Powered By Blogger
পুরানা বিক্রি ক্যোয়ারীর জন্য তারিখ অনুসারে বাছাই করা পোস্ট দেখানো হচ্ছে৷ প্রসঙ্গ অনুসারে বাছাই করুন সব পোস্ট দেখান
পুরানা বিক্রি ক্যোয়ারীর জন্য তারিখ অনুসারে বাছাই করা পোস্ট দেখানো হচ্ছে৷ প্রসঙ্গ অনুসারে বাছাই করুন সব পোস্ট দেখান

বুধবার, ২ জুলাই, ২০২৫

ভূতের ভরসা

 

 ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা দিয়ে কলেজে এখন ছুটি। সর্বজিৎ প্রফুল্লনগরে এসেছে মাসী্মার বাড়ি বেড়াতে। এই জায়গাটা সর্বজিতের খুব পছন্দের জায়গা। ছোট্ট শহর বলেই, শহরের সব সুযোগসুবিধে যেমন মেলে, তেমনি মেলে দেদার গাছপালাওয়ালা, নিরিবিলি ফাঁকা মাঠঘাট। মনটা হালকা হয়ে যায়, ভালো হয়ে যায়।

এর সঙ্গে অবশ্য আছে মাসিমার দারুণ রান্না। নানান পদ রান্না করে সর্বজিৎকে খাওয়াতে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন। মেয়েরা তাঁর পেছনে লাগার জন্যে কিছু বললে, তিনি বলেন, “তোরা তো আমার হাতে সারা বছর খাস, তা সত্ত্বেও তোদের মন পাই না। আর ও বেচারা সারাটি সময় হস্টেলে ছাইপাঁশ কী খায়, না খায় তার ঠিক নেই; দুদিন বাড়ি এলে খাওয়াবো না? একশ বার খাওয়াবো, সে তোরা হিংসে কর, আর যাই কর

তাদের তিনবোনের কেউই সর্বজিৎকে হিংসে করে না। বরং সর্বজিৎকে খুব ভালোবাসে। সর্বজিতের ডাক নাম, সরু। সরুদা এলে বরং খুব মজা হয়। এই কটাদিন মা কিংবা বাবা লেখাপড়া নিয়ে খুব চাপ-টাপ দেন না। রোজই বিকেলের দিকে পাহাড়-চূড়ায় বেড়াতে যাওয়া হয়, নেমে এসে বাজারের সামনে ফুচকাওয়ালার থেকে ফুচকা, চুরমুর খাওয়া হয়। আর সারা দিন গল্পতো আছেই। সরুদার কাছে গল্প শোনাও দারুণ মজা, নানান জায়গার নানান ঘটনার কথা এমন করে বলবে, হাসতে হাসতে চোখে জল চলে আসে। মাও থাকেন সে সব সময়, তিনিও খুব হাসেন।

সেদিন সন্ধেবেলা বারান্দায় বসে সবাই মিলে গল্প হচ্ছিল, বাবা-মাও ছিলেন; হঠাৎ সরুদা বলল, রুন্টুঝুন্টু, তোদের সেই বেস্ট ফ্রেন্ড রুকু-সুকু কোথায়, দেখছি না যে!

সামনের পেয়ারা গাছের আড়াল থেকে রুকুসুকু, হালকা ধোঁয়ার মতো বেরিয়ে এল। তাদের মুখে একগাল হাসি। মৃদু হাওয়ায় দুলতে থাকা ভারি পর্দার মতো দুলতে দুলতে রুকু বলল, আজ্ঞে, এখানেই আছি, দাদা। আপনি সকালে এলেন, সারাটাদিন মজার মজার কথা বলছেন, শুনছি। তারপরে আপনারা বিকেলে পাহাড়চূড়ায় বেড়াতে গেলেন, আমরাও সঙ্গী হলাম। আপনি এলে বাড়িটা খুব জমজমাট লাগে। এবারে কিন্তু বেশ কটাদিন থাকতে হবে, দাদা। সেই কবে এসেছিলেন, আপনাকে তো প্রায় ভুলেই গেছিলাম। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সকালে হুট করে দরজা খুলে যেভাবে ঢুকলেন, আমি তো ভাবছিলাম আপনাকে ঠেলে বের করে দেব। সুকু, চিনতে পেরে বলল, আরে ইনি তো সরুদাদা! তা না হলে কি যে অসৈরণ কাণ্ডটা ঘটে যেত!লজ্জায় মাথা নিচু করে দুলতে লাগল রুকু।

সরুদা মুচকি হেসে বলল, বোঝো কাণ্ড, রুন্টুঝুন্টু তোর বন্ধুরা আমাকে ঠেলে ফেলে দিতে আসছিল

ঠিকই তো বলেছে। ওদের কি দোষ, বছরে এক আধবার এলে, ওরকমই হবেরুন্টু হেসে উত্তর দিল। রুন্টুর খোঁচাটা সরুদা গায়ে মাখল না। গম্ভীরমুখে সরুদা জিগ্‌গেস করল, সে না হয় হল। কিন্তু রুকু, প্রমোটার প্রমথবাবু আর জ্যোতিষী কাত্যায়ন শাস্ত্রী কী করছে এখন”?

দুজনেই বড়ো কষ্টে আছে, দাদা। প্রথমবাবুর ফ্ল্যাট যারা বুক করেছিল তারা রোজ এসে সকাল থেকে রাত অব্দি প্রথমবাবুর ঘরে ধর্না দিয়ে বসে থাকে। প্রথমবাবু ভোরে বেরিয়ে যায়, মাঝ রাত্রে ঘরে ফেরে। আর নাত্যায়ন শাস্ত্রী কলকাতায় কার্জন পার্কের সামনে টিয়াপাখির খাঁচা নিয়ে বসে, হপ্তায় পঞ্চাশ ষাট টাকার বেশি রোজগার হয় না। দুজনের দুর্গতি দেখলে, আপনার চোখে জল চলে আসবে, দাদা

তোরা প্রমথকে প্রথম আরা কাত্যায়নকে নাত্যায়ন বলছিস কেন, রে”? সরুদা বিরক্ত হয়ে জিগ্‌গেস করল।

ওরা তো অশরীরি, ঠাকুর দেবতার নাম নিতে পারে না, তাই ওরকম বলেরুন্টু ওদের হয়ে উত্তরটা দিয়ে দিল। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সরুদা, তারপর বলল, অ। এতসব নিয়ম কানুন তোদেরও মানতে হয়, বুঝি? বুঝলাম। কিন্তু কথাটা হচ্ছে, ওরা আমাদের সর্বনাশ করতে এসেছিল, তাই আমরা ওদের শাস্তি দিয়েছি, রুকু, কিন্তু ওদের সর্বনাশ তো আমরা চাইনি

একদম ঠিক বলেছেন, দাদা। এই নিয়ে আমাদের সমাজে খুব কথা শুনতে হচ্ছে। বলছে আমাদের জন্যেই নাকি মানুষরা ভুল বোঝেসুকু খুব উত্তেজিত হয়ে বলল।

তোদের সমাজ? সেটা কিরকম বস্তু?” সরুদা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

রুকু বলল, “আমাদের সমাজকে নিরাকার সমাজ বলে। আমাদের সমাজেও নেতা আছে মন্ত্রী আছে, প্যাঁচ পয়জার আছে, দলবল আছে। পুলিশ আছে, আইন আদালত আছে। একদমই মানুষদের মতো। তবে কিনা মানুষরা যেমন নিজেদের মধ্যে মারদাঙ্গা, লুটপাট করে; খুনোখুনি করে, আমাদের তেমন হয় না। আগে ভূতেরা খুব হিংস্র হতো, মানুষের ঘাড় মটকাতো, ভয় দেখাতো। বেশ কবছর হল সে সব একদম বন্ধ

হঠাৎ তোদের এই সুবুদ্ধির কারণ?” সরুদা জিগ্‌গেস করল।

রুকু তার উত্তরে বলল, দাদা, মানুষ অপঘাতে মরেই তো ভূত হয়। মানুষ যে হারে মরছে, ভূতেদের সংখ্যাও তো বেড়ে চলেছে। আজকাল মানুষরা নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করেই এত মরছে, তার ওপর আমরা ঘাড় মটকালে ভূতেদের আর পা ফেলার জায়গা থাকবে না। সেই কারণেই আমাদের নেতারা সকলে মিলে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন, আর কোন নরহত্যা নয়। বরং মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করো, পারলে উপকার করো

সুকু এতক্ষণ চুপ করে বসে শুনছিল, এখন বলল, একটা কিছু ভাবুন দাদা, যাতে প্রথমবাবু, নাত্যায়ন শাস্ত্রী আর ওই ফ্ল্যাট বুকিং করা আটষট্টি জন লোক দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারে, আগের মতো আবার সব যেন ঠিকঠাক চলতে থাকে

সরুদা গম্ভীরভাবে বলল, “হুম, সেটাই তো ভাবছি, কি ভাবে কী করা যায়। আমার মনে হচ্ছে, তোদের নাত্যায়ন শাস্ত্রীই আমাদের হয়ে পুরো কাজটা সামলে দিতে পারবে, যদি তোরা দুজনে তাকে একটু সাহায্য করতে পারিস

আমরা সাহায্য করার জন্যেই তো বসে আছি, দাদা। আপনি শুধু হদিশটা বাৎলে দিনরুকু-সুকু একসঙ্গে বলে উঠল।

 

 

 

কাত্যায়ন শাস্ত্রী ফুটপাথের একধারে সকাল নটার মধ্যেই গুছিয়ে বসে পড়ে। তার সামনে প্লাস্টিকের চাদরের ওপর টিয়াপাখির খাঁচা, খাঁচার সামনে সাজানো ভাগ্যফল লেখা সারি সারি কার্ড। দুটো টাকা দিলে, কাত্যায়ন খাঁচার দরজা খুলে দেয়। পোষা টিয়াপাখি, বাইরে বেরিয়ে এসে একটা কার্ড ঠোঁটে নিয়ে কাত্যায়নের হাতে ধরিয়ে দিয়ে, আবার খাঁচার মধ্যে ঢুকে পড়ে। খাঁচার দরজা বন্ধ করে কাত্যায়ন, ভাগ্য বিচার করতে আসা গরিব-গুর্বো মানুষগুলোকে, সেই কার্ডের লেখা পড়ে শোনায়। সে সব কার্ডের কোনটায় লেখা থাকে –”আপনার শুদীন আসতে আর দেরী নেই। আর মাত্র কয়েকটা দীনের প্রতিক্‌খা  কোনটায় – “আপনার দূঃখের দীন শেষ হয়ে এসেছে, আর কটা দীন পরেই আপনি যা চাইছেন সব পেয়ে যাবেন

সেদিনও কাত্যায়ন শাস্ত্রী সকাল নটার আগেই গুছিয়ে বসেছিল, কার্জন পার্কের উলটোদিকের ফুটপাথে। সকলের অলক্ষ্যে, তার দুপাশে এসে বসল রুকু আর সুকু। কাতারে কাতারে অফিসের বাবুরা দৌড়চ্ছে তাদের অফিসের দিকে। কাত্যায়ন তাদের দেখছিল আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিল। রোজ বাড়িতে মাছের ঝোল ভাত খেয়ে নিশ্চিন্তে অফিস করা এই বাবুরা কত কত টাকা মাইনে পায়, আর দুটো টাকা দিয়ে নিজের ভাগ্যটা জানতেও এদের কোন ইচ্ছে হয় না? মাত্র দুটোই তো টাকা!

রুকু খুব চাপা স্বরে বলল, “ও টাকায় টিয়ার জন্যে ভিজে ছোলা কিংবা পাকা লংকারও দাম তো ওঠে না, শাস্ত্রীজি। আপনার কি হবে”?

ঘাড় ঘুরিয়ে কাত্যায়ন শাস্ত্রী চারদিকে তাকালো, আশেপাশে কাউকেই দেখতে পেল না। তাহলে কে বলল কথাটা? কথাটা তার একদম মনের কথা, কিন্তু মনের কথা এমন স্পষ্ট করে কানেও শোনা যায় নাকি? একটু চমকে গেলেও কাত্যায়ন শাস্ত্রী ঘাবড়ালো না। তার মনে আছে প্রফুল্লনগরের সেই দিনের ঘটনার কথা, কিন্তু এটা তো আর প্রফুল্লনগর নয়। কলকাতা শহর। পিছনদিকে রাজভবন, সামনে কার্জন পার্ক। মাঝখানের চওড়া রাস্তা দিয়ে দৌড়ে চলেছে অজস্র বাস আর গাড়ি। দৌড়ে চলেছে হাজার হাজার চাকুরে লোক। এ হচ্ছে সরকারি খাস জায়গা। প্রকাশ্য দিনের বেলা এখানে কোন ভূতের বাপের ক্ষমতা হবে না, তার কোন ক্ষতি করার।

রুকু আবারও বলল, “আমরা এখানে এসেছি আপনার কোন ক্ষতি করতে নয়, শাস্ত্রীজি, বরং উপকার করতেই এসেছি এই কথা শুনে, কাত্যায়ন শাস্ত্রীর ঘাড় একদম শক্ত হয়ে গেল, ঘাড় বেয়ে নেমে আসতে লাগল বরফ শীতল ভয়ের স্রোত। কোনরকমে, তিনবার ঢোঁক গিলে বলল, “যা ক্ষতি করেছ, ভূতভাইরা, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, এখন আবার উপকার?”

হুঁ। উপকার। ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁরুকু হাসল প্রমথবাবুর মতো। অপকার যারা করে, তারা উপকারও করতে পারেরুকুর হাসি শুনে, আরো চমকে গেল কাত্যায়ন শাস্ত্রী, ভাবল প্রমথবাবুও এসেছেন বুঝি সঙ্গে, বলল, প্রমথদাও এসেছেন নাকি? তিনি কবে অশরীরি হয়ে গেলেন, জানতে পারি নি তো!

বালাই ষাট! তিনি কোন দুঃখে অশরীরি হবেন? তবে হ্যাঁ, তিনি খুব মনোকষ্টে আর দুশ্চিন্তায় আছেন, তাঁকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন, একমাত্র আপনি!সুকু কাত্যায়ন শাস্ত্রীকে বলল।

এত দুঃখেও কাত্যায়ন শাস্ত্রীর হাসি পেল, বিষণ্ণ হাসিমাখা মুখে বলল, “আমাকে এই দুর্গতি থেকে কে উদ্ধার করে, তার ঠিক নেই, আমি উদ্ধার করবো, প্রমথদাকে?”

ঠিক তাই। আপনি এই টিয়াপাখির খাঁচা যার কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন, তাকে ফেরত দিয়ে চলে যান প্রথমবাবুর হিমঘরে। সেখানেই তিনি সারাটাদিন বসেন। বাড়ি ফেরেন প্রায় মাঝরাত্রে, বাড়ি থেকে বেরিয়েও পড়েন ভোর রাত্রে

কাত্যায়ন শাস্ত্রীর ভয়টা এবার একটু কেটে যেতে লাগল। বুকে যেন একটু বল পাচ্ছে, মুচকি হেসে বলল, ভূতেরাও যে পাগল হয় জানা ছিল না, ভাই! প্রমথদার সামনে দাঁড়ালে আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবেন। আমার কোন কথাই শুনবেন না

 রুকু বলল, শুনবেন, শুনবেন। ঠিক মতো বলতে পারলে সব কথা শুনবেন, এমন কি মেনেও নেবেন। মেনে নেওয়া ছাড়া তাঁর আর অন্য রাস্তা নেই কিনা!

আচ্ছা। শুনিই তাহলে কি করতে হবেকাত্যায়ন শাস্ত্রীর মনে ভয়টা প্রায় আর নেই বললেই চলে।

খুব ভালো। আপনি যে আমাদের ভরসা করেছেন, আর ভয় পাচ্ছেন না, ধরে নিন এতেই আপনার আদ্দেক কাজ হয়ে গেছে। এবার কী করতে হবে শুনুন। ছেঁড়াখোঁড়া এই জামাপ্যান্ট ছেড়ে লাল কাপড় পড়তে হবে, যাকে বলে রক্তাম্বর। ঘাগু তান্ত্রিকেরা যেমন পড়েন আর কি! এমন মিন মিন করে কথা বললেও হবে না, বেশ রোখ টোখ নিয়ে ডেকে হেঁকে কথা বলতে হবে। আপনি-আজ্ঞে না বলে, তুই বলতে হবে, এক ধাক্কায়

প্রমথদাকে আমি তুইবলবো, আমাকে কি ভূতে পেয়েছে, নাকি?” কাত্যায়ন শাস্ত্রী খুব বিরক্তমুখে বলল।

রুকু ধৈর্য হারালো না, বলল, “ভূতে তো আপনাকে পেয়েইছে, আমরাই কি ভূত নই? রাজভবনের ফুটপাথে বসে, এই যে আপনি আপনমনে বক বক করে চলেছেন; অনেকেই কিন্তু আপনাকে দেখে অবাক হচ্ছে, ভাবছে আপনাকে ভূতে পেয়েছে, নয়তো আপনার মাথাটা গেছে!

কাত্যায়ন শাস্ত্রী আশেপাশে লোকজনের দিকে তাকালো। উল্টোদিকে একজন কচি শসা ছাড়িয়ে, বিটনুন মাখিয়ে বিক্রি করছে, সে সত্যি সত্যি তার দিকে বার বার দেখছে। ডানদিকে একটু তফাতে এক বুড়ি পা ছড়িয়ে বসে ভিক্ষে করছে, সেও তার দিকে বার বার তাকাচ্ছে। এতক্ষণ কাত্যায়ন শাস্ত্রী লক্ষ্য করেনি, এখন লক্ষ্য করে বেশ ভড়কে গেল।

রুকু বলল, “আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছেন তো? কথা কম বলে, আমাদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন। যেমন বলছি, সেভাবে কাজ করলে, প্রথমে প্রথমবাবুর ভালো হবে, তারপর আপনারও উপকার হবে। আপনার হারিয়ে যাওয়া সুনাম, চাই কি আগের থেকে অনেক বেড়েও যেতে পারে। কি ঠিক করলেন বলুন, আমাদের কথামতো কাজ করবেন? হ্যাঁ কিংবা না তে উত্তর দিন, বেশী কথা বলবেন না

ভাববার জন্যে কিছুক্ষণ সময় নিল কাত্যায়ন শাস্ত্রী, টিয়াপাখির ভরসায় তার যে দিন চলবে না, সে ব্যাপারে তার চেয়ে ভালো আর কে জানে? তবে ভূতের ওপর ভরসা করাটাও উচিৎ হবে কিনা, কে জানে? কিন্তু এখন তো আর কোন উপায়ও নেই। বিশেষ করে, এই দুই ভূত যখন তার পিছনে পড়ে আছে, তার থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায়ও তো তার জানা নেই। কাত্যায়ন শাস্ত্রী ঘাড় ঝুঁকিয়ে বলল, “হুঁ

ভেরি গুড। টিয়াপাখির ঝাঁপ গুটিয়ে তুলে, এখন তাড়াতাড়ি চলুন হাওড়ার ট্রেন ধরতে হবে

 

তালতলার বিহারি মজনুর আলির হরেক ব্যবসা। তার কাছে ম্যাজিকের সরঞ্জাম, টিয়াপাখির খাঁচা সমেত ভাগ্য গোনার বাক্স, মানুষের ওজন মাপার ঘড়ি আর ঘন্টা, বীণ সমেত তিন সাপের ঝাঁপি, একখানা এয়ার গান, সিসের গুলি, আর বেলুন চিপকানো বোর্ডে টিপ প্র্যাকটিস করার সরঞ্জাম, আরও অনেক জিনিষ পাওয়া যায়। সে সকালবেলা টাকা জমা নিয়ে এইসব সরঞ্জাম ভাড়া দেয়, আর রাত্রে ভাড়ার টাকা নিয়ে জিনিষ ফেরত নেয়। কাত্যায়ন শাস্ত্রী অসময়ে হাজির হয়ে, খাঁচা জমা দিতে, খুব অবাক হল মজনুর আলি, বলল, কা, কাত্যায়ন ভাই, আভি আভি লিয়ে গেলে, আভি আভি ওয়াপসভি লিয়ে এলে, বেওসাটা ভালো লাগল না?”

তা নয়, মজনুর ভাই, অন্য একটা ব্যবসা মাথায় এসেছে, তুমি একটু হেল্প করলে, ভালো হয়।

লতুন বেওসা? সে কি রকম আছে, একটু বোলেন তো?”

লাল ধুতি আর চাদর আছে, মজনুর ভাই? সঙ্গে রুদ্রাক্ষের মালা, টালা হলে, ভালো হয়।

কাত্যায়ন শাস্ত্রীর এই কথায়, খুব একচোট হো হো করে হাসল মজনুর আলি, বলল, কাপালিক বাবার বেওসা। এতো বহোত পুরানা বেওসা হল। তুমি কাপালিক বনবে, ব্যোমকালী কলকাত্তাওয়ালি? হা হা হা হা। কাপালিকের সোব তামঝাম হামার কাছে মিলবে - হে রতনোয়া, কাত্যায়ন ভাইকো ও কাপালিকওয়ালা ড্রেস দিখাও

মজনুর আলির শাগরেদ রতন, ঘরের ভেতর থেকে খুঁজে পেতে কাপালিকের ড্রেস নিয়ে এল। রক্তাম্বর, সঙ্গে লাল কাপড়ের ঝোলা। রুদ্রাক্ষের মালা তিন সেট গলায় পড়ার জন্যে একটা বড়ো, হাতে পড়ার জন্যে একজোড়া ছোটো। একটা লাউয়ের খোলায় বানানো কমণ্ডলু আর একটা খুব ব্যাঁকাত্যারা পাকানো অদ্ভূত দেখতে লাঠি। আর একজোড়া খড়ম। কাপালিক সাজার মোক্ষম ড্রেস দেখে কাত্যায়ন শাস্ত্রী নিশ্চিন্ত হল।

মজনুর আলি বলল, পসন্দ হলো তো, কাত্যায়ন ভাই? তোবে রেট একটু বেশি পড়বে। জোমা একশ টাকা, আর ভাড়া রোজ তিরিশ টাকা!

একশ টাকা জমা! অত টাকা কোথায় পাবো মজনুর ভাই, টিয়াপাখির পঞ্চাশটাকা সকালে জমা দিয়ে গেলাম, ওটাতেই কাজ চালিয়ে দিন, মজনুর ভাই

বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে মজনুর আলি বলল, ঠিক আছে, কাত্যায়ন ভাই, লেকিন ভাড়া চালিশ টাকা রোজ দিতে হোবে! কোতোদিনের জন্যে লিবেন?”

চার-পাঁচদিন তো বটেই, দু একদিন বেশিও হতে পারে। চল্লিশটাকা রোজ একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? মজনুর ভাই, পঁইত্রিশ হলে, ভালো হতো

চালিশ বোলে দিলোম বাস, চালিশ। লিতে হয় লিন, না লিবেন তো না লিন। এক পয়সা কোম হোবে না

 

 স্টেসন থেকে প্রমথবাবুর হিমঘর শহর ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা দূরে বড়ো রাস্তার ধারে। ট্রেন থেকে নেমে কাত্যায়ন শাস্ত্রী, হাঁটা লাগাল হিমঘরের দিকে। যদিও সে এর আগে কোনদিন যায়নি, তবে চিনতে অসুবিধে হবে না, কারণ সারাক্ষণ রুকু-সুকু তার সঙ্গেই রয়েছে। ছোট্ট শহর ছাড়িয়ে ফাঁকা মাঠের ধার দিয়ে যাবার সময়, একটা বড়ো গাছতলার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাত্যায়ন শাস্ত্রী জামা-প্যান্ট বদলে, কাপালিকের রক্তাম্বর পড়ে নিল। তারপর রুদ্রাক্ষের মালা পড়ে, হাতে কমণ্ডলু আর সেই ব্যাঁকা লাঠি নিয়ে, যখন দাঁড়াল, কে বলবে এ সেই কার্তিক চন্দ্র হাতি, ওরফে কাত্যায়ন শাস্ত্রী। কাঁধের লাল ঝোলার মধ্যে ভাঁজ করে ঢুকিয়ে নিল পুরোনো জামা-প্যান্ট। তার এই বেশ বদলের সাক্ষী রইল, রুকু-সুকু দুই ভাই, মাঠে চড়তে থাকা একটি গরু আর তিনটে ছাগল।

বিশাল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কাত্যায়ন শাস্ত্রীর বুকটা কিন্তু কেঁপে উঠল। রুকুসুকু পাশে থেকে বলল, “কাউকে ‘আপনি’ বা ‘তুমি’ বলবেন না, শাস্ত্রীজী, ‘তুই’ বলবেন। আর যতো জোরে আর ধমকে কথা বলবেন, লোকে ততই আপনাকে ভক্তি করবে, এ কথাটা মোটেই ভুলবেন না যেন

ভয়ে যে আমার পা কাঁপছে, ভূত ভাইকাত্যায়ন শাস্ত্রীর গলাও কেঁপে উঠল।

পা কাঁপছে, কাঁপতে দিন। গলা যেন না কাঁপে। খুব জোরে শ্বাস নিয়ে গলাটা সাফ করে নিন

কাত্যায়ন শাস্ত্রী তাই করল, তারপর বন্ধ লোহার গেটে ঠকঠক আওয়াজ তুলল। একজন দারোয়ান গেটের সামনে কাপালিককে দেখেই নিচু হয়ে নমস্কার করল, বলল, গোড় লাগি, মহারাজ। ইধার কুছ ভিখ নেহি মিলেগা, আগে যাইয়ে

ভিক্ষে চাওয়ার কথাটা কাত্যায়ন শাস্ত্রীর ভীষণ গায়ে লাগল। প্রচণ্ড রাগে জ্বলে উঠল তার শরীর, বলল, চোপরাও, বেয়াদব। সাধু সন্তকো ভিখারি বোলতা হ্যায়, মূরখ? যা যাকে আপনা মালিক, প্রমথ্‌কে বুলা। বোল সাধু মহারাজ আয়ে হ্যাঁয়।

কাত্যায়ন শাস্ত্রীর বলার দাপটে দারোয়ানজি তো বটেই রুকু-সুকুও রীতিমত চমকে উঠল। রুকু-সুকু একটু দূরে সরে দাঁড়াল। দারোয়ানজি আর কথা না বাড়িয়ে, আরেক বার নিচু হয়ে নমস্কার করল, তারপর দৌড়ে চলে গেল অফিসের দিকে। কাত্যায়ন শাস্ত্রী চুপিচুপি জিগ্‌গেস করল, “ঠিক আছে তো, ভূত ভাই?”

একদম, মোক্ষম দিয়েছেন, শাস্ত্রীজী। ব্যস, এই দাপটটা ধরে রাখতে পারলেই কেল্লা ফতে। আপনার সুদিন ফিরে আসবে

দারোয়ানজির কথায় প্রমথবাবু অফিসের থেকে বাইরে এসে দেখলেন, গেটের বাইরে কে একজন লাল কাপড় পড়া সাধু মহারাজ এসে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে অদ্ভূত লাঠি, আর কমণ্ডলু। এমনিতেই তাঁর এখন মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়, প্রমোটারি করতে গিয়ে এমন ডুবেছেন, সেখান থেকে কিভাবে মুক্তি পাবেন তার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না। মাদুলি, গাছের শেকড়, নানান ধরনের রত্ন, যাগ-যজ্ঞ, স্বস্ত্যয়ন, ঝাড়-ফুঁক - কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এই সাধু মহারাজ নিজে নিজেই এসে যখন দেখা দিয়েছেন, কথা বলতে দোষ কি? কার মধ্যে কী আছে কিছু বলা যায়? তিনি দারোয়ানজিকে বললেন, “জলদি যাকে গেট খোল দো, মহারাজকো আনে দো

দারোয়ান দৌড়ে এল, পিছনে প্রমথবাবুও এগিয়ে গেলেন গেটের দিকে। কাত্যায়ন শাস্ত্রী খোলা গেট দিয়ে ঢুকে, প্রমথবাবুর সামনে দাঁড়াল, বুক ভরে শ্বাস নিয়ে জোর গলায় বলল, চিনতে পারছিস”?

প্রমথবাবু চিনতে ভুল করেননি। এতো সেই কার্তিক, কাত্যায়ন শাস্ত্রী। তাঁরা একসঙ্গেই ভূতের তাড়া খেয়ে পালিয়েছিলেন। সে ব্যাটার এতো সাহস, আজ তাঁকে তুইবলছে? রাগও হচ্ছিল, আবার অবাকও হচ্ছিলেন মনে মনে। কোন কথা না বলে তিনি তাকিয়ে রইলেন কার্তিকের দিকে।

কাত্যায়ন শাস্ত্রী, মৃদু হেসে বললেন, “মূর্খ, চিনতে পারলি না তো? আমি কাত্যায়ন শাস্ত্রী। ভূতের তাড়া খেয়ে ভয়ে তুই পালিয়ে এসে বাসা বেঁধেছিস এই হিমঘরে! আর আমি সেই অপমানের শোধ তুলবো বলে চলে গেছিলাম হিমালয়ে। গুরুদেবের কাছে মন্ত্র নিয়ে তিনমাস তপস্যা করে গত পরশু সিদ্ধিলাভ করেছি। গুরুদেব বললেন, যা বেটা, আভি যাকে লড় যা ভূতোঁকে সাথ। সমঝা দে উনকো, তু কোন গুরুকা চেলা হ্যায়। আজই ফিরলাম, সোজা চলে এলাম তোর এখানে। রাজি থাকিস তো চল, আমার সঙ্গে। কাল বাদে পরশু শনিবার রাত্রে বোঝাপড়া হয়ে যাক সেই ভূতেদের সঙ্গে। ভূতেদের বাবার নাম না ভূলিয়ে দিয়েছি, তো আমার নাম, কাত্যায়ন শাস্ত্রী নয়

এই কথায়, রুকু-সুকু একটু বিরক্ত হয়ে কাত্যায়ন শাস্ত্রীর কানে কানে বলল, “আপনার এতটা উপকার করতে চলেছি আমরা, শাস্ত্রীজী, তার পরেও আমাদের বাবার নাম ভুলিয়ে দেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?”

খুব আস্তে কাত্যায়ন শাস্ত্রী বলল, “স্যরি, ভূতভাই। ওটা ফ্লোতে মুখ ফক্সে বেরিয়ে গেছে

রুকু বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনি চালিয়ে যান, প্রথমবাবু মোটামুটি ঘায়েল হয়ে এসেছেন

 

প্রথমদিকে প্রমথবাবুর যে একটু রাগ হচ্ছিল না তা নয়, বেজায় হচ্ছিল। ব্যাটা কাত্তিক চন্দ্র হাতি, কাত্যায়ন শাস্ত্রী হয়েও তাঁর সামনে বিনয়ের অবতারটি হয়ে থাকত। তার আজকের এই চেহারা আর ব্যবহার দেখে ঠিক কী করা উচিৎ, তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তবে এটা বুঝতে পারলেন, সেই মিনিমিনে কার্তিক আর মিনমিনে নেই, যেন বাঘ হয়ে উঠেছে। এদিকে তাঁর সময়টাও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, প্রমোটারির জমিটা নিয়ে আর অনেক লোকের থেকে ফ্ল্যাটের অ্যাডভান্স বুকিং নিয়ে তিনি অথৈ জলে পড়ে আছেন। সেক্ষেত্রে এই নতুন কাত্যায়ন যদি আবার সব ঠিকঠাক করে দিতে পারে, মন্দ কী? তাতে যদি কাত্যায়ন তাঁকে তুই-তোকারি করে, কিংবা তাঁকে যদি কাত্যায়নকে আপনি-আজ্ঞে করতে হয়, তাতেই বা ক্ষতি কি? জমির ব্যাপারটা মিটে গেলে তাঁরই লাভ, আর না মেটাতে পারলে ব্যাটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দেশছাড়া করতে তাঁর কতক্ষণ সময় লাগবে?

কি ভাবছিস, রে, বেটা? মনে কোন দ্বিধা রয়েছে, কোন সংশয়?” তারপর কাত্যায়ন শাস্ত্রী একটু মোলায়েম স্বরে ঠাট্টার সুরে বলল। তোদের কি এখানে অতিথি এলে বসতে বলার রেওয়াজ নেই? চা-জলখাবারেরও কোন ব্যবস্থা নেই? এই করে তুই ব্যবসা চালাস রে, প্রমথ?”

কাত্যায়ন শাস্ত্রীর এই কথায় প্রমথবাবু থতমত খেয়ে  বললেন, আসুন আসুন কাত্যায়নজী, ছি ছি, কী অন্যায় বলুন দিকি। সেই থেকে আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলছি। আসুন আসুন, ভেতরে আসুন। অ্যাই কানাই, বাইকটা নিয়ে চট করে সিঙাড়া, জিলিপি, মিষ্টি-টিষ্টি কি পাস নিয়ে আয় তো। সিঙাড়া যেন গরম হয়। আসুন, আপনি এখানটায় আরাম করে বসুন

তক্তপোশের উপর বিছানো গদিতে আরাম করে বসল কাত্যায়ন শাস্ত্রী, ঘরে এসি চলছে, মাথার উপরে হাল্কা স্পিডে ফ্যান ঘুরছে। আরামে কাত্যায়ন শাস্ত্রীর শরীরটা জুড়িয়ে গেল। তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে স্বস্তিতে। এতক্ষণ সব ঠিক ঠাক চলছে, এবার পরশু রাতের যজ্ঞটা যদি ভালোয় ভালোয় মিটিয়ে ফেলতে পারে, তাহলেই তার পাথর চাপা কপাল আবার খুলে যাবে! ভূতভাইয়েরা যখন তাকে এতটাই সাহায্য করছে, তখন বাকিটাও ভালোয় ভালোয় মিটবে বলেই তার আশা।

আরামটা একটু ধাতস্থ হতে বলল, “বেটা প্রমথ, এখন ওদিকের কি অবস্থা বলতো?”

মেঝেয় পাতা কার্পেটে প্রমথবাবু বসে পড়ে বললেন, “সেই যে, ভূতের অত্যাচারে আপনি আর আমি পালিয়ে এসেছিলাম, সে কথায় তো চারদিকে ঢিঢি পড়ে গেল, আমার সেই জমিটার নামই হয়ে গেল ভূতডাঙা। কেউ আর সেখানে কাজ করতে যেতে চায় না। আটষট্টিজন ফ্ল্যাট বুক করে অগ্রিম টাকা দিয়েছিল, তারা একে একে আসতে লাগল, টাকা ফেরত নেবার জন্যে। এক-আধ টাকা নাকি? প্রত্যেকের দু লাখ করে হলে, কত টাকা বুঝে দেখুন, বাবা, সে কি আর হুট করে ফেরত দেওয়া সম্ভব?”

ঠিক কথা! তারপর?” চোখ বন্ধ করে, হাল্কা পা নাচাতে নাচাতে কাত্যায়ন শাস্ত্রী বলল।

তারপর আর কী, বাবা? প্রথমদিকে তারা একজন দুজন করে আসত। তারপর তারা সবাই মিলে প্রতারিত ফ্ল্যাট ওনার্স সমিতিখুলে ফেলেছে। এখন সেই সমিতির পাঁচ থেকে ছজন প্রতিনিধি রোজ সকাল ছটায় আমার বাড়ি এসে রাত দশটা অব্দি বসে থাকে। দুটো শিফট। সকাল ছটা থেকে দুপুর দুটো, আবার দুটো থেকে রাত দশটা। কত বুঝিয়েছি। কত অনুরোধ করেছি, কটা মাস সময় দেওয়ার জন্যে। কিন্তু কে কার কথা শোনে? এখন আমিই বাড়িছাড়া, ভোর পাঁচটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি, রাত এগারোটার পরে বাড়ি ঢুকি

বুঝতে পারছি, খুবই কষ্টের মধ্যে রয়েছিস রে, প্রমথ। যাকগে, আর মাত্র দুটো দিন। তোর দুঃখের দিন শেষ হয়ে গেছে। আমি যখন এসে গেছি তোর আর কোন চিন্তা নেই। শনিবার মাঝরাতে আমার কাজ আমি করে দেব। রবিবার সকাল থেকে জমিতে লোকজন লাগিয়ে তোর কাজ শুরু করে দে। ঝোপঝাড় কেটে জমি সাফ করা আর মাটি কাটার কাজ, আমি দাঁড়িয়ে থেকে শুরু করিয়ে দিতে চাই। ব্যস, তাহলেই তোর ফ্ল্যাট কেনা লোকেরাও স্বস্তি পাবে, তোকে আর জ্বালাবে না। কি রে ব্যাটা, ঠিক আছে তো?”

হ্যাঁ বাবা, ঠিক তো আছে, কিন্তু –”

কিন্তু কী? কাত্যায়ন শাস্ত্রী যা বলছে, তা করে দেখাতে পারবে কি না? তাইতো”?

না, মানে, ওই ইয়ে আর কি! মনে খুব ভয় ধরে গেছে বাবা

ভয়? কিসের ভয়? হা হা হা হাকাত্যায়ন শাস্ত্রীর দমফাটা হাসিতে রুকু-সুকুও চমকে উঠল।

তা মানে, আপনি যখন ইয়ে, ভরসা দিচ্ছেন, তখন আর কিসের ভয়, ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁবহুদিন পরে প্রমথবাবু তাঁর হারানো হাসিটা আবার ফিরে পেলেন।

কাত্যায়ন শাস্ত্রী সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, “তোর হাসিটা, কতদিন পরে ফিরে পেলি, বল? ওই সঙ্গে দ্যাখ তোর কানাই, সিঙাড়া-জিলিপিও নিয়ে এলো

সত্যি সত্যি কানাই ঘরে ঢুকল সিঙাড়া আর জিলিপির মস্তো ঠোঙা নিয়ে, কাত্যায়ন শাস্ত্রী বলল, “আমাকে দেওয়ার আগে একটা প্লেটে চারটে সিঙাড়া আর চারটে জিলিপি দে, আমার সঙ্গে দুজন আছে, তাদেরও খাওয়াতে হবে!

কাত্যায়ন শাস্ত্রীর সঙ্গে দুজন? কোথায়? কাউকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না তো? প্রমথবাবু, কানাই এবং ঘরে আরো তিনজন ছোকরা ভয়ে ভয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। কিন্তু কেউ কিছু বলল না। কানাই একটা প্লেটে চারটে সিঙাড়া, চারটে জিলিপি সাজিয়ে ভীষণ ভয়ে ভয়ে বলল, “বাবা, এগুলো কাকে দিতে হবে বললেন”?

হা হা হা হা, আমার বন্ধুদের! তারাও তো আমারই মতো অনেকক্ষণ না খেয়ে রয়েছে, রে ব্যাটাতারপর পাশের ঘরটা দেখিয়ে বলল, “ওঘরে কে আছে?”

আজ্ঞে, ওটাই আমাদের অফিস ঘর, এখন কেউ নেই

খুব ভালো, ওই ঘরে টেবিলের ওপর প্লেটটা রেখে দিয়ে, বেরিয়ে আয়। দরজাটা ভেজিয়ে দিবি। আর দেখিস কেউ যেন ওঘরে এখন না যায়

কাত্যায়ন শাস্ত্রীর এই কথায় সকলেরই ভয়ে প্রাণ উড়ে যাবার যোগাড়। কানাই কোনমতে প্লেটটা অফিস ঘরের টেবিলে রেখে বেরিয়ে এল দৌড়ে, তারপর দরজাটা ভেজিয়ে দিল ধড়াম করে।

ভয় কি রে পাগলা, আমি তো আছিমুচকি হেসে কাত্যায়ন শাস্ত্রী বলল, “আয়, এবার আমরা সবাই মিলে ভাগ করে খাই –”

প্রমথবাবু এতক্ষণ ফ্যালফ্যাল চোখে দেখছিলেন সব কিছু, এবার মেঝে থেকে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কাত্যায়ন শাস্ত্রীর পায়ের ওপর, যদি কোন দোষ ত্রুটি হয়ে থাকে তো ক্ষমা করে দেবেন, বাবা। অবোধ শিশু আমরা কি বুঝবো, আপনার লীলা”?

কাত্যায়ন শাস্ত্রীর সিঙাড়ার গন্ধে খিদেটা চনমন করে উঠেছিল, প্রমথবাবুর এই আদিখ্যেতায় খুব বিরক্ত হল, আঃ ছাড়, ছাড়। আমি কেউ নেই রে, পাগল। এ আমার গুরুর লীলা, এ আমার তারামায়ের লীলা। ছাড়, খিদে পেয়েছে, অ্যাই কানাই প্লেটে সিঙাড়া দে

 

গরম সিঙাড়ায় কামড় দিয়ে কাত্যায়ন শাস্ত্রী খুব আনন্দ পেল। এমন মজা আর আনন্দ সে জীবনে কোনদিন পায়নি। প্রমথবাবুর মতো জাঁদরেল লোক, তার পায়ের ওপর মেঝেয় বসে আছেন। সে কথা বলে চলেছে, আর প্রমথবাবু জোড় হাতে সে কথা ভক্তিভরে শুনছেনএ জিনিষ সে কোনদিন কল্পনাও করেনি। তার পাথর চাপা কপাল যে খুলে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে আর বাকি রইল না। একটা সিঙাড়া শেষ করে দ্বিতীয়টা খাবার সময় দেখল, প্রমথবাবু কিছু খাচ্ছেন না। কাত্যায়ন শাস্ত্রী বলল, “খুব ভালো গরম সিঙাড়া, খেলে চিত্তশুদ্ধি হয়। কি রে, তুই খাবি না?”

না, বাবা, আপনি খান। আপনার সেবা মানে, আমারও সেবাপ্রমথবাবু গদ্গদ হয়ে বললেন।

এই নে, তবে তুই আমার প্রসাদ পাআধ-খাওয়া দ্বিতীয় সিঙাড়াটা প্রমথবাবুর হাতে তুলে দিল কাত্যায়ন শাস্ত্রী। দুহাতে সেই এঁটো সিঙাড়া মাথায় ঠেকিয়ে প্রমথবাবু বললেন, জয়, বাবা কাত্যায়নের জয়। জয় তারা মায়ের জয়

তারপর সেই সিঙাড়ার টুকরো ভেঙে ভেঙে সকলে মিলে ভাগ করে নিলেন নিজেদের মধ্যে।

 

সিঙাড়া জিলিপি চা খেয়ে খুব তৃপ্তি পেল কাত্যায়ন শাস্ত্রী। বলল, “, এবার বাড়ি যাবি না? সন্ধে হয়ে এল, তো! এ কটা দিন তোর বাড়িতেই এক কোণায় থাকতে দিবি তো রে, ব্যাটা?”

প্রমথবাবু আঁতকে ওঠার মতো বললেন, “আজ্ঞে, কাত্যায়নবাবা, সে তো আমার সৌভাগ্য। কিন্তু এখন বাড়ি ফিরলেই যে সেই সমিতির লোকেরা চেপে ধরবে। আমি তো এগারোটার আগে বাড়ি ফিরতে পারি না, বাবা!

কাত্যায়ন শাস্ত্রী খুব বিরক্ত হয়ে ধমকে বলল, ধুর ব্যাটা, সেই থেকে বলছি, তোর কোন ভয় নেই। কথা কানে যাচ্ছে না, নাকি? বাড়ি চল। কতদিন এইভাবে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াবি, অ্যাঁ? তোর নামে কদিন আগেও বাঘে গরুতে একঘাটে জল খেত, সে সব কথা ভুলে গেলি কী করে?” তারপর একটু নরম সুরে বলল, “রাত্রে কী খাওয়াবি বল? পাঁঠার মাংস যেন থাকে। তাছাড়া তোর যা প্রাণ চায়

কাত্যায়ন শাস্ত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এল। পিছনে প্রমথবাবু, ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি বের করতে। কানাই খুব ভয়ে আর নিচু হয়ে জিগ্‌গেস করল, “বাবা, আপনার বন্ধুরাও যাবে তো? অফিস ঘরে ঢুকবো”?

কাত্যায়ন শাস্ত্রী কানাইয়ের পিঠে আদর করে একটা হালকা চাপড় মারল, বলল, বোকা ছেলে! আমার বন্ধুদের কোথাও যাবার জন্যে গাড়িঘোড়া লাগে না রে, ব্যাটা। তেনারা সব অশরীরি। যা যা ব্যাটা, আর ভয় নেই, অফিস ঘর থেকে প্লেটটা বের করে নিয়ে আয়  

অফিস ঘরে ঢুকে কানাইদের চক্ষু চড়কগাছ! টেবিলের ওপর প্লেটটা খালি, জিলিপির দু এক ফোঁটা রস ছাড়া কিচ্ছু পড়ে নেই প্লেটে!

 

 শনিবারের মাঝরাতে যজ্ঞ শুরু করে শেষ হল যখন তখন সকাল হয়ে গেছে। সকালে হাঁটতে বেরোনো লোকজন অনেকেই এসে জড়ো হতে থাকল একে একে। কয়েকমাস আগে, এই মাঠেই ভূতেদের তাণ্ডবের কথা সকলেরই মনে ছিল। আজ প্রমথবাবুকে তাঁর দলবল নিয়ে মাঠের মধ্যে জাঁকিয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখে সকলেই খুব অবাক হল। প্রমথবাবুর পাশেই দাঁড়িয়েছিল কাত্যায়ন শাস্ত্রী। আজ কাত্যায়ন শাস্ত্রীর ভয়ংকর চেহারা। পরনে রক্তাম্বর। পায়ে খড়ম। গলায় হাতে রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে টুকটুকে সিঁদুরের বিশাল তিলক। সারা গায়ে মুখে ছাইভস্ম মেখে ভয়ংকর।

প্রমথবাবুর আজ বড়ো আনন্দের দিন। তাঁর জমিতে এমন নির্বিঘ্নে যজ্ঞ সম্পন্ন হয়ে যাবে, তিনি ভাবতেও পারেননি। কোন লোকই এখানে কাজ করতে আসতে চাইছিল না। হাতে-পায়ে ধরে, অনেক টাকার লোভ দেখিয়ে কিছু লোককে আনা গিয়েছে। সকাল থেকেই তারা লেগে পড়েছে ঝোপঝাড় কেটে জমি সাফ করার কাজে। কিছু লোক লেগে পড়েছে বাড়ির ভিতের জন্যে মাটি কাটার কাজে। প্রথমে সকলেরই মনে একটু ভয় ভয় ছিল, এখন আর নেই। অনেকেই এসে মহাতান্ত্রিক কাত্যায়ন শাস্ত্রীর পায়ে এসে প্রণাম করে গিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করে চলেছে।

ভালোয় ভালোয় সব কিছু মিটে যাবার পর, কাত্যায়ন শাস্ত্রীকে নিয়ে প্রমথবাবু বাড়ি ফিরলেন। স্নান সেরে, কাত্যায়ন শাস্ত্রী লুচি, আলুরদম, একগাদা মিষ্টি দিয়ে জলখাবার খেয়ে বড়ো আরামে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসল।  কাত্যায়ন শাস্ত্রীর পায়ের কাছে মেঝেয় বসে প্রমথবাবু বললেন, “কাত্যায়নবাবা, এরপর আপনার কি প্ল্যান?” সারা রাত জেগে যজ্ঞ করে ক্লান্ত কাত্যায়ন শাস্ত্রীর চোখে ঘুম আসছিল আরামে, বলল, কাল ভোর বেলায় বেরিয়ে যাবো। হিমালয়ে। গুরুদেবের সঙ্গে বাকি জীবনটা সাধন ভজনেই কাটিয়ে দেব ভাবছি

হিমালয়ে? না, না, বাবা, তা কী করে হয়? আমাদের কে রক্ষা করবে? আপনাকে যখন এই রূপে আবার ফিরে পেয়েছি আর ছাড়ছি না।

তোদের রক্ষা করবেন মা তারা, আমি তো নিমিত্তমাত্র রে, পাগল!

আমরা বাবা, পাপীতাপী মানুষ, আমাদের ডাকে মা তারা মোটেই সাড়া দেন না। আমাদের ডাকে সাড়া দেবেন আপনি! আপনাকে কিছুতেই ছাড়ছি না। আপনাকে এই প্রফুল্লনগরেই থাকার বাসা দেব। আপনি এখানেই থেকে, আমাদের মতো সংসারের মায়ায় বাঁধা-পড়া মানুষদের বিপদে আপদে একটু উদ্ধার করে দেবেন, ব্যস। আর কিচ্ছু চাই না। গতরাত্রের যজ্ঞের জন্যে আপনার সেবায়, তিরিশহাজার- না না তিরিশ বড্ডো কম হয়ে যাচ্ছে, পুরো পঞ্চাশ দেবো, বাবা। দয়া করে, আপনি আর না করবেন না, বাবা

আচ্ছা, আচ্ছা, এখন যা, আমি ভেবে দেখবো না হয়। আমার এখন বিশ্রামের সময় হল। যাবার সময় দরজাটা চেপে দিয়ে যাস। আর দেখিস কেউ যেন বিরক্ত না করে। দুপুরে সেবার আগে আমাকে আর ডাকবি না, এখন যা

প্রমথবাবু কাত্যায়ন শাস্ত্রীকে গড় হয়ে প্রণাম করলেন। তারপর পা টিপে টিপে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজাটা চেপে বন্ধ করে দিলেন। কাত্যায়ন শাস্ত্রী চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল, তারপর নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমিয়ে পড়ল।

 

***

 

সন্ধের পর রুকু-সুকুর কাছে সব ঘটনা শুনে সরুদা বললতার মানে যেমন যেমন বলেছিলাম, ঠিক তেমনই সব করে ফেলেছিস তোরা?”

আজ্ঞে হ্যাঁ দাদা, কোথাও কোন গণ্ডগোল হয় নি

এই ব্যাপারে আমার এই দুই বোনের রুন্টুঝুন্টুর কথা কেউ জানবে না তো”?

ঘুণাক্ষরেও না। আমরা এই কজন ছাড়া, কেউ না

প্রমথবাবু তাঁর প্রমোটারির সঙ্গে আবার শপিংমল বানানোর কথাও আর ভাববেন কি?”

একদম না, মলের কথা তিনি নোংরা মলের মতোই ত্যাগ করেছেনরুকুর এই কথায় সুকু হাসল ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ।

যাক মনের মধ্যে একটা কাঁটা বিঁধে ছিল, সেটা দূর হল। এবার প্রমথবাবু তাঁর ক্ষতিটুকু সামলে নেবেন। আর কাত্যায়ন শাস্ত্রীও তার পুরোনো চেম্বার আর তন্ত্রচর্চার ঠিকানা পেয়ে গেল, আগের মতোই।

সরুদা বলল, অন্যায় কাজ করলে শাস্তি পাওয়া উচিৎ। কিন্তু তাই বলে কারো সর্বনাশ করাটা কোন কাজের কথা নয়, বুঝলি, রুন্টুঝুন্টু। এ যা হলো, বেশ হলো।

 -০-

আমার "তেঁনারা" গল্প সংকলন গ্রন্থ থেকে নেওয়া - বইটি ঘরে বসে পেতে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করে বুক করতে হবে - 

তেঁনারা

    

শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪

পুরানা বিক্রি (অণু গল্প)

 

    পুজোর আগে ঘরদোর সাফ করাটা সংসারের একটা বড় কাজ। দেয়ালে, সিলিংয়ে, পাখার ব্লেডের ঝুল ঝাড়া। আচারের শিশি, সসের বোতল জমে উঠেছে খাবার টেবিলের একধারে। সব ফেলতে হবে। অপ্রয়োজনীয় অবান্তর জিনিষ - সব বাতিল। ও হ্যাঁ, গতবার মায়ের ভোগ কিনে খাওয়া হয়েছিল, ওরা দিয়েছিল মাটির নকশা করা পাতিল  – সেটাও এবার বাতিল। পুরোনো খবরের কাগজগুলোর গতি করতে ডাকলাম পুরোন কাগজ বিক্রিওয়ালাকে। বারো কেজি কাগজ, সঙ্গে ছ কেজি বই।

কাগজওয়ালা তার বিশাল বস্তায় ভরে নিল সবকিছু, গেঁজ থেকে টাকা বের করতে করতে জিজ্ঞাসা করল, “পুরোনো লোহা-লক্কড় নেই?” না । “পুরোনো ঘড়ি, ইনভার্টার নেই”? “না নেই”। “পুরোন মেরুদণ্ড?” “সে তো কবেই বেচে দিয়েছি”। 

--০০--         

নতুন পোস্টগুলি

ভূতের ভরসা

  ১   ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা দিয়ে কলেজে এখন ছুটি। সর্বজিৎ প্রফুল্লনগরে এসেছে মাসী্মার বাড়ি বেড়াতে। এই জায়গাটা সর্বজিতের খুব পছন্দের জায়গা।...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ