পরির বাড়িতে একতলার বসার ঘরে হুড়মুড়িয়ে
ঢুকেই নিখিল দেখল অচেনা এক ভদ্রলোক বসে আছেন। নিখিল একটু হকচকিয়ে কী বলবে ভাবছে,
কিন্তু তাকে দেখেই ভদ্রলোক এমন দাপটের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে দিলেন, যেন অনেক
দিনের চেনা।
“বসুন, বসুন। আরে, এখানে নয়, এখানে নয়,
ওই...ওই...চেয়ারটায়”। চেয়ারটা সন্তর্পনে একটু দূরে সরিয়ে খুব সাবধানে নিঃশব্দে
বসল নিখিল। মনে হল চেয়ারটা যেন ফঙ্গবেনে কাচের, একটু এধার ওধার হলেই ভেঙে চুরচুর
হয়ে যাবে। নিখিলের বসাটা মন দিয়ে লক্ষ্য করার পর ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, “হুঁ, হুট
করে একেবারে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন, তা কাকে চাই?”
নিখিল খুব আমতা আমতা করে বলল, “আামি
নিখিল, ইয়ে মানে... পরি...মানে পরিচিতা নেই?”
ভদ্রলোক একটু অবাক হয়ে গমগমে গলায়
বললেন, “খি আশ্চর্য, পরির বাড়িতে পরি থাকবে না তো, কে থাকবে? তা আপনি কী পরিচিতার
খুব পরিচিত?”
ভদ্রলোকের আলতো ধমকে নিখিল একটু
যেন এলোমেলো হয়ে গেল, বলল, “আজ্ঞে, হ্যাঁ আমি আর পরিচিতা একই কলেজে পড়েছি, সেই
থেকেই আমরা পরিচিতা....ইয়ে মানে... ও আমার পরিচিত এবং খুব ভালো বন্ধু”।
নারকেলের বাস্নার পুরুষ্টু
ঝাঁপালো দুই ভুরু কুঁচকে ভদ্রলোক নিখিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “পরি এখন তো আর কলেজে
পড়ে না, পাস করে চাকরি করছে। তা আপনি কী এখনো কলেজেই, নাকি কাজ কম্মো কিছু যোগাড়
হয়েছে?”
নিখিল ভীষণ বিনীত স্বরে বলল, “না,
না পরির সঙ্গেই কলেজ থেকে পাস করে গেছি, আর কাজ বলতে, হ্যাঁ, অকাজ-কাজ দুটোই করি
বৈকি!”
নাকমুখ কুঁচকে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস
করলেন, “কাজ বলতে যদি চাকরি ধরে নিই, তাহলে অকাজটা কী?”
নিখিল একটু গর্ব করে বলল, “অকাজ
মানে, ওই একটু আধটু লেখালেখি করি”।
ভদ্রলোক বিরক্ত মুখে বললেন, “লেখালেখি
করেন? মানে লেখক? তা কী ধরনের ইয়ে লেখা হয় শুনি?”
ভদ্রলোকের কৌতূহলে নিখিল খুব
উৎসাহ পেল, বলল, “বেশীর ভাগ ছোট গল্প, স্যার, বড়দের জন্যে, ছোটদের জন্যে। তাছাড়াও দু
একটা উপন্যাস...”।
“অ, চার্লস ডিকেন্স? ডেভিড
কপারফিল্ড, এ টেল অব টু সিটিজ গোছের, নাকি মপাসাঁ গোছের”?
নিখিল অবাক হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে
রইল, কিছুক্ষণ। তারপর খুব মৃদুস্বরে বলল, “আমি স্যার বাংলায় লিখি, ইংরিজিতে নয়!”
“বা-আং-লা-আ-য়?” ভদ্রলোক নাক
কুঁচকে বললেন, “বঙ্কিম, শরৎ, রবিঠাকুরের পর, বাংলায় কেউ লেখে? চোখে পড়েনি তেমন!”
নিখিল কোন উত্তর দিল না। চোখের
সামনে এমন একটি স্পেসিমেন সে দেখতে পাবে কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। ২০২৫-এর এই
ভ্যাপসা শ্রাবণে, ইংরিজি সাহিত্য বলতে কেউ চার্লস ডিকেন্সের নাম বলবে, ভাবা যায়
না। এমন অঘটন আজও হয়? তার মনে হল, এই পুজোর ছুটিতে তুঙ্গভদ্রা কিংবা নর্মদা বেসিনে
টিরানোসোরস খুঁজতে গেলে, কেমন হয়? বলা যায় না, এরকমই দু একপিস সেখানে, এখনো হয়তো
ঘুরে বেড়াচ্ছে! কিছু না বলে, সে তাকিয়ে রইল ভদ্রলোকের দিকে।
নিখিলের কোন উত্তর না পেয়ে
ভদ্রলোক আরো উৎসাহী হয়ে বললেন, “ফ্রম শেক্সপিয়ার থেকে আপ টু ডিকেন্স পর্যন্ত, এক্সসেপ্ট
ইংলিশ লিট্রেচার ছাড়া, ইন দিস প্ল্যানেট, আর কিছু হয় না”। তারপর একটু থেমে, করুণাঘন গলায়
আরো বললেন, “আমি বাংলাকে মোটেই ডিজহার্টেন করছি না, আফটার অল ইট ইজ মাই মাদার্স
ল্যাংগোয়েজ। তবে সাহিত্যের কথা যদি বলতেই হয়, তাহলে বলব, ইন কম্প্যারিজন্ উইথ দেম
তুলনা করলে, বাংলা ইজ আ মেয়ার ছাইল্ড”। “ছাইল্ড” কথাটা বলার সময় দু কাঁধ ঝাকিয়ে যা শ্রাগ করলেন,
সে দেখার মতো! অবিকল ষাটের দশকের মার্লন ব্রাণ্ডো টাইপ।
ভদ্রলোক নিখিলের মুখের দিকে
তাকিয়ে তার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করলেন, তারপর বললেন, “আপনাকে “তুমি” বললে
কিছু মনে করবে না, নিশ্চয়ই! তুমি যখন পরির বন্ধু, “তুমি” বলতেই পারি”।
নিখিল বিনয়ের অবতার হয়ে বলল, “মনে
কী করবো, তুমিই বলবেন, স্যার”।
ভদ্রলোক সম্মতির ঘাড় নেড়ে বললেন,
“ওয়েল, যে কথা হচ্ছিল, সে কথায় ফিরে আসি। সাহিত্য হিসেবে বাআংলাআ... এই যেমন ধরো,
সাগরসঙ্গমে নবকুমার। তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন? ঠিইইক আআছে, চলে যায়।
তবে কি না, সেই ইয়েটা ঠিক পাওয়া যায় কী? মানে, কী বলতে চাইছি বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই”।
নিখিল ভাবলেশহীন মুখে বলল, “আজ্ঞে,
সে তো বটেই! জলের মতো পরিষ্কার। এ আর না বোঝার কী আছে? একটু ইয়েই যদি না পাওয়া
যায়, তা হলে আর সাহিত্য লিখে বা পড়ে লাভ কী?”
ভদ্রলোক খুব উজ্জ্বল মুখে নিখিলকে
সমর্থন করে বললেন, “এক্স্যাক্টলি। তারপরে যেমন ধরো, রথের মেলা হইতে ঘরে ফিরিয়া
রাধারাণী দেখিল টাকায় নাম লেখা আছে রুক্মিণী কুমার রায়। এখানেও কোথায় যেন সেই
ইয়েটার একটা অভাব রয়ে গেল। তোমার কী তাই মনে হয় না?”
“আজ্ঞে একশ বার মনে হয়। মনে না
হয়ে উপায় আছে? ওই ইয়েটুকু ছাড়া কী আর ইয়ে হয়?”
“তুমি কেমন লিখছো, তা আমি জানি
না। আর সে জানার আমার প্রবৃত্তিও হয় না। কারণ আমি আবার কোন কিছুর মুখের ফেস
ভ্যালুতে যাই না। সেটা আমার দোষ বা গুণ যাই বলো। আমি আসলে যে কোন বিষয়ের গভীরে না
গিয়ে, কোন ধারণা তৈরি করতে পারি না”।
নিখিল উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল, “দারুণ
বলেছেন, স্যার। অন্য কিছুর ফেস ভ্যালুতে গেলেও, মুখের ফেস ভ্যালুতে কক্খনো যেতে
নেই”।
ভদ্রলোক উজ্জ্বল চোখে নিখিলের
দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি বেশ ইন্টেলিজেন্ট। তোমার সাধারণ কমন সেন্স জ্ঞানও খুব
পরিষ্কার”।
নিখিল গদ্গদ স্বরে বলল, “থ্যাংকিউ
স্যার, থ্যাংকিউ”।
নিখিলের কথায় পাত্তা না দিয়ে
ভদ্রলোক আবার বললেন, “বাংলা সাহিত্য একটা সময় তো গুলে খেয়েছি, হে। সব কথা বলতে
গেলে, রাত ভোর হয়ে যাবে”।
“তা হোক না, স্যার। আপনার থেকে দু
একটা কণাও যদি পাই, আমার কাছে সেটাই সম্পদ হয়ে থাকবে। আমার সময়ের কোন অভাব নেই,
স্যার”।
“আরে তোমার সময়ের কথা কে ভাবছে,
হে? কিন্তু তাই বলে আমার সময়ের কোন মূল্যই নেই বলতে চাও? সাতখানা কোম্পানীর আমি ডিরেক্টর!
হতভাগা চেয়ারম্যানগুলো আমাকে ছাড়া একপাও চলতে পারে না। এই অজিত লাহিড়ি ছাড়া
কোম্পানীগুলো এতদিনে ডকে উঠে যেত, হে”।
নামটা শুনে নিখিল একটু চমকে উঠল।
এ নাম তো সে পরির মুখে বহুবারই শুনেছে! পরির প্রবাসী কাকা, দারুণ নাকি পণ্ডিত লোক!
এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটির নামকরা প্রফেসর! পরির মুখে এঁনার নামে, সে এত প্রশংসা
শুনেছে, নিখিল অনেকবার ঈর্ষাও অনুভব করেছে, এই ভেবে যে, পরি কাকে বেশি ভালোবাসে,
তাকে নাকি তার এই কাকাকে? পরির মুখে শুনে এই ভদ্রলোক সম্পর্কে তার ধারণা হয়েছিল
মহান, কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে জালিস্য জালি লোক! তার ওপর প্রফেসর-ট্রফেসর কিচ্ছু
নয়, সাতখানা কোম্পানীর ডিরেক্টর! এযে একেবারে ঢপের চপ, ছ্যাঃ। পরিকে চেপে ধরতে হবে
তো!
অজিতবাবু নিখিলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ
তাকিয়ে থাকার পর আবার শুরু করলেন, “নাও আয়াম রানিং সিক্সটিসিক্স। আর কতদিন টানতে
পারবো হে! মাঝে মাঝে মনে হয় এসব ছেড়ে ছুড়ে, শেষ কটা বছর আরামে ছুটি কাটাই। কিন্তু
দায়িত্ব? আমার কলমের একটি খোঁচায় অনেকেরই পেটের ভাত বন্ধ হয়ে যাবে, হে, পেটের ভাত
বন্ধ হয়ে যাবে। তা তো আর হতে দিতে পারি না! যতদিন ঈশ্বর ক্ষমতা দেবেন, চালিয়ে দিয়ে
যাই সংসারগুলো। আমি চোখ বুজলে, তিনিই যা করার করবেন। তবে হ্যাঁ, তোমাদের ওই ঈশ্বর-টীশ্বরেও
আমার তেমন আস্থা নেই”।
“আজ্ঞে, আপনিই তো কত লোকের
অন্নদাতা, আপনিও তো ঈশ্বরের মতোন”।
“আরে না, না। ওসব তেমন কিছু নয়। নিজের
কথা অন্যের কাছে ঢাক পিটিয়ে আমি বলি না, বা বলতে পছন্দও করি না। যাক গে, যে কথা
বলছিলাম। তোমাদের এই রবিঠাকুরকে ধরো। আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল
থাকে...এভাবে একটা দেশের সর্বনাশ করার কী যুক্তি আমি বুঝে পাই না”।
নিখিল আশ্চর্য হয়ে বলল, “দেশের
সর্বনাশ?”
“সর্বনাশ নয়, কী বলছ হে? এমনিতেই
ইওরোপ, আমেরিকার সাধারণ মানুষ, ভারত সম্বন্ধে খুব ধোঁয়াটে একটা ধারণা নিয়ে থাকে।
হাতি, জটাওয়ালা সাধু। কুম্ভমেলা। সাপের খেলা, আগুনে ঝাঁপ, রোপ ট্রিক্স। ভারতে শিশুমেয়েদের
জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বিবেকানন্দ পড়েছ? তিনি এক আমেরিকান
ভদ্রলোকের এরকম প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, “হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন, ভারতে পুরুষরাই
সন্তান ধারণ করে”! তার মানে আমরা সবাই পুরুষের গর্ভজাত! হা হা হা হা, ব্যাপারখানা
বুঝে দেখ একবার। তা এরকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে নদী নিয়ে এমন কবিতা না লিখলেই
চলছিল না? ছোট নদী। বোশেখ মাসে হেঁটে লোকজন, গাড়ি পার হয়ে যায়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা
নাইবার কালে গামছায় জল নিয়ে মাথায় ঢালে, মাছ ধরে। এ সব কেন? উনি একবারও ভেবে
দেখলেন না, এর পর, ওই নদীতে ব্রিজ বানানোর জন্যে কিংবা ইরিগেসানের ড্যাম বানানোর
জন্যে, কোনো ফরেন ব্যাংক বা ইনভেস্টার আমাদের দেশে আসবে? তারা হাসবে না? বলবে না -
ইন সামার ভেরি লিট্ল্ ফ্লো অফ ওয়াটার ইন রিভার, পিপ্ল্ ওয়াক অন ইট, নো ব্রিজ
ইজ রিকয়ার্ড টু ক্রস দ্য রিভার? বিশ্বকবি হয়ে, এমন একটা কবিতা লেখা অবিমিশ্রতা নয়?”
নিখিল পুলকিত হয়ে বলল, “ছি ছি ছি
ছিঃ। একেবারে অবিমিশ্র অবিমৃষ্যতা, বৈকি!”
“তবে? তারপরে ধরো তালগাছ। তালগাছ
একপায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে। ছাড়িয়ে তো ছাড়িয়ে, তাতে হয়েছেটা কী? তালগাছ থেকে কী
পাই কি আমরা? তাল? বছরে এক-দুদিন, তালের মাড়ি ঘষে বের করে, কটা ফুরুলি, তালক্ষীর, তালের
রুটি। গরমের শুরুতে তালশাঁস। লক্ষ্মীপুজোয় তালের
ফোঁপোল। তাছাড়া তালপাতার ভেঁপু, তালপাতার সেপাই। ছোটলোকের নেশার জন্যে তাড়ি। আর
একটু আধটু তালগুড়! এর জন্যেই এত হইচই, কবিতা? কেন আমগাছকে প্রোমোট করা যেত না?
কিংবা নারকেল? আম, নারকেল আর নারকেলের নানান প্রোডাক্ট কম এক্সপোর্ট হয়? এর থেকে
আমাদের কম ডলার আমদানি হয়? এর কোন উত্তর আছে তোমার কাছে?” নিখিল কোন উত্তর দিল না। তাকিয়ে
রইল ফ্যালফ্যাল করে।
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, “নেই,
আমি জানি কোন উত্তর নেই। আরেকটা এক্সামপ্ল নমুনা দিই। শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই,
আর সবই গেছে ঋণে। সবই যখন ঋণে চলে গেল, তখন বাকি এই দুবিঘে নিয়েই বা এত আদিখ্যেতা
কেন? বাবু তো ফ্রিতে জমি নেবেন, কিংবা লেঠেল দিয়ে জমি কেড়ে নেবেন, এমন তো বলেননি।
বলেছিলেন, এ জমি লইব কিনে! তা হলে? বাবু একটা বাগান করেছেন, তার সঙ্গে আরো দু বিঘে
হলে তাঁর বাগানটা আরো সুন্দর সাজাতে পারবেন। একটা বাগানের প্রোডাকসান জানো? কত
ফল-ফুরুলি, কত রকমের ফুল। বাবুরও লাভ, দেশ এবং দশেরও লাভ। তাছাড়া গাছ লাগান, প্রাণ
বাঁচান। এক একটা গাছ মানে কতটা অক্সিজেন? পরিবেশের কতটা উন্নতি? সেদিকটা ভেবে
দেখবেন না? সে সব দিকে না গিয়ে, উপেনের পেন নিয়ে উনি সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়িওয়ালা
কবিতা লিখে ফেললেন? আমি তো বলবো ঘোরতর অন্যায় করলেন। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে যে বিক্ষোভ
আর ভুল বোঝাবুঝি সে কী ওই উপেনকে দিয়েই শুরু নয়?”
নিখিলের মনে হল, কথায় কথায়
অজিতবাবু বেশ উত্তেজিত এবং রেগে উঠলেন! সে কোন কথা না বলে, চুপ করে শুনতে লাগল। ভদ্রলোক
একটু থেমে থেকে, খুব চিন্তা করতে করতে বললেন, “তবেএএএ একটা গল্প বরং বেশ লেগেছিল”।
“তাই? আপনার ভাল লেগেছিল? বলেন
কী? কোনটা বলুন তো?”
“ভদ্রলোকের মোটামুটি একটা লেখার
হাত তো ছিলই, সেটা তো আর অস্বীকার করা যায় না। ছুটি। সেই যে ফটিকের গল্প। বাপ মরা
দুরন্ত ছেলেটাকে মামা এসে নিয়ে গেল, নিজের কাছে রেখে মানুষ করবে বলে। তারপর মামীর
অবহেলা, মুখঝামটা। তারপর তো কদিনের জ্বরে মারাই গেল ছোঁড়া”।
“হুঁ। খুব প্যাথেটিক গল্পটা, এমন
প্রাণবন্ত দুরন্ত একটা ছেলে...”
“অ্যাই, তোমাদের ওমনি নাকে কান্না
শুরু হয়ে গেল। গল্পটার আসল বিষয়বস্তুটাই তোমরা ধরতে পারোনি...”।
নিখিল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল
ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “ফটিক মামার বাড়ি যাওয়ার
সময় নৌকায় নদী পার হয়েছিল। সে নদী বেশ গভীর...একে বাঁও মেলে না। দুয়ে বাঁও
মেলেএএএএ না। বলি কিছু বুঝতে পারলে? এটাই ওই গল্পের সারকথা। ছোট নদীর বর্ণনা দিয়ে
যে ভুল হয়েছিল, এই গল্পে তার প্রায়শ্চিত্ত হল!”
নিখিল একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “এই
কটা লেখা ছাড়া আপনি রবিঠাকুরের কবিতা-টবিতা, গল্প-টল্প বেশি কিছু পড়ার সময় পাননি
মনে হয়!”
অজিতবাবু খুব তাচ্ছিল্যে মুখ
বেঁকিয়ে বললেন, “ন্যা, ন্যাঃ, পড়ার প্রবৃত্তিও হয়নি। আমাদের শিক্ষাদপ্তরের মাথা
মাথা লোকেরা অনেক মাথা ঘামিয়ে আমাদের পাঠ্য বইয়ের সিলেবাস বানান। তাঁরা বুঝে শুনে
বেছেবুছে কয়েকটি স্যাম্পল আমাদের পড়ার জন্যে সিলেক্ট করে থাকেন। বলি, ভাত রাঁধতে
গিয়ে তুমি কী হাঁড়ির সব চাল টিপে টিপে দেখ? বলো না, কটা চাল টেপ?”
“আজ্ঞে দু একটা”।
“অ্যাঅ্যাঅ্যাই...তারপর ধরো মাংস
রান্নার সময়, সব মাংসের টুকরো কী চেখে চেখে দেখ, সেদ্ধ হল কী না, তেল-মশলা-নুন
ঠিকঠাক হল কী না?” নিখিল অসম্মতিতে ঘাড় নাড়তে অজিতবাবু বললেন, “ঠিক সেরকম, ওই
স্যাম্পলগুলি মন দিয়ে পড়লেই বোঝা যায় কার কত দৌড়, বুঝলে না? আমার আবার
পল্লবগ্রাহীতা ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ নয়, আমি যাই অনেক গভীরে ডিপরুটেড শেকড় পর্যন্ত।
আর সেভাবেই পড়ে বুঝতে পেরেছি, আর কিছু পড়ার দরকার নেই! শুনেছি রবিঠাকুর তাঁর সারাজীবনে
গাদা-গুচ্ছের লিখেছেন! তিনি অনর্থক খেটেছেন বলেই, আমাকেও সময় নষ্ট করে, সব পড়তে
হবে, তুমি কী আমাকে অতই আহাম্মক ঠাউরেছ?”
“আজ্ঞে না, আপনি পাঁচটা কোম্পানির
ডিরেক্টর, আপনার কত দায়িত্ব...”।
“রাবিশ। পাঁচটা নয় সাত-সাতখানা
কোম্পানির আমি ডিরেক্টর”।
“স্যরি স্যার, ভুল হয়ে গেছে”।
“স্যরি বললেই হয়ে গেল? অবিশ্যি
তোমাকেই বা বকাবকি করে লাভ কী? বাঙালী ঘরেই তো তোমার জন্ম, তোমার আর দোষ কী?
বাঙালীরা ইংরিজির সব কিছু সরিয়ে, “স্যরি”-টুকুকেই সার মেনেছে! বলি পড়াশুনো কোথায়
করেছো, নিশ্চয়ই বাংলা মিডিয়মে”?
“আজ্ঞে হ্যাঁ, প্রমদারঞ্জন মাল্টিপার্পাস
হাইস্কুল”।
মুখ টিপে হেসে অজিতবাবু বললেন,
“ওই ভুলটা আমি আর করিনি, আমার নেক্সট জেনারেশনকে আমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়েছি।
নিজের পুত্র এবং কন্যা বলে গর্ব করছি না, তারা সত্যিই মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। ইংরিজিতে
তারা যখন কথা বলে, কে বলবে তারা সায়েবের বাচ্চা নয়! ওরা ভাইবোনে নিজেদের মধ্যে
ইংরিজিতেই কথা বলে, আর যখন তারা গল্প করে, আমি যে আমি এত ইংরিজি ভক্ত, সেও কেমন
ভ্যাবলা মেরে থাকি। আফটার অল আমারও তো ব্যাকগ্রাউন্ড ওই বাংলা মিডিয়াম কী না? এই
বয়েসে এখনও একটা কমপ্লেক্স কাজ করে, আর কী!”
“এই কমপ্লেক্সকে কম বলে ছোট করবেন
না, স্যার, বরং বেশিপ্লেক্সই বলুন”!
নিখিলের মন্তব্যে কান না দিয়ে
অজিতবাবু বলতেই লাগলেন, “আমার পুত্রকন্যা দুজনেই বাংলা লিখতেও পারে না, পড়তেও পারে
না। বলতে পারে, বাট তাতে এত হিন্দি আর ইংরিজি থাকে...তাকে বাংলা না বলাই ভালো।
একটা কথা তো স্বীকার করবে, বাংলা হচ্ছে আদতে ছোটলোকের ভাষা। চাষাভুষো, কেরানি-মজুরদের
ভাষা, আমজনতার ভাষা! সে ভাষা ভদ্র, অ্যারিস্টোক্র্যাট, ব্লুব্লাড সমাজে একেবারেই
অচল”।
এই সময় নিখিলের মোবাইলটা বেজে
উঠল, ফোন তুলে পর্দায় দেখল, পরির কল। নিখিল অজিতবাবুর থেকে ইশারায় অনুমতি নিয়ে ঘরের বাইরে
বারান্দায় এল, অজিতবাবুর ব্যাপারটা খুব যেন মনঃপূত হল না, তাঁর কথা বলার বেশ একটা
মুড এসেছিল, তাতে বাধা পড়াতে নাক-মুখ কুঁচকে “হুঁ” বললেন।
ফোন কানেক্ট করে নিখিল বলল, “তুই
কোথায় রে? তোদের বাড়িতে কতক্ষণ এসে বসে আছি, আর তোর দেখা নেই”!
“ও মা, তাই? নীচেয় কী করছিস?”
“তোর বাড়িতে এমন একটা জিনিষ আমদানি
করেছিস, আগে বলবি তো! ওফ জান কয়লা করে দিল, মাইরি”।
“কেন বল তো?”
“তোদের বসার ঘরে ঢোকামাত্র এক
ভদ্রলোকের খপ্পরে পড়েছি, এর চে কোন টেররিস্টের পাল্লায় পড়লেও শান্তিতে থাকতাম”।
“কে? কাকু? এঃ রাম। তোকে তো বলাই
হয়নি। তুই এক কাজ কর, সিঁড়ি দিয়ে একদম ছাদে চলে আয়!”
“ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পালানোর থেকে,
সামনের সদর দরজা দিয়ে পালানো সহজ নয়?”
“আঃ বাজে বকিস না, যা বলছি শোন।
চটপট ছাদে আয় ”।
ফোনটা কেটে দিল পরি। নিখিল আর সময়
নষ্ট না করে একবার বসার ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে, জোড়া জোড়া সিঁড়ি টপকে দৌড়ে উঠে
গেল ছাদে। পরি দাঁড়িয়েছিল সিঁড়ির মাথায়। নিখিলের হাত ধরে ছাদের এক কোণে নিয়ে গিয়ে
বলল, “কাকু কী বলছিলেন, রে তোকে?”
“এই কী তোর সেই কাকু? যার
প্রশংসায় তুই একেবারে পঞ্চমুখ!”
“হ্যাঁ। ছোটবেলায় আমাদের বাবা-মা
মারা যাবার পর, উনিই আমাদের দুই ভাইবোনকে নিজের ছেলেমেয়ের মতো মানুষ করেছেন।
আমাদের জন্যে বিয়ে-থাও করেননি। ভাবা যায়?”
“সে কী? উনি যে বললেন, ওঁনার
ছেলে-মেয়েকে ইংরিজি মিডিয়ামে পড়িয়ে চৌখোস সায়েব বানিয়েছেন!”
পরি ভীষণ অবাক হয়ে বলল, “যাঃ,
কাকু তোকে তাই বলেছে?”
“তবে? তার ওপর তুই বলেছিলি উনি
নাকি বিরাট পণ্ডিত লোক, প্রচুর পড়াশুনো...কিন্তু এত ভুলভাল ভাঁট বকেন কেন? তুই
বলেছিলি, উনি এলাহাবাদ না কোথাকার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর...কিন্তু উনি তো বললেন,
উনি সাতটা কোম্পানির ডিরেক্টার!”
“কোম্পানীর ডিরেক্টার? কাকু
বলেছেন? তোকে? কী বলছিস?”
“হ্যাঁরে বাবা, তা নাহলে আমি জানব
কী করে? তাছাড়া ওঁনার বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের ওপর এত আক্রোশ কেন বল তো?”
পরি নিখিলের কথা শুনে এত অবাক হল
যে, হাঁ করে তাকিয়ে রইল নিখিলের মুখের দিকে। মাথায় হাত দিয়ে বলল, “দাঁড়া দাঁড়া,
তুই যা বলছিস কাকুর সম্বন্ধে, তাতে আমার মাথা ঘুরছে...কিছুই বুঝতে পারছি না”!
এই সময় পরির মোবাইলে রিং হল, পরি ফোন তুলে দেখল কাকু কল করেছেন। কানেক্ট করে বলল, “হ্যাঁ কাকু, বলো”। তারপর অনেকক্ষণ শুনল, নিখিল পরির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, মনে মনে ঠিক করল, এমন পাগল আর ভণ্ড লোকের হাত থেকে পরিকে বাঁচাতেই হবে!
“....”
“কাকু, কাকু তুমি যে কী না...”
পরির কথায় নিখিল মনে মনে শূণ্যস্থান পূরণ করল, ...যন্তোর জিনিষ একখানা!
“....”
“হা হা হা হা ... সত্যি তুমি
পারোও কাকু। আমাকে অব্দি চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে! হা হা হা হা... ”। পরির হাসি যেন আর থামতেই
চায় না, দেখে নিখিলের গা জ্বলে উঠল।
“....”
“আসছি, আসছি। হ্যাঁ গো, দুজনেই
আসছি”। ফোনটা অফ করে, পরি নিখিলের মুখের দিকে তাকালো, তারপর আবার হাসতে লাগল
খুব...।
নিখিল একটু রেগেই গেল, “কী এত
হাসছিস বলতো হ্যা হ্যা করে, এত হাসির কী হল?”
পরি নিখিলের হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে
নামতে নামতে বলল, “কাকু আমাদের এক্খুনি নীচেয় ডাকছে...চল...”।
নিখিল থমকে গেল, বলল, “না, আমি আর
যাবো না ওই মালের কাছে?”
পরি হাসতে হাসতেই বলল, “তুই আমার
কাকুকে মাল বললি? নীচেয় চল, তারপর তোর হচ্ছে”।
প্রিয় কাকুকে “মাল” বলা সত্ত্বেও
পরিকে হাসতে দেখে নিখিল খুব অবাক হল, তার ওপর পরি তার হাত ধরে টানছিল, তাই নিচেয়
নামতে বাধ্য হল।
নীচের বসার ঘরে ঢুকে, পরি বলল, “এই যে কাকু তোমার পালিয়ে যাওয়া আসামী” বলেই হাসতে লাগল ওড়নায় মুখ চেপে। অজিতবাবুও হো হো করে কিছুক্ষণ হাসলেন, তারপর হাসতে হাসতেই বললেন, “আরে বসো, বসো, নিখিল। পুরো ব্যাপারটা তোমায় এখন খুলেই বলি, পরি তো সেই কবে থেকে তোমার প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ...হা হা হা হা ... ওই দেখ, কেমন লজ্জা পাচ্ছে মেয়েটা...হা হা হা ...তুই এখন এ ঘর থেকে যা, নিখিলের জন্যে মিষ্টি-টিষ্টি নিয়ে আয় আর সবার জন্যে চা...বেচারা খুব বিভ্রান্ত... হা হা হা ... ওর সঙ্গে ততক্ষণ আমার প্রাইভেট টকটা সেরে নিই”।
পরি রান্নাঘরে চলে যেতে কাকু,
নিখিলের দিকে তাকিয়ে মজা পাওয়া মুখে বললেন, “এই ক’ বছরে, পরির মুখে তোমার এত
প্রশংসা শুনেছি, সে আর বলার নয়! তোমার নাকি এত বুদ্ধি, তত বুদ্ধি। লেখাপড়ায় ভালো।
তার পরে এই লেখ, সেই লেখ। আমার পরিকে তুমি এই ভালোবাস, সেই ভালোবাস। সে সব শুনে আমার খুব
হিংসে হত, বুঝলে, ভীষণ হিংসে! ভাবতাম আমার সেই ছোট্ট মেয়েটা তার প্রিয় কাকু ছাড়াও এমন
কোন্ ছেলে পেল, যে একেবারে তার মাথা ঘুরিয়ে দিল। তাই এবারে ঠিক করেছিলাম, তোমাকে
বাজিয়ে দেখবো। তোমাকে আগে থেকে কিছু বলতে, পরিকে আমিই মানা করেছিলাম। পরির সঙ্গে
আমার চ্যালেঞ্জ ছিল, তোমাকে বোকা না বানাতে পারলে আমি তোর কাকুই নই”!
অজিতবাবুর গলাটা আবেগে কেমন যেন
কেঁপে উঠল, আবেগের সেই সংক্রমণে নিখিলও অভিভূত। সশ্রদ্ধ চোখে সে অজিতবাবুর মুখের
দিকে তাকিয়ে রইল, কোন কথা বলল না। নিজেকে সামলে নিয়ে অজিতবাবু আবার বললেন, “আজ সকালে
ফ্লাইটে আসার সময় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল, বুঝলে? আমার পাশের সিটে বসেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের
বিখ্যাত শিল্পপতি, ভদ্রলোকের নামটা আর বললাম না, সে আর তোমাদের জেনে কাজ নেই! আলাপ
হবার পর, একঘন্টার জার্নিতে তিনি যা যা বলেছিলেন, সেই কথাগুলোই আমি একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তোমাকে বলে কেমন চমকে দিলাম, বলো?” তারপর একটু থেমে হাসি হাসি মুখে আবার
বললেন, “নিজের মূর্খামিকেও কী ভাবে গভীর পাণ্ডিত্যের অহঙ্কারে মুড়িয়ে বাতেলা দেওয়া
যায়, ভদ্রলোকের কাছে শেখার আছে বৈকি! তবে তোমার
সব লেখাই আমি পড়েছি, মানে পরিই পড়িয়েছে... আয়াম প্রাউড অফ ইউ, নিখিল।”
এই সময় পরি একটা ট্রেতে কিছু
স্ন্যাক্স আর তিন কাপ চা নিয়ে ঘরে এল। অজিতবাবু তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছ্যাঃ, শুধুই
স্ন্যাক্স, মিষ্টি-টিষ্টি কিচ্ছু নেই? তোদের দুজনের যে একই সঙ্গে প্রমোশন হচ্ছে,
সেই আনন্দে কিছু খাওয়া-দাওয়া হবে না?”
পরি ও নিখিল একসঙ্গে অবাক হয়ে বলে
উঠল, “প্রমোশন?”
কাকু দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে
ঝাঁপালো দুই ভুরু নাচিয়ে বললেন, “তুমি ছিলে বয়ফ্রেণ্ড, আর তুই গার্লফ্রেণ্ড, খুব
শিগ্গিরি হবি পতি-পত্নী, এটা যদি প্রমোশন না হয়, তাহলে আর কোনটা প্রমোশন?” বলেই
হা হা হা হা করে হাসতে লাগলেন প্রাণ খুলে।
নিখিল আর পরি দুজনেই অজিতবাবুকে
প্রণাম করল।
নিখিল অস্ফুট গলায় বলল, “কাকু
আপনি রিয়্যালি গ্রেট”।
অজিতবাবু নিখিলের কাঁধে হাত রেখে
বললেন, “ইউ টু”!
পরি কাকুর পাশে সোফার হাতলে বসে,
কাকুর গলা জড়িয়ে ধরল, অজিতবাবু পরির মাথায় হাত রেখে বললেন, “আমার খেপি মাটা, আমার
পাগলি মাটা”, বলতে বলতে আনন্দে তাঁর দুচোখ ঝাপসা হয়ে এল।
..০০..
খুব ভালো লাগল। মধুর সমাপ্তি।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ, ভাই
উত্তরমুছুন