মঙ্গলবার, ২৪ জুন, ২০২৫

হারানো হীরে

 

 

ভীষণমামা সিঁড়ি দিয়ে উঠলে আমরা দোতলার ঘর থেকেই টের পেয়ে যাই ও আসছে। প্রত্যেকটা সিঁড়ির ধাপে দুইপায়ে দাঁড়িয়ে তারপর নেক্সট স্টেপে পা ফেলে। ওর ভারি শ্বাস-প্রশ্বাসের এবং পায়েরও ভারি আওয়াজ সহজেই কানে আসে। ১৫৭.৬ সেমি হাইটে তাঁর ওজন পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন কেজির বেশী হওয়া উচিৎ ছিল না, কিন্তু আপাতত সেঞ্চুরী পার করে একটু থিতু হয়েছে ১০৩.৫ কেজিতে। তার মানে ওর বডি মাস ইনডেক্স ৪১.১ – ওবেসিটির চূড়ান্ত!

সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ আমি আমার ঘরে লাইফ সায়েন্স পড়ছিলামমা আমার ঘরেই বসে ছিলেন। পুজোর রেকাবি ঢাকা দেওয়ার খঞ্চেপোশ বানাচ্ছিলেন মা - কাঁটা আর সাদা সুতো দিয়েমায়ের হাতের টানা পোড়েনে সুতোর লাচিটা মেঝেয় এধার থেকে ওধার গড়াচ্ছিল – হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে ওটা জ্যান্ত মা বুনতে বুনতেই আমাকে বললেন, ‘কি ব্যাপার বল তো? সাগর আজ একটা করে স্টেপ জাম্প করে সিঁড়ি উঠছে! কোনদিন এমন করে না তো। মনে হচ্ছে খুব টেনসানে আছে...’। 

ভীষণমামার নাম কিন্তু মোটেই ভীষণ নয়, তাঁর নাম ভবসাগর সেন - সংক্ষেপে বি এস সেন, সেখান থেকে আরো সংক্ষেপে - ভীষণ – অবিশ্যি এর পিছনে তাঁর মেদবহুল শরীরটিও অনেকাংশে দায়ী। একটু সরল ভোলেভালা এই মানুষটি আমার মায়ের সত্যি সত্যি ভাইও নন। বিয়ের পর আমার মা যখন এপাড়ায় আসেন বাবার চেয়ে বয়সে ছোট পাড়া-প্রতিবেশীরা মাকে স্বাভাবিকভাবেই বৌদি বলতেন। ভীষণমামার নাকি সেটা পছন্দ হয়নি, মাকে বলেছিল –“আমি সক্কলের মতো আপনাকে বৌদি ডাকব না...”।

বয়সে অনেকটাই ছোট গুবলুগাবলু লাজুক ছেলেটির কথায় মা হেসে ফেলে বলেছিলেন, “ওমা, তাই নাকি? তা হলে কি বলে ডাকবে”?

“তুমি আমার দিদি হলে বেশ হতো, আমি তোমাকে দিদি ডাকব, ব্যস

“বাঃ, সে তো বেশ মজা হবেআমরাও তো দুই বোন – কোন ভাই নেই। সেই ভালো, আজ থেকে তুমি আমার ভাই হলে...”  এসব ঘটনা তো হয়ে গেছে আমার জন্মের অনেক আগে। কাজেই জন্মাবার পর আমি বড় হতে হতে ভীষণমামাকে আমাদের মামা বলেই জানি।

 

“দিদি, কি করছো – প্রতিমা বলল তুমি ওপরের ঘরে আছ" বলতে বলতে ভীষণমামা ঘরে ঢুকলেন। মা মুখ না তুলেই বললেন, “এতক্ষণ তোর পায়ের শব্দ শুনছিলাম, এখন তোর গলা শুনলাম। বহুদিন ধরে বলছি ওয়েটটা এবার কমা, সাগর এই বয়সেই বড়ো অসুখে পড়ে নিজেও ভুগবি - সব্বাইকে ভোগাবি”।

“চেষ্টা, কম করছি ভাবছ? অনেক চেষ্টা করছি। খাওয়া-দাওয়া তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। রাতে মাত্র চোদ্দটা রুটি খাই। তার ওপর আলু খাওয়া অলমোস্ট ছেড়ে দিয়েছি বলতে পারো। তরকারির আলু তো খাইই না, ভাতের সঙ্গে শুদ্ধু আলুভাতে আর লুচি বা পরোটা হলে আলু চচ্চড়ি। ব্যস আর নো আলু। দ্যাখো না, কদিনের মধ্যে কেমন চিমসে মেরে যাই। তখন আমাকে চিনতেও পারবে না, দিদি”।

“এই তোর খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেবার নমুনা? বললে কথা শুনবি না, সে আমি জানি। কারণ আমি তো আর তোর সত্যি সত্যি দিদি নই, শুনবি কেন? নিজের দিদি হলে ঠিক শুনতিস”

“এই দ্যাখো, কি কথায় যে কি কথা তুমি এনে ফেলো না, দিদি...”

“থাক ওসব আর আমায় শুনিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে বল কী হয়েছে? মনে হচ্ছে খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছিস”?

মায়ের এই কথায় আমিও ঘাড় ঘুরিয়ে ভীষণমামাকে দেখলাম, কোথাও দুশ্চিন্তার কোন লক্ষণ ধরতে পারলাম না। কিন্তু ভীষণমামার অবাক হওয়া মুখ দেখে বুঝলাম মা ঠিকই বলেছেন। মা কিন্তু একমনেই হাতের কাজ করছিলেন।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভীষণমামা বলল, “তোর মা কি করে সব ধরে ফেলে বলতো? কিছুই বললাম না, কিছুই করলাম না – কিন্তু ঠিক ধরে ফেলল আমি ঝামেলায় পড়েছি”?  

আমি হেসে ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘কার মা সেটা দেখ! আমারই তো মা!’ মা কিছু বললেন না। খুব মন দিয়ে খঞ্চেপোশ বুনছিলেন – কাঁটা আর সুতোর দ্রুত ওঠানামায় সুন্দর নকশা বেড়ে উঠছিল মায়ের হাতে।

গম্ভীর মায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, ভীষণমামা বললেন, জানো দিদি, পরপর দুদিন আমাদের দোকানে চুরি হয়ে গেল’

‘সে কি রে? কবে’?

‘কাল আর আজ’

‘কি করে’?

‘সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না’

‘তোদের দোকানে তো সিসিটিভি ইন্সটল্ড রয়েছে, না? তাতেও ধরা পড়েনি’?

‘সেখানেই তো রহস্য। কালকে এবং আজকেও - দুবার মিনিট পনের কুড়ির জন্যে কারেন্ট ছিল না। মনে হচ্ছে সেই সময়েই ঘটেছে ব্যাপারটা’

‘তোদের জেনারেটর নেই’?

‘না। ইনভার্টার আছে। তাতে কিছু লাইট জ্বলে। এসি আর সিসিটিভি চলে নাআজকাল লোডশেডিং তো তেমন হয় না’

‘যে জিনিষগুলো হারিয়েছে তার কিরকম দাম হতে পারে’?

‘কাল একটা নেকলেস উইথ ডায়মন্ড স্টাডকরা পেন্ডেন্ট আর আজ একটা ডায়মন্ড রিং। দুটো মিলিয়ে মোটামুটি সাড়ে তিনতো হবেই’

‘সাড়ে তিন হাজার’? আমি জিগ্যেস করলাম।

মা খুব চিন্তান্বিত মুখে উত্তর দিলেন, ‘দূর বোকা, লাখ’ একটু পরে মা আবার বললেন, ‘আচ্ছা, তোরা কি খোঁজ করেছিলি – ওইসময় ওপাড়ায় লোডশেডিং হয়েছিল কিনা’?

‘করেছিলামআশেপাশে কোন দোকানেই কারেন্ট যায় নি, আমাদেরটা ছাড়া’।

‘শিয়োর?’

‘হ্যাঁ গো, দিদি, শিয়োর’

‘হুঁ। তার মানে লোডশেডিং নয়’

‘না’

‘আচ্ছা, দুদিন কি একই সময়ে কারেন্ট চলে গিয়েছিল’?

‘না। কালকে এই ধরো সাড়ে বারোটা নাগাদ। আর আজ তিনটের একটু পরে’

‘কি করে রেস্টোরড হল’?

‘মানে’?

‘মানে, কি করে আবার কারেন্ট এলো’?

‘মেন সুইচের দুটো কিটক্যাট মিসিং ছিল’

‘কাল এবং আজ – দুদিনই’?

‘দুদিনই। আমাদের দোকানের আট দশটা দোকান পরেই “বিজলি”-ইলেক্ট্রিক্যালসের দোকান আছে – সেখান থেকে নতুন কিনে রিপ্লেস করতে হয়েছে। আমাদের দোকানের সজল কিনতে গিয়েছিল, তাকে “বিজলি”র একজন সেলসম্যান বলেছে – “কিরে রোজ দুটো করে কিটক্যাট কিনছিস – তোরাও ইলেক্ট্রিকের দোকান খুলবি নাকি”’?

মা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবলেন। তারপর আবার জিগ্যেস করলেন, ‘পুলিশে খবর দিয়েছিস’?

‘হ্যাঁ’

‘কিছু বলল’?

‘কি আর বলবে? দোকানের সবাইকে এক এক করে জেরা করল। বিশেষ করে পাঁচজন কর্মচারি, দুজন সিকিউরিটি আর সজল – ও আমাদের চা-টা দেয়, ফাই ফরমাস খাটেআমাদেরও সকলকে”।

‘তোদের সকলকে মানে? কে কে’?

‘বাবা, জেঠু, বড়দা, মেজদা আর আমি’

‘আর কর্মচারি পাঁচজন’?

‘তিনজন বহুদিনের পুরোনো – আমি জ্ঞান হয়ে থেকে দেখে আসছি – খুব বিশ্বাসী লোক। আর বাকি দুজন মেয়ে – দুজনেই বছর দুয়েক হল জয়েন করেছে - কাউন্টার সামলানোর জন্যে’

‘তোরা পাঁচজনই কি রোজ সারাদিন দোকানে থাকিস’?

‘না, না। আমি আর বাবা রোজ প্রায় সারাদিনই থাকি। বাবা ক্যাশে বসেন। তবে কার্ডহোল্ডার কাস্টমার এলে আমাকেই...কার্ড পাঞ্চ করার ব্যাপারটা বাবা ঠিক পারেন না। আর ওরা মাঝে মাঝে আসে। কাল বড়দা - মেজদা এসেছিল। আজ ওরা তো ছিলই - জেঠুও এসেছিলেন’

‘কারেন্ট চলে যাওয়ার সময় কি ওঁনারা ছিলেন’? ভীষণমামা বলল,

‘হুঁ... কাল যখন কারেন্ট যায়, বড়দা মেজদা দুজনেই ছিল। কারেন্ট ফিরে আসার আগেই দুজনে একইসঙ্গে বেড়িয়ে গেল....’

‘এক মিনিট, কালকে ঠিক কখন প্রথম ধরা পড়ল যে নেকলেসটা খোয়া গেছে’?

‘তা ধরো প্রায় সাড়ে চারটের সময়। আসলে তুমি তো জানো, দিদি, আমাদের শোরুমের বেশ সুনাম আছে, তার ওপর এখন বিয়েরও লগনসা চলছে। এগারোটা সাড়ে এগারোটা থেকেই ভিড় বেশ জমে ওঠে... দুপুরের দিকে তো বটেই...। ব্যাপারটা কি হয়, আমাদের নানান আইটেম, ডিসপ্লে বক্সে বা ট্রেতে সাবধানে সাজিয়ে রাখা থাকে। ভিড়ের সময় তাড়াতাড়িতে, কাস্টমারের ডিম্যান্ড অনুযায়ী আইটেম দেখাতে গিয়ে ওই বক্স আর ট্রেগুলো একটু এলোমেলো হয়ে যায় আর কি। ভিড়ের চাপ একটু কমলেই আমরা আবার আগের মতো সাজিয়ে ফেলি ঠিক ঠিক বক্সে বা ট্রেতে। কাল সাড়ে চারটে নাগাদ দোকানে ভিড়টা একটু হাল্কা হতে ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়ল – নেকলেসটা নেই’

‘ও । আর আজ’?

‘কালকের মতো আজও কারেন্ট চলে যাওয়ায় আমাদের মনে একটা সন্দেহ হচ্ছিলই। কাজেই আজ কারেন্ট আসার পরই আমরা সব আইটেম চেক করতে শুরু করি এবং তখনই ধরা পড়ে যে ডায়মন্ড রিংটা মিসিং – তা ধরো প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ’।

‘নেকলেস খোয়া যাওয়ার ব্যাপারটা কালকে যখন ধরা পড়ল, কে কে জানত’?

‘কেন? দোকানের সবাই। এমনকি দুজন – না, তিনজন কাস্টমার ছিল তখন শোরুমে - তারাও’।

‘তোর বড়দা, মেজদা, জেঠু’?

‘না ওঁদেরকে জানানো হয় নি। আসলে কাল তো আমরাও ঠিক শিয়োর ছিলাম না। অনেক সময় কি হয় নেকলেস বক্সের মধ্যে ভেলভেটের যে প্যাডিং থাকে, তার তলায় চলে গেলে চট করে খুঁজে পাওয়া যায় না। কালকে আমরা সেটাই ভেবেছিলাম। প্রায় পঞ্চান্ন বছরের পুরোনো ব্যবসা – আগে ছিল দোকান, এখন শোরুম – কিন্তু এমন তো কোনদিন হয় নি। তবে মনে খটকা একটা ছিল – কারণ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যখন পাওয়া গেল না’।

‘আজ যখন কারেন্ট চলে যায়, ওঁনারা কেউ ছিলেন না’?

‘হুঁ, মেজদা ছিল, দুটো নাগাদ এসেছিল, আজও কারেন্ট চলে যাওয়ার পর পরই বেরিয়ে গেল। তারপর আবার এসেছিল – জেঠু, বড়দা আর মেজদা। আমিই ফোন করে ডেকেছিলাম, সাড়ে তিনটের সময় – যখন আমরা শিয়োর হলাম যে ব্যাপারটা সিরিয়াস। ওঁনারা এলেন, এই ধরো, চারটে নাগাদ-’

‘তারপর পুলিশকে কখন খবর দিলি’?

‘জেঠুই সব শুনে বাবাকে বললেন – পুলিশকে খবর দিতে। বড়দার সঙ্গে থানার ওসির চেনাশোনা আছে...বড়দাই ফোন করেছিল’।

‘পুলিশ কখন এল’?

‘প্রায় পৌনে পাঁচটা নাগাদ’।

‘পুলিশ কি করল’?

‘বললাম না, সক্কলকে জেরা করল, কাউকেই ছাড়ে নি’।

‘সার্চ করে নি’?

‘হুঁ, করল তো। সবাইকে। মেয়েদেরকেও – মেয়ে পুলিশও ছিল একজন। কিন্তু কিচছু পাওয়া গেল না’।

‘তোদেরকেও করেছিল’?

‘আমাদেরকে? না, না। আমাদেরকে করে নি’।

‘কেন’?

‘যাঃ, কী যে বলো না তুমি, দিদি। আমাদের দোকান আর আমাদেরকেই সার্চ করবে? নিজের দোকান থেকে কেউ মাল সরায় নাকি’?

‘হতেই পারে...বলা যায়’?

‘কী বলছো, তুমি’? ভীষণমামা কেমন যেন চমকে উঠল, মনে হল।

 

মা কোন উত্তর দিলেন না বা কথাও বললেন না। মুখ নীচু করে হাতের বোনাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ মুখ তুলে বললেন, ওই দ্যাখ, তোর কথা শুনতে শুনতে এক্কেবারে ভুলেই গেছিলাম। তুই সোজা দোকান থেকেই এসেছিস না? ছি ছি...নিশ্চয়ই তোর খিদে পেয়েছেভুটকু, প্রতিমাকে বলে আয় তো – সাগরের জন্যে দুটো পরোটা আর বেগুন চটপট ভেজে দিতে। একটু পরে চা। আমিও খাব এককাপ। নাঃ থাক, চা আর বলতে হবে না, এই অসময়ে। আর হ্যাঁ, পরোটাদুটো কড়া করে ভাজতে বলিস’

আমি মায়ের কথা শেষ হবার আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সিঁড়ির মাথা থেকে মায়ের কথাগুলো প্রতিমাদিকে ইকো করে দিলাম অবিকল। কারণ ঘর ছেড়ে বেরোনোর ইচ্ছে আমার একটুও ছিল না। মায়ের কথাবার্তার ধরণটা ঠিক ফেলুদার মতো লাগছিল – জানিনা কেন মনে হচ্ছিল, মা ঠিক ধরে ফেলবেন এবং সেটা পুলিশদের অনেক আগেই।

আমি ঘরে ঢুকতেই ভীষণমামা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যারে, জ্যোতি, মোটে দুটো বললি’?

আমি কিছু বলার আগেই মা বললেন, ‘হ্যাঁ, মোটে দুটোই। এখন সওয়া আটটা বাজছে, তোরা আবার দশটার মধ্যে খেয়ে নিস- তখন আবার চোদ্দটা রুটি...’

‘ঠিক আছে, দিদি, ঠিক আছে’।

‘প্রতিমার পরোটা আসতে আসতে আমার কয়েকটা ব্যাপার জানার আছে – বল তো তোদের এই জুয়েলারির শোরুম কি শুধু তোরাই চালাস – না তোর জেঠুরও অংশ আছে’?

‘না গো, দিদি, বাবা আর আমিই চালাই। আসলে আমাদের বাবারা তো দুভাই। আর দাদুর মোট চারটে ব্যবসা ছিল – বাবাদের দুভাইকে সমান ভাগ করে দিয়েছিলেন। দুটো জুয়েলারি, একটা বস্ত্রালয় আর একটা ফার্মেসি। আমাদের ভাগে একটা জুয়েলারি আর ফার্মেসি, জেঠুর ভাগে আরেকটা জুয়েলারি আর বস্ত্রালয়’।

‘তার মানে তোদের জুয়েলারি বা ফার্মেসির দোকানের লাভ লোকসানের কোন দায়িত্ব তোর জেঠুদের নেই’?

‘না’।

‘হুঁ। আচ্ছা, দিন কয়েক আগে তোর মেজদা সম্পর্কে কি যেন বলছিলি...’

‘মেজদা সম্পর্কে? কী বলেছিলাম বলো তো’?

‘আরে বাবা, বলেছিলি না, মাধুরী মানে তোর বউদি মারা যাবার পর মেজদা কেমন যেন হয়ে গেছে...কী হয়েছে’?

‘সে আর কী বলব, দিদি, ঘরের কথা। মেজদা আর আগের মতো নেই। প্রায় রোজই ড্রিংক করে। তাছাড়াও নানান বাজে লোকের সঙ্গে মেলামেশা করে – অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে। মানে কুসঙ্গে পড়লে যা হয় আর কি...’

এরমধ্যে আমি প্রশ্ন করে ফেললাম, ‘কুসঙ্গ মানে কি, সাগরমামা’?

আমার এই প্রশ্নে মা খুব বিরক্ত হলেন, ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন – কিছু বললেন না। মার এই বিরক্তি দেখে আমি তো বটেই, মামাও চেপে গেল ব্যাপারটা।

‘তোর জেঠু কিংবা বড়দা নিশ্চই তোর মেজদাকে এসব ব্যাপারে প্রশ্রয় দেন না’।

‘মোটেই না। তাই কেউ দেয় নাকি? জেঠুতো ভীষণ রাগারাগি করেন – প্রায় রোজই। বড়দা–বড়বৌদিও কি কম বোঝাচ্ছেন? কিন্তু মেজদার কি যে মতিভ্রম হয়ে গেল...কারো কথা শুনছেই না...’।

‘আচ্ছা, সাগর, তোর মেজদা বদলোকের পাল্লায় পড়ে এইসব যে করে বেড়াচ্ছে, তার তো ভালোই খরচ-খরচা আছে নাকি – তা এতো টাকা পয়সা দিচ্ছে কে’?

মা যে কথাটা ভীষণমামাকে জিগ্যেস করলেন তা নয়। মাথা নীচু করে চিন্তা করতে করতে নিজের মনেই বললেন কথাটা। কিন্তু মায়ের কথাটা শুনে আমি তো বটেই, ভীষণমামাও হতভম্ব হয়ে গেলাম। তারমানে ভীষণমামার মেজদার কীর্তি এটা – তাঁর বদখেয়ালের খরচ মেটানোর জন্যে – কি সর্বনাশ! তাহলে কি হবে? ঘরের মধ্যেই আসামী!

 

এই সময়েই প্রতিমাদি ঘরে ঢুকল রেকাবিতে পরোটা, বেগুনভাজা আর জলভরা গ্লাস নিয়ে। ভীষণমামা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল উত্তেজিত হয়ে – কিন্তু ভীষণমামা কিছু বলার আগেই মা বলে উঠলেন, ‘এখন ওসব কথা থাক, সাগর। আগে খেয়ে নে’।

তারপর মা প্রতিমাদিকে ইশারায় কিছু বললেন, প্রতিমাদি মুচকি হেসে ঘাড় নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মা বললেন, ‘হ্যাঁ, সাগর, কি বলতে যাচ্ছিলি, বল। তখন তোকে থামিয়ে দিলাম, কারণ আমি চাই না প্রতিমার কানে এসব কথা যাক’।

ভীষণমামা গরম গরম পরোটার বড়ো একটা টুকরো ছিঁড়ে বেগুনভাজার সঙ্গে মুখে পুরে নিয়ে ভরা গলায় বলল, ‘ঠিক কথা, দিদি, এসব কথা বাইরের কেউ শুনলে আমাদের কি বদনামটাই না হবে। কিন্তু, দিদি, তুমি একদম শিয়োর, মেজদাই করেছে এটা’?

‘মোটেই না। আমি একবারও বলিনি। আমি শুধু সম্ভাবনার কথা ভাবছি। দ্যাখ, পরপর দুদিন দুটো আইটেম যে ভাবে হারিয়ে গেল – বাইরের লোক যে কেউ করেনি, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। তার মানে করার মধ্যে তোরা – আর নয়তো তোদের কর্মচারীদের কেউ। তাই না’?

‘ওরে বাবা, তাহলে তো কেঁচো খুঁড়তে সাপ না বেরিয়ে পড়ে’! ভীষণমামা একখানা পরোটা শেষ করে দ্বিতীয়টাকে আক্রমণ করল।

‘এবার তোর কর্মচারীদের কথা বলতো এক এক করে...’।

‘কর্মচারী? দাঁড়াও, বলছি...সলিলকাকা - সলিল মজুমদারসবচেয়ে সিনিয়ার লোক। মুর্শিদাবাদে গ্রামে বাড়ি। মাসে একবার বাড়ি যান, স্যালারি হবার পর আর তাছাড়া পুজোয়, কিংবা বাড়িতে বিয়েটিয়ের মতো বিশেষ অকেশনে বাড়ি যান। সূর্যসেন স্ট্রিটের একটি মেসে থাকেন। সকালে উনিই প্রথম আসেন – সন্ধ্যেয় সবার পড়ে মেসে ফেরেন। ভীষণ চাপা নির্বিবাদী কিন্তু খুব সিনসিয়ার, পরিপাটি মানুষ। কাজে কোনদিন গাফিলতি করেন না’।

‘দাঁড়া ভুটকু, সংক্ষেপে লিখে রাখ তো, সাগর যা বলছে... একদম নাম ধরে লিখবি। ভুল করিস না যেন...’। ভীষণমামাকে থামতে বলে, মা আমাকে বললেন কথাগুলো।

মায়ের কথার মধ্যেই প্রতিমাদি আবার ঘরে ঢুকল – আলাদা প্লেটে আরো দুটো পরোটা আর কাঁচের বাটি ভরা সুজির পায়েস – কিসমিস, কাজুর কুচি বিছানো।

ভীষণমামা মুখে পরোটা নিয়ে আনন্দে একগাল হাসল, বলল, ‘আরো দুটো পরোটা, দিদি? তার সঙ্গে আবার পায়েসও? বা, বা। প্রতিমা তোমার রান্নার কিন্তু কোন জবাব নেই।’ প্রতিমাদি পরোটাদুটো ভীষণমামার প্লেটে ট্রান্সফার করে দিল আর পায়েসের বাটিটা রেখে দিল প্লেটের পাশে।

‘নে, নে, বকিস না বেশি। এই শেষ কিন্তু। আর কিচছু পাবি না, এই বলে দিলাম’। মায়ের কথা শুনে প্রতিমাদি ফিক করে হেসে নিচেয় চলে গেলমা আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘লিখেছিস, ভুটকু’?

‘হুঁ, হয়ে গেছে...’। আমি উত্তর দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম, ভীষণমামা আর কি বলে, সেটা শোনা আর লেখার জন্যে। মা ভীষণমামাকে বললেন, ‘আবার শুরু কর, সাগর, সলিলবাবুর সম্বন্ধে আর কী জানিস’?

‘সলিলকাকার? ব্যস এই তো... আর কী জানবো’?

‘সে কি রে? সলিলবাবু তোদের সবচেয়ে পুরোনো লোক। তাঁর সম্বন্ধে আর কিছু জানিস না? তাঁর কটা ছেলে মেয়ে। তারা কী করে। ওঁনার স্ত্রীর শরীর-স্বাস্থ্য কেমন – কিচ্ছু জানিস না’?

‘দাঁড়াও, দিদি, দাঁড়াও। তোমার একদম হাঁড়ির খবর চাই? তাহলে বলছি শোন। বছর চারেক আগে ওঁনার মেয়ের বিয়ে হল। একটাই মেয়ে। আর এক ছেলে আছে – সেই বড়ো। ওই মেয়ের বিয়ের পরে আমাদের সকলকে মুর্শিদাবাদের মনোহরা আর ছানাবড়া এনে খাইয়েছিল। দারুণ মিষ্টি – দিদি, তুমি খেয়েছ কোনদিন’?

‘ওসব কথা এখন থাকনেক্সট বল...’

‘হ্যাঁ, ওনার ছেলে বিএসসি পাশ করে অনেকদিন বসেই আছে। তেমন কোন কাজ কর্ম জোটেনি। টুকটাক টিউশনি করে হাতখরচ চালায়। মাঝে কি একটা ব্যবসা শুরু করার ঝোঁক হয়েছিল। বাবার থেকে সলিলবাবু লাখ দেড়েক টাকাও চেয়েছিল ধার হিসেবে। কিন্তু বাবা প্রস্তাব দিয়েছিলেন আমাদের ফার্মেসিতে চাকরি করার জন্যে। সলিলবাবু রাজি হননি। তারপরে ওই টাকা ধারের প্রসঙ্গটাও চাপা পড়ে গিয়েছিল।

তারপরে আছেন বংশীবাবু। বংশীধর দে – বংশীধর না ধারী মনে করতে পারছি না। আগে ভীষণ খিটখিটে ছিলেন, কিন্তু মানুষটা ভালো। পান থেকে চুন খসলেই খুব রাগারাগি করতেনতবে বাবাকে খুব ভয় করেন আর সম্মানও করেন। ইদানীং অবিশ্যি ওঁর খিটখিটে ভাবটা বেশ কমে গেছে, জানি না কেন, বেশ কিছুদিন হল শান্তভাবেই কাজকর্ম করছেনএঁড়েদায় বাড়ি। দুই মেয়ে। একমেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে বছর তিনেক হল। আর ছোট মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে – এই সামনের বোশেখে’।         

‘মেয়ের বিয়েতে টাকা পয়সা নিয়ে কোন সমস্যা আছে – জানিস’?

ভীষণমামা তিন নম্বর পরোটা শেষ করে চারে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পায়েসও তুলছে চামচে করে। সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে আওয়াজ করছে পায়েস খাওয়ার সময়। আর আমি দ্রুত হাতে লিখে চলেছি ভীষণমামার দোকানের কর্মচারীদের বায়ো-ডেটা।

মায়ের প্রশ্নে খাওয়া থামিয়ে ভীষণমামা বলল, ‘তুমি ঠিক ধরেছ, দিদি। এই তো দিন পনের আগে বংশীবাবু আমাকে বলেছিল লাখ খানেক মতো টাকা ধার দেবার জন্যে। আমি বলেছিলাম বাবার সঙ্গে কথা বলতে। কারণ দশ-বিশ হাজার হত, সে আমি করে দিতে পারতাম, কিন্তু অতটাকা ধার দিতে গেলে বাবাকে জানাতেই হবে’।

‘বংশীবাবু তোর বাবার সঙ্গে কথা বলেছিলেন কিনা জানিস’?

‘জানি না। বাবা আমাকে তো কিছু বলেননি। আর আমিও ব্যাপারটা ভুলেই গেছিলাম – তুমি জিগ্যেস করাতে মনে পড়ল। তোমার কি মনে হয়, দিদি, তবে কি বংশীবাবুই....’?

‘আমার কিচ্ছু মনে হচ্ছে না, সাগর। আমি এখন শুধু শুনছি। আর কি কি জানিস, বল”।

‘হুঁ, বলছি। বংশীবাবুর বাপ-মা মরা ভাইঝি, কণা, আমাদের দোকানেই জয়েন করেছে বছর দুয়েক হল। যখন আমাদের দোকান রেনোভেট করে, নতুন শোরুম বানিয়ে তোলা হল - তার পর পরই। ছোটবেলাতেই অ্যাক্সিডেন্টে ওর বাপ-মা মরে গিয়েছিল। সেই থেকে বেচারি কাকার কাছেই মানুষহায়ার সেকেন্ডারি পাস করে বসেইছিল। কাউন্টারের জন্যে মেয়ে খোঁজা হচ্ছে শুনে বংশীবাবু বাবা আর জেঠুকে বলে-কয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। শান্ত-শিষ্ট ভালো মেয়ে – কেমন যেন ভিতু ভিতু টাইপের, খুব আস্তে কথা বলে, আর এমনিতে খুব চুপচাপ থাকে। তবে এটা বোঝা যায় কণা, কাকাকে খুব ভালোবাসে এবং কাকাও ভাইঝিকে’

‘ও কেএবার নেক্সট, বল’।

‘নেক্সট, হচ্ছেন, কুন্তল চ্যাটার্জি। ইনিও আমাদের সঙ্গে রয়েছেন প্রায় বছর বিশেক তো হবেই। ব্যাচেলার, খুব শৌখিন লোক। একটু মেয়েলি টাইপ। সারাক্ষণ চুল আর মুখের প্রসাধন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকেন। জামা কাপড়ের দিকেও তীক্ষ্ণ নজর – সর্বদা ফিটফাট ধোপদুরস্ত থাকতে পছন্দ করেন। আর ওঁর ভীষণ শখ পারফিউমের – রোজই নতুন নতুন গন্ধ মেখে শোরুমে আসেন। এসবের মধ্যেও উনি নিজের কাজটা কিন্তু ভালই করেন। উনি অবিশ্যি কাউন্টারে বসেন না। আমাদের হিসেব-পত্র মানে অ্যাকাউন্টসটা উনিই সামলান। আমাদের কনসালটিং চার্টাড অ্যাকাউন্ট ফার্মের সঙ্গে উনিই যোগাযোগ করেন এবং যাবতীয় ট্যাক্সের রিটার্ন সাবমিট, আইন-কানুন উনিই সামলান। উনি থাকেন বিকেপাল-হাটখোলায় নিমু গোঁসাই লেনে’।

‘ঠিক আছে। কুন্তলবাবুর ব্যাপারটা পরে না হয় আবার জানব, নেক্সট বল’।

‘নেক্সট হচ্ছে, মেয়ে দুটি। কণা, যার কথা তোমাকে আগেই বললাম, বংশীবাবুর ভাইঝি। আর আছে শিঞ্জিনী সাঁতরা। প্যারালাইজড বাবাকে নিয়ে মা আর ও থাকে গড়িয়ায় বোড়ালের কাছে। অ্যাকচুয়ালি শিঞ্জিনী হচ্ছে মেজবৌদির মাসীর মেয়ে। বছর আটেক আগে ওর বাবা ম্যাসিভ সেরিব্রাল অ্যাটাকে প্যারালাইজড হয়ে যান। তখন ও সবে হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছে। চিকিৎসার খরচা সামলাতে সামলাতে মোটামুটি নিঃশেষ হয়ে যায় ওর বাবার জমানো টাকা পয়সা। হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে বিএসসিতে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু লেখাপড়া কন্টিনিউ করতে পারে নিশেষমেষ বৌদির রেকমেন্ডেসনে আমরা ওকে এনগেজ করাতে সত্যি ওর খুব সুরাহা হয়েছিল। খুব ভালো মেয়ে। এই বয়সেই খুব ম্যাচিওরড। খাটিয়ে এবং ভীষণ সিনসিয়ার। বাড়িতে এত দুর্যোগের মধ্যেও ভেঙে পড়েনি - লড়ে যাচ্ছে রীতিমতো। শুনেছি শিঞ্জিনীর বাজারে লাখ দুয়েকের মতো দেনা আছে- শোধ করছে আস্তে আস্তে’।

‘শিঞ্জিনীর বয়েস কত হবে – চব্বিশ-পঁচিশ, না?  দেখতে কেমন রে’?

‘এই এপ্রিলে পঁচিশ হবে। দেখতে বেশ – মানে ভালোই...আর কি। কিন্তু, তুমি দেখলে বুঝতে পারবে দিদি, মেয়েটা সত্যি আর পাঁচজনের মতো নয় ...’

‘হুঁ। বুঝেছি... না দেখেও বুঝতে পারছি। শিঞ্জিনী তো হল, নেক্সট বল...’?

‘ব্যস, পাঁচজনই তো কর্মচারি আমাদের – হয়ে গেল তো”!

‘বাঃ, সিকিউরিটি দুজন? তারপরে সজল’?

‘ও হ্যাঁ। ওদেরও শুনবে’? সিকিউরিটিদের মধ্যে একজন রামপ্রীত মিশির। আমরা মিশিরজী বলি। বহুদিন ধরে আছে, আমি অন্তত জ্ঞান হয়ে থেকে ওকে দেখছি। বিহারি – আরা জেলায় বাড়ি। বছরে একবার বাড়ি যায়, প্রায় মাসখানেক থাকে। ওই সময়টা আমাদের সত্যি ভীষণ অসুবিধে হয়। হাট্টা কাট্টা চেহারা – দেখলে বোঝার জো নেই যে ওর বয়েস সত্তরের কাছাকাছি। ওর হাতেই বন্দুক থাকে, সারাটা দিন ও শোরুমের ভিতরে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে – ভেতর, বাইরে দুদিকেই লক্ষ্য রাখে। ওর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আমাদের কারোর কোন দ্বিধা নেই, দিদি, এটুকু বলতে পারি’

‘খুব ভালো কথা, নেক্সট’?।

‘নেক্সট হচ্ছে জনার্দ্দন মাজি। মেদিনীপুরের কোথাও বাড়ি। মেজদার রেফারেন্সে ওকে রাখা হয়েছে, এই মাস ছয়েক হল – এক রকম আমাদের অমতেই। আমাদের কেউই রাজি ছিলাম না। মেজদার জোরাজুরিতে বাবা নিমরাজি হয়ে ওকে রেখেছেন। জেঠু একদম এগেন্সটে ছিলেন – বাবাকে মানাও করেছিলেন অনেকবার। ওকে শোরুমের ভেতর ঢুকতেই দেওয়া হয় না। বাইরেই থাকে। কাস্টমার এলে কাঁচের পাল্লা খুলে দেওয়া আর সেলাম দেওয়াই ওর আসল ডিউটি’

 

একটু থেমে ভীষণমামা আবার বলতে শুরু করল, ‘লাস্ট হচ্ছে, সজল। সজল আমাদের বাড়িতে রান্না করে যে বিভামাসী - তার ছেলে। হুগলীর আদিসপ্তগ্রামে বাড়ি ছিল। বিভামাসীর সঙ্গে ছোটবেলা থেকে আমাদের বাড়িতেই মানুষ হয়েছে। আমরাই ওকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছিলাম, তারপর আর পড়তে চাইল না। এই বছর খানেক হলো ওকে শোরুমে লাগিয়ে দিয়েছি। ফাই ফরমাস খাটে। সকলকে জল দেওয়া, চা দেওয়া - বড় কাস্টমার এলে কোল্ড ড্রিঙ্কস দেওয়া। দুপুরে লাঞ্চের সময় সকলের টিফিন এনে দেওয়া এই সব করে আর কি। বেশ ফুর্তিবাজ ভাল ছেলে, সর্বদা হাসিমুখ। সবার সঙ্গে জেঠু, কাকু, দিদিভাই সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেছে এবং সকলেই ওকে বেশ পছন্দ করে’।

‘ঠিক হ্যায়। আপাতত এই অব্দিই থাকতুই বাড়ি গিয়ে রেস্ট নে। তোরা রাত্রে মোটামুটি কটার সময় ঘুমোতে যাস’?

‘এই ধরো এগারোটা, কেন বলোতো’?

‘যদি দরকার পড়ে, আরো কিছু জানতে তোকে ফোন করতে পারি। আচ্ছা, আরেকটা ব্যাপার বলতো...পুলিশের সার্চিং আর ইনভেস্টিগেশন কটা অব্দি চলেছিল, পুলিশ যাওয়া পর্যন্ত সকলেই কি শোরুমে ছিল’?

‘না, না, সব্বাই চলে গিয়েছিল, জেঠু, বাবা আর আমি ছিলাম শেষ অব্দি। পুলিশ বেরিয়ে যেতে, বাবা ক্যাশ নিয়ে বেরিয়ে এলেন – আমরাও চলে এসেছি’।

‘সকালে কটার সময় তোদের শোরুম খোলা হয়?’   

‘এই ধরো সাড়ে নটার মধ্যে আমি আর সজল চলে যাই। ঝাড়পোঁছ সাফ সাফাই করার জন্যে এক মাসী আসে, তারপর দশটা – সোয়া দশটা থেকে শোরুম পুরো খুলে যায়’।

‘গুড, কাল আমাকেও তুলে নিবি, যাওয়ার সময়, আমি যাব তোদের সঙ্গে

‘কেন বলতো, দিদি?’

‘সে পরে বলবএখন আয়, রাত হল আর দেরী করিস না। যা হবার কাল হবে। আর ও হ্যাঁ, দরকার পড়লে এগারোটার মধ্যে ফোন করতে পারি। চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে’।

 

 

 

মায়ের সুতোর গোলা গড়িয়ে গড়িয়ে চেয়ারের পা আর আমার পড়ার টেবিলের পায়ের সঙ্গে পাকিয়ে জড়িয়ে-মরিয়ে বিচ্ছিরি জট পড়ে গিয়েছিল। ভীষণমামা চলে যাবার পর, মা আমাকে সুতোর জট ছাড়িয়ে আবার গোলা পাকাতে বলে, আমার লেখাগুলো নিয়ে বসলেন। আমি বসলাম সুতোর জট ছাড়াতে আর মা বসলেন ভীষণমামার হীরে রহস্যের জট ছাড়াতে। 

সুতোর জট ছাড়িয়ে গোলা পাকিয়ে আমি যখন সবে মায়ের পাশে বসে বুঝতে গেলাম কতখানি রহস্যভেদ হল, মা বললেন, ‘বাবাঃ, দশটা কুড়ি হয়ে গেছে? চ, চ, খেয়ে নিই - বেচারা প্রতিমা খাবার কোলে বসে আছে’। কাজেই রহস্য নিয়ে কোন কথা আর হল না। নিচেয় খাবার টেবিলে তো কোন কথাই সম্ভব নয়। কারণ মা তো অলরেডি বলেই দিয়েছিলেন প্রতিমাদির সামনে এসব নিয়ে কোন আলোচনা না করতে। আমি ভীষণ টেনসানে চটপট খেয়ে নিলাম, কিন্তু মা প্রতিমাদির সঙ্গে কালকে কি রান্না হবে সেই নিয়ে আলোচনা করলেন খুব শান্তভাবে। কাল শনিবার, বাবা আসবেন রাতের দিকে। রোববারটা থেকে আবার বেরিয়ে যাবেন সোমবার ভোরের ট্রেনে। বাবার প্রিয় কিছু খাবারের প্রিপেরেসনের কথাই মা বলে দিলেন প্রতিমাদিকে।

 

খাওয়ার পর আমরা ওপরে চলে এলাম। মা নিজের ঘরে গিয়ে ফোন করলেন ভীষণমামাকে।

‘হ্যালো, সাগর? শোভাদিদি বলছি, রে...

‘.....’  

‘একটা কথা, তোরা এবং পুলিশ শোরুমের সব জায়গাই তো খুঁজেছিলি, না’?

‘....’

‘টয়লেটে’?

‘.....’

‘ঠিক আছে। আমি কিন্তু কাল সকালে তোর জন্যে ওয়েট করবো। শুয়ে পড়, গুড নাইট’।

‘.....’           

ফোনটা রেখে মা আবার আমার ঘরে এলেন, আমার বিছানা থেকে খাতাটা নিতে নিতে বললেন, ‘জানি রে সোন্টু, তোর পেট ফেটে যাচ্ছে সব কিছু শুনতে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত বলার মতো কিচ্ছু মাথায় আসছে না। রাতটা একটু ভাবতে দে। তাছাড়া প্রতিমাও এখনি শুতে চলে আসবে। আজকের রাতটা একটু টেনসনে কাটা, কাল কিছু একটা হয়ে যাবে। তাছাড়া কাল তোর স্কুল ছুটি যখ্‌ন, আমার সঙ্গে চ, অনেক কিছু দেখতেও পাবি হয়তোগুডনাইট, ভুটকু’ মা চলে গেলেন আমার লেখা খাতাটা নিয়ে।

 

 

 

 

মায়ের ওপর বেশ রাগ হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু মায়ের যুক্তি না মেনে উপায়ও নেইকাজেই টেনসান নিয়ে আর গোমড়া মুখ করে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। অন্যদিন রাত সাড়ে এগারোটা-বারোটা অব্দি পড়ি, আজকে ইচ্ছে হল না। শুয়ে শুয়ে ঘরের সিলিংযের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম, ভীষণমামার কর্মচারীদের জীবন বৃত্তান্ত। মা পারবেন তো সলভ করতে? এর আগে ছোটখাটো সমস্যা মাকে সলভ করতে দেখেছি। কিন্তু এটা অনেক বড় ব্যাপার, বেশ জটিল এবং অনেক টাকারও।

 

ছোটবেলা থেকেই দেখেছি মা হচ্ছেন গোয়েন্দা গল্পের পোকা। ফেলুদার ভীষণ ভক্ত। ব্যোমকেশকেও বেশ পছন্দ করেন। আর শার্লক হোমস তো রয়েইছেন! এর সঙ্গে সঙ্গে দেখেছি মায়ের কাছে শক্ত শক্ত ধাঁধাঁ, পাজল-টাজল, লজিক্যাল প্রব্লেম কোন ব্যাপার না। আমার বাবা ইঞ্জিনীয়ার - কিন্তু এসব ব্যাপারে মায়ের কাছে দেখেছি একদম হেরো হয়ে যান। কাজেই জানিনা কেন আমার মনে হচ্ছিল, এই হীরে গায়েবের রহস্যটা মায়ের কাছে নস্যি। আর পুলিশরা কোন কিনারা করার আগেই মা নিশ্চিত হিল্লে করে দেবে ব্যপারটার।

 

ভীষণমামাদের ফ্যামিলিটা অদ্ভূত ভালো। বিশাল বনেদি বড়লোক। বিশাল বাড়ি-গাড়ি সবই আছে – কিন্তু বড়লোকেদের মতো এতোটুকু অহংকার বা দেমাক নেই। ছোটবড়ো সকলের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক রেখে চলেন। তবে ওঁনাদের সকলের নামগুলো শুনলে মনে হয় মান্ধাতার আমলের কলকাতার ইতিহাস থেকে নেওয়া। ভীষণমামার বাবারা দুই ভাই - জেঠুর নাম ভবতারণ সেন, আর বাবার নাম ভবশরণ সেনওঁনারা অবিশ্যি আমার দাদু হন, আর আমাকে খুব ভালোও বাসেন। আমার নাম যদিও জ্যোতিষ আর ডাক নাম জ্যোতি, ওঁনারা আমাকে ডাকেন নন্দকিশোর বলে। ওঁনারা ভীষণ রাধাকৃষ্ণের ভক্ত। আর ওঁদের বাড়ির একতলার বিশাল ঠাকুরঘরে সোনার মুকুট মাথায় পড়ানো রাধা-কৃষ্ণের যুগলমূর্তি আছে – সেও দেখার মতো।

ভবতারণবাবুর দুই ছেলে – ভবনিধি আর ভবধারা, আর ভবসাগর মানে ভীষণমামা ভবশরণবাবুর একমাত্র ছেলে। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে একসঙ্গে বড়ো হয়েছেন বলে ভীষণমামা ওঁদের বড়দা, মেজদা বলে

ভীষণমামার আগেকার দোকানে এবং পরে রেনোভেট হয়ে সাজানোগোজানো ঝাঁ চকচকে শোরুমে বার কয়েক গিয়েছি। পয়লা বোশেখ-নববর্ষের দিন তো বটেই – ওঁনারা অবিশ্যি বলেন হালখাতা। লাল শালুমোড়া ভাঁজ করা একটা মোটা খাতা সকাল সকাল চলে আসে কালীঘাটে মাকালীর চরণের স্পর্শ নিয়ে। তার প্রথম পাতায় থাকে লাল আলতায় ডোবানো টাকার ছাপ, তার নীচে আলতায় লেখা থাকে “শুভ লাভ” আর স্বস্তিক চিহ্ন

 

সারাটা সন্ধেয় ভীষণমামার বর্ণনা অনুযায়ী লোকগুলোর বায়ো-ডেটা মনে করার চেষ্টা শুরু করলাম। ভীষণমামার মেজদা, সলিল মজুমদার, বংশীধর দে আর তাঁর ভাইঝি কণা দে, কুন্তল চ্যাটার্জী, শিঞ্জিনী সাঁতরা, রামপ্রীত মিশির, জনার্দ্দন মাজি আর বিভা মাসীর ছেলে সজল। মেজদার কুসঙ্গের খরচের টাকা। সলিলবাবুর ছেলের ব্যবসার জন্যে টাকা। বংশীবাবুর মেয়ের ও ভাইঝির বিয়ের টাকা। শিঞ্জিনীর বাবার অসুখের দেনা। টাকার দরকার তো সবারই!

 

মেজদা - যতই কুসঙ্গে মিশুক, নিজের কাকা এবং নিজের ভাইয়ের দোকান থেকে গয়না সরিয়ে নেবে, অন্ততঃ আমার এটা মনে হচ্ছে না। যদিও ‘কুসঙ্গ’ ব্যাপারটা ঠিক কি আমার পরিষ্কার আইডিয়া নেই, তবে – ‘কুসঙ্গ’ কি - আমি জিগ্যেস করাতে মা যে ভাবে কড়া চোখে তাকালেন, তাতে কুসঙ্গের প্রভাবে, কে জানে কী না কী হতে পারে!

 

সলিল মজুমদার - ছেলেকে একটা কিছু করে দাঁড় করাবার চিন্তা, তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে তাঁর ছেলের ব্যবসার টাকা যোগাড়ের জন্যে হাত সাফাই করা খুব অসম্ভব নয়

 

বংশীবাবু ও কণা দে – মনে হয় ভাইঝির দায়িত্ব নেবার জন্যে তাঁর বাড়িতে অশান্তি ছিল। ইদানীং কণার চাকরি হওয়াতে তিনি অনেকটাই নিশ্চিন্ত। কিন্তু তাঁরও মাথায় আছে নিজের ছোট মেয়ে আর তারপরে ভাইঝিরও বিয়ে দেওয়ার দুশ্চিন্তা। কারণ তাঁর এই অসহায় ভাইঝিটিকেও তিনি নিজের মেয়েদের মতোই ভালোবাসেন। কাজেই তাঁর পক্ষেও গয়না সরিয়ে টাকা জোগাড়ের এই ফন্দি অসম্ভব নয়।

 

কুন্তল চ্যাটার্জী – আপাতত কোন উদ্দেশ্য তাঁর পাওয়া যাচ্ছে না এবং তাঁর পক্ষে গয়না সরানোর সু্যোগও নেই বললেই চলে

 

শিঞ্জিনী সাঁতরা – বাবার অসুখের দেনায় বেচারা ডুবে আছে। তার পক্ষেও এমন কাজ করে ফেলা কিছু অসম্ভব নয়।

 

এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই জানিনা কোথা থেকে নাকে ভীষণ কড়া পারফিউমের গন্ধ পেলামএকজন লোক - মুখটা দেখা যাচ্ছে না, পিছন ফিরে অনেকক্ষণ ধরে চুল আঁচড়েই চলেছে আর হাত দিয়ে চুল সেট করে চলেছে গন্ধটা মনে হয় ওই লোকটার গা থেকে আসছে।  ওদিকে খুব তীক্ষ্ণ গলায় কেউ চিৎকার করে বলছে – ‘হীরেগুলো কে সরাল শুনি? আমি জানতে চাই কে সরাল...যত্তো সব আহাম্মকের দল। এই ভাবে কেউ হীরে সরায়’? হঠাৎ ভীষণমামা সামনে এসে দাঁড়াল, বলল, “হীরে কে সরিয়েছে, আমি জানি। হীরে সরিয়েছে জ্যোতি, কারণ আমার বাবাকে বহুবার বলতে শুনেছি, জ্যোতি, হীরের টুকরো ছেলে...তাহলে?” সেই শুনে লাগাতার চুল আঁচড়ানো লোকটা, পিছন ফিরে থেকেই বলে উঠল, - “ওমা, তাই? তাহলে তো আমাদের জ্যোতি, ভীষণ অসব্য আর দুষ্টু...”  আমি বলে উঠলাম – “মোটেও না, আমি মোটেই হীরে সরাই নি”।  সেই শুনে একটি মেয়ের গলা পেলাম, “ঠিক আছে, আগে তো ওঠ...ওঠ ওঠ...ওঠ না”।

 

‘উঠে পড়। সেই থেকে ডাকছি কি ঘুম, রে বাবা তোর। এখনো উঠলি না’? কিন্তু এই মেয়েটির গলা তো আমার ভীষণ চেনা। আরে, এতো আমার মায়ের গলা... আমার মা আমাকে ডাকছেন তো... তার মধ্যে ওই লোকগুলো কোথা থেকে এসে জুটল? নাঃ, এবার তো উঠতেই হবে... উঠে পড়লাম, বুঝলাম আমি এতক্ষণ ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিলাম, আর বাস্তবটা হল মায়ের ডাক। স্নান-টান সেরে মা আমার ঘরে এসেছেন - আমার টেবিলের বইপত্রগুলো গোছাচ্ছেন আর আমাকে ডেকে চলেছেন - আমার ঘুম ভাঙানোর জন্যে।

 

 

 

 

নটা বেজে আট মিনিটে ভীষণ মামার সাদা স্কর্পিও গাড়িটা আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়াল। মা আর আমি রেডিই ছিলাম। প্রতিমাদিকে বলে আমরা বেরিয়ে গাড়িতে উঠলাম। সজল বসেছিল সামনে। আমি মাঝখানে ঢুকে বসতে মা উঠে এলেন বাঁদিকে, আর আমার ডান দিকে ভীষণমামা। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভীষণমামার শোরুমে পৌঁছতে পাক্কা আঠারো মিনিট লাগল। আমরা দোকানে পৌঁছলাম নটা ছাব্বিশে।

 

দোকানের কোলাপসিবল গেট বন্ধ। তিনটে তালা ঝুলছে। ভীষণমামা মিশিরজীকে ডাকতে, ভিতরের কাঁচের ভারি দরজা খুলে, হাতে চাবির বিশাল বোঝা নিয়ে বেরিয়ে এল মিশিরজী। হরেক রকমের - অন্ততঃ পঞ্চাশটা চাবি আছে মস্ত রিংটায়। সেখান থেকে ঠিকঠিক চাবি বের করে তিনটে তালাই চটপট খুলে দিয়ে মিশিরজী গেট খুলে দিল। গেটটা পুরোটা খুলবে না, কারণ মাথার একটু ওপরে লোহার চেন দিয়ে কোলাপসিবল গেটটা বাঁধা এবং তালা দেওয়া একজন লোকের বেশী একবারে ঢোকা সম্ভব নয়।

ভারি দরজা দিয়ে ঢুকেই বাঁদিকে মিটার রুম। মা মিটার রুমের দরজাটা খুলল, দরজাটা খুলেই সামনের দেওয়ালে দুটো মিটার লাগানো, তার সঙ্গে মেন সুইচ। নীচে - ওপরে ইলেক্ট্রিকের অনেক তার এলোমেলো ঝুলে আছে। মা গলা বাড়িয়ে ভিতরে দেখলেন – আমিও দেখলাম তিনটে ভাঙা প্লাস্টিকের চেয়ার, অনেকগুলো বাতিল গয়নার বাক্স। খালি ভাঙাচোরা পেটি, একটা কমপিউটার কিবোর্ড। ছোট্ট এক চিলতে ঘরটা ডাম্পরুম হিসেবেও ব্যবহার হয় - বোঝা গেল।

মা ভীষণমামাকে বললেন, ‘ওই জঞ্জালের মধ্যেই চারটে কিটক্যাটই পাওয়া যাবে। বেশি খুঁজতেও হবে না’।

‘থাক, থাক, তোমাকে আর ওই জঞ্জালের মধ্যে কিটক্যাট খুঁজতে হবে না বেরিয়ে এসো, দিদি। হীরে খুঁজতে এসে তুমি কিটক্যাট খুঁজছ’?

 

ভীষণমামার গলায় কেমন যেন বিরক্তির সুর। আমরা মিটার রুমের দরজা ছেড়ে সরে আসতেই, ভীষণমামা খুব তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিল। ভীষণমামাকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল। মায়ের সঙ্গে এভাবে কথা বলতেও কোনদিন শুনিনি আমি। মা কি ভীষণমামার এই ব্যবহার লক্ষ্য করল না? বুঝতে পারলাম না, কারণ এরপরই মা জিগ্যেস করলেন, ‘হ্যারে, তোদের টয়লেটটা কোথায়, রে’?

‘ওই তো সামনে বাঁদিকের কোণায়। কেন তুমি যাবে নাকি এখন’?

‘হ্যাঁ। যাবো। জ্যোতি আমার সঙ্গে আয় তো...’ মা টয়লেটের দিকে এগোলেন, সঙ্গে আমিও।

হঠাৎ ভীষণমামা অদ্ভূত এক কান্ড করে বসল। দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে, মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দিদি, তুমি এখন টয়লেটে যাবে না। আগে আমি যাবো, তারপর..., আমি আগে যাবোই’।

 

আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম টয়লেট যাওয়া নিয়ে ভীষণমামার এই জিদ দেখে। মায়ের দেখলাম কোন তাপ-উত্তাপ নেই। মায়ের মুখে হাল্কা হাসি, অনেকক্ষণ ভীষণমামার দিকে তাকিয়ে থেকে মা স্মিতমুখেই বললেন, ‘আমাকে তুই দিদি বলে মোটেই ভাবিস না, সাগর। ভাবলে এতদূর নীচেয় তুই নামতে পারতিস না। পথ ছাড়, আমাকে যেতে দে। আমাকে আমার কাজ করতে দে। তাতে আমি বলছি তোর ভালো হবে। তুই আমাকে যাই ভাবিস, আমি কিন্তু তোকে ভাই ছাড়া অন্য কিছু ভাবি না’।

মায়ের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল ভীষণমামা, তারপর কী বুঝল কে জানে, হাত নামিয়ে সরে দাঁড়াল।

 

মা আর আমি টয়লেটে ঢুকলাম – একটা কমোড আর একটা ওয়াশ বেসিন। ওয়াশ বেসিনের ওপর লিকুইড সোপ কন্টেনার। দেওয়ালে আয়না। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন – ঘরের মধ্যে ন্যাপথালিন আর ডিজইনফেক্ট্যান্টের গন্ধ। টয়লেটের ভিতরে ঢুকে মা চারদিকটা চোখ বুলিয়ে নিলেনতারপর কমোডের সামনে গিয়ে লো-হাইট সিস্টার্নের ঢাকনাটা খুলে ফেললেনখোলাই ছিল – পোর্সেলিনের ঢাকনাটা আলগা চাপানো ছিল ট্যাংকের ওপর। মা নীচু হয়ে সিস্টার্ন ভরা জলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে দিলেনআর একটু পরে ভেজা মুঠি তুলে আনলেন জলের বাইরে। তারপর ঢাকাটা আবার লাগিয়ে দিলেন – দুপাশের স্ক্রু টাইট করে ঠিকঠাক – তারপর বললেন, ‘স্যানিটারি-প্লাম্বিং ব্যাপারটাও ভাগ্যিস অল্পবিস্তর জানা ছিল, কাজে লেগে গেল, কি বলিস সাগর? যাই হোক ভালো করে লাগিয়ে দিলাম, আর মনে হয় খুলতে হবে না’।

 

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ভীষণমামা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে – তার বিষণ্ণ ম্লান মুখ কাগজের মতো সাদাআমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। জলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে মা কি তুলে আনলেন তাও জানি না। কিন্তু টয়লেট থেকে বেরিয়ে মা ভীষণমামাকে ডেকে বললেন, ‘আয় আমার সঙ্গে, কিছু কথা আছে, কোন ঘরে বসা যায় বল তো, সাগর? ভুটকু আয়’ 

 

আগেই বলেছি, আমার ডাক নাম জ্যোতি। মা ভালো মুডে থাকলে আমাকে অবিশ্যি ভুটকু, সন্টু, মান্টু যা খুশি নামে ডাকেন। আর আমার ওপর রেগে গেলে বা কোন টেনসনে থাকলে জ্যোতি ডাকেন। একটু আগে আমাকে জ্যোতি বলে ডেকেছিলেন, এখন আবার ভুটকু। তার মানে মা এখন ভালো মুডে আছেন। পুরোটা না বুঝলেও এটুকু বুঝলাম, মা রহস্যের জট মোটামুটি খুলে ফেলেছেন - আর সেটা পুলিশরা ধরে ফেলার আগেই!

 

 

 

 

বাবা, মা এবং আমি ভীষণমামার বাড়ি পৌঁছলাম সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ। ভীষণমামা নীচেই ছিল, বাবাকে গাড়ি রাখার জায়গা দেখিয়ে দিতে, বাবা গাড়ি লক করে বেরিয়ে এলেন – তারপর আমরা চারজনেই বাড়িতে ঢুকলাম। নীচের ঠাকুরঘরে রাধা-কৃষ্ণ মন্দিরের সামনে বসে মা গড় হয়ে প্রণাম করলেন। বাবা হাঁটু মুড়ে বসে, দেখাদেখি আমিও একইভাবে প্রণাম করলাম। একটু আগেই আরতি হয়ে গেছে। ধূপের আর নানান ফুলের পবিত্র সুবাসে মনটা স্নিগ্ধ হয়ে এল।

প্রণাম সেরে পিছন ফিরেই আমরা দেখলাম, ভীষণমামার বাবা ভবশরণবাবু দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর মুখে সৌম্য প্রীতির হাসি। আমাদের দেখেই বললেন, ‘এসো, মা এসো। আসুন সমরেশবাবু, আসুন। অনেকদিন পরে আপনাদের আবির্ভাব হল বলা যায়’। তারপর আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘কিরে, দাদুকে আর মনেই পড়ে না নাকি – আয়, আয়, ওপরে চল’?

 

সবাই মিলে আমরা ওপরে গেলাম। দোতলায় ভীষণমামারা থাকেন। আর তিনতলায় ভীষণমামার জেঠুরা। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে বাঁদিকের প্রথম ঘরটাই বসার ঘর। বেশ বড়ো - সোফা, ডিভান, টিভি। কাঁচের দেওয়াল আলমারিতে শোপিস দেওয়ালে গোপিনী সহ রাধা-কৃষ্ণের রাস লীলার ছবি - ব্যাকগ্রাউন্ডে জ্যোৎস্নাসহ পূর্ণিমার চাঁদ এবং কদম গাছ, কাছে দূরে কয়েকটা ময়ূর আর হরিণ। আর কদম গাছের ডালে বাঁধা ঝুলা থেকে ঝুলছেন কৃষ্ণকিশোর আর রাইকিশোরী। তেল রঙে আঁকা ছবিটার এমনই প্রভাব গোটা ঘরটাকেই খুব উজ্জ্বল আর আনন্দময় লাগে। আমি যতবার এসেছি ছবিটা দেখে মুগ্ধ হয়েছি।

 

আমরা সবাই বসার পর ভবশরণবাবু বসলেন একটা সিঙ্গল সোফায়। ভীষণমামা বসল ওঁনার পিছনে একটা কুশন আঁটা চেয়ারে।

সবার মুখের দিকে তাকিয়ে ভবশরণবাবু বললেন, ‘প্রথমে একটু নাতি শীতল সরবৎ সেবা হোক। তারপর সামান্য মিষ্টিমুখ। দাদা আসছেন। দাদা এলেই আমাদের কথাবার্তা শুরু হবে। কিন্তু যে বদনাম থেকে তুমি আমাদের পরিবারকে বাঁচালে, শোভামা, তার কোন মূল্য হয় না। তুমি ভাবছ বুড়ো উচ্ছ্বসিত হয়ে গেছে - তা নয় মা – বরং ভেবে নিশ্চিন্ত লাগছে - আমরা চোখ বুজলেও সাগরের মাথার ওপর সর্বদা তার মাথায় থাকবে তার দিদির মমতাময়ী হাত’। ভীষণমামার বাবা ভবশরণবাবুর কথাগুলো আমার ভালই লাগল। বাবা-মায়ের প্রশংসা শুনলে কোন ছেলের বুকটা গর্বে না ফুলে ওঠে?   

 

ভীষণমামার মা এলেন ঘরে, সঙ্গে কাজের মেয়ের হাতের ট্রেতে সুদৃশ্য মার্বেলের গ্লাসে সরবৎ। ভীষণমামার মায়ের পরনে চওড়া লাল আর মেরুনের ডোরা পাড় সাদা খোলের শাড়ি। পায়ে আলতা। কপালে-সিঁথিতে সিঁদুর - স্মিত, শান্ত মুখ দুই হাতেই অনেকগুলি চুরি আর শাঁখা-পলা।  নিজে হাতে সবাইকে সরবতের গ্লাস পরিবেশন করলেন। পরিবেশন শেষে মায়ের পাশে এসে বসলেন। মায়ের একটি হাত টেনে নিজের হাতে নিয়ে বললেন, ‘কতদিন পরে এলি বল দেখি, শোভাভুলেই গেছিলি মনে হয়?’

‘না, না, মাসিমা, ভুলব কেন? আসলে ও বাইরে থাকে, জ্যোতির স্কুল, টিউসন, লেখাপড়া...সময় হয়ে ওঠে না’। মা অন্য হাতে ভীষণমামার মায়ের হাতটি চেপে ধরে বললেন।

‘তা ঠিক, আজকাল সকলে এত ব্যস্ত, কারুর হাতে সময় নেই...তবু ভাল সাগর এই কেলেঙ্কারি করল বলে তোর সময় হল...মাসিমার সঙ্গে দেখা করার সু্যোগ হল’।

মা কিছু উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই ভীষণমামার জেঠু ঘরে ঢুকলেন। সকলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘আমার একটু দেরি হয়ে গেল দোকান থেকে ফিরতে...। অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম আপনাদের’।

মা বললেন, ‘না, না, মেসোমশাই, আমরা এই একটু আগেই এসেছি। মাসিমার সঙ্গে আলাপ করছিলাম। আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই – ইনি আমার স্বামী সমরেশ সান্যাল... ওই যাঃ, স্বামীর নাম নিয়ে ফেললাম, মাসিমা দোষ নিও না কিন্তু... আর এটি আমার পুত্র জ্যোতিষ্ক সান্যাল...’। বাবা আর আমি ভদ্রলোককে জোড় হাতে নমস্কার করলাম, উনিও প্রতি নমস্কার করলেন, তারপর বললেন, ‘ভেরি গুড, আলাপ হয়ে ভালই লাগল। খাঁদুর মুখে যা শুনলাম আপনার কথা – আপনি তো মির‍্যাকল করে দিয়েছেন – আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন থানা পুলিশের হ্যাপা-হুজ্জোত আর বদনাম থেকে’।

 

শেষ কথাগুলো উনি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন। ‘খাঁদু’ নামটা কার আমি বুঝতে পারলাম না, ভীষণমামার নয় জানি – ভীষণমামার বাবার কি? হতেও পারে, মায়ের মুখে শুনেছি আগেকার দিনে এমন নাকি হত – যার ভাল নাম হয়তো সমরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরি - তার ডাক নাম হল ‘ন্যাপা’! ভীষণমামার জেঠু সবার মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আমরা তো সবাই রেডি, তাহলে, শোভা মা, শুরু কর তোমার কথা। আর দেরি করার কোন কারণ নেই...। কি বলিস রে, খাঁদু’? খাঁদু অর্থাৎ ভীষণমামার বাবা ভবশরণবাবুও মাথা নেড়ে জেঠুর কথায় সায় দিলেন। তার মানে আমার অনুমানই ঠিক - ভীষণমামার বাবা ভবশরণ সেনের ডাকনাম ‘খাঁদু’।

 

ঘরের সকলেরই দৃষ্টি এখন মায়ের দিকে। কারুর মুখে কোন কথা নেই, সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন মায়ের কথা শোনার জন্যে। মা কি একটু নার্ভাস ফিল করছেন? মা বাবার দিকে একবার তাকালেন, বাবা মায়ের দিকেই তাকিয়েছিলেন, সামান্য মাথা নাড়িয়ে বাবা মাকে শুরু করতে বললেন।

মা শুরু করলেন, ‘গতকাল, সাগর এসে বলল যে - আপনাদের দোকান থেকে পরপর দুদিন হীরের গয়না চুরি গিয়েছে। শুনে আমি খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম। পরপর দুদিন কি ভাবে চুরি হওয়া সম্ভব? একই লোক দুদিন করল? নাকি দুদিন আলাদা দুজন লোক? তারপরে স্বাভাবিক কৌতূহল থেকে সাগরের থেকে জিগ্যেস করে সবটা শুনে আবার আশ্চর্য হলাম – চুরির পদ্ধতিটাও এক। খালি সময়ের হেরফের। অর্থাৎ যে কাজটা করছে সে সিসিটিভি অফ রাখতে চাইছে এবং তার সঙ্গে আচমকা লাইট চলে যাওয়াতে, সকলের অপ্রস্তুত অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে। তখন একটা ব্যাপার আমার মাথায় এলো - মেন সুইচ থেকে কিটক্যাট সরানো, আর কাউন্টার থেকে গয়না সরানো - একইজনের কাজ হতে পারে না। মিনিমাম দুজন থাকতেই হবে।

 দুজন থাকার কথাটা যখন আমার মাথায় এলো, তখন আমি জুটি খুঁজতে শুরু করলাম। এমন জুটি যাদের নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস আর ভালো তালমিল থাকা একান্ত জরুরি। সাগরের বর্ণনা অনুযায়ী দেখলাম তিনটে জুটি দাঁড়াচ্ছেপ্রথম বংশীধরবাবু আর তাঁর ভাইঝি কণা। সাগরের মেজদা আর শিঞ্জিনী – কারণ ওরা পূর্ব পরিচিত শালী-জামাইবাবু। অথবা মেজদা আর জনার্দ্দন - কারণ জনার্দ্দনকে মেজদাই একরকম জোর করে ঢুকিয়েছেন...’।

 

এই অব্দি বলে মা একটু থামলেন। সকলেই আগ্রহ নিয়ে শুনছিলেন, কেউ কিছু বললেন না – অপেক্ষা করতে লাগলেন কতক্ষণে মা আবার শুরু করবেন। আমি ভাবছিলাম এত সহজ যুক্তিগুলো কেন আমার মাথায় আসে নি? যাই হোক মা আবার শুরু করলেন, ‘এরপর সাগরের বর্ণনা শুনে বুঝলাম বংশীধরবাবু, কণা, শিঞ্জিনী, মেজদা সকলেরই বেশ কিছু টাকার দরকার। বংশীধরবাবুর মেয়ের এবং ভাইঝি কণার বিয়ের গুরু দায়িত্ব, শিঞ্জিনীর মাথায় বাবার চিকিৎসার অনেক দেনা, মেজদার বাজে খরচের বোঝা। জনার্দ্দন এখানে খুব বড়ো ফ্যাক্টর নয় – নিডি গরিব ছেলে, দশ-বিশ হাজারই তার কাছে অনেক।

এরপর আমার মাথায় এলো কাজটা সুন্দর করে সমাধা করার সুযোগ কার বেশি। এখানে দেখলাম জনার্দ্দনের কোন রোল হতেই পারছে না। জনার্দ্দনের গেটের ভিতরে ঢোকার অনুমতি নেই। তার পক্ষে কিটক্যাট খুলে ফেলা বা ভিতরে ঢুকে গয়না সরানো সম্ভব নয়। মেজদার পক্ষে কিটক্যাট সরানো হয়তো সম্ভব – কিন্তু গয়না সরানো অসম্ভব। তিনি কাউন্টারের ওপারে গিয়ে গয়নার বাক্সে হাত দিলে সবারই চোখে পড়ে যাবেন – কারণ কোনদিনই মেজদা আপনার দোকানের কাউন্টারে বসেন না, বা গয়না ঘাঁটাঘাঁটি করেন না। কাজেই রইল বাকি তিন বংশীধর, কণা আর শিঞ্জিনী।

এইখানে আমার আবার একটা ব্যাপার মাথায় এলো - সাহস। কার পক্ষে কতটা সাহসী হওয়া সম্ভব? মানে এই যে গয়নাগুলি চুরি গেল - এটা তো ধরা পড়বেই। এবার কে চুরি করল – এটা নিয়ে হৈ চৈ হবেই...। আমি চুরি করলাম অথচ আমাকে ধরা যাবে না তখনই, যখন আমি অন্য কারুর ঘাড়ে চুরির দায়টাকে গছাতে পারব। আর যদি সেটা আমি না পারি, ধরা পড়তেই হবে — সেক্ষেত্রে আমার বা আমাদের চাকরিটি যাবে! এইবার আরেকটা দিক ভাবার কথা, এই বাজারে বংশীবাবু ও কণার পক্ষে একসঙ্গে সেই রিস্ক নেওয়া সম্ভব কি? সাগরের মুখে যা শুনেছি একেবারেই সম্ভব নয়। ওঁদের এতোদিনের চাকরিটা গেলে ওঁনারা আক্ষরিক অর্থেই পথে বসবেন। কাজেই রইল বাকি শিঞ্জিনী আর মেজদা।

 

এইখানেই সাগর আমাকে কনফিউজড করে দিয়েছিল এবং আমাকে বেশ খানিকক্ষণ ভাবিয়ে তুলেছিল। শিঞ্জিনী মেজবৌদির মাস্তুতো বোন, কাজেই মেজদার শালীমেজদার সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক থাকা মোটেই অসম্ভব নয়। কিন্তু আমার মনে একটা খটকা লাগল, শিঞ্জিনীর পরিচয় দেবার সময় সাগর একবারও মেজদার সঙ্গে কোনরকম সম্পর্কের কথাই উল্লেখ করল না। সবসময়েই মেজবৌদির রেফারেন্স দিল। এবং শিঞ্জিনীর কথা বলার সময় ওর গলায় খুব একটা আবেগ ছিল – যেটা অন্য কারোর ক্ষেত্রে আমি পাইনি। এটাও আমাকে খুব ভাবিয়ে তুলেছিল। সাগর শিঞ্জিনীর জন্মদিন জানে, বয়েস জানে, যেটা যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ না হলে জানার কথা নয়। এতগুলো লোকের এবং কণারও পরিচয় দিল খুব স্বাভাবিক নির্লিপ্ত স্বরে, কিন্তু শুধুমাত্র শিঞ্জিনীর ক্ষেত্রেই সেটা পাল্টে গেল। কেন?

এটা তখনই সম্ভব, যদি শিঞ্জিনীর সঙ্গে ওর মনের একটা নিবিড় যোগাযোগ ঘটে থাকে, এবং সেটাই ঘটে গেছে। অর্থাৎ সাগর শিঞ্জিনীর প্রতি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে আর মনের সেই দুর্বলতার টানেই ঘটিয়ে ফেলল এমন একটা ঘটনা। সাগর ভেবেছিল এতগুলো লোকের মধ্যে কনফিউজড হয়ে সমস্ত ব্যাপারটাই খিচুড়ি হয়ে যাবে – আর সমস্ত ব্যাপারটা রহস্য হিসেবেই থেকে যাবে। সকলেই সকলকে সন্দেহ করবে – কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কাউকেই নিশ্চিতভাবে সাব্যস্ত করা যাবে না। দু-ছমাস পরে ব্যাপারটা ধামা চাপা পড়ে যাবে দুঃস্বপ্নের মতো’                        

 

মা একটানা কথা বলার পর থামলেন। টেবিলে রাখা গ্লাস তুলে এক চুমুকে বাকি সরবৎটুকু পান করে গ্লাসটা আস্তে আস্তে টেবিলে রাখলেন – যাতে কোন শব্দ না হয়। ঘরে সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভীষণমামার বাবা ও জেঠু মুখ নীচু করে গভীর চিন্তায় মগ্ন। ভীষণমামার মাও মুখ নীচু করে আছেন কিন্তু তাঁর চোখ থেকে ঝরে পড়ছে অশ্রু।

বেশ কিছুক্ষণ পরে ভীষণমামার মা প্রথম কথা বললেন কান্নাভেজা স্বরে, ‘কি বিপদের হাত থেকে যে, তুই আমাদের বাঁচালি, শোভা। গয়না যেত সে তো যেতই। তার চেয়েও বড়ো ক্ষতি হতো এই পরিবারে। আমাদের নিজেদের সংসারেও ঢুকে পড়তে পারত অবিশ্বাস, সন্দেহ আর অশান্তি। এ বাড়ির তিন ছেলেকে আমরা কেউই আলাদা করে দেখিনি কোনদিন। আমি মুখ দেখাতে পারতাম না রে, দাদা আর দিদিভাইয়ের কাছে। নিধি আর ধারার কাছেও লজ্জা রাখার জায়গা থাকতো...?

তারপর নিজের শাড়ির আঁচলে নাক আর চোখ মুছে ভীষণমামাকে বললেন, “কিরে? সেই থেকে বসে বসে নিজের কুকম্মের বৃত্তান্ত গিলছিস, যা না বামুনদিকে বলে সবার জলখাবারটা এখানে পাঠিয়ে দে’।

ভীষণমামার পক্ষে এই ঘরে এই পরিস্থিতিতে বসে থাকা সত্যি বেশ অস্বস্তিকর, তাই ছাড়া পেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছিল, ভীষণমামার মা আবার ডেকে বললেন – ‘আর শোন। তোকে আর এখন আসতে হবে না - আমাদের কিছু জরুরি কথা আছে...এখানে তোর না থাকাই ভাল’।

 

 

 

 

সে রাত্রে গাড়িতে বাড়ি ফেরার পথে মাকে জিগ্যেস করেছিলাম, ‘মা, তোমার যুক্তি সব তো বুঝলাম। কিন্তু টয়লেটে সিস্টার্নের ভিতর হীরের আংটি আছে তুমি কী করে জানলে’?

মা বললেন, ‘ওটা একটা ক্যালকুলেটেড গেস, খেটে গেছে। ভেবে দ্যাখ, আগের দিন ওরা বের হবার আগে পর্যন্ত পুলিশ ছিল, আর সকলকে সার্চ করেছিল। কাজেই আংটিটা নিজের কাছে কেউই রাখবে না, বা নিশ্চয়ই বাইরে কোথাও পাচার করতেও পারেনি। মোটামুটি নিরাপদ, আর জেনারেলি কেউ ওই জায়গার কথা ভাববেও না, তাই ওই জায়গাটাই আমার মনে হয়েছিল’

ড্রাইভ করতে করতে বাবা বললেন, ‘তোর মা, ভবিষ্যতে বহুলোকের বদ মতলব বানচাল করে দেবে মনে হচ্ছে’।

আমি বললাম, ‘কিন্তু বাবা, ফেলুদা যেমন ‘পারিশ্রমিক’ পেতেন, মাকে কিন্তু একটা সন্দেশ খাইয়ে ছেড়ে দিল, কোন পারিশ্রমিকই দিল না’। আমার কথা বাবা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ধুস, কটা টাকায় কি আসে যায়? স্যাটিসফ্যাকসানটা চিন্তা কর...’।

 

কিন্তু এই কথার দুদিন পরে ভীষণমামার মা ভীষণমামার সঙ্গে আমাদের বাড়ি এসেছিলেন, আর মায়ের গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন সরু চেনের সোনার হার - তাতে চারটে ছোট্ট হীরে বসানো একটা পেন্ডেন্ট! আর বললেন মাসদেড়েক পরে ভীষণমামার বিয়ে, শিঞ্জিনী আমার মামী হবে। বাড়ির সবাইকে তার জন্যে নেমন্তন্নও করে গেলেন।     

 

---০০---

গল্পটি আমার "তিন এক্কে তিন হেমকান্ত মীন" গল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত। বইটি ঘরে বসে পেতে চাইলে নীচের লিংকে ঠ্যালা দিতে হবে। 

তিন এক্কে তিন হেমকান্ত মীন

সোমবার, ২৩ জুন, ২০২৫

প্রতিবাদের আলো

  'আমাদের দেশে গরমকালটাই বেশ, জানেন বাবু। এই দ্যাকেন না, সাড়ে ছটা পার হয়ে গেল, একনো আকাশে আলো বাজতিচে। সু্য্যি ডুবে গ্যাচে ঠিকই, কিন্তু আলোর রং আর জুলুসে কেমন মাকামাকি হয়ে গিয়েচে আকাশখান। দিব্যি একখান বেনিয়ান গায়ে লদির ধারে হাওয়ার মজা লিচ্ছি আমরা। আর এ যদি হত শীতকাল? বাসরে – এতক্ষণ চারদিক আঁধার। লদির বুক থেকে গুঁড়ি মেরে উঠে আসত চাপ চাপ কুয়াশা। আর এদিকে মানুষগুলান কোতায় পিরেন, কোতায় চাদর, মাথা মুড়ো ঢেকে, কাঠের আগুন জ্বেলে জবুথবু – লদির ধারে বসার সাহস হত কারো? বলেন না, হতো’?

ধীরেন এভাবেই কথা বলে। ওর সব কথাতেই থাকে দর্শনের ছোঁয়া আর জীবনের অদ্ভূত আস্বাদ। এই চায়ের দোকানটা ধীরেনের আর আমি রোজই সন্ধের ঝোঁকে আসি, এখানে চা খেতে। নদীর পাথুরে কিনারায় একটা বেঞ্চি পেতে দেয় ধীরেন, কাঁচের গ্লাস ভরা ঘন দুধের চা খাই আর ওর কথা শুনি। নদীর আওয়াজ শুনি। বাঁদিকে খানিকটা নীচেয় আছে শ্মশান – সেখান থেকে মাঝে মধ্যে শ্মশানযাত্রীদের হরিধ্বনি - তাও শুনি। আর চিন্তার জাল বুনি। সব মিলিয়ে বেশ লাগে। ধীরেনের ভাষায় বললে, বলতে হয় “জেবনের রসে জ্যাবজ্যাবে”। ধীরেন এমনই সব কথা বলে আর সুন্দর হাসে। হাসলে তার চোখ ছোট হয়ে যায়, চোখের কোণের চামড়া কুঁচকে গিয়ে, চামড়ার ভাঁজ থেকে ঝরে পড়ে অভিজ্ঞতার রেণু।

ওর এই কথা, আন্তরিক হাসি ছাড়াও, ওর আছে এক অদ্ভূত মায়ার সম্পর্ক। ওর কাছে একটি মেয়ে থাকে, তার নাম ফুলি। বছর চোদ্দ বয়েস হবে বড় জোর। শামলা রংয়ের ডাগর চোখের মেয়ে। ছটফটে, চঞ্চল আর বাপের মতোই হাসিমুখি। বাপের সবকাজেই সে হাত লাগায় সমান তালে, আর আমি এসে দোকানে বসলে, যদি সে সময় খদ্দেরের চাপ কম থাকে, মেয়ে তার বাপকে আমার কাছে গল্প করার জন্যে পাঠিয়ে দেয়। ফুলি জানে, ওর বাবা কথা বলতে ভালোবাসে আর আমার মতো ভালো শ্রোতা, তার আর কে আছে?

বাবা বললাম বটে। ধীরেন কিন্তু ফুলির জনক বাবা নয়। ফুলির বাবা হয়ে ওঠার পিছনে আছে এক অদ্ভূত ঘটনা। ধীরেনের মুখে সে বৃত্তান্ত শুনে যতটা অবাক হয়েছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি মুগ্ধ হয়েছিলাম ধীরেনের প্রতি।  

‘সেদিন সকাল থিকে টানা ঝড় আর বিষ্টি। মনে হতেচিল বাতাসের ঝাপটে এই বুঝি খুলে গেল মাথার ওপর এ দোকানের চাল। বাঁশের খাঁচায় বারবার মচ মচ শব্দ উঠতেছেল হাওয়ার দাপটে। দোকানে খদ্দের নেই – বিক্রিবাটা নেই সারাটা দিন, একটু বেলার দিকে বিষ্টির ঝাপটে নিভে গেল উনুনটাও – আর জ্বালি নাই। রাধামা্দবের ইচ্চে নয় যখন, তখন তোলাই থাক না আজ, আমার বিকিকিনি। আমার বুকের খাঁচাটাও বাবু, নড়বড় করে উঠেতেচেল সেদিন। এমন দিনেই বাবু, উথাল পাথাল করে মনটা। সঙ্গী নাই সাথি নাই, মনের কথা কইবার লোক নাই, কার সাথে দুটা কথা কয়ে মনটারে হাল্কা করব, কন দেকি? ওই বেঞ্চে বসে বসেই সারাটা দিন কেটে গেল। কেউ আসে না। মনের মানুষ না আসু্‌ক, একজন খদ্দেরও এদিক মাড়ায় নাই সেদিন। খদ্দেরও তো মানুষ, নাকি বলেন। তার সাথে মনের কথা না হোক, কিছু কথা তো কওয়া যায়। চুলার আগুন মরে গেচে, মনের আগুন তো নেভে না বাবু – সে তো জ্বলতেই থাকে। সেদিন বাবু আমি ক্রাসিনের ইস্টোভও রেডি রেকেচিলাম – যদি কেউ আসে তার জন্যি চা বানাবো বলে। কিন্তু কেউ এল না। আমার বিকল মনের পরীক্ষা লিতেই কিনা কে জানে, রাধামাদব সেদিন দিনটা্রেই করে দিলেন ছোট্ট। সন্ধ্যে হবার অনেক আগেই আঁধার ঘনিয়ে এল অসময়ে। আমি দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে ঘরের ভেতর যেয়ে বসলাম। বাসরে, তাতে পকিতি আরো যেন রেগে উঠল। সে কি ঝড় তুফান, আর কি বিষ্টি। আমার দোকানে আমি ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণীও নাই, কিন্তু টিনের চালে, টিনের দেওয়ালে সে কি দাপাদাপি – মনে হয় একশ’ মানুষ হামলে পড়ে ঝাঁকাচ্চে তারে – তাদের গায়ে খ্যাপা হাতির বল। মুখে তাদের বাক্যি নাই, শুধু গর্জন – কিসের আক্রোশ, সে তারাই জানে আর জানেন রাধামাদব।

রাত তখন কত কে জানে। ঘড়ি তো নাই। ক্রাসিনের স্টোভে ভাত চড়ায়েচেলাম, সঙ্গে দুটা আলু পটল। দেওয়ালের ফাঁক ফোকরে আসা হাওয়ায় সে ইস্টোভের আগুনও সেদিন নির্জীবের মতো ভিতু ভিতু। তবু ফুটতেচিল – চাল ফুটে ভাত হওয়ার সময় বাবু – হাঁড়িও খুব কথা কয়। লক্ষ্য করেচেন কি বাবু। সে অনেক কথা। খিদের কথা। তৃপ্তির কথা। ভালোবাসার কথা। খিদের মুখে দুটো অন্নর মতো ভালোবাসা জীবকে আর কে দেয়, কন তো বাবু? আমি বেশ বুঝতে পারি – ওদের কথা। ওদের ঘ্রাণ। আমি খাটিয়ায় বসে, একমনে তাদের কথা শুনতেচিলাম আর দেখতেচেলাম ইস্টোভে নীল আগুনের কাঁপা কাঁপা শিখা। মনের অন্দরে ছিলেন রাধামাদব আর তাঁর অনন্ত লীলা। বাইরে তখন অশৈলী তাণ্ডব আর ঘরে চলতিচে অন্নের যোগাড়, এ কি রাধামাদবের লীলা নয়, কি বলেন বাবু?

সেই সময়ে ঝাঁপ পড়া দরজায় আওয়াজ উঠল ঝমঝমিয়ে। প্রথমটায় বুজিনি বাবু ভেবেচেলাম ঝড়ের বাতাসে অমন হচ্চে। বেশ অনেকক্ষণ পর কান করে যেন শুনতে পেলাম এক মেয়েমানুষের গলা – কেউ আচো, খোল না – দোরটা খোলো না একটিবার। আর তার সঙ্গে ঝমঝম দরজা ঝাঁকানোর আওয়াজ। মনে হল ভুল শোনলাম। এই দুর্যোগের রাত্রে কে আমার এই দোকানে আসতে যাবে। ভয় হল। অশরীরি কেউ নয়তো – শুনেচি এমনি রাতেই তাঁদের আনাগোনা বাড়ে। আবার মনে হল তেনাদের কাছে আমার ওই পলকা দোর কিসেরই বা বাধা? তেনাদের ইচ্চে হলে, অমনিই তো আসতে পারেন। রাধামাদব শক্তি দিলেন, বিবেক দিলেন। দোরটা খুললাম। দামাল ঝোড়ো হাওয়া আর তুমুল বিষ্টির ঝাপটার সঙ্গে ঘরে এসে ঢুকে পড়ল একজন মেয়েমানুষ। এক ঝলক দেখার পর সব অন্ধকার – ঝোড়ো হাওয়ায় আমার ঘরে জ্বলতে থাকা কুপিটা তখন নিভে গেচে।

ঝাঁপ বন্ধ করে, দেশলাই খুঁজে আবার কুপিটা জ্বালালাম আর তার আলোয় দেখলাম সেই মেয়েরে। মাথা থেকে পা অব্দি ভিজে সপসপ করচে, পরনের কাপড় চুপ্পুরি ভেজা আর কাদামাখা। মাটিতে শুয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্চে সেই মেয়ে – তার পায়ের তলার মাটি ভেসে যাচ্চে জলে আর রক্তে। মেয়েটি বাবু ভরা পোয়াতি। আমি দৌড়ে গিয়ে ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে ইস্টোভে জল চাপায়ে দিলাম। এই অসময়ে কার কাচে যাবো, এ অবস্থার মেয়েটারে নিয়েই বা এখন কি করব ভাবতেচেলাম, আর অপেক্ষা করতেচেলাম জল গরমের, ততক্ষণে শুনতে পেলাম বাবু কচি শিশুর কান্না। সেকি জোর বাবু তার গলার। বাইরের এত ঝড়ের গর্জন, বিষ্টির মাতন - সব ছাপিয়ে জেগে উঠল তার কান্না। এ নতুন জেবনের কান্না, তাকে আটকায় এমন সাধ্যি কার। কোনদিন, বাবু, সংসার ধর্ম করি নাই, রাধামাদবের নাম নিয়েই দিব্বি কাল কাটাইতেচেলাম, সেই আমার কাচেই কিনা এসে জুটল এমন ঝক্কি? এমন খেলা রাধামাদব ছাড়া, আর কেই বা খেলতে পারেন বলেন দিকি।

পেথমেই বাচ্চাটার নাড়ি কেটে মুক্ত করে দেলাম তার মায়ের বাঁধন। তারপর গরমজলে সাফসুতরো করে আমার পুরোনো ধুতির পুঁটলিতে জড়িয়ে ফেললাম তাকে। এতক্ষণ তার মাকে লক্ষ্য করি নাই, এখন মায়ের কোলে বাচ্চারে তুলে দিতে গিয়ে দেখি মায়ের অবস্থা সঙ্গীণ। বাচ্চারে কোলে নিতে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করে্চিল একবার – কিন্তু পারল না। তার চোখের দৃষ্টি তখন থির, চোকের কোলে জমে উঠেচে জল, কিন্তু তার ফ্যাকাসে ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা। বাচ্চার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার চোখ বুজে এল বাবু, আর সে চোখ মেলল না।

আচ্ছা, রাধামাদবের এ কেমন লীলা আপনি আমারে বোজান দেকি। আমি কথা বলার জন্যি মানুষ খুঁজতেচিলাম, তা না হয় সত্যি, তাই বলে এমন মানুষ। চেনা নাই, জানা নাই। কোথায় বাড়ি, কাদের মেয়ে। না আমি জানি তার কিছু, না সে আমারে জানে। অথচ দেখেন, সে চলে গেল আমার হাতে এই টুকুন এক জেবন গচ্ছিত রেখে? আমার চাল নাই চুলা নাই, রাধামাদবের ইচ্চেয় আমার দিন চলে যায় কোনমতে, সেখানে একি বিপদ কন দিকি। আজ রাতটুকুন হয়তো কোন পেকারে চলে যাবে – কিন্তু কাল সকালে? লোক আচে, জন আচে, থানা আচে, পুলিশ আচে – তা্রা কি আমারে ছেড়ে দিবে? কি করব কিছুই যখন ভেবে কূল করতে পারতেচি না, আমার কোলের পুঁটলিতে ওই মেয়ে কথা কয়ে উঠল। কি কথা কে জানে – শিশুর ভাষা বোঝার সাধ্যি তো আমার নাই বাবু। আমি ওর মুখের দিকে চাইলাম – দেখি আমার দিকেই তাকিয়ে আচে টালুক টালুক চোখে – সে দৃষ্টিতে কি যে ছেল বাবু, বলতে পারব নি। ভরসা ছেল। বিশ্বাস ছেল। সদ্যজাত শিশু আরেকজন মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে কিসের সন্ধান করে? বাঁচার পেত্যয় ছাড়া? বড়ো মায়া হল বাবু, অর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, অরে আরো জোরে চেপে ধরলাম বুকে। অর ওই ছোট্ট বুকের ধুকধুকুনি আমার বুকে এসে বাজতে থাকল, বাবু। আমি রাধামাদবকে বললাম, এ আমার কি করলে ঠাকুর, আমারে এ কি মায়ার বাঁধনে বেঁধে দিলে অচেনা অজানা কার এক শিশুর সঙ্গে?

দিনকতক বাবু এ ঘটনা নিয়ে খুব টানাপোড়েন, দৌড়ঝাঁপ, কথা চালাচালি চলল। আস্তে আস্তে একদিন থিতিয়ে গেল, মিটেও গেল সব। ও মেয়ে আমার কোলেই বড় হতে লাগল দিন কে দিন। আজ পর্যন্ত কেউ আসে নি বাবু, অর মায়ের কিংবা অর খোঁজ নিতে। ওর মায়ের কোতায় বাড়ি, কাদের মেয়ে, কাদের বউ – কিছুই জানা গেল নি বাবু। মাঝের থিকে আমার সঙ্গে জুড়ে গেল ওর নিবিড় সম্পর্ক। রাধামাদবের এ বিচিত্র লীলা নয়, কি বলেন, বাবু’?

ধীরেনের প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারিনি, কিন্তু সেদিন খুব মন দিয়ে লক্ষ্য করেছিলাম মেয়েটিকে। সপ্রতিভ সুন্দর তার ব্যবহার। একা হাতেই দোকানের প্রায় সব কাজ সামলায়, আবার বাপেরও খেয়াল রাখে পুরোদস্তুর। তার চোখের আলোয় ধরা পড়ে তার পড়ে পাওয়া বাবার প্রতি, তার এই ছোট্ট দোকানদারি দুনিয়ার প্রতি, অসীম মায়া আর ভালোবাসা।

  

 মাঝখানে চাকরি সূত্রে আমায় অন্যত্র চলে যেতে হয়েছিল। প্রায় বছর পাঁচেক পরে আবার এই মফস্বল শহরে যেদিন ফিরে এলাম, দেখলাম অনেক পাল্টে গেছে জায়গাটা। সব জায়গাতেই নিজস্ব নিয়মে লোক সংখ্যা বাড়ে, উন্নতি হয় – যুগের হাওয়া এসে নাড়িয়ে দিয়ে যায় তার সনাতন ভাবগতিক। সেটাই স্বাভাবিক।

ধীরেন আর তার মেয়ে ফুলির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, এই শহরে ফিরে এসে আবার মনে পড়ল। কাজের অবসরে একদিন সন্ধ্যেবেলা সেই নদীর ধারে ধীরেনের দোকানে গেলাম। হদিসই পেলাম না সে দোকানের। অনেক দোকান আর ঝুপড়ি গজিয়ে উঠেছে আশে পাশে। তাদের চারপাঁচজনকে জিগ্যেস করলাম ধীরেনের কথা, তার মেয়ে ফুলির কথা। কেউই জানে না ওদের সম্পর্কে, শুধু একজন আমাকে খুব সন্দেহভরে জিগ্যেস করল, আমি কে? ধীরেনের খোঁজে আমার কি দরকার? আরো সাতপাঁচ অবান্তর প্রশ্ন। আমি নির্বিবাদি ভদ্রলোক, আমি বেশি দূর আর ঘাঁটালাম না, সরে এলাম সেখান থেকে। শ্মশানের কাছেও একবার গেলাম। সিমেন্টের বাঁধানো পরিচ্ছন্ন চাতাল, নদীর ঘাটে নামার জন্যে সুন্দর বাঁধানো সিঁড়ি। আর নীচে নামার পথের ডানদিকে গড়ে উঠেছে একটি ছোট্ট নতুন কালীমন্দির। এসবই নতুন হয়েছে, আর ধীরেনের দোকানটা এই খানেই কোথাও ছিল – প্রগতির ধাক্কায় সে দোকান আজ বিলুপ্ত। মনে রেখেই বা কি লাভ? তাই ভুলেই গিয়েছিলাম ওদের কথা।

সামান্য ঠান্ডা লেগে জ্বর হওয়াতে সেদিন অফিসে বের হইনি, বাড়িতেই ছিলাম। শুয়েছিলাম আমার একলা বাসাবাড়ির বিছানায়। আধো ঘুমে আচ্ছন্ন আমার চেতনায় হঠাৎ যেন শুনলাম খুব চেনা কণ্ঠস্বর। ‘জয় গুরু। জয় রাধামাদবের জয়, কিচু ভিক্ষে পাই মা’। এ স্বর আর ওই বাচন ভঙ্গী আমার খুব চেনা – এ ধীরেন ছাড়া কেউ নয়। আমি বারান্দায় দৌড়ে গেলাম, নীচে তাকিয়ে দেখতে পেলাম ধীরেনকে। জোড় হাতে খুব সংকুচিত ভঙ্গীতে দরজার সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।

আমি ডাকলাম তাকে, ‘ধীরেন, না’? সে মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকাল। আমায় চিনতে পারল কিনা বুঝতে পারলাম না। বললাম, ‘ভেতরে এসো, কথা আছে তোমার সঙ্গে’। আমি নেমে গেলাম, নীচের বসার ঘরে। ধীরেন এসে দাঁড়াল দরজায়। বললাম, ‘দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এসো। আমাকে চিনতে পারছ না’?

‘পারচি বাবু, চিনতে পারচি’।

‘তবে? ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছ কেন, তোমার দোকান কি হল? তোমার সেই মেয়ে ফুলি কি করছে? জান, তোমার দোকানের খোঁজে একদিন গিয়েছিলাম নদীর ধারে, কেউ বলতেই পারল না তোমার খবর’? আমার কৌতূহলে আর আগ্রহে ধীরেন হাসল। তার হাসি আর আগের মতো নেই, এ হাসিতে সেই আগেকার ধীরেনকে আর পেলাম না। এ হাসি ভীষণ করুণ আর কষ্টের হাসি। ধীরেন বলল, ‘সে অনেক কথা, বাবু। যদি অনুমতি করেন, সন্ধ্যের পর এসে আপনারে শোনাতে পারি’।

‘আচ্ছা, তাই এসো’। আমিও এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম তার ভেঙে যাওয়া শরীরি ভাষা। যাবার সময় সে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল,

‘কিচু দেবেন নি, বাবু’? সে ছিল এক দোকানের মালিক, সে দোকান যত ছোটই হোক না কেন। আজ তার এই হাত পেতে ভিক্ষে করার প্রবৃত্তিতে আমি একটু বিরক্তই হলাম, তবুও পার্স খুলে তার হাতে তুলে দিলাম একটা দশ টাকার নোট। উত্তরে সে বলল – ‘জয় রাধামাদবের জয়’।

 

 ‘আমার সে দোকান দেকতে আপনি গেচলেন, বাবু? কেমন দেকলেন জায়গাটা? আমি অনেকদিন যাই না, ওদিকে। গেলে ওরা ধমকায়, চড় থাপ্পড় মারে। আর কেনই বা যাব বলেন তো, গেলেই তো সব মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় সব কথা।

ভয় জিনিষটা বাবু মানুষকে কুরে কুরে খায়। ওপর থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরটা একদম ফোঁপরা হয়ে যায়। সারাদিনে সব কাজই করবেন, কিন্তু মনের ভেতরটাতে সারাক্ষণ টিক টিক করতে থাকবে ভয়। খেয়ে শুয়ে আপনি শান্তি পাবেন নি। আমাদের সেই ভয়টাই ধরিয়ে দিয়েচেল কটা লোক। আমাদের দোকানে আসত। তাদের কুনজর পড়ল ফুলির পরে। পেথম পেথম আজে বাজে কথা বলত, আমরা গায়ে মাকতাম না। তারপর শুরু হল বাবু ওর হাত ধরে টানাটানি আর এমন সব কথা বার্তা, বাপ হয়ে সে কথা কানে তোলা যায় না। প্রতিবাদ করলাম একদিন, আমাকেও যাচ্ছেতাই বললে বাবু, বললে আমি ওর কিসের বাপ? বাপ মায়ের ঠিক নেই যে মেয়ের, সে মেয়েকে নিয়ে আমার এত পীরিত কিসের? এ পীরিত কিসের পীরিত - তারা যে ইঙ্গিত করল বাবু, সে আমি মুখে আনতে পারব নি। তারপর খুব হাসলে বাবু ওই লোকগুলো, হ্যা হ্যা করে – আমাদের ভয় পাওয়া মুখ দেখে। অপমানে আর লজ্জায় ঝলসে যাওয়া আমাদের মুখ দেখে, ওরা খুব হাসলে। দোকানে আরও অনেক লোক ছেল বাবু - কেউ চা খাচ্চিল, কেউ খাবার খাচ্চিল, তারা যেন কেউ শুনতেই পেল না, এমন ভাবে মুখ নামিয়ে রইল। সেই শুরু হল বাবু, আমাদের কোনরকমে বেঁচে থাকা – ভয়কে সঙ্গী করে টিকে থাকা।

দুর্যোগ কি শুধু পকিতি আনতে পারে, বাবু? মানুষও পারে। পকিতির চেয়েও সে দুর্যোগ অনেক নিষ্ঠুর। পকিতি আমাদের শুধু ধ্বংসই করতে পারে, মৃত্যু এনে দিতে পারে, কিন্তু চরম লজ্জা দেয় না কিংবা বীভৎস অপমানও করতে পারে না। মানুষ পারে। এই জন্যেই মানুষ অনেক বড়ো, পকিতির চেয়েও বড়ো। একদিন সেই দুর্যোগ, বাবু, এসেই গেল আমাদের ওপর।

হুলির দিনে মানুষজন বড় বেহিসেবী হয়ে যায়, রংযের নেশায়, মদের নেশায় – আরো নানান নেশায়। আমরা এমনিতেই ভয়ে খুব সিঁটিয়ে থাকতাম, সেদিন তাই সাততাড়াতাড়ি ঝাঁপ ফেলে আমরা ঢুকে পড়েচেলাম দোকানের ঘরে। বাপ মেয়েতে রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে, শুয়েও পড়েচেলাম তাড়াতাড়ি। রাত কত হবে বাবু, জানি না, দোর ভেঙে ঢুকে পড়ল ওরা পাঁচজন। সকলেই নেশায় মত্ত। গায়ে তাদের অসম্ভব শক্তি। আমার ফুলিকে তুলে নে যাচ্চিল ওরা। আমি আটকাতে গেলাম, আমাকে খুব মারল – মেঝেয় ফেলে সে কি ভীষণ মার। পাল্টা মার দেবার শক্তি তো আমার নাই, সহ্য করার শক্তিই বা কতটুকু আমার? ওদের মার খেতে খেতে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

জ্ঞান যখন ফিরল, সব চুপচাপ - নিস্তব্ধ। জ্ঞান ফেরার পর প্রথম কি মনে হয়েচেল বাবু, জানেন? কিচুই যেন হয় নি, সব বুঝি দুঃস্বপ্ন। মানুষের মন কি আশ্চর্য, তাই না বাবু। মেঝেয় উঠে বসে, ঘরের চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম – নাঃ, স্বপ্ন তো নয়, সব কিছু তছনছ, এলোমেলো, ভেঙে চুরে সর্বনাশ। ফুলি কোথায়? এ কথা মনে হতেই আমার শরীলে শেতল স্রোত বয়ে গেল। মাথার ভেতরটা বেবাক শূণ্য। নিজের আড়ষ্ট শরীলের যন্ত্রণা ভুলে, উঠে দাঁড়ালাম। দোকানের একধারে দুটো বেঞ্চ জুড়ে এক করে রাখা - তার ওপরে শুয়ে আচে ফুলি। হাত পা ছড়িয়ে উদাসীন উলঙ্গ - আমার ফুলি মা শুয়ে আছে। কি বীভৎস সে দৃশ্য – একখান শাড়ি দিয়ে তারে ঢেকে দিলাম আর তুলে নিলাম বুকে – তকনো তার প্রাণ ছেল বাবু, আমার বুকের সঙ্গে তার বুকের ধুকধুক তকনো বাজতেচেল।

দোকানের ভাঙা ঝাঁপ সরিয়ে বের হলাম বাইরে। একখান ভ্যান চাই – ফুলিরে হাসপাতাল নে যেতে হবে। তকন শেষ রাত। আমার ডাকাডাকিতে বেরিয়ে আসতেচেল, কিন্তু আমাদের অবস্থা দেখে কেউ রাজি হচ্চিল না। সকলেই জানে কিনা, কে আর বিপদের মধ্যে জড়াতে চায় নিজেরে? অনেক কাকুতি মিনতির পর একজন রাজি হল – তার ভ্যানে যখন তুললাম ফুলিরে, আর কোন সাড়া পেলাম না ফুলির। আর এই প্রথম লক্ষ্য করলাম বাবু, ফুলির দুটো হাতই ভাঙা, ফুলির দুটো হাত যেন ফুলির নয় – এমত ঝুলছেল দুপাশে।

শেষ রাতের হাসপাতালে ঘুম থেকে উঠে এসে ডাক্তার, নার্স খুব বিরক্ত হয়ে চেক করল, ফুলিরে। তারপর খুব নিশ্চিন্তে তারা বলে দিলে ফুলি মারা গেচে – আর কিচু করার নেই। নিয়ম কানুন যা হবে, সকালের বড়ো ডাক্তাররা না এলে হবে না। বসেই রইলাম ফুলির মড়া শরীর কোলে আগলে। সকাল হল। ডাক্তারবাবুরা সব এলেন। তেনারা থানায় খবর দিলেন। পুলিশ এল। আমার বয়ান নিল। ওরা ফুলিরে নিয়ে গেল কাঁটা ছেঁড়া করে রিপোর্ট বানাতে – আরও বাকি ছিল, বাবু, আমার ফুলিরে কাটতে, ছিঁড়তে, ভাঙতে। সারা জেবনে এত টিপ ছাপ দিই নি বাবু – সেদিন আমার ফুলির মড়া শরীরটা ফিরে পেতে এত জায়গায় টিপ লাগাতে হল – বাস্‌ রে, দেশের আইন বাবু এত্ত কড়া? কোত্থাও একটু এদিক সেদিক হবার যেন জো নাই, বলেন? ওই শ্মশানেই বাবু আমার ফুলিরে দাহ করে দোকানে যখন ফিরলাম, সেও রাত প্রায় শেষ।

তারপর আর কি হবে বাবু, খুব কদিন থানায় হাজরি, দৌড়ঝাঁপ - টানাপোড়েন চলল।  খদ্দেররাও তেমন আর দোকানমুখো হচ্ছিল না, সারাটাদিন বসে বসে অনর্থক চিন্তা করতাম আর আমি চমকে চমকে উলুকভুলুক তাকাতাম – মনে হত ফুলি যেন ডাকল, বলল – “বাবা, চারটে চায়ের দাম নাও”। দোকানে মন বসছেল না। এরই মধ্যে একদিন সন্ধ্যে বেলা সেই চারজন আবার এল, খুব গালাগাল, ধমক আর সঙ্গে চড় থাপ্পড় দিয়ে শাসিয়ে গেল আমায়। সেই সন্ধ্যেতেই, বাবু আমি বের হয়ে পড়লাম, সামান্য কিছু টাকা পয়সা ছেল আর সঙ্গে কিছু কাপড় চোপড় নিয়ে। দোকান পড়ে রইল দোকানের মতো।

সরকারি রেল স্টেশনের একধারে থাকার জায়গা জুটে গেল। আর হাতের জমানো পয়সা শেষ হতে, শুরু করে দিলাম ভিক্ষে। এখন বেশ আচি বাবু। যেদিন পয়সা জোটে খাই, যেদিন জোটে না – সেদিন হরিমটর। কমাস আগে, একদিন হোটেলে বসে খাচ্চিলাম। টিভিতে খবর দেকতেচিলাম, শহরের বাবুরা রাস্তায় নেমে মোমবাতি জ্বালাইতেচেন, সক্কলের হাতে জ্বলচে মোমবাতি – কোন এক মেয়েকে অনেকে মিলে রেপ করেচে - তার প্রতিবাদে। আপনিও দেখেচেন নিশ্চয়ই – আপনি জ্বালাননি, বাবু? সেদিন থেকে আমিও আমার ভিক্ষের পয়সা থেকে দুটো তিনটে টাকা বাঁচিয়ে ফেলি, বাবু, আর ওই টাকায় আমিও রোজ একটা করে মোমবাতি কিনে জ্বালিয়ে রাখি শিয়রে। জ্বলন্ত শিখার দিকে তাকিয়ে থাকি – বেশ লাগে, একদম আমার ফুলির মতো, বাবু। একটু ভীতু আর অসহায় - হাল্কা বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে – দমকা বাতাসে নিভে যায়। আচ্ছা বাবু, আমার ফুলিরেও তো ওরা রেপই করেছেল, না’?

ধীরেন মাথা নীচু করে বসে রইল বেশ খানিকক্ষণ। ধীরেনের মনে এখনও অনেক প্রশ্ন, কিন্তু কোন প্রশ্নেরই উত্তরের জন্যে আর ওর মাথাব্যথা নেই। আর সত্যি বলতে আমি কি উত্তর দেব?  এতদিন এ সমস্ত কথা ও কাউকে বলতে পারে নি, মনের মধ্যে গুমরে মরছিল। আজ আমাকে বলে কিছুটা ভারমুক্ত হল। আমার কাছে কিচ্‌ছু প্রত্যাশা করে না ও, কারণ ও জানে - আমিও একজন ভদ্রলোক। যে রাধামাধবের লীলা্রসে ধীরেন আগে মজে থাকত, তাঁর নাম আজ মাত্র একবারই শুনলাম ওর মুখে – সকালবেলায় ভিক্ষের উপকরণ হিসেবে। যেখানে রাধামা্ধবের ওপরই আর ওর ভরসা নেই, সেখানে আমার কি অধিকার আছে ওকে সান্ত্বনা দেবার! আমিও মাথা হেঁট করে বসে রইলাম চেয়ারে।

অনেকক্ষণ পর, ধীরেন উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘অনেক রাত হল, বাবু, আজ আমি চলি। তবে যাবার আগে বাবু একখান কথা কবো’?

‘বলো’।

কাঁধের ঝোলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে ধীরেন একখানা মোমবাতি বের করল, বলল, ‘আপনার দেওয়া সকালের টাকা থেকে একখান মোমবাতি কিনেচিলাম বাবু, যদি জ্বালতে দেন, কে জানে, মেয়েটা হয়তো একটু শান্তি পাবে। ও আপনারেও খুব মান্যি করত, বাবু’।

আমি বললাম, ‘দাও’।

ধীরেন বসার ঘরের টেবিলে মোমবাতিটি জ্বালিয়ে রাখল, আর নিভিয়ে দিল ঘরের বিজলি আলো। তারপর ধীরেন অস্ফুট স্বরে বলল, ‘আজ তবে আসি, বাবু’।

 ও চলে যাবার পরও আমি একলা নির্বাক বসেই রইলাম বহুক্ষণ। আমার ঘরে তখন মোমবাতির কাঁপাকাঁপা দুর্বল শিখার স্নিগ্ধ আলো। এ আলো ধীরেনের প্রতিবাদের আলো এ শিখায় সে নিজে পুড়তে থাকবে প্রতিক্ষণ, কিন্তু কোনদিন কোথাও আগুন ধরাতে পারবে না।

 -০০-


"দশে দশ" গ্রন্থে এই গল্পটি সংকলিত। বইটির প্রকাশক সৃষ্টিসুখ প্রকাশন - নীচের লিংকে ক্লিক করে অর্ডার করলেই ঘরে বসে পাওয়া যাবে বইটি 






শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)-র আত্মকথন - বিশ্বলোকের সাড়া - পর্ব ১

 

[ব্লগার কিশোরের মন্তব্যঃ আমার স্কুল জীবনের বন্ধু কাজল মুখার্জি - অধুনা নিউজিল্যাণ্ডের তোরঙ্গা নিবাসী। বন্ধুপত্নী কুটু (ভালো নাম প্রদীপ্তা মুখার্জি) গৃহবধূ - কিন্তু চারদেয়ালের ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে কোনদিন থাকেননি। কুটু সমাজসেবী, সমাজ সংগঠক এবং যথেষ্ট প্রতিভাময়ী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। সত্যি বলতে সমগ্র নিউজিল্যাণ্ডে বিশেষ করে নিউজিল্যাণ্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বঙ্গ সমাজে কুটু অবিসংবাদিত একজন সাংস্কৃতিক মানুষ। তাঁর রচিত আত্মকথন "বিশ্বলোকের সাড়া" আমার এই ব্লগে প্রকাশ করার অনুমতি পেয়ে আমি সম্মানিত।]

 

 

বিশ্বলোকের সাড়া - প্রথম পর্ব 

প্রদীপ্তা মুখার্জি (কুটু)

তুমি মোর পাও নাই পরিচয়

 আমি প্রদীপ্তা, প্রদীপ্তা মুখার্জি; ডাক নাম কুটু, এনামেই আমায় সবাই চেনে। পূর্ব ভারতের কোলকাতা শহর নিবাসী এক মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম।

বাবা ছিলেন পেশায় শিক্ষক, মা ঘর-সংসার সামলাতেন। চার ভাই আর চার বোনের মধ্যে আমিই ছিলাম সবার ছোট। বড় হয়েছি খুব হৈচৈ করা আনন্দে এবং স্নেহময় শাসনের মিশেলে। 

ছোটবেলা থেকেই কেন জানি না সঙ্গীত আমাকে টানতো। পড়াশোনার থেকে গান, নাচ, নাটক এই সবই অনেক বেশী পছন্দের। কিন্তু মধ্যবিত্ত সংসারে লেখাপড়ার দিকেই অনুরাগ ছিল বেশি, অতএব পড়াশোনা করাতেই অনেক বেশী সময় দিতে হত। কিন্তু পরবর্তী কালে উচ্চশিক্ষার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়  সুযোগ পাওয়া মাত্র সঙ্গীতকেই বেছে নিলাম। ব্যাচেলর অফ মিউজিক। এটাই আমার মনোমত বিষয় ছিল বলেই হয়তো, পরীক্ষাগুলোও ভালোভাবে উৎরেও গেলাম।

ছোটবেলাটা কেটেছে মা, বাবা, দাদা, দিদিদের যুগপৎ আদর ও শাসনে। যদিও বাড়িতে নিয়ম-কানুন মানানোর যথেষ্ট প্রচেষ্টা ছিল - রোজ ভোরে উঠে পড়তে বসতে হত, এমনকি ছুটির দিনেও, তার অন্যথা করার অনুমতি মিলত না।

তবে মজাদার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলিও নিয়মিত পালন করা হত। বছরের প্রথম দিকে হত সরস্বতীপুজো। এই পুজো যেমন বাড়িতে হত, তেমনই হত স্কুল এবং বড়ো হওয়ার পর কলেজেও। ছোট্টবেলায় যখন আমরা প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী, বছরে ওই এই একটি দিনই, শাড়ি পরার সুযোগ পেতাম। বড়োসড়ো শাড়ির পুঁটলি শরীরে জড়িয়ে, আঁচল-টাঁচল সামলে, নানান স্কুলে ঘুরে ঘুরে প্রসাদ খাওয়া আর নতুন বন্ধু পাতানোর মজা আর আনন্দের স্মৃতি আজও মধুর। সে দিনগুলি ছিল বিরাট উত্তেজনার, পুজোটা যেন গৌণ, মুখ্য ছিল ওই আনন্দ আর মজাটাই।

তার পরেই আসত মার্চ মাস বসন্তের উতল হাওয়া নিয়ে, মনে ধরত নানান রঙ ও গান, কারণ দোল আসছে। ওই দিন মা পুজোর ঘরে পায়েস বানাতেন, তারপরে রাধা-কৃষ্ণের পুজো করতেন, ঠাকুরকে আবীর দেওয়া হতো। তারপর আমরা ছোটরা বাবা, মা ও গুরুজনদের আবীর দিতাম। তারপরেই শুরু হতো আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে আর পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে রঙিন হয়ে ওঠা এবং অন্যকে রঙিন করে তোলার উচ্চকিত আনন্দ আর মজা।

এপ্রিলে আসতো ১লা বৈশাখ, বাঙালীদের নববর্ষ। সেও এক মহানন্দের উৎসব। নতুন নতুন পোষাকনানান রান্না বান্না, খাওয়া দাওয়া, তার সাথে গান বাজনা ও নাচ, হৈচৈ নিয়ে একশ মজা।

অক্টোবর বা নভেম্বরে আসতো বাঙালির বহু আকাঙ্ক্ষিত মহোৎসব দুর্গাপুজো, সঙ্গে নিয়ে আসত কালীপুজো, দীপাবলি, ভাইফোঁটার অনেক ছুটি আর হাজার মজার সম্ভার নিয়ে। 

 

স্বপন যদি মধুর এমন

 খুব মনে পড়ে আমার প্রাইমারী স্কুলের দিন গুলো। বাড়ি থেকে অল্প হেঁটেই স্কুল। বিরাট জমি নিয়ে ইংরেজি আমলের তৈরি মস্ত স্কুল বাড়ি; কলকাতার নাকতলাতে, আনন্দ আশ্রম বালিকা বিদ্যালয়। পড়াশুনো করতে হত ঠিকই কিন্তু ছোট্টবেলা থেকেই সঙ্গীতই ছিল আমার সব থেকে প্রিয়।

বাড়িতে রেকর্ডে গান শুনতাম। রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরেছিলাম সেই ছোটবেলা থেকে। প্রথমে তাঁর গান, তারপর বড় হয়ে তাঁর গল্প, উপন্যাস, নাটক এর প্রেমে পড়ি। নিজের ভালো লাগার জন্যই রেকর্ড শুনে শুনে গান তুলতাম সাত আট বছর বয়েস থেকে। নয় বছর বয়েসে আকাশবাণী থেকে ডাক পেলাম, শিশুদের অনুষ্ঠানে গান গাইবার জন্য।

আমার বড় দিদি, আমায় ভর্তি করে দিয়েছিলেন গানের স্কুলে। এরই মধ্যে আমাদের পাড়ায় বা পাশের পাড়ায় প্রায়ই আমার ডাক পড়ত গান শোনাবার জন্য। ওই বয়েসেই রবীন্দ্রসঙ্গীতে এতই ডুবে ছিলাম যে পড়াশোনায় ফাঁক পড়ত প্রায়ই। স্কুলের দিদিমণিরা বাবার কাছে নালিশ করেছিলেন যে আমি পড়াশোনা না করে গানের পেছনে বেশী সময় দিই।

আমার স্বপ্ন ছিল সঙ্গীত নিয়ে পড়া। তাই যখন পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পেলাম তখন ভীষণ খুশী হয়েছিলাম, গর্বিত বোধ করেছিলাম। মনে হয়েছিল আমার গানের পাখি এতদিনে খুঁজে পেল ওড়ার মতো মুক্ত আকাশ।  কলেজে পড়ার সময় তখনকার দিনের বহু নামী শিল্পীর সান্নিধ্যে আসতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেছি। ওঁদের কাছ থেকে অনেক যত্নে গান শিখেছি, ওঁদের পরিচালনায় অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে গর্বিত বোধ করেছি।

এর মধ্যেই কোন একদিন বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়লাম। আমার স্বামী ছিলেন আমার বহুদিনের মনের মানুষ, কাজেই আমাদের মনের অমিলটুকুও মধুর হয়ে উঠল আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কে।

আমার পুত্র আবীরের বয়েস যখন সবে এক, তখন আমার প্রথম বিদেশ যাত্রার সূত্রপাত। দিল্লীর চাকরি ছেড়ে একটি ইতালীয় কোম্পানিতে চার বছরের চুক্তিতে কাজল জয়েন করল, আর ইরানে একটি পাওয়ার প্ল্যাণ্ট নির্মাণের জন্যে ওর সঙ্গে আমরা রওনা দিলাম ইরান। আমরা ইরান পৌঁছলাম ১৯৯২ সালে।

দিল্লী থেকে দুবাই হয়ে তেহরান পৌঁছলাম এমিরেটসের বিমানে। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে আমাদের বেজায় উত্তেজনা ছিল, এবং ভীষণ ভালো লেগেছিল বিমান সেবিকাদের, যেমন সুন্দরী, তেমনি আন্তরিক ব্যবহার।

ইরান সম্পর্কে তখন তেমন কিছুই জানতাম না, শুধু জানতাম ওখানকার গোলাপ বিখ্যাত, পড়েছিলাম রবিঠাকুরের “পারস্যে” প্রবন্ধে। ওই প্রবন্ধেই জেনেছিলাম ওদেশের সঙ্গীতের কথা, মানুষজনের কথা। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩২-এর মে মাসে পারস্যে ছিলেন তাঁর জন্মদিনের সময়, উনি লিখেছেন, “আমার পারসি বন্ধুরা সকাল থেকে পুষ্পবৃষ্টি করেছেন, নানা বর্ণের ফুল, বিশেষতঃ গোলাপ”। আর জানতাম পারস্যের বিখ্যাত কবি, আমার ভীষণ প্রিয় কবি হাফেজের কথা। হাফেজের শহর সিরাজ ও ইস্পাহান; আমরা পরে ইস্পাহানে কবি হাফেজের স্মৃতি সৌধ দেখতে গিয়েছিলাম, ওঁনার সমাধিতে ফুল ছড়িয়ে আমার মন ভরে গিয়েছিল।

তেহরানে প্লেন নামলো। প্লেন থেকে নামার আগে আমায় পরতে হল, “মান্টো” আর “রুসেরি”। মান্টো হল প্রায় গোড়ালি অব্দি ঝুলওয়ালা ওভারকোটের মতো পোষাক, তবে সাধারণ কাপড়ের। আর রুসেরি হলো স্কার্ফ, মাথা ঢাকা দেওয়ার জন্যে। তবে মুখ ঢাকার কোন প্রয়োজন হয়নি। এই পোষাক আমরা ভারত থেকেই বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম।

তেহরান এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমেই যেটা চোখে পড়েছিল সেটা হল Temperature Board – বাইরের তাপমান তখন শূণ্যের পাঁচ ডিগ্রি নিচে। যদিও আমরা প্রস্তুত ছিলাম, পর্যাপ্ত গরম পোষাক ছিল সাথে, তবুও জীবনের প্রথম মাইনাস তাপমানের সম্যক মুখোমুখি হওয়ার আগে ওই লেখাটা দেখেই যেন শীতের শিহরণ টের পেলাম শরীরে।

তেহরান থেকে প্রায় ন/দশ ঘণ্টার ড্রাইভে আমাদের গন্তব্য কেরমানশাহ, কাজলের কর্মস্থল। অধিকাংশ রাস্তাই তখন বরফে ঢাকা, রাস্তার দুপাশ ঘুমিয়ে আছে সাদা বরফের চাদর মুড়ি দিয়ে। প্রায় শেষ বিকেলে আমরা পৌঁছলা, কেরমানশাহ। ছোট্ট সুন্দর জনপদ, তার চারদিক ঘিরে রয়েছে বরফে মোড়া ছোট ছোট পাহাড়।

সবার জীবনে “প্রথম” যে কোন ব্যাপারই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, এবং আনন্দের তো বটেই। ইরান আমার কাছে সেই প্রথম বিদেশ যাত্রা। পরে বহু দেশ গিয়েছি, এখন যেমন দীর্ঘ প্রবাসী রয়েছি নিউজিল্যাণ্ডে, কিন্তু প্রথম বিদেশ যাত্রার আনন্দ ও উত্তেজনার অভিজ্ঞতা অতুলনীয়। ইরান এমন একটি দেশ, যেখানে আমি সবদিক থেকেই বিদেশিনী, তাদের ভাষা জানি না, বুঝি না। তাদের জীবনযাত্রা, পোষাক-আষাক, সামাজিক চালচলন, রূপ, সঙ্গীত, সবকিছুই আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

খুব সুন্দর একটা তিনতলা বাড়িতে আমাদের প্রবাসের নীড় গড়ে উঠল। নিচের তলায় থাকতেন আমাদের বাড়িওয়ালা, সপরিবারে মহম্মদ আমিনী। আমাদের ফ্ল্যাটের প্রায় প্রতিটি ঘরের জানালা থেকেই দূরের বরফে ঢাকা পাহাড় দেখা যেত। ভোরের আলোয় সোনালী রঙে রঙীন হয়ে সেজে উঠতো তারা। ঘরের ভেতরে সেন্ট্রাল হিটিং থাকায় সাধারণ পোষাকেই থাকা যেত, কিন্তু বাইরে তখন অসম্ভব ঠাণ্ডা। আমাদের ওই ইরান বাসের কয়েক বছরে, আমরা সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পেয়েছিলাম মাইনাস বাইশ ডিগ্রি! ওরই মধ্যে ছোট্ট আবীরকে নিয়ে শুক্রবারের সপ্তাহান্তে চলত আমাদের বরফ নিয়ে খেলা, বরফের পুতুল বানানোর নানান মজা।

ইরানে গিয়ে বাধ্য হয়েছিলাম ফারসী ভাষা শিখতে। প্রথমে বেজায় অসুবিধে হয়েছিল, কারণ আমাদের আশেপাশের প্রতিবেশী ও পড়শিদের কেউই হিন্দি তো বটেই, এমনকি কাজচলা গোছের ইংরিজিও জানত না। হাত-পা নেড়ে, নানান অঙ্গভঙ্গী করে নিজের বক্তব্য পেশ করার প্রচেষ্টা যাঁরা করেছেন, একমাত্র তাঁরাই বুঝবেন, সে সময় আমি কতখানি অসহায় বোধ করতাম।  অতএব আমাকেই ওদের ভাষা শেখার উদ্যোগ নিতে হল। নিজের এই অভিজ্ঞতার জন্যে, পরবর্তী জীবনে নিউজিল্যাণ্ডে বাস করার সময় যখন শরণার্থীদের সঙ্গে মিশেছি এবং তাঁদের নিয়ে কাজ করেছি, তখন ভাষা নিয়ে অসহায়তার বিষয়টা আমাকে নতুন করে বুঝতে হয়নি।

যাই হোক, ধীরে ধীরে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে পরিচিতি বাড়ল, কাজলের সহকর্মী ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গেও আলাপ হল। আমার পুত্র আবীরও সমবয়সী বন্ধু পেয়ে গেল অচিরেই। এভাবেই আমার ফারসী জ্ঞানের পরিধি বাড়তে লাগল অত্যন্ত ধীর লয়ে, এবং আবীর আমাকে পেছনে ফেলে, ফারসীতে শিখে ফেলল অতি দ্রুত, এবং ন-দশ মাসের মধ্যেই ও দিব্যি ফারসী বলতে শিখে গেল। আমি কোথাও আটকে গেলে, আমার বালক-গুরুর কাছেই চলত আমার শিক্ষানবিশী। ওইটুকু বয়সেই আবির বাংলা, ইংরিজি এবং ফারসী মোটামুটি একই তালে বলতে পারত। আমার ইরানী বান্ধবীরা আবিরকে বলত, “ডিকশনারি”, কারণ আমাদের বাড়িতে এলে আলাপের সময়, তাঁরাও আবিরেরই সাহায্য নিতেন, interpreter হিসেবে।

কাজল রোজই ভোরে বেড়িয়ে যেত, শহর থেকে অনেকটাই দূরে ছিল ওদের কর্মস্থল, construction siteআমি আর ছোট্ট আবীর আমাদের বিশাল বড় অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম এক্কেবারে একা। সদ্য ভারত থেকে গিয়ে ওই সময়ের প্রত্যেকটি দিন খুবই একঘেয়ে আর বিষণ্ণ লাগত। দেশে থাকতে যেখানে খুশি, যখন খুশি বেরিয়ে পড়ায় কোন বাধা ছিল না। এখানেও বেরিয়ে পড়তে অন্য বাধা কিছু ছিল না, একমাত্র অন্তরায় ছিল ভাষা। বাইরে বেরিয়ে ট্যাক্সিকে কী বলবো? তখনও ইরানে, অন্ততঃ আমাদের ছোট্ট শহরে সুপার মার্কেট গড়ে ওঠেনি। দোকানে কিংবা বাজারে গিয়ে কী বলবো? মাঝে মাঝেই পুত্রকে নিয়ে পার্কে যেতাম, ও অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খুব দৌড়োদৌড়ি করত এবং মিশেও যেত খুব তাড়াতাড়ি। শৈশবের সারল্যে ভাষা কোন অন্তরায় হত না।

পার্ক থেকে ফেরার পথে একদিন একটি দোকানে গিয়েছিলাম, কিছু চকলেট, ড্রাই ফ্রুট্‌স্‌ আর বিস্কিট কিনতে। দোকানে সাজানো জিনিষগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে সংগ্রহ করা গেল। দোকানী ভদ্রলোক সব জিনিষ একটি প্যাকেটে ঢুকিয়ে তুলে দিলেন আবিরের হাতে, আবিরের বয়েস তখন বছর দুয়েক। আমি টাকা দিতে গেলাম, ভদ্রলোক কিছুতেই নেবেন না, আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? উনি স্মিতমুখে বললেন, “শামা মেহমান-এ ইরান” – অর্থাৎ আপনারা ইরানের অতিথি। আপ্লুত হয়েছিলাম ভদ্রলোকের অসাধারণ আপ্যায়নে। অবিশ্যি এমন আপ্যায়ন এরপরেও বেশ কয়েকবার মিলেছিল, নানান মানুষের থেকে - ট্যাক্সিতে, দোকানে, বাজারে। ভারতীয়দের প্রতি সাধারণ ইরানীদের এই ভালোবাসা আমার ইরান বাসের অভিজ্ঞতায় অন্যতম মধুর স্মৃতি।

এভাবেই দিন গড়াতে লাগল। নির্বান্ধব দিনগুলিতে ওই পার্কটিই ছিল আমার ও আমার পুত্রের মুক্ত বাতাস।  একদিন হঠাৎ করেই আলাপ করতে এলেন এক মধ্যবয়স্ক মহিলাতাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর পুত্র ও কন্যা, তাদের বয়েস কুড়ি একুশ তো হবেই। আলাপে দেখা গেল ছেলেটি অল্পবিস্তর ইংরিজি জানে। অতএব সেই দোভাষী হয়ে আমার এবং ওর মায়ের কথাগুলি বলতে লাগল। এখানে আসার পর এতদিনে কেউ আমার কথা শুনছেন, আমিও শুনছি তাঁর কথা। সেদিন কী যে ভালো লেগেছিল, সে কথা আজও মনে পড়লে রোমাঞ্চ অনুভব করি। এমন পরিস্থিতিতে যাঁরা না পড়েছেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন না, এই আনন্দ।

আলাপে জানলাম পরিবারটি “সসজেদি” পরিবার। মহিলা বললেন, আমি তাঁকে ‘আন্টি’ ডাকতে পারিজেনে ভালো লাগলো ইরানেও “মামা”, “মাসি” সম্বোধনে সম্পর্ক গড়ার প্রচলন আছে। আমাকে উনি আশ্বাস দিলেন, প্রয়োজনে ওঁর সঙ্গে এবং ওঁর ছেলের সঙ্গে আমি নির্দ্বিধায় যোগাযোগ করতে পারি। আমরা উভয়েই ফোন নম্বর লিখে রাখলাম।

এর কিছুদিন পরেই পেলাম ওঁদের বাড়ি সান্ধ্যভোজের নিমন্ত্রণ। ততদিনে ওখানকার সামাজিক আদব-কায়দা কিছু কিছু রপ্ত করেছি, কিছু শিখেছি বই পড়ে, টিভি দেখে, এবং কাজলের সহকর্মীদের বাড়ি গিয়ে। আন্টি আমাদের নিতে গাড়ি পাঠিয়েছিলেন, ওঁনার ছেলে “পুয়ান” এসেছিল সঙ্গে। ওঁনার বাড়িতে পৌঁছে দেখি, পুরো পরিবার – তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে গেট অব্দি এগিয়ে এসেছেন, আমাদের অভ্যর্থনা করতে। সংস্কৃতের সংস্কৃতিতে একেই বলে “প্রত্যুদ্গমন”।

বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি, সারা বাড়ি পারস্য কার্পেটে মোড়া। দেওয়ালে সিল্কের কার্পেট ঝোলানো, হাতে আঁকা ছবির মতো সুন্দর কার্পেটগুলি অনবদ্য সুন্দর, এমনটা আগে কোনদিন দেখিনি। পরে জেনেছিলাম শ্রীযুক্ত মসজেদি, ওই শহরের অন্যতম ধনী ও বিখ্যাত মানুষ, স্থানীয় সমাজে তাঁর বিপুল সম্মান।

সারা সন্ধ্যে প্রচুর খাওয়াদাওয়া হল, আড্ডা হল, আমি গান শোনালাম, ওঁরাও গান শোনালেন। এভাবেই ওই পরিবারের সঙ্গে গড়ে উঠল নিবিড় সম্পর্ক, যা আজও অটুট। আজও আন্টির সঙ্গে ফোনে কথা হয়, আন্টি কান্নাকাটি করেন, বলেন, “তোমাদের এ জীবনে আর দেখবো না, ভাবতে পারি না...”।                                     

স্বামীর চাকরি সূত্রে আমরা ভারত ছেড়ে ইরানে পৌঁছে, অপরিচিত পরিবেশের রূঢ় বাস্তবের অভিঘাতে আমার সঙ্গীত চর্চা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎই সেখানে এক পিয়ানো শিল্পীর সাথে আলাপ হয় এবং সামান্য অনুরোধেই তিনি আমায় পিয়ানো শেখাতে রাজী হয়ে গেলেন। নির্বান্ধব পরিবেশের মধ্যে এমন একটা সুযোগ পেয়ে ভীষণ খুশী হয়েছিলাম। ছোটবেলা থেকেই আমি হারমোনিয়াম বাজাতাম, তাই পিয়ানোতে গানের সুর তুলতে পারতাম সহজে।

একটা ফারসি গান আমার খুব ভালো লাগতো। সেটাই আমি পিয়ানোতে তুলে নিয়েছিলাম। একদিন যখন আমি ক্লাসে সেই গানের সুর পিয়ানোতে বাজিয়ে শোনাচ্ছিলাম, আমার শিক্ষক আনন্দে দৌড়ে গিয়ে অন্দরমহল থেকে তাঁর মাকে ডেকে নিয়ে এলেন। তাঁরা দুজনেই অভিভূত হয়েছিলেন, একজন ভারতীয়কে ইরানের অতি প্রচলিত গান পিয়ানোয় বাজিয়ে শোনানোর জন্যে। আমি আজও দেখতে পাই, ফরজাদের মায়ের চোখের সরল বিস্ময় আর আনন্দ। কেন যে মানুষ গান গেয়ে মনের আলাপ না করে, Gun-point-এ মনের প্রলাপ বাধায় আজও বুঝে উঠতে পারিনি।

সে যাই হোক, সুদূর ইরানেই গানের চর্চা আবার শুরু হয়ে গেলো। বেশ কিছু ফার্সী গান শিখেছিপিয়ানো বাজানো শিখেছি ওখানেই। 


চলবে...



সুরক্ষিতা - পর্ব ৪

 

 

বিতান যখন ছোট্ট। তাকে ঘিরে উজ্জ্বল সম্ভাবনার স্বপ্নে শুভময়ী দেবী ভেবে রেখেছিলেন, তিনি স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দেবেন। বিতানের লেখাপড়া ও জীবনচর্চার পূর্ণ দায়িত্ব নিতে তিনি মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল তাঁর এই চাকরি আর সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলা, একসঙ্গে চলতে পারে না। তাঁর এই চাকরির জন্যে বিতানের প্রতি এতটুকু অবহেলাও যদি ঘটে যায়, আর তার জন্যে যদি বিতান এক অসফল, মধ্যমানের জীবনে গিয়ে পৌঁছয়, নিজেকে তিনি ক্ষমা করতে পারবেন না। কাজেই তিনি স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলেন চাকরিটা ছেড়ে দেবেন।

কিন্তু বিতানের বাবা, শুভময়ী দেবীর শাশুড়ি কেউই মেনে নিতে পারেননি, তাঁর এই অদ্ভূত সিদ্ধান্ত। তাঁদের মনে হয়েছিল এটা বাড়াবাড়ি। ছেলেকে মানুষ করার জন্যে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে – কেন? যাদের বাবা-মা দুজনেই কর্মরত, তাদের ছেলেমেয়েরা কি মানুষ হয় না? বিস্তর হয়, অজস্র উদাহরণ আছে আশেপাশে, চেনা-জানা পরিবারে। আবার এমনও অনেক পরিবার আছে, যেখানে মা চাকরি করেন না, সর্বদা ঘর সংসার সামলান, কিন্তু তাঁদের ছেলে-মেয়েরা একদমই মানুষ হয়নি। শুভময়ীদেবী এ যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন, সত্যি এরকম কোন সহজ-সরল নিয়ম হয় না - হতে পারে না, কিন্তু তবুও তিনি ঠিকই করে ফেলেছিলেন, বিতানের লেখাপড়া শুরু হলেই চাকরিতে ইস্তফা দেবেন।

কিন্তু তার আগেই বিতানের মারাত্মক অসুখটা ধরা পড়ল, ব্যর্থ চিকিৎসা পদ্ধতি চলতে লাগল দীর্ঘদিন কলকাতা থেকে চেন্নাই, চেন্নাই থেকে ভেলোর - ডাক্তার, হাসপাতাল, চেকআপের শিডিউলড ডেটস মেনটেন করতে করতে তাঁরা জেরবার। বছর পাঁচেক এরকম টানাপোড়েন, আর দুশ্চিন্তার বিনিদ্র রজনী পার করে, একসময় সব ডাক্তারই অসহায় মুখে স্বীকার করে নিল এ ব্যাধি দুরারোগ্য – নিরাময়ের একমাত্র আশা ঈশ্বর এবং তাঁর অলৌকিক মহিমা। এই ব্যাপারটা জানার পর দুশ্চিন্তা দূর হল। কারণ বুকের মধ্যে যে আশার আলো এতদিন ধরে জ্বলছিল, সেটা নিভে যাওয়ার পর এখন সমস্তই অন্ধকার। এখন শুধু নিশ্ছিদ্র আঁধারে পথচলা। এ পথের শেষ কোথায় জানা নেই। পথের শেষে লক্ষ্যপূরণের কোন দিশা নেই।

অসুস্থ ছেলেকে কে দেখভাল করবে, মা ছাড়া? আপন মায়ের মতো মরমী সেবা কে দিতে পারে আর? কাজেই এইবার শুভময়ী দেবীকে সকলেই চাকরিটা ছেড়ে দেবার প্রস্তাব দিল। তাঁর স্বামী, তাঁর শাশুড়ি, পাড়া-পড়শী, আত্মীয়-স্বজন। শুভময়ী দেবীর সঙ্গে এইখানেই আবার মতবিরোধ ঘটল সকলের। শুভময়ী দেবী স্কুলের চাকরিটা প্রাণ গেলেও আর ছাড়তে পারবেন না। কারণ তাঁর নিজের জন্যে দিনে কিছুটা সময় অন্ততঃ দরকার, যখন তিনি ভুলে থাকতে পারবেন চঞ্চল এক শিশুর এই নিদারুণ পরিণতির মানসিক যন্ত্রণা। ভুলতেও কি পারবেন - পারবেন না, অন্ততঃ আনমনা থাকতে পারবেন স্কুলের কাজ নিয়ে, ক্লাসভরা নানান বয়সী মেয়েদের সাহচর্যে। না, কোন মতেই আর তাঁর পক্ষে স্কুলের কাজ ছাড়া সম্ভব নয়।

ছেলেকে মানুষ করার তাগিদে তাঁর চাকরি ছেড়ে দেবার পূর্বসিদ্ধান্ত যেমন কেউ মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। এবার অসুস্থ ছেলের নিত্যসেবা করার গুরু দায়িত্ব এড়িয়ে, চাকরি না ছাড়ার সিদ্ধান্তও কেউ মেনে নিল না। তাঁর মাতৃত্বের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলির সঠিক মূল্যায়ন সেবারও কেউ করেনি, এবারও কেউ করার চেষ্টা করল না। কাজেই সকলেই বিরক্ত হল। তাঁর স্বামীও বিদ্রূপ করতে ছাড়েননি, বলেছিলেন এটা নাকি শুভময়ী দেবীর পলায়নবৃত্তি মানসিকতা, নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি না হয়ে, এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন তো হতেও পারে মায়ের নিরন্তর সেবায় বিতান আরোগ্য হতে থাকল – ডাক্তাররা যে বলেছিলেন ঈশ্বরের মহিমা - মায়ের সেবাতে সেই মহিমা অধরা নাও তো থাকতে পারে!

শুভময়ী দেবীর চাকরি না ছাড়ার অটল সিদ্ধান্তের জেরে একটি প্রাইভেট সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল – যারা প্রফেশন্যাল অ্যাটেন্ডেন্টস অ্যারেঞ্জ করে দেয়। সেই সংস্থা থেকেই নার্স পাঠিয়ে দিয়েছিল বিতানকে দেখা শোনার জন্যকথা হয়েছিল, বারো ঘন্টার একটিমাত্র শিফ্‌টের জন্যে – সকাল আটটা থেকে রাত আটটা। পনেরদিন পর পর ডিউটি চেঞ্জ হয়ে অন্য নার্স আসত। প্রথম বছর দেড়েক কোন অসুবিধে হয়নি, কারণ দুজন নার্সই পনের দিনের অল্টারনেট রোটেশনে আসত। তারা বুঝে গিয়েছিল বিতানের সমস্যাগুলো আর তার প্রয়োজন। এভাবেই সব কিছু চলছিল রুটিন মাফিক। রাত্রিটা শুভময়ী দেবী নিজেই সামলে নিতেন। কতটুকু আর, রাত্রে সাড়ে নটা-দশটা পর্যন্ত - তারপর তো বিতান অঘোরে ঘুমোয় ট্রাঙ্কুইলাইজারের এফেক্টে। আর সকালে সাতটায় ঘুম থেকে ডেকে তুলে বেডপ্যান দিয়ে, মুখটুখ ধুইয়ে দেওয়ার কাজটা তিনিই করতেন। সকাল আটটায় নার্স এসে ব্রেকফাস্ট আর ওষুধ দিয়ে শুরু করত তার ডিউটি।

নিয়মমাফিক যেমন চলার চলছিল ঠিকঠাক। যে দুজন নার্স প্রথম দিকে নিয়মিত আসছিল, তারা হঠাৎ আসা বন্ধ করে দেওয়াতে, ঝামেলাটা শুরু হল। নতুন নতুন নার্স আসত আর তাকে আদ্যন্ত বোঝাতে হত – চার পাঁচ দিনে সে কাজ কিছুটা বুঝে যাওয়ার পরই আবার আসত নতুন নার্সবহুবার বলা সত্ত্বেও সেই সংস্থা থেকে প্রতিশ্রুতি ছাড়া কোন সুরাহা পাওয়া যায়নি। উপরন্তু এই নতুন নার্সরা আদৌ কেউ নার্স ছিল না, সাধারণ কাজের মেয়েকেই ওই সংস্থা পাঠাতে শুরু করেছিলতাঁরা ঐ সংস্থাকে মাস গেলে চারশো টাকা রোজ হিসেব বারোহাজার টাকা পেমেন্ট করতেন, কিন্তু ওই মেয়েদের মুখে শুনেছিলেন ওরা নাকি মেরে কেটে মাসে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার পায়   

মাস চার-পাঁচেক এভাবে চলার পর ঠিক হল, কোন নার্স আর নয়, কোন সাধারণ কাজের মেয়েকেই সারাদিনের জন্যে রাখা হবে। সন্ধান চলতে লাগল। দু-একজন আসছিল, কিন্তু পছন্দ হচ্ছিল না। শুভময়ী দেবীর কোন প্রফেশনাল ঝি নয়, প্রয়োজন ছিল একটি মেয়ের, যে সহজ মনে কাজটা শিখে নেবে। আর একটু আন্তরিকতা যদি থাকে তাহলে তো কথাই নেই।

চলবে...


নতুন পোস্টগুলি

উকুন

  ১ ধুলি পাঁচ নম্বর উকুনটা মেরে, ছ নম্বরটাকে চুলের গোড়া থেকে তুলে আনল। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের নখে রেখে, ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে চেপে ...