Powered By Blogger

শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

এখনও মারীচ

 

গেটের বাইরে থেকে একটি মেয়ে খুব কুণ্ঠিত স্বরে ডাকল, “স্যার, আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল, ভেতরে আসতে পারি?”  

মর্নিং ওয়াক সেরে বাড়ির ছোট্ট বাগানে একটু ঘোরাঘুরি করা ডাক্তার অমিয় সান্যালের বহুদিনের অভ্যেস। এ সময় তাঁর ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বন্ধুরাও তাঁকে বিরক্ত করে না। সকালের এই স্নিগ্ধ আলোয় তাঁর বাগানে ফুটে থাকা উজ্জ্বল ফুলগুলির সঙ্গ তাঁর মনে অত্যন্ত শান্তির অনুভূতি এনে দেয়। কোন উটকো লোকের উপস্থিতি সেই শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাক – সেটা তিনি পছন্দ করেন না। বিরক্ত হন খুব।

ডাক্তারবাবু বিরক্ত হয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন গেটের দিকে, বিরক্ত মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ব্যাপার?”

“কিছু কথা ছিল স্যার, যদি একটু সময় দেন কাইণ্ডলি। বেশি সময় নেব না, – দশ-পনের মিনিট”।

ওঁদের কথাবার্তা শুনতে পেয়ে হেমন্ত বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। হেমন্ত ডাক্তারবাবুর পরিচারক - সর্বক্ষণের সঙ্গী। সাধক সঙ্গীতজ্ঞদের যেমন দু একজন অপরিহার্য সঙ্গতদার থাকে – হেমন্তও তাই। বারান্দায় উঠে বেতের  চেয়ারে বসতে বসতে ডাক্তারবাবু হেমন্তকে বললেন, “ভেতরে আসতে বল”। হেমন্ত মেয়েটিকে ডেকে ভেতরে চলে গেল নিজের কাজে।  

 শান্ত ও ধীর পায়ে মেয়েটি এল। হাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গী করল। ডাক্তারবাবু মুখ তুলে তাকালেন – সামনের চেয়ারে বসতে ইশারা করলেন। মেয়েটি বসল। মেয়েটির পরনে সস্তা চটকদার রঙের শাড়ি। পায়ে গোলাপি রঙের বাহারি প্লাস্টিকের স্যণ্ডেল। শাড়ির আঁচলে পুরো শরীর ঢেকে মেয়েটি চেয়ারে বসেছে আলগোছে - খুব সংকোচ নিয়ে। তবুও উগ্র এবং উচ্ছৃঙ্খল জীবনের আভাস পেলেন মেয়েটির শরীরী ভাষায়। ডাক্তারবাবু বললেন, “কী বলবেন বলুন”

“আমি মিতালি। কলকাতার একটি পতিতা পল্লীতে আমার বাস। আমাদের মতো মেয়েদের আপনার কাছে আসার দুঃসাহস কখনো হয়নি, হবেও না। কিন্তু বাধ্য হয়েই...”

ডাক্তারবাবু কোন উত্তর দিলেন না, তাকিয়ে রইলেন মিতালির মুখের দিকে।

মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ বসে রইল মিতালি, তারপর বলল, “তিন চারজন এনজিও দিদি আসেন আমাদের পাড়ায়, নিয়মিত। আমাদের বিপদে-আপদে সাহায্য করেন খুব। তাঁদের মুখেই আপনার নাম শুনেছি”। মিতালি আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর মুখ তুলে বলল, “আপনি নাকি বেশ কয়েক বছর ধরে মেয়েদের শরীরে অদ্ভূত এক পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন! তাতে নাকি...”  

                

ডাক্তার অমিয় হাত তুলে মিতালিকে থামালেন, বললেন, “তোমাদের পেশার কোন মেয়ের সঙ্গে আমার কোনদিন সেভাবে পরিচয় হয়নি, মা। কিংবা হয়তো কখনো হয়েছে, পেশেন্ট হিসেবে, বুঝতে পারিনি। নিজের সত্যি পরিচয় দিয়ে তুমি যে কথা জানতে এসেছ, সে কথা তোমাদের জানা একান্ত জরুরি। কাজেই সব কথাই তোমাকে বলব, মন দিয়ে শোনো।       

বিগত বছর তিরিশ বা হয়তো তারও কিছু বছর আগে থেকে – জাতিকাদের শরীরে আশ্চর্য এক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই পরিবর্তনটি প্রথম ধরা পড়ে মুর্শিদাবাদ সদর হাসপাতালে। সেখানে একটি ছবছরের বালিকাকে রাতের অন্ধকারে কেউ বা কারা ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল। পরদিন সকালে সেই বালিকার দেহ উদ্ধার হলেও অপরাধীদের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। পুলিশ জোর তদন্ত শুরু করেছিল এবং স্থানীয় নেতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, অপরাধী অচিরেই ধরা পড়বে, আইন আইনের পথেই চলবে। আইনের হাত থেকে কেউ রক্ষা পাবে না।  

এদিকে ওই দিন দুপুরের দিকে হাসপাতালে জনৈক মধ্যবয়সী পুরুষকে তার বাড়ির লোক গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে নিয়ে আসে। আচ্ছন্ন অবস্থায় আনা ভদ্রলোকের অসুস্থতার প্রধান লক্ষণ ছিল তীব্র শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ এবং অনিয়মিত হার্টবিট। অ্যাডমিশনের সঙ্গে সঙ্গেই অক্সিজেন এবং স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ব্লাড টেস্টের ব্যবস্থা হল, ইসিজির ব্যবস্থাও করা হল। তারপর থরো চেকআপ করতে গিয়ে আমরা লক্ষ্য করলাম ভদ্রলোকের দু হাতে এবং কোমর থেকে নিম্নাঙ্গে – দুই পায়ে, উরুতে এবং বিশেষ করে দুদিকেরই ইনগুইনাল রিজিয়নে সিভিয়ার ইনফ্লামেশন রয়েছে। ইনগুইনাল রিজিয়ন হল বাংলায় যাকে আমরা উরুসন্ধি বা কুঁচকি বলি। আর ইনফ্লামেশন মানে প্রদাহ, তার মানে কী বলব - গভীর লাল রঙের দাগড়া-দাগড়া হয়ে সামান্য ফুলে উঠেছে জায়গাগুলো। আমাদের চামড়ায় পোকা-টোকার কামড়ে বা বিষাক্ত রস লেগে গেলে, যেমন হয় আর কি!

তখন আমার বয়েস বিয়াল্লিশ। ততদিনে আমার প্রায় সতের বছরের ওপর প্র্যাকটিসিং এক্সপিরিয়েন্স হয়ে গেছে – কিন্তু এরকম অ্যাকিউট ইনফ্লামেশন আগে কোনদিন দেখিনি। তারপরে আরো দেখলাম, লোকটির বুকে কাঁধে বেশ কিছু নখের আঁচড়ের ক্ষত – সেই ক্ষতগুলো ঘিরেও একই ধরনের ইনফ্লামেশন!

যাই হোক আমাদের মেডিক্যাল বিদ্যে-বুদ্ধি-অভিজ্ঞতা দিয়ে যথাসাধ্য চিকিৎসা শুরু করলাম – কিন্তু লোকটির কণ্ডিশন খারাপ হতে লাগল দ্রুত – রাত্রে যমে-মানুষে টানাটানি অবস্থা। শেষ অব্দি রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ লোকটি হার্ট ফেল করল – মারা গেল। পরিবারের লোকজনকে মৃত্যু সংবাদ দেওয়া মাত্র তারা উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, আমাদের গাফিলতিতে তাদের পরমপূজ্য পিতৃদেবের মৃত্যু হয়েছে। দুজন জুনিয়ার ডাক্তার এবং একজন নার্সকে মারধর করল। আমার ভাগ্য ভালো – কেউ গায়ে হাত তোলেনি। তবে অশ্রাব্য গালাগালিতে আমার চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে দিয়েছিল। ভাঙচুর করেছিল বেশ কিছু চেয়ার টেবিল – ছিঁড়েখুঁড়ে নষ্ট করে দিয়েছিল বেশ কিছু ফাইল। ওরা চলে যাওয়ার প্রায় আধঘন্টা পরে পুলিশ এসেছিল পরিস্থিতি সামাল দিতে।

পরের দিন সকালে দুটি দেহেরই পোস্টমর্টেম হল। আমাদের কাছে যা রিপোর্ট এল – ওই লোকটিই বালিকা অভয়াকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল। লোকটি ছিল মেয়েটির প্রতিবেশী – অতি পরিচিত জ্যেঠুমণি...। তবে আমাদের কাছে রিপোর্ট যাই আসুক – পরে সে রিপোর্ট বদলে দেওয়া হয়েছিল, কারণ ওই লোকটির রাজনৈতিক মহলে বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। এবং যেহেতু অসহায় অভয়া এবং তার ধর্ষক লোকটি দুজনেরই মৃত্যু হয়েছিল, অতএব এ নিয়ে আমরাও কোন উচ্চবাচ্য করে জলঘোলা করাটা সমীচীন মনে করিনি।

তবে আমাদের কাছে লোকটির ব্লাড স্যাম্পল ছিলছিল মেয়েটির রক্তের নমুনাও। মেয়েটির রক্তে অস্বাভাবিক কিছু না পাওয়া গেলেও, লোকটির রক্তে পাওয়া গেল যথেষ্ট পরিমাণের বিষ, এবং তীব্র মাত্রার সেই বিষের কারণেই যে তার মৃত্যু হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। গোটা বিষয়টিই তখন গোপন রাখা হয়েছিল। আমাদের মধ্যে যে কয়েকজন জানতাম, অবাক হয়েছিলাম - লোকটির শরীরে এত পরিমাণে বিষ এল কোথা থেকে? তার ভিসেরার পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কিন্তু কোন বিষের উল্লেখ ছিল না। তার মানে খাবার বা পানীয়ের সঙ্গে  নয়, এ বিষ তার শরীরে ঢুকেছে সরাসরি রক্তে। বিষধর সাপের ছোবল থেকে আমাদের শরীরে যেভাবে বিষ রক্তে মেশে – হয়তো সেইভাবে। কিন্তু লোকটির কাঁধে ও পিঠে কিছু নখের আঁচড় ছিল। কিন্তু লোকটির নিম্নাঙ্গে সে ধরনের কোন ক্ষত চিহ্ন ছিল না। অথচ লোকটির অ্যাকিউট ইনফ্লামেশন ছিল  দুই উরু এবং উরুসন্ধিতে। কেন? কী করে হল? ঠিক বোঝা গেল না। ব্লাড-স্যাম্পল থেকে যে বিষ পাওয়া গেল, তার অ্যানালিসিস করে দেখা গেল – এ ধরনের বিষ এর আগে কখনও দেখা যায়নি।

অতএব একটা প্রশ্ন রয়েই গেল, এই বিশেষ ধরনের বিষটি লোকটির শরীরে কোথা থেকে এল?  

আমরা অন্যান্য হাসপাতালের আরএমও এবং সুপারদেরকে এই বিষয়টি গোপনে কিন্তু সবিস্তারে জানালাম। প্রথমে কেউই বিশ্বাস করেননি, বরং আমাদের বিদ্রূপ করেছিল, বলেছিল আমাদের মাথা থেকে এসব উদ্ভট আইডিয়া মুছে ফেলতে।

এই ঘটনার কিছু দিন পরেই মেদিনীপুর হাসপাতাল থেকে বারো বছরের এক কিশোরী অভয়ার শ্লীলতাহানির সংবাদ এল। অপরাধী পুরুষটির বয়স ছিল বত্রিশ। মেয়েটিকে সে একটি নির্জন বাড়িতে নিয়ে যায় এবং জোর করে তাকে বিবস্ত্র করার পর, ঘটনাস্থলেই লোকটি অজ্ঞান হয়ে যায়। সুযোগ পেয়ে মেয়েটি সেখান থেকে বাড়িতে পালিয়ে আসে। মেয়েটিকে নিয়ে তার পরিবারের লোক প্রথমে থানায় যায় এবং পরে মেয়েটি হাসপাতালে ভর্তি হয়। মেয়েটির বয়ান অনুযায়ী পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে অপরাধীকে যখন গ্রেপ্তার করে, লোকটির তখনও জ্ঞান ফেরেনি। অতএব তাকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ই ক্ষেত্রেও অপরাধী যুবকটির হাতে, পায়ে, গালে, গলায় একই ধরনের ইনফ্লামেশন – লোকটির সেরে উঠতে সময় লেগেছিল প্রায় সাড়ে তিনমাস। বিচারে লোকটির পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল।

আমাদের দেশে ধর্ষণ এবং শ্লীলতাহানির ঘটনা যেহেতু সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে, অতএব এর পরেও বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে একই ধরনের ঘটনার প্রচুর সংবাদ আসতে লাগল। সৌভাগ্যক্রমে ভিকটিম কন্যাদের কেউই ধর্ষিত হয়নি – তার কারণ অপরাধীদের বিবেকবোধ নয়। তার কারণ অপরাধীরা তীব্র বিষক্রিয়ায় ঘায়েল হয়ে মেয়েগুলিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।

যাই হোক আমার এই কৌতূহল এবং সত্য সন্ধানের প্রচেষ্টা আমার ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষদের পছন্দ হয়নি। সে কারণে আমার ওপর বাড়তে থাকে প্রশাসনিক চাপ এবং কর্মস্থলে কিছু সহকর্মীদের চরম অসহযোগিতা। যারা প্রশাসনের খুব কাছের লোক এবং আমড়াগাছি করে নানান সুযোগ সুবিধা উপভোগ করে”।

“আশ্চর্য! আপনি তো কোন অন্যায় করেননি। একটা অদ্ভূত অসুখের রহস্য খুঁজে বের করতে চাইছিলেন। তাতে ওদের আপত্তি কিসের?”

“কোন অন্যায় না করাটাই যে আজকের যুগে সবচেয়ে বড়ো অন্যায়, জানো না? সে যাগ্‌গে, আমি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে এলাম – একটি প্রাইভেট হাসপাতালে যোগ দিলাম – তার সঙ্গে ব্যক্তিগত চেম্বারে প্র্যাকটিস শুরু করলাম। প্রাইভেট হাসপাতালে সাধারণতঃ ধর্ষণের কেস নিয়ে কেউ আসে না, কাজেই এই বিষয়টা নিয়ে আরো গবেষণা করার কোন উপায় আমার রইল না।  

কিন্তু কলকাতায় স্থিতু হওয়ার কয়েক মাস পরে – একদিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ আমার চেম্বারে এক দম্পতি এলেন। ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়েই আমি চমকে উঠলাম। লক্ষ্য করলাম তাঁর দু হাতের দিকেও এবং নিশ্চিত হলাম – আমার অনুমান সঠিক। ভদ্রলোক কি কোন মেয়ে বা মহিলার সঙ্গে জোরজবরদস্তি করতে গিয়েছিলেন?

কৌতূহল নিয়ে আমি আলাপ শুরু করলাম, চিকিৎসার ব্যাপারে নয়, ওঁর পারিবারিক অবস্থা জানার জন্য। ভদ্রলোক ও মহিলা দুজনেই ভালো চাকরি করেন। এক ছেলে ও এক মেয়ে নামী স্কুলে লেখাপড়া করে – অর্থাৎ উচ্চবিত্ত সুখী পরিবার।

ভদ্রলোকের চিকিৎসার প্রসঙ্গ আসতে, আমি বললাম, ওঁনার চিকিৎসা এই চেম্বারে হওয়া সম্ভব নয়। ওঁনাকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে। সকাল সাড়ে দশটা-এগারোটা নাগাদ আমি যে প্রাইভেট হাসপাতালে বসি – সেখানে নিয়ে আসবেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভর্তি করে নেব। তবে আমার কিছু প্রশ্ন আছে, কোনরকম সঙ্কোচ না করে, নির্দ্বিধায় বলতে হবে – আমরা ছাড়া অন্য কেউ সে কথা জানবে না বা শুনবে না, কথা দিচ্ছি।

ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ঠিক কখন থেকে এই উপসর্গ দেখা গিয়েছে? মহিলা বললেন, গতকাল মাঝরাতে।

আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, মাঝরাতে? তখন আপনার স্বামী কোথায় ছিলেন?

কেন? বাড়িতে। আমাদের বেড রুমে! ডিনারের পর – ছেলেমেয়েরা তাদের ঘরে শুয়ে পড়েছে কিনা দেখে, আমরা রোজ যেমন বেডরুমে যাই।

তারপর কী হয়েছিল?

মহিলা বেশ একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, তার মানে? আপনি এবার কিন্তু আমাদের প্রিভেসিতে ইন্টারফিয়ার করছেন?

আমি খুব শান্ত স্বরেই বললাম, একটি ম্যারেড কাপল্‌ রাত্রে তাদের বেডরুমে স্বাভাবিক অবস্থায় কী করে সে কথা আমি জানি, ম্যাডাম। কিন্তু তাও জানতে চাইছি, কারণ তাতে আপনার হাজব্যাণ্ডের অসুখটা বুঝতে এবং সারাতে আমার সুবিধা হবে।

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর, মহিলা বললেন, আমি কাল খুব টায়ার্ড ফিল করছিলাম, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে চাইছিলাম। ওকে আমি সেটা বললামও – জেনারালি খুব এমপ্যাথেটিক, কিন্তু সামহাউ কাল ও রেস্টলেস হয়ে উঠেছিল – আমি বারবার আপত্তি করা সত্ত্বেও জোর করছিল। তার কিছু পরেই যন্ত্রণায় ও কেমন যেন কুঁকড়ে গেল এবং ওর শরীরে ওই সিমটমগুলো ফুটে উঠতে লাগল। এরপর কাল সারারাত আমরা আর ঘুমোতে পারিনি...।   

আমি মহিলাকে থামিয়ে বললাম, আর আমার কিছু শোনার নেই ম্যাডাম। এধরনের কেস এর আগেও অনেকগুলো হ্যাণ্ডল করেছি। কিন্তু সেগুলোর ভিকটিম ছিল রেপিস্ট পুরুষরা। তাই আপনার হাজব্যাণ্ডের সিমটম দেখে আমি খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম। সুখী দাম্পত্যের মধ্যেও যে এমন ঘটতে পারে...। হাসপাতালে চলে আসুন – আর আমি এক্সপেক্ট করব, আপনিও আমাকে পূর্ণ কোঅপারেট করবেন, ম্যাডাম। যদি করেন, আমাদের চিকিৎসা শাস্ত্রে একটা নতুন অধ্যায় লেখা হতে পারে।

“মহিলা কোঅপারেট করেছিলেন”?

করেছিলেন বৈকি! তার পূর্ণ সহযোগিতা ছাড়া আমার পক্ষে এই রহস্যভেদ সম্ভবই হত না। ওদের পরিবার এখন আমাদের একান্ত আপনজন। সম্পর্কে অনেকদিনই আমি মেয়েটির কাকু হয়ে গেছি।  ভাইঝি, জামাই, নাতি-নাতনী নিয়ে আমার পরিবার এখন অনেকটাই বড়ো হয়ে গেছে”।

“কী জানতে পারলেন”?  

“আমরা প্রকৃতিকে যতই জয় করতে চাই না কেন – প্রকৃতি তার বিবর্তনের কাজ ঠিকই চালিয়ে যায় – ধীরে ধীরে। প্রথম থেকেই অপরাধীদের ইনফ্লেমড স্কিন-স্যাম্পলের মাইক্রোস্কোপিক টেস্ট করে দেখছিলাম – খুব সূক্ষ্ম - খালি চোখে দেখা যায় না – স্কিনের মধ্যে অজস্র রোঁয়া ফুটে আছে, যার বায়োলজিক্যাল টার্ম সেটা (seta), প্লুরালে সেটাই বা সেটি (setae)। ইন ফ্যাক্ট যেখানে যেখানে ওই সেটি ঢুকেছে – সেখানেই দেখা দিয়েছে ইনফ্লামেশন।  

শুঁয়োপোকার গায়ে প্রায়ই এধরনের সেটি থাকে। কেন থাকে? শুঁয়োপোকাদের অনেক শত্রু – তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে। এমনকি তুলনায় আমাদের মতো অনেক বড়ো চেহারার প্রাণীদের গায়েও সেই সেটি বিঁধলে আমাদের অস্বস্তি হয়, চুলকায় – লাল হয়ে ছোটখাটো ইনফ্লামেশন হয়, তাই না? শুঁয়োপোকার সেটি সূক্ষ্ম হলেও চোখে দেখা যায়। কিন্তু ওই স্কিন স্যাম্পলে পাওয়া সেটি তার থেকেও বহুগুণ বেশি সূক্ষ্ম এবং অনেক বেশি বিষাক্ত।

এই সেটি বা রোঁয়া এল কোথা থেকে – সেটা বুঝতে পারছিলাম না। এই মেয়েটি সাহায্য করাতে সব রহস্যের সমাধান হয়ে গেল।

কবে থেকে শুরু হয়েছে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় – তবে বেশ কিছু বছর ধরে – হয়তো তিরিশ বা তারও  বেশি বছর আগে থেকেই মেয়েদের শরীরে আশ্চর্য এই বিবর্তন শুরু হয়েছে। স্বাভাবিক রোমের পাশাপাশি, মেয়েদের শরীরে জন্ম থেকেই প্রায় অদৃশ্য এই সেটির সৃষ্টি হচ্ছে। ওই মেয়েটিকে পরীক্ষা করেই বুঝতে পারি – আপত্তি সত্ত্বেও ওর হাজব্যাণ্ড যখন মেয়েটিকে আদর করতে শুরু করে – যেখানে যেখানে স্পর্শ করেছে – গালে, গলায় বা ঘাড়ে চুমো দিয়েছে, পেটে পিঠে হাত বুলিয়েছে – ওই অঞ্চলের সেটি বিষ নিয়ে ঢুকেছে স্বামীর ঠোঁটে, গালে, দুই হাতে...। মেয়েটির শরীরে ওই জায়গাগুলি ছাড়া সর্বত্র ওই সেটি অক্ষত ছিল, যেখানে যেখানে স্বামী স্পর্শ করেছে - ছিল না শুধু সেই জায়গাগুলিতে। মনে হয়েছিল, ওই জায়গাগুলো তো তার মানে রোঁয়াবিহীন হয়ে গেল। ওগুলো আবার কি গ্রো করবে, নাকি ন্যাড়া হয়েই থেকে যাবে আজীবন? হ্যাঁ গ্রো করেছিল।  দিন পনের পর মেয়েটিকে আবার যখন পরীক্ষা করি – দেখলাম কোন জায়গাই আর শূণ্য নেই – ভরে উঠেছে নতুন সেটিতে।

“কিন্তু এরকম ঘটতে থাকলে পরিস্থিতি তো ভয়ংকর হয়ে উঠবে। মানুষ প্রেম করতে কিংবা ভালোবাসতে ভয় পাবে! সন্তান-সন্ততি না আসলে – রুদ্ধ হয়ে যাবে মানবজাতির প্রবাহ”!

“একদমই না। নিশ্চিন্ত থাকতে পারো - সে রকম হওয়ার কোন কারণই নেই। ব্যাপারটা ঠিক কী ভাবে ঘটছে তোমাকে বলি। আমরা অনেকদিন ধরেই ব্যাড টাচ এবং গুড টাচ কি, জানি। ছোটদের স্কুলে অনেকদিন ধরেই তো এ নিয়ে সচেতন করা শুরু হয়েছে। এখানেও প্রাইম ফ্যাক্টর হচ্ছে ওই ব্যাড টাচ আর গুড টাচ। ছেলে মাকে, বাবা মেয়েকে কিংবা ভাই বোনকে, এমনকি সাধারণ ছেলেবন্ধুরাও কোন মেয়েবন্ধুকে স্বাভাবিক স্পর্শ করলে এই সেটি রিঅ্যাক্ট করে না। অর্থাৎ যাদের স্পর্শে মেয়েটির অস্বস্তি হয় না,  সেক্ষেত্রে এই সেটি নিষ্ক্রিয় থাকে। কিন্তু যখনই শরীরে অস্বস্তিকর এবং অবাঞ্ছিত স্পর্শ লাগে, তখনই মেয়েটির শরীর অ্যালার্ট হতে থাকে এবং এই রোঁয়াগুলি অ্যাক্টিভ হতে থাকে। এবার যদি সেই ব্যক্তি ধর্ষক হয় – তার স্পর্শে মেয়েটির মনে যখন হিংস্র ঘৃণা ও ভয়ের সৃষ্টি হয় – এই রোঁয়াগুলিও তখন তীব্র বিষ প্রয়োগের জন্যে প্রস্তুত হয়ে ওঠে। বিষের প্রাথমিক সঞ্চারেও যদি নরাধম পুরুষটি ক্ষান্ত না হয়, যদি সে মেয়েটির কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে গায়ের জোরে উপগত হওয়ার চেষ্টা করে – বিষক্রিয়ায় সেই নরাধম জ্ঞান হারাবে এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে তার মৃত্যু অবধারিত। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও মহিলা নির্বিশেষে উরু, উরুসন্ধি এবং উপস্থের চারপাশে রোমের যেমন আধিক্য থাকে, তেমনই আধিক্য থাকে সেটিরও – সেই তীব্র বিষক্রিয়ার চিকিৎসা আমরা করতে পারিনি। তবে শিশু কিংবা বালিকারা এই ধরনের নরাধমের শিকার হলে, খুব স্বাভাবিক কারণেই বিষের তীব্রতা কম হয় – কারণ তাদের শরীরে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো রোমের উন্মেষ তো আর হয় না। তবে আমার বিশ্বাস, যে হারে বালিকা নির্যাতন হচ্ছে, তাদের রক্ষার্থে, কোনদিন প্রকৃতি হয়তো তাদের শরীরও ওই সূক্ষ্ম রোমে ঢেকে দেবে।

“আপনি বললেন, তীব্র বিষক্রিয়ার চিকিৎসা আপনারা করতে পারেননি। কেন, সেটা কি ইচ্ছাকৃত”?

“হতে পারে। এর বিরুদ্ধে কিছু একটা করতেই হবে – এমন উৎসাহ হয়তো আমাদের মনে জাগছে না। অন্ততঃ আমার মনে তো নয়ই। তার কারণ, প্রথমত, পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে আদালতের বিচার যে ভাবে বারবার প্রহসনে পরিণত হয় সে তো আমরা দেখেছি। সেক্ষেত্রে প্রকৃতির বিচারকে মেনে নিলে ক্ষতি কী? প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষের মৃত্যু হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ভূমিকম্প, ঝড়, সুনামিতে তো এক সঙ্গে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। সে মৃত্যুর বিচার নিয়ে আমরা তো কখনো ভাবিত হই না? তাহলে মেয়েদের ওপরে ঘটে চলা কদর্য অপরাধের প্রতিকারের জন্য, সহজাত বিচারের ব্যবস্থা দিয়েই প্রকৃতি যদি মেয়েদের সৃষ্টি করে, সে বিচারকে বাধা দেব কেন?    

এবং দ্বিতীয়ত, এই নিয়ে কোন গবেষণাই এখনো শুরু হয়নি। বিশেষ কোন হরমোনের কারণে মেয়েদের শরীরে এই সূক্ষ্ম রোঁয়াগুলি আসছে। কী ভাবে ওই বিষ তাদের শরীরে তৈরি হচ্ছে, এবং কী ভাবেই বা সেই বিষ সঠিক মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে প্রতিটি রোমে রোমে – সে তথ্য আমাদের কাছে তো নেই। সাধারণ বিষক্রিয়ায় আমরা শরীরের ইমিউনিটি বাড়ানোর চিকিৎসা করি, তীব্র বিষের ক্ষেত্রে অ্যান্টিভেনাম অ্যাপ্লাই করি। স্বল্প বিষের নিরাময় এখনও সম্ভব হচ্ছে, কিন্তু বিষের মাত্রা বাড়লে তার প্রতিষেধক দরকার। তার জন্যে প্রয়োজন দীর্ঘ গবেষণার সুযোগ। সে সুযোগ আর দিচ্ছে কে?

তবে আমি মনে করি, প্রতিষেধক যতদিন না বেরোয় ততদিন মেয়েদের পক্ষেই মঙ্গল – চরম বিপর্যয় থেকে বহু মেয়েই পরিত্রাণ পেয়ে যাচ্ছে। এরকম ক্ষেত্রে আগে কী হতো? তদন্ত করা। প্রমাণ যোগাড় করা। সাক্ষী যোগাড় করা। মাসের পর মাস ধরে অভিযুক্তদের বয়ান - সাক্ষীদের বয়ান। সামনাসামনি বসিয়ে একসঙ্গে বয়ান। তদন্তকারীদের গোপন রিপোর্ট পড়ে বিচারপতিদের চমকে চমকে ওঠা। এত সবের পরেও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে জামিন বা বেকসুর খালাস পেয়ে যাওয়া...। ফালতু এত সাতকাহনের দরকারই নেই... যেমন কর্ম তেমন ফল, একেবারে হাতেহাতে সাজা পেয়ে যাচ্ছে কালপ্রিটগুলো। বাড়াবাড়ি করলে হাতে পেয়ে যাচ্ছে যমের বাড়ির কনফার্মড টিকিটও!

এই মৃত্যু নিয়ে কোন বিতর্কও উঠবে না। কেউ বলবে না – প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে ফাঁসানো হয়েছে। কেউ বলবে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রেপ আটকানো যায়নি - যাবে না। এই সমস্যার সমাধান মৃত্যুদণ্ড হতে পারে না। সমস্যার সমাধানটা কি জিজ্ঞাসা করলে বলবে – সর্বস্তরে শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। এদিকে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাকেই লাটে তুলে দেওয়ার ব্যাপারে সকল রকমের প্রচেষ্টা চলছে, অত্যন্ত আন্তরিকভাবে”।   

“কিন্তু বিষয়টা গণ-মাধ্যমে প্রচার করে সকলকে সচেতন করা হচ্ছে না কেন? তাতে তো ছেলেরা ভয় পাবে, এরকম অপরাধ থেকে বিরত থাকবে। মেয়েরাও নিশ্চিন্ত হতে পারবে”।

“তাই হয় নাকি? যারা দেশ চালায়, তারা সব কথা সবার কাছে বলবে কেন? দুরন্ত, দামাল সব মানুষগুলো, গণতন্ত্রের চেয়ারগুলোকে অক্টোপাসের মতো ধরে রাখার জন্যে, কত কত ভালো ভালো কাজ করছে নিত্যদিন, তারা দু-একদিন যদি কোন দুষ্টুমি করেই ফেলে – সেটাকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখাই গণতান্ত্রিক দেশের নেতাদের কর্তব্য বৈকি। তাদের ভয় দেখিয়ে মেয়েদের নিশ্চিন্ত করবে, কোন আহাম্মক? কিন্তু তোমাদের এ বিষয়ে কৌতূহল কেন?”

“আমরা যে সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি, স্যার”।

“ক্ষতি? কিসের ক্ষতি?”

“আমাদের পেশায় পুরুষ নিয়ে কোন বাছবিচার তো করা চলে না, স্যার। সেখানে গুডটাচ-ব্যাডটাচ - যেমন আপনি বললেন, সেই বিলাসিতাও আমাদের করা চলে না। অতএব আমাদের ইচ্ছায় – অনিচ্ছায় পুরুষের হাতে শরীর মেলে ধরতেই হয়। কিন্তু মন তো নির্বিকার থাকে না, থাকতে পারে না, স্যার – তাতে পুরুষরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। যারা নিয়মিত আসত, তারা প্রথম প্রথম দু-চারবার বুঝতে পারেনি, কিন্তু পরে তারাও বুঝতে পারছে। তারা আমাদের পাড়ায় আসা বন্ধ করে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা খাব কি”?

ডাক্তারবাবু অনেকক্ষণ কোন কথা বললেন না, তাকিয়ে রইলেন তাঁর বাগানের দিকে। প্রকৃতির নিয়মে বাঁধা প্রতিটি জীবন – গাছপালা, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি...। সভ্য মানুষ, সভ্যতার শুরু থেকেই প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে প্রতিদিন। এই সভ্যতাই একদিকে সৃষ্টি করেছে ধর্ষণ, অন্য দিকে এই মেয়েটির পেশা।

কিছুক্ষণ পর তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমাকে এই কাজ ছেড়ে অন্য কোন কাজ করার উপদেশ দেওয়া অর্থহীন। কারণ সভ্য সমাজ তোমাকে কখনোই স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করার অনুমতি দেবে না। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজই করতে হবে। তোমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে যাও, মা। দেখি কোন ওষুধ খুঁজে পাই কি না – যে ওষুধে কিছুক্ষণের জন্যে অসাড় হয়ে থাকবে তোমার মন। সে ওষুধ কতখানি ক্ষতি করবে তোমার শরীরের – সেটাও বুঝতে হবে। শরীরের সাংঘাতিক ক্ষতি স্বীকার করেও বহু কর্মীকে যেমন কাজ করে যেতে হয়, হয়তো তোমাকেও...”।

কথা শেষ করলেন না ডাক্তারবাবু মাথা নাড়তে লাগলেন আপন মনে। একটু পরে আবার বললেন, “আমরাই নির্বাচিত করি যে জনপ্রতিনিধিদের তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। সেই প্রতিনিধিদের নির্বাচন করা ব্যর্থ বিচার-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলা যাবে না। বললেই ভয়ানক ক্ষতি। তার থেকে প্রকৃতির বিরুদ্ধেই যাওয়াই সমীচীন, সে ক্ষতিটা, যদিও অমোঘ, আসে ধীরে ধীরে। তবে ক্ষতি দুদিকেই – রাম মারুক কিংবা রাবণ – আমরা যে মারীচ”।

 

-০-

          

                 

সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৫

চোত-বোশেখের পালা

 

চৈত্রসংক্রান্তি, ১৩৪৬ বঙ্গাব্দ

    আমাদের ছোটবেলাকার কালের সে সব দিন অন্যরকম ছিল। আমরা কাছাকাছি জেলার গেরাম গঞ্জ থেকে কলকেতায় আসিতাম রুজি রোজগারের আশায় কিংবা আমাদের ছেলে পিলেরা আসিত ভালো নেকাপড়া শিকিয়া দেশের দশের উবগার করার আশায়। মৌমাচির চাকের মতো আমরা বাসা বাঁধিতাম কলকেতার মেসবাড়িগুনোতে। সে সব মেসবাড়িতে দিনরাত ভনভন ভ্যানভ্যান লাগিয়াই থাকিত। আমাদের সংগে কলকেতার তকনো এত মাকামাকি হয়ে ওটেনি, আমারা হপ্তা-পনেরদিন কলকেতায় থাকিতাম ঠিকই, কিন্তু ছুটিছাটা পাইলেই ন্যাজ তুলিয়া গেরামের বাড়িতে পলাইতাম। কলকেতাকে আমরা তকনো পরবাস ভাবিতাম, গেরামের বাড়িতে ফিরিয়া ডাঙ্গার মাচ জলে পড়িয়া যেন পরাণ ফিরিয়া পাইতাম।

    চোত মাসের প্রায় পুরোটাই - বাসন্তীপুজো, রামনবমী, চড়কের মেলা সব মিলিয়ে গেরামে টানা মোচ্ছব চলিত  এই মাসে বাড়িতে কুটুম্বদের আসা-যাওয়া চলিতেই থাকিত। ঘরে ঘরে খাওয়া দাওয়া, বাহিরে ড্যাং ড্যাংআ, ড্যাং ড্যাং ঢাকের বাদ্যি; গেরামের ছেলেপিলের দল আমরা খুব মজিয়া থাকিতাম।  

    বেলা একটু বাড়িলেই, মাঠের দিকে চাহিয়া দেকিতাম চোতের রোদ্দুরে দূরের ঝোপঝাড়, গাছপালা ঝিলিমিলি করিতএলোমেলো শুকনো হাওয়া বহিত শনশন। শীতের ঝরাপাতা, সেই হাওয়ার হাত ধরিয়া ঝরঝর শব্দে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ঘূর্ণী নেত্য করিতআর জলখাবারের বেলা পার হইলেই আমরা সেই ডাক শুনিতাম “বাবা তারকনাতের চরণের সেবা লাগি, বাবা মহাদেএএএব” মাঠের ওধার থেকে ডাক দিয়ে দিয়ে একমাসের ব্রত লইয়া সেই সন্নিসির দল গেরস্তর বাড়ির দুয়োরে দুয়োরে ভিখ মাগিয়া বেড়াইত। আমাদের দোরের সামনে আসার আগেই ঠাকমা বলিতেন “অ বউমা, ওই সন্নিসির দল আসছে, সিধে ঠিক করো, বাছা” সিধে মানে সিদ্ধ করিয়া খাইবার যোগাড়। তাহার মধ্যে থাকিত, আতপ চাল, একটু মুগ, ছোলা কিংবা মটর ডাল, আর টুকটাক কিছু সবজি - আলু, বেগুন, কাঁচকলা কিংবা কুমড়োর ফালি। ছোট বেতের বোনা ধামায় মা সিধে সাজাইয়া তুলিতেনছোট্ট একটি মাটির কটোরায় একটু সরষের তেল, অন্য আরেকটি ভাঁড়ে নুন, কাঁচালংকা। আমাদের দুয়োরের সামনে সেই সন্নিসিদের দল এসে দাঁড়াইত আর বলিত “জয় বাবা তারকনাতের জয়” ঠাকুমা কিংবা মা তাদের ঝোলায় সেই সিধে ঢালিয়া দিত সিধে নেওয়ার পর সন্নিসিরা বলিয়া উঠিত “জয় বাবা মহাদেবের জয়”

    এই ধরনের ব্রত রাখা সন্নিসিরা ছিল একাহারী, দিনের বেলায় একবার মাত্র দুপুরের ভোজন, সূর্যাস্তের পর খাওয়া নিষিদ্ধ। সন্নিসিদের আরো নিয়ম ছিল, তাদের দলের সকলের একবেলার মতো খাবার যোগাড় হইলেই ভিক্ষার সমাপ্তি একেই মাধুকরী বলা হইত। পরের দিনের জন্য খাবার জমাইয়া রাখিলে ব্রতর বিধি ভাঙ্গিয়া যাইত, আর বাড়তি চাল ডাল সবজি বিক্রি করিবার কোন প্রশ্নই ছিল না, সে ছিল মহাপাপ। পর্যাপ্ত সিধে যোগাড় হইয়া গেলে, তারা মাঠের ধারের পায়ে চলা পথ ধরিয়া চলিয়া যাইত চড়ক মেলার মাঠে। খোলা মাঠের মধ্যে কাঠকুটা যোগাড় করিয়া, ইঁট কিংবা পাথরের টুকরোর ওপর মাটির বড়ো মালসার মধ্যে রান্না করিত ফ্যানভাত, সবজিসেদ্ধ, ডালসেদ্ধ। রান্না সারিয়া, পুকুর হইতে ডুবকি স্নান সারিয়া, তাহারা সবাই গোল হইয়া বসিয়া সরিষার তৈল আর নুন মাখিয়া সিদ্ধান্ন সেবা করিত। হাপুস হুপুস শব্দ উঠিত, জিভে কাঁচালংকার ঝাল লাগিলে আওয়াজ করিত সি সি সি সি। খাওয়া সাঙ্গ হইলে মাটির যতো মালসা আর পাত্র ফেলিয়া দিত আস্তাকুঁড়ে। বাসনপত্র, তৈজস সামগ্রী কোন কিচুর প্রতিই লোভ কিংবা মায়া যেন না আসে, তাই এই বিধানযাহাদের এই মায়া থাকে তাহারা তো সন্নিসি নয়, তাহারা গেরস্ত।

    একমাস অবধি এই সন্নিসিব্রতর পর শেষ দিনে এই সন্নিসিরা এবং আশে পাশের অন্য গ্রামের সন্নিসিরাও আসিয়া জড়ো হইত চড়ক মেলার মাঠে। মোটা শালের লম্বা বল্লীর অনেকটা মাটিতে গাড়িয়া খাড়া হইত চড়ক গাছ। তাহার মাথায় লোহার তৈরি মোটা শূল। শক্ত পোক্ত লম্বা একটি বাঁশের ঠিক মাঝখানে গোল ফুটা করিয়া লোহার রিং পড়ানো থাকিতগোল এই ফুটার মধ্যে শালের মাথার শূলের উপর বসাইলে, চড়কগাছ প্রস্তুত, মস্ত এক T-র মতো দেখিতে হইত সেই বাঁশের দুই প্রান্তে থাকিত লোহার মোটা হুক, সেই হুকের মধ্যে লম্বা রশি পড়ানো থাকিত। রশির এক প্রান্ত ধরিয়া থাকিত বয়স্ক আর অভিজ্ঞ কয়েকজন সন্নিসি। আর অন্য প্রান্তে থাকিত পোক্ত লোহার তৈরি বঁড়শির মতো হুক। দুই প্রান্তের দুই হুকে, কোমরে দড়ি বাঁধিয়া এবার দুই সন্নিসি বলিয়া উঠিত “বাবা তারকনাথের সেবা লাগি”সমস্বরে উপস্থিত সমস্ত লোক চিৎকার করিয়া উঠিত “বাবা মহাদেব”এইবার অন্য প্রান্ত ধরিয়া থাকা অভিজ্ঞ সন্ন্যাসীরা, রশিতে টান দিতেই, কোমরে হুক বাঁধা ওই দুই সন্নিসি ঝুলিয়া পড়িত শূণ্যে। রশির টানে তাহারা দুইজন, উঁচুতে আরো উঁচুতে উঠিতে উঠিতে, চড়ক গাছের T-র দুই প্রান্তে  দুলিতে থাকিত ওপর থেকে সন্নিসি দুইজন চিৎকার করিয়া বলিত “বাবা তারকনাথের সেবা লাগি” নিচেয় দাঁড়ানো, অভিজ্ঞ সন্ন্যাসীরা স্বস্তির শ্বাস লইয়া বলিত “বাবা মহাদেব” এই দুই জয়ধ্বনির অর্থ অনেকটা সংকেতের মতো। ওপরের দুই সন্নিসি জয়ধ্বনি দিয়া আসলে বলিল, তাহারা ঠিক আছে, কোনকিচুর অসুবিধে নাই। আর নিচের সন্নিসিরা জয়ধ্বনিতে নিশ্চিন্ত হইয়া যেন বলিল, যাক বাবা, এবার তবে শুরু করচি

    এই শুরু হইবার সময়টাতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসিত। কারণ, নিচের সন্ন্যাসীদের দড়ির টানে তখন চড়ক গাছের মাথা ঘুরিতে শুরু করিয়াছে। ঘুরিবার গতি বাড়িতে বাড়িতে চড়ক গাছের মাথা বন বন করিয়া ঘুরিতে লাগিত সুতোয় বাঁধা ঢিলের মতো, ঝুলিতে থাকা দুই সন্ন্যাসীও মহাশূণ্যে ঘুরিতে থাকিত বন বন করে। সেই দৃশ্যে ভয়ে আমার চোখ বন্ধ করিয়া ফেলিতাম, সর্বদা মনে হইত, যদি কিছু একটা ঘটিয়া যায়, সন্নিসি দুইজনার কি হইবে! আশেপাশের দর্শকরা ভয়াকুল বিস্ময়ে চিৎকার করিয়া উঠিত “জয় বাবা মহাদেবের জয়”

     সেকালে চড়কের মেলায় চড়কগাছের ওই ভয়ংকর খেলা ছাড়াও আরো অনেক খেলা দেখিয়া শিহরিত হইতাম। সন্নিসিরা জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়া নগ্ন পদব্রজ করিতেন। কেহ কেহ জিহ্বায় লৌহ শলাকা বিদ্ধ করাইত; কেহ বা হাতের জ্বলন্ত মশালে মুখ হইতে ক্যারাসিন তৈল নিক্ষেপ করিয়া, আগুনের তীব্র হলকা সৃষ্টি করিত। সন্নিসিদের এইসব ভয়ংকর খেলা দেখিয়া বাল্যকালে আমরা অভিভূত হইতাম। এই সব খেলা দেখিবার পর পিতার হাত ধরিয়া আমরা মেলার নানান পসরা দেখিতাম। পাঁপড় ভাজা, জিভে ছ্যাঁকা দেওয়া জিলিপি, আলুর চপ, বেগুনি সহযোগে মুখের স্বাদ বদল করিতাম। মায়ের জন্যে কিনিতাম লোহার সাঁড়াশি, তেল উঠাইবার পলা, আলতা, সিঁদুর, ভগিনীদের জন্য কাঠের পুতুল, কাঁচের রঙিন চুড়ি আমরা ভ্রাতাগণ মাটির তৈরি কলা ও পেয়ারা, সুভাষ বোস ও রবি ঠাকুর, কাঠের গোশকট, জিভ বের করা তুলার কুকুর লইয়া বাবার সঙ্গে যখন ফিরিতাম, সূর্য তখন পাটে বসিবার যোগাড় করিতেছেন। মেলায় দীর্ঘক্ষণ ঘুরিয়া পরিশ্রান্ত কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে পিতা কাঁধে তুলিয়া লইতেন। পিতার কাঁধে উঠিয়া পথচলার মজাই আলাদা। কনিষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি স্নেহ মিশ্রিত ঈর্ষা লইয়া, পিতার হাত ধরিয়া আমরা আপন গেরামে ফেরার পথ চলিতাম। 

পয়লা বৈশাখ, ১৩৬৬ বঙ্গাব্দ

    সেই কালে মোকাম কলকেতার নানান অঞ্চলে চড়কের মেলা বসিত। আমাদের শৈশবে কিংবা বাল্যে দেখা আমাদের গেরামের মেলার সহিত তাহার বিস্তর ফারাক। কলকেতার মেলায় অনেক বেশি জাঁকজমক। কাঠের নাগরদোলাকাঠের হাতিঘোড়ায় বসিয়া বন বন করিয়া ঘুরিবার মেরি-গো-রাউণ্ড। চোখধাঁধানো মনোহারি পসরা কিংবা খাদ্যসামগ্রী, সব ব্যাপারেই কলকেতার মেলা বিশিষ্টকাঁচের ও চিনামাটির তৈরি সায়েব-মেম পুতুল। রূপার তবক দেওয়া মিঠা পান। নানান রঙের সিরাপ দেওয়া, বরফ শীতল রঙিন সরবৎ। মালাই কুলফি। যুবা বয়েসে বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়িয়া কলকেতার মেলা বেশ কয়েকবার দেখিয়া অবাক হইয়াছিলাম, কিন্তু তাহাতে প্রাণের সাড়া পাই নাই। বরং মজা পাইয়াছিলাম অন্যত্র।

    কলকেতার চেতলার হাট মশারি আর মাছের জালের জন্যে বহুদিন হইতেই বিখ্যাত। কিন্তু আমি চেতলার যে মোহজালে মুগ্ধ হইলাম তাহা সংয়ের সাজ। পয়লা বোশেখের আগে ও পয়লা বোশেখের দিন চেতলার সং দেখিতে জন সমাগম হইত বিস্তর। কার্বাইড গ্যাসের চোখধাঁধানো উজ্জ্বল আলোয় বিচিত্র বেশে বেশ কিছু লোক সাজিয়া উঠিত কলকেতার বাবুদের নষ্টামি, আখড়ার মহারাজদের ধ্যাষ্টামি, কূলবধুদের গোপন ভ্রষ্টামি, মোহান্ত এলোকেশী সম্বাদ; এসব নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ তো ছিলই। তাহার উপর আরো থাকিত নির্ভেজাল হাসির উপস্থাপন। বুকফাটা কান্না, দমফাটা হাসি, আহ্লাদে আটখানা, কাজের ভারে কুঁজো। সন্ধ্যার পর জেলেপাড়ার সঙদের সেই মিছিল সমাবেশ, উপস্থিত জনগণের সহিত আমরাও অত্যন্ত উপভোগ করিতাম।

    পয়লা বোশেখের দিন সকালে ভৃত্যের মাথায় বেতের ধামায় লাল শালুমোড়া জাব্দা খাতা, শ্রীগণেশ ও শ্রীলক্ষ্মীর মূর্তি, লক্ষ্মীদেবীর ঝাঁপি লইয়া বাবুদের কেরানীরা দলে দলে আসিতেন কালীঘাটের কালী মন্দিরে। মন্দিরে পুজার ভিড়ে রীতিমতো হট্টগোল উপস্থিত হইত। দাপুটে বাবুদের কেরানীরা অর্থের দাপট দেখাইতে কসুর করিতেন না, তাঁহাদের উৎকোচে মন্দিরের পুরোহিতগণের মধ্যে হুড়াহুড়ি পড়িয়া যাইত। এই পুরোহিতগণ মাকালীর সহিত সরাসরি যোগাযোগ ঘটাইয়া সম্বৎসরের ব্যবসার সুবন্দোবস্ত করিয়া দিবার আশ্বাস দিতেন। পুজার পর তাঁহারা জাব্দা খাতায় আলতাকালিতে উপরে ‘ওঁমা’, তাহার নিচে ‘শ্রীশ্রীকালিমাতা সহায়’ লিখাইয়া লইতেন। তাহার নিচে স্বস্তিকা চিহ্ন আর একদম নিচের দুই কোণায় আলতায় ডোবানো রৌপ্যমুদ্রার দুই পিঠের মোহর।

    কলকেতা শহরে সে সব মেলা আজিকালি আর তেমন দেখি না। লোকে আজিকালি অন্ধকার ঘরে টিকিট কাটিয়া বায়োস্কোপ দেখে। তাহারা নায়ক নায়িকাদের গান আর মেকি হাসিকান্নায় মজিয়া থাকে। শুনিয়াছি কলকাতার নব্য বাবুরা এখন চড়কের মেলা, সং ইত্যাদির আনন্দকে “ছোটলোকি” বলে। বলে এসব সেকেলে ফক্কুড়ি দেখিয়া সময় নষ্ট করিবার মতো সময় তাহাদের নাই। হবে হয়তো। আমাদের যৌবনে আমরা তো এসব খুবই উপভোগ করিতাম। আজিকালি বয়স হইয়াছে, এ যুগের ছোকরাদের মতিগতি আর বোধগম্য হয় না।  

    আমার গিন্নি পয়লা বোশেকের ছুটির দুপুরে বড়োই তরিবতে রন্ধন করেন। সজনে ডাঁটার শুক্ত, রুই মাছের মুড়ো দেওয়া ভাজা মুগের ডাল, ঝিরিঝিরি আলুভাজা, পটল-আলুর মাখোমাখো তরকারি, রক্তরাঙা ঝোলের মধ্যে দুইখানি অর্ধগোলক আলু সহ অনেকটা কচিপাঁঠা, কাঁচা আমের পাতলা অম্বল। সবার শেষে মিঠে দধি। এইরূপ আকণ্ঠ মধ্যাহ্ন ভোজের পর, গালে গিন্নির হাতের পান লইয়া, পয়লা বোশেখের দুপুরটি দিবানিদ্রায় অতিবাহিত করি, জানালা দরোজা বন্ধ প্রায় অন্ধকার ঘরে।

    দিবানিদ্রা সারিয়া বারান্দায় যখন বসি, পথের আলো জ্বালাইবার জন্য পুরসভার কর্মচারিরা লম্বা আঁকশি হাতে দৌড়াইয়া চলে। পাড়ার যতো বাড়ির দরোজায় দরোজায় বেলফুলের মালা লইয়া ফিরিওয়ালা ডাক পাড়ে “বেইলফুউউল”। তাহার চিকন কণ্ঠের সুরে ও বেলফুলের সৌরভে প্রথম বৈশাখের সন্ধ্যাটি বড়ো মধুর হইয়া উঠে। তাহার পশ্চাতে আসে মালাইবরফ এবং কুলফি মালাইয়ের ফিরিওয়ালা। পাড়ার বখাটে ছোকরার দল তাহাকে আড়ালে ডাকিয়া সিদ্ধি মিশ্রিত কুলফি মালাই খাইয়া অকারণ হাসিতে পাড়া মাতায় তোলে।

    সন্ধ্যা একটু গড়াইলে, পাটভাঙা ধুতি আর গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি পড়িয়া রাশভারি মুখে বাহির হই। পায়ের পাম্পশুতে মচ মচ ধ্বনি তুলিয়া যখন হাঁটি নিজের ভারিক্কি চালে নিজেই অবাক হই। গেরামে থাকিতে যাহারা আমাকে ‘আত্তাঁ’ বলিয়া চিনিত, তাহারা আমার এই ‘আত্মারামবাবু’ মার্কা চেহারা দেখিলে কিরূপ ভিমরি খাইত কল্পনা করিয়া, বড়ো আল্লাদ পাই।

    কালেজ স্ট্রিটের মেডিক্যাল কলেজের বিপরীতে কল পাইপের বিপণিগুলির অধিকাংশই আমাদের দেশজ সুহৃদদের মালিকানা। হালখাতা উপলক্ষে এই সব বিপণির উদার হৃদয় মালিকেরা অতিথি আপ্যায়নের বিপুল আয়োজন করিয়া থাকে।

    দোকানের প্রবেশ পথেই একজন কর্মচারী পিচকারি হইতে মাথায় মুখে গায়ে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করিয়া গোলাপজল ছিটাইয়া দেয়। সদ্য গ্রাম হইতে আসিয়া কলকেতা নিবাসী হইবার পর যেবার প্রথম হালখাতা অনুষ্ঠানে আসিয়াছিলাম, এই ঘটনায় অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াছিলাম। বলা নাই কওয়া নাই, খামোখা আমার গাত্রে জল ছিটাইয়া দেওয়া, এ কী ধরনের রসিকতা? সৌভাগ্যক্রমে সেই ক্ষণে বিপণির মালিকপুত্র “আসুন খুড়ামহাশয়” বলিয়া আমার হাতে ঝাউপাতায় মোড়া গোলাপকলি উপহার দিয়া ভিতরে বসাইয়াছিল। নচেৎ সেদিন হয়তো কুরুক্ষেত্র বাধাইয়া নিজেকেই হাস্যাস্পদ করিতাম। বসিবার পর দেখিয়াছিলাম ওই কর্মচারি সকলকেই ওই জল ছিটাইতেছে, ও তাহাতে গোলাপের সুবাস। ক্রোধ প্রশমিত হইলে, নিজ গাত্রেও ওই গোলাপজলের সুবাস উপলব্ধি করিয়া চমকিত হইয়াছিলাম।

    বিপণির ভিতরের প্রাত্যহিক ব্যবসায়িক পরিবেশ আজ নাই উজ্জ্বল আলোর নিচে ফরাস পাতা, তাহাতে ধবধবে চাদর বিছানোফরাসে বসিয়া অশীতিপর এক মুসলিম বৃদ্ধ সানাই বাজাইতেছেন। তাঁহার সহিত তবলায় একজন সঙ্গত করিতেছেনসেই সানাইয়ের মাঙ্গলিক সুর যেন নতুন বর্ষের শুভদিনের সূচনা করিতেছে। কিন্তু আশ্চর্য, সেই সুরের প্রতি উপস্থিত কাহারো মনোযোগ নাই। সকলেই নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপে ব্যস্ত। সকলের হাতেই কি এক পানীয়ের বোতল, তাহাতে সরু পাইপ বসানো। সেই পাইপে ঠোঁট লাগাইয়া হাল্কা চুমুকে সকলে পানীয়ের মজা লইতেছে। এই পানীয় কি সুরা জাতীয় কিছু? কলকেতার বাবুরা কি প্রকাশ্য সন্ধ্যালোকে নির্লজ্জের মতো মদ্যপান করিয়া থাকে?

    এই সব ভাবিতে ভাবিতে বিপণির মালিক অমিয়ভূষণ মহাশয়, আমার কাছে আসিয়া নমস্কার করিয়া বলিলেন, ‘সব ভালো তো আত্তাঁ, কোন রকম সংকোচ করবা না। আরে একি, তোমাকে কোল্ডিংক দেয় নি? অ্যাই ব্যাচা, এদিকে একটা কোল্ডিংক নে আয়। বাড়ির সব খপর ভালো? বাচ্চা পরিবার, সবাই? হে হে হে, খুব ভালো। আরে আসুন আসুন বিপত্তারণবাবু, আজকাল আপনার আর দ্যাকাই পাওয়া যায় না, আমি ওদিকটা একবার দেকে আসি, যেদিকটা না দেকবো, সেকানেই ...বোয়লে না?” অমিয়ভূষণবাবু অন্যদিকে যাইবার পরেই ব্যাচা নামের ছোকরাটি আমার হাতে এক বোতল শীতল পানীয়ের মধ্যে সরু পাইপ ডুবাইয়া দিয়া গেল। অন্যদের দেখাদেখি কায়দা করিয়া আমিও পাইপে অধর চাপিয়া পানীয় টানিয়া লইলাম। স্বাদ মন্দ নয়। স্বাদ ও গন্ধে মদ বলিয়াও মনে হইল না, কারণ ইহার পূর্বে ছোকরাকালে কুসঙ্গে পড়িয়া দু একদিন ব্রান্ডির স্বাদ লইয়াছিলাম।    

    কিন্তু ও কী ও, আমার এ কী হইল? পানীয় গলাধঃকরণের পরই পেটের মধ্যে বিশাল উদ্গারের উদ্গম হইল। আমি রোধ করিতে পারিলাম না, আমার কণ্ঠ হইতে অদ্ভূত এক শব্দ নির্গত হইল। মনে হইল আমার উদরের অজ বালক পুনর্জীবন পাইয়া তাহার মাতার সন্ধানে ডাকিতেছে। আমার আশেপাশে উপবিষ্ট, বিশিষ্ট জনের দুই চারিজন আমার বাণীতে চমকিত হইলেন, ঘাড় ফিরাইয়া আমার আপাদমস্তক মাপিয়া লইলেন। ইহার পর ওই ভুল আর করি নাই, পাইপে হাল্কা টানে অল্প পানীয় পান করিতে লাগিলাম। তাহাতেও ছোট ছোট উদ্গার উঠিতেছিল, কিন্তু আমি সেগুলিকে নাসিকা পথে ছাড়িতে লাগিলাম। তাহাতে নাসিকা জ্বলিতে লাগিল, কিন্তু সম্মান রক্ষা হইল। এমন পানীয় মনুষ্যজাতির সভ্যতায় কোন মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত করিবে, বলিতে পারি না।

    অমিয়ভূষণবাবুর বিপণি হইতে দুইখানি বাঙ্গালা ক্যালেণ্ডার ও দুই বাস্কো মিষ্টান্ন লইয়া বিদায় লইলাম। তাহার পর আরো ছয়খানি পরিচিত বিপণিতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিয়া টানা রিকশয় গৃহে ফিরিলাম। আমার বগলে তখন পাঁচখানি বাঙ্গালা ক্যালেণ্ডার ও দুই হাতে নয় বাস্কো মিষ্টান্নআরো দুইখানি হাত থাকিলে, আরো কয়েকটি বিপণিতে যাইতে পারিতাম ভাবিয়া আক্ষেপ হইল। কিন্তু বিধির বিধানে হাত মাত্র দুইখানি!

    রাত্রের রন্ধন হইতে মুক্তি পাইয়া আমার গৃহিণী আনন্দিতা হইলেন। দুই পুত্র ও দুই কন্যা সহ আমরা সকলে নয়খানি বাস্কো উদরসাৎ করিয়া পরিতৃপ্ত হইলাম। গৃহিণীর বানানো একখানি পান গালে লইয়া বাহিরের বারান্দায় দাঁড়াইলাম। ভাবিলাম পয়লা বোশেখের মঙ্গলরাত্রি বড়ো আনন্দে যাপিত হইল।

    জানি না কেন এই সময় মনে পড়িল সেই শীর্ণ বৃদ্ধ সানাইশিল্পীর কথা। তাঁহার সানাইবাদনের প্রতি আমাদের কাহারো বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। একদল শূকরের সম্মুখে ছড়ানো মুকুতার মতো তাঁহার শিল্প প্রয়াস তিনি বিতরণ করিতেছিলেন, শুধুমাত্র তাঁহার নিজের ও পরিবারের উদরপূর্তির প্রত্যাশায়। একজন শিল্পীর, নামজাদা নাই বা হইলেন, এ হেন অবহেলা আমরা না করিলেও পারিতাম।

    পয়লা বৈশাখে নববর্ষের এই শুভ দিনটিতে তাঁহার সানাইয়ের সেই মাঙ্গলিক সুর কলকেতার স্বার্থ সন্ধানী মানুষের অন্তরে এতটুকুও দাগ রাখিতে পারিল না। আগামী কল্য দোসরা বৈশাখ, আর পাঁচটা সাধারণ কর্মব্যস্ত দিনের সহিত এতটুকুও ফারাক থাকিবে না। সকালে গৃহিণীর প্রস্তুত মৎস্যের ঝোল-ভাত নাকে মুখে গুঁজিয়া দপ্তরে যাইব। দিনগত পাপক্ষয় করিতে করিতে আরও একটি বৎসর পার হইয়া জীবনে আরও এক পয়লা বৈশাখ আসিবে, ভাবিতে ভাবিতে কখন ঘুমাইয়া পড়িলাম মনেও নাই।

-   ০০ –

[আত্মারাম বাগচি মহাশয়ের জন্ম প্রাক-স্বাধীনতা যুগে, কর্ম উত্তর-স্বাধীনতার দিনগুলিতে। তাঁর স্মৃতিকথার আংশিক পরিমার্জিত রূপ “চোত-বোশেখের পালা”; বানান ও শব্দ ব্যবহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।]

শুক্রবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৫

মহাভারতের অশুদ্ধি

 

প্রাত্যহিক বাক্যালাপে, ধরা পড়ে যাওয়া ছোটখাটো ভুলত্রুটি ঢাকতে আমরা প্রায়ই বলে থাকি “একটু আধটু ভুলভ্রান্তি করে ফেলেছি তো কী হয়েছে, তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে নাকি?”। বঙ্গের ভক্তপ্রাণ সরল কবি শ্রী কাশীরাম দাস একথা শুনলে নির্ঘাৎ দুঃখ পেতেন। তিনি মহাভারতের বঙ্গ সংস্করণ লিখতে গিয়ে বারবারই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, “মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান”। অমৃত কখনো অশুদ্ধ হয় নাকি? নাকি তাকে উচ্ছিষ্ট করা যায়? অমৃত সর্বদাই পবিত্র।

কিন্তু মহাভারত সত্যিই অমৃত কী না, সে ব্যাপারে ঘোরতর সংশয়ের উদ্রেক করেছিলেন স্বয়ং দেবর্ষি নারদ। আজ্ঞে হ্যাঁ, টিভির মহাভারত সিরিয়ালে, হাতে বীণা আর কপালে তিলক আঁকা যে নারদকে দেখেছিলেন, ইনিই সেই নারদ। যাঁর মুখে সদা সর্বদা “নারায়ণ, নারায়ণ” শুনে তাঁর ভক্তিরসে আমরাও আপ্লুত হতাম। আবার সামনে বিবদমান দুই বন্ধুজনের ঝগড়া উস্কে দিতে, নখে নখ ঘষে আমরা ছোটবেলায় যে “নারদ, নারদ” জপ করতাম, ইনিও সেই একই নারদ। এ হেন নারদই মহাভারতকে যাচ্ছেতাই রকম হ্যাটা করেছিলেন। তাও আড়ালে আবডালে নয়! মহাভারত রচয়িতা স্বয়ং কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের মুখের ওপরেই ছ্যা ছ্যা করে উস্তুম-ফুস্তুম ধমক দিতে কার্পণ্য করেননি। সেই ঘটনার কথা আবার নিজেই গুছিয়ে লিখে গিয়েছেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন, শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের প্রথম স্কন্ধের চতুর্থ এবং পঞ্চম অধ্যায়ে! ঘটনাটা কেমন ঘটেছিল, সংক্ষেপে আগে বলে নিই।

 

“শুক, শুক, অ্যাই শুক, কোথায় চললি? ধেড়ে ছেলে, এই অবস্থায় কেউ বাইরে বের হয়? কোমরে একটা কাপড় জড়িয়ে নে হতভাগা! তোর না হয় লাজ-লজ্জার বালাই নেই, কিন্তু আমার ব্যাপারটা বোঝ, সমাজে আমি মুখ দেখাব কী করে?”

এই এক ছেলে শুকের জন্যে দ্বৈপায়নের দুশ্চিন্তার অবধি নেই। তাঁরই পুত্র, অথচ তিনি তাঁকে ঠিক বুঝতে পারেন না। সবাই বলে, তিনি মহাযোগী, পরম ব্রহ্মে একনিষ্ঠ, তিনি ব্রহ্মজ্ঞ। তিনি সমদর্শী এবং ভেদজ্ঞানরহিত, অর্থাৎ বসন ও দিগ্বসনে অথবা খাদ্য এবং বিষ্ঠার মধ্যে তিনি কোন প্রভেদ দেখতে পান না। যদিও তিনি এখন যুবক, কিন্তু তাঁর আচার আচরণ দেখলে মনে হয়, অপরিণত বুদ্ধি শিশু। এই নিয়েই দ্বৈপায়নের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। তিনি তো এমন পুত্র চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর নিজের মতো পুত্র শুকও বেদজ্ঞ হয়ে উঠবে, তাঁর দেহরক্ষার পর পুত্র শুক পিতার নাম আরও উজ্জ্বল করবে। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে তিনি বেজায় হতাশ হয়ে পড়ছেন, তাঁর মনে হচ্ছে এ পুত্র উল্টে তাঁর নাম ডোবাবে।

শুক ছাড়াও দ্বৈপায়নের আরও তিন পুত্র ছিল, তারা সকলেই তখন গতায়ু। তাছাড়া সেই পুত্রদের ওপর তাঁর পিতৃত্বের তেমন কোন অধিকার ছিল না। আত্মজকে কোলে পিঠে করে, লালন করার যে আনন্দ, ওই তিন পুত্রের ক্ষেত্রে সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। কারণ ওই তিন পুত্রের মধ্যে দুজন ছিল হস্তিনাপুরের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী, ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডু। আর অন্যজন বিদুর, প্রাসাদের অন্তঃপুরিকা এক দাসীর গর্ভজাত। যাকে ভাইপো দুর্যোধন উঠতে বসতে কটুকাটব্য করতেন, ক্ষত্তা, দাসীপুত্র আরও অশ্রাব্য কত কি!

অতএব পিতৃস্নেহের সবটাই তিনি শুকদেবকে উজাড় করে দিয়েছেন। কিন্তু পুত্রের নির্বিকার ব্যবহারে তিনি বিড়ম্বিত বলেই সর্বদা উৎকণ্ঠায় থাকেন। আজও পুত্র শুককে নগ্ন অবস্থায় আশ্রমের বাইরে বেরোতো দেখে, ব্যাকুল হয়ে ডাকতে ডাকতে দ্বৈপায়ন পুত্রের পিছু নিলেন, “দাঁড়া, শুক দাঁড়া, আমার কথাটা শুনে যা”। শুকদেব সম্পূর্ণ নির্বিকার, কোন দিকেই দৃকপাত নেই, পিতার ডাক যেন শুনতেই পেলেন না। একই গতিতে তিনি পিতার বদরিকাশ্রম ছেড়ে হেঁটে চললেন সরোবরের পাশ দিয়ে, কাননে ঘেরা গ্রামের পথ দিয়ে। দ্বৈপায়নের বয়েস হয়েছে তিনি এখন বার্ধক্যের সীমায় পৌঁছেছেন, যুবক পুত্রের হাঁটার সঙ্গে তাল রাখতে না পেরে তিনি অনেকটাই পিছিয়ে পড়লেন।

যথা সম্ভব দ্রুত এসে যখন তিনি সরোবরের কাছে পৌঁছলেন, সরোবরের জলে যেন হুলস্থূল পড়ে গেল। তিনি চমকে তাকিয়ে দেখলেন, বেশ কয়েকজন অপ্সরাতুল্য খোলামেলা যুবতী সরোবরের জলে স্নান করছে। তাঁকে দেখতে পেয়ে তাদের মধ্যে কেউ জলের মধ্যে গলা অব্দি ডুবে রইল, কেউ ভেজা কাপড়ে শরীর ঢাকতে ব্যস্ত হয়ে উঠল, কেউ বা লজ্জায় স্তম্ভিত হয়ে মুখ ঢাকল তাদের করকমলে। পুত্রের জন্যে উদ্বেগের মধ্যেও নারীদের আচরণে দ্বৈপায়ন বিস্মিত হলেন, তিনি ওই রমণীদের জিজ্ঞাসা করলেন, “একটু আগেই আমার যুবক পুত্র তোমাদের সামনে দিয়েই নগ্ন অবস্থায় হেঁটে গেল, তখন তো তোমরা লজ্জা নিবারণের কোন চেষ্টা করনি! তাহলে আমার মতো বৃদ্ধকে দেখে তোমরা এত উতলা হলে কেন বলো তো, বাছা? তোমরা কী জানো না, আমি কে?”

লজ্জানত মুখে এক যুবতী উত্তর দিল, “আপনাকে কে না চেনে মহর্ষি, আপনি আমাদের গৌরব। আর আপনার যুবক পুত্র শুকদেব যোগীশ্রেষ্ঠ – নিষ্পাপ শিশুতুল্য, তাঁর দৃষ্টিতে নারীপুরুষে কোন প্রভেদ নেই। তাঁর দৃষ্টিতে আমাদের সংকোচ আসে না, কিন্তু আপনার...”। যুবতী কথা সম্পূর্ণ করল না, লজ্জায় মুখ নীচু করে আকণ্ঠ ডুব দিল সরোবরের জলে। স্তম্ভিত দ্বৈপায়ন পুত্র শুকদেবের পিছনে আর দৌড়লেন না, তিনি মাথা নীচু করে ধীর পায়ে চিন্তিত মুখে ফিরে চললেন তাঁর আশ্রমের দিকে। সরোবরে স্নানরতা প্রগলভা রমণীরা আজ তাঁর ও তাঁর পুত্রের আচরণের প্রভেদটুকু তাঁর চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল।

অথচ সারাজীবনে তিনি তো ধর্মাচরণ ও ধর্মপথ থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান ও গভীর বোধের প্রয়োগে বলা যায় তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন। বেদের বিক্ষিপ্ত মন্ত্র সমূহ তিনি একত্র করে চারটি বেদগ্রন্থে সংহত করেছেন। এর জন্যে দেশের পণ্ডিত মহল তাঁকে “বেদব্যাস” উপাধিতে সম্মান করেছেন। শূদ্র আর স্ত্রীলোকের বেদপাঠ নিষিদ্ধ। কিন্তু তাঁর মনে হয়েছিল, কেনই বা তারা ধর্ম আচরণ এবং ধর্মতত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হবে? বিশেষতঃ তাদের এবং সর্বসাধারণকে সকল ধর্মতত্ত্ব জানানোর জন্যেই তিনি মহাভারত রচনা করেছেন। সে গ্রন্থকে বিদ্বানসমাজ পঞ্চমবেদ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁর অসাধারণ এই দুই কীর্তিই ভারতের ধর্ম চেতনাকে এক উচ্চস্তরে প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু তাও লঘুমতি ওই চপলা তরুণীরা তাঁর দৃষ্টিতে সমদর্শন খুঁজে পায় না!

 

 

আপাত তুচ্ছ এই ঘটনাটাই নড়িয়ে দিল তাঁর আত্মবিশ্বাসের ভিত। গভীর চিন্তায় তিনি এখন সর্বদাই নিমগ্ন থাকেন, প্রাত্যহিক নিত্যকর্ম ছাড়া অন্য কোন কাজেই তিনি আর নিবিষ্ট হতে পারেন না। সর্বদাই তাঁর মনে হয়, তাঁর এই অগাধ পাণ্ডিত্য, তাঁর ওই অসামান্য কীর্তিসমূহ সবই অসার, ব্যর্থ। তাঁর এতদিনের জীবন ও জীবনচর্যা যেন এক ঊষর ক্ষেত্র, যেখানে তাঁর জ্ঞান ও বোধের বীজ তিনি উপ্ত করার চেষ্টা করেছেন ঠিকই, কিন্তু মনে হচ্ছে সে সবই সম্পূর্ণ ব্যর্থ এবং নিষ্ফল হয়েছে।

সারাটাদিন প্রাত্যহিক নিয়মানুবর্তী কর্ম ব্যস্ততার মধ্যে কোনভাবে কালাতিপাত করার পর, সায়াহ্নে তিনি নিজেকে সব কিছু থেকে মুক্ত করে নেন। এই সময়ে তিনি চলে আসেন আশ্রমের অদূরে বহমানা সরস্বতী নদীর নির্জন তীরে। একটি পাথরের উপরে বসে তিনি তাকিয়ে থাকেন বহতা নদীর দিকে, নদীর ওপারে এবং এপারেও। সন্ধ্যা নেমে আসে ধীরে ধীরে। সারাদিনের কর্মব্যস্ত মানুষজন এবং গৃহপালিত পশুরদল এসময়ে যে যার ঘরে ফেরে। তাদের পায়ে-চলা পথে, ক্ষুরের আঘাতে ধুলো উড়তে থাকে। সে ধুলোয় আবছা হয়ে আসে তাঁর পশ্চাৎপট, ঝাপসা হয়ে যায় পিছনে ফেলে আসা তাঁর আশ্রম। সব কিছুই মনে হয় অলীক, মায়া। তাঁর এতদিনের বিপুল কর্মকাণ্ডকেও যেমন আজকাল অনর্থক পণ্ডশ্রম মনে হচ্ছে। তিনি বিষণ্ণ মনে গভীর চিন্তায় ডুবে যান, তিনি নিজের প্রতিই অসন্তোষে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বারবার, মাথা নাড়েন নিজের অসাফল্যে!

এমনই একদিন, সরস্বতীর তীরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। রাত্রির আকাশে জেগে উঠছে একটি-দুটি তারা। কে যেন পিছন থেকে তাঁকে ডাক দিলেন, “এই অন্ধকারে একলা বসে, কী চিন্তা করছ, দ্বৈপায়ন? অগাধ পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও তোমার এত চিন্তা কিসের বলো তো?” দ্বৈপায়ন আশ্চর্য হলেন, আশ্রমে সকল শিষ্যদের তিনি কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন, এই সময় কেউ যেন তাঁকে বিরক্ত না করে। তা সত্ত্বেও কে এখানে এল তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে?

দ্বৈপায়ন উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে তাকালেন, এবং অস্পষ্ট তারার আলোতেও তাঁর দেবর্ষি নারদকে চিনতে অসুবিধে হল না। দ্বৈপায়ন নত হয়ে করজোড়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিস্মিত বিনীত কণ্ঠে বললেন, “দেবর্ষি, আপনি অসময়ে এখানে?”

দেবর্ষি নারদ মৃদু হাস্য করে বললেন, “বসো হে, বসো। তোমার সঙ্গে দুটো মনের কথা কইব বলেই আসা। তোমার আশ্রমে গিয়েছিলাম, সেখানে শুনলাম, তুমি এখানে, আর তুমি শিষ্যদের বলে এসেছ, কোনভাবেই কেউ যেন তোমাকে বিরক্ত না করে। তা গায়ে পড়ে বিরক্ত করার ব্যাপারে নারদের মতো সুনাম ভূভারতে আর কারও নেই, কী বলো?” এই কথা বলে দেবর্ষি হা হা করে হাসলেন, এবং পিড়িং পিড়িং শব্দ তুললেন তাঁর বীণায়। তারপর হাসি থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কিছুদিন ধরেই তোমাকে বিষণ্ণ, অবসন্ন দেখছি, দ্বৈপায়ন। সেই উদ্বেগেই আমার এখানে আসা। তোমার শারীরিক কুশল তো?”

দেবর্ষির প্রশ্নে খুশিই হলেন দ্বৈপায়ন, দেবর্ষি বহুদর্শী সর্বতত্ত্বজ্ঞানী, তাঁর কাছে ত্রিভুবনে অজানা কোন বিষয়ই নেই। তাঁর মনের সংশয় দূর করা একমাত্র এই দেবর্ষির পক্ষেই সম্ভব। দ্বৈপায়ন বিনীত কণ্ঠে নিজের মনের সকল কথা মেলে ধরলেন দেবর্ষিকে। সব কথা শুনে দেবর্ষি কিছুটা বিদ্রূপের স্বরে বললেন, “বলো কী হে? তুমি সর্ব ধর্মতত্ত্বে পূর্ণ মহাভারতের মতো গ্রন্থ রচনা করেছ, আসমুদ্রহিমাচলের মানুষ তোমার কীর্তিতে ধন্য ধন্য করছে। আর তুমি কি না মনের অশান্তিতে একলা বসে আছে, নির্জন তমসাচ্ছন্ন এই সরস্বতী তীরে?”

“সবই সত্য, দেবর্ষি, কিন্তু শুকের ওই ঘটনার পর থেকেই আমার মনে হচ্ছে, আমি সম্পূর্ণ হতে পারিনি, আমার জ্ঞানে কী একটা যেন অধরা থেকে গিয়েছে। বহু চিন্তা করেও, সেটা যে কী কিছুতেই ধরতে পারছি না। আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারেন, দেবর্ষি? আপনার তুল্য জ্ঞান এই জগতে আর কার আছে? আমার মনের এই সংশয় দূর করতে পারবেন একমাত্র আপনিই”।

দেবর্ষি নারদ গম্ভীর স্বরে বললেন, “দ্বৈপায়ন, তোমার মহৎ রচনায় তুমি ভগবানের নির্মল যশের কথা প্রায় উল্লেখই করনি। তুমি কী বুঝতে পারছ না, ভগবান বাসুদেবের মহিমা বর্ণনা ছাড়া যে কোন সৃষ্টিই অসার এবং নিষ্ফল? তোমার মতো সর্ববেদজ্ঞ কীভাবে এমন ভুল করলে, দ্বৈপায়ন? মহাভারতের অপরূপ কাহিনী, রমণীয় উপমা, বিচিত্র অলঙ্কারের পদবিন্যাস সব কিছুই জলাঞ্জলি হয়েছে, কারণ ওই গ্রন্থে শ্রীহরির জগৎপবিত্র যশোগাথা তুমি বর্ণনা করনি। দ্বৈপায়ন, তুমি কি জানো না, বাসুদেবের অপার মহিমার বর্ণনাহীন যে কোন গ্রন্থই, শুধুমাত্র কাকের মতো ব্যক্তিরাই উপভোগ করে। তারা কিছুক্ষণের জন্য তোমার বিশাল গ্রন্থের বিচিত্র কাহিনী, অলঙ্কার ঠুকরে ঠুকরে উপভোগ করবে, তারপর অন্যত্র উড়ে যাবে। কিন্তু ব্রহ্মনিষ্ঠ সত্ত্বপ্রধান ভক্ত হংসরা তোমার এই গ্রন্থে কখনোই তৃপ্তি লাভ করতে পারবেন না। দ্বৈপায়ন, তুমি কি জানো না, যে গ্রন্থ ভগবানের যশোগাথা বিবৃত করে, সেই গ্রন্থই সম্পূর্ণ। সেই গ্রন্থ যদি অশুদ্ধপদ, ভ্রষ্ট উপমা ও ভ্রান্ত অলঙ্কারে রচিত হয়, তবুও সেই গ্রন্থই হয়ে ওঠে সারগ্রন্থ, সেই গ্রন্থই হংসসম ভক্তজনের লীলাক্ষেত্র হয়ে ওঠে”।

দ্বৈপায়ন নত মস্তকে দেবর্ষির কথাগুলি চিন্তা করতে লাগলেন। অন্ধকারে নীরব দ্বৈপায়নকে কিছুক্ষণ চিন্তা করার সময় দিয়ে দেবর্ষি নারদ আবার বললেন, “দ্বৈপায়ন, তুমি ভগবানের অপার লীলা সমস্তই অবগত আছো। তুমি নিজেকে পরমপুরুষ পরমাত্মার অংশ বলেই জেনে রাখো। তোমার জ্ঞান নিশ্ছিদ্র, তোমার দৃষ্টি অব্যর্থ, তোমার জন্য কোন আচার্যের উপদেশের প্রয়োজন নেই। এখন থেকে তুমি মহানুভব শ্রীহরির গুণাবলী বর্ণনা করো। প্রজ্ঞাবান লোকেরা বলেন, উত্তমশ্লোক ভগবানের গুণবর্ণনাই সৎপুরুষের তপস্যা। ভগবান বাসুদেবের যশোগাথাই বেদজ্ঞান; সকল যজ্ঞের অনুষ্ঠান, স্তবপাঠ, জ্ঞান ও দানের অক্ষয় ফল স্বরূপ। অতএব বিলম্ব না করে, আগামী কাল থেকে তুমি সেই কর্মেই নিরত হও”।

মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাই শুরু করলেন। হরিবংশ, শ্রীমদ্ভাগবতের মতো মহাপুরাণ সহ অন্ততঃ আঠারোটি পুরাণ তিনি রচনা করে ফেললেন!

 

 

এ সবই ভক্তি এবং বিশ্বাসের কথা। ভাবনা-চিন্তা, বিদ্যা-বুদ্ধি বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারলে মহর্ষি দ্বৈপায়নের এই কীর্তিতে এতটুকুও সংশয় জাগে না।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা অতটা বিশ্বাসী হতে পারেন না। তাঁরা বলেন, মহাভারতের কেন্দ্রীয় ঘটনা “কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ”-র সময় কাল মোটামুটি ৯০০ বি.সি.ই। আমরা জানি এই যুদ্ধের প্রধান প্রতিপক্ষ একই কৌরব গোষ্ঠীর দুই জ্ঞাতি শাখা, কুরু এবং পাণ্ডব। মহাভারতের রচয়িতা নিজেই লিখেছেন, তিনি নিজেই এই দুই শাখা গোষ্ঠীর পিতা, অর্থাৎ তাঁর নিয়োগেই বিচিত্রবীর্যর দুই পত্নীর ক্ষেত্রে ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডুর জন্ম। তখনকার রাজবংশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্রই রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতেন। কিন্তু বিচিত্রবীর্যর দুই পুত্রের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র অগ্রজ হওয়া সত্ত্বেও জন্মান্ধ ছিলেন বলে রাজা হতে পারেননি। রাজা হয়েছিলেন অনুজ পাণ্ডু। বেশ কয়েক বছর রাজত্ব করার পর রাজা পাণ্ডু রাজ্যের শাসন ভার দাদা ধৃতরাষ্ট্রের হাতে সমর্পণ করে, বনবাসী হয়েছিলেন।

পাণ্ডু যতদিন রাজা হয়ে হস্তিনাপুরে উপস্থিত ছিলেন, ততদিন অগ্রজ ধৃতরাষ্ট্রের পত্নী গান্ধারীর সঙ্গে পাণ্ডুপত্নী রাণি কুন্তীর আদৌ সুসম্পর্ক ছিল না। জন্মান্ধ পতির কারণে তিনি রাণি হতে পারেননি। অতএব কুন্তী যখন রাণি হলেন, অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিতা হওয়ার জ্বালা তাঁর অন্তরে তীব্র ঈর্ষার সঞ্চার করেছিল। সেই ঈর্ষা আরও প্রবল হয়ে উঠল, যখন দুই নারী প্রায় একই সময়ে গর্ভধারণ করলেও, কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠিরে জন্ম হল গান্ধারী পুত্র দুর্যোধন ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই। অর্থাৎ কুরু রাজবংশের পরবর্তী প্রজন্মের জ্যেষ্ঠ পুত্র হলেন যুধিষ্ঠির, ফলতঃ তিনিই হলেন হস্তিনাপুর রাজসিংহাসনের ন্যায্য উত্তরাধিকারী। তীব্র এই ঈর্ষার বাতাবরণ থেকেই কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের সূচনা হল।

কুটিল রাজনৈতিক আবর্তের নানান উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে ঘটনা পরম্পরা যখন অনিবার্য কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছিল, সেই সময়ে পাণ্ডুপুত্রদের পক্ষে সর্বদাই সহায় ছিলেন মহর্ষি দ্বৈপায়ন। সত্যি বলতে, পাণ্ডবদের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জয়ের পিছনে ভগবান কৃষ্ণের ভূমিকা যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, মহর্ষি দ্বৈপায়নের ভূমিকাও প্রায় তার সমান বললেও হয়তো অত্যুক্তি হয় না।

অতএব, নিঃসন্তান বিচিত্রবীর্যর ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার বপন থেকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ পর্যন্ত দ্বৈপায়নের ওতপ্রোত উপস্থিতি অত্যন্ত স্পষ্ট। সেক্ষেত্রে, বিশেষজ্ঞজনের মতানু্যায়ী নশো খ্রীস্টপূর্বাব্দকেই যদি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের নির্দিষ্ট কাল বলে ধরে নিই, তাহলে, তাঁর জীবনকাল ৯৭০ থেকে ৮৯০-৮৮৫ খ্রীস্টপূর্বাব্দের মধ্যে অনুমান করাই যায়। অথচ পণ্ডিতেরা পুরাণ রচনার প্রারম্ভিক কাল অনুমান করেছেন, খ্রীস্টপূর্বাব্দের শেষ পর্যায়ে অথবা খ্রীস্টাব্দের প্রাথমিক পর্যায়ে। এর অর্থ দেবর্ষি নারদের পরামর্শে তিনি যখন পুরাণ রচনায় হাত দিলেন তখন তাঁর বয়েস প্রায় হাজার বছরের কাছাকাছি!

ঠিক এইখান থেকেই শুরু হল প্রকৃত ঘটনার সাজানো ইতিহাস রচনা। যার ফলে কোন ঘটনার নির্দিষ্ট কাল নির্ণয়ে আমাদের অনুমান ছাড়া অন্য কোন পন্থা অবশিষ্ট রইল না। মহাভারত রচনার প্রায় আটশ-নশ বছর পরে, সরাসরি অভিযোগ তোলা হল মহাভারত আদতে একটি অসার গল্পকথা। বলা হল বেদব্যাস বিরচিত এই বহুল জনপ্রিয় উপাখ্যান “কাক”-এর মতো অধার্মিক মানুষদের কাছেই রুচিকর, ভক্ত ও ধার্মিক “হংস”-তুল্য মানুষরা, কখনোই এই উপাখ্যান শ্রবণে তৃপ্তি পেতে পারেন না।

শুরু হল, মেদবর্জিত নিরাভরণ মহাভারতে বিক্ষিপ্ত অপ্রাসঙ্গিক ঘটনার অনুপ্রবেশ। তার সঙ্গে নিত্য নতুন পুরাণ রচনারও হিড়িক পড়ে গেল। কিন্তু সাধারণ মানুষ আচমকা উৎপন্ন এই সব পুরাণের গল্প বিশ্বাস করবে কিসের ভরসায়? অতএব পুরাণকার পণ্ডিতেরা ব্যবহার করলেন বেদব্যাসের নাম, খ্যাতি এবং প্রায় হাজার বছর ধরে প্রচলিত তাঁর জনপ্রিয় বিশ্বাসযোগ্যতা। তাই পুরাণ রচনার সূচনায় পুরাণকারেরা গড়ে তুললেন, অদ্ভূত ওই কাহিনী, যেখানে অবিসংবাদিত পণ্ডিত ও বেদজ্ঞ দ্বৈপায়ন নত মস্তকে মেনে নিলেন তাঁর ভ্রান্তি। এরপরেও মাত্র একখানি পুরাণ রচনা করেই তিনি ক্ষান্ত হলেন না, পরবর্তী চারশ-পাঁচশ বছরে তিনি কত যে পুরাণ রচনা করেছেন, তা নিয়ে আজও বিতর্কের শেষ নেই। আর এই সময় কালেই তাঁর রচিত “অশুদ্ধ” মহাভারত কালে কালে কলেবর বৃদ্ধি করে হয়ে উঠল শুদ্ধ হংস-বিহারযোগ্য ধর্মগ্রন্থ।

অতএব ক্ষমতালিপ্সু তথাকথিত সমাজসংস্কারকরা ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে সেই ধুরন্ধর পুরাণকারদের ট্র্যাডিশানেই আজও যে ইতিহাসের অশুদ্ধি ঘটাবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী? কিন্তু তাতেও কী আর অমৃতসমান মহাভারতের অশুদ্ধি ঘটতে পারে?

 

..০০..

  

           

("ধর্মাধর্ম" গ্রন্থের একটি অধ্যায় থেকে সংগৃহীত)   

বুধবার, ২ এপ্রিল, ২০২৫

মেকি মেডেল

 

 

অশীতিপর নীলিমা দুধে ভেজানো মুড়ির বাটিটা শেষ করে, দাওয়া থেকে উঠোনে নামলেন। চৈত্রের উজ্জ্বল রৌদ্রের ওমমাখা সকালে, কাঁপা-কাঁপা পায়ে উঠোনটা পেরোতে ভালই লাগছিল। সুষি থাকলে তাঁকে এভাবে হাঁটতে দিত না, হয় হাত থেকে এঁটো বাটিটা কেড়ে নিয়ে নিজেই কলতলায় যেত। টেপাকল টিপে বাটিটা ধুয়ে ফেরার সময় বাটি ভরে জল আনত তাঁর মুখটা কুলকুচি করে ধোয়ার জন্যে এবং জলেভেজা হাতে মুখ মুছিয়ে দিত নিজের হাতে। অথবা খুব জোরজার করলে, হাত ধরে পাশে পাশে হেঁটে যেত কলতলা অব্দি।

মাঝে মাঝে একটু বিরক্ত হন নীলিমা, তাঁর বয়েস হয়েছে ঠিকই কিন্তু এতটা অথর্বও তিনি হননি, যে নিজের এইটুকু কাজও তিনি করে উঠতে পারবেন না। কিন্তু এখন উঠোনটুকু পার হতে হতে তাঁর মনে হল, দাওয়া থেকে কলতলা পর্যন্ত উঠোনটা বিস্তর পথতাঁর দুর্বল পায়ের মন্থর গতিতে মনে হচ্ছে যেন অনন্ত পথযাত্রা। গত চল্লিশ বছর ধরে বয়স্ক হয়ে উঠতে উঠতে, তিনি বুঝতেই পারেননি, সেই ছোট্ট উঠোনটাই কোন জাদুতে এমন বিস্তীর্ণ মাঠ হয়ে উঠল!

সুষিটা তাঁকে খুব বকাবকি করে, বেশি হাঁটাচলা করতে দেয় না, তাঁকে কোন কাজই প্রায় করতে দেয় না। এখন এই উঠোন পার হতে হতে মনে হল, সুষি ঠিকই করে। প্রায় বছর তিরিশেক ধরে এই সুষি তাঁর নিত্য ছায়াসঙ্গী। সুষি তাঁকে যতটা বোঝে এবং চেনে, ততটা তিনি নিজেও বোঝেন না – চেনেন না নিজেকে। কলতলায় পৌঁছে তিনি টিউবওয়েল টেপার চেষ্টাও করলেন না। চারটে বালতিতে জল ভরে রেখে গেছে, সুষি। তার একটা থেকে মগে জল তুলে বাটি ধুলেন, কুলকুচি করে মুখ ধুলেন। জলভরা বালতিগুলোর দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হল, এখন চানটাও সেরে নিলে হত। নয়তো আবার এতটা হাঁটতে হবে চান করতে আসার সময়। কিন্তু তিনি তো গামছা, তেল, সাবান, শুকনো কাপড় কিছুই আনেননি...উজ্জ্বল আলো থেকে তিনি ছায়াঢাকা দাওয়ার দিকে তাকালেন একবার – সুষির ভাইঝির আজ পাকাদেখা, না গেলেই নয়, তাই দাদার বাড়ি গেছেতার ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে...হয়তো সন্ধে...। সুষিটা না থাকায় তিনি অসহায়বোধ করলেন খুব। সুষির ব্যবস্থায় অবিশ্যি কোন ফাঁক নেই, পাশের বাড়ির ঊষাকে বলে গেছে, হাতের কাজকম্ম সেরে সে চলে আসবে, যে কোন সময়। এতক্ষণ একলা এই বাড়িতে...সুষিটা তাঁর অভ্যেসটাও খারাপ করে দিয়েছে...একটা কথা বলার লোকও কেউ নেই?

“নীলিমাদেবী, বাড়ি আছেন?”

নিজের নাম শুনে অবাক চোখে তাকালেন নীলিমা, উঠোনের ওই কোণে সদর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে কেউ ডাকছে তাঁর নাম ধরে। তাঁর কাছে অনেকেই আসে, কিন্তু বহুদিন কেউ তো এভাবে তাঁকে ডাকে না। কেউ বলে, মায়ী, কেউ বলে দিদি, কেউ বলে দিদা। নিজের এই নামটা তিনি যেন ভুলেই গেছিলেন। নীলিমা তাকিয়ে রইলেন অচেনা লোকটির দিকে। লোকটি তাঁকে দেখতে পেয়ে জিগ্যেস করল, “নীলিমাদেবী? আপনিই কী নীলিমাদেবী?” নীলিমা ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন, কিছু বললেন না, ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলেন, অপেক্ষায় রইলেন, ভদ্রলোক কেন এসেছেন জানার কৌতূহলে।

ভদ্রলোক আরও ভেতরে ঢুকে এলেন, সঙ্গে আরও তিনজন। হাত তুলে আধো নমস্কার করে বললেন, “আমি সঞ্জয় দত্ত। আমরা ডিএম অফিস থেকে আসছি, আপনার জন্যে একটা সুখবর নিয়ে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এবছরের “শ্রীময়ী” অ্যাওয়ার্ডটা আপনাকেই দেওয়া হবে, কনগ্র্যাচুলেশন্‌স্‌” নীলিমা কিছু বললেন না, টিউবওয়েলের মাথায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভদ্রলোক মুখে হাসি নিয়ে এগিয়ে এলেন, নীলিমার দিকে খাঁকি রঙের একটি লম্বা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এই যে এর মধ্যে আপনার অ্যাওয়ার্ড কনফার্মেশনের চিঠি” হাত বাড়িয়ে নীলিমা খামটা নিলেন, তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলেন, হ্যাঁ তাঁর নামই লেখা আছে, নীলিমা সেনগুপ্ত। খামটাও যে সরকারি, তাতেও বোধহয় সন্দেহ নেই, খামের ওপরেই বড়ো করে ছাপা আছে, অন ইণ্ডিয়া গভর্নমেন্ট সার্ভিস। ভদ্রলোক এবার একটা সাদা কাগজে ছাপানো চিঠি আর একটা পেন এগিয়ে দিলেন নীলিমার দিকে,  বললেন, “এ্‌এই, এখানটায় রিসিভ্‌ড্‌ লিখে একটা সই করে দেবেন প্লিজ। অ্যাকনলেজমেন্ট আর কি, বুঝতেই তো পারছেন, সরকারি ব্যাপার, একটু এদিক-সেদিক হবার জো নেই...!”

নীলিমা পেনটা আর সাদা কাগজের চিঠিটা হাতে নিলেন। চিঠিটা পড়ার চেষ্টা করলেন, পারলেন না, ছোট ছোট অক্ষরগুলো একেবারেই ঝাপসা, চোখে চশমা নেই যে। সুষিটা থাকলে, এখনই ছুট্টে গিয়ে চশমাটা আনতে পারতনীলিমা একটু দ্বিধা নিয়ে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালেন, বললেন, “চোখে চশমাটা নেই তো...ঘরে আছে...ভেতরে আসুন...” নীলিমা দাওয়ার দিকে হাঁটতে শুরু করেই বুঝলেন, ব্যাপারটা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। সরকারি অফিসাররা তাঁর হাঁটা দেখলেই, তাঁর দুর্বলতার কথা বুঝে ফেলবে। অধৈর্য হয়ে উঠবে, বিরক্ত হবে, যেন তাদের সময়ের খুবই অভাব। নীলিমাদেবী আমাদের কত কাজ, আপনার হাতে চিঠি পৌঁছে দেওয়াটাই আমাদের একমাত্র কাজ নয়নীলিমা জানেন, যতদিন শরীরে শক্তি থাকে, মানুষ অশক্তদের অবজ্ঞা মেশানো সহানুভূতি বোঝাতে কসুর করে না। হলও তাই।

চারজনের মধ্যে তিনজন তাদের ঘড়ি দেখল। সঞ্জয়বাবু বললেন, “আপনি বুঝি একলাই থাকেন? সঙ্গে কেউ নেই? এই বয়সে এমন একা, একা...! এই হয়, জানেন? আপনি সারাজীবন কত আর্ত-অসহায়কে সাহায্য করেছেন, এখানকার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন, অসুখ-বিসুখে বুক দিয়ে সেবা করেছেন...আর দেখুন, আজ শেষ বয়সে আপনাকেই দেখার কেউ নেই? এরা এমনই হয়, জানেন?”

নীলিমা দাওয়ায় ওঠার সিঁড়িতে পা রেখে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন সঞ্জয়বাবুর দিকে, বেশ ঝাঁজালো স্বরে বললেন, “এরা কেমন হয়, আপনি কী করে জানলেন? থাকেন তো সদর শহরে, এদের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে।”

“ন্‌না...মানে ইয়ে...কথার কথা...বললাম আর কী?” ভদ্রলোক একটু থতমত খেয়ে বললেন। নীলিমা ততক্ষণে ঘরের ভেতর ঢুকে গেছেন। দাওয়ার সামনে, সঞ্জয়বাবুর সঙ্গী রজতবাবু বললেন, “বাপরে বুড়ি হেভি টেঁটিয়া তো! এই বয়সেও কী তেজ?”। সঞ্জয়বাবু চোখের থেকে চশমাটা হাতে নিয়ে উঠোনের চারদিক দেখতে দেখতে বললেন, “কিছুটা হলেও আমি জানি, সারাটা জীবন এ অঞ্চলের মানুষদের জন্যে নীলিমাদেবী কী করেছেন। আর এই অঞ্চলে ওঁর কতখানি জনপ্রিয়তা! আপনাদের মন্ত্রিমশাইও সে কথা ভালোভাবেই জানেন, রজতবাবু, তা নইলে কি আর রাতারাতি উনি এই প্রাইজ পেয়ে যান? নাকি নিজে এসে ওঁনার হাতে অ্যাওয়ার্ড তুলে দেওয়ার গরজ দেখান?”

রজতবাবু রুলিং পার্টির লোক, স্থানীয় নেতা, তিনি একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনারা মানে প্রশাসনের লোকেরা, সব কিছুই ব্যাঁকা চোখে দেখেন, কিন্তু এসময় আপনার একথাটা এভাবে বলাটা ঠিক হচ্ছে না, স্যার। আমাদের পার্টি সবসময় গুণীজনের সম্মান করে সেটা তো মানবেন?” সঞ্জয়বাবু ঠোঁটে হাসি নিয়ে বললেন, “সে কথা না মেনে উপায় আছে? আপনারা গুণীজনের সম্মানের সঙ্গে ভালোভাবেই জানেন ভোট গুনতে...”।

তাঁর কথা শেষ হবার আগেই নীলিমা ঘর থেকে বেরিয়ে দাওয়ায় এলেন, হাত বাড়িয়ে পেন আর কাগজটা সঞ্জয়বাবুর হাতে ফেরত দিয়ে জিগ্যেস করলেন, “প্রাইজ আনতে কোথায় যেতে হবে? আমার অবস্থা তো দেখছেন, কোথাও যাবার কথা চিন্তা করলেই আজকাল গায়ে জ্বর আসে”। সঞ্জয়বাবু কিছু বলার আগেই, রজতবাবু বলে উঠলেন, “আমরা রয়েছি কী করতে, ঠাক্‌মা? আপনাকে কোত্থাও যেতে হবে না। পরশুদিন সকালে মিনিস্টারস্যার নিজে আসছেন আপনার বাড়ি! তিনি নিজে এসে আপনার হাতে প্রাইজ তুলে দেবেন। আপনার সঙ্গে আলাপ করবেন তিনি নিজে। তিনি বলেছেন, আপনি আমাদের সকলের মায়ের মতন। তিনি নিজেও আপনার ছেলের মতো”। প্রত্যেকবার “তিনি নিজে” কথাটা বলছিলেন বড়ো জোরের সঙ্গে, যেন ওটাই আসল কথা!

খুব অবাক এবং ভয় পাওয়া সুরে নীলিমা বললেন, “আমার এই বাড়িতে আসবেন, মিনিস্টার? কবে?”

সঞ্জয়বাবু বললেন, “হ্যাঁ, নীলিমাদেবী, আমাদের কাছে সেরকমই ইন্সট্রাকশন এসেছে। মিনিস্টারস্যার পরশুদিন আপনার বাড়ি আসবেন। চিন্তা করবেন না, আমরা আছি। তাছাড়া রজতবাবুরা তো আছেনই - যা কিছু করার সব ওঁরাই করবেন”

নীলিমা বললেন, “কী করবেন?”

রজতবাবু বললেন, “ঠাক্‌মা, বুঝতেই তো পারছেন, মিনিস্টার মানে ভিআইপি। তাঁর আসার মতো এই বাড়িটাকে সাজিয়ে তুলতে হবে। তাছাড়া তাঁর সিকিউরিটির ব্যাপার আছে, অনেক বডিগার্ড থাকবে। বাড়ির চারপাশটা ঠিকঠাক করতে হবে...”

নীলিমা আতঙ্কিত সুরে বললেন, “বাড়ির চারপাশ ঠিকঠাক মানে?”

রজতবাবু খুব সাবলীল সুরে বললেন, “আশেপাশের বাড়িগুলো সব খালি করতে হবে যে, ঠাক্‌মা। মিনিস্টার স্যারের নিরাপত্তা নিয়ে তো আর ছেলেখেলা করা যায় না! কার মনে কী আছে, কোন ঝুঁকি নেওয়াটা  ঠিক হবে না! তাছাড়া এই উঠোনটাকেও গুছিয়ে নিতে হবে, ওই, ওই দিকের ঝোপঝাড়গুলো সাফ করতে হবে...”

নীলিমা আরো অবাক হয়ে বললেন, “ওদিকে ঝোপঝাড় কোথায়? ওগুলো তো ফুলগাছ, টগর, কাঞ্চন, জবা, শিউলি...”।

রজতবাবু নিশ্চিন্ত সুরে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ ওই...ওইগুলোই...ওগুলোকে সাফ না করলে মিনিস্টারের সঙ্গে যে সব গেস্ট আসবেন, প্রেসের লোকজন আসবে, আমাদের ছেলেরা আসবে, সিকিউরিটি, পুলিশ, প্রশাসনের লোকজন...তারা সব দাঁড়াবে কোথায়? ও নিয়ে আপনি ভাববেন না, ঠাক্‌মা, যা করার আমি আর আমার ছেলেরা করে নেব...”।

নীলিমা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন দাওয়ার খুঁটি আঁকড়ে, একটা কথাও বলতে পারলেন নাসঞ্জয়বাবু আবার আধা নমস্কার করে বললেন, “আজ আমরা তাহলে চলি, নীলিমাদেবী? হাতে খুব বেশি সময়ও নেই, মাঝে মাত্র একটাই দিন। মিনিস্টারের ভিজিট বলে কথা, এ কী সামান্য ঝক্কি?” নীলিমার উত্তরের অপেক্ষা না  করে চারজনেই বেরিয়ে গেলেন, বাড়ির বাইরে। যাওয়ার সময় টেনে দিয়ে গেলেন সদর দরজাটা।

 

 

ওরা চারজন চলে যাওয়ার পর তিনি দাওয়াতেই বসেছিলেন। ভাবছিলেন, সরকারি অফিসার আর পার্টির নেতার কথাগুলো। তাঁর অ্যাওয়ার্ড পাওয়াটা কী এতই আনন্দের ব্যাপার! যে আনন্দের জন্যে ঘর ছাড়তে হবে তাঁর এতদিনের পড়শীদের? বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ওরা যাবে কোথায়? অনেকেরই আবার তাঁর মতোই বয়স্ক বাপ-মা আছে। তাদের নিয়ে? আর তাঁর নিজের হাতে লাগানো ওই ফুলগাছগুলো? যারা তাঁর সঙ্গে কথা বলে, হাসে। ফুল ফুটিয়ে তোলে অজস্র। ফুটে ওঠা প্রত্যেকটি ফুল কি তাদের ভালোবাসার হাসি নয়?  কত বছর ধরে, ওরা রয়েছে তাঁর সঙ্গেওদের ওরা সাফ করে ফেলবে? কেটে ফেলবে? ভিআইপি মিনিস্টারের পক্ষে ওরা মোটেই নিরাপদ নয়? ওদের সরিয়ে কিছু উটকো লোক এসে ওখানে দাঁড়াবে নিরাপত্তার কারণে?

বহুদিনের পুরোন সেই ভয়ংকর দুর্ঘটনার কথাও এখন তাঁর মনে পড়ে গেল। সেদিন সেই দুর্ঘটনায় তিনি হারিয়েছিলেন তাঁর সন্তান এবং সেই সন্তানের পিতাকে। সেই ভয়ংকর স্মৃতি থেকে পালিয়ে এসেছিলেন বহুদূরের এই নির্বান্ধব জগতে। প্রথমদিকে এই গ্রামে তাঁর হঠাৎ উড়ে এসে বসা এবং গায়ে পড়ে প্রতিবেশীদের খোঁজখবর নেওয়া, এখানকার কেউই ভাল চোখে দেখেনি। তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে সকলেই সন্দিহান ছিল। কিন্তু তিনিও পিছিয়ে যাননি, হাল ছেড়ে ফিরে যাননি তাঁর বাবা-মা দাদার সংসারে। তাঁকে বোঝানোর অনেক চেষ্টাই করেছিলেন তাঁরা – বাবা, মা, দাদা-বৌদি, তাদের ছেলে-মেয়ে। কোন কিছুই তাঁকে আবার শহরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি, না তাঁর মায়ের চোখের জল, না এখানকার মানুষগুলোর সন্দিগ্ধ দৃষ্টি!

ঠিক কী ভাবে এবং কবে থেকে তিনি এই গ্রামেরই একজন হয়ে উঠেছিলেন, সে কথা খেয়াল করে মনে রাখেননি। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি একদিন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, এরা তাঁকে মেনে নিয়েছে। এদের দুঃখেসুখে, আধি-ব্যাধিতে তিনি এদের পাশে থাকবার স্বীকৃতি আদায় করে নিতে পেরেছেন। তাঁর কাছে লেখাপড়া শুরু করে, অনেক ছেলেমেয়েই শহরের স্কুলে, কলেজে গিয়ে এখন উচ্চশিক্ষিত - অনেকেই এখন শহরের শিক্ষিত সমাজে জায়গা করে নিয়েছে সসম্মানে। বেশ কবছর হল, শুধু এই গ্রামেই নয়, আশেপাশের অনেক-অনেক গ্রামের হতদরিদ্র মানুষগুলির সময়ে-অসময়ে অন্যতম তিনিই সহায়।

এই মানুষগুলির সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত তাঁর এই দীর্ঘ সম্পর্কের স্বীকৃতি এই অ্যাওয়ার্ড! তাঁর এই অ্যাওয়ার্ড জয়ের বিরল সম্মানে ঘরছাড়া হবে, তাঁর আশেপাশের এই পড়শি মানুষগুলি? তিনি বরাবর যাদের সহায় থাকতেন চেয়েছেন, তাদের তিনি বিপন্ন করবেন, হঠাৎ কপাল খুলে পেয়ে যাওয়া এই অ্যাওয়ার্ডের জন্যে? কিন্তু এই বয়সে পাওয়া এই অ্যাওয়ার্ড তাঁকে কী দেবে? দেশ জোড়া খ্যাতি? এই অ্যাওয়ার্ডের মেডেল গলায় দুলিয়ে, আর কোন নতুন শক্তি তিনি ফিরে পাবেন, যার বিনিময়ে এতগুলো লোককে অকারণ বিরক্ত করা চলে?

 বেশ শব্দ করে খুলে গেল সদর দরজার পাল্লাটা! নীলিমা চমকে উঠলেন। আবার কে এল? ওরা কী এসে গেল, তাঁর আশেপাশের ঘরগুলি খালি করতে? অথবা তাঁর ফুলের গাছগুলিকে উৎখাত করতে? দরজার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলেন নীলিমা, কে এল? দরজা দিয়ে ঢুকে এল ঊষা, তার পেছনে এপাড়ার অনেকগুলি মেয়ে-বউ। ঊষার আসার কথা ছিল অনেক আগেই। সুষি ব্যবস্থা করে গিয়েছিল, সে দাদার বাড়ি থেকে না ফেরা পর্যন্ত ঊষা এসে থাকবে নীলিমার সঙ্গে। ঘরের কাজ-টাজ সেরে আসতে দেরি করেছে হয়তো। এখন একমুখ হাসি নিয়ে লাফাতে লাফাতে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল নীলিমাকে। বলল, “ও দিদা, তুমারে নাকি সরকার পেরাইজ দিবে! গাঁয়ের সক্কলে বলতিছে! সত্যি বটে গো? তুমার কাছে কারা সব এয়েছিল, তারা নাকি সরকারি লোক?” ঊষার পিছন পিছন এসে দাঁড়ানো মেয়েবউগুলোর চোখেও আনন্দ কৌতূহল। নীলিমা ওদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমাদের ওরা কিছু বলেনি?”

“কারা?”

“ওই যে সরকারি লোক আর পার্টির নেতারা?”

“কই, না তো! আমাদিকে আবার কী কইবে, উয়ারা আমাদিকে মানুষ বলে গণ্যি করে নাকি?”

“বলেনি? পরশু মিনিস্টার আসবে, আমাকে প্রাইজ দিতে?”

সকলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে অবাক আনন্দে, ওদের মধ্যে গণার মা বলল, “বলো কী, মায়ি, মিনস্টর? সেই যে গলায় মালা লিয়ে সভায় খুব বক্তিমে দেয়? হাতজোড় করে বারবার নমস্কার করে? আমি দেকিচি একবার, সেবার গণার বাপের সঙ্গেরে সদরে গেচলম, ওকেনে মিটিং ছ্যালো। আমি দেকিচি। সেই মিনস্টর?”     

নীলিমা ম্লান মুখে বললেন, “মিনিস্টার আসছে বলল, কোন মিনিস্টার সে আর আমি জিগ্যেস করিনি”।

ঊষা ভীষণ খুশি হয়ে বলে উঠল, “সে যাই হোক দিদা, আমাদের গাঁয়ের পেস্টিজটা কোথায় দাঁড়াবে একবার কওদিনি? এ দিগরে কোন গাঁয়ে কোন মিনস্টার এয়েচে, বলো?”

“মিনিস্টার এলে, তোদের সক্কলকে যে ঘর ছেড়ে দিতে হবে, মা। কদিনের জন্যে জানি না, হয়তো দুদিন, অথবা আরও বেশি...”।

গণার মা অবাক হয়ে বলে উঠল, “ক্যানে? তুমি পেরাইজ পেলে, আমাদিগে ঘর ছাড়তি হবে ক্যানে?”

“ওই যে বললি, মিনিস্টার আসছে। সে তো একজন কেউকেটা বটে। তাকে তোরা যদি মেরে ফেলিস?”

উপস্থিত সকলের কণ্ঠ থেকে বের হল আতঙ্কের সুর। ঊষা বলল, “আমরা মেরে ফেলাব? মিনস্টারকে?”

“আহা যদি মেরে ফেলিস? তাইতো ওরা বলল, তোদের ঘর থেকে বের করে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেবে। মিনিস্টারের জীবন নিয়ে তো আর ছেলেখেলা করা যায় না। তার সঙ্গে কত বড়ো বড়ো লোক আসবে, পুলিশ আসবে। ওদের সঙ্গে টিভির লোকেরাও আসবে ছবি তুলতে। সকলেরই জীবনের দাম আছে! আর আমার ওই ফুলগাছগুলোকেও ওরা কেটে ফেলবে”।

গণার মা গলায় ঝাঁজ মিশিয়ে বলল, “ওরাও বুজি মিনিস্টারকে মেরে ফেলতে পারে? মিনস্টারের জেবন এতই ঠুনকো যদি থালে সে আসচে ক্যানে, আমাদের গাঁয়”?

নীলিমা মুখ নিচু করে মাথা নাড়লেন, বললেন, “আমি মানা করে দেব, ওরা আসবে না। আমি প্রাইজ নেব না গণার মা বলল, “পেরাইজ নেবেনি?”

“না, তোদের তাড়িয়ে দিয়ে, আমার কোন প্রাইজের প্রয়োজন নেই”।

 

 

মিনিস্টার সায়েবের বসার ঘরে সকাল সাতটা নাগাদ এসে প্রায় ঘন্টা দুয়েক হতে চলল। রজতবাবু আর সঞ্জয়বাবু ঠায় বসে আছেন। রজতবাবু মাঝে মাঝেই শিউরে উঠছেন, আর চাপা গলায় সঞ্জয়বাবুকে জিগ্যেস করছেন, “কী হবে বলুনতো?” তুমুল ঝাড় যে খেতেই হবে, সেটা নিশ্চিত। কিন্তু কথাটা এখনই না বললেও তো নয়! নীলিমাদেবীকে অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার খবরটা কাল সন্ধ্যে থেকে সবকটা টিভি চ্যানেলে অনবরত দেখিয়ে চলেছে। এক্সক্লুসিভ, ব্রেকিং নিউজ। একই খবর, বারবার, লাগাতার। আজ সকালে সবকটা পেপারের হেডলাইনে এসে গেছে খবরটা। এদিকে গতকাল একটু সন্ধের পর বুড়ি পার্টির দপ্তরে খবর পাঠিয়েছে, তিনি অ্যাওয়ার্ড নেবেন না। খবরটা পেয়েই রজতবাবু আর সঞ্জয়বাবু পড়িমরি দৌড়ে গিয়েছিলেন ওই ধ্যাদ্ধেড়ে ধুলোওড়া গ্রামে। বুড়িটা হঠাৎ খেপে গেল কেন, সেটা জানতে। বলা যায় না, হতভাগা বিরোধীরা কিছু উস্কানি দিয়েছে, ওদেরই চক্রান্ত হয় তো!

রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বুড়ির বাড়ি গিয়ে যা শুনলেন, তাতে দুজনেরই, চক্ষু চড়কগাছ! বুড়ি যে হেব্বি টেঁটিয়া, সেটা রজতবাবু বেশ বুঝেছিলেন, কিন্তু সে যে এতটা, তা বুঝতে পারেননি। বুড়ি অ্যাওয়ার্ড নেবে না! নেব না বললেই হল? মামার বাড়ির আব্দার নাকি? মিনিস্টার ঠিক করেছেন, অ্যাওয়ার্ড দেবেন, তার ওপরে কথা হয়? কেন নেবেন না? পঞ্চাশবার জিগ্যেস করেও তার উওর পাওয়া গেল না। ঘাড়ত্যাড়া বুড়ির একটাই কথা “না”। শেষে অনেক কথা চালাচালি করে বোঝা গেল, বুড়ির পড়শিদের আগামীকালই ঘর খালি করে অন্যত্র যাওয়ার কথা বলাতেই নাকি বুড়ির গোসা! ওরা কেন যাবে, কোথায় যাবে? কোথায় আবার যাবে, জাহান্নমে যাবে। আরে, মিনিস্টার সায়েবের নিরাপত্তা নিয়ে এমন ছেলেমানুষী কথা কেউ কোথাও শুনেছে? বুড়ির ভিমরতি হয়েছে, তা নইলে এমন কথা কেউ বলে? মিনিস্টারের সিকিউরিটির ব্যাপারটা কিছুতেই তার নিরেট মাথায় ঢোকানো গেল না। শুরু থেকে শেষ অব্দি বুড়ির একটাই কথা, “না”!

গতকাল ওখান থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছিল, মিনিস্টার সায়েবকে তখনই খবরটা দেওয়া যায়নি। আজ সকালেই তাই দুজনে এসে উপস্থিত হয়েছে মিনিস্টারের ঘরে। অপেক্ষা করছেমিনিস্টার সায়েবের পিএকে সব বলা হয়েছে, কিন্তু পিএ তো পিএই। ঘরের দেওয়ালের মতো, চুপ করে বসে সব শুনল, কিন্তু কোন তাপ-উত্তাপ বা কোন মন্তব্য করল না। সব শোনার পর ঠোঁট উল্টে, ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, “স্যারকে বলে দেখুন, উনি কী বলেন?” রজতবাবুর রাগ হল খুব, সে তো বলবই, কিন্তু তুমি আছ কী করতে? এই সময়ে তোমার স্যারকে একটু ম্যানেজ করতে পার না? তাহলে আর তুমি কিসের পিএ, হে?

সাড় আটটা নাগাদ মিনিস্টার সায়েব বসার ঘরে এসে বললেন, “জীবন বলছিল, আপনারা অনেকক্ষণ এসে বসে আছেন? কালকের অনুষ্ঠানের অ্যারেঞ্জমেন্ট সব রেডি নাকি?” জীবন মিনিস্টার সায়েবের পিএ-র নাম। সঞ্জয়বাবু বললেন, “ইয়ে...মানে এদিকে একটা মুশকিল দেখা দিয়েছে, নীলিমাদেবী বলেছেন...”।

মিনিস্টার সায়েব উল্টোদিকের সোফায় আরাম করে বসে বললেন, “অ্যাওয়ার্ড নেবেন না, তাই তো? ঠিকই তো বলেছেন? আপনারা মাথামোটা, ওঁনার সঙ্গে গেছেন রাজনীতি করতে?” রজতবাবু অবাক হয়েছিলেন খুব, তাঁর ধারণা ছিল, তাঁর মুখে প্রথম শুনে মিনিস্টারসায়েব বোমার মতো ফেটে পড়বেন। কিন্তু সেসব কিছুই হল না, উল্টে তিনি লক্ষ্য করে দেখলেন, মিনিস্টারসায়েব মোটামুটি খোশমেজাজেই রয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যে থেকে তাঁর মনের মধ্যে অসম্ভব আতঙ্কের যে একটা চাপ ছিল, সেটা অনেক হাল্কা হয়ে এল।

তিনি প্রায় সবকটি দাঁত বের করে বিগলিত হেসে বললেন, “আপনি তো সবই জানেন, স্যার...আমরা জাস্ট ওঁনাকে খবরটা দিতে গিয়েছিলাম...তাতেই উনি একেবারে বিগড়ে গেলেন...”।

মিনিস্টার সায়েব বাঘের মতো গর্জন করে উঠলেন, “ইডিয়েট। খবর দিতে গেছিলেন, নাকি দাদাগিরি করতে গেছিলেন? এতদিন এই লাইনে রয়েছেন, দাদাগিরি ছাড়া অন্য আর কিছু বোঝেন? কে বলেছিল, ওঁনার পাড়ার লোকেদের ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে? কিসের জন্যে?”

এই প্রবল ধমকানিতে রজতবাবুর বুকটা আবার কেঁপে উঠল, কোনরকমে বললেন, “সে তো আপনার সিকিউরিটির জন্যে স্যার। আপনার আর অন্যান্য গেস্টদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। ছোটলোকের গ্রাম তো, স্যার। কার পেটে কী বজ্জাতি লুকিয়ে আছে, বলা তো যায় না, স্যার?”

“রজত, তুমি যে শুধু একটা আস্ত গাধা, তাই নয়, তুমি অত্যন্ত ইতর। দুবেলা ভরপেট খেতে না পাওয়া ওই গ্রামের গরিব মানুষগুলোকে তুমি ছোটলোক বলছো? তোমার মতো ছোটমনের লোককে আমি আমাদের দলে চাই না। কালকের অনুষ্ঠানটা মিটলে, পরশু শহরে গিয়েই আমি তোমার নামে কমপ্লেন করবো। কী ভেবেছো কী? নিজেকে খুব বড়ো নেতা মনে করো?” রাগে আর উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলেন, মিনিস্টার সায়েব। পিএ জীবন একগ্লাস জল এগিয়ে দিলেন, মিনিস্টার সায়েবের দিকে। গেলাস থেকে একচুমুক জল খেয়ে গেলাসটা ফিরিয়ে দিলেন জীবনের হাতে, তারপর বললেন, “সঞ্জয়বাবু, কালরাত্রেই আমার কাছে সব খবর এসেছিল। আমি আমাদের লোকদের স্পেসিফিক্যালি বলে দিয়েছি, কোনরকম বাড়াবাড়ি যেন না হয়। বেশি ভিড়ভাট্টা করে দলবাজিও যেন না হয়। এখানকার দুই কলেজের প্রিন্সিপাল থাকবে, ডিসি, এসি থাকবে। দশ-বারো জনের বেশি পুলিশ ফোর্সের দরকার নেই। আর থাকবে দুটো চ্যানেলের রিপোর্টাররা তাদের সঙ্গে ক্যামেরা-ট্যামেরার তাম্‌ঝাম্‌ নিয়ে, ব্যস্‌আর কেউ না”

সঞ্জয়বাবু খুব বশংবদ স্বরে উত্তর দিলেন, “তাই হবে, স্যার”।

“আপনি এখনই বেরিয়ে পড়ুন, সারাদিন ওখানে থেকে সব ঠিকঠাক অ্যারেঞ্জ করুন, আর লোকাল মানুষদের মনে কোনরকমেই কোন ক্ষোভ, বিরক্তি বা ভয় যেন না আসে, সেটা দেখাও আপনার কর্তব্য”।

সঞ্জয়বাবুর সঙ্গে রজতবাবুও সোফা ছেড়ে উঠছিলেন। মিনিস্টার সায়েব বললেন, “সঞ্জয়বাবু, আপনি বাইরে পাঁচমিনিট ওয়েট করুন, রজতকে দুটো কথা বলেই আমি ছেড়ে দিচ্ছি”।

সঞ্জয়বাবু নিচু হয়ে নমস্কার করে বললেন, “ও কে, স্যার, নো প্রবলেম, স্যার”। সঞ্জয়বাবু ঘর থেকে বের হতেই মিনিস্টার সায়েব আবার ধমকানির সুরে রজতবাবুকে বললেন, “নীলিমাদেবীকে অ্যাওয়ার্ডটা আমরা কেন দিচ্ছি, তোমার কোন আইডিয়া আছে, রজত?”

“মানে...ইয়ে...যদ্দূর জানি, ওই ভোটের হিসেব আর কি?”

“লাস্ট ইলেকশনে ওই দিকের ব্লকগুলোতে আমরা সাড়ে দশ হাজারে পিছিয়েছিলাম, মনে আছে?”

“হ্যাঁ স্যার, ওটা আমাদের দলের সুখেনের কারসাজি ছিল, স্যার। আমাকে বাঁশ দেওয়ার জন্যে হারামজাদা বিশ্বাসঘাত করেছিল...”।

“তুমি গাড়লের থেকেও আজেবাজে কিছু একটা, রজত। সুখেনের পেছনে পঞ্চাশ-একশর বেশি লোক নেই, সেখানে সাড়ে দশহাজার এল কোত্থেকে? আর সুখেন যদি প্রবলেম করে, তাকে সামলানোর দায়িত্ব কার – তোমার না আমার”? রজত মুখচুণ করে বসে রইল সোফায়। মিনিস্টার সায়েব আবার বললেন, “ওদিকের গরীবগুর্বো মানুষদের ওপর নীলিমাদেবীর খুব প্রভাব। ওঁকে ওদিকের গাঁয়ের লোকেরা ভীষণ মান্যি করে, সেটা জানো? নীলিমাদেবীকে এখন অ্যাওয়ার্ডটা দিলে, ভোটের সময় আমরা পাব রিওয়ার্ড! ওখানকার মানুষগুলোর মনের মধ্যে একবার ঢুকে পড়তে পারলেই, বাস্‌, কেল্লা ফতে, সব ভোটে এসে জমা হবে আমাদের বাক্সে! নিরেট মাথায় ঢোকাতে পারলাম?”

“হ্যাঁ, স্যার”।

“শুনলাম তুমি কাল, নীলিমাদেবীকে প্রণাম করোনি, একটা নমস্কারও করোনি? বাজারের ষাঁড়ের মতো গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়েছিলে? এভাবে তুমি রাজনীতি করবে, রজত? নেতা হয়েছো বলে, মানীর মান রাখবে না? এখন যাও যেমন বললাম, সব রেডি কর। বেশি ছেলেপুলে সঙ্গে নিয়ে যাবে না, বাছাবাছা কিছু ছেলে নিয়ে যাবে। তারা যেন মারমুখো না হয়। আরা তারা কী শ্লোগান দেবে ঠিক করেছো?”

মিনিস্টার সায়েবের এমন সহজ প্রশ্নে রজতবাবু বিস্মিত হলেন খুব, বললেন, “আজ্ঞে... ইয়ে...আপনার নামে...আর পার্টির নামে...জিন্দাবাদ...”।

মিনিস্টার সায়েব বিরক্ত হয়ে মুখ ভেংচে বললেন, “তুমি একটি আস্ত ছাগল। এতক্ষণ কী বোঝালাম? আমার নাম, পার্টির নাম ভুলেও উচ্চারণ করবে না। বলবে, “সবার মা, নীলিমা”“নীলিমায়িকি জয়”মনে থাকবে? গোটা অনুষ্ঠানে কোন রাজনৈতিক রং যেন না লাগে...বোঝা গেল? যাও, এবার বিদেয় হও”।

 

 

অনুষ্ঠানটা ভালোয় ভালোয় মিটে গেল সকাল দশটার একটু আগেই। এ একদিকে ভালই হয়েছে, চৈত্রের রোদ একটু বেলা হলেই পিঠ পোড়ায়। আকাশে ধুলো উড়িয়ে গোটা দশেক নানান সাইজের গাড়ি বেরিয়ে গেল গ্রাম থেকে, এখন নিশ্চিন্ত। নীলিমার দাওয়ায় অনেকেই রয়েছে, তাঁকে ঘিরে। সকলের মুখই আনন্দে আর খুশিতে উজ্জ্বল। সব থেকে খুশি হয়েছে ঊষা আর সুষি। সুষি অনেকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখছিল মেডেলটা। মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে দু-তিনবার বলেছিল “ম্যাডেল” – যেন বীজমন্ত্র আওড়াচ্ছে! ঊষাতো মেডেলটা নিজের গলায় পরে সকলকে দেখাচ্ছে, “হ্যাদ্দাখ, কেমন লাগতিছে ম্যাডেল পরে!” ওটা রেপ্লিকা, আসলটা আছে ছোট্ট গয়নার বাক্সে নীলিমার হাতে। যে বিশাল মালাটা ওরা নীলিমার গলায় পরিয়েছিল, সেটা খুব যত্ন করে কেউ ঝুলিয়ে দিয়েছে, ঘরের দরজার ডানদিকের হুকে, ওখানে একটা ক্যালেণ্ডার রয়েছে, সেটা এখন ঢাকা পড়ে গেছে। আজকের এই দিনটা নীলিমার জীবনে এবং এই পিছিয়ে থাকা গ্রামগুলোর জীবনেও, অন্য সব দিনকে যেন ঢেকে দিল!

ধোপভাঙা সরুপাড় সাদা শাড়ি আর জামায়, আজ নীলিমাকে অন্য রকম দেখাচ্ছিল, বেশ স্নিগ্ধ, শুদ্ধ, পবিত্র - যেন দেবী, নীলিমাদেবীএখানকার মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁর এতদিনের এত কাছের সম্পর্ক, কিন্তু কেউ কোনদিন তাঁকে প্রণাম করেছে এমন মনে পড়ে না তাঁর। এদের সকলের চোখের দৃষ্টিতে থাকে কৃতজ্ঞতা, আর মুখের হাসিতে থাকে আন্তরিক ভালোবাসা, সেখানে প্রণামের কথা কারও মনেই আসেনি। গতকাল এবং আজ শহরের ওই লোকগুলো, এমনকি ওই মিনিস্টার সায়েবও নিচু হয়ে পরম ভক্তি ভরে প্রণাম করল তাঁকে!

ঊষা উঠোনময় নেচে নেচে বারবার মেডেলটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল, একসময় হঠাৎ চেঁচিয়ে জিগ্যেস করল,  “ও দিদা, এ ম্যাডেলখান কী সোনার?”

তাঁকে ঘিরে বসে থাকা উঠোনের সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে নীলিমা ম্লান হেসে বললেন, “ধুর ক্ষেপি, সবটাই তো মেকি”!

 

..০০..

            

নতুন পোস্টগুলি

ভূতের ভরসা

  ১   ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা দিয়ে কলেজে এখন ছুটি। সর্বজিৎ প্রফুল্লনগরে এসেছে মাসী্মার বাড়ি বেড়াতে। এই জায়গাটা সর্বজিতের খুব পছন্দের জায়গা।...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ