১
আজকের
দিন ধরলে পাঁচদিন হল, পুলক মনাদার এই ঘরে আটকে রয়েছে।
সে আটকে আছে ঠিকই কিন্তু অসুবিধে তেমন কিছু নেই। ঘরে খাট, আলমারি, টেবিল, চেয়ার, টিভি সবই মজুত। ঘরটাও বেশ বড়ো আর দুটোদিক খোলামেলা বলে আলো বাতাসের কোন অভাব নেই। দক্ষিণদিকে বাড়ির কম্পাউণ্ডেই একটা আম গাছ, তার ফাঁক দিয়ে পাঁচিলের বাইরে একটা পুকুরও চোখে পড়ে। আর পুবদিকে পাঁচিলের ওপাশে টিন আর টালির চাল দেওয়া একটানা অনেক বস্তির পরেই শেয়ালদা সাউথ সেকশনের রেল লাইন চলে গেছে। ভোর থেকে অনেক রাত অব্দি এ লাইনে ঘন ঘন ট্রেনের যাতায়াত – আপ এবং ডাউন দু’দিকেই।
মনাদা
মানে মনতোষ দত্ত, তাদের এই এলাকার নেতা। পার্টির জোনাল কমিটির সেক্রেটারি। বাড়িটা
মনাদারই বাড়ি। একতলায় পার্টি অফিস আর মনাদারই কন্স্ট্রাকশনের অফিস, রুমঝুম
বিল্ডার্স, বৌদির নামে চালায়। আর দোতলায় মনাদা আর মনাদার ফ্যামিলি থাকে। তিনতলার
পুরোটাই গেস্টদের জন্যে রাখা আছে, মোট পাঁচখানা রুম – সবকটা রুমেই অ্যাটাচ্ড্
বাথ, একই ধরনের সাজানো-গোছানো। অন্য
ঘরগুলো সব খালি, আর পুলক যে ঘরটাতে রয়েছে, সেটাই সব থেকে ভাল।
আজ থেকে
সাত কি আট বছর আগেও মনাদা আর পুলক সামনের ঐ বস্তিতেই থাকত। এর মধ্যে কি করে যে কী হয়ে
গেল, পুলক আজও বুঝে উঠতে পারেনি। প্রায় বছর দুয়েক হতে চলল, মনাদা এ বাড়িটা বানিয়ে
উঠে এসেছে। কিন্তু পুলকরা আজও রয়ে গেছে ঐ বস্তিতেই! তবে এই পাঁচটাদিন স্পেশাল
গেস্ট হয়ে পুলক আছে মনাদার এই ঘরে, তার পরিবার আছে ঐ বস্তিতেই!
সারাটা
দিন এই একটা ঘরে বসে বসে কত আর খবরের কাগজ পড়া যায় বা টিভি দেখা যায়? আর সেই খবরের
কাগজের প্রথম পাতায় বা টিভির পর্দায় যদি থাকে তার নিজেরই খবর এবং ছবি! এই
মূহুর্তেই যেমন, বাংলা প্রত্যেকটা নিউজ চ্যানেলে তার খবরই দেখাচ্ছে, ব্রেকিং
নিউজ... ‘ঘটনার পাঁচ দিন পরেও অধরা পুলক। কী করছে প্রশাসন? কী করছে রাজ্য পুলিশ? পুলক
কোথায় জানার জন্যে আমাদের প্রতিনিধি চলে গেছে ওর পাড়ার ক্লাবে, কী বলছে পুলকের
সঙ্গীরা? শুনে নেব – হ্যাঁ, প্রদীপ, আজ পাঁচদিন পুলকের কোন হদিশ পাচ্ছে না
প্রশাসন, এ বিষয়ে কী বলছে ওর সঙ্গীরা?... “দেখ চামেলী, এখন আমরা এই যে ক্লাবের
সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সংগ্রামী ক্লাব। এই ক্লাবেই সন্ধ্যের পর রোজ আসত পুলক...
ক্যারাম খেলত, তাস খেলত, আড্ডা দিত। আজ নিয়ে পাঁচদিন ধরে সে আসছে না। পাড়ার লোকেরা
কেউ কিছু জানে না। ঘটনার পর থেকে সে এই ক্লাবেও আসে নি, পাড়াতেও তাকে দেখা যায় নি,
এরকমই বলছে স্থানীয় মানুষজন।
তাদের বক্তব্য পুলক এই এলাকাতেই নেই, হয়তো এই রাজ্যেও সে নেই বলেই অনেকর
ধারণা।...চ্যানেল
থেকে আমি প্রদীপ হালদার আর আমার সঙ্গে ক্যামেরায় নিতাই হাজরা”। এতক্ষণ আমরা পুলকের পাড়ার ক্লাব ও
তার সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে চাইছিলাম পুলকের কোন সন্ধান পাওয়া যায় কিনা। আর
কতদিনে তাকে ধরা সম্ভব? জানতে হলে চোখ রাখুন...’।
পুলিশ
আসবে না, সে ব্যাপারে পুলক নিশ্চিত, কারণ ওদিকটা সামলাচ্ছে মনাদা। পুলিশ মনাদার
পরামর্শ ছাড়া এক পাও হিলবে না। কিন্তু প্রথম
দুটো দিন এই সব খবরে খুব টেনসান হয়ে যেত পুলকের, সত্যি সত্যি তার ঘরের দরজায় এসে ক্যামেরা
নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে না তো মিডিয়া? পুলিশের চেয়েও মিডিয়া এখন অনেক ভয়ংকর।
পরশুদিন
সাংবাদিক সম্মেলন ছিল, সেখানে মনাদা বলেছে – ‘পুলক যে দলেরই হোক তার নিরপেক্ষ
বিচার হবে। পুলক ভারতবর্ষের যে প্রান্তেই গা ঢাকা দিক, তাকে ঠিক খুঁজে বের করা
হবে। আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন আর নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যাপারে সহযোগিতা করুন’। সেখানে এক সাংবাদিক জিগ্যেস
করেছিল – ‘পুলক আপনার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল বলে শোনা যাচ্ছে’! মনাদা হেসে উত্তর দিয়েছিল
– ‘আমরা জনগণের সঙ্গে থেকে জনগণের জন্যে কাজ করি, শুধু পুলক কেন, আপনিও কি আমার কম
ঘনিষ্ঠ নাকি? আইন তার নিজস্ব পথ ধরেই চলবে, অপরাধীকে কেউ আড়াল করলে, তাকেও ছেড়ে
দেওয়া হবে না।’ সেদিন পুলক বুঝে গেছে মিডিয়াও তার কাছে আসতে পারবে না। কারণ মনাদার
বাড়িতেই যে সে গা ঢাকা দিয়ে আছে, সেটা মিডিয়া ভেবে উঠতে পারবে না, আর যদিও বা
ভাবে, মনাদাকে চ্যালেঞ্জ করে এ বাড়িতে আসার সাহস করবে না।
খাওয়া
দাওয়ার ব্যাপারেও পুলকের কোন কমপ্লেন নেই। বরং পুলক তার নিজের বস্তির ঘরে যা খেত
সে তুলনায় রাজকীয় বলা যায়। যেমন এই এখন, রাত্রি দশটা বাজতে না বাজতেই ভানু এসে ছটা
রুটি, চিকেন কারি আর ফুলকপির সব্জি দিয়ে গেল। সন্ধ্যে বেলা দিয়েছিল দুটো সিঙাড়া আর
চা। দুপুরে মাছের ঝোল, ডাল, ভাত তরকারি। সকালে
তিনটে রুটি আর আলু চচ্চড়ি। মোটামুটি
এরকমই চলছে গত পাঁচদিন ধরে। মাছ, চিকেন নয়তো ডিম থাকেই রোজ। এত ব্যস্ততা আর ঝামেলার মধ্যেও সব
দিকেই মনাদার সমান নজর – ভাবা যায় না। পুলক বিশ্বাস করে, মনাদার এই অস্বাভাবিক সাফল্যের,
এটাও একটা কারণ। ঠাণ্ডা
মাথায় সব দিক সামলে, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ঠিক সময় বুঝে কাজ সেরে ফেলা! এমন
তরতরিয়ে উপরে ওঠার রহস্যটা, ওখানেই লুকিয়ে।
সারাটাদিন
এই একটামাত্র ঘরে শুয়ে বসে থাকা আর সময়মতো খাওয়া ছাড়া পুলকের কোন কাজ নেই। সময়
কাটতেই চায় না, বিরক্তিকর লম্বা মনে হয় দিন আর রাতগুলোকে। নিষ্কর্ম বিশ্রাম, তার
ওপর চাপা টেনসান – রাত্রে ঘুম আসতে চায় না, এলেও বারবার ভেঙে যায়। আজও খাওয়ার পর
এগারোটার সময় পুলক দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিল, শুয়ে শুয়েই সিনেমা দেখছিল টিভিতে।
সাড়ে
এগারোটার সময় দরজায় ঠক ঠক শব্দে পুলক চমকে উঠে বসল বিছানায়। কে হতে পারে এত
রাত্রে? ভানু, নাকি মনাদা? নাকি অন্য কেউ? আবারও আওয়াজ হল, বাইরে থেকে মনাদার গলা
পেল,
‘কি রে,
ঘুমিয়ে পড়লি নাকি’? পুলক মনাদার সাড়া পেয়ে বিছানা থেকে নেমে ঘরের আলো জ্বালালো,
দরজা খুলে দিল। মনাদা ঘরে এল, মনাদার পিছনে পূর্ণ। ঘরে এসে চেয়ারে বসল মনাদা, পূর্ণ
বসল না, দাঁড়িয়ে রইল দরজার সামনে দেয়ালে হেলান দিয়ে। মনাদা ঘরের চারদিকে চোখ
বুলিয়ে নিয়ে পুলককে জিগ্যেস করল,
‘ঘুমিয়ে
পড়েছিলি’?
‘নাঃ,
শুয়ে পড়েছিলাম, শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিলাম। ঘুম
আসে নাকি? কাজকম্মো নেই, সারাটা দিন বসে বসে আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একদম ভাল্লাগছে না -
কিছু একটা করো। কতদিন আর এভাবে বেকার বসে থাকতে হবে, মনাদা? মনাদা হাসল একটু, বলল,
‘তোদের
নিয়ে এই হচ্ছে মুশকিল। কাজ ছাড়া বসে থাকতে পারিস না। কটাদিন বিশ্রাম কর, আরাম কর,
কাজ তো রইল সারা জীবন। এই আমায় দেখ না, বিশ্রামের কোন সুযোগই নেই। দিন রাত পার্টি,
অফিস মিটিং, ভাষণ, ফিঁতে কাটা, সমাজ সেবায় দাঁত বের করা...হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা...
একটা দিন একটু দম ফেলার সময় পাই না। তোর মতো এমন চান্স পেলে, আমি এমন ছটফট করতাম
না, রে শালা’, মনাদা আবার হাসল হ্যা হ্যা ক’রে। মনাদার মনটা খুব ভালো, যখন হাসে, প্রাণখোলা
হাসি।
‘না, না।
যথেষ্ট বিশ্রাম হয়ে গেছে, এবার কিছু একটা কাজ দাও, এখান থেকে বের করে নিয়ে চলো
আমাকে’।
মনাদা
কিছু বলল না, পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করে, একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার রাখল
টেবিলের ওপর। মনাদা কবছর আগেও বিড়ি খেত, এখন বিদেশী সিগারেট খায় – কত দাম পুলকের ধারণা
নেই, তবে অনেক দাম তো নিশ্চয়ই।
সিগারেটের
ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে পুলককে লক্ষ্য করতে করতে মনাদা বলল, ‘কলকাতার এখন যা সিচুয়েশন, তোকে
প্রোটেকশন দেওয়াটা খুব রিস্কি হয়ে যাচ্ছে, রে। আমি ভাবছি তোকে বাইরে পাঠিয়ে দেব
– ওয়েষ্ট বেঙ্গলের বাইরে। কটা মাস একটু গা ঢাকা দিয়ে থাক। সময় হলেই তোকে আবার ডেকে নেব’।
অবাক হয়ে
পুলক জিগ্যেস করল, ‘কোথায় যাবো’?
‘সে তুই
আমার ওপর ছেড়ে দে, না। আমি সব ঠিক করে ফেলেছি। কালকে রাত সাড়ে আটটা-নটা নাগাদ তোকে
নিয়ে পূর্ণ বেরিয়ে যাবে, বাইপাসের মোড়ে একটা গাড়ি ওয়েট করবে, সুমো। সুমোটা তোকে
রাতের মধ্যে পৌঁছে দেবে ধানবাদ। তোকে ইউপির একটা ঠিকানা দিয়ে দেবে পূর্ণ, ধানবাদ
থেকে তুই নিজের মতো চলে যাবি। টাকা পয়সা নিয়ে ভাবিস না – আপাতত পঞ্চাশ নিয়ে চালা।
কাল পূর্ণ তোকে টাকাটা হ্যাণ্ড ওভার করে দেবে’।
পুলক
মাথা নীচু করে কিছু ভাবতে লাগল। মনাদা চুপ করে লক্ষ্য করতে লাগল পুলককে। বিচক্ষণ
মনাদা জানে তার এই প্রস্তাব মেনে নেওয়া ছাড়া পুলকের কাছে এখন আর কোন বিকল্প নেই।
মনাদা
ভাববার সময় দিল পুলককে, তারপর সিগারেটটা নিভিয়ে দিয়ে বলল, ‘জিতেন সাঁতরা বড্ড
লাফাচ্ছে তোর কেসটা নিয়ে। জানিস তো? হারামজাদাটা তোর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে। এক ঐ জিতেন ছাড়া, পাড়ায় আর কেউ
মুখ খুলছে না। যতো চুদুর-বুদুর ঐ জিতেনটার। টিভিতে কি স্টেটমেন্ট দিয়েছে দেখেছিস’?
পুলক ঘাড় নাড়ল, দেখেছে। তারপর মুখ তুলে তাকালো মনাদার দিকে, বলল, ‘তুমি কি বলছো,
ওকেও নামিয়ে দেব? বলো না, আজ রাত্রেই মালটাকে খালাস করে দিয়ে আসি’।
‘পাগল
হয়েছিস নাকি, এই সময়ে জিতেন খালাস হয়ে গেলে, কেস একদম গড়বড় হয়ে যাবে। পাব্লিক আর
মিডিয়া পুরো খার খেয়ে যাবে। পুরো কেসটা আমার হাতের বাইরে চলে যাবে। আমি অন্য কিছু
ভাবছি। জিতেনের কাপড়ের দোকানটা এখন, ওর মেয়ে সীমাই চালায়, না? রাত সাড়ে আটটা নাগাদ দোকান বন্ধ করে মেয়েটা একলা
একলা ঘরে ফেরে’।
‘যাচ্চলে,
শেষ অব্দি ঐ মেয়েছেলেটাকে নামাতে বলছো’?
মনাদা
জিভে চুক শব্দ করে বিরক্ত মুখে তাকাল পূর্ণর দিকে, বলল,
‘এ
ছেলেটার মাথায় কি আছে রে, পূর্ণ? সেই থেকে খালি নামিয়ে দেব আর খালাস করে দেব। এ
ছাড়া আর কিছুই জানে না’। তারপর
পুলকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজ তোকে একটা কথা বলি শোন। মার্ডারের থেকেও কাজের জিনিষ
হচ্ছে, ভয়। এক
পিস মার্ডার হয়ে গেছে। এলাকার মানুষজন ভয় পেয়েছে। আরও একটা মার্ডার করলেই কী
পাবলিকের মনে ভয় বাড়বে? বাড়তে পারে, নাও বাড়তে পারে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে, পাবলিক
হয়তো এমন ক্ষেপে উঠলো, তোদের ধরার জন্যে, পুলিশকেই চাপে ফেলে দিল। তখন কেসটা বহুত কিচাইন হয়ে যাবে, সামলানো
যাবে না।
এলাকার
পাবলিকের মনে একবার সন্ত্রাস আর আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিতে পারলে, তোর কাজ ধর, ম্যাক্সিমাম
হয়ে গেল। দু চারটে মার্ডারের থেকেও সেটা ব্যাপক কাজ দেয়। একে বলে শকথেরাপি, খুব কাজের
জিনিষ। মার্ডার
হচ্ছে শেষ কথা, বার বার মার্ডার হলে আতঙ্কের ধারটা ভোঁতা হয়ে যায়। তাতে অনেক পাবলিক হেবি বার খেয়ে, খচে গিয়ে
আন্দোলন টান্দোলন চালু করে দেয়। মিছিল, মহা মিছিল। ওদিকে অপোনেন্ট পার্টিরাও পেছন
থেকে কাটি মারার সুযোগ পেয়ে যায়। এই পাবলিকের উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটাকেই আমাদের
দুমড়ে দিতে হবে। আর সেটার জন্যে এমন আতঙ্ক ছড়াতে হবে, এলাকায় সন্নাটা ছেয়ে যাবে।
পাবলিকের আন্দোলন, বিপ্লব-টিপ্লব সব ইয়েতে ঢুকে যাবে। কী বল, পূর্ণ?’
মনাদা এবার
খ্যাঁক খ্যাঁক করে গা দুলিয়ে হাসতে লাগল।
পুলক
বুঝতে পারল না, মনাদা ঠিক কী বলতে চাইছে। পূর্ণর মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু পূর্ণর মুখের দিকে তাকানো আর দেওয়ালের
দিকে তাকানো একই ব্যাপার। পূর্ণ মনাদার ছায়াসঙ্গী বডিগার্ড। তার ভাবলেশহীন মুখে কোনদিন হাসি দেখেনি পুলক। কোনদিন চমকাতে বা অবাক হতে দেখেনি। কোন অনুভুতিই নেই মনে হয়। পুলক জানে পূর্ণর কোমরে এখনও
অন্ততঃ দুটো লোডেড রিভলভার রাখা আছে। আর আছে ভীষণ শীতল ও আবেগহীন দক্ষতা।
‘তাহলে?
কী করতে হবে?’
‘দোকান
বন্ধ করে ফেরার সময়, জিতেনের মেয়েটাকে ল্যাংটো করে দিতে হবে সকলের সামনে।
শ্লীলতাহানি’। এক চোখ
টিপে ইশারা করল মনাদা, চমকে উঠল পুলক।
‘কে
করবে?’
‘তুই
করবি। আরো তিনজন ছেলে দেব তোর সঙ্গে’। মনাদার
কথায় নিশ্চিন্ত আশ্বাস, তবু যেন বিশ্বাস হল না পুলকের।
‘কি বলছ,
মনাদা। মিঠুনের মার্ডার নিয়েই বিশ বাঁও জলে
– তার ওপর এই কেস? পাবলিক পেলে আমাকে জ্যান্ত রাখবে?’
‘পাবলিক
পাবে কেন? কাজটা করেই তুই সরে পড়বি বাজারের পিছনের পুকুরের দিকে। ওদিকটা অন্ধকার
থাকে, ওখানে টাকা আর বাইক নিয়ে ওয়েট করবে পূর্ণ, তোকে বাইকে পৌঁছে দেবে বাইপাস
পর্যন্ত – বললাম না? পরশু সকালে তো তুই ধানবাদ থেকে পগার পার ইউপির দিকে!’
মনাদা
আবার একটা সিগারেট ধরাল, পুলককে কিছুক্ষণ ভাববার সময় দিল আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাপতে
লাগল পুলকের ভাবগতিক। একটু পরে আবার বলল, ‘তুই তো শালা, বিয়েথাও করিস নি, মেয়েদের
কাপড়চোপড় কোনদিন খুলেছিস?’ নিজের রসিকতায় মনাদা আবার খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে গিয়ে
গলায় সিগারেটের ধোঁয়া বাধিয়ে কাশতে শুরু করল। কাশির দমক একটু সামলে আবার একই ভাবে
হাসতে হাসতে বলল- ‘ও ব্যাপারটা ছেলেদের শেখাতে হয় না, কি বল পূর্ণ?’
২
মনাদা আর পূর্ণ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রাত বারোটা পঁচিশে। দরজা বন্ধ করে পুলক লাইট নিভিয়ে খাটে এসে বসল। ভাবতে লাগল মনাদার কথাগুলো।
পুলক
হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি। মনাদা যাবার সময় বলে গেল, ‘কাল রাত ঠিক আটটায় বেরিয়ে
যাবি, পিছনের আমগাছ ধরে পাঁচিল টপকে পুকুরের পাড় দিয়ে। মনোতোষ দত্তের বাড়ি থেকে
পুলক বের হচ্ছে, এটা পাবলিক দেখে ফেললে কি হবে সেট বুঝতেই পারছিস?’
পুলক খুব
ভালো করেই জানে, তার রাজি হওয়া বা না হওয়াতে মনাদার কিচ্ছু যাবে আসবে না। পুলক না
করলে অন্য কেউ করে দেবে। আর পুলককে ঘাড় থেকে নামাতে মনাদার এক মিনিটও সময় লাগবে
না। এই যে মনাদা, সাংঘাতিক রিস্ক নিয়েও তাকে পাঁচদিন ধরে নিজের বাড়িতে রাজার হালে
পুষছে – সেটা পুলককে ভরসা করে বলেই তো? পুলককে দিয়ে কাজ হয় বলেই তো?
কিন্তু
এই কাজটা পুলকের মাথায় ঠিক সেট হচ্ছে না। সব কিছুরই একটা সেটিং থাকে, না? মার্ডার
ব্যাপারটা পুলকের মাথায় বেশ সেট হয়ে গেছে। মিঠুনের আগে আরো তিনজন তার হাতে মার্ডার
হয়েছে। নেপাল, মহাদেব আর বীরেন্দর।
এরা তিনজন তাদের দলেরই লোক – কিন্তু মনাদার অ্যান্টি। ওদের তখনই খালাস না
করলে মনাদার সঙ্গে সঙ্গে পুলকদেরও খালাস হয়ে যাবার খুব চান্স ছিল। মার্ডার হওয়ার
পর বিরোধী দলের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে মনাদা এমন হুজ্জোত শুরু করেছিল, যে তার দিকে কেউ
লক্ষ্যই করেনি। মিটিং, মিছিল, পথ অবরোধ। তারপর তিনজনকেই শহীদ ঘোষণা করে, পাড়ায়
গলির মুখে শহীদ বেদী বানিয়ে মনাদা পুরো ব্যাপারটা নিখুঁত সামলে দিয়েছিল। এখন সেই
শহীদ বেদীগুলোতে পাড়ার কুত্তারা হিসি করে, তাদের এলাকা ঠিক রাখে।
মিঠুনের কেসটা
একটু আলাদা। ছেলেটা পরোপকারি, সমাজসেবী টাইপের। কোন দলটল করত না, কিন্তু বেশ
পপুলার ছিল পাড়ায়। পাড়ার লোকেদের সঙ্গে থাকত, অন্যায়টন্যায় দেখলেই খেপচু হয়ে পেছনে
লেগে পড়ত। মনাদা একটা পুকুর বুজিয়ে ফ্ল্যাট বানানোর মাখন স্কিম বানিয়েছে – সেটা
নিয়ে কাটি করতে বসল মিঠুন! মনাদার দোষ নেই, মনাদা অনেক চেষ্টা করেছিল - ভালো কথায়
বুঝিয়ে, টাকার টোপ ফেলে, ভয় দেখিয়ে। কিছুতেই মালটা লাইনে এল না, শেষ অব্দি টপকে
দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় রাখেনি মিঠুন। তার হাতে মার্ডার হয়ে গেল – আর সেখানেই
ফেঁসে গেল পুলক – নিখুঁত কাজের মধ্যেও একটা ফাঁক রয়ে গেল - জিতেন সাঁতরা। ভোর
পাঁচটায় মর্নিং ওয়াক করতে বের হওয়া মিঠুনকে খালাস করার সময় দেখে ফেলেছিল জিতেন।
ব্যাটার হাঁপানির টান, বারান্দায় দাঁড়িয়ে, হাপরের মতো ফুসফুসে ভোরের বাতাস টানছিল,
ওই দৃশ্য দেখে টেনশানে তার এমন টান উঠল, রাস্তা থেকেও তার শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ
শুনতে পেয়েছিল পুলক। দেখতে পেয়েছিল, জিতেন সাঁতরার ঠেলে বেরিয়ে আসা, আতঙ্কিত চোখ
দুটো।
সেই
জিতেনের মেয়ের কাল শ্লীলতাহানি করতে হবে, রাত সাড়ে আটটায় ভরা বাজারের মধ্যে! মনাদা
এটাকে বলল শকথেরাপি, সন্ত্রাসের শক। আতঙ্কথেরাপি! এই ট্রিটমেন্টেই জিতেনের সব তেল
বেরিয়ে যাবে? সত্যি কথা বলার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বার তেল; বিচারের একমাত্র সাক্ষী
হবার তেল?
৩
আটটা কুড়ির মধ্যে পুলক পৌঁছে গেল। জিতেনের বীণাপাণি বস্ত্র বিপণির উল্টোদিকে মনসা দশকর্মা ভাণ্ডার। তার পাশের গলিতে ঝুপসি অন্ধকারে মিশে সে দাঁড়িয়ে রইল। এই গলি দিয়েই তাকে সরে পড়তে হবে – খুব নোংরা আর সরু গলি, দু পাশে কোন বসতি নেই – বাজারের দোকানদারদের অনেকগুলো গুদাম আছে পর পর। এই গলির শেষেই পুকুর, তার ধার দিয়ে চলে যাওয়া যায় পাশের গলিতে। দোকানের ভিতরে সীমাকে এখান থেকে দেখতে পাচ্ছিল পুলক। একজন কর্মচারিও রয়েছে। দোকান বন্ধ করার আগে, সব কিছু দেখে নিচ্ছে। দোকানের পাশে একটা চায়ের দোকান – সেখানে চা খাচ্ছে পরেশ। পরেশ মনাদার লোক। আরো দুজন কে আছে? চেনা আর কাউকে চোখে পড়ল না পুলকের।
দোকানের
লাইট, বাইরের সাইনবোর্ডের লাইট নিভিয়ে দিয়ে সীমা আর কর্মচারি লোকটা বেরিয়ে এল
বাইরে। সীমার হাতে তালা। কাঁচের পাল্লা বন্ধ করে লোকটা তালা দিল দরজায়। এরপর রোলিং
শাটার - লোকটা ঘড় ঘড় শব্দে টানতে শুরু করল শাটারটা। চায়ের দোকান থেকে পরেশ এগিয়ে গেল
সীমার দিকে পুলকও বেরিয়ে এল গলি থেকে। পরেশ সীমাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল সোজা,
আচমকা ধাক্কায় হকচকিয়ে যাওয়া সীমাকে ধরে ফেলল পুলক। ডান হাতের ব্লেড চালিয়ে দিল
সীমার পিঠের ব্লাউজ আর ব্রেসিয়ারে। বাঁহাত দিয়ে সীমার বুকের কাছে খামচে ধরল শাড়ি
আর ব্লাউজ – হেঁচকা টানে উন্মুক্ত হয়ে গেল সীমা। জীবনে এই প্রথমবার পুলক স্পর্শ
করল কোন মেয়ের বুক এবং চাক্ষুষ করল তার নগ্নতা!
পুলক আর
দাঁড়াল না দৌড়তে লাগল নির্দিষ্ট গলির দিকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় আর লজ্জায় সীমা যখন বিমূঢ়, দুজন ছেলে সামনে এল, রাস্তায়
লুটিয়ে থাকা শাড়ির আঁচল তুলে সীমার শরীরে জড়িয়ে দিতে দিতে একজন বলল, ‘বাড়ি যান,
দিদিভাই। বাবাকে বলুন – উটকো ঝামেলায় না জড়াতে। আপনারা ভদ্রলোক – ছোটলোকদের এই সব ব্যাপারে
কেন জড়াচ্ছেন নিজেদের? কেন এসবের মধ্যে থাকেন’?
পথচারী
আর আশেপাশের দোকানের অজস্র লোক চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে উপভোগ করল এই ঘটনা।
৪
দেয়ালে লটকানো
এলইডি টিভিতে নিউজ দেখছিল মনাদা। পিছনের চেয়ারে বসেছিল পূর্ণ।
“ব্রেকিং
নিউজ...মিঠুন হত্যা তদন্তে নতুন মোড়। প্রকাশ্য রাস্তায় মিঠুনহত্যার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীর
একমাত্র মেয়ের শ্লীলতাহানি...ঘটনাস্থলের কিছুটা দূরে উদ্ধার মিঠুন হত্যার অন্যতম
অভিযুক্ত পুলক বিশ্বাসের গুলিবিদ্ধ লাশ। ঠিক কী ঘটেছে আমরা জেনে নেব ঘটনাস্থলে
উপস্থিত আমাদের প্রতিনিধি প্রদীপের কাছে, হ্যাঁ প্রদীপ – ঠিক কী ঘটেছে, আমাদেরকে
জানাও...
‘চামেলি,
একটু আগে এই সাড়ে আটটা - পৌনে নটা নাগাদ এখানে এক ভদ্রমহিলার শ্লীলতাহানির অভিযোগ
উঠেছে। সে সময় খুব স্বাভাবিকভাবেই এখানে অনেক লোকজন ছিল – এই সময়েই বাজারের সব
দোকানই বন্ধ হবার সময়। ভদ্রমহিলাও দোকান বন্ধ করছিলেন। উনি দাঁড়িয়েছিলেন দোকানের
সামনে, দোকানের দরজা বন্ধ করছিল ভদ্রমহিলার দোকানের এক কর্মচারী, বিপুলবাবু। সেই সময় তাঁকে পাশ থেকে কেউ একজন
ধাক্কা দেয়। ধাক্কার জোর এতটাই ছিল,
ভদ্রমহিলা প্রায় পড়ে যাবার মতো হয়েছিলেন, আর এই সামনের গলি থেকে দৌড়ে এসে
তাঁকে ধরে ফেলেছিল পুলক। এই পুলক তুমি জানো, চামেলী, মিঠুনহত্যার অন্যতম অভিযুক্ত।
তাকে গত ছদিন ধরে প্রশাসন খুঁজে বেড়াচ্ছে কিন্তু ধরা পড়েনি। সেই পুলক আজ এইখানে কিভাবে
এসে উপস্থিত হল – সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষের মনে...তার মানে সে কী
আদৌ এলাকার বাইরে যায়নি? এখানেই কোথাও গা ঢাকা দিয়ে ছিল? রাজনৈতিক আর ওয়াকিবহাল
মহল থেকে এমন প্রশ্নও উঠে আসছে বার বার...
‘প্রদীপ,
শ্লীলতাহানির ঘটনাটা ঠিক কী হয়েছে আমাদেরকে জানাও’।
‘হ্যাঁ
চামেলী, ধাক্কা লেগে ভদ্রমহিলা পড়ে যাওয়ার মতো হওয়াতে পুলক এসে তাকে ধরে ফেলেছিল
আর খুব দক্ষ হাতে খুলে দিয়েছিল ভদ্রমহিলার শাড়ি, ছিঁড়ে ফেলেছিল ব্লাউজ ও অন্তর্বাস’
‘ভদ্রমহিলার
মানসিক অবস্থা এখন কেমন, কী বলছেন উনি এই ঘটনার পর...?’
‘মানসিক
দিক থেকে ভদ্রমহিলা একেবারেই ভেঙে পড়েছেন – এই মূহুর্তে উনি ঘটনাস্থলে নেই – বাড়ি
চলে গেছেন – কারোর সঙ্গে দেখাও করছেন না...’
‘ওদিকে
পুলক বিশ্বাসকে কে বা কারা মারল, সে সম্বন্ধে কী জানা যাচ্ছে, প্রদীপ?’
‘কিছুই
জানা যাচ্ছে না, চামেলী। পুলিশের সন্দেহ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই পুলকের মৃত্যু
হয়েছে। পুলক বিশ্বাসের লাশ ময়না তদন্তের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তদন্তকারী
পুলিশের মতে পুলকের মাথায় গুলির চিহ্ন ছিল এবং ওই গুলিতেই তার মৃত্যু হয়েছে...’।
‘প্রদীপ,
আমরা তোমার কাছে আবার ফিরে আসবো আরো খবর জানার জন্যে। এর মধ্যে আমরা কথা বলে নেব
এলাকার নেতা মনোতোষবাবুর সঙ্গে’...
টেবিলে রাখা ফোনটা এই সময় বেজে উঠল, মনাদা বুঝতে পারল এটা চামেলীর ফোন, টিভিতে চামেলী তখন বলছে – ‘আমরা এই এলাকার জনপ্রিয় নেতা ও পার্টির জোনাল কমিটির সেক্রেটারি মনোতোষ দত্তের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি...হ্যালো, মনোতোষ বাবু, আজকে এই মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?’
‘আমি
আপনাদের চ্যানেলেই এই মাত্র এই ঘটনাটা দেখলাম। এরকম ঘৃণ্য এবং ন্যক্কারজনক ঘটনা এ শহরের
ইতিহাসে আগে কোনদিন ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। আমি তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছি। এই চরম
অরাজকতা ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে আমি তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করছি। জনগণের কাছে আমার
অনুরোধ, তাঁরা যেন ভুল পথে পরিচালিত হয়ে, কোন প্ররোচনায় কান না দেন। আর প্রশাসনের
কাছে আবেদন রাখছি এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হোক, দলমত নির্বিশেষে সকলের সহযোগিতা
আমি প্রার্থনা করছি। প্রকৃত দোষী যেন অবিলম্বে চরম শাস্তি পায়’।
‘ধন্যবাদ,
মনোতোষবাবু...’।
‘নমস্কার’।
ফোনটা কেটে দিল মনাদা। মিউট করে
দিল টিভিটাও। টিভিতে একই খবর আবার দেখাতে লাগল দেখে, মনাদা পূর্ণকে চাপা গলায়
জিগ্যেস করল –
‘গুলিটা
ঠিক জায়গায় লেগেছিল, তুই শিয়োর তো, পূর্ণ’?
‘একদম।
রগের নীচে, বাঁচার কোন চান্স রাখিনি’।
[এই
গল্পটি আদ্যন্ত একটি রূপকথা, বাস্তবে কোন ঘটনার সঙ্গে এবং কোন চরিত্রের সঙ্গে কোন
ভাবেই কোন মিল থাকতে পারে না, কারণ আমরা ভারতীয়-বাঙালী; চির শান্তি আর মৈত্রীর
ধ্বজাধারী, কৃষ্টি ও কলার পূজারী]
-০-
-০-
দারুন | আমাদের রাজ্যে এরকম ঘটনা কল্পনাই করা যায় না....!!
উত্তরমুছুনসত্যিই তো!
উত্তরমুছুন