সকাল ছটা নাগাদ আমরা চারবন্ধু এসে তেরাস্তার মোড়ে দাঁড়ালাম। এখান থেকে ডানদিকের রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই শ্যামলদের বাড়িটা। ওখানেই শ্যামল গত রাত্রে শুতে এসেছিল। আমরা সবাই, এমনকি আমার বাবা-মা-দাদাও পঞ্চাশবার বলেছিল – রাত্রে ও বাড়িতে না থাকতে। হতভাগা কারো কথায় কান দিল না। আমাদের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া সেরে সাড়ে নটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ল। সঙ্গে নিল একটা শতরঞ্চি, মাথার বালিশ, একটা মশারি আর চাদর। এক বোতল জল, একটা গল্পের বই আর টর্চ। আমরাও ওর সঙ্গে এসেছিলাম – এই মোড় অব্দি। তখনও ওকে বুঝিয়েছিলাম – জেদ না করে, ফিরে আসতে। শোনেনি, বলেছিল, নিজের বাড়িতে নিজের বিছানায় ঘুমোনোর মজাই আলাদাই। চলি রে, গুডনাইট।
গতকাল শ্যামল ওর বাড়ির
দিকে চলে যাওয়ার পর আমরা কিছুক্ষণ এই মোড়েই দাঁড়িয়েছিলাম। আমরা ঠিক করেছিলাম আজ
সকাল হলেই ওর বাড়িতে আমরা একসঙ্গে হানা দেব। হতভাগাটা বেঁচে আছে না মরে গেছে – সেটা তো
দেখতে হবে!
শ্যামলের জন্যে কেন আমরা
সকলেই এত উদ্বিগ্ন সে কথাটা বলি। ওদের বাড়িটা কয়েক বছর হল খালি পড়ে আছে – কেউ থাকে
না। বেচারার বাবা-মা মারা গেছেন ওর ছোট বেলাতেই। দূর সম্পর্কের এক পিসি থাকতেন
ওদের বাড়িতে, তিনিও মারা গেলেন বছর ছয়েক আগে। লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট শ্যামল – অর্থাৎ শ্যামলেন্দু, পাঁচ বছর আগে উচ্চ
শিক্ষার জন্যে যখন বিদেশ গেল, ও বাড়িতে থাকার মতো আর কেউই রইল না। সব ঘরে এবং সদর
দরজায় তালা দিয়ে ও বেরিয়ে গিয়েছিল – চাবির গোছাটা রেখে গিয়েছিল আমাদের বাড়িতে।
দীর্ঘদিন বাড়িতে কেউ
বসবাস না করলে যা হয় – শ্যামলদের বাড়িটাও প্রায় হানাবাড়ি হয়ে উঠছিল। চারপাশে ঝোপঝাড়
- আগাছার জঙ্গল। বাড়ির দেওয়ালে পুরু শ্যাওলার আস্তর – ছাদের আলসেতে দুটো চারটে
বট-অশথের চারা...। সত্যি বলতে বাড়িটার দিকে তাকালে দিনের বেলাতেও গাটা কেমন ছমছম
করে উঠত। তার ওপর ও পাড়ার লোকদের মুখে শুনেছি – রাত্রে অন্ধকার বাড়ির ভেতর থেকে
কেমন যেন হাড়হিম করা শব্দ হয়। কারা যেন চাপা গলায় কথা বলে, হাসে, এমনকি কাঁদেও! এ
ছাড়াও ওদের বাড়ির ঝোপঝাড় থেকে মাঝে মধ্যেই বেরিয়ে আসত – দু একটা গোখরো, কেউটে...।
স্বাভাবিকভাবেই পাড়ার লোক এলাকাটা এড়িয়ে চলতে লাগল।
এত বছর বাদে গতকাল
বিকেলে শ্যামল আমাদের বাড়ি এল। বলছিল, এখন থেকে ও এখানেই থাকবে। এখান থেকেই কলকাতার
অফিসে যাওয়া আসা করবে। ওর আসার খবর পেয়ে আরো তিন বন্ধু এল, জিতু, বিনু আর বাবু। স্কুলে
পড়ার প্রথমদিন থেকে কলেজের শেষদিন পর্যন্ত আমাদের পাঁচজনের বন্ধুত্বে কোনদিন
এতটুকু আঁচড় পড়েনি। ছোটবেলা থেকেই পাড়ায়-ঘরে আমরা পাণ্ডব নামে পরিচিত ছিলাম।
আমাদের মধ্যে শ্যামল লেখাপড়ায় সব থেকে
ভালো ছিল – কলেজ পাশ করে সে বাইরে চলে গেল – আমরাও লেখাপড়া শেষ করে কাজে লেগে
গেলাম। অতএব এতদিন পরে শ্যামলেন্দু ফিরে আসায় আমরা সকলেই খুব খুশি হয়েছিলাম সন্দেহ
নেই।
যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে
আমরা চারবন্ধু শ্যামলের বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। গেট দিয়ে ঢুকে চারপাশটা লক্ষ্য করেই
বুকের ভেতরটা কেমন গুরগুর করে উঠল। চারদিকেই কেমন যেন অস্বস্তিকর অমঙ্গলের লক্ষণ। বিনু
আর জিতু আমাদের মধ্যে সব থেকে সাহসী, বলল, চল ভেতরে ঢুকি। নীচের সদর দরজাটা ভেজানো
ছিল – ঠেলতেই খুলে গেল। একতলার চারটে ঘরেই তালাবন্ধ। বাঁদিকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। শ্যামলের
ঘরটা দোতলায়। ও যখন এখানে থাকত - কতবার
এসেছি আমরা। দোতলায় উঠে সিঁড়ির ডানদিকের দ্বিতীয় ঘরটা শ্যামলের।
শ্যামলের ঘরের দরজাটাও
ভেজানো। বিনু ডাকল, “শ্যামল, উঠেছিস?”
কোন সাড়া না পেয়ে আমি
দরজায় ঠেলা দিলাম। খুলে গেল। মেঝেয় পাতা শতরঞ্চিতে শ্যামল শুয়ে আছে - আমাদের দিকে
পিছন ফিরে। কিন্তু ওর মুখটা দরজার দিকে ফেরানো এবং বিস্ফারিত দুই চোখ স্থির
দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। বিছানা থেকে একটু তফাতে জলের বোতলটা গড়াচ্ছে। খোলা
বইটা উলটে পড়ে আছে একটু দূরে। মশারির তিনটে খুঁট খোলা এবং কেউ যেন সেটাকে ঝটকা
দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে, বিছানা থেকে একটু দূরে।
ভালো করে দেখার জন্যে
আমি ঘরের ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিলাম, জিতু জামার কলার ধরে আমায় বাইরে টেনে এনে ফিসফিস
করে বলল, “শ্যামলটা তো মরেছে...তুইও মরবি নাকি? এখানে আর এক মূহুর্তও নয়...পাড়ার
সবাইকে খবর দিই – চল...”। বিনু আমার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে লাগল, পিছনে জিতু
আর বাবু।
খবরটা পাড়ায় চাউর হতে
বেশি সময় লাগল না। দত্তজ্যেঠু আমাদের পাড়ায় বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি, তিনি আমাদের কথা শুনে
বললেন, “এখন কেউ ও বাড়িতে যাবি না। বাইক নিয়ে দুজন এখনই বেরিয়ে যা, থানায় গিয়ে
খবরটা জানিয়ে আয়। তারা যা ভালো বুঝবে তাই করবে”।
পাড়ার বয়স্ক সকলেই তাঁকে
সমর্থন করলেন, জিতুর বাবা বললেন, “ঠিক বলেছেন দত্তদা। বারবার মানা করা সত্ত্বেও শ্যামল
নিজের দোষে মারা পড়ল। এখন আর আমাদের কী করার আছে?”
বিনুর কাকিমা বললেন, “ঠিক
কথা। কথায় বলে - ডানপিটে ছেলেদের বেঘোরে মরণ হয় - এর মধ্যে কেউ যদি নাক গলিয়েছিস -
তার ঠ্যাং আমি ভাঙবো, এই বলে রাখলাম। যা করার পুলিশকে করতে দে”।
আমার বাবা বাড়িতে ছিলেন
না, বাজারে গিয়েছিলেন। পাড়ার মুখে ভিড় দেখে, থলে ভর্তি বাজার নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন,
জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হয়েছে দত্তদা? সবাই বাইরে কেন?”
দত্তজ্যেঠু অবাক হয়ে
বললেন, “সেকিরে জগু, কিছুই শুনিসনি? শ্যামলতো কাল রাত্রে মারা গেছে – মটকানো ঘাড় নিয়ে
ওর ঘরের বিছানাতেই পড়ে আছে তার দেহটা...”।
বাবা চমকে উঠে বললেন,
“কী সাংঘাতিক কাণ্ড, কারা করল এসব? কিন্তু...”।
বিনুর কাকিমা বললেন,
“কারা করল – সে কথা মুখে না আনাই ভালো দাদা। কিসের থেকে কী হয় – বলা যায়?”
জিতুর বাবা বললেন,
“দত্তদা বলেছেন – যত তাড়াতাড়ি সম্ভব থানায় খবর দিতে... আমাদেরও তাই মত...”
বাবা বললেন,
“কিন্তু...”।
দত্তজ্যেঠু একটু বিরক্ত
হয়েই বললেন, “আবার কিন্তু কিসের জগু?” জগু আমার বাবার নাম - জগদানন্দ।
বাবা বললেন, “আমি তো শ্যামলকে
পানুর চায়ের দোকানে বসে থাকতে দেখলাম...আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, কাকু বাজার হয়ে
গেল? আপনাদের বাড়ি গিয়েছিলাম – স্বপনকে অনেক বার ডাকলাম – সাড়াই দিল না। সকাল সকাল
কোথায় যে গেল...। তাই পানুদার দোকানে এলাম চা খেতে”। “কোথায় আর যাবে – তুমি বাড়ি এসো
বাবা...আমি এগোচ্ছি” - বলে আমি চলে এলাম – হাতে ভারি থলে – তাই আর দাঁড়াইনি”।
আমরা তো বটেই, উপস্থিত সকলে
স্তম্ভিত হয়ে গেল বাবার কথা শুনে। কারো মুখে কোন কথা নেই। আমার ঠাকুমা এতক্ষণ চুপ
করে সবার কথা শুনছিলেন, বললেন, “বাজারের থলিটা ঘরে রেখে আয়, জগু – খুব জোর বেঁচে
গেছিস ওই থলিটার জন্যে”।
বাবার হাত থেকে বাজারের
থলিটা নিয়ে আমিই দৌড়ে বাড়িতে রেখে এলাম। তারপর ফিরে এসে যা শুনলাম – মাথা থেকে পা
পর্যন্ত শিউরে উঠল। শ্যামল এখন নাকি নিশি হয়ে সবাইকে ডেকে ডেকে বেড়াচ্ছে...। নিশি হচ্ছে এক ধরনের ভূত, নিজের দল ভারি করার
জন্যে সে নাকি বন্ধু-বান্ধব, চেনাজানাদের ডেকে ডেকে বেড়ায়। যে সেই ডাকে সাড়া দিয়ে তার
সঙ্গে যায় – ব্যস্, সেখানেই তার শেষ। পরাণপাখিটা ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় নিশির সঙ্গে,
আর পড়ে থাকে তার প্রাণহীন দেহটা। আমার আর বাবার ভাগ্য খুব ভালো। কারণ আমি শ্যামলের
ডাকে সাড়া দিইনি আর বাবা ভারি থলির জন্যে শ্যামলের কাছে যেতে পারেননি। কী ভয়ংকর
বিপদ থেকে যে আমরা পরিত্রাণ পেয়েছি – সে কথা ভেবে, আমি আরও একবার শিউরে উঠলাম।
ওই জমায়েতে বয়স্করা সকলেই
যখন তাঁদের শোনা ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন, সেই সময়েই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল
শ্যামল। সামনে এসে বলল, “এ রাম, তোরা সব এখানে? আর আমি তোদের খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। কিন্তু কী
ব্যাপার রে? এত ভিড় কেন এখানে? কী হয়েছে?”
উপস্থিত সক্কলে হতবাক
দাঁড়িয়ে রইলাম শ্যামলের মুখের দিকে তাকিয়ে। একটু পরে বিনুর কাকিমা আমার ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা
করলেন, “ও খুড়িমা, ভূতের মুখে কোনোদিন রাম নাম শুনেছ?”
ঠাকুমা আমতা আমতা করে
বললেন, “না বাপু, আমাদের কালে এসব শুনিনি। আজকাল সবই যেন পালটে যাচ্ছে”!
ঘটনার ঘনঘটায় হতভম্ব হয়ে
গেলেও, শ্যামল বেঁচে আছে জেনে খুব আনন্দ পেয়ে আমি বললাম, “তুই...তুই তার মানে মারা
যাসনি? দিব্যি বেঁচে আছিস...!”
“আমি মরে গেছি? কোন
দুঃখে মরব রে, হতভাগা? ওঃহো বুঝেছি...তোরা তো রাম ভীতুরে...”। বলে শ্যামল হাসতে
লাগল হো হো করে। দত্তজ্যেঠু খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোর এত হাসি পাচ্ছে কেন,
শ্যামল?”
শ্যামল খুব লজ্জা পেয়ে বলল,
“দোষটা আমারই জ্যেঠু। গতকাল ও বাড়িতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত স্বপনরা আমাকে বারবার
নিষেধ করেছিল। বলেছিল ও বাড়িতে নির্ঘাৎ ভূত আছে। শুনে ভয় যে করেনি তা নয় - তবুও
জিদ করেই গিয়েছিলাম। বিছানা করে রাত্রে শোয়ার পরেও বেশ ভয় ভয় করছিল। কিন্তু
মোমবাতির আলোয় বই পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম – বুঝতেও পারিনি। পাখিদের
ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। আমার ঘরে শুয়ে এত ধরনের বিচিত্র পাখির ডাক আগে কোনদিন
শুনিনি, জ্যেঠু – আজ সকালে যেমন শুনলাম। বুঝতে পারলাম ভূত-টূত কিস্সু নেই – ওসব আমাদের
কল্পনা। আসলে প্রকৃতিই আমাদের পরিত্যক্ত বাড়িটাকে ঘিরে ফেলেছে।
নীচেয় নেমে বাড়ির চারদিকটা
কিছুক্ষণ ঘুরলাম। আমকে দেখেই বেশ কিছু প্রাণী সট্সট্ ঢুকে পড়ল ঝোপঝাড়ের পিছনে –
মনে হল মেছোবেড়াল আর ভাম। একটা নেউলকেও দেখলাম। তাদের সবারই ভাবখানা – আমাদের জগতে
তুমি আবার কে হে, উড়ে এসে জুড়ে বসলে? এদের প্রায় সকলেই রাতচরা প্রাণী, বুঝলাম এদের
চলাফেরার আওয়াজ কিংবা ডাকাডাকি শুনেই আশেপাশের মানুষ ভয় পায়। তখনই মনে হল স্বপনদের
সঙ্গে একটু মজা করলে কেমন হয়?
ওপরে গিয়ে মশারিটা খুলে ছুঁড়ে
দিলাম একদিকে। জলের বোতলটা গড়িয়ে দিলাম মেঝেয় – আর বইটা খোলা অবস্থায় রেখে দিলাম
একটু দূরে। তারপর গায়ের জামাটা খুলে উলটো করে পরলাম। বোতাম লাগানো দিকটা রইল পিঠের
দিকে... ব্যস্। অপেক্ষায় রইলাম কখন স্বপনরা আসে।
ছটা দশ নাগাদ সিঁড়িতে পায়ের
শব্দ পেলাম। আমি বিছানায় শুয়ে পড়ে চাদরটা টেনে নিলাম বুক অব্দি। কারণ জামা উলটে
বুককে পিঠ বানানো যায় – কিন্তু পাদুটোকে তো উল্টোনো যায় না। তারপর হাতদুটোও চাদরের
ভেতর লুকিয়ে নিলাম। ওরা এসে ঘরের দরজা ঠেলতেই স্থির চোখে তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে।
ওরা ভাবল আমি ঘাড় মটকে মারা গেছি। স্বপন ঘরের ভেতরে আসছিল – কিন্তু জিতু ওকে টেনে বাইরে
নিয়ে গেল। স্বপন ঘরে ঢুকলে আমি ধরা পড়ে যেতাম – চোখের পাতা না ফেলে কতক্ষণ আর
একভাবে তাকিয়ে থাকা যায়?”
শ্যামলের কথা শেষ হতে
আমরা সকলেই হাসতে লাগলাম, বললাম, “হতভাগা খুব ঠকালি, আমাদের”!
শ্যামল লাজুক হেসে বলল,
“ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াবে, আমি বুঝিনি জ্যেঠু... এক্সট্রিমলি সরি”।
আমার ঠাকুমা হাসতে হাসতে
শ্যামলের একটা কান ধরে বললেন, “তুই কেন সরি হবি, বাবা? তুই তো আমাদের সকলের চোখ
খুলে দিলি রে, হতভাগা ডানপিটে - দস্যি ছেলে”!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন