প্রবন্ধ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
প্রবন্ধ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সোমবার, ৭ জুলাই, ২০২৫

বাংলার কিছু স্টেশন – কিছু অনুভব

 আমার সুদীর্ঘ জীবনের প্রত্যেকটি রেলযাত্রায় প্রতিবারই নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেমন পৌঁছেছি তেমনই সে পথে কখনো পেয়েছি ইতিহাসের স্পর্শ, কখনো জাগিয়েছে কৌতূহল, কখনো পেয়েছি নির্মল আনন্দ। কিছু স্টেশন নিয়ে আমার সেই নানান অনুভবের কথাই এখন বলব।  

১) আদিসপ্তগ্রামঃ - হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইনে ব্যাণ্ডেল জংশন থেকে ৪ কিমি দূরত্বে আদি সপ্তগ্রাম স্টেশন বাংলার মধ্যযুগে অত্যন্ত সম্পন্ন বন্দর নগর ছিল, যদিও সে সময় তার নাম ছিল সপ্তগ্রাম। সরস্বতী নদীর তীরে অবস্থিত এই বন্দরনগরীর গৌরবকথার বারবার উল্লেখ পাওয়া যায় বাংলার মঙ্গল কাব্যগুলিতে। হিন্দু রাজত্বের পর মুসলিম রাজত্বেও এই বন্দর-নগরের গুরুত্ব এতটুকু কমেনি। শোনা যায় মরক্কো নিবাসী ভূপর্যটক ইবন বতুতা (১৩০৪-১৩৬৮), ১৩৫০ সালে কিছু দিন এই নগরে বাস করেছিলেন। তাঁর লেখা ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে এই নগরের এবং দক্ষিণ বাংলার সমসাময়িক বহু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। ১৫৩৫ থেকে বহু বাধা, বিঘ্ন এবং বারবার যুদ্ধের পর ১৫৫০ সালে বাংলার তৎকালীন আফগান শাসকের থেকে পর্তুগীজরা এই বন্দর থেকে বাণিজ্য করার অনুমতি পায়। যদিও পরবর্তী কালে সরস্বতী নদী নাব্যতা হারায় এবং তার প্রবাহ একসময় ক্ষীণ হতে হতে অবলুপ্ত হয়ে যায়। সেই সঙ্গে সপ্তগ্রামও অতীতের সমস্ত গৌরব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে।

  

২) আমবাড়ি – ফালাকাটাঃ - নিউজলপাইগুড়ি থেকে আসামগামী রেলপথে, জলপাইগুড়ি জেলার একটি রেল স্টেশন। দ্রুতগামী রেলগাড়ি এই স্টেশনকে না ধরলেও, নিউজলপাইগুড়ি এবং হলদিবাড়ি থেকে প্যাসেঞ্জার ট্রেনের রেলপথে এই স্টেশনটি বেশ বিখ্যাত। এই স্টেশনের নামটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ – কারণ নামের প্রথম অংশটি গ্রামের নাম – আমবাড়ি এবং দ্বিতীয় নামটি ওই গ্রামের আরাধ্য দেবমূর্তি রাজা ফালাকাটার নামে।



চিত্রের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা - জিও বাংলা ডট কম।

শোনা যায় প্রায় ৩০০ বছর আগে যে ফালাকাটা দেবতার পুজো শুরু হয় – সেটি প্রকৃতপক্ষে শিবঠাকুর। যে মন্দিরে এখন ফালাকাটা দেবের পুজো হয় সেটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেবী চৌধুরানি, যাঁর কথা চিরন্তন করে গিয়েছেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিম। কথিত আছে দেবী চৌধুরানির সঙ্গে ভবানী পাঠকও এই মন্দিরে নিয়মিত পুজো দিতে আসতেন। প্রাচীন পরম্পরা অনুযায়ী আষাঢ় মাসের প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে, মন্দিরে স্থাপিত তিনটি বিগ্রহের পুজা হয় – রাজা ফালাকাটা, তুলাকাটা এবং ধনাকাটা। এই পুজোর পরেই জমিতে আমন ধান রোপনের কাজ শুরু হয়। এই পুজো উপলক্ষে যেহেতু দূরদূরান্ত থেকে ভক্ত সমাবেশ হয়, সেই কারণে অন্য সময় স্টেশনটি নির্জন থাকলেও, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে খুবই ব্যস্ত হয়ে ওঠে।  

     

২) কর্ণ সুবর্ণঃ - কাটোয়া – আজিমগঞ্জ রেলপথে একটি ছোট স্টেশন কর্ণসুবর্ণ, বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্কর (রাজত্বকাল ৬০৬-৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দ) রাজধানীর স্মৃতি বহন করে চলেছে আজও। যদিও এই শহরের গৌরব অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী মাত্র ৩১ বছর, রাজা শশাঙ্কর মৃত্যুর পরেই এই শহর ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয় এবং কালের নিয়মে ধ্বংস হয়ে যায়। এই রাজধানী শহরের অদূরেই ছিল বৌদ্ধদের রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার স্থানীয় মানুষের মুখে সে নাম ছিল রাঙামাটি বিহার। এই বিহার ঠিক কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে নিয়ে যদিও বিতর্ক আছে, তবে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এটির প্রতিষ্ঠাতা মৌর্য সম্রাট ধর্মাশোক। কর্ণসুবর্ণ এবং রাঙামাটি বিহার সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায় হিউ-য়েন-সাং-য়ের ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে। ভারতের ইতিহাসে শশাঙ্ক বিখ্যাত কারণ সম্রাট হর্ষবর্ধন অন্ততঃ বার দুয়েক চেষ্টা করেও তাঁকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারেননি। বরং হর্ষবর্ধন সিংহাসনে বসার আগে, তাঁর দাদা রাজ্যবর্ধনকে (৬০৬ সালে) শশাঙ্ক যুদ্ধে পরাস্ত করে হত্যা করেছিলেন। সিংহাসনে বসার কিছুদিন পর হর্ষবর্ধন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন, এবং বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হয়ে চিরশত্রু হিন্দু রাজা শশাঙ্ককে বৌদ্ধ বিদ্বেষী মনে করতেন। কিন্তু হিউ-য়েন-সাং-য়ের ভ্রমণ বৃত্তান্তে রাঙামাটি বিহারের বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং কর্ণসুবর্ণ (যার চলিত নাম ছিল কানসোনা) নগরের হিন্দুদের মধ্যে কোন বৈরীতার উল্লেখ নেই – বরং দুই ধর্মের মধ্যে তিনি সম্প্রীতিই লক্ষ্য করেছিলেন।          

 

৩) কৃষ্ণনগরঃ বাংলার ইতিহাসে নদীয়ার রাজা এবং রাজধানী শহর কৃষ্ণনগরের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-৮৩) এক স্মরণীয় নাম। তিনি সংস্কৃত ও ফার্সী দুটি ভাষাতেই যেমন বিদ্বান ছিলেন, তেমনি তিনি সঙ্গীত ও অস্ত্রবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। বিদ্যাচর্চার জন্যে মধ্যযুগে বাংলার নদীয়া জেলার যে সর্বভারতীয় খ্যাতি ছিল, তার অনেকটাই তিনি ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। তাঁর সভায় নবরত্ন সভার মতোই জ্ঞানী-গুণীজনের সমাবেশ ছিল। তাঁর সভাকবি ছিলেন সাধক রামপ্রসাদ ও ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। রামপ্রসাদের শ্যামাসঙ্গীত আজও বাংলার ঘরে ঘরে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্য, শত খানেক বছর আগেও অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। তাঁর সভায় আরও ছিলেন, পুরাণ বিশারদ পণ্ডিত গদাধর তর্কালঙ্কার, পণ্ডিত কালিদাস সিদ্ধান্ত ও কন্দর্প সিদ্ধান্ত, রাজজ্যোতিষী অনুকূল বাচস্পতি, রাজবৈদ্য ও আয়ুর্বেদাচার্য গোবিন্দরাম, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার,  হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত প্রমুখ। এছাড়াও ছিলেন গোপালচন্দ্র বিদূষক – যিনি গোপাল ভাঁড় নামে আজও বঙ্গ সমাজে তাঁর তাৎক্ষণিক বুদ্ধি এবং তীক্ষ্ণ রসবোধের জন্য সুপরিচিত। শোনা যায়, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র বাংলায় জগদ্ধাত্রী পূজারও প্রচলন করেছিলেন।         

 

৪) খাগড়াঘাট রোডঃ - কাটোয়া – মালদহ রুটে এই স্টেশনের অতীত ঐতিহ্য আধুনিক যুগে কেউই মনে রাখেনি। খাগড়াঘাট ভাগিরথীর পশ্চিম তীরে হলেও – নদীর পূর্ব পাড়ের খাগড়া গ্রাম বিগত হাজার খানেক বছর আগে থেকে বিখ্যাত ছিল কাঁসা এবং পিতলের বাসনপত্রের জন্য। শুধু মাত্র বাসনপত্র নয়, কাঁসা, পিতল এবং অষ্টধাতুর  মূর্তিশিল্পেও এই গ্রামটির সুনাম ছিল দেশেবিদেশে। আমাদের ছোটবেলাতেও দেখেছি, কন্যার বিবাহে বরকে “খাগড়াই কাঁসার” দানসামগ্রী দিতে পেরে কন্যার পিতারা বড়ো তৃপ্তি পেতেন। স্টেনলেস স্টিল এবং অন্যান্য আধুনিক উপকরণ আমাদের এই প্রাচীন শিল্পটিকে মোটামুটি শেষ করে ছেড়েছে। গুরুত্ব হারিয়েছে খাগড়া।

 

৫) গুঞ্জরিয়াঃ - ছাত্রাবস্থায় জলপাইগুড়িতে থাকার সময় শেয়ালদা থেকে নিউজলপাইগুড়িগামী দার্জিলিং মেল ছিল আমাদের নিত্যসাথী। সেরকমই কোন এক যাত্রার সময়, সিগন্যাল না পেয়ে দার্জিলিং মেল দাঁড়িয়ে গেল “গুঞ্জরিয়া” স্টেশনে। জায়গাটি উত্তর দিনাজপুর জেলায়তখন সবে ভোরের আলো ফুটেছে, নির্জন-নিরিবিলি, গাছপালা ঘেরা ফাঁকামাঠের মধ্যে স্টেশন। আমাদের এক বন্ধু বলেছিল, এই স্টেশনের নাম নিশ্চয়ই রবিঠাকুর রেখেছিলেন। মংপু, দার্জিলিং, কালিম্পং যাওয়ার পথে তিনি নিশ্চয়ই কোনদিন এইখানে নেমেছিলেনগাছগাছালি ঘেরা নিরিবিলি এই জায়গাটি ঋষিপ্রতিম কবির মনে হয়তো কোন অনুভূতির গুঞ্জরন তুলেছিল। বন্ধুর গল্পটি সত্যি কিনা জানি না, অন্য কোন সূত্রে এই তথ্যটি আজ পর্যন্ত পাইনি। কিন্তু আজও ওই লাইনে যাওয়ার সময় মনে মনে আশা করি, ট্রেনটি যেন সিগন্যাল না পায়, ওই স্টেশনে যেন একবারটি দাঁড়ায়, মনে পড়ে যায় কবিগুরুর গানের দুটি পংক্তি -

“ফিরে ফিরে চিত্তবীণায় দাও যে নাড়া,

গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া দেয় সে সাড়া”।

 

৬) জয়নগর-মজিলপুরঃ শেয়ালদা-লক্ষ্মীকান্তপুর রেলপথে জয়নগর-মজিলপুর বেশ ব্যস্ত একটি স্টেশন। শেয়ালদা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪৯ কিমি। জয়নগরের নাম শুনলেই আমাদের প্রথমেই মনে আসে এই অঞ্চলের বিখ্যাত মোয়ার কথা। নলেনগুড় এবং ক্ষীর দিয়ে মাখা সুগন্ধী খইয়ের মোয়াগুলি শীতের দিনের অত্যন্ত লোভনীয় একটি খাবার সন্দেহ নেই। মোয়া ছাড়াও এই অঞ্চলটি মনে রাখার মতো – এর প্রাচীন ঐতিহ্যের জন্য, কিন্তু সে সব কথা আমরা এখন প্রায় ভুলতে বসেছি। নিমতা গ্রামের বাসিন্দা কবি কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গল কাব্যে এই অঞ্চলের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬৫৮ সালে। সে সময় এই সম্পন্ন গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যেত হুগলি নদীর প্রধান শাখানদী আদি গঙ্গা। এই নদী পথে বাণিজ্যের কারণেই এই অঞ্চল সে সময় অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু গ্রাম হয়ে উঠেছিল। পরবর্তী কালে আদিগঙ্গার প্রবাহ ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার কারণে এই অঞ্চলটির গৌরব অনেকটাই ম্লান হয়ে আসে। শোনা যায় সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে, বাংলার সুবাদার ইসলাম খানের কাছে যশোরের (আধুনিক বাংলাদশে)  রাজা প্রতাপাদিত্য পরাজিত হওয়ায়, চন্দ্রকেতু দত্ত নামক জনৈক ভাগ্যান্বেষী সম্পন্ন ব্যক্তি যশোর ছেড়ে মজিলপুরে চলে আসেন। তাঁর সঙ্গে আসেন তাঁদের পারিবারিক পুরোহিত শ্রীকৃষ্ণ উদ্গাতা এবং রঘুনন্দন পোতা। পরবর্তী সময়ে দত্ত পরিবার বাণিজ্য করে প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণ উদ্গাতার বংশধরেরা ভট্টাচার্য উপাধি গ্রহণ করেন, এবং শিক্ষা-দীক্ষায় এই বংশ অত্যন্ত সুনাম অর্জন করেন। বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক ও অসামান্য পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী এই বংশেরই সন্তান। এই বংশের আরেক কৃতী সন্তান হলেন বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী কানাইলাল ভট্টাচার্য।

সেই প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন কালের গ্রাসে অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেলেও, বেশ কিছু নিদর্শন আজও জয়নগরের তৎকালীন গৌরব ও সমৃদ্ধির সাক্ষ্য দেয়। যেমন, জয়চণ্ডী মন্দির, নাটমন্দির সহ রাধাবল্লভ মন্দির ও তার সংলগ্ন চারচালা দোলমঞ্চ, দ্বাদশ শিবমন্দির ইত্যাদি।     

    

) ঝাপটের ঢাল, পিচকুরির ঢাল এবং নোয়াদার ঢালঃ পূর্ব বর্ধমানে সাহেবগঞ্জ লুপে এই তিনটি স্টেশনের অবস্থান। প্রায় পাশাপাশি এই তিনটি স্টেশনের নামে ঢাল শব্দটিতেই আমার কৌতূহলএই অঞ্চলের পশ্চাৎভূমি কি অনেকটাই উঁচু, এই তিনটি এলাকা কি নিম্নগামী, ঢালু? সেই কারণেই কি তিনটি গ্রামের নামে ঢাল যুক্ত হয়েছে? ওইদিকের কিছু অধিবাসীদের কাছে জিজ্ঞাসা করে কোন উত্তর পাইনি – বলেছিলেন - নাম-নামই তার আবার কারণ কি? তবে নোয়াদার ঢাল সম্বন্ধে একটি জনশ্রুতি শোনা যায় – পরপর দুটি স্টেশনের নামে ঢাল শব্দটি শুনে ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার নাকি বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “নো আদার ঢাল”। কিন্তু ভালো ইংরিজি না জানা বাঙালী ওভারসিয়ার ভেবেছিল সায়েব স্টেশনটির নাম রাখল- “নোয়াদার ঢাল”।

 

) পলাশীঃ শেয়ালদা-বহরমপুর শাখায় পলাশী স্টেশনের অদূরের আমবাগানে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্নেল রবার্ট ক্লাইভের। নবাবের সৈন্য বাহিনীর তুলনায় যদিও কোম্পানির সৈন্য সংখ্যা ছিল তুচ্ছ। কিন্তু সিরাজের প্রধান সেনাপতি ও অন্যান্য আমলাদের ষড়যন্ত্রে নবাব সেই যুদ্ধে শুধু পরাজিত হননি, নিহতও হয়েছিলেন তাঁর নিজেরই বিশ্বাসঘাতক এক কর্মচারীর হাতে। দিনটা ছিল ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন। এই সাফল্য লোভী ও হিংস্র স্বার্থপর ব্রিটিশজাতিকে পথ দেখিয়েছিল কীভাবে ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতকে গ্রাস করে চরম শোষণ করা সম্ভব। অর্থাৎ প্রভাবশালী সামান্য কিছু মুসলিম ও হিন্দুর ব্যক্তিগত স্বার্থজনিত চক্রান্তের কারণে, ভারতের আপামর জনসাধারণকে চরম দুর্ভোগে প্রায় ১৯০ বছর ব্রিটিশের পদানত থাকতে হয়েছিল। ভারতের যাবতীয় সম্পদ প্রায় নিঃশেষে লুঠ করে, সে সময় ব্রিটেন হয়ে উঠেছিল বিশ্বের এক নম্বর বৈভবশালী, সভ্য, শিক্ষিত ও রুচিশীল দেশ! তার সূত্রপাত হয়েছিল এই পলাশীতেই।           

       

) বর্ধমানঃ - হাওড়া-দিল্লি রেলপথে বর্ধমান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যস্ত জংশন স্টেশন। মিহিদানা-সীতাভোগের জন্য বিখ্যাত এই শহরটির ঐতিহাসিক গুরুত্বও কিন্তু অপরিসীম, যদিচ আমরা অনেকেই সেকথা মনে রাখি না। বর্ধমান পূর্ব ভারতের প্রাচীনতম জনপদের একটি। এই জনপদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় জৈন কল্পসূত্রে। বলা হয় ২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীর যাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল বর্ধমান – ধর্মপ্রচারের জন্য কিছুদিন আস্তিকগ্রামে ছিলেন। তাঁর পুণ্য স্মৃতিতে এই জনপদের নাম হয় বর্ধমান। হিন্দু, বৌদ্ধ এবং মুসলিম শাসনকালেও এই শহর এবং জনপদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। যার ফলে এই শহরটিকেই বাংলার প্রাচীনতম শহর বলা যায় – যা আজও সগৌরবে বিদ্যমান।   

       

১০) বোলপুর-শান্তিনিকেতনঃ - বর্ধমান–রামপুরহাট রেলপথে বোলপুর স্টেশন। প্রথমেই এই বোলপুর নামের ইতিহাসটা জেনে নেওয়া যাক। মার্কণ্ডেয়পুরাণ অনুযায়ী রাজা সুরথ ছিলেন এই অঞ্চলের রাজা, এবং তাঁর রাজধানী ছিল বোলপুর সংলগ্ন সুপুর এলাকা। এই রাজা সুরথের নাম মহালয়ার ভোরে শ্রীশ্রীচণ্ডীপাঠের সময় আমরা শুনেছি এবং তিনিই মর্তে মহিষাসুরমর্দিনী দূর্গাপূজার প্রচলন করেন। সন্ধিপূজার সময় তিনি নাকি লক্ষাধিক ছাগবলি দিতেন এবং সেই রক্ত প্রবাহ আটকাতে বাঁধ দেওয়া হত প্রতিবছর। এই বলি থেকেই ওই অঞ্চলের নাম হয়েছিল বলিপুর, যা লোকমুখে হয়ে ওঠে বোলপুর এবং সেই বাঁধের নামেই আজকের বাঁধগোড়া এলাকা।

প্রাচীন কাহিনী যাই হোক, আধুনিক বোলপুরের সঙ্গে সর্বতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর স্বপ্ন ও অজস্র স্মৃতি।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ একবার পশ্চিম-ভ্রমণ থেকে ফেরার পথে আমদপুর স্টেশনে নেমে পাল্কি চড়ে বোলপুর হয়ে রায়পুর যাচ্ছিলেন। তাঁর ভক্ত-শিষ্য শ্রীকণ্ঠ সিংহরায় ছিলেন রায়পুরের জমিদার। যাওয়ার পথে তাঁর চোখে পড়ে প্রায় জনবিরল অনন্ত-বিস্তৃত এই নিঃস্ব প্রান্তরটি – যার এক প্রান্তে সম্বল ছিল দুটি মাত্র ছাতিমগাছ। জায়গাটি তাঁর ভালো লেগে যায় এবং ধ্যানী ও প্রকৃতিরসিক মহর্ষি স্থির করেন – এইখানেই আসন পেতে তিনি মগ্ন থাকবেন তাঁর পরমপিতার ধ্যানে – এই বিবাগী প্রান্তরই হবে তাঁর শান্তিনিকেতন। রায়পুরের জমিদারের থেকে প্রায় ২০ একর জমি লিজ নিয়ে তিনি ১৮৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শান্তিনিকেতন আশ্রম।

সেই আশ্রমটিই তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের হাতে পড়ে হয়ে উঠল বিশ্ব-মনীষার মিলনক্ষেত্র। আশ্রম ভিত্তিক বিদ্যালয় দিয়ে শুরু করে, আমৃত্যু কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তুললেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর আমন্ত্রণে বিশ্বের কত দেশ থেকে সম্মিলিত হয়েছিলেন কত যে মনীষী। শুধু বিদ্যাচর্চাই নয় – ছবি আঁকা, ভাস্কর্য, নৃত্য, গীত, অভিনয় – এককথায় ললিতকলার সর্ববিষয়েই সে সময় ভারতবর্ষে শান্তিনিকেতনই ছিল পথিকৃৎ।    

সেই স্মৃতি বাঙালী হিসেবে আমাদের যেমন গর্বিত করে, তেমনই তাকে ঘিরে আধুনিক বিদ্বজ্জনদের নানান কলহ চরম লজ্জা দেয়।

 

) মুর্শিদাবাদঃ শেয়ালদা-লালগোলা রেলপথে এ স্টেশনের অবস্থান। ১৭০৩ থেকে ১৭৭১ পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ ছিল সুবে বংলার রাজধানী। মুঘল আমলে সুবে বাংলা বলতে আধুনিক পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, বিহার ও ঊড়িষ্যা অঞ্চল বোঝাতো। শোনা যায় মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যান্য যে কোন অঞ্চলের তুলনায় এই সুবে বাংলা থেকেই নাকি সর্বাধিক রাজস্ব আদায় হত। সেই কারণেই, মুঘল বাদশা আওরঙ্গজেব, ১৭০৩ সালে ঢাকার দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁদক্ষতায় আস্থা রেখে, তাঁকে বাংলার দেওয়ান হিসাবে নিযুক্ত করেন। বাংলার দেওয়ান হয়ে মুর্শিদকুলি খাঁ ঢাকা থেকে ভাগীরথীর তীরের ছোট শহর মকসুদাবাদে তাঁর দপ্তর সরিয়ে আনেন এবং ১৭০৪ সালে বাদশা আওরঙ্গজেবের অনুমতি নিয়ে নিজের নামে এই শহরের নাম রাখেন মুর্শিদাবাদ। মুঘল বাদশাদের দেওয়ান হলেও প্রকৃতপক্ষে মুর্শিদাকুলি খাঁ হয়ে উঠলেন বাংলার নবাব – কারণ বাংলার শাসন ব্যবস্থায় দিল্লি তেমন নাক গলাত না, সময় মতো নির্দিষ্ট রাজস্ব পেয়ে গেলেই দিল্লি খুশি থাকত।

১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দিল্লির মসনদ ঘিরে মুঘল পরিবারে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হল, স্বাধীন নবাব হয়ে উঠতে মুর্শিদকুলির কোন বাধাই রইল না। প্রশাসক হিসাবে অত্যন্ত দক্ষ মুর্শিদকুলি, এবার নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে তুললেন মুর্শিদাবাদ শহর এবং রাজ্য প্রশাসন। তখনকার ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায় – ভাগীরথীর তীরে রম্য প্রাসাদ ও বাগিচা ঘেরা মুর্শিদাবাদ ছিল উজ্জ্বল এক শহর – যেখানে সব সম্প্রদায়ের মানুষই আনন্দে, সুখে, শান্তিতে বাস করত।

১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর মুর্শিদাবাদের মসনদে বসলেন, তাঁর জামাই সুজাউদ্দিন। তাঁর আমলে শহরে আরও অনেক প্রাসাদ নির্মিত হয় এবং বেড়ে ওঠে শহরের জাঁকজমক। এরপর ১৭৩৯ সালে সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর মসনদে বসলেন তাঁর পুত্র সরফরাজ। কিন্তু মাত্র একবছরের মধ্যে তাঁর পিতার অমাত্য ও পারিষদদের ষড়যন্ত্রে, তাঁর পিতার অধীনস্থ বিহারের দিওয়ান আলিবর্দী মুর্শিদাবাদ দখল করতে এলে, ১৭৪০ সালে গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ পরাজিত এবং নিহত হলেন। আলিবর্দী হলেন মুর্শিদাবাদের নতুন নবাব।

আলিবর্দী খাঁ অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর আমলেই - ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ - মারাঠা বর্গীদের আক্রমণে দক্ষিণবঙ্গ প্রত্যেকবছর বিধ্বস্ত হতে থাকে এবং তাঁকেও ব্যতিবস্ত থাকতে হত। অবশেষে আলিবর্দির সঙ্গে মারাঠাদের বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা দেওয়ার এক চুক্তির ভিত্তিতে ১৭৫১ সালের পর বর্গী আক্রমণ থেকে বাংলা পরিত্রাণ পায়।

১৭৫৬ সালে আলিবর্দীর মৃত্যুর পর, তাঁর মসনদে বসলেন তাঁর দৌহিত্র, মাত্র ২৩ বছর বয়সী সিরাজদ্দৌলা। প্রথম থেকেই তাঁকে ঘিরে প্রাসাদের ভিতরে এবং প্রশাসনিক মহলে ঘোরতর ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে থাকে। সেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েই ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে তিনি ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত হন এবং পরে নিহত হন।

সিরাজের পতনের পর ব্রিটিশ গভর্নর ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ শহর এবং তার ঐশ্বর্য দেখে বিস্মিত হয়ে লিখেছিলেন,মুর্শিদাবাদ লণ্ডন শহরের মতোই বিশাল, জনবহুল এবং ধনী শহর, কিন্তু দুটোর মধ্যে তফাত একটাই, এই শহরের অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রত্যেক ব্যক্তি, যে বিপুল পরিমাণ সম্পদের অধিকারী, কোন লণ্ডনবাসীর পক্ষেই তা কল্পনা করা সম্ভব হবে না”।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের ছোট্ট অংশ বাংলার এই ঐশ্বর্য ভাণ্ডার লুঠ করে ব্রিটিশদের অর্থলিপ্সা বেড়ে গেল বহুগুণ। সম্পূর্ণ ভারত লুঠের জন্য তারা প্রস্তুতি শুরু করল এবং ১৭৭ সালে মুর্শিদাবাদ থেকে তারা বাংলার  রাজধানী সরিয়ে আনল কলকাতায়, পরে কলকাতাই হয়ে ওঠে ভারতের রাজধানী।

মুর্শিদাবাদ পড়ে রইল অবহেলায় এবং কালের নিয়মে ধ্বংস হয়ে গেল স্বাধীন বাংলার শেষ গৌরবময় ইতিহাস।       

 

) রাজাভাত খাওয়াঃ – নিউজলপাইগুড়ি – আলিপুরদুয়ার রেলপথে এই স্টেশনটির নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসাধারণ এক মৈত্রীর লোককথা। কোচবিহারের কোচ রাজাদের সঙ্গে ভূটানের ভোট রাজাদের ছিল তীব্র রেষারেষি, উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকত এবং উভয়েই হার মেনে মিত্রতা স্থাপনের পক্ষপাতী ছিলেন না। এইরকম পরিস্থিতিতে ১৮০০ সালের কোন এক সময় কোচ রাজা প্রতিজ্ঞা করলেন, ভোট রাজাকে পরাস্ত না করে তিনি ভাত খাবেন না।  এই প্রতিজ্ঞার কথা কানে আসতে ভূটানের রাজা বিচলিত হলেন এবং সপারিষদ দেখা করতে গেলেন কোচ রাজার সঙ্গে। দুই পক্ষের সাক্ষাৎ হয়েছিল এই গ্রামেই – কিন্তু সেবার আর যুদ্ধ নয় দুই রাজা মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একত্রে আহার করেছিলেন, বলা বাহুল্য ভাতই ছিল উভয় রাজার প্রধান খাদ্য। সেই থেকেই নাকি এই গ্রামের নাম রাজাভাত খাওয়া।

  --০০--

 প্রবন্ধটি একপর্ণিকা প্রকাশণী থেকে প্রকাশিত "বাংলার স্টেশন কথা"-র একটি অধ্যায়। বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন এই ঠিকানায় - 

                                                 বাংলার স্টেশন কথা

                                    সম্পা: পথিক রাহা ও রাজীবকুমার সাহা

                        একপর্ণিকা প্রকাশনী, ৪০০\- (১৫% ছাড় ও ফ্রি শিপিং)

                            WhatsApp Easy Order  +91 9366 531 526

                        কলেজ স্ট্রিটে জয়ঢাক প্রকাশন ১৮, সূর্য সেন স্ট্রিট দ্বিতল


 

রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫

বাংলার রেল

 

১. রেলযাত্রার সূচনা

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ জয়ের পর ধীরে ধীরে গোটা দেশটাই গ্রাস করে নিয়ে, আমাদের শাসন করতে লাগল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি নামে ইংল্যাণ্ডের একটি বাণিজ্যিক সংস্থা। সেই শাসনব্যবস্থার কাঠামোটি কেমন ছিল, সেটা সংক্ষেপে এখানে বলে নিলে, পরের আলোচনাগুলি বুঝতে অসুবিধে হবে না।

সবার ওপরে ছিল - ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে নিযুক্ত একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী।

সেই ক্যাবিনেট মন্ত্রীর অধীনে ছিল একটি বিশেষ বোর্ড। তাদের দায়িত্ব ছিল ভারতীয় বিষয়ের নীতি নির্ধারণ।

এই বোর্ডের অধীনে ছিল কোম্পানির কোর্ট অফ ডিরেক্টরস। এই ডিরেক্টররা সকলেই লণ্ডনে থাকত।

এই কোর্ট অফ ডিরেক্টারসদের অধীনে থাকত একজন গর্ভনর জেনারেল। যার কাজ ছিল কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে (পরে রাজভবনে) বসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সামলে কোম্পানির স্বার্থ বজায় রাখা। অর্থাৎ সে সময় আমাদের সামনে, আমাদের দেশের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা ছিল ওই গভর্নর জেনারেল।         

 

  পলাশীর যুদ্ধের সাতাশি বছর পর ভারতীয় রেলপথ নির্মাণের প্রথম প্রস্তাব এসেছিল ১৮৪৪ সালে। সেই প্রস্তাবটি এনেছিলেন রোলাণ্ড ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেনসন নামে এক ব্রিটিশ ভদ্রলোকের কোম্পানি। এই স্টিফেনসন সায়েব ছিলেন প্রথম সফল বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কর্তা জর্জ স্টিফেনসনের ভাইপো। এই স্টিফেনসন সায়েবই পরবর্তী সময়ে ইস্টার্ন রেলওয়ে কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়েছিলেন।

এই প্রস্তাবের সমর্থনে ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ (১৮৪৪-১৮৪৮) বলেছিলেন “শুধুমাত্র সৈন্য এবং রণসম্ভার পরিবহনের জন্যেই কলকাতা থেকে দিল্লি রেলপথ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি”। তাঁর এই প্রস্তাবের উত্তরে কোর্ট অফ ডিরেক্টারসরা, লণ্ডনে বসে উত্তর দিয়েছিল, প্রথমেই কলকাতা-দিল্লির মতো দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ না করে সীমিত দৈর্ঘ্যের ছোটছোট প্রকল্প দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। তার সমর্থনে বলেছিল,    

ভারতের বিচিত্র আবহাওয়া এবং অদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য কলকাতা-দিল্লির মতো দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ বেশ ভজকট ব্যাপার হয়ে উঠবে, কারণ -   

১. ঘন ঘন বৃষ্টি ও বন্যা।

২. নিয়মিত ঝড়ো হাওয়া এবং কড়া রৌদ্রের প্রভাব।

৩. নানা ধরনের পোকা (যেমন উইপোকা, ঘূণ) এবং অপকারী প্রাণীর (যেমন ইঁদুর) থেকে কাঠ ও মাটির ভয়ানক ক্ষতির সম্ভাবনা।

৪. কাঠ বা ইঁটের গাঁথনির নিচে ক্ষতিকারক গাছগাছড়া দ্রুত গজিয়ে ওঠা।

৫. দেশের অসংরক্ষিত এবং সুরক্ষাহীন অঞ্চল দিয়ে রেলপথ নির্মাণ করতে হবে।

৬. দক্ষ এবং বিশ্বস্ত ইঞ্জিনিয়ার যোগাড় করতে এবং তাদের ব্যয় বহন করাও কঠিন হবে।

তৎকালীন বিশ্বে সবথেকে উন্নত এবং সুসভ্য লণ্ডনবাসী কোর্ট অফ ডিরেক্টারসরা এদেশের প্রখর রৌদ্র, ইঁদুর ও পোকামাকড়ের উপদ্রব এবং আগাছা গজিয়ে ওঠাকে ভয় পেয়েছিলেন!

তবে কোম্পানির কোর্ট অফ ডিরেক্টারসরা প্রস্তাবিত এই রেলপথের আর্থিক উপযোগিতা বিষয়ে বেশ সুচিন্তিত ও দূরদর্শী মতামত দিয়েছিলেন সন্দেহ নেই – “এখনও পর্যন্ত এদেশের (গ্রেট ব্রিটেন) অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, যাত্রী বহন থেকেই আমাদের অধিকাংশ আয় হয়, পণ্য পরিবহনের আয় যৎসামান্য। ভারতের পরিস্থিতি ইংল্যাণ্ডের ঠিক বিপরীত। এখানকার শহরের জনবহুল ধনী মানুষদের তুলনায় ভারতীয়রা গরিব। এবং ভারতীয় জনগণ বাসকরে বিশাল এক দেশের বিচ্ছিন্ন নানান অঞ্চলে। কিন্তু অন্যদিকে ভারত মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের অফুরন্ত ভাণ্ডার। সস্তা কিন্ত দ্রুত পরিবহনের অভাবে সেই সম্পদ বিশ্ব-বাজার থেকে প্রচুর মুনাফা অর্জন করতে পারছে না। অতএব, এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ভারতীয় রেলপথ বাণিজ্যিক পণ্যপরিবহন করে বিপুল অর্থ উপার্জন করতে পারবে, কিন্তু যাত্রী পরিবহনে সে আয় হবে নগণ্য”।

ভারতের স্বাধীনতা লাভের সাতাত্তর বছর পরেও এই পরিস্থিতির এতটুকু পরিবর্তন হয়নি।

 

যাই হোক ১৮৪৪ সালে হাওড়া থেকে দিল্লি রেলপথ বানানোর প্রথম প্রস্তাব উঠলেও, ভারতে প্রথম ট্রেন চালু হয়েছিল, ১৮৫৩ সালে বোম্বাই (মুম্বাই) থেকে থানা। ১৮৫৩ সালে হাওড়া থেকে পাণ্ডুয়া রেললাইন পাতা হয়ে গেলেও, ওই পথে ট্রেন চালু হয়েছিল ১৮৫৪ সালে। এই বিলম্বের প্রধান তিনটি কারণ ,   

১) এই লাইনে চলার উপযুক্ত কিছু কামরা নমুনা হিসেবে বিলেত থেকে বানিয়ে পাঠানো হয়েছিল “গুডউইল” নামের একটি জাহাজে। তীরে এসে তরী ডোবার মতো, গঙ্গাসাগরের কাছে এসে সে জাহাজ গেল ডুবে। এই দুর্ঘটনার পরে ইস্টার্ন রেলের ইঞ্জিনিয়ার মিঃ হজসন, নিজের নকশামতো কলকাতাতেই রেলের কামরা নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই নির্মাণে অনেকটাই সময় লেগেছিল।

২) কলকাতার জন্যে বিলেত থেকে যে ইঞ্জিন পাঠানো হয়েছিল, সেই জাহাজ ভুল করে চলে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। সেখান থেকে অন্য আরেকটি জাহাজে চাপিয়ে সেই ইঞ্জিন ফিরিয়ে আনা হয়েছিল কলকাতায়। অতএব ইঞ্জিন আনতেও অকারণেই অনেকটা বিলম্ব হয়েছিল।

এই ইঞ্জিনটি হাওড়ার রেলযাত্রার শুরু থেকে নিয়মিত ব্যবহার করা হয়েছিল। এবং দীর্ঘদিন এটি হাওড়া রানিগঞ্জের ১২১ মাইল দূরত্ব নিয়মিত  যাওয়া-আসা করত।  ১৮৯৫ সালে এই ইঞ্জিনটির নাম দেওয়া হয়েছিল “ফেয়ারি কুইন”।  ১৯০৯ সালে এই ইঞ্জিনটিকে অবসর দেওয়া হয়। সেই ইঞ্জিনটি দিল্লির রেলওয়ে মিউজিয়ামে আজও সযত্নে রাখা আছে। কখনো কখনো টুরিস্টদের জন্যে এই ইঞ্জিনটিকে আজও চালু করা হয়। অর্থাৎ ফেয়ারি কুইন আজও স্টিম ছাড়ে, ধোঁয়া ছাড়ে এবং সিটি বাজায় এবং টুরিস্ট ট্রেন হিসেবে মাঝে মাঝে যাতায়াত করে দিল্লি থেকে আলওয়ার পর্যন্ত।  দুটি কামরার ছোট্ট ট্রেন - যাত্রী সংখ্যা ৫০ জন। ফেয়ারি কুইন বিশ্বের প্রাচীনতম একমাত্র সচল রেল ইঞ্জিন ও গাড়ি - তার নাম উঠেছে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে।  


 তখনকার ও এখনকার ফেয়ারি কুইন ইঞ্জিন 


৩) তৃতীয় কারণটি হল দুই সাম্রাজ্যের সীমানা-সংক্রান্ত বিবাদ। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত চন্দননগর ছিল ফরাসী সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। হাওড়া থেকে পাণ্ডুয়া গামী রেলপথ গিয়েছে চন্দননগরের পাশ দিয়ে। সেই সময় সে জায়গাটি ব্রিটিশ না ফরাসী সাম্রাজ্যের অধীন – সেই বিতর্ক সাব্যস্ত হতেও দীর্ঘদিন গড়িয়েছিল।

শেষমেষ অনেক বাধা বিপত্তি কাটিয়ে, ১৮৫৪ সালের ১৫ই আগষ্ট মঙ্গলবার, কলকাতা থেকে হুগলি পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে রেলের প্রথম যাত্রা শুরু হল। এই উপলক্ষে ইস্ট ইণ্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি থেকে যে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল, সেটির অনুবাদ এখানে দিলাম,

 

ইস্ট ইণ্ডিয়ান রেলওয়ে

এমাসের ১৫ তারিখ মঙ্গলবার থেকে ট্রেন হাওড়া ও হুগলি ছাড়বে নিম্নলিখিত সময়ে –

হাওড়া থেকে সকাল ১০-৩০ মিঃ, বিকাল ৫-৩০ মিঃ

হুগলি থেকে       ৮-১০ মিঃ,        ৩-৩৮ মিঃ

ট্রেন থামবে বালী, শ্রীরামপুর ও চন্দননগর স্টেশনে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে ট্রেন হাওড়া ও পাণ্ডুয়ার মধ্যে চলবে আর সব স্টেশনেই দাঁড়াবে।

যাঁরা কম ভাড়ায় মাসিক টিকিট চান, তাঁদের অনুরোধ করা হচ্ছে, তাঁরা যেন যে কোনো স্টেশনে ফর্মের জন্যে দরখাস্ত করেন ও ফর্মগুলি ভর্তি করে যত শীঘ্র ম্যানেজিং ডিরেক্টার ও এজেন্টের কাছে পাঠিয়ে দেন। মাসিক টিকিটের ভাড়া পরে ঠিক করা হবে। পরবর্তী ১ জানুয়ারির আগে মাসিক টিকিট দেওয়া হবে না।

আর ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেনসন

১২ই আগস্ট, ১৮৫৪                                                  ২৯ থিয়েটার রোড, কলকাতা

 

ওই সময় হুগলি পর্যন্ত প্রথম শ্রেণীর ভাড়া ছিল ৩ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর ১ টাকা ২ আনা ও তৃতীয় শ্রেণীর ৭ আনা। তখনকার হিসেবে স্টেশনগুলির দূরত্ব এবং সফর-কাল কিরকম ছিল, সেটাও একবার দেখে নেওয়া যাক-

হাওড়া থেকে বালী – ৫.৫ মাইল – ১১ মিনিট, বালী থেকে শ্রীরামপুর ৬.৫ মাইল – ১৪ মিনিট, শ্রীরামপুর থেকে চন্দননগর – ৮.৫ মাইল – ২০ মিনিট। চন্দননগর থেকে চুঁচুড়া – ৩ মাইল – ৮ মিনিট। সেই সময় চুঁচুড়া আর হুগলিকে একই স্টেশন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। অতএব হাওড়া থেকে চুঁচুড়া পর্যন্ত ২৩.৫ মাইল পথে ট্রেনের চলতি সময় লাগত ৫৩ মিনিট। অর্থাৎ গাড়ির গতি ছিল গড়ে ২৬.৬০ মাইল প্রতি ঘন্টায়। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে গাড়ি স্টেশনে দাঁড়ানোর সময় – মোট ৩৮ মিনিট। তাহলে হাওড়া থেকে চুঁচুড়া পৌঁছতে মোট সময় লেগেছিল ৯১ মিনিট – দেড় ঘন্টাঅর্থাৎ চুঁচুড়া থেকে সকাল ৮-১০ এ ছেড়ে ফেয়ারি কুইন হাওড়া পৌঁছত সকাল ৯-৪০ নাগাদ। সেটি সকাল ১০-৩০টায় হাওড়া ছেড়ে চুঁচুড়া পৌঁছত দুপুর বারোটায়। সেটি আবার চুঁচুড়া ছাড়ত বিকেল ৩-৩৮এ এবং হাওড়া পৌঁছত বিকেল ৫-১০ নাগাদ। তারপর হাওড়া থেকে বিকেল ৫-৩০টায় ছেড়ে সারারাত চুঁচুড়াতেই থেকে যেত।   

এভাবেই আমাদের স্বাধীনতা দিবসের ঠিক ৯৩ বছর আগে, একই দিনে বাংলায় রেলগাড়ির যাত্রা শুরু হয়েছিল।

 

 

২. রেলপথের জাল বিছানো            

১৮৫৪ সালের ১৫ই আগস্ট রেলযাত্রার উদ্বোধনের মাত্র তিন বছরের মধ্যে – ১০ই মে ১৮৫৭ - শুরু হয়েছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াই। উত্তর এবং মধ্যভারতের আচমকা এই সর্বাত্মক লড়াইয়ে বৃটিশ কোম্পানি যেমন হতভম্ব হয়ে পড়েছিল, তেমনই তাদের ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছিল বিস্তর। অবশ্য দেড় বছরের মধ্যে, পয়লা নভেম্বর ১৮৫৮ সালে সর্বশক্তি দিয়ে এই লড়াইকে তারা দমন করতে সক্ষম হয়েছিল।

এই লড়াইয়ের শেষে ভারত থেকে কোম্পানি-রাজ মুছে গেল, শুরু হল ব্রিটিশ রাজ। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে নতুন আইন পাস হল – গভর্নমেন্ট অফ ইণ্ডিয়া অ্যাক্ট ১৮৫৮। সেই আইনে তারা সরাসরি ভারতের শাসনভার তুলে নিল নিজেদের হাতে। ইংল্যাণ্ডের তখনকার রানি ভিক্টোরিয়া বিবৃতি দিলেন, “তাঁর ভারতীয় প্রজারাও, একজন বৃটিশ নাগরিকের সমান মর্যাদার অধিকারী”। অবশ্য এই বিবৃতির সঙ্গে বৃটিশ সংবিধানের কোনই সাযুজ্য ছিল না এবং ১৯৪৭ পর্যন্ত বৃটিশ-রাজত্বে রানির বিবৃতিটিকে মিথ্যা প্রলাপ হিসাবেই গণ্য করা উচিৎ

১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম লণ্ডনের বৃটিশ শাসকদের মোক্ষম একটা শিক্ষা দিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, নিবিড় যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাঁধতে না পারলে, ব্যাপ্ত এই দেশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা দুরূহ হয়ে উঠবে। অতএব তারা পূর্ণ উদ্যমে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা নির্মাণে লেগে পড়ল। এই রেলপথ প্রসারে বড়ো বাধা হয়ে উঠেছিল, ভারতের এবং বাংলার বড়ো বড়ো নদীগুলি। অতএব রেল যোগাযোগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে নদী-সেতু বানানোর ধুম পড়ে গেল। বাংলার রেলপথের সঙ্গে যেহেতু পূর্বভারতের প্রত্যক্ষ সংযোগ অতএব কয়েকটি প্রধান সেতুর কথা এখানে উল্লেখ করছি-

১) বিহারের আরার কাছে শোন নদীর সেতু – ১৮৬৩ সালে চালু হয়েছিল।

২) এলাহাবাদের কাছে যমুনার সেতু – ১৮৬৫ সালে।

৩) দিল্লিতে যমুনার সেতু – ১৮৬৬ সালে।

৪) গঙ্গার ওপর জুবিলি সেতু – ১৮৭৭ সালে – এটি ব্যাণ্ডেল ও নৈহাটি স্টেশনকে যুক্ত করেছে। এই সেতুর নাম জুবিলি, কারণ রানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এই ব্রিজটিকে চালু করা হয়েছিল।

৫) অবশ্য বালী ব্রিজ বা উইলিংডন সেতু তৈরি হয়েছিল অনেক পরে – ১৯৩১ সালে।

 রেলপথ নির্মাণের এই ব্যাপক কর্মকাণ্ডের প্রসঙ্গে রেললাইনের মাপ নিয়ে দু চার কথা বলা প্রয়োজন। ব্রিটিশদের নিয়ম অনুযায়ী রেলট্র্যাকে সমান্তরাল দুটি রেললাইন বিছানো হতো তিনটি মাপে – এই তিনটি মাপকে গেজ (Gauge) বলা হয় – ব্রড গেজ, মিটার গেজ এবং ন্যারো গেজ।

ব্রডগেজ – এই মাপে দুটি রেললাইনের মধ্যে দূরত্ব হয় ১.৬৭৬ মি। ব্রডগেজের লাইনগুলিতে দ্রুতগতিতে ট্রেন চালানো অনেক সুবিধেজনক এবং নিরাপদ হয়। তাছাড়া কামরার আকার অনেকটাই বড়ো হওয়ার কারণে অনেকবেশি যাত্রী ও পণ্য বহন করতে পারে।

মিটারগেজ – এই মাপে দুটি রেললাইনের মধ্যে দূরত্ব হয় ১.০০ মি। লাইন ছোট হওয়াতে, খুব স্বাভাবিক কারণেই রেলপথ নির্মাণের এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচও অনেকটাই কম হয়। সেই কারণে এই লাইনগুলি কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় – কিংবা পাহাড়ি জায়গায়, যেখানে ঢালু পথে চলাচল করতে হয়, সেখানেই ব্যবহার করা হত। এই লাইনে ট্রেনের গতি ব্রডগেজের তুলনায় অনেকটাই কম রাখতে হ

ন্যারোগেজ – এই মাপে দুটি রেললাইনের মধ্যে দূরত্ব হয় মাত্র ০.৭৬২ মি। এই ট্রেনগুলি সাধারণতঃ প্রত্যন্ত ও প্রান্তিক অঞ্চলে খোলা হত। অবশ্য দার্জিলিং ও সিমলার চড়াই-উতরাইয়ের যাত্রা পথে এই লাইন ব্যবহার করা হয়েছিল।

সে সময় ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকরা প্রধান রেলপথগুলি ব্রডগেজ, শাখা লাইনগুলি মিটারগেজ এবং প্রশাখা লাইনগুলি ন্যারোগেজ লাইন বানানোর পরিকল্পনা করেছিলেন এবং সেভাবেই রেললাইন পাতা চালু করেছিলেন।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের বিদায়ের সময় ভারতে মোট রেলপথ ছিল ৫৪,৫৬৮ কিমি। তার মধ্যে ব্রডগেজ ছিল প্রায় ৪৬.১৪% এবং মিটারগেজ ছিল প্রায় ৪৪.২৮% - প্রায় সমান-সমান। আর ন্যারোগেজ ছিল ৯.৫৮%।    

স্বাধীনতার পর ভারতীয় রেল এই গেজ প্রথার আমূল পরিবর্তন শুরু করে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট ৬৮,৯০৭ কিমি রেলপথের প্রায় ৯৫.৬৭% লাইন ব্রডগেজে রূপান্তরিত করা হয়ে গিয়েছে। মিটার গেজ এবং ন্যারোগেজ লাইন অবশিষ্ট আছে যথাক্রমে মাত্র ২.৪৩% ও ১.৯০%।

ব্রিটিশ ভারতে রেলপথ বিছানোর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পণ্য ও প্রয়োজনে সৈন্য পরিবহন আর গৌণ উদ্দেশ্য ছিল যাত্রী পরিবহন। এই যাত্রী পরিবহনের আবার দুটি ভাগ ছিল – প্যাসেঞ্জার ট্রেন এবং মেল বা এক্সপ্রেস ট্রেন। প্যাসেঞ্জার ট্রেনগুলি স্বাভাবিক ভাবেই প্রতি স্টেশনে দাঁড়াত, গতি ছিল অনেকটাই শ্লথ, গয়ংগচ্ছ ভাব। মেল বা এক্সপ্রেস ট্রেনগুলির কিন্তু তা নয় – তারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্টেশনে দাঁড়াত, এবং গতি ছিল সেই সময়কার তুলনায় যথেষ্ট বেশি। কিন্তু এই ট্রেনগুলিও আসলে ব্রিটিশ সরকারের মেল (Mail) অর্থাৎ ডাক-বহনকারী গাড়ি ছিল। তার সঙ্গে প্যাসেঞ্জার ট্রেনের থেকে তুলনায় বেশী ভাড়াযাত্রী নেওয়া হত ট্রেন চালানোর খরচ তোলার জন্যে। রাজধানী শহর কলকাতা (পরবর্তীকালে দিল্লি) থেকে বার্তা নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন শহরে চিঠিপত্র-নির্দেশ-রিপোর্ট-অভাব-অভিযোগের সংবাদ আদানপ্রদান, এবং দেশের নানান প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা অর্থ-মণি-রত্ন, সোনার অলঙ্কার রাজধানীর রাজকোষে বহন করাই ছিল এই মেলট্রেনগুলির মুখ্য উদ্দেশ্য।                 

হাওড়া-হুগলি রেললাইনে যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৫/০৮/১৮৫৪ – সে কথা আগেই বলেছি। এরপর ১৮৬৬ সালে প্রথম হাওড়া-দিল্লি মেলট্রেন চালু হয়েছিল – তার নাম ছিল ১ আপ/২ ডাউন মেল ট্রেন। পরে এই ট্রেনটিকেই কালকা মেল নাম দিয়ে হাওড়া থেকে কালকা পর্যন্ত চালানো হত।

হাওড়া থেকে প্রথম রেলযাত্রার ১৭বছর পর আজ ২০২সালে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের রেলপথের বিস্তার গোটা বিশ্বে এখন চতুর্থ স্থানে। অক্টোবর ২০২৩ সালের হিসেব অনুযায়ী ভারতীয় রেলপথের মোট দৈর্ঘ ৬৮,৯০৭ কিমি.। তারমধ্যে ৬০,৮১৩ কিমি বৈদ্যুতিকরণ সম্পন্ন হয়ে গেছে। অর্থাৎ “কু-ঝিক-ঝিক” করে চলা স্টিফেনসনের স্টিম-ইঞ্জিন উঠে গিয়ে,  আমাদের অধিকাংশ ট্রেন এখন চলে বিদ্যুতে এবং কিছু চলে ডিজেল ইঞ্জিনে। তার সঙ্গে বেড়েছে ট্রেনের গতি, সুখস্বাচ্ছন্দ্য, এবং ট্রেনের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ।

  ওপরের ম্যাপ থেকে পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক রেললাইনের পরিস্থিতি সম্যক বোঝা যাবে।      

৩. দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ

রেলযাত্রা নিয়ে অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে দক্ষিণবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার চিরন্তন সমস্যার কথা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। দীর্ঘ সেই সমস্যা এবং তার সাবলীল সমাধানের কথাই এখন বলব।

শিয়ালদহ স্টেশন থেকে জলপাইগুড়ি/শিলিগুড়ি পর্যন্ত সরাসরি রেলযোগাযোগ শুরু হয়েছিল পদ্মার উপর ১৯১৫ সালে হার্ডিঞ্জ সেতু নির্মাণের পর। সেতুটির অবস্থান আধুনিক বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার ভেরামারা থেকে পাবনার ঈশ্বরদি অঞ্চলে। শেয়ালদা থেকে রাণাঘাট হয়ে কুষ্টিয়ার ট্রেন চালু হয়েছিল ১৯০২ সালে।

তার আগে শিয়ালদা থেকে লালাগোলা (১৯০৭ সালে এই ব্রডগেজ লাইন চালু হয়েছিল) যেতে হত। তারপর গঙ্গার পশ্চিমপাড়ের লালগোলাঘাট থেকে স্টিমারে পদ্মাপার হয়ে নামতে হত পূর্বপারের গোদাগারিঘাটে (এখন বাংলাদেশে)। তারপর ওপাড়ের মিটার গেজ লাইনের ট্রেন ধরে মালদা জংশন হয়ে জলপাইগুড়ি এবং শিলিগুড়ি যেতে হত। অতএব সপরিবারে মালপত্র-লটবহর নিয়ে পায়ে হেঁটে নদীর চর ভেঙে স্টিমারে চাপা এবং ওপাড়ে গিয়ে একই ভাবে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ট্রেন অব্দি পৌঁছানো – ভয়ংকর কষ্টসাধ্য ছিল। বিশেষতঃ অসুস্থ এবং বয়স্কদের পক্ষে ছিল মারাত্মক। এর সঙ্গে ঋতু অনুযায়ী গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতের কষ্ট থাকত উপরি পাওনা।    

হার্ডিঞ্জ সেতু নির্মাণের পর এই অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এই পথের অজস্র যাত্রী। কিন্তু এই সৌভাগ্য বেশি দিন সইল না। ১৯৪৭ সালে ভারতভাগের পর হার্ডিঞ্জ সেতু রয়ে গেল পূর্বপাকিস্তানে। অতএব উত্তরবঙ্গ যাত্রা আবার দুরূহ হয়ে উঠল গঙ্গা-পার হওয়ার একইরকম যন্ত্রণায়।

মালদার আগে গঙ্গা পার হওয়ার দুটি পথ ছিল। একটি বিহারের সকরিগালঘাট থেকে স্টিমারে মনিহারিঘাট গিয়ে, সেখান থেকে কাটিহারের ট্রেন ধরা। এবং দ্বিতীয়টি হল – ধূলিয়ানে গঙ্গা পার হয়ে ওপাড়ের খেজুরিয়াঘাট থেকে মালদা যাওয়া। দ্বিতীয় পথটি সংক্ষিপ্ত, কিন্তু গঙ্গার ক্রমাগত ভাঙনে কিছুদিনের মধ্যেই ধুলিয়ানঘাট ব্যবহারযোগ্য রইল না। অতএব সেই পথ পরিত্যাগ করে অনেকটাই ঘুরপথ – সকরিগলিঘাট-মনিহারিঘাট হয়ে উঠল উত্তরবঙ্গ যাওয়ার একমাত্র পথ।

১৯৫৯ সালে বিহারে গঙ্গার দক্ষিণে মোকামা জংশন এবং গঙ্গার উত্তরে বারৌনি জংশনকে জুড়ে রাজেন্দ্রসেতু নির্মাণ হওয়াতে স্টিমার বা লঞ্চে গঙ্গা পার হওয়ার ঝামেলা মিটল। কিন্তু কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার দূরত্ব এবং সময় বেড়ে গেল অনেকটাই।

অতএব বিকল্প রাস্তা খোঁজা শুরু হল। ধূলিয়ানঘাটের অদূরে ফরাক্কা নামের একটি গ্রাম পাওয়া গেল, যেখান থেকে সহজে গঙ্গা পার হয়ে খেজুরিয়াঘাট যাওয়া সম্ভব। অতএব ভারতীয় রেল ফরাক্কা অব্দি নতুন রেললাইন পাতার কাজ শুরু করল, এবং খেজুরিয়াঘাট থেকে জলপাইগুড়ি পর্যন্ত মিটার গেজ লাইন বদলে ব্রডগেজ লাইন পেতে ফেলল ১৯৬০ সাল নাগাদ। কিন্তু এবার আর ছোট স্টিমার নয় গঙ্গা পার করার জন্যে এল বিশাল বিশাল বজরা ও স্টিমার। এগুলিকে বলা হত ওয়াগন ফেরি (Wagon ferry) এক একটি বজরায় ৯ জোড়া লাইন পাতা থাকত এবং প্রতি লাইনে দুটি করে কামরা সেট করা যেত। অর্থাৎ প্রতি বজরা একবারে ১৮টি কামরা নিয়ে নদী পার করতে পারত। এরকম ১০টি বজরা ছিল, অতএব প্রতিবারে ১৮০টি কামরা পারাপার করা সম্ভব ছিল। একদিনে সব থেকে বেশি ৪৫০টি কামরা পারাপার করার রেকর্ডও পাওয়া গেছে। এভাবেই চলছিল প্রায় ১১ বছর।

এরমধ্যেই ফরাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু হয় এবং তার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৬২ সালে। সেই সময়েই ঠিক হয় ফরাক্কা ব্যারেজের ওপরে রেলপথ এবং তার পাশাপাশি তৈরি হবে গাড়ি চলাচলের সড়ক পরিবহণ। ১৯৭১ সালের ১১ই নভেম্বর উভয় পথই চালু হয়ে গেল। দূর হল দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থার বহুদিনের সমস্যা।        

 

৪. ট্রেন ও আমাদের আবেগ

(ক) তুফান এক্সপ্রেস বা মেল – এই ট্রেনটি হাওড়া-শ্রীগঙ্গানগর রুটে চালু হয়েছিল পয়লা জুন, ১৯৩০। এই ট্রেনটি সেই সময়ে ভারতের দীর্ঘতম রেলপথ ছিল – ১২২৯ মাইল (১৯৭৮ কিমি)। এখনকার হিসেবে, মোট আটটি রাজ্যকে এই ট্রেনটি যুক্ত করেছিল - পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানা। এই ট্রেনটির গতি এবং “তুফান” নামে ভারতবাসী এতই উদ্বেল হয়েছিল, যে বম্বের সিনেমা জগতে ১৯৩৪ সালে “তুফান মেল”-নামের একটি সিনেমা রিলিজ করেছিল। এর পর ১৯৪২ সালে আরেকটি সিনেমা “রিটার্ন অফ তুফান মেল” রিলিজ করেছিল। এই সিনেমা সম্বন্ধে আজ আর তেমন কিছু জানা যায় না। কিন্তু বাংলায় “শেষ উত্তর” ও তার হিন্দি ভার্সান “জওয়াব” সিনেমায় আমাদের বাংলার কাননদেবীর কণ্ঠের “তুফান মেল” গানদুটি – আমাদের ছোটবেলাতেও আমাদের গুরুজনদের বহুবার গুনগুন করতে শুনেছি। আজও ইউটিউবে গানদুটি শুনলে তুফানমেল সম্পর্কে জনগণের সমসাময়িক মুগ্ধতার আঁচ পাওয়া যায়।

বাংলা গানের প্রথম পর্বটি এরকম - “তুফান মেল, তুফান মেল যায়। তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, ময়নামতীর হাট এড়িয়ে, কাশের বনে ঢেউ খেলিয়ে বংশীবটের ছায়, যায় যায় যায় তুফান মেল...”।  

https://www.youtube.com/watch?v=VQD6Md1BbOM

হিন্দিতে গানের প্রথম স্তবকটি এরকম - “তুফান মেল, দুনিয়া ইয়ে দুনিয়া তুফান মেল। ইসকে পাহিয়ে জোর সে চলতে, অওর আপনা রাস্তা তয় করতে, সয়ানেসে কাম নিকালে, বচ্চে সমঝে খেল। তুফান মেল…”।

https://www.youtube.com/watch?v=kNZS86YYP0g

স্বাধীনতার পরে তুফান মেলের তুলনায় বহুগুণ গতিসম্পন্ন এবং দীর্ঘতর রেলপথে বহু ট্রেন দৌড়ে চলেছে প্রত্যেকদিন – কিন্তু জনমানসে তুফান মেলের মতো এমন বিস্ময়ের আবেগ কেউ জাগাতে পারেনি।

স্বাধীনতার পর এই ট্রেনটির নাম হয়েছিল উদ্যান আভা তুফান এক্সপ্রেস ১৯শে মে ২০২০ সালে এই ট্রেনটি ভারতীয় রেল থেকে তুলে নেওয়া হয়। তুফানের গতি আজ স্তব্ধ।

 

(খ) বাল্যকাল ও রেলগাড়ি

আমাদের ছোটবেলায় মাঝেমধ্যে বর্ধমান জেলার পালসিটে মাসির বাড়ি বেড়াতে যেতাম। পালসিট স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে মাসির বাড়ির চিলেকোঠার জানালা দিয়ে মাঠের ধার দিয়ে রেলগাড়ি যাওয়া দেখতে পেতাম। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের ক্ষেত। সকালের উজ্জ্বল রোদ্দুরে ঝলমলে নীল আকাশ। তার মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। সে দৃশ্য আজও মনে পড়লে মনটা বড়ো উদাস হয়ে যায়। তবে আমাদের সময় অধিকাংশই ছিল ধোঁয়াহীন ইএমইউ লোকালট্রেন। কিছুকিছু ছিল সামান্য ধোঁয়া ওঠা ডিজেল চালিত দূরপাল্লার ট্রেন।

একটু বড়ো হয়ে জলপাইগুড়িতে প্রায় চারবছর হস্টেলে থাকতে হয়েছিল। আমাদের হস্টেলের পাশেই ছিল নিবিড়-সবুজ বিস্তীর্ণ চা-বাগান। বাগানের ও পাশ দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। রাত জেগে সেমেস্টারের পড়া করার সময় মাঝরাতে আমাদের কানে আসত ওই লাইন দিয়ে দৌড়ে চলা তিনসুকিয়া মেলের আওয়াজ। সে আওয়াজে মনটা বড়ো ঘরমুখো হয়ে উঠত। দৌড়ে গিয়ে বারান্দা থেকে দেখতাম সে ট্রেনের আলোকোজ্জ্বল জানালাগুলির দ্রুত সরে সরে যাওয়া। সে দৃশ্য, সে আওয়াজ দূরে চলে গেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে এসে আবার বই খুলে বসতাম, কিন্তু মন বসত না, মন তখনও দৌড়ে চলত ওই ট্রেনটির সঙ্গে।        

এ প্রসঙ্গে “পথের পাঁচালি” সিনেমায় কাশবনের ভিতর দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে দিদি দুর্গা এবং ভাই অপুর রেলগাড়ি দেখার দৃশ্য অবিস্মরণীয় হয়ে গিয়েছে। বাঙালীর মনে ওই দৃশ্য চিরস্থায়ী আসনে বিরাজ করবে চিরকাল।

 

(গ) রেলগাড়ি-রেলগাড়ি খেলা

আমরা কলকাতার যে সরকারি স্কুলটিতে পড়তাম, সে স্কুলের নিজস্ব কোন মাঠ ছিল না। খেলাধুলো করতে আমাদের যেতে হতো কলেজ স্ট্রিট (এখন বিধান সরণি) পার হয়ে উল্টোদিকে অন্য একটি সরকারি স্কুলে। সে স্কুলে দৌড়ে বেড়ানোর মতো বেশ প্রশস্ত একটি মাঠ ছিল।

সকাল সাড়ে আটটা – নটা নাগাদ আমাদের ক্লাসের তিরিশ জন সারিবদ্ধ বাচ্চাকে নিয়ে দিদিমণিরা রাস্তা পার করতেন। পিঁপড়ের মতো পিছুপিছু সার দিয়ে যেতে যেতে আমাদের মাথায় আসত “রেলগাড়ি-রেলগাড়ি” খেলা। সকলেই সামনের বন্ধুর দুকাঁধে হাত রেখে টুকুরটুকুর দৌড়তাম আর মুখে আওয়াজ করতাম ঝিক-ঝিক – মাঝে মাঝে ডেকে উঠতাম “কু-উ-উ-উ”।  উত্তর আর দক্ষিণ - দু’দিকে দাঁড়িয়ে যেত ট্রাম, বাস, মটর গাড়ি, রিকশ, সাইকেল। ট্রাম-বাসের ড্রাইভার-যাত্রীরা জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে আমাদের দেখতেন। তাঁদের কোনদিন বিরক্তি বা উষ্মা প্রকাশ করতে দেখিনি – বোধহয়, মজাই পেতেন, হয়তো তাঁদেরও ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যেত।

বড়ো হয়ে টিভিতে এই খেলাটি একটি গানের ভিডিওতে দেখেছিলাম। নিজের গলায় “রেলগাড়ি, ছুকছুক-ছুকছুক” গান গেয়ে, বাচ্চাদের একটি “রেলগাড়ি” খেলা পরিচালনা করেছিলেন স্বয়ং দাদামণি অশোককুমার। ১৯৬৮ সালের আশীর্বাদ সিনেমার গান – ইউটিউবে দেখে নিতে পারেন। গানটির রচয়িতা শ্রী হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় (ফেলুদার “সিধুজ্যাঠা” এবং শ্রীমতী পদ্মজা নাইডুর ভাই) - ছোটবেলাটা ফিরিয়ে এনেছিলেন এক লহমায়। 

https://www.youtube.com/watch?v=qn_v5PyhQJE

দাদামণি এই গানটির তাৎপর্যপূর্ণ একটি বড়োদের ভার্সান শুনিয়েছিলেন মুম্বাইয়ের এক অনুষ্ঠানে – সেটিও হারীনবাবুর লেখা। সে গানটিও ইউটিউবে শুনে নিতে পারেন।


(ঘ) রেলযাত্রা ও রেলযাত্রী

ব্রিটিশ-রেল যুগে, মোটামুটি ১৮৭১ সাল নাগাদ, দূর-পাল্লার ট্রেনে চারটি শ্রেণী থাকত। প্রথম শ্রেণী ছিল প্রধানত উচ্চপদস্থ শ্বেতবর্ণ মানুষদের জন্য। দু’একজন উচ্চ পদস্থ কৃষ্ণবর্ণ মানুষকেও অবশ্য অনুমতি দেওয়া হত, যেমন পেয়েছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর এই প্রথম শ্রেণীতে রেলযাত্রা নিয়ে একটি মজার গল্প শোনা যায়।

একবার মধুপুর থেকে কলকাতা ফেরার সময়, স্যার আশুতোষ রেলের প্রথম শ্রেণীতে উঠেছিলেন। তাঁর কামরায় ছিল জনৈক ইংরেজ সায়েব একই কামরায় নেটিভ মানুষটিকে তার মোটেই সহ্য হচ্ছিল না। স্যার আশুতোষ অবশ্য সায়েবকে গ্রাহ্য না করে, নিজের নির্দিষ্ট বার্থে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর ঘুম ভাঙতে তিনি কামরার মধ্যে তাঁর জুতো জোড়া খুঁজে পেলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন, এ ওই সায়েবের কীর্তি। তাঁর ঘুমের মধ্যে ব্যাটা তাঁর জুতোজোড়া বাইরে ফেলে দিয়েছে। সে সময় সায়েবও তার নিজের বার্থে ঘুমোচ্ছিল, কামরার হুকে ঝুলছিল সায়েবের কোট। স্যার আশুতোষ হুক থেকে কোটটি তুলে নিয়ে, চলন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলেন

কিছুক্ষণ পর সায়েব ঘুম ভেঙে উঠে নিজের কোট দেখতে না পেয়ে খুব রেগে গেল, জিজ্ঞাসা করল, “আমার কোট কোথায়?” স্যার আশুতোষ খুব শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাই তো, আমার জুতোজোড়াও যে খুঁজে পাচ্ছি না”। সায়েব উদ্ধতভাবে উত্তর দিল, “তোমার জুতোজোড়া গেছে বাইরে হাওয়া খেতে”। স্যার আশুতোষ আরও শান্ত ও নিশ্চিন্ত সুরে বললেন, “তাহলে তো ঠিকই আছে, সায়েব। তোমার কোট গিয়েছে, আমার জুতোজোড়া খুঁজতে”! একজন নেটিভের থেকে এমন শান্ত উত্তর শুনে, কোটের শোক ভুলে, সায়েব নাকি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।

 দ্বিতীয় শ্রেণী ছিল মধ্যবিত্ত শ্বেতবর্ণ এবং উচ্চবিত্ত কৃষ্ণবর্ণ মানুষদের জন্যে। তবে এই শ্রেণীতেও সায়েব- নেটিভের দ্বন্দ্বের কথা বাংলা সাহিত্যে বিরল নয়।

তৃতীয় শ্রেণী ছিল মধ্যবিত্ত নেটিভদের জন্যে। কামরায় কাঠের বেঞ্চ সেট করা থাকত। প্রথম দিকে কামরাতে কোন টয়লেট থাকত না। দীর্ঘ অনুরোধ, আন্দোলন, কর্তৃপক্ষের কাছে লেখালেখির পর ১৮৯১ সাল থেকে কামরায় শৌচাগারের ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল।

তীর্থযাত্রা, পশ্চিমের বিশুদ্ধ জল ও বায়ুতে স্বাস্থ্যোদ্ধার কিংবা চাকরিসূত্রে প্রবাসযাত্রার জন্যে মধ্যবিত্তদের কাছে এই তৃতীয় শ্রেণীর রেলযাত্রা যথেষ্ট আদরণীয় ছিল। তবে তার সাজসরঞ্জাম ও যোগাড়যন্ত্রর কথা শুনলে, এ যুগের রেলযাত্রীরা আঁতকে উঠতে পারে

কর্তা-গিন্নি ও তাঁদের নানানবয়সী চার-পাঁচটি সন্তান। কর্তার একজন ভাই অথবা শ্যালক ও একজন বিধবা ভগিনী অথবা কুমারী শ্যালিকা। একজন ভৃত্য ও একটি কাজের মেয়ে। এই নিয়ে তখনকার দিনে একটি মাঝারি পরিবার হত। অতএব অন্ততঃ তিন-চারটে লোহার ট্রাঙ্ক (তখনকার দিনে পোর্টমান্টো বা Portmanteau বলত) ভরা জামাকাপড়। শতরঞ্চিতে জড়ানো তিন চারটি বেডিং – বিছানার চাদর, বালিশ, বাড়তি কিছু শতরঞ্চিসহ। বড়ো বড়ো বেতের ধামায় শিল-নোড়া, হামানদিস্তা, নানান মশলা, বড়ি, আচারের বয়াম ইত্যাদি। কিছু ভালো চাল, আমসত্ত্ব, ঘিয়ের শিশি। গিন্নিমার হাতের কাছে থাকত ছোট ঝুড়িতে পানের সরঞ্জাম, যাত্রাপথে খাবার জন্যে লুচি, পরোটা, তরকারি, মুড়ি, চিঁড়ে, গুড়। কুঁজোয় খাবার জল। সে জল ফুরিয়ে গেলে স্টেশনে স্টেশনে নেমে কুঁজো ভরে জল আনা ছিল অবশ্য কর্তব্য। এছাড়াও থাকত কাজের লোকেদের নিজস্ব পুঁটলি, তার মধ্যে জামাকাপড় ছাড়াও থাকত চিরুনি, মাথার তেল, দোক্তা, গুড়াখু ইত্যাদি। ও বলতে ভুলেছি, কর্তার হুঁকো-কলকে, তামাক-টিকের দায়িত্ব থাকত ভৃত্যের হাতে। ঠিক ঠিক সময়ে কর্তার হাতে সাজা-হুঁকো তুলে দিতে না পারলে কুরুক্ষেত্র বেধে যাওয়ার উপক্রম হত।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, সে সময় তীর্থযাত্রা এবং বায়ুপরিবর্তন উপলক্ষে অন্তুতঃ মাসতিনেক প্রবাসে থাকতে হত। আর চাকরিসূত্রে অন্ততঃ ছ’মাস। কারণ, দেশে অর্থাৎ নিজের গ্রামে ঘুরে যাওয়ার জন্যে, “মুখপোড়া” সায়েব-কর্তা কবে ছুটি মঞ্জুর করবে, তার ঠিক কি? অতএব বিদেশ-বিভূঁইয়ে কোথায় কী পাওয়া যাবে, কি যাবে না, সেই দূরদর্শীতা থেকেই রেলযাত্রার এই বিপুল আয়োজন করতে হত।   

পরবর্তী কালে শতরঞ্চি বাঁধা বেডিংয়ের পরিবর্তে এল মোটা ক্যম্বিস কাপড়ের তৈরি – বেল্টবাঁধা হোল্ড-অল (Hold-All) এবং সুটকেশ। আমার ছোটবেলায় আমার পিতৃদেবকে কর্মসূত্রে দিন সাত-দশের জন্যে প্রায়ই বাইরে যেতে হত। ছোটবেলায় বাবার হোল্ড-অল গোছানো শিখেছিলাম মন দিয়ে। সে শিক্ষা এবং পৈতৃক হোল্ড-অলটি আমার জীবনে একবারই কাজে লেগেছিল, জলপাইগুড়ির হস্টেলে প্রথমবার যাওয়ার সময়।

চতুর্থ শ্রেণী ছিল নিম্নবিত্ত এবং মজদুর মানুষদের জন্যে। এই কামরাগুলিতে শোয়া-বসার কোন ব্যবস্থা থাকত না। লোহার মেঝেতেই গাদাগাদি করে শুয়ে বা বসে যাত্রা করতে হতে। এক্ষেত্রেও দীর্ঘ আন্দোলনের পর, বেঞ্চের ব্যবস্থা করা হয় ১৮৮৫ সাল থেকে।

আধুনিক দূর পাল্লার ট্রেনে মোট পাঁচটি শ্রেণিতে যাত্রা করা যায়, 1AC, 2AC, 3AC, Second class Sleeper, General (unreserved)। কিছু কিছু ট্রেন Chair car হয়তাতে AC বা NonAC কামরায় চেয়ারে বসে যাত্রা করতে হয়। অবশ্য এই ট্রেনগুলির দূরত্ব সীমা আট-দশ ঘন্টার মধ্যেই সীমিত রাখা হয়।

 

(ঙ) ছড়া ও চাকার ছন্দে রেলগাড়ি

ছোটবেলায় এই ছড়াটি আমরা সকলেই পড়েছি, শুনেছি, আধোআধো উচ্চারণে আবৃত্তি করে, ঘনিষ্ঠ পরিজনের আদর ও হাততালি কুড়িয়েছি,  

“আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি

যদুর মাস্টার শ্বশুরবাড়ি।

রেলকাম ঝমাঝম            

পা পিছলে আলুর দম”।

কিছুটা “ননসেন্স” প্রকৃতির হলেও, ছড়ার বক্তব্য মনে হয়, যদুর মাস্টার শ্বশুরবাড়ি যাবেন বলে তাড়াতাড়ি রেলগাড়ি ধরতে চললেন। সঙ্গে ছিলাম আমি (I) এবং ভাই। ঝমঝম শব্দে রেলগাড়ি এল, কিন্তু মাস্টারমশাই তাড়াহুড়োতে পা পিছলে পড়লেন, পায়ের গোছ ফুলে আলু হয়ে উঠল। তখনকার দিনে, প্ল্যাটফর্ম থেকে লোহার সিঁড়ি বেয়ে কামরায় উঠতে হত। পা পিছলে যাওয়া তেমন আশ্চর্যের নয়।

আরও শুনেছি দ্রুতগামী ট্রেনের চাকার শব্দছন্দে নানান বক্তব্য। যেমন আমার ঠাকুমা বলতেন, তিনি নাকি চাকার আওয়াজে, “দিদি কোথা, দাদা কোথা” শুনতে পেতেন। এক সহযাত্রী বৈষ্ণব ভক্তের মুখে শুনেছিলাম, ঈশ্বর সন্ধানের ব্যাকুলতা, “কালা কোথা রাধা কোথা”! শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কোন এক উপন্যাসে পড়েছিলাম, এই চাকার চলার ছন্দে নায়ক শুনেছিল “দিন কাল ভাল নয়” ।         

 

৫. স্টিম ইঞ্জিনের বিস্ময়

আধুনিক টেকনোলজিতে ইঞ্জিন যতই শক্তিশালী এবং সুষমসুন্দর হোক এবং স্টিম-ইঞ্জিন যতই ব্রাত্য হয়ে যাক, স্টিম ইঞ্জিনের প্রাথমিক বিস্ময় মন থেকে বোধহয় কখনও মুছে যাবে না। আমার স্টিমইঞ্জিন-টানা ট্রেনে চড়ার বাল্যের একটিমাত্র স্মৃতিই সম্বল। খুব সংক্ষেপে সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলাম আমার “বিনিসুতোর মালা” গ্রন্থে। সে কথা আরেকবার বলি –

মহাষষ্ঠীর সকালে হাওড়া থেকে বাজারসাউ প্যাসেঞ্জার ছাড়ল। এই ট্রেন আমাদের কালনা পৌঁছে দেবে ঘন্টা চারেকের মধ্যে। বাবার কাছে জানলাম এই ট্রেন ব্যান্ডেল পর্যন্ত দু একটা স্টেশানে দাঁড়াবে। ব্যান্ডেলে ইঞ্জিন বদল হবে। এখন টানছে ডিজেলের ইঞ্জিন, ব্যান্ডেলের পর টানবে কয়লার স্টিম ইঞ্জিন।

এর আগেও বেশ কয়েকবার ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা ছিল, কিন্তু সেটা ছিল ইলেক্ট্রিক ট্রেনের। ডিজেলের গাড়ি ধ্বক ধ্বক শব্দ করে, দুদ্দাড় দৌড়ে পার হয়ে যেতে লাগল একটার পর একটা ষ্টেশন। বাপরে তার কি শক্তি। এর তুলনায় ইলেক্ট্রিক ট্রেন অনেক শান্ত আর নিরীহ। কিন্তু ব্যাণ্ডেলে স্টিমইঞ্জিন লাগিয়ে ট্রেন যখন যাত্রা শুরু করল, সে এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা।

ইঞ্জিন বদলের জন্যে অনেকটা সময় লাগত, তাই বাবা আমাদের নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামলেন, স্টিম ইঞ্জিন কেমন হয় দেখানোর জন্যে। ট্রেনের সামনে থেকে চার পাঁচজন রেলকর্মী খুলে দিলেন ডিজেল ইঞ্জিনের বাঁধন, সে ইঞ্জিন মুক্তির আনন্দে ভোঁ শব্দ করে বেরিয়ে গেল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ পর কু-উ-উ-উ-উ বাঁশি বাজিয়ে পিছন করে আসতে লাগল স্টিম ইঞ্জিন। মাথার ওপরে তার কালো ধোঁয়া, আর নীচের দিকে ভস ভস করে সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে। আস্তে আস্তে এসে, সে ধড়াম করে ধাক্কা লাগাল ট্রেনের গায়ে, তারপর দাঁড়িয়ে পড়ল। রেলকর্মীরা ট্রেনের সঙ্গে বেঁধে ফেললেন এই ইঞ্জিনকে। যতক্ষণ সে দাঁড়িয়ে ছিল, তীব্র শব্দে সে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল, রাগী মোষের মতো। লোহার বাঁধন শক্ত হতেই, স্টিম ইঞ্জিন বাঁজিয়ে দিল বাঁশি, কু-উ-উ-উ-উ। মাথার ওপরে কালো ধোঁয়ার রাশি ছাড়তে লাগল ভক ভক করে, আর লম্বা লম্বা শ্বাস নেওয়ার মতো ভস ভস করে স্টিম ছাড়তে লাগল ইঞ্জিন। বাবার হাত ধরে আমরা দৌড়ে উঠে পড়লাম ট্রেনে। আমরা উঠতেই ট্রেন গড়াতে লাগল মা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন, এখন নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন- ‘এত দেরি করলে কেন? যদি ট্রেন ছেড়ে দিত’?...

...অতি উৎসাহে জানালার বাইরে মুখ বাড়াচ্ছিলাম, বাবা মানা করলেন। বললেন, ইঞ্জিনের ধোঁয়ায় কয়লার গুঁড়ো থাকে প্রায়ই, চোখে ঢুকে গেলে ভীষণ কষ্টকর জানালা দিয়ে শরতের প্রকৃতি দেখতে দেখতে মনে হল। ইলেকট্রিক ট্রেন বড্ড কাজের, রসকষহীন কাঠখোট্টা। সকালের যে ডিজেল ট্রেনে এলাম সেটার গায়ে বড্ড জোর, ভয় করে, মনে হয় সামনে কিছু পড়লে ঢুঁ মেরে ঠেলে ফেলে দেবে খ্যাপা হাতির মতো। কিন্তু এই স্টিমের ট্রেন খুব মজার। তেমন তাড়াহুড়ো নেই। একটা স্টেশনে দাঁড়ালে যেন নড়তেই চায় না। ভাবখানা আমার মতো, বেড়াতেই তো যাচ্ছি ভাই, এত তাড়া কিসের? দুপাশে সবকিছু দেখে শুনে, লোকজনকে ব্যতিব্যস্ত না করে দিব্বি শান্ত, শিষ্ট। স্টেশনে লোকজন উঠছে, নামছে। পান বানিয়ে আনছে দোকান থেকে। কেউ কল টিপে জল খেয়ে আসছে। এই ট্রেনও খুব জল খায়। একটু বড়ো স্টেশনে লাইনের ধারে লম্বা গলা জিরাফের মতো পাইপ ঘুরিয়ে ট্রেনের পেটে ভরে দিচ্ছে জল। বাপরে সে কি জল খাওয়া। জল-টল খাওয়া হলে মিষ্টি করে ডাক দিল- কু-উ-উ-উ। যেন বলতে চায়, এবারে উঠে পড় হে, আর কি, গন্তব্যে পৌঁছতে হবে না?”...

এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে বড়ো হয়ে “শোলে” সিনেমার স্টিমইঞ্জিনের দৃশ্যের যেমন অনেক মিল ছিল, তেমনি অমিলও ছিল বিস্তর। সেখানে বেলচা দিয়ে ফারনেসে কয়লা ঢালছিলেন “বীরু” অর্থাৎ ঝকঝকে সুস্বাস্থ্যবান নায়ক ধর্মেন্দ্র। কিন্তু বাস্তবে আমি দেখেছিলাম, ফারনেস ও বয়লারের তীব্র গরমে বেলচাওয়ালা শ্রমিকের সারা গা-মুখ ঘামে ও কয়লার ধুলোকালিতে জবজব করছে। ফারনেস ও বয়লারের তীব্র উত্তাপে তাঁর মুখমণ্ডল বিবর্ণ। পরনে অত্যন্ত মলিন বেঢপ জামা-প্যান্ট, মাথায় কালোরঙের একটা টুপি। ইঞ্জিন ড্রাইভার যিনি ছিলেন, যিনি সিনেমার বীরুর মতোই দড়ির লিভার টেনে বাঁশি বাজিয়ে ট্রেনের যাত্রা শুরু করলেন, তাঁর দশাও গরমে, ঘামে, ধুলোময়লাতে একই রকম।

যদিও শোলে সিনেমার সেই স্টিম-ইঞ্জিন-দৃশ্য ছিল স্বপ্নের মতো সাজানো, কিন্তু বাস্তবে ওই ইঞ্জিন-যন্ত্রের সঙ্গে সেই কালে ছিল মানুষের সহ্যশক্তি ও পরিশ্রমের অটুট সমন্বয়। তুলনায় ডিজেল বা ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিন চালানো অনেক সহজ হয়েছে – কিন্তু ট্রেনের দ্রুত গতির সঙ্গে বেড়েছে দুশ্চিন্তা আর মানসিক উদ্বেগ।


 --০০--     

 

   তথ্য ঋণঃ

১.  A History of Indian Railways – Mr. G S Khosla, Ministry Of Railway (Rail Board), Government of India. Published in 1988.  

২. কলিকাতা দর্পণ (প্রথম পর্ব) – শ্রীযুক্ত রাধারমণ মিত্র  

 

  

   


নতুন পোস্টগুলি

বুনো ওল

  গতরাত থেকেই অঝোর নিম্নচাপের ধারায় আমাদের এদিকে জলভাসি। সকাল সাড়ে দশটায় অফিস যাওয়ার ইচ্ছেহীন চেষ্টায় ক্ষান্ত দিলাম। কিন্তু ঘরে বসেই বা সারা...