Powered By Blogger

বুধবার, ২১ মে, ২০২৫

অদ্বিতীয়া

 [দিল্লির "কলমের সাত রঙ" পত্রিকার বৈশাখী সংখ্যায় প্রকাশিত] 

 

চেতলা অহীন্দ্র মঞ্চের উল্টোদিক থেকে রোজকার মতোই “চেপে পড়ো” অ্যাপের নির্দিষ্ট গাড়িতে উঠল মঞ্জরী। গাড়িতে উঠতেই গুরপ্রীত কওর মিষ্টি হেসে তাকাল, বলল, “গুড মর্নিং, মঞ্জু”। মঞ্জরীও উত্তরে বলল, “ভেরি গুড মর্নিং”। মঞ্জরী গাড়ির দরজা বন্ধ করে বেল্ট লাগাতেই, সামনে পাছা বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অটোটাকে পাশ কাটিয়ে গুরপ্রীত গাড়ি চালিয়ে দিল। মঞ্জরীর মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলল, “কীরে, আজ কি মুড অফ নাকি, মুখটা গোমড়া করে রয়েছিশ যে?”

মঞ্জরী হেসে উত্তর দিল “কোথায় মুখ গোমড়া? কিছুই হয়নি”!

গুরপ্রীত থাকে নিউ আলিপুরের বি ব্লকে, আর তার অফিস নিউ টাউনে। এতটা দূরত্ব বাসে-টাসে গুঁতোগুঁতি করে রোজ অফিসে যাওয়া এবং ফেরা তার পোষাচ্ছিল না। তাই বাবার গাড়িটা সে নিজেই ড্রাইভ করে যাওয়া-আসা করছিল। কিন্তু এতটা পথ মুখ বুজে প্রত্যেকদিন গাড়ি চালিয়ে যাতায়াত করাও তো বেশ বিড়ম্বনার ব্যাপার। তাই সে “চেপে পড়” অ্যাপে রেজিস্টার করে তিনজন সহযাত্রিনী যোগাড় করে ফেলেছে। চারজনে গল্প করতে করতে জার্নি-টাইমটা দিব্যি কেটে যায় – আবার তেলের খরচা আর গাড়ি সার্ভিসিংয়ের পয়সাও উঠে আসে। মঞ্জরী ওঠে চেতলায়, সহেলি ওঠে গড়িয়াহাট থেকে, আর সিক্তা ওঠে কসবা মোড় থেকে। গুরপ্রীতের মাতা বঙ্গবালা এবং পিতা শিখ সর্দারজি। ইংরিজি, গুরুমুখী, পাঞ্জাবি, হিন্দী ও বাংলা অনর্গল বলতে পারে। বাংলায় তো অসম্ভব দখল, শুধু একটাই দোষ গুরপ্রীতের – ওর উচ্চারণে স নেই শবই শ।

রাসবিহারী মোড়ের সিগন্যালটা খেয়ে গাড়ি থামাল, তারপর মঞ্জরীর কথার উত্তরে গুরপ্রীত বলল, “কিছুই হয়নি বললে হবে? পতিদেবের সঙ্গে কিংবা শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে কিছু একটা খিটিমিটি তো নিশ্চিত হয়েছে”।

মঞ্জরী বলল, “না রে বাবা, সে সব কিছু না। বাই দা ওয়ে আমি কিন্তু ফেরার সময় তোর সঙ্গে ফিরব না। অফিস থেকেই সোজা মানিকতলা মায়ের কাছে যাব”।

সিগন্যাল খুলে যাওয়াতে, গুরপ্রীত গাড়ি স্টার্ট করে ফার্স্ট গিয়ার ফেলতে ফেলতে জিজ্ঞাসা করল, “এনি থিং রং? বাবা-মার শরীর খারাপ হয়নি তো?”

“না, না। ওঁদের শরীর ঠিক আছে। অনেকদিন যাওয়া হয়নি – তাই ভাবলাম কটা দিন থেকে আসি মায়ের কাছে...”।

“একদম খালি হাতে? কোন ব্যাগ-ট্যাগ নিসনি?”

“টুকটাক কিছু আমার এই ব্যাগেই নিয়ে নিয়েছি...আর কাপড়চোপড় মায়ের কাছে রাখাই থাকে...ও নিয়ে কোন চাপ নেই”।

“ওক্কে। যাই বলিস, তুই কিন্তু আসল ব্যাপারটা চেপে গেলি। আমাকে বললি না”।

মঞ্জরী কিছুক্ষণ চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে রইল, তারপর লেকমলের হাল্কা সিগন্যালটা পার করে বলল, “সকালে ছোট্ট একটা ব্যাপারে মা এমন রিয়্যাক্ট করলেন, জাস্ট ভাবা যায় না”।

“কোন মা, শাশুড়ি মা? তুই যে বলিস তোর শ্বশুর শাশুড়ি খুব ভাল – তোকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন?”

“সেটাই। মেয়ের মতো – আর নিজের মেয়ের মধ্যে কিছুটা ফারাক হয়তো থেকেই যায়। ব্যাপারটা এতই সামান্য, এখনও চিন্তা করলে অবাক লাগছে”। মঞ্জরী একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, “অফিসের জন্যে রেডি হয়ে পথিক আর আমি টেবিলে খেতে বসেছিলাম, মা খাবার সার্ভ করছিলেন। হঠাৎই আমার হাতে লেগে কাচের গেলাসটা টেবিল থেকে পড়ল - ভেঙে চুরমার – মেঝেয় জল থৈ থৈ। তাড়াহুড়োর সময় মেঝেয় ভাঙা কাচ, ছড়িয়ে পড়া জল ... খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার”।

দেশপ্রিয় মোড়ের সিগন্যালটাও খেয়ে গেল গুরপ্রীত, বলল “ধ্যাত্তেরিকা...দুটো সেকেণ্ডের জন্যে... যাগ্‌গে, তারপর?”

“ভাঙা কাচ আর জলটা মুছে নেওয়ার জন্যে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাব...মা রীতিমতো ঝংকার তুলে বললেন, থাক থাক বৌমা, আমি দেখছি... খাওয়া ছেড়ে উঠে তোমাকে আর কাজ দেখাতে হবে না...তারপর প্লেটে ভাত আর তরকারি দিতে দিতে বললেন, কদিনের জন্যে তুমি বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে এস বৌমা। বুঝতে পারছি তুমি খুব প্রেসারে আছ। আজই সন্ধেবেলা অফিস থেকে চলে যাও – কদিন ওখানে থেকে মাথাটা ঠাণ্ডা করে এস”।

“তোকে নাম ধরে ডাকেন আর “তুই” বলেন – বলেছিলি না?”

“হ্যাঁ তাই বলেন, কিন্তু কোন কারণে বিরক্ত হলে বৌমা আর “তুমি” বলেন”।

সিগন্যাল খুলতে গুরপ্রীতের গাড়ি আবার গড়াতে লাগল, গাড়ি থার্ড গিয়ারে তুলে বলল, “হুম। বুঝলাম, তারপর? তুই কিছু বললি না?”

“নারে, ব্যাপারটা এতটাই আচমকা ঘটে গেল, আমি মাথা নিচু করে ভাত নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে, উঠে পড়লাম। ওই সময় আমি যদি কিছু বলতাম, ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে উঠত...”।

“তা ঠিক, পথিকও কিছু বলল না?”

“নাঃ, কিচ্ছু না। আমার দিকে খুব সহানুভূতি মাখা দুঃখীদুঃখী মুখে তাকাচ্ছিল বারবার”। গুরপ্রীতের হাসি পেলেও হাসল না, গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। লেক ভিউ রোডের সিগন্যালটা নির্বিঘ্নে পেরিয়ে – ট্রাঙ্গুলার পার্কের সিগন্যালে আবার আটকে গেল।

মঞ্জরী আবার বলল, “আমরা বাড়ি থেকে বেরোনর সময়ে মা আবার বললেন, অন্যভাবে নিস না, মা। কদিন ও বাড়ি থেকে ঘুরেই আয়। আজ শুক্রবার, মঙ্গলবার ফিরে আসিস - আর ওই দিন অফিসে ছুটি নিয়ে নিস, কিন্তু। যা বললাম, তার যেন নড়চড় না হয়, আমার কথার অবাধ্য হবি না”।

গুরপ্রীত মঞ্জরীর মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে দেখল, তারপর সিগন্যাল খুলতে গাড়ি স্টার্ট করে বলল, “ বেরোনর সময় আবার “তুই” বললেন? আশ্চর্য তো?”

“হ্যাঁ”।

“দেখ মঞ্জু, গড়িয়াহাটে সহেলি ওঠার আগেই আমি এই প্রসঙ্গটা ক্লোজ করতে চাই। ওদের সামনে এসব আলোচনা না করাই ভাল। তবে আমার কেমন খটকা লাগছে, মঞ্জু, উনি তোর ওপর মোটেও বিরক্ত হননি। অন্য কিছু ব্যাপার আছে”।

“কে জানে? জানি না। রাস্তায় বেরিয়ে পথিক বলল, মায়ের কথায় ও খুব বিরক্ত হয়েছে... এ কটা দিন ও আমার সঙ্গেই থাকবে”।

গুরপ্রীত হেসে বলল, “ওয়াও। আমি শিয়র এসবের পেছনে দারুণ একটা প্ল্যান আছে – তোর জন্যে সারপ্রাইজ”।

“তোর তাই মনে হচ্ছে?” মঞ্জরী ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল গুরপ্রীতের দিকে।

“গড়িয়াহাট এসে পড়েছি, এখন এসব কথা থাক। তবে যা বুঝলাম, কাল, সোম আর মঙ্গল তোর সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। দেখা হবে সেই বুধবার...। সহেলি গাড়ির দিকে এগিয়ে এল, গুরপ্রীত এবং মঞ্জরী একই সঙ্গে বলে উঠল, “হাই সহেলি, গুড মর্নিং”।

 

সন্ধে সাড়েসাতটা নাগাদ মঞ্জরী পথিকের সঙ্গে মানিকতলায় তার বাপের বাড়ি পৌঁছল। ওদের দুজনকে একত্রে দেখে মঞ্জরীর মা প্রীতমা একটু আশ্চর্য হয়েই বললেন, “ওমা, কোন খবর না দিয়ে দুটিতে এসে উপস্থিত হলি? আয়, আয় ভেতরে আয়, খবর-টবর সব ভালো তো?”

মঞ্জরী বসার ঘরের সোফায় বসে বলল, “তোমার কাছে থাকতে এলাম। কাজের চাপে আমার হাতপা নাকি বশে নেই। তাই ওবাড়ির মা এখানে পাঠালেন কটা দিন রিল্যাক্স করে যেতে।”

প্রীতমাদেবী আরও অবাক হলেন, “সে আবার কি? নিশ্চয়ই কিছু ঘটিয়েছিস – বাবা পথিক, কী ব্যাপার বলো তো? তোমার মা অকারণে এরকম বলার মানুষ তো নন?”

পথিক মঞ্জরীর পাশেই বসেছিল, বলল “আজ সকালে খাবার টেবিলে মঞ্জুর কনুই লেগে একটা কাচের গ্লাস ভেঙে গেছে... সেই সময়েই...”।

প্রীতমাদেবী কী বলবেন ভেবে পেলেন না, মেয়ে জামাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “যাগ্‌গে, মঞ্জরী পথিককে নিয়ে তোর ঘরে যা, অফিসের জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেস হয়ে আয়, তারপর সব কথা শুনব। এখন তোদের জলখাবারের যোগাড় দেখি। এদিকে তোর বাবা একবার বেরোলে আর ফেরার নাম করে না। জামাই এসেছে... আর তিনি এখন বন্ধুদের সঙ্গে...যা ওঠ - ঘরে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নে”।

মঞ্জরী আর পথিক উঠে ভেতরে গেল, প্রীতমাদেবী ফোন তুলে কর্তাকে ধরলেন, “শুনছো, মঞ্জু আর জামাই এসেছে, আড্ডা ছেড়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি এস – কথা আছে। আর ফেরার সময় কিছু মিষ্টি-টিষ্টি – চিকেন-টিকেন নিয়ে এস”। ফোন বন্ধ করে তিনি রান্নাঘরে গেলেন।

গিন্নির ফোন পাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন অতনুবাবু। ঘরে ঢুকতেই তাঁর নাকে এল লুচিভাজার গন্ধ। ইদানীং তাঁর লিপিড প্রোফাইল আর বিপি সামান্য বিশ্বাসঘাতকতা করায় – ও জিনিষ তাঁর গালের নাগালে আর আসে না। বাইরের ঘরে জুতো ছেড়েই তিনি সরাসরি রান্নাঘরে ঢুকে দেখলেন, গিন্নি বেজায় ব্যস্ত। প্রতিমা লুচি বেলছে আর প্রীতমা গরম তেলে লুচি ছাড়ছেন। পাশে একটা থালায় বড়ো বড়ো বেগুনের টুকরো নুন আর হলুদ মেখে হাসছে। অতনুবাবু অন্ততঃ চারটে লুচি উইথ দুপিস বেগুনভাজার আশায় বুক বেঁধে খুব নরম সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, “মঞ্জুরা এমন হঠাৎ করে চলে এল, তোমায় আগে ফোন করেনি?”

প্রীতমা গরম তেল থেকে লুচি তুলতে তুলতে বললেন, “হাত চালা প্রতিমা, এর পরে আবার বেগুন ভাজতে হবে। একবার ফোন করলে এত হুটোপাটি করতে হত? সব যোগাড় করে রেখে দিতাম”। শেষ কথাগুলি তিনি অতনুবাবুকে বললেন।

“হুঁ। কী ব্যাপার কিছু বুঝলে? মঞ্জু তো এমন করে না!”

“ঠিক বুঝলাম না। জামাই বলল, আজ সকালে খেতে বসে মঞ্জুর হাত লেগে নাকি একটা কাচের গ্লাস ভেঙেছে। তাতেই বিরক্ত হয়ে বেয়ান মঞ্জুকে খুব বকাবকি করেছেন, আর বলেছেন, কটা দিন বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে এস, বৌমা”।

অতনুবাবু মিষ্টির বাক্সদুটো ফ্রিজের মাথায় রেখে, প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে চিকেনটা বের করে একটা বড় বাটিতে ঢালতে ঢালতে বললেন, “তেলের শিশির জায়গায়, জলের গেলাস?”

প্রীতমাদেবী বললেন, “সে আবার কি?”

“কেন শোননি? তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর ওপর রাগ করো? অন্নদাবাবু সেখানে ভারত ভাঙার কথা বলেছিলেন, কিন্তু এখানে যে পরিবার ভাঙার উপক্রম?”

“যাঃ ও আবার কী অলক্ষুণে কথা বলছ? বেয়ান আমাদের তেমন লোকই নন। আমাদের মঞ্জুই কিছু একটা বড়ো গণ্ডগোল বাধিয়েছে”।

“উঁহু, তাহলে পথিককে সঙ্গে নিয়ে এসে পড়ল কেন? ব্যাপারটা অত সহজ আর সিম্পল নয় মনে হচ্ছে”!

“কি জানি বাপু, আমার এখন অত ভাববার সময় নেই। আগে দুজনকে খেতে দিই। ওদের ফ্রেশ হতে বললাম, তুমি দেখ তো ওদের হল কি না?”

অতনুবাবু বাইরে এসে, মঞ্জুদের ঘরের সামনে দাঁড়ালেন, গম্ভীর গলায় একটু বেশ জোরে কাশলেন, তারপর দরজায় টোকা মেরে বললেন, “পথিক, মঞ্জু তোমাদের হল বাবা? খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, তোমাদের মা তাড়া দিচ্ছেন যে”।

খুট শব্দে দরজার ছিটকিনি খুলে প্রথমে পথিক, পিছনে মঞ্জু বের হল। পথিক পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল, দেখাদেখি মঞ্জুও।

অতনুবাবু হাসতে হাসতে বললেন, “আরে ধ্যাৎ কী যে করিস তোরা, খেতে বসার আগে কেউ পায়ের ধুলো নেয়? আবার তো হাত ধুতে হবে”।

পথিক হেসে উত্তর দিল, “ওই তো বেসিন, হাতটা ধুয়ে নিলেই হল”।

অতনুবাবু ডাইনিং টেবিলে বসলেন, বললেন, “আয় আয় বসে পড়, তোর মা এখনই সব নিয়ে আসছে”। বেসিনে হাত ধুয়ে পথিক এবং মঞ্জু টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে বসল। অতনু দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। মঞ্জুটার মুখ কিছুটা গম্ভীর, তবে পথিকের স্বাভাবিক। এর মধ্যেই প্রীতমা দু হাতে দুটি প্লেটে চারটে করে লুচি আর দুটো করে বেগুনভাজা এনে পথিক আর মঞ্জুর সামনে রাখলেন। বললেন, “গরম গরম খেয়ে নাও বাবা, সেই কোন সকালে দুটো ভাত মুখে গুঁজে অফিসে বেরোও... খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। অফিসে কী খাও কে জানে?”

মঞ্জু একটু মনখারাপি সুরে বলল, “মা, লুচি চারটে না, দুটো তুলে দিচ্ছি, আর একটা বেগুনভাজা”।

প্রীতমাদেবী অতনুবাবুর জন্যেও একটা প্লেটে দুটো লুচি আর বেগুনভাজা নিয়ে এসেছিলেন, কর্তাকে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন কী হয়েছে? খিদে হয়নি না মন খারাপ? খেয়ে নে, রাত্তিরে বরং রুটি কম খাস”।

মঞ্জু ঘ্যানঘেনে সুরে বলল, “না মা, প্লিজ। একদম ভাল্লাগছে না। আমি বাবার প্লেটে তুলে দিচ্ছি”।

পথিক মঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বলল, “এত টেনশান কর না, মঞ্জু। বারবার তো তোমাকে বলছি কিচ্ছু হয়নি। মা তোমার ওপর মোটেই রাগ করেননি। যেটুকু করেছেন, আমি বলছি মিলিয়ে নিও, মঙ্গলবার তিনিই সব কিছু ভুলিয়ে দেবেন”।

মঞ্জু কান্নাধরা গলায় বলল, “আমাকে বাচ্চা মেয়ে পেয়েছ? যা বোঝাবে তাই বুঝে যাব?”

মঞ্জুর চোখের জল দেখে বিচলিত হলেন প্রীতমাদেবী এবং অতনুবাবুও। একমাত্র কন্যা। এই বছর খানেক আগে ভালো ঘর-বর দেখে বিয়ে দিয়েছেন। পথিকের মতো জামাই লাখে একটা মেলে। কিন্তু তার থেকেও বড় ব্যাপার পথিকের বাবা-মা। এমন সজ্জন ভালোমানুষ আজকাল বড়ো দেখা যায় না। তাঁরা যতবারই গিয়েছেন, তাঁদের কন্যা মঞ্জুকে ও বাড়িতে বিরাজ করতে দেখেছেন। ও বাড়ি থেকে ফিরে তাঁরা কত্তা-গিন্নিতে মাঝে মাঝে অভিমানও করেছেন, দেখলে, মেয়েটা আমাদের যেন ভুলেই গিয়েছে! মনে হচ্ছে শ্বশুর-শাশুড়িই ওর বাপ-মা, আর আমরা কেউ নই! ওরে মুখপুড়ি তোকে যে দশমাস পেটে ধরেছি, তোর বাপ আর আমি যে তোকে বুকে করে আগলে আগলে এতটি বড় করে তুললাম, সে সব কথা ভুলে গেলি? আবার মনকে সান্ত্বনাও দিয়েছেন, সারাজীবন মেয়েকে আপন করে রাখার জন্যে তো মেয়েদের জন্ম হয় না। তিনিও কি বাবা-মায়ের কম আদরের দুলালি ছিলেন? স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি এবং মঞ্জুকে নিয়ে তিনিও কি তাঁর বাপ-মাকে ভুলে যাননি?

মঞ্জু মুখ নামিয়ে কোনরকমে দুটো লুচি আর বেগুনভাজা খেয়ে উঠে গেল। প্রীতমাদেবী বললেন, “কী রে উঠে পড়লি কেন? বাবা তোদের জন্যে হাতে করে সন্দেশ নিয়ে এল, দুটো মুখে দিবি না?” বেসিনে মুখ হাত ধুয়ে এসে মঞ্জু বলল, “ভাল্লাগছে না, রাত্রে খাবো”, তারপর নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল।

পথিক দেখল কিছু বলল না। খুব মন দিয়ে ছটা লুচি, বেগুনভাজা আর দুটো কড়াপাক সন্দেশ তৃপ্তি করে খেয়ে উঠল। বেসিনে মুখ হাত ধুয়ে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বলল, “আমার মায়ের ব্যবহারে মঞ্জু একটু মুষড়ে পড়েছে, কিন্তু বিশ্বাস করুন মঞ্জুকে নিয়ে মায়ের একটা মজার প্ল্যান আছে। আর তার জন্যেই এত সব নাটক”।

প্রীতমাদেবী স্বামীর মুখের দিকে অসহায় চোখে তাকালেন, তারপর ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “মেয়েটাকে বহুদিন এমন মনমরা থাকতে দেখিনি, তোমার মায়ের কী প্ল্যান, বাবা?”

অতনুবাবু পথিকের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা মঞ্জুকে গোপন করে, ওকে চমকে দেওয়ার জন্যে কিছু একটা মজার প্ল্যান ভেঁজেছ, তাই না? তা তোমরা ফিরছ কবে?”

পথিক ম্লান হাসল, বলল, “মঙ্গলবার। মায়ের সেরকমই আদেশ”।

প্রীতমাদেবী জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার মায়ের প্ল্যানটা কী, বললে না তো?”

পথিক প্রীতমাদেবীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আগামী কাল আমার মা-বাবা আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। আমরা দুজন অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর, সাড়ে এগারোটা-বারোটা নাগাদ। দুপুরে এখানেই খাবেন। এর থেকে বেশি কিছু বলতে আমার মানা আছে। যা বলার মা-বাবাই বলবেন”।

প্রীতমাদেবী অবাক হয়ে পথিকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সঙ্কোচের হাল্কা হাসিমাখা মুখে পথিক বলল, “আগামীকাল আমার বাবা-মা আসার ব্যাপারটাও মঞ্জুকে এখনই বলবেন না, প্লিজ”।

 

 

 

আধুনিক সভ্যতায় কত ট্রেন কত এরোপ্লেন নিত্য দেরি করে চলে। কিন্তু মঞ্জরীর মাথায় গুচ্ছের দুশ্চিন্তা এবং দ্বিধার বোঝা চাপিয়ে, মঙ্গলবার সকালটা ক্যালেণ্ডারের পাতার মতো একেবারে কাঁটায় কাঁটায় এসে পড়ল। গত রাত্রে তার ভাল ঘুম হয়নি। নানান চিন্তায় তার বারবার ঘুম টুটেছেআচ্ছা, সে কি আজ থেকে পঞ্চাশ-একশ বছর আগেকার যুগে ফিরে যাচ্ছে? শাশুড়ি যেমন খুশি নাচাবে সেও মাদারির হাতে বাঁধা বাঁদরীর মতো নেচে চলবে? কাচের একটা গেলাস কনুইয়ের ধাক্কায় পড়ে ভেঙে যাওয়াতে – শাশুড়ি তাকে মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন বাপের বাড়ি থেকে কয়েকটা দিন ঘুরে আয়। আর মঞ্জরীও সুবোধ বালিকার মতো চলে এল? শাশুড়ি বলেছিলেন, মঙ্গলবার অফিসে ছুটি নিয়ে সকাল আটটার মধ্যে বাড়ি আসবি। এর যেন কোন অন্যথা না হয়। আর সেও আজ এই সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে স্নান-টান সেরে সাজুগুজু করতে বসেছে, নেচে নেচে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্যে?

সে শুনেছে শনিবার তারা অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর ওশাশুড়িমাতা ও শ্বশুরপিতা এ বাড়িতে এসেছিলেন। তার মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প-গাছা করে গেছেন। সানন্দে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরেছেন। এবং তার জন্যে রানি কালারের জমিতে ছোট্ট ছোট্ট হলুদের বুটি দেওয়া উজ্জ্বল সুন্দর টাঙ্গাইল তাঁতের একটি শাড়ি দিয়ে গেছেন। সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ এবং শায়া। তিনি নাকি বারবার বলে গেছেন মঞ্জু যেন মঙ্গলবার এই শাড়ি পরেই ও বাড়িতে যায়। আজকে সে সাজতে বসেছে এবং সেই শাড়িটিই বিছানায় রেখেছে সেজে উঠে পরবে বলে!

কেন? কিসের জন্যে? সে যথেষ্ট লেখাপড়া করেছে। নিজের যোগ্যতায় সে চাকরি যোগাড় করেছে। তার বয়স অনুপাতে তার পদমর্যাদা এবং বার্ষিক ক্ষতিপূরণ অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। সে তো পতি-নির্ভর লবঙ্গলতাসম গৃহবধূ নয়। সে তার ইচ্ছেমত জীবন যাপন করতেই পারে – তার মধ্যে নাক গলানোর অধিকার শ্বশুর-শাশুড়ির কতটা আছে? এমন কি তেমন তেমন হলে তার বাবা-মায়েরও নেই। তাহলে সে কেন যাচ্ছে আজ? মঞ্জরী কাল রাত্রে শোবার পর ভেবেছিল – অফিসেই যাবে, শ্বশুরবাড়ি যাবে না। ছুটি নেওয়া সত্ত্বেও অফিসে গেলে সহকর্মীরা অবাক হবে? হোক না। যে অনুষ্ঠানের জন্যে সে ছুটি নিয়েছিল, সে বলবে, সেই অনুষ্ঠান ভেস্তে গিয়েছে? আর শ্বশুরবাড়ি না গেলে, শাশুড়ি রাগ করবে? কতটা? তার স্বামী পথিক সেও কি ক্ষুণ্ণ হবে? কতটা? ও বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্কটাই ছিন্ন হয়ে যাবে? ডিভোর্স? সধবা মঞ্জরী থেকে, ডিভোর্সি মঞ্জরী? তাদের কোন ছেলেপুলে হয়নি, অতএব তার বাবা-মা কি আবার খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন, “ডিভোর্সী - নাম-মাত্র বিবাহ – কর্পোরেট অফিসে চাকরিরতা সুন্দরী গৃহকর্মনিপুণা শাণ্ডিল্য গোত্রীয় যুবতীর জন্য পাত্র চাই”? এই দুই বাড়ির সম্পর্কগুলো কি ওই কাচের গেলাসের মতোই ঠুনকো? তার কনুইয়ের হাল্কা ঠোকাতেই ভূমিসাৎ হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে পড়বে মেঝেয়? ভাঙা সম্পর্কের টুকরোতে ক্ষতবিক্ষত হবে তাদের সকলের জীবন?   

নাঃ। এতটা দূরদর্শী দুশ্চিন্তার স্বপক্ষে সবল যুক্তি বা প্রমাণ মঞ্জরী নিজের মনের অন্দরে খুঁজে পাচ্ছে না। যাকে বলা যায় “ঠোস সাবুদ”। তার মনের মধ্যে এখনও জাঁকিয়ে বসে রয়েছে, তার প্রতি শ্বশুর এবং শাশুড়ির নিঃস্বার্থ অপত্য স্নেহ – তার ওপরে ওঁদের অকুণ্ঠ নির্ভরতা ও বিশ্বাসও। মাত্র একদিনের আচরণ থেকে এতটা বিষম পরিণতির চিন্তা করার সময় এখনও আসেনি। আজ ও বাড়ি গিয়ে তাকে ঘিরে কী ঘটনা ঘটে, দেখাই যাক না? তারপর না হয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে!

অতএব সাড়ে সাতটা নাগাদ মঞ্জরী আর পথিক রেডি হয়ে তাদের ঘর থেকে বের হল। মায়ের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। ওদের দেখে প্রীতমাদেবী বেরিয়ে এলেন। মঞ্জরী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি এত সকালে কোথায় বেরোচ্ছ, মা?”

“আমরাও যাবো তো, ও বাড়িতে। তোর বাবাও রেডি, গাড়ি বের করতে গিয়েছে। তোরা রেডি?”

“তোমরাও ও বাড়িতে যাবে?” মঞ্জরীর বিশ্বাসই হচ্ছে না, “কিন্তু কেন?”

প্রীতমাদেবী থমথমে মুখে বললেন, “বেরোনর সময় সে সব কথা এখন থাক। তিক্ততা বাড়বে...”।

মঞ্জরী বলল, “কিসের তিক্ততা?”

সে কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, “ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করেছিস তো? তোরা এগো, আমি দরজা বন্ধ করে সদরে তালা দেব”।

হতভম্ব মঞ্জরী পথিকের সঙ্গে বাইরে এল। পথিকের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী ব্যাপার বলো তো?” পথিক মঞ্জরীর দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, “নো আইডিয়া”!

অতনুবাবু গাড়ি বের করে রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। প্রীতমাদেবী গাড়ির কাছে এসে বললেন “তোরা দুজনে পিছনে বস, আমি সামনে বসছি”। মঞ্জরীর বিয়ের পর থেকে একসঙ্গে কোথাও গাড়ি নিয়ে বেরোলে, অতনুবাবুর পাশের সিটটা জামাই পথিকের জন্যেই বরাদ্দ থাকত। মা আর মঞ্জরী বসত পিছনের সিটে, কথা বলতে বা গল্প করতে সুবিধে হত বেশ। আজ তার ব্যত্যয় কেন? মঞ্জরীর মনে খটকা।

গলি থেকে বেরিয়ে গাড়ি বড়ো রাস্তায় পড়তেই, মঞ্জরী জিজ্ঞাসা করল, “তখন তুমি কিসের তিক্ততা বাড়বে বলছিলে, মা?”

“ওফ্‌, একটা কথা তোর মাথায় ঢুকলে, সেটাতেই তুই আটকে থাকিস, মঞ্জু! ওসব আলোচনা এখন থাক না”।

মঞ্জরীর গলায় জেদ, “না, বলতেই হবে। বলা নেই কওয়া নেই - তোমরা হঠাৎ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লে কেন”?

অতনু সামলানোর চেষ্টায় বললেন, “কেন আবার কি? গাড়িটা অনেকদিন বের করিনি, তোরা এতটা পথ যাবি – গাড়িটা ঠিকঠাক থাকবে, আমারও হাতপাগুলোর একটু প্র্যাক্টিস হবে...এই সব ভেবেই...”।

“একদম বাজে অজুহাত দিও না, বাবা। তোমাদের আজই ও বাড়িতে যাওয়ার কী এমন দরকার পড়ে গেল, সেটাই জানতে চাইছি”।

সকাল সকাল গাড়ি নিয়ে বেরোনর এই এক মজা, রাস্তা-ঘাট বেশ খালিই থাকে। পরপর দুটো-তিনটে মোড়ের সিগন্যাল ক্লিয়ার পাওয়া যায়। অতনুবাবু মিনিট পনেরর মধ্যেই বেকবাগান মোড় পার হয়ে শরৎ বোস রোডে ঢুকে পড়লেন।

“মা, তুমি বলবে না?”

“আচ্ছা, কী এত জিদ করিস বলতো, ছেলেমানুষের মতো? পথিকের বাবা-মা শনিবার আমাদের বাড়িতে এসে নেমন্তন্ন করে গেছেন, আজ যাওয়ার জন্যে। যাচ্ছি। কেন আত্মীয়-পরিজনের বাড়ি কী মানুষ যায় না?”

“একশবার যায়, কিন্তু সেখানে তিক্ততা আসছে কোত্থেকে? আর তুমি আগে বলনি কেন? আমাদের সঙ্গে তোমরাও যাবে?”

“তিক্ততা নয়? এই যে তুই সেই শুক্কুরবার থেকে আজ পর্যন্ত মুখটা তোলো-হাঁড়ির মতো করে ঘরে ঘুরে বেড়ালি, সেটা তিক্ততা নয়? তার ওপর আগেই যদি বলতাম, আমরাও তোদের সঙ্গে যাবো, তুই কী ভাববি, কী মনে করবি – সেই ভয়েই তোকে বলিনি”।

অতনুবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, “তিক্তম্‌ আশুফলপ্রদম্‌”, রেয়ার ভিউ দিয়ে মেয়ের মুখটা দেখে মুচকি হাসলেন।

বিরক্তমুখে মঞ্জু বাবার দিকেই তাকিয়ে বলল, “তার মানে?”

অতনুবাবু হাসলেন, বললেন, “এগুলো আগেকার দিনের কবিরাজদের প্রবচন – ওষুধ যত তেঁতো হবে, তার ফল হবে তত তাড়াতাড়ি। আমি কবিরাজ নই, তবে এটুকু বলতে পারি – এই কদিনের তিক্ততার শেষে, একটু পরেই দারুণ মজাদার কিছু ঘটবে। ওই তো রাসবিহারি মোড় এসে গেছে। আহা সিগন্যালটাও খোলা আছে, সাঁ সাঁ করে পৌঁছে যাব, চেতলা অহীন্দ্র মঞ্চ। এখনকার মতো এই সব কথার নটেগাছগুলোকে মুড়িয়ে ফ্যাল”।        

 

 

গাড়ির আওয়াজ পেয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন শুক্তিদেবী আর অনীশবাবু। অনীশবাবুর মুখে হাসি, কিন্তু শুক্তিদেবীর মুখেচোখে কেমন যেন উদ্বেগ। মঞ্জুকে কাছে টেনে নিয়ে হাত ধরে ঘরে ঢুকলেন, সোজা নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে, বিছানায় বসালেন। তারপর মঞ্জুর মুখটা তুলে ধরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। মঞ্জু অবাক হয়ে দেখল, শুক্তিদেবী কাঁদছেন, তাঁর দুচোখ বেয়ে নেমে আসছে অবিশ্রান্ত অশ্রুধারা। মঞ্জু দুহাতে জড়িয়ে ধরল শাশুড়িকে।

শুক্তিদেবী কান্নাধরা গলায় বললেন, “আমার ওপরে যাচ্ছেতাই রাগ করেছিস না? শুনেছি এ কদিন তুই ভালো করে খাসনি, হাসিস নি। মুখ গোমড়া করে ছিলি সারাক্ষণ। শুনে আমার বুকের ভেতরটা যে কেমন করছিল, সে কথা তোকে বোঝাতে পারব না, পাগলি। আমারও মুখে রুচি নেই, রাতে ঘুম নেই, সিরিয়ালে মজা পাইনি। ভাবছিলাম আমার সোনার টুকরো মেয়েটাকে সিরিয়ালের দজ্জাল শাশুড়ির মতো আমি এত কষ্ট দিতে পারলাম তো?”

মঞ্জুও আবেগ সামলাতে পারল না, তার দুই চোখ ঝামড়ে জল চলে এল, কানে কানে বলল, “কেন এমন করলে বলো তো, মা?”

শুক্তিদেবী উত্তর দিলেন না। নিজের চোখ মুছলেন, পরম মমতায় মঞ্জুরও চোখের জল মুছে দিলেন। তার কপালে একটি চুম্বন এঁকে দিয়ে গভীর স্বরে বললেন, “বলছি, এখন ও ঘরে চল”।    

বসার ঘরে সবাই রুদ্ধশ্বাস বসেছিল, শুক্তিদেবী আর মঞ্জু ঢুকতেই সবাই গভীর শ্বাস নিল। মঞ্জুর শ্বশুর অনীশবাবু ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “যাক, কিছুটা বৃষ্টি যখন হয়েছে, তখন মেঘলাভাবটা কেটে এবার রবিকিরণ দেখা যাবে, কী বলেন, অতনুবাবু?”

অতনুবাবু বললেন, “ঠিক বলেছেন, চারদিনের টানা দুর্যোগ মনে হচ্ছে আজ কেটে গেল”।

বসার ঘরের অন্যদিকে ডিভান সরিয়ে, মেঝেয় কার্পেটের বড় একটা আসন পাতা ছিল। সুন্দর রঙিন আলপনা আঁকা সেই আসনটি ঘিরে। শুক্তিদেবী মঞ্জুকে বুকের কাছে ধরে নিয়ে আসনের সামনে দাঁড়ালেন, বললেন, “এই আসনটিতে লক্ষ্মীসোনার মতো চুপটি করে বস। পূবমুখো। আমি এখনই আসছি”।

মঞ্জু অবাক হয়ে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকাল, কিছু বলল না, তার চোখের কোলে এখনও জল টলটল করছে। শুক্তিদেবী স্নেহস্বরে মৃদু ধমক দিলেন, “হাঁ করে মুখ দেখছিস কি? কথা কানে গেল না? আসনে বস, আমি এখনই আসছি।”

মঞ্জু আসনে পা দিয়ে দাঁড়াল, সসঙ্কোচে ধীরে ধীরে বসল, সলজ্জ মুখে সোফায় বসা সকলের মুখের দিকে তাকাল। সকলের মুখেই এখন হাসি, বাবা, মা, পথিক, অনীশবাবু। সকলেই সোফা ছেড়ে মেঝেয় এসে বসলেন, মঞ্জুকে ঘিরে। প্রীতমাদেবী মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন।

অনতিবিলম্বেই শুক্তিদেবী ঘরে এলেন, তাঁর হাতে সাজানো বরণডালা। পিছনে সুষমাদি পেতলের বড় থালায় এনেছে, প্রদীপ, ধূপদানি আর শাঁখ, একপাশে ধান, দুর্বা। শুক্তিদেবী মেঝেয় বসলেন, বরণডালা রাখলেন মঞ্জুর সামনে। সুষমাদির হাত থেকে পেতলের থালাটি নিয়ে, মেঝেয় এক পাশে রাখলেন। দেশলাই জ্বেলে প্রদীপ জ্বাললেন, প্রদীপের জ্বলন্ত শিখা থেকে ধরিয়ে নিলেন দুটি ধূপ। সুগন্ধে ভরে উঠতে লাগল বসার ঘরের প্রতিটি কোণ। এবার শুক্তিদেবী হাঁটুগেড়ে বসলেন, দুহাতে সাজানো বরণডালা নিয়ে, বললেন, “সুষমা, শাঁখ বাজা, প্রীতমা উলু দাও। তারপর নিজেও উলু দিতে দিতে বরণ করলেন মঞ্জুকে। আশ্চর্য ভালো লাগায় মঞ্জুর দুই চোখ আবার জলে ভরে উঠল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুক্তিদেবীর মুখের দিকে। শুক্তিদেবী মঞ্জুর চিবুক স্পর্শ করে চুমো খেলেন।

বরণডালাটি সুষমার হাতে তুলে দিয়ে, মঞ্জুর মাথায় ধান আর দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, “আশীর্বাদ করলাম, অ্যাই মেয়ে, আমাকে প্রণাম করার কথাটা বলে দিতে হবে নাকি? এবার সকলেই তোকে আশীর্বাদ করবেন, চুপটি করে বসে থাক। আমি আসছি।” শুক্তিদেবী উঠলেন, সুষমাদির সঙ্গে রান্নাঘরে গেলেন।

সকলের আশীর্বাদ পর্ব শেষ হতেই, শুক্তিদেবী বড় প্লেটে সাজিয়ে আনলেন চারটে লুচি আর বেগুনভাজা। মঞ্জুর সামনে রেখে বললেন, “শুরু কর, আরো আনছি”।

“আমি কি একা একা খাবো নাকি? সবাইকে দাও। তুমিও নাও”।

“কেউ পালাচ্ছে না, সবাই খাবে – আজকে তুই আগে...আজ তোর দিন, আমাদের মধ্যে আজ তুই অদ্বিতীয়া রানি”।

সকলের হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে মঞ্জু লজ্জা পাচ্ছিল, কিন্তু শাশুড়ি ছাড়বেন না, তাই লুচি ছিঁড়ে বেগুনভাজার টুকরো সহ মুখে পুরে বলল, “আজকে কী বলো তো? আমাকে এত আদর করছ? আমার কিন্তু ভীষণ লজ্জা লাগছে”।

মমতামাখা স্বরে শুক্তিদেবী বললেন, “আজ আমাদের বধূদ্বিতীয়া”।

মঞ্জু থমকে গেল, “সে আবার কি? এমন তো কোনদিন শুনিনি”।

অনীশবাবু বাবু হা হা করে হাসলেন, বললেন, “আমাদের মানে জামাইদের নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে চিরকাল অনেক আদিখ্যেতা হয় – বলা হয় জামাই ষষ্ঠী! কিন্তু কই, বাপ-মায়ের ঘর ছেড়ে আসা মেয়েটিকে কোন বিশেষ দিনে কোন যত্নআত্তি আমরা কোনদিন করি না তো? এটি তোমার শাশুড়িমায়ের আবিষ্কার, বৌমা, বধূদ্বিতীয়া”।

শুক্তিদেবী মঞ্জুর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিলেন। কর্তার কথা শেষ হতে সুষমাদিকে ডাকলেন, “কইরে, সুষমা দুটো লুচি আরো নিয়ে আয়। সঙ্গে মিষ্টির প্লেটটাও নিয়ে আসিস”।

মঞ্জু আঁতকে উঠল যেন, “তুমি জান মা, আমি চারটের বেশি লুচি কোনদিন খাই না”।

শুক্তিদেবী রীতিমতো ভিলেনি কায়দায় বললেন, “কিন্তু আজ তো আপনাকে ছটা লুচি খেতেই হবে মঞ্জরীদেবী। শুক্রবার চারটে লুচি আপনি খাননি, দুটো লুচি খেয়েই মাকে বলেছিলেন, ভাল্লাগছে না। সে আমার ওপরে রাগ করেই না?”

মঞ্জু এবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, বলল, “তোমরা সবাই মিলে আমার সঙ্গে চিটিং করলে না? পথিক তো বটেই, এমন কি আমার বাবা-মাকেও দলে টেনে নিয়েছিলে?”

শুক্তিদেবীও হাসলেন, বললেন, “পথিকের বাবাকে প্রথম যখন এসব কথা বলেছিলাম, ও তো এককথায় রাজি হয়ে গেল। কিন্তু আমি বললাম, মঞ্জুকে এ বাড়ি থেকে কদিনের জন্যে তাড়াই কী করে?”

মঞ্জু আঁতকে উঠে বলল, “তার মানে?”

শুক্তিদেবী বললেন, “আহা, ব্যাপারটা পুরো শোন না। জামাইরা সকলেই জামাইষষ্ঠীর দিন সেজেগুজে বউকে বগলে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যায়। তুই তো শ্বশুরবাড়িতেই আছিস। তুই বাড়ির মধ্যেই থাকবি, আর আমি বরণডালা সাজিয়ে উলু দিয়ে তোকে বরণ করব... নাঃ আমার মোটেই মনঃপূত হল না। সেটা বড্ডো ন্যাকা-ন্যাকা হয়ে যাচ্ছিল”।

মঞ্জু চার নম্বর লুচি শেষ করে পঞ্চমে হাত দিয়ে বলল, “আমাকে বললেই পারতে, আমি কদিন না হয় বাপের বাড়ি থেকে এমনিই ঘুরে আসতাম”।

শুক্তিদেবী মুখ ভেংচে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই আমার সেই মেয়েই বটে। তোকে সব কথা বললে, তুই আমাকেই উপদেশ আর জ্ঞান দিয়ে আমার পুরো স্বপ্নটাই ভেস্তে দিতিস। বলতিস, ওসব বধূদ্বিতীয়া- টিতিয়া কোন কাজের কথা নয়, ওসব বোরিং আর বোকাবোকা ব্যাপার-স্যাপার তোর একদমই পছন্দ নয়। তোকে আমি চিনি না, হুঁঃ”।

মঞ্জু খিলখিল করে হাসল, বলল, “সে কথা মন্দ বলনি। কিন্তু কাচের গেলাস ভাঙা?”

শুক্তিদেবী বিখ্যাত গোয়েন্দাদের মতো মুচকি হেসে বললেন, “ওটাই তো আমার ফাঁদ – যে ফাঁদে তুই কনুই ঠেকালি। অন্যাদিন আগেই দিই, সেদিন খাবার বাড়ার পরে জলের গ্লাসটা দিয়েছিলাম। তোরা চেয়ারে বসে খেতে শুরু করার পর। জলভরা গেলাসটা রাখলাম, টেবিলের একদম কোণায় তোর হাতের একদম কাছাকাছি। ব্যস, তুই ঠেলা মেরে গেলাসটা ভাঙলি, আর আমিও তোকে তাড়াবার জন্যে কড়া করে দুটো কথা শুনিয়ে দিলাম”।

মঞ্জু হাসল, বলল, “বাব্বাঃ, তোমার মাথায় এত দুষ্টু বুদ্ধি? বোঝা যায় না তো?”

অনীশবাবু বললেন, “তোকে তো তাড়াল বৌমা, তুই যাওয়ার পর সে কি কান্না তোর শাশুড়ি মায়ের। বললে, মেয়েটাকে খেতে দিয়ে অমন মুখ ঝামটা দিলাম? ছিছি ছিছি। তার পরের দিন তোদের বাড়ি গিয়ে সব কথা খুলে বলে কতকটা স্বস্তি হল। তাও এ কটা দিন তোর চিন্তায় যা করল শুক্তি, সে কথা...”।

শুক্তিদেবী এবার মুখ ঝামটা দিয়ে স্বামীকে বললেন, “থাক, থাক। আমার কথা নিয়ে তোমার এত ঢাক পেটানোর কী দরকার বুঝি না বাপু। সুষমা, মঞ্জুর হয়ে গেছে, এবার আমাদের খাবারগুলোও নিয়ে আয়। কদিন পরে সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া যাক”।

-০০-   

শুক্রবার, ৯ মে, ২০২৫

যুদ্ধ প্রস্তুতি - পর্ব ১

 [২২শে এপ্রিল ২৫ এর পহেলগামে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ভারত কী পদক্ষেপ নেয়, তার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম আমরা। যতদিন গেছে - ভারতের তুলনায় পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামরিক শক্তির তুচ্ছতা নিয়ে বহু কথা বলা হয়েছে সামাজিক মাধ্যমের প্রতিটি শাখায়। জনগণেশ বারবার বলেছে - এত অপেক্ষার কী আছে - ভারত তো নিমেষে গুঁড়িয়ে দিতে পারে বিরুদ্ধ দেশকে। দীর্ঘ পনেরদিন অপেক্ষার পর ভারত সরকার দুর্দান্ত আঘাত হেনেছে। পাকিস্তানের সীমানার বাইরে থেকেই ভারত নটি জঙ্গী ঘাঁটি বিধ্বস্ত করেছে মোট একুশটি মিসাইলের আঘাতে। অর্থাৎ নিখুঁত এবং নিশ্চিত আঘাত হানার জন্যে ভারত মাত্র চোদ্দদিন সময় নিয়েছে প্রস্তুতির জন্যে। সরাসরি রণাঙ্গনে নামার আগে এই যুদ্ধ প্রস্তুতির কথাই চিন্তা করেছিলেন যুধিষ্ঠির।  বনবাস এবং অজ্ঞাতবাসের তের বছরে ধৈর্য ধরে নিখুঁত পরিকল্পনা করেছিলেন - কী ভাবে যুদ্ধ জয় নিশ্চিত করা যায়। সেই আলোচনাই করেছি - মহাভারতের বনপর্ব থেকে।] 


কপট দ্যুতক্রীড়ায় শোচণীয় পরাজয়ের ফলে সপত্নীক পাণ্ডবদের চূড়ান্ত অপমানিত এবং রাজ্য থেকে নির্বাসিত হয়ে বারো বছর বনবাস ও একবছর অজ্ঞাতবাসের প্রতিজ্ঞা পালন করতে হয়েছিল। ভীম, অর্জুন এবং দ্রৌপদী, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের এই প্রতিজ্ঞা পালনে মোটেই সন্তুষ্ট হননি। তাঁদের সকলেরই বক্তব্য ছিল, শকুনির সাহায্যে কৌরবপক্ষ যেখানে অসদুপায়ে অক্ষক্রীড়া পরিচালনা করে, পাণ্ডবদের সঙ্গে চরম শঠতা করেছে, সেখানে এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা দুর্বলতার লক্ষণ। স্বয়ং বাসুদেব, রাজা দ্রুপদ ও তাঁর পুত্রদের সহায়তা নিয়ে, মহাবল ভীম ও অর্জুনের মতো বীরের পক্ষে কুরুবীরদের বিনাশ করা, শুধুমাত্র যুধিষ্ঠিরের অনুমতির অপেক্ষা!

কিন্তু পত্নী দ্রৌপদী ও ভাইয়েরা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন জেনেও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির নিজের প্রতিজ্ঞায় অটল রইলেনতিনি বললেন, কোন কারণেই তিনি ধর্মপথ থেকে ভ্রষ্ট হবেন না এবং তাঁর প্রাজ্ঞ দূরদর্শীতা দিয়ে সকলকেই বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ভীম ও অর্জুন অতুলনীয় বীর তাতে তাঁর কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু বিপক্ষীয় পক্ষে আছে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, শল্য, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন প্রমুখ বীরেরা। তাঁদের সকলকে পরাস্ত করে রাজ্য জয় করা দুঃসাহসিক হঠকারিতা হয়ে যেতে পারে। তিনি অবশ্যই যুদ্ধ করবেন, কিন্তু ত্রয়োদশ বছরের প্রতিজ্ঞা পালনের পর! আর এই দীর্ঘ সময়টা তিনি ধৈর্য নিয়ে ব্যবহার করতে চাইছেন, তাঁর দুই মহাবল ভাইয়ের নিবিড় অনুশীলন এবং প্রচুর অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহের জন্য। যাতে তেরবছর পর তাঁদের ঈপ্সিত রাজ্যজয় নির্বিঘ্ন ও নিশ্চিত হয়!

একথা ঠিক দুরাত্মা দুর্যোধন ও তাঁর ভাইয়েরা সকলেই নিষ্ঠুর আততায়ী। তারা পাণ্ডবদের বধ করার জন্য বিষপ্রয়োগ করেছে, গৃহে অগ্নি সংযোগ করেছে, তাদের পৈতৃক রাজ্য হরণ করেছে এবং ধর্মপত্নীকে প্রকাশ্য রাজসভায় চরম অপমান করেছে।  অতএব ক্ষত্রিয় ধর্মমতে তারা অবশ্যই বধ্য শত্রুকিন্তু সেই শত্রুদের মধ্যে আছেন শ্রদ্ধেয় পিতামহ ভীষ্ম, গুরু দ্রোণ ও কৃপ, আত্মীয় শল্য এবং জ্ঞাতিভ্রাতাগণ!  রাজা যুধিষ্ঠির অবিচল ধর্মপথের পথিক, ভূভারতের সকলে তাঁকে ধর্মরাজ বলেই শ্রদ্ধা করে। রাজ্যলোভে জ্ঞাতি হত্যা ক্ষাত্রধর্মেও সমীচিন কিনা, সে বিষয়ে তিনি যেন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। সেই কারণেই প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নামার আগে প্রভাবশালী ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নৈতিক সমর্থন না পেলে তিনি যুদ্ধবিষয়ে মনস্থির করতে পারছেন না 

তাঁর এই উদ্দেশ্য কতটা সফল হয়েছিল, সেটা এবার দেখে নেওয়া যাক বেদব্যাস বিরচিত মূল মহাভারতের, মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ কৃত বাংলা অনুবাদের “বন পর্ব” থেকে।      

 

 

মহর্ষি ব্যাসদেবের অনুগ্রহ

পাণ্ডবদের বারো বছরের বনবাসের মধ্যে, দ্বৈতবনে তখন সবেমাত্র তের মাস পার হয়েছে। পাণ্ডবপত্নী দ্রৌপদীর কাছে বনবাসের চরম ক্লেশ দিন দিন অসহ্য হয়ে উঠছে। বিরক্ত হয়ে তিনি একদিন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে ক্ষত্রিয় রাজার ধর্ম–অধর্ম নিয়ে অনেক উপদেশ দিলেন। তাঁর একটাই উদ্দেশ্য, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যেন তাঁর বীর ভাইদের এখনই যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেন। রাণি দ্রৌপদীর দৃঢ় বিশ্বাস, মহাবলী ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব এবং রাজা যুধিষ্ঠির নিজে, দুর্যোধন সহ সকল কৌরব পক্ষকে বিনাশ করার জন্য যথেষ্ট। অতএব, এই অরণ্যে বৃথা কালহরণ না করে, রাজা যুধিষ্ঠিরের অবিলম্বে হস্তিনাপুর জয়ে উদ্যোগী হওয়া উচিৎ। যুদ্ধ করে অপহৃত রাজ্য অধিকার করা অথবা পরাজিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হওয়াই ক্ষত্রিয়দের একমাত্র ধর্ম। তাছাড়া যে দ্যূত ক্রীড়াতে দুর্যোধনরা শঠতা অবলম্বন করেছিল, সেই কপট দ্যূত ক্রীড়ায় পরাস্ত হয়ে, তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্যে সুদীর্ঘ এই বনবাসের কৃচ্ছ্রসাধন, কোন ভাবেই ধর্ম আচরণ হতে পারে না। অধার্মিক দুরাত্মা দুর্যোধন এবং তার সঙ্গীদের অবিলম্বে সমুচিত শাস্তি দিয়ে, এখন রাজ্য পুনরুদ্ধার করাই, ক্ষত্রিয় বীরের একমাত্র ধর্ম হওয়া উচিৎ!

দ্রৌপদীর যুক্তি মেনে নিয়েও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বললেন, “হতে পারে দ্যূতক্রীড়ায় দুর্যোধন কপটতার আশ্রয় নিয়েছিল, কিন্তু আমি যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম, তার মধ্যে তো কপটতা, ছিল না! অতএব আমি আমার প্রতিজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হতে পারবো না, যাজ্ঞসেনি। কারণ ধর্মপথ ছাড়া অন্য কোন পন্থা আমার কোনদিন ছিল না, আজও নেই”সেখানে উপস্থিত ছিলেন, মধ্যম পাণ্ডব ভীম। তিনি রাণি দ্রৌপদীর কথায় অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠে, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “কৃষ্ণা ঠিকই তো বলেছেন, দাদা। তুমি একবার আদেশ দাও, আমি আর অর্জুন মিলে কৌরব আর তাদের সঙ্গী সাথীদের বিনাশ করে দিই! তুমি আবার রাজা হও, তোমার সঙ্গে আমরাও আবার নিশ্চিন্ত রাজ্যসুখে দিন কাটাই”।

মহারাজ যুধিষ্ঠির পত্নী দ্রৌপদীকে যে কথা বলতে পারেননি, মহাবীর ভ্রাতা ভীমকে সেই বাস্তব পরিস্থিতির কথা বললেন, “ভাই বৃকোদর, তোমাদের দুজনের বীরত্বে আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। কিন্তু কৌরবপক্ষে আছেন, পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা – এঁদের বীরত্বকে অবহেলা করো না। আগে যে সকল রাজাদের আমরা পরাস্ত করে বশীভূত করেছিলাম, তারাও এখন আমাদের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে দুর্যোধনের পক্ষেই সসৈন্যে উপস্থিত হবে, বলা বাহুল্য! এই সকল কথা চিন্তা করে, আমার রাত্রের নিদ্রা উচ্ছিন্ন হয়ে গেছে”!

দ্রৌপদী ও দুই পাণ্ডব যখন দীর্ঘ এই আলোচনায় ব্যস্ত, সেই সময় মহাযোগী দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব সেখানে উপস্থিত হলেন। পাণ্ডবদের থেকে যথা বিহিত সম্মান ও পূজা গ্রহণ করার পর, তিনি রাজা যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “হে নরশ্রেষ্ঠ, আমি স্বীয় মনস্বী প্রভাবে তোমার মনের ভাব বুঝতে পেরে, তোমার কাছে সত্বর উপস্থিত হলাম। তুমি যে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন ও দুঃশাসনের থেকে ভয়ের আশঙ্কা করছো, তার নিরাকরণের জন্যই আমার এই আসা! হে রাজেন্দ্র, যে উপায়ে তোমার এই ভয় দূর হতে পারে, সে কথা শুনে সেই কার্যের অনুষ্ঠান করলে, তোমার আর চিন্তার প্রয়োজন দেখি না!”।

[মহামুনি পরাশরের পুত্র মহর্ষি শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস ভূভারতে অত্যন্ত প্রাজ্ঞ এবং জ্ঞানী বলে সুবিদিত। তিনি রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু এবং ধর্মরাজ বিদুরের পিতা, অর্থাৎ তিনি পঞ্চপাণ্ডব ও দুর্যোধনাদি ধার্তরাষ্ট্রদের পিতামহ। তাঁর কাছে পাণ্ডব ও কৌরব উভয় পক্ষই সমান স্নেহের, কিন্তু ইদানীং তিনি কৌরবপক্ষের আচরণে বিরক্ত, বিদ্বিষ্ট। তাঁর মতো ত্রিকালদর্শী মহর্ষিও স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের সামনে এসে কৌরব বধের উপায় উপদেশ করছেন! এই নৈতিক সমর্থনই পরবর্তী কালে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের রাজ্য জয়ের পাথেয় হয়ে উঠবে!]

ত্রিকালজ্ঞ মহর্ষি ব্যাসদেব, রাজা যুধিষ্ঠিরকে নির্জনে ডেকে নিয়ে বললেন, “হে ভরতকুলতিলক, আমি তোমাকে “প্রতিস্মৃতি” নামে একটি রহস্যবিদ্যা দান করছি, তুমি মনোযোগে এই বিদ্যা গ্রহণ করো। পরে এই বিদ্যা তুমি মহাবাহু অর্জুনকে অর্পণ করবে। এই বিদ্যা অনুযায়ী অর্জুন সাধনা করলে, স্বয়ং মহাদেব ও মহেন্দ্রর অনুগ্রহে অনেক অস্ত্রলাভ করতে পারবে। অর্জুন এই সাধনার প্রভাবে বরুণ, কুবের, ধর্মরাজ প্রমুখ দেবগণেরও সাক্ষাৎ লাভ করবে। মনে রেখো, অর্জুন সামান্য মানুষ নয়, চিরন্তন মহাতেজা ঋষি। ভগবান নারায়ণ তার সহায়, অর্জুনকে কেউই পরাজিত করতে পারবে না। সে রুদ্র, ইন্দ্র ও লোকপালদের থেকে আরও অনেক অস্ত্র পেয়ে মহৎকার্য সম্পন্ন করতে পারবে” 

এরপরে মহর্ষি ব্যাস আরও বললেন, “হে কৌন্তেয়, এখন তুমি নিজেদের বাসোপযোগী অন্য অরণ্যের সন্ধান করো! কারণ, অরণ্যের একস্থানে দীর্ঘবাস প্রীতিকর হয় না। তুমি বেদবেদাঙ্গপারগ অনেক ব্রাহ্মণের ভরণপোষণ করছো। তাতে অরণ্যবাসী তপস্বীরা উদ্বিগ্ন হচ্ছেন; লতা, গুল্ম, ওষধি বিনষ্ট হচ্ছে এবং অসহায় মৃগদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে উঠছে!”

[মহর্ষি ব্যাসদেব কী শুধু অরণ্যবাসী তপস্বীদের বিরক্তি এবং অরণ্যের বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষার জন্যই মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে সতর্ক করলেন? নাকি শত্রু কৌরবপক্ষের গুপ্ত আক্রমণের আশঙ্কায় পাণ্ডবদের এক অরণ্য থেকে অন্য অরণ্যে ক্ষণস্থায়ী বিচরণের পরামর্শ দিলেন! সে কথাটা কী উহ্য রইল?]

লোকতত্ত্বজ্ঞ ভগবান ব্যাস ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে ওই আশ্চর্য বিদ্যা ও উপদেশ দিয়ে চলে যাওয়ার কিছুদিন পরেই, মহারাজ যুধিষ্ঠির সপরিবারে দ্বৈতবন ত্যাগ করে, সরস্বতী নদীর উপকূলে কাম্যকবনে চলে এলেন। তাঁর পিছনে রইলেন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরাও। কাম্যক বনে এসে মহারাজ যুধিষ্ঠির মহর্ষি ব্যাসদেবের দেওয়া সেই মন্ত্র নিবিষ্ট মনে বারবার অভ্যাস করলেন।

তারপর একদিন নির্জনে অর্জুনকে ডেকে, ভ্রাতার অঙ্গ স্পর্শ করে, খুব শান্তভাবে বললেন, “হে ভ্রাতঃ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ ও অশ্বত্থামা – এঁরা সকলেই পূর্ণ চতুষ্পাদ ধনুর্বেদে সম্যক অধিকার লাভ করেছেন। এঁরা সকলেই ব্রাহ্ম, দৈব ও মানুষী অস্ত্রসমূহের ধারণ, প্রয়োগ ও অন্যে প্রয়োগ করলে তার প্রতিকারের বিষয়ে সুশিক্ষিত। দুর্যোধন এঁদের প্রচুর অর্থদান করে, গুরুর সম্মান দিয়ে সন্তুষ্ট রেখেছে। কার্যকাল উপস্থিত হলে, এঁরা সকলেই প্রতিদানস্বরূপ নিজেদের বলবীর্য প্রকাশ করবেন। হে অর্জুন, তুমি আমাদের সকলের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র এবং তোমাতেই সমগ্র দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, এখন যে কর্তব্যের কথা বলছি, মন দিয়ে শোনো। আমি মহর্ষি বেদব্যাসের থেকে একটি গূঢ় বিদ্যা গ্রহণ করেছি। ওই বিদ্যার প্রয়োগে সমস্ত জগৎ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে! তুমি ওই বিদ্যায় সংযুক্ত ও সুসমাহিত হয়ে তপস্যায় মনোনিবেশ করলে, যথাসময়ে দেবতাদের প্রসাদ লাভ করবে। অতএব, তুমি এখনই ধনু, কবচ ও খড়্গ গ্রহণ করে, সাধুব্রতধারী মুনির মতো উত্তরদিকে যাত্রা করো। কিন্তু কাউকে এই বিদ্যার কথা প্রকাশ করবে না। পুরাকালে দেবগণ বৃত্রাসুরের থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য দেবরাজ ইন্দ্রকে সকল দিব্যাস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন। তুমি তাঁর থেকে সকল অস্ত্র একসঙ্গেই পেয়ে যাবে, এই বিদ্যার প্রভাবে তিনিই তোমাকে সমুদয় অস্ত্র প্রদান করবেন। তুমি আজই দীক্ষিত হয়ে পুরন্দরের সাক্ষাতের জন্য যাত্রা করো”।

এই কথা বলে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অর্জুনকে সেই রহস্যবিদ্যা অধ্যয়ন করালেন। তারপর মহর্ষি ব্যাসবিহিত নিয়ম অনুসারে অর্জুনকে দীক্ষিত ও কায়মনোবাক্যে সংযত করে, প্রস্থানের আদেশ দিলেন। অর্জুন এই ভাবে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আদেশে গাণ্ডীব ধনু, অক্ষয় তূণীর, কবচ, বর্ম, গোধাঙ্গুলিত্র[i] ধারণ করে, প্রজ্জ্বলিত হুতাশনে আহুতি দান করলেন। তারপর ব্রাহ্মণদের নিষ্ক[ii] দান করে স্বস্তিবাচন করিয়ে, ধার্তরাষ্ট্রদের বধ করার উদ্দেশে কৃতসংকল্প হয়ে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে, ঊর্ধ্বদিকে তাকিয়ে প্রস্থান করলেন। সেই সময়ে সিদ্ধ ব্রাহ্মণগণ ও গূঢ় ভূতেরা অর্জুনকে দেখে বললেন, “হে মহাবীর, অনতিকাল মধ্যেই তোমার সংকল্প সিদ্ধ হবে। তোমার নিশ্চয়ই জয়লাভ হবে, তুমি প্রস্থান করো” এবং সকলেই আশীর্বাদ করলেন।

দ্রৌপদী মহাকায় অর্জুনকে প্রস্থান করতে দেখে অশ্রুসজল নয়নে বললেন, “হে মহাবাহো, তোমার জন্মগ্রহণ কালে, মাতা কুন্তী যা অভিলাষ করেছিলেন এবং তোমার যেমন ইচ্ছা, সেই সকলই সফল হোক। এখন প্রার্থনা করি, ক্ষত্রিয়কুলে যেন আর কারো জন্ম না হয়! যাঁরা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন কর জীবিকা নির্বাহ করেন, সেই ব্রাহ্মণদের আমি নমস্কার করি। পাপাত্মা দুর্যোধন রাজসভায় বহুবিধ অশালীন বাক্য সহ আমাকে “গরু গরু” বলে যে উপহাস করেছিল, সেই দুরপনেয় দুঃখের থেকেও, এখন তোমার বিয়োগজনিত দুঃখ গুরুতর মনে হচ্ছে! তোমার ভ্রাতৃগণ তোমার বীরকার্যের কথা উল্লেখ করে, সর্বদা আনন্দ করবে। হে নাথ, তুমি দীর্ঘ প্রবাসজনিত প্রয়াস স্বীকার করলে, আমাদের ভোগ, ধন বা জীবনে কদাচ সন্তোষ জন্মাবে না। আমাদের সুখ, দুঃখ, জীবন, মরণ, রাজ্য ও ঐশ্বর্য একমাত্র তোমাতেই সমাহিত রয়েছে! তুমি মঙ্গল লাভ করো। তুমি যে কার্যসাধন করতে যাচ্ছো, সে কাজ মহাবলীর; অতএব তুমি জয়লাভের জন্য নির্বিঘ্নে প্রস্থান করো। ধাতা ও বিধাতাকে নমস্কার করি, তোমার মঙ্গল হবে। তুমি প্রবাসে যাত্রা করো, হ্রী, শ্রী, কীর্তি, দ্যুতি, উত্তমা, পুষ্টি, লক্ষ্মী ও সরস্বতী তোমাকে যাত্রা পথে রক্ষা করবেন। তুমি জ্যেষ্ঠের অর্চনা করো, তাঁর আজ্ঞার প্রতিপালন করো, অতএব আমি তোমার শান্তির জন্য বসু, রুদ্র, আদিত্য, মরুৎগণ, বিশ্বদেব ও সাধ্যগণকে আরাধনা করবো। খচর[iii], পার্থিব, দিব্য এবং অন্যান্য বিঘ্নকারী ভূতগণ তোমার মঙ্গল বিধান করুন”।

দ্রৌপদীর বিদায়ী আশীর্বাদের পর, মহাবীর পার্থ ভ্রাতৃগণ ও পুরোহিত ধৌম্য মহাশয়কে প্রদক্ষিণ করে, শরাসন হাতে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। ভূতগণ ইন্দ্রের লক্ষণ যুক্ত প্রবল পরাক্রান্ত তেজঃপুঞ্জকলেবর অর্জুনের গমন পথে বিঘ্ন সাধনে নিবৃত্ত হল। 

 

দেবরাজ ইন্দ্রের সহায়তা

তপস্বী নিষেবিত[iv] বহু অচল অতিক্রম করে একদিন মহাবীর অর্জুন দেবগণ পরিবৃত দিব্য হিমাচলে উপনীত হলেন। সেখানে হিমালয় ও গন্ধমাদন পর্বত পার হয়ে অতি দ্রুত অহোরাত্র অতন্দ্রিত[v] হয়ে দুর্গম স্থান সকল অতিক্রম করে, পরিশেষে ইন্দ্রনীল পর্বতে উপস্থিত হলেন। সেখানে অকস্মাৎ অন্তরীক্ষ থেকে “তিষ্ঠ”[vi] – এই বাক্য শুনে তিনি থামলেন, এবং ইতস্ততঃ দেখতে লাগলেন। দেখলেন, একটি বৃক্ষতলে, ব্রাহ্মশ্রীসম্পন্ন সুদীর্ঘ জটাধারী এক তপস্বী বসে আছেন।

সেই তপস্বী অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বৎস, ক্ষত্রিয় ব্রতধারী হয়ে, ধনু, বর্ম ও শর হাতে, কটিতটে অসিকোষ বেঁধে এই স্থানে উপস্থিত হলে, তুমি কে? এই স্থান শান্তপ্রকৃতি, বিনীতক্রোধ তপস্বী ব্রাহ্মণদের আশ্রম, এখানে সংগ্রামের কোন সম্ভাবনাই নেই, অতএব শস্ত্রেরও কোন প্রয়োজন নেই। সুতরাং এখনই তোমার ওই শরাসন দূরে নিক্ষেপ করো, তুমি পরমা গতি লাভ করেছো!” অসামান্য ওজঃ ও তেজঃ সম্পন্ন সেই ব্রাহ্মণ সহাস্য আস্যে এইকথা বারবার বললেও দৃঢ়ব্রত অর্জুনকে কোনভাবেই ধৈর্যচ্যুত করতে পারলেন না।

সেই ব্রাহ্মণ তখন প্রসন্নমুখে বললেন, “হে বৎস, আমিই দেবরাজ ইন্দ্র। তুমি অভীষ্ট বর প্রার্থনা করো”।

মহাবীর অর্জুন কৃতাঞ্জলি হয়ে প্রণাম করে বললেন, “ভগবন্‌, আমি আপনার কাছেই অস্ত্র শিক্ষালাভের অভিলাষ নিয়ে এসেছি, আপনি কৃপা করে আমাকে এই বর দিন”।

দেবরাজ ইন্দ্র প্রীতমনে সহাস্যবদনে বললেন, “বৎস, তুমি এই স্থানে এসেছো, তোমার অস্ত্র-শস্ত্রের আর প্রয়োজন কী? এখন অভীষ্ট লোকলাভে যত্ন করো। তুমি পরম গতি লাভ করেছো!”

ধনঞ্জয় বললেন, “ভগবন্‌, আমি লোভ, কাম, দেবত্ব ও সুখলাভের প্রত্যাশা করি না, দেবতাদের ঐশ্বর্যকেও নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর মনে করি। আমি ভ্রাতৃগণকে অরণ্যে ত্যাগ করে, বৈরনির্যাতনের সঙ্কল্পে এসেছি, এর অন্যথা হলে ত্রিলোকে চিরকাল আমার অপযশ রটনা হবে”!

দেবরাজ ইন্দ্র অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “হে তাত, তুমি যখন ত্রিশূলধারী ভূতনাথ শঙ্করের দর্শন পাবে, আমি সেই সময় তোমাকে আমার সকল দিব্যাস্ত্র প্রদান করবো। অতএব তাঁর সাক্ষাৎলাভের জন্য সর্বতোভাবে যত্ন করো। তাঁর সন্দর্শন হলেই, তোমার সকল অভীষ্ট পূরণ হবে”। এই কথা বলে দেবরাজ ইন্দ্র সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।  

 

কিরাতবেশী মহাদেবের সাক্ষাৎ

ভূতভাবন ভগবান ভবানীপতির সন্দর্শন সংকল্পে একনিষ্ঠ ধনঞ্জয়, সেই মহাগিরি হিমাচলের নিকটবর্তী দুর্গম অরণ্যানী পার হয়ে গিরিপৃষ্ঠে গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে পুষ্পভারে অবনত বৃক্ষের উপরে নানান পাখি সুমধুর সুরে গান করছে। চারিদিকে বিপুল আবর্ত[vii]বতী নদী শোভা পাচ্ছে। ওই নিম্নগা[viii]সকলের জল অতি পবিত্র, সুশীতল ও নির্মল। নদীর দুইপাশে মনোহর বনরাজি বিরাজমান এবং হংস, কারণ্ডব[ix], সারস, ক্রৌঞ্চ, পুংস্কোকিল, ময়ুর প্রভৃতি পাখির কলতানে মুখর। মহামনা অর্জুন এই দৃশ্য দেখে অত্যন্ত প্রীত হলেন।

তিনি সেই পরম রমণীয় বনদেশে দর্ভ[x]ময় বাস পরিধান করে, দণ্ড ও অজিনে শরীর মণ্ডিত করে ভূতলে বিশীর্ণ পত্রমাত্র শয্যা করে বাস করতে শুরু করলেনতিনি প্রথম মাসে ত্রিরাত্রি অন্তর, দ্বিতীয় মাসে ষড়রাত্রি অন্তর এবং তৃতীয় মাসে পক্ষকাল অন্তর ফলমাত্র ভক্ষণ করে, কঠোর তপশ্চর্যায় ব্রতী হলেন। চতুর্থমাস থেকে বায়ুমাত্র ভক্ষণ করে, ঊর্ধবাহু এবং পদাঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগ মাত্রে মেদিনী স্পর্শ করে তপস্যা শুরু করলেন। সতত অবগাহন করায়, তাঁর মাথার জটাকলাপ পিঙ্গলবর্ণ হয়ে উঠল।

সেই অরণ্যের অধিবাসী মহর্ষিগণ, তপস্বী অর্জুনের এই সাধনা দেখে অত্যন্ত আশ্চর্য হলেন। তাঁরা একত্র মিলিতভাবে দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে উপস্থিত হলেন এবং প্রণাম করে বললেন, “হে দেবেশ্বর, মহাতেজা অর্জুন হিমাচল পর্বতে ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করেছেন, তাঁর তপস্যার প্রভাবে চতুর্দিক এবং আমরাও সন্তাপিত হচ্ছি! তাঁর কী অভিপ্রায় আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি, অতএব আপনি তাঁকে নিবৃত্ত করুন”।

সর্বভূতপতি মহর্ষিদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “হে তপোধনগণ, তোমরা অর্জুনের কারণে বিষণ্ণ হয়ো না, তোমরা নিজ নিজ আশ্রমে ফিরে যাও। আমি ধর্মাত্মা অর্জুনের অভিপ্রায় বুঝেছি, স্বর্গ, আয়ু অথবা ঐশ্বর্যে তার কোন আকাঙ্ক্ষা নেই।  তার যা অভিলাষ, আমি অচিরেই তা পূর্ণ করবো।” দেবাদিদেব ভবের আশ্বাসবাক্যে মহর্ষিগণ নিশ্চিন্ত চিত্তে নিজ নিজ নিকেতনে ফিরে গেলেন।

 

মহর্ষিদের বিদায়ের পর ভগবান পশুপতি কিরাতবেশ ধারণ করলে, তিনি কাঞ্চনদ্রুম ও দ্বিতীয় সুমেরু পর্বতের মতো শোভাময় হলেন। তিনি হাতে নিলেন পিনাক, শরাসন ও আশীবিষের মতো শরসমূহ। তিনি কিরাতীর ছদ্মবেশে স্বীয় পত্নী উমাদেবীকেও সঙ্গে নিয়ে অর্জুনের তপোবনের দিকে যাত্রা করলেন।  তাঁদের সঙ্গে চললেন অজস্র অঙ্গনা ও অঙ্গনগণ।

কিরাতরূপী ভগবান ভবানীপতি ক্রমে ক্রমে তপস্যারত পার্থের কাছে এসে লক্ষ্য করলেন, মূক নামে এক অদ্ভূতদর্শন দানব, বরাহ রূপ ধারণ করে অর্জুনকে আক্রমণ করে সংহার করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সেই দেখে অর্জুন  গাণ্ডীব ধনুতে শর স্থাপন করে, জ্যাতে টংকার দিয়ে বললেন, “অরে দুরাত্মন, আমি তো তোর কোন অপকার করিনি, তথাপি তুই আমাকে সংহার করতে উদ্যত হয়েছিস! অতএব আমিই তোকে আগে যমালয়ে পাঠাচ্ছি।”

এইসময় কিরাতবেশী ভগবান শঙ্কর, অর্জুনকে বরাহের উপর শর নিক্ষেপে উদ্যত দেখে, তাঁকে নিবারণের জন্য বললেন, “হে তাপস, আমিই আগে এই ইন্দ্রনীল পর্বত সদৃশ বরাহকে দেখতে পেয়েছি।” অর্জুন তাঁর কথায় অবহেলা করে বরাহের উপর শর নিক্ষেপ করলেন; কিরাতবেশী শংকরও তৎক্ষণাৎ ওই বরাহের উপর বজ্রতুল্য এক বাণ নিক্ষেপ করলেন। নিক্ষিপ্ত উভয় শর একইসময়ে সেই বরাহের গায়ে বিদ্ধ হল। তারপর উভয়ের অন্যান্য আরও অনেক নিক্ষিপ্ত শরে বিদ্ধ হয়ে, বরাহ শয্যাশায়ী হল এবং মৃত্যুর আগে ভয়ঙ্কর রাক্ষসরূপ ধারণ করে প্রাণত্যাগ করল।

অতঃপর স্ত্রীগণপরিবৃত কিরাতবেশী মহাদেবকে দেখে অর্জুন প্রসন্ন মুখে হাস্য করে বললেন, “হে কনকপ্রভ পুরুষ, তুমি কে? এই ঘোরতর নির্জন অরণ্যে তুমি স্ত্রীগণের সঙ্গে ভ্রমণে বেরিয়েছ? তোমার কি কিছুমাত্র ভয় করছে না? তুমি কিসের জন্য আমার পূর্বলক্ষিত পশুকে শর নিক্ষেপ করলে? ওই বরাহ কী কারণে জানি না, আমাকে সংহারের জন্যেই এসেছিল, আমি ওকে আগেই দেখেছিলাম; তার প্রতি শর নিক্ষেপ করে তুমি মৃগয়াধর্মের বিরুদ্ধ আচরণ করেছ! অতএব এখন আমিই তোমার প্রাণ সংহার করবো।”

কিরাতবেশী ভগবান শংকর, সব্যসাচী ধনঞ্জয়ের এই কথা শুনে শান্ত স্বরে বললেন, “হে বীর, আমার জন্য তুমি ভীত হয়ো না। এই বনের নিকটস্থ ভূমিতেই আমার আবাসস্থান। আমরা সতত এই বহুসত্ত্বযুক্ত বনে ভ্রমণ করি। তুমি অগ্নিতুল্য তেজস্বী, সুকুমার ও সুখের যোগ্য হয়েও, কিসের জন্য এই দুষ্কর জনশূণ্য অরণ্যে একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছো?”

অর্জুন বললেন, “আমি গাণ্ডীব ধনু ও অগ্নিসম অস্ত্রসমূহ নিয়ে দ্বিতীয় কার্তিকেয়র মতো এই অরণ্যে বাস করছি। ওই মহারাক্ষস বরাহরূপ ধরে আমাকে সংহার করতে এসেছিল, এখন আমিই তার প্রাণ সংহার করলাম”।

কিরাত বললেন, “হে তাপস, আমিই ওই পশুকে আগে লক্ষ্য করেছিলাম এবং আগে আমার নিক্ষিপ্ত শরসমূহেই ওই পশুর মৃত্যু হয়েছে! হে মন্দাত্মন, নিজ শক্তিতে অহংকারী হয়ে, নিজের দোষ অপরের উপর আরোপ করা কখনই উচিৎ নয়। তুমি অত্যন্ত দাম্ভিক, অতএব আমিই তোমাকে আজ যমসদনে পাঠাবো। দাঁড়াও, আমি তোমার উপর বাণ নিক্ষেপ করছি, তুমিও নিজের সাধ্য অনুযায়ী আমার প্রতি শরনিক্ষেপে ত্রুটি করো না।” মহাবীর অর্জুন কিরাতের এই কথায় ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর উপর শর নিক্ষেপ করলেন।

কিরাত সহাস্যে সেই শরসমুদয় সহ্য করে বললেন, “ওরে মন্দমতে, আরো বাণ নিক্ষেপ কর, তোর কাছে নারাচ[xi] প্রভৃতি আরও যে সব মর্মবিদারক অস্ত্র আছে, সব নিক্ষেপ কর”। কিরাতের কথা শুনে ক্রুদ্ধ অর্জুন শরবৃষ্টি করতে শুরু করলেন, কিন্তু কিরাতরূপী ভগবান শংকর সে সব অস্ত্রই অনায়াসে সহ্য করলেন। ভগবান পিনাকপাণি অর্জুনের নিক্ষিপ্ত সমুদয় শর সহ্য করে, অক্ষত শরীরে পর্বতের মতো অবিচল দাঁড়িয়ে রইলেন। অর্জুন নিজের বাণবর্ষণ ব্যর্থ হতে দেখে, অত্যন্ত বিস্মিত হলেন এবং “সাধু, সাধু” বলে, কিরাতকে ধন্যবাদ দিতে দিতে চিন্তা করলেন, ‘ইনি কে? ইনি দেবাদিদেব রুদ্র বা অন্য কোন দেবতা, অথবা যক্ষ কিংবা কোন রাক্ষস হবেন! শুনেছি, গিরিশ্রেষ্ঠ হিমালয়ে দেবতাদের সমাগম আছে। ভূতনাথ পিনাকপাণি ছাড়া আমার শরনিকর সহ্য করার ক্ষমতা আর কারও নেই! যদি ইনি মহাদেব ছাড়া অন্য কোন দেবতা বা যক্ষ হন, তীক্ষ্ণ শরপ্রহারে আমি তাঁকে শমনসদনে পাঠাবোই!’

মহাবীর অর্জুন নতুন উদ্যমে সূর্য্যকিরণের মতো মর্মভেদী শত শত নারাচ সকল নিক্ষেপ করতে লাগলেন। কিন্তু পর্বত যেমন শিলাবর্ষণ অনায়াসে সহ্য করে, ছদ্মবেশী শূলপাণিও সেই সকল নারাচ সহ্য করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্জুনের সকল বাণ যখন নিঃশেষ হয়ে গেল, মহাবীর অর্জুন ভীত হলেন। খাণ্ডববন দহনের সময় যিনি বীর অর্জুনকে এ দুই অক্ষয় তূণীর দান করেছিলেন, সেই অগ্নিদেবকে স্মরণ করে, তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন ‘আমার সকল বাণ নিঃশেষ হয়ে গেছে, এখন কী নিক্ষেপ করি? আর এই পুরুষই বা কে? আমার সকল বাণ গ্রাস করে ফেলল? শূলাগ্র দিয়ে যেমন হস্তীকে সংহার করা চলে, তেমনি শরাসনের অগ্রভাগ দিয়েই একে যমালয়ে পাঠাব’।

এই কথা চিন্তা করে মহাবলী অর্জুন কিরাতকে শরাসন দিয়ে আকর্ষণ করে, জ্যা দিয়ে বেঁধে, তাঁকে বজ্রের মতো মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগলেন। কিন্তু কিরাতবেশী মহাদেব অর্জুনের হাত থেকে তৎক্ষণাৎ শরাসন কেড়ে নিলেন! ধনুক কিরাতের হস্তগত হল দেখে অর্জুন মহা ক্রোধে কিরাতের মাথা লক্ষ্য করে খড়্গ ছুঁড়লেন, কিন্তু সেই ভয়ংকার খড্গও কিরাতের মাথায় লেগে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল! এরপর অর্জুন বড়ো বড়ো শিলা ও বৃক্ষসকল নিয়ে আক্রমণ শুরু করলেন, কিন্তু কিরাতরূপী ভূতনাথ সে আঘাতও নির্বিকার চিত্তে সহ্য করে নিলেন। এরপর নিরস্ত্র পার্থ কিরাতের গায়ে মুষ্টি প্রহার শুরু করায়, কিরাতরূপী শঙ্করও অর্জুনকে মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগলেন।

এইভাবে মহাবীর পার্থ ও কিরাতের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মহা পরাক্রমশালী বীর কৌন্তেয় কিরাতের বক্ষে প্রবল আঘাত করলে, কিরাতও পার্খর বক্ষে ঘোরতর আঘাত করলেন। তখন সেই মহাপরাক্রমশালী দুই বীর বাহু নিষ্পেষণ ও বক্ষ সংঘর্ষণে মহামল্লযুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। কিছুক্ষণ মল্লযুদ্ধের পর কিরাতবেশী মহাদেব তাঁর গাত্র নিষ্পেষণ করায়, অর্জুনের চিত্ত বিক্ষুব্ধ হল এবং অঙ্গসকল নিরুদ্ধ হয়ে, হৃতশক্তি জড়ের মতো ভূতলে পড়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ পরে অর্জুন চৈতন্যলাভ করে, রুধিরাক্ত কলেবরে, দুঃখিত চিত্তে মাটির স্থণ্ডিল[xii] রচনা করে, পুষ্প মাল্য দিয়ে শরণ্য ভগবান পিনাকীর অর্চনা করলেন। পূজাবসানে কিরাতের মস্তকে সেই পুষ্পমাল্য দেখে, তিনি বিস্মিত হলেন এবং তাঁর চিত্তে জ্ঞানের উদয় হল। তিনি তৎক্ষণাৎ কিরাতরূপী ভগবানের দুই চরণে আশ্রয় নিলেন।

 

 

প্রসন্ন মহাদেবের পাশুপত অস্ত্র দান

দেবাদিদেব মহাদেব প্রসন্নমুখে, তপস্যায় ক্ষীণতনু অর্জুনকে বললেন, “হে ফাল্গুন, আমি তোমার এই অলোকসামান্য কর্ম ও সাহস দেখে পরম পরিতুষ্ট হয়েছি। তোমার মতো শৌর্যশালী ও ধৃতিমান ক্ষত্রিয় আর কেউ নেই। তোমার ও আমার তেজ ও বীর্য আজ সমান বোধ হল। আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছি। হে বিশালাক্ষ, আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু দান করছি, তুমি আমাকে অবলোকন করো। তুমি পুরাতন ঋষি! দেবগণ তোমার শত্রু হলেও, তুমি অনায়াসে সংগ্রামে তাদের পরাজিত করতে পারবে।  আমি প্রীতি-প্রফুল্ল চিত্তে তোমাকে অনিবারণীয় অস্ত্র দান করলাম, একমাত্র তুমিই সেই অস্ত্র ধারণে সমর্থ হবে”

দিব্যচক্ষু লাভের পর উমাদেবীর সঙ্গে শূলপাণি মহাদেবকে প্রত্যক্ষ করে পুরঞ্জয় পার্থ নতজানু হয়ে তাঁদের প্রণাম করার পর, তাঁদের স্তুতি করে বললেন, “হে কপর্দ্দিন, হে সর্বদেবেশ। হে ভগনেত্র-নিপাতন, হে দেবদেব মহাদেব। হে নীলকণ্ঠ, জটাধর। হে ত্রিনেত্র, হে ত্র্যম্বক, আপনিই সকল কারণের শ্রেষ্ঠ, আপনিই দেবতাদের গতি, সমস্ত জগৎ আপনার থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। এই ত্রিলোকের মধ্যে, কি দেব, কি অসুর, কি মানব আপনার জেতা কেউই নেই। হে বিষ্ণুরূপ শিব, হে শিবরূপ বিষ্ণো, হে দক্ষযজ্ঞ বিনাশন, হে হরিরুদ্র, আপনাকে নমস্কার। হে ললাটাক্ষ, হে সর্ব, হে বর্ষক, হে শূলপাণে, হে পিনাকধারিন, হে সূর্য, হে মার্জ্জালীয়[xiii], হে বেধঃ, হে ভগবান, হে সর্বভূতমহেশ্বর, আমি আপনাকে প্রসন্ন করছি। হে শঙ্কর, আপনি আমার অপরাধ মার্জনা করুন। হে দেবেশ, আমি আপনার দর্শনের অভিলাষী হয়েই দয়িত তাপসগণের আশ্রয় এই মহাপর্বতে এসেছি। হে ভগবন, আপনি সর্বদেবনমস্কৃত, আমি অসমসাহসিক কর্ম করে আপনার নিকট অপরাধ করেছি, আমাকে ক্ষমা করুন। হে উমাবল্লভ, আমি না জেনে আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করার স্পর্ধা করেছিলাম, এখন আমি আপনার শরণাপন্ন, আমার সেই অপরাধ ক্ষমা করুন”।

মহাতেজাঃ ভগবান ভূতভাবন ভবানীপতি সহাস্যবদনে অর্জুনের বাহু ধারণ করে বললেন, “ক্ষমা করলাম”, তারপর অর্জুনকে আলিঙ্গন করে বললেন, “হে ধনঞ্জয়, তুমি পূর্বজন্মে নর নামের মহাপুরুষ ছিলে এবং নারায়ণের সঙ্গে অনেক অযুত বর্ষ তপস্যা করেছিলে। তুমি ও পুরুষোত্তম বিষ্ণু, এই উভয় ব্যক্তিতেই পরম তেজ সন্নিবেশিত হয়েছে, তোমরাই এই জগতের ভার বহন করছো। হে প্রভো, তুমি ইন্দ্রের অভিষেক সময়ে জলদের মতো গম্ভীরগর্জনশালী মহাশরাসন গ্রহণ করে, নারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে দানবদের বিনাশ করেছিলে। এই তোমার সেই গাণ্ডীব ধনু, যা আমি মায়াবলে গ্রহণ করেছিলাম। হে কুরুনন্দন, তোমার তূণীরদুটি পুনরায় অক্ষয় হবে। আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছি, তুমি নিঃসন্দেহে যথার্থ পরাক্রমশালী, এখন তুমি অভিলষিত বর প্রার্থনা করো। হে অরাতিনিসূদন, এই মর্তলোকে তোমার সদৃশ পুরুষ আর কেউ নেই, স্বর্গেও তোমার থেকে প্রধান ক্ষত্রিয় আর কাউকে দেখছি না।”

অর্জুন বললেন, “হে ভগবান, অনুগ্রহ করে আমাকে বরদান করার অভিলাষ যখন করেছেন, তখন প্রসন্ন হয়ে আমাকে সেই ব্রহ্মশির নামক ঘোরতর দর্শন পাশুপত অস্ত্র দান করুন, যে ভীমপরাক্রম অস্ত্র যুগান্ত সময়ে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডকে একবারে বিনাশ করে থাকে। আমি ঘোরতর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়ে আপনার যে অস্ত্র দিয়ে কর্ণ, ভীষ্ম, কৃপ ও দ্রোণকে সংহার করবো; যে অস্ত্র দিয়ে আমি দানব, রাক্ষস, পিশাচ, গন্ধর্ব ও পন্নগদেরকে সংগ্রামে দগ্ধ করবো। হে ভগবন্‌, এই আমার প্রথম অভিলাষ, আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে এই বিষয়ে সফল ও সমর্থ করুন।”

[মহাবীর অর্জুন সদ্ধর্ম অনুসারে তাঁর অস্ত্র সংগ্রহের কারণ ভগবান শঙ্করকে স্পষ্ট করেই বললেন, কিন্তু ভগবান ভবানীপতি অর্জুনের নিজ হাতে কর্ণ, ভীষ্ম, কৃপ, দ্রোণের সংহারের সঙ্কল্পের কথা শুনেও এতটুকু বিচলিত বা বিরূপ হলেন না! এর থেকে বড়ো নৈতিক সমর্থন আর কী হতে পারে?]

ভগবান মহাদেব বললেন, “হে পার্থ, আমি তোমাকে সেই পরমপ্রিয় পাশুপতাস্ত্র প্রদান করছি। তুমি এই অস্ত্র ধারণ, ব্যবহার ও প্রতিষেধ করতে সমর্থ হবে। মানুষের কথা দূরে থাক, ইন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ ও পবনও এই অস্ত্র ব্যবহারে অভিজ্ঞ নন। তুমি কিন্তু এই অস্ত্র কখনো দুর্বল পুরুষের উপর প্রয়োগ করো না, তাতে সমস্ত জগতের বিনাশ ঘটে যাবে। এই চরাচরে এই অস্ত্রের অবধ্য কেউ নেই! মন, চক্ষু, বাক্য বা শরাসন দিয়ে এই অস্ত্র প্রয়োগ করলে অবশ্যই তেজস্বী শত্রুকুল নির্মূল হয়ে যায়”।

মহাবীর ধনঞ্জয়, ভগবান মহাদেবের কথা শুনে, পবিত্র মনে তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, “হে বিশ্বেশ, আপনি অনুগ্রহ করে, আমকে ওই অস্ত্রের বিষয়ে শিক্ষা দিন”। দেবাদিদেব মহাদেব ত্যাগ ও সংহারের মন্ত্রসহ সেই মূর্তিমান মৃত্যুসম অস্ত্র অর্জুনকে প্রদান করলেন। সেই অদ্ভূত অস্ত্র ত্র্যম্বক উমাপতির মতোই, অর্জুনকেও ভজনা করল, অর্জুনও প্রীতিপ্রসন্ন মনে সেই অস্ত্র গ্রহণ করলেন।

এইভাবে অর্জুন অস্ত্র গ্রহণ করা মাত্র, পর্বত, কানন, সাগর, আকর, নগর ও গ্রাম সহ সমস্ত মেদিনী কেঁপে উঠল। সহস্র সহস্র শঙ্খ, দুন্দুভি ও ভেরির আওয়াজ গর্জন করে উঠল। দেব ও দানবেরা দেখলেন, ওই মারাত্মক অস্ত্র অর্জুনের হস্তগত হয়েছে! দেবাদিদেব মহাদেব অমিত তেজবান অর্জুনের গাত্র স্পর্শ করা মাত্র, তাঁর শরীরের সকল অশুভ বিনষ্ট হয়ে গেল। তারপর ভগবান শূলপাণি অর্জুনকে স্বর্গে যাওয়ার অনুমতি ও নির্দেশ দিলেন। মহাবীর পাণ্ডুনন্দন ভগবানকে প্রণাম করে, কৃতাঞ্জলি হয়ে, সপত্নীক ভগবানের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলেন। এরপর প্রসন্নচিত্ত ভবানীপতি ভগবান, তাঁর সামনেই উমাদেবীকে সঙ্গে নিয়ে, গিরিবর হিমাচল ছেড়ে, আকাশমার্গে প্রস্থান করলেন।


...চলবে 



[i] গোধা – গোসাপ, গোসাপের চর্ম থেকে বানানো অঙ্গুলিত্র।

[ii] স্বর্ণমুদ্রা।

[iii] আকাশ-চর

[iv] সেবিত, আরাধিত

[v] নিরলস, আলস্যহীন

[vi] থামো।

[vii] ঘূর্ণিময়, স্রোতোস্বিনী।

[viii] নিম্নগামী, নদী, নদীর স্রোত সর্বদাই নিচের দিকে প্রবাহিত হয়।

[ix]  বালিহাঁস

[x] তৃণ, কুশ।

[xi] লৌহমুখ বাণ।

[xii] যজ্ঞবেদী।

[xiii] কিরাত, শুদ্ধদেহ, নীলকণ্ঠ


নতুন পোস্টগুলি

চ্যালেঞ্জ - নাটক

  কুশীলব   (মঞ্চে প্রবেশের ক্রম অনুসারে)   প্রাণপণবাবু                       কমলা – প্রাণপণবাবুর স্ত্রী                  প্রতাপ – প্...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ