১
পরি বাড়িতে ছিল না, অণুদি সদর দরজা খুলে দিতে, ঢুকতে ঢুকতেই সে অণুদিকে জিগ্যেস করল, “দাদা, কোথায় গো?”
অণুদি চোখ উলটে বলল, “আঁদার ঘরে মুখ গুঁজে পড়া করতিসে”। কথাটা শুনেই খুব বিরক্ত
হল পরি, জিভে “চুক” আওয়াজ করে, দৌড়ে গেল দাদার ঘরে।
অণুদি ঠিকই বলেছে, ঘরের
ভেতরটা সত্যিই আধো অন্ধকার। শেষ বিকেলের এই আলোয় বই পড়া চলতে পারে না। অথচ তার
মধ্যেই টেবিলে ঘাড় নিচু করে তার দাদা গাব্দা একখানা বই পড়ে চলেছে। পরি খটাস্
শব্দে আলোর সুইচ অন করে, একটু রাগত স্বরেই বলল, “তুই কী রে, দাদা?”
পরির ডাকে পরির দাদা, কড়ি জ্ঞানের সমুদ্র থেকে ভুস করে উঠে এল, তারপর শুশুকের মতো মুখ
তুলে বলল,
“কেন বল তো, অ্যাদ্দিন ঘর করে, আমি কী, সেকথা বুঝতে তোর এখন
অসুবিধে হচ্ছে বুঝি?”
“বাজে
বকিস না তো! আজ তোর জন্মদিন, আর তুই এখনও এই হুলিয়া নিয়ে তিন সন্ধেবেলায় বসে বসে বই
পড়ছিস?”
কড়ি বোনের পেছনে লাগার সুরে বলল, “কেন, বইয়ের কোন ছুৎমার্গ আছে এমন তো
শুনিনি! বই কোন মন্দিরও নয় বা দামি হোটেলও নয়, যে সেজেগুজে পারফিউম না লাগালে
তার দরজা খুলবে না। যদিও মন্দিরের থেকে বই কোন অংশে কম নয়”।
“ওফ্, আবার তোর কলেজের লেকচার
শুরু করলি! লক্ষ্মী দাদা আমার, শোন না, একটু পরেই অনেক লোকজন আসতে শুরু করবে! তার আগেই শেভ-টেভ
করে ফ্রেস হয়ে নে, তারপর
পাজামা-পাঞ্জাবি পরে রেডি হয়ে নে না”!
কড়ি অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, “লোকজন আসবে? কারা আসবে?”
পরির অনেক কাজ বাকি, সে ঝড়ের বেগে দাদার ঘর গোছাতে গোছাতে বলল, “সে আসবে! মাসিমা সব
অ্যারেঞ্জ করেছেন। খাবার দাবার আপ্যায়ন সব। মাসিমা আধঘন্টার মধ্যে এসে পড়বেন। আর
তোকে এ অবস্থায় দেখলে কুরুক্ষেত্র বাধাবেন, এ আমি তোকে বলে রাখলাম, দাদা”।
এর পরেও কড়ি পরির কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলে উঠল, “য্যাঃ য্যাঃ মাসিমার
চামচেগিরি করিস না। যার জন্মদিন সে কিছুই জানলো না, এদিকে নেমন্তন্ন?”
পরির মাথা এবার গরম হতে শুরু করল, একটু ধমকের সুরেই বলল, “বোকা বোকা কথা বলিস না, দাদা, মাসিমার ইচ্ছে ছিল তোকে
সারপ্রাইজ দেবে,
তাই আগে
থেকে বলেননি”!
“অ!
তাই? তাহলে জেনে রাখ আমিও
সারপ্রাইজ দিতে পারি। তোর মাসিমাকে এমন সারপ্রাইজ দেব... !”
“তুই
মাসিমাকে সারপ্রাইজ দিবি? তোর মুণ্ডুটা একদম গেছে, দাদা। যা পারিস কর, আমি ওপরে চললাম। তোর
সঙ্গে কথা বলে ফালতু মাথা খারাপ করার মানে হয় না”। রাগে অগ্নিশর্মা পরি দুমদুম পা
ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
পরি যে সত্যি রেগে গেছে, সেটা এতক্ষণে বুঝলো কড়ি। আর সেটা বুঝতে পেরে, কড়ি খুব অসহায় বোধ করতে
লাগল। তাদের মা যখন মারা যান, পরির বয়েস চোদ্দ আর সে সতেরর কোঠায়। সেই থেকেই পরি সব দিক
সামলে চলেছে,
এই ঘর, সংসার, বাবার এবং তার খেয়াল রাখা
– সব কিছু। বছর দেড়েক আগে বাবা মারা যাবার পর, কড়ি এখন বোনের ওপরেই সম্পূর্ণ
নির্ভরশীল। পরি ছোটবোন হলে কী হবে – বড়দিদির মতোই কড়িকে বুকে করে আগলে রাখে! এই সব
করতে গিয়ে পরি যে লেখাপড়ায় ধেড়িয়েছে, তাও নয়। হিস্ট্রিতে এমএ করে, সে এখন একটা কলেজের পার্টটাইম
লেকচারার,
তার সঙ্গে
আবার পিএইচডি করছে!
কড়ি বোনকে মানানোর জন্যে ডেকে উঠল, “পরি ও পরি, সব কথায় হুট করে এত রেগে
যাস কেন?
দুটো কথা
বললেই অমন রাগ করতে হয় বুঝি? আমার পাজামা-পাঞ্জাবি কোথায় আছে, বের করে দে”। পরি সে কথা শুনতে পেল না, সে অণুদিদিকে নিয়ে
ততক্ষণে ওপরে চলে গেছে, হলঘর সাজাতে।
অগত্যা কড়ি ওয়াশরুমে ঢুকল, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের মুখটা দেখল।
উস্কোখুস্কো চুল, দুদিনের
দাড়ি না কাটা গালে, সত্যিই
তার হুলিয়াটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। টিউব থেকে ছয় মিলিমিটার শেভিং ক্রিম নিয়ে ভেজা
ব্রাশ গালে ঘষতে লাগল! গাল ভর্তি ফেনা বানিয়ে, সবে রেজারটা তুলেছে, দরজায় বেল বাজল ডিংডং!
পরিরা কেউই নিচেয় নেই, তাহলে
কড়ি এখন কী করবে, এ
অবস্থাতেই দরজা খুলতে যাবে? নাকি গামছায় গাল মুছে নেবে? কে আসতে পারে এখন? মাসিমাই হয়তো! আবার বেল
বাজল, ডিংডং। নাঃ, দরজা না খুললে, পরি আরও রেগে যাবে, অতএব কড়ি ফেনাভরা গাল
নিয়েই দরজাটা খুলে দিল।
ফুলের সুন্দর একটা বোকে নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছিল বিন্দি। সে কড়ির দিকে
তাকিয়েই চমকে উঠল এবং তার গলা থেকে যে আওয়াজটা বেরোল, দেওয়ালে আরশোলা বা টিকটিকি দেখলে
মেয়েরা অমন আওয়াজই করে! অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে কড়ি অনেক কষ্টে বলতে পারল, “না...মানে ইয়ে তোমার
...এদিকে দাড়ি...আসলে পরিরা ওপরে... তুমি ভেতরে কেন... তুমি বাইরে এসো... না মানে
বাইরে যাও...না না...”।
কড়ির কথার নমুনা শুনে বিন্দি
মুখে হাত চাপা দিয়ে খুকখুক হাসতে লাগল, তারপর কড়ির পাশ কাটিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল দোতলায়!
দোতলায় গিয়ে সে চেপে রাখা হাসির ফোয়ারা খুলে দিতেই, পরি জিগ্যেস করল, “অ্যাই বিন্দি, হাসছিস কেন রে? কী হয়েছে?”
কড়ি এতক্ষণে ধাতস্থ হয়ে খুব শান্ত প্রত্যয়ের সুরে মনে মনে বলল, “বাইরে কেন, বিন্দি? ভেতরে এসো...যাও যাও ওপরে
যাও, পরিরা ওপরে আছে”। কিন্তু
একটু পরেই সে ওপর থেকে পরি এবং বিন্দির সম্মিলিত হাসির আওয়াজ শুনতে পেল, সঙ্গে অণুদিদিরও! কড়ি
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, বিন্দিকে
দেখলেই সে এমন ন্যাজে-গোবরে হয়ে যায় কেন?
দাড়ি কামানো শেষ করে, কড়ি যখন মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিচ্ছিল, সেই সময় পরি নিচেয় এল, তার হাতে নতুন এক সেট
পাজামা-পাঞ্জাবির প্যাকেট। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে, ভয়ে ভয়ে বোনের মুখের দিকে তাকাল
কড়ি, দেখে স্বস্তি পেল, পরির মুখটা এখন বেশ
হাসি-হাসি!
পরি দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল, বলল, “গুড। এই তো আমার মিষ্টি দাদাটির
মতো দেখাচ্ছে! এই পাজামা-পাঞ্জাবিটা চটপট পরে নে দাদা, পাঞ্জাবিতে বোতাম পরিয়ে দিয়েছি!”
কড়ি সামান্য অনুযোগের সুরে বলল, “বিন্দি আসবে বলিসনি তো! তোরা সবাই
ওপরে, কী অপ্রস্তুতে যে
পড়েছিলাম...”!
পরি ঠোঁট টিপে হেসে বলল, “কেন, বিন্দি আসবে জানলে তুই সাজুগুজু করে, প্রস্তুত হয়ে থাকতিস, বুঝি?”
পরির এই কথার ইঙ্গিতটা বুঝে, কড়ি আরো যেন বিপদে পড়ে গেল, আমতা আমতা করে বলল, “না, তা ওই একটু...ইয়ে
মানে...তা নয়...তবে...”।
পরি হাসতে হাসতে বলল, “তুই আবার অপ্রস্তুত হবার আগে, পাজামা-পাঞ্জাবি পরে চটপট রেডি
হয়ে নে, দাদা। আমি এখনই আসছি”।
বলেই হালকা পায়ে পরি আবার দোতলায় দৌড়ে গেল।
২
নিমন্ত্রিত বলতে বিন্দি, বিন্দির বাবা-মা আর বিন্দির দাদা রূপকথা - সবাই চলে
এসেছেন! কিন্তু মাসিমারাই এলেন অনেক দেরিতে - সাড়ে সাতটা নাগাদ।
মাসিমা সাজানো হলঘরে পা দিয়েই কথার বন্যা বইয়ে দিলেন, “একটু দেরি হয়ে গেল রে, সোনা, কী করবো বল...ওম্মম্মাআআআ, কী সুন্দর... তুই আর
বিন্দি সাজিয়েছিস, সঙ্গে
অণুও ছিল?
বাঃ ভারি
সুন্দর হয়েছে রে। এই সেদিনের পরি...কী কাজের মেয়ে হয়ে উঠেছিস? একা হাতে সব
সামলানো...চাট্টিখানি কথা? আমরা মা দুগ্গা বলি, কিন্তু তাঁর তো দশ হাত, কিন্তু আমাদের পরি দু
হাতেই ঘরের কাজ,
লেখাপড়া...আহাহা, তুই আবার এত লজ্জা
পাচ্ছিস কবে থেকে, পরি? মেসোমশাই? আসছে তো – বিষাণের সঙ্গে
খাবারের প্যাকেটগুলো... একনম্বরের ঢ্যাঁড়স! কে আবার? তোদের মেসোমশাই! ওর জন্যেই তো এত
দেরি হল,
একটা কাজ
যদি ঠিকঠাক করতে পারে। বাবা, রূপ তুমি একটু নিচে যাও না বাবা, তোমাদের মেসোমশাইকে আমার একটুও
ভরসা হয় না। দুটো প্যাকেট হয়তো গাড়িতেই ভুলে আসবে। কড়িকেই বলতাম, কিন্তু আজ তো ওরই
জন্মদিন... কিছু মনে করলে না তো, রূপ? তুমি তো আমাদের ঘরের ছেলে!” সামান্য বিরতি দিয়েই আবার, “কড়ি তোর যেমন ধনুক ভাঙা
পণ, ছোট বোনের বিয়ে না হলে, তুই ছাদনাতলায় পা তুলবি
না, সেরকম পণ অন্যেরও যে
থাকতে পারে সেটা বুঝতে পারিস না, কেন? তোর এই অবুঝ জেদের ধাতটা পেয়েছিস, জাঁইবাবুর থেকে... তুই চুকঃ
পরি... আমি তোদের বাবার শালী... আমি যা খুশি বলতে পারি... আমার অমন লক্ষ্মীপ্রতিমা
দিদিটা কম ভুগেছে... জাঁইবাবুর ওই জেদের জন্যে... সে সব তোরা দেখিসনি, তোরা তখন বাচ্চা...
দেখলেও বুঝিসনি! পরিকে দেখি আর দিদির কথা মনে পড়ে যায়... পরিটা একদম দিদির ধাত
পেয়েছে...সবার জন্যে মায়ামমতা... ঘরবার সবদিক সামলানো...না, না, কড়ি এভাবে এড়িয়ে যাস না, তুই আর পরি দুজনেই নিজের
পায়ে দাঁড়িয়ে গেছিস, তার
ওপর পৈতৃক এই বাড়ি...দিদির গয়নাগাঁটি, জাঁইবাবুর রেখে যাওয়া টাকাপয়সা, সে তোদের দুই ভাইবোনের, তার মধ্যে তো কেউ ভাগ
বসাতে যাচ্ছে না? তাহলে
এত চিন্তা কিসের? বিয়ের
কথা বললেই ছেলেরা এমন ভাব করে, তাদের যেন ধরে বেঁধে বাঘের মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে”!
“তা
ব্যাপারটা সেরকমই দাঁড়ায় বৈ কি!” ওপরে এসে মেসোমশাই, রূপ আর বিষাণ অনেকগুলো প্যাকেট
এনে টেবিলে সাজিয়ে রাখছিলেন, রাখতে রাখতে মেসোমশাই ফোড়ন কাটলেন।
মাসিমা মুখঝামটা দিয়ে বললেন, “চু্প করো তোঃ। তুমি আবার বুড়ো বয়েসে ছোকরাদের তালে তাল
মিলিও না। সংসারের তুমি দেখলেটা কী? সারাজীবন তো চিনেছো এক অফিস, আর বড়ো সায়েব। বিষাণ, তুমি গাড়িতেই থেকো দরকার
পড়লে ডাকবো,
কেমন? তবে ঘুমিও না, বাবা, তোমার তো গাড়িতে বসলেই
ঘুম পেয়ে যায়,
এত ঘুম
কোত্থেকে আসে কে জানে! কড়ি আর কিন্তু ঘুমিয়ে থাকার সময় নয়। পরিরও বয়েস হচ্ছে। এই
মাঘ এলে পঁচিশ পূর্ণ হবে, আমাদের সময় মেয়েদের কুড়িতেই বুড়ি বলতো। সে সব দিন আর নেই, দেশের আইনকানুন পালটে
গেছে, তা বলে মেয়েদের ধুমসি হয়ে
ঘুরে বেড়ানোটাও কোন কাজের কথা নয়। তুই বিয়ে না করলে, পরির যে বিয়ে হতে পারছে না, সে কথা তোর না বোঝার তো
কারণ নেই...”।
“আমার
একটা কথা আছে...সেটা ছোট্ট করে সেরে নিই? তুমি যা শুরু করেছো, সেটা দুশো বাহান্ন এপিসোডের জটিল
সিরিয়ালের মতো...কিছুই বোঝা যাচ্ছে না”। কথার প্রবাহে বাধা পড়ায় মাসিমা ভুরু
কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন, স্বামীর
দিকে। মেসোমশাই আবার বললেন, “আপনাদের, মানে বেয়ান আর বেয়াইমশাইয়ের সম্মতি যখন পাওয়াই গেছে, তখন এই অঘ্রাণে বিন্দি
সিঁদুরের টিপ হয়ে কড়ির কপালে পড়ুক, আর পরি উড়ে যাক রূপকথার রাজ্যে!” বলেই মেসোমশাই হো হো হেসে
তাকালেন পরি আর বিন্দির দিকে, বিন্দি আর পরি লজ্জায় মুখ নামিয়ে দৌড়ে চলে গেল ঘরের বাইরে।
রূপকথা আর বিন্দির বাবা-মা উল্টোদিকের সোফায় বসেছিলেন, তাঁরাও হাসতে লাগলেন খুব!
মাসিমা বললেন, “আমি বেশ গুছিয়ে বলছিলাম, তুমি দিলে সব ভণ্ডুল করে!”
রূপকথার পাশেই কড়ি বসেছিল, সে ফিসফিস করে রূপকে জিগ্যেস করল, “ব্যাপারটা ঠিক কী দাঁড়ালো বল তো? এত হাসাহাসিরই বা কী আছে?”
রূপ বলল, “বলছি, পাশের ঘরে চ”। দুজনে
চুপচাপ পাশের ঘরে গিয়ে বিছানায় বসল, রূপ কড়ির মাথায় চাঁটি মেরে বলল, “তোকে বেশ ভালো ছেলে বলেই জানতাম, কিন্তু তুই যে বিন্দিকে
ইয়ে করিস,
সেটা তো
কোনদিন বলিসনি,
শালা?”
“তুই
আমায় বলেছিলি,
পরি আর তোর
মধ্যে একটা ইয়ে চলছে?”
হাসতে হাসতে রূপকথা বলল, “ইয়েটিয়ে আর নয়, এবার বিয়ে!” দুই বন্ধুই হেসে উঠল হো হো করে।
.০০.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন