৪
সে তীব্র স্বরে ঝেঁকে উঠল, “শালোরা, চোকের মাতা খেয়েচু না কির্যা?
খানাখন্দ চোকে পড়ে না? মাঠাকরেন, ঠিক আছেন তো? খোকাঠাউর ঠিক আছে তো? শালোরা চলছে
যেন বুড়ো কানা গাধা, খানা খন্দ কিচুই চোখে পড়তেচে না”।
বউমাঠাকরুন মুচকি হেসে বললেন, “ভরতকা, এমন চললে আমাদের মাথায় অনেক আলু
গজিয়ে উঠবে, তখন আর তোমাকে রোদে জলে আলু চাষ করতে হবে না”।
এই কথায় একটু অপ্রতিভ হয়েও ভরতকা হাসল হো হো করে, তার পর বলল, “আর হবে
না, মাঠাকরেন, বলদদুটোকে কেমন চানকে নিয়ে যাই এবার, দেখই না”।
আচমকা গাড়ির ঝাঁকুনিতে চমকে উঠেছে কোলের ছেলেটাও। নিশ্চিন্ত আরামে
মায়ের কোলের ওমে ঘুমোচ্ছিল বেচারা, এখন ছোট্ট দুই হাতের মুঠি আর দুই পা ছুঁড়ে মাকে
ব্যস্ত করে তুলল। ছেলের মুখের দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে বউমাঠাকরুণ বলতে লাগলেন, “কু
হয়েচে বাবা? ভোয় পেয়েচো, ভোয়? কিচ্চু হয়নি বাবা, মায়ের কোলেই তো রয়েচ, সোনা, কোন
ভোয় নেই, ঘুমু করো”।
নীলাভ সাদার মধ্যে গভীর কালো চোখের তারায় যে ভয় ফুটে উঠেছিল শিশুর,
মায়ের চেনা মুখের দিকে তাকিয়ে, আর মায়ের কথার আওয়াজে সে ভয় কেটে গেল। ফোকলা মুখে
হেসে ফেলল একগাল, তারপর মুঠি খুলে হাত বাড়িয়ে দিল মায়ের মুখের দিকে; নীচু হয়ে থাকা
মায়ের নাক আর গাল খাবলাতে লাগল। মোচার কলির মতো ছোট্ট ছোট্ট আঙুলের পাতলা নখের
খোঁচায়, গালে নাকে ব্যথা লাগে। এই কষ্টটুকুতেও মার আনন্দ, বরং খুব ব্যথা লাগার ভান
করে আস্তে চেঁচিয়ে উঠলেন “আউ”। তাতে ছেলে আরো আমোদ পেয়ে খল খল
করে হাসতে লাগল, কথা বলার চেষ্টায় নানান আওয়াজ করে উঠল।
“তবে রে, দুষ্টু ছেলে, মায়ের মুখে খিমচি দিয়ে খিলখিলিয়ে হাসি? দাঁড়াতো,
দাঁড়াতো, আঙুলগুলো কামড়ে দিই”। ছেলের আঙুলের কয়েকটা, মা মুখের
মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে দুই ঠোঁটে হাল্কা চেপে ধরলেন। ছেলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মায়ের
চোখের দিকে; মায়ের কণ্ঠস্বর, মায়ের ঠোঁটে ধরা পড়া তার আঙুলের ডগায় অদ্ভূত অনুভব।
মা কী রেগে গেলেন? মাকি সত্যিই তাকে শাস্তি দিতে পারেন? ছেলের দুই চোখে সংশয়,
অজানা আশংকা আর অভিমানে তার পাতলা দুই ঠোঁট ফুলে উঠল। তাই দেখে কোন মা পারেন রাগ
করে থাকতে?
বউমাঠাকরুন ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে বলতে লাগলেন, “উ বাবা, তোমাকে কে বকেছে
বাবু? তোমার মা তোমাকে বকেছে? তোমার মা খুব দুট্টু আর বম্মাস, তাই না বাবু”? মায়ের কথার ভঙ্গিতে আর ঘাড়
নাড়ায় শিশু নিঃসংশয় হল, তার মুখে একটু একটু হাসি ফুটে, আবার খলখল করে বেজে উঠল
আনন্দে আর সেই সঙ্গে ভিজিয়ে দিল মায়ের কোল।
বউমাঠাকরুণ একইভাবে ছেলেকে আদর করতে করতে
বললেন, “ওই যাঃ, তুমি হাসতে হাসতে হুসু করে ফেললে? অ্যাঁ, এত্ত দুত্তু হয়েছো আর
বলতে পারো না, মা, মা, হুসু কব্বো? মণি, ওই পুঁটলিটা খুলে একটা ন্যাকড়া দে না,
রে”? শেষের কথাটা বোনকে বলতে বলতে তিনি ছেলের ভেজা প্যাণ্টটা খুলে দিলেন,
ন্যাংটাপুটো ছেলে ঘাড় ঘুরিয়ে আর চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগল, মায়ের মুখ, মায়ের মাথার
পিছনে চালচিত্রের মতো গাড়ির ছইয়ের নকশা। দুলছে, সবকিছুই দুলছে, গাড়ির চলার গতিতে
দুলেই চলেছে। শিশু পাদুটো ভাঁজ করে, পায়ের বুড়ো আঙুলটা নিজের মুখে পুরে চুষতে
লাগল।
মণি সেই দৃশ্য দেখে মজা পেল খুব, বলল, “তোর
ছেলের কাণ্ড দ্যাখ, দিদি, আর কিছু না পেয়ে নিজের পায়ের বুড়ো আঙুল চুষছে”!
"ও আমার বিষ্ণুঠাকুর... মহর্ষি মার্কণ্ডেয় একদিন মহাপ্রলয়-সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো, বটপাতায় বানানো ছোট্ট এক নৌকোতে শিশু বিষ্ণুকে ওইভাবেই দেখেছিলেন - দুই হাতে দুই পা মুখের কাছে এনে - পায়ের বুড়ো আঙুল চুষছিলেন শিশু বিষ্ণু - তাঁর মুখে ছিল জগৎ ভোলানো বির্নিমল হাসি ...। পুরাণের এই গল্পটা শুনিসনি"? মণির হাত থেকে কাপড়ের টুকরোটা নিয়ে ছেলেকে পরাতে পরাতে বউমাঠাকরুণ বললেন, “তুই দ্যাখ। আমি ওই দেখছি সারাদিন, ওর কিত্তিকলাপ দেখি আর খুব হাসি পায় মাঝে মাঝে। তবে একটা কী বল তো? ভুটকু আর যাই করুক, কান্নাকাটি খুব কম। এক একটা ছেলে থাকে না, এপাশ ফিরতে ভ্যাঁ, ওপাশ ফিরতে ভ্যাঁ। ভুটকু আমার তেমন নয়, ফোকলা মুখে সর্বদাই হাসি, কেবল খুব খিদে-টিদে পেলে একটু খুঁৎখুঁৎ করে, এই যা”।
খিদের কথায় বউমাঠাকরুণ নিজের দুইস্তনে ভার
অনুভব করলেন, ছেলেটা অনেকক্ষণ খায়নি, তাঁর দুই স্তনে জমে উঠেছে শিশুর জীবনসুধা।
শুকনো কাপড় পরে শিশু এখন অনেকটাই স্বস্তি পেল এবং খিদেও অনুভব করতে লাগল। সে মুখে
আওয়াজ করে হাত বাড়িয়ে দিল, মায়ের বুকে। বউমাঠাকরুণ ছেলেকে শাড়ির আঁচলের মধ্যে
নিয়ে, নিজের স্তনভার হাল্কা করতে সন্তানের অধরে তুলে দিলেন বৃন্ত। শিশু দুইহাতে
স্তন ধরে, পরম তৃপ্তিতে শুষতে লাগল মাতৃসুধা। মণি কোন কথা বলছিল না, সে শুধু দেখছিল তার
দিদির এই পূর্ণতা। তার মধ্যেও কোথাও জন্ম নিচ্ছিল এই পূর্ণতা লাভের স্বপ্ন, তার
মনের মধ্যেও যেন ঘন্টা বাজতে লাগল, লিটিং লিং লিটিং লিং টিংলি টিং।
বৌমাঠাকরুণ মণিকে বললেন, “মণি, তোর জামাইবাবুকে জিগ্যেস করতো মুড়ি-টুড়ি
কিছু দিই, দুটো মুখে দিক। বাড়ি পৌঁছতে ভাতখাবার বেলা পার হয়ে যাবে তো। হীরু ভেতরে
আয়, নারকেল নাড়ু দিয়ে মুড়ি খাবি। ভরতকাকা মুড়ি খাবে, নাকি চিঁড়ে দেব, ভিজিয়ে গুড়
দিয়ে মেখে খাবে?”
হীরু পর্দা ফাঁক করে, মাকে বলল, “আমাকে চারটে নাড়ু দেবে, আর মুড়িতে
মুড়কি দেবে কিন্তু”।
মা হেসে বললেন, “সে না হয় দেব, কিন্তু তুই ভেতরে আয়, বাইরে বসে খাবি
নাকি”?
“এই তো আমি বাবার পাশে বেশ আছি, ভরতকাকাও আছে, আমি এখানেই খাবো”।
মণিমাসি বললেন, “আমার কাছে আয় না, হীরু। একসঙ্গে খাই। বাইরে বসে কেউ
খায় নাকি?”
হীরু উত্তর দিল, “কেন? বাবা খাবে, ভরতকাকা খাবে, তাহলে আমিও খাবো”।
মণিমাসি বোঝানোর চেষ্টা করলেন, “বোকা ছেলে, ওঁরা তো বড়ো। তুই কিনা ছোট; মা-মাসির কাছে বসেই, ছোটরা খায়”।
খুব গম্ভীরভাবে হীরু উত্তর দিল, “আমি আর ছোটটি নেই, মাসি”।
তার কথায় বাবা এবং ভরতকাকা হা হা করে খুব হাসলেন খানিকটা। মণিমাসি একটু
অপ্রতিভ হলেন দেখে, বউমাঠাকরুণ মুখ টিপে হেসে বোনকে চাপা গলায় বললেন, “পান্না হবার
পর থেকে, ও এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছে। ভাইয়ের ওপর খুব দাদাগিরি ফলায় আজকাল, জানিস?”
ভরতকাকা গাড়ির গতি কমাতে কমাতে বললেন, “মাঠাকরেন, এক কাজ করি থালে,
সামনের ওই অশথতলায় কিছুক্ষণ দাঁড়াই, পাশে পুষ্করিণীও আছে। ওখানে আমাদের ভোজনও হবে,
বলদদুটোরও একটু জিরেন হবে”।
পর্দা ফাঁক করে, বউমাঠাকরুণ জায়গাটা দেখলেন;
বেশ নিরিবিলি, ছায়া ছায়া জায়গা, পুকুরটাও বেশ ভাল, মনে হচ্ছে পরিষ্কার জল। তাঁর
মনে ধরল জায়গাটা। বললেন, “সেই ভালো, ভরতকাকা। এক ভাবে ছইয়ের ভেতরে বসে বসে আমাদেরও
মাজা ধরে গেছে”।
হীরুর মধ্যে আজকাল খুব একটা গাম্ভীর্য এসে
গেছে, সে এখন অনেকটাই বড়ো, একজন ছোট্ট ভাইয়ের সে দাদা। সে এখন আর বাবা কিংবা মায়ের
কোলে চড়তে চায় না, বিশেষ করে ভাই হবার পর। বড়দাঠাকুর
তাকে গ্রামের পাঠশালায় কদিন পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানকার পরিবেশ, লেখাপড়ার
ধরণধারণ, তাঁর পছন্দ হয়নি। তিনি ঠিক করেছেন, ছেলেদের লেখাপড়া কলকাতাতেই করাতে হবে।
তিনি সরকারি যে আপিসে চাকরি করেন, সেখানে বেতন দুশবত্রিশটাকা সাতচল্লিশ পয়সা। কলকাতায়
পঞ্চাশ কি পঁচাত্তর টাকায় ছোট্ট একটা বাসা নিয়ে, সংসার চালানো মুশকিল হবে, কিন্তু ছেলেদের
ভবিষ্যতের মুখ চেয়ে সেটুকু কষ্ট মানিয়ে নেওয়া যাবে। বড়দাঠাকুর কাউকে এখনো কিছুই বলেননি,
এমনকি তাঁর ছেলেদের মাও জানেন না, কিন্তু মনে মনে তিনি সব ঠিক করে ফেলেছেন।
পরিবারকে আপাততঃ বাপেরবাড়িতে রেখে তিনি কলকাতায় গিয়ে বাসা ঠিক করে আসবেন এবং
মাসখানেকের মধ্যে পরিবার নিয়ে স্থিতু হবেন কলকাতায়। তাঁর ইচ্ছে আছে, এই
জানুয়ারিতেই হীরুকে কলকাতার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবেন। এই পোষের সাত তারিখে হীরুর
বয়েস ছয় পূর্ণ হবে।
“হা, হা, হা, বাঁ, বাঁ, বাঁ, বাস বাস হা, হা,
হা”। ডানদিকের বলদের পিঠে হাল্কা চাপড় দিতে
দিতে, মাঝ রাস্তা ছেড়ে বাঁদিক ঘেঁষে বিশাল অশথের ঝিরঝিরে ছায়ায় গাড়ি দাঁড় করাল
ভরতকাকা। দাঁড় করিয়েই ঝুপ করে নেমে পড়ল মাটিতে। গাড়ির সামনে গিয়ে জোয়াল ধরে বলল,
“বড়দাঠাকুর, বড়োখোকাকে নিয়ে নেমে পড়েন, জোয়ালটা খুলে দেই, বলদদুটো একটু জিরিয়ে
নিক”।
বড়দাঠাকুর ছেলে হীরুকে নিয়ে নিচেয় নামতে,
গাড়িতে ঝাঁকুনি লাগল, ভরতকাকা চেঁচিয়ে বলল, “মা ঠাকরেন, গাড়ি এবার নামাবো,
দিদিমণিকে নিয়ে একটু সামলে বসবেন”। খুব
আস্তে আস্তে ভরতকাকা গাড়িটাকে ছেড়ে দিল, নিজের ভারে, গাড়ির পেছনটা মাটিতে ঠেকে
গেল। বলদদুটো কাঁধের ভার মুক্ত হয়ে চঞ্চল হয়ে উঠল আরামে, তাদের শান্ত করার জন্যে,
ভরতকাকা জিভে টক টক আওয়াজ করতে করতে বলতে লাগল, “হা, হা, হা”।
অশথের মোটা একটা শেকড়ে বলদের রশিদুটো বেঁধে
ফেলল ভরতকাকা, তারপর গাড়ির তলায় বেঁধে রাখা খড়ের বাণ্ডিল থেকে দুটো এনে, খুলে
বিছিয়ে দিল বলদ দুটোর সামনে। বলদদুটো মাথা নামিয়ে খড় চিবোতে শুরু করতে, ভরতকাকা
তাদের গলায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল, “অবোলা জীবও তো কেষ্টরই জীব, নাকি
বড়দাঠাকুর? শুধু খাটিয়ে হদ্দ করলেই হবে, একটু আধটু আরামও দিতে হবে না?”
পুকুরের জলে হাতপা-মুখ ধুয়ে ভরতকাকা আর বাবার
সঙ্গে হীরু গাড়ির কাছেই আবার ফিরে এল। বউমাঠাকরুণ কাঁসার বাটিতে মুড়িমুড়কি মেখে
রেখেছিলেন। সেই দেখে ভরতকাকা হা হা করে হেসে বলল, “দাঁড়াশ সাপের খোরাক হচ্ছে গোদা
গোদা কোলা ব্যাং, তাকে কি আর ফড়িং খাওয়ালে চলে, বৌমাঠাকরেন? আমার এই গামছায় চিঁড়ে
দাও দিকি মা, পুষ্করিণীর জলে ভিজিয়ে আনি, তারপর গুড় পাটালি যা হয় খানিক দিও। তোমার
ও মুড়ি মুড়কি আমার দাঁতেই লেগে থাকবে, উদর পজ্জন্ত আর পৌঁছবে না”।
বউমাঠাকরুণ মুখ টিপে হাসলেন, বললেন, “তুমি এত
বাজে কথাও বলতে পারো, কাকা! মুড়িমুড়কি তোমার জন্যে নয়, দাঁড়াও তোমাকে চিঁড়েই
দিচ্ছি”।
মণিমাসি হীরু আর বড়দাঠাকুরকে মুড়িমুড়কির বাটি
বাড়িয়ে দিলেন। অন্যদিকে
বউমাঠাকরুণ, অন্য পুঁটলি খুললেন। পুঁটলি
থেকে ঢেঁকিতে কোটা লালচে মোটা চিঁড়ে, দুই হাতের আঁজলা ভরে তুলে ভরতকাকার পেতে
দেওয়া গামছায় ঢালতে লাগলেন। পাঁচ আঁজলা দেওয়ার পরই ভরতকাকা হৈ হৈ করে উঠল, বলল, “আমাকে
কি বক রাক্কোস ঠাউরেছো, মা? তোমার ও অন্নপুন্নার ভাণ্ডার শেষ হবার নয়, সে কি আর
জানি না, মা”?
বউমাঠাকরুণ একটু শাসনের স্বরে বললেন, “কাকা,
তোমাকে সকালে-দুপুরে রোজ আমিই ভাত বেড়ে দিই, আমি জানি না, তুমি কতটা খাবে”?
“সে কথা একশবার মা, মা জানবে না ছেলের উদরের
খবর? তাও কখনো হয়? দাও মা, দাও। যা দেবে দাও”। বউমাঠাকরুণ থেমে গিয়েছিলেন, আরো
দু আঁজলা তুলে দিয়ে বললেন, “যাও, ভিজিয়ে আনো গে। আমি গুড় আর পাটালি বার করছি”।
চিঁড়েগুলো গামছার মধ্যে মুড়ে ভরতকাকা দৌড়ে চলে
গেল, পুকুরের ঘাটে। চিঁড়ে সমেত গামছাটা পুকুরের জলে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রেখে, সেটা তুলে
এনে মেলে ধরল বউমাঠাকরুণের সামনে। মাটির হাঁড়ির থেকে দুমুঠি সোনারঙা আখের গুড় নিয়ে
ঢেলে দিলেন ভেজা চিঁড়ের ওপর, তার ওপরে দিলেন চারটে গুড়ের পাটালি আর চিনির বাতাসা
একমুঠো। ভরতকাকা গামছা তুলে নেবার পর, তার হাতে দিলেন চারটে নারকেলের নাড়ু।
ভরতকাকা কিছু বলল না, তার দু চোখে আনন্দের হাসি।
দুটো নাড়ু মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বলল, “বউমাঠাকরুনের
হাতে যেন কোন আগল নেই”। তারপর
গামছা মুঠি করে নিয়ে, ঘাসের ওপর বসল, অশথ গাছের তলায়। গুড় আর বাতাসা দিয়ে চিঁড়ে
মেখে, ভেজা চিঁড়ে খেতে লাগল সপ, সপ, সঙ্গে পাটালির টাকনা। ছইয়ের ভেতর থেকে
বউমাঠাকরুণ আর মণিমাসি, ভরতকাকার খাওয়া দেখছিল।
মণিমাসি বললেন, “মানুষটা খুব ভাল, না রে দিদি?
তোকে খুব ভালোও বাসে”।
বোনের শাড়ির আঁচল থেকে মুড়ি আর মুড়কি তুলে
খেতে খেতে, আনমনে বউমাঠাকরুণ বললেন, “আমরা যাতে ভালো থাকি, তার জন্যে এই মানুষগুলো
সারাদিন খেটে মরে। কিন্তু আমাদের ধর্মে নাকি আছে এরা অচ্ছ্যুত, ছোঁয়া অব্দি যাবে
না। আগের জন্মের পাপে নাকি ওরা নীচু জাত, আর পুণ্যের ফলে আমরা বামুন। তোর
জামাইবাবুর মা খুব কড়া, এতটুকুও বেচাল হতে দেন না। চিঁড়ে দিতে গিয়ে, এই যে আমি
কাকার গামছাটা দুবার ছুঁয়ে ফেলেছিলাম; উনি দেখলে কুরুক্ষেত্রে বাধাতেন, আমারও,
ভরতকাকারও। আমাকে এই অবেলায় চান করাতেন। কিন্তু আমি জানি এমন মানুষ,
আমাদের বামুন জাতেও খুব কম আছে। পুজো পালায় পায়ের সামনে মাটি ছুঁয়ে, আমায় যখন
প্রণাম করে, এত খারাপ লাগে; মনে হয়, এটাই পাপ। বাবার বয়সি একজন মানুষ, আমি বামুনের
মেয়ে কিংবা বউ বলেই, মেয়ের বয়সি আমাকে প্রণাম করবে? ঘোমটার আড়ালে মুখ ঢেকে, আমিও
মনে মনে প্রণাম করি; বলি হে ঠাকুর, হে নারায়ণ, এমন নিয়ম তুমি বানিয়েছ? বিশ্বাস হয়
না। কে জানে তোমার কেমন বিধান?”
দিদির কথায় মণিমাসিও দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর
চুপ করে দেখতে লাগল, শীতের হাওয়ায় ঝরে পড়তে থাকা অশথের শুকনো পাতা। বলদদুটো তখন খড়ের
বাণ্ডিল শেষ করে, আশেপাশের ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছিল, তাদের চলাফেরায়, তাদের গলায়
বাঁধা ঘন্টিতে আওয়াজ উঠছিল, লিটিং লিং লিটিং লিং টিংলি টিং।
মাঝেরগাঁ থেকে বাঁক নিয়ে, ক্যানেলের বাঁধ পার করে বড় রাস্তা সোজা চলে
গেছে মালম্বার দিকে, মালম্বা পার হয়েও কোথায় চলে গেছে... সে পথের শেষ নেই। পথ কোথাও যায় না, হাত পা
ছড়িয়ে অলস শুয়ে থাকে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। পথ চলে মানুষ, পথের ধারে ধারে গড়ে তোলে তার
নানান গন্তব্য। বড়দাঠাকুরদের গাড়ি ওদিকে যাবে না, ক্যানেলের বাঁধ পার করে,
বাঁদিকে গড়ানে মেঠো রাস্তা নেমে গেছে ক্যানেলের ডানদিক দিয়ে। সেই গড়ানে রাস্তায়
হুড়হুড়িয়ে নেমে এলো গাড়িটা। স্কুলের টিফিনে ছুটি পাওয়া কিছু ডেঁপো ছেলের দল, এই
ক্যানেলের বাঁধে বসে আড্ডা দেয়, গুরুজনদের লুকিয়ে বিড়ি টানে। তাদের মধ্যে একজন
চিনতে পেরেছে, বড়দাঠাকুরকে। সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ন’জামাইবাবু? নদিদিরা এসেচে, বুঝি?’
বড়দাঠাকুর মুখ তুলে তাকালেন, মুখটা চেনা চেনা লাগল, কিন্তু নাম মনে
করতে পারলেন না। ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। কিছু বললেন না। বিয়ের দিন
আর তারপরে মোট বার তিনেক এই গ্রামে তিনি এসেছেন, তাঁর পক্ষে সবার নাম মনে রাখা
সম্ভব নয়, কিন্তু এ গ্রামের জামাই হিসেবে, তাঁকে অনেকেই চেনে।
ছইয়ের পিছনের পর্দা সরিয়ে, ভেতর থেকে বউমাঠাকরুন বললেন, ‘অ্যাই চিন্টু,
স্কুল পালিয়ে এখানে বিড়ি টানতে এসেচিস, না? দাঁড়া হারুকাকে বলচি’।
‘অ্যাই ন’দি, বাবাকে বলো না। বাবা শুনলে আর আস্ত রাখবে না আমাকে’।
বউমাঠাকরুন আর মণিদিদিমণি মুখ টিপে হাসলেন একটু। বউমা নিজের গ্রামে
ফিরে আসছেন। এই গ্রামেই তাঁর জন্ম, তাঁর শৈশবের, বাল্যের নানান দৌরাত্ম্যের অনেক
সাক্ষী এই গ্রামের পথঘাট, গাছপালা, মাঠ প্রান্তর। মুখের থেকে সরে গিয়ে, তাঁর ঘোমটা
এখন ভেঙে পড়েছে খোঁপার ওপর। শ্বশুরবাড়ির বড়ো বৌমা এবং দুই পুত্রসন্তানের জননী
হিসেবে তাঁর শরীরী গাম্ভীর্য এতক্ষণে ঝরতে শুরু করেছে। তিনি এখন বাপ-মায়ের আদরের কন্যা। তাঁর আনন্দময় মুখে নিরুদ্বেগ
হাসি, তাঁর চোখের দৃষ্টিতে কৈশোরের চঞ্চলতা।
“চিন্টু, সাইকেল এনেছিস? একখুনি দৌড়ে যা, গিয়ে মা আর দাদাকে বল,
জামাইবাবু এসে গেছে”।
“এই যাচ্ছি ন’দি, তুমি ভেবো না”। দাঁড় করানো সাইকেলটাকে টেনে ঘোরাতে ঘোরাতে উত্তর দিল চিন্টু। তারপর বাঁ হাতে সাইকেলের রড ধরে ঝুলতে ঝুলতে, হাফ প্যাডেলে সাইকেল চালিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল গাঁয়ের দিকে।
এখান থেকে গ্রাম খুব দূর নয়, খুব জোর মাইলখানেক হবে। পর্দা খোলা ছইয়ের ভেতরে বসে বউমাঠাকরুন তাকিয়ে রইলেন পিছিয়ে যেতে থাকা রাস্তা, ঘাট, ক্যানেলের পাড়, মাঠ প্রান্তরের দিকে। পথের ধারের বাবলা গাছ। হাওয়ায় উড়তে থাকা বাবুইয়ের খালি বাসা। শ্বশুরবাড়ির কড়া নিয়ম শৃঙ্খলা, ঘোমটা, পর্দার আড়াল থেকে মুক্ত হয়ে, শৈশবের এই গ্রামে অনেকদিন পর ফিরে এসে, তিনি যেন আবেগে ডুবে গেলেন। কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে, তার মুখের ওপর তিনি শাড়ির আঁচল ঢেকে দিলেন, গাড়ির নিকে বড্ডো ধুলো। তারপর আবার তাকিয়ে রইলেন, রাস্তার দিকে।
নিজের গ্রামের তুলনায় অনেক সম্পন্ন এই গ্রামটি বড়দাঠাকুর বেশ উপভোগ
করেন। এই গ্রামে ছেলে মেয়েদের আলাদা আলাদা হাইস্কুল আছে। স্কুলের সামনে খেলার মাঠ
আছে। একটা হেলথ সেন্টার আছে। গ্রামীণ ব্যাংকর একটি শাখাও খুলেছে সদ্য। এই গ্রামে
ডাকঘর আছে। শোনা যাচ্ছে মেমারি আর বর্ধমান থেকে দুটো বাস রুট চালু হয়ে যাবে খুব
শিগ্গিরি। বাস চালু হয়ে গেলে বর্ধমান, এমনকি কলকাতাও চলে আসবে হাতের কাছেই।
কলকাতার কথা মনে পড়তে, তিনি কোলের কাছে জড়সড়ো বসে থাকা বড় ছেলে হীরুর
দিকে তাকালেন। একমাথা কালো চুলের ওপর লালচে ধুলোর হালকা আস্তর। চুলে হাত বুলিয়ে
দিতে, বাবার দিকে তাকাল হীরু। বড়ো বড়ো চোখের দিকে তাকিয়ে বড়দাঠাকুর বললেন, “কলকাতা
যাবি, হীরু”?
মস্ত ঘাড় হেলিয়ে হীরু বলল, “হ্যাঁ। কবে যাব, বাবা?”
বড়দাঠাকুর কোন উত্তর দিলেন না, পুত্রের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “খুব
তাড়াতাড়ি, দেখা যাক।”
হীরুর আরও অনেক প্রশ্ন ছিল, সে সব ঢাকা পড়ে গেল, তার দুই মাসির আনন্দ
চিৎকারে, “ওই তো, ন’দিদি আর জামাইবাবুর গাড়ি”।
চিন্টুর কাছে খবর পেয়ে, বৌমাঠাকরুনের ছোট দুই বোন বাড়ি থেকে একটু এগিয়ে,
মন্দিরতলায় এসে দাঁড়িয়েছিল। সেখানেই গাড়ি দাঁড় করাতে হল, বোনেরা শুনল না, নদির
ছোটছেলে পান্নাকে তারা দেখেইনি। মণিদিদিও নেমে এল ছইয়ের ভেতর থেকে। সুভোদিদি
পান্নাকে কোলে নিতেই, পান্না ঘুম ভাঙা অবাক চোখে দেখতে লাগল নতুন সেই মুখ। ওদের
নামিয়ে দিয়ে বৌমাঠাকরুন, বড়দাঠাকুর আর হীরুকে নিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল, বাড়ির দিকে।
পান্নাকে কোলে নিয়ে সুভোমাসি হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ও মা, ন’দির এ ছেলেটা
কি ভালো রে! অচেনা কোলে এসেও একটু কাঁদে না! এ বাবা, আঙুলে কী হয়েছে, ন্যাকড়া
বাঁধা কেন? এইটুকু কচি ছেলের আঙুল কাটল কী করে?”
নদিদির কাছে যেমন শুনেছিল মণিদিদি বলল, “ন’দি, ছেলে কোলে নিয়ে কুটনো কাটছিল, বাঁহাত বাড়িয়ে পান্না খামচে ধরেছিল বঁটির পাত। কচি আঙুল কেটে নাকি রক্তারক্তি ব্যাপার। ওষুধ দিয়ে শাড়ির পাড় বেঁধে রক্ত বন্ধ করতে হয়েছিল।
শ্বশুরবাড়ির সদরদুয়োরে গাড়ি এসে যখন দাঁড়াল, তখন বেলা হয়েছে বেশ। বড়দাঠাকুর
বাঁ হাতের কব্জি ঘড়িতে দেখলেন, বেলা প্রায় পৌনে দুটো। শীতের দুপুর দেখ না দেখ শেষ
হয়ে বিকেল হয়ে যাবে। বাড়ির সকলেই সদরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মায়ের হাতে বরণডালা,
বড়বৌদির হাতে শাঁখ। গাড়ি থামতেই উলুধ্বনি দিয়ে উঠল সমবেত মেয়েরা। গাড়ি থেকে নেমে, বড়দাঠাকুর
হীরুর হাত ধরে, পাশে বৌমাঠাকরুনকে নিয়ে সদর দরজার সামনে দাঁড়ালেন। বরণ করতে করতে,
উলু থামিয়ে, বৌমাঠাকরুনের মা বললেন, “পান্না কোথায় গেল, অ্যাই সুভো পান্নাকে সোনার
কোলে দে। পান্নাকে নিয়ে সোনা এই প্রথম বাড়ি আসছে! বরণ করতে হবে না?”
মেয়ে-জামাই, নাতিদের নিয়ে বড়মা বাড়ির ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পর, সদরের
রাস্তাটা একটু ফাঁকা হল। গ্রামের পাড়া-প্রতিবেশীর মেয়েবউরা যাঁরা এসে জমা হয়েছিলেন,
তাঁদের কেউ কেউ বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন, কেউ ফিরে গেলেন নিজের নিজের বাড়ি। বৌমাঠাকরুনের
বাপের বাড়ির রাখাল, ভুবনমামা এসে দাঁড়িয়েছিল ভরতকাকার পাশে। বিয়ের পর
বার তিনেক আসা যাওয়াতে দুজনের বেশ ভালোই ভাবসাব হয়ে উঠেছে। ভিড় কমতে ভুবনমামা আর
ভরতকাকা গাড়ি ঘুরিয়ে, হাতে হাতে সব জিনিষপত্র নামিয়ে দিয়ে এল ভেতরবাড়ির দাওয়ায়।
তারপর খালি গাড়ি নিয়ে চলল, গোয়াল বাড়ির দিকে। সেখানেই বলদরা বিশ্রাম নেবে। গোয়ালে বলদের ব্যবস্থা
করে, খামারে গাড়িটা রেখে, ভরতকাকার ছুটি। তারপর ভুবনমামা ভরতকাকাকে নিয়ে পুকুরে
স্নান টান সেরে, ফিরে আসবে বৌমাঠাকরুনের বাড়িতে। অনেকটা পথ এসে, সকলেই যেমন
ক্লান্ত, তেমনই গন্তব্যে পোঁছে যাওয়াতে সবাই নিশ্চিন্ত। গাড়ির গতিতে এখন আর কোন
তাড়া নেই, হেলতে দুলতে চলতে লাগল বলদদুটো। তাদের গলার ঘন্টি বিলম্বিতে বাজতে লাগল,
লিটিং লিং লিটিং লিং টিংলি টিং।
--০০--
লিটিং লিং পর্ব শেষ। পরের মঙ্গলবার আসবে পরবর্তী রম্য রচনা - "মুখে নেই রা"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন