Powered By Blogger

রবিবার, ৬ জুলাই, ২০২৫

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)-র আত্মকথন - বিশ্বলোকের সাড়া - পর্ব ৩

 বিশ্বলোকের সাড়া - তৃতীয় পর্ব 

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)


বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি, সেই তো স্বর্গভূমি

অভিবাসী পরিবারের অন্দরমহলে এই রকম ঘনিষ্ঠতার জন্যেই কানে আসতে লাগল, ছাত্রীদের দৈনন্দিন জীবনের নানান সমস্যার কথা। তার মধ্যে থাকতো তাদের শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচারের কথাও। এই ঘটনাগুলো আমায় ভীষণ ভাবে নাড়া দিত। আমি একই সঙ্গে চিন্তিত আর ব্যথিত হতাম। ভাবতাম ওঁদের জন্যে কী করে কিছু করা যায়, কারণ কিছু না করে চুপ করে মেনে নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছিল আমার কাছে। কী করে ভুলে যাই রবীন্দ্রনাথের সেই মন্ত্র, “অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে”।  

ESOL এর সমন্বয় আধিকারিক (co-ordinator) Philippa Cairns-কে একদিন বলেই ফেললাম, আমি এঁদের জন্যে এ ব্যাপারে কিছু করতে চাই। ফিলিপা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন, তাঁর সহযোগিতায় আমি পড়াশোনা এবং খোঁজ-খবর শুরু করলাম, পারিবারিক-হিংসা (Family-Violence)-র ব্যাপারে এদেশের আইন-কানুন কতখানি সজাগ।   

এই সময়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ হল এক মহিলা’র তিনি তখন সবে অকল্যান্ডে একটি সামাজিক সংস্থা (Social Organisation) শুরু করেছেন পারিবারিক-হিংসা’র-শিকার মহিলাদের (Domestic Violence victim ) জন্য । আমি সেখানে প্রথম ট্রেনিং নিলাম এই নির্যাতিতাদের সাহায্য করার। ওখানে ছাড়াও আমি আরো কয়েকটি অন্যান্য সামাজিক সংস্থা থেকেও অন্য ট্রেনিংও নিলাম। এইভাবেই আমার কাজের শুরু। আমি যুক্ত হলাম Tauranga Women’s Refuge- বলে একটি সংস্থাইয়। এটি একটি নারী-আবাস, সেখানে পারিবারিক হিংসার শিকার মেয়েদের আশ্রয় দেওয়া হয়। এ ধরনের নারী-আবাস অবশ্য দেশের অন্য অনেক শহরেই আছে। 

এখানে কাজ করতে করতে আমি অনুভব করলাম, একজন ইংরেজি না জানা একা এক অভিবাসী নারীর পক্ষে, যে কিনা এসেছে সম্পূর্ণ অন্য সমাজ এবং ধর্ম থেকে, পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক উঠতে পারে। এই সংগঠন তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়ালেও, তার জীবনে আরও কত যে সমস্যা আছে যার কোন ধারণাই নেই এই সংগঠনের কর্মীদের। ইংরেজি না জানায়, এঁরা এঁদের সমস্যার কথা, মানসিক পীড়ার কথা আলোচনা করতে পারেন না, আর কাউন্সেলরদের পক্ষেও তাদের দৈনন্দিন জীবনের জটিলতার কথাও বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না। এমন অনেক সামাজিক প্রথা, রীতিনীতি, অভ্যাস, সেগুলি সবই না বলা থেকে যায়, যেগুলি উন্নতদেশের বিদেশীদের চোখে মূল্যহীন। 

একদিন অনেক সাহস নিয়ে শুরু করলাম “দিশা” - Ethnic Women's Support Group। যে সংস্থা অসহায় নারীদের দিশা দেখাবে। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল Women Empowerment & womens’ rights। 

আমার সন্তানেরা তখন বেশ ছোট, ছোটটির বয়স দুই আর বড়জন আট। কিন্তু তাও সাহস করে নেমে পড়লাম; অভিবাসী মহিলাদের ওই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারিনি। কাজল গোড়া থেকেই আমার পাশে ছিল, অনেক সাহায্য করেছে। প্রথমে বাড়ি থেকেই কাজ করতাম, তারপরে একটা অফিস শুরু করি।  কয়েক বছর পরে চালু করতে পারলাম সেফ হাউজ। এটি শুধু অভিবাসী মহিলাদের জন্যই। বহু নিপীড়িত মহিলাকে আশ্রয় দিতে পেরেছি। বহু মহিলা এখানে থেকে নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে বা আবার নতুন করে বাঁচতে শিখেছেন। এই কাজের সূত্রে আমি পেয়েছি এক ভালো বন্ধু। Angie Warren-Clarke। এঞ্জি ছিলেন তৌরাঙা রিফুজের কোওর্ডিনেটর। আমরা একসাথে কাজ করেছি। কাজের সূত্রে আমরা দুজনে ভালো বন্ধু হয়ে গেছি। এখন উনি আমাদের পার্লামেন্টের একজন এমপি। 

বাইশ বছর আগে যখন আমি “দিশা” শুরু করি, ওই মহিলাদের সামাজিক মননে ছিল অটল-অহমিকার চূড়ান্ত ভ্রান্তি। আমার কাজের কথা কাউকে বলতে পারতাম না। বহু মানুষের, বিশেষতঃ পুরুষদের ধারণা ছিল, আমার কাজের জন্যে তাঁদের সংসার ভাঙছে। এমনকি আমার মেয়েও যখন আমায় প্রশ্ন করতো 'মা, তুমি কি করো?', আমি মিথ্যে বলতাম, “আমি গান করি, মানুষকে গান শোনাই”! 

এতদিনে সাধারণ মানুষ অনেক সচেতন হয়েছেন। অনেক সামাজিক পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করেছি। বাইশ বছর আগে যখন আমি এই কাজ শুরু করি, আমাদের সঙ্গে যে পুলিশরা আসতেন, তাঁদের সকলেই হতেন পুরুষ। সময় বদলে গেছে, এখন আমাদের সাহায্যের জন্যে আসেন মহিলা পুলিশেরা, তাঁরা ওই অসহায় মহিলাদের প্রতি অনেকটাই সংবেদনশীল এবং সহানুভূতিসম্পন্না।   

এই সমাজ সেবার সাথে সাথেই আমি চালিয়ে গেছি আমার গান আর রবীন্দ্রনাথের প্রচার। অবশ্য তার সাথে ছিল আমার স্বামী-সংসার, ছেলে-মেয়ের স্কুল, খেলা, ব্যালে। আমার ছেলে আবীর,  Earth-Science & Environmental Planning নিয়ে পড়াশোনা করেছে Waikato University থেকে, এখন চাকরি করে স্কটল্যান্ডের এডিনবরা শহরে। হকি খেলে, নিউজিল্যান্ডের হয়ে অনূর্ধ্ব একুশ (Under 21) দলের হয়েও সে খেলেছে। আমার মেয়ে অনাহিতা, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে আইন আর সঙ্গীত নিয়ে পড়াশোনা করেছে। পড়াশোনার সাথে সাথে সে চালিয়ে গেছে তার নিজের সঙ্গীত সাধনা। সে নিজে গান লেখে, সুর দেয় আর performও করে পাশ্চাত্য সঙ্গীত।  আমার কাছে ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিখেছে, ও খব ভালবাসে রবীন্দ্রাসঙ্গীত। আমার সাথে অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছে। ওর জন্ম এইদেশে  কিন্তু আমাদের ছেলে মেয়ে দুজনেই বাংলা বলতে পারে।  Accent অন্যরকম কিন্তু বলতে পারে। মেয়ে আপাতত সুদুর লন্ডন শহরে বাস করে, চাকরী করে সেখানকার আইন-মন্ত্রনালয়ে । আমার স্বামী কাজল পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। গত ৩০ বছর ধরে এখানকার এক নামকরা Consulting Company, BECA তে চাকরি করে। এদের তিন জনকে নিয়েই আমার নিউজিল্যান্ডের সংসার।

অনেক, অনেক কিছু পেয়েছি এদেশে এসে। ভালোবাসা পেয়েছি, মিশতে পেরেছি নানা দেশের মানুষের সাথে, অনেক কিছু শিখতে পেরেছি তাদের সংস্কৃতি থেকে। এদেশের একটা ব্যাপার ভীষণ মন কাড়ে, এখানকার সাধারণ মানুষের সত্যনিষ্ঠা। মানুষ মানুষকে অনেক বেশি মূল্য দেয়, সেটা অবশ্য সরকারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সরকারের স্বচ্ছতাও উল্লেখযোগ্য।

নানা দেশের মানুষকে গান শিখিয়েছি ও এখনো শেখাই।  নানা অনুষ্ঠানে গান করেছি, আমি নিজে অনুষ্ঠান প্রযোজনাও করেছি আর তার সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথের গান ছড়িয়ে দিয়েছি নিউজিল্যান্ডে। আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথের সমস্ত সৃষ্টির বিরাট একটা ভূমিকা আছে। এই অধ্যায় না থাকলে আমার জীবন অপূর্ণ থেকে যেতো।

শিল্পী হিসেবে এই প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমি নানান সঙ্গীত ও শিল্প সংস্থার স্বীকৃতি পেয়েছি। COGS (Community Organisation Grants Scheme) এর প্যানেল মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি। Creative Tauranga-র প্যানেলেও নির্বাচিত হয়েছি। এসবই আমার কাজের ও অনুভূতির স্বীকৃতি, যা এঁদের কাছ থেকে পেয়েছি দুহাত ভরে। 

সমাজসেবা আর সঙ্গীতচর্চার সূত্রে যোগাযোগ হয়েছে বহু মানুষের সাথে, অনেক সাথী পেয়েছি আর পেয়েছি কিছু ভালো বন্ধু, যাঁরা আমাকে সব সময়ে উৎসাহ দিয়েছেন, উদ্দীপনা যুগিয়েছেন। তাদের মধ্যে তিন জন হলেন Angie Warren-Clarke, Jan Tinneti এবং Priyanca Radhakrishnan.

“দিশা” নিয়ে কাজ করা কালীন আরো একজন এর সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল, যার কথা না বললেই নয়। Merrivale Community Centre-এ এক মিটিংয়ে আলাপ হয়েছিল, মেরিভেল প্রাইমারী স্কুলের তখনকার প্রিন্সিপাল Jan Tinetti-র সাথে। তিনি প্রাইমারী স্কুলের প্রিন্সিপাল হওয়া সত্ত্বেও মেরিভেল Community-র সাথে যুক্ত ছিলেন অঙ্গাঙ্গীভাবে। ওঁনার সাথে আলোচনা হলো ইমিগ্র্যান্টদের সমস্যা নিয়ে এবং দিশার নানান কাজ নিয়ে। অনেক সমর্থন পেয়েছিলাম জ্যানের কাছ থেকে। সেই থেকে আমাদের বন্ধুত্বের সূত্রপাত। ২০২০-র নতুন সরকারে জ্যান এখন মন্ত্রীত্বের পদে নিযুক্ত।

একটা ছোট্ট ঘটনার কথা না বললেই নয়, যেটা আমার মনে ভীষণ ভাবে দাগ কেটেছিল। আমাদের নিউজিল্যান্ডে আসার দ্বিতীয় দিন। আমরা তখন একজনের বাড়িতে পেয়িংগেস্ট ছিলাম এবং কাজল সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে গিয়েছিল ভাড়া বাড়ির খোঁজে। কাজল আগের দিন দেখিয়ে দিয়েছিল বাড়ির কাছেই একটা দোকান, যেখানে চাল ডাল এইসব পাওয়া যায়। আমি সকাল বেলা পুত্র ছোট্ট আবীরকে নিয়ে সেখানে গেলাম। চাল, ডাল এই সব সাংসারিক সামগ্রী কেনার পরে দাম দিতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম আমার কাছে নিজি ডলার নেই। আমি তাই দোকানীকে আমেরিকান ডলারই দিলাম। ভদ্রলোক বয়স্ক, পরে জেনেছিলাম পাকিস্তানের অভিবাসী; আমায় উর্দু মিশ্রিত হিন্দীতে জিগ্যেস করলেন, "বেটি কব আয়ি হো?" হাতে আমেরিকান ডলার দেখে উনি বুঝে নিয়েছিলেন যে আমরা সদ্য সদ্য এসেছি। বলেছিলেন, “আমি তো এই টাকা নিতে পারবো না, তবে তোমার খাবার দাবার তুমি নিয়ে যাও, পরে যখন ডলার ভাঙাবে আমায় দিয়ে যেও”।  আমি পরের দিনই টাকা ভাঙিয়ে গিয়ে দিয়েছিলাম আর অনেক ধন্যবাদও জানিয়েছিলাম। ১৯৯৫ সালে ভারত থেকে আসা আমি, ভাবতেও পারি নি, এই ধরনের মনুষ্যত্ব এখনো আছে মানুষের মনে। সম্পূর্ণ অজানা অচেনা এক মানুষকে এই ভাবে বিশ্বাস করা, ভাবা যায় না। ওই ভদ্রলোকের সেদিনের সহানুভূতি আমায় মনুষ্যত্বের এক নতুন পাঠ পড়িয়েছিল সেদিন। 

[নীচের লিংক থেকে সুদীপ্তার গাওয়া একটি উচ্চাঙ্গ এবং একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে নিন - ব্লগার কিশোর]  


ন্যায়না ভর আয়ে

সেই ভাল সেই ভাল 

চলবে...


২টি মন্তব্য:

  1. অনবদ্য, অসাধারণ তোমার লেখা অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী আত্মকথন পার্ট তিন। এতো গভীর তোমার আবেগ অসহায় নারীদের জন্য পড়ে, আমার চোখে সত্যিই জল এসে গেছে। কুটু রানীর সাথে ইয়ার্কিই করেছি, তার অন্তর যে এতো বিস্তৃত বুঝতেই পারিনি। এইরকমই থেকো চিরদিন। অনেক আশীর্বাদ রইলো তোমার ও তোমার পরিবারের জন্য।
    কাজলদা, কলকাতা।

    উত্তরমুছুন

নতুন পোস্টগুলি

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)-র আত্মকথন - বিশ্বলোকের সাড়া - শেষ পর্ব

  বিশ্বলোকের সাড়া - শেষ পর্ব  প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু) আছ অন্তরে চিরদিন   লিখতে বসলে কত কিছুই মনে পড়ে যায়। স্মৃতির দরজাগুলো যেন খুলে যা...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ