বিশ্বলোকের সাড়া - চতুর্থ পর্ব
প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)
কেমন করে গান কর, হে গুণী
সেই কোন মেয়েবেলা থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে আমার নিবিড়
সম্পর্ক গড়ে উঠেছে – সে কথা ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। বড় হতে হতে
তাঁর গান যত শুনেছি, শিখেছি, এবং গেয়েছি, ততই মনে হয়েছে তাঁর অজস্র লেখা – বিশেষতঃ তাঁর প্রতিটি গান কী আশ্চর্য
বর্ণময়। প্রতিটি ঋতুর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে – আমাদের মনের যাবতীয় সূক্ষ্ম আবেগকে এমন
বাণীময় সুরে আলোকোজ্জ্বল করে তুলেছেন তিনি কোন জাদুতে। মাঝে মাঝে মনে হয় - বয়েসের
সঙ্গে সঙ্গে আমার মননে তাঁর গানের যে পূর্ণতার পরশ পেয়েছি – সে হয়ত একজন্মে
সম্পূর্ণ হওয়ার নয়। জন্মান্তর বলে সত্যিই যদি কিছু থেকে থাকে – পার হয়ে যাবে হয়ত
আরেক জন্ম – কে জানে হয়তো আরও অনেক
জন্ম।
“যা দেখেছি যা পেয়েছি
তুলনা তার নাই।
এই
জ্যোতিঃসমুদ্র-মাঝে
যে শতদল
পদ্ম রাজে
তারি মধু
পান করেছি
ধন্য আমি তাই - ”
বাস্তবিক ঠিক এমন মানসিকতার মধ্যেই শুরু হল আমার নতুন পথ
চলা। নিজের গায়কী সত্ত্বার উদ্ভাবন। সেই দিনটি ছিল একান্ত ঘরোয়া, আন্তরিক
এক সান্ধ্যসঙ্গীতের আসর। সেখানে আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম। আর সেখানেই ঘটে গেল আমার
জীবনের মোড় ঘোরানো এক ঘটনা—প্রথম দর্শন, প্রথম শ্রবণ—এক
মহান শিল্পীর সঙ্গে। এমন একটি মুহূর্ত যে আমার সঙ্গীত-জীবনে উদয় হবে, তা কোনোদিন কল্পনাতেও আসেনি। কখনও কখনও জীবন এমন কিছু সৌন্দর্য নিয়ে আসে
যা স্বপ্নকেও ছাপিয়ে যায়—এ যেন এক অলৌকিক স্পর্শ, এক
অভাবনীয় আশীর্বাদ।
সেই আসরে পরিচয় হল উস্তাদ গুলাম আব্বাস খানজির সঙ্গে।
বিশ্ববরেণ্য এই হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় ও গজল শিল্পী, যাঁর
কণ্ঠে বহমান এক প্রাচীন ঐতিহ্য—মিয়াঁ তানসেনের উত্তরাধিকারী রামপুর সাহাসওয়ান
ঘরানার শ্রেষ্ঠতম রূপ। তাঁর গলায় ছিল যাদু, তাঁর সুরে ছিল
এক অন্তর্লীন ব্যঞ্জনা। তাঁর প্রতিটি তান যেন সময়কে থমকে দাঁড় করিয়ে দেয়। তাঁর
প্রতিটি আলাপন শ্রোতাকে নিয়ে যায় ঊর্ধলোকের পবিত্র এক জগতে। আমি আপ্লুত হলাম,
বিমুগ্ধ হলাম।
এভাবেই জীবনের পটে আঁকা হল এক অনির্বচনীয় অধ্যায়ের শুরু
- এক অনন্যসাধারণ শিল্পীর সম্যক সাহচর্য।
এই পরম সৌভাগ্য সামান্য এক পরিচয় নয়, এ এক
অন্তর্জাগরণের মুহূর্ত—যেখানে আমার সংগীতসাধনা যেন এক নবজন্ম খুঁজে পেল। স্বরবিতানের স্বরলিপি অনুসরণ কিংবা
অনুকরণ করে এতকাল যে গান আমি চর্চা করেছি – উস্তাদজি মহার্ঘ আসন বিছিয়ে আমাকে
বসিয়ে দিলেন সেই সঙ্গীতের খাস দরবারে। এই
যাত্রা শুরু হয়েছে তাঁর আশীর্বাদ ও সান্নিধ্যে, আমি অন্তরে গভীরভাবে অনুভব করি—এ পথ আমায় নিয়ে
চলবে আরও উচ্চতর সাধনার দিকে। সে সাধনায় আমার পাথেয় হোক – আপনাদের সকলের শুভেচ্ছা
এবং আন্তরিক আশীর্বাদ। তিনটি গানের
নৈবেদ্যে এখানে রইল –
অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
স্মৃতির মণিমুক্তোর ভাণ্ডার হাতড়ে কত কথাই যে মনে পড়ে! তখনই মনে হয়, এসবই আমার ওপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ।
একসময় আমি একজন নামী ফটোগ্রাফারের সঙ্গে কাজ করতাম, তাঁর
নাম রস ক্লেটন (Ross Clayton)। তাঁর মূল পেশা ছিল
মেডিক্যাল ফোটোগ্রাফি, কিন্তু তিনি পোর্ট্রেট আর ল্যাণ্ডস্কেপ স্টাডিতেও
ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সেই কাজেই আমি তাঁকে কখনো সখনো সামান্য কিছু সাহায্য করেছি। সেই
সূত্রে রস-এর সঙ্গে গিয়েছিলাম পৃথিবীবিখ্যাত ফটোগ্রাফার ব্রায়ান ব্রেক (Brian
Brake)-এর প্রদর্শনী দেখতে। সেখানেই প্রথম দেখলাম তাঁর নামকরা ছবি,
“Monsoon Girl”, যার সাবজেক্ট আর কেউ নয়, আমাদের
অতি পরিচিতা অপর্ণা সেন। ওঁর পিতা শ্রীযুক্ত চিদানন্দ দাশগুপ্তর বন্ধু ব্রায়ানের
লেন্সে ধরা পড়েছে কিশোরী অপর্ণার বৃষ্টিস্নাত মুখ, ফটোগ্রাফির
জগতে অমর হয়ে গেছে ওই চিত্রপট।
সেই সন্ধ্যায় প্রদর্শনীর workshop জমা হওয়া উপস্থিত
অতিথিশিল্পী ও দর্শকরা যখন শুনলেন, আমিও ভারতবর্ষের কলকাতার
কন্যা, তাঁরা ধরে নিলেন, আমি নিশ্চয়ই Monsoon
Girl-এর পরিচিতা। তাঁরা আমাকে কিছু বলার জন্যে অনুরোধ করলেন। আমি
বললাম, ব্যক্তিগতভাবে ওঁকে চিনি না, তবে
উনি বাংলা তথা ভারতের একজন প্রখ্যাতা অভিনেতা ও চিত্রপরিচালক। উনি কান ফিল্ম
ফেস্টিভ্যালের নিমন্ত্রিত বিচারক হয়েছিলেন এবং এই সব পরিচয় ছাড়াও তিনি একজন
চিন্তাশীল লেখক। সেদিন এসব কথা বলতে বলতে আমি বারবার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিলাম এই
গৌরবে যে, কলকাতা বা ভারতের পরিচিতি শুধু শুধু গরিব এবং
পিছিয়ে পড়া দেশ হিসেবে নয়, সেখানে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন
ঐতিহ্যের ইতিহাস ছাড়াও এমন অনেক কিছু আছে, যার স্বীকৃত
বিশ্বজোড়া।
বেশ কয়েকবছর আগে কলকাতার এক নামি ব্যাণ্ড “চন্দ্রবিন্দু”
এসেছিল অকল্যাণ্ডে অনুষ্ঠান করতে। ব্যাণ্ডের এক গায়কের পুত্র, নিজি-র
ক্রিকেট অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের বিরাট ভক্ত, তার আবদার
কেনের একটি ছবি তার চাই। উদ্যোক্তাদের সকলেই জানতেন, আমরা
তোরঙার বাসিন্দা, আর কেনও তোরাঙার গর্ব। সেই উদ্যোক্তাদের
একজন (আমাদের খুবই অন্তরঙ্গ বন্ধু) বাড়ি থেকে ফোনে আমাকে বললেন, “কুটুদি, আমি বলেছি, তোমরা
কেনকে চেনো, সেই শুনে একজন তোমার সাথে কথা বলতে
উদ্গ্রীব...”। তারপর “চন্দ্রবিন্দু”-র সেই শিল্পীর বিনীত অনুরোধ পেলাম, “দিদি, আমায় একটা ছবি অন্ততঃ দেবেন, না হলে আমার পুত্র আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না, কান্নাকাটি
জুড়ে দেবে। বলবে, আমি নিজি ঘুরে গেলাম অথচ কেন-এর একটা ছবিও
নিয়ে যেতে পারলাম না?” পুত্রের প্রতি পিতার গভীর এই স্নেহ
দেখে আমি খুবই আনন্দ পেলাম।
উইলিয়ামসন পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি ক্রিকেট সূত্রেই।
আমাদের পুত্র আবীর কেনের সঙ্গেই ক্রিকেট খেলেছে, পাঁচ-ছ বছর থেকে – স্কুল দলে,
আঞ্চলিক ও প্রাদেশিক দলে। সেই দলের কোচ এবং ম্যানেজার ছিল আমার
স্বামী কাজল।
আমি সেই রাত্রেই ফোন করলাম কেন-এর বাড়িতে, ওর মা
জানালেন, কেন তখন দেশের বাইরে। আমার অনুরোধ শুনে তিনি খুবই
খুশি হলেন, পুত্রের খ্যাতি এবং ভক্তজন সুদূর ভারতবর্ষেও
ছড়িয়ে রয়েছে শুনলে কোন মা উচ্ছ্বসিত না হবেন? তার পরের দিনই উনি কাজলের অফিসে
পোঁছে দিয়েছিলেন, কেনের সই করা ফটো।
এ ব্যাপারটা আমরা ভারতীয় প্রেক্ষীতে হয়তো ভাবতে
পারিনা। কিন্তু এদেশে এটাই স্বাভাবিক।
জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গেলেও তারকারা দূর আকাশের অধরা নক্ষত্র হয়ে যায় না। কেন শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে নয়, অধিনায়ক
হিসেবেও চূড়ান্ত সফল, তার প্রমাণ মিলেছে, গত বিশ্বকাপের এবং টেস্টচ্যাম্পিয়ন্স কাপের ফাইন্যালে। কেন শুধু ক্রিকেটার
হিসেবে নয়, খুব বড়ো মনের মানুষ হিসেবেও অত্যন্ত জনপ্রিয়।
এই প্রেক্ষীতে আরেকটি ঘটনার কথাও বলতে চাই, সেবার
ভারত নিজি সফরে এসেছিল ওয়ান-ডে সিরিজ খেলতে।
তোরঙার স্টেডিয়ামেও একটা ম্যাচ হয়েছিল, সেখানে আমরাও
উপস্থিত হয়েছিলাম খেলা দেখতে। আমরা যখন মাঠে ঢুকে স্টেডিয়ামের দিকে এগোচ্ছি,
কেন নেট প্র্যাকটিস সেরে ফিরছিল প্যাভিলিয়নের দিকে। আমাদের দেখতে
পেয়ে, কেন এগিয়ে এল, আমাদের সঙ্গে হাত
মেলালো, কয়েকটা কথা বলে চলে গেল প্যাভিলিয়নে। বিশ্ববিখ্যাত
তারকার এমন সৌজন্য আমাদের অভিভূত করেছিল নিঃসন্দেহে। এর বিপরীতে, কয়েক বছর আগের কোন এক ম্যাচে ভারতীয় টিমের জনৈক বাঙালী খেলোয়াড়কে মাঠে
উপস্থিত বেশ কিছু বাঙালী দর্শক বাংলায় ডেকেও কোন সাড়া পাননি। তিনি ফিরেও দেখেননি,
সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেছিলেন, ভারতীয় এবং বাঙালী
দর্শকদের। হতে পারে ভারতবর্ষে জনপ্রিয়তার উন্মত্ততা, তারকাদের
জনস্রোত থেকে দূরে থাকতে শেখায়। অথবা হয়তো তাঁদের অহমিকা গগনচুম্বী। এখানকার সমাজে
এমনটা কখনো চোখে পড়েনি, তারকা খেলোয়াড়, বিশ্বজয়ী অ্যাথলিট, এমনকি প্রধানমন্ত্রীকেও সাধারণ
মানুষের সঙ্গে সহৃদয় আলাপে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। খ্যাতি বা ক্ষমতা এখানকার
মানুষদের মধ্যে দূরত্ব গড়ে দেয় না। এঁদের সকলেই এই মূল্যবোধে বিশ্বাস করেন যে,
তাঁরা নিজেদের গুণেই সাফল্য এবং খ্যাতি অর্জন করেন ঠিকই, কিন্তু জনগণের জন্যেই তাঁদের এই জনপ্রিয়তার গৌরব।
চলবে...
ভালোই লাগছে পড়ে ....
উত্তরমুছুনThank you ❤️
মুছুনরিসেন্ট রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলো কুটু ফার্স্টক্লাস গেয়েছে।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ। খব ভালো লাগলো জেনে।
মুছুনCommented by Ustad Ghulam Abbas Khan:-
উত্তরমুছুন"Dear Pradipta
I read your story. It's beautiful and heart touching. It's an amazing journey. I am so happy that you carried your music to New Zealand and contributed so much towards Indian art and culture. You also contributed so much to the society of New Zealand.
I wish you all the very best .
Countless blessings" 🙏
🙏
উত্তরমুছুনEnjoyed reading. Stay blessed 🙏
উত্তরমুছুনCommented by Mr. Debashish Bakshi, Kolkata
Bondhu, about your powerful work, supporting women affected by domestic violence, and I was deeply moved. Your dedication, the depth of your training, and the strength of your connections in this vital cause truly inspire me. I’m profoundly proud of you—for your courage, compassion, and unwavering commitment. Keep shining your light where it’s most needed.” 🙏🏽🥰
উত্তরমুছুনSampa
USA.