শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৫

ধর্মাধর্ম - ১/২

 

প্রথম পর্ব (৭০,০০০ বিসিই থেকে ১২,০০০ বিসিই) - ২য় পর্বাংশ

১.২.২ বিজ্ঞানের স্ফুলিঙ্গ

তবে অবরে সবরে ইরেক্টাসদের কপাল অবিশ্যি খুলেও যেত। যেমন হয়েছিল সেদিন। সকাল সকাল অরণ্যে খাদ্য সন্ধানে[1] গিয়ে হঠাৎ তাদের চোখে পড়ল দলছুট একলা এক বুনো শুয়োর[2] ঝোপঝাড়ের আড়ালে বড়ো এক পাথরে পিঠ দিয়ে সেটা শুয়ে আছে। পশুটার লক্ষণ দেখে দলের বয়স্ক এবং অভিজ্ঞরা বুঝে গেল এর আয়ু বেশিক্ষণ নেই। পশুটার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, হয়তো তার নিজেরই দলের যুবক বরাহের সঙ্গে প্রাণপণ লড়াইতে মারাত্মক জখম হয়েছে। সে এখন অত্যন্ত দুর্বল - মৃত্যুর প্রহর গুনছে। ভাগ্য ভাল এখনও কোন হায়না বা শৃগাল এর সন্ধান পায়নি, রক্তের গন্ধে তারা যে কোন মূহুর্তে চলে আসতে পারে, আর তাহলেই এমন সুযোগ ফেলে পালাতে হবে ইরেক্টাসদের।

ইরেক্টাসদের দল একহাতে লাঠি বা বাঁশ নিয়ে চটপট ঘিরে ধরল শুয়োরটাকে। অন্য হাতে মাটিতে পড়ে থাকা পাথরের টুকরো তুলে দাঁড়িয়ে রইল। সকলেই উত্তেজনায় টানটান, অপেক্ষা করতে লাগল সর্দারের সংকেতের। এবং সংকেত আসতেই সকলে একসঙ্গে ছুঁড়তে শুরু করল পাথরের টুকরো। চার-পাঁচজন সতর্ক ভঙ্গিতে আরও এগিয়ে গেল পশুটার দিকে, তারপর পশুটার পিঠে মাথায় লাঠির বাড়ি লাগাতে শুরু করল দমাদ্দম। দুর্বল পশুটা এবার ভয় পেল, তার ঘোলাটে চোখে এখন যুগপৎ রাগ এবং ভয়। কোনরকমে সে উঠে দাঁড়াল, তারপর পাথরের টুকরোর আঘাতে অতিষ্ঠ হয়ে দৌড় লাগাল ইরেক্টাসদের ব্যূহ ভেদ করে। প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও ইরেক্টাসের দল তাড়া করে গেল দুর্বল শুয়োরটার পিছনে, পিছনে রয়ে গেল মাত্র দুজন।

শুয়োরটা পালানোর সময় তার দাঁতের আঘাতে জখম করে দিয়েছে একজন ইরেক্টাসকে, সে মাটিতে পড়ে কাতরাতে লাগল, তার উরুর ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে দরদর করে। তার এই অবস্থা দেখে তরুণ এক ইরেক্টাস, ওখানেই রয়ে গেল। আশেপাশের ঝোপঝাড় থেকে লতাপাতা, এনে চটপট প্রলেপ বানিয়ে ঢেকে দিল আহতের ক্ষত। রক্ত ক্ষরণ বন্ধ হতে আহত মানবটি আচ্ছন্ন অবস্থায় শুয়েই রইল ঘাসে। তরুণ বসে রইল আহতের পাশে, সে এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত। তার দলের লোকেরা শুয়োরটাকে মেরে নিশ্চয়ই তাড়তাড়ি ফিরবে, ততক্ষণ আহত লোকটিকে নিয়ে তাকে ওখানেই অপেক্ষা করতে হবে।

হঠাৎই তার নাকে এসে লাগল শুকনো পাতা-ডালাপালা পোড়ার গন্ধ। এ গন্ধ সে চেনে, অরণ্যে আগুন লাগলে দূর থেকে এই গন্ধেই তারা টের পায়। আতঙ্কে সে উঠে দাঁড়াল, কোনদিকে কোথায় আগুন লেগেছে? তার দল কে জানে অরণ্যের কতদূরে ঢুকে পড়েছে, সে এখন কী করবে? আহত লোকটিকে নিয়ে সে কোন দিকে যাবে? অসহায় ভয়ে চারপাশে খুঁজতে খুঁজতে, সে দেখতে পেল, বুনো শুয়োরটা যে বড়ো পাথরে পিঠ দিয়ে শুয়েছিল, তার সামনের ঝোপঝাড়গুলিতে আগুন ধরেছে, বড়সড়ো নয়, ধিকিধিকি জ্বলছে, তারই হাল্কা ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে।

তার মনে হল, এই আগুন বাড়তে বাড়তে তাদের হয়তো গ্রাস করবে। প্রচণ্ড আতঙ্কে সে চিৎকার করে উঠল, তারপর উন্মাদের মতো, পাথর ছুঁড়তে লাগল জ্বলতে থাকা ঝোপগুলোর দিকে। রাগে চিৎকার করতে করতে বেশ অনেকক্ষণ পাথর ছোঁড়ার পর, সে হঠাৎই লক্ষ্য করল আগুন আর জ্বলছে না, ধোঁয়াও বন্ধ হয়েছে। ভারি অবাক হল, আগুন কী নিভে গেল? আগুন কী নেভানো যায়? ঠিক বিশ্বাস হল না যেন। সন্তর্পণে ঝোপের কাছে এগিয়ে গিয়ে সে দেখল, তার ছোঁড়া পাথরের স্তূপের মধ্যে আগুন সত্যিই নিভে গেছে।

একটু নিশ্চিন্ত হয়ে সে নিচু হয়ে কয়েকটা পাথরের টুকরো হাতে নিয়ে চিন্তা করতে লাগল, জখম পশুটা যখন এই বড় পাথরটার নিচে শুয়েছিল, তখন নিশ্চয়ই আগুন ছিল না। যদি থাকত, শুয়োরটা নিশ্চয়ই এখানে নিরাপদ আশ্রয় ভাবত না। তাহলে তারপরে আগুন কী করে জ্বলল? ভাবতে ভাবতে দু হাতের দুটো পাথরে একটু ঘষাঘষি করতেই সে ভয়ে আঁতকে উঠে ফেলে দিল পাথর দুটো। কী ভয়ংকর, এই পাথরগুলোতেই যে আগুন রয়েছে!  অদ্ভূত দুই পাথরের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল তরুণ ইরেক্টাস। তারপর নিচু হয়ে বসে সেই পাথরদুটো আবার তুলে নিল হাতে। তারা নদীর ধারে যে নুড়ি পাথর সংগ্রহ করে, এই পাথরগুলো তেমন নয়। পাথরের গা অনেকটাই মসৃণ, রংটাও বেশ কিছুটা আলাদা। খুব সন্তর্পণে পাথরদুটো আবার ঘষতেই ফস করে আবার স্ফুলিঙ্গ দেখতে পেল। এবার অতটা ভয় লাগল না, বার বার ঘষতে ঘষতে বেশ বড়ো বড়ো ফুলকির ছিটে বেরোতে লাগল পাথর থেকে। মাটি থেকে তুলে এই পাথরগুলোই যখন তারা পশুটার দিকে ছুঁড়ছিল, কিছু কিছু পাথর কি অন্য পাথরে লেগে ফুলকি ছিটকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে শুকনো ঘাস পাতায়?

হঠাৎ কিছু মনে হতে তরুণ ইরেক্টাস মাটিতে বেশ কিছু শুকনো ঘাস-কুটোকাটা-পাতা যোগাড় করে একটা স্তূপ বানাল। তারপর পাথর দুটো ঘষে শুকনো পাতার খুব কাছাকাছি ফুলকি সৃষ্টি করতে লাগল। এই ফুলকি থেকে কী শুকনো পাতা-কাঠ-কুটোয় আগুন ধরানো সম্ভব? সেটাই সে আবিষ্কার করতে চাইছিল। অনেকক্ষণ ধরে ঘষে ঘষে যখন সে অধৈর্য হয়ে উঠছিল, মনে হচ্ছিল, আগুন এভাবে জ্বলে না, জ্বলতে পারে না। “ধুস এই পণ্ডশ্রম করে আর লাভ নেই” এমনই বিরক্তিতে পাথর দুটো শেষবারের মতো জোরে ঘষতেই তার জোরালো ফুলকিতে শুকনো পাতায় আগুন ধরে গেল। ভয় পেয়ে সে প্রায় উলটে পড়ে যাচ্ছিল আর কি, কিন্তু একটু লক্ষ্য করে দেখল ভয় পাওয়ার মতো তেমন কিছু ঘটেনি। জ্বলতে থাকা শুকনো পাতার ওপর কিছু কাঠকুটো শুকনো ঘাস ধরতে সেগুলোতেও আগুন ধরে গেল। তার মানে সে ছোট্ট একটা আগুন তৈরি করতে পেরেছে, আগুনটা কিছুক্ষণ জ্বলতে দিয়ে, সে এবার পাথর দিয়ে কিছুটা মাটি চাপা দিয়ে দিতে সে আগুন নিভেও গেল সহজেই।

সেই তরুণ ইরেক্টাস বেশ মজা পেল। এতদিন সে বড়োদের মুখে শুনেছে, দু একবার নিজের চোখেও দূর থেকে দেখেছে অরণ্যের মধ্যে আগুনের তাণ্ডবলীলা। সেই আগুনই খুব ছোট্ট হয়ে, তার হাতে কী বশ মানল? সে পিছন ফিরে দেখল তার আহত সঙ্গী এখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে ঘাসের ওপর শুয়ে। সে ঘাসের ওপর বসে বারবার দুই পাথর ঘষে রপ্ত করতে লাগল আগুন জ্বালানো আর নেভানোর খেলা।

শেষ দুপুরে তার দলের মানবেরা যখন প্রবল হইচই করতে করতে বড়ো আর মোটা গাছের ডালের সঙ্গে লতার দড়ি দিয়ে বাঁধা বিশাল শুয়োরটাকে বয়ে আনল, ততক্ষণে সে দক্ষ হয়ে উঠেছে আগুন জ্বালানো ও নেভানোর প্রক্রিয়ায়। আর দেরি না করে বড়ো পাতায় মুড়িয়ে লতার বাঁধনে বেঁধে সে বেশ কিছু পাথর কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। তারপর দু তিনজন মিলে আহত সঙ্গীকে নিয়ে তারা সব্বাই রওনা হল তাদের রাতের আশ্রয়ের দিকে। আজ তাদের বড়ো আনন্দের দিন। মহাভোজের আনন্দে তাদের আর যেন তর সইছিল না, তারা প্রচণ্ড উৎসাহে চিৎকার করতে করতে দৌড়তে লাগল। এই চিৎকার শুধু আনন্দের নয়, প্রবল এই চিৎকারে দূরে থাকবে পিছু নেওয়া শ্বাপদের দলও!

শিকার করা পশুকে নিয়ে বাসায় যখন তারা ফিরল, তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছিল। গহন অরণ্যের কোনে কোনে জমে উঠছিল রহস্যময় রাতের আঁধার। বয়স্ক পুরুষ ও মহিলারা যাঁরা বাসাতেই থাকেন শিশু এবং বাচ্চাদের সামলাতে, তাঁরাও আজ আনন্দিত। এতবড়ো জন্তু শিকার হয়েছে, গোটা দলকে অন্ততঃ দু-তিনদিন খাদ্যের চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু তাঁরা উদ্বিগ্ন, এখনই অন্ধকার নেমে আসবে, তখন রক্ত মাংসের গন্ধে চলে আসবে হিংস্র শ্বাপদের দল। তাঁরা সকলকে তাড়া দিলেন “তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি, ছালটাল ছাড়িয়ে বাচ্চাদের আগে খাইয়ে ওদের ঘুম পাড়াতে হবে, তারপর বড়োরা খাবে... আজ রাত জাগতে হবে সবাইকে, পাহারা দিতে হবে...তাড়াতাড়ি...”।

সেই তরুণ ছেলেটি, তার নাম দেওয়া যাক অগ্নি, হাসল, মাকে বলল, “অত চিন্তা করো না, মা। আমি ব্যবস্থা করছি। কোন বজ্জাত জন্তুর ক্ষমতা হবে না এদিকে আসার”। “তুই আবার কী করবি”, ছেলের ছেলেমানুষি কথায় মা বিরক্তই হলেন। কিন্তু সকলেই যখন মৃত পশুকে সাফ করে খাবার উপযুক্ত করে তুলতে ব্যস্ত তখন বাসার চারদিকে জ্বলে উঠল বেশ কয়েকটি অগ্নিকুণ্ড। সেই আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। প্রথমে সকলে বেশ ভয় পেলেও একটু পরে সকলেই ভরসা পেল অগ্নির কথায় এবং কৃতিত্বে। সেদিনের গভীর রাত পর্যন্ত মহাভোজটা জমে উঠল আনন্দ-উত্তেজনায়।

কিছুটা দূর থেকে বন্য পশুদের চাপা গর্জন শোনা যাচ্ছিল, ওরাও আজ আশ্চর্য ও ভীত। দুপেয়ে এই মানবগুলো আগুন জ্বালিয়ে ফেলল কেমন করে? ওদের ডাক শুনতে শুনতে অগ্নির মা, ছেলের মাথার চুলগুলি এলোমেলো করে দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, “জানোয়ারগুলোকে আজ খুব জব্দ করেছিস, অগ্নি। এমন রোজ পারবি তো?” অগ্নি শুয়োরের এক টুকরো মাংস চিবোতে চিবোতে বলল, “পারবো মা”।

এভাবেই মানব জীবনে কিছুটা স্বস্তি আর নিরাপত্তা এনে দিয়েছিল আগুনের ব্যবহার। কিন্তু এই যুগান্তকারী ঘটনার কোন ইতিহাস নেই।    

১.২ আগুনের সীমিত ব্যবহার

দুটো পাথরে ঠোকাঠুকি করলে ছোটখাটো যে আগুনের ফুলকি দেখা যায়, তা দিয়ে কিন্তু আগুন জ্বালানো যায় না। আগুন জ্বালানোর জন্য অনেক বড়ো ফুলকির দরকার হয়, আর যে দুটো পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর মতো ফুলকি তৈরি করা যেত তারা প্রধানতঃ হল ফ্লিন্ট (Flint) আর পাইরাইট (Pyrite) পাথর। এই পাইরাইট যদি লোহা মিশ্রিত হয়, তবে তার ফুলকি হয় সবচেয়ে জোরদার। চক বা চুণাপাথরের (Lime stone) মধ্যে কেলাসিত (crystallized) একটি বিশেষ কোয়ার্জ (Quartz) পাথরকে ফ্লিন্ট বলে।

 

উপরের ছবিটি প্রস্তর যুগের একটি ফ্লিন্ট পাথরের অস্ত্র[3]। এই ফ্লিন্ট পাথরের বিশেষত্ব হল, একটা বিশেষ দিক থেকে আঘাত করলে, বেশ পাতলা, মসৃণ অথচ শক্ত স্তরে ভেঙে যায়। তারপর একটু ঘষাঘষি করলে, পাথরের ধারালো অস্ত্র বানিয়ে তোলা যেত সহজেই। প্রস্তর যুগের মানুষেরা যখন পাথরের অস্ত্রশস্ত্রই বহুল ব্যবহার করত, তাদের কাছে ফ্লিন্ট পাথরের অস্ত্র ছিল সব থেকে কাজের জিনিষ। আর পাইরাইট একধরনের খনিজ পাথর, প্রধানত লোহা বা তামার সালফাইড; পাললিক (sedimentary) পাথরের স্তরে মাঝে মধ্যেই পাওয়া যায়। বহুদিন পরে মানুষ যখন লোহা আবিষ্কার করতে পেরেছিল, তখনও লোহা আর এই ফ্লিন্ট পাথরের ঘর্ষণে আগুনের ফুলকি ব্যবহার করেই আগুন জ্বালাত। সত্যি বলতে ইলেক্ট্রনিক লাইটার আবিষ্কারের আগে, সেই সেদিন পর্যন্ত আমরা যে গ্যাসলাইটারে লোহার চাকায় চাপ দিয়ে আগুন জ্বালতাম, তার নিচেয় থাকত ফ্লিন্ট পাথরের ছোট্ট একটা কুচি, যাকে চলতি বাংলায় আমরা চকমকি পাথর বলি। অতএব ইরেক্টাস প্রজাতির সেই ছোকরা মানব দৈবাৎ যে পাথরে আগুনের ফুলকি খুঁজে পেয়ে আশ্চর্য হয়েছিল, সেটি ছিল এই Flint stone-এর টুকরো।

তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, কয়েক লক্ষ বছর ধরে ইরেক্টাস এবং নিয়াণ্ডারথাল মানব প্রজাতি নিয়মিত আগুন ব্যবহার করলেও (অধ্যায় ১.১-এর সারণি দেখুন), তারা আগুনের সীমাহীন সম্ভাবনার কথা চিন্তাই করতে পারেনি। শুরুর দিন থেকেই তারা আগুনের ব্যবহার করেছিল রাতের অন্ধকারে বন্যপশুদের আক্রমণ থেকে তাদের আশ্রয়গুলিকে নিরাপদ রাখতে। আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডার দিনে আগুনের তাপে হাত-পা গা সেঁকে একটু আরাম উপভোগ করতে। এছাড়া আগুনের অন্য কোন ব্যবহারের নিদর্শন প্রত্নবিজ্ঞানীরা খুঁজে পাননি।

কিন্তু আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ - পঞ্চান্ন হাজার বছর আগে আগুনের আরেকটি চমকপ্রদ গুণ আবিষ্কার করে ফেলেছিল, আমাদের পূর্বপুরুষ - হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির মানুষ। সেটাও একটা দৈবাৎ ঘটনা, কিন্তু তার ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। পৃথিবীতে আমরা যে আজ শ্রেষ্ঠ এবং সব থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি, তার সূচনা হয়েছিল সেই দিনটিতেই। কল্পনায় সেদিনের ঘটনাটার দিকে একটু চোখ ফেলা যাক। তারপর আলোচনা করা যাবে এই আবিষ্কারের আশ্চর্য ফলাফলের।

১.২.১ দাবানলের অভিজ্ঞতা

এবার আমি পৌঁছে গেছি আজ থেকে পঞ্চাশ - পঞ্চান্ন হাজার বছর আগের এক রাতে। ছোট্ট এক পাহাড়ের মাথায় বসে, পাহাড়তলির জঙ্গলে আমি ভয়ংকর এক দাবানল দেখছি। আমার সামনে বেশ বড়ো একটা গুহা আর তার সামনে অনেকটা সমতল জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির একটি বড়ো দল। ছেলে-মেয়ে, ছোকরা-ছুকরি, প্রৌঢ়া-প্রৌঢ়, বুড়োবুড়ি সবাই বসে বসে নিরীক্ষণ করছে, নিচের অরণ্যের তাণ্ডব দহন। চোখ ঝলসানো কমলা রঙ আর তার সঙ্গে উজ্জ্বল হলুদের লকলকে শিখায় আকাশের গায়েও যেন আগুনের রঙ ধরেছে। ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলী বয়ে তপ্ত বাতাস আমাদের শরীরেও মাঝেমাঝে জানান দিয়ে যাচ্ছে ওই আগুনের তীব্রতার আঁচ।

ছোট বড়ো গাছের কাণ্ড আর ডালপালা দাউ দাউ আগুনে ফট-ফট, মটমট শব্দে ফাটছে। তাদের ডালে ডালে বাসা বেঁধে থাকা পাখিরা তীব্র ভয়ে ডাকতে ডাকতে উড়ে পালাচ্ছে। আর কত পাখি যে বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝরে পড়ছে আগুনের মধ্যে, তার কোন হিসেব নেই। জঙ্গলের জন্তু জানোয়ারেরাও চিৎকার করতে করতে দিশাহারা হয়ে দৌড়চ্ছে। কত প্রাণী জ্বলতে জ্বলতে পড়ে গেল আগুনের মধ্যে, তারও কোন ইয়ত্তা নেই। তপ্ত বাতাস বয়ে আনছে তাদের মরণ আর্তনাদের আওয়াজ, আর রোম ও চামড়া পোড়া উৎকট গন্ধ। সে আওয়াজ আর গন্ধ মৃত্যুভয়ের কাঁপন তুলছে মানুষগুলোর পাঁজরেও। ওই আগুন উঠে এসে ছোট্ট এই পাহাড়ের মাথার বসতিকেও গ্রাস করে নেবে না তো? তাঁরাও কী নিচের ওই জন্তু জানোয়ারের মতো চিৎকার করতে করতে ঝলসে পুড়ে মারা যাবেন?

সারারাত পুরো দলটা দু চোখে আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে রইলেন নিচের আগুনের দিকে। অবুঝ শিশুরা ছাড়া কেউই ঘুমোনোর কথা ভাবতেও পারেননি। এই দলের প্রবীণতম মানুষটিও ঠায় বসেছিলেন গুহামুখের বাইরে। নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিলেন নিচের জঙ্গলের দিকে।

তেমন কোন বিপদ অবিশ্যি ঘটল না। শেষ রাতের দিকে আগুন ঝিমিয়ে এল, যদিও অজগর সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছিল সর্বত্র। মধ্যবয়স্ক এক মানুষ, খুব ক্লান্তির মধ্যেও স্বস্তির সুরে বৃদ্ধকে বললেন, “এবার মনে হচ্ছে, আগুনটা নিভে যাওয়ার মতো হয়েছে, তাই না বাবা?”

এই বৃদ্ধের পাঁচ পুত্র, সাত কন্যা। তাদের মধ্যে তাঁর বড়ো কন্যাই এই দলের নেত্রী। তিনি রাতজাগা ঘোলাটে চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, “মনে তো হচ্ছে তাই। জন্তুদের ভয় দেখাতে রোজ রাত্রে আমরা যে আগুন জ্বালি। সেই আগুনই কী ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, দেখলি?" বৃদ্ধের দুর্বল ঘাড়ের ওপর মাথা নড়তে লাগল, কাঁপতে থাকা দুই হাত জড়ো করে তিনি আগুনকে প্রণাম করলেন, বললেন, “রুষ্ট হলে এক রাত্রের মধ্যে, আগুন জ্বালিয়ে ছাই করে দিতে পারেন এত বড়ো একটা জঙ্গল। চোখের পলকে ঝলসে, পুড়িয়ে মারতে পারেন ভয়ংকর সব জন্তুকেও...। তিনি অগ্নি, তিনি রুদ্র, তিনি ভয়ংকর। কিন্তু কী উজ্জ্বল সুন্দর তাঁর এই ধ্বংসের রূপ ...”।

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে নিচের জঙ্গলের পরিস্থিতি মানুষগুলোর চোখে পরিষ্কার হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। বিস্তীর্ণ ওই জঙ্গলের থেকেই মানুষের এই দলটি তাঁদের খাদ্য আহরণ করেন, কখনো কখনো শিকার করেন ছোট ছোট প্রাণী। কিন্তু আজ সেই জঙ্গল দগ্ধ, নিঃস্ব, সেখানে কোথাও কোন প্রাণের সাড়া নেই। সবুজ অরণ্য আজ ঢাকা পড়েছে ধূসর ছাইয়ের তলায়। 

দলের ছোকরাদের মধ্যে একজন তার পাশে বসে থাকা মধ্যবয়স্কা মহিলাকে বলল, “আমাদের খাবারের যা যোগাড় আছে তাতে আজকের দিনটা হয়তো টেনেটুনে চলে যাবে, মা। কিন্তু কাল? নিচের জঙ্গল থেকে বহুদিন আর কিছুই পাওয়া যাবে না। আমাদের আজই এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে, নতুন জঙ্গলের খোঁজে। নয়তো...”।

মধ্যবয়স্কা মহিলাই ওই বৃদ্ধার বড়ো কন্যা - এ দলের নেত্রী। তিনি পুত্রের কথার না বলা অংশটুকু অনেক আগেই বুঝেছিলেন, ‘নয়তো মরতে হবে অনাহারে’। কিন্তু এই সংকট থেকে সহজে পরিত্রাণ পাওয়ার হদিশ তাঁরও জানা নেই। তিনি তাঁর বৃদ্ধ পিতার দিকে তাকালেন কোন পরামর্শের আশায়। কিন্তু বৃদ্ধও কোন উত্তর দিলেন না, তাঁর দুর্বল কাঁধের উপর নড়বড়ে মাথাটি নড়তেই লাগলো।

এই সময়েই পায়ে চলা পথে হেঁটে এক তরুণ নিচের থেকে উঠে এল সমতলে। এসময় পাহাড়তলি থেকে উঠে আসা এতই অপ্রত্যাশিত সকলেই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে এসে দলনেত্রীর পাশে বসল, বলল, “ভোরের আলো ফোটার একটু আগেই আমি নিচেয় গিয়েছিলাম, মাসি”।

বৃদ্ধ ও দলনেত্রীকে ঘিরে বসে থাকা দলের সমস্ত পুরুষ ও মহিলারা তরুণের কথা শুনে আরও বিস্মিত হল। তাদের সকলের চোখে একই প্রশ্ন, কেন গিয়েছিলি? কী করতে? এসময় একা একা কেউ নিচেয় যায়? কী দেখলি সেখানে?

কেউ জিজ্ঞাসা না করলেও তরুণ বলল, “গোটা জঙ্গলটাই বিলকুল সাফ হয়ে গেছে, মাসি। মাটিতে পড়ে আছে ছাই আর পোড়া কাঠের স্তূপ। আগুনের আঁচে ঝলসে কালো হয়ে যাওয়া প্রাণহীন বিশাল গাছগুলো আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও কোন পাখির ডাক নেই। ছোট বড়ো কোন প্রাণীর কোন সাড়াশব্দ নেই। পোকামাকড়, প্রজাপতি, ফড়িং, এমনকি একটা পোকাও দেখতে পেলাম না কোথাও। সমস্ত জঙ্গলটা নিষ্প্রাণ, বোবা হয়ে গেছে একদম”। তরুণ একটু থামল। সকলেই তার কথা শুনছিল, কেউ কোন কথা বলল না, অপেক্ষায় রইল তরুণের মুখের দিকে তাকিয়ে।

তরুণ একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “কাল সন্ধেয় আমার তেমন খাওয়া হয়নি, আমার বড্ডো খিদে পেয়েছিল, মাসি”। তরুণ এই ছেলেটি দলনেত্রীর এক বোনের ছেলে। এই ছেলেটি ওর বয়সী অন্য ভাইদের মতো দুর্দান্ত সবল নয়। বরং একটু শান্ত, ভিতু ভিতু, দল থেকে সর্বদাই আলাদা থাকে। অন্য সবাই যখন দলবেঁধে জঙ্গলের এদিক সেদিক খাবার খুঁজে বেড়ায়, এই ছেলেটা তখন পাথরের ওপর বসে, পাহাড় দেখে, আকাশ দেখে, পাখি দেখে, প্রজাপতি দেখে সময় নষ্ট করে। তাকে শোধরানোর চেষ্টাতেও বড়োরা এখন ক্ষান্তি দিয়েছে। অপদার্থ একটা - ওকে দিয়ে কিছু হবার নয়। তবুও মা-মাসির মন - দুর্বল নিরীহ এই ছেলের প্রতি একটু যেন বেশিই প্রশ্রয় তাঁদের। দলনেত্রী কিছুটা অধৈর্য হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, “খিদে পেয়েছিল তো নীচেয় গিয়েছিলি কী করতে?”

১.২.২ ঝলসানো মাংসের স্বাদ

কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে, তরুণ বলল, “ভীষণ খিদে পেয়েছিল, বিশ্বাস করো মাসি। কিন্তু চারদিকে কিচছু ছিল না খাবার মতো। একটা ফল, একটা কন্দ, এমনকি এতটুকু শাকপাতাও নয়। এধারে ওধারে পড়ে আছে অজস্র পশুর দেহ - পোড়া, ঝলসে যাওয়া। তাদের গায়ে লোম নেই, চামড়া নেই। দগদগে মাংসের স্তূপ। কোনটা কোন জন্তু চট করে চেনাও যাচ্ছে না। যাদের মাথার শিং আর পায়ের ক্ষুর বা থাবাগুলো আস্তো আছে, শুধু তাদেরই চেনা যাচ্ছে”।

সামান্য বিরতি নিয়ে, তরুণ মাসির মুখের দিকে একবার তাকাল, তারপর আবার বলতে শুরু করল, “আমার সঙ্গে বাঘনখের ছুরিটা ছিল, সেই ছুরি দিয়ে শিংওয়ালা একটা হরিণের গা থেকে এক চাকলা মাংস কেটে নিলাম। সে মাংস এতই নরম, এতটুকু কষ্ট হল না ছাড়াতে! প্রথমে একটু ঘেন্না হচ্ছিল, কিন্তু তাও মুখে দিলাম। একদম অন্যরকম স্বাদ। একটু পোড়া পোড়া গন্ধ, কাঁচা রক্ত-মাংসের গন্ধ প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু সে মাংস তুলতুলে নরম, চিবোতে, দাঁতে কাটতে এতটুকু অসুবিধে হল না। খারাপ লাগল না, মাসি। খুব খিদে পেয়েছিল, মাসি, অনায়াসে ভরপেট মাংস খেয়ে ফেললাম”।

দলের সবাই অস্ফুট আওয়াজে শিস দিয়ে উঠে বলল, “ইসসসস, শেষ পর্যন্ত তুই পোড়া মাংস খেলি? ছি ছি ছি, তোর কী এতটুকু ঘেন্না-পিত্তি নেই রে?” 

সে কথায় কান না দিয়ে, তরুণ খুব উৎসাহের সঙ্গে আরো বলল, “আমি বলি কি, মাসি। চলো না, আমরা সবাই মিলে পাহাড়তলিতে যাই, বেশ কয়েকটা ঝলসানো পশু তুলে আনি ওপরে। তাতে আমাদের তিন-চারদিন সহজেই চলে যাবে। এর মধ্যে নতুন জঙ্গলের সন্ধানে আমরা কিছুটা সময়ও পেয়ে যাবো...”।

বৃদ্ধ এতক্ষণ শুনছিলেন তরুণের কথা, শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, “হতভাগা, অপদার্থ, করেছিস কী? অগ্নির মুখের গ্রাস তুই চুরি করেছিস? তিনি ক্রুদ্ধ হলে, কী করতে পারেন গতকাল রাত্রে চোখের সামনে দেখলি না? এরপরেও তোর এমন দুর্বুদ্ধি হল কী করে?” পাঁজর কাঁপিয়ে কয়েকবার শ্বাস টেনে তিনি আবার বললেন, “তুই তো মরবিই, মারবি আমাদের সকলকে, আমাদের গোটা দলকে। হতভাগা, তোর জন্যে আমাদের সকলকে অগ্নির রোষানলে জ্বলতে হবে”।  বৃদ্ধ ক্রোধে এতটাই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন যে, তাঁর সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল থরথর করে।           

দলনেত্রী বৃদ্ধ পিতার অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হলেন, বললেন, “বাবা, তুমি এত উত্তেজিত হয়ো না তো। সারারাত তুমি একভাবে বসে আছো, এতটুকুও ঘুমোওনি। ভেতরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করো দেখি, আমি এদিকটা সামলাচ্ছি”। তিনি দুই তরুণীকে ইশারা করলেন, বৃদ্ধকে ধরে গুহার ভিতরে নিয়ে যেতে। মেয়েদুটির কাঁধে ভর রেখে গুহার দিকে হাঁটতে হাঁটতে সেই বৃদ্ধ তখনো বলে চললেন, “ওই ছোঁড়াকে দূর করে দে দল থেকে! দলের ভালো চাস তো এরকম দুরাচারকে প্রশ্রয় দিস না। হতভাগাকে শেয়ালে শকুনে ছিঁড়ে খাক, ওই হবে ওর সঠিক শাস্তি। তা নাহলে এই দলের প্রত্যেকে মরবে - জ্বলে ছাই হয়ে যাবে সব্বাই...”।

বৃদ্ধ পিতার গুহার ভেতরে না যাওয়া পর্যন্ত, দলনেত্রী কোন কথা বললেন না। তারপর বোনপোকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুই ওই পোড়া মাংস খেলি? তোর ভালো লাগলকাঁচা টাটকা রক্ত মাংস ছাড়া অন্য কোন মাংস খাবার কথা আমি তো ভাবতেই পারি না”! প্রৌঢ়া নেত্রীর কথা সব্বাই সমর্থন করল, অনেকে সেই যুবককে উপহাস করে বলল, “তাই না বটে, পোড়া মাংস আবার কেউ খায় নাকি? থুঃ থুঃ। কোন পশুকেও কোনদিন পোড়া মাংস খেতে দেখিনি। তুই তো পশুরও অধম হয়ে গেলি!”।

প্রৌঢ়া নেত্রী হাত তুলে সবাইকে চুপ করার আদেশ দিলেন, সবাই থামলে তিনি বললেন, “আমি অবশ্য অতটা বিরুদ্ধে যেতে চাইছি না। কারণ, আমরা এখন ভীষণ সংকটে, জঙ্গল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, জ্যান্ত পশুরা পালিয়ে গেছে দূরের কোন জঙ্গলে। নতুন জঙ্গল খুঁজে আমাদের সকলের বেঁচে থাকার মতো যথেষ্ট খাবার যোগাড় করতে বেশ কদিন সময় লাগবে। ততদিন, যদি একদম অখাদ্য না হয়, আমরা সবাই নিচেয় গিয়ে ব্যাপারটা দেখে আসতেই পারি”।

কয়েকজন বৃদ্ধ বাবার এবং অগ্নির রোষের কথা মনে করিয়ে দিল, কিন্তু প্রৌঢ়া নেত্রী সে কথায় কান দিলেন না। তিনি জানেন এই পরিস্থিতিতে এত বড়ো দলটাকে সুস্থ ভাবে বাঁচিয়ে রাখাটা অনেক বেশি জরুরি। অনাহারে যদি দলের অধিকাংশ মারাই যায়, তখন অগ্নির রোষে কী আর এমন এসে যাবে? তরুণ বোনপোর কথাগুলো পুরোটা মেনে নিতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু অস্বীকার করে উড়িয়ে দেওয়ার জোরও পাচ্ছেন না।  শিশু আর বৃদ্ধদের দেখা শোনার জন্যে কয়েকজন মহিলা থেকে গেল, দলের বাকিরা দ্রুত নেমে গেল পাহাড়তলির দিকে, সকলের সামনে সেই যুবক আর নেত্রী মহিলা। সকলের হাতে বাঘ কিংবা ভালুকের নখ দিয়ে তৈরি নানান আকারের ফলা।

 ফেলে যাওয়া সেই হরিণের পা থেকে বেশ কয়েকটা টুকরো মাংসের ফালি কেটে তুলল সেই তরুণ। একে একে বাড়িয়ে দিল প্রৌঢ়া নেত্রী, তার মা ও অন্যান্য মাসীদের দিকে। অধীর আগ্রহে অন্য সকলে তাকিয়ে রইল তাঁদের দিকে। মহিলারা জিভে ঠেকিয়ে স্বাদ নিলেন, গন্ধ নিলেন, তারপর দাঁতে কেটে চিবোতে লাগলেন মাংসের টুকরো। একদম অন্য রকম স্বাদ। একটু পোড়া পোড়া গন্ধ, কিন্তু তাতেও পশুর নিজস্ব গন্ধ সামান্য হলেও টের পাওয়া যাচ্ছে। তবে সব থেকে আশ্চর্য – মাংস এতই নরম, এ মাংস পূর্ণ বয়স্ক হরিণের বলে মনেই হচ্ছে না, মনে হচ্ছে খুব বাচ্চা কোন হরিণের। তাঁদের আচরণে দলের অন্য সকলেই কিছুটা ভরসা পেল, তারাও সবাই নিজেদের ফলা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাংস কেটে কেটে তুলতে।

পোড়া মাংসের অভিনব স্বাদ নিতে নিতে প্রৌঢ়া দলনেত্রী এবং তাঁর বোনেরা, দলের অন্য সকলের দিকেই লক্ষ্য রাখছিলেন। তাঁরা দেখলেন, শিকার করে আনা বড়ো একটা হরিণকে শেষ করতে যে সময় লাগে, তার অর্ধেক সময়েই দু দুটো প্রমাণ সাইজের আধপোড়া হরিণ শেষ করে দিয়েছে তাঁর দলটা। তার মানে ঝলসে যাওয়া এই পশুর মাংস ছাড়িয়ে খেতে অনেক কম সময় লাগছে। এই মাংস শিশু এবং নড়বড়ে দাঁত বৃদ্ধদের পক্ষেও অসুবিধের হবে না।

প্রৌঢ়া নেত্রী সবাইকে নির্দেশ দিলেন, যতগুলো সম্ভব এমন ঝলসানো পশু নিয়ে উপরে গুহার মধ্যে সংগ্রহ করতে, তারপর তরুণ বোনপোর কাঁধে হাত রাখলেন, বললেন, “তোর থেকে আমরা এ এক নতুন শিক্ষা পেলাম। বিপদের সময় জীবন ধারনের জন্যে প্রচলিত ভাবনা চিন্তাগুলোকে সরিয়ে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর এ কথাও ঠিক, আগুনে ঝলসানো পশু খাবার পক্ষে খুবই সুবিধের।  কিন্তু এমন তো রোজ হবে না। আর একবার আগুন লাগলে পুরো জঙ্গলই তো সাফ হয়ে যাবে! মাংস ছাড়া আমাদের আর কোন খাবারও জুটবে না। কাজেই এমন সুবিধে আমাদের ভাগ্যে রোজ রোজ না আসাই মঙ্গলের”।

“কিন্তু, মাসি, আমাদের দরকার মতো আমরা তো শিকার করে এনেও, আগুনে ঝলসে নিতে পারি!” যুবকের এই কথায় প্রৌঢ়া নেত্রী ভীষণ বিরক্ত হলেন, রূঢ়ভাবে বললেন, “অমন কথা মুখে আনলি কী করে, হতভাগা? অগ্নি আমাদের তাপ দেন, আলো দেন, রাতের অন্ধকারে পশুদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করেন। তিনি এই জঙ্গলকে কেন জ্বালিয়ে ছাই করলেন, সে তাঁর খেয়াল। কিন্তু সেই অগ্নিকে আমরা ব্যবহার করবো এমন একটা নোংরা কাজে? আমাদের শিকার করে আনা পশু ঝলসাতে? ছি, ছি, এমন কথা কোনদিন যেন আর না শুনি”। তরুণ বোনপো মাথা নিচু করে রইল, কিছু বলল না। প্রৌঢ়া নেত্রী আবার বললেন, “তাছাড়া ঝলসানো এই মাংস খেয়ে আমাদের শরীর কেমন থাকে, সেটাও তো বোঝা দরকার। আমাদের বাপ-ঠাকুরদাদের কেউ কখনো কাঁচা মাংস ছাড়া অন্য কিছু মুখেও তোলেননি, এই পোড়া মাংস যদি আমাদের পেটে সহ্য না হয়? না বাপু, যুগ যুগ ধরে যেমনটা চলে আসছে, সে পথেই চলা ভাল।”

ওই ঝলসানো মাংস যে তাঁদের অনভ্যস্ত পেটে সহ্য হয়েছিল এবং অতি সহজে হজমও হয়েছিল, সে কথা বলাই বাহুল্য। এবং অচিরেই যুগ যুগ ধরে প্রচলিত কাঁচা খাবার খাওয়ার প্রবণতা থেকেও মানুষ সম্পূর্ণ সরে এসেছিল। যদিও সেই প্রৌঢ়া দলনেত্রী আর তাঁর তরুণ বোনপো সেদিন কল্পনাই করতে পারেননি, এই আকস্মিক ঘটনা মানুষকে কোন সুদূরপ্রসারী সভ্যতার পথ দেখিয়ে দিল। পরবর্তী কয়েক হাজার বছরের মধ্যে মানুষ আগুনে ঝলসে, পুড়িয়ে, সেঁকে - শুধুমাত্র মাংস নয়, কন্দ, মূল, নানান আনাজও খেতে শুরু করেছিল। শিখে গিয়েছিল ফুটন্ত জলে সেদ্ধ করে খাবার বানানোর অজস্র প্রণালী। যাকে আমরা বলি রন্ধন। মানুষ এই রন্ধন প্রক্রিয়ায় যত সড়গড় হয়েছে, ততই প্রকৃতি থেকে আবিষ্কার করেছে নিত্য নতুন খাদ্য সম্ভার। তার মেনু ততই সমৃদ্ধ হয়েছে সুদীর্ঘ খাদ্যতালিকায়। 


...চলবে...         




[1] জঙ্গলে আদিম মানুষের জীবনধারণের পেশা অনুযায়ী বিশেষজ্ঞরা এই মানুষদের নাম দিয়েছেন hunter–gatherer বা hunter–foragerএই পর্যায়ে সংগ্রহ করাটাই ছিল আদিম মানবদের জীবনধারণের প্রধান উপায়। এই সংগ্রহ বলতে ফল-মূল-কন্দ-শাক-পাতা যেমন থাকত, তেমনি থাকত পাথরের টুকরো, গাছের শক্ত ডাল, বাঁশ, এমনকি বড়ো বড়ো জন্তুদের পায়ের হাড়, দাঁত, নখ এমন নানান জিনিষ। এগুলি তারা ধীরে ধীরে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শিখছিল, মৃত পশুদের দাঁত বা নখ ব্যবহার করত ছুরি হিসেবে, মাংস বা ফলের শক্ত খোসা কাটতে।       

[2] উল্লিখিত কাল্পনিক ঘটনায় আমি একটি বুনো শুয়োরের কথা বলেছি, এটি বুনো গোরুও হতে পারে, বাইসন হতে পারে, নীলগাই হতে পারে। আসলে যে সময়ের কথা বলেছি তখন ধর্মভিত্তিক খাদ্যাখাদ্য বিচার – গরু শুয়োর, ভেজ-ননভেজ – করে বিলাসিতার কোন অবকাশ ছিল না। সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটাই ছিল চরম বিলাসিতা।

[3] চিত্র ঋণ Wikipedia


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

ধর্মাধর্ম - ১/৫

[এর আগের পর্ব পড়তে  হলে এই সুত্রে প্রবেশ করুন -  ধর্মাধর্ম - ১/৪ ]   প্রথম পর্ব  (৭০ , ০০০ বিসিই থেকে ১২ , ০০০ বিসিই) - ৫ম পর্বাংশ ১.৪.২ বিশ...