Powered By Blogger

বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪

সহযাত্রী

 

বিশালাক্ষীপুর পার হয়ে ট্রেনটা আচমকা ব্রেক মেরে থমকে গেল। তার লোহার হাতপায়ে এমন আওয়াজ উঠল, আমার পিলে চমকে যাওয়ার যোগাড়। তার কারণও আছে, একে তো আমি যে কামরায় বসে আছি, সেটায় একজন লোকও নেই।  কামরার জানালা দিয়ে বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না, এমন অন্ধকার। তার ওপর কী হল কে জানে, আচমকা ব্রেক মারতেই কামরার ভেতরের লাইটগুলোও, ঝপ করে নিভে গেল একসঙ্গে।

অথচ হাওড়া থেকে এই ট্রেনে যখন উঠেছিলাম, কামরায় পা রাখার জায়গা ছিল না, এত্তো ভিড়। নানা বয়সের লোকজনের কথাবার্তায় কামরা গমগম করছিল। তার ওপর ছিল ভেণ্ডারদের ডাকাডাকি। “অ্যাই, চা। চা গরম”“সল্টেড বাদাম, ডালমুট, চিপ্‌স্‌স্‌স্‌”। “ঝালমুড়ি, মশলামুড়িইইই”। “পতিতের বিখ্যাত আলুরদম, ঘুগ্‌নি”। সে সব হইচই হট্টগোল একটু একটু করে কমতে লাগল। ব্যাণ্ডেলে এসে বসার সিট পেয়ে গেলাম, তাও জানালার ধারে! তারপর থেকে ট্রেন যতই ছুটছিল আর থামছিল, লোক কমছিল ততই। বিশালাক্ষীপুরে ট্রেন দাঁড়াতে, পুরো কামরা খালি। একলা আমিই বসে রইলাম জানালার কাঠে কনুইয়ের ভর দিয়ে, গালে হাত রেখে। আমার গন্তব্য হাবিবগঞ্জ, এই ট্রেন ওই অব্দিই যাবে। আজ রাত্রে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে, কাল ভোরে আবার রওনা হবে হাওড়ার দিকে।

ট্রেনটা হাওড়া থেকেই ছেড়েছিল মিনিট কুড়ি লেটে। সত্যি বলতে, লেট না হলে আমি ট্রেনটা ধরতেই পারতাম না। তখন অনেকে বলেছিল, এটুকু লেট, ব্যাণ্ডেলের পর মেক আপ করে নেবে। কিন্তু সে আর হয়নি, উলটে লেট বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় দেড়ঘণ্টাঠিকঠাক চললে, এতক্ষণ আমার পিসিমণির বাড়ি পৌঁছে, জল-পেঁয়াজি-মুড়ি চা খেয়ে আইপিএল দেখার কথা। সে তো হলই না, বরং যা অবস্থা, তাতে কতক্ষণে পৌঁছোব সেটাই এখন দেখার। মোবাইলের পর্দায় দেখলাম, এখনই বাজছে সাড়ে আটটা। বিশালাক্ষীপুর থেকে হাবিবগঞ্জ আধঘন্টার পথ। পিসিমণি নিশ্চয়ই চিন্তা করছেন। ফোনে যে বলে দেব, তারও উপায় নেই। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই ফোনে নেটওয়ার্ক আসছে না। ফোনে চার্জের অবস্থাও সুবিধের নয়। জ্বালিয়ে রাখতে ভরসা হচ্ছে না। কে জানে পরে যদি দরকার হয়।  

আমি যাকে বলে ভিতু টাইপের ছেলে, তা কিন্তু মোটেই নয়। কিন্তু অন্ধকার কামরায় একলা! অন্ধকার যে এত ঘন থকথকে কাদার মতো হয়, আগে কোনদিন বুঝিনি। হাত নাড়ালেও চটচটে অন্ধকার লেগে যাচ্ছিল হাতে। আচ্ছা জামাকাপড়েও কী অন্ধকারের দাগ লাগে? কে জানে? আলোয় গেলে বোঝা যাবে! বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। একজন কথা বলার মতো লোক থাকলে এতটা খারাপ লাগত না। আর কী আশ্চর্য, চিন্তাটা মাথায় আসা মাত্রই একজন ভদ্রলোক, লাইন থেকে ট্রেনের কামরায় উঠতে উঠতে বললেন,

“সেদিন তোমায় দেখেছিলেম ভোরবেলায়...”। বললেন না, গুনগুন করে গাইছিলেন। আমি মোবাইলের পর্দাটা অন করতে নীলচে আলোর আভায় দেখলাম, ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পরা, মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। আমার হাতে আলোর আভা দেখে আমার দিকেই এগিয়ে এলেন। আমার সামনের সিটে বসতে বসতে বললেন,

“কদ্দূর”?

“হাবিবগঞ্জ”

“অ। আমারও তাই যাবার কথা ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আরো অনেকদূর...হাবিবগঞ্জে কাদের বাড়ি?” আমি আমার পিসেমশাইয়ের নাম বললাম। একবারেই চিনতে পারলেন। বললেন,

“অ ছক্কা? ছক্কা আপনার কে হয়?” আমার পিসেমশাইয়ের ডাকনাম ছকু ওঁনার বন্ধুরা শুনেছি ছক্কা বলেও ডাকেন। তবে ভাল নাম শরদিন্দু শর।

“আমার ছোট পিসেমশাই”।

“তাই বুঝি? তাহলে তো তুমি অনেকটাই ছোট। খামোখা “আপনি”, “আজ্ঞে” করছি কেন? অন্ধকারে ভালো বুঝতেই পারা যাচ্ছে না, ছাই! তা কী করা হয়?”

“আজ্ঞে, এই হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষা দিয়েছি”।

“অ, তার মানে নতুন ডানা গজাচ্ছে?”  কথাটার মানে বুঝলাম না, চুপ করে রইলাম।

“কথাটা বোঝা গেল না, না? মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। এখন হয়েছে হায়ার সেকেণ্ডারি, আমাদের সময় ছিল ম্যাট্রিকম্যাট্রিক দিয়েই আমাদের মনে হত, বেশ বড়সড় হয়ে গেছি। উড়তে শুরু করতাম। একাএকা কিংবা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে এখান ওখান যাওয়া আসা শুরু করে দিতাম! বাবা-মার সঙ্গ আর ভাল লাগত না!”  হাসতে হাসতে বললেন ভদ্রলোক। কথাটা খারাপ বলেননি, নতুন ডানা গজানোর কথাটা ভালই লাগল। কলকাতায় ফিরে বন্ধুদের মধ্যে কথাটা চাউর করতে হবে।

“তোমার নামটা কী যেন বললে, হে, ছোকরা?”

“আজ্ঞে বলিনি তো!”

“বলোনি? কেন বলোনি, কেন? চট করে বলে ফেল দেখি”। 

“আজ্ঞে ভূয়সী ভড়। আমার দাদু রেখেছিলেন নামটা।”

“বাঃ বাঃ, বেশ নাম। আমি তো জিগ্যেস করিনি, নামটা কে রেখেছিলেন সেটা বললে কেন?”

“আজ্ঞে আমার নাম বললেই, সবাই জিগ্যেস করে। তাই আজকাল নিজে থেকেই বলে দিই”। হা হা করে আবার হেসে উঠলেন ভদ্রলোক, তারপর বললেন,

“আমার নাম বিশাল, বিশাল চক্রবর্তী। এ নামটা আমি নিজেই রেখেছি।” আমি অবাক হয়ে তাঁর ঝাপসা চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিজেই নিজের নাম রাখা যায় নাকি? ভদ্রলোক হয়তো আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরে বললেন,

“ঠাকুরদা আমার নাম রেখেছিলেন হরিপদ চক্রবর্তী। নামটা আমার মোটেই পছন্দ হয়নি। আইএ পরীক্ষার আগে শেয়ালদা কোর্টে এফিডেবিট করে, হয়ে গেলাম বিশাল। বাবার পয়সায় খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলাম। এতদ্বারা সর্বসাধারণকে জানানো যাইতেছে, অদ্য হইতে আমি শ্রী হরিপদ চক্রবর্তী শেয়ালদার এফিডেবিট বলে শ্রী বিশাল চক্রবর্তী হইলাম”। বিশালবাবুর কথায় মনে পড়ল, এমন বিজ্ঞাপন খবরের কাগজে দেখেছি বটে, “আমি শ্রীযুক্ত গণারাম, অদ্য হইতে শ্রীযুক্ত অর্কপ্রভ হইলাম”

“ছক্কা, মানে তোমার ওই ছোট পিসেমশাই, খেলাধুলোয় খুব তুখোড় ছিল, জানো কী? ফুটবল হোক কিংবা ক্রিকেট। স্কুল টিম হোক, কলেজ টিম হোক, ছক্কা ছাড়া টিমই হতো না। আমরা যেবার ম্যাট্রিক দিলাম, ছক্কা তখন বোধহয় সিক্সে কিংবা ফাইভে পড়ে। সেবার আমাদের স্কুল, এই মহকুমায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। কার জন্যে জানো? তোমার পিসেমশাই ছক্কার জন্যে। ওইটুকুনি ছোঁড়া নিজেদের বক্স থেকে বল নিয়ে, একাএকা গোল দিয়ে এল অপোনেন্টকে! এক আধবার নয়, তিন তিন বার! সে বছর ছক্কাই হায়েস্ট গোলগেটার হয়েছিল! সেই থেকে আলাপ। বুঝেছ? পরে আমি যখন কলেজে আটকে পড়লাম, ছক্কা আমাদের কলেজেই এল। একসঙ্গে তিনবছর খেলেছি! তারপর ও গ্র্যাজুয়েট হয়ে চাকরি পেয়ে গেল, আর আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ইন্সিওরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হয়ে গেলাম”। আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম,

“এঃ রাম, লেখাপড়া ছেড়ে দিলেন কেন?” বিশালবাবু খুব রেগে গেলেন, ধমক দিয়ে বললেন,

“আমার সামনে ওই সব আজেবাজে কথা একদম বলবে না! গুরুজনের সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে?” আমি গুম হয়ে বসে রইলাম। যাচ্চলে, কী এমন কথা বললাম, কে জানে? আমি মোবাইল টিপে সময় দেখলাম, ৮.৫৮। ট্রেনটা যেভাবে থমকে আছে চলবে কী চলবে না, বোঝাই যাচ্ছে না। হঠাৎ বাইরে থেকে মুখের ওপর কেউ টর্চ মারল, জিগ্যেস করল,

“খোকা কী একলা? কোথায় যাওয়া হবে? হাবিবগঞ্জ নাকি?” খোকা বলাতে আমার একটু রাগ হল, কিন্তু ওঁনার থেকে কিছু যদি জানতে পারা যায়, তাই বললাম,

“হ্যাঁ কাকু। কিন্তু ট্রেনের কী হল? কখন ছাড়বে?” ভদ্রলোক হনহনিয়ে সামনের দিকে যেতে যেতে বললেন,

“একটু দেরি হবে”। আমি হতাশ হয়ে আবার কামরার ভেতরে মুখ ঘোরালাম। দেখলাম ভদ্রলোক আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে বললেন,

“ইয়ে, মানে তোমাকে তখন ওরকম বকাবকি করাটা আমার ঠিক হয়নি। তোমার আর দোষ কী? ছেলেমানুষ, তুমি অতশত কী করে জানবে? তবে একটা কথা বলি, কিছু মনে কোরো না, হে। তোমার মাথাটি তেমন সরেস নয়, নিরেট। তোমাকে বললাম, তোমার পিসেমশাই যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে, তখন আমি ম্যাট্রিক দিয়েছি। তারপরে বললাম, কলেজে তোমার পিসেমশাইয়ের সঙ্গে খেলেছি! তাতেও বুঝতে পারলে না? আইএ পড়ার সময় এবং কলেজে পড়তেও বেশ কয়েকবার গাড্ডু খেয়েছিলামতোমার পিসেমশাই এক চান্সে সব পরীক্ষায় পাশ করে গেল, আমি সেবারও পারলাম না। বলি, আমার কী লজ্জা ঘেন্না থাকতে নেই? “একবার না পারিলে, দেখ শতবার” কবি বলেছেন বলেই কী আমাকে একশ বার চেষ্টা করতে হবে?” আমি ঠিক কী উত্তর দেব না বুঝে বললাম,

“আজ্ঞে, তা তো বটেই!”

“একটা কথা জেনে রাখো, জীবনে সব কিছু হয় না। যাদের লেখাপড়া হয়, তাদের লেখাপড়াই হয়, আর কিছু হয় না। আমাকেই দেখো না। লেখাপড়া ব্যাপারটা তেমন সুবিধে করতে না পারলেও কী করিনি জীবনে? এই যে তুমি জানালায় কনুই রেখে বসে আছো। আগে হলে তোমার একটা লাইফ ইন্সিওরেন্স, আমি করিয়েই ছাড়তাম”।

“তার মানে?” আমি খুব অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম।

“ধরো, ওই জানালার লোহার শাটারটা ঝপাং করে পড়ল তোমার কনুইতে। কিংবা ধরো হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় গাছের মোটা একটা ডাল ভেঙে এসে পড়ল তোমার কনুই ঘেঁষেঅথবা চারমণি সাইজের একটা বিশাল পাথর এসে গড়িয়ে পড়ল...”আমি ভয়ে ভয়ে হাতটা ভেতরে ঢুকিয়ে নিলাম, এতক্ষণ কী ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিয়ে আমি বসেছিলাম, ভাবতেই শিউরে উঠলাম। ভদ্রলোক আশ্বস্ত করার সুরে বললেন,

“তবে এই বিশাল থাকতে তোমার বিশাল কোন ক্ষতি হত না। ইন্সিওর করলেই, তোমার হাত ভেঙেই যাক কিংবা কেটেই যাক, তুমি সিওর টাকা পেয়ে যেতে! তারপর বসো না যত ইচ্ছে কনুই বের করে। হাতটার ক্ষতি হবে ঠিকই, কিন্তু ইন্সিওরেন্সের টাকায় চপটা, কাটলেটটা, জিলিপি-সিঙ্গাড়াটা, সেও তো ওই হাতে না হোক অন্য হাতে মুখে তোলা যাবে!”  আমি বেশ বিরক্ত হয়ে, আবার কনুই বের করে বসলাম। কোন কথা বললাম না।  ভদ্রলোক আবার বকতে শুরু করলেন,

“এদিকে খুব পাট হয় জানো তো? পাট, পাট, ইংরিজিতে যাকে জুট বলেইন্সিওরেন্সের কাজটা ছেড়ে দিয়ে জুটের ব্যবসায় জুটে গেলাম। রূপোলী আর সোনালী পাটের গাঁট, গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাষীদের থেকে কিনতাম, দিয়ে আসতাম হাওড়ার জুট মিলে। কয়েকজন বন্ধু মিলে খুব লাভ করতাম, বুঝেছো? যে দামে কিনতাম, তার চার-পাঁচগুণ দামে মিলে বেচে দিতাম। পাটের গাঁটওয়ালা না বলে, আমাদের গাঁটকাটাও বলতে পারো!” নিজের বোকা বোকা রসিকতায় নিজেই, হে হে করে হাসলেন খানিকটা। তারপর আবার বললেন,

“সে ব্যবসাটাও ভেস্তে গেল। কোথা থেকে কিছু লোক এসে জুটলো, তাদের গাঁটে গাঁটে পাটোয়ারি বুদ্ধি! তারা চাষীদের থেকে আমাদের চেয়ে বেশী দামে গাঁট কিনে, আমাদের থেকে কম দামে মিলকে বেচত। ওদের সঙ্গে সকলেরই বেশ মিলমিশ হয়ে গেল! অতএব আমাদের পাটব্যবসার পাট তুলে দিতে হল”। ভদ্রলোকের বাজে বকবক ভালো লাগছিল না। কিন্তু কিছু করারও নেই, ট্রেন একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আমি গম্ভীরভাবে বললাম,

“তার মানে আপনার পাটের ব্যবসা ডুবল পাটে, ব্যবসাটাও বোধহয় সকলে পারে না”।

“কে বলেছে তোমায়? আরশোলার ব্যবসায় কম কামিয়েছি? তারপর ব্যাং?”

“আরশোলার ব্যবসা? সে আবার কেমন? ব্যাং শুনেছি বিদেশে কোথাও কোথাও খায়”।

“বিদেশের নিকুচি করেছে। আমাদের নিজের দেশ থাকতে, বিদেশ কেন? স্কুলে কী নিয়ে পড়েছো হে?”

“আজ্ঞে আরশোলা নিয়ে তো পড়িনি! ইলেভেন টুয়েলভে সাবজেক্ট ছিল সায়েন্স”।

“বায়োলজি ছিল না? সেখানে আরশোলা, ব্যাং কাটোনি? তাদের পৌষ্টিকতন্ত্র দেখনি?” আমার মনে পড়ল। বায়োলজি প্র্যাক্‌টিক্যালে কেটেছি বৈকি!

“সেই আরশোলা আপনি সাপ্লাই করতেন?”

“তোমাদের কলকাতার কোন স্কুল বলো?” আমি স্কুলের নাম বললাম। শুনে মুখ ব্যাঁকালেন, বললেন,

“নাঃ, আমরা নই। তোমাদের স্কুলে সাপ্লাই করত ন্যাপা বক্সি। হতভাগা যেমন টিকটিকির মতো দেখতে, তেমনি তার আরশোলাগুলোও! না খেতে পেয়ে শুঁটকে পাৎলা। আরে বাবা, আরশোলা ভরপেট খাবে, তবে না তার পৌষ্টিকতন্ত্র পুষ্ট হবে! তাই দেখে, তবে না আমাদের দেশের ছেলেরা দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে! হুঁ হুঁ ব্যবসা অত সস্তার ব্যাপার নয়। আমার আরশোলা আর ব্যাং কেটে কত্তো ছেলে বড়ো বড়ো ডাক্তার হয়ে গেল! সেদিন কলকাতায় এক ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। বুকে একটা ব্যথা ব্যথা হচ্ছিল, চেক আপ করাতে। খুব নামকরা ডাক্তার, চেস্ট স্পেশালিস্ট, বারোশো টাকা ফিস! শুনেছি বাড়িতেও অনেক চেস্ট বসিয়েছে, টাকা রাখার জন্যে!  চেস্ট মানে সিন্দুকও হয়, জানো তো? আমি তো তাকে চিনতে পারিনি। কিন্তু আমাকে দেখেই বলে উঠলে, “স্যার, আপনি এখানে?” অবাক হয়ে আমি তাকিয়ে আছি দেখে বলল, “চিনতে পারলেন না, স্যার, আপনার আরশোলা না পেলে, আজ আমি এখানে আসতে পারতাম, স্যার?” আমি হে হে হেসে ম্যানেজ করলাম। আমাকে খুব যত্ন নিয়ে দেখল, কিন্তু ফিসের একটা পয়সাও নিল না! সেও তো ওই আরশোলার জন্যেই নাকি?”

এই সময় ট্রেনটা দুবার ভোঁ ভোঁ ডাক ছেড়ে, আড়মোড়া ভাঙলো, তারপর গড়াতে শুরু করল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, কিন্তু কামরার আলো জ্বলল না। মোবাইলে টাইম দেখলাম নটা বত্রিশ! ভদ্রলোক আবার কথা বলতে শুরু করলেন,

“আরশোলা নিয়ে যারা ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে তারা আমার দু চক্ষের বিষ! অনেকেই বলে “আরশোলা আবার পক্ষি, ভ্যারেণ্ডা আবার বিরিক্ষি”। তাদের কথায় কানও দেবে না। আরশোলা ছাড়া তোমাদের মতো ছেলেপুলেদের শিক্ষাটাই মাটি হয়ে যেত। আজ গাঁয়ে গঞ্জে এত যে ডাক্তার, তার জন্যে আরশোলাদের আত্মত্যাগের কথা ভুলে থাকা যায়!” ভদ্রলোকের গলাটা আবেগে কেমন বুজে এল, “আরশোলা আমাদের ভবিষ্যৎ, আরশোলা আমাদের জাতীয় শিক্ষার ভিত”ভদ্রলোক কেঁদে ফেললেন কিনা অন্ধকারে বুঝতে পারলাম না, তবে গলা শুনে তাই মনে হল। আমার মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল,

“আপনার মাথা-ফাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো?” ভদ্রলোক এতটা রেগে যাবেন বুঝতে পারিনি,

“দেখ হে ছোকরা, ছোট মুখে বড়ো কথা আমার একদম সহ্য হয় না! ছক্কাকে আমি তোমার নামে কমপ্লেন করবো। পেট খারাপের কথা বলতে, চোখ খারাপের বলতে, কিচ্ছু মনে করতাম না। আমার মাথা খারাপের কী দেখলে হে? দেখাতে পারবে, আমার মাথাটা কোথায় খারাপ হয়েছে? দেখাও তো, দেখাও তো..”

ঠিক সেই সময়েই কামরার আলোগুলো জ্বলে উঠল, কিন্তু ভদ্রলোক “দেখাও তো, দেখাও তো” বলে যা দেখালেন, তাতে আমি সব অন্ধকার দেখতে লাগলাম...

 

গল্পে বা সিনেমায় যেমন বলার নিয়ম, সেভাবেই, “আমি কোথায়, আমি এখানে এলাম কী করে” কথাগুলো আমিই বললাম, কিন্তু মনে হল অন্য কেউ অনেক দূর থেকে বলছে, আমি শুনছি।

“অ ভুয়ো, আমি তোর পিসিমণি বলছি রে, চোখ মেলে তাকা। এ পাশে তোর পিসেমশাই, ওপাশে দাঁড়িয়ে মাটি আর শুঁটি। তাকা বাবা, তাকা। দেকো দিকি কী বিপদেই পড়ল আমার সোনাছেলেটা!” আরেঃ এ তো পিসিমণির গলা!  শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। আস্তে আস্তে চোখ মেলে, প্রথমে ঝাপসা তারপর স্পষ্ট দেখতে পেলাম মুখগুলো। সিনেমাতে প্রায়ই যেমন দেখায় আর কি! পিসিমণি, পিসেমশাই, পিসতুতো দাদা মাটি আর বোন শুঁটিকেও দেখলাম। তারমানে পিসিমণির বাড়িতেই শুয়ে আছি!

কিছুক্ষণ ধাতস্থ হয়ে, বিছানায় উঠে বসলাম। এক গেলাস গরম দুধ চুমুক দিয়ে খেতে খেতে বেশ আরাম পাচ্ছিলাম। পিসেমশাই সামনেই বসেছিলেন, জিগ্যেস করলেন,

“কেমন বুঝছিস রে? কী হয়েছিল বলতো, ভয় পেয়েছিলি?”

“আপনার বন্ধু বিশালবাবু...”।

“বিশালদা? পাগলা বিশু - তুই তাকে চিনলি কী করে?”

“আমার কামরায় উঠলেন তো, বিশালাক্ষীপুর ছেড়ে এসে, ট্রেনটা ঘচাং করে থেমে গেল যেখানে, সেখানে”। পিসিমণি আঁতকে উঠলেন আমার কথায়, পিসেমশাই কিছু বললেন না, তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। পিসিমণি বললেন,

“শুনছো, আমি কিন্তু ভালো বুঝছি না। তুমি এখনই পশুপতি ওঝাকে ডেকে আনো”।

“থামো তো! আগে ওকে বলতে দাও। কামরায় বিশালদা উঠল, তারপর?”

“খুব বক বক করতে লাগলেন। কামরাতে আর কেউ ছিল না। আলোও চলে গেছিল। একা একা ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে বসে, প্রথমে বেশ ভালই লাগছিল ভদ্রলোকের কথা শুনতে।  কিন্তু পরে বড্ডো বাজে বকতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পর ট্রেন ছাড়ল, তারও কিছুক্ষণ পর কামরায় আলো এল। তখন ভদ্রলোক নিজের মাথাটা...”। দৃশ্যটা মনে করে আমার আবার হেঁচকি উঠতে লাগল, পিসিমণি দৌড়ে গিয়ে লোহার চাবি আনলেন একটা, আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

“এটা ধরে থাক বাবা, কোন ভয় নেই। আর মনে মনে রাম-নাম জপ কর”রাম-নামের কথায় মনে পড়ল, আমি একবার “এঃ রাম” বলেছিলাম বলে, ভদ্রলোক খুব রেগে উঠেছিলেন। তবে কী ভদ্রলোক...। পিসেমশাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছেন দেখে আবার বললাম,

“ভদ্রলোক নিজের মাথাটা খুলে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে ধমকাচ্ছিলেন, “আমার মাথাটা কোথায় খারাপ হয়েছে? দেখাও তো, দেখাও তো”। আমার মাথাটা ঘুরে উঠল, সব কিছু অন্ধকার হয়ে এল।” পিসেমশাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

“বিশালদা, আজই সন্ধেতে বিশালাক্ষীপুর ছাড়িয়ে একটা লেভেল ক্রসিংয়ে তোর ট্রেনের তলাতেই কাটা পড়েছে। সেই জন্যেই আচমকা ব্রেক মেরে ট্রেনটা থেমে গেছিলতারপর বিশালদার লাশ সরিয়ে ট্রেন ছাড়তে অনেক দেরি হয়েছিল। বিশালদার লাশ পাওয়া গেছে, কিন্তু পাশে মাথাটা ছিল না! তোর ট্রেন লেট হচ্ছে শুনে আমি স্টেশনে গিয়েছিলাম, সেখানেই এই সব শুনলাম। তারপর ট্রেনটা আমাদের স্টেশনে পৌঁছালো দশটা কুড়িতে। খুঁজে খুঁজে তোকে বের করলাম, দেখলাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছিস ট্রেনের কামরায়”  আমি ভয়ে রীতিমতো তোৎলাতে লাগলাম,

“ত্-তার ম্-মানে যা দেখেছিলাম, সেটা সত্যি!! ত্-তার ম্-মানে, উনি আসলে বিশালবাবুর ...”। পিসিমণি হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরলেন, বললেন,

“চুপ কর, এ সময় ওঁদের আর নাম নিতে হবে না, বাবা”।

 

-০০-

 

ছোটদের জন্য নানান স্বাদের কুড়িটি গল্পের সংকলন "এক কুড়ি কিশোর" গ্রন্থের একটি গল্পটি এটি। ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে নীচের সূত্রে ঠ্যালা দিয়ে বুক করতে হবে। 


     

 

     

শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৪

গোলমেলে ফুটবল

 

 গত বুধবার যা হল, সে আর বলার কথা নয়। আমাদের ঝিঙেপোতা সবুজ সংঘের সঙ্গে ওপাড়ার সুহৃদ সংঘের ফুটবল ম্যাচ ছিল। তার যা রেজাল্ট হল, তাতে পাড়ায় আমাদের মুখ দেখানোই দায় হয়ে উঠল। খেলায় হার জিত আছে, সে আর কে না জানে? খেললে সব সময় জিততেই হবে, এমনও হয় না। কিন্তু তাই বলে এমন হার? ছ্যাঃ। ক্রিকেট খেলায় ছাব্বিশ রানে দু উইকেট হামেশা হয়, কিন্তু ফুটবলে, ২৬-২ গোলে হারা! আমার এই আট বছরের ফুটবল জীবনে কোনদিন ঘটে নি। সুহৃদ সংঘের ছাব্বিশ গোল, আর আমাদের দু গোল, সে গোল দুটো অবশ্য আমারই দেওয়া! আমিই এই দলের ক্যাপ্টেন বীরু।

আমাদের এই মিলনপল্লীর মাঠে সাত-আটজনের টিম করে আমরা ফুটবল খেলি। ছোট মাঠ তো, দু একবার চেষ্টা করে দেখা গেছে, বাইশজন মাঠে নামলে সেটা আর খেলা থাকে না, মেছো হাট হয়ে যায়। হাতে পায়ে জট লেগে যায়। স্কুলের গরমের ছুটিতে, এই মাঠেই আমাদের পাড়ার যত লিগ ম্যাচগুলো হয়। আর স্কুল খোলার আগে সেমি ফাইন্যাল, ফাইন্যাল হয়ে, লিগ শেষ হয়ে যায়। চ্যাম্পিয়ন ক্লাবের ঘরে ‘ঝিঙেপোতা শ্রীমতীসৌদামিনীদেবী স্মৃতি ফুটবল উন্নয়ন সমিতি’র কাপ ঢুকে পড়ে। ক্লাবঘরে নড়বড়ে টেবিলের ওপর শুকনো ফুলের মালা পড়ে চকচকে কাপ, সারাবছর শোভা পায়।

গতবার এই কাপ আমাদের ক্লাবে ছিল। লিগ শুরু হবার আগে উন্নয়ন সমিতির সেক্রেটারির কাছে সে কাপ ফেরত চলে গেছে। এবারের লিগ শেষে, সেই কাপ কোন ক্লাবের ঘরে যাবে সেটাই এখন দেখার। কিন্তু আমাদের আজকের খেলার যা নমুনা, তাতে এবার আমাদের হাতে যে চা খাবার কাপও জুটবে না, সে কথা বলাই বাহুল্য। আমাদের টিমে সেন্টু আর ভজা পিটোপিঠি দুই ভাই, দুজনেই সেরা খেলোয়াড়। ভজা বড়ো, আর সেন্টু বছর দুয়েকের ছোট। সেন্টু খেলে ফরওয়ার্ডে আর ভজা গোল পোস্ট সামলায়। আমাদের মাঠে গোলপোস্ট একটাই, মাঠের পশ্চিমদিকে, বাঁশের কাঠামো। আর উল্টোদিকে পাইনদের পোড়ো বাড়ির উচুঁ পাঁচিলে হলুদ রঙে আঁকা অন্য গোল পোস্ট

আমাদের সেন্টু পায়ে একবার বল পেলে, সে বল তার পা ছাড়ে না। চুম্বকের সঙ্গে কাঁচা লোহার মতো বলটা তার পায়েই যেন চিপকে থাকেসে বল গোলে ঢোকার আগে সেন্টুর পা ছাড়ে। অথচ আজ তার পা থেকে একটা গোলও পাওয়া গেল না। যে কবার বল পেয়েছে, সুহৃদ সংঘের ছেলেদের পায়ে বল তুলে দিয়ে সে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।  আর যে কটা গোলে শট নিয়েছে, বল উড়ে গেছে গোলপোস্টের অনেক বাইরে দিয়েফুটবলে ভাগ্যিস ওয়াইড বল হয় না, হলে আমাদের হয়তো পেনাল্টি খেতে হত।

ওদিকে আমাদের ভজা তালপাতার সেপাইয়ের মতো ঢ্যাঙা আর হাড্ডিসার চেহারা হলে কি হবে, দারুণ ছটফটে। ডিগবাজি দিয়ে, লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে, গোলমুখি বলকে খপাৎ করে পাকড়াও করে ফেলে। ঠাকুমার মুখে শুনেছি, ছোটবেলায় পবনপুত্র হনুমান নাকি, ভোরের সূর্যকে টুকটুকে ফল ভেবে, আকাশ থেকে টুক করে পেড়ে এনেছিলেন। আমাদের ভজুও সেরকমই শূণ্য থেকে, যখন তখন দু হাতে গোলমুখি বল নামিয়ে আনতে পারে। আজকে পারল না। একটা বলও ধরতে পারল না। মাগুর মাছের মতো গোলমুখি বলগুলো ভজার পায়ের ফাঁক দিয়ে বগলের তলা দিয়ে, আর হাত ফস্কে একের পর এক গোলে ঢুকে গেল। ভজা নিজে এবং আমরা বাকি সবাই অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম তার আজকের এলেম

সেদিন খেলা শেষ হবার মিনিট আটেক আগেই খেলা অবশ্য শেষ হয়ে গিয়েছিল, নাহলে আরও কতো গোল আমাদের কপালে লেখা ছিল কে জানে! হয়েছিল কি, সেকেণ্ড হাফে সুহৃদসংঘ পাইনবাড়ির দেওয়ালের দিকের গোলপোস্ট সামলাচ্ছিল। সেন্টু গোল থেকে সাত ফুট দূর থেকে এমন একটা শট মারল, বল চলে গেল পাইন বাড়ির উঁচু পাঁচিল টপকে ভেতরের আগাছার জঙ্গলে। শেষ বিকেলে ওই আগাছার জঙ্গল থেকে বল খুঁজে আনার মতো বুকের পাটা আমাদের ছিল না। আর বল খুঁজে এনে শেষ আট মিনিটে চব্বিশটা বকেয়া গোল শোধ করে, আমরা খেলায় সমতা আনবো, এমন আশাও ছিল না। কাজেই আমি, আমার দলের ক্যাপ্টেন, সকলের সঙ্গে কথা বলে, হার স্বীকার করে নিলাম আর সিদ্ধান্ত দিলাম, আজকের মতো খেলা এখানেই শেষ। আর পাইনবাড়ির ভেতরে চলে যাওয়া বলটা আমাদেরই ক্লাবের বল। কাজেই ওটা ফিরিয়ে আনার কোন তাড়া নেই, কাল সকালে ধীরেসুস্থে নিয়ে এলেই হবে।

খেলা শেষ ঘোষণা হওয়ার পর রেফারি সুমন্তদা চলে গেলেন। কিছুক্ষণ থেকে, আমাদের কাটা ঘায়ে নুন-টুন ছিটিয়ে চলে গেল সুহৃদসংঘের ছেলেরাও। আমরা আটজন, সাতজন খেলছিলাম, আর হাবু একস্ট্রা, গোল হয়ে বসলাম মাঠের ধারে, পাইনবাড়ির দেওয়ালটা পিছনদিকে রেখে। তেমন কিছুই বলার ছিল না। ছাব্বিশটা গোল খেয়ে আমাদের অবস্থা কাহিল। 

হাবু ঘাসের একটা চিকন ডগা চিবুতে চিবুতে বলল, ‘সেন্টুকে কিছুক্ষণ রেস্ট দিয়ে আমাকে নামাতে পারতিস। বীরু, বরাবর দেকেচি সেন্টুর ব্যাপারে তুই একদম অন্ধ'।

আমি একথার কী আর উত্তর দেব? ক্যাপ্টেন হিসেবে এমন কথা আমাকে এখন শুনতেই হবে। আমি তো জানি হাবুর এলেম, সেন্টুর ধারে কাছেও দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু আজকে যা হল, কিছু বলার মতো আমার আর মুখ নেই। কে জানে, হাবু খেললে, আমি আর ও মিলে হয়তো আরো কয়েকটা গোল শোধ করা যেত। হাবুর কথার উত্তর না দিয়ে আমি সেন্টুর দিকে তাকালাম। জিগ্যেস করলাম, ‘তোর আজ কি হল বলতো, সেন্টু? আজ তোর কিচ্ছু ঠিকঠাক হচ্ছিল না। না পারলি বল পায়ে রাখতে। না পারলি একটাও ঠিকঠাক পাস দিতেনিজে শট নিয়ে গোলে একবারও বল ঢোকাতে পারলি না। এমন তোর কোনদিন দেখিনি’।

আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস আর ব্যাজারমুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেন্টু বলল, ‘আউট অফ ফর্ম। বুঝেছিস বীরু, আজকে একদম আউট অফ ফর্মে ছিলাম। প্রথম থেকেই খুব নার্ভাস লাগছিল। পায়ে বল এলেই মনে হচ্ছিল, এটা কি রে বাবা, গোলমতো বলটাকে কিভাবে সামলাবো। বলের ঠিক কোনখানে মারলে ঠিকঠাক পাস হবে বুঝতে বুঝতেই সুহৃদ সংঘের ঝন্টু নয়তো মিল্টন বলটা কেড়ে নিচ্ছিল।‘

‘সে তো নেবেই, খেলতে নেমে তুই বল নিয়ে গবেষণা করবি, আর অন্য সবাই দাঁড়িয়ে দেখবে তাই হয় নাকি?’ বিরক্ত হয়েই বললাম সেন্টুকে। 

সেন্টু মাথা ঘাড় চুলকে বলল, ‘সেই। সেটাই তো। কিছুতেই বুঝতে পারলাম না, কিভাবে শট মারতে হবে। বলটা এমন গোল না হয়ে একটু ট্যাপা মতো হলে, আমার মনে হয় খেলার সুবিধে হতো’।

সেন্টুর এই কথায় আমাদের দলের সবাই হেসে উঠল হ্যা হ্যা করেআমি আরো বিরক্ত হলাম, আর অবাকও হলাম। আমাদের দলে আমি আর সেন্টু একসঙ্গে খেলছি, প্রায় বছর চারেক হতে চলল। আমাদের রেকর্ড আছে আঠারোটা পর্যন্ত গোল করার। গতবারই আমাদের ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, আর সেন্টু হয়েছিল সবচেয়ে বেশি গোলদাতা। ১৫৮টা গোল দিয়েছিল, কুড়িটা ম্যাচেতার মুখে একথা শুনে আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না। 

হতাশ হয়ে আমি এবার ভজাকে জিগ্যেস করলাম, ‘হ্যাঁরে ভজা, তোর কি মনে হয়, ফুটবলের সাইজটা কেমন হওয়া উচিৎ? তোরা দুই ভাই আজকে বাড়ি থেকে কী খেয়ে এসেছিস বলতো? একটা গোলও সেভ করতে পারলি না? চারটে গোল তো, গড়ানে বলে হল। তোর জায়গায় লালুকে দাঁড় করিয়ে দিলেও, অন্ততঃ ওই চারটে গোল কম খেতে হত’।

লালু আমাদের পাড়ারই কুকুর, আমাদের পায়ে পায়ে ঘোরাঘুরি করে, অন্যদিন আমদের দলের ঠিক পিছনেই সামনের থাবায় মুখ রেখে, চুপচাপ শুয়ে থাকে। আজকেও রয়েছে, কিন্তু বেশ খানিকটা তফাতে। ভয়ে ভয়ে দেখছে আমাদের দিকে, আর মাঝে মাঝেই মুখ তুলে ডাক ছাড়ছে, ‘ওওওউউউউউ’। আমাদের দুর্গতি দেখে লালুও কি হতাশ হয়ে আমাদের সঙ্গ ছাড়ল? কে জানে?

ভজা সেন্টুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, ‘বলটা বড্ডো গোল, এত গোল বলে খেলা যায় নাকি? হাত দিয়ে ধরবো কি করে, খালি ফস্কে যাচ্ছিলতাছাড়া কে যে কখন কোনদিক থেকে ধড়াম ধড়াম করে শট মারছে, বুঝবো কি করে? এই ডান দিক থেকে, এই বাঁদিক থেকে। কখনো ওপরে, কখনো নিচে। এ আবার কি? গোলে শট মারার একটা বাঁধাধরা নিয়ম থাকবে তো! সে সবের কোন বালাই নেই!’

ভজার উত্তর শুনে এবার কিন্তু কেউ হাসল না। সবাই গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। আমিও চুপ করেই রইলাম, এ কথার কি উত্তর আমার জানা নেই। এই সমস্যার সমাধানটাই বা কি? আমার মাথাতে এলো না।  ভজা আমাদের দিকে তাকিয়ে ছোটভাই সেন্টুর দিকে তাকাল। তারপর নিজেদের মধ্যে চোখে চোখে ইশারা করে আমাদের বলল, ‘উঠলাম রে, বীরুকালকে কোন খেলা নেই তো’?

‘না, কাল নেই। পরশু আছে। তবে আমরা আর খেলব না’। আমি গম্ভীর মুখে উত্তর দিলাম।

‘কেন?’ সেন্টু জিগ্যেস করল।

‘কেন, আবার কি? এই খেলা খেলে লোক হাসিয়ে কী হবে’? আমি একটু ঝাঁজিয়ে উত্তর দিলাম। ‘তার ওপর তোরা যা বললি; কথা বলে দেখি বলটাকে ট্যাপা বা চ্যাপ্টা কিংবা চৌকোণা করা যায় কিন!’ ওরা যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছিল,  আমি ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম

‘দ্যাখ কি হয়’। বলে,  ভজা সেন্টুর কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল। আমরা ওদের দিকেই দেখছিলাম। পাইনদের পাঁচিল বরাবর হেঁটে, পাঁচিল যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে বাঁদিকে ঘুরে গেল, আর দেখা গেল না।  

আমরা ছ’জন এবার নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। আমাদের সকলেই প্রায় একসঙ্গে বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। চুপ করে বসেইছিলাম, বুদ্ধ প্রথম কথা বলল, ‘কেসটা কি বলতো, বীরু?’

‘কিছুই বুঝতে পারছি না’। আমি বললাম।

‘এবারের লিগটা মাঠে মারা গেল, মনে হচ্ছে’, দীপু বলল।

‘কুছু হয়নি, আমরা ও দোনোকো ছেড়েই খেলবো। হাবু আছে, নিমাই আছে, জিতেনভি আছে’। ভিকি বলল। ভিকি বছর দুয়েক হল আমাদের পাড়ায় এসেছে, বিহারিবাংলা বোঝে, তবে বাংলা বলে মিলিয়ে মিশিয়ে

‘ভিকি একদম ঠিক বলেছে। সেন্টু আর ভজার মাথা খারাপ হয়ে গেছে বলে, লিগ খেলা ছেড়ে দিতে হবে নাকি? ওদের ছাড়াই আমরা খেলব। তুই কাল সকালেই সবাইকে ডাক, বীরুকাল বিকেলে আমাদের ম্যাচ নেই, কাল বিকেলেই আমরা নিজেদের মধ্যে প্র্যাকটিস খেলা খেলে নেব’। নরেনের এই কথায় সবাই সমস্বরে সায় দিল। 

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, তাই হবে। কাল সকালে ভিকি আর দীপু আমার সংগে চল, নিমাই আর জিতেনের সঙ্গে কথা বলে নেব’। সকলেই আমার কথায় সানন্দে বলে উঠল, ‘ইয়েস, হারি বা জিতি যাই হোক, লিগ খেলা আমরা ছাড়বো না’। আমি চিন্তিত মুখে বললাম,

‘কিন্তু, সেন্টু আর ভজার কি হল, বল তো? এতবছর ধরে দিব্বি ভালো খেলছিল, হঠাৎ আজ এরকম খেলার ছিরি! তার ওপর আবার বলে কিনা, বলের শেপ পাল্টাতে হবে! আমার কিন্তু ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না!’

‘তোর কি মনে হচ্ছে, বল তো?’ হাবু আমাকে জিগ্যেস করল। 

আমি গভীর চিন্তা করতে করতে বললাম, ‘মগজে কিছুই ঢুকছে না’।

এই কথাটা আমি শেষ করেছি কি করিনি, হঠাৎ আমার পিঠে ধাঁই করে এসে নামল, আমাদের হারিয়ে যাওয়া বলটা। আমি পাইনদের পাঁচিলের দিকে পিঠ করে বসেছিলাম। মনে হল, পাঁচিলের ওপার থেকে কেউ বলটা ছুঁড়ে দিল। তবে কি সেন্টু আর ভজা ওপাশে গিয়েছিল বলটা খুঁজতে? আমরা এখানে আছি জেনে, ওরাই ছুঁড়ে দিল বলটা? নিশ্চয়ই তাই। কিন্তু এই আধো সন্ধ্যেবেলায়, সেন্টু আর ভজা পাইনদের ওই পোড়ো বাড়িতে ঢুকল কি করে? ও বাড়ির অনেক বদনাম আছে, দিনের বেলাতেই লোকে ঢুকতে সাহস পায় না, আর এই সন্ধেবেলায়, ওরা দুজনে...! নাঃ, আজ ওরা দুইভাই একটার পর একটা চমক দিয়েই চলেছে!

লালু একটু আগে আমাদের কাছে এসে শুয়েছিল রোজকার মতো। এখন এই বলটা ধুপ করে এসে পড়াতে, দৌড়ে পালিয়ে গেল অনেকটা দূরে, তারপর পাইনদের পোড়ো বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আর্ত স্বরে ডাকল, ‘ওওওউউউউউ’।

 

 সাড়ে আটটার সময় আমার টিউসনের মাস্টারমশাই চলে যাবার পর, পড়ার টেবিলে অংকের খাতা নিয়ে আমি আবার বসলাম। স্কুলে ছুটি বলে লেখাপড়ায় ফাঁকি দিলে মা খুব রেগে যান। এদিকে আমার মনে হয় সারাদিন লেখাপড়া করলেই হবে? খেলাধুলো করতে হবে না? গপ্পের বইও তো পড়তে হবে নাকি? মা সেটা বুঝতে চান না। অতএব, হাতে পেন নিয়ে, অংকের বই খুলে, অংকের লম্বা খাতার নিচেয় রেখে, আমায় টিনটিন পড়তে হয়। ‘আমেরিকায় টিনটিন’এর প্রথম পাতা পড়ে সবে দ্বিতীয় পাতায় যাবো, ঘাড়ের কাছে জানালার বাইরে থেকে সেন্টুর গলা পেলাম,

‘অ্যাই, বীরু, কি করছিস’? আমাকে এমন চমকে দেওয়ার জন্যে খুব রাগ হল আমার, বললাম,

‘দেখছিস তো পড়ছি। জিগ্যেস করছিস কেন’?

‘পড়ছিস? ছাই পড়ছিস। পড়ছিস তো টিনটিন’।

‘বেশ করেছি, তাতে তোর কি’?

‘কাকিমাকে বলে দিলে, বুঝবি আমার কি!’

এবার আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম সেন্টুর দিকে। ভালো জামা-প্যান্ট পড়ে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে কোথাও যাবে, বিয়ে বাড়ি কিংবা কোন নেমন্তন্ন বাড়ি। আমার দিকে তাকিয়ে হতচ্ছাড়া ভুরু নাচাচ্ছে! মাকে বলে দিলে আর রক্ষে নেই। 

আমি একটু নরম সুরে বললাম, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, কি বলবি বল?’

‘আজকে খেলার কি রেজাল্ট, রে? আজকে মা বাবা এমন করল না, কিছুতেই ছাড়ল না –’

আমি রাগে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম প্রায়, সামলে নিলাম। সারাক্ষণ মাঠে খেলে, তারপর এত কাণ্ডের পর এসেছে আমার কাছে খেলার রেজাল্ট জানতে! আমি আবার ঝাঁজালো সুরে বললাম, ‘ইয়ার্কি করিস না, সেন্টু। তুই জানিস না, খেলার কি রেজাল্ট’?

‘কি করে জানবো। আমি আর দাদা তো মা বাবার সঙ্গে জেঠুর বাড়ি গেছিলাম অনন্তপুরে, এই ফিরছি। আমরা কিছুতেই যাব না, মা-বাবাও আমাদের না নিয়ে যাবেন না। তোকে একবার যে এসে বলে যাবো, তাও পারলাম না রে’।

‘তার মানে, বলতে চাস, বিকেলে তুই আর ভজা আমাদের সঙ্গে খেলিস নি’?

‘না। কি করে খেলবো? আমরা তো এই মাত্র ফিরলাম। এখনো জামা কাপড় ছাড়িনি, তার আগেই চলে এলাম তোর সঙ্গে দেখা করতে!’

‘ইয়ার্কির সীমা আছে, সেন্টু। ভাবিস না এই সব কথায় আমি ভুলে গিয়ে তোদেরকে পরশু আবার খেলতে নেব। আমাকে অত বোকা ভাবিস না’।

‘তার মানে? আজ খেলতে পারলাম না বলে, পরশু আমাদের খেলতেই নিবি না? ক্যাপ্টেন বলে তুই যা খুশি করবি নাকি?’

‘আজ তুই একটাও গোল করতে পারলি না। ভজা একটাও গোল সেভ করতে পারল না। গোটা দলটাকে তোরা দুজনে ডুবিয়ে দিলি। আবার তোদের খেলায় নেব?’

‘কি আজেবাজে বকছিস, বীরুআমরা খেলতেই আসতে পারলাম না, তাতে গোল করা, গোল সেভ করার কথা আসছে কি করে?’

‘আমিও তো সেই কথাই বলছি, আজ তো তোরা খেলতেই পারলি না, আমাদের টিম গো হারা হারল’।

‘আরে বাবা, আমিও তো বলছি, আমরা তো ছিলামই না, খেললাম কখন’?

‘সত্যিই তাই, তোরা খেললি কখন, পুরোটাই তো ছেলেখেলা করলি’।

‘দিন-কে-দিন তুই বেশ গাধা হয়ে উঠছিস, বীরু পঞ্চাশবার বলছি, আমরা অনন্তপুর গিয়েছিলাম, জেঠতুতো দিদির ছেলের অন্নপ্রাশনে, ঝিঙেপোতায় আমরা সারাদিনই ছিলাম না। তবু তুই এক কথা বলে চলেছিস’।

‘তোরা আজ সারাটা বিকেল আমাদের সঙ্গে খেলিস নি’?

‘না’।

‘আমরা আজ ২৬-২ গোলে হেরেছি তোরা জানিস না’?         

‘২৬-২? এ রাম। এতটা খারাপ হবে আমরা বুঝিনি রে, বীরু! হাবু খেলেনি? কিংবা নিতাই, জিতেন?’

সেন্টুর এই কথায় আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। বললাম, ‘খেলার শেষে, বলটা গোল না হয়ে, ট্যাপা হলে ভালো হয়, তুই বলিস নি’? আমার কথায় সেন্টু খুব হাসল,

‘হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা, ফুটবল কখনো ট্যাপা হয় নাকি? এ আবার একটা কথা হল’?

‘বাড়ি ফেরার পথে পাইনদের বাড়ির ভেতর থেকে আমাদের বলটা তুই আমার পিঠে ছুঁড়িস নি?’

‘কখন বল তো, আজ’?

‘হ্যাঁ আজ। খেলা শেষ হয়ে যাবার পর আমরা মাঠে বসেছিলাম। তখন সন্ধে হবো হবো করছে’।

‘তুই পাগল হয়েছিস, বীরুতুই জানিস আমি কিরকম ভিতুসন্ধে বেলায় আমি যাবো ওই পাইনদের পোড়ো বাগানে, বল খুঁজতে? আমাকে কি ভূতে পেয়েছে’?

‘ভূত’? এই কথা শুনে আমার মাথাটা কেমন যেন ঘুরে গেল।

‘অ্যাই বীরু, কি হয়েছে, কিসের ভূত’?

‘আমাদের সঙ্গে তোরা, নাকি ওরা যে খেলছিল, ওরা কি তবে... ?’

 

চেয়ার উল্টে পড়ে যেতে যেতে আমি শুনলাম, জানালার বাইরে থেকে সেন্টু ডাকছে, ‘অ্যাই বীরু, বীরু, কি হল কী তোর?’  ওদিকে চেয়ার উল্টে পড়ার বিকট শব্দে, মায়ের গলা শুনতে পেলাম, ‘ও কিরে বীরু, চেয়ার থেকে পড়ে গেলি নাকি রে? কি হয়েছে, বীরু’?

মা দৌড়ে আসছেন আমার কেমন যেন সব অন্ধকার হয়ে গেল।

 -০০-

["তেঁনারা" গ্রন্থে গল্পটি সংকলিত।]

গ্রন্থটির ই-বুক পেতে হলে এই লিংকে গিয়ে অর্ডার করুন - 

https://play.google.com/store/books/details/%E0%A6%A4_%E0%A6%A8_%E0%A6%B0_TENARA_TENARA_JOYDHAK_PRAKASHAN?id=Nvn8EAAAQBAJ&hl=en-US&pli=1

শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪

বাড়ি যান, দিদিভাই

  


 

আজকের দিন ধরলে পাঁচদিন হল, পুলক মনাদার এই ঘরে আটকে রয়েছে।

 সে আটকে আছে ঠিকই কিন্তু অসুবিধে তেমন কিছু নেই। ঘরে খাট, আলমারি, টেবিল, চেয়ার, টিভি সবই মজুত।  ঘরটাও বেশ বড়ো আর দুটোদিক খোলামেলা বলে আলো বাতাসের কোন অভাব নেই। দক্ষিণদিকে বাড়ির কম্পাউণ্ডেই একটা আম গাছ, তার ফাঁক দিয়ে পাঁচিলের বাইরে একটা পুকুরও চোখে পড়ে। আর পুবদিকে পাঁচিলের ওপাশে টিন আর টালির চাল দেওয়া একটানা অনেক বস্তির পরেই শেয়ালদা সাউথ সেকশনের রেল লাইন চলে গেছে। ভোর থেকে অনেক রাত অব্দি এ লাইনে ঘন ঘন ট্রেনের যাতায়াত – আপ এবং ডাউন দু’দিকেই

মনাদা মানে মনতোষ দত্ত, তাদের এই এলাকার নেতা। পার্টির জোনাল কমিটির সেক্রেটারি। বাড়িটা মনাদারই বাড়ি। একতলায় পার্টি অফিস আর মনাদারই কন্‌স্ট্রাকশনের অফিস, রুমঝুম বিল্ডার্স, বৌদির নামে চালায়। আর দোতলায় মনাদা আর মনাদার ফ্যামিলি থাকে। তিনতলার পুরোটাই গেস্টদের জন্যে রাখা আছে, মোট পাঁচখানা রুম – সবকটা রুমেই অ্যাটাচ্‌ড্‌ বাথ, একই ধরনের সাজানো-গোছানোঅন্য ঘরগুলো সব খালি, আর পুলক যে ঘরটাতে রয়েছে, সেটাই সব থেকে ভাল

আজ থেকে সাত কি আট বছর আগেও মনাদা আর পুলক সামনের ঐ বস্তিতেই থাকত। এর মধ্যে কি করে যে কী হয়ে গেল, পুলক আজও বুঝে উঠতে পারেনি। প্রায় বছর দুয়েক হতে চলল, মনাদা এ বাড়িটা বানিয়ে উঠে এসেছে। কিন্তু পুলকরা আজও রয়ে গেছে ঐ বস্তিতেই! তবে এই পাঁচটাদিন স্পেশাল গেস্ট হয়ে পুলক আছে মনাদার এই ঘরে, তার পরিবার আছে ঐ বস্তিতেই!

সারাটা দিন এই একটা ঘরে বসে বসে কত আর খবরের কাগজ পড়া যায় বা টিভি দেখা যায়? আর সেই খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বা টিভির পর্দায় যদি থাকে তার নিজেরই খবর এবং ছবি! এই মূহুর্তেই যেমন, বাংলা প্রত্যেকটা নিউজ চ্যানেলে তার খবরই দেখাচ্ছে, ব্রেকিং নিউজ... ‘ঘটনার পাঁচ দিন পরেও অধরা পুলক। কী করছে প্রশাসন? কী করছে রাজ্য পুলিশ? পুলক কোথায় জানার জন্যে আমাদের প্রতিনিধি চলে গেছে ওর পাড়ার ক্লাবে, কী বলছে পুলকের সঙ্গীরা? শুনে নেব – হ্যাঁ, প্রদীপ, আজ পাঁচদিন পুলকের কোন হদিশ পাচ্ছে না প্রশাসন, এ বিষয়ে কী বলছে ওর সঙ্গীরা?... “দেখ চামেলী, এখন আমরা এই যে ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সংগ্রামী ক্লাব। এই ক্লাবেই সন্ধ্যের পর রোজ আসত পুলক... ক্যারাম খেলত, তাস খেলত, আড্ডা দিত। আজ নিয়ে পাঁচদিন ধরে সে আসছে না। পাড়ার লোকেরা কেউ কিছু জানে না। ঘটনার পর থেকে সে এই ক্লাবেও আসে নি, পাড়াতেও তাকে দেখা যায় নি, এরকমই বলছে স্থানীয় মানুষজন তাদের বক্তব্য পুলক এই এলাকাতেই নেই, হয়তো এই রাজ্যেও সে নেই বলেই অনেকর ধারণা...চ্যানেল থেকে আমি প্রদীপ হালদার আর আমার সঙ্গে ক্যামেরায় নিতাই হাজরা”এতক্ষণ আমরা পুলকের পাড়ার ক্লাব ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে চাইছিলাম পুলকের কোন সন্ধান পাওয়া যায় কিনা। আর কতদিনে তাকে ধরা সম্ভব? জানতে হলে চোখ রাখুন...’

 

পুলিশ আসবে না, সে ব্যাপারে পুলক নিশ্চিত, কারণ ওদিকটা সামলাচ্ছে মনাদা। পুলিশ মনাদার পরামর্শ ছাড়া এক পাও হিলবে না।  কিন্তু প্রথম দুটো দিন এই সব খবরে খুব টেনসান হয়ে যেত পুলকের, সত্যি সত্যি তার ঘরের দরজায় এসে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে না তো মিডিয়া? পুলিশের চেয়েও মিডিয়া এখন অনেক ভয়ংকর।

পরশুদিন সাংবাদিক সম্মেলন ছিল, সেখানে মনাদা বলেছে – ‘পুলক যে দলেরই হোক তার নিরপেক্ষ বিচার হবে। পুলক ভারতবর্ষের যে প্রান্তেই গা ঢাকা দিক, তাকে ঠিক খুঁজে বের করা হবে। আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন আর নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যাপারে সহযোগিতা করুন’সেখানে এক সাংবাদিক জিগ্যেস করেছিল – ‘পুলক আপনার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল বলে শোনা যাচ্ছে’! মনাদা হেসে উত্তর দিয়েছিল – ‘আমরা জনগণের সঙ্গে থেকে জনগণের জন্যে কাজ করি, শুধু পুলক কেন, আপনিও কি আমার কম ঘনিষ্ঠ নাকি? আইন তার নিজস্ব পথ ধরেই চলবে, অপরাধীকে কেউ আড়াল করলে, তাকেও ছেড়ে দেওয়া হবে না।’ সেদিন পুলক বুঝে গেছে মিডিয়াও তার কাছে আসতে পারবে না। কারণ মনাদার বাড়িতেই যে সে গা ঢাকা দিয়ে আছে, সেটা মিডিয়া ভেবে উঠতে পারবে না, আর যদিও বা ভাবে, মনাদাকে চ্যালেঞ্জ করে এ বাড়িতে আসার সাহস করবে না।

খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও পুলকের কোন কমপ্লেন নেই। বরং পুলক তার নিজের বস্তির ঘরে যা খেত সে তুলনায় রাজকীয় বলা যায়। যেমন এই এখন, রাত্রি দশটা বাজতে না বাজতেই ভানু এসে ছটা রুটি, চিকেন কারি আর ফুলকপির সব্জি দিয়ে গেল। সন্ধ্যে বেলা দিয়েছিল দুটো সিঙাড়া আর চা। দুপুরে মাছের ঝোল, ডাল, ভাত তরকারিসকালে তিনটে রুটি আর আলু চচ্চড়িমোটামুটি এরকমই চলছে গত পাঁচদিন ধরে। মাছ, চিকেন নয়তো ডিম থাকেই রোজএত ব্যস্ততা আর ঝামেলার মধ্যেও সব দিকেই মনাদার সমান নজর – ভাবা যায় না। পুলক বিশ্বাস করে, মনাদার এই অস্বাভাবিক সাফল্যের, এটাও একটা কারণ ঠাণ্ডা মাথায় সব দিক সামলে, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ঠিক সময় বুঝে কাজ সেরে ফেলা! এমন তরতরিয়ে উপরে ওঠার রহস্যটা, ওখানেই লুকিয়ে

সারাটাদিন এই একটামাত্র ঘরে শুয়ে বসে থাকা আর সময়মতো খাওয়া ছাড়া পুলকের কোন কাজ নেই। সময় কাটতেই চায় না, বিরক্তিকর লম্বা মনে হয় দিন আর রাতগুলোকে। নিষ্কর্ম বিশ্রাম, তার ওপর চাপা টেনসান – রাত্রে ঘুম আসতে চায় না, এলেও বারবার ভেঙে যায়। আজও খাওয়ার পর এগারোটার সময় পুলক দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিল, শুয়ে শুয়েই সিনেমা দেখছিল টিভিতে।

সাড়ে এগারোটার সময় দরজায় ঠক ঠক শব্দে পুলক চমকে উঠে বসল বিছানায়। কে হতে পারে এত রাত্রে? ভানু, নাকি মনাদা? নাকি অন্য কেউ? আবারও আওয়াজ হল, বাইরে থেকে মনাদার গলা পেল,

‘কি রে, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি’? পুলক মনাদার সাড়া পেয়ে বিছানা থেকে নেমে ঘরের আলো জ্বালালো, দরজা খুলে দিল। মনাদা ঘরে এল, মনাদার পিছনে পূর্ণ। ঘরে এসে চেয়ারে বসল মনাদা, পূর্ণ বসল না, দাঁড়িয়ে রইল দরজার সামনে দেয়ালে হেলান দিয়ে। মনাদা ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে পুলককে জিগ্যেস করল,  

‘ঘুমিয়ে পড়েছিলি’?

‘নাঃ, শুয়ে পড়েছিলাম, শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিলামঘুম আসে নাকি? কাজকম্মো নেই, সারাটা দিন বসে বসে আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একদম ভাল্লাগছে না - কিছু একটা করো। কতদিন আর এভাবে বেকার বসে থাকতে হবে, মনাদা? মনাদা হাসল একটু, বলল,

‘তোদের নিয়ে এই হচ্ছে মুশকিল। কাজ ছাড়া বসে থাকতে পারিস না। কটাদিন বিশ্রাম কর, আরাম কর, কাজ তো রইল সারা জীবন। এই আমায় দেখ না, বিশ্রামের কোন সুযোগই নেই। দিন রাত পার্টি, অফিস মিটিং, ভাষণ, ফিঁতে কাটা, সমাজ সেবায় দাঁত বের করা...হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা... একটা দিন একটু দম ফেলার সময় পাই না। তোর মতো এমন চান্স পেলে, আমি এমন ছটফট করতাম না, রে শালা’, মনাদা আবার হাসল হ্যা হ্যা ক’রে মনাদার মনটা খুব ভালো, যখন হাসে, প্রাণখোলা হাসি।

‘না, না। যথেষ্ট বিশ্রাম হয়ে গেছে, এবার কিছু একটা কাজ দাও, এখান থেকে বের করে নিয়ে চলো আমাকে’

মনাদা কিছু বলল না, পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করে, একটা সিগারেট ধরালসিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার রাখল টেবিলের ওপর। মনাদা কবছর আগেও বিড়ি খেত, এখন বিদেশী সিগারেট খায় – কত দাম পুলকের ধারণা নেই, তবে অনেক দাম তো নিশ্চয়ই

সিগারেটের ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে পুলককে লক্ষ্য করতে করতে মনাদা বলল, ‘কলকাতার এখন যা সিচুয়েশন, তোকে প্রোটেকশন দেওয়াটা খুব রিস্কি হয়ে যাচ্ছে, রেআমি ভাবছি তোকে বাইরে পাঠিয়ে দেব – ওয়েষ্ট বেঙ্গলের বাইরে। কটা মাস একটু গা ঢাকা দিয়ে থাক সময় হলেই তোকে আবার ডেকে নেব’

অবাক হয়ে পুলক জিগ্যেস করল, ‘কোথায় যাবো’?

‘সে তুই আমার ওপর ছেড়ে দে, না। আমি সব ঠিক করে ফেলেছি। কালকে রাত সাড়ে আটটা-নটা নাগাদ তোকে নিয়ে পূর্ণ বেরিয়ে যাবে, বাইপাসের মোড়ে একটা গাড়ি ওয়েট করবে, সুমো। সুমোটা তোকে রাতের মধ্যে পৌঁছে দেবে ধানবাদ। তোকে ইউপির একটা ঠিকানা দিয়ে দেবে পূর্ণ, ধানবাদ থেকে তুই নিজের মতো চলে যাবি। টাকা পয়সা নিয়ে ভাবিস না – আপাতত পঞ্চাশ নিয়ে চালা। কাল পূর্ণ তোকে টাকাটা হ্যাণ্ড ওভার করে দেবে’

পুলক মাথা নীচু করে কিছু ভাবতে লাগল। মনাদা চুপ করে লক্ষ্য করতে লাগল পুলককে। বিচক্ষণ মনাদা জানে তার এই প্রস্তাব মেনে নেওয়া ছাড়া পুলকের কাছে এখন আর কোন বিকল্প নেই।

মনাদা ভাববার সময় দিল পুলককে, তারপর সিগারেটটা নিভিয়ে দিয়ে বলল, ‘জিতেন সাঁতরা বড্ড লাফাচ্ছে তোর কেসটা নিয়ে। জানিস তো? হারামজাদাটা তোর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবেএক ঐ জিতেন ছাড়া, পাড়ায় আর কেউ মুখ খুলছে না। যতো চুদুর-বুদুর ঐ জিতেনটার। টিভিতে কি স্টেটমেন্ট দিয়েছে দেখেছিস’? পুলক ঘাড় নাড়ল, দেখেছে। তারপর মুখ তুলে তাকালো মনাদার দিকে, বলল, ‘তুমি কি বলছো, ওকেও নামিয়ে দেব? বলো না, আজ রাত্রেই মালটাকে খালাস করে দিয়ে আসি’।

‘পাগল হয়েছিস নাকি, এই সময়ে জিতেন খালাস হয়ে গেলে, কেস একদম গড়বড় হয়ে যাবে। পাব্লিক আর মিডিয়া পুরো খার খেয়ে যাবে। পুরো কেসটা আমার হাতের বাইরে চলে যাবে। আমি অন্য কিছু ভাবছি। জিতেনের কাপড়ের দোকানটা এখন, ওর মেয়ে সীমাই চালায়, না?  রাত সাড়ে আটটা নাগাদ দোকান বন্ধ করে মেয়েটা একলা একলা ঘরে ফেরে’

‘যাচ্চলে, শেষ অব্দি ঐ মেয়েছেলেটাকে নামাতে বলছো’?

মনাদা জিভে চুক শব্দ করে বিরক্ত মুখে তাকাল পূর্ণর দিকে, বলল,

‘এ ছেলেটার মাথায় কি আছে রে, পূর্ণ? সেই থেকে খালি নামিয়ে দেব আর খালাস করে দেব। এ ছাড়া আর কিছুই জানে না’তারপর পুলকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজ তোকে একটা কথা বলি শোন। মার্ডারের থেকেও কাজের জিনিষ হচ্ছে, ভয় এক পিস মার্ডার হয়ে গেছে। এলাকার মানুষজন ভয় পেয়েছে। আরও একটা মার্ডার করলেই কী পাবলিকের মনে ভয় বাড়বে? বাড়তে পারে, নাও বাড়তে পারে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে, পাবলিক হয়তো এমন ক্ষেপে উঠলো, তোদের ধরার জন্যে, পুলিশকেই চাপে ফেলে দিলতখন কেসটা বহুত কিচাইন হয়ে যাবে, সামলানো যাবে না।

এলাকার পাবলিকের মনে একবার সন্ত্রাস আর আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিতে পারলে, তোর কাজ ধর, ম্যাক্সিমাম হয়ে গেল। দু চারটে মার্ডারের থেকেও সেটা ব্যাপক কাজ দেয়একে বলে শকথেরাপি, খুব কাজের জিনিষ মার্ডার হচ্ছে শেষ কথা, বার বার মার্ডার হলে আতঙ্কের ধারটা ভোঁতা হয়ে যায় তাতে অনেক পাবলিক হেবি বার খেয়ে, খচে গিয়ে আন্দোলন টান্দোলন চালু করে দেয়। মিছিল, মহা মিছিল। ওদিকে অপোনেন্ট পার্টিরাও পেছন থেকে কাটি মারার সুযোগ পেয়ে যায়। এই পাবলিকের উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটাকেই আমাদের দুমড়ে দিতে হবে। আর সেটার জন্যে এমন আতঙ্ক ছড়াতে হবে, এলাকায় সন্নাটা ছেয়ে যাবে। পাবলিকের আন্দোলন, বিপ্লব-টিপ্লব সব ইয়েতে ঢুকে যাবে। কী বল, পূর্ণ?’  

মনাদা এবার খ্যাঁক খ্যাঁক করে গা দুলিয়ে হাসতে লাগল।

পুলক বুঝতে পারল না, মনাদা ঠিক কী বলতে চাইছে। পূর্ণর মুখের দিকে তাকাল কিন্তু পূর্ণর মুখের দিকে তাকানো আর দেওয়ালের দিকে তাকানো একই ব্যাপার। পূর্ণ মনাদার ছায়াসঙ্গী বডিগার্ড তার ভাবলেশহীন মুখে কোনদিন হাসি দেখেনি পুলক কোনদিন চমকাতে বা অবাক হতে দেখেনিকোন অনুভুতিই নেই মনে হয়পুলক জানে পূর্ণর কোমরে এখনও অন্ততঃ দুটো লোডেড রিভলভার রাখা আছে। আর আছে ভীষণ শীতল ও আবেগহীন দক্ষতা।

‘তাহলে? কী করতে হবে?’

‘দোকান বন্ধ করে ফেরার সময়, জিতেনের মেয়েটাকে ল্যাংটো করে দিতে হবে সকলের সামনে। শ্লীলতাহানি’ এক চোখ টিপে ইশারা করল মনাদা,  চমকে উঠল পুলক।

‘কে করবে?’

‘তুই করবি। আরো তিনজন ছেলে দেব তোর সঙ্গে’মনাদার কথায় নিশ্চিন্ত আশ্বাস, তবু যেন বিশ্বাস হল না পুলকের।

‘কি বলছ, মনাদা। মিঠুনের মার্ডার নিয়েই বিশ বাঁও জলে  – তার ওপর এই কেস? পাবলিক পেলে আমাকে জ্যান্ত রাখবে?’

‘পাবলিক পাবে কেন? কাজটা করেই তুই সরে পড়বি বাজারের পিছনের পুকুরের দিকে। ওদিকটা অন্ধকার থাকে, ওখানে টাকা আর বাইক নিয়ে ওয়েট করবে পূর্ণ, তোকে বাইকে পৌঁছে দেবে বাইপাস পর্যন্ত – বললাম না? পরশু সকালে তো তুই ধানবাদ থেকে পগার পার ইউপির দিকে!’

মনাদা আবার একটা সিগারেট ধরাল, পুলককে কিছুক্ষণ ভাববার সময় দিল আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাপতে লাগল পুলকের ভাবগতিক। একটু পরে আবার বলল, ‘তুই তো শালা, বিয়েথাও করিস নি, মেয়েদের কাপড়চোপড় কোনদিন খুলেছিস?’ নিজের রসিকতায় মনাদা আবার খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে গিয়ে গলায় সিগারেটের ধোঁয়া বাধিয়ে কাশতে শুরু করল। কাশির দমক একটু সামলে আবার একই ভাবে হাসতে হাসতে বলল- ‘ও ব্যাপারটা ছেলেদের শেখাতে হয় না, কি বল পূর্ণ?’

 

 মনাদা আর পূর্ণ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রাত বারোটা পঁচিশেদরজা বন্ধ করে পুলক লাইট নিভিয়ে খাটে এসে বসল। ভাবতে লাগল মনাদার কথাগুলো।  

পুলক হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি। মনাদা যাবার সময় বলে গেল, ‘কাল রাত ঠিক আটটায় বেরিয়ে যাবি, পিছনের আমগাছ ধরে পাঁচিল টপকে পুকুরের পাড় দিয়ে। মনোতোষ দত্তের বাড়ি থেকে পুলক বের হচ্ছে, এটা পাবলিক দেখে ফেললে কি হবে সেট বুঝতেই পারছিস?’

পুলক খুব ভালো করেই জানে, তার রাজি হওয়া বা না হওয়াতে মনাদার কিচ্ছু যাবে আসবে না। পুলক না করলে অন্য কেউ করে দেবে। আর পুলককে ঘাড় থেকে নামাতে মনাদার এক মিনিটও সময় লাগবে না। এই যে মনাদা, সাংঘাতিক রিস্ক নিয়েও তাকে পাঁচদিন ধরে নিজের বাড়িতে রাজার হালে পুষছে – সেটা পুলককে ভরসা করে বলেই তো? পুলককে দিয়ে কাজ হয় বলেই তো?

কিন্তু এই কাজটা পুলকের মাথায় ঠিক সেট হচ্ছে না। সব কিছুরই একটা সেটিং থাকে, না? মার্ডার ব্যাপারটা পুলকের মাথায় বেশ সেট হয়ে গেছে। মিঠুনের আগে আরো তিনজন তার হাতে মার্ডার হয়েছে। নেপাল, মহাদেব আর বীরেন্দর এরা তিনজন তাদের দলেরই লোক – কিন্তু মনাদার অ্যান্টি। ওদের তখনই খালাস না করলে মনাদার সঙ্গে সঙ্গে পুলকদেরও খালাস হয়ে যাবার খুব চান্স ছিল। মার্ডার হওয়ার পর বিরোধী দলের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে মনাদা এমন হুজ্জোত শুরু করেছিল, যে তার দিকে কেউ লক্ষ্যই করেনি। মিটিং, মিছিল, পথ অবরোধ। তারপর তিনজনকেই শহীদ ঘোষণা করে, পাড়ায় গলির মুখে শহীদ বেদী বানিয়ে মনাদা পুরো ব্যাপারটা নিখুঁত সামলে দিয়েছিল। এখন সেই শহীদ বেদীগুলোতে পাড়ার কুত্তারা হিসি করে, তাদের এলাকা ঠিক রাখে।    

মিঠুনের কেসটা একটু আলাদা। ছেলেটা পরোপকারি, সমাজসেবী টাইপের। কোন দলটল করত না, কিন্তু বেশ পপুলার ছিল পাড়ায়। পাড়ার লোকেদের সঙ্গে থাকত, অন্যায়টন্যায় দেখলেই খেপচু হয়ে পেছনে লেগে পড়ত। মনাদা একটা পুকুর বুজিয়ে ফ্ল্যাট বানানোর মাখন স্কিম বানিয়েছে – সেটা নিয়ে কাটি করতে বসল মিঠুন! মনাদার দোষ নেই, মনাদা অনেক চেষ্টা করেছিল - ভালো কথায় বুঝিয়ে, টাকার টোপ ফেলে, ভয় দেখিয়ে। কিছুতেই মালটা লাইনে এল না, শেষ অব্দি টপকে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় রাখেনি মিঠুন। তার হাতে মার্ডার হয়ে গেল – আর সেখানেই ফেঁসে গেল পুলক – নিখুঁত কাজের মধ্যেও একটা ফাঁক রয়ে গেল - জিতেন সাঁতরা। ভোর পাঁচটায় মর্নিং ওয়াক করতে বের হওয়া মিঠুনকে খালাস করার সময় দেখে ফেলেছিল জিতেন। ব্যাটার হাঁপানির টান, বারান্দায় দাঁড়িয়ে, হাপরের মতো ফুসফুসে ভোরের বাতাস টানছিল, ওই দৃশ্য দেখে টেনশানে তার এমন টান উঠল, রাস্তা থেকেও তার শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল পুলক। দেখতে পেয়েছিল, জিতেন সাঁতরার ঠেলে বেরিয়ে আসা, আতঙ্কিত চোখ দুটো। 

সেই জিতেনের মেয়ের কাল শ্লীলতাহানি করতে হবে, রাত সাড়ে আটটায় ভরা বাজারের মধ্যে! মনাদা এটাকে বলল শকথেরাপি, সন্ত্রাসের শক। আতঙ্কথেরাপি! এই ট্রিটমেন্টেই জিতেনের সব তেল বেরিয়ে যাবে? সত্যি কথা বলার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বার তেল; বিচারের একমাত্র সাক্ষী হবার তেল?

 

 আটটা কুড়ির মধ্যে পুলক পৌঁছে গেল জিতেনের বীণাপাণি বস্ত্র বিপণির উল্টোদিকে মনসা দশকর্মা ভাণ্ডার। তার পাশের গলিতে ঝুপসি অন্ধকারে মিশে সে দাঁড়িয়ে রইল। এই গলি দিয়েই তাকে সরে পড়তে হবে – খুব নোংরা আর সরু গলি, দু পাশে কোন বসতি নেই – বাজারের দোকানদারদের অনেকগুলো গুদাম আছে পর পর। এই গলির শেষেই পুকুর, তার ধার দিয়ে চলে যাওয়া যায় পাশের গলিতে দোকানের ভিতরে সীমাকে এখান থেকে দেখতে পাচ্ছিল পুলক। একজন কর্মচারিও রয়েছে। দোকান বন্ধ করার আগে, সব কিছু দেখে নিচ্ছে। দোকানের পাশে একটা চায়ের দোকান – সেখানে চা খাচ্ছে পরেশ। পরেশ মনাদার লোক। আরো দুজন কে আছে? চেনা আর কাউকে চোখে পড়ল না পুলকের।

দোকানের লাইট, বাইরের সাইনবোর্ডের লাইট নিভিয়ে দিয়ে সীমা আর কর্মচারি লোকটা বেরিয়ে এল বাইরে। সীমার হাতে তালা। কাঁচের পাল্লা বন্ধ করে লোকটা তালা দিল দরজায়। এরপর রোলিং শাটার - লোকটা ঘড় ঘড় শব্দে টানতে শুরু করল শাটারটা। চায়ের দোকান থেকে পরেশ এগিয়ে গেল সীমার দিকে পুলকও বেরিয়ে এল গলি থেকে। পরেশ সীমাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল সোজা, আচমকা ধাক্কায় হকচকিয়ে যাওয়া সীমাকে ধরে ফেলল পুলক। ডান হাতের ব্লেড চালিয়ে দিল সীমার পিঠের ব্লাউজ আর ব্রেসিয়ারে। বাঁহাত দিয়ে সীমার বুকের কাছে খামচে ধরল শাড়ি আর ব্লাউজ – হেঁচকা টানে উন্মুক্ত হয়ে গেল সীমা। জীবনে এই প্রথমবার পুলক স্পর্শ করল কোন মেয়ের বুক এবং চাক্ষুষ করল তার নগ্নতা!

পুলক আর দাঁড়াল না দৌড়তে লাগল নির্দিষ্ট গলির দিকে ঘটনার আকস্মিকতায় আর লজ্জায় সীমা যখন বিমূঢ়, দুজন ছেলে সামনে এল, রাস্তায় লুটিয়ে থাকা শাড়ির আঁচল তুলে সীমার শরীরে জড়িয়ে দিতে দিতে একজন বলল, ‘বাড়ি যান, দিদিভাই। বাবাকে বলুন – উটকো ঝামেলায় না জড়াতে। আপনারা ভদ্রলোক – ছোটলোকদের এই সব ব্যাপারে কেন জড়াচ্ছেন নিজেদের? কেন এসবের মধ্যে থাকেন’?

পথচারী আর আশেপাশের দোকানের অজস্র লোক চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে উপভোগ করল এই ঘটনা

 

 

দেয়ালে লটকানো এলইডি টিভিতে নিউজ দেখছিল মনাদা। পিছনের চেয়ারে বসেছিল পূর্ণ।

“ব্রেকিং নিউজ...মিঠুন হত্যা তদন্তে নতুন মোড়। প্রকাশ্য রাস্তায় মিঠুনহত্যার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীর একমাত্র মেয়ের শ্লীলতাহানি...ঘটনাস্থলের কিছুটা দূরে উদ্ধার মিঠুন হত্যার অন্যতম অভিযুক্ত পুলক বিশ্বাসের গুলিবিদ্ধ লাশ। ঠিক কী ঘটেছে আমরা জেনে নেব ঘটনাস্থলে উপস্থিত আমাদের প্রতিনিধি প্রদীপের কাছে, হ্যাঁ প্রদীপ – ঠিক কী ঘটেছে, আমাদেরকে জানাও...

‘চামেলি, একটু আগে এই সাড়ে আটটা - পৌনে নটা নাগাদ এখানে এক ভদ্রমহিলার শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে। সে সময় খুব স্বাভাবিকভাবেই এখানে অনেক লোকজন ছিল – এই সময়েই বাজারের সব দোকানই বন্ধ হবার সময়। ভদ্রমহিলাও দোকান বন্ধ করছিলেন। উনি দাঁড়িয়েছিলেন দোকানের সামনে, দোকানের দরজা বন্ধ করছিল ভদ্রমহিলার দোকানের এক কর্মচারী, বিপুলবাবুসেই সময় তাঁকে পাশ থেকে কেউ একজন ধাক্কা দেয়। ধাক্কার জোর এতটাই ছিল,  ভদ্রমহিলা প্রায় পড়ে যাবার মতো হয়েছিলেন, আর এই সামনের গলি থেকে দৌড়ে এসে তাঁকে ধরে ফেলেছিল পুলক। এই পুলক তুমি জানো, চামেলী, মিঠুনহত্যার অন্যতম অভিযুক্ত। তাকে গত ছদিন ধরে প্রশাসন খুঁজে বেড়াচ্ছে কিন্তু ধরা পড়েনি। সেই পুলক আজ এইখানে কিভাবে এসে উপস্থিত হল – সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষের মনে...তার মানে সে কী আদৌ এলাকার বাইরে যায়নি? এখানেই কোথাও গা ঢাকা দিয়ে ছিল? রাজনৈতিক আর ওয়াকিবহাল মহল থেকে এমন প্রশ্নও উঠে আসছে বার বার...

‘প্রদীপ, শ্লীলতাহানির ঘটনাটা ঠিক কী হয়েছে আমাদেরকে জানাও’

‘হ্যাঁ চামেলী, ধাক্কা লেগে ভদ্রমহিলা পড়ে যাওয়ার মতো হওয়াতে পুলক এসে তাকে ধরে ফেলেছিল আর খুব দক্ষ হাতে খুলে দিয়েছিল ভদ্রমহিলার শাড়ি, ছিঁড়ে ফেলেছিল ব্লাউজ ও অন্তর্বাস’

‘ভদ্রমহিলার মানসিক অবস্থা এখন কেমন, কী বলছেন উনি এই ঘটনার পর...?’

‘মানসিক দিক থেকে ভদ্রমহিলা একেবারেই ভেঙে পড়েছেন – এই মূহুর্তে উনি ঘটনাস্থলে নেই – বাড়ি চলে গেছেন – কারোর সঙ্গে দেখাও করছেন না...’

‘ওদিকে পুলক বিশ্বাসকে কে বা কারা মারল, সে সম্বন্ধে কী জানা যাচ্ছে, প্রদীপ?’

‘কিছুই জানা যাচ্ছে না, চামেলী। পুলিশের সন্দেহ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই পুলকের মৃত্যু হয়েছে। পুলক বিশ্বাসের লাশ ময়না তদন্তের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তদন্তকারী পুলিশের মতে পুলকের মাথায় গুলির চিহ্ন ছিল এবং ওই গুলিতেই তার মৃত্যু হয়েছে...’।

‘প্রদীপ, আমরা তোমার কাছে আবার ফিরে আসবো আরো খবর জানার জন্যে। এর মধ্যে আমরা কথা বলে নেব এলাকার নেতা মনোতোষবাবুর সঙ্গে’...        

 টেবিলে রাখা ফোনটা এই সময় বেজে উঠল, মনাদা বুঝতে পারল এটা চামেলীর ফোন, টিভিতে চামেলী তখন বলছে – ‘আমরা এই এলাকার জনপ্রিয় নেতা ও পার্টির জোনাল কমিটির সেক্রেটারি মনোতোষ দত্তের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি...হ্যালো, মনোতোষ বাবু, আজকে এই মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?’

‘আমি আপনাদের চ্যানেলেই এই মাত্র এই ঘটনাটা দেখলাম। এরকম ঘৃণ্য এবং ন্যক্কারজনক ঘটনা এ শহরের ইতিহাসে আগে কোনদিন ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। আমি তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছি। এই চরম অরাজকতা ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে আমি তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করছি। জনগণের কাছে আমার অনুরোধ, তাঁরা যেন ভুল পথে পরিচালিত হয়ে, কোন প্ররোচনায় কান না দেন। আর প্রশাসনের কাছে আবেদন রাখছি এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হোক, দলমত নির্বিশেষে সকলের সহযোগিতা আমি প্রার্থনা করছি। প্রকৃত দোষী যেন অবিলম্বে চরম শাস্তি পায়’

‘ধন্যবাদ, মনোতোষবাবু...’

‘নমস্কার’।

 ফোনটা কেটে দিল মনাদা। মিউট করে দিল টিভিটাও। টিভিতে একই খবর আবার দেখাতে লাগল দেখে, মনাদা পূর্ণকে চাপা গলায় জিগ্যেস করল –

‘গুলিটা ঠিক জায়গায় লেগেছিল, তুই শিয়োর তো, পূর্ণ’?

‘একদম। রগের নীচে, বাঁচার কোন চান্স রাখিনি’

 

[এই গল্পটি আদ্যন্ত একটি রূপকথা, বাস্তবে কোন ঘটনার সঙ্গে এবং কোন চরিত্রের সঙ্গে কোন ভাবেই কোন মিল থাকতে পারে না, কারণ আমরা ভারতীয়-বাঙালী; চির শান্তি আর মৈত্রীর ধ্বজাধারী, কৃষ্টি ও কলার পূজারী]

 

-০-


[গল্পটি "দশে দশ" গ্রন্থে সংকলিত] 

-০-

নতুন পোস্টগুলি

জঙ্গী ব্যবসা

  ১   ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ