১
এ তল্লাটে প্রমথ শিকদারের নামে বাঘে-গরুতে একঘাটে বসে গল্পগুজব করে, জল খায়। গোলগাল কালোকোলো চেহারায় ঘাড় নেই, কোমর নেই। আছে মস্ত বড়ো একটি পেট। গলায় শেকলের মতো মোটা সোনার চেন দুলিয়ে, ধপধপে সাদা পাঞ্জাবিতে পেটটি মুড়ে, পিছনে চার পাঁচজন শাগরেদ নিয়ে যখন পথে হাঁটেন, সে ভারি ভারিক্কি আর রাশভারি ব্যাপার হয়ে ওঠে। রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলোও মাঝরাস্তা ছেড়ে নর্দমার ধারে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। একটুও ঘেউ ঘেউ করে না।
তাঁর দুহাতের দশ আঙুলে চোদ্দটি আংটি। চোদ্দ ভাগ দুই ইকোয়ালস টু সাত
রকমের ব্যবসা, প্রমথবাবু বলেন বিজিনেস। কয়লার ব্যবসা, ট্রান্সপোর্টের
ব্যবসা, সতেরখানা মিনিবাস চলে মেনরুটে। আলু আর পেঁয়াজ বোঝাই
চারখানা হিমঘর। আজকাল তেমন না চলা দুটো সিনেমা হল। আর বিশাল জমিতে হাত পা ছড়ানো
রাইস মিল। আর সর্বশেষ সাতনম্বরটা হল বাড়ি বানানোর প্রমোটারি। ইদানীং এই প্রমোটারি
করতে গিয়েই তাঁকে কিছুটা মুশকিলে পড়তে হয়েছে বলে তিনি বেশ মনমরা। মুশকিল আসানের
জন্যে জ্যোতিষীর কাছে আরেকটি রত্নের বিধান নেবেন, নাকি
তারাপীঠ খ্যাত কোন তান্ত্রিকের শরণাপন্ন হবেন, এই দ্বিধায়
তিনি চিন্তাকুল।
২
মৃদুলবাবু নামেও মৃদু, কাজে কর্মেও মৃদু। আজকের দিনে এমন নির্বিবাদি সাতে
পাঁচে না থাকা ভদ্র মানুষ প্রায় বিরল বললেই চলে। রোগা পাতলা একহারা চেহারার
মানুষটি প্রফুল্লনগরে পঁয়তিরিশ বছরের উপর রয়েছেন চাকরি সূত্রে। দীর্ঘদিন এই জায়গায়
থাকার ফলে তাঁর ও তাঁর পরিবারের জায়গাটি খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছে। ছুটিছাটাতে
মেদিনীপুরের এগরা মহকুমায় তাঁদের আদি নিবাসে যান ঠিকই কিন্তু মন টেঁকে না। দিন
চারেক থাকার পরেই প্রফুল্লনগর ফেরার জন্যে তাঁদের মন আঁটুবাঁটু করে।
প্রফুল্লনগর সরকারি শিল্পনগরী, সেখানে চাকরি থেকে অবসরের পর আর থাকার
উপায় নেই। তাছাড়া প্রফুল্লনগরকে মৃদুলবাবু যে একাই ভালোবাসেন, তাতো নয়, আরো অনেকেই এমন আছেন। তাঁরা সকলেই
মৃদুলবাবুর সহকর্মী। বছর দশেক আগে অনেকে মিলে প্রফুল্লনগরের পাশেই বিশাল জমি
কিনেছিলেন একসঙ্গে, তারপর নিজের নিজের দরকার এবং সাধ্যমতো
ভাগ করে নিয়েছিলেন। মৃদুলবাবু নিয়েছিলেন কাঠা পাঁচেকের জমি। তাঁর স্ত্রীর বহুদিনের
স্বপ্ন ছিল ছোট্ট একটা বাড়ি, সামনে ফুলের গাছ, পিছনে সব্জিবাগান আর দু চারটে ফলফুলুরির গাছ। দামে একটু কমে পেয়েছিলেন এবং
নিরিবিলিতে থাকবেন বলে মৃদুলবাবু জমিটা নিয়েছিলেন একদম এক শেষ প্রান্তে। প্রায়
পঁয়ত্রিশজন সহকর্মী মিলে শখ করে গড়ে তোলা এই জায়গাটার নাম দিয়েছিলেন
জয়ন্তনগর।
চাকরি থেকে অবসর নিয়ে মৃদুলবাবু নতুনবাড়িতে উঠে এসেছেন এই বছর দুয়েক
হল। মনোমত গাছপালা লাগিয়ে আর সকাল বিকেল তাদের সেবাশুশ্রূষা করে নিশ্চিন্ত আরামে
অবসর জীবন কাটাচ্ছেন তিনি আর তাঁর স্ত্রী। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে ব্যাঙ্গালুরুতে
থাকে, আর একমাত্র ছেলে কলকাতার হস্টেলে থেকে ডাক্তারি পড়ে। কাজেই বাড়িতে থাকার
লোক মৃদুলবাবু আর তাঁর স্ত্রী।
৩
ছোটখাটো জমিতে প্রোমোটারি করে হাত পাকানো প্রমথবাবুর এইবার চোখে পড়ল
জয়ন্তনগরের পিছনের জমিটা। বিশাল জমিটা জলের দরে একসঙ্গে নিয়ে নিলে হাউসিং
কমপ্লেক্স করতে কোন বাধা নেই। কুয়ো সাইজের সুইমিং পুল, রুমাল সাইজের
সবুজ বাগান, আর একটা হনুমান মার্কা দোলনা, একটা জিরাফমার্কা স্লিপ খাটানো চিলড্রেন্স্ পার্কের লোভ দেখিয়ে শ দেড়েক
ফ্ল্যাট অনায়াসে বেচে দেওয়া সম্ভব। প্রমথবাবুর এক শাগরেদ আরো বুদ্ধি দিল
বড়োরাস্তার ধারে একটা শপিং মল খুলতে পারলে, ফ্ল্যাটের দাম
বেড়ে যাবে দুগুণ।
শাগরেদের প্রস্তাবটা খুব মনে ধরে গিয়ে প্রমথবাবুর মুশকিল শুরু হল।
জয়ন্তনগরের পিছনের যে বিশাল জমিটা প্রমথবাবু হস্তগত করেছেন, রাস্তার দিকে তার
মুখটা বেশ ছোট, শপিংমল করার মতো যথেষ্ট নয়। শপিংমল করার মতো
জায়গা হতে পারে মৃদুলবাবুর জমি ও তাঁর পিছনের দুটো জমি হাতাতে পারলে। পিছনের জমি
দুটো এখনো খালি পড়ে আছে, কাজেই ওদুটোকে বেশি দাম ফেললেই
পাওয়া যাবে, কিন্তু মৃদুলবাবুর শখের বাড়িটা?
৪
রোববার সাতসকালে নয়নতারার ঝাড়ে নিচু হয়ে জল ঢালতে ঢালতে মৃদুলবাবু
দেখলেন, তাঁর বাড়ির সদরে প্রমথবাবু আর তাঁর পিছনে চার পাঁচজন হাট্টাকাট্টা শাগরেদ
দাঁড়িয়ে আছে।
জোড়হাত করে দুগাল ফোলানো হাসিমুখে প্রমথবাবু বললেন, “বাঃ, ফাসকেলাস বাগান বানিয়েচেন, মৃদুলবাবু? খুব সোন্দর”। প্রমথবাবুর মতো ডাকসাইটে লোকের
মুখে নিজের নাম শুনে মৃদুলবাবু আরো ঘাবড়ে গেলেন। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, তাঁর হাতের
ঝাঁঝরি থেকে ঝরে পড়তে থাকা জলে হাবুডুবু খেতে লাগল নয়নতারার চারাগুলো। মৃদুলবাবুর
অবস্থা বুঝতে প্রমথবাবুর অসুবিধে হল না।
গ্রিলের গেটের ছিটকিনি খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “আপনি কিছু বলছেন
না, তাই নিজেই ঢুকে পড়লাম, ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ”। বিশাল পেট দুলিয়ে হাসলেন
প্রমথবাবু। এতক্ষণে যেন মৃদুলবাবু ধাতস্থ হলেন।
নয়নতারার চারাগুলোর ওপরেই ঝাঁঝরি ফেলে দিয়ে হাত জোড় করে এগিয়ে গেলেন
প্রমথবাবুর দিকে, বললেন, “আপনার মতো মানুষ আমাদের মতো সামান্য লোকের
ঘরে, খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, স্যার। আসুন,
আসুন। সামনে কি ইলেকশন নাকি, কই শুনিনি তো!
বিধানসভা না লোকসভা”?
“ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ, আমাকে কি দেখে নেতা মনে হচ্ছে? তা অবিশ্যি মন্দ বলেন নি। না, মৃদুলবাবু সে সব নয়,
অনেক খেটেখুটে সামান্য কিছু জমিয়েছি, আপনাদের
সকলের শুভ ইচ্ছায়। কাজের চাপে পাড়াপড়শীদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়ে ওঠে না, তাই এলাম একবার এদিকে। তা, বেশ বানিয়েছেন বাড়িটা।
আমার খুব মনে লেগেছে”।
“ওই আর কি”? হেঁ হেঁ হেঁ, বিগলিত
হেসে মৃদুলবাবু বললেন, “গরীবের স্বপ্নটুকুই তো সম্বল”।
“তবে যাই বলুন, আজকাল বাড়ি করে বুড়ো বয়সে একা একা
থাকা খুব মুশকিল। দেখুন না, এত বড়ো বাড়ি, সামনে পেছনে গাছপালা। রাতবিরেতে বিপদ আপদ হলে কাকপক্ষিরও সাড়া পাবেন
ভেবেছেন? এর চেয়ে ফ্ল্যাট কিন্তু খুব ভালো। সারাক্ষণ
সিকিউরিটি। দেড়শ ফ্ল্যাটের লোকজন। ভাবতে পারছেন? বিপদে আপদে একবার
হাঁক দিলে ঘরে পা ফেলার জায়গা পাবেন না, ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ ।
তারপরে ধরুন সকালে বিকেলে সাঁতার, শরীরটাকে তো রাখতে হবে!
ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ। বিকেলের দিকে নাতি নাতনীদের হাত ধরে চিলড্রেন্স্ পার্ক। এগুলোও কি
কম স্বপ্ন? ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ”।
প্রমথবাবুর দুলতে থাকা অদ্ভূত পেটের দিকে তাকিয়ে রইলেন, মৃদুলবাবু।
শুধুমাত্র ফ্ল্যাটের উপকারিতা বোঝানোর জন্যে প্রমথবাবুর মতো লোক সাত সকালে তাঁর
বাড়ি বয়ে এসেছেন, এটা অসম্ভব। মৃদুলবাবু কিছু বললেন না,
অপেক্ষা করতে লাগলেন প্রমথবাবুর পরের কথার জন্যে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রমথবাবু আবার বললেন, “চোদ্দ আনা নয়,
একদম পড়ে পাওয়া ষোলো আনা, মৃদুলবাবু। আপনাকে
একটা ফ্ল্যাট আমি দিতে চাই, একদম ফ্রি”!
“ফ্রি? তার মানে? কেন”?
“একদম ফ্রি। তার সঙ্গে নগদ টাকা – তা ধরুন তিন লাখ,
না না তিন নয়, তিনে শত্রু হয়, ধরুন চার। একটু থেমে বড়ো মার্বেলের গুলির মতো গোলগোল চোখ করে বললেন –
কি? অফারটা কেমন? চৈত্র
সেলকেও হার মানাবে, মোশাই। ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ”।
কিছুই বুঝতে না পেরে, অবাক চোখে প্রমথবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন
মৃদুলবাবু, কিছু বললেন না।
“আপনার এই বাড়িটা আমার খুব পছন্দ। ওই চার লাখ টাকাটা আপনার এই বাড়ি আর
জমিটুকুনির জন্যে, আর ফ্ল্যাটটা পুরোপুরি ফ্রি। কি এবার কেমন
মনে হচ্ছে অফারটা? বাম্পার না? ঘুঁ ঘুঁ
ঘুঁ”।
এতক্ষণে মৃদুলবাবু বুঝতে পারলেন প্রমথবাবুর আসল উদ্দেশ্যটা।
উত্তেজিত ভাবে বললেন, “কিন্তু এ বাড়িতো আমি বেচব না, প্রমথবাবু। আমরা থাকব বলে এই বাড়ি বানিয়েছি, বেচে
ফ্ল্যাটে যাবার জন্যে তো নয়”।
এতক্ষণের হাসিমাখা মুখ তাও সহ্য হচ্ছিল, এখন প্রমথবাবুর উৎকট গম্ভীরমুখের
দিকে তাকিয়ে, মৃদুলবাবুর গা জ্বলে গেল। প্রমথবাবু গম্ভীর
মুখে বললেন, “কটা দিন একটু ভেবে দেখতে ক্ষতি কি, মৃদুলবাবু। ঝোঁকের মাথায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনেক সময়েই ভুল হয়ে যায়। তাছাড়া,
আমার সিদ্ধান্তটাও তো একেবারে ফেলে দেবার নয়। আমার এই জায়গাটা যে না
হলেই নয়”।
“কটা দিন কেন, প্রমথবাবু, সারা
জীবন ধরে ভাবলেও আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না”, মৃদুলবাবু খুব
দৃঢ়স্বরে বললেন।
“বেশ কথা। কিন্তু জীবনের আর কি ভরসা বলুন দেখি। আজ আছে, কাল হয়তো নেই। বিজিনেস করি বলে, ভাববেন না যেন,
সাহিত্য টাহিত্য বুঝি না। ওই যে বলে না, পদ্ম
পাতায় জল, করে টলোমল, ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ। সে
যাক, তাহলে আজ এখন আসি মৃদুলবাবু, আপনার
সঙ্গে আলাপ হয়ে খুবই আনন্দ পেলাম। তবে অফারটা কিন্তু মনে রাখবেন – বাম্পার অফার, ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ । আরেকবার ভেবে দেখবেন,
ভাবতে তো আর ট্যাক্সো লাগে না। ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ”।
৫
মৃদুলবাবুর মতো নির্বিবাদী লোককে তুলে, তাঁর জমিটা হাতিয়ে নেওয়াটা
প্রমথবাবুর কাছে মশা মারার সামিল। সেখানে মুশকিল হত না, মুশকিলটা
হলো অন্য জায়গায়।
রোববার দিন মৃদুলবাবুর বাড়ি থেকে ফিরে প্রমথবাবু তাঁর শাগরেদদের সঙ্গে
বসে ঠিক করলেন, বুধবার থেকে শুরু করে দেবেন ফ্ল্যাট বানানোর কাজ। বুধবার শুভ দিন, খনার বচনে আছে, মঙ্গলের ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছে তথা যা। বুধবার দিন জনা পঞ্চাশেক শ্রমিক
গিয়েছিল কাজ শুরু করতে। গাছপালা, ঝোপ ঝাড় কেটে, জমিটাকে মাপ জোক
করার মতো সাফ করার জন্যে। নকশায় দেখানো ফ্ল্যাটবাড়ি, সুইমিং
পুল, চিল্ড্রেন্স্ পার্ক, রাস্তা,
কোথায় কোনটা হবে সেটাকে জমিতে হিসেব মতো ঠিক ঠাক বসাতে হবে তো?
মিনিট পনের হয়েছে কি, হয় নি, ঝোপঝাড়ে শ্রমিকরা সবে
কাস্তে, দায়ের কোপ মারতে শুরু করেছে, হঠাৎ
চারদিক থেকে শুরু হয়ে গেল পাথর বৃষ্টি। পাথর শুধু নয়, ইঁটের
টুকরো, আধলাও। পঞ্চাশজন লোক নেহাত কম নয়, চ্যাংড়া ছোঁড়াদের কীর্তি ভেবে তারা চারদিকে দৌড়োদৌড়ি করেও কাউকে দেখতে
পাচ্ছিল না। কিন্তু ঢিলের বৃষ্টি একবারের জন্যেও ঢিলে হল না। অন্ততঃ জনা দশেকের
মাথায় আলু, নাকে আলু, কপালে আলু। ছোট
খাটো চোট তো সবাই পেয়েছে। আধঘন্টা চেষ্টা করেও যখন কাউকেই দেখা গেল না, বেচারা লোকগুলো ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল কাজ ছেড়ে। যাবার আগে হাল্লা লাগিয়ে দিল,
ওই জমিতে নির্ঘাৎ ভূত আছে।
৬
প্রমথবাবু ছিলেন না, হিমঘরে আলু দেখতে গিয়েছিলেন। লালচে রঙের হাজার হাজার
বস্তায় ভরা আলু দেখলে তাঁর বড়ো আনন্দ হয়। শীতের শেষে চাষির ঘর থেকে তিনটাকা কিলো
দরে আলু তোলেন, প্রথমদিকে দশটাকায় ছাড়েন, পরের দিকে কুড়ি বাইশেও দর তুলে দেন। ডাক্তারের পরামর্শে তাঁর আলু খাওয়া
বারণ, কিন্তু আলু থেকে সারাবছরে তাঁর যা আয় হয় তাতে তাঁর
মার্বেলের গুলির মতো চোখও স্বপ্নালু হয়ে ওঠে।
শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী স্বর্ণপদক প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তান্ত্রিক। এই সোনার পদক তাকে কে দিয়েছিল কেউ জানে না। সপ্তাহের ছদিন দক্ষিণবঙ্গের ছটি প্রান্তে এঁনার জমজমাট চেম্বার। নৈহাটি, ঘুঁটিয়ারি শরীফ, প্রফুল্লনগর, চাকদহ, শেওড়াফুলি আর লক্ষ্মীকান্তপুর, সোম থেকে শণি এই তাঁর চেম্বারের রুটিন। আজ বুধবার, তাঁর চেম্বার প্রফুল্লনগরে। আধঘন্টার মধ্যে তাঁকে বাইকে করে তুলে নিয়ে এল প্রমথবাবুর জনৈক শাগরেদ।
৭
বাড়ির ভেতর থেকে শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রীর বানানো প্রমথবাবুর
জন্মকোষ্ঠি আনানোই ছিল। শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী প্রমথবাবুকে প্রণাম করে সামনে
বসতেই, প্রমথবাবু তার দিকে ছুঁড়ে দিলেন কোষ্ঠিটা।
বললেন, “সময়টা ভালো যাচ্ছে না হে, কাত্তিকচন্দোর, কুষ্ঠিটা একবার দেখে দাও তো”। শ্রীশ্রী কাত্যায়নের আদি
নাম ছিল কার্তিক চন্দ্র হাতি। প্রমথবাবু দীর্ঘ পরিচয় সূত্রে এসব তথ্য জানেন। মিনিট
পাঁচেক খুব মন দিয়ে কোষ্ঠির দিকে তাকিয়ে থেকে শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী খুব
গম্ভীর চিন্তামগ্ন মুখে বলল, “জমি সংক্রান্ত ঝামেলা মনে হচ্ছে, দাদা”। প্রমথবাবু মুগ্ধচোখে তাকিয়ে রইলেন, শ্রীশ্রী
কাত্যায়ন শাস্ত্রীর দিকে। কোষ্ঠি থেকে মুখ না তুলে সে আরো বলল, “আপনারা তো ভূত প্রেতে বিশ্বাস করেন না দাদা, আমার
কিন্তু মনে হচ্ছে আপনার ওপর অপদেবতার বক্র দৃষ্টি পড়েছে”।
প্রমথবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “মোক্ষম বলেছ, ভায়া।
আমরা বিশ্বাস করি বা না করি, যা আছে সে তো আছেই। এখন এর থেকে
মুক্তির উপায় কি তাই বলো”।
কোষ্ঠি ছেড়ে এবার শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী তার রেক্সিনের ব্যাগ খুলে
বহুদিনের পুরোনো একটা পুঁথি বের করল। এমন জিনিষ উপস্থিত কেউই দেখে নি কোনদিন। তারা
হুমড়ি খেয়ে পড়তে যাচ্ছিল শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রীর ঘাড়ে। প্রমথবাবু মেঘের মতো
স্বরে বললেন, “অ্যাই, ওকে ডিস্টার্ব করিস না, এসব মোটেই ছেলে খেলার জিনিষ নয়।
খুব চিন্তান্বিত মুখে শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী বলল, “একটা স্বস্ত্যয়ন
করা দরকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পারলে সামনের শনিবার। আপনার
জানাশোনা ভালো তন্ত্রসাধক কেউ আছে নাকি, দাদা”?
“তুমি থাকতে আমি কারো কাছে যাবো না, কাত্তিক।
স্বস্ত্যয়ন করলে তুমিই করবে”।
“কিন্তু আপনি তো জানেনই, দাদা, শনিবারে
আমার লক্ষ্মীকান্তপুরে কথা দেওয়া আছে”।
“রাখো তোমার কথা। যা করার তুমিই করবে। এর আর নড়চড় চলবে না”।
“আপনি বললে তো না করতে পারিনা, দাদা, এই হচ্ছে মুশকিল। তবে ক্ষতি হয়ে যাবে বড্ড”।
“কত ক্ষতি হবে? বলি আমিও তো তোমাকে তোমার দক্ষিণা দেব নাকি? বাদবাকি যা খরচা হবে সেও দেব”।
“তা ধরুন, স্বস্ত্যয়নের যোগাড়েই হাজার সাতেক যাবে,
আর আমার দক্ষিণা যা আপনার ভালো মনে হয়”।
প্রমথবাবু কোন ঝুঁকির মধ্যে যেতে চান না, তিনি বললেন, “সব মিলিয়ে তোমায় দশহাজার এক দোবো। তুমি আর মনে কোন দ্বিধা রেখো না, কাত্তিক। শনিবারের ব্যাপারটা পাক্কা করে নাও। আর এই নাও আজকের পাঁচশো”। পকেট থেকে পাঁচশো টাকার
নোট বের করে কাত্তিকের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
কাত্তিক নোটটা হাতে নিয়ে কপালে ঠেকালো, তারপর নিজের পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে
বলল, “আজকেরটা দরকার ছিল না, দাদা,
আমি কি আপনার পর? তবে আপনার আশীর্বাদ যখন নিতে
তো হবেই”।
“তুমি যে আমায় কি চিন্তা মুক্ত করলে, কাত্তিক,
তুমি বুঝবে না”।
“আজ্ঞে, সে কথাতো একশবার। আপনারা হচ্ছেন কৃতী পুরুষ।
তবে ওই কথাই রইল দাদা, সামনের শনিবার মধ্যরাতে, আমি সব যোগাড় করে ঠিক সময় মতো চলে আসব”।
৮
ইন্দিরাদিদি রাত নটা পর্যন্ত পড়িয়ে কালকের হোমটাস্ক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার
পর রুনু আর ঝুনুও বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এই সময়টা মাও পড়ার জন্যে খুব কিছু
বলেন না। কারণ ইন্দিরাদিদি এমন কড়া, তিনঘন্টার মধ্যে এতটুকুও ফাঁকি দেবার উপায়
রাখে না। গতবারের চেয়ে এবারের রেজাল্টটা অনেক ভালো হওয়ায় বাড়ি থেকে চাপটা কিছুটা
হলেও কমেছে।
বাইরে বেরিয়ে রুনুঝুনু পেয়ারা গাছের ছায়ায় বসে থাকা ঝাপসা রুকু-সুকুকে
দেখতে পেল।
রুনু জিগ্গেস করল, “কি রে, আর কিছু নতুন খবর পেলি”?
“ওঃ, তোমাদের এই পড়ার চাপটা তোমরা কি করে সহ্য করো,
ভেবে পাই না। ভয় লাগে না? এখন বুঝছি, কেন তোমরা আমাদেরকে ভূত জেনেও ভয় পাওনি। লেখাপড়া
ব্যাপারটাই এমন ভয়ংকর, তার পরে আর কোন কিছুতেই ভয় লাগে না”।
“বাজে বকিস না তো। সকালের পর আর কিছু হয়নি তো”?
“হয়নি আবার? প্রথমবাবুর বাড়িতে বিকেলে জোর মিটিং
হয়েছে”।
“প্রথম নয়, প্রমথ”।
“জানি, প্রমথ মানেও কিনা ভূত
তাই মানুষের ওই নাম আমরা উচ্চারণ করতে চাই না”।
“আচ্ছা বেশ, কিসের মিটিং বল”।
“কিসের আবার ভূত তাড়ানোর মিটিং”।
“মানে”? রুনু-ঝুনু একসঙ্গে চমকে উঠল।
“হুঁ। বাসস্ট্যান্ডের গায়ে ছোট্ট গুমটিতে শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী বসে,
চেন”?
“না। কেন? কী করেছে সে”?
“মস্ত তান্ত্রিক, শনিবার স্বস্ত্যয়ন করে আমাদের পাড়া
ছাড়া করবে”।
“তান্ত্রিক? তার মানে যারা সেই ওঁ হ্রিং ক্রিং ফট্
করে? সর্বনাশ, তাহলে কি হবে”?
“ধুর ভেবো না তো, কিচ্ছু হবে না। ও তান্ত্রিক না
হাতি। ওর সত্যি নাম হচ্ছে নাত্তিক চন্দ্র হাতি”।
“নাত্তিক? নাত্তিক আবার কারো নাম হয় নাকি”?
“আরে বাবা, নাত্তিক নাত্তিক। মা দুগ্গার ছোট ছেলে।
আমরা ভূততো তাই ঠাকুর দেবতার নাম করতে পারি না”।
“ও কার্তিক। তাই বল। কিন্তু তাহলে মা দুর্গার নাম করলি কি করে? তিনি কি ঠাকুর নন”?
“তুমি একদম বোকা ঝুনুদিদি, মায়ের আবার ঠাকুর-দেবতা কি?
মা তো মা-ই। মায়ের নাম সবাই, সবসময় উচ্চারণ
করতে পারি”।
“আচ্ছা, আচ্ছা, বুঝেছি, এখন শনিবারে কী হবে, তাই বল”।
“সে আমরা ঠিক করে নিয়েছি। আমরা সেদিন প্রফুল্লনগরে যতো ভূত আছে সব্বাইকে নিয়ে মাঠে জড়ো হবো। আর স্বস্ত্যয়ন শুরু করার আগেই ঢিল মেরে
সব পণ্ড করে দেব, দেখ না। প্রথম মারব প্রথমকে আর ওই
নাত্তিককে”।
এতক্ষণ সুকু কোন কথা বলেনি, রুকুর শেষ কথায় সুকু আওয়াজ করল - ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ।
সেই শুনে ঝুনু বলল, “ও আবার কি আওয়াজ, ঘুঘুর ডাকের মতো”?
হি হি করে হেসে রুকু বলল, “ও হচ্ছে প্রথমের হাসি। সেদিন ওর হাসি আমরা
ঘু ঘু ঘুচিয়ে দেবো”।
মায়ের রান্না হয়ে গিয়েছিল, বারান্দার দিকে তাঁর আসার শব্দ পেয়ে
রুকুসুকু মিলিয়ে গেল পেয়ারা গাছের আড়ালে।
৯
ঊষাদি, মৃদুলবাবুর স্ত্রী, রুনুঝুনুর মায়ের খুব বন্ধু।
ঊষাদিরা যখন প্রফুল্লনগরে ছিলেন, রুনুঝুনুর মায়ের সঙ্গে খুব
ভাব ছিল, একদম নিজের ছোটবোনের মতো ভালবাসতেন রুনুঝুনুর মাকে।
আর মৃদুলবাবুর পাশের জমিটাও রুনুঝুনুর বাবা মুকুন্দবাবু নিয়েছেন। ইচ্ছে আছে চাকরি
থেকে অবসরের পর পাশাপাশি বাড়িতে থাকবেন। আপদে বিপদে কোন সমস্যা হবে না। রবিবারের
সকালে ঘটনার পরেই ঊষাদি ফোন করে সব জানিয়েছিল রুনুঝুনুর মাকে। প্রমথবাবুর দেওয়া
প্রস্তাব শুনে আর মুকুন্দবাবুর কাছে প্রমথবাবুর ভয়ংকর পরিচয় শুনে রুনুঝুনুর মায়ের
বুক কেঁপে উঠেছিল - হে ঠাকুর, একি বিপদে ফেললে ঊষাদিদিকে।
সেই রোববার থেকে চিন্তায় তাঁর ভালো ঘুম হচ্ছে না।
আজ দুপুরে মুকুন্দবাবু খেতে এসে প্রমথবাবুর জমিতে ভূতের ঢিল মারার
ঘটনাটা শুনিয়েছেন। সেই শুনে অব্দি তাঁর চিন্তা আরো বেড়ে গেছে। এক ছিল প্রমথবাবু, তার ওপরে জুটল ভূতের ঢিল! কি সর্বনেশে কাণ্ড। হে প্রমথনাথ, হে ভূতনাথ, তোমার ভূতদের তুমি
সামলাও, বাবা। প্রমথনাথ শিব ঠাকুরের আরেক নাম। ব্যাপারটা
নিয়ে সেই থেকে সারাক্ষণ চিন্তা করতে করতে সন্ধ্যেবেলা তাঁর মাথায় এল, এর পিছনে তাঁর মেয়েদের, রুনুঝুনুর হাত নেই তো?
তাদের ভূতবন্ধু রুকুসুকু যমজ ভূতের কাণ্ড নয়তো এটা? গতবছর তাঁরা যখন
সিমলা-কুলু-মানালি হয়ে হরিদ্বার বেড়াতে গিয়েছিলেন, এই দুই যমজ ভূত এক কাণ্ড বাধিয়ে বসেছিল। তাঁর খুব
সন্দেহ হচ্ছে, এ ওদেরই কীর্তি।
“কি করছিস রে, তোরা দুজনে”? রুনুঝুনুকে
জিগ্গেস করলেন ওদের মা।
“কিচ্ছু না, এই একটু ঠাণ্ডা হাওয়া খাচ্ছি”।
“ওরা এসেছিল”?
“কারা”?
“কারা আবার, রুকুসুকু”?
“হুঁ, এসেছিল। তোমার ভয়ে চলে গেছে, মা”।
“বোঝো কাণ্ড, এতদিন জানতাম ভূতেদের
মানুষ ভয় পায়, এখন ভূতেরা আমাকে ভয়
পাচ্ছে”!
“সবাইকে নয়, ওরা মায়েদের খুব ভয় করে”।
“আজ সকালে প্রমথবাবুর জমির ঘটনাটা ওদেরই কাজ, না”?
“হুঁ”।
“তোরা কি পাগল হয়ে গেছিস, প্রমথবাবু আমাদের ছেড়ে দেবে,
জানতে পারলে”?
“কেউ জানবে কেন? আর প্রমথবাবু কেন ধমকেছে, মৃদুলজেঠুর মতো শান্তশিষ্ট ভালো মানুষ কে? আমরা তো
কেউ কিছু করতে পারবো না, রুকুসুকু যদি আটকাতে পারে, চেষ্টা করে দেখুক না”।
“প্রমথবাবু এত সহজে ছেড়ে দেবে ভেবেছিস? ও নাম করা
তান্ত্রিক ডেকে যাগযজ্ঞ করাবে, রুকুসুকুকে তাড়িয়ে আমাদের
নিয়ে পড়বে। আমরাও বিপদে পড়ব, বিপদে পড়বে ঊষাদিরাও”।
“করছে তো, আসছে শনিবার, প্রমথবাবুর
জমিতে বিশাল যজ্ঞ”।
“তোরা কি করে জানলি”?
“রুকুসুকু খবর দিয়ে গেল। ওরাও রেডি, সব ভূত মিলে পণ্ড করে দেবে যজ্ঞ”।
“এই ভয়ংকর কাণ্ডের মধ্যে তোরা কেন জড়িয়ে পড়লি”?
“সরুদা বলে, কাউকে না কাউকে তো সামনে আসতেই হবে, তা
না হলে প্রমথবাবুদের মতো লোকদের ভূতের কেত্তন তো বেড়েই চলবে।
তুমি একদম চিন্তা করো না, মা। রুকুসুকু সবদিক ঠিক সামলে দেবে,
ভেবো না। কথাগুলো শুধু পাঁচকান না হয় সেটা দেখ। এমনকি ঊষা
জেঠিমাদেরও বলো না”।
১০
কালো সর্ষে,
সাদা সর্ষে, কালো তিল, ধুনো,
গুগ্গুল, সতেরটা কাঁঠালি কলা, ১০৮টা বেলপাতা, এক পোয়া আতপ চাল, ঘি, মধু, গোবর, বেল কাঠ, পঞ্চ শস্য, পঞ্চগুঁড়ি,
মড়ার খুলি, ছাগলের পায়ের হাড়। দরকার ছিল মানুষের পায়ের হাড়, যোগাড় করতে পারে নি শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী। তাই ছাগলের সামনের পায়ের
হাড় দিয়ে ম্যানেজ করে নিয়েছে পাড়ার মাংসের দোকান থেকে। ছাগলের না মানুষের চিনতে
পারার আগেই, সাধারণ লোকে হাড় দেখলেই চমকে যাবে।
রাত্রি বারোটা নয় গতে মাহেন্দ্রক্ষণ। সাড়ে এগারোটা নাগাদ শ্রী
কার্তিকচন্দ্র হাতি বারমুডা আর টি শার্ট ছেড়ে, রক্তাম্বর পড়ে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত
তান্ত্রিক শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী হয়ে উঠল। কপালে মোটা করে সিঁদুরের
টিপ। স্বস্ত্যয়নের সব যোগাড় নিয়ে উঠে পড়ল প্রমথবাবুর জাইলো গড়িতে। গাড়িতে
প্রমথবাবু এবং তাঁর ভাইপো। বাকিরা সবাই বাইকে। সকলের মনের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা, আজ স্বচক্ষে
দেখতে পাওয়া যাবে ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ।
ঈশাণ কোণে মুখ করে বেলগাছের নীচে একটা জায়গা ঠিক করাই ছিল। সেখানে আসন
পেতে স্বস্ত্যয়নের যোগাড় নিয়ে বসে পড়ল শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী । ঘিয়ের প্রদীপ
জ্বলে উঠল, ধুপ, ধুনো, গুগ্গুলের সুগন্ধে
রাতের জঙ্গল ভরে উঠল। হোম কুণ্ড তৈরি করে শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী প্রমথবাবুর
থেকে যখন হোম শুরু করার অনুমতি চাইল, মোবাইলের পর্দায় সময়
তখন রাত বারোটা বেজে আট মিনিট।
প্রমথবাবুর থেকে আনুষ্ঠানিক অনুমতি পাবার পর, শ্রীশ্রী
কাত্যায়ন শাস্ত্রী চিৎকার করে উঠল, “ব্যোমশংকর, কালি করালী নৃমুণ্ডমালিনী ভীমা ভয়ংকরী মা, তোর সব
চেলাদের সামলে রাখ মা, সামলে রাখ...”। তারপর হোমকুণ্ডে আগুন
ধরিয়ে জ্বালিয়ে তুলল হোমের আগুন। ঘিয়ের পাত্র থেকে কাঠের কুষিতে ঘি নিয়ে, “ওং হ্রিং ক্রিং ঋং
লং অং বং চং স্বাহা”, বলে যজ্ঞে ঘি দিতেই উপস্থিত সকলের পিঠে
এসে পড়তে লাগল ঢিল, আর আশপাশ থেকে অনেকগুলো কণ্ঠে সমবেত সুর
শোনা গেল “স্বাআআ হাআআআ”। শ্রীশ্রী কাত্যায়ন
শাস্ত্রীর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল, একবার তার মনে হল সব ছেড়ে ছুড়ে পালায়,
কিন্তু টাকাও তো নেহাত কম নয়, প্রায় পনেরদিনের
রোজগার!
দুরুদুরু বুকে সে বলল, “তেনারা এসে গেছেন, তেনারা
বিঘ্ন সৃষ্টি করছেন। দাদা, ব্যাপার খুব সুবিধের নয় মনে
হচ্ছে...” শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী একটা বেলপাতা ঘিয়ে ডুবিয়ে, যজ্ঞের আগুনে দিতে দিতে বলল, “ওং হ্রিং ক্রিং ঋং লং
অং বং চং স্বাহা”। এবারে হাজার কন্ঠের স্বর শোনা গেল “স্বাআআ হাআআআ”,
তার সঙ্গে চারদিক থেকে ঝরতে লাগল ঢিল আর ইঁটের বৃষ্টি। এবার আর থামল
না, লাগাতার চলতেই থাকল, “স্বাআআ হাআআআ”
আর তার সংগে সংগে ঢিলের বৃষ্টি। তার সঙ্গে নতুন শুরু হল ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ
শব্দে সমবেত হাসি।
শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “দাদা, এই অবস্থায় আপনি হাসছেন? আমি চললাম, বেঁচে থাকলে অনেক সাধনা করতে পারবো...”
“আমি হাসছি? হতভাগা, তোর মনে এই
ছিল রে কেতো, কি যজ্ঞি শুরু করলি, এ যে
দুনিয়ার ভূত এসে জড়ো হয়ে গেল। আমাকে ফেলে যাস নি, বাবা
কাত্তিক”। প্রমথবাবু শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রীর হাত ধরে দৌড়তে শুরু
করলেন গাড়ির দিকে। গাড়ির কাছে পৌঁছে দেখলেন কেউ নেই, না ড্রাইভার, না তাঁর কোন শাগরেদ। বিপদ বুঝে কে কখন পালিয়ে গেছে তিনি জানতেও পারেন নি।
অথচ তাঁদের পিছনে তাড়া করে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ঢিলের বৃষ্টি, আর ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ হাসি। তাঁদের দুজনের পিঠে আর মাথায় যে পরিমাণ আলু গজিয়ে
উঠেছে, তাতে তাঁর হিমঘর অনেকটাই ভরে উঠবে। যদিও এ আলু
অখাদ্য!
১১
এর পরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। প্রমথবাবুর ওই জমিটার লোকমুখে নামই হয়ে
গেল ভূতডাঙা। আটষট্টি জন পার্টি, প্রমথবাবুর ফ্ল্যাট কেনার জন্যে বুকিং করেছিল, তারা সবাই সকালে সন্ধ্যেয় প্রমথবাবুর বাড়ি এসে বসে থাকে টাকা ফেরত নেওয়ার
জন্যে। প্রমথবাবু ভোরে বেরিয়ে যান ফেরেন প্রায় মাঝরাত্রে। আজকাল তিনি ভুলেও আর
হাসেন না।
আমার "তেঁনারা" গল্প সংকলন গ্রন্থ থেকে নেওয়া - বইটি ঘরে বসে পেতে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করে বুক করতে হবে -