Powered By Blogger

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

আমরি বাংলা - ১

বসার ঘরে ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে ফল্গু বলল, “দিদু, এই যে আমরা এখন ব্রেকফাস্ট খাচ্ছি তার কোন বাংলা নেই?” দিদু অর্থাৎ ফল্গুর দিদিমা কিছু বলার আগেই ফল্গুর মা নিভাদেবী বিরক্ত হয়ে বললেন, “বাংলা ভাষা নিয়ে পিএইচডি করছিস আর তুই ব্রেকফাস্টের বাংলা জানিস না? থাকবে না কেন? প্রাতরাশ।”

ফল্গু মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বলল, “ধ্যাৎ ওটা তো কলোনিয়াল বাংলা। ব্রেকফাস্টের সঙ্গে মিলিয়ে শব্দটা বানানো হয়েছে সংস্কৃত থেকে ধার করে। ওটা জানি, কিন্তু এই বাংলায় লোকেরা সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ-টুখ ধুয়ে কি কিছু খেত না? নাকি সেটাও আমাদের শিখিয়ে বৃটিশরা আমাদের ধন্য করে দিয়েছিল? যদি তা না হয়, তাহলে এই খাওয়াটাকে তারা নিশ্চয়ই কিছু একটা বলত। সেটা কি? গ্রামের মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির গিন্নিরা নিশ্চয়ই ছেলেমেয়েদের ডেকে বলতেন না, “ওরে খ্যাঁদা, পল্টু, বোঁচা, কুসমি, চম্পা প্রাতরাশ বেড়েছি, খাবি আয়”। অথবা “অ খ্যাঁদা, তোর বাবার প্রাতরাশটা বৈঠকখানা ঘরে দিয়ে আয়”। এটা সম্ভব বলে তোমার মনে হয়, মা?”

নিভাদেবী বললেন, “তোর যতো সব উদ্ভট চিন্তা। ওসব ভেবে আর হবেটা কি? আজ সারা উত্তর ভারত হাইওয়ে দিয়ে ঘুরে আয় – ছোট বড়ো ঢাবায় সর্বত্র – বাইরে টিনের বোর্ডে লেখা থাকে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার। তার মানে কথাগুলো শুধু বাংলা নয় সর্বত্র চালু হয়ে গেছে”।

“তা হয়েছে, মানছি। কিন্তু তার আগে কী বলা হত? দিদু জানো?”

ফল্গুর দিদিমা নাতনি আর মেয়ের কথা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিলেন। নাতনির প্রশ্নের উত্তরে মুচকি হেসে বললেন, “বলতো বই কি। সকালের খাওয়াকে বলত জলখাবার। দুপুরের খাওয়াকে বলত ভাত খাওয়া। আর রাত্রের খাওয়াটাকে রাতের খাবারই বলত। তবে সত্যি বলতে ওরকম পোশাকি মানে তোদের ভাষায় ফর্মাল নাম সত্যিই ছিল না। ওই যে তুই বললি না, মধ্যবিত্ত গিন্নিরা ছেলেমেয়েদের খেতে ডাকতেন, খ্যাঁদা, পল্টু মুড়ি বেড়েছি খাবি আয়। অথবা ছাতু মেখেছি খাবি আয়। দুপুরে ডাকতেন, ভাত বেড়েছি, খাবি আয়। কোন কোন উগ্রচণ্ডী মায়েরা রেগে গেলে বলতেন, “ভাত বেড়ে দিয়েছি, গিলে আমায় উদ্ধার করো”। আবার মায়েদের মুখে শুনেছি, স্বদেশী করা ছেলেদের মায়েরা ভাতের হাঁড়ি কোলে সারারাত জেগে অপেক্ষা করতেন। লাঞ্চ, ডিনার তো দূরের কথা – মধ্যাহ্ন-আহার কিংবা নৈশ-ভোজন এসব কথাও কাউকে কোনদিন বলতে শুনিনি – পড়েছি সাহিত্য-উপন্যাসে। ইংরিজিতে শিক্ষিত সাহিত্যিকরা বাংলা উপন্যাস লিখতে গিয়ে লাঞ্চ বা ডিনারের সমার্থক শব্দ বানিয়েছিলেন তৎসম শব্দ ধার করে।    

তার ওপর ধর, তখন তো আর ঘরেঘরে বা হাতেহাতে ঘড়ি ঘুরত না। লোকে এই খাবারের নামে সময়ও বুঝে যেত। যেমন ধর আমাদের ছোটকা কোথাও যাবে, মাকে বলল, “এই তো জলখাবার খেয়ে বেরোব, বাড়ি ফিরে ভাত খাবো”। সকলেই বুঝে গেল – ছোটকা সকাল সাড়ে আটটা-নটা নাগাদ বেরিয়ে, দুপুর দেড়টা-দুটো নাগাদ ফিরবে। ঘড়ির দরকারই হত না।    

আসলে সে সব দিনে আমাদের বাঙালী ঘরের প্রধান শস্যই ছিল ধান। তার থেকেই তৈরি হত, ভাতের চাল, মুড়ি, খই, চিঁড়ে। ছোলা বা যব গুঁড়ো করে ছাতু। ছোটবেলায় দুধ আর গুড় দিয়ে মাখা যবের ছাতু, আমরা কম খেয়েছি? বেশ আনন্দ করেই খেয়েছি”।

ফল্গু উজ্জ্বল মুখে বললে, “বাঃ বেশ বললে তো, দিদু”।

“বেশ কি বললাম জানি না, বাপু। আজকাল শহরে দেখেছি শনিবার রাত্রে ডিনার করতে করতে লোকে পরের দিন ব্রেকফাস্টে কী খাবে তার প্ল্যান করে। ছেলে বলে সাউথ ইন্ডিয়ান খাবো। মেয়ে বলে চিজ স্যাণ্ডুইচ। বাবা বলে লুচি-আলু চচ্চড়ি। মা বলে ছোলে বাটুরা। সকালে মুখ ধুয়ে ছেলে বা মেয়ে বসে পড়ে ফোন নিয়ে – সবার মনোমতো খাবারের অর্ডার দিয়ে দেয়। আধঘন্টার মধ্যে ঘরে পৌঁছে যায় গরমাগরম খাবার। ব্রেকফাস্ট। আমাদের সময় এমন কল্পনা করতে পারলে, আমাদের নাম আজ জুলে ভার্ন বা এইচ জি ওয়েল্‌সের মতো স্মরণীয় হয়ে থাকত”।

 

ব্রেকফাস্ট সাঙ্গ করে ফল্গু আর নিভাদেবী কফির আর দিদু ব্রজবালা চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। ফল্গুর কৌতূহল শেষ হয়নি, সে বলল, “আমাদের স্কুল লাইফ পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল রবি ঠাকুর ছাড়া বাংলা ভাষায় আর কেউ গান লেখেননি। বাংলা ভাষায় যা কিছু লেখা হয়েছে – কবিতা কিংবা গদ্য -গল্প, উপন্যাস”।

নিভাদেবী বিরক্ত হলেন খুব, “কি যাতা বলছিস? নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদের গান শুনিসনি?”

ফল্গু এতটুকুও বিচলিত না হয়ে বলল, “কোথায় শুনব, বলো। আমাদের স্কুলের যে কোন অনুষ্ঠানে, পাড়ার যে কোন ফাংশানে সর্বত্র শুনেছি রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাড়িতেও তুমি কিংবা বাবা গান চালাতে – বাংলা মানেই রবীন্দ্র সঙ্গীত – হেমন্ত, সুচিত্রা, কণিকা, দেবব্রত, সাগর, ঋতু। তাছাড়া বাবা কিশোরের আর লতার হিন্দি গান শুনতে পছন্দ করতেন। এ ছাড়া আমাদের গান শোনার কোন উপায় ছিল? ও হ্যাঁ আরেকজনের গান শুনতাম, পাড়ায় কালীপুজোর সময় – পান্নালালের শ্যামাসঙ্গীত। আমার ধারণা ছিল, গানগুলি ওঁরই রচনা। বাংলা নিয়ে পড়াশুনো করতে গিয়ে দেখলাম, ওরেব্বাবা, বাংলা গানের অথৈ ভাণ্ডার। আমাদেরকে সে সব শুনতেই দেওয়া হয় না। সে সব গানের এখনও চর্চা হয়, কিন্তু রবি ঠাকুরের ভারে সবাই চ্যাপ্টা হয়ে গেছে”।

ব্রজবালা বললেন, “আমার জন্ম স্বাধীনতার ন-বছর আগে। ছোটবেলায় রবিঠাকুরের গান যে শুনিনি তা নয়। তবে সে সব অধিকাংশই দেশাত্মবোধক – বাংলার মাটি, আমার সোনার বাংলা, সঙ্কোচের বিহ্বলতা, আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে। নজরুলের গানও খুব শুনেছি, কারার ওই লৌহ কপাট, দুর্গম গিরি কান্তার। সে সব গাইত আমাদের স্কুলের দাদা-দিদি, কিংবা মাস্টারমশাইরা। অর্থাৎ শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা। কিন্তু বললে বিশ্বাস করবি না, আমাদের কান জুড়িয়ে দিত চারণকবিদের গান। তাঁদের মধ্যে সবার সেরা ছিলেন মুকুন্দ দাস। সকলে বলত চারণ কবি মুকুন্দ। আহা সে কী গান – গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। ভয় কী মরণে, রাখিতে সন্তানে। আরেকটা গান ছিল, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।  সে গান মা, কাকিমা, ঠাকুরমাদের কানে গেলেই দেখতাম মন দিয়ে শুনতেন, তাঁদের চোখ জলে ভরে উঠত। বড়ো হয়ে, তখন ভারত স্বাধীন হয়ে গেছে, আমিও সে গান শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলেছি কতবার। আমি তো মুকুন্দ দাসের কণ্ঠে এ গান শুনিনি, শুনেছি আমাদের গ্রামে আসা গীতজীবীদের কণ্ঠে”।

নিভা অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালেন, ফল্গু জিজ্ঞাসা করল, “গীতজীবী মানে?”

ব্রজবালা লাজুক হেসে বললেন, “ভিক্ষার জন্যে কেউ কেউ গান গায়, সে গানে আন্তরিকতা থাকে না, এবং সে গানের মর্যাদাও সে বুঝতে পারে না। তার আসল লক্ষ্য ভিক্ষা, ভিক্ষা পেলেই গান থামিয়ে পাশের বাড়ি বা পাশের পাড়ায় হাঁটা দেয়। বাড়ির লোকজনও দেখতাম তাদের ভিক্ষে দিয়ে বিদায় করতে পারলে যেন বেঁচে যায়। অন্যদিকে কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁরা বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালে বাড়িতে সারা পড়ে যেত। ঠাকুমাকে বলতে শুনেছি, “অ কেষ্ট, অনেকদিন পর এদিকে এলি, বাবা। খপর সব ভালো তো”। আজ্ঞে খপর ভালই মা ঠাকরোন, এদিকে ছিলম না, গেছিলাম ঘোষপাড়ার মেলায়। তাই ক’মাস এদিকে...”।  “তা বেশ, একটু ব বাবা, জলখাবার খেয়ে একটু জিরিয়ে নে। হাতের কাজ সেরে গান শুনবো তোর। তা সেই কৃষ্ণপদও নিশ্চিন্তে জলখাবার খেয়ে ছায়ায় বসে টুংটাং করে তার একতারার তার বাঁধত।

দুপুরের রান্নাবান্না-ঘরের কাজ শেষ হলে ঠাকুমা হাঁক পাড়তেন, কই রে কোথায় গেলি সব। সবাই এসে বসলে কৃষ্ণপদ সকলকে প্রণাম জানিয়ে গান ধরত। তার গলা হেমন্ত, মান্না, কিশোরের মতো মেজে-ঘষে পোষ মানানো গলা নয়। গ্রীষ্মের দাহে দগ্ধ হতে থাকা ফুটিফাটা মাঠের মতো উদ্ধত। শরতের শস্য-ভরা ক্ষেতের গন্ধমাখা স্বপ্নময়। হেমন্তের হিমঝরা সন্ধ্যার মতো বিষণ্ণ-বিধুর। উদাত্ত, ব্যাপ্ত সেই কণ্ঠ নিমেষে আমাদের বেঁধে ফেলতে পারত, কথা আর সুরের নিবিড় বন্ধনে। বৈঠকখানা ঘরে বসে দাদু এবং তাঁর প্রতিবেশী বন্ধুরা হুঁকোয় টান দিতে ভুলে যেতেন।

পরপর চার-পাঁচখানা গান শুনে ঠাকুমা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বিরতি ঘোষণা করতেন। বলতেন, “এখন থাক বাবা। বেলা হল। পুকুরে ডুব দিয়ে এসে দুটি ভাত মুখে দিয়ে একটু গড়িয়ে নে। রোদের তাপটা পড়লে বাড়ি যাবি”।

সেই কৃষ্ণপদ বিকেলের দিকে আরও কখানা গান শুনিয়ে, যখন বাড়ি ফিরত, মায়েরা তার ঝোলায় সিধে ভরে দিত। চাল, ডাল, কিছু আনাজ, তেল, নুন, মশলা। আমাদের দাদু দিতেন নগদ দুটাকা কিংবা তিনটাকা। এই রকম গুণী মানুষদের আমি বলি গীতজীবী। গানই ছিল তাঁদের জীবিকা, কিন্তু সেটাকে কেউ ভিক্ষা বলে মনে করত না। সাধারণ মানুষের মন জয় করেই তাঁরা জীবিকা অর্জন করতেন। শুধু কৃষ্ণপদ নয়, আরো অনেকে আসতেন – নাকে-কপালে আঁকা চন্দনের তিলক, গায়ে নামাবলি। তাঁরা গাইতেন – রাধা ও কৃষ্ণের রাসলীলা, মাথুর, মানভঞ্জন…সে সব গানও ছিল অপূর্ব। আমরাও হাঁ করে শুনতাম – আর বড়োরা তো আনন্দে দুঃখে কেঁদে তাঁদের শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে ফেলতেন”।

 

ব্রজবালা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর আবার বললেন, “তোদের তো দোষ নেই দিদিভাই, দোষ তো আমাদের । মাতৃভাষা মায়ের দুধের মতো – এ কথাটা আমাদের মনে আসে একমাত্রে ভাষা দিবসে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এখন আমাদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে মায়ের দুধ ছাড়িয়ে বাচ্চাদের কত দ্রুত সেরেল্যাক খাওয়ানো যায়। ভাষার ক্ষেত্রেও এই সেরেল্যাক আমাদের সেরে দিয়েছে – দেশি ডাল-ভাত-শাকসব্জি-মাছ-মাংস ভুলে আমরা বেড়ে উঠছি ইংরিজি আর মুম্বাইয়ান হিন্দিতে...। দুঃখ করে লাভ কি? বাংলা ভাষা এখন ভেসে চলেছে বেনো জলে – তাকে ফিরিয়ে আনবে  ভবিষ্যতের কোন বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-শরৎ-রবিঠাকুর – কে জানে? 


চলবে...       


শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

পঋপাটি ফে৯ওর





 নৃপেনবাবু বিনোদিনী দেবী উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন দীর্ঘদিন। এই মফস্বল শহরে তাঁর ছাত্র সংখ্যা ঈর্ষণীয়। টোটো চালক থেকে ব্যাঙ্গালুরু শহরের পাঁচলাখি সফ্‌টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বিশাল বঁটিতে ঝপাঝপ ছ-সাত কিলোর কাতলা মাছ কেটে কাটাপোনা বিক্রেতা থেকে – জার্মান প্রবাসী তুলনামূলক সাহিত্যের নামকরা অধ্যাপক।

তাঁর পুত্র - ওই স্কুলেরই ছাত্র - দীপেনও কম যান না। আমেরিকার একটি বিখ্যাত ইউনিভার্সিটির কৃষি বিভাগে অধ্যাপনা করেন এবং জল ছাড়াই যে কোন জমিতে উচ্চ ফলনশীল ধানের উৎপাদনযোগ্য সংকর বীজ সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। সফল হলে পৃথিবীর চেহারাটাই পালটে যাবে। সাহারা, কালাহারি এমনকি আমাদের ঘরের থর মরুভূমিতেও দিগন্ত বিস্তৃত চোখ জুড়োনো সবুজ ধানক্ষেত দেখা যাবে। গবেষণা এখনও সফল হয়নি, কিন্তু হতে কতক্ষণ – কাল কিংবা পরশু...।

প্রতি বছর শীতকালে দীপেন সপরিবারে বাড়ি আসেন। এবারে আসতে পারেননি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সেমিনারে ইউরোপ যেতে হয়েছে। তাই দীপেনের স্ত্রী নমিতা এসেছেন তাঁর একমাত্র পুত্র নমপেনকে নিয়ে। এখানে তাঁরা মাস খানেক থাকবেন। মাসখানেক পর দীপেন এলে, আরও দিন সাতেক থেকে এক সঙ্গে উড়ে যাবেন আমেরিকায়।

নিজের পুত্র হলে কী হবে, নৃপেনবাবু দীপেনকে একদমই গ্রাহ্য করেন না। পত্নীর সামনে তিনি পুত্রকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু পুত্র-প্রসঙ্গ এলেই, তিনি মনে মনে “হতভাগা, গাধা একটা” বলে বেশ শান্তি পান। তাঁর যুক্তি সেই ধান চাষই যখন করবি, তখন অতদূরে না গিয়ে মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান কিংবা বড়জোর তাঞ্জাভুর যেতে পারতিস?

আরো একটা কারণ আছে। তাঁর নাতিটির নাম নমপেন। প্রথম বার শুনে তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর পুত্র কম্বোডিয়াতে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য দেখে বা শুনে, ওখানকার রাজধানীর নামে পুত্রের নাম নমপেন রেখেছে। ঘন্টা – মোটেই তা নয়। তাঁর বউমার নাম নমিতার – নম, আর দীপেনের পেন – দুইয়ে মিলে নমপেন। তাঁর নাতির নাম।

এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি আরও জেনেছেন, কম্বোডিয়া দেশটার নাম তাঁর পুত্র শুনেছে – কিন্তু সেটা ঠিক কোন দিকে সে জানে না। একটু ভেবেচিন্তে বলেছিল, ইউরোপের কোন দেশ মনে হয় – লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া, আর্মেনিয়া, কম্বোডিয়া...। নৃপেনবাবু কিছু বলেননি। মনে মনে দীপেনের ভূগোলের মাস্টারমশাই ভূদেববাবুর কান মলে দিয়ে বলেছিলেন, “হতভাগা, দীপেনটাকে ভূগোলে পাসমার্ক দিয়েছিলি কী করে”? প্রসঙ্গতঃ ভূদেববাবুও তাঁর ছাত্র ছিলেন।

 

কথায় আছে টাকার থেকে সুদ মিষ্টি। নৃপেনবাবুর ক্ষেত্রেও কথাটি সমান প্রযোজ্য। নিজের পুত্রটিকে তিনি গাধা মনে করলেও, পৌত্র নমপেনকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করেন। এবং বিশ্বাস করেন, বছর চোদ্দর এই প্রতিভাধর নাতিটিই তাঁর নামের পূর্ণ মর্যাদা রাখবে, এমনকি বংশের নামও উজ্জ্বল করবে।  

বাড়ি আসার পরের দিনই তাঁর বউমা একটি আবদার করলেন, বললেন, “বাবা, নমু মোটামুটি বাংলা বলতে পারে। ওখানে তো বাংলা শেখার সুযোগ খুব কম, তাই পড়তে বা লিখতে জানে না। এই এক মাসে যদি নমুকে বাংলা অক্ষর পরিচয় আর লেখাটা একটু শিখিয়ে দেন...তাহলে আমি ফিরে গিয়ে বাংলা বইটই পড়ানো চালু করে দেব”।

বৌমার কথায় নৃপেনবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, বললেন, “মোক্ষম বলেছ বউমা। মাতৃভাষা হল মায়ের দুধের মতো। সে কী আর কৌটোর দুধ কিংবা প্লাস্টিক-প্যাকেটের দুধ দিয়ে পূরণ হয় মা? মাতৃভাষা না জানলে কোন বিদ্যা বা জ্ঞানই পূর্ণ হতে পারে না...”।

নৃপেনবাবুর স্ত্রী বললেন, “এই শুরু হল লেকচার... ক্লাসের ঘন্টা না পড়া পর্যন্ত থামবে না। পাগলকে কোনদিন, সাঁকো নাড়া দিও না, বলতে আছে, বৌমা?”

নমিতা মুচকি হাসলেন, কিছু বললেন না। শ্বশুর শ্বাশুড়ির মধ্যে এই নিরন্তর খুনসুটির ব্যাপারটা নমিতা বেশ উপভোগ করেন।

 

দাদু ও নাতির যৌথ উদ্যোগে শুরু হল বাংলা-শিক্ষা অভিযান। বাংলা পড়া ও লেখা দ্রুত গতিতেই চলতে লাগল। অবশ্য একথাও মানতে হবে নমপেন বা নমু এতটুকু চঞ্চল, অমনোযোগী বা অধৈর্য হল না – সমান উৎসাহে দাদুর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে গেল।

ঠিক কুড়ি দিন পর। রবিবারের সকাল। নৃপেনবাবুর স্ত্রী ব্রেকফাস্টের টেবিলে বললেন, “শুনছো, আমি আর বৌমা একটু শপিং করতে যাবো টাউন মলে। আজ রবিবার – সন্ধের দিকে খুব ভিড় হয় – আমরা এবেলাতেই যাবো – এই এগারোটা-সাড়ে এগারোটা নাগাদ, ফিরতে ফিরতে দেড়টা দুটো হয়ে যাবে। আমাদের জন্যে অপেক্ষা করো না - তুমি আর নমু খেয়ে নিও। নীলিমাকে বলে যাচ্ছি – ও খাবার বেড়ে দেবে। কেমন?”

কথাটা শুনেই নৃপেনবাবুর মাথায় একটা আইডিয়া এল। এতদিন তিনি নমুকে পড়িয়েছেন, লিখিয়েছেন বাঁধা-ধরা ছোটদের বই থেকে। সেসব নমুর ভালই আয়ত্ত হয়ে গেছে। সে সব পড়ে সত্যি সত্যি নমু কতটা শিখেছে এবং বুঝেছে তার একটা পরীক্ষা নিলে কেমন হয়?

ছাত্রদের উপহার দেওয়া অনেক ডাইরি তাঁর ড্রয়িং কাম ডাইনিং রুমের বুকসেলফের ড্রয়ারে রাখা থাকে। ব্রেকফাস্টের পর তিনি নতুন একটা ডাইরি আর একটা পেনসিল বের করে নমুকে বললেন, “দাদুভাই, আজকে একটা নতুন খেলা খেলব”।

নমু বেশ মজা পেয়ে বলল, “বাঃ কী খেলা দাদু”?

“খেলাও বটে আবার লেখাপড়াও বটে”।

“খেলা আর লেখাপড়া একসঙ্গে?” নমু বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠল।

“হুঁ। খেলাটার নাম ধরো ডাইরি-ডাইরি খেলা। মানে এখন থেকে দুপুরের খাওয়ার সময় পর্যন্ত তুমি যা যা দেখবে, যা যা কথা বলবে, যা যা করবে এবং শুনবে, সব লিখে রাখবে তোমার ডাইরির পাতায়। বুঝতে পারলে?”

“ধরো এই তুমি আমাকে যা বললে, সে কথাও লিখবো? তারপর দিম্মা, মা, নীলিমা মাসি, আজ বাগানে মালিমামা এসেছে, যে যা বলবে, করবে, তারপর আমি যা যা করব, সব লিখবো?”

“গুড। ঠিক বুঝেছ। বাগানে গেলে গাছের নাম, ফুলের নাম, পাখির নাম, যা জানো সে সবও লিখবে...”।

“এখনই শুরু করি?”

“করো। কিন্তু এখন কাউকে দেখাবে না, এমনকি আমাকেও না। আমাকে দেখাবে সেই দুপুরে খাওয়ার আগে। ঠিক আছে?”

বিশাল ঘাড় নেড়ে নমু বলল, ঠিক আছে।

“ডাইঋ ডাইঋ খেলা

দাদুর থেকে ডাইঋ আর পেন্সিল নিলাম। এই ডাইঋতে আমি এখন থেকে যা কিছু দেখব, শুনব - সব ৯খে রাখবো। ঘর থেকে বেঋয়েই  দেখি সিঁড়ির মাথায় বেড়ালটা বসে আছে। আমাকে দেখেই পড়িমঋ করে দৌড়ে পালাল। কি মুশকিল, এখনও পর্যন্ত বেড়ালটা আমার পঋচিত হতে পারল না? আমাকে দেখলেই ভয় পায় কেন? কই অন্য কাউকে তো ভয় পায় না। কই ঠাকুমা কিংবা নী৯মামাসিকে তো ভয় পায় না? দাদুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দাদু বলেছিল, তোমার ঠাকুমা আর নী৯মা ওকে পঋপাটি করে খেতে দেয় যে – মাছ, দুধের বাটি – তাই বেড়ালটা ওদের পায়ে পায়ে ঘোরে।   

 নিচে বাগানে গেলাম। মা৯মামাকে দেখতে পেলাম না। পিছনদিকে গিয়ে দেখি মা৯মামা মাটিতে বসে কাজ করছে। জিজ্ঞাসা করলাম, “মা৯মামা কী করছো গো?”

আমাকে দেখে হেসে বলল, “এই মাটিটা একটু খুঁড়ে দিচ্ছি। গাছের গোড়া খুঁড়ে দিলে শেকড়ে হাওয়া পায়, গাছ খুব বাড়ে। আমাদের গায়ে ঝিঋঝিঋ হাওয়া লাগলে যেমন ভাঋ আরাম হয়, গাছেদেরও হয় জানো তো?”

“এটা কী গাছ গো মামা?”

“পেঁয়াজ গাছ, সবে গজাচ্ছে। আরও দিন সাতেক গেলে পুষ্ট হয়ে পেঁয়াজক৯ হবে”।

“আর ওই চারাগু৯?”

“ওগুলো গাজর – এধারে টোম্যাটো। টোম্যাটোকে অনেকে বি৯তি বেগুন বলে জানো তো! ওই দিকে লংকা। আর ওই যে ওদিকের কটা বেগুন গাছ। আর এই যে এইখানে আছে ফুলকপি আর বাঁধাকপি। ফুলকপির সবে ফুল এসেছে – দিন পনের পরে এত্তোবড়ো ফুল হবে – সে ফুলকপি দিয়ে তরকাঋ রাঁধলে যা স্বাদ হবে না – সব কিছু ভু৯য়ে দেবে”।

“আর ওদিকের লম্বা লম্বা পাতাওয়ালা গাছগুলো কি?”

“ওগুলো? ওগুলো কলাগাছ – কাঁঠা৯ কলা। সবে মোচা এসেছে, কলা হতে অনেক দেঋ”।

“মোচা থেকে কলা?”

“হ্যাঁগো মোচার বড়ো বড়ো পাপড়ির তলায় সাজানো আছে – সাঋসাঋ ক৯র গুচ্ছ। ওগুলোই বেড়ে বেড়ে হয়ে যাবে কলার কাঁদি”।

ভেতর থেকে মা ডাকলেন, “নমু, কোথায় গে৯? আমরা এবার বেরোব”।

আমি মা৯মামাকে বললাম, “মা ডাকছেন। আসি”। দৌড়ে দোতলায় গিয়ে দেখি মা আর দিদিমা বাইরে যাওয়ার জন্যে রেডি। ঠাকুমা রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নী৯মামাসিকে বলছেন, “নী৯মা, মেসোমশাইকে সাড়ে বারোটা থেকে তাগাদা দিবি চান করতে যাবার জন্যে। আর যদি চা চায় একবার দিবি – ৯কার চা। চিনি ছাড়া। একটু পরে নমুসোনার জন্যে একটা ডিমের পোচ দিবি, সামান্য নুন-গোলমঋচ দিয়ে। মেসোমশাইকে দিবি না”।

মা বললেন, “একদিন একটা ডিম খেলে কী হবে মা? বাবা ডিম খেতে ভালোবাসেন”।

ঠাকুমা বললেন, “না বৌমা তুমি জানো না, ডিম খেলেই ওঁনার পেটের ক৯ক পেনটা বেড়ে ওঠে। আর শোন দেড়টার মধ্যে খেতে দিয়ে দিবি। মেসোমশাইকে ভাত কম দিয়ে তরকাঋ বেশি দিবি। কেমন? ডাক্তার বলেছে বেশি বেশি তরকাঋ খেতে। নমুসোনা, ঠিক সময় মতো স্নান সেরে দাদুর সঙ্গে খেয়ে নেবে, কেমন? দাদু যেন বেশি দুষ্টুমি না করে, লক্ষ্য রাখবে”।

মা বললেন, “তোর হাতে ওটা কি, নমু?”

আমি বললাম, “ডাইঋ, দাদু বলেছেন ডাইঋ ৯খতে”।

মা বললেন, “৯খছিস? কই কী ৯খ৯ দেখি?”

আমি বললাম, “এখন দেখানো যাবে না, দাদু মানা করেছেন। বলেছেন কেউ যেন দেখতে না পায়। দাদু দুপুরে খাবার আগে দেখবেন”।

ঠাকুমা বললেন, “ছাড়ো বৌমা, বেঋয়ে পড়ি। তোমার বাবার যত্তো ছিটিয়া৯ কারবার, সারাজীবন মাষ্টাঋ করে মাথার মধ্যে ছিটমহল বানিয়ে ফেলেছেন। নী৯মা আমার বেরোচ্ছি...” গলা তুলে নৃপেনবাবুকে চেঁচিয়ে বললেন, “শুনছো, আমরা বেরোচ্ছি”। তারপর নমুর গাল টিপে বললেন, “তুমি তো লক্ষ্মী ছেলে, দাদুর দিকে একটু নজরদাঋ করো, কেমন? দাদু যেন দুষ্টুমি না করতে পারে। আমরা বেরোলে দরজাটা বন্ধ করে ওপরেই থেকো”।

মা-ঠাকুমা বেঋয়ে যেতে আমি আবার বাগানে গেলাম। মা৯মামা দেখলাম ফুলের বাগানে কাজ করছেন। কী সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটেছে – এতো বড়ো বড়ো – তেমনি সুন্দর রঙ। মা৯মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এগুলো কী ফুল মামা?”

“ডা৯য়া। রোদ্দুর পড়ে ফুলগুলো যেন খিলখি৯য়ে হাসছে, তাই না, ছোটবাবু? আর ওই দিকে দেখ চন্দ্রমল৯কা। কতরকমের রঙ, দেখছো? ওই দিকের গুলো সূর্যমুখী আর এই যে এগুলো ক্যালেনডুলা। তারপাশেই দেখ এই যে এগু৯ গাঁদাফুল। রকমাঋ রঙের ফুল শীতকালেই হয়। গরমকালের ফুলে তেমন রঙ হয় না, অধিকাংশই সাদা – বে৯, শিউ৯, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, টগর, মালতী, কামিনী। একটু একটু রঙ থাকে কাঁঠা৯ চাঁপায়, মাধবীলতায়। অবিশ্যি গরমের অধিকাংশ ফুলেই ভাঋ মিষ্টি গন্ধ হয় – শীতকালের ফুলে আবার তেমন গন্ধ হয় না”।

মা৯মামার সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে বললাম – “এই বড়ো গাছগুলো কী গাছ, মামা”।

“ওই গাছটা আম গাছ, আম্রপা৯ – ছোট ছোট আম পাকলে মিছঋর মতো মিষ্টি। এটা জামরুল। আর ওইটা হল ৯চু। গরমকালে ৯চু পেকে লাল টুকটুকে হয়ে ওঠে – ওঃ সবুজপাতার মধ্যে থোকাথোকা পাকা লাল ৯চুগুলো হাওয়ায় যখন দোলে - সে ভাঋ চমৎকার দেখতে লাগে। গরমকালে একবার চলে এসো না, ছোটবাবু। দাদুর বাগানের আম্রপা৯ আর ৯চু খেলে, আমেঋকা ফিরতে তোমার ইচ্ছেই হবে না...”।

মা৯মামার কাজ হয়ে গেল। বাগানের নানান যন্ত্রপাতি ধুয়ে মুছে পঋপাটি করে গুছিয়ে রাখলেন, গ্যারেজের এক কোনে। বললেন, “এখন তবে আসি, ছোটবাবু। আমি আবার বেষ্পতিবার আসবো, তুমি থাকবে তো?”

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ থাকব, বাবা আসবেন মাসের শেষ দিকে – তারপর আমাদের আমেঋকা ফিরতে হবে...”। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল – এমন সুন্দর দেশ আমাদের – এসব ছেড়ে আমরা কেন আমেঋকায় থাকি – সেটা তো আমাদের দেশ নয়...। মা৯মামা চলে গেলেন, আমি দরজা বন্ধ করে দোতলার সিঁড়িতে পা দিতেই নী৯মামাসির ডাক শুনলাম – “নমুবাবা, ওপরে এসো...”। বুঝলাম আমার পোচ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।

সিঁড়ির মাথায় নী৯মামাসির সঙ্গে দেখা হল, তাঁর এক হাতে ডিমের পোচ আর অন্য হাতে ৯কার চা। বললেন, “দাদুর ঘরে চলো। ওখানে বসে দাদুর সঙ্গে গল্প করতে করতে খাবে”।

দাদুর ঘরে ঢুকে দেখি দাদু খাটে মশাঋর ভেতরে ঢুকে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। আমি অবাক হয়ে দাদুকে জিজ্ঞাসা করলাম, “দাদু তুমি দিনের বেলা মশাঋর মধ্যে ঢুকে বসে আছো কেন?” দাদু মশাঋর থেকে বেড়িয়ে এসে সোফায় বসতে বসতে বললেন, “এস, বসো, দাদুভাই। দিন হোক বা রাত, মশাদের আমি মোটেই বিশ্বাস কঋ না। কখন যে হুল ফোটাবে...ঠিক তোমার দিদিমার মতো”।

টেবিলে চায়ের কাপ রেখে নী৯মামাসি দাদুর কথায় মুখ টিপে হেসে বললেন, “মেসোমশাই, আপনার চা। চা খেয়েই আপনি কিন্তু চান করে নেবেন। গিজার চালু করে দিয়েছি”। তারপর আমার হাতে প্লেট আর চামচ ধঋয়ে দিয়ে বললেন, “তুমিও পোচ খেয়েই চান করতে যাবে। তোমাদের বাথরুমেও গিজার চালু করে দিয়েছি”।

নী৯মামাসি চলে যেতে দাদু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “তোমার পোচে নুন-গোলমঋচ দিয়েছে তো, দাদুভাই? গোলমঋচের গুঁড়ো ছাড়া পোচের স্বাদ জমে না। আমারও পোচ খুব প্রিয়, খুব খেতাম – কিন্তু তোমার ঠাকুমা ডাক্তারদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে...আমার ডিম খাওয়াটাই নাকচ করে দিয়েছে। কী ঝকমাঋ বলো তো, দাদুভাই!”

   দাদুর সামনে বসে তাঋয়ে তাঋয়ে পোচ খেতে খুব খারাপই লাগছিল। কিন্তু দাদুর বয়স হয়েছে – ডিম-টিম না খাওয়াই ভালো।

চা শেষ করে দাদু বললেন, “কই কী ৯খলে, কেমন ৯খলে দেখি। এই পরীক্ষায় তুমি পাশ করলে, আমারও পাশ করা হবে। বুঝবো আমি এতদিনেও মাষ্টাঋ করা ভু৯নি”।

আমি ডাইঋ লেখা এখানেই শেষ করলাম। লেখাপড়া করতেও যে এমন মজা হয় – এর আগে বুঝতেই পাঋনি”।

-  -  -

 

নমু পোচ শেষ করে ডাইরিটা দাদুর হাতে দিয়ে বলল, “তুমি দেখ দাদু, আমি ততক্ষণ স্নানটা সেরে আসি”।

নৃপেনবাবু ডাইরি খুলতে খুলতে বললেন, “বেশ বেশ। সেই ভালো। আমি তোমার লেখাটা পড়ে ফেলি”।

ডাইরি পড়তে পড়তে নৃপেনবাবু বেশ কয়েকবার জিভে বিরক্তিসূচক আওয়াজ করলেন। বিড়বিড় করে বললেন, “দোষ তো দাদুভাইয়ের নয় – আমার। আমি পুরোপুরি ফেল করে গেলাম। দাদুভাইকে বলাই হয়নি – বাংলা ভাষায় ৯ বর্ণের কোন ব্যবহারই আর নেই। এও বলা হয়নি – ঋ বিশেষ কিছু তৎসম – অর্থাৎ সংস্কৃত - যেমন ঋতু, ঋষি, ঋত, ঋজু, ঋত্বিক, এই রকম সীমিত কিছু শব্দ ছাড়া আর কোথাও ব্যবহার হয় না। এটা যদি বলে দিতাম দাদুভাইয়ের লেখায় তো কোন খুঁত ছিল না! একশো তো একশ। কিন্তু আমি? ছিঃ – ফেল হয়তো করিনি। কিন্তু বত্রিশের বেশি – অর্থাৎ বড়ো জোর টায়েটায়ে পাশ করেছি বলা চলে।

কিন্তু ওর ঠাকুমা এসব কী বলেছে আমার সম্পর্কে? – তাও বৌমা, নীলিমা, নাতির সামনে? আমি ছিটিয়াল? মাষ্টারি করে করে আমার মাথায় ছিট-মহল গজিয়েছে? তার ওপর আমি দুষ্টুমি করলে, আমাকে সামলাবে আমাদের নাতি? ছি ছি। ছেচল্লিশ বছর একসঙ্গে ঘর করে, নিজের স্বামী সম্পর্কে এই রকম মন্তব্য? মহিলার মাথার ঠিক আছে তো?

তার পরেই ভাবলেন, কিন্তু তিনিই বা কম কিসে? নাতির সামনে ঠাকুমাকে মশার সঙ্গে তুলনা করলেন? ওর ঠাকুমা তাঁকে মশার মতো হুল ফোটান? ছি ছি। তিনিও তো বজ্জাতিতে তাঁর স্ত্রীর থেকে এক চুলও কম যান না!

ডাইরিটা হাতে নিয়ে নৃপেনবাবু অনেকক্ষণ বসে রইলেন। জানালা দিয়ে দূর আকাশে একটা চিলকে ভেসে বেড়াতে দেখলেন বহুক্ষণ। তারপর মৃদু হেসে সিদ্ধান্ত করলেন, দীর্ঘ দাম্পত্যের এটাই মজা। পরষ্পরের পিছনে লাগাতেই সম্পর্কটা সুন্দর টিকে থাকে – একদম গলাগ৯ – পঋপাটি সম্পর্ক।   

 ----০০০০----

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৪

বিপ্লবের আগুন - শেষ পর্ব

 

“আমার দাদামশাই মহারাজা মহেন্দ্র খুব পণ্ডিত মানুষ ছিলেন। আদর করে আমার নাম রেখেছিলেন ব্রজাংশু। ডাকনাম ব্রজ। আমার বাবা ছিলেন উচ্চপদস্থ সেনাধিকারিক। উত্তরসীমান্তে কোন এক যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি প্রাণ হারান। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাধ্যক্ষের অনেক সময়েই মৃত্যু ঘটে কিন্তু সেনাধিকারিকের মৃত্যু অত্যন্ত বিরল এবং অস্বাভাবিক। শোনা যায় তাঁর মৃত্যুর পিছনে কোন ষড়যন্ত্র ছিল। এবং সে ষড়যন্ত্রের উৎস ছিল রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুর। যদিও কোন অনুসন্ধানই ফলপ্রসূ হয়নি। সে যাই হোক আমার দাদামশাই জামাতার মৃত্যুর পর সপুত্র বিধবা কন্যাকে নিজের প্রাসাদেই সস্নেহে স্থান দিয়েছিলেন। অর্থাৎ আমি বড়ো হয়েছি একদিকে রাজপ্রাসাদের অপরিমিত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে এবং অন্যদিকে প্রচ্ছন্ন কিন্তু অত্যন্ত কুটিল আন্তঃপুরিক যড়যন্ত্রের মধ্যেও।

আপনারা জানেন কিনা জানি না, দাদামশাইয়ের জীবিত অবস্থায়, এ রাজ্যের ঘোষিত যুবরাজ ছিলেন বড়োমামা। এবং বার্ধক্যের কারণে দাদামশাই যখন বারবার অসুস্থ এবং দুর্বল হতে লাগলেন, দাদামশাইয়ের পরামর্শে বড়োমামাই রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব নিতে শুরু করেন। তখন আমার বয়েস পাঁচ কি ছয়। সৌভাগ্যক্রমে আমি আমার দাদামশাই ও বড়োমামা – উভয়েরই অত্যন্ত স্নেহেরপাত্র ছিলাম।

সেবার দীর্ঘ অসুস্থতার পর দাদামশাই বেশ কিছুটা নিরাময় হলেন। অন্তঃপুরে বেশ একটা স্বস্তির আবহ তৈরি হল। বড়োমামাকে সেজমামা একদিন বললেন, পিতৃদেব এখন অনেকটাই সুস্থ, রাজবৈদ্য বলছেন আপাততঃ বিপদ কেটে গেছে। আমরা দীর্ঘদিনের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়েছি। এই হেমন্তে চলো না দাদা, আমরা কদিন মৃগয়া করে আসি – এই বিনোদনটুকু আমাদের মানসিক উদ্বেগকে উপশম দেবে। বড়োমামা প্রথমে আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু সেজমামা দাদামশাইয়ের থেকে অনুমতি পেয়ে যাওয়ার পর বড়োমামা না করতে পারলে না – সম্মত হয়ে গেলেন।

নির্দিষ্ট দিনে পূর্বদিকের পাহাড়ি জঙ্গলের দিকে ওঁনারা সদলবলে যাত্রা শুরু করলেন। প্রাসাদে বেশ একটা আনন্দের পরিবেশ। দ্বিতলের অলিন্দে দাঁড়িয়ে দাদামশাই ওঁদের বিদায় দিলেন, তাঁর পাশে ছিলাম আমি। ওঁদের দলটা দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার পরেও দাদামশাই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, তাকিয়ে রইলেন পূবের আকাশের দিকে। রাজবৈদ্যমশাই কাছাকাছিই ছিলেন, তিনি সতর্ক করে বললেন, “রাজামশাই, এবার কক্ষে চলুন – অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন। এবার আপনার একটু বিশ্রাম প্রয়োজন”। দাদামশাই আমার হাতটা ধরে নিঃশব্দে নিজের কক্ষে গেলেন। শয্যাপ্রান্তে বসে আনমনে বললেন, “মনটা বড়ো কু গাইছে, বাবা ব্রজ, মনে হচ্ছে মৃগয়ার অনুমতি দিয়ে আমি ঠিক কাজ করিনি...”

আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “কেন দাদামশাই?”

দাদামশাই হাসলেন, ভীষণ ম্লান হাসি, বললেন, “কী জানি হঠাৎ মনে হল। তোমার অস্ত্রশিক্ষা, অধ্যয়ন কেমন চলছে ব্রজ? এতটুকু ফাঁকি দেবে না কিন্তু, একদিন তোমাকেই হয়তো এ রাজ্যের হাল ধরতে হবে...। তুমি এখন যাও, শিক্ষান্তে দ্বিপ্রহরে এস। আমি এখন একটু একা থাকতে চাই”।

অস্ত্রশিক্ষা বা অধ্যয়নে আমি যে সুবোধ বালক ছিলাম, তা নয় চণ্ডদাদা। মহারাজের প্রিয় দৌহিত্র বলে আমার গুরুদেবরা আমায় তেমন ভর্ৎসনা করতেন না এবং সেই সুযোগে আমি বিস্তর ফাঁকি দিতাম। কিন্তু সেদিন দাদামশাইয়ের ওই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মলিন অসহায় হাসিটুকু, আমার মধ্যে আশ্চর্য এক পরিবর্তন এনে দিল। ওই দিনের পর থেকে কোন শিক্ষাতেই আমি একদিনের জন্যেও ফাঁকি দিইনি”।

মাথা নীচু করে বজ্র অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ তুলে বলল, “দাদামশাইয়ের আশঙ্কাই সত্য হল। যাত্রা করার দশম দিনে বড়োমামা ফিরলেন - ঘোড়ার পিঠে নয় – আট বাহকের কাঁধে শিবিকায় চড়ে। মারাত্মক অসুস্থ। রাজবৈদ্য গম্ভীর মুখে পরীক্ষা করে বললেন, যুবরাজমশাইয়ের – বাউরু ভেঙেছে, পাঁজরের অস্থি ভেঙেছে দুটো বা তিনটে। মাথাতেও কিছু ক্ষত ছিল – কিন্তু সেগুলো তেমন গুরুতর নয়। বড়োমামার সুদীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক অসুস্থতার চিকিৎসা শুরু হল। রাজবৈদ্য বললেন, পায়ের হাড় জোড়া দেওয়ার উপায় আমার জানা আছে। কিন্তু পঞ্জরাস্থি জোড়া দেওয়ার কোন উপায় আমার জানা নেই। উপরন্তু আমার ধারণা ভাঙা পাঁজরের একটি বা দুটি হাড় যুবরাজমশাইয়ের ফুসফুসের ওপর চেপে বসেছে – অতএব শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে কোন রকম শ্রমসাধ্য কাজ তাঁর পক্ষে করা আর সম্ভব হবে না। শুয়ে বসে আরামে-বিশ্রামেই তাঁকে আজীবন থাকতে হবে”।

চণ্ড জিজ্ঞাসা করল, “এরকম ভয়ংকর দুর্ঘটনা কী করে হল?”

বজ্র বেশ কিছুক্ষণ চণ্ডর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী করে হল – আমাদেরও প্রশ্ন ছিল সেটাই। বিশ্বাসযোগ্য কোন উত্তর পাইনি। সেজমামা দাদামশাইকে বলেছিলেন, বড়মামার ঘোড়াটা নাকি আচমকা পাগল হয়ে গিয়েছিল। মৃগয়ার তৃতীয় দিন সকালে বড়োমামাকে পিঠে নেওয়ার ক্ষণকাল পরেই তাঁর ঘোড়াটি হঠাৎ ভীষণ চিৎকার করে, লাফিয়ে উঠে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে দৌড় দিয়েছিল জঙ্গলের পাহাড়ি পথে। লোকজন নিয়ে তার পিছু ধাওয়া করে প্রায় ক্রোশ দুয়েক দূরে বড়োমামাকে পথের ধারে একটা বড়ো পাথরের ওপর পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল – আর তার থেকে আরও কিছুটা দূরে পড়েছিল ঘোড়াটাও। তার সামনের ডান-পাটা ভেঙেছিল। বড়োমামাকে উদ্ধার করে রাজধানীতে ফিরে এসেছিল সবাই। আর ঘোড়াটাকে মেরে ওই জঙ্গলেই মাটিতে পুঁতে দিয়ে এসেছিল ওরা”।

বজ্র কিছুক্ষণ পরে বলল, “এর বছরখানেক পর দাদামশাই মারা গেলেন। বড়মামা রাজবংশের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং মহারাজের মনোনীত যুবরাজ হওয়া সত্ত্বেও, যেহেতু তিনি অসুস্থ - রাজ সিংহাসনে বঞ্চিত হলেন। মন্ত্রীসভার অনুমতি নিয়ে সিংহাসনে বসলেন সেজমামা। সিংহাসনে বসে সেজমামা, বড়োমামাকে পাঠিয়ে দিলেন এই পশ্চিমের বিষয়াধিপতি করে। তাঁর সঙ্গে এলাম আমিও। সেও আজ হয়ে গেল প্রায় বছর আষ্টেক। বছর পাঁচেক আগে বিজুমামা – বড়োমামার নিজস্ব অনুচর, দীর্ঘদিন মামার দেখাশোনা করছেন। বড়োমামাকে শ্রদ্ধাভক্তি করেন এবং ভালোবাসেন নিজের ছোট ভাইয়ের মতো। আমাকে একদিন ডেকে গোপনে বলেছিলেন, বড়োরাজাবাবুর দুর্ভাগ্যটা কোন দুর্ঘটনা নয় বজ্রবাবা। গভীর ষড়যন্ত্র। জঙ্গলে ঝোপের মধ্যে আমি যখন ঘোড়াটাকে পড়ে থাকতে দেখি – যন্ত্রণায় ছটফট করছিল ঘোড়াটা – চিৎকার করছিল বারবার। ঘোড়াটার পাছার কাছে প্রায় আমূল বিঁধে ছিল একটা নারাচ। সেজোরাজার বিশ্বস্ত রক্ষীরা ঘোড়াটাকে মেরে ফেলার পর, ওই নারাচটা বের করতে গিয়ে হাতে ছ্যাঁকা খেয়েছিল, মোটা কাপড় দিয়ে চেপে ধরে টেনে বের করেছিল নারাচটা। বুঝতে পারছো ব্রজবাবা, কোন প্রাণীর শরীরে যদি চরম উত্তপ্ত লোহার তির বিঁধিয়ে দেওয়া যায় – সে পাগল হবে না? যতই না সে বড়োরাজার স্নেহের বিশ্বস্ত ঘোড়া হোক!”  

প্রথম পরিচয়েই ছোকরাকে বেশ ভালো লেগে গেল চণ্ডর। সুদর্শন শালপ্রাংশু শরীর, চোখদুটোতে মায়াময় স্বপ্ন আছে। কথা একটু বেশিই বলে কিন্তু বাচাল নয়, আবার দেমাকিও নয়। ছোকরার মনটা পাহাড়ি তটিনীর মতো, স্বচ্ছতোয়া এবং খরস্রোতা। সমতলের নদীর মতো ভাবগম্ভীর বিস্তৃত ঘোলাজলে আপাত ধীরস্রোতের তলায় বিপজ্জনক চোরাস্রোত-প্রবাহিনী নয়।

একটু সময় নিয়ে চণ্ড বলল, “একটা কথা - আপনার নাম বললেন ব্রজাংশু, ডাকনাম ব্রজ। অথচ আমরা আপনার নাম শুনে এসেছি বজ্র। আমরা কি ভুল শুনেছিলাম”।

বজ্র হেসে বলল, “না ভুল শোনেননি। প্রাসাদে আমার নাম ব্রজ – কিন্তু প্রাসাদের বাইরে মাঠে ঘাটে প্রান্তরে সকলেই আমাকে বজ্র বলেই ডাকে। এই নামটাই আমার প্রিয় কারণ এ নামে আমায় যারা ডাকে তারাই আমার বন্ধু – তারাই আমার সহযোদ্ধা। এদের ভরসাতেই আমি আমার পরিকল্পনা মতো এগিয়ে চলেছি”।

“কী পরিকল্পনা? বর্তমান রাজা, আপনার সেজমামাকে সিংহাসনচ্যুত করে, বড়োমামাকে সিংহাসনে বসানো?”

“বড়োমামার স্বাস্থ্যের যা অবস্থা, রাজ্যভার কাঁধে নেওয়ার সাধ্য তাঁর আর নেই। সিংহাসনে আমিই বসব, বড়োমামা হবেন আমার অভিভাবক”।

“পারবেন? রাজার সঙ্গে মন্ত্রণা দেওয়ার জন্যে এত মন্ত্রী, সেনাধ্যক্ষ রয়েছেন। অতি দক্ষ শত শত সেনা রয়েছে। রাজকোষে রয়েছে প্রচুর সম্পদ। সেই বিপুল শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করে পারবেন?”

“বিপুল এই শক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ তো আমি করব না, চণ্ডদাদা? সে কথা মনেও আনি না। প্রথমে এই বিষয়টুকু ধীরে ধীরে আমি আয়ত্তে আনতে চাই

“কী করে? এই বিষয়টিও তো আপনার সেজমামার রাজ্যাধীন। এখানে কোন বিশৃঙ্খলা হলে, আপনার সেজমামা চুপ করে বসে থাকবে?”

বজ্র একটু চিন্তা করে বলল, “আমাদের এই বিষয়ের মোট পাঁচটি ভূক্তিতে আস্থান আছে। সেই আস্থানগুলি আমার সেনাদল বারবার লুঠ করবে এবং রাজরক্ষীদের হত্যা করবে। যেভাবে ভল্লাদাদা আপনাদের রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তের আস্থানটিকে জয় করেছিলেন। এবং ভল্লাদাদার পরামর্শে যেভাবে পাশের রাজ্যের বটতলির ছেলেরা তাদের রাজ্যের দুটি আস্থান আক্রমণ করেছে। শুনেছি ভল্লাদাদাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি থাকলে তাঁর সাহায্যে আমার দলটিকে খুব তাড়াতাড়ি তৈরি করে ফেলতে পারতাম...”। একটু থেমে আবার বলল, “আচ্ছা, সত্যিই কি তাঁর মৃত্যু হয়েছে? অনেকে বলে, তাকে মারতে পারে এমন কোন বাপের বেটা নাকি এখনও জন্মায় নি? তিনি বেঁচে আছেন তো বটেই এবং গোপনে প্রস্তুত হচ্ছেন, আরো বড়ো কোন আঘাত হানার জন্যে। শুনেছি, আপনাদের রাজধানী কদম্বপুর থেকে নির্বাসনের সময়, তাঁর ওপর বীভৎস নির্যাতন করা হয়েছিল। সে সময়েই যখন তিনি মারা যাননি, অত সহজে তাঁর মৃত্যু হতেই পারে না। এই কারণেই তাঁর মৃত্যুর সংবাদটাই নাকি একটা লোকশ্রুতি রটনা?”

চণ্ড শান্ত ধীর স্বরে উত্তর দিল, “ভল্লা আমাদের সহকর্মী ছিল। তার সঙ্গে আমাদের দুজনার – আমার ও মারুলার – যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতাও ছিল। কিন্তু ভল্লার যে মৃত্যু হয়েছে – এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই”।

উভয়পক্ষই নীরব রইল কিছুক্ষণ। একটু পরে চণ্ড বলল, “আমাদের থেকে অস্ত্র-শস্ত্র সম্ভার ছাড়া আর কী কী সাহায্য আশা করছেন”।

“বাঃ সাহায্য মানে সব ধরনের সাহায্য। আমার সঙ্গীদলকে নিয়মিত মহড়া দিয়ে বলিষ্ঠ সেনাদল বানিয়ে তুলতে হবে। শুধু যুদ্ধ করা শিখলেই তো হয় না, যুদ্ধ করার নানান কৌশলও শেখাতে হবে। আমাদের এদিকে প্রচুর নদী-নালা-বিল-জলাভূমি সে তো আপনি জানেনই। সেই সমস্ত বাধা-বিপত্তি দ্রুত অতিক্রমের দক্ষতাও তাদের অর্জন করতে হবে। এক কথায় - আমার স্বপ্ন আমার সেনাদল যেন রাজধানীর সেনাদলের সঙ্গে সমানে সমানে যুঝতে পারে”।

বজ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে চণ্ড খুব মন দিয়ে তার কথা শুনছিল, বলল, “আপনার দলে এখন কতজন মানুষ আছে?”

“আপাততঃ প্রায় শ দুয়েক – আরও শ’ চারেক মানুষ আমি ডাক দিলেই যে কোনদিন চলে আসবে”।

“এত লোকের মহড়া ক্ষেত্র কোথায় করবেন – আপনার কিংবা আমাদের রাজ্যসীমার ভিতরে তো করা যাবে না”।

“না তো – দু রাজ্যেরই সীমার বাইরে যে নিরপেক্ষ জঙ্গল সেখানেই বানাচ্ছি। আজ আর সম্ভব নয়, বেলা পড়ে এল, কাল সকালে চলে আসুন না – আপনাকে সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব। অস্ত্রাগার বানাচ্ছি – আমার দলের ছেলেদের থাকার জন্যে প্রচুর ঘর তুলছি। তাদের থাকা -খাওয়ার কোন অসুবিধা যাতে না হয় তার জন্যে বড়ো বড়ো শস্য ভাণ্ডার বানাচ্ছি...”। একটু হেসে বজ্র আরও বলল, “মাস দুয়েক আগে আপনাদের রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত এবং নোনাপুর ও সুকরা গ্রাম আমি দেখে এসেছি। আপনারা চেনেন কিনা জানি না, এ রাজ্যের রামালি, আর রাজ্যের বটতলি গ্রামের মিলা ও জনা,  ওদের সবার সঙ্গেই আমি আলাপ করে এসেছি

চণ্ড হেসে বলল, “বাঃ তাহলে তো অনেক কাজই এগিয়ে রেখেছেন”।

“হ্যাঁ। রামালির সঙ্গে আমি কথা বলে জেনেছি – ওর দল থেকে অন্ততঃ দশজন ছেলেকে ও পাঠাতে পারবে – যারা আমার ছেলেদের মহড়া দেবে। বলেছে, পঞ্চাশ জনের এক একটা দল গড়ে নিয়ে মহড়া শুরু করলে কাজটা সহজ হবে। কিন্তু আপনাদের রাজধানী থেকে ও নির্দেশ না পেলে কোন লোকই পাঠাতে পারবে না। আপনারা রামালিকে চেনেন না?”

“না, নাম শুনেছি - চিনি না। কিন্তু ও কি ওই দশ জন ছেলের মাসোহারা কত দিতে হবে কিছু বলেছে?”

“না তা বলেনি – বলেছে, ওসব যা ঠিক করার রাজধানী থেকেই করবে। আচ্ছা, ভল্লাদাদা যেমন সবকিছুতেই চূড়ান্ত দক্ষ ছিল শুনেছি – রামালির ছেলেদের নিশ্চয়ই সেই দক্ষতা হবে না। আপনাদের মধ্যে কেউ যদি – মানে আপনাদের রাজধানী থেকে বলেছিল – আপনারাও নাকি ভল্লাদাদার থেকে কোন অংশে কম নন…”।

“ঠিক কিসের দক্ষতা বলছেন বলুন তো?”

“এই যেমন ভল্ল, বল্লম, তির ছোঁড়ার দক্ষতা। কিংবা রণপা এবং ঘোড়ায় চড়ার দক্ষতা…। অথবা একটা দলকে পরিচালনা করার – সঠিক পরিকল্পনা করে একটা আক্রমণকে নিখুঁত সফল করে তোলা…মানে সত্যিকারের একজন সেনাধ্যক্ষের যা যা দক্ষতা প্রয়োজন…”।

“ভল্লা যে আমাদের মধ্যে সেরা যোদ্ধা ছিল, ও বেঁচে থাকতে সে কথা কোনদিন স্বীকার করিনি। কিন্তু এখন ও আর নেই – অতএব আজ সে কথা মেনে নিতে আমাদের কোন বাধা নেই”।

“আপনারা কি ভল্লাদাদাকে ঈর্ষা করতেন?”

চণ্ড বজ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “হয়তো। শুধু দক্ষতাকে নয় ওর জনপ্রিয়তাকেও। একজন নির্বাসন দণ্ড পাওয়া অপরাধী তার প্রতি জনগণের কেন এত ভক্তি? আপনি এখন রাজাসনে নেই, কয়েকবছর পর আপনি আশা করি রাজা হবেন, একজন অপরাধীর এত জনপ্রিয়তা  আপনি কি তখন ভালো চোখে দেখবেন”?

“কিন্তু ভল্লাদাদা তো অপরাধীই নয়। রাজার একজন দুশ্চরিত্র আত্মীয়কে ভল্লাদাদা প্রথমে সতর্ক করেছিল, তারপরেও সে শুধরে না যাওয়ায় তার শল্য চিকিৎসা করে তাকে উচিৎ সাজা দিয়েছে। কোন ভাবেই আমি ভল্লাদাদাকে অপরাধী বলে মনে করতে পারছি না”।

“দেখুন আমরা সকলেই রাজার সেবক মাত্র – রাজার আদেশ বা নির্দেশ ছাড়া কোন কাজই আমাদের করণীয় নয়। তার অন্যথা যে করবে, সে অপরাধী বৈ কি!”

অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না, বজ্র খুব মন দিয়ে বারবার দেখতে লাগল চণ্ড এবং মারুলার মুখ। সামান্য অস্বস্তি নিয়ে চণ্ড উঠে দাঁড়াল, বলল “আমরা আজ তবে চলি বজ্রভাই, রাজধানী থেকে অস্ত্রশস্ত্র পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে। রামালির কাছেও বার্তা পাঠাতে হবে যত দ্রুত সম্ভব দশ-বারো জন ভালো দক্ষ ছেলে যেন পাঠায়…আরো কিছু প্রয়োজনীয় কাজ…”।

বজ্র উঠে দাঁড়িয়ে হাসল, বলল, “ঠিক আছে। এখন তুমি এস। কিন্তু কাল থেকেই তুমি এবং মারুলাদাদা আমাদের ছেলেদের মহড়া শুরু করে দাও না, ভল্লাদাদা”।

চণ্ড কোন উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইল বজ্রের চোখের দিকে। মারুলা অবাক স্বরে বলল, “ও তো চণ্ড, ভল্লা তো মারা গেছে বেশ ক মাস হল”।

বজ্র বলল, “আমাকে ফাঁকি দিতে পারোনি ভল্লাদাদা। এতক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলেই আমার মনে হচ্ছিল আমি এক অসাধারণ প্রাজ্ঞ যোদ্ধার সঙ্গে কথা বলছি। সে লোকটি ভল্লাদাদা ছাড়া আর কে হবে? আগেই বললাম তোমাদের পশ্চিম সীমান্তে গিয়ে বহু মানুষের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তারা সকলেই তোমার মৃত্যুতে একদিকে অত্যন্ত হতাশ এবং অন্যদিকে সন্দিগ্ধ – সত্যিই তুমি মারা গেছ কিনা। কিন্তু নোনাপুর গ্রামে চারজনের সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝেছি – তুমি মারা যাওনি…”।

চণ্ডর মুখে মৃদু হাসি, কোন কথা বলল না। মারুলা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তারা কারা?”

বজ্রও হাসল, “ভল্লাদাদার মৃত্যুতে সব থেকে বেশি ভেঙে পড়ার কথা ছিল যে চারজনের – কমলিমা, রামালি, কুসিবোন আর আহোক। ওরা আমার সামনে হাহুতাশ করছিল বারবার …কিন্তু সে হুতাশে কোন আন্তরিকতা ছিল না – কারণ ওরা জানত – ভল্লাদাদা সুস্থ শরীরেই বেঁচে আছে… এবং ওদের সকলের আশীর্বাদে আরও বহুদিন বেঁচে থাকবে। ওরা বিশ্বাস করে – মেকি মড়াকান্নার বাড়াবাড়ি একজন জীবন্ত মানুষকেও অসুস্থ করে তুলতে পারে…তোমাকে ওরা এতটাই ভালোবাসে, ভল্লাদাদা”।

চণ্ড হেসে বলল, “আপনার শালীনতা ও বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হলাম, রাজা ব্রজাংশু। আপনার হাতেই দুরাত্মা সেজমামার পরাভব ঘটবে – এ আমি নিশ্চিত দেখতে পাচ্ছি। এবং কথা দিচ্ছি, আমাদের পক্ষ থেকে সমস্ত সাহায্যই আপনি পাবেন। কিন্তু আমি ভল্লা হয়েও এখন আর ভল্লা নই, আমি এখন চণ্ড। প্রশাসনিক কারণে ভল্লার মৃত্যু ঘটেছে – তাকে বাঁচিয়ে তুলে চণ্ডকে বিপন্ন করবেন না”।

বজ্র হাসল, বলল, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন চণ্ডদাদা – আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না”।

 

বজ্রর থেকে বিদায় নিয়ে চণ্ড আর মারুলা রণপা চড়ে রওনা হল, তাদের নিকটবর্তী আস্থানের দিকে। এক সময় মারুলা বলল, “এভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিপ্লব হতে হতে সব রাজ্যেই বেশ একটা সাম্য সুন্দর পরিস্থিতি চলে আসবে – কী বল, চণ্ড? সিংহাসনে বসা রাজারা অত্যাচার অবিচার করার আগে দশবার ভাববে”।

চণ্ড হাসল, বলল, “ছাই হবে। একবার যে ক্ষমতায় বসতে পায়, সে চিরকাল সেই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায়। সেই ক্ষমতার দম্ভ এবং লোভ তাকে অত্যাচারের পথে টেনে নিয়ে যাবে – যাবেই। আর তাকে সিংহাসন থেকে টেনে ধুলোয় নামানোর জন্যে বিপক্ষ মানুষ বিপ্লব করবে। বারবার – চিরকাল। বিপ্লব চলবে...রমরমিয়ে বাড়বে অস্ত্র-শস্ত্রের ব্যবসা। এর থেকে বিশ্বের কোন দেশের কোন রাজ্য কোনোদিন মুক্তি পাবে না। আমাদের সভ্যতা যতদিন থাকবে, এ আগুন নিভেও নিভবে না – কোথাও না কোথাও জ্বলতেই থাকবে...”। একটু থেমে চণ্ড হাসতে হাসতে আবার বলল, “তোর বা আমার এবং আমাদের ছেলেপুলেদেরও কাজের অভাব কোনদিনই হবে না, নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস – সে রাজ্যের রাজা যিনিই থাকুন”।

মারুলা বলল, “ঠিক বুঝলাম না। ধরা যাক এ রাজ্যের রাজা হল এই রাজবংশেরই ছেলেপুলে নাতিদের কেউ – সেক্ষেত্রে তোর কথামতো আমাদের অবস্থান একই থাকবে। কিন্তু অন্য রাজ্যের রাজা অথবা এ রাজ্যেরই কোন বিপ্লবী নেতা যদি রাজার সিংহাসনে  বসে? তখন? সে আমাদের পাছায় লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়ে তার নিজের লোকদের বসাবে না? সে রাজা আমাদেরকে বিশ্বাস করবে?”

চণ্ড বলল, “বিশ্বাস না করে যাবে কোথায়? নতুন কোন রাজা যুদ্ধ জয় করে সিংহাসনে বসলে, একথা ঠিক, সে প্রশাসনের মাথাগুলোকে -  মানে মন্ত্রীদের - ছেঁটে ফেলে তার মনোমত লোককে মন্ত্রীর পদে বসাবে। কিন্তু তার নীচের স্তরে থাকা প্রশাসনিক লোকদের গায়ে হাতও দেবে না। নতুন রাজা হুট করে অত লোক পাবে কোথায়? আর পেলেও এই রাজ্যের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের খুঁটিনাটি বিষয় তারা জানবে কিংবা বুঝবে কী করে? অতই সহজ নাকি? জেনে রাখবি, নতুন রাজা এলে প্রশাসনের মাথাগুলো অবশ্যই কাটা পড়বে – কিন্তু ধড় থেকে পা পর্যন্ত গোটা শরীরটাকে সে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখবে। কারণ এ ছাড়া তার অন্য কোন উপায় নেই”।

“বুঝলাম। কিন্তু আমরাই বা নতুন রাজার হয়ে কাজ করব কেন? আমরা তো আমাদের বর্তমান রাজার বিশ্বস্ত অনুচর। আমাদের রাজা পদচ্যুত হওয়ার পর – আমরা যদি অন্য রাজার হয়ে কাজ করি – আমরা কি বিশ্বাসঘাতক হয়ে উঠবো না? সেটা কি উচিৎ হবে?”

চণ্ড হেসে ফেলল, তারপর বলল, “তুই ঠিক কার প্রতি বিশ্বস্ত এ কথা কোনদিন ভেবে দেখেছিস, মারুলা? আমরা তো কেউই রাজাকে চিনি না – কোন রকম ব্যক্তিগত পরিচয় নেই – অচেনা, অপরিচিত একজন মানুষের প্রতি, আমরা সত্যিই কি বিশ্বস্ত? নাকি আমরা এই রাজ্যের প্রতি বিশ্বস্ত? রাজ্য মানে যদি কিছু নগর, কিছু জনপদ আর অজস্র গ্রামের সমষ্টি হয়। তার সঙ্গে থাকবে জল-জঙ্গল-পাহাড়-নদী আর বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্র। তাই না? এই রাজ্যের প্রতি আমরা বিশ্বস্ত – কথাটা কেমন কেমন শোনাচ্ছে না? হাস্যকর মনে হচ্ছে না?”

ওফ্‌, এমন সব কথা বলিস না তুইশালা আমার মাথাটাই খারাপ করে ছাড়বি”।

মুচকি হেসে চণ্ড বলল, “দাঁড়া দাঁড়া তোর মাথা খারাপ তে এখনও একটু বাকি আছে, পুরোটা শুনলে তোর মাথাটা সম্পূর্ণ খারাপ হবেসত্যি বলতে আমরা সকলেই নিজ-নিজ সংসার-পরিবারের প্রতি বিশ্বস্ত। আমাদের নিয়মিত নিশ্চিন্ত উপার্জনের প্রতি আমরা বিশ্বস্ত। রাজধানী এবং প্রশাসনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার কারণে কিছুটা প্রতিপত্তি উপভোগ এবং তার ফলে উপরি কিছু সুযোগ-সুবিধে লাভের প্রতি আমরা বিশ্বস্ত। আমাদের এই বিশ্বস্ততা অটুট থাকলে – আমরা রাজ্যের প্রতি তো বটেই – যে কোন রাজার প্রতিও সর্বদা বিশ্বস্ত থাকব। আমাদের এই সকল বিশ্বস্ততায় যদি কোনভাবেই  হাত না পড়ে – তাহলে রাজার সিংহাসনে কখন কে বসল। কিংবা কখন কে উলটে গেল – তাতে কিছু কী যায় আসে আমাদের? আর আমাদের এই প্রভাব-প্রতিপত্তির সুবিধায় যদি কোনদিন টান পড়ে, বিপ্লবী হয়ে উঠতে আমাদের কতদিন লাগবে”?

মারুলা কিছু বলল না, মাটির দিকে তাকিয়ে পথ চলতে লাগল।

শেষ শরতের দিন ছোট হয়ে এসেছে অনেক। সূর্য এখন অস্তাচলে – শিরশিরে উত্তুরে হাওয়ায় জুড়িয়ে যাচ্ছে পথচলার সব ক্লান্তি। তাদের আস্থান এখনও ক্রোশ খানেক দূরে।  


সমাপ্ত    


এই উপন্যাসটি সম্পূর্ণ পড়তে হলে, এই লিংকে গিয়ে প্রথম পর্ব থেকে শুরু করুন - ] 

                        

    

নতুন পোস্টগুলি

চ্যালেঞ্জ - নাটক

  কুশীলব   (মঞ্চে প্রবেশের ক্রম অনুসারে)   প্রাণপণবাবু                       কমলা – প্রাণপণবাবুর স্ত্রী                  প্রতাপ – প্...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ