধাক্কায় পড়ে ভেঙে যাওয়াতে – শাশুড়ি তাকে মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন বাপের বাড়ি থেকে কয়েকটা দিন ঘুরে আয়। আর মঞ্জরীও সুবোধ বালিকার মতো চলে এল? শাশুড়ি বলেছিলেন, মঙ্গলবার অফিসে ছুটি নিয়ে সকাল আটটার মধ্যে বাড়ি আসবি। এর যেন কোন অন্যথা না হয়। আর সেও আজ এই সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে স্নান-টান সেরে সাজুগুজু করতে বসেছে, নেচে নেচে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্যে?

সে শুনেছে শনিবার তারা অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর ওশাশুড়িমাতা ও শ্বশুরপিতা এ বাড়িতে এসেছিলেন। তার মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প-গাছা করে গেছেন। সানন্দে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরেছেন। এবং তার জন্যে রানি কালারের জমিতে ছোট্ট ছোট্ট হলুদের বুটি দেওয়া উজ্জ্বল সুন্দর টাঙ্গাইল তাঁতের একটি শাড়ি দিয়ে গেছেন। সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ এবং শায়া। তিনি নাকি বারবার বলে গেছেন মঞ্জু যেন মঙ্গলবার এই শাড়ি পরেই ও বাড়িতে যায়। আজকে সে সাজতে বসেছে এবং সেই শাড়িটিই বিছানায় রেখেছে সেজে উঠে পরবে বলে!

কেন? কিসের জন্যে? সে যথেষ্ট লেখাপড়া করেছে। নিজের যোগ্যতায় সে চাকরি যোগাড় করেছে। তার বয়স অনুপাতে তার পদমর্যাদা এবং বার্ষিক ক্ষতিপূরণ অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। সে তো পতি-নির্ভর লবঙ্গলতাসম গৃহবধূ নয়। সে তার ইচ্ছেমত জীবন যাপন করতেই পারে – তার মধ্যে নাক গলানোর অধিকার শ্বশুর-শাশুড়ির কতটা আছে? এমন কি তেমন তেমন হলে তার বাবা-মায়েরও নেই। তাহলে সে কেন যাচ্ছে আজ? মঞ্জরী কাল রাত্রে শোবার পর ভেবেছিল – অফিসেই যাবে, শ্বশুরবাড়ি যাবে না। ছুটি নেওয়া সত্ত্বেও অফিসে গেলে সহকর্মীরা অবাক হবে? হোক না। যে অনুষ্ঠানের জন্যে সে ছুটি নিয়েছিল, সে বলবে, সেই অনুষ্ঠান ভেস্তে গিয়েছে? আর শ্বশুরবাড়ি না গেলে, শাশুড়ি রাগ করবে? কতটা? তার স্বামী পথিক সেও কি ক্ষুণ্ণ হবে? কতটা? ও বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্কটাই ছিন্ন হয়ে যাবে? ডিভোর্স? সধবা মঞ্জরী থেকে, ডিভোর্সি মঞ্জরী? তাদের কোন ছেলেপুলে হয়নি, অতএব তার বাবা-মা কি আবার খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন, “ডিভোর্সী - নাম-মাত্র বিবাহ – কর্পোরেট অফিসে চাকরিরতা সুন্দরী গৃহকর্মনিপুণা শাণ্ডিল্য গোত্রীয় যুবতীর জন্য পাত্র চাই”? এই দুই বাড়ির সম্পর্কগুলো কি ওই কাচের গেলাসের মতোই ঠুনকো? তার কনুইয়ের হাল্কা ঠোকাতেই ভূমিসাৎ হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে পড়বে মেঝেয়? ভাঙা সম্পর্কের টুকরোতে ক্ষতবিক্ষত হবে তাদের সকলের জীবন?   

নাঃ। এতটা দূরদর্শী দুশ্চিন্তার স্বপক্ষে সবল যুক্তি বা প্রমাণ মঞ্জরী নিজের মনের অন্দরে খুঁজে পাচ্ছে না। যাকে বলা যায় “ঠোস সাবুদ”। তার মনের মধ্যে এখনও জাঁকিয়ে বসে রয়েছে, তার প্রতি শ্বশুর এবং শাশুড়ির নিঃস্বার্থ অপত্য স্নেহ – তার ওপরে ওঁদের অকুণ্ঠ নির্ভরতা ও বিশ্বাসও। মাত্র একদিনের আচরণ থেকে এতটা বিষম পরিণতির চিন্তা করার সময় এখনও আসেনি। আজ ও বাড়ি গিয়ে তাকে ঘিরে কী ঘটনা ঘটে, দেখাই যাক না? তারপর না হয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে!

অতএব সাড়ে সাতটা নাগাদ মঞ্জরী আর পথিক রেডি হয়ে তাদের ঘর থেকে বের হল। মায়ের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। ওদের দেখে প্রীতমাদেবী বেরিয়ে এলেন। মঞ্জরী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি এত সকালে কোথায় বেরোচ্ছ, মা?”

“আমরাও যাবো তো, ও বাড়িতে। তোর বাবাও রেডি, গাড়ি বের করতে গিয়েছে। তোরা রেডি?”

“তোমরাও ও বাড়িতে যাবে?” মঞ্জরীর বিশ্বাসই হচ্ছে না, “কিন্তু কেন?”

প্রীতমাদেবী থমথমে মুখে বললেন, “বেরোনর সময় সে সব কথা এখন থাক। তিক্ততা বাড়বে...”।

মঞ্জরী বলল, “কিসের তিক্ততা?”

সে কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, “ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করেছিস তো? তোরা এগো, আমি দরজা বন্ধ করে সদরে তালা দেব”।

হতভম্ব মঞ্জরী পথিকের সঙ্গে বাইরে এল। পথিকের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী ব্যাপার বলো তো?” পথিক মঞ্জরীর দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, “নো আইডিয়া”!

অতনুবাবু গাড়ি বের করে রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। প্রীতমাদেবী গাড়ির কাছে এসে বললেন “তোরা দুজনে পিছনে বস, আমি সামনে বসছি”। মঞ্জরীর বিয়ের পর থেকে একসঙ্গে কোথাও গাড়ি নিয়ে বেরোলে, অতনুবাবুর পাশের সিটটা জামাই পথিকের জন্যেই বরাদ্দ থাকত। মা আর মঞ্জরী বসত পিছনের সিটে, কথা বলতে বা গল্প করতে সুবিধে হত বেশ। আজ তার ব্যত্যয় কেন? মঞ্জরীর মনে খটকা।

গলি থেকে বেরিয়ে গাড়ি বড়ো রাস্তায় পড়তেই, মঞ্জরী জিজ্ঞাসা করল, “তখন তুমি কিসের তিক্ততা বাড়বে বলছিলে, মা?”

“ওফ্‌, একটা কথা তোর মাথায় ঢুকলে, সেটাতেই তুই আটকে থাকিস, মঞ্জু! ওসব আলোচনা এখন থাক না”।

মঞ্জরীর গলায় জেদ, “না, বলতেই হবে। বলা নেই কওয়া নেই - তোমরা হঠাৎ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লে কেন”?

অতনু সামলানোর চেষ্টায় বললেন, “কেন আবার কি? গাড়িটা অনেকদিন বের করিনি, তোরা এতটা পথ যাবি – গাড়িটা ঠিকঠাক থাকবে, আমারও হাতপাগুলোর একটু প্র্যাক্টিস হবে...এই সব ভেবেই...”।

“একদম বাজে অজুহাত দিও না, বাবা। তোমাদের আজই ও বাড়িতে যাওয়ার কী এমন দরকার পড়ে গেল, সেটাই জানতে চাইছি”।

সকাল সকাল গাড়ি নিয়ে বেরোনর এই এক মজা, রাস্তা-ঘাট বেশ খালিই থাকে। পরপর দুটো-তিনটে মোড়ের সিগন্যাল ক্লিয়ার পাওয়া যায়। অতনুবাবু মিনিট পনেরর মধ্যেই বেকবাগান মোড় পার হয়ে শরৎ বোস রোডে ঢুকে পড়লেন।

“মা, তুমি বলবে না?”

“আচ্ছা, কী এত জিদ করিস বলতো, ছেলেমানুষের মতো? পথিকের বাবা-মা শনিবার আমাদের বাড়িতে এসে নেমন্তন্ন করে গেছেন, আজ যাওয়ার জন্যে। যাচ্ছি। কেন আত্মীয়-পরিজনের বাড়ি কী মানুষ যায় না?”

“একশবার যায়, কিন্তু সেখানে তিক্ততা আসছে কোত্থেকে? আর তুমি আগে বলনি কেন? আমাদের সঙ্গে তোমরাও যাবে?”

“তিক্ততা নয়? এই যে তুই সেই শুক্কুরবার থেকে আজ পর্যন্ত মুখটা তোলো-হাঁড়ির মতো করে ঘরে ঘুরে বেড়ালি, সেটা তিক্ততা নয়? তার ওপর আগেই যদি বলতাম, আমরাও তোদের সঙ্গে যাবো, তুই কী ভাববি, কী মনে করবি – সেই ভয়েই তোকে বলিনি”।

অতনুবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, “তিক্তম্‌ আশুফলপ্রদম্‌”, রেয়ার ভিউ দিয়ে মেয়ের মুখটা দেখে মুচকি হাসলেন।

বিরক্তমুখে মঞ্জু বাবার দিকেই তাকিয়ে বলল, “তার মানে?”

অতনুবাবু হাসলেন, বললেন, “এগুলো আগেকার দিনের কবিরাজদের প্রবচন – ওষুধ যত তেঁতো হবে, তার ফল হবে তত তাড়াতাড়ি। আমি কবিরাজ নই, তবে এটুকু বলতে পারি – এই কদিনের তিক্ততার শেষে, একটু পরেই দারুণ মজাদার কিছু ঘটবে। ওই তো রাসবিহারি মোড় এসে গেছে। আহা সিগন্যালটাও খোলা আছে, সাঁ সাঁ করে পৌঁছে যাব, চেতলা অহীন্দ্র মঞ্চ। এখনকার মতো এই সব কথার নটেগাছগুলোকে মুড়িয়ে ফ্যাল”।        

 

 

গাড়ির আওয়াজ পেয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন শুক্তিদেবী আর অনীশবাবু। অনীশবাবুর মুখে হাসি, কিন্তু শুক্তিদেবীর মুখেচোখে কেমন যেন উদ্বেগ। মঞ্জুকে কাছে টেনে নিয়ে হাত ধরে ঘরে ঢুকলেন, সোজা নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে, বিছানায় বসালেন। তারপর মঞ্জুর মুখটা তুলে ধরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। মঞ্জু অবাক হয়ে দেখল, শুক্তিদেবী কাঁদছেন, তাঁর দুচোখ বেয়ে নেমে আসছে অবিশ্রান্ত অশ্রুধারা। মঞ্জু দুহাতে জড়িয়ে ধরল শাশুড়িকে।

শুক্তিদেবী কান্নাধরা গলায় বললেন, “আমার ওপরে যাচ্ছেতাই রাগ করেছিস না? শুনেছি এ কদিন তুই ভালো করে খাসনি, হাসিস নি। মুখ গোমড়া করে ছিলি সারাক্ষণ। শুনে আমার বুকের ভেতরটা যে কেমন করছিল, সে কথা তোকে বোঝাতে পারব না, পাগলি। আমারও মুখে রুচি নেই, রাতে ঘুম নেই, সিরিয়ালে মজা পাইনি। ভাবছিলাম আমার সোনার টুকরো মেয়েটাকে সিরিয়ালের দজ্জাল শাশুড়ির মতো আমি এত কষ্ট দিতে পারলাম তো?”

মঞ্জুও আবেগ সামলাতে পারল না, তার দুই চোখ ঝামড়ে জল চলে এল, কানে কানে বলল, “কেন এমন করলে বলো তো, মা?”

শুক্তিদেবী উত্তর দিলেন না। নিজের চোখ মুছলেন, পরম মমতায় মঞ্জুরও চোখের জল মুছে দিলেন। তার কপালে একটি চুম্বন এঁকে দিয়ে গভীর স্বরে বললেন, “বলছি, এখন ও ঘরে চল”।    

বসার ঘরে সবাই রুদ্ধশ্বাস বসেছিল, শুক্তিদেবী আর মঞ্জু ঢুকতেই সবাই গভীর শ্বাস নিল। মঞ্জুর শ্বশুর অনীশবাবু ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “যাক, কিছুটা বৃষ্টি যখন হয়েছে, তখন মেঘলাভাবটা কেটে এবার রবিকিরণ দেখা যাবে, কী বলেন, অতনুবাবু?”

অতনুবাবু বললেন, “ঠিক বলেছেন, চারদিনের টানা দুর্যোগ মনে হচ্ছে আজ কেটে গেল”।

বসার ঘরের অন্যদিকে ডিভান সরিয়ে, মেঝেয় কার্পেটের বড় একটা আসন পাতা ছিল। সুন্দর রঙিন আলপনা আঁকা সেই আসনটি ঘিরে। শুক্তিদেবী মঞ্জুকে বুকের কাছে ধরে নিয়ে আসনের সামনে দাঁড়ালেন, বললেন, “এই আসনটিতে লক্ষ্মীসোনার মতো চুপটি করে বস। পূবমুখো। আমি এখনই আসছি”।

মঞ্জু অবাক হয়ে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকাল, কিছু বলল না, তার চোখের কোলে এখনও জল টলটল করছে। শুক্তিদেবী স্নেহস্বরে মৃদু ধমক দিলেন, “হাঁ করে মুখ দেখছিস কি? কথা কানে গেল না? আসনে বস, আমি এখনই আসছি।”

মঞ্জু আসনে পা দিয়ে দাঁড়াল, সসঙ্কোচে ধীরে ধীরে বসল, সলজ্জ মুখে সোফায় বসা সকলের মুখের দিকে তাকাল। সকলের মুখেই এখন হাসি, বাবা, মা, পথিক, অনীশবাবু। সকলেই সোফা ছেড়ে মেঝেয় এসে বসলেন, মঞ্জুকে ঘিরে। প্রীতমাদেবী মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন।

অনতিবিলম্বেই শুক্তিদেবী ঘরে এলেন, তাঁর হাতে সাজানো বরণডালা। পিছনে সুষমাদি পেতলের বড় থালায় এনেছে, প্রদীপ, ধূপদানি আর শাঁখ, একপাশে ধান, দুর্বা। শুক্তিদেবী মেঝেয় বসলেন, বরণডালা রাখলেন মঞ্জুর সামনে। সুষমাদির হাত থেকে পেতলের থালাটি নিয়ে, মেঝেয় এক পাশে রাখলেন। দেশলাই জ্বেলে প্রদীপ জ্বাললেন, প্রদীপের জ্বলন্ত শিখা থেকে ধরিয়ে নিলেন দুটি ধূপ। সুগন্ধে ভরে উঠতে লাগল বসার ঘরের প্রতিটি কোণ। এবার শুক্তিদেবী হাঁটুগেড়ে বসলেন, দুহাতে সাজানো বরণডালা নিয়ে, বললেন, “সুষমা, শাঁখ বাজা, প্রীতমা উলু দাও। তারপর নিজেও উলু দিতে দিতে বরণ করলেন মঞ্জুকে। আশ্চর্য ভালো লাগায় মঞ্জুর দুই চোখ আবার জলে ভরে উঠল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুক্তিদেবীর মুখের দিকে। শুক্তিদেবী মঞ্জুর চিবুক স্পর্শ করে চুমো খেলেন।

বরণডালাটি সুষমার হাতে তুলে দিয়ে, মঞ্জুর মাথায় ধান আর দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, “আশীর্বাদ করলাম, অ্যাই মেয়ে, আমাকে প্রণাম করার কথাটা বলে দিতে হবে নাকি? এবার সকলেই তোকে আশীর্বাদ করবেন, চুপটি করে বসে থাক। আমি আসছি।” শুক্তিদেবী উঠলেন, সুষমাদির সঙ্গে রান্নাঘরে গেলেন।

সকলের আশীর্বাদ পর্ব শেষ হতেই, শুক্তিদেবী বড় প্লেটে সাজিয়ে আনলেন চারটে লুচি আর বেগুনভাজা। মঞ্জুর সামনে রেখে বললেন, “শুরু কর, আরো আনছি”।

“আমি কি একা একা খাবো নাকি? সবাইকে দাও। তুমিও নাও”।

“কেউ পালাচ্ছে না, সবাই খাবে – আজকে তুই আগে...আজ তোর দিন, আমাদের মধ্যে আজ তুই অদ্বিতীয়া রানি”।

সকলের হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে মঞ্জু লজ্জা পাচ্ছিল, কিন্তু শাশুড়ি ছাড়বেন না, তাই লুচি ছিঁড়ে বেগুনভাজার টুকরো সহ মুখে পুরে বলল, “আজকে কী বলো তো? আমাকে এত আদর করছ? আমার কিন্তু ভীষণ লজ্জা লাগছে”।

মমতামাখা স্বরে শুক্তিদেবী বললেন, “আজ আমাদের বধূদ্বিতীয়া”।

মঞ্জু থমকে গেল, “সে আবার কি? এমন তো কোনদিন শুনিনি”।

অনীশবাবু বাবু হা হা করে হাসলেন, বললেন, “আমাদের মানে জামাইদের নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে চিরকাল অনেক আদিখ্যেতা হয় – বলা হয় জামাই ষষ্ঠী! কিন্তু কই, বাপ-মায়ের ঘর ছেড়ে আসা মেয়েটিকে কোন বিশেষ দিনে কোন যত্নআত্তি আমরা কোনদিন করি না তো? এটি তোমার শাশুড়িমায়ের আবিষ্কার, বৌমা, বধূদ্বিতীয়া”।

শুক্তিদেবী মঞ্জুর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিলেন। কর্তার কথা শেষ হতে সুষমাদিকে ডাকলেন, “কইরে, সুষমা দুটো লুচি আরো নিয়ে আয়। সঙ্গে মিষ্টির প্লেটটাও নিয়ে আসিস”।

মঞ্জু আঁতকে উঠল যেন, “তুমি জান মা, আমি চারটের বেশি লুচি কোনদিন খাই না”।

শুক্তিদেবী রীতিমতো ভিলেনি কায়দায় বললেন, “কিন্তু আজ তো আপনাকে ছটা লুচি খেতেই হবে মঞ্জরীদেবী। শুক্রবার চারটে লুচি আপনি খাননি, দুটো লুচি খেয়েই মাকে বলেছিলেন, ভাল্লাগছে না। সে আমার ওপরে রাগ করেই না?”

মঞ্জু এবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, বলল, “তোমরা সবাই মিলে আমার সঙ্গে চিটিং করলে না? পথিক তো বটেই, এমন কি আমার বাবা-মাকেও দলে টেনে নিয়েছিলে?”

শুক্তিদেবীও হাসলেন, বললেন, “পথিকের বাবাকে প্রথম যখন এসব কথা বলেছিলাম, ও তো এককথায় রাজি হয়ে গেল। কিন্তু আমি বললাম, মঞ্জুকে এ বাড়ি থেকে কদিনের জন্যে তাড়াই কী করে?”

মঞ্জু আঁতকে উঠে বলল, “তার মানে?”

শুক্তিদেবী বললেন, “আহা, ব্যাপারটা পুরো শোন না। জামাইরা সকলেই জামাইষষ্ঠীর দিন সেজেগুজে বউকে বগলে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যায়। তুই তো শ্বশুরবাড়িতেই আছিস। তুই বাড়ির মধ্যেই থাকবি, আর আমি বরণডালা সাজিয়ে উলু দিয়ে তোকে বরণ করব... নাঃ আমার মোটেই মনঃপূত হল না। সেটা বড্ডো ন্যাকা-ন্যাকা হয়ে যাচ্ছিল”।

মঞ্জু চার নম্বর লুচি শেষ করে পঞ্চমে হাত দিয়ে বলল, “আমাকে বললেই পারতে, আমি কদিন না হয় বাপের বাড়ি থেকে এমনিই ঘুরে আসতাম”।

শুক্তিদেবী মুখ ভেংচে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই আমার সেই মেয়েই বটে। তোকে সব কথা বললে, তুই আমাকেই উপদেশ আর জ্ঞান দিয়ে আমার পুরো স্বপ্নটাই ভেস্তে দিতিস। বলতিস, ওসব বধূদ্বিতীয়া- টিতিয়া কোন কাজের কথা নয়, ওসব বোরিং আর বোকাবোকা ব্যাপার-স্যাপার তোর একদমই পছন্দ নয়। তোকে আমি চিনি না, হুঁঃ”।

মঞ্জু খিলখিল করে হাসল, বলল, “সে কথা মন্দ বলনি। কিন্তু কাচের গেলাস ভাঙা?”

শুক্তিদেবী বিখ্যাত গোয়েন্দাদের মতো মুচকি হেসে বললেন, “ওটাই তো আমার ফাঁদ – যে ফাঁদে তুই কনুই ঠেকালি। অন্যাদিন আগেই দিই, সেদিন খাবার বাড়ার পরে জলের গ্লাসটা দিয়েছিলাম। তোরা চেয়ারে বসে খেতে শুরু করার পর। জলভরা গেলাসটা রাখলাম, টেবিলের একদম কোণায় তোর হাতের একদম কাছাকাছি। ব্যস, তুই ঠেলা মেরে গেলাসটা ভাঙলি, আর আমিও তোকে তাড়াবার জন্যে কড়া করে দুটো কথা শুনিয়ে দিলাম”।

মঞ্জু হাসল, বলল, “বাব্বাঃ, তোমার মাথায় এত দুষ্টু বুদ্ধি? বোঝা যায় না তো?”

অনীশবাবু বললেন, “তোকে তো তাড়াল বৌমা, তুই যাওয়ার পর সে কি কান্না তোর শাশুড়ি মায়ের। বললে, মেয়েটাকে খেতে দিয়ে অমন মুখ ঝামটা দিলাম? ছিছি ছিছি। তার পরের দিন তোদের বাড়ি গিয়ে সব কথা খুলে বলে কতকটা স্বস্তি হল। তাও এ কটা দিন তোর চিন্তায় যা করল শুক্তি, সে কথা...”।

শুক্তিদেবী এবার মুখ ঝামটা দিয়ে স্বামীকে বললেন, “থাক, থাক। আমার কথা নিয়ে তোমার এত ঢাক পেটানোর কী দরকার বুঝি না বাপু। সুষমা, মঞ্জুর হয়ে গেছে, এবার আমাদের খাবারগুলোও নিয়ে আয়। কদিন পরে সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া যাক”।

-০০-   

শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০২৫

দিনটা হোলি

 সকাল সকাল সদর দরজায় দুমদাম ঘা আর তার সঙ্গে একটি মেয়ের ডাকাডাকি শুনে, অন্বেষাদেবী উঠোনে নামলেন। দরজার দিকে যেতে যেতে বেশ গলা তুলেই বললেন, “ওফ্‌ কি ডাকাতে মেয়ে রে, বাবা। দরজাটাই না ভেঙে পড়ে। দাঁড়া দাঁড়া, আর দরজা বাজাস না মা, খুলছি”। তাঁর আচরণে বা কণ্ঠস্বরে কোথাও বিরক্তির লেশমাত্র নেই, বরং যথেষ্ট প্রশ্রয়ের সুরেই বললেন কথাগুলো।

দরজা খুলতেই দেখলেন, ফুটকি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে গভীর রাগরাগ ভাব, কিন্তু ঠোঁট থেকে হাসির আভাসটা পুরো মুছতে পারেনি। ফুটকি রাগত স্বরে বলল, “তুমি আমাকে ডাকাতে মেয়ে বললে, কাকিমা? এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। একদিন দেখো সত্যিই তোমাদের বাড়ি ডাকাতি করতে আসবো, হ্যাঁ। তখন টেরটি পাবে”।

“বাড়িতে ঢোক তো আগে। তুই ডাকাতি করতে এলে উলু দিয়ে শাঁখবাজিয়ে বরণডালা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো। তাতে আবার টের পাওয়ার আছেটা কী, রে পোড়ারমুখি?

“ও, শুধু ডাকাতে মেয়ে বলে হচ্ছিল না, তাই আবার পোড়ারমুখিও হয়ে গেলাম?”

“সব কথা ওভাবে ধরিস কেন? আমরা পুরোনো দিনের লোক। কথায় কথায় তোদের মতো “আই লাভ ইউ”, “আই মিস্‌ ইউ” বলতে পারিনা। ওগুলোই আমাদের স্নেহ, ভালোবাসা আর আদরের কথা। ভেতরে আয় বস। পাখাটা চালিয়ে দিই। দোল পড়তেই কেমন চিড়বিড়ে গরম পড়েছে, দেখেছিস?” 

ঘরে ঢুকেই ফুটকি পিছন থেকে অন্বেষা দেবীর গলা জড়িয়ে ধরে, আদুরে সুরে বলল, “ও কাকিমা, আজ কী খাওয়াবে গো?” 

“তুই আসবি জেনে, নারকেল কুচি দিয়ে নিরিমিষ ঘুগনি আর কিসমিস দেওয়া হালুয়ার বরফি বানিয়ে রেখেছি। ময়দা মাখা আছে – গরম গরম লুচি ভেজে দেব”। 

“বাঃ রে আমি, একা একা খাবো নাকি? কাকু কোথায়? এখনো ওঠেননি?”

“কঅঅঅঅখন উঠে পড়েছে, তোর কাকু। মর্নিং ওয়াক সেরে। চা খেয়ে এখন বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে। ওটা মুখস্থ না হলে, উঠবে না”।

“আর তোমার ছেলে?”

অন্বেষাদেবী, আড়চোখে ফুটকির মুখের দিকে তাকালেন, তারপর মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, “সে খোঁজে তোর কী দরকার? তুই আমার কাছে এসেছিস, নাকি আমার ছেলের কাছে?”

ফুটকি অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “দরকার আবার কী? সেদিন ভুবনকাকা আমাদের বাড়ি এসেছিলেন, বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বউ, ছেলেমেয়ে কেমন আছে ভুবন? গাইগরুটা ঠিকঠাক দুধ দিচ্ছে তো? হাঁসগুলো রোজ পুকুরে যায় তো? ভুবনকাকা আমাদের দেশের জমিজায়গা দেখা শোনা করেন। বাড়িতে কেউ এলে, কিংবা কোথাও গেলে ওরকম জিজ্ঞাসা করতে হয়, তাই করলাম”।

অন্বেষাদেবী এবার খুব জোরে হেসে ফেললেনহাসতে হাসতে বললেন, “বেশ চোপা করতে শিখেছিস তো? তোর সঙ্গে আমার জমবে ভালো”। একটু অবাক হয়ে, ফুটকি জিজ্ঞাসা করল, “তোমার সঙ্গে আমার কী জমবে গো?” 

“তোরা তো আবার সিরিয়াল দেখিস না। দিনরাত হোয়াটসয়্যাপ আর ফেসবুকে মুখ গুঁজে বসে থাকিস। সিরিয়াল দেখলে বুঝতে পারতিস, শাশুড়ি আর বউরা সব পাটভাঙা শাড়ি ব্লাউজ পরে, গয়নায় গা সাজিয়ে সারাক্ষণ কেমন চুলোচুলি, ঢুসঢাস করে। চোখ ঘুরিয়ে, ঘাড় নাড়িয়ে আর নাক-ঠোঁট-ভুরু কচলে তারা এমন সব ব্যায়াম করে না? ওদের কক্‌খনো ছানি পড়বে না। ঘাড় কনকন করবে না। বুড়ো বয়েসেও তাদের নাকের পাশে, ঠোঁটের পাশের চামড়ায় কোঁচ পড়বে না। তোরা  “আন্টি” হওয়ার ভয়ে যেসব অ্যান্টি-এজিং ক্রিম ঘষিস গালে, ওসব কিচ্‌ছু লাগবে না। দেখে নিস”।

অন্বেষা দেবীর কথা শুনে হাসতে হাসতে ফুটকির পেটে খিল ধরে যাওয়ার যোগাড়। হাসির দমক একটু কমলে বলল, “আহা, এত নিন্দে করছো, দেখতেও তো ছাড়ো না”।

“তুই আয়, তখন দেখবি, ঘরে এমন সিরিয়াল জমিয়ে দেব, পাড়ার লোক সিরিয়াল ছেড়ে আমাদেরই দেখতে আসবে”।

ফুটকি লাজুক হেসে বলল, “আহা, আমি বুঝি তাই বললাম? তোমার বাড়ি আসতে আমার বয়েই গেছে”।      

অন্বেষা দেবী বললেন, “আমার কাছে অত লজ্জা আর পেতে হবে না, মা। তুই বরং ওপর থেকে ঘুরে আয়, ততক্ষণ আমি লুচি ভাজার যোগাড় করি”।

এই সময়েই ওপর থেকে নেমে ঘরে ঢুকলেন, অনিমেষবাবু - ফুটকির কাকু। ঘরে পা দিয়েই বললেন, “ফুটকি মায়ের গলা পেলাম, দরজায় গুম গুম কিল মারারও আওয়াজ পেলাম। তারপরেও অনেকক্ষণ কোন সাড়া না পেয়ে নিজেই নেমে এলাম। মনে হল, যা শুনেছি, সে সবই তবে ঝুট কি? আসেনি কি আমাদের ফুটকি?” বলে হা হা করে হেসে উঠলেন, হাসলেন অন্বেষা দেবীও।

ফুটকি অপ্রস্তুত হাসি মুখে নিয়ে বলল, “আমি বরং তোমাদের ছাদটা একবার দেখে আসি। অনেকদিন তোমাদের ছাদটা দেখা হয়নি”।

অনিমেষবাবু নিরীহ মুখে বললেন, “সেই ভালো, ঘুরে আয়। আমগাছ ঝেঁপে কেমন মুকুল এসেছে, ছাদ থেকে দেখতে পাবি। আর কাঁঠাল গাছের সারা গায়ে কেমন মুচি ধরেছে, তাও। আর হ্যাঁ, ভুলেও যেন, বিল্টুর ঘরে যাস না। আমার সঙ্গেই বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল। তোর গলা শুনেই নিজের ঘরে গিয়ে ইয়াম্মোটা একখানা বই মুখে নিয়ে বসেছে। পড়ছে কিনা জানি না, তবে ডিস্টার্ব করাটা উচিৎ হবে না”। হাসি চাপতে অন্বেষা দেবী মুখে আঁচল চাপা দিলেন।

লজ্জায় রাঙা হয়ে ফুটকি বলল, “কাকু, তুমি আর কাকিমা দুজনেই না, একেবারে Zআতা”। তারপর দৌড়ে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে দোতলায়।

 

ফুটকি, ভালো নাম অভীষ্টা আর বিল্টু, ভালো নাম অনময়, ছোটবেলা থেকেই ভীষণ বন্ধু। দুই পরিবারের মধ্যেও ভীষণ ঘনিষ্ঠতা। দুই পরিবারের এই ঘনিষ্ঠতা এখন নির্দ্বিধায় বৈবাহিক সম্পর্কের দিকে এগোচ্ছে। সদ্য পিএইচডি করে, অনময় এখন একটি কলেজের লেকচারার। আর অভীষ্টা এম এ পাস করে, অন্য একটি কলেজে পার্টটাইম পড়ায়, তার সঙ্গে পিএইচডিও করছে। দুজনেই যখন কর্মক্ষেত্রে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে, অতএব উভয় পরিবারেরই এখন একটাই লক্ষ্য মুক্ত দুই ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর পায়ে শিকলি দিয়ে সংসারের দাঁড়ে বেঁধে ফেলা।

ফুটকি দোতলায় গিয়ে নিঃশব্দে বারান্দা পেরোলো, তারপর কাকু কাকিমাদের ঘর ছাড়িয়ে, পাশের ঘরে উঁকি দিল। সাদা পাজামা আর স্যাণ্ডো গেঞ্জি গায়ে বিল্টু টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে আছে। এবং অত্যন্ত মনোযোগে মোটা একটা বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। দরজার পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকল ফুটকি। নিঃসাড়ে এগিয়ে বিল্টুর পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। বিল্টু একবারের জন্যেও এতটুকু নড়াচড়া করল না, ফুটকিরও ধারণা সে অতি গোপনে এ ঘরে ঢুকেছেকিন্তু বিল্টু কী করে টের পেল কে জানে, শরৎবাবুর নভেলে যেমন থাকে, সেভাবে বলল, “এভাবে অসময়ে একলা পুরুষের ঘরে, তোর আসাটা ঠিক হয়নি, ফুটকি। সমাজ, প্রতিবেশীদের কথাটা তোর মাথায় রাখা উচিৎ ছিল। নিচে বাবা-মাও আছেন। আমাকে নিয়ে তোর নামে কলঙ্ক রটবে, সে আমার সইবে না রে”।

ফুটকি এত অবাক হল, তার সঙ্গে এত চটেও গেল, চট করে কোন উত্তর দিতে পারল না।

একটু সময় নিয়ে, মাথা নিচু করে, মেঝেয় পায়ের বুড়ো আঙুল ঘষতে ঘষতে ফুটকি বলল, “আমাকে ভুল বুঝবেন না, বিল্টুবাবু। কারণ, প্রথমতঃ এই ঘরে কোন পুরুষ আছে এ ধারণা আমার ছিল না। দ্বিতীয়তঃ, আমি এক সরলা নারী। শ্বশ্রু মাতা ও পিতার নির্দেশেই আমি আপনার ধ্যান ভাঙাতে এসেছি। আজকে বসন্তোৎসব, দোলের সকাল। আমি যে এসেছি, সেকথা অবগত হওয়া সত্ত্বেও, একখানা গাব্দা বইয়ে মুখে গুঁজে তপস্যার ঢং করার মতো বিড়ম্বনা আর কী হতে পারে?”

বিল্টুর ভেতরে হাসির ফোয়ারা উঠে আসতে চাইছিল। সেটাকে কোন মতে চেপে রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ফুটকিকে দুহাতে বুকে টেনে নিল, তারপর বলল, “এ ঘরে কোন পুরুষ নেই, না? বসন্তোৎসবে আমি বই নিয়ে ঢংয়ের তপস্যা করছি?” বলেই ফুটকির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। ফুটকি কোন আপত্তি করল না। বেশ কিছুক্ষণ তার ঠোঁটে বিল্টুর উষ্ণ ও দুষ্টু স্পর্শ উপভোগ করার পর তার মনে হল, বিল্টুকে আর পাত্তা দেওয়া ঠিক হবে না। বিল্টুর দু হাত থেকে ছাড়া পেতে ছটফট করে উঠল, বলল, “ছিঃ, সকাল সকাল এঁটো করে দিলি তো? কাকিমা ঠিক টের পেয়ে যাবেন। ওঁনার সামনে এখন কী করে যাবো?”

ফুটকির আচমকা এই অভিযোগে বিল্টু অপ্রস্তুত হল, ফুটকিকে ছেড়ে দিয়ে, জিজ্ঞাসা করল, “এ রাম তাহলে কী হবে?”

ছাড়া পেতেই ফুটকি এক দৌড়ে দরজার সামনে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো, মুখ ভেংচে বলল, “কী হ্যাব্যে? তুই একটা বুদ্ধু, আর ভিতুর ডিম...”। বলেই দৌড়ে সিঁড়ির দিকে গিয়ে, উঠে গেল ছাদে। বিল্টু ঘন ঘন ঘটনার মোচড়ে অবাক হল খুব। এমন নয় যে, সে আজই প্রথম ফুটকিকে চুমু খেল। এর আগেও খেয়েছে বহুবার। কিন্তু আজ কী সে কিছু বোকামি করে ফেলল? “অ্যাই, ফুটকি” জোরে ডাকতে গিয়েও ডাকল না, নিচেয় বাবা-মা আছেন, শুনতে পেলে, ব্যাপারটা আরও হাস্যকর হবে।

সেও দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদে গেল, দেখল, মুকুল ভরা আমগাছের সামনে আলসেতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, ফুটকি গুনগুন করে গান গাইছে। বিল্টু তার পাশে দাঁড়াতে, আড়চোখে দেখল, গান না থামিয়েই লাজুক হাসল। তারপর বিল্টুর একটা হাত নিজের দু হাতে ধরে, গালে ঠেকালো। তারপর বিল্টুর কানে কানে গাওয়ার মতো গাইল,

“দখিন হাওয়ায় কুসুমবনের বুকের কাঁপন থামে না যে।

নীল আকাশে সোনার আলোয় কচি পাতার নূপুর বাজে।

ওরে শিরীষ, ওরে শিরীষ,

মৃদু হাসির অন্তরালে গন্ধজালে শূণ্য ঘিরিস –

তোমার গন্ধ আমার কণ্ঠে আমার হৃদয় টেনে আনে।

লুচির গন্ধ নাকে এলে, আর কি আমার মন মানে”? গানের শেষে এই লাইনটা জুড়ে দিয়ে ফুটকি খিলখিলিয়ে হেসে বলল, “এবার নিচেয় চল, যা অবস্থা করেছিস, গরম লুচি ঠোঁটে ঠেকাতে পারলে হয়”।

বিল্টু একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “অমন সুন্দর গানের মুডটা এভাবে সর্বনাশ করতে হয়? রবিঠাকুরের এ গানটা কারো গলায় শুনিনি তো”। 

ফুটকি হাসতে হাসতে বলল, “এতগুলো বছর লক্ষ্মীছেলে হয়ে শুধু বই-মুখেই তো কাটালি। এসব আর শুনবি, কোত্থেকে? অনেকেই গেয়েছেন, কিন্তু আমার ভালো লাগে শ্রীরাধা বন্দোপাধ্যায়েরটি। অপূর্ব। এত অনায়াস উদাত্ত গেয়েছেন, আর এতই রাবীন্দ্রিক, বুকের ভেতরটা কেমন শিরশির করে ওঠে। আমার মতো অলক্ষ্মীর সঙ্গে ঘর কর, সব পাবি। রবিঠাকুরের গান, লুচি, নারকেল দেওয়া ঘুগনি, কিসমিস দেওয়া হালুয়ার বরফি।

        

দুপুরের খাওয়ার পর কাকিমার ঘরেই সারাক্ষণ থাকতে হল ফুটকিকে। বার দুয়েক কাকিমার তন্দ্রা এসেছে ভেবে, ফুটকি চুপিচুপি পাশের ঘরে যাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্ত বিছানা থেকে নামতেই, কাকিমা প্রথমবার গম্ভীর গলায় বললেন, “কোথায় যাওয়া হচ্ছে? এ ঘরের বাইরে বের হলে, ঠ্যাং খোঁড়া করে ফেলে রাখবো”। আর দ্বিতীয়বার বললেন, “বিছানা থেকে মেঝেয় পা দিয়ে দেখ, তোর পিঠ আমি আস্তো রাখব না”।

দ্বিতীয়বার ধরা পড়ে কাকিমার কাছে বকুনি খেয়ে, ফুটকি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “তুমি আর মা, একই তো! খালি ঠ্যাং ভাঙবো, আর পিঠ ফাটাবো। ভেবেছিলাম, বিয়ের পর একটু আরামে থাকবো, বকাঝকা করার কেউ থাকবে না। নেচে নেচে বেড়াবো। তা নয়, সেই তুমিও বকছো। তাহলে আর বিয়ে-টিয়ে করে লাভ কী?”

কাকিমা উঠে বসলেন, হাসতে হাসতে ফুটকির মাথাটা কোলে নিয়ে, ফুটকির চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন, “এমন উতলা হস না রে, মেয়ে। এখন মনে হচ্ছে কাকিমাটা খুব হিংসুটি ভিলেন, সিনেমার গল্পের মতো তোদের প্রেমে খালি ব্যাগড়া দিচ্ছে। পরে বুঝবি রে, মুখপুড়ি, কোন কিছুতেই রাশ আলগা করতে নেই। তাতে সব কিছুই চট করে সস্তা আর একঘেয়ে হয়ে যায়। অনেকটা চাওয়া, একটু পাওয়া – তাতে আগ্রহ বেড়ে ওঠে। অনেক চাওয়া আর সবটা পাওয়া মানেই তো শেষ হয়ে যাওয়া রে, খেপি। তার পরে আর থাকবে কী? সেটা বুঝতে শিখলেই জীবনে আনন্দের অভাব ঘটে না। এই যে মন্ত্রটা শিখিয়ে দিলাম, কোনদিন ভুলবি না। আজকাল চারদিকেই শুনছি, বিয়ে ভাঙার গল্প। এই বিয়ে সেই ডিভোর্স। আবার বিয়ে, আবারও ডিভোর্স। আমার মতো যেদিন বুড়ি হবি, একদিন এই দিনটার কথা ভাববি, দেখবি খুব মজা পাবি”।

ফুটকি কেঁদে ফেলেছিল, কাকিমা টের পেলেন একটু পরে। শাড়ির আঁচলে ফুটকির চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন, “কদিন পরেই তুই আমাদের ঘর আলো করবি। সে জেনেও আজ তোকে কাঁদিয়ে বড়ো আনন্দ পেলাম রে, পাগলি। দুঃখের দিনে ডুকরে কেঁদে ওঠা কিছু না। কিন্তু আনন্দের দিনে যে চুপিচুপি কাঁদতে পারে, তার চোখের কোলে, জানবি, দুঃখের দিনেও থাকে খুশির ছোঁয়া। মুখ তোল, তাকা আমার দিকে। কই? দেখি, মুখখানা। অ্যাই তো, এই না হলে তুই আমার মেয়ে? সোনা মা, আমার। পাঁচটা বাজল, চল চা করি। চা খেয়ে বিল্টু তোকে বাইকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসুক। দোলের সন্ধে, দিনকাল ভালো নয়। পথে ঘাটে নেশাখোর লোকেদের নানান উপদ্রব”।

ফুটকি কান্না ভেজা চোখ মেলে কাকিমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। বলল, “তোমাকে আর মাকে খুব ইচ্ছে করে গলায় আঁচল দিয়ে গড় হয়ে প্রণাম করতে। কিন্তু পারি না, কেন বলো তো? মনে হয় নিজের মাকে ঘট ঘট করে প্রণাম করার মধ্যে কেমন যেন একটা লোক দেখানে-পনা থাকে। শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা যদি ভেতরে থাকে, সে তো আপনিই ঝরে পড়বে মা, তোমার পায়ে। স্যরি, কাকিমা”।

অন্বেষা দেবী হাসলেন, বললেন, “স্যরি, কিসের? আর কটা দিনই তো বাকি। তারপর তো, কাকিমার, মাটুকুই থাকবে, বাকি যাবে সরে। আর মাকে প্রণাম করার কথা বলছিস? বুকের দুধ খাওয়ার সময় সব সন্তানই তার মায়ের গায়ে কতই না লাথি মারে!  তার জন্যে কোন মা কি প্রত্যাশা করেন, তাঁর সন্তান হিসেব করে, তাঁকে সব প্রণাম মিটিয়ে দেবে? তা কক্‌খনো নয় রে”।

একটু বিরতি দিয়ে আবার বললেন, “শাস্ত্রে আছে ছেলেদের দু বার করে জন্ম হয়। শাস্ত্রের নিয়ম আগে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় আর বৈশ্য ছেলেদের জন্যে ছিল। এখন শুধু ব্রাহ্মণরা সেই নিয়ম রক্ষা করে। কিন্তু আমি বলি, মানুষের সমাজে যখন থেকে বিয়ের প্রথা শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে প্রতিটি কন্যাই দ্বিজা। একজন মা কন্যার জন্ম দেন, অন্য মা সেই কন্যাকে সংসারে মাতৃরূপে প্রতিষ্ঠা দেন। উভয় পক্ষ থেকেই এর অন্যথা হলে, সে সংসারে ভাঙন ধরে, আগুন জ্বলে – কেউ শান্তি পায় না”।

এতক্ষণ অন্বেষা দেবী আবেগের মধ্যে ছিলেন, হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরল, বললেন, “এই মুখপুড়ি, কোল থেকে নাম, চল চা করি, দেরি হয়ে যাচ্ছে। সন্ধে হয়ে যাবে তোর ফিরতে। ওঠ”।

কুচো নিমকি দিয়ে চা খাওয়া হতে, অন্বেষা দেবীর তাড়াতেই ফুটকিকে বাইকে বসিয়ে বিল্টু বের হল। সোজা রাস্তায় না গিয়ে সে একটু ঘুর পথে নির্জন এক মাঠের ধারে দাঁড় করিয়ে খুব বিরক্তি নিয়ে বলল, “তোর জন্যে আমি সারাটা দুপুর অপেক্ষায় রইলাম, আর তুই এলিই না। মায়ের ঘরেই ঘুমিয়ে পড়লি? হোলির পুরো দিনটাই তুই মাটি করে দিলি, মাইরি”।

ফুটকি বিল্টুর চোখে চোখ রেখে বলল, “ঘুমোইনি তো। তোর মায়ের কাছে নতুন জন্ম নিলাম। তোর মা বললেন, দ্বিজা”।

“তার মানে?”

“সে সব তুই এখন বুঝবি না। আর দুপুরে তোর কাছে যেতে পারিনি বলে, রাগ করিস না, প্লিজ। তোকে পরে বুঝিয়ে বলবো। আর এখানেই বা আমাকে আনলি কেন? আপনজনকে বুঝি লুকিয়ে চুরিয়ে ভালোবাসতে হয়? আয় আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিবি চল। তোর মা হয়তো, আমার মাকে ফোন করবেন। আমাদের দেরি হলে, দুশ্চিন্তা করবেন দুজনেই”।

ব্যাজার মুখে বাইকে চড়ল বিল্টু, ফুটকি পিছনে বসতে, বাইক স্টার্ট করে বলল, “কী যে তোর হল, কিছুই বুঝলাম না”।

ফুটকি বিল্টুকে জড়িয়ে ধরে তার কানে কানে বলল, “আজ যে দিনটা হোলি। এইচ ও এল ওয়াই, হোলি। আজকের দিনে যেটুকু হল, তাতেই বসন্তের বাতাস খেলে গেল বুকের মধ্যে! কিছু বুঝলি, বুদ্ধু?”

 

.০০.

শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

পঋপাটি ফে৯ওর





 নৃপেনবাবু বিনোদিনী দেবী উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন দীর্ঘদিন। এই মফস্বল শহরে তাঁর ছাত্র সংখ্যা ঈর্ষণীয়। টোটো চালক থেকে ব্যাঙ্গালুরু শহরের পাঁচলাখি সফ্‌টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বিশাল বঁটিতে ঝপাঝপ ছ-সাত কিলোর কাতলা মাছ কেটে কাটাপোনা বিক্রেতা থেকে – জার্মান প্রবাসী তুলনামূলক সাহিত্যের নামকরা অধ্যাপক।

তাঁর পুত্র - ওই স্কুলেরই ছাত্র - দীপেনও কম যান না। আমেরিকার একটি বিখ্যাত ইউনিভার্সিটির কৃষি বিভাগে অধ্যাপনা করেন এবং জল ছাড়াই যে কোন জমিতে উচ্চ ফলনশীল ধানের উৎপাদনযোগ্য সংকর বীজ সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। সফল হলে পৃথিবীর চেহারাটাই পালটে যাবে। সাহারা, কালাহারি এমনকি আমাদের ঘরের থর মরুভূমিতেও দিগন্ত বিস্তৃত চোখ জুড়োনো সবুজ ধানক্ষেত দেখা যাবে। গবেষণা এখনও সফল হয়নি, কিন্তু হতে কতক্ষণ – কাল কিংবা পরশু...।

প্রতি বছর শীতকালে দীপেন সপরিবারে বাড়ি আসেন। এবারে আসতে পারেননি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সেমিনারে ইউরোপ যেতে হয়েছে। তাই দীপেনের স্ত্রী নমিতা এসেছেন তাঁর একমাত্র পুত্র নমপেনকে নিয়ে। এখানে তাঁরা মাস খানেক থাকবেন। মাসখানেক পর দীপেন এলে, আরও দিন সাতেক থেকে এক সঙ্গে উড়ে যাবেন আমেরিকায়।

নিজের পুত্র হলে কী হবে, নৃপেনবাবু দীপেনকে একদমই গ্রাহ্য করেন না। পত্নীর সামনে তিনি পুত্রকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু পুত্র-প্রসঙ্গ এলেই, তিনি মনে মনে “হতভাগা, গাধা একটা” বলে বেশ শান্তি পান। তাঁর যুক্তি সেই ধান চাষই যখন করবি, তখন অতদূরে না গিয়ে মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান কিংবা বড়জোর তাঞ্জাভুর যেতে পারতিস?

আরো একটা কারণ আছে। তাঁর নাতিটির নাম নমপেন। প্রথম বার শুনে তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর পুত্র কম্বোডিয়াতে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য দেখে বা শুনে, ওখানকার রাজধানীর নামে পুত্রের নাম নমপেন রেখেছে। ঘন্টা – মোটেই তা নয়। তাঁর বউমার নাম নমিতার – নম, আর দীপেনের পেন – দুইয়ে মিলে নমপেন। তাঁর নাতির নাম।

এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি আরও জেনেছেন, কম্বোডিয়া দেশটার নাম তাঁর পুত্র শুনেছে – কিন্তু সেটা ঠিক কোন দিকে সে জানে না। একটু ভেবেচিন্তে বলেছিল, ইউরোপের কোন দেশ মনে হয় – লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া, আর্মেনিয়া, কম্বোডিয়া...। নৃপেনবাবু কিছু বলেননি। মনে মনে দীপেনের ভূগোলের মাস্টারমশাই ভূদেববাবুর কান মলে দিয়ে বলেছিলেন, “হতভাগা, দীপেনটাকে ভূগোলে পাসমার্ক দিয়েছিলি কী করে”? প্রসঙ্গতঃ ভূদেববাবুও তাঁর ছাত্র ছিলেন।

 

কথায় আছে টাকার থেকে সুদ মিষ্টি। নৃপেনবাবুর ক্ষেত্রেও কথাটি সমান প্রযোজ্য। নিজের পুত্রটিকে তিনি গাধা মনে করলেও, পৌত্র নমপেনকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করেন। এবং বিশ্বাস করেন, বছর চোদ্দর এই প্রতিভাধর নাতিটিই তাঁর নামের পূর্ণ মর্যাদা রাখবে, এমনকি বংশের নামও উজ্জ্বল করবে।  

বাড়ি আসার পরের দিনই তাঁর বউমা একটি আবদার করলেন, বললেন, “বাবা, নমু মোটামুটি বাংলা বলতে পারে। ওখানে তো বাংলা শেখার সুযোগ খুব কম, তাই পড়তে বা লিখতে জানে না। এই এক মাসে যদি নমুকে বাংলা অক্ষর পরিচয় আর লেখাটা একটু শিখিয়ে দেন...তাহলে আমি ফিরে গিয়ে বাংলা বইটই পড়ানো চালু করে দেব”।

বৌমার কথায় নৃপেনবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, বললেন, “মোক্ষম বলেছ বউমা। মাতৃভাষা হল মায়ের দুধের মতো। সে কী আর কৌটোর দুধ কিংবা প্লাস্টিক-প্যাকেটের দুধ দিয়ে পূরণ হয় মা? মাতৃভাষা না জানলে কোন বিদ্যা বা জ্ঞানই পূর্ণ হতে পারে না...”।

নৃপেনবাবুর স্ত্রী বললেন, “এই শুরু হল লেকচার... ক্লাসের ঘন্টা না পড়া পর্যন্ত থামবে না। পাগলকে কোনদিন, সাঁকো নাড়া দিও না, বলতে আছে, বৌমা?”

নমিতা মুচকি হাসলেন, কিছু বললেন না। শ্বশুর শ্বাশুড়ির মধ্যে এই নিরন্তর খুনসুটির ব্যাপারটা নমিতা বেশ উপভোগ করেন।

 

দাদু ও নাতির যৌথ উদ্যোগে শুরু হল বাংলা-শিক্ষা অভিযান। বাংলা পড়া ও লেখা দ্রুত গতিতেই চলতে লাগল। অবশ্য একথাও মানতে হবে নমপেন বা নমু এতটুকু চঞ্চল, অমনোযোগী বা অধৈর্য হল না – সমান উৎসাহে দাদুর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে গেল।

ঠিক কুড়ি দিন পর। রবিবারের সকাল। নৃপেনবাবুর স্ত্রী ব্রেকফাস্টের টেবিলে বললেন, “শুনছো, আমি আর বৌমা একটু শপিং করতে যাবো টাউন মলে। আজ রবিবার – সন্ধের দিকে খুব ভিড় হয় – আমরা এবেলাতেই যাবো – এই এগারোটা-সাড়ে এগারোটা নাগাদ, ফিরতে ফিরতে দেড়টা দুটো হয়ে যাবে। আমাদের জন্যে অপেক্ষা করো না - তুমি আর নমু খেয়ে নিও। নীলিমাকে বলে যাচ্ছি – ও খাবার বেড়ে দেবে। কেমন?”

কথাটা শুনেই নৃপেনবাবুর মাথায় একটা আইডিয়া এল। এতদিন তিনি নমুকে পড়িয়েছেন, লিখিয়েছেন বাঁধা-ধরা ছোটদের বই থেকে। সেসব নমুর ভালই আয়ত্ত হয়ে গেছে। সে সব পড়ে সত্যি সত্যি নমু কতটা শিখেছে এবং বুঝেছে তার একটা পরীক্ষা নিলে কেমন হয়?

ছাত্রদের উপহার দেওয়া অনেক ডাইরি তাঁর ড্রয়িং কাম ডাইনিং রুমের বুকসেলফের ড্রয়ারে রাখা থাকে। ব্রেকফাস্টের পর তিনি নতুন একটা ডাইরি আর একটা পেনসিল বের করে নমুকে বললেন, “দাদুভাই, আজকে একটা নতুন খেলা খেলব”।

নমু বেশ মজা পেয়ে বলল, “বাঃ কী খেলা দাদু”?

“খেলাও বটে আবার লেখাপড়াও বটে”।

“খেলা আর লেখাপড়া একসঙ্গে?” নমু বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠল।

“হুঁ। খেলাটার নাম ধরো ডাইরি-ডাইরি খেলা। মানে এখন থেকে দুপুরের খাওয়ার সময় পর্যন্ত তুমি যা যা দেখবে, যা যা কথা বলবে, যা যা করবে এবং শুনবে, সব লিখে রাখবে তোমার ডাইরির পাতায়। বুঝতে পারলে?”

“ধরো এই তুমি আমাকে যা বললে, সে কথাও লিখবো? তারপর দিম্মা, মা, নীলিমা মাসি, আজ বাগানে মালিমামা এসেছে, যে যা বলবে, করবে, তারপর আমি যা যা করব, সব লিখবো?”

“গুড। ঠিক বুঝেছ। বাগানে গেলে গাছের নাম, ফুলের নাম, পাখির নাম, যা জানো সে সবও লিখবে...”।

“এখনই শুরু করি?”

“করো। কিন্তু এখন কাউকে দেখাবে না, এমনকি আমাকেও না। আমাকে দেখাবে সেই দুপুরে খাওয়ার আগে। ঠিক আছে?”

বিশাল ঘাড় নেড়ে নমু বলল, ঠিক আছে।

“ডাইঋ ডাইঋ খেলা

দাদুর থেকে ডাইঋ আর পেন্সিল নিলাম। এই ডাইঋতে আমি এখন থেকে যা কিছু দেখব, শুনব - সব ৯খে রাখবো। ঘর থেকে বেঋয়েই  দেখি সিঁড়ির মাথায় বেড়ালটা বসে আছে। আমাকে দেখেই পড়িমঋ করে দৌড়ে পালাল। কি মুশকিল, এখনও পর্যন্ত বেড়ালটা আমার পঋচিত হতে পারল না? আমাকে দেখলেই ভয় পায় কেন? কই অন্য কাউকে তো ভয় পায় না। কই ঠাকুমা কিংবা নী৯মামাসিকে তো ভয় পায় না? দাদুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দাদু বলেছিল, তোমার ঠাকুমা আর নী৯মা ওকে পঋপাটি করে খেতে দেয় যে – মাছ, দুধের বাটি – তাই বেড়ালটা ওদের পায়ে পায়ে ঘোরে।   

 নিচে বাগানে গেলাম। মা৯মামাকে দেখতে পেলাম না। পিছনদিকে গিয়ে দেখি মা৯মামা মাটিতে বসে কাজ করছে। জিজ্ঞাসা করলাম, “মা৯মামা কী করছো গো?”

আমাকে দেখে হেসে বলল, “এই মাটিটা একটু খুঁড়ে দিচ্ছি। গাছের গোড়া খুঁড়ে দিলে শেকড়ে হাওয়া পায়, গাছ খুব বাড়ে। আমাদের গায়ে ঝিঋঝিঋ হাওয়া লাগলে যেমন ভাঋ আরাম হয়, গাছেদেরও হয় জানো তো?”

“এটা কী গাছ গো মামা?”

“পেঁয়াজ গাছ, সবে গজাচ্ছে। আরও দিন সাতেক গেলে পুষ্ট হয়ে পেঁয়াজক৯ হবে”।

“আর ওই চারাগু৯?”

“ওগুলো গাজর – এধারে টোম্যাটো। টোম্যাটোকে অনেকে বি৯তি বেগুন বলে জানো তো! ওই দিকে লংকা। আর ওই যে ওদিকের কটা বেগুন গাছ। আর এই যে এইখানে আছে ফুলকপি আর বাঁধাকপি। ফুলকপির সবে ফুল এসেছে – দিন পনের পরে এত্তোবড়ো ফুল হবে – সে ফুলকপি দিয়ে তরকাঋ রাঁধলে যা স্বাদ হবে না – সব কিছু ভু৯য়ে দেবে”।

“আর ওদিকের লম্বা লম্বা পাতাওয়ালা গাছগুলো কি?”

“ওগুলো? ওগুলো কলাগাছ – কাঁঠা৯ কলা। সবে মোচা এসেছে, কলা হতে অনেক দেঋ”।

“মোচা থেকে কলা?”

“হ্যাঁগো মোচার বড়ো বড়ো পাপড়ির তলায় সাজানো আছে – সাঋসাঋ ক৯র গুচ্ছ। ওগুলোই বেড়ে বেড়ে হয়ে যাবে কলার কাঁদি”।

ভেতর থেকে মা ডাকলেন, “নমু, কোথায় গে৯? আমরা এবার বেরোব”।

আমি মা৯মামাকে বললাম, “মা ডাকছেন। আসি”। দৌড়ে দোতলায় গিয়ে দেখি মা আর দিদিমা বাইরে যাওয়ার জন্যে রেডি। ঠাকুমা রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নী৯মামাসিকে বলছেন, “নী৯মা, মেসোমশাইকে সাড়ে বারোটা থেকে তাগাদা দিবি চান করতে যাবার জন্যে। আর যদি চা চায় একবার দিবি – ৯কার চা। চিনি ছাড়া। একটু পরে নমুসোনার জন্যে একটা ডিমের পোচ দিবি, সামান্য নুন-গোলমঋচ দিয়ে। মেসোমশাইকে দিবি না”।

মা বললেন, “একদিন একটা ডিম খেলে কী হবে মা? বাবা ডিম খেতে ভালোবাসেন”।

ঠাকুমা বললেন, “না বৌমা তুমি জানো না, ডিম খেলেই ওঁনার পেটের ক৯ক পেনটা বেড়ে ওঠে। আর শোন দেড়টার মধ্যে খেতে দিয়ে দিবি। মেসোমশাইকে ভাত কম দিয়ে তরকাঋ বেশি দিবি। কেমন? ডাক্তার বলেছে বেশি বেশি তরকাঋ খেতে। নমুসোনা, ঠিক সময় মতো স্নান সেরে দাদুর সঙ্গে খেয়ে নেবে, কেমন? দাদু যেন বেশি দুষ্টুমি না করে, লক্ষ্য রাখবে”।

মা বললেন, “তোর হাতে ওটা কি, নমু?”

আমি বললাম, “ডাইঋ, দাদু বলেছেন ডাইঋ ৯খতে”।

মা বললেন, “৯খছিস? কই কী ৯খ৯ দেখি?”

আমি বললাম, “এখন দেখানো যাবে না, দাদু মানা করেছেন। বলেছেন কেউ যেন দেখতে না পায়। দাদু দুপুরে খাবার আগে দেখবেন”।

ঠাকুমা বললেন, “ছাড়ো বৌমা, বেঋয়ে পড়ি। তোমার বাবার যত্তো ছিটিয়া৯ কারবার, সারাজীবন মাষ্টাঋ করে মাথার মধ্যে ছিটমহল বানিয়ে ফেলেছেন। নী৯মা আমার বেরোচ্ছি...” গলা তুলে নৃপেনবাবুকে চেঁচিয়ে বললেন, “শুনছো, আমরা বেরোচ্ছি”। তারপর নমুর গাল টিপে বললেন, “তুমি তো লক্ষ্মী ছেলে, দাদুর দিকে একটু নজরদাঋ করো, কেমন? দাদু যেন দুষ্টুমি না করতে পারে। আমরা বেরোলে দরজাটা বন্ধ করে ওপরেই থেকো”।

মা-ঠাকুমা বেঋয়ে যেতে আমি আবার বাগানে গেলাম। মা৯মামা দেখলাম ফুলের বাগানে কাজ করছেন। কী সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটেছে – এতো বড়ো বড়ো – তেমনি সুন্দর রঙ। মা৯মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এগুলো কী ফুল মামা?”

“ডা৯য়া। রোদ্দুর পড়ে ফুলগুলো যেন খিলখি৯য়ে হাসছে, তাই না, ছোটবাবু? আর ওই দিকে দেখ চন্দ্রমল৯কা। কতরকমের রঙ, দেখছো? ওই দিকের গুলো সূর্যমুখী আর এই যে এগুলো ক্যালেনডুলা। তারপাশেই দেখ এই যে এগু৯ গাঁদাফুল। রকমাঋ রঙের ফুল শীতকালেই হয়। গরমকালের ফুলে তেমন রঙ হয় না, অধিকাংশই সাদা – বে৯, শিউ৯, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, টগর, মালতী, কামিনী। একটু একটু রঙ থাকে কাঁঠা৯ চাঁপায়, মাধবীলতায়। অবিশ্যি গরমের অধিকাংশ ফুলেই ভাঋ মিষ্টি গন্ধ হয় – শীতকালের ফুলে আবার তেমন গন্ধ হয় না”।

মা৯মামার সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে বললাম – “এই বড়ো গাছগুলো কী গাছ, মামা”।

“ওই গাছটা আম গাছ, আম্রপা৯ – ছোট ছোট আম পাকলে মিছঋর মতো মিষ্টি। এটা জামরুল। আর ওইটা হল ৯চু। গরমকালে ৯চু পেকে লাল টুকটুকে হয়ে ওঠে – ওঃ সবুজপাতার মধ্যে থোকাথোকা পাকা লাল ৯চুগুলো হাওয়ায় যখন দোলে - সে ভাঋ চমৎকার দেখতে লাগে। গরমকালে একবার চলে এসো না, ছোটবাবু। দাদুর বাগানের আম্রপা৯ আর ৯চু খেলে, আমেঋকা ফিরতে তোমার ইচ্ছেই হবে না...”।

মা৯মামার কাজ হয়ে গেল। বাগানের নানান যন্ত্রপাতি ধুয়ে মুছে পঋপাটি করে গুছিয়ে রাখলেন, গ্যারেজের এক কোনে। বললেন, “এখন তবে আসি, ছোটবাবু। আমি আবার বেষ্পতিবার আসবো, তুমি থাকবে তো?”

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ থাকব, বাবা আসবেন মাসের শেষ দিকে – তারপর আমাদের আমেঋকা ফিরতে হবে...”। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল – এমন সুন্দর দেশ আমাদের – এসব ছেড়ে আমরা কেন আমেঋকায় থাকি – সেটা তো আমাদের দেশ নয়...। মা৯মামা চলে গেলেন, আমি দরজা বন্ধ করে দোতলার সিঁড়িতে পা দিতেই নী৯মামাসির ডাক শুনলাম – “নমুবাবা, ওপরে এসো...”। বুঝলাম আমার পোচ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।

সিঁড়ির মাথায় নী৯মামাসির সঙ্গে দেখা হল, তাঁর এক হাতে ডিমের পোচ আর অন্য হাতে ৯কার চা। বললেন, “দাদুর ঘরে চলো। ওখানে বসে দাদুর সঙ্গে গল্প করতে করতে খাবে”।

দাদুর ঘরে ঢুকে দেখি দাদু খাটে মশাঋর ভেতরে ঢুকে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। আমি অবাক হয়ে দাদুকে জিজ্ঞাসা করলাম, “দাদু তুমি দিনের বেলা মশাঋর মধ্যে ঢুকে বসে আছো কেন?” দাদু মশাঋর থেকে বেড়িয়ে এসে সোফায় বসতে বসতে বললেন, “এস, বসো, দাদুভাই। দিন হোক বা রাত, মশাদের আমি মোটেই বিশ্বাস কঋ না। কখন যে হুল ফোটাবে...ঠিক তোমার দিদিমার মতো”।

টেবিলে চায়ের কাপ রেখে নী৯মামাসি দাদুর কথায় মুখ টিপে হেসে বললেন, “মেসোমশাই, আপনার চা। চা খেয়েই আপনি কিন্তু চান করে নেবেন। গিজার চালু করে দিয়েছি”। তারপর আমার হাতে প্লেট আর চামচ ধঋয়ে দিয়ে বললেন, “তুমিও পোচ খেয়েই চান করতে যাবে। তোমাদের বাথরুমেও গিজার চালু করে দিয়েছি”।

নী৯মামাসি চলে যেতে দাদু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “তোমার পোচে নুন-গোলমঋচ দিয়েছে তো, দাদুভাই? গোলমঋচের গুঁড়ো ছাড়া পোচের স্বাদ জমে না। আমারও পোচ খুব প্রিয়, খুব খেতাম – কিন্তু তোমার ঠাকুমা ডাক্তারদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে...আমার ডিম খাওয়াটাই নাকচ করে দিয়েছে। কী ঝকমাঋ বলো তো, দাদুভাই!”

   দাদুর সামনে বসে তাঋয়ে তাঋয়ে পোচ খেতে খুব খারাপই লাগছিল। কিন্তু দাদুর বয়স হয়েছে – ডিম-টিম না খাওয়াই ভালো।

চা শেষ করে দাদু বললেন, “কই কী ৯খলে, কেমন ৯খলে দেখি। এই পরীক্ষায় তুমি পাশ করলে, আমারও পাশ করা হবে। বুঝবো আমি এতদিনেও মাষ্টাঋ করা ভু৯নি”।

আমি ডাইঋ লেখা এখানেই শেষ করলাম। লেখাপড়া করতেও যে এমন মজা হয় – এর আগে বুঝতেই পাঋনি”।

-  -  -

 

নমু পোচ শেষ করে ডাইরিটা দাদুর হাতে দিয়ে বলল, “তুমি দেখ দাদু, আমি ততক্ষণ স্নানটা সেরে আসি”।

নৃপেনবাবু ডাইরি খুলতে খুলতে বললেন, “বেশ বেশ। সেই ভালো। আমি তোমার লেখাটা পড়ে ফেলি”।

ডাইরি পড়তে পড়তে নৃপেনবাবু বেশ কয়েকবার জিভে বিরক্তিসূচক আওয়াজ করলেন। বিড়বিড় করে বললেন, “দোষ তো দাদুভাইয়ের নয় – আমার। আমি পুরোপুরি ফেল করে গেলাম। দাদুভাইকে বলাই হয়নি – বাংলা ভাষায় ৯ বর্ণের কোন ব্যবহারই আর নেই। এও বলা হয়নি – ঋ বিশেষ কিছু তৎসম – অর্থাৎ সংস্কৃত - যেমন ঋতু, ঋষি, ঋত, ঋজু, ঋত্বিক, এই রকম সীমিত কিছু শব্দ ছাড়া আর কোথাও ব্যবহার হয় না। এটা যদি বলে দিতাম দাদুভাইয়ের লেখায় তো কোন খুঁত ছিল না! একশো তো একশ। কিন্তু আমি? ছিঃ – ফেল হয়তো করিনি। কিন্তু বত্রিশের বেশি – অর্থাৎ বড়ো জোর টায়েটায়ে পাশ করেছি বলা চলে।

কিন্তু ওর ঠাকুমা এসব কী বলেছে আমার সম্পর্কে? – তাও বৌমা, নীলিমা, নাতির সামনে? আমি ছিটিয়াল? মাষ্টারি করে করে আমার মাথায় ছিট-মহল গজিয়েছে? তার ওপর আমি দুষ্টুমি করলে, আমাকে সামলাবে আমাদের নাতি? ছি ছি। ছেচল্লিশ বছর একসঙ্গে ঘর করে, নিজের স্বামী সম্পর্কে এই রকম মন্তব্য? মহিলার মাথার ঠিক আছে তো?

তার পরেই ভাবলেন, কিন্তু তিনিই বা কম কিসে? নাতির সামনে ঠাকুমাকে মশার সঙ্গে তুলনা করলেন? ওর ঠাকুমা তাঁকে মশার মতো হুল ফোটান? ছি ছি। তিনিও তো বজ্জাতিতে তাঁর স্ত্রীর থেকে এক চুলও কম যান না!

ডাইরিটা হাতে নিয়ে নৃপেনবাবু অনেকক্ষণ বসে রইলেন। জানালা দিয়ে দূর আকাশে একটা চিলকে ভেসে বেড়াতে দেখলেন বহুক্ষণ। তারপর মৃদু হেসে সিদ্ধান্ত করলেন, দীর্ঘ দাম্পত্যের এটাই মজা। পরষ্পরের পিছনে লাগাতেই সম্পর্কটা সুন্দর টিকে থাকে – একদম গলাগ৯ – পঋপাটি সম্পর্ক।   

 ----০০০০----

নতুন পোস্টগুলি

জঙ্গী ব্যবসা

  ১   ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ