মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট, ২০২৫

কঠোপনিষদ - ১/৩


প্রথম অধ্যায়

তৃতীয় বল্লী


ঋতং পিবন্তৌ সুকৃতস্য লোকে

গুহাং প্রবিষ্টৌ পরমে পরার্ধে।

ছায়াতপৌ ব্রহ্মবিদো বদন্তি

পঞ্চাগ্নয়ো যে চ ত্রিণাচিকেতাঃ।। ১/৩/১

ঋতং পিবন্তৌ সুকৃতস্য লোকে

গুহাং প্রবিষ্টৌ পরমে পরার্ধে।

ছায়া-আতপৌ ব্রহ্মবিদঃ বদন্তি

পঞ্চ-অগ্নয়ঃ যে চ ত্রিণাচিকেতাঃ।। ১/৩/১

“সকল দেহে নিজের কর্মের ফলভোগকারী যে দুই পুরুষ হৃদয়ের গুহায় অধিষ্ঠান করছেন, ব্রহ্মবিদগণ এবং যাঁরা পঞ্চ-অগ্নিক ও ত্রিণাচিকেতগণও, তাঁদের রৌদ্র-ছায়ার মতোই সম্পর্কযুক্ত বলেন”

[পরমেশ্বর এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন, সেই কারণে তাঁকে সূূুকৃত বলা হয়৷ জগতে যা কিছু ভগবৎ-ক্রিয়া - তার সবটুকুই শোভন ও সুন্দর এবং কার্যত আনন্দময়। এই আনন্দকেই ঋত বলা হয়েছে। সুকৃত পরমেশ্বর তাঁর সুকৃতি প্রসূত ঋত অর্থাৎ আনন্দ পান - উপভোগ - করেন*।

দুই পুরুষ বলতে জীব ও পরমাত্মা কিংবা জীবাত্মা ও পরমাত্মার কথা বলা হয়েছে। পঞ্চাগ্নির উপাসক গৃহস্থগণ – গার্হপত্য, দক্ষিণাগ্নি, আহবনীয়, সত্য ও অবসথ্য – এই পাঁচ অগ্নি অথবা আকাশ, মেঘ, পৃথিবী, পুরুষ ও স্ত্রী – এই পাঁচ বিষয়কে অগ্নি বলা হয়েছে।]

*রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন - "জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ" অথবা "আমার চোখে তো সকলই শোভন, সকলই নবীন, সকলই বিমল, সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন..." - এ সবই ওই পরমেশ্বর ও তাঁর পরমানন্দের বন্দনা।  


যঃ সেতুরীজানানামক্ষরং ব্রহ্ম যৎ পরম্‌।

অভয়ং তিতীর্ষতাং পারং নচিকেতং শকেমহি।।

১/৩/২

যঃ সেতুঃ ঈজানানাম্‌ অক্ষরং ব্রহ্ম যৎ পরম্‌।

অভয়ং তিতীর্ষতাং পারং নচিকেতং শকেমহি।।

১/৩/২

“সংসার সমুদ্র পার হওয়ার সেতুস্বরূপ মহান যে নাচিকেত অগ্নি এবং ভয়হীন পরপারে পৌঁছোতে ইচ্ছুক জ্ঞানীদের আশ্রয় যে পরমব্রহ্ম - উভয়কেই আমরা জানতে সক্ষম হই”

 

আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু।

বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ।। ১/৩/৩

আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথম্‌ এব তু।

বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহম্‌ এব চ।।

“রথরূপ শরীরের আত্মাকে, রথী বলে জেনো। আরও জেনো, বুদ্ধি সেই রথের সারথি আর মন সেই রথের বল্গা”

 

 

ইন্দ্রিয়াণি হয়ানাহুর্বিষয়াংস্তেষু গোচরান্‌।

আত্মেন্দ্রিয়মনোযুক্তং ভোক্তেত্যাহুর্মনীষিণঃ।। ১/৩/৪

ইন্দ্রিয়াণি হয়ান্‌ আহুঃ বিষয়ান্‌ তেষু গোচরান্‌।

আত্মা-ইন্দ্রিয়-মনঃ-যুক্তং ভোক্তা ইতি আহুঃ মনীষিণঃ।।

“জ্ঞানীগণ ইন্দ্রিয়সমূহকে রথের অশ্ব, বিষয়-সম্পদকে সেই অশ্বদের চারণভূমি বলেন। তাঁরা এই ইন্দ্রিয় ও মন যুক্ত আত্মাকেই ভোক্তা বলেন”

  

যস্ত্ববিজ্ঞানবান্‌ ভবত্যযুক্তেন মনসা সদা।

তস্যেন্দ্রিয়াণ্যবশ্যানি দুষ্টাশ্বা ইব সারথেঃ।। ১/৩/৫

যঃ তু অবিজ্ঞানবান্‌ ভবতি অযুক্তেন মনসা সদা।

তস্য ইন্দ্রিয়াণি অবশ্যানি দুষ্টা-অশ্বা ইব সারথেঃ।।

“যে ব্যক্তির বুদ্ধিরূপ সারথি অজ্ঞানী ও অবিবেকী, যার মন সর্বদা অসংযত, তার ইন্দ্রিয়সমূহ দুষ্ট অশ্বের মতোই সারথির বশে থাকে না”।

 

যস্তু বিজ্ঞানবান্‌ ভবতি যুক্তেন মনসা সদা।

তস্যেন্দ্রিয়াণি বশ্যানি সদশ্বা ইব সারথেঃ।। ১/৩/৬

যঃ তু বিজ্ঞানবান্‌ ভবতি যুক্তেন মনসা সদা।

তস্য ইন্দ্রিয়াণি বশ্যানি সৎ-অশ্বা ইব সারথেঃ।।

“কিন্তু যে জ্ঞানী ও বিবেকী ব্যক্তির মন সর্বদা সমাহিত, তাঁর সংযত অশ্বরূপ-ইন্দ্রিয়সমূহ বুদ্ধিরূপ-সারথির নিয়ন্ত্রণে থাকে। [কখনো বিপথগামী হয় না]”। 

 

যস্ত্ববিজ্ঞানবান্‌ ভবত্যমনস্কঃ সদাঽশুচিঃ।

ন স তৎপদমাপ্নোতি সংসারং চাধিগচ্ছতি।। ১/৩/৭

যঃ তু অবিজ্ঞানবান্‌ ভবতি অমনস্কঃ সদা অশুচিঃ।

ন স তৎপদম্‌ আপ্নোতি সংসারং চ অধিগচ্ছতি।।

“যে অবিবেকী ব্যক্তির মন অসংযত এবং অপবিত্র, সে কখনো পরমব্রহ্মপদ লাভ করতে পারে না, সংসারের বন্ধনেই সে বারবার ফিরে আসে”

 

যস্তু বিজ্ঞানবান্‌ ভবতি সমনস্কঃ সদা শুচিঃ।

স তু তৎ পদমাপ্নোতি যস্মাদ্ভুয়ো ন জায়তে।। ১/৩/৮

যঃ তু বিজ্ঞানবান্‌ ভবতি সমনস্কঃ সদা শুচিঃ।

স তু তৎ পদম্‌ আপ্নোতি যস্মাৎ ভুয়ঃ ন জায়তে।।

“কিন্তু যে জ্ঞানী ও বিবেকী ব্যক্তির মন সর্বদা সমাহিত ও শুচি, সেই ব্যক্তি পরমব্রহ্মপদ লাভ করতে পারেন এবং যার ফলে তাঁকে আর জন্মগ্রহণ করতে হয় না”।

 

বিজ্ঞানসারথির্যস্তু মনঃপ্রগ্রহবান্‌ নরঃ।

সোঽধ্বনঃ পারমাপ্নোতি তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্‌।।

১/৩/৯

বিজ্ঞান-সারথিঃ যঃ তু মনঃপ্রগ্রহবান্‌ নরঃ।

সঃ অধ্বনঃ পারম্‌ আপ্নোতি তৎ বিষ্ণোঃ পরমং পদম্‌।।

 

“যে ব্যক্তির সারথি-রূপ বুদ্ধি বিবেকী, যাঁর বল্গারূপ-মন সংযত, তিনি সংসারের ঊর্ধে পরমবিষ্ণুপদ লাভ করেন”।   

 

ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরা হ্যর্থা অর্থেভ্যশ্চ পরং মনঃ।

মনসস্তু পরা বুদ্ধির্বুদ্ধেরাত্মা মহান্‌ পরঃ। ১/৩/১০

ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরা হি অর্থা অর্থেভ্যঃ চ পরং মনঃ।

মনসঃ তু পরা বুদ্ধিঃ বুদ্ধেঃ আত্মা মহান্‌ পরঃ।

“ইন্দ্রিয়সমূহের থেকে তার বিষয়সমূহ (শোনা, দেখা, স্পর্শ ইত্যাদি) শ্রেষ্ঠ, এই বিষয়সমূহ থেকে মন শ্রেষ্ঠ। কিন্তু মনের থেকেও শ্রেষ্ঠ বুদ্ধি, আর বুদ্ধির থেকেও শ্রেষ্ঠ জীবাত্মা”।

 

মহতঃ পরমব্যক্তমব্যক্তাৎ পুরুষঃ পরঃ।

পুরুষান্ন পরং কিঞ্চিৎ সা কাষ্ঠা সা পরা গতিঃ।।

১/৩/১১

মহতঃ পরম্‌ অব্যক্তম্‌ অব্যক্তাৎ পুরুষঃ পরঃ।

পুরুষাৎ ন পরং কিঞ্চিৎ সা কাষ্ঠা সা পরা গতিঃ।।

 

“এই জীবাত্মা থেকে অব্যক্ত শ্রেষ্ঠ, অব্যক্ত থেকে পরমাত্মা পুরুষ শ্রেষ্ঠ। পরমপুরুষের পরে আর কিছুই নেই, তিনিই সর্বোত্তম, তিনিই পরমগতি”।

 

এষ সর্বেষু ভূতেষু গূঢ়ো আত্মা ন প্রকাশতে।

দৃশ্যতে ত্বগ্র্যয়া বুদ্ধ্যা সূক্ষ্ময়া সূক্ষ্মদর্শিভিঃ।। ১/৩/১২

এষঃ সর্বেষু ভূতেষু গূঢ়ঃ আত্মা ন প্রকাশতে।

দৃশ্যতে তু অগ্র্যয়া বুদ্ধ্যা সূক্ষ্ময়া সূক্ষ্মদর্শিভিঃ।।

এই পরমাত্মা সর্বজীবের আত্মারূপে প্রচ্ছন্ন রয়েছেন, কিন্তু তাও তাঁর প্রকাশ বুঝতে পারা যায় না। কিন্তু সূক্ষ্মদর্শী জ্ঞানীরা একনিষ্ঠ সাধনা ও সূক্ষ্ম চেতনা দিয়ে তাঁকে দেখতে পান”। 

 

যচ্ছেদ্‌ বাঙ্‌মনসী প্রাজ্ঞস্তদ্‌ যচ্ছেজ্‌জ্ঞান আত্মনি।

জ্ঞানমাত্মনি মহতি নিযচ্ছেৎ তদ্‌যচ্ছেচ্ছান্ত আত্মনি।। ১/৩/১৩

যচ্ছেৎ বাক্‌-মনসী প্রাজ্ঞঃ তৎ যচ্ছেৎ জ্ঞান আত্মনি।

জ্ঞানম্‌ আত্মনি মহতি নিযচ্ছেৎ তৎ যচ্ছেৎ শান্ত আত্মনি।।

“প্রাজ্ঞব্যক্তিরা বাক্যাদি সকল ইন্দ্রিয়কে মনে অর্পণ করবেন, তারপর মনকে আত্মজ্ঞানে এবং আত্মজ্ঞানকে জীবাত্মায় অর্পণ করবেন। সেই শান্ত-সমাহিত আত্মাকে পরমাত্মায় সমর্পণ করবেন”।   

 

উত্তিষ্ঠত জাগ্রত

প্রাপ্য বরান্‌ নিবোধত।

ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া

দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।। ১/৩/১৪

উত্তিষ্ঠত জাগ্রত

প্রাপ্য বরান্‌ নিবোধত।

ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া

দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।।

“ওঠো (আত্মজ্ঞান লাভের জন্য উন্মুখ হও), (মোহনিদ্রা থেকে) জাগো, শ্রেষ্ঠ আচার্যের আশ্রয়ে আত্মজ্ঞান লাভ করো। জ্ঞানীরা বলেন, তীক্ষ্ণধার ক্ষুরের মতোই এই জ্ঞানের মার্গ দুরধিগম্য”।   

 

অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ং তথাঽরসং নিত্যমগন্ধবচ্চ যৎ।

অনাদ্যনন্তং মহতং পরং ধ্রুবং  নিচায্য তন্মৃত্যুমুখাৎ প্রমুচ্যতে।। ১/৩/১৫

অশব্দম্‌ অস্পর্শম্‌ অরূপম্‌ অব্যয়ম্‌ তথা অরসম্‌ নিত্যম্‌ অগন্ধবৎ চ যৎ।

অনাদি-অনন্তম্‌ মহতম্‌ পরম্‌ ধ্রুবম্‌  নিচায্য তৎ মৃত্যুমুখাৎ প্রমুচ্যতে।।

“যিনি অশব্দ, অরূপ, অব্যয়, রসহীন, গন্ধহীন কিন্তু নিত্য শাশ্বত, সেই অনাদি অনন্ত মহতের থেকেও মহীয়ান পরমপুরুষকে উপলব্ধি করতে পারলে, মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়”। 

 

নাচিকেতমুপাখ্যানং মৃত্যুপ্রোক্তং সনাতনম্‌।

উক্ত্বা শ্রুত্বা চ মেধাবী ব্রহ্মলোকে মহীয়তে।। ১/৩/১৬

নাচিকেতম্‌ উপাখ্যানম্‌ মৃত্যুপ্রোক্তম্‌ সনাতনম্‌।

উক্ত্বা শ্রুত্বা চ মেধাবী ব্রহ্মলোকে মহীয়তে।।

নচিকেতাকে বলা যমরাজের এই সনাতন উপদেশের উপাখ্যান, যিনি নিজে শোনেন অথবা অন্যের কাছে বর্ণনা করেন, সেই বিবেকবান জ্ঞানী ব্রহ্মাত্মস্বরূপে পূজনীয়।     

 

য ইমং পরমং গুহ্যং  শ্রাবয়েদ্‌ ব্রহ্মসংসদি।

প্রযতঃ শ্রাদ্ধকালে বা তদানন্ত্যায় কল্পতে

তদানন্তায় কল্পতে ইতি।। ১/৩/১৭

য ইমং পরমং গুহ্যং  শ্রাবয়েৎ ব্রহ্মসংসদি।

প্রযতঃ শ্রাদ্ধকালে বা তৎ আনন্ত্যায় কল্পতে

তৎ আনন্তায় কল্পতে ইতি।। ১/৩/১৭

শুদ্ধ সংযত মনে যিনি এই অতি গোপন তত্ত্ব ব্রহ্মসংসদে কিংবা শ্রাদ্ধের সময় সকলের কাছে বর্ণনা করেন, তাঁর সেই কর্ম অনন্ত ফল প্রদান করে। তাঁর অনন্ত ফললাভ হয়।

[ব্রহ্মসংসদ – ব্রহ্মজ্ঞান লাভে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের সমাবেশ।]   

সমাপ্ত প্রথম অধ্যায় - তৃতীয় বল্লী

চলবে... ২/১ বল্লী আসবে সামনের বুধবার।  

২টি মন্তব্য:

  1. পডলাম। জানতে পারলাম অনেক কিছু। Thank you Kishor da.

    উত্তরমুছুন
  2. অনেক ধন্যবাদ পড়ে মন্তব্য করার জন্যে। অনুরোধ করি এই ব্লগের অন্য লেখাগুলিও পড়ো, ভালো লাগলে শেয়ার করো এবং ফলো করো।

    উত্তরমুছুন

নতুন পোস্টগুলি

মা হওয়া নয় মুখের কথা

  গতকাল সময় হয়নি, আজ সকালে ঘুম ভাঙার পরেই মণিমাসি আর সুভামাসি পান্নাকে তুলে আনল, নদিদির কোলের কাছ থেকে। পান্না জেগেই ছিল, মায়ের কোলের কাছে...