গতকাল সময় হয়নি, আজ সকালে ঘুম ভাঙার পরেই মণিমাসি আর সুভামাসি পান্নাকে
তুলে আনল, নদিদির কোলের কাছ থেকে। পান্না জেগেই ছিল, মায়ের কোলের কাছে শুয়ে হাতপা
ছুঁড়ছিল, আর মুখে নানান আওয়াজ করছিল। মণি যখন তাকে হুস করে কোলে তুলে নিল, প্রথমে
একটু অবাক হলেও কাঁদল না, মুখের কাছে দু হাত নিয়ে, দেখতে লাগল, মণিমাসির মুখের
দিকে। পান্নাকে নিয়ে মণিমাসি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে সুভামাসি খুব আস্তে ভেজিয়ে দিল
ঘরের দরজাটা।
কুঠুরি ঘরের লম্বা পিঁড়েয় এসে, পান্নাকে কোলে নিয়ে বসল মণিমাসি। সুভামাসিও তার পাশে বসে ঝুঁকে
দেখতে লাগল পান্নাকে। তাদের সামনে ওষুধের বাক্স। তার মধ্যে সাদা তুলো, বোরিক তুলো।
টিংচার আয়োডিনের ছোট্ট শিশি। ডেটলের শিশি। অ্যান্টিব্যাক্ট্রিনের শিশি। সিবাজল
পাউডার। ছোট্ট কাঁচি। ব্যাণ্ডেজের কাপড়। টুকটাক আরো কিছু ওষুধ আর জিনিষপত্র।
মণিমাসি খুব সন্তর্পণে পান্নার বাঁ হাতের অনামিকায় জড়ানো ন্যাকড়ার
বাঁধনটা খুলতে চেষ্টা করল। চারদিন আগের বাঁধা মোক্ষম গিঁট খোলা যাচ্ছিল না।
সুভামাসি ঝুঁকে দেখতে দেখতে বলল, “কাঁচি দেব? কেটে দে, দিদি। ও গিঁট আর খোলা যাবে
না”। বাঁ হাতটা চেপে ধরাতে পান্না বিরক্ত হচ্ছিল, জোর করছিল ছাড়ানোর জন্যে আর মুখে
আওয়াজ করছিল, ঠোঁট সরু করে।
“তাই দে”।
কাঁচি দিয়ে গিঁটটা কেটে ফেলার পর, শাড়ির ফালির পরত খুলে আসতে লাগল। দু
তিন পাক খোলার পর পান্না টের পেল ব্যথাটা। শুকনো রক্ত আর পুঁজে ক্ষতস্থানে আটকে
গিয়েছে ন্যাকড়ার ফালি। টেনে খুলতে গেলেই সে ব্যথা পাচ্ছে। ডান হাত ছুঁড়ে সে মণিমাসির হাতে ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল এবার।
গতকাল দুপুর থেকে যে শিশুর কান্না একবারও শোনা যায়নি, সেই কান্নার আওয়াজে বাড়ির
অন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠে, ভোরের ঘুম ভেঙে বেরিয়ে আসতে লাগল, ঘর ছেড়ে।
মণিমাসি পান্নার চোখে চোখ রেখে বলল, “কট্টো দিয়ে ফেলেচি, বাবু? আহারে,
মরে যাই। সুভা, এক কাজ কর, এভাবে হবে না, ছোট্ট বাটিতে খানিকটা গরম জল কর। গরম জলে
না ভেজালে এ ন্যাকড়া খোলা যাবে না”। সুভা দ্রুতপায়ে অ্যালুমিনিয়মের বাটিতে জল
নিয়ে, কেরোসিনের স্টোভ জ্বালতে বসল।
পান্নার বড়োমামা হন্তদন্ত হয়ে, বারান্দায় এসে বললেন, “তোরা ছেলেটাকে
নিয়ে কী করছিস বলতো? অ, আঙুলটা? ন্যাকড়াটা খোলা যাচ্ছে না?” তিনিও এসে মণিমাসির
পাশে বসলেন। “সুভা গরমজল করছিস? গুড। গরমজলে তুলো ভিজিয়ে, ফোঁটা ফোঁটা ফেললে, ন্যাকড়াটা
খুলে আসবে”।
“তাই করবো। সুভা জলটা নিয়ে আসুক”। পান্নার দিদিমা খুব ভোরে উঠে বাইরে
যান, তিনি ফিরে এসে পান্নাকে নিয়ে ওদের বসে থাকতে দেখে অবাক হলেন। তারপর ব্যাপারটা
বুঝতে পেরে, রান্নাঘরে গিয়ে একটা সাঁড়াশি নিয়ে এলেন। সুভাকে সেটা দিয়ে বললেন, “এই
সাঁড়াশি নে, জলে বুড়বুড়ি কাটছে, ওতেই হবে। নামিয়ে ফেল। ফুটন্ত জল কচি হাতে সইতে
পারবে কেন? হাঁদা মেয়ে, জল গরম করতে বসেছিস আর সাঁড়াশি নিসনি? জল গরম হলে, হাত
দিয়ে ধরতে পারবি? বোনপোর হাত দেখতে গিয়ে, নিজের হাত পোড়াবি?”
গরম জলের মধ্যে বোরিক তুলোর টুকরো ভিজিয়ে, ন্যাকড়ার ওপর টুপ টুপ জল
ফেলতে লাগল সুভামাসি, আর মণিমাসি অতি সন্তর্পণে ছাড়াতে লাগল ন্যাকড়ার ফালি।
ততক্ষণে কলুমাসিও চলে এসেছে।
বড়োমামা বললেন, “কলু এক কাজ কর দেখি, আমার ঘর থেকে একটা ঝুমঝুমি নিয়ে
আয়, চোখের সামনে আওয়াজ করলে, কিছুটা আনমন হবে”। কলুমাসি দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এল, আর উবু
হয়ে বসে সে নিজেই বাজাতে লাগল পান্নার চোখের সামনে। পান্না ডানহাত বাড়ালো সেটা
ধরার জন্যে, সত্যি বাঁহাতের দিকে এখন আর তার লক্ষ্য নেই।
ন্যাকড়ার ফালি সরাতেই সকলেই চমকে উঠলেন আঙুলের অবস্থা দেখে এবং
দুর্গন্ধে! পান্নার মা, বাবা, দাদা হীরুও ততক্ষণে চলে এসেছে।
পান্নার দিদিমা খুব বিরক্ত হলেন মেয়ের ওপর, বললেন, “এ কিন্তু তোর খুব অন্যায়,
সোনা। এইটুকু একটা ছেলে, তার হাতটার এই অবস্থা করে রেখেছিস? ছি ছি ছি। দুটি মাত্র
ছেলে। তাদের দিকেও তোর চোখ দেবার সময় হয় না?” সোনা নিজেও খুব অপরাধী বোধ করছিলেন,
তিনি কোন উত্তর দিলেন না, অপলক তাকিয়ে রইলেন ছেলের মুখের দিকে।
“বলি, ঘরের কাজ আগে করবি, না ছেলেকে দেখবি? আমিও তো বাছা তোমাদের
আটবোন, দুই ভাইকে বিইয়েছি, বড়ো করেছি, আবার ঘরের কাজও সেরেছি। কই এমন তো হয়নি
কোনদিন?” কিছুক্ষণ থেমে আবার বললেন, “তোর শাশুড়িকেও বলিহারি। বাবা, অচ্যুত কিছু
মনে কোর না। কচি নাতি, সবে এই এক বছর পূরল, তাঁরও কী একবার মনে হয়নি,
নাতির হাতটা একবার দেখি। ছি ছি ছি। সংসারে থেকে পুজো, পাব্বণ, ব্রত, উপোস-তাপাস
করে কী লাভ? যদি নিজের লোকেদের কোন কাজেই না আসি? তার থেকে সব ছেড়ে ছুড়ে সন্নিসি
হয়ে চলে গেলেই হয়”।
বড়োমামা দিদিমাকে বললেন, “মা, চুপ কর, ছেড়ে দাও। যা হবার তো হয়েছে, এখন
আর ওসব বলে কী লাভ? মণি, সুভা, গরম জল দিয়ে আলতো মুছে নে জায়গাটা। কাঁচা ডেটল
দিয়ে, বেঁধে দিয়েছিলি, না রে, সোনা? চারপাশটা পচে হেজে গেছে। এইটুকু বাচ্চার
চামড়ায় কাঁচা ডেটল সহ্য হবে কেন?”
দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন কী করবি? করুণাসিন্ধুকে একবার ডাকবি নাকি?
এসে একবার দেখে যাক”।
“করুণামামা তো নেই, গতকাল বর্ধমান গেছেন, ফিরবেন সেই বুধ বা বেষ্পতিবার”। করুণাসিন্ধু এলএমএফ
ডাক্তার, গ্রামেরই মানুষ। হাতযশ ভালোই, ডাকতে, হাঁকতে পাওয়াও যায়।
“তাহলে?”
“দেখি, একটু বেলায় মহিমকাকাকে বলে হোমিওপ্যাথি যদি কিছু দেন। কাল সকাল
অব্দি কেমন থাকে দেখি, সেরকম হলে মাঝের গাঁ নিয়ে যাবো। মণি, এবার খুব হাল্কা করে,
এই এতটুকু টিংচার আয়োডিন জলে ফেলে, সেটা দিয়ে জায়গাটা ভিজিয়ে দে। ব্যস ব্যস, দু
ফোঁটা আর না। এবার তুলোটা ভিজিয়ে, চিপে নে। হ্যাঁ, এবার থুপ থুপ করে। আমি তো বলবো মা, এই
ছেলেটাই হাবা। এমন অবস্থা হাতের, ব্যথা লাগছে না? অন্য কোন বাচ্চা হলে, চিল চিৎকার
করে পাড়ার লোকের ঘুম ছুটিয়ে দিত। হ্যাঁ, হয়েছে, এবার একটু শুকুতে দে, একদম শুকনো”।
সুভোমাসি আর মণিমাসি শুকোনোর কথায় হাল্কা ফুঁ দিতে দুজনেই নীচু হতে গেল, আর তাদের
মাথায় মাথায় ঠোক্কর লাগল, ঠক। দুজনেই দুজনের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে মাথায় হাত
বোলাতে লাগল।
বড়মামা হা হা হেসে বললেন, “বোনপোর আঙুল, দুই মাসির মাথায় এবার শিং
গজিয়ে ছাড়বে, নে নে আরেকবার ঠুকে নে। তারপর দেখ শুকোলো কিনা”? দুই বোনে আরেকবার
হালকা মাথা ঠোকার পর, মণিমাসি বলল, “হ্যাঁ, শুকিয়েছে”।
“গুড। এবার কাটা জায়গাটাতে সিবাজল পাউডার ছড়িয়ে দে হালকা করে, তারপর ওখানটা
ছোট্ট একটা গজের টুকরোয় চাপা দিয়ে, ব্যাণ্ডেজ করে দে। ব্যাণ্ডেজটা তিন, চার পরতের
বেশি যেন না হয়”। মণিমাসি আর সুভামাসী অত্যন্ত মনোযোগে পান্নার আঙুলের সেবা করছিল
যখন, তখন পান্না মণিমাসির চুলের একটাগুছি ডান হাতের আঙুলে জড়িয়ে, মুখে নেবার
চেষ্টা করছিল বারবার। আর আঙুলে ব্যথা লাগলে চমকে উঠে মুখ বেঁকিয়ে কান্নার ভঙ্গি
করছিল।
পুরো ব্যাপারটা হয়ে গেলে, সুভামাসি খুব করুণ মুখ করে বলল, “আমার কোলে একবার
দে না, দিদি”।
পান্নার দিদিমা বললেন, “নিবি বাছা, নিবি। পান্না কিছু পালিয়ে যাচ্ছে
না। এখন ওকে সোনার কোলে দে, একটু খাক। আর শোন, রোজ সকালে একবার করে, আঙুলটা খুলে
দেখবি, কেমন আছে। তারপর ওষুধ দিয়ে আবার ব্যাণ্ডেজ করে দিবি। এই সময় করুণাসিন্ধু আবার
কোন চুলোয় গেল কে জানে! দরকারের সময়ে কাউকে পাওয়া যায় না”।
এতক্ষণ, সোনা অপরাধীর মতো বসেছিলেন মণিমাসির পিছনে, একটা কথাও বলেননি। সমস্ত
মনপ্রাণ দিয়ে চাইছিলেন, নিজেই ছেলের এই সেবাটুকু করতে, অথচ সংকোচে বলতে পারছিলেন
না। এখন মায়ের কথায়, অধীর আগ্রহে, পান্নাকে নিজের কোলে তুলে নিলেন। বুকের মধ্যে
চেপে ধরে, পান্নার গালে গাল ঠেকালেন। হঠাৎ যেন ভারি হয়ে উঠল তাঁর দুই স্তন, আঁচলের
মধ্যে পান্নাকে নিয়ে, তার মুখে তুলে দিলেন বৃন্ত। এখন তাঁর পাশে তিন বোন, মা আর
বৌদি ছাড়া আর কেউ নেই। সোনা আঁচল সরিয়ে, পান্নার মুখের দিকে তাকালেন। তার রেশমের
মতো কোমল চুলে হাত বোলাতে বোলাতে তাকিয়েই রইলেন। উষ্ণ দুধের তৃপ্তিতে শিশুর চোখ
বুজে আসছে।
মাঝে মাঝে
শ্বাস নেওয়ার বিরতিতে, সে চোখ মেলে দেখছে মায়ের মায়াবি মুখখানি। তার চোখে ঘুম
জড়িয়ে আসছে, নিশ্চিন্ত ঘুম। সোনার ঠোঁট কাঁপছে। তিনি মনে মনে বললেন, এভাবে কষ্ট
পাচ্ছিস, একবার বলতেও তো পারতিস মাকে। কথা বলতে পারিস না, গলা ছেড়ে কাঁদতেও তো
পারতিস, বাবা! এত্তো, এত্তো অভিমান মায়ের ওপর! বোনেদের সামনে তিনি চাইছিলেন না,
কিন্তু সামলাতে পারলেন না নিজেকে। তাঁর দুচোখ উপচে নেমে এল অশ্রু।
সুভামাসি বলে উঠল, “এ মা, ও ন’দি, কাঁদছিস কেন?”
পান্নার দিদিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, উঠে যাওয়ার সময় বললেন, “কাঁদবে বইকি,
বাছা। কাঁদুক, মনটা হাল্কা হোক। মা হওয়া কী মুখের কথা বাছা? সে তোরা এখন বুঝবি না,
বুঝবি পরে। তোরা যা, ওষুধপত্র সব যথাস্থানে তুলে রাখ। বৌমা চলো, আমরা চান সেরে
আসি, জামাই আছে, তার জলখাবারের যোগাড় করতে হবে। অনেক কাজ। সোনা এখন ছেলেকে নিয়ে একলাই থাকুক। হীরু, তুই বাবা বোস,
মায়ের কাছে”।
..০০..
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন