প্রায় মাস তিনেক হল, আমার বোন ছুটির একটি মেয়ে হয়েছে জেনেও, ওদের বাড়ি যেতে পারিনি। খুবই খারাপ লাগে। কিন্তু কিছু করারও ছিল না। তার কয়েকদিন আগেই মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে হাসপাতাল, ডাক্তার, ওষুধ আর দৌড়োদৌড়িতেই ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। তারপর যা হল, সে তো আরও ভয়ংকর। মা চলেই গেলেন। সে সময়টা যে কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছি, ভাবলে এখনও মন খারাপ হয়ে যায়। সব কাজকর্ম, শ্রাদ্ধশান্তি একা হাতেই সামলাতে হল। ওই সময় ছুটি আর আমার ভগ্নীপতি, বিভাস পাশে থাকলে, একটু মনের জোর পেতাম। কিন্তু ছুটির সে সময় আসার উপায় ছিল না। বিভাস একদিন এসেছিল কিন্তু থাকতে পারেনি। সকালে এসে রাত্রের ট্রেনেই ফিরতে হয়েছিল তাকে। ছুটির এই সময়ে, তাকে ছেড়ে বিভাস থাকবেই বা কী করে?
মায়ের অসুস্থতা আর ওই শ্রাদ্ধশান্তির কাজে বেশ কিছুদিন অফিস কামাই
হয়েছিল। কাজেই হুট করে আবার ছুটি নিয়ে ছুটির কাছে যাওয়াটা সম্ভব হচ্ছিল না।
উপরন্তু পাড়ার বয়স্ক কজন উপদেশ দিলেন, মা হচ্ছেন মহাগুরু। মায়ের মৃত্যু মানে
মহাগুরু নিপাত। এই সময় একটু সাবধানে চলাফেরা করা উচিৎ। তাছাড়া এই অবস্থায় সদ্যজাতা
শিশুর কাছেও যাওয়াটা নাকি উচিৎ নয়। মন থেকে বিশ্বাস না করলেও, একটু ভয়ই পেয়েছিলাম।
সে সময়ের মানসিক দুর্বলতার জন্যেই বোধ হয়, মনে হয়েছিল, আমার বোনের বা তার মেয়ের
কোন অমঙ্গল যদি সত্যিসত্যিই ঘটে যায়!
আসলে মা যেদিন মারা গেলেন, তার দশদিন পরেই ছুটির মেয়ে হল। বোনের
শাশুড়িমা নাতনীর নাম রেখেছেন, টিপ। টিপের জন্মের সময়ে কিছু জটিলতা হওয়ায়, ছুটিও
বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এখন অনেকটাই সেরে উঠেছে, কিন্তু তাও ট্রেন জার্নির এতটা
ধকল নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মচলন্দনগর থেকে জলপাইগুড়ির
মোহিতপুর, আসা যাওয়ার ধকলটাও তো নেহাত কম নয়। তাছাড়া আমার মা-হারা এই একার সংসারে শিশু মেয়েকে সে
সামলাবেই বা কী করে? বিভাসের মা খুবই মমতাময়ী মহিলা, তিনি ছুটিকে নিজের মেয়ের মতোই
যত্নআত্তি করেন।
যাই হোক ছুটি আর বিভাসের বারবার ডাকাডাকিতে, আমি শেষ অব্দি ওদের বাড়ি
যেতে রাজি হলাম। দিন সাতেকের ছুটি নিয়ে রওনা হলাম জলপাইগুড়ি। পাশের বাড়ির কাকিমাকে
চাবি দিতে গিয়েছিলাম, আমি ছুটি নিয়ে ছুটির বাড়ি যাচ্ছি শুনে খুব খুশি হলেন না,
বললেন, একটা বছর কাটিয়ে গেলে পারতিস। বললাম, ঘুরেই আসি একবার। ছুটি বড্ডো
কান্নাকাটি করছে, বারবার বলছে, দাদা একবারটি আয়।
মোহিতপুর বাসস্ট্যাণ্ডে বিভাস আমার জন্যে সাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। বাস
থেকে নেমে, আমার ব্যাগটা হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে বিভাসের পিছনের উঠে বসলাম। বিভাস
জিগ্যেস করল, “সাইকেলে যেতে পারবি, নাকি রিকশা করবো”? বিভাস আর আমি কলকাতায় একই
কলেজে পড়তাম। খুবই ভালো বন্ধু, তারপর তো ছুটির সঙ্গে ওর বিয়ে হল। আমি একটু হেসে
বললাম, “তোর ঘাড়ে চেপে যাওয়ার মজাই আলাদা, সাইকেল ছেড়ে রিকশায় চড়তে যাবো কোন
দুঃখে?” কথা না বাড়িয়ে বিভাস সাইকেল চালু করল, আমি জিগ্যেস করলাম, “কাল রাত্রে
বলছিলি, টিপের গাটা একটু গরম গরম লাগছে, জ্বর-টর আসেনি তো?”
“নাঃ জ্বর-টর নয়। কিন্তু মেয়েটা কাল প্রায় সারারাতই ঘুমোয়নি। বারবার
আমার নয়তো ছুটির ফোনটা হাতে নিয়ে কী যে বলতে চাইছিল বুঝলাম না। একটু হয়তো শুল, আমরাও
শুলাম। আধঘন্টা না যেতেই উঠে পড়ে, আমাকে নয় ওর মাকে থাবড়া দিয়ে জাগিয়ে ফোন দেখায়”।
“ফোনে কোন গেম-টেম বা সিনেমা দেখে ভালো লেগেছে হয়তো, বারবার দেখতে
চাইছে। আজকাল বাচ্চাদের ফোনের ওপর খুব ঝোঁক”।
“না রে, আমরাও তাই ভেবেছিলাম। খাবার সময় ওকে ভোলানোর জন্যে কয়েকটা
গানের ভিডিও দেখান হয়, সেগুলো দেখিয়ে শান্ত করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখেইনি, বরং
বিরক্ত হচ্ছিল খুব...। অন্য কিছু করতে বলছিল, সেটা কী, বুঝতে বুঝতেই রাত কাবার
হয়ে গেল।”
“বাব্বা, একরত্তি মেয়ের এত কৌতূহল?” কিছুক্ষণ আমরা কেউ কথা বললাম না।
বিভাস সাইকেল চালাতে লাগল। কেন জানি না আমার মনে হল, বিভাস সাইকেলটা খুব আস্তে
চালাচ্ছে, এখনই একদৌড়ে গিয়ে মেয়েটাকে বুকের মধ্যে নিয়ে খুব আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছিল।
বিভাস বড়ো রাস্তা থেকে বাঁদিকের ছোট ঢালু রাস্তায় নামতে নামতে বলল, “আমার মনে
হচ্ছে, তোর আসার অপেক্ষাতেই ও এত ছটফট করছে!”
“যাঃ। আমাকে তো দেখেইনি। চেনেই
না। তাছাড়া তিনমাসের একটা শিশু, মামা কী বস্তু, খায় না মাথায় মাখে বুঝতে পারে
নাকি?”
“তা ঠিক। কিন্তু যেদিন থেকে আমাদের এখানে তুই আসছিস, এ কথা নিয়ে আলোচনা
হচ্ছে, সেদিন থেকেই ও যেন খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছে”।
“তাই?”
“হুঁ। কাল মনে হয়নি। এখন মনে হচ্ছে, মেয়েটা গতকাল ফোনে হয়তো তোর সঙ্গে
যোগাযোগ করতে বলছিল। কদ্দূর এলি, ট্রেন লেট কী না, ট্রেনে খাওয়াদাওয়া কী
করলি...এসব জানার কৌতূহল হচ্ছিল হয়তো!”
“কী বলছিস? এমন হতে পারে নাকি?”
“জানি না, মনে হল, তাই বললাম। হতেও তো পারে”!
আমারও টিপ বলে ছোট্ট একরত্তি ওই মেয়েটাকে দেখার জন্যে মনটা ভীষণ
উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছে।
কিছুটা দূর থেকেই ওদের দেখতে পেলাম। বিভাসের মা, ছুটি আর ছুটির কোলে
ছোট্ট টিপ। গ্রিল-গেটের বাইরেই ওঁরা দাঁড়িয়েছিলেন। বিভাস সাইকেল নিয়ে সামনে
দাঁড়াতেই, বিভাসের মা বললেন, “ওফ্, মেয়ে বটে; অচেনা অদেখা মামাকে দেখার জন্যে কী
ছটফটই না করছে! ঘরে থাকতে দিচ্ছে না”।
ছুটি মিষ্টি হেসে বলল, “আয়। ভাল আছিস, দাদা”?
আমি সাইকেল থেকে নেমে মাসিমা, বিভাসের মাকে প্রণাম করলাম। ছুটির কোল
থেকে টিপ হাত বাড়াল আমার কাছে আসবে বলে। ওকে কোলে নিতে ইচ্ছে হচ্ছিল খুব, কিন্তু
ভয়ও পাচ্ছিলাম। সারারাতের ট্রেন জার্নি, তারপরে ভোরবেলার বাসে এতটা এলাম! সারা
গায়ে – জামাকাপড়ে ধুলোময়লার তো অন্ত নেই। এই অবস্থায় শিশুকে কোলে নেওয়া মোটেই উচিৎ
নয়।
আমি টিপকে বললাম, “একটু দাঁড়াও মা, জামাকাপড় ছেড়ে, মুখহাত ধুয়ে তোমায়
কোলে নেব। বিচ্ছিরি ধুলো আর নোংরা সারা গায়ে”।
বিভাসের মা বললেন, “ঠিক বলেছ বাবা, আমি বলি কি, গরম জলে চানটাও সেরে
নাও, স্বস্তি
পাবে। এতটা পথ জার্নি করে এলে। চলো চলো, ঘরে চলো”।
আমরা সবাই বাড়িতে ঢুকলাম, বিভাস সাইকেলে আমার ব্যাগটা নিয়ে পেছনে আসতে
লাগল।
স্নান সেরে এসে পরিষ্কার পাজামা পাঞ্জাবি পরেই আমি ডাক দিলাম, “কই রে,
আমার টিপ সোনা কই?” ছুটি টিপকে কোলে নিয়ে সামনে এলো, বলল, “ওফ্, মেয়ে সেই থেকে
বাথরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে...কখন তুই বেরোবি। এ রাম, চুল আঁচড়ালি না?” চুল
আঁচড়ানোর কথা আমার মনেই ছিল না, আসলে আমিও টিপকে কোলে নিতে চাইছিলাম, যত তাড়াতাড়ি
সম্ভব।
চুলের ওপর হাত বুলিয়ে বললাম, “ঠিক আছে। কে আর দেখবে এখানে, তোরাই তো।
এচো, এচো, ছোনা মাটা...” বলে হাত বাড়িয়ে খুব সাবধানে আমি টিপকে কোলে নিলাম। টিপও
উদ্গ্রীব ছিল, টুক করে কোলে এসে, আমার গলা জড়িয়ে ধরল। ছুটি হেসে বলল, “বাবাঃ,
মায়ের চেয়েও মামা বেশি আদরের...টিপকে নিয়ে তুই বোস, দাদা, আমি তোর জলখাবার আনছি।
মা, লুচি আর বেগুন ভাজছেন”।
আমি টিপকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললাম, “তাই যা। আমি ততক্ষণ টিপের
সঙ্গে একটু ভাব করি”।
টিপকে কোলে নিয়ে আমি বাইরের বারান্দায় এলাম। এতক্ষণ টিপ আমার গলা জড়িয়ে
কাঁধে মুখ রেখেছিল, এবার সে গলা ছেড়ে আমার মুখের দিকে তাকাল। তার দু চোখের দিকে
তাকিয়ে আমার অদ্ভূত এক অনুভূতি হল। হাল্কা নীলচে সাদা টলটলে চোখের মধ্যে ঘন কালো
চোখের তারা, আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। কী দেখছে? কী খুঁজছে আমার মুখে?
“এত দিন লাগল তোর এখানে আসতে? ছুটি পাসনি, না? এমন আর কক্খনো করিস
না...”।
কে বলল কথাটা? আশেপাশে ঘাড় ঘোরালাম। কেউ কোত্থাও নেই। সামনের ঘাসে আর
গাছের ডালে কিছু চড়ুই, শালিক, ঘুঘু আর কাক ওড়াওড়ি করছে। আমার ঘাড় থেকে শিরশিরে
একটা অনুভূতি পিঠের দিকে নামতে লাগল। এই কণ্ঠস্বর আমার খুবই পরিচিত। ভীষণ পরিচিত।
হাজার লোকের কণ্ঠস্বরের মধ্যেও এই স্বর আমি ঠিক চিনে ফেলতে পারি! আমি টিপের মুখের
দিকে আবার তাকালাম। আগের মতোই সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার পবিত্র পাতলা
রাঙা দুই ঠোঁটে এখন মুচকি হাসি।
“এমন কক্খনো করিস না আর, তোকে দেখতে যে, বড্ডো ইচ্ছে করে, বাবা।
ছুটি-ছাটা পেলেই চলে আসবি, কেমন?”
আমি তাকিয়ে রইলাম শিশুর চোখের দিকে। টিপ কথাগুলো বলেনি। তাঁর দুই ঠোঁট
এতটুকুও নড়েনি। কিন্তু আমার চেতনায় কথাগুলো বেজে উঠল। কীভাবে জানি না। এখন টিপ তার
দুই হাত বাড়িয়ে মোচার ছোট্টছোট্ট কলির মতো আঙুলগুলি রাখল আমার গালে, কপালে।
আমার দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে এল, আমি অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম, “মা”!
টিপ ফোকলা মুখে ছোট্ট ছোট্ট হাত চাপা দিয়ে হেসে উঠল খিলখিল করে, অপূর্ব
স্বর্গীয় সেই হাসি। আমি বুকের মধ্যে চেপে ধরলাম টিপকে। “চিনতে পেরেছিস তাহলে?”
কথাটা স্পষ্ট শুনলাম, আর শুনে আমার দু চোখ ঝাপসা করে নেমে এল অশ্রুধারা!
..০০..
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন