দ্বিতীয় অধ্যায়
প্রথম বল্লী
পরাঞ্চি খানি ব্যতৃণৎ স্বয়ম্ভূস্তস্মাৎ পরাঙ্ পশ্যতি
নান্তরাত্মন্। কশ্চিদ্ধীরঃ প্রত্যগাত্মানমৈক্ষদ্
আবৃত্তচক্ষুরমৃতত্বমিচ্ছন্।। ২/১/১ |
পরাঞ্চি খানি ব্যতৃণৎ স্বয়ম্ভূঃ তস্মাৎ পরাঙ্ পশ্যতি
না অন্তরাত্মন্। কশ্চিৎ ধীরঃ প্রত্যক্-আত্মানম্ ঐক্ষৎ আবৃত্ত-চক্ষুঃ অমৃতত্বম্
ইচ্ছন্।। |
[পরাঞ্চি> বহির্মুখ, খানি> ইন্দ্রিয়সমূহ, ব্যতৃণৎ>সৃষ্টি
করিয়াছেন।] স্বয়ম্ভূ পরমেশ্বর জীবের ইন্দ্রিয়সমূহকে বহির্মুখ করে
সৃষ্টি করেছেন। এই কারণে জীব বাহ্য বিষয়সমূহকেই দেখে থাকে, অন্তরের বিষয় দেখতে পায়
না। কোন কোন জ্ঞানী ব্যক্তি অমৃতত্ব লাভের ইচ্ছায় বাইরের বিষয় থেকে চক্ষু আদি ইন্দ্রিয়সমূহকে
নিবৃত্ত করে, অন্তরের আত্মাকে দর্শন করতে পারেন।
ইন্দ্রিয়সমূহ মানুষের জ্ঞানের দ্বারস্বরূপ। কিন্তু এই দ্বার যেন শুধু বাইরের
দিকেই খোলে – ভেতরের দিকে নয়। সেই কারণে সে কেবল বাইরের জগৎ-লীলা সম্পর্কে অবহিত
হয় – কিন্তু অন্তরের জীবাত্মাকে দেখতে বা উপলব্ধি করতে পারে না। অতএব সে দেহকেই আত্মা
বলে মনে করে এবং কামনা-বাসনায় বিভ্রান্ত হয়ে দেহেরই সেবা করে। প্রকৃতপক্ষে সে অজ্ঞান
এবং জীবন-মৃত্যুর চক্রে বারবার এই মর্ত্য জগতেই ফিরে ফিরে আসে।
পরাচঃ কামাননুযন্তি বালাস্তে মৃত্যোর্যন্তি বিততস্য
পাশম্। অথ ধীরা অমৃতত্বং বিদিত্বা ধ্রুবমধ্রুবেষ্বিহ ন
প্রার্থয়েন্তে।। ২/১/২ |
পরাচঃ কামান্ অনুযন্তি বালাঃ তে মৃত্যোঃ যন্তি
বিততস্য পাশম্। অথ ধীরা অমৃতত্বং বিদিত্বা ধ্রুবম্ অধ্রুবেষু ইহ ন
প্রার্থয়েন্তে।। ২/১/২ |
বালকের তুল্য অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিরা বাইরের কামনার বিষয়সমূহে প্রবৃত্ত থেকে
মৃত্যুর বিস্তৃত জালে আবদ্ধ হয়। কিন্তু বিবেকী ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা অমৃতত্বকে
উপলব্ধি করে, ওই অনিত্য কামনার বিষয় প্রার্থনা করেন না।
যেন রূপং রসং গন্ধং শব্দান্ স্পর্শাংশ্চ মৈথুনান্। এতেনৈব বিজানাতি কিমত্র পরিশিষ্যতে। এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/৩ |
যেন রূপম্ রসম্ গন্ধম্ শব্দান্ স্পর্শান্ চ
মৈথুনান্। এতেন এব বিজানাতি কিম্ অত্র পরিশিষ্যতে। এতৎ বৈ তৎ।। |
যিনি এই আত্মাকে উপলব্ধি করে রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ এবং মৈথুন উপভোগ
করতে পারেন, তাঁর কাছে আর কোন বিষয় জানতে অবশিষ্ট থাকতে পারে? ইনিই (আত্মা) সেই
পরমপদ।
স্বপ্নান্তং জাগরিতান্তং চোভৌ যেনানুপশ্যতি। মহান্তং বিভুমাত্মানং মত্বা ধীরো ন শোচতি।। ২/১/৪ |
স্বপ্ন-অন্তম্ জাগরিত-অন্তম্ চ উভৌ যেন অনুপশ্যতি। মহান্তং বিভুম্ আত্মানং মত্বা ধীরঃ ন শোচতি।। |
স্বপ্ন এবং জাগরণ – উভয় অবস্থাতেই যে আত্মার জন্যে আমরা সবকিছু দেখতে পাই,
সেই মহান আত্মাকে উপলব্ধি করতে পারেন যে জ্ঞানী ও বিবেকী, তিনি কোন কিছুতেই আর
দুঃখ করেন না।
য ইমং মধ্বদং বেদ আত্মানং জীবমন্তিকাৎ। ঈশানং ভূতভব্যস্য ন ততো বিজুগুপ্সতে। এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/৫ |
যঃ ইমম্ মধ্বদম্ বেদঃ আত্মানম্ জীবম্ অন্তিকাৎ। ঈশানম্ ভূতভব্যস্য ন ততঃ বিজুগুপ্সতে। এতৎ বৈ তৎ।। |
যিনি এই কর্মফলভোগী আত্মাকে জীবের ভূত-ভবিষ্যতের নিয়ন্তা রূপে, নিজের
অন্তরে তাঁর উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারেন, সেই ব্যক্তির কাছে আর কোন বিষয়ই গোপন
থাকতে পারে না। ইনিই সেই পরমাত্মা।
যঃ পূর্বং তপসো জাতমদ্ভ্যঃ পূর্বমজায়ত। গুহাং প্রবিশ্য তিষ্ঠন্তং যো ভূতের্ভিব্যপশ্যত। এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/৬ |
যঃ পূর্বম্ তপসঃ জাতম্ অদ্ভ্যঃ পূর্বম্ অজায়ত। গুহাম্ প্রবিশ্য তিষ্ঠন্তম্ যঃ ভূতেভিঃ ব্যপশ্যত। এতৎ বৈ তৎ।। |
জলের আগে যিনি জন্ম নিয়েছেন, প্রথম চিৎশক্তি থেকে যাঁর জন্ম, সর্বজীবের
অন্তরে পঞ্চভূতের সঙ্গে যিনি অবস্থান করেন, সেই আত্মপুরুষকে যিনি দেখেছেন, তিনি
সেই ব্রহ্মকেই দেখেছেন। ইনিই সেই পরব্রহ্ম।
[ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম – এই পঞ্চভূত থেকে জীবের জন্ম, কিন্তু
পঞ্চভূত সৃষ্টির আগে যাঁর জন্ম হয়েছে, তিনিই পরমব্রহ্ম।]
যা প্রাণেন সম্ভবত্যদিতির্দেবতাময়ী। গুহাং প্রবিশ্য তিষ্ঠন্তীং যা ভূতেভির্ব্যজায়ত। এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/৭ |
যা প্রাণেন সম্ভবতি অদিতিঃ দেবতাময়ী। গুহাম্ প্রবিশ্য তিষ্ঠন্তীম্ যা ভূতেভিঃ ব্যজায়ত। এতৎ বৈ তৎ।। |
সর্বদেবতাময়ী অদিতি প্রাণরূপে আবির্ভূত এবং সর্বভূতে সমন্বিত হয়ে, সকল
জীবদেহে প্রবেশ করে অধিষ্ঠান করেন। (যিনি তাঁকে দেখেন, তিনি) সেই ব্রহ্মকেই দেখেন।
[অদিতি নামের অর্থ যিনি শব্দ, ঘ্রাণ, বাক্য ইত্যাদিকে ভোগ করেন, অর্থাৎ
ইন্দ্রিয়ের সকল বিষয়সমূহের উপভোক্ত্রী। প্রাণ পঞ্চভূতের উপভোক্তা – অতএব অদিতি ও
প্রাণ সমার্থক। ]
অরণ্যোর্নিহিতো জাতবেদা গর্ভ ইব সুভৃতো গর্ভিণীভিঃ। দিবে দিব ঈড্যো জাগৃবদ্ভির্হবিষ্মদ্ভির্মনুষ্যেভিরগ্নিঃ। এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/৮ |
অরণ্যোঃ নিহিতঃ জাতবেদা গর্ভঃ ইব সুভৃতঃ গর্ভিণীভিঃ। দিবে দিব ঈড্যো জাগৃবদ্ভিঃ হবিষ্মদ্ভিঃ মনুষ্যেভিঃ অগ্নিঃ। এতৎ বৈ তৎ।। |
গর্ভিণীর কাছে যেমন গর্ভ, দুই অরণির মধ্যে জাতবেদ অগ্নি তেমনই সুরক্ষিত
থাকেন। জাগ্রত-চৈতন্য এবং যজ্ঞকুশল যোগীরা প্রত্যেক দিন সেই অগ্নির আরাধনা করেন।
সেই অগ্নিও এই ব্রহ্ম।
[যাজ্ঞিক ঋষিরা দুই টুকরো কাঠ ঘষে আগুন জ্বালাতেন, তার নাম অরণী। উপরের
টুকরোর নাম উত্তর অরণী এবং নিচের টুকরোর নাম অধর অরণী। “জাতবেদা” শব্দের এক অর্থ
অগ্নি, অন্য অর্থ সৃষ্টির সকল তত্ত্ব যিনি জানেন। অতএব অগ্নিই সেই পরমপুরুষ।]
যতশ্চোদেতি সূর্যোঽস্তং যত্র গচ্ছতি। তং দেবাঃ সর্বে অর্পিতাস্তদু নাত্যেতি কশ্চন। এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/৯ |
যতঃ চ উদেতি সূর্যঃ অস্তম্ যত্র গচ্ছতি। তং দেবাঃ সর্বে অর্পিতাঃ তৎ উ ন অত্যেতি কঃ চন। এতৎ বৈ তৎ।। |
যাঁর থেকে সূর্য উদিত হন, যাঁতে সূর্য অস্ত যান; সকল দেবতা যাঁকে আশ্রয় করে
অবস্থান করেন, কিন্তু কখনই অতিক্রম করতে পারেন না। তিনিই সেই সর্বাত্মক ব্রহ্ম।
যদেবেহ তদমুত্র যদমুত্র তদন্বিহ। মৃত্যোঃ স মৃত্যুমাপ্নোতি য ইহ নানেব পশ্যতি।। ২/১/১০ |
যৎ এব ইহ তৎ অমুত্র যৎ অমুত্র তৎ অনু ইহ। মৃত্যোঃ সঃ মৃত্যুম্ আপ্নোতি যঃ ইহ নানা ইব পশ্যতি।। |
যা কিছু এখানে আছে, তার সব কিছু সেখানে আছে। যা কিছু সেখানে আছে সব এখানেও
আছে। যে এই জগৎকে নানা রূপে দেখে, সেই মৃত্যুর পরেও মৃত্যু লাভ করে।
[ব্রহ্ম জগতের সর্বত্র ব্যাপ্ত, এই জগতে ব্রহ্মের ঊর্ধে বা ব্রহ্মের থেকে
পৃথক কিছুই নেই। যে ব্যক্তি এই জগৎকে ব্রহ্মের থেকে পৃথক (নানা ইব) বিভিন্ন রূপ
মনে করে, সে অজ্ঞানী, তাকে জন্ম-মৃত্যুর সংসারে বারবার ফিরে আসতে হয়।]
মনসৈবেদমাপ্তব্যং নেহ নানাস্তি কিঞ্চন। মৃত্যোঃ স মৃত্যুং গচ্ছতি য ইহ নানেব পশ্যতি।। ২/১/১১ |
মনসা এব ইদম্ আপ্তব্যং ন ইহ নানা অস্তি কিঞ্চন। মৃত্যোঃ স মৃত্যুং গচ্ছতি যঃ ইহ নানা ইব পশ্যতি।। |
এই জগতে ব্রহ্ম থেকে পৃথক কিছুই নেই, এই তত্ত্বটি শুদ্ধ-সংস্কৃত মন দিয়েই
উপলব্ধি করা যায়। যে “জগৎ ব্রহ্মের থেকে যেন পৃথক” এমন দেখে, সে মৃত্যুর থেকেও
মৃত্যুর দিকে যায়।
অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষো মধ্য আত্মনি তিষ্ঠতি। ঈশানো ভূতভব্যস্য ন ততো বিজুগুপ্সতে।। এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/১২ |
অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষঃ মধ্য আত্মনি তিষ্ঠতি। ঈশানঃ ভূতভব্যস্য ন ততঃ বিজুগুপ্সতে। এতৎ বৈ তৎ।। |
দেহের অভ্যন্তরে যে অঙ্গুষ্ঠপরিমিত পুরুষ অধিষ্ঠান করেন, তিনি জীবের
ভূত-ভবিষ্যৎ ও বর্তমানের নিয়ন্তা। এই তত্ত্বটি জানলে সাধক নিজেকে গোপনে রাখতে
পারেন না। ইনিই সেই আত্মা।
অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষঃ জ্যোতিরিবাধূমকঃ। ঈশানো ভূতভব্যস্য স এবাদ্য স উ শ্বঃ। এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/১৩ |
অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষঃ জ্যোতিঃ ইব অধূমকঃ। ঈশানঃ ভূতভব্যস্য স এব অদ্য স উ শ্বঃ। এতৎ বৈ তৎ।। |
সেই অঙ্গুষ্ঠপরিমিত পুরুষ যিনি তিনকালের নিয়ন্তা, তিনি নির্ধূম জ্যোতিঃ
রূপে (অন্তরে) প্রকাশিত। তিনি আজও আছেন, আগামীকালও থাকবেন। ইনিই সেই ব্রহ্ম।
[নির্ধূম মানে বিশুদ্ধ, নির্মল, নিষ্কলঙ্ক।]
যথোদকং দুর্গে বৃষ্টং পর্বতেষু বিধাবতি। এবং ধর্মান্ পৃথক পশ্যংস্তানেবানুবিধাবতি।। ২/১/১৪ |
যথ উদকম্ দুর্গে বৃষ্টম্ পর্বতেষু বিধাবতি। এবং ধর্মান্ পৃথক পশ্যন্ তান্ এব অনুবিধাবতি।। |
পর্বতের দুর্গম শিখরে বৃষ্টি হলে, জলধারা যেমন নানা দিকে প্রবাহিত হয়,
তেমনই যে ব্যক্তি জীবের ধর্ম অনুযায়ী আত্মাকে পৃথক মনে করে, সে ওই বিভেদকেই অনুসরণ
করে।
যথোদকং শুদ্ধে শুদ্ধমাসিক্তং তাদৃগেব ভবতি। এবং মুনের্বিজানত আত্মা ভবতি গৌতম।। ২/১/১৫ |
যথা উদকম্ শুদ্ধে শুদ্ধম্ আসিক্তম্ তাদৃক্ এব
ভবতি। এবং মুনেঃ বিজানত আত্মা ভবতি গৌতম।। |
শুদ্ধ জল
যেমন শুদ্ধজলে পড়লে শুদ্ধই থাকে, হে নচিকেতা, জ্ঞানী ব্যক্তির আত্মারও একই ভাব হয়
(অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্রহ্মভাবই লাভ করেন)।
চলবে...
কৃতজ্ঞতাঃ
উপনিষদঃ শ্রীযুক্ত অতুলচন্দ্র সেন
উপনিষদ গ্রন্থাবলীঃ স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন