Powered By Blogger
বিপ্লবের আগুন শেষ পর্ব ক্যোয়ারীর জন্য তারিখ অনুসারে বাছাই করা পোস্ট দেখানো হচ্ছে৷ প্রসঙ্গ অনুসারে বাছাই করুন সব পোস্ট দেখান
বিপ্লবের আগুন শেষ পর্ব ক্যোয়ারীর জন্য তারিখ অনুসারে বাছাই করা পোস্ট দেখানো হচ্ছে৷ প্রসঙ্গ অনুসারে বাছাই করুন সব পোস্ট দেখান

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৪

বিপ্লবের আগুন - শেষ পর্ব

 

“আমার দাদামশাই মহারাজা মহেন্দ্র খুব পণ্ডিত মানুষ ছিলেন। আদর করে আমার নাম রেখেছিলেন ব্রজাংশু। ডাকনাম ব্রজ। আমার বাবা ছিলেন উচ্চপদস্থ সেনাধিকারিক। উত্তরসীমান্তে কোন এক যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি প্রাণ হারান। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাধ্যক্ষের অনেক সময়েই মৃত্যু ঘটে কিন্তু সেনাধিকারিকের মৃত্যু অত্যন্ত বিরল এবং অস্বাভাবিক। শোনা যায় তাঁর মৃত্যুর পিছনে কোন ষড়যন্ত্র ছিল। এবং সে ষড়যন্ত্রের উৎস ছিল রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুর। যদিও কোন অনুসন্ধানই ফলপ্রসূ হয়নি। সে যাই হোক আমার দাদামশাই জামাতার মৃত্যুর পর সপুত্র বিধবা কন্যাকে নিজের প্রাসাদেই সস্নেহে স্থান দিয়েছিলেন। অর্থাৎ আমি বড়ো হয়েছি একদিকে রাজপ্রাসাদের অপরিমিত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে এবং অন্যদিকে প্রচ্ছন্ন কিন্তু অত্যন্ত কুটিল আন্তঃপুরিক যড়যন্ত্রের মধ্যেও।

আপনারা জানেন কিনা জানি না, দাদামশাইয়ের জীবিত অবস্থায়, এ রাজ্যের ঘোষিত যুবরাজ ছিলেন বড়োমামা। এবং বার্ধক্যের কারণে দাদামশাই যখন বারবার অসুস্থ এবং দুর্বল হতে লাগলেন, দাদামশাইয়ের পরামর্শে বড়োমামাই রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব নিতে শুরু করেন। তখন আমার বয়েস পাঁচ কি ছয়। সৌভাগ্যক্রমে আমি আমার দাদামশাই ও বড়োমামা – উভয়েরই অত্যন্ত স্নেহেরপাত্র ছিলাম।

সেবার দীর্ঘ অসুস্থতার পর দাদামশাই বেশ কিছুটা নিরাময় হলেন। অন্তঃপুরে বেশ একটা স্বস্তির আবহ তৈরি হল। বড়োমামাকে সেজমামা একদিন বললেন, পিতৃদেব এখন অনেকটাই সুস্থ, রাজবৈদ্য বলছেন আপাততঃ বিপদ কেটে গেছে। আমরা দীর্ঘদিনের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়েছি। এই হেমন্তে চলো না দাদা, আমরা কদিন মৃগয়া করে আসি – এই বিনোদনটুকু আমাদের মানসিক উদ্বেগকে উপশম দেবে। বড়োমামা প্রথমে আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু সেজমামা দাদামশাইয়ের থেকে অনুমতি পেয়ে যাওয়ার পর বড়োমামা না করতে পারলে না – সম্মত হয়ে গেলেন।

নির্দিষ্ট দিনে পূর্বদিকের পাহাড়ি জঙ্গলের দিকে ওঁনারা সদলবলে যাত্রা শুরু করলেন। প্রাসাদে বেশ একটা আনন্দের পরিবেশ। দ্বিতলের অলিন্দে দাঁড়িয়ে দাদামশাই ওঁদের বিদায় দিলেন, তাঁর পাশে ছিলাম আমি। ওঁদের দলটা দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার পরেও দাদামশাই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, তাকিয়ে রইলেন পূবের আকাশের দিকে। রাজবৈদ্যমশাই কাছাকাছিই ছিলেন, তিনি সতর্ক করে বললেন, “রাজামশাই, এবার কক্ষে চলুন – অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন। এবার আপনার একটু বিশ্রাম প্রয়োজন”। দাদামশাই আমার হাতটা ধরে নিঃশব্দে নিজের কক্ষে গেলেন। শয্যাপ্রান্তে বসে আনমনে বললেন, “মনটা বড়ো কু গাইছে, বাবা ব্রজ, মনে হচ্ছে মৃগয়ার অনুমতি দিয়ে আমি ঠিক কাজ করিনি...”

আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “কেন দাদামশাই?”

দাদামশাই হাসলেন, ভীষণ ম্লান হাসি, বললেন, “কী জানি হঠাৎ মনে হল। তোমার অস্ত্রশিক্ষা, অধ্যয়ন কেমন চলছে ব্রজ? এতটুকু ফাঁকি দেবে না কিন্তু, একদিন তোমাকেই হয়তো এ রাজ্যের হাল ধরতে হবে...। তুমি এখন যাও, শিক্ষান্তে দ্বিপ্রহরে এস। আমি এখন একটু একা থাকতে চাই”।

অস্ত্রশিক্ষা বা অধ্যয়নে আমি যে সুবোধ বালক ছিলাম, তা নয় চণ্ডদাদা। মহারাজের প্রিয় দৌহিত্র বলে আমার গুরুদেবরা আমায় তেমন ভর্ৎসনা করতেন না এবং সেই সুযোগে আমি বিস্তর ফাঁকি দিতাম। কিন্তু সেদিন দাদামশাইয়ের ওই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মলিন অসহায় হাসিটুকু, আমার মধ্যে আশ্চর্য এক পরিবর্তন এনে দিল। ওই দিনের পর থেকে কোন শিক্ষাতেই আমি একদিনের জন্যেও ফাঁকি দিইনি”।

মাথা নীচু করে বজ্র অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ তুলে বলল, “দাদামশাইয়ের আশঙ্কাই সত্য হল। যাত্রা করার দশম দিনে বড়োমামা ফিরলেন - ঘোড়ার পিঠে নয় – আট বাহকের কাঁধে শিবিকায় চড়ে। মারাত্মক অসুস্থ। রাজবৈদ্য গম্ভীর মুখে পরীক্ষা করে বললেন, যুবরাজমশাইয়ের – বাউরু ভেঙেছে, পাঁজরের অস্থি ভেঙেছে দুটো বা তিনটে। মাথাতেও কিছু ক্ষত ছিল – কিন্তু সেগুলো তেমন গুরুতর নয়। বড়োমামার সুদীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক অসুস্থতার চিকিৎসা শুরু হল। রাজবৈদ্য বললেন, পায়ের হাড় জোড়া দেওয়ার উপায় আমার জানা আছে। কিন্তু পঞ্জরাস্থি জোড়া দেওয়ার কোন উপায় আমার জানা নেই। উপরন্তু আমার ধারণা ভাঙা পাঁজরের একটি বা দুটি হাড় যুবরাজমশাইয়ের ফুসফুসের ওপর চেপে বসেছে – অতএব শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে কোন রকম শ্রমসাধ্য কাজ তাঁর পক্ষে করা আর সম্ভব হবে না। শুয়ে বসে আরামে-বিশ্রামেই তাঁকে আজীবন থাকতে হবে”।

চণ্ড জিজ্ঞাসা করল, “এরকম ভয়ংকর দুর্ঘটনা কী করে হল?”

বজ্র বেশ কিছুক্ষণ চণ্ডর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী করে হল – আমাদেরও প্রশ্ন ছিল সেটাই। বিশ্বাসযোগ্য কোন উত্তর পাইনি। সেজমামা দাদামশাইকে বলেছিলেন, বড়মামার ঘোড়াটা নাকি আচমকা পাগল হয়ে গিয়েছিল। মৃগয়ার তৃতীয় দিন সকালে বড়োমামাকে পিঠে নেওয়ার ক্ষণকাল পরেই তাঁর ঘোড়াটি হঠাৎ ভীষণ চিৎকার করে, লাফিয়ে উঠে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে দৌড় দিয়েছিল জঙ্গলের পাহাড়ি পথে। লোকজন নিয়ে তার পিছু ধাওয়া করে প্রায় ক্রোশ দুয়েক দূরে বড়োমামাকে পথের ধারে একটা বড়ো পাথরের ওপর পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল – আর তার থেকে আরও কিছুটা দূরে পড়েছিল ঘোড়াটাও। তার সামনের ডান-পাটা ভেঙেছিল। বড়োমামাকে উদ্ধার করে রাজধানীতে ফিরে এসেছিল সবাই। আর ঘোড়াটাকে মেরে ওই জঙ্গলেই মাটিতে পুঁতে দিয়ে এসেছিল ওরা”।

বজ্র কিছুক্ষণ পরে বলল, “এর বছরখানেক পর দাদামশাই মারা গেলেন। বড়মামা রাজবংশের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং মহারাজের মনোনীত যুবরাজ হওয়া সত্ত্বেও, যেহেতু তিনি অসুস্থ - রাজ সিংহাসনে বঞ্চিত হলেন। মন্ত্রীসভার অনুমতি নিয়ে সিংহাসনে বসলেন সেজমামা। সিংহাসনে বসে সেজমামা, বড়োমামাকে পাঠিয়ে দিলেন এই পশ্চিমের বিষয়াধিপতি করে। তাঁর সঙ্গে এলাম আমিও। সেও আজ হয়ে গেল প্রায় বছর আষ্টেক। বছর পাঁচেক আগে বিজুমামা – বড়োমামার নিজস্ব অনুচর, দীর্ঘদিন মামার দেখাশোনা করছেন। বড়োমামাকে শ্রদ্ধাভক্তি করেন এবং ভালোবাসেন নিজের ছোট ভাইয়ের মতো। আমাকে একদিন ডেকে গোপনে বলেছিলেন, বড়োরাজাবাবুর দুর্ভাগ্যটা কোন দুর্ঘটনা নয় বজ্রবাবা। গভীর ষড়যন্ত্র। জঙ্গলে ঝোপের মধ্যে আমি যখন ঘোড়াটাকে পড়ে থাকতে দেখি – যন্ত্রণায় ছটফট করছিল ঘোড়াটা – চিৎকার করছিল বারবার। ঘোড়াটার পাছার কাছে প্রায় আমূল বিঁধে ছিল একটা নারাচ। সেজোরাজার বিশ্বস্ত রক্ষীরা ঘোড়াটাকে মেরে ফেলার পর, ওই নারাচটা বের করতে গিয়ে হাতে ছ্যাঁকা খেয়েছিল, মোটা কাপড় দিয়ে চেপে ধরে টেনে বের করেছিল নারাচটা। বুঝতে পারছো ব্রজবাবা, কোন প্রাণীর শরীরে যদি চরম উত্তপ্ত লোহার তির বিঁধিয়ে দেওয়া যায় – সে পাগল হবে না? যতই না সে বড়োরাজার স্নেহের বিশ্বস্ত ঘোড়া হোক!”  

প্রথম পরিচয়েই ছোকরাকে বেশ ভালো লেগে গেল চণ্ডর। সুদর্শন শালপ্রাংশু শরীর, চোখদুটোতে মায়াময় স্বপ্ন আছে। কথা একটু বেশিই বলে কিন্তু বাচাল নয়, আবার দেমাকিও নয়। ছোকরার মনটা পাহাড়ি তটিনীর মতো, স্বচ্ছতোয়া এবং খরস্রোতা। সমতলের নদীর মতো ভাবগম্ভীর বিস্তৃত ঘোলাজলে আপাত ধীরস্রোতের তলায় বিপজ্জনক চোরাস্রোত-প্রবাহিনী নয়।

একটু সময় নিয়ে চণ্ড বলল, “একটা কথা - আপনার নাম বললেন ব্রজাংশু, ডাকনাম ব্রজ। অথচ আমরা আপনার নাম শুনে এসেছি বজ্র। আমরা কি ভুল শুনেছিলাম”।

বজ্র হেসে বলল, “না ভুল শোনেননি। প্রাসাদে আমার নাম ব্রজ – কিন্তু প্রাসাদের বাইরে মাঠে ঘাটে প্রান্তরে সকলেই আমাকে বজ্র বলেই ডাকে। এই নামটাই আমার প্রিয় কারণ এ নামে আমায় যারা ডাকে তারাই আমার বন্ধু – তারাই আমার সহযোদ্ধা। এদের ভরসাতেই আমি আমার পরিকল্পনা মতো এগিয়ে চলেছি”।

“কী পরিকল্পনা? বর্তমান রাজা, আপনার সেজমামাকে সিংহাসনচ্যুত করে, বড়োমামাকে সিংহাসনে বসানো?”

“বড়োমামার স্বাস্থ্যের যা অবস্থা, রাজ্যভার কাঁধে নেওয়ার সাধ্য তাঁর আর নেই। সিংহাসনে আমিই বসব, বড়োমামা হবেন আমার অভিভাবক”।

“পারবেন? রাজার সঙ্গে মন্ত্রণা দেওয়ার জন্যে এত মন্ত্রী, সেনাধ্যক্ষ রয়েছেন। অতি দক্ষ শত শত সেনা রয়েছে। রাজকোষে রয়েছে প্রচুর সম্পদ। সেই বিপুল শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করে পারবেন?”

“বিপুল এই শক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ তো আমি করব না, চণ্ডদাদা? সে কথা মনেও আনি না। প্রথমে এই বিষয়টুকু ধীরে ধীরে আমি আয়ত্তে আনতে চাই

“কী করে? এই বিষয়টিও তো আপনার সেজমামার রাজ্যাধীন। এখানে কোন বিশৃঙ্খলা হলে, আপনার সেজমামা চুপ করে বসে থাকবে?”

বজ্র একটু চিন্তা করে বলল, “আমাদের এই বিষয়ের মোট পাঁচটি ভূক্তিতে আস্থান আছে। সেই আস্থানগুলি আমার সেনাদল বারবার লুঠ করবে এবং রাজরক্ষীদের হত্যা করবে। যেভাবে ভল্লাদাদা আপনাদের রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তের আস্থানটিকে জয় করেছিলেন। এবং ভল্লাদাদার পরামর্শে যেভাবে পাশের রাজ্যের বটতলির ছেলেরা তাদের রাজ্যের দুটি আস্থান আক্রমণ করেছে। শুনেছি ভল্লাদাদাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি থাকলে তাঁর সাহায্যে আমার দলটিকে খুব তাড়াতাড়ি তৈরি করে ফেলতে পারতাম...”। একটু থেমে আবার বলল, “আচ্ছা, সত্যিই কি তাঁর মৃত্যু হয়েছে? অনেকে বলে, তাকে মারতে পারে এমন কোন বাপের বেটা নাকি এখনও জন্মায় নি? তিনি বেঁচে আছেন তো বটেই এবং গোপনে প্রস্তুত হচ্ছেন, আরো বড়ো কোন আঘাত হানার জন্যে। শুনেছি, আপনাদের রাজধানী কদম্বপুর থেকে নির্বাসনের সময়, তাঁর ওপর বীভৎস নির্যাতন করা হয়েছিল। সে সময়েই যখন তিনি মারা যাননি, অত সহজে তাঁর মৃত্যু হতেই পারে না। এই কারণেই তাঁর মৃত্যুর সংবাদটাই নাকি একটা লোকশ্রুতি রটনা?”

চণ্ড শান্ত ধীর স্বরে উত্তর দিল, “ভল্লা আমাদের সহকর্মী ছিল। তার সঙ্গে আমাদের দুজনার – আমার ও মারুলার – যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতাও ছিল। কিন্তু ভল্লার যে মৃত্যু হয়েছে – এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই”।

উভয়পক্ষই নীরব রইল কিছুক্ষণ। একটু পরে চণ্ড বলল, “আমাদের থেকে অস্ত্র-শস্ত্র সম্ভার ছাড়া আর কী কী সাহায্য আশা করছেন”।

“বাঃ সাহায্য মানে সব ধরনের সাহায্য। আমার সঙ্গীদলকে নিয়মিত মহড়া দিয়ে বলিষ্ঠ সেনাদল বানিয়ে তুলতে হবে। শুধু যুদ্ধ করা শিখলেই তো হয় না, যুদ্ধ করার নানান কৌশলও শেখাতে হবে। আমাদের এদিকে প্রচুর নদী-নালা-বিল-জলাভূমি সে তো আপনি জানেনই। সেই সমস্ত বাধা-বিপত্তি দ্রুত অতিক্রমের দক্ষতাও তাদের অর্জন করতে হবে। এক কথায় - আমার স্বপ্ন আমার সেনাদল যেন রাজধানীর সেনাদলের সঙ্গে সমানে সমানে যুঝতে পারে”।

বজ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে চণ্ড খুব মন দিয়ে তার কথা শুনছিল, বলল, “আপনার দলে এখন কতজন মানুষ আছে?”

“আপাততঃ প্রায় শ দুয়েক – আরও শ’ চারেক মানুষ আমি ডাক দিলেই যে কোনদিন চলে আসবে”।

“এত লোকের মহড়া ক্ষেত্র কোথায় করবেন – আপনার কিংবা আমাদের রাজ্যসীমার ভিতরে তো করা যাবে না”।

“না তো – দু রাজ্যেরই সীমার বাইরে যে নিরপেক্ষ জঙ্গল সেখানেই বানাচ্ছি। আজ আর সম্ভব নয়, বেলা পড়ে এল, কাল সকালে চলে আসুন না – আপনাকে সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব। অস্ত্রাগার বানাচ্ছি – আমার দলের ছেলেদের থাকার জন্যে প্রচুর ঘর তুলছি। তাদের থাকা -খাওয়ার কোন অসুবিধা যাতে না হয় তার জন্যে বড়ো বড়ো শস্য ভাণ্ডার বানাচ্ছি...”। একটু হেসে বজ্র আরও বলল, “মাস দুয়েক আগে আপনাদের রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত এবং নোনাপুর ও সুকরা গ্রাম আমি দেখে এসেছি। আপনারা চেনেন কিনা জানি না, এ রাজ্যের রামালি, আর রাজ্যের বটতলি গ্রামের মিলা ও জনা,  ওদের সবার সঙ্গেই আমি আলাপ করে এসেছি

চণ্ড হেসে বলল, “বাঃ তাহলে তো অনেক কাজই এগিয়ে রেখেছেন”।

“হ্যাঁ। রামালির সঙ্গে আমি কথা বলে জেনেছি – ওর দল থেকে অন্ততঃ দশজন ছেলেকে ও পাঠাতে পারবে – যারা আমার ছেলেদের মহড়া দেবে। বলেছে, পঞ্চাশ জনের এক একটা দল গড়ে নিয়ে মহড়া শুরু করলে কাজটা সহজ হবে। কিন্তু আপনাদের রাজধানী থেকে ও নির্দেশ না পেলে কোন লোকই পাঠাতে পারবে না। আপনারা রামালিকে চেনেন না?”

“না, নাম শুনেছি - চিনি না। কিন্তু ও কি ওই দশ জন ছেলের মাসোহারা কত দিতে হবে কিছু বলেছে?”

“না তা বলেনি – বলেছে, ওসব যা ঠিক করার রাজধানী থেকেই করবে। আচ্ছা, ভল্লাদাদা যেমন সবকিছুতেই চূড়ান্ত দক্ষ ছিল শুনেছি – রামালির ছেলেদের নিশ্চয়ই সেই দক্ষতা হবে না। আপনাদের মধ্যে কেউ যদি – মানে আপনাদের রাজধানী থেকে বলেছিল – আপনারাও নাকি ভল্লাদাদার থেকে কোন অংশে কম নন…”।

“ঠিক কিসের দক্ষতা বলছেন বলুন তো?”

“এই যেমন ভল্ল, বল্লম, তির ছোঁড়ার দক্ষতা। কিংবা রণপা এবং ঘোড়ায় চড়ার দক্ষতা…। অথবা একটা দলকে পরিচালনা করার – সঠিক পরিকল্পনা করে একটা আক্রমণকে নিখুঁত সফল করে তোলা…মানে সত্যিকারের একজন সেনাধ্যক্ষের যা যা দক্ষতা প্রয়োজন…”।

“ভল্লা যে আমাদের মধ্যে সেরা যোদ্ধা ছিল, ও বেঁচে থাকতে সে কথা কোনদিন স্বীকার করিনি। কিন্তু এখন ও আর নেই – অতএব আজ সে কথা মেনে নিতে আমাদের কোন বাধা নেই”।

“আপনারা কি ভল্লাদাদাকে ঈর্ষা করতেন?”

চণ্ড বজ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “হয়তো। শুধু দক্ষতাকে নয় ওর জনপ্রিয়তাকেও। একজন নির্বাসন দণ্ড পাওয়া অপরাধী তার প্রতি জনগণের কেন এত ভক্তি? আপনি এখন রাজাসনে নেই, কয়েকবছর পর আপনি আশা করি রাজা হবেন, একজন অপরাধীর এত জনপ্রিয়তা  আপনি কি তখন ভালো চোখে দেখবেন”?

“কিন্তু ভল্লাদাদা তো অপরাধীই নয়। রাজার একজন দুশ্চরিত্র আত্মীয়কে ভল্লাদাদা প্রথমে সতর্ক করেছিল, তারপরেও সে শুধরে না যাওয়ায় তার শল্য চিকিৎসা করে তাকে উচিৎ সাজা দিয়েছে। কোন ভাবেই আমি ভল্লাদাদাকে অপরাধী বলে মনে করতে পারছি না”।

“দেখুন আমরা সকলেই রাজার সেবক মাত্র – রাজার আদেশ বা নির্দেশ ছাড়া কোন কাজই আমাদের করণীয় নয়। তার অন্যথা যে করবে, সে অপরাধী বৈ কি!”

অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না, বজ্র খুব মন দিয়ে বারবার দেখতে লাগল চণ্ড এবং মারুলার মুখ। সামান্য অস্বস্তি নিয়ে চণ্ড উঠে দাঁড়াল, বলল “আমরা আজ তবে চলি বজ্রভাই, রাজধানী থেকে অস্ত্রশস্ত্র পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে। রামালির কাছেও বার্তা পাঠাতে হবে যত দ্রুত সম্ভব দশ-বারো জন ভালো দক্ষ ছেলে যেন পাঠায়…আরো কিছু প্রয়োজনীয় কাজ…”।

বজ্র উঠে দাঁড়িয়ে হাসল, বলল, “ঠিক আছে। এখন তুমি এস। কিন্তু কাল থেকেই তুমি এবং মারুলাদাদা আমাদের ছেলেদের মহড়া শুরু করে দাও না, ভল্লাদাদা”।

চণ্ড কোন উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইল বজ্রের চোখের দিকে। মারুলা অবাক স্বরে বলল, “ও তো চণ্ড, ভল্লা তো মারা গেছে বেশ ক মাস হল”।

বজ্র বলল, “আমাকে ফাঁকি দিতে পারোনি ভল্লাদাদা। এতক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলেই আমার মনে হচ্ছিল আমি এক অসাধারণ প্রাজ্ঞ যোদ্ধার সঙ্গে কথা বলছি। সে লোকটি ভল্লাদাদা ছাড়া আর কে হবে? আগেই বললাম তোমাদের পশ্চিম সীমান্তে গিয়ে বহু মানুষের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তারা সকলেই তোমার মৃত্যুতে একদিকে অত্যন্ত হতাশ এবং অন্যদিকে সন্দিগ্ধ – সত্যিই তুমি মারা গেছ কিনা। কিন্তু নোনাপুর গ্রামে চারজনের সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝেছি – তুমি মারা যাওনি…”।

চণ্ডর মুখে মৃদু হাসি, কোন কথা বলল না। মারুলা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তারা কারা?”

বজ্রও হাসল, “ভল্লাদাদার মৃত্যুতে সব থেকে বেশি ভেঙে পড়ার কথা ছিল যে চারজনের – কমলিমা, রামালি, কুসিবোন আর আহোক। ওরা আমার সামনে হাহুতাশ করছিল বারবার …কিন্তু সে হুতাশে কোন আন্তরিকতা ছিল না – কারণ ওরা জানত – ভল্লাদাদা সুস্থ শরীরেই বেঁচে আছে… এবং ওদের সকলের আশীর্বাদে আরও বহুদিন বেঁচে থাকবে। ওরা বিশ্বাস করে – মেকি মড়াকান্নার বাড়াবাড়ি একজন জীবন্ত মানুষকেও অসুস্থ করে তুলতে পারে…তোমাকে ওরা এতটাই ভালোবাসে, ভল্লাদাদা”।

চণ্ড হেসে বলল, “আপনার শালীনতা ও বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হলাম, রাজা ব্রজাংশু। আপনার হাতেই দুরাত্মা সেজমামার পরাভব ঘটবে – এ আমি নিশ্চিত দেখতে পাচ্ছি। এবং কথা দিচ্ছি, আমাদের পক্ষ থেকে সমস্ত সাহায্যই আপনি পাবেন। কিন্তু আমি ভল্লা হয়েও এখন আর ভল্লা নই, আমি এখন চণ্ড। প্রশাসনিক কারণে ভল্লার মৃত্যু ঘটেছে – তাকে বাঁচিয়ে তুলে চণ্ডকে বিপন্ন করবেন না”।

বজ্র হাসল, বলল, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন চণ্ডদাদা – আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না”।

 

বজ্রর থেকে বিদায় নিয়ে চণ্ড আর মারুলা রণপা চড়ে রওনা হল, তাদের নিকটবর্তী আস্থানের দিকে। এক সময় মারুলা বলল, “এভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিপ্লব হতে হতে সব রাজ্যেই বেশ একটা সাম্য সুন্দর পরিস্থিতি চলে আসবে – কী বল, চণ্ড? সিংহাসনে বসা রাজারা অত্যাচার অবিচার করার আগে দশবার ভাববে”।

চণ্ড হাসল, বলল, “ছাই হবে। একবার যে ক্ষমতায় বসতে পায়, সে চিরকাল সেই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায়। সেই ক্ষমতার দম্ভ এবং লোভ তাকে অত্যাচারের পথে টেনে নিয়ে যাবে – যাবেই। আর তাকে সিংহাসন থেকে টেনে ধুলোয় নামানোর জন্যে বিপক্ষ মানুষ বিপ্লব করবে। বারবার – চিরকাল। বিপ্লব চলবে...রমরমিয়ে বাড়বে অস্ত্র-শস্ত্রের ব্যবসা। এর থেকে বিশ্বের কোন দেশের কোন রাজ্য কোনোদিন মুক্তি পাবে না। আমাদের সভ্যতা যতদিন থাকবে, এ আগুন নিভেও নিভবে না – কোথাও না কোথাও জ্বলতেই থাকবে...”। একটু থেমে চণ্ড হাসতে হাসতে আবার বলল, “তোর বা আমার এবং আমাদের ছেলেপুলেদেরও কাজের অভাব কোনদিনই হবে না, নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস – সে রাজ্যের রাজা যিনিই থাকুন”।

মারুলা বলল, “ঠিক বুঝলাম না। ধরা যাক এ রাজ্যের রাজা হল এই রাজবংশেরই ছেলেপুলে নাতিদের কেউ – সেক্ষেত্রে তোর কথামতো আমাদের অবস্থান একই থাকবে। কিন্তু অন্য রাজ্যের রাজা অথবা এ রাজ্যেরই কোন বিপ্লবী নেতা যদি রাজার সিংহাসনে  বসে? তখন? সে আমাদের পাছায় লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়ে তার নিজের লোকদের বসাবে না? সে রাজা আমাদেরকে বিশ্বাস করবে?”

চণ্ড বলল, “বিশ্বাস না করে যাবে কোথায়? নতুন কোন রাজা যুদ্ধ জয় করে সিংহাসনে বসলে, একথা ঠিক, সে প্রশাসনের মাথাগুলোকে -  মানে মন্ত্রীদের - ছেঁটে ফেলে তার মনোমত লোককে মন্ত্রীর পদে বসাবে। কিন্তু তার নীচের স্তরে থাকা প্রশাসনিক লোকদের গায়ে হাতও দেবে না। নতুন রাজা হুট করে অত লোক পাবে কোথায়? আর পেলেও এই রাজ্যের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের খুঁটিনাটি বিষয় তারা জানবে কিংবা বুঝবে কী করে? অতই সহজ নাকি? জেনে রাখবি, নতুন রাজা এলে প্রশাসনের মাথাগুলো অবশ্যই কাটা পড়বে – কিন্তু ধড় থেকে পা পর্যন্ত গোটা শরীরটাকে সে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখবে। কারণ এ ছাড়া তার অন্য কোন উপায় নেই”।

“বুঝলাম। কিন্তু আমরাই বা নতুন রাজার হয়ে কাজ করব কেন? আমরা তো আমাদের বর্তমান রাজার বিশ্বস্ত অনুচর। আমাদের রাজা পদচ্যুত হওয়ার পর – আমরা যদি অন্য রাজার হয়ে কাজ করি – আমরা কি বিশ্বাসঘাতক হয়ে উঠবো না? সেটা কি উচিৎ হবে?”

চণ্ড হেসে ফেলল, তারপর বলল, “তুই ঠিক কার প্রতি বিশ্বস্ত এ কথা কোনদিন ভেবে দেখেছিস, মারুলা? আমরা তো কেউই রাজাকে চিনি না – কোন রকম ব্যক্তিগত পরিচয় নেই – অচেনা, অপরিচিত একজন মানুষের প্রতি, আমরা সত্যিই কি বিশ্বস্ত? নাকি আমরা এই রাজ্যের প্রতি বিশ্বস্ত? রাজ্য মানে যদি কিছু নগর, কিছু জনপদ আর অজস্র গ্রামের সমষ্টি হয়। তার সঙ্গে থাকবে জল-জঙ্গল-পাহাড়-নদী আর বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্র। তাই না? এই রাজ্যের প্রতি আমরা বিশ্বস্ত – কথাটা কেমন কেমন শোনাচ্ছে না? হাস্যকর মনে হচ্ছে না?”

ওফ্‌, এমন সব কথা বলিস না তুইশালা আমার মাথাটাই খারাপ করে ছাড়বি”।

মুচকি হেসে চণ্ড বলল, “দাঁড়া দাঁড়া তোর মাথা খারাপ তে এখনও একটু বাকি আছে, পুরোটা শুনলে তোর মাথাটা সম্পূর্ণ খারাপ হবেসত্যি বলতে আমরা সকলেই নিজ-নিজ সংসার-পরিবারের প্রতি বিশ্বস্ত। আমাদের নিয়মিত নিশ্চিন্ত উপার্জনের প্রতি আমরা বিশ্বস্ত। রাজধানী এবং প্রশাসনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার কারণে কিছুটা প্রতিপত্তি উপভোগ এবং তার ফলে উপরি কিছু সুযোগ-সুবিধে লাভের প্রতি আমরা বিশ্বস্ত। আমাদের এই বিশ্বস্ততা অটুট থাকলে – আমরা রাজ্যের প্রতি তো বটেই – যে কোন রাজার প্রতিও সর্বদা বিশ্বস্ত থাকব। আমাদের এই সকল বিশ্বস্ততায় যদি কোনভাবেই  হাত না পড়ে – তাহলে রাজার সিংহাসনে কখন কে বসল। কিংবা কখন কে উলটে গেল – তাতে কিছু কী যায় আসে আমাদের? আর আমাদের এই প্রভাব-প্রতিপত্তির সুবিধায় যদি কোনদিন টান পড়ে, বিপ্লবী হয়ে উঠতে আমাদের কতদিন লাগবে”?

মারুলা কিছু বলল না, মাটির দিকে তাকিয়ে পথ চলতে লাগল।

শেষ শরতের দিন ছোট হয়ে এসেছে অনেক। সূর্য এখন অস্তাচলে – শিরশিরে উত্তুরে হাওয়ায় জুড়িয়ে যাচ্ছে পথচলার সব ক্লান্তি। তাদের আস্থান এখনও ক্রোশ খানেক দূরে।  


সমাপ্ত    


এই উপন্যাসটি সম্পূর্ণ পড়তে হলে, এই লিংকে গিয়ে প্রথম পর্ব থেকে শুরু করুন - ] 

                        

    

রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

বিপ্লবের আগুন - পর্ব ৩২

হাটের কেনাকাটা সেরে ডামল নদীর ঘাটে এসে বসল। এখান থেকে নদী পার হয়ে ওপাড়ে পৌঁছতে হবে তাকে। নদী পার হয়ে ক্রোশ দুয়েক হাঁটলেই পিপুলতলা গ্রাম। ওপাড়ের বেশ কিছু যাত্রী নিয়ে এদিকেই আসছে নৌকোটা। ভাদরের ভরা নদীতে স্রোত আছে ভালই – বিশেষ করে মাঝগাঙে।  সেই স্রোত এড়াতেই ওপাড়ের ঘাট ছেড়ে, নৌকোটা নদীর আড়াআড়ি উজানে বয়ে গেল বেশ কিছুটা। এখন নৌকোটা এপাড়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে আসছে। দেখলে মনে হবে, এ পাড়ের ঘাটটা যে ও পাড়ের সোজাসুজি উল্টোদিকে – সে কথা নাইয়া যেন ভুলে গেছিল। বহতা নদীর ঘোলাটে সবুজ জলের দিকে ডামল তাকিয়ে রইল।

ঘাটের পইঠাতে পা ঝুলিয়ে ছজন হাটুরে ছোকরা গাঁজা খাচ্ছিল। তাদের হাতে হাতে ঘুরছিল জ্বলন্ত কলকে। নদীর আঁশটেগন্ধী হাওয়ার সঙ্গে ডামলের নাকে আসছিল গাঁজার ধোঁয়ার গন্ধও। একটু বিরক্ত হচ্ছিল ডামল, কিন্তু কিছু করার নেই। এ দেশের ছেলেপিলেরা গাঁজার নেশায় পোক্ত না হতে পারলে সাবালক হয় না। বোধহয় সে অন্যতম ব্যতিক্রম। তার বাবাকেও সে কোনদিন নেশা করতে দেখেনি। হয়তো সে কারণেই নেশার ব্যাপারে তার কোনদিনই কোন আগ্রহ জন্মায়নি। কিন্তু সে দেখেছে গাঁজার আসরে বসা, মানুষগুলির মধ্যে নিবিড় একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে। এমন কি নেশার টানে আসা অচেনা অজানা রসিক মানুষও সেই আসরে যোগ দিতে চাইলে, সকলেই সাগ্রহে অনুমতি দেয়। এবং কলকের প্রসাদ আস্বাদনের মধ্যে অচেনা লোকটিও হয়ে ওঠে পরম মিত্র।

এ ব্যাপারে মারুলা রীতিমতো অভিজ্ঞ। হতভাগার নেশা নেই, কিন্তু প্রয়োজনে এরকম গাঁজার আসরে সে অনায়াসে ভিড়ে যেতে পারে। কলকেটা তার হাতে দু-তিনবার ঘুরতে না ঘুরতেই, সে আসরের লোকদের থেকে অচেনা গ্রামের হাঁড়ির খবর বের করে আনতে পারে।

মারুলার কথা মনে হতেই ডামল কিছুটা আনমনা হয়ে গেল। হতভাগাটা এখন কোথায়? বাড়ি এসেছে? নোনাপুরের কী সংবাদ? রতিকান্তকে শেষ পর্যন্ত খাসি করতে পেরেছিল মারুলা? কমলিমা, রামালি, কুসিরা, অন্যান্য ছেলেরা - কেমন আছে? প্রায় সাতমাস সে নোনাপুরে ছিল। ভালো-মন্দ মিলিয়ে ওখানকার লোকগুলোর সঙ্গে সে বড্ডো বেশিই জড়িয়ে পড়েছিল। কারণ সত্যি বলতে, পনের বছর বয়সে রাজধানীতে নিয়ে গিয়ে তার বাবা যেদিন থেকে তাকে এই রাজ কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল, তারপর থেকে, সে নিজের গ্রামেই একসঙ্গে টানা সাতমাস থাকেনি।

সে বাড়ি এসেছে জষ্টির শেষ দিকে। আড়াই মাসের ওপর হতে চলল। তার কন্যা ভূমিষ্ঠ হয়েছে সে আসার মাস খানেক আগেই। বাড়ি ফিরে সদ্যজাতা শিশুকে প্রথম কোলে নিয়ে তার চোখে জল চলে এসেছিল। সে অশ্রু আনন্দের না কষ্টের – সে কথা আজও সে বুঝতে পারেনি। প্রথম সন্তানের বাবা হওয়ার আনন্দ তো ছিলই। কিন্তু কষ্টও ছিল। নিজের প্রথম সন্তানের জন্মের মতো আশ্চর্য এক ঘটনার মুহূর্তে সে উপস্থিত থাকতে পারেনি। হুল এবং মায়ের চরম উদ্বেগের সময় পাশে থেকে পিতৃসুলভ কোন কর্তব্যই সে পালন করতে পারেনি। রাষ্ট্রের ব্যবস্থায় একজন অভিজ্ঞা ধাই এবং সেবিকা অবশ্য ছিল সর্বক্ষণ। সেবিকা মহিলা তার বাড়িতেই এখনও রয়েছে। প্রতি পক্ষান্তরে ধাইমা আসে শিশু ও তার মায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষায়। একথা সত্যি কোথাও কোন ত্রুটি ঘটেনি। ত্রুটি যা কিছু ঘটেছে, সে সব তার অর্থাৎ কন্যার পিতার পক্ষ থেকেই।

সেদিন ডামলের মনে হয়েছিল, এরকম কাজের তার কী প্রয়োজন? যে কাজের জন্যে সে নিজের পরিবার, নিজের সন্তানের পাশে সময়মতো থাকতে পারে না? কিসের জন্যে সে ছুটে চলেছে রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে? তার পরিবারের সুখ-শান্তি-নিরাপত্তার জন্যেই তো? গ্রাম প্রধানকে বলে এই গ্রামে কিছু জমি নিয়ে – সে যদি অন্যান্য গ্রামবাসীদের মতো চাষবাস শুরু করে – অনায়াসে সে পেয়ে যেতে পারে নিশ্চিন্ত সুস্থির একটা জীবন। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সমান ভাগীদার হয়ে সে সর্বদা থাকতে পারবে, তার এই ছোট্ট সুন্দর পরিবারের সঙ্গে।

একথা সে আর কাউকেই বলেনি, একমাত্র হুলকে ছাড়া। শুনে হুল অনেকক্ষণ কিছু বলেনি, তাকিয়ে ছিল ডামলের চোখের দিকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, “চাষবাসের কাজ তোমারে মোটেই মানাবে গো...।

অবাক হয়ে ডামল একটু জেদ নিয়ে জবাব দিয়েছিল, “ক্যানে? মানাবে না ক্যানে? গোটা রাজ্য জুড়ে এত লোককে মানাচ্চে, আর আমি কোন রাজার ব্যাটা এয়েচি?”

চোখের দৃষ্টিতে ঈষৎ ধমক দিয়ে বিরক্ত হুল বলল, “ও আবার কী কতা? এর মধ্যে বাবাঠাকুরকে টানতিস ক্যানে?” ডামল একটু থতমত খেয়ে বলল, “বাবাকে আবার কখন টানলাম?”

“বারে, ওই যে বল্লে, আমি কোন রাজার ব্যাটা?”

“বোজো, বাবাকে টানব ক্যানে? ও একটা কতার কতা…”

খুব গম্ভীর স্বরে হুল বলল, “অমন কতার কতাও বলতে নেই, ঠাকুর পাপ দে”।

ডামল হেসে ফেলে বলল, “ওই দ্যাক, তোর মেয়ে কেমন মা-সোহাগী হয়েচে – পা ছুঁড়ে আমাকে লাথি মারল। তুই যে আমার ওপর রেগে গেচিস, এইটুকুনি মেয়েও বুজে ফেলেচে”।

ফিক করে হেসে হুল বলল, “মা-সোহাগী না হাতি। যবে থেকে মেয়ে তার বাপকে পেয়েচে – তখন থেকেই সে বাপকে চোকে হারাচ্চে…”।

ডামল মেয়ের ছোট্ট নাকে নাক ঘষতে, মেয়ে হাঁ করে চেঁটে দিল ডামলের থুতনি। খিলখিল করে হাসল ডামল, এবং ফোকলা মুখে হাসল ওদের কন্যাও। ডামল মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল মেয়ের মুখের দিকে, চোখের দিকে। আত্মজার মুখের এই হাসি, তার দুই চোখের এমন নিষ্পাপ নির্ভরতা ছেড়ে সে কোথায় ঘুরে বেড়াবে শহরে শহরে, গ্রামে-প্রান্তরে, বনে-বাদাড়ে? দিনের পর দিন, মাসের পর মাস? ডামল হুলকে জিজ্ঞাসা করল, “তোর কেন মনে হচ্চে চাষ-বাস আমাকে মানাবে না? ঘরেই থাকব, চাষবাস করব, চোখের সামনে দেখব তিল তিল করে মেয়ের বড়ো হয়ে ওঠা। দুজনে মিলে মেয়েটারে খুব আদর-যত্নে বড়ো করে তুলব রে, হুল”।

হুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “গেরামের সারাদিনের কটকেনা নিয়ে থাকলে অধিকাংশ মানুষই কেমন জানি ছোট মনের হয়ে যায়ঘাটে নাইতে গিয়ে মেয়ে-বউদের মুখে, গ্রামের পুরুষদের কিত্তিকলাপ শুনি তো…। অনেকেই গাঁজা খায়, মদ খায়। চণ্ডীমণ্ডপে বসে হয় গুটি খেলে, নয় এর নামে তার নামে চুকলি কেটে সময় কাটায়। করবেই বা কী? চাষবাসের কাজ মানে তো - বীজ-বোনা আর ফসল কাটা – বছরে সাকুল্যে চারমাস কি বড়ো জোর পাঁচ মাস? বাকি সময় -  সকাল থেকে রাতের দু প্রহর পর্যন্ত গাব-জ্বাল দেয়া ছাড়া করবে কী লোকগুলো? একটু থেমে হুল আবার বলল, “সত্যি-মিথ্যে জানি না, শুনেছি দু-একজন টাকার কুমীর আবার নগরে যায় – নানান কুকিত্তি করতে”।  

ডামল কোন কথা বলল না। রেশমী চুলে ভরা মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মন দিয়ে সে হুলের কথা শুনছিল। হুল আড় চোখে তাকিয়ে দেখল ডামলের গম্ভীর মুখটা। তারপর আবার বলল, “তোমার কাজের কতা কিচু কিচু শুনেচি ধাইদিদির কাচে। তুমি কোতায় কোতায় ঘুরে বেড়াও। রাজধানীর কত বড় বড় মানুষের সঙ্গে তোমার চেনাশোনা। তুমি না থাকলে, ফুলকিদিদি নিয়মিত আসে আমাদের দেখাশোনা করতে। ধাইদিদি আর বিম্‌লাকে তো ফুলকিদিদিই সঙ্গে করে এনেচিল। ও সময় এ গাঁয়ের ধাইমাও এয়েচিল, পাড়ার বউদের সঙ্গে। কিন্তু ধাইদিদির সঙ্গে কতাবাত্তা বলে সে একেবারে যেন বোবা হয়ে গেলসারাক্ষণ সঙ্গে ছিল, কিন্তু একটাও রা কাড়েনি। অবিশ্যি ফুলকিদিদি তার পাওনাগণ্ডা পুরো মিটিয়ে দেওয়াতে ধাইবুড়ি খুব খুশি হয়েচে। মেয়েকে বুকে নিয়ে আশীব্বাদ করেচে খুব”।

ডামল কিছু বলল না দেখে, একটু পরে হুল বলল, “এই সব দেখেশুনে গাঁয়ের মানুষরা তোমারে এখন যেমন সমীহ করেতুমি ওদের মতো চাষবাস করলে, কিংবা ওদের সঙ্গে চণ্ডীমণ্ডপে বসে দুবেলা গুটি চালাচালি করলে কী তোমারে আর সে মর্যাদা করবে? তোমারেও ওদের দলে টেনে নামানোর তরে ওরা সব্বাই উঠে পড়ে লাগবে না?

ডামল তবুও কোন উত্তর দিল না। গোঁজ হয়ে বসেই রইল বিছানার একধারে। এরপর হুল আর কথা না বাড়িয়ে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় অস্ফুটে বলেছিল “মায়ের ওপর দিয়ে কদিন বড্ডো ধকল গেচে, আমি আসচি...”।

এই নিয়ে ডামল আর কথা বাড়ায়নি। হুলের কথায় সে কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল ঠিকই – কিন্তু এটাও ঠিক  গ্রামের মানুষরা তার সঙ্গে ভাবসাব করার জন্যে মুখিয়ে বসে আছে তাও নয়। তার বাবার সময় থেকেই গ্রামের পাঁচজনের সঙ্গে তাদের পরিবারের একটা দূরত্ব ছিলই। বড়ো হয়ে বাবার হাত ধরে সেও রাজকাজে যোগ দেওয়ার কারণে সে দূরত্ব বেড়েছে বই কমেনি। সেই দূরত্বের কারণ তাদের কাজের গোপনীয়তা। আর্থিক স্বাচ্ছল্য। বিপদে আপদে প্রতিবেশীদের ওপর নির্ভরশীল না থাকা। অর্থাৎ এই রাজকাজ শুধু নিজের পরিবার নয়, গ্রামের মানুষদের থেকেও তাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ডামল দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তা করেছিল – অনেক হয়েছে, আর নয় – এভাবে চলতে পারে না। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে স্বাভাবিক হৃদ্যতা গড়ে তুলতেই হবে – আর কাল হরণ নয়, এবার তেড়েফুঁড়ে লাগতে হবে।

প্রায় পক্ষকাল লেগেছিল গ্রামের বয়স্ক এবং তার সমবয়সী মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হতে। যে পরিচয়ে বিকেলের দিকে গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে বসে সকলের সঙ্গে সুখদুঃখের আলাপ আলোচনা করা যায়। কটা দিন বেশ ভালই লাগছিল ডামলের। তারপর থেকেই বেরিয়ে আসতে লাগল ওদের আসল রূপ। হয়তো তার প্রতি সমীহবশতঃ অথবা চক্ষুলজ্জার খাতিরে প্রথম কয়েকটা দিন তারা নেশাটেশা করেনি। কিন্তু নেশাখোর মানুষ কতদিন আর অমন সুন্দর বৈকালগুলোকে বিফলে যেতে দেবে? একদিন তারা সসঙ্কোচে প্রস্তাব করেই বসল, “বাইরে বাইরে খুব ঘোরাঘুরির কাজ, তা ভায়ার নিশ্চয়ই ঘাসের নেশায় কোন আপত্তি নেই”? ডামল হেসে ফেলে বলেছিল, “নাঃ, কোনদিনই করিনি, করার ইচ্ছেও নেই”। “বেশ, বেশ, খুব ভালো। কিন্তু আমরা যদি সকলে বাবার প্রসাদ একটু পেতে ইচ্ছে করি, তাতে ভায়ার কোন আপত্তি হবে না আশা করি”। ডামল উত্তর দিয়েছিল “আমার আবার আপত্তি কিসের? আপনারা শুরু করুন”।

সেদিন ডামল আপত্তি করলেও ওরা নিরস্ত হত কি? হত না। বাবার-প্রসাদ বঞ্চিত কয়েকটা দিন যে তাদের কী ভাবে কেটেছে – সে তারাই জানে। আপত্তি করলেও সেদিন তারা নেশা করতই। গাঁজার কলকে সকলের হাত ঘুরতে ঘুরতে নিমেষে যেমন শেষ হচ্ছিল, তেমনই ভরেও উঠছিল তৎক্ষণাৎ। নেশার সঙ্গে সঙ্গে আসর জমতেও সময় লাগল না। বদলে যেতে লাগল তাদের ভাষা এবং আচরণ। সে ভাষা যেমন অশ্রাব্য, তেমনি কদর্য তাদের অঙ্গভঙ্গি। কেউ কেউ অশ্লীল আদিরসের গল্প বললেই – অন্যরা ফেটে পড়ছে উল্লাসে। ডামল দেখল এবং শুনল কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে ধীরে সরে এল সেখান থেকে। এমন মানুষজনের  সঙ্গী হওয়ার থেকে নদীর নির্জন ঘাট তার কাছে অনেক শান্তির। হুলই সঠিক চিনেছে, গ্রামের এই পরিবেশকে এবং তার কন্যার বাপটিকেও।

 

ডামলের চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে গেল। কাঁধে হাত রেখে তার ডানপাশে এসে কেউ বসল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মারুলা! অবাক আনন্দে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, জিজ্ঞাসা করল, “তুই এখানে? কোত্থেকে এলি, যাবি কোথায়?”

মারুলা বলল, “আসছি বাড়ি থেকে। যাবো তোর বাড়ি। আমাকে দেখে তেমন খুশি হলি না মনে হচ্ছে?”

“শালা তোর তাই মনে হচ্ছে? কিন্তু আমি এখানে বসে আছি তুই জানলি কী করে?”

মারুলা স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় বলল, “অচেনা মানুষ দেখেই হাটের মোদকমশাইয়ের বেজায় কৌতূহল। জিজ্ঞাসা করল, কোথা থেকে আসা হচ্ছে, যাওয়া হবে কোথায়? তোর আর তোর গ্রামের নাম বলতেই বলল, একটু আগেই ঘাটের দিকে এসেছিস...চলে এলাম। দেখলাম জলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবনার জাবর কেটে চলেছিস”।

ওদের কথার মধ্যেই নৌকোটা পাড়ে এসে ঠেকল। ডামল হাসল, বলল, “চল। যেতে যেতে কথা হবে”।   

 

দুপুরের খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম সেরে মারুলাকে নিয়ে ডামল গেল তাদের বাড়ির পিছন দিকে। বিরাট  এক জারুল গাছের ছায়ায় গিয়ে দুজনে বসল।

ডামল বলল, “হুঁ। রাজধানী থেকে কী বার্তা নিয়ে এলি? একটু ঝেড়ে কাশ তো!”

“মাস খানেক পরে বেরোতে পারবি?”

“এবার কোন দিকে?”                                                                        

“পূবদিকে। পাশের রাজ্যের এক মাকাল অস্ত্র কিনতে চায়। হতভাগা, ওই রাজ্যের এক বিষয়াধিকারিকের ভাগ্নে। বটতলি গ্রামের কাহিনী শুনে তার বীরত্ব চেগে উঠেছে। বিদ্রোহ করতে চায় নিজেরই মামার বিরুদ্ধে”।

“মামা বিষয়াধারিক মানে, সে তো রাজবংশেরই একজন। মামাকে শেষ করে ভাগ্নে নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করার সাধ হয়েছে? কিন্তু সাধ্য আছে?”

“তা তো জানি না রে। আমাদের লখাই - এদিকের আস্থানের আধিকারিককে এই গোপন বার্তা পাঠিয়েছে। সে সংবাদ গিয়েছে রাজধানীতে। নোনাপুর থেকে ফেরার পথে যখন রাজধানী গিয়েছিলাম, মান্যবর নিবাত বলেছিলেন – বর্ষার পরে তুমি ডামলের সঙ্গে যোগাযোগ করে – রাজধানীতে আসবে। তারপর দুজনে মিলে লেগে পড়ো। আরও বললেন, এবারের কর্মকাণ্ডে তোর নাম হবে চণ্ড”।

“তুই কবে ফিরেছিস, নোনাপুর থেকে?”

“এই তো মাস দেড়েক হল। ঘরে আর মন টিকছে না, শালা। শুয়ে বসে দিন কাটিয়ে গতরে ঘুণ ধরে যাচ্ছে। ভাবছি আশ্বিনের পূর্ণিমা সেরে রাজধানী যাবো – তুই যাবি তো?”

মারুলার “শুয়ে বসে দিন কাটিয়ে গতরে ঘুণ ধরে যাচ্ছে” কথাটা ডামলের মনে ধরে গেল বেজায়। বাড়ি আসার পর মাস খানেক বেশ ভালই লাগছিল – কিন্তু তার পর থেকেই তারও মন চঞ্চল হচ্ছিল ধীরে ধীরে। এভাবে শুয়ে বসে আর কতদিন? নিশিদিন অপেক্ষা করছিল রাজধানী থেকে কবে তার ডাক আসবে। মারুলার কথায় স্বস্তি পেল ডামল, কিন্তু সরাসরি উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ওদিকের কী খবর? খাসি হয়ে রতিকান্ত খুশি?”

“বেশ বলেছিস, শালা” বেশ কিছুক্ষণ খিঁক খিঁক করে হাসল মারুলা, তারপর বলল, “রাজবৈদ্যদের লাগাতার চিকিৎসায় হতভাগার ঘা সারতে মাস দেড়েক লেগেছিল। শষ্পকের মুখে শুনেছি সে এখন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। দু বেলা ঘন্টা নাড়িয়ে পুজো করে। মুখে সর্বদা ঠাকুরদেবতাদের নাম। আমিষ খাবার ছোঁয় না, শাক-সব্জি, ঘাস-পাতা চিবোচ্ছে চারবেলা”। আবার কিছুক্ষণ খিঁক খিঁক হেসে বলল, “শালা এক পাপের প্রতিমূর্তিকে, পুণ্যের পথে ঠেলে দিলাম – আমার কি একটুও পুণ্য সঞ্চয় হবে না রে, ডামল”?

ডামলও হাসল, বলল, “সত্যিই ভাবা যায় না। আর ওদিকের কী খবর – কমলিমা, রামালি…”।

মারুলা একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “ভালই আছে, রে সবাই ভালো আছে। কমলিমায়ের কথা মনে পড়লেই মনে কেমন একটা পাপবোধ আসে। অমন মানুষটাকে বহু বছর আগেই শোকে-তাপে পুড়িয়েছিলেন ঈশ্বর। এতদিন পরে আমরাও তাঁকে ভয়ানক আঘাত দিয়েছি। সেই সমস্ত ক্ষতে প্রলেপের ব্যবস্থা তুইই তো করে এসেছিলি, ডামল, তিনজনকে এক সুতোয় বেঁধে। রামালি আর কুসিকে বুকে নিয়ে কমলিমা ভালই আছেন”।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডামল কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে রইল, একটু পরে বলল, “ওদিকে বটতলির ছেলেদের কী খবর – কিছু শুনেছিস?”

“আরেব্বাস রে, ওরা তো কাণ্ড বাধিয়ে ফেলেছে! ওখান থেকে বেরিয়ে আসার কয়েকদিন আগে রামালির মুখে শুনলাম। ওদিকের কোন এক আস্থানায় আক্রমণ করে সর্বস্ব লুঠ করে নিয়ে এনেছে। আটজন রক্ষী এবং রক্ষীসর্দার মারা গেছে। এখানে আসার আগে বীজপুরে ছিলাম দুদিন। হাটের লোকজন দেখলাম খুব উত্তেজিত। খুব বাগ্‌বিতণ্ডা চলছে – একপক্ষ বলছে ঠিক করেছে, কতদিন মানুষ পড়ে পড়ে মার খাবে? আরেক পক্ষ বলছে, এভাবে রাজার বিরুদ্ধে যাওয়াটা ঠিক নয়। তোমাদের অভাব-অভিযোগের কথা রাজাকে জানাও। তার উত্তরে প্রথম পক্ষ বলছে, রাজাকে পাচ্ছি কোথায় যে বলব? আমাদের কাছে রাজকর্মচারীরাই তো রাজা – ব্যাটারা চুরি করে আর দুর্নীতি করে আমাদের শেষ করে দিল”। মারুলা একটু থেমে আবার বলল, “বললে বলবি আমি বানিয়ে বলছি – প্রথম পক্ষের কাছে “ভল্লা” এখন বীর, যে ন্যায়ের পক্ষে লড়ে প্রাণ দিয়েছে। আর দ্বিতীয়পক্ষের কাছে “ভল্লা” ডাকাত – যে ছোকরাদের মাথাগুলো চিবিয়ে খেয়ে গেছে”।

ডামল কোন কথা বলল না, দূরের মাঠের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। পশ্চিমদিকে সূর্য হেলে পড়েছে। পাখপাখালির দল ফিরে আসছে তাদের বাসায়। খুব শান্ত-নিরিবিলি চারদিক। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডামল বলল, “আবারও সেই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। শান্তির জায়গাতে অশান্তি তৈরি করা। ঠিক আছে - আশ্বিনের কৃষ্ণা তৃতীয়ায় আমি রাজধানী পৌঁছে যাবো…ওখানেই তাহলে তোর সঙ্গে দেখা হবে?”

মারুলা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

ডামল একটু পরে জিজ্ঞাসা করল, “কিন্তু আমাদের কাজটা শুধু অস্ত্র-শস্ত্র বিক্রি করা”?

“মনে হয় না। মান্যবর নিবাতের কথা শুনে মনে হল, বটতলির ছেলেদের মতোই এদের ছোকরাদেরও যুদ্ধ শেখাতে হবে। তা নাহলে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে করবে কি?”

“বটতলির ছোকরারা হল সাধারণ ঘরের ছেলে। রাজকর্মচারীদের ওপর তিতিবিরক্ত হয়েই ওরা একাজে নেমেছে। কিন্তু এ তো বলছিস বিষয়াধিকারিকের ভাগ্নে – বড়োলোকের লালু ছোকরা। সে কী করে বিদ্রোহ করার ফন্দী আঁটছে – আর তার কথা শুনে সাধারণ ছেলের দল রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নেমে যাবে? ব্যাপারটা ঠিক বুঝছি নারে, মারুলা”।


চলবে...



নতুন পোস্টগুলি

জঙ্গী ব্যবসা

  ১   ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ