মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫

বিদায়বেলার মালাখানি

 

 

সামান্য দিবানিদ্রা ও বিশ্রামের পর অনাদি এখন কিছুটা সুস্থ বোধ করছেন। বুকের ভেতর সেই চাপ ভাবটা রয়েছে, তবে অনেকটাই কম। করুণাডাক্তার ঠিকই বলেছিলেন, সাধারণ গ্যাস আর অম্বল, চিন্তার কারণ নেই। বিকেলে পাড়ায় বেরিয়েছিলেন। পোড়ো-মন্দিরতলায় তাঁদের বয়স্ক মানুষদের একটা জমায়েত হয়, সেখানে নানান কথাবার্তায় সময়টা কাটে। খুব যে আনন্দ পান সেই আড্ডায়, তা হয়তো নয়, কিন্তু কীই বা করার আছে এই গাঁয়েঘরে। সে আড্ডায় গ্রামের কথাবার্তা, এই দিগড়ের কথাবার্তা হয়, কলকাতার কংগ্রেস রাজনীতির কথাও ওঠে। আজকাল আর একটা বিষয় নিয়েও খুব চর্চা হচ্ছে, বিশেষ করে ছেলে ছোকরাদের মধ্যে। সেটা হল কমিউনিস্ট রাজনীতি। জার্মানীর এক সায়েবের তত্ত্ব বুঝে, রাশিয়ার দুই সায়েব খুব নাকি সাড়া ফেলে দিয়েছেন সারা বিশ্বে। ভারতের স্বাধীনতা সবে বারো বছরের বালক। স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা কংগ্রেস দলের প্রতি বয়স্কদের এখনও অবিমিশ্র বিশ্বাস আর ভরসা। নেহরুর এখনও অবিসংবাদিত জনপ্রিয়তা। তিনি আবার রাশিয়া পন্থী। কিন্তু আজকের যুবসমাজ বয়স্কদের এই ভরসায় আর আস্থা রাখতে পারছে না। তারা চাইছে নতুন কিছু, তারা চাইছে আমূল সামাজিক পরিবর্তন। 

আগে তেমন শোনা যেত না, আজকাল কয়েকটা কথা খুব শোনা যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, বুর্জোয়া, শ্রেণীশত্রু। অনাদি শুনেছেন, তাঁরাই আজকাল এই সমস্ত বিশেষণের অধিকারী। উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁদের বেশ কিছুটা জমি জায়গা আছে। তাঁরা নিজে হাতে চাষ করেন না, চাষ করান ভাগচাষী বা চাষ-মজুরদের দিয়ে। ভাগচাষীরা গ্রামেরই বাসিন্দা, তাদের নিজস্ব জমি নেই, অথবা থাকলেও সে সামান্য। অনাদির মতো জমির মালিকরা চাষের জমি দেয়, বীজ দেয়, চাষের বলদ দেয়, দেয় লাঙল। ভাগচাষীরা চাষ করে, ফসল ফলায়, ফসল তোলে। বদলে তারা পায়, উৎপন্ন শস্যের একটা অংশ। এর মধ্যে শঠতা আছে, তঞ্চকতা আছে, ভুল আছে, ভ্রান্তি আছে, অহংকার আছে, জেদ আছে, আছে বঞ্চনা। কিছু কিছু অপ্রিয় ঘটনার অভাব নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও যুগ যুগ ধরে এমনই চলে আসছে। দুঃখে-সুখে, দায়-দৈবে, শান্তি-অশান্তিতে পরষ্পরের নির্ভরতায় কেটে গেছে কত শত বছর।

ঠিক যেমন বহু বহু ঝড়-ঝাপটা সয়ে - দাঁড়িয়ে আছে এই পোড়ো মন্দির। সারা গায়ে পোড়ামাটির কাজ করা – দেওয়ালে ফাটল ধরা এই মন্দির – যার ভিতের অনেকটাই চলে গেছে কালের করাল গ্রাসে। কেউ বলে তিনশ, কেউ বলে চারশ বছরের পুরোনো এই মন্দির…। অনাদি পড়ন্ত বিকেলের আবছা আলোয় কিছুক্ষণ মুখ তুলে তাকিয়ে রইলেন মন্দিরের দিকে।    

ভাগচাষ ছাড়া চাষ-মজুর বা মুনিষ খাটিয়েও জমির মালিকরা চাষ আবাদ করেন। তাঁরা ছেলে-মজুরদের বলেন মুনিষ, আর মেয়ে-মজুরদের কামিন। মানুষ আর কামিনী থেকেই ওই দুই শব্দের উৎপত্তি কবে হয়েছিল কে জানে! বর্ষার আগে সাঁওতাল পরগণা, দুমকা থেকে মুনিষ আর কামিনরা গ্রামে গ্রামে চলে আসে। জমির মালিকদের খামারে তারা অস্থায়ি বাসা নেয়। প্রত্যেক বছর চাষের জমি তৈরি থেকে শুরু করে, ফসল তুলে মালিকের গোলায় শস্য ভরা পর্যন্ত সমস্ত কাজ তারাই করে। বন্যা কিংবা খরায় ফসলের ক্ষতি হলে তাদের কোন দায় থাকে না। থাকা খাওয়া ছাড়া, চুক্তি অনুযায়ি তাদের মজুরি মিটিয়ে দিতে হয়। মানুষের স্বাভাবিক স্বভাবে এক্ষেত্রেও বঞ্চনা আর তঞ্চকতার অভাব নেই। জমি মালিকদের অন্ধ স্বার্থ আর অহংকারের জন্যে খেটে খাওয়া এই অকিঞ্চন মানুষগুলোর মনেও তাই ক্ষোভ আর ক্রোধ জন্ম নিচ্ছে। দিনকাল আর আগের মত থাকছে না।

গ্রামে গ্রামে এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর ক্ষোভ আর ক্রোধকে কাজে লাগিয়ে, কলকাতার শিক্ষিত অল্পবয়সি যুবকরা সংগঠিত করছে অদ্ভূত এক বিপ্লব। তারা কমিউনিজমে দীক্ষিত, তারা বিশ্বাস করে সাম্যবাদে। ধনী আর দরিদ্র, এই দুই শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা সমাজকে ভেঙে চুরে, তারা গড়ে তুলতে চায় শ্রেণীহীন সমাজ। দুনিয়ার সমস্ত শ্রমজীবী মানুষদের তারাই একমাত্র মুখপাত্র। অত্যাচারিত ও বঞ্চিত সর্বহারাদের তারাই একমাত্র সহায়। কমিউনিজম ছড়িয়ে পড়ছে সারা ভারতে, তবে তাদের বেশি প্রভাব পশ্চিমবঙ্গ আর কেরালায়। বছর তিনেক আগে কেরালার জনগণ তাদের রাজ্যে নির্বাচিত করেছে, কমিউনিস্ট সরকার। তারা চলে এসেছে সংসদীয় ক্ষমতার অলিন্দে। পশ্চিমবঙ্গেও কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা এখন দ্রুত নিম্নগামীবিপ্লবের নামে প্রতিরোধ, প্রতিঘাত বেড়ে উঠছে প্রতিদিন, শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামেও তার প্রভাব টের পাওয়া যাচ্ছে প্রত্যহ।

নির্বিবাদী, সজ্জন এই মানুষটি বিশ্বাস করেন মানুষের নিজস্ব মূল্যবোধে। যে মূল্যবোধ তিনি অর্জন করেছেন, সুপ্রাচীন এক ঐতিহ্যের পরম্পরা থেকে। এক শ্রেণীর মানুষ তাঁকে শ্রেণীশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলছে, এই ভাবনা তাঁকে পীড়া দেয়। অথচ এই বিশাল সমাজের মধ্যে তিনি কতটুকু? কীই বা তাঁর কর্তব্য, কতোটুকুই বা তাঁর ক্ষমতা? বিপুল ভারতবর্ষের সাধারণ জনগণের মধ্যে তিনি অতি সাধারণ একজন ক্রীড়নক। তাঁর হাতে কিছুই নেই। অমোঘ ভবিতব্যের মতো তাঁকেও মেনে নিতেই হবে, সামাজিক পরিবর্তন, পরিবর্তিত পর্যবেক্ষণ এবং তার ফলাফল। তিনি নিজে ভালো কী মন্দ এ প্রশ্ন সেখানে অবান্তর।

অনাদি সন্ধের একটু পরে বাড়ি ফিরলেন। কলতলায় হাত পা ধুয়ে উঠে এলেন ঠাকুরঘরের বারান্দায়। তাঁর হাতে গামছা এগিয়ে দিল কন্যা সুভা। তার অন্য হাতে পট্টবস্ত্র। তিনি এখন সন্ধ্যা আহ্নিকে বসবেন। ঠাকুরঘরের ছোট্ট পরিসরে পেতলের ছোট্ট সিংহাসনে শালগ্রাম শিলা প্রতিষ্ঠিত। টাটকা ফুল আর তুলসি পাতায় ঢাকা। ছোট্ট একটি প্রদীপের স্নিগ্ধ আলো। ধুপদানিতে জ্বলতে থাকা ধুপের সুগন্ধে ঘরটি পবিত্র। পাটের কাপড় পরে তিনি কম্বলের আসনে বসলেন, কোষা থেকে কুষিতে কফোঁটা গঙ্গাজল নিয়ে, বাঁহাতে ঢাললেন। তিনবার ওঁ বিষ্ণু মন্ত্রে তিনি আচমন করে শুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তারপর হাতের মূলচক্র মুদ্রায়, সমগ্রীবকায় হয়ে কতক্ষণ বসে রইলেন আসনে, তাঁর চোখ বন্ধ, শ্বাস অত্যন্ত ধীর, অধরে জপমন্ত্র।

 

সন্ধ্যাহ্নিকের পর ঠাকুরঘরের বাইরে এসে, পট্টবস্ত্র বদলে, অনাদি কাচা ধুতি পরলেন। আহ্নিকের পর তিনি অনেকটাই স্বস্তি অনুভব করছিলেন। সকালে শারীরিক অস্বস্তিতে যে উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন, এখন তিনি অনেকটাই সুস্থ বোধ করছেন। যদিও বুকে একটা যেন চাপ অনুভব হচ্ছে।

বৌমা এসে জিগ্যেস করলেন, “বাবা, জলখাবার কিছু দি? দুপুরে তো প্রায় কিছুই খেলেন না”

অনাদি হাসলেন, বললেন, “দুপুরে কিছুই খাইনি বলতে চাও, মা? কদিন গুরুভোজনের পর, আজ একটু লঘুপাক হয়েছে, ঠিকই। এখন একটু খিদে খিদেও পাচ্ছে। তুমি বরং চারটি মুড়ি দাও, সঙ্গে শসা আর নারকেল কুচি। বাস, আর কিছু না”

বৌমা বঁটি পেতে শসার খোসা ছাড়াতে বসলেন। সুভা দাওয়ায় আসন পেতে রেখেছিল, অনাদি সেই আসনে গিয়ে বসলেন। একলা বসে থাকতে দেখে ষোড়শীবালা হাতে হ্যারিকেন নিয়ে সামনে এলেন। একধারে হ্যারিকেনটা রেখে দাওয়াতেই বসে বললেন, “অন্ধকারে বসে, একা একা কী ভাবছো?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনাদি বললেন, “হাআঃ, ভাবনার শেষও নেই, শুরুও নেই। বিষ্ণু ফিরেছে”?

“ফিরেছে। হাত মুখ ধুয়ে ওপরের ঘরে গেছে, কলের গান বাজাবে বোধ হয়”

“বাঃ, ওকে বলো তো, রবিবাবুর সেই গানটা বাজাতে”

ষোড়শীবালা মেয়ে সুভাকে ডাকলেন, “অ্যাই সুভা, একবার ওপরে যা তো, মা। তোর বাবা কী গান শুনতে চাইছে, দাদাকে গিয়ে বল।”

সুভা ও বাড়ি থেকে দৌড়ে এল, “কী হয়েছে, মা?

অনাদি বললেন, “তোর বড়দা কলের গান চালাতে গেল মনে হয়। ওকে গিয়ে বল, রবিবাবুর একটা গান বাজাতে”

সুভা আবার দৌড়ে ওপরের সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল, অনাদি বললেন, “কোন গান বলবি?

সুভা থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “কোন গান?

“কোন গান? পুরোটা না শুনেই ছুটতে লাগলি, খেপি! বলবি তার বিদায় বেলার মালাখানি’, মনে থাকবে”? সুভা আর দাঁড়াল না, দৌড়ে উঠে গেল দোতলায়।

অনেকদিন চালানো হয়নি বলে বিষ্ণু গ্রামোফোনের বাক্স খুলে একটু ঝাড়পোঁছ করছিলেন। এখন সুভার মুখে বাবার গান শোনার ইচ্ছে হয়েছে শুনে, একটু হাসলেন, বললেন, “আচ্ছা, যা আমি বসাচ্ছি”রেকর্ডের বাক্স থেকে কাননদেবীর রেকর্ডটা খুঁজতে খুঁজতে তাঁর মনে পড়ল, বর্ধমানের কলেজে পড়ার সময় তাঁর বায়োস্কোপ আর গানের ঝোঁক হয়েছিল খুব। পয়সা জমিয়ে তখনই কিনেছিলেন এই গ্রামোফোনটা। বাড়িতে যখন নিয়ে এসেছিলেন, বাবা খুব বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, “এসব বিলাসিতা আমাদের জন্যে নয়”মাকে বলেছিলেন, “তোমার বড়ো ছেলে একেবারেই বখে গেছে, আজকাল সে উড়তে শিখেছে! পানের দোকানের মতো, তোমার ঘরেও এখন লারেলাপ্পা গান বাজবে! ছি ছি ছি”

কিছুদিন পরে অবিশ্যি গানটান শুনতে শুনতে, বাবাও এখন অনেক গানের ভক্ত হয়ে উঠেছেন। মাঝে মাঝেই আদেশ করেন, বিষ্ণু তোর ওই কলে, সেই গানটা একবার বাজা তো। কাননদেবীর এই গানটা ১৯৩৭ সালে বেরিয়েছিল, আজ এত বছর পরেও গানটা শুনলে, কেমন যেন গায়ে কাঁটা দেয়। যেমন গানের কথা, তেমনি গায়কী। খুঁজে পেয়ে, প্যাকেট থেকে বের করে, রেকর্ডটা নরম কাপড়ে মুছলেন। গ্রামোফোনের ডিস্কে রেকর্ডটা চাপিয়ে দিলেন সন্তর্পণে। তারপর দয়ের মতো হ্যাণ্ডেল ঘুরিয়ে গ্রামোফোনে দম দিলেন বেশ খানিকক্ষণ। এবার গ্রামোফোনের ওপরে একটা নব ঘোরাতেই ঘুরতে শুরু করল রেকর্ড, ঘুরতে শুরু করল রেকর্ড কোম্পানির গান শোনা কুকুরের ছবি। এবার ক্রেডলের স্ট্যাণ্ড থেকে, স্টাইলাস হেড তুলে, নতুন পিন লাগালেন, তারপর হেডটা নামিয়ে দিলেন চলন্ত রেকর্ডের শেষ প্রান্তে। প্রথমে কিছুক্ষণ খড়খড় আওয়াজের পর, অর্গ্যানের আওয়াজ আর কাননদেবীর কণ্ঠ শোনা গেল। গ্রামের নির্জন শান্ত সন্ধ্যায়, সেই অদ্ভূত কণ্ঠস্বরের আবেশ ছড়িয়ে পড়ল। সেই গানের বাণী, কী যে বার্তা পৌঁছে দিল শ্রোতার মনে।

গান শুরু হতেই অনাদি নিশ্চল বসে রইলেন আসনে। ষোড়শীবালা, চুপ করে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর দিকে। একটি বাটিতে আমতেলমাখা অল্প মুড়ি, আর অন্য প্লেটে কুচোনো শসা আর নারকেল নিয়ে চিত্রার্পিতের মতো অপেক্ষা করতে লাগলেন বৌমা। শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও গানের রেশ যেন চারপাশে রয়ে গেল বেশ কিছুক্ষণ।

অনাদি একটু পরে চোখ মেলে তাকালেন, বললেন, “বাঃ। কী গানই বেঁধে গেছেন, রবিবাবু। আর তেমনি গলা মেয়েটির, কী যেন নাম? আহা, মনটা ভরিয়ে দিয়ে গেল”গুনগুন করে, আবৃত্তির সুরে বললেন,    

দিনের শেষে যেতে যেতে পথের পরে

ছায়াখানি মিলিয়ে দিল বনান্তরে।

সেই ছায়া এই আমার মনে, সেই ছায়া ওই কাঁপে বনে,

কাঁপে সুনীল দিগঞ্চলে রে।

তার বিদায়বেলার মালাখানি আমার গলে রে

বৌমা মুড়ির বাটি আর শসার প্লেট নামিয়ে রাখলেন অনাদির সামনে। অনাদি যেন আবার বাস্তবে ফিরলেন, স্ত্রীকে বললেন, “তোমার বড়পুত্র, বর্ধমান থেকে বিএ ডিগ্রিখানা যেমন এনেছে তার সঙ্গে এই কলের গান এনে একটা মস্তো কাজের কাজ করেছে”

 

বিকেল থেকে সন্ধে পর্যন্ত শরীরে যে একটা হাল্কা, ঝরঝরে অনুভূতি হচ্ছিল, এখন সেটা আর নেই। বুকের চাপটা বাড়ছে, জাঁকিয়ে বসেছে। শ্বাস নিতে অস্বস্তি হচ্ছে কিছুটা। ষোড়শীবালা রাত্রের খাবারের জন্যে যখন ডাকলেন, মনের মধ্যে খাবার কোন ইচ্ছে টের পেলেন না।

অনাদি বললেন, “রাত্রে কিছু খাবো না, ভাবছি”।

“সে কী? আবার কী শরীর খারাপ লাগছে নাকি? সন্ধ্যেবেলা যে বললে ভালো আছো?

“ভালই তো ছিলাম। এখন আবার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। বুকের কাছে একটু চাপ মতো লাগছে”

“বিষ্ণুকে বলি, করুণা ডাক্তারকে খবর দিক”

“না, গো না। সে রকম কিছু নয়। একটু শুয়ে ঘুমোলেই ভালো হয়ে যাবে। কাল সকালে যা হবার হবে, এখন এই রাত্রে আর লোককে ব্যতিব্যস্ত করে লাভ নেই”

“তাহলে, এককাজ করি, দুটো রুটি আর একটু দুধ এনে দি, খাও”

“না, না, এখন আর কিছু খাবো না। এক গেলাস জল দাও বরং খেয়ে শুতে যাই”

“তাই আবার হয় নাকি? সারারাত না খেয়ে কাটাবে? কথায় আছে, রাতের উপোসে হাতিও দুব্বল হয়ে যায়। তুমি আর না করো না, দুধ-রুটি এনে দি, খেয়ে শুয়ে পড়ো”

অনাদি বাধ্য হয়েই খেতে বসলেন, বিষ্ণু আর তিনি পাশাপাশি বসলেন। বিষ্ণু ভাত-ডাল, আলু পোস্ত আর মাছের ঝাল খেলেন, অনাদি খেলেন রুটি আর দুধ। সংক্ষিপ্ত খাওয়া সেরে অনাদি চলে গেলেন নিজের ঘরে। বিছানায় টানটান শুয়ে শ্বাস নিতে লাগলেন, জোরে জোরে। বুকের অস্বস্তিটা বাড়ছে।

কিছুক্ষণ পর সোনা আর মণি এলেন বাবার কাছে। সোনা জিগ্যেস করলেন, “বাবা, কি ঘুমোলে?

“নারে মা, আয়। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে তো। পান্না, হীরুর খাওয়া হয়েছে”?

“হ্যাঁ বাবা, ওদের খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে এলাম। মা বলল, তোমার নাকি শরীর ভালো লাগছে না”!

“হুঁ ওই রকমই। বয়েস তো হচ্ছে”!

মাথার কাছে বসে, সোনা বাবার কপালে হাত দিয়ে বললেন, “তুমি এত ঘামছো কেন, বাবা? অঘ্রাণের শেষ, আমাদের সবার গায়েই চাদর থাকা সত্ত্বেও শিরশিরে ঠাণ্ডা লাগছে। আর শুধু একখানা জামা গায়ে দিয়ে তুমি ঘামছো? খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা? দাদাকে বলি, করুণামামাকে খবর দিক, একবার দেখে যাক”

“না রে পাগলি। অস্বস্তি একটু হচ্ছে। সে তেমন কিছু না। অল্পতেই লোককে ব্যস্ত করিস না”সোনা আর কথা বললেন না। তাঁর মনে হল, কথা না বাড়িয়ে, চোখ বুজে চুপচাপ শুয়ে থাকলে বাবা স্বস্তি পাবেন। সোনা বাবার মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন আর মণি হাত বোলাতে লাগল বাবার পায়ে। বাঁ হাত বাড়িয়ে হ্যারিকেনের পলতেটা একটু নামিয়ে দিলেন, ঘরের আলোটা স্তিমিত হয়ে এলে অনেকটা।

ঘামটা কমছিল না। শ্বাস নিতেও কষ্টটা বাড়ছিল। তার সঙ্গে পেটেও একটা অস্বস্তি। অনাদি কিছুক্ষন চোখ বুজে শুয়ে থাকার পর ভাবলেন, একবার বাহ্যে গেলে, কিছুটা স্বস্তি মিলবে হয়তো। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন, বললেন, “হ্যারিকেনটা নিয়ে আমার সঙ্গে একটু চ তো মা, একবার পাইখানায় যাই”

সোনা দ্রুত উঠে এসে হ্যারিকেনের পলতে উঠিয়ে আলোটা বাড়িয়ে দিলেন। আর মণি দৌড়ে গেল গামছা আনতে। সোনা বললেন, “পেট খারাপ হয়নি তো, বাবা?

“নাঃ। সকালে মাঠে গেলাম। ভালোই তো হল। জানি না কেন, এখন মনে হচ্ছে আবার হবে”

অনাদি ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরোলেন, সামনে হ্যারিকেন হাতে সোনা। মণিও সঙ্গে রইল, তার হাতে গামছা। নতুন ঘরের পৈঠেতে ধুতি, জামা ছেড়ে, অনাদি গামছা পরে, পাইখানার দিকে এগোলেন। সোনা মণিকে বললেন, “তুই হ্যারিকেন দেখিয়ে বাবার সঙ্গে যা। বাবা ঘরে ঢুকে গেলে হ্যারিকেনটা ধাপিতে রেখে আসিস। ততক্ষণ আমি একটা বালতিতে জল নিয়ে আসি”সোনা টিউবওয়েল টিপে এক বালতি জল এনে পাইখানার দরজার সামনে রাখলেন। মণির হাত ধরে বললেন, “চ আমরা নতুন ঘরের দাওয়ায় বসি, বাবার হয়ে গেলে আসবো”ওরা দুবোনে দাওয়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, লক্ষ রাখতে লাগল পাইখানার দরজার দিকে। দুজনেই খুব উদ্বিগ্ন। মণি বলল, “আমার কিন্তু খুব ভয় করছে, দিদি। দাদাকে বললে হতো না?

“দাদাকে বলবো তো, বাবাকে ঘরে নিয়ে যাই, দাদাকে খবর দেব” দুজনে আর কোন কথা বলল না। নানান চিন্তা করতে করতে সোনার মনে হল, বসত বাড়ির ভেতরেই আজ যদি এই পাইখানা না থাকতো, কী হত?  অসুস্থ শরীরে বাবাকে আজ খিড়কির বাঁশবাগানে ছুটতে হতো!

সোনা নিজেই তখন ফ্রক পরা ছোট্ট খুকি। তাঁর পরের বোন সাবির বয়েস ছয়, মণি বছর তিনেকের, আর ভাই চিনু তখন মায়ের পেটে। বাড়িতে নতুন কুয়ো বসানোর তোড়জোড় চলছিল। দাদা তখন সবে বর্ধমান গেছেন, কলেজে পড়তে। দাদা বাড়ি এসে সব শুনে, বাবাকে বলেছিলেন,

“কুয়ো বসাতে হও বসাও, সেখানে একটা পাইখানা হোক। আর জলের জন্যে বসাও টিউকল। চিরকালের মতো সমস্যা মিটে যাবে। বাড়ির মেয়েগুলোকে, মাকে আর ভোর বেলা মাঠে ছুটতে হবে না”দাদার কথায় বাবা গুরুত্ব দেননি, বলেছিলেন, “আজকালকার ছোকরাদের শুধু বারফট্টাই। খরচ-খরচার ব্যাপারটা দেখতে হবে না? আমার উপযুক্ত ছেলে, বাবার জমিদারি দেখে ফেলেছে! বাহ্যে করতে মানুষ মাঠে যাবে না তো কি, ঘরে হাগবে? যত্তোসব উদ্ভট চিন্তা ভাবনা”

আর মা বলেছিলেন, “সে কি, বাছা? বাড়িতে নিত্যসেবার শালগ্রাম ঠাকুর রয়েছেন, সে বাড়ির ভেতরে হবে পাইখানা? ছি ছি এ কথা তুই ভাবতে পারলি, বিষ্ণু?” দাদা কথা বাড়াননি। বাবা-মায়ের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। তারপর পাঁচিলের ধারের ওই কোনায় কুয়ো খোঁড়া হল, জল উঠল। কুয়োর পাড় বাঁধিয়ে, শানের চাতাল বানিয়ে জল তোলা শুরু হল। দাদা বর্ধমান থেকে ছুটিতে এসে, একদিন খুব ভোরে সেই কুয়োর পাড়ে বসেই বাহ্যে করে, নোংরা করে দিলেন কুয়োটা। সকালে বলেও দিলেন সে কথা মাকে এবং বাবাকে। কদিন খুব চেঁচামেচি, হৈচৈ চলল। দাদার সঙ্গে বাবা কথা বলাই বন্ধ করে দিলেন বেশ কদিন। শেষমেষ মা বুঝিয়েসুঝিয়ে বাবাকে রাজি করিয়েছিলেন। চারপাশে দেয়াল তুলে, দরজা বসিয়ে, টিনের চালের ছাউনি দিয়ে ঘর হল। কুয়োর মুখে ঢালাই করে, পাদানি লাগিয়ে, বসার জায়গা তৈরি হল। চালু হয়ে গেল পাইখানার ঘর। প্রথম প্রথম তাদেরও দাদার ওপর খুব রাগ হয়েছিল, বাবা, মায়ের সঙ্গে অমন শয়তানি করার জন্যে। কিন্তু যত বড়ো হয়েছে, তারা সকলেই বুঝেছে এর প্রয়োজনীয়তা। তারা বুঝেছে, উদ্দেশ্য সঠিক হলে, বাবা-মায়েরও কিছু কথার অবাধ্য হওয়াটা জরুরি। আজ আরেকবার সেটা টের পেল সোনা।

দরজা খুলে অনাদি বালতির জল ভেতরে নিলেন। একটু পরে আবার বেরিয়েও এলেন। হ্যারিকেনের আলোয় তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দুই বোনেই খুব ভয় পেয়ে গেল। বাবার চোখের চাউনি কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত, ভয়ার্ত। দুই বোনে এগিয়ে যেতে, অনাদি জিজ্ঞাসা করলেন, “শব্দটা কিসের বল তো, মা? বুঝতে পারলি?”

“শব্দ? কিসের শব্দ, বাবা?”

“সে কি, তোরা শুনতে পাসনি? অত জোরে আওয়াজ হল, আর তোরা শুনতে পাসনি? টিনের চালে ভারি পাথর আছড়ে পড়ার মতো, বিকট আওয়াজ?”

“না তো। আমরা দুজনেই তো সারাক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়েছিলাম”

“সে কি রে? ওই আওয়াজের পরেই, সব কিছু যেন অন্ধকার হয়ে গেল। আমার মাথাটা কেমন টলে উঠল। আমি কোথায়, এখন দিন না রাত, কিছুই যেন বুঝতে পারছিলাম না। একটু পরেই আস্তে আস্তে আবার সব ঠিক হয়ে এল। কী হলো বল তো, মা?” দুই বোনের কেউই কোন উত্তর দিতে পারল না। তবে তারা বুঝতে পারল, বাবার শরীর একদমই ভালো নয়। এখনই করুণামামাকে খবর দিতে হবে।

দুই মেয়ের সঙ্গে টিউকলের দিকে যেতে যেতে অনাদি শিউরে উঠলেন একবার। তাঁর বাঁদিকের ঘাড়, কাঁধ, বাহুতে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করছেন। এসব কিসের লক্ষণ? সোনা টিউকল টিপে জল করে দিলেন, অনাদি হাত, পা মুখ ধুলেন। তারপর মণির হাত থেকে নিয়ে ধুতি আর জামা পরে বললেন,

“আমি এখন ঘরে যাবো তনু, আমাকে একটু ধর। বিকাশ, বিষ্ণুকে গিয়ে শিগ্‌গির খবর দে, মা। তোদের মাকেও ডাক। বেশি সময় আর নেই রে, পাগলি”বাবার এই অসহায় কথায় সোনা কেঁদেই ফেললেন, মণিও।

“কীসব আবোল তাবোল, বলছো বাবা” সোনা আর মণি কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে উঠলেন,

‘দাদা, দাদা, ও মা। মা? বাবা কেমন করছে, শিগগির এসো’

বিষ্ণু ঘরে বসে লণ্ঠনের আলোয় বই পড়ছিলেন, দৌড়ে এলেন। ষোড়শীবালা আর বৌমা সকলকে খাইয়ে, হাতের কাজ কর্ম সেরে খেতে বসেছিলেন। খাওয়া ছেড়ে, কোনমতে হাতে জল দিয়ে দৌড়ে এলেন। অনাদি বিছানায় শুতে শুতে সকলের দিকে তাকালেন, তাঁর চোখের দৃষ্টি অস্বচ্ছ। বাবার মুখের দিকে একবার তাকিয়েই, বিষ্ণু দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন। সদরের খিল খুলে অন্ধকার পথে দৌড়ে চললেন করুণামামার বাড়ি। তাড়াহুড়োতে টর্চটা আনার কথা মনে হয়নি।

বাবার বুকে হাত বোলাতে বোলাতে, সোনা আর মণি ব্যাকুল হয়ে জিগ্যেস করতে লাগলেন, “বাবা, ও বাবা? কোথায় কষ্ট হচ্ছে, বাবা? ও বাবা, কথা বলছো না, কেন? একটু জল এনে দিই খাও না, বাবা”।

অনাদি হাতের ইঙ্গিতে জল চাইলেন। হাতে ভর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু হাত কাঁপছিল থরথর করেসোনা আর ষোড়শিবালা দুজনে মিলে উঠে বসিয়ে দিলেন অনাদিকে। বৌমা কলসি থেকে এক গেলাস জল এনে বাবার হাতে তুলে দিলেন। গেলাস খালি করে এক চুমুকে জল খেয়ে, অনাদি তৃপ্তির শ্বাস ছাড়লেন ‘আঃ’আবার শুয়ে পড়তে পড়তে জিজ্ঞাসা করলেন, “এত রাত হল, বিষ্ণু এখনো ফেরেনি?”

ষোড়শীবালা বললেন, “বাড়িতেই তো ছিল, ও তো করুণাকে ডাকতে বের হল এইমাত্র”সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে, অনাদি বালিশ জড়িয়ে পাশ ফিরে শুলেন। দু তিনবার দীর্ঘ শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে, চোখ বন্ধ করলেন। সোনা আর মণির হাতের তালুর নিচে স্থির হয়ে গেল তাঁর হৃদয়ের স্পন্দন। হাহাকার করে উঠলেন দুজনে।

ষোড়শীবালা দিশাহীন দৃষ্টিতে দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলেন, “তোরা অমন কেঁদে মরছিস কেন, পোড়ারমুখি? বিষ্ণু আসছে তো ডাক্তারকে নিয়ে, এত অধৈর্য হলে হয়? বিষ্ণুটাও কী যে করছে, কখন গেছে, এখনো ফেরার নাম নেই। বৌমা, চিনুকে একবার পাঠাও না। আলোটা নিয়ে সদরে দাঁড়িয়ে দেখুক দাদা আসছে কিনা?”

বৌমা ষোড়শীবালাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “চিনুতো নেই, মা। চিনু কালনা গেছে বড়দির বাড়ি। আপনার ছেলে এখনই এসে যাবে মা”

“সেই থেকে তো এসে যাবে এসে যাবে করছো, কোথায় আসছে বাছা? মানুষটা যে কষ্ট পাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছো না”

বিষ্ণু আর ডাক্তার করুণাসিন্ধু ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। অনাদির মুখের দিকে তাকিয়েই, তাঁর মুখটা পাথরের মতো হয়ে গেল। তাঁর মুখের দিকে সকলের অসহায় দৃষ্টি। বিছানায় বসে, তিনি অনাদির একটা হাত তুলে নাড়ি পরীক্ষা করলেন। তারপর চোখের পাতা টেনে টর্চের আলোয় পরীক্ষা করলেন চোখের মণি। উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় নত করে, বললেন, “আমার আর কিছু করার নেই, দিদি”

ষোড়শীবালা প্রচণ্ড আক্ষেপে চেঁচিয়ে উঠলেন, “তুমি কিছু করার নেই বললেই আমি শুনবো? জলজ্যান্ত মানুষটা, এই তো একটু আগেই গান শুনল, খাবার খেল, আর তুমি বলছো কিছু করার নেই? বিষ্ণু তুই গাড়ির ব্যবস্থা কর। আমি এখনই তোর বাবাকে বর্ধমান নিয়ে যাবো। সেখানে না হলে, কলকাতা”

বিষ্ণু মায়ের পাশে বসে, জড়িয়ে ধরলেন, মাকে। দুজনেই কাঁদতে লাগলেন হাহাকার করে। কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে ভয়ে ভয়ে নিচেয় নেমে এল, সুভা, কলু আর হীরু। সুভার কোলে পান্না। ওদেরকে কাছে টেনে নিলেন বৌমা। পান্নাকে তিনি নিজের কোলে নিলেন। এতজনের কান্নায় বিহ্বল পান্না, বিপন্ন মুখে তাকিয়ে দেখতে লাগল সকলের মুখ। তাকে ভালোবাসার, তার নির্ভরতার সব মুখগুলিই এখন অসহায়, ব্যাকুল। তার কাছে এই স্মৃতি স্থায়ি নয়, কিন্তু দুর্বোধ্য এক বোধ তার মনে বাসা বেঁধে রইল।

 ..০০..

পরের পর্ব "পাখির চোখ" এই সূত্রে - পাখির চোখ  

আগের পর্ব " অভাব জয়ের স্বভাব" - এই সূত্রে - অভাব জয়ের স্বভাব

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

ধর্মাধর্ম - ১/৫

[এর আগের পর্ব পড়তে  হলে এই সুত্রে প্রবেশ করুন -  ধর্মাধর্ম - ১/৪ ]   প্রথম পর্ব  (৭০ , ০০০ বিসিই থেকে ১২ , ০০০ বিসিই) - ৫ম পর্বাংশ ১.৪.২ বিশ...