প্রবন্ধ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
প্রবন্ধ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শনিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৫

শ্রীমদ্ভাগবৎ কৃষ্ণ

 

৫.৪.১ শ্রীমদ্ভাগবৎ কৃষ্ণ

শ্রীমদ্ভাগবত পূর্ণতঃ বিষ্ণুর মহিমা বর্ণন। তার মধ্যে অবশ্যই সিংহভাগ দখল করেছেন শ্রীকৃষ্ণ। এই পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের মর্ত্যলীলার যাবতীয় ঘটনার কথা জানা যায়। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম বিবরণের কথা ভারতীয় হিন্দুদের অতি পরিচিত, সে বর্ণনায় যাচ্ছি না। একটিমাত্র বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কৃষ্ণের জন্মের পরেই মাতা যশোদার কন্যার সঙ্গে মাতা দেবকীর পুত্রের বদলাবদলি ঘটিয়ে ছিলেন পিতা বসুদেব। মাতা দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান ভেবে, রাজা কংস এই কন্যাটিকে যখন হত্যা করতে গেলেন, দেখা গেল, এই কন্যা কোন সাধারণ শিশু নয়, তিনি দেবী যোগমায়া। তিনি অষ্টভুজা দেবী, তাঁর হাতে ধনু, শূল, বাণ, চর্ম, খড়গ, অসি, চক্র ও গদা। তিনি দিব্যমালা, বসন ও রত্ন-অলংকারে ভূষিতা। পুজোর অর্ঘ নিয়ে তাঁর সঙ্গীরা - সিদ্ধ, চারণ, গন্ধর্ব, কিন্নর, অপ্সরা ও উরগগণ - তাঁর স্তুতি করছিল। বলা বাহুল্য, এই দেবী অনার্য দেবী, কৃষ্ণের জন্মের নিরাপত্তার জন্যেই তিনি মাতা যশোদার গর্ভে আবির্ভূতা হয়েছিলেন।

এরপর কৃষ্ণের শৈশব, বাল্য ও কৈশোরের নানান আশ্চর্য লীলার কথা আমরা সকলেই জানি, তবুও আরেকবার সংক্ষেপে আলোচনা করে নেওয়া যাক।

রাজা কংস দেবকীর কন্যা সন্তানের দেবী রূপ দেখেও নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না, কারণ অন্তর্হিত হওয়ার আগে দেবী ঘোষণা করেছিলেন, “রে দুষ্ট কংস, আমাকে মেরে তুই কী করবি? তোর শত্রু তোর মৃত্যুরূপে কোথাও না কোথাও জন্ম নিয়েছেন। অতএব, এরপর তুই আর অন্য নিরাপরাধ শিশুদের অকারণ বধ করিস না”। কংসের মন্ত্রণাদাতারা সকলেই ছিলেন, রাক্ষস বা দৈত্য-দানব। তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে, তিনি স্থির করলেন, মথুরা, ব্রজ (বৃন্দাবন) এবং আশেপাশের গ্রামের শিশুদের, যাদের বয়স দশদিনের আশেপাশে, তাদের হত্যা করবেন। ভোজরাজ কংসের এই “কৃষ্ণ-হত্যা” সিদ্ধান্তের সঙ্গে রোম প্রশাসক হেরডের “যিশু-হত্যা” ঘোষণার আশ্চর্য মিল। দুই কাহিনীর কোনটি মূল এবং কোনটি অন্যকে প্রভাবিত করেছিল, আজ তার হদিশ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

শ্রীকৃষ্ণ শৈশব থেকেই অলৌকিক শক্তির অধিকারী, আর হবে নাই বা কেন, মানুষের রূপে তিনিই যে পরমপুরুষ পুরুষোত্তম ঈশ্বর বিষ্ণু। তাঁর নিত্য সঙ্গী ছিলেন তাঁর বৈমাত্রেয় দাদা, বলরাম, গোপরাজা নন্দর পত্নী রোহিণীর পুত্র। তিনিও বিষ্ণুর অংশ-অবতার। দুই ভাইকে একত্রে রাম-কৃষ্ণও বলা হত। শৈশব থেকে বাল্য বয়েসের মধ্যেই তিনি অনেকগুলি কীর্তি করে ফেললেন। কৃষ্ণকে বধ করতে রাজা কংস তাঁর যে অনুচরদের পাঠাচ্ছিলেন, যেমন পূতনা রাক্ষসী, দৈত্য তৃণাবর্ত বা চক্রবাত, বৎসাসুর, বকাসুর, ধেনুকাসুর, অঘাসুর বা অজগর অসুর, অরিষ্টাসুর, কেশী দৈত্য, প্রলম্ব– সকলেই কৃষ্ণের হাতে নিহত হলেন। তরুণ বয়সে তিনি দমন করলেন কালিয় নাগকে।

এই কাহিনীগুলিতে অলৌকিক রোমাঞ্চ অনুভব করা ছাড়া আর কোন তাৎপর্য নেই।  অবশ্য চিন্তা করলে একটি তাৎপর্য মনে আসে, শ্রীকৃষ্ণের মামা রাজা কংস নিশ্চয়ই অনার্য? তা নাহলে তাঁর মন্ত্রণাদাতা পারিষদ থেকে শিশু কৃষ্ণকে বধ করতে আসা অনুচরী/অনুচররা রাক্ষসী, দৈত্য, অসুর কেন? সদ্যজাত শ্রীকৃষ্ণকে রক্ষা করতে শিশুকন্যা রূপে জন্ম নিলেন অনার্য দেবী যোগমায়া, আবার তাঁকে হত্যা করতে রাজা কংস “সুপারি” দিলেন অনার্য খুনীদের! অতএব শ্রীকৃষ্ণর সঙ্গে মাতুল কংস ও মাতুলের শ্বশুর জরাসন্ধের সঙ্গে যে দীর্ঘ বিবাদ সেটি আসলে ছিল অনার্য যদু, বৃষ্ণি, শূরসেন, ভোজ, অন্ধক ও চেদি গোষ্ঠীর অন্তর্দ্বন্দ্ব। সে কথা আগেও বলেছি, এই গ্রন্থের ২.৬.২ অধ্যায়ে।

এবার শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার দুটি ঘটনা, আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে, সে দুটির উল্লেখ এখানে করছি। 

 

৫.৪.১.১ ব্রাহ্মণযজ্ঞে অন্ন প্রার্থনা

একবার যমুনা তীরে গোচারণের সময় রাম-কৃষ্ণ সহ সকল গোপবালক ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ গোপবালকদের বললেন, “একটু দূরেই দেখ, ব্রাহ্মণরা দেবযজ্ঞ করছেন। সেখানে গিয়ে তোরা দাদা আর আমার নাম করে বল, আমরা সবাই ক্ষুধার্ত আমাদের অন্নদান করুন”। গোপবালকরা যজ্ঞস্থলে গিয়ে ব্রাহ্মণদের সেকথা বলাতে, ব্রাহ্মণেরা “হ্যাঁ” বা “না” কোন উত্তর দিলেন না। গোপবালকরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে শ্রীকৃষ্ণকে সব কথা বলাতে, কৃষ্ণ হাসলেন, বললেন, “এবার তোরা ব্রাহ্মণীদের কাছে যা, সেখানে গিয়ে একই কথা বলবি”। গোপবালকরা এবার ব্রাহ্মণীদের কাছে গিয়ে রাম ও কৃষ্ণের নামে অন্ন প্রার্থনা করল।

ব্রাহ্মণীরা কৃষ্ণের অনেক কথা আগেই শুনেছিলেন। তিনি কাছেই যমুনাতীরে রয়েছেন শুনে, তাঁরা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। প্রচুর অন্ন এবং সুস্বাদু খাদ্যের সম্ভার নিয়ে তাঁরা প্রায় দৌড়ে এলেন। কৃষ্ণের শ্যামলবরণ[1] কান্তি, পীতবসন, গলায় বনমালা, মাথায় শিখীপুচ্ছ দেখে তাঁরা বিহ্বলা হয়ে কৃষ্ণকে আলিঙ্গনও করে ফেললেন। রাম-কৃষ্ণ ও গোপবালকদের অন্ন ও খাদ্য নিবেদন করে, তাঁরা কিছুক্ষণ কৃষ্ণের সঙ্গে আলাপ করলেন। কিন্তু ফেরার সময় তাঁরা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন, কারণ আসার সময় তাঁরা স্বামীদের অনুমতি না নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসেছিলেন। উপরন্তু আবেগের বশে তাঁরা গোপবালক কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে ফেলেছিলেন। তাঁরা আশংকা করছিলেন, তাঁদের স্বামীরা হয়তো তাঁদের গ্রহণ করবেন না। কিন্তু কৃষ্ণ তাঁদের আশ্বাস দিলেন, সেরকম কিছু ঘটবে না, বললেন, “আপনারা আমাতেই সমর্পিত চিত্ত, নিবেদিত প্রাণ, অতএব কেউ আপনাদের কোন দোষ দেখবে না”। ব্রাহ্মণীরা যজ্ঞস্থলে ফিরে যেতে, সত্যিই কেউ কিছু বললেন না। ব্রাহ্মণরা নিজ নিজ পত্নীদের সঙ্গে যথারীতি যজ্ঞে আহুতি দিয়ে, যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন।

ব্রাহ্মণ্য ধর্মের যজ্ঞ-অনুষ্ঠানে আহুতি দেওয়ার সময়, পত্নীদের পতির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোন ভূমিকা থাকত না। সেই বুঝেই কী কৃষ্ণ এমন একটা ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। তিনি কী অনুমান করেছিলেন, ব্রাহ্মণরা যজ্ঞের ব্যস্ততায় গোপবালকদের কথায় গুরুত্ব না দিলেও, অলস বসে থাকা দ্বিজপত্নীরা তাঁর নাম শুনলেই, তাঁকে দেখার জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে উঠবেন? আশৈশব তাঁর অতিনায়কোচিত অলৌকিক কীর্তির সৌরভ যে মহিলা মহলে তাঁকে প্রবাদে পরিণত করেছে, সেটাও কী তিনি বুঝতে পেরেছিলেন? এও কী বুঝেছিলেন, নায়কের প্রতি মহিলাদের উদ্বেল আবেগকে তাঁদের স্বামীরা তেমন দোষাবহ মনে করেন না? ধন্য বটে তাঁর নারী ও নর-চরিত্র বিশ্লেষণ।  

 

৫.৪.১.২ কৃষ্ণের ইন্দ্র বিরোধ

একবার রাম-কৃষ্ণ গোকুলে যাওয়ার পথে দেখলেন, গোপেরা ইন্দ্রযজ্ঞ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি পিতাকে এই যজ্ঞের কথা জিজ্ঞাসা করায় গোপরাজ নন্দ বললেন, “বৎস, ভগবান ইন্দ্র মেঘের দেবতা। বর্ষায় মেঘ থেকে তিনি বৃষ্টি দেন বলেই আমাদের ক্ষেত্র, নদী, সরোবর সরস হয়, আমাদের সমৃদ্ধি আসে। এই কারণেই আমরা দেবরাজ ইন্দ্রের প্রীতির জন্যে এই যজ্ঞের অনুষ্ঠান করি”। এর উত্তরে কৃষ্ণ যে কথাগুলি বললেন, সেগুলিকে বৈপ্লবিক বললেও কম বলা হয়। তিনি বললেন, “পিতা, নিজের কর্মবশেই জীব সুখ, দুঃখ, ভয় বা মঙ্গল ভোগ করে। যদি কর্মফল দাতা কোন ঈশ্বর থেকে থাকেন, তিনি কর্মকর্তাকেই সমর্থন করবেন। কারণ যে কোন কর্মই করে না, তাঁকে তিনি ফল দেবেন কী করে? চতুর্বণ অনুযায়ী কর্ম নির্দিষ্ট করা আছে। ব্রাহ্মণরা বেদপাঠ ইত্যাদি, ক্ষত্রিয়রা পৃথিবীর রক্ষণাবেক্ষণ, বৈশ্যরা বার্তা অর্থাৎ কৃষি-বাণিজ্য এবং শূদ্ররা তিনবর্ণের সেবা করে জীবিকা নির্বাহ করবে। বৈশ্যবৃত্তি চার ধরণের কৃষি, বাণিজ্য, গোরক্ষা ও কুসীদ[2]। এর মধ্যে আমরা গোপালন করে থাকি।

তাছাড়া সৃষ্টি, স্থিতি ও ধ্বংসের কারণ যথাক্রমে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণ। মেঘরাজি রজোগুণে পরিচালিত হয়ে, বর্ষা ঘটায়, তার থেকে শস্যাদি উৎপন্ন হয় এবং মানুষ শস্য দিয়ে জীবনধারণ করে। এখানে ইন্দ্রের ভূমিকা কোথায়? আমরা বনবাসী, আমাদের নগর ও জনপদ কিছুই নেই। অতএব আমাদের কর্তব্য গো, ব্রাহ্মণ ও পর্বতের উদ্দেশে যজ্ঞ করা। পিতা, এই আমার অভিমত। আপনি যদি ভালো মনে করেন, তাহলে ইন্দ্রযজ্ঞ ছেড়ে এই যজ্ঞের অনুষ্ঠান করুন। এই যজ্ঞ ব্রাহ্মণদের এবং আমারও অভিপ্রেত”। গোপরাজ নন্দ খুশি মনেই গো, ব্রাহ্মণ ও পর্বত যজ্ঞের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন।

ওদিকে স্বর্গে বসে ইন্দ্র শুনলেন, ব্রজে তাঁর যজ্ঞ স্থগিত হয়ে গেছে। তিনি কৃষ্ণ ও গোপরাজ নন্দের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে সংবর্তক নামের ভয়ংকর মেঘকে পাঠালেন, প্রবল বর্ষণ ও বজ্রপাতে ব্রজের গোষ্ঠকে প্লাবিত করার জন্যে। তিনি বললেন, “কৃষ্ণ কে? একজন সাধারণ মানব। সে অবিনীত, অজ্ঞ, বাচাল, বালকমাত্র। ঐশ্বর্যের অহংকারে গোপেরা উদ্ধত হয়ে, আমার অপ্রিয় আচরণ করল? সংবর্তক, যাও, তুমি গোপদের ঐশ্বর্য এবং তাদের পশু সম্পদ ধ্বংস করে এসো”।

সংবর্তকের প্রভাবে গোকুলে প্রবল ঝড়, ঝঞ্ঝা ও শিলাবৃষ্টি শুরু হল। প্রবল বর্ষণে নদীতে বন্যা দেখা দিল। কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন, ইন্দ্রের যজ্ঞ না করাতে, ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হয়েছেন। তিনি নিজের হাতে গোবর্ধন পর্বত তুলে নিলেন এবং ব্রজবাসী সবাইকে বললেন, সমস্ত পশুদের নিয়ে, সেই পর্বতের গুহায় আশ্রয় নিতে। ব্রজবাসীরা তাই করলেন এবং সাতদিন প্রবল বর্ষণের মধ্যে তাঁরা সকলেই নিরাপদে সেই পর্বতের অন্দরে বাস করলেন। সাতদিন ধরে গোবর্ধন পর্বতকে হাতে ধারণ করে থাকা শ্রীকৃষ্ণের অদ্ভূত বিক্রমে ইন্দ্র হার মানলেন, তিনি বর্ষণে ক্ষান্ত হলেন। মেঘ সরে গিয়ে উজ্জ্বল সূর্যের উদয় হল। ব্রজবাসীরা গিরি কন্দর ছেড়ে বের হয়ে এলেন, শ্রীকৃষ্ণও গোবর্ধন পর্বতকে আবার যথাস্থানে স্থাপনা করলেন।

ইন্দ্র পূজা ছেড়ে, গো-ব্রাহ্মণের পূজা করার মধ্যে, ব্রাহ্মণ্যধর্মকে অবহেলা করে হিন্দুধর্মের প্রতিষ্ঠা বলেই আমি মনে করি। হিন্দু ধর্মে ভগবান কৃষ্ণ-গোবিন্দের স্তবের মন্ত্রই হল “ওঁ ব্রহ্মণ্যদেবায়, গো-ব্রাহ্মণ হিতায় চ, জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায়, গোবিন্দায় নমোনমঃ”। আরও একটা বিষয়ে খটকা লাগে, দেবরাজ ইন্দ্র যখন শুনলেন, ব্রজবাসীরা তাঁর পূজা বন্ধ করেছেন এবং এর পিছনে আছেন কৃষ্ণ, তখন তিনি কৃষ্ণকে “অবিনীত, অজ্ঞ, বাচাল, বালক” বললেন কেন? দেবরাজ হয়েও তিনি কী জানতেন না, কৃষ্ণরূপে ভগবান বিষ্ণুই মর্তে আবির্ভূত হয়েছিলেন? পৃথিবীতে ধর্ম সংস্থাপনের জন্যে কৃষ্ণ হয়ে ভগবান বিষ্ণুর আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই স্বর্গের দেবমহলে এর প্রস্তুতি হয়েছিল, শ্রীরামচন্দ্রের আবির্ভাবের পূর্বপ্রস্তুতির মতো। যেমন, ব্রজরাজ নন্দ, তাঁর দুই রাণি – রোহিণী ও যশোদা, বলরাম (যিনি বিষ্ণুর অংশ-অবতার) এবং ব্রজের সকল গোপ ও গোপীগণ স্বর্গ থেকে আবির্ভূত, তাঁরা কৃষ্ণের আগে জন্ম নিয়েছিলেন, শিশু ও বালক কৃষ্ণকে লালন-পালনের জন্য। রাজা কংসের চোখে ধুলো দিতে, কৃষ্ণের সঙ্গে একই সময়ে আবির্ভূতা হয়েছিলেন, দেবী যোগমায়া। দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গের এই সব সংবাদ কিছুই জানতেন না?  কেমন দেবরাজ তিনি? নাকি পুরাণকারেরা কাহিনী কল্পনার সময়, এই দিকটি খেয়াল রাখেননি? নাকি অনার্য বা হিন্দু দেবতার কাছে বৈদিক দেবরাজের লাঞ্ছনার ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত ভাবেই উপস্থাপিত করেছেন? 

 

৫.৪.১.৩ রাস উৎসব

মহিলা মহলে কৃষ্ণের আধিপত্য ছিল প্রবল। ব্রজের বয়স্থা মহিলাদের আদর্শ ছিলেন মা যশোদা, তাঁদের সকলেই দুরন্ত শিশু ও বাল-কৃষ্ণের দৌরাত্ম্য অনুভবের স্বপ্ন দেখতেন। বালক-কৃষ্ণের মুখ দর্শনেই তাঁদের কুচযুগ পয়স্বিনী হয়ে উঠত। আবার ব্রজের কিশোরী থেকে যুবতীরাও তাঁর দর্শন এবং স্পর্শ লাভের জন্যে ব্যাকুল। এমন কি বিবাহিতা রমণীরাও কৃষ্ণ প্রেমে উন্মাদিনী। তাঁদের এই গণ উন্মাদনার কারণ কৃষ্ণের রূপ, তাঁর অপ্রচলিত বেশভূষা, তাঁর অলৌকিক কীর্তির প্রবাদ এবং তাঁর মোহন-বাঁশির সুরের জাদু। সবার উপরে রয়েছে তাঁর কোমলে-কঠোর মেশা অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।

মহিলা মহলে কৃষ্ণের এই গণ সম্মোহনকে ভাগবত শাস্ত্রে রাস-উৎসব, রাস-যাত্রা বা রাস-ক্রীড়া বলা হয়েছে। রাস শব্দের উৎপত্তি রস থেকে, আবার রাস শব্দের অর্থ শব্দ, ধ্বনি বা কোলাহল। অর্থাৎ রাস-উৎসব রসময় কোলাহল। 

সেদিন কার্তিকমাসের পূর্ণিমা তিথি। পূর্ণ চন্দ্র উদিত হয়েছে পূর্ব আকাশে। সামান্য হিমের পরশ লাগা স্নিগ্ধ বাতাস বহমান। যমুনার তীরে একাকী ভ্রমণ করতে করতে, কৃষ্ণ তাঁর বাঁশিতে তুললেন অদ্ভূত মোহন সুর। গোপপল্লীগুলিতে সেই মোহিনী সুরের মন-কাড়া জাদু বয়ে নিয়ে গেল হেমন্তের মনোরম বাতাস। নির্মেঘ  আকাশ প্লাবিত নির্মল জ্যোৎস্নায়। বাতাসে ভেসে আসা সূরমূর্ছনা, আকাশের মোহিনী আলোক গোপনারীদের ঘর ছাড়তে বাধ্য করল। কেউ রান্না করছিলেন, কেউ শিশুকে স্তন্যপান করাচ্ছিলেন, কেউ স্বামীসেবা করছিলেন। যাঁর যা কিছু হাতের কাজ ফেলে, তাঁরা দৌড়ে চললেন যমুনার তীরে। তাঁদের পিতা, মাতা, স্বামী, পুত্র, ভ্রাতারা নিষেধ করলেন বারবার, কিন্তু ওই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে তাঁদের যে অন্য কোন উপায় নেই! তাঁরা সমবেত হলেন যমুনা পুলিনে।

 


বাঁকুড়া - বিষ্ণুপুরের শ্যামরাই মন্দিরের দেওয়ালে "রাসযাত্রা"-র টেরাকোটা মোটিফ। চিত্র - লেখক।  

 

সমবেত ব্রজবালাদের দেখে লীলাপুরুষ বললেন, “এত রাত্রে তোমরা এখানে কেন? তোমরা কী জানো না, নির্জন এই যমুনাতটে এখন নিশাচর পশুরা ঘুরে বেড়ায়? তোমরা এখনই ব্রজপল্লীতে ফিরে যাও, সেখানে তোমাদের মাতা-পিতা-পতি-ভ্রাতারা তোমাদের দেখতে না পেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তোমাদের আচরণে বন্ধু ও আত্মীয়দের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করো না”। গোপললনারা কৃষ্ণের কথায় হতাশ হলেন, তাঁরা প্রণয়-অভিমানে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। কৃষ্ণ স্মিতমুখে আবার বললেন, “তোমরা কি, যমুনার তীরে পূর্ণ-জ্যোৎস্নার শোভা দেখতে এসেছ? তাহলে বলি, দেখা তো হয়েছে, এবার গৃহে ফিরে যাও। হে কল্যাণি, তোমরাই গৃহের ঐশ্বর্য, তোমরা ঘরে ফিরে পতি, পিতা-মাতা-সন্তান-শিশুদের সেবায় মনোনিবেশ করো। হে কুলকামিনীগণ, আমার ধ্যান, চিন্তা বা আমার কথাতে যেমন প্রীতিবন্ধন হয়, আমার স্পর্শে তেমন হয় না। অতএব তোমরা এখনই ঘরে ফিরে যাও”।

গোপললনারা ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, “হে প্রভো, এমন কঠিন কথা তোমার বলা উচিৎ হচ্ছে না। স্বামী-পুত্র-সংসার সব ছেড়েই আমরা তোমার কাছে এসেছি। তোমার সেবা করলেও স্বামী-পুত্রেরই সেবা হবে। আমাদের যে মন ও হাত এতদিন সংসারের কাজে সতত লিপ্ত ছিল, সেই মন ও হাত তুমি কেড়ে নিয়েছ। আমরা জেনেছি, তুমিই সেই আদি পুরুষ, যিনি দেবতাদের রক্ষা করেন, এখন এসেছ আমাদের ব্রজভূমির দুঃখনাশ করতে। আমরা তোমার কিংকরী, তোমার করকমল আমাদের তপ্ত স্তনে এবং মাথায় অর্পণ করো, আমাদের তৃপ্ত করো”। এর পর কৃষ্ণ মনোরম যমুনা পুলিনে গোপললনাদের আলিঙ্গন করলেন, তাঁদের হাতে, চুলে, উরুতে, কোমরে, স্তনে হাত রাখলেন। শতাধিক গোপরমণী তাঁর স্পর্শে মানিনী হয়ে উঠলেন। তাঁরা সকলেই নিজেকে জগতের শ্রেষ্ঠ নারী বলে মনে করলেন। গোপীদের এই গর্ব, অভিমান ও তূরীয় অবস্থা দেখে কৃষ্ণ সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

কৃষ্ণ অদৃশ্য হয়ে যেতে গোপ কামিনীরা তাঁর বিরহে অস্থির হয়ে উঠলেন। তাঁরা বনের তৃণ, গাছপালা, নদীর জল, বালুতট সকলের কাছে উন্মাদিনীর মতো, জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, তারা কৃষ্ণকে দেখেছে কিনা? তাঁদের মধ্যে কেউ নিজেই কৃষ্ণ হলেন, কেউ হলেন বৎসাসুর, কেউ হলেন পূতনা। তাঁরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় মত্তা হলেন। কেউ হামাগুড়ি দিয়ে বালকৃষ্ণের মতো আচরণ করতে লাগলেন। এক কথায় তাঁরা কৃষ্ণময় হয়ে নিজেদের মধ্যেই মত্ত হয়ে উঠলেন। এক সময়ে তাঁরা কৃষ্ণ বিরহে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে গান ধরলেন।

এই সময়েই হঠাৎ উপস্থিত হলেন কৃষ্ণ। তাঁর অকস্মাৎ আবির্ভাবে গোপললনাদের মধ্যে আনন্দের স্রোত বয়ে গেল, গোপরমণীদের অবসন্ন শরীরে যেন প্রাণ ফিরে এল। তাঁরা সকলে কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে, মাঝখানে বসিয়ে, চারদিকে ঘিরে রাখলেন। একজন গোপকামিনী কৃষ্ণের প্রতি কটাক্ষ করে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে কৃষ্ণ, কেউ ভজনা করলে, তাঁকেও অন্য কেউ ভজনা করেন। আবার তাঁকে কেউই ভজনা করেন না। অথবা কেউই কাউকে ভজনা করেন না। হে সখে, এই ব্যাপারটা কেমন, আমাকে বুঝিয়ে দাও তো!”

কৃষ্ণ বললেন, “সখীরা, যাঁরা পরষ্পরের ভজনা করেন, তাঁরা স্বার্থের জন্যেই ভজনা করেন, সেখানে ধর্ম বা বন্ধুত্বের কোন উদ্দেশ্য থাকে না। যাঁরা ভজনা করেন না, অথচ তাঁদের যাঁরা ভজনা করেন, তাঁরা পিতামাতার মতো দয়ালু ও স্নেহ অনুসারে দুই প্রকারের ভজনা করেন। দয়ালু ভজনায় নিষ্কৃতি লাভ হয় এবং যাঁরা স্নেহময় হয়ে ভজনা করেন, তাঁরা বন্ধুত্ব লাভ করেন। দরিদ্র ব্যক্তি হঠাৎ ধন লাভ করে, সে ধন যদি হারিয়ে ফেলে, তাহলে সে যেমন সর্বদা এই নিয়েই চিন্তায় মগ্ন থাকে, তেমনি তোমরাও সব ভুলে এতক্ষণ আমার চিন্তাতেই মগ্ন ছিলে। তোমরা গৃহের কঠিন শৃঙ্খল ছিন্ন করে আমার কাছে এসেছ, এই মিলন অনিন্দনীয়। আমি তোমাদের এই উপকারের কোন প্রতিদান দিতে পারবো না। সুতরাং প্রত্যুপকার করে আমি অ-ঋণীও হতে পারলাম না, আমার ঋণ মোচনের একমাত্র সহায় তোমাদের এই প্রেমবন্ধন”।

গোপীরা ভগবান কৃষ্ণের এই সান্ত্বনা বাক্যে, বিরহের কথা ভুলে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন এবং তাঁরা পরমানন্দে নিজেদের হাতে হাত রেখে কৃষ্ণকে ঘিরে নৃত্য ও গীত শুরু করলেন। কৃষ্ণ-গোবিন্দ রমণীবেষ্টনে আবদ্ধ হয়ে রাসলীলা করতে লাগলেন। রাস-উৎসব শুরু হল। কৃষ্ণ প্রতি দুই জন গোপীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই হাত দুই গোপীর কাঁধে রাখলেন। প্রত্যেক গোপ রমণীরই মনে হল, কৃষ্ণ তাঁর পাশেই আছেন, তাঁর কণ্ঠে হাত রেখে তাঁর মুখের দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন। এই রাস উৎসবে বিভোর হয়ে রইলেন গোপরমণীরা, তাঁদের সকলের অঙ্গেই কৃষ্ণের মোহন স্পর্শের অনুভব। রাত্রি শেষ প্রহরে কৃষ্ণের আদেশে তাঁরা যখন অনিচ্ছায় নিজ নিজ ঘরে ফিরলেন, কৃষ্ণ মায়ায় মোহিত ব্রজবাসীরা মনে করলেন, তাঁদের পত্নী, মা, ভগিনী ও কন্যারা সারারাত তাঁদের পাশেই ছিলেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যভারত এবং মথুরার মতো বেশ কিছু অঞ্চলের পশুপালক অনার্য গোষ্ঠীদের মধ্যে কৃষ্ণ নামে এক বংশীধারী রাখাল বালক ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন এবং বালদেবতা হিসেবে পূজিত হতেন। মহিলা মহলে তাঁর প্রভাব ছিল ঈর্ষণীয়। সেই অনার্য কৃষ্ণের নানান প্রবাদ কাহিনীকে আরও রমণীয় এবং কামোদ্দীপক (erotic) করে তুলেছিলেন পুরাণকারেরা। হয়তো তাঁরা মনে করেছিলেন, ধর্মরসের মধ্যে কিছুটা দৈবী আদিরস সঞ্চার করলে, সাধারণ জনসমাজ কৃষ্ণ সম্পর্কে আরও কৌতূহলী হয়ে উঠবে, বাড়বে ভাগবত ধর্মের প্রভাব। 

৫.৪.১.৪ দ্বারকাধীশ কৃষ্ণ

দ্বারকা ও রাজস্থানে কৃষ্ণ “রণছোড়জী” নামেই প্রসিদ্ধ। এই নামটি সম্ভবতঃ মধ্যযুগ থেকে প্রচলিত হয়েছিল। যেমন আমাদের পূর্বভারতে, কৃষ্ণ নামটি কাহ্ন, কানু, কানাই নামেও জনপ্রিয় হয়েছে মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদকর্তাদের প্রভাবে।

অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ “রণছোড়” শব্দটির অর্থ – যিনি যুদ্ধ ছেড়ে এসেছেন। মথুরায় কংসবধের পর, রাজা কংসের শ্বশুর পরাক্রান্ত চেদিরাজ জরাসন্ধ, কৃষ্ণ-নিধনের জন্যে বারবার (পৌরাণিক মতে আঠারোবার) মথুরা আক্রমণ করেছিলেন। সে যুদ্ধে কোন পক্ষই জয়ী হতে পারেননি, কিন্তু প্রতিটি যুদ্ধেই দুই পক্ষের বহু নিরীহ সৈন্য নিহত, আহত এবং অজস্র সম্পদ হানি হত। এই অকারণ রক্তপাত এবং শক্তি ও সম্পদ-ক্ষয় এড়াতে কৃষ্ণ যুদ্ধ ছেড়ে সুদূর দ্বারকায় সরে গিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে এ তাঁর অসাধারণ দূরদর্শীতা, ধৈর্য ও বিচক্ষণতার পরিচয়। কারণ পরবর্তীকালে তিনি মধ্যম পাণ্ডব ভীমের সঙ্গে একক যুদ্ধে প্ররোচিত করে জরাসন্ধকে নিহত করিয়ে শত্রুমুক্ত হয়েছিলেন, সেখানে কোন নিরীহের রক্তপাত হয়নি। প্রতিকূল সময়ে যুদ্ধ ছেড়ে আসা যে আসলে অনুকূল সময়ে যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতি, সে কথাটাই শ্রীকৃষ্ণের “রণছোড়জি” নামের মহিমা।                

দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের দশজন প্রধানা পত্নীর নাম শোনা যায় - রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, নাগ্নজিতী, কালিন্দী, মাদ্রী, মিত্রবৃন্দা, ভদ্রা। প্রাগজ্যোতিষপুরের ভৌমাসুর বহু রাজাকে পরাস্ত করে ষোল হাজার রাজকন্যাকে বন্দী করে রেখেছিলেন। প্রাগজ্যোতিষপুরের নরকাসুরকে বধ করে, কৃষ্ণ ভৌমাসুরের অন্তঃপুরে যান এবং বন্দিনী রাজকন্যাদের মুক্ত করার আদেশ দিলে, ষোল হাজার রাজকন্যা তাঁকেই পতিরূপে বরণ করেছিলেন। কৃষ্ণও সানন্দে তাঁদের গ্রহণ করে, দ্বারকায় পাঠিয়েছিলেন, এবং প্রত্যেক পত্নীর জন্যে সুন্দর গৃহ নির্মাণ করিয়েছিলেন। প্রধানা দশ মহিষীর প্রত্যেকের গর্ভে ভগবান কৃষ্ণের দশটি করে পুত্রের জন্ম হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন, প্রদ্যুম্ন, চারুদেষ্ণ, ভানু, শাম্ব, সুমিত্র, পুরুজিৎ, বীর, সুবাহু, প্রঘোষ, বৃক, হর্ষ, সংগ্রামজিৎ, বৃহৎসেন প্রমুখ। শোনা যায় তাঁর মোট পুত্রসংখ্যা নাকি সহস্রাধিক।

ব্রজবাসী কৃষ্ণের আরও একটি বহুল জনপ্রিয় প্রেমের উপাখ্যানের উল্লেখ মহাভারত বা শ্রীমদ্ভাগবতে পাওয়া যায় না। সেটি হল পরবর্তী কালের বহুল জনপ্রিয় রাধা-কৃষ্ণ উপাখ্যান। মহাভারতের পরিপূরক গ্রন্থ “খিলহরিবংশ”-এ – কৃষ্ণের রাসলীলার বর্ণনায় কৃষ্ণের মুখে দুটি মাত্র নামের উদ্দেশে বিরহ ভাবের উল্লেখ পাওয়া যায়, “হা রাধে! হা চন্দ্রমুখি!” (খিল হরিবংশ, অধ্যায় ৭৬), কিন্তু তাঁদের সম্পর্কে আর কোন বিবরণ বা তথ্য পাওয়া যায় না। অথচ পরবর্তী কালের কবিকুল, বিশেষত বঙ্গের কবিকুল এই যুগলকে নিয়ে অজস্র ভাবের ও আবেগের গান ও পদাবলী রচনা করেছেন। কৃষ্ণভক্ত যুগাবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর (১৪৮৬-১৫৩৩ সি.ই) আবির্ভাবের পর, বঙ্গদেশে রাধা-কৃষ্ণই অন্যতম প্রধান উপাস্য হয়ে উঠেছিলেন।

--০০--

[আমার "ধর্মাধর্ম" গ্রন্থের পঞ্চম পর্বের চতুর্থ অধ্যায় থেকে সংকলিত।]



[1] ভালোবেসে আমরা যতই “শ্যামলবরণ” বা “রঙটা একটু চাপা” বলি না কেন, এই গাত্রবর্ণ অনার্য লক্ষণ। আদতে তিনি কৃষ্ণবর্ণই ছিলেন, তাই তাঁর নামও কৃষ্ণ। তাঁর কৃষ্ণবরণ বলিষ্ঠ কান্তিতে উজ্জ্বল পীতবসন, গলায় বনফুলের মালা, অঙ্গে হাল্কা স্বর্ণালঙ্কার এবং কেশে শিখীপক্ষ – অসাধারণ এক স্টাইল স্টেটমেন্ট। আর্য বা অনার্য – সে যে সভাতেই তিনি উপস্থিত হোন না কেন –তাঁর উপস্থিতি সর্বদাই প্রত্যয়ী পৌরুষরূপে অনন্য এক ঔজ্জ্বল্য সঞ্চার করে। এর সঙ্গে ছিল শৈশব থেকে আবাল্য, তাঁর নানান কীর্তির মহিমা। বাস্তবিক, এমন একজন ব্যক্তিত্ব সামনে এসে দাঁড়ালে, হয় মুগ্ধ হতে হয় অথবা ঈর্ষায় দগ্ধ হতে হয়, কিন্তু কোনমতেই অবহেলা করা যায় না। মহিলাদের আর দোষ কি?   

[2] কুসীদ মানে সুদ, কুসীদজীবী মানে যাঁরা সুদের বিনিময়ে ঋণ দেন, এখানে শ্রেষ্ঠী অর্থাৎ Banker 

সোমবার, ৭ জুলাই, ২০২৫

বাংলার কিছু স্টেশন – কিছু অনুভব

 আমার সুদীর্ঘ জীবনের প্রত্যেকটি রেলযাত্রায় প্রতিবারই নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেমন পৌঁছেছি তেমনই সে পথে কখনো পেয়েছি ইতিহাসের স্পর্শ, কখনো জাগিয়েছে কৌতূহল, কখনো পেয়েছি নির্মল আনন্দ। কিছু স্টেশন নিয়ে আমার সেই নানান অনুভবের কথাই এখন বলব।  

১) আদিসপ্তগ্রামঃ - হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইনে ব্যাণ্ডেল জংশন থেকে ৪ কিমি দূরত্বে আদি সপ্তগ্রাম স্টেশন বাংলার মধ্যযুগে অত্যন্ত সম্পন্ন বন্দর নগর ছিল, যদিও সে সময় তার নাম ছিল সপ্তগ্রাম। সরস্বতী নদীর তীরে অবস্থিত এই বন্দরনগরীর গৌরবকথার বারবার উল্লেখ পাওয়া যায় বাংলার মঙ্গল কাব্যগুলিতে। হিন্দু রাজত্বের পর মুসলিম রাজত্বেও এই বন্দর-নগরের গুরুত্ব এতটুকু কমেনি। শোনা যায় মরক্কো নিবাসী ভূপর্যটক ইবন বতুতা (১৩০৪-১৩৬৮), ১৩৫০ সালে কিছু দিন এই নগরে বাস করেছিলেন। তাঁর লেখা ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে এই নগরের এবং দক্ষিণ বাংলার সমসাময়িক বহু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। ১৫৩৫ থেকে বহু বাধা, বিঘ্ন এবং বারবার যুদ্ধের পর ১৫৫০ সালে বাংলার তৎকালীন আফগান শাসকের থেকে পর্তুগীজরা এই বন্দর থেকে বাণিজ্য করার অনুমতি পায়। যদিও পরবর্তী কালে সরস্বতী নদী নাব্যতা হারায় এবং তার প্রবাহ একসময় ক্ষীণ হতে হতে অবলুপ্ত হয়ে যায়। সেই সঙ্গে সপ্তগ্রামও অতীতের সমস্ত গৌরব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে।

  

২) আমবাড়ি – ফালাকাটাঃ - নিউজলপাইগুড়ি থেকে আসামগামী রেলপথে, জলপাইগুড়ি জেলার একটি রেল স্টেশন। দ্রুতগামী রেলগাড়ি এই স্টেশনকে না ধরলেও, নিউজলপাইগুড়ি এবং হলদিবাড়ি থেকে প্যাসেঞ্জার ট্রেনের রেলপথে এই স্টেশনটি বেশ বিখ্যাত। এই স্টেশনের নামটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ – কারণ নামের প্রথম অংশটি গ্রামের নাম – আমবাড়ি এবং দ্বিতীয় নামটি ওই গ্রামের আরাধ্য দেবমূর্তি রাজা ফালাকাটার নামে।



চিত্রের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা - জিও বাংলা ডট কম।

শোনা যায় প্রায় ৩০০ বছর আগে যে ফালাকাটা দেবতার পুজো শুরু হয় – সেটি প্রকৃতপক্ষে শিবঠাকুর। যে মন্দিরে এখন ফালাকাটা দেবের পুজো হয় সেটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেবী চৌধুরানি, যাঁর কথা চিরন্তন করে গিয়েছেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিম। কথিত আছে দেবী চৌধুরানির সঙ্গে ভবানী পাঠকও এই মন্দিরে নিয়মিত পুজো দিতে আসতেন। প্রাচীন পরম্পরা অনুযায়ী আষাঢ় মাসের প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে, মন্দিরে স্থাপিত তিনটি বিগ্রহের পুজা হয় – রাজা ফালাকাটা, তুলাকাটা এবং ধনাকাটা। এই পুজোর পরেই জমিতে আমন ধান রোপনের কাজ শুরু হয়। এই পুজো উপলক্ষে যেহেতু দূরদূরান্ত থেকে ভক্ত সমাবেশ হয়, সেই কারণে অন্য সময় স্টেশনটি নির্জন থাকলেও, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে খুবই ব্যস্ত হয়ে ওঠে।  

     

২) কর্ণ সুবর্ণঃ - কাটোয়া – আজিমগঞ্জ রেলপথে একটি ছোট স্টেশন কর্ণসুবর্ণ, বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্কর (রাজত্বকাল ৬০৬-৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দ) রাজধানীর স্মৃতি বহন করে চলেছে আজও। যদিও এই শহরের গৌরব অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী মাত্র ৩১ বছর, রাজা শশাঙ্কর মৃত্যুর পরেই এই শহর ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয় এবং কালের নিয়মে ধ্বংস হয়ে যায়। এই রাজধানী শহরের অদূরেই ছিল বৌদ্ধদের রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার স্থানীয় মানুষের মুখে সে নাম ছিল রাঙামাটি বিহার। এই বিহার ঠিক কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে নিয়ে যদিও বিতর্ক আছে, তবে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এটির প্রতিষ্ঠাতা মৌর্য সম্রাট ধর্মাশোক। কর্ণসুবর্ণ এবং রাঙামাটি বিহার সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায় হিউ-য়েন-সাং-য়ের ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে। ভারতের ইতিহাসে শশাঙ্ক বিখ্যাত কারণ সম্রাট হর্ষবর্ধন অন্ততঃ বার দুয়েক চেষ্টা করেও তাঁকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারেননি। বরং হর্ষবর্ধন সিংহাসনে বসার আগে, তাঁর দাদা রাজ্যবর্ধনকে (৬০৬ সালে) শশাঙ্ক যুদ্ধে পরাস্ত করে হত্যা করেছিলেন। সিংহাসনে বসার কিছুদিন পর হর্ষবর্ধন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন, এবং বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হয়ে চিরশত্রু হিন্দু রাজা শশাঙ্ককে বৌদ্ধ বিদ্বেষী মনে করতেন। কিন্তু হিউ-য়েন-সাং-য়ের ভ্রমণ বৃত্তান্তে রাঙামাটি বিহারের বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং কর্ণসুবর্ণ (যার চলিত নাম ছিল কানসোনা) নগরের হিন্দুদের মধ্যে কোন বৈরীতার উল্লেখ নেই – বরং দুই ধর্মের মধ্যে তিনি সম্প্রীতিই লক্ষ্য করেছিলেন।          

 

৩) কৃষ্ণনগরঃ বাংলার ইতিহাসে নদীয়ার রাজা এবং রাজধানী শহর কৃষ্ণনগরের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-৮৩) এক স্মরণীয় নাম। তিনি সংস্কৃত ও ফার্সী দুটি ভাষাতেই যেমন বিদ্বান ছিলেন, তেমনি তিনি সঙ্গীত ও অস্ত্রবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। বিদ্যাচর্চার জন্যে মধ্যযুগে বাংলার নদীয়া জেলার যে সর্বভারতীয় খ্যাতি ছিল, তার অনেকটাই তিনি ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। তাঁর সভায় নবরত্ন সভার মতোই জ্ঞানী-গুণীজনের সমাবেশ ছিল। তাঁর সভাকবি ছিলেন সাধক রামপ্রসাদ ও ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। রামপ্রসাদের শ্যামাসঙ্গীত আজও বাংলার ঘরে ঘরে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্য, শত খানেক বছর আগেও অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। তাঁর সভায় আরও ছিলেন, পুরাণ বিশারদ পণ্ডিত গদাধর তর্কালঙ্কার, পণ্ডিত কালিদাস সিদ্ধান্ত ও কন্দর্প সিদ্ধান্ত, রাজজ্যোতিষী অনুকূল বাচস্পতি, রাজবৈদ্য ও আয়ুর্বেদাচার্য গোবিন্দরাম, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার,  হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত প্রমুখ। এছাড়াও ছিলেন গোপালচন্দ্র বিদূষক – যিনি গোপাল ভাঁড় নামে আজও বঙ্গ সমাজে তাঁর তাৎক্ষণিক বুদ্ধি এবং তীক্ষ্ণ রসবোধের জন্য সুপরিচিত। শোনা যায়, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র বাংলায় জগদ্ধাত্রী পূজারও প্রচলন করেছিলেন।         

 

৪) খাগড়াঘাট রোডঃ - কাটোয়া – মালদহ রুটে এই স্টেশনের অতীত ঐতিহ্য আধুনিক যুগে কেউই মনে রাখেনি। খাগড়াঘাট ভাগিরথীর পশ্চিম তীরে হলেও – নদীর পূর্ব পাড়ের খাগড়া গ্রাম বিগত হাজার খানেক বছর আগে থেকে বিখ্যাত ছিল কাঁসা এবং পিতলের বাসনপত্রের জন্য। শুধু মাত্র বাসনপত্র নয়, কাঁসা, পিতল এবং অষ্টধাতুর  মূর্তিশিল্পেও এই গ্রামটির সুনাম ছিল দেশেবিদেশে। আমাদের ছোটবেলাতেও দেখেছি, কন্যার বিবাহে বরকে “খাগড়াই কাঁসার” দানসামগ্রী দিতে পেরে কন্যার পিতারা বড়ো তৃপ্তি পেতেন। স্টেনলেস স্টিল এবং অন্যান্য আধুনিক উপকরণ আমাদের এই প্রাচীন শিল্পটিকে মোটামুটি শেষ করে ছেড়েছে। গুরুত্ব হারিয়েছে খাগড়া।

 

৫) গুঞ্জরিয়াঃ - ছাত্রাবস্থায় জলপাইগুড়িতে থাকার সময় শেয়ালদা থেকে নিউজলপাইগুড়িগামী দার্জিলিং মেল ছিল আমাদের নিত্যসাথী। সেরকমই কোন এক যাত্রার সময়, সিগন্যাল না পেয়ে দার্জিলিং মেল দাঁড়িয়ে গেল “গুঞ্জরিয়া” স্টেশনে। জায়গাটি উত্তর দিনাজপুর জেলায়তখন সবে ভোরের আলো ফুটেছে, নির্জন-নিরিবিলি, গাছপালা ঘেরা ফাঁকামাঠের মধ্যে স্টেশন। আমাদের এক বন্ধু বলেছিল, এই স্টেশনের নাম নিশ্চয়ই রবিঠাকুর রেখেছিলেন। মংপু, দার্জিলিং, কালিম্পং যাওয়ার পথে তিনি নিশ্চয়ই কোনদিন এইখানে নেমেছিলেনগাছগাছালি ঘেরা নিরিবিলি এই জায়গাটি ঋষিপ্রতিম কবির মনে হয়তো কোন অনুভূতির গুঞ্জরন তুলেছিল। বন্ধুর গল্পটি সত্যি কিনা জানি না, অন্য কোন সূত্রে এই তথ্যটি আজ পর্যন্ত পাইনি। কিন্তু আজও ওই লাইনে যাওয়ার সময় মনে মনে আশা করি, ট্রেনটি যেন সিগন্যাল না পায়, ওই স্টেশনে যেন একবারটি দাঁড়ায়, মনে পড়ে যায় কবিগুরুর গানের দুটি পংক্তি -

“ফিরে ফিরে চিত্তবীণায় দাও যে নাড়া,

গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া দেয় সে সাড়া”।

 

৬) জয়নগর-মজিলপুরঃ শেয়ালদা-লক্ষ্মীকান্তপুর রেলপথে জয়নগর-মজিলপুর বেশ ব্যস্ত একটি স্টেশন। শেয়ালদা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪৯ কিমি। জয়নগরের নাম শুনলেই আমাদের প্রথমেই মনে আসে এই অঞ্চলের বিখ্যাত মোয়ার কথা। নলেনগুড় এবং ক্ষীর দিয়ে মাখা সুগন্ধী খইয়ের মোয়াগুলি শীতের দিনের অত্যন্ত লোভনীয় একটি খাবার সন্দেহ নেই। মোয়া ছাড়াও এই অঞ্চলটি মনে রাখার মতো – এর প্রাচীন ঐতিহ্যের জন্য, কিন্তু সে সব কথা আমরা এখন প্রায় ভুলতে বসেছি। নিমতা গ্রামের বাসিন্দা কবি কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গল কাব্যে এই অঞ্চলের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬৫৮ সালে। সে সময় এই সম্পন্ন গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যেত হুগলি নদীর প্রধান শাখানদী আদি গঙ্গা। এই নদী পথে বাণিজ্যের কারণেই এই অঞ্চল সে সময় অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু গ্রাম হয়ে উঠেছিল। পরবর্তী কালে আদিগঙ্গার প্রবাহ ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার কারণে এই অঞ্চলটির গৌরব অনেকটাই ম্লান হয়ে আসে। শোনা যায় সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে, বাংলার সুবাদার ইসলাম খানের কাছে যশোরের (আধুনিক বাংলাদশে)  রাজা প্রতাপাদিত্য পরাজিত হওয়ায়, চন্দ্রকেতু দত্ত নামক জনৈক ভাগ্যান্বেষী সম্পন্ন ব্যক্তি যশোর ছেড়ে মজিলপুরে চলে আসেন। তাঁর সঙ্গে আসেন তাঁদের পারিবারিক পুরোহিত শ্রীকৃষ্ণ উদ্গাতা এবং রঘুনন্দন পোতা। পরবর্তী সময়ে দত্ত পরিবার বাণিজ্য করে প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণ উদ্গাতার বংশধরেরা ভট্টাচার্য উপাধি গ্রহণ করেন, এবং শিক্ষা-দীক্ষায় এই বংশ অত্যন্ত সুনাম অর্জন করেন। বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক ও অসামান্য পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী এই বংশেরই সন্তান। এই বংশের আরেক কৃতী সন্তান হলেন বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী কানাইলাল ভট্টাচার্য।

সেই প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন কালের গ্রাসে অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেলেও, বেশ কিছু নিদর্শন আজও জয়নগরের তৎকালীন গৌরব ও সমৃদ্ধির সাক্ষ্য দেয়। যেমন, জয়চণ্ডী মন্দির, নাটমন্দির সহ রাধাবল্লভ মন্দির ও তার সংলগ্ন চারচালা দোলমঞ্চ, দ্বাদশ শিবমন্দির ইত্যাদি।     

    

) ঝাপটের ঢাল, পিচকুরির ঢাল এবং নোয়াদার ঢালঃ পূর্ব বর্ধমানে সাহেবগঞ্জ লুপে এই তিনটি স্টেশনের অবস্থান। প্রায় পাশাপাশি এই তিনটি স্টেশনের নামে ঢাল শব্দটিতেই আমার কৌতূহলএই অঞ্চলের পশ্চাৎভূমি কি অনেকটাই উঁচু, এই তিনটি এলাকা কি নিম্নগামী, ঢালু? সেই কারণেই কি তিনটি গ্রামের নামে ঢাল যুক্ত হয়েছে? ওইদিকের কিছু অধিবাসীদের কাছে জিজ্ঞাসা করে কোন উত্তর পাইনি – বলেছিলেন - নাম-নামই তার আবার কারণ কি? তবে নোয়াদার ঢাল সম্বন্ধে একটি জনশ্রুতি শোনা যায় – পরপর দুটি স্টেশনের নামে ঢাল শব্দটি শুনে ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার নাকি বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “নো আদার ঢাল”। কিন্তু ভালো ইংরিজি না জানা বাঙালী ওভারসিয়ার ভেবেছিল সায়েব স্টেশনটির নাম রাখল- “নোয়াদার ঢাল”।

 

) পলাশীঃ শেয়ালদা-বহরমপুর শাখায় পলাশী স্টেশনের অদূরের আমবাগানে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্নেল রবার্ট ক্লাইভের। নবাবের সৈন্য বাহিনীর তুলনায় যদিও কোম্পানির সৈন্য সংখ্যা ছিল তুচ্ছ। কিন্তু সিরাজের প্রধান সেনাপতি ও অন্যান্য আমলাদের ষড়যন্ত্রে নবাব সেই যুদ্ধে শুধু পরাজিত হননি, নিহতও হয়েছিলেন তাঁর নিজেরই বিশ্বাসঘাতক এক কর্মচারীর হাতে। দিনটা ছিল ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন। এই সাফল্য লোভী ও হিংস্র স্বার্থপর ব্রিটিশজাতিকে পথ দেখিয়েছিল কীভাবে ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতকে গ্রাস করে চরম শোষণ করা সম্ভব। অর্থাৎ প্রভাবশালী সামান্য কিছু মুসলিম ও হিন্দুর ব্যক্তিগত স্বার্থজনিত চক্রান্তের কারণে, ভারতের আপামর জনসাধারণকে চরম দুর্ভোগে প্রায় ১৯০ বছর ব্রিটিশের পদানত থাকতে হয়েছিল। ভারতের যাবতীয় সম্পদ প্রায় নিঃশেষে লুঠ করে, সে সময় ব্রিটেন হয়ে উঠেছিল বিশ্বের এক নম্বর বৈভবশালী, সভ্য, শিক্ষিত ও রুচিশীল দেশ! তার সূত্রপাত হয়েছিল এই পলাশীতেই।           

       

) বর্ধমানঃ - হাওড়া-দিল্লি রেলপথে বর্ধমান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যস্ত জংশন স্টেশন। মিহিদানা-সীতাভোগের জন্য বিখ্যাত এই শহরটির ঐতিহাসিক গুরুত্বও কিন্তু অপরিসীম, যদিচ আমরা অনেকেই সেকথা মনে রাখি না। বর্ধমান পূর্ব ভারতের প্রাচীনতম জনপদের একটি। এই জনপদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় জৈন কল্পসূত্রে। বলা হয় ২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীর যাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল বর্ধমান – ধর্মপ্রচারের জন্য কিছুদিন আস্তিকগ্রামে ছিলেন। তাঁর পুণ্য স্মৃতিতে এই জনপদের নাম হয় বর্ধমান। হিন্দু, বৌদ্ধ এবং মুসলিম শাসনকালেও এই শহর এবং জনপদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। যার ফলে এই শহরটিকেই বাংলার প্রাচীনতম শহর বলা যায় – যা আজও সগৌরবে বিদ্যমান।   

       

১০) বোলপুর-শান্তিনিকেতনঃ - বর্ধমান–রামপুরহাট রেলপথে বোলপুর স্টেশন। প্রথমেই এই বোলপুর নামের ইতিহাসটা জেনে নেওয়া যাক। মার্কণ্ডেয়পুরাণ অনুযায়ী রাজা সুরথ ছিলেন এই অঞ্চলের রাজা, এবং তাঁর রাজধানী ছিল বোলপুর সংলগ্ন সুপুর এলাকা। এই রাজা সুরথের নাম মহালয়ার ভোরে শ্রীশ্রীচণ্ডীপাঠের সময় আমরা শুনেছি এবং তিনিই মর্তে মহিষাসুরমর্দিনী দূর্গাপূজার প্রচলন করেন। সন্ধিপূজার সময় তিনি নাকি লক্ষাধিক ছাগবলি দিতেন এবং সেই রক্ত প্রবাহ আটকাতে বাঁধ দেওয়া হত প্রতিবছর। এই বলি থেকেই ওই অঞ্চলের নাম হয়েছিল বলিপুর, যা লোকমুখে হয়ে ওঠে বোলপুর এবং সেই বাঁধের নামেই আজকের বাঁধগোড়া এলাকা।

প্রাচীন কাহিনী যাই হোক, আধুনিক বোলপুরের সঙ্গে সর্বতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর স্বপ্ন ও অজস্র স্মৃতি।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ একবার পশ্চিম-ভ্রমণ থেকে ফেরার পথে আমদপুর স্টেশনে নেমে পাল্কি চড়ে বোলপুর হয়ে রায়পুর যাচ্ছিলেন। তাঁর ভক্ত-শিষ্য শ্রীকণ্ঠ সিংহরায় ছিলেন রায়পুরের জমিদার। যাওয়ার পথে তাঁর চোখে পড়ে প্রায় জনবিরল অনন্ত-বিস্তৃত এই নিঃস্ব প্রান্তরটি – যার এক প্রান্তে সম্বল ছিল দুটি মাত্র ছাতিমগাছ। জায়গাটি তাঁর ভালো লেগে যায় এবং ধ্যানী ও প্রকৃতিরসিক মহর্ষি স্থির করেন – এইখানেই আসন পেতে তিনি মগ্ন থাকবেন তাঁর পরমপিতার ধ্যানে – এই বিবাগী প্রান্তরই হবে তাঁর শান্তিনিকেতন। রায়পুরের জমিদারের থেকে প্রায় ২০ একর জমি লিজ নিয়ে তিনি ১৮৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শান্তিনিকেতন আশ্রম।

সেই আশ্রমটিই তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের হাতে পড়ে হয়ে উঠল বিশ্ব-মনীষার মিলনক্ষেত্র। আশ্রম ভিত্তিক বিদ্যালয় দিয়ে শুরু করে, আমৃত্যু কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তুললেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর আমন্ত্রণে বিশ্বের কত দেশ থেকে সম্মিলিত হয়েছিলেন কত যে মনীষী। শুধু বিদ্যাচর্চাই নয় – ছবি আঁকা, ভাস্কর্য, নৃত্য, গীত, অভিনয় – এককথায় ললিতকলার সর্ববিষয়েই সে সময় ভারতবর্ষে শান্তিনিকেতনই ছিল পথিকৃৎ।    

সেই স্মৃতি বাঙালী হিসেবে আমাদের যেমন গর্বিত করে, তেমনই তাকে ঘিরে আধুনিক বিদ্বজ্জনদের নানান কলহ চরম লজ্জা দেয়।

 

) মুর্শিদাবাদঃ শেয়ালদা-লালগোলা রেলপথে এ স্টেশনের অবস্থান। ১৭০৩ থেকে ১৭৭১ পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ ছিল সুবে বংলার রাজধানী। মুঘল আমলে সুবে বাংলা বলতে আধুনিক পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, বিহার ও ঊড়িষ্যা অঞ্চল বোঝাতো। শোনা যায় মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যান্য যে কোন অঞ্চলের তুলনায় এই সুবে বাংলা থেকেই নাকি সর্বাধিক রাজস্ব আদায় হত। সেই কারণেই, মুঘল বাদশা আওরঙ্গজেব, ১৭০৩ সালে ঢাকার দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁদক্ষতায় আস্থা রেখে, তাঁকে বাংলার দেওয়ান হিসাবে নিযুক্ত করেন। বাংলার দেওয়ান হয়ে মুর্শিদকুলি খাঁ ঢাকা থেকে ভাগীরথীর তীরের ছোট শহর মকসুদাবাদে তাঁর দপ্তর সরিয়ে আনেন এবং ১৭০৪ সালে বাদশা আওরঙ্গজেবের অনুমতি নিয়ে নিজের নামে এই শহরের নাম রাখেন মুর্শিদাবাদ। মুঘল বাদশাদের দেওয়ান হলেও প্রকৃতপক্ষে মুর্শিদাকুলি খাঁ হয়ে উঠলেন বাংলার নবাব – কারণ বাংলার শাসন ব্যবস্থায় দিল্লি তেমন নাক গলাত না, সময় মতো নির্দিষ্ট রাজস্ব পেয়ে গেলেই দিল্লি খুশি থাকত।

১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দিল্লির মসনদ ঘিরে মুঘল পরিবারে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হল, স্বাধীন নবাব হয়ে উঠতে মুর্শিদকুলির কোন বাধাই রইল না। প্রশাসক হিসাবে অত্যন্ত দক্ষ মুর্শিদকুলি, এবার নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে তুললেন মুর্শিদাবাদ শহর এবং রাজ্য প্রশাসন। তখনকার ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায় – ভাগীরথীর তীরে রম্য প্রাসাদ ও বাগিচা ঘেরা মুর্শিদাবাদ ছিল উজ্জ্বল এক শহর – যেখানে সব সম্প্রদায়ের মানুষই আনন্দে, সুখে, শান্তিতে বাস করত।

১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর মুর্শিদাবাদের মসনদে বসলেন, তাঁর জামাই সুজাউদ্দিন। তাঁর আমলে শহরে আরও অনেক প্রাসাদ নির্মিত হয় এবং বেড়ে ওঠে শহরের জাঁকজমক। এরপর ১৭৩৯ সালে সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর মসনদে বসলেন তাঁর পুত্র সরফরাজ। কিন্তু মাত্র একবছরের মধ্যে তাঁর পিতার অমাত্য ও পারিষদদের ষড়যন্ত্রে, তাঁর পিতার অধীনস্থ বিহারের দিওয়ান আলিবর্দী মুর্শিদাবাদ দখল করতে এলে, ১৭৪০ সালে গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ পরাজিত এবং নিহত হলেন। আলিবর্দী হলেন মুর্শিদাবাদের নতুন নবাব।

আলিবর্দী খাঁ অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর আমলেই - ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ - মারাঠা বর্গীদের আক্রমণে দক্ষিণবঙ্গ প্রত্যেকবছর বিধ্বস্ত হতে থাকে এবং তাঁকেও ব্যতিবস্ত থাকতে হত। অবশেষে আলিবর্দির সঙ্গে মারাঠাদের বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা দেওয়ার এক চুক্তির ভিত্তিতে ১৭৫১ সালের পর বর্গী আক্রমণ থেকে বাংলা পরিত্রাণ পায়।

১৭৫৬ সালে আলিবর্দীর মৃত্যুর পর, তাঁর মসনদে বসলেন তাঁর দৌহিত্র, মাত্র ২৩ বছর বয়সী সিরাজদ্দৌলা। প্রথম থেকেই তাঁকে ঘিরে প্রাসাদের ভিতরে এবং প্রশাসনিক মহলে ঘোরতর ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে থাকে। সেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েই ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে তিনি ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত হন এবং পরে নিহত হন।

সিরাজের পতনের পর ব্রিটিশ গভর্নর ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ শহর এবং তার ঐশ্বর্য দেখে বিস্মিত হয়ে লিখেছিলেন,মুর্শিদাবাদ লণ্ডন শহরের মতোই বিশাল, জনবহুল এবং ধনী শহর, কিন্তু দুটোর মধ্যে তফাত একটাই, এই শহরের অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রত্যেক ব্যক্তি, যে বিপুল পরিমাণ সম্পদের অধিকারী, কোন লণ্ডনবাসীর পক্ষেই তা কল্পনা করা সম্ভব হবে না”।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের ছোট্ট অংশ বাংলার এই ঐশ্বর্য ভাণ্ডার লুঠ করে ব্রিটিশদের অর্থলিপ্সা বেড়ে গেল বহুগুণ। সম্পূর্ণ ভারত লুঠের জন্য তারা প্রস্তুতি শুরু করল এবং ১৭৭ সালে মুর্শিদাবাদ থেকে তারা বাংলার  রাজধানী সরিয়ে আনল কলকাতায়, পরে কলকাতাই হয়ে ওঠে ভারতের রাজধানী।

মুর্শিদাবাদ পড়ে রইল অবহেলায় এবং কালের নিয়মে ধ্বংস হয়ে গেল স্বাধীন বাংলার শেষ গৌরবময় ইতিহাস।       

 

) রাজাভাত খাওয়াঃ – নিউজলপাইগুড়ি – আলিপুরদুয়ার রেলপথে এই স্টেশনটির নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসাধারণ এক মৈত্রীর লোককথা। কোচবিহারের কোচ রাজাদের সঙ্গে ভূটানের ভোট রাজাদের ছিল তীব্র রেষারেষি, উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকত এবং উভয়েই হার মেনে মিত্রতা স্থাপনের পক্ষপাতী ছিলেন না। এইরকম পরিস্থিতিতে ১৮০০ সালের কোন এক সময় কোচ রাজা প্রতিজ্ঞা করলেন, ভোট রাজাকে পরাস্ত না করে তিনি ভাত খাবেন না।  এই প্রতিজ্ঞার কথা কানে আসতে ভূটানের রাজা বিচলিত হলেন এবং সপারিষদ দেখা করতে গেলেন কোচ রাজার সঙ্গে। দুই পক্ষের সাক্ষাৎ হয়েছিল এই গ্রামেই – কিন্তু সেবার আর যুদ্ধ নয় দুই রাজা মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একত্রে আহার করেছিলেন, বলা বাহুল্য ভাতই ছিল উভয় রাজার প্রধান খাদ্য। সেই থেকেই নাকি এই গ্রামের নাম রাজাভাত খাওয়া।

  --০০--

 প্রবন্ধটি একপর্ণিকা প্রকাশণী থেকে প্রকাশিত "বাংলার স্টেশন কথা"-র একটি অধ্যায়। বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন এই ঠিকানায় - 

                                                 বাংলার স্টেশন কথা

                                    সম্পা: পথিক রাহা ও রাজীবকুমার সাহা

                        একপর্ণিকা প্রকাশনী, ৪০০\- (১৫% ছাড় ও ফ্রি শিপিং)

                            WhatsApp Easy Order  +91 9366 531 526

                        কলেজ স্ট্রিটে জয়ঢাক প্রকাশন ১৮, সূর্য সেন স্ট্রিট দ্বিতল


 

নতুন পোস্টগুলি

পায়রা

  [গল্পটি শোনাও যাবে "ঋতুযানের অদ্ভূত গল্প" সিরিজ - ইউটিউবের এই চ্যানেলে,  পায়রা  ]   ভোর সাড়ে ছটায় মোবাইলের আওয়াজে স্বপনের ঘুম ভে...