শুক্রবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

কেনোপনিষদ - খণ্ড ১ ও ২

 

এই উপনিষদের প্রথম শব্দ ‘কেন’, এই কারণে এই উপনিষদের নাম কেনোপনিষদ। এই “কেন” শব্দের অর্থ – কেন বা why নয়। কেন এই সংস্কৃত শব্দের অর্থ কাহার দ্বারা – অর্থাৎ জগতের সমস্ত ঘটনা কে ঘটাচ্ছেন?  এ উপনিষদটি চার খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম দু খণ্ড পদ্যে এবং শেষ দুই খণ্ড গদ্যে লিখিত। অনেক পণ্ডিতের মতে, এই উপনিষদের গদ্যাংশ, পদ্যাংশের অনেক আগেই রচিত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে আরও মনে রাখতে হবে – ঋগ্বেদ থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের অধিকাংশ শাস্ত্রীয় রচনা ছন্দবদ্ধ পদ্যাকারে রচিত – গদ্য রচনা যথেষ্ট বিরল। অতএব, এই উপনিষদের গদ্যাংশ ভারতের প্রাচীনতম গদ্যরচনার অন্যতম নিদর্শন।    

ঈশোপনিষদের মতো কেনোপনিষদেরও উদ্দেশ্য অমৃতত্ব লাভ এবং ব্রহ্মের সঙ্গে জগৎ ও জীবের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। তবে ঈশোপনিষদের মতো এই উপনিষদের বিষয় এত ব্যাপক নয়। এর বিষয় জীব-আত্মার সঙ্গে ব্রহ্ম-আত্মার সম্বন্ধ স্থাপন। প্রথমে শিষ্য-গুরু প্রশ্ন ও উত্তরের মাধ্যমে, তারপর একটি রূপক কাহিনীর সাহায্যে ব্রহ্মতত্ত্বের আলোচনা করা হয়েছে। 

শান্তিপাঠ

 

ওঁ সহ নাববতু, সহ নৌ ভুনক্তু, সহ বীর্যং করবাবহৈ তেজস্বি নাবধীতমস্তু,

মা বিদ্বিষাবহৈ।।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

ওঁ সহ নৌ অবতু, সহ নৌ ভুনক্তু, সহ বীর্যং করবাবহৈ তেজস্বি নৌ অধীতম্‌ অস্তু,

মা বিদ্বিষাবহৈ।।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

 

আমাদের দুজনকে তিনি সমভাবে রক্ষা করুন, দুজনকেই সমভাবে (জ্ঞান) লাভ করান, আমাদের উভয়কেই (জ্ঞানলাভের) উপযুক্ত করে তুলুন। আমাদের উভয়ের কাছেই লব্ধজ্ঞান যেন তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। (আমরা যেন পরষ্পরের প্রতি) বিদ্বেষ না করি।  ওঁ শান্তি, সকল বিঘ্নের শান্তি হোক।

 

ওঁ আপ্যায়ন্তু মমাঙ্গানি বাক্‌ প্রাণশ্চক্ষুঃ শ্রোত্রমথো বলমিন্দ্রিয়াণি চ সর্বাণি। সর্বং ব্রহ্মৌপনিষদম্‌। মাহং ব্রহ্ম নিরাকুর্যাং, মা মা ব্রহ্মা নিরাকরোৎ অনিরাকরণমস্তু।

অনিরাকরণং মেঽস্তুতদাত্মনি নিরতে য উপনিষৎসু ধর্মাস্তে ময়ি সন্তু, তে ময়ি সন্তু। ওঁ শান্তিঃ  ওঁ শান্তিঃ  ওঁ শান্তিঃ ।।

 

ওঁ আপ্যায়ন্তু মম অঙ্গানি বাক্‌ প্রাণঃ চক্ষুঃ শ্রোত্রম্‌ অথ বলম্‌ ইন্দ্রিয়াণি চ সর্বাণি। সর্বং ব্রহ্ম ঔপনিষদম্‌। মা অহং ব্রহ্ম নিরাকুর্যাং, মা মা ব্রহ্মা নিরাকরোৎ অনিরাকরণম্‌ অস্তু।

অনিরাকরণং মে অস্তুতৎ-আত্মনি নিরতে য উপনিষৎসু ধর্মাঃ তে ময়ি সন্তু, তে ময়ি সন্তু। ওঁ শান্তিঃ  ওঁ শান্তিঃ  ওঁ শান্তিঃ ।।

 

আমার সমস্ত অঙ্গ – বাক, প্রাণ, চোখ, কান, বল ও সকল ইন্দ্রিয় পুষ্টিলাভ করুক। এই সমস্তই যে ব্রহ্মের স্বরূপ, সেই তত্ত্বই এই উপনিষদ।  আমি যেন ব্রহ্মকে অস্বীকার না করি, ব্রহ্ম যেন আমাকে প্রত্যাখ্যান না করেন, কখনোই প্রত্যাখ্যান না করেন।

তাঁর সঙ্গে আমার নিত্যসম্বন্ধ থাকুক। উপনিষৎ সমূহে যে ধর্ম তত্ত্ব আছে, তারা আমার আত্মায় নিযুক্ত হোক, সেই আত্মায় আমি নিরত হই। ওঁ শান্তি, সকল বিঘ্নের শান্তি হোক।

 

প্রথম খণ্ড

 

কেনেষিতং পততি প্রেষিতং মনঃ

কেন প্রাণঃ প্রথমঃ প্রৈতি যুক্তঃ।

কেনেষিতাং বাচমিমাং বদন্তি

চক্ষুঃ শ্রোত্রং ক উ দেবো যুনক্তি।। ১/১

 

কেন ইষিতং পততি প্রেষিতং মনঃ

কেন প্রাণঃ প্রথমঃ প্রৈতি যুক্তঃ।

কেন ইষিতাং বাচম্‌ ইমাং বদন্তি

চক্ষুঃ শ্রোত্রং ক উ দেবঃ যুনক্তি।। ১/১

 

কার ইচ্ছায় এবং নির্দেশে আমাদের মন চালিত হয়? কার আদেশে প্রধান প্রাণ নিজ কাজে নিযুক্ত হয়? কার ইচ্ছায় মানুষ এত কথা বলে, কোন জ্যোতির্ময় পুরুষই বা চোখ, কানকে নিয়ন্ত্রণ করেন? [এই প্রশ্নগুলির উত্তর জানতে কোন শিষ্য যেন তাঁর গুরুকে জিজ্ঞাসা করছেন।]

এখানে “প্রাণঃ প্রথমঃ” – অর্থাৎ প্রাণই প্রধান – প্রাণ ছাড়া কোন ইন্দ্রিয়ই কার্যক্ষম হয় না।  

 

শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং মনসো মনো যদ্‌

বাচো হ বাচং স উ প্রাণস্য প্রাণঃ।

চক্ষুষশ্চক্ষুরতিমুচ্য ধীরাঃ

প্রেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি।। ১/২

শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং মনসঃ মনঃ যদ্‌

বাচঃ হ বাচং স উ প্রাণস্য প্রাণঃ।

চক্ষুষঃ চক্ষুঃ অতিমুচ্য ধীরাঃ

প্রেত্য অস্মাৎ লোকাৎ অমৃতা ভবন্তি।। ১/২

   [শিষ্যের প্রশ্নের উত্তরে গুরু বলছেন] যাঁর শক্তিতে কান শুনতে পায়, মন চিন্তা করে, বাগেন্দ্রিয় কথা বলে, তাঁর শক্তিতেই প্রাণ উজ্জীবিত হয়, চোখ দেখতে পায়। তিনিই সমস্ত ইন্দ্রিয়ের চালক, পণ্ডিতেরা এই তত্ত্ব জেনে আত্মবুদ্ধি ত্যাগ করে, সংসারের ঊর্ধ্বে অমৃতলোক অনুভব করেন।   

 

ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছতি ন বাগ্‌গচ্ছতি নো মনঃ।

ন বিদ্মো ন বিজানীমো যথৈতদনুশিষ্যাৎ।। ১/৩

ন তত্র চক্ষুঃ গচ্ছতি ন বাক্‌ গচ্ছতি ন মনঃ।

ন বিদ্মঃ ন বিজানীমঃ যথা এতৎ অনুশিষ্যাৎ।। ১/৩

চোখ তাঁকে দেখতে পায় না, বাক্যে তাঁকে বর্ণনা করা যায় না, মনেও তাঁর কল্পনা করা যায় না। আমরা তাঁর স্বরূপ জানি না, অতএব কী ভাবে তাঁর কথা তোমাকে বলবো, তাও জানি না।


অন্যদেব তদ্বিদিতাদথো অবিদিতাদধি।

ইতি শুশ্রুম পূর্বেষাং যে নস্তদ্‌ব্যাচচক্ষিরে।। ১/৪


অন্যৎ এব তৎ বিদিতাৎ অথ অবিদিতাৎ অধি।

ইতি শুশ্রুম পূর্বেষাং যে নঃ তৎ ব্যাচচক্ষিরে।। ১/৪

আমাদের জানা, এমনকি অজানা সকল বিষয় থেকেই তিনি ভিন্ন, আমাদের পূর্ববর্তী গুরুদের কাছে এমন ব্যাখ্যাই আমরা শুনেছি।


যদ্বাচাঽনুভ্যুদিতং যেন বাগভ্যুদ্যতে।

তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে॥ ১/


যৎ বাচা অনুভ্যুদিতং যেন বাক্‌ অভ্যুদ্যতে।

তৎ এব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি ন ইদম্‌ যৎ ইদম্‌ উপাসতে॥ ১/

যাঁকে কথায় প্রকাশ করা যায় না, কিন্তু আমাদের বাক্য যিনি প্রকাশিত করেন, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানবে – কিন্তু যাঁকে আমরা উপাসনা করি, তিনি নন।

“ন ইদম্‌ যৎ ইদম্‌ উপাসতে” – অর্থাৎ যাঁকে আমরা উপাসনা করি, তিনি নন” - এই কথাটি পরবর্তী শ্লোকগুলিতে বারবার বলা হয়েছে কারণ এই বক্তব্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর আগের উপনিষদগুলি থেকে আমার জেনেছি – এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্ম প্রকৃতপক্ষে সর্বব্যাপী এক চেতন-পুরুষ বা আত্মা, তিনিই আমাদের সকল জ্ঞানের প্রকাশক। এই ব্রহ্মই আমাদের একমাত্র উপাস্য। কিন্তু আমরা যে সকল অনাত্ম জড়পদার্থে – অর্থাৎ দেবদেবীর মূর্তিতে - ব্রহ্মত্ব আরোপ করে, সেই দেবদেবীর উপাসনা করি – তাঁরা কেউই স্বরূপতঃ ব্রহ্ম নন। তাঁদের উপাসনা কখনোই ব্রহ্মোপাসনা হতে পারে না। এমনকি আমাদের সনাতন ধর্মে যে ত্রিমূর্তি বা ত্রিদেবের – ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের উপাসনা করা হয়, সেই ত্রিদেবের ব্রহ্মাও ব্রহ্ম নন। ব্রহ্মা সাকার কিন্তু ব্রহ্ম নিরাকার। ব্রহ্ম সর্বব্যাপী এবং সচ্চিদানন্দস্বরূপ, অব্যক্ত, অনির্বচ্চনীয় জগতাত্মা।     

 

যন্মনসা ন মনুতে যেনাহুর্মনো মতম্।

তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে॥ ১/

যৎ মনসা ন মনুতে যেন আহুঃ মনঃ মতম্।

তৎ এব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি ন ইদং যৎ ইদম্‌ উপাসতে॥ ১/

মন যাঁকে চিন্তা করতে পারে না, অথচ যিনি মনে চেতনার প্রকাশ ঘটান, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানবে – কিন্তু যাঁকে আমরা উপাসনা করি, তিনি নন।


যচ্চক্ষুষা ন পশ্যতি যেন চক্ষূংষি পশ্যতি।

তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে॥ ১/


যৎ চক্ষুষা ন পশ্যতি যেন চক্ষূংষি পশ্যতি।

তৎ এব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি ন ইদং যৎ ইদম্‌ উপাসতে॥ ১/

চোখ যাঁকে দেখতে পায় না, অথচ যিনি আমাদের দৃষ্টিতে আলো দিয়েছেন, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানবে – কিন্তু যাঁকে আমরা উপাসনা করি, তিনি নন


যচ্ছ্রোত্রেণ ন শৃণোতি যেন শ্রোত্রমিদং শ্রুতম্।

তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে॥ ১/


যৎ শ্রোত্রেণ ন শৃণোতি যেন শ্রোত্রম্‌ ইদং শ্রুতম্।

তৎ এব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি ন ইদং যৎ ইদম্‌ উপাসতে॥ ১/

কান যাঁকে শুনতে পায় না, অথচ যিনি আমাদের শ্রবণে শব্দের বোধ সঞ্চার করেন, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানবে – কিন্তু যাঁকে আমরা উপাসনা করি, তিনি নন।


যৎ প্রাণেন ন প্রাণিতি যেন প্রাণঃ প্রণীয়তে।

তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে॥ ১/


যৎ প্রাণেন ন প্রাণিতি যেন প্রাণঃ প্রণীয়তে।

তৎ এব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি ন ইদং যৎ ইদম্‌ উপাসতে॥ ১/

এই প্রাণ যে প্রাণকে উপলব্ধি করতে পারে না, অথচ যিনি আমাদের প্রাণে জীবনীশক্তি সঞ্চার করেন, তুমি তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জানবে – কিন্তু এই যাঁকে আমরা উপাসনা করি, তিনি নন।

 

কেনোপনিষদ প্রথম খণ্ড সমাপ্ত

 

  

দ্বিতীয় খণ্ড

 

যদি মন্যসে সুবেদেতি দভ্রমেবাপি

নূনং ত্বং বেত্থ ব্রহ্মণো রূপম্।

যদস্য ত্বং যদস্য দেবেষ্বথ নু

মীমাংস্যমেব তে; মন্যে বিদিতম॥ ২/

যদি মন্যসে সুবেদ ইতি দভ্রম্‌ এব অপি

নূনং ত্বং বেত্থ ব্রহ্মণো রূপম্।

যদস্য ত্বং যদস্য দেবেষু অথ নু

মীমাংস্যম্‌ এব তে; মন্যে বিদিতম॥ ২/

যদি তুমি মনে কর আমি ব্রহ্মকে ভালোভাবেই জেনেছি, তবে এই ব্রহ্মের দেবত্ব স্বরূপ সামান্য রূপই জেনেছ। সুতরাং ব্রহ্ম আজও তোমার বিচার্য বিষয়। [শিষ্য বললেন] “আমার মনে হয় আমি ব্রহ্মকে জেনেছি

 

নাহং মন্যে সুবেদেতি নো ন বেদেতি বেদ চ।

যো নস্তদ্বেদ তদ্বেদ নো ন বেদেতি বেদ চ॥ ২/

না অহং মন্যে সুবেদ ইতি নো ন বেদ ইতি বেদ চ।

যো নঃ তৎ বেদ তৎ বেদ নো ন বেদ ইতি বেদ চ॥ ২/

আমি মনে করি না আমি ব্রহ্মকে ভালোভাবে জেনেছি। আমি তাঁকে জানি না তা নয়, আবার জানি যে তাও নয়। আমাদের [শিষ্যদের] মধ্যে যিনি এই তত্ত্ব বুঝতে পেরেছেন, তিনিই ব্রহ্মকে বুঝতে পেরেছেন।

 

যস্যামতং তস্য মতং মতং যস্য ন বেদ সঃ।

অবিজ্ঞাতং বিজানতাং বিজ্ঞাতমবিজানতাম্॥ ২/

যস্য অমতং তস্য মতং মতং যস্য ন বেদ সঃ।

অবিজ্ঞাতং বিজানতাং বিজ্ঞাতম্‌ অবিজানতাম্॥ ২/

যিনি মনে করেন তিনি ব্রহ্মকে জানেন না, প্রকৃতপক্ষে তিনিই ব্রহ্মকে জানেন। যিনি মনে করেন তিনি ব্রহ্মকে জেনেছেন, তিনি তাঁকে জানেননি। প্রকৃত জ্ঞানী ব্রহ্মকে জানেন এমন মনে করেন না, কিন্তু অজ্ঞ জনেরা মনে করে।

 

প্রতিবোধবিদিতং মতমমৃতত্বং হি বিন্দতে।

আত্মনা বিন্দতে বীর্যং বিদ্যয়া বিন্দতেঽমৃতম॥ ২/

প্রতিবোধবিদিতং মতম্‌ অমৃতত্বং হি বিন্দতে।

আত্মনা বিন্দতে বীর্যং বিদ্যয়া বিন্দতে অমৃতম্‌/

যিনি প্রতিটি আত্মবোধে ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেন, তিনিই অমৃতরূপ মোক্ষ লাভ করেন। শুধুমাত্র আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে যে সামর্থ্য লাভ করা যায়, সেই বিদ্যাতেই অমৃতত্ব লাভ সম্ভব 

 

ইহ চেদবেদীদথ সত্যমস্তি

ন চেদিহাবেদীন্মহতী বিনষ্টিঃ।

ভূতেষু ভূতেষু বিচিত্য ধীরাঃ

প্রেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি॥ ২/

ইহ চেৎ অবেদীৎ অথ সত্যম্‌ অস্তি

ন চেৎ ইহ অবেদীৎ মহতী বিনষ্টিঃ।

ভূতেষু ভূতেষু বিচিত্য ধীরাঃ

প্রেত্য অস্মাৎ লোকাৎ অমৃতা ভবন্তি॥ ২/

এই জীবনেই যদি কেউ ব্রহ্মকে জানতে পারে, তার সত্য লাভ হয়, কিন্তু তা যদি না হয় তার মহতী বিনাশ উপস্থিত হয় (অর্থাৎ সে এই সংসারের জরা-মৃত্যু, সুখ-দুঃখের অধীন হয়)। অতএব জ্ঞানীব্যক্তিরা সর্বভূতে পরম ব্রহ্মকে উপলব্ধি করে, এই জাগতিক লোকের ঊর্ধে অমৃতস্বরূপ হয়ে থাকেন।

 

কেনোপনিষদ দ্বিতীয় খণ্ড সমাপ্ত


...চলবে...

বৃহস্পতিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

সুরক্ষিতা - পর্ব ১৪

 

১৪

 ছবি রান্নাঘরে চলে যেতে শুভময়ীদেবী আরাম করে কফির মাগে চুমুক দিলেন। পাটা ছড়িয়ে দিলেন, বারান্দার রেলিংয়ের ধাপিতে। বারান্দার বাইরে একটানা বৃষ্টি ঝরছে – খুব জোরে নয় কিন্তু ঝিরঝির কিংবা রিমঝিম তালে। এমন বৃষ্টি দেখেই অনেকটা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়, মনে হল শুভময়ীদেবীর। অনেকটা মানে কতটা? কতক্ষণ? দশমিনিট, পনের মিনিট...তারপর নির্ঘাৎ একঘেয়ে লাগবে। সেক্ষেত্রে এত বড়ো দিনটা – যাকে সাহেবি ভাষায় বলে রেনি ডে – এই বারান্দায় – এই চেয়ারে বসেই সারাটাদিন কাটানো সম্ভব? ব্যাপারটা ভাবতেই শুভময়ীদেবী হাঁফিয়ে উঠলেন, তাড়াতাড়ি কফির মাগ শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। কিছু একটা করতেই হবে। এভাবে চুপচাপ বসে সময় নষ্ট করার কোন অর্থ হয় না। সময় বহিয়া যায় – নদীর স্রোতের প্রায়। যা কিছু পেণ্ডিং কাজ আজ শেষ করে ফেলা যায় – শেষ করতে না পারলেও – অন্ততঃ সমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।

পেণ্ডিং কাজ তাঁর বেশ কিছু আছে অফিসে – কিন্তু সে জায়গাটি আজ অগম্য – যাওয়া যাবে না – অতএব সে কাজ নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। যেহেতু এই ঘরের বাইরে তিনি যেতে পারছেন না, অতএব ঘরে এমন কি কি কাজ আছে – যা তিনি এখন শেষ করতে পারেন? হঠাৎই তাঁর মনে হল, বই পড়া যায়।

মাস খানেকের বেশিই হল, তাঁর হাতে একটি বই এসেছে, নাম ধর্মাধর্ম– বেশ গাব্দা চেহারার বই। বইটা দেখেই তাঁর মনে বিতৃষ্ণা এসেছিল। কিন্তু যে ভদ্রলোক বইটি দিয়ে গেলেন, তাঁর নাম নিমাইবাবু – বহুদিনের পরিচিত। তিনি বহু স্কুলের লাইব্রেরিতেই বই সাপ্লাই করেন – আবার লাইব্রেরির জন্যে অনেক স্যাম্পল্‌ বইও দিয়ে যান – যেগুলি পড়ে লাইব্রেরিয়ান এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষিকারা লাইব্রেরির জন্যে বই সিলেক্ট করেন ও রেকমেণ্ড করেন।

শুভময়ীদেবী বইটা হাতে নিয়েই বলেছিলেন, “এই বই নিয়ে আমি কী করব? ধর্ম-টর্ম নিয়ে লেখা – এসব আমার একদমই চলে না”।

নিমাইবাবু হেসে বললেন, “এর আগে কোনদিন আপনাকে উটকো কোন বইয়ের স্যাম্পল্‌ দিয়েছি, ম্যাডাম? এই বইটা দিচ্ছি – তার কারণ এই বইটিতে আশ্চর্য এক অঙ্ক আছে…”।

শুভময়ীদেবী অবাক হয়ে বলেছিলেন, “ধর্মের বইয়ে অঙ্ক? সে তো আরও মারাত্মক”।

নিমাইবাবু আবার বললেন, “এই বইটা সে অর্থে ধর্মের বইও নয় – আবার অঙ্কের বইও নয়। কিন্তু আবার দুটোই। ঠিক বোঝাতে পারলাম না। ভদ্রলোক পেশায় ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, সেসব ছেড়েছুড়ে দিয়ে এখন লেখা-টেখা নিয়েই আছেন। এই বইটি ম্যাডাম – উনি পাঁচটি পর্বে ভাগ করেছেন, প্রত্যেকটি পর্বের একটা করে টাইম-ফ্রেম আছে। যেমন ধরুন – প্রথম পর্ব শুরু হচ্ছে ৭০,০০০ বিসিই থেকে ১২,০০০ বিসিই, দ্বিতীয় পর্বের সময়কাল ১২,০০০ থেকে ৬০০ বিসিই, এভাবেই চতুর্থ পর্ব শেষ করেছেন ১৩০০ সিইতে – মানে ভারতে মুসলিম শাসন শুরুর ঠিক আগে পর্যন্ত। এই সময়কালের মধ্যে মানুষ কী ভাবে সভ্য হয়েছে, চাষবাস শিখেছে, ব্যবসাবাণিজ্য শিখেছে এবং তার পাশাপাশি কিভাবে তাদের জীবনে এসেছে শিল্প-কলা-সংস্কৃতি-সাহিত্য -বিজ্ঞান। এবং এই সব কিছুর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মনে এসেছে ধর্ম চেতনা, বিশ্বাস, রীতিনীতি – রিচুয়াল্‌স্‌ - একদম অঙ্কের মতো। শেষ পর্বে তিনি সাম-আপ করেছেন - পুরো বিষয়টি – সেখানে থেকে তিনি ডিরাইভ করে দেখিয়েছেন – আজকের দিনে - ২০২৫ সালেও – বিজ্ঞানেসভ্যতায় আমরা ভীষণ উন্নতি করেছি ঠিকই – কিন্তু মানসিকতায় ১৩০০ সিইর পরে আর তেমন এগোতেই পারিনি। আমার কথা বিশ্বাস করুন, ম্যাডাম, বাংলা ভাষায় ধর্মের বই, ইতিহাসের বই – অজস্র আছে। আমাকে পড়তেই হয়, পড়েওছি অনেক – কিন্তু এমন বই এর আগে আর পাইনি। আমার অনুরোধ পড়ে দেখুন”।

এর পরে আর নিমাইবাবুর কথা ফেলতে পারেননি শুভময়ীদেবী। বাড়ি এনে বইটা শুরু করেছিলেন – এবং সত্যি কথা বলতে প্রথম তিনটি পর্ব শেষ করেছিলেন প্রায় এক নিশ্বাসে – অত বড় বড় চ্যাপ্টার মাত্র দশদিনে। এবং তাঁর মনে হয়েছিল নিমাইবাবু বইটি সম্পর্কে এতটুকুও অত্যুক্তি করেননি। কিন্তু চতুর্থ পর্বের মাঝামাঝি থেকেই – বইটা ভীষণ একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। অবশ্য লেখক সে কথা বলেওছেন – ৬৫০ থেকে ১৩০০ সিই ভারতের রাজনৈতিক অবক্ষয়ের কাল – সেই বিশৃঙ্খলার কথা পড়তে পড়তে অধৈর্য হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। শুভময়ীদেবী সেইখানে এসেই এখন আটকে আছেন – আজ চেষ্টা করে দেখা যাক কতটা এগোনো যায়।

বসার ঘর থেকে বইটা এনে তিনি বারান্দাতেই আবার বসলেন। বইটি খুলে – বুকমার্ক ছিল – দক্ষিণাপথ বা দাক্ষিণাত্যের রাজবংশ থেকে পড়া শুরু করলেন। এর আগে ছিল উত্তরভারতের অজস্র রাজবংশ ও তাদের নিরন্তর যুদ্ধ কাহিনী। মিনিট কুড়ি পড়ার পর তিনি কিছুটা হাঁফিয়ে উঠলেন। নিমাইবাবুর কথা মনে পড়ল – লেখক ভারতের ইতিহাসটাকে দেখেছেন নিখুঁত অঙ্কের মতোই – কিন্তু এই চতুর্থ পর্বে এসে সে অঙ্ক হারিয়ে গিয়েছে। প্রায় তের হাজার বছর ধরে এগিয়ে চলা ভারতীয় সভ্যতার নিরন্তর প্রগতি – শুধু থমকে গিয়েছে তাই নয় – এলোমেলো লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এবং সেই সুযোগে ঘটে গিয়েছে মুসলিম আক্রমণ ও আগ্রাসন। লেখক নিরপেক্ষ মনে এই সবের বিশ্লেষণ করে পৌঁছচ্ছেন নতুন কিছু সিদ্ধান্তে। সেটা কি? খুব কৌতূহল হচ্ছে জানতে।

মন্দ নয়, ভালই লাগছে বইটা – এই বিষয়ের বই তিনি এত মনোযোগে বহুদিন পড়েননি। কিন্তু এ বই বর্ষার দিনে সময় কাটানোর বই নয়। শুভময়ীদেবী বই থেকে মুখ তুলে বাইরে তাকালেন – এবং আশ্চর্য হলেন – বৃষ্টি একেবারেই ধরে গেছে – যদিও আকাশের মুখ ভার। যে কোন মুহূর্তে আবার নামতে পারে। হঠাৎই তাঁর মাথায় এল ছোট্ট একটা অ্যাডভেঞ্চার করার ইচ্ছে – যাকে দুষ্টুমিও বলতে পারা যায়।

বৃষ্টি থেমে গেছে। ছবি রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত। তিনি যদি পার্সটা নিয়ে নিঃশব্দে নেমে যান – এবং পাড়ার দোকান থেকে গোটা ছয়েক ডিম কিনে আনেন। কী করবে ছবি? চমকে যাবে না? আশ্চর্য হবে না? হতাশ হয়ে বলবে না, মামীমা, তুমি যেন একটা কি! বলা নেই কওয়া নেই – এভাবে কেউ এই দুর্যোগের দিনে বাইরে বের হয়? যদি কিছু একটা হয়ে যেত – পেছল রাস্তায় পড়ে গিয়ে হাত-পা-কোমরে চোট পেতে? বাইরে কারোর কাছে আমি মুখ দেখাতে পারতাম? সবাই বলত, তুই থাকতে মামীমাকে ওভাবে ছেড়ে দিলি কোন আক্কেলে, ছবি? সমস্ত ব্যাপারটা ভেবে শুভময়ীদেবী মজা পেলেন খুব এবং একটুও দেরি না করে, ঘর থেকে পার্সটা নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়লেন দরজা খুলে।

তাঁদের কমপ্লেক্সের সিকিউরিটি তাঁকে দেখে অবাক হল, জিজ্ঞেস করল, “ম্যাডাম আপনি? কোথায় চললেন? রাস্তায় তো জল জমে আছে”।

শুভময়ীদেবী মুচকি হেসে বললেন, “এই যাবো একটু – টুকটাক কিছু কেনার আছে …”।

“ম্যাক্সিমাম দোকানই বন্ধ, দু-একটা খোলা আছে, দেখুনছবিদি নেই? বাড়ি গেছে নাকি?”

শুভময়ীদেবীর ভয় ছবি তাঁর গলার শব্দ পেয়ে বারান্দায় না চলে আসে – তাহলেই তাঁর অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর দফারফা! তিনি আড় চোখে তিনতলার বারান্দার দিকে তাকালেন – না ছবি নেই। সিকিউরিটির কথার উত্তর না দিয়ে রাস্তায় নামলেন।

সিকিউরিটি ঠিকই বলেছিল রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে আছে এবং অধিকাংশ দোকানই বন্ধ। রাস্তার লেভেলে যে দোকানগুলো – সেগুলোর ভেতরে জল ঢুকে গেছে। হাঁটুর নীচে অব্দি জমা জল ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর বালিকা বয়সের কথা মনে পড়ল। বহুদিন এমন হয়েছে, স্কুল চলাকালীন এমন বৃষ্টি হয়েছে – স্কুল ছুটির পর রাস্তায় নেমে দেখেছেন হাঁটু পর্যন্ত জল। সেই দৃশ্যে তাঁর এবং তাঁর সহপাঠী-বন্ধুরা চিৎকার করে উঠতেন আনন্দে। তারপর হাতে জুতো নিয়ে সবাই মিলে কথা বলতে বলতে, জল ভেঙে ভেঙে হাঁটতেন। চলার গতি অত্যন্ত ধীর – আজকে তাঁর মনে হল – তিনি ও তাঁর বন্ধুরা জলের তলায় দেখতে না পাওয়া পথে হোঁচট খাওয়ার ভয়ে নয় – আসলে তাঁরা ধীরে ধীরে হাঁটতেন এই জলবিহার যেন চট করে শেষ না হয়ে যায়…।

বাঁদিকে গাড়ি বারান্দার নীচে একটা দোকান খোলা রয়েছে দেখে – সেদিকে এগিয়ে গেলেন শুভময়ীদেবী। দোকানদারের চেহারা দেখে মনে হল – বিহারী।

বিহারী ভদ্রলোক অবাক চোখে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “বলুন মা-জী”

“ডিম আছে? ছটা ডিম নেব”?

প্লাস্টিকের একটা পাৎলা ব্যাগ ফুঁ দিয়ে খুলতে খুলতে বিহারী দোকানদার বলল, “ডিম লিতে আপনি চলে এলেন, মা-জী? ছবিদিদি নাই”?

শুভময়ীদেবী বেশ অস্বস্তিতে পড়লেন, বিহারী ভদ্রলোক কি এ পাড়ার সবাইকেই চেনেন? কই তিনি তো ওঁনাকে চেনেন না? প্লাস্টিকের ব্যাগে ছটা ডিম ভরে – ব্যাগের মুখটা টাইট করে বেঁধে দিলেন বিহারী ভদ্রলোক। শুভময়ীদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “কত দাম”।

মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বিহারী ভদ্রলোক বললেন, “ও আমি ছবিদিদির থেকে লিয়ে লিব, মা-জী। আপনি সাবধানে লিয়ে যান”।

“বাঃ মজা! ডিম লিব আমি – আর দাম দেবে ছবিদিদি? কেন?”

“বাত তো একহি হল না…” বিহারী ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললেন, “ছত্রিশ টাকা”।

 

টাকাকড়ির হিসেব মিটতে শুভময়ীদেবী ডিম নিয়ে রওনা হলেন তাঁদের কমপ্লেক্সের দিকে, একইভাবে জল ভেঙে। কমপ্লেক্সের গেট দিয়ে ঢুকেই তিনতলার বারান্দার দিকে তাকালেন – ছবি দাঁড়িয়ে আছে। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।

সিকিউরিটি ছেলেটি বলল, “ছবিদিদি জিজ্ঞেস করছিলেন, আপনি কোথায় গেলেন…”

শুভময়ীদেবী কিছু বললেন না, সাবধানে এগোলেন, তাঁর ব্লকের সিঁড়ির দিকে। তাঁর পাজামা ভিজে সপ সপ করছে – জড়িয়ে ধরেছে তাঁর পায়ের গোছ। জলও ঝরছে টপটপ করে। স্যান্ডেলটা বোধহয় চামড়ার – নয়তো রেক্সিনের - এতক্ষণ জলে ভিজে কেমন যেন ল্যাতপেতে হয়ে গেছে – তাঁর পায়ের চেটোর সঙ্গে তার ঠিক বনিবনা হচ্ছে না। খুব সাবধানে পা ফেলেও – সিঁড়ির প্রথম ধাপেই স্লিপ করল তাঁর স্যাণ্ডেলটা। তিনি হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তেও সামলে নিয়ে ধপ করে বসে পড়লেন সামনের মেঝেতে। নাহলে নাকে চোট তো পেতেনই – হয়তো চশমার কাচ-টাচ ভেঙে বড়ো বিপদ ঘটে যেত।

শুভময়ীদেবীর পড়ে যাওয়ার আওয়াজে সিকিউরিটি দৌড়ে এল চেঁচাতে চেঁচাতে – “ছবিদি, ম্যাডাম পড়ে গেছে, শিগ্‌গির নীচেয় এসো”। পাশের বন্ধ-দরজা ফ্ল্যাটগুলি থেকেও বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক ও মহিলা বেরিয়ে এল দরজা খুলে। “কী হয়েছে? আরে রে রে, ম্যাডাম পড়ে গেলেন কী করে…খুব বেশি চোট লাগেনি তো?”

অপ্রস্তুত হেসে শুভময়ীদেবী বললেন, “না, না পাটা স্লিপ করে পড়ে গেছি…তেমন কিছু নয়…”।

ছবি নিঃশব্দে তাঁর পিছনে এসে দাঁড়াল, অস্ফুট স্বরে বলল, “তুমি ডিম আনতে গিয়ে এই কাণ্ড বাধালে?! উঠে দাঁড়াতে পারবে, আমার কাঁধে ভর দিয়ে? নাকি ধরব?”

“তাই পারেন নাকি? ওঁনাকে শক্ত করে ধর না দু হাতে…” এক প্রতিবেশী মহিলা ঝাঁজালো গলায় বললেন।

মহিলার কথার ভঙ্গিতে শুভময়ীদেবী উঠে দাঁড়ালেন – একটাও কথা না বলে ছবির কাঁধে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তিনি যতক্ষণ নীচেয় বসে থাকবেন…ওই ভদ্রলোক ও মহিলারা অনবরত ছবিকে দোষারোপ করে, তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে।

তাঁরা দুজনে নির্বিঘ্নে ফার্স্ট ল্যাণ্ডিংয়ে পোঁছে যেতে, নীচেয় দাঁড়ানো ভদ্রলোকদের একজন বললেন, “সব ঠিক আছে তো, ম্যাডাম? ডাক্তারকে কল দেব কি?”

ল্যাণ্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে শুভময়ীদেবী হাত তুলে বললেন, “একদম ঠিক আছি। খামোখা আপনাদের ব্যতিব্যস্ত করে তুললাম… অসুবিধে নেই, আমি চলে যাবো…”।

ল্যাণ্ডিং ঘুরে দ্বিতীয় ফ্লাইটে পা দিতেই নীচের মানুষরা যে যার ঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল। একজন মহিলা বললেন, “কী দিনকালই না পড়ল। এই দুর্যোগের দিনে, মহিলা দোকানে বেরিয়েছেন ডিম কিনতে আর কাজের লোক ঘরের সোফায় বসে বসে মোবাইল ঘাঁটছে…। কাজের লোক রেখে লাভ কী?”। যথেষ্ট চাপা স্বরে বললেও কথাগুলো শুভময়ীদেবী এবং ছবির কানে পৌঁছল। ছবির মুখের দিকে মুখ তুলে তাকাতেও পারলেন না শুভময়ীদেবী।

...চলবে...

           

বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

চুরি বিদ্যে মহাবিদ্যে...

[ এর আগের পর্ব এই সূত্রে পড়া যাবে - সনাতনীর সন্ধানে   ]


আমাদের কলকাতার ছোট্ট বাসা বাড়ির ততোধিক ছোট পরিসরে মায়ের ভান্ডার থেকে হরলিক্স, মাখন এবং বিস্কুট চুরি করে ধরা না পড়াটাই আশ্চর্য ছিল। প্রায় প্রত্যেকবারই ধরা পড়তামপ্রচুর বকাবকি এবং পিঠের ওপর মায়ের চড়টা চাপড়টা বরাদ্দ থাকতচড়চাপড় খেয়ে মুখ গোমড়া করে ওঘরে চলে যেতাম আর দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকতাম বিছানায়। এর মানে আমি খুব রেগে গেছি মায়ের ওপর। একটু পরেই মা আসতেন পাশের ঘরেবিছানার একপাশে বসতেন, পিঠে হাত রাখতেন। আমার রাগ আরো বেড়ে যেত, মায়ের হাত সরিয়ে দিতাম ঝটকা দিয়ে – মা মুখ টিপে হাসতেন, বলতেন –

-‘ইস, ফর্সা পিঠে কেমন লাল লাল দাগ হয়ে গেছে। খুব লেগেছে না? ছি ছি, এমন ঘুনুসোনাকে কেউ এভাবে মারে’? আমার কণ্ঠ তখন আবেগে রুদ্ধ, ভীষণ মমতায় মা আমার পিঠে হাত বোলাতেনরুদ্ধ আবেগ কান্না হয়ে উঠে আসত, আমি ফুঁপিয়ে উঠতাম, পিঠ ফুলে ফুলে উঠতমা আবার বলতেন-

–‘কে মেরেছে, বাবা, তোমাকে? কে এত কষ্ট দিল আমার ঘুনুসোনাকে?’ পিঠ ফিরিয়ে থেকেই শেষ অভিমানটুকু উজাড় করে দিয়ে কান্নাভাঙা গলায় আমি চেঁচিয়ে উঠতাম –

-‘কে আবার, মা - আমার মা, তুমিই তো মারলে আমাকে...’। ভারি গলায় মা বললেন-

-‘উঁহু, তাহলে ও তোমার মা নয়, ও রাক্কুসী। মা এমন মারতেই পারে না ঘুনুসোনাকে...’। নিমেষের মধ্যে সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে যেতাম, আমি লাফিয়ে উঠে বসতাম মায়ের সামনাসামনি, বলতাম-

-‘মোটেও রাক্কুসি নয় - মা। আমার মা...’। কান্না ভেজা চোখে তাকিয়ে দেখি মায়ের চোখেও জল। বুকের কাছে টেনে নিয়ে মা বলতেন-

-‘কেন চুরি করিস বলতো? সব তো তোদেরই জন্যে। আমারও এমন রাগ হয়ে যায়...’

কলকাতায় মায়ের ছোট্ট ভান্ডার পার হয়ে গিয়ে মামাবাড়িতে দিদিমার বৃহত্তর ভান্ডারের সন্ধান দিয়েছিল বন্নিদিদি। সেখানেও বন্নিদিদির পূর্ণসহযোগিতায় চৌর্যবৃত্তির হাতযশ বেড়ে উঠেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু এসবই ছিল নিজস্বাপহারণ - নিজের জিনিষই চুরি করা। কারণ এসব খাদ্যদ্রব্য মা কিংবা দিদিমা আমাদের মনোরঞ্জনের জন্যেই সংগ্রহে রাখতেন। দিদিমার ভান্ডারেও আমাদের চৌর্যবৃত্তি ধরা পড়ে দিদিমার থাবড়ি খেয়েছি অনেক, আর খেদোক্তি শুনেছি বিস্তর – ‘পোড়ারমুখো (আমাকে আর বন্নিদিদির ক্ষেত্রে পোড়ারমুখি), এসব তো তোদের জন্যেই বানানো। তা সে আকাচা কাপড়ে ছোঁয়াছুঁয়ি না করলে চলছিল না’? আচারের বয়াম আকাচা কাপড়ে ছুঁলে, আচার নাকি বিগড়ে যায়। 

সে যাই হোক, এইবার ডাক এল পরস্বাপহরণের।

তখনকার দিনে সম্বৎসরে একবারই ধান হতো। ধান কাটার পর শীতকালে বেবাক নেড়া পড়ে থাকত ধূসর মাঠ কে মাঠ। কেউ কেউ টুকটাক চাষবাস করতেন সর্ষে, আলু, আখ, মুসুরডাল...। খাপছাড়া সবুজের দেখা মিলত এখানে সেখানে। দেখবার মতো ছিল – সর্ষের ক্ষেতগুলি - সবুজ পশমিনার ওপর উজ্জ্বল হলুদের অনবদ্য বুটির কাজ। হিমেল উত্তুরে হাওয়া এসে যখন দোলা দিয়ে যেত সর্ষে ফুলের বৃন্তে - মুগ্ধ হয়ে দেখা ছাড়া অন্য কোন বর্ণনা আসত না মনে। বড়ো হয়ে সেই বর্ণনা শুনেছি কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের মন্মোহিনী কণ্ঠে – ‘...আকাশের লাগে ধাঁধা, রোদের আলো ওই যে বাঁধা। বুঝি ধরার কাছে আপনাকে সে মাগলো – সর্ষে ক্ষেতের ফুল হয়ে তাই জাগলো, নীলদিগন্তে...’। এমন নিখুঁত রূপকল্প রচনা রবি ঠাকুরের পক্ষেই সম্ভব। যতবার গানটি কানে আসে চোখের ওপর দুলতে থাকে উজ্জ্বল হলুদের সেই শামিয়ানা...।

আখের ক্ষেত ছিল মাঠে বেশ কয়েকটি। সবচেয়ে নিরাপদ, লোকালয় থেকে নির্জন দূরত্বে একটি আখের ক্ষেত নির্বাচন করে আমরা পাঁচজন রওনা হলাম এক মধ্যদ্বিপ্রহরে। আমরা দুইভাই, মামাতো দুইভাই, আর মামাতো বড়ো দাদার পাড়ার এক বন্ধু। আমাদের মধ্যে মামাতো বড়ো দাদা আর তার বন্ধু সবার বড়ো, আর আমি সবচেয়ে ছোট। আমি আর পিঠোপিঠি মামাতো দাদা হাফপ্যান্ট পড়া আর বাকিরা ডোরাকাটা পায়জামা। জানিনা কেন, এই পায়জামাগুলোকেই গ্রামে সবাই ফুলপ্যান্ট বলত, আর ফুলপ্যান্টকে বলত সুট। দাদারা ছোট ভাঁজ করা ছুরি নিয়েছিল, আমরা হাফপ্যান্টের বাচ্চা বলে আমাদের ছুরি মেলে নি।

 আমরা যখন আখের সুউচ্চ বহির্বেষ্টনী সাবধানে এড়িয়ে ক্ষেতের অন্দরে ঢুকলাম, দেখলাম সে ক্ষেতের আখ খেতে এমন কিছু আর বাকি নেই। মাঝখানটা বেশ ফাঁকা, আখের চিবোনো ছিবড়ে আর আখের খোসা স্তূপাকারে ছড়ানো যত্র তত্র। অর্থাৎ আমরা এ কাজেও পথিকৃৎ হতে পারলাম না, আমাদের আগেও অনেকেই এই ক্ষেতের রসাস্বাদন করে গেছে। অনুশোচনার অবকাশ ছিল না, তাই ঝপাঝপ গোটা দশেক আখ ছুরির আঘাতে ধরাশায়ী হল এবং টুকরো হয়ে চলে এল সাফসুফ হয়ে। আমরা নিজের নিজের হাত ও দাঁতের সহযোগিতায় নেমে পড়লাম ইক্ষুর রসগ্রহণে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমাদের যা ছিবড়ে জমা হয়ে উঠল তাতে আমরা সকলেই আড়ালে বসে লুকোতে পারতাম অনায়াসে। পেটের মধ্যে আখের রস টলমল করছে, আখের খোসা ছাড়াতে গাল ও ঠোঁটের ভেতর আর মাড়ি ছিঁড়ে জ্বালা করছিল, রসে চ্যাটচ্যাট করছিল কনুই অব্দি হাত আর মুখের চারপাশ। শুনেছি আখের রস নাকি জন্ডিসের অব্যর্থ পথ্য, কিন্তু সেদিন ধরা পড়লে আমাদের কেস যে জন্ডিস হতো - সেটাও ব্যর্থ হতো না নিশ্চিৎ।    

ক্ষেত মালিকের নিশ্চয়ই ইচ্ছে ছিল বাড়িতেই আখের গুড় বানিয়ে নেওয়ার। যে গুড়ের থেকে আমাদের এই বঙ্গভূমির একাংশের প্রাচীন যুগেই নাম হয়েছিল গৌড় এবং গৌড়িয় মাধ্বীর সুখ্যাতি পৌঁছেছিল মহাভারতের সুরারসিকদের কাছেও। কিন্তু যেদিন তাঁর অন্তঃসারহীন আখের খেতের সম্যক হদিশ তিনি পেয়েছিলেন, তাঁর অন্তঃকরণে কি অনুভূতি হয়েছিল এবং আমাদের কি পরিমাণ শাপশাপান্ত করেছিলেন - সে চিন্তা করলে আজও মনের ভিতর অস্বস্তি হয় ভীষণ।

সে দিন রাতে ভাত খাবার সময় কোন তরকারিই মুখে রোচে নি - এমন ঝালআসলে ঝাল-টাল কিচ্ছু না আমার মুখের ভিতরে যা অবস্থা তাতে সামান্য নুনের স্পর্শেও জ্বলে উঠছিল। কেন এবং কি করে হল - মা ও মাসীমাদের জেরার চোটে আমার জেরবার হাল, অবশেষে বড়মামীমার হস্তক্ষেপে মীমাংসা হল দুধ ভাতের প্রেসক্রিপ্সনে। বন্নিদিদি কিন্তু ছাড়েনি - আমার পেট থেকে কথা বের করে নিয়েছিল সেই রাত্রেই এবং ‘বেশ হয়েছে, খুব ভালো হয়েছে, আর যাবি আমাকে না বলে?’ বলেও, আমাকে অনেকখানি মধু এনে দিয়েছিল লুকিয়ে – আঙুলে করে লাগিয়ে দিয়েছিল গালে আর ঠোঁটের ভিতরে।

এই ঘটনার পরে আমার মতো বাচ্চারা ব্রাত্য হয়ে গেলাম দাদাদের দল থেকে। বাস্তবিক আমার জন্যে প্রায় ধরা পড়ার উপক্রম হচ্ছিল সক্কলের। কিন্তু আমরাও হার মানলাম না। আমাদের আলাদা একটা দল তৈরি হয়ে গেল গোপনে এবং আমাদের প্রথম অ্যাকশন প্ল্যান হল আলুপোড়া খাওয়া। কচুপোড়া ব্যাপারটা তাও শুনেছিলাম – উত্তর কলকাতায় ‘কচু পোড়া খেলে যা’ লব্জটা তখন প্রায়ই শোনা যেত – কিন্তু আলুপোড়া কোনদিন শুনিনি। শোনা তো সামান্য কথা, একেবারে চেখে দেখার সুযোগ আসছে জেনে রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠলাম।

 আলুপোড়া অভিযানের দিন সকালে – সাজসাজ রব পড়ে গেল আমাদের মধ্যে - কিন্তু অত্যন্ত গোপনে। আলু পোড়াবার জন্যে ঘুঁটে, কেরোসিন তেল, দেশলাই। টেস্টের জন্যে নুন, লংকা ও গোলমরিচের গুঁড়ো, শিশিতে সামান্য সর্ষের তেল, যদি আলু কাটাকুটি করতে লাগে বলে দুটো ছুরি। এরইমধ্যে আমি বারবার জিগ্যেস করছিলাম – ‘কিরে আসল জিনিষ, আলু নিবি না’? – ‘ধূর, ওতো মাঠে...’। ওদের কথাবার্তার কোন হদিশ পাই না, এসে থেকে তো মাস খানেক হতে চলল মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছি বিস্তর, মাঠে আবার আলু কোথায়? পাছে আমাকে সবাই বোকা ভাবে, এই চিন্তা করে চেপে গেলাম, মনে মনে নিশ্চিত ছিলাম, এ মিশন ব্যর্থ হবে এবং সময়ে আমার দূরদর্শীতায় সকলে মুগ্ধ হতে বাধ্য।

নির্দিষ্ট সময়ে আলাদা আলাদা ভাবে যার যার দায়িত্ব অনুযায়ী জিনিষপত্র নিয়ে আমরা রওনা হলাম। গ্রামের বাইরে একটা জায়গায় আমরা জড়ো হয়ে রওনা হলাম মাঠের দিকে। আমি এতক্ষণ লক্ষ্য করছিলাম কেউ আলু নেয় নি। আসার পথে এত দোকান গেল, সব দোকানেই আলু পাওয়া যায়, সে সব ছেড়ে এই মাঠে আলু নিয়ে কে বসে আছে কে জানে – টেরটি পাবে বাছাধনেরা।  

চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা গিয়ে একটা মাঠে সবাই গিয়ে থেমে গেলাম। সে মাঠে আলুর কোন চিহ্ন নেই। গোটা মাঠে আধা সবজে আধা হলদে হয়ে যাওয়া চারাগাছে ভর্তি, আমার হাঁটুর হাইট হবে বড়ো জোর। একটাই বিশেষত্ব নজরে এল - এর মাটিটা। দুপাশে সামান্য নালি কেটে গাছের গোড়াগুলো উঁচু করে ঝুরো ঝুরো মাটিতে ঢাকা। 

আমাদের দলের একজন একটা গাছ কে নিষ্ঠুর ভাবে টেনে তুলতেই শেকড়ের সঙ্গে বেরিয়ে এল বেশ একমুঠো আলু – ছোট বড় মাঝারি সাইজের। অবাক কান্ড – তার আগে শিব্রাম চকরবরতির লেখায় পড়েছিলাম, আলু হয় বড় বড় গাছে ...টুসকি দিয়ে খুব সাবধানে আলু পাড়তে হয়...আর এইখানে মাটির ভিতরে সেই আলু? 

এহেন অবাক কান্ডে আমি যারপরনাই অভিভূত হলাম এবং আমাদের বাচ্চা দলের সাফল্য সম্পর্কে আমার আর সন্দেহের অবকাশ রইল না। সেই বিকেলে ঘুঁটে ও মাঠের শুকনো আগাছার কাঠকুটো জোগাড় করে আলু পোড়া বানানো হলআধপোড়া, ঝামাপোড়া, আধকাঁচা, দরকচা আলুই ক্যাঁচক্যাঁচ করে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আমরা যখন ফেরার পথ ধরলাম, সূর্য তখন পাটে বসার আগে একটু থমকে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন - এই ছোঁড়াগুলো ফাঁকা মাঠে করছেটা কি? 

আমাদের নিরাপদ ও সাকসেসফুল মেডেন মিশন আমাদের সাহস ও আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিল। 

আমরা যখন বাড়ি পৌঁছলাম, বন্নিদিদি সদর দরজায় সন্ধ্যার প্রদীপ দেখাচ্ছিল। চালধোয়ার ধুচুনির মধ্যে প্রদীপ, তার অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে প্রদীপের বহুধা আলো ঠিকরে পড়ছে চারদিকে। কি একটা মন্ত্র পড়ছিল বিড়বিড় করে, মুখে কথা না বলে ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করল ‘কোন চুলোয় যাওয়া হয়েছিল শুনি’? আমি বললাম ‘এই তো বেড়াতে’বন্নিদিদি তুলসীতলায় প্রদীপটা নামিয়ে মাথা নীচু করে নমস্কার করল তিনবার। আমি প্যান্টের পকেট থেকে দুটো আলুপোড়া বন্নিদিদির দিকে বাড়িয়ে দিতে, বন্নিদিদি বলল, ‘দাঁড়া, দাঁড়া, তোর আকাচা কাপড়, ছুঁয়ে দিস না। আলুপোড়া কোথায় পেলি? মাঠে আলু চুরি করতে গিয়েছিলি? সেদিন আখ চুরি, আজ আলু - কি শুরু করেছিস? তুই এই গ্রামের ছেলে নোস - কলকাতায় থাকিস। ভালো স্কুলে পড়িস। নপিসিমা-পিসেমশাই তোকে এইসব করার জন্যে এখানে নিয়ে এসেছে? তোর এই কাজের জন্যে তোর বাবা-মাকে কেউ যদি পাঁচকথা শোনায় - তোর ভাল লাগবে তো’? 

সেই সন্ধ্যায় তুলসীমঞ্চের সামনে, মুখের ওপর খেলা করা প্রদীপের স্নিগ্ধ আলোয় - বন্নিদিদির কথাগুলো আমাকে এমন এক সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল যার ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। আজ পর্যন্ত জীবনের প্রত্যেকটি বেপথু মুহূর্তে, দীপের সীমিত আলোয় বন্নিদিদির দীপ্ত মুখের সেই কথাগুলি সঠিক পথের দিশারী হয়ে আমার কাছে ফিরে এসেছে বারবার।

 

-০০-

[পরের পর্ব "লোকশিল্পীর বিলুপ্তি"]  

সনাতনীর সন্ধানে

 

[এর আগের পর্ব এই সূত্র থেকে পড়া যাবে - রতনে রতন চেনে।]

এমন নয় যে মামার বাড়ি বা গ্রাম বাংলা আমার কাছে নতুন জায়গা। এর আগেও গেছি। কিন্তু এইবারটা একটু অন্যরকম। অন্যান্য বার আমাদের থাকার সময় হত সীমিত, সাতদিন বড়জোর দশদিন। কলকাতার আবদ্ধ জীবনের থেকে মুক্তির রসাস্বাদন শুরু হবার আগেই যেন ফেরার আয়োজন চালু হয়ে যেত। এবারে থাকাটা একদম আলাদা সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য।

পৌঁছোনোর পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে টেনে তুলে দিল ছোটমাসিমা - হাতে ধরিয়ে দিল একটা কাঁসার গেলাস ধরে দেখলাম সেটা কনকনে ঠান্ডা। এমনিতেই কলকাতার চেয়ে অনেক বেশী ঠান্ডা এখানে। গেলাসটা হাতে ধরতে আমার হাড়গোড় পর্যন্ত কেঁপে উঠল ঠান্ডায়। ফিকে বাদামি রঙের, সরস্বতীপুজোর পায়েসের গন্ধ মাখা পানীয় – সঠিক বললে - সার্ভড অ্যাজ চিল্ড। হাল্কা চুমুক দিতেই দাঁতের গোড়া ঝাঁকিয়ে উঠল ঝনঝন করে, কিন্তু রসনার স্বাদকোরকগুলি রীতিমত নড়েচড়ে বসল এমন একটি অনাস্বাদিত রসের অভূতপূর্ব আস্বাদ পেয়ে। পানীয়টি খেজুর গাছের রস – আর এ জিনিষ যে আমাদের কলকাতায় মিলবে না সেটা গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করতেও ছাড়ল না ছোটমাসিমাবাবা আমার পাশেই বসেছিলেন, তিনিও মাসিমার কথায় কোন প্রতিবাদ করলেন না। অথচ ওই বয়সেই অনেক বয়স্ক লোকের মুখেই শুনেছিলাম – ‘কি পাওয়া যায় না, হে - পয়হা ফেললে বাঘের দুদও মেলে কলকেতায়’!

সেদিন সকালেই বাবা নিমের ডাল দিয়ে দাঁতন করলেনবিষাক্ত কেমিক্যালযুক্ত পেস্ট আর প্লাস্টিকের বুরুশের থেকে অন্ততঃ একদিন প্রাকৃতিক মুক্তি পাবার জন্যে। বাবার দেখাদেখি বায়না ধরলাম আমিও। ভাবলাম না জানি এও কোন অজানা জগৎ খুলে দেবে আমার সামনে। খেজুররসে সদ্যতৃপ্ত রসনা সেদিন চমকে উঠেছিল আমার এ হেন অবিমৃষ্যকারিতায়, আর আমার অন্তরাত্মার হাতে পায়ে ধরে বারবার বলেছিল ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’বারবার মানা করা সত্ত্বেও শুনিনি বলে, ছোটমাসিমা আমার কি অবস্থা দাঁড়ায় দেখতে সামনেই দাঁড়িয়েছিল। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত তিক্ত হয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু বাবার মতো গম্ভীরভাবে পায়চারি করতে করতে নিমের ডালেই দাঁত মেজেছিলাম সেদিন এবং সেই বয়সেই বুঝে গিয়েছিলাম - ইগো বড় বালাই।

সেদিন বিকেলেই বাবা ফিরে গেলেন কলকাতায়। ছোটমামা বাবাকে এগিয়ে দিতে গেলআমরা সদর দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম যতক্ষণ বাবাকে দেখা যায়। দিদিমা, দুই মাসিমা, মামাতো দিদি এবং সবার পিছনে বড়োমামা - সকলেই ছিলেন আমাদের সঙ্গে। বাবা যখন রাস্তার মোড়ে আড়ালে চলে গেলেন, দিদিমা হাত জোড় করে নমস্কার করে বললেন ‘সব ভালো রেখো, মা বিপত্তারিণী’, ঘোমটা দেওয়া মায়ের গম্ভীর মুখ আর চোখে জল টলটল করছিল। ভীষণ মন খারাপ করতে লাগল বাবার জন্যে।

আমি অচিরেই আমার মামাতো দিদির একান্ত ভক্ত হয়ে উঠলাম। বহ্নি আমার উচ্চারণে হয়ে গেল বন্নিদিদি। কাজে অকাজে বন্নিদিদির সঙ্গী হবার জন্যে আমি উদ্গ্রীব থাকতাম, আর বন্নিদিদিও আমার মতো একটি অনুরক্ত ভাই পেয়ে যারপরনাই হ্লাদিতা হয়েছিল সন্দেহ নেই।

দুপুরে দিদিমা, মা-মাসিমার দিবানিদ্রার অবসরে আমি বন্নিদিদির একান্ত সঙ্গী হিসেবে দিদিমার কড়ির বয়ামে সুরক্ষিত কুলের আচার, আমের মিষ্টি ও টক আচার, আমচূর ইত্যাদির নিয়মিত অংশীদার হতে পেরেছিলাম। মাঝে মাঝে কোথা থেকে কে জানে বন্নিদিদি কৎবেল জোগাড় করে আনত। সকালে সর্ষের তেল, বিট নুন, গুড় দিয়ে মেখে রেখে দিত রোদ্দুরে - কিন্তু সকলের চোখের আড়ালে। দুপুরে সেই জারিয়ে ওঠা কৎবেলের গন্ধেই মুখের ভিতরটা রসস্থ হয়ে উঠত। তর্জনীর ডগায় অল্প একটু মাখা নিয়ে বন্নিদিদি টেষ্ট করত, তার চোখ ছোট্ট হয়ে যেত কুঁচকে, আর জিভে টক করে আওয়াজ তুলে বলত –‘দারুউউণ’। তারপর আমার জিভেও একটু লাগিয়ে দিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করত - কেমন? অদ্ভূত স্বাদে আমার মোহিত রসনা তখন জবাবরহিত, তাই ঘাড় নাড়িয়ে বন্নিদিদির রসবোধকে পূর্ণ সমর্থন করে বন্নিদিদির বাটির দিকে তাকাতে, বন্নিদিদি আদ্দেকের বেশ কিছুটা কম আমার হাতে তুলে দিয়ে বলত-

– ‘বেশী খাসনি, বদহজম হবে। আর তোর পেট খারাপ হলে মা আমার পিঠ ফাটাবে...’।  বন্নিদিদির মা মানে আমার মামিমা।

একদিন সকালবেলা নটা সাড়ে নটা নাগাদ ছোট্ট একটি বালতি হাতে বন্নিদিদি আমাকে বলল ‘আমার সঙ্গে যাবি তো চ, গোয়ালে যাব গাই দুইতে’। আমার বিশ্বাসই হয়নি। বন্নিদিদি কতো বড়ো আমার চেয়ে – মেরেকেটে বছর তিন কি চারেকের হবে। সে ওই বড়ো বড়ো শিংওলা গরুগুলোকে সামলাতে পারবে? এই বুঝি পেটে শিং দিয়ে গুঁতিয়ে দিল - এই ভয়েই তো আমি সারা!

বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেক দূরেই মামাদের খামার বাড়ি, তার একধারে টালির চাল দেওয়া টানালম্বা গোয়াল ঘর। বুকসমান উঁচু মাটির চাতালে ছটা পোড়ামাটির লাল রংয়ের ডাবা বসানো। মেঝেয় ছটা খোঁটা পোঁতা আছে, গরু মোষ বাঁধার জন্যে। চারিদিক গোময় এবং গোমূত্রলিপ্ত অর্থাৎ হিন্দুশাস্ত্র মতে পবিত্রদুধসাদা বাছুরটা গোয়ালের বাইরে বাধাঁ ছিল, বড়ো বড়ো কালো চোখ মেলে দেখছিল তার মাকে আর ছটফট করছিল মায়ের কাছে যাবার জন্যে। গোয়ালে খোঁটায় বাঁধা মা গাইটি - যার দিদিমা নাম রেখেছিলেন গৌরী - বারবার ডেকে উঠছিল হাম মা...

ভুবনমামা - মামাবাড়ির রাখাল - লম্বা পাতবঁটিতে ঘস ঘস করে গরুমোষের খাবার ‘ছানি’ কুচোচ্ছিল খড়ের আঁটি কেটে কেটে। সে মুখ তুলে তাকাল, বলল - ‘এতক্কনে এলে বন্নিদিদি, সেই থিকে তোমার গউরি ডেকে ডেকে সারা -’। মামাবাড়ির বাসন মাজা, ঘর নিকোনো, ঘুঁটে দেওয়ার কাজ করে বিধবা ভামিমাসী - সত্যভামা – আমাদের দেখে হাসল। তার দুহাতে গোবর লেগে, একটা ঝুড়িতে গোবর তুলে রাখছে সে, দুপুরে ঘুঁটে দেবে বলে।

বন্নিদিদি খোঁটা থেকে বাছুরটাকে খুলে দিতেই বাছুরটা ছুট্টে চলে গেল তার মায়ের কাছে। মাথার ঢুঁ দিয়ে দিয়ে মায়ের পালান চুষতে শুরু করল আর গৌরী ঘাড় ঘুরিয়ে ধূসর রঙের লম্বা জিভ দিয়ে চাঁটতে লাগল তার সন্তানের গা, পিঠ আর সদা চঞ্চল লেজটিসেইসময় বা তার কিছুদিন পরে কংগ্রেসের ভোটের সিম্বল ছিল ‘গাইবাছুর’ – অবিকল যেন এই গৌরী আর তার বাছুরের ছবি। সেই সিম্বলকে প্রত্যক্ষ জেনেছিলাম বন্নিদিদির সঙ্গে মামাবাড়ির গোয়ালে। 

মিনিট চারপাঁচেক পরেই বন্নিদিদি বাছুরটাকে টেনে সরিয়ে আনল, আমাকে দড়িটা ধরিয়ে দিয়ে বলল –‘শক্ত করে ধরে রাখ, কাছে আসতে দিস না’বলেই উবু হয়ে বসে গেল গৌরীর নীচে বালতিটা রেখে। দুটি বাঁট দুহাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে চেপে চেপে দুধ দুইতে শুরু করলফিনকি দিয়ে ঝরে পড়া সফেন দুধে খালি বালতি আস্তে আস্তে ভরে উঠতে লাগল – এই দুধ আমাদের পুষ্টি দেবে, দেবে লাবণ্য ও শক্তিকারণ দিদিমার মুখে শুনেছি “দুধে লাবণ্য বৃদ্ধি, ঘৃতে বৃদ্ধি বল। মাংসে মাংস বৃদ্ধি, শাকে বৃদ্ধি মল” সমস্ত দুধ নিংড়ে নিয়ে প্রায় পৌনে-বালতি ভরা দুধ নিয়ে বন্নিদিদি উঠে এল, আমাকে বলল বাছুরটাকে ছেড়ে দিতে - ছেড়ে দিলাম। অবুঝ ক্ষুধার্ত বাছুরটা আবারও ছুটে গেল তার মায়ের কাছে। গৌরী তখন নিঃস্ব – তার রিক্ত পালানে নিজের সন্তানের স্পর্শও তখন বিরক্তিকর।

এর আগে গরুর রচনা পড়েছি। সে অনুযায়ী গুনে গুনে বুঝে নিয়েছি তার শিং, পা, ক্ষুর লেজের চুলচেরা হিসেব। আমাদের পুষ্টিবিধানের জন্যে তার নিরলস দুগ্ধ সরবরাহের উপকারী প্রয়াসের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ছিল সেই সব রচনায়। বাড়িতে দেখেছি যে কোন যজ্ঞ অনুষ্ঠানে, পঞ্চগব্য আবশ্যিক উপচার এবং শুনেছি বহুল প্রচলিত মন্ত্রে গোমাতার স্তব ও স্তুতিসেদিন বুঝেছিলাম চরম এক বঞ্চনাকে কি সুচারুভাবেই না ঢেকে রাখা হয়েছে মানবসভ্যতার উন্মেষ থেকে!

এই শোষণ, দোহন ও বঞ্চনার ইতিহাস ততটাই প্রাচীন, যতটা প্রাচীন মানুষের সামাজিক ইতিহাস। সবল শোষণ করে অবলকে, সক্ষম দোহন করে অক্ষমকে এবং একে আড়াল করার জন্যে আবহমানকাল ধরে চলে আসছে পাপ-পুণ্য, পূর্বজন্মের সুকৃতি-দুষ্কৃতির খতিয়ান। নির্বলের হতাশা এবং সবলের সম্ভাব্য বিবেক দংশন যদি কোনভাবেই ঢাকা না দেওয়া যায়, তাহলেও হাতে তো থাকছেই - কপালের লিখন – ‘নেকন, নেকন, বুয়েচ হে, সবই কপালের নেকন’!

এতটা স্পষ্ট উপলব্ধি সেদিনই আমার ঘটে গিয়েছিল মোটেই তা নয়, কিন্তু চেতনায় এই রূপটা যে একটা অস্পষ্ট আকার নিচ্ছিল এটা সত্যি। কলকাতার বাসায় আমাদের ছোট্ট সীমিত সংসারে, উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত পাড়ায় এবং স্কুলের ছকবাঁধা নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে এই চেতনার আভাস আসাও – অন্ততঃ সেই বয়সে – একপ্রকার অসম্ভবই ছিল আমার মনে হয়।

সে যাই হোক, বাড়ি এসে মাকে বন্নিদিদি আর আমার কৃতিত্বের কথা সবিস্তারে জানাতে, মা বলল প্রাচীনকালে মেয়েরাই নাকি গাই দুইত মানে দোহন করত আর সংস্কৃতের দোহন শব্দ থেকেই নাকি দুহিতা শব্দ এসেছে – যার মানে কন্যা বা মেয়ে। তার মানে বন্নিদিদি ভারতবর্ষের এক কন্যার সনাতন প্রতিরূপ এবং প্রতিভূ! আশ্চর্য!

 

এমন ভাবেই প্রত্যেকটি দিন - নিত্যনতুন এবং অভিনব স্বাদ রূপ রস নিয়ে ধরা দিতে লাগল আমার কাছে। চিনে নিতে লাগলাম আমার জীবনের ভিত্তি আর সম্পর্কের সব শিকড়গুলি। গোগ্রাসে আত্মসাৎ করছিলাম এর সবকিছু। গড়ে উঠতে লাগল এক ভিন্ন মাত্রার জীবনবোধ। যে বোধ আমার চেনাশোনা শহরের জীবনযাপন পদ্ধতির থেকে অনেকটাই আলাদা।

 

-০০-

[এর পরের পর্ব এই সূত্র থেকে পড়া যাবে "চুরি বিদ্যে মহাবিদ্যে"]  

নতুন পোস্টগুলি

ধর্মাধর্ম - ১/৫

[এর আগের পর্ব পড়তে  হলে এই সুত্রে প্রবেশ করুন -  ধর্মাধর্ম - ১/৪ ]   প্রথম পর্ব  (৭০ , ০০০ বিসিই থেকে ১২ , ০০০ বিসিই) - ৫ম পর্বাংশ ১.৪.২ বিশ...