[এর আগের পর্ব পড়তে হলে এই সুত্রে প্রবেশ করুন - ধর্মাধর্ম - ১/৪]
প্রথম পর্ব (৭০,০০০ বিসিই থেকে ১২,০০০ বিসিই) - ৫ম পর্বাংশ
১.৪.২
বিশ্বাসে মিলায় শান্তি
এই মানুষগুলির জীবন পুরোপুরি নির্ভর করত প্রকৃতির ওপর – তার উদ্ভিদ, গাছপালা তাদের বুনো ফল, শিকড়, কন্দ, ছত্রাক ও বুনো শস্য
সংগ্রহ এবং মাছ অথবা ছোট-খাটো বন্য পশুর শিকার। বিপদও ছিল বিস্তর – হিংস্র
প্রাণীদের আক্রমণ, যেমন
বাঘ, সিংহ; ভূমিকম্প, বজ্রগর্ভা ঝড়বৃষ্টি এবং
দাবানল। এমনকি আপাত নিরীহ তৃণভোজী পশুরাও কখনো কখনো ক্ষেপে উঠত, দুরমুশ করে দিত তাদের
নিদ্রাজড়িত রাত্রির বসতিগুলি। যেমনটি ঘটেছিল মিত্তিকার পরিবারে। অতএব প্রত্যেকটি
দিন এবং দিনের পর দিন তাদের জীবন ও জীবনযাত্রায় ছিল নানান অনিশ্চয়তা, কাল কী ঘটতে পারে, তার ধারণাও করা যেত না।
প্রকৃতির ওপর এই নির্ভরতা শুধু হোমো স্যাপিয়েন্সদের নয়, অন্য সকল প্রজাতির
প্রাণীদেরও স্বাভাবিক প্রবণতা। জঙ্গলের সমস্ত জীব এবং গাছপালাও প্রকৃতির ওপর
সম্পূর্ণ নির্ভর করত[1]। তবে
তাদের জীবন এবং জীবনধারণের চিন্তা একমুখী, সেখানে আছে শুধুই বর্তমান।
ভবিষ্যতের কথা - কাল বা পরশু কী ঘটতে পারে, সে চিন্তা করার সামর্থ্য তাদের
থাকে না। অতএব কোন সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কা বা দুশ্চিন্তা করার বিলাসিতাও তাদের
থাকে না।
সে ভাবনা এল মানুষের মনে – অর্থাৎ তার মস্তিষ্কে। অবসর সময়ে তারা
অতীতের অভিজ্ঞতার কথা চিন্তা করে, ভবিষ্যতের দুর্ভাবনায় মানুষ শঙ্কিত হয়। সেই সেবারের মতো
যদি এখনই একটা ভূমিকম্প ঘটে যায়। অথবা একদল সিংহের কবলে যদি পড়তে হয়। অথবা কোন
প্রতিবেশী মানবদল বা মানুষের দলের সঙ্গে যদি লড়াই বেধে যায়। একবার ভাবতে শুরু করলে
এমন “যদি”-র কোন শেষ থাকে না। এমনই অজস্র সম্ভাব্য কাল্পনিক ঘটনা, যার নিয়ন্ত্রণ তাদের
ক্ষমতার বাইরে,
সেগুলি
নিয়েই তাদের দুশ্চিন্তা এবং আশঙ্কা। কাল্পনিক এই দুশ্চিন্তা আর আশঙ্কার যে মানসিক
চাপ, তার থেকে মুক্তির জন্যে
তারা আরও একটি নতুন কল্পনার আশ্রয় নিল, তার নাম বিশ্বাস। এই দুশ্চিন্তাগুলিকে পুরোটাই কাল্পনিক
বলাটা আমার হয়তো একটু বাড়াবাড়ি হল, কিন্তু এগুলো নিয়ে মাথা খারাপ করে আরেকটা কল্পনাকে আঁকড়ে
ধরার যুক্তিটাকে আমার তার থেকেও বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। কেন? বলছি।
আমরা যদি সেই সময়কার মোট জনসংখ্যার তুলনায়, বাঘের কবলে বা সাপের কামড়ে মৃত
মানুষের সংখ্যার তুলনা করি, দেখা যাবে সংখ্যাটা নগণ্য। আধুনিক জীবনেও প্রতিদিন যত
মানুষ নানান যানবাহনে চাপেন, তার তুলনায় যত মানুষ যানবাহনের দুর্ঘটনায় মারা পড়েন, সেই সংখ্যাটা অত্যন্ত
নগণ্য নয় কি?
তা নাহলে, আমি আজ এই বই কী করে
লিখছি এবং আপনারাই বা ধৈর্য নিয়ে এই বই কী করে পড়ছেন? এবং সত্যি কথা বলতে আমরা সকলেই
জানি, বাঘ এবং সিংহের মতো
হিংস্র শিকারী পশুরা আজ অবলুপ্তির কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে, আর বিপরীত দিকে, বিশ্বজুড়ে আজ মানুষের
সংখ্যা বৃদ্ধির হার আমাদের বিশেষ উদ্বেগের কারণ এবং সে বিষয়ে আমরা অত্যন্ত আশঙ্কা
এবং দুশ্চিন্তায় রয়েছি! পৃথিবীতে “মানুষ”-এর সংখ্যা “যদি” এভাবেই বাড়তে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতের
“মানুষ”-এর কী হবে?
অতএব, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত
হওয়াটা আমাদের অনন্য বৈশিষ্ট্য, যা অন্য সমস্ত জীবজগতের থেকে আমাদের সম্পূর্ণ আলাদা করে
তুলেছে। আর আমাদের এই অনন্য আচরণ প্রকৃতি-মায়ের পরেও অন্য আরেকটি বিশেষ বিষয়ে
আমাদের নির্ভর করতে শিখিয়েছে। প্রকৃতি-মা মাঝেমধ্যে আমাদের ঝড়-ঝঞ্ঝার শাস্তি দিলেও, আমাদের খাদ্য-সংস্থান
করেন, আমাদের লালন-পালন করেন।
আমাদের প্রজননেও সাহায্য করেন, যাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষেরা তাঁকে পুরোপুরি
আয়ত্ত্বে আনতে পারে! কিন্তু প্রকৃতি ছাড়া অন্য যে বিষয়ে আমরা নির্ভর করি, সেটা সঠিক কী? এক কথায় সেটা বলা খুব
মুশকিল, কারণ একে স্পর্শ করা যায়
না, গন্ধে টের পাওয়া যায় না, চোখে দেখতে পাই না, কিন্তু যদি (এখানে আবার
একটা “যদি” এসে পড়ল!) আমরা বিশ্বাস করি, তাহলে আমরা তাকে অনুভব করতে পারি।
পিতা পশুপতির দলটিকে কিছু রীতি বা প্রথা পালন করতে লক্ষ্য করেছিলাম, যেমন বয়স্ক মহিলা এবং
পুরুষরা শিকারে বেরোন লোকদের ঘিরে একটা গণ্ডী রচনা করেছিলেন। অস্ফুট কিছু কথা বলতে
বলতে, সকলেই জোড় হাতে গভীর
মনোযোগে ও শ্রদ্ধায় শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শুধু ওই বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলি ছাড়া, যারা তখনো বিশ্বাস করতে
শেখেনি। বড়োরা কৃতজ্ঞ মুখ তুলে তাকিয়ে ছিলেন ওই বড়ো পাথরটার দিকে। সেই সময় দলের
সকলের মন এই আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন ছিল, দলের সকলেই মারাত্মক কোন আঘাত ছাড়া, নিরাপদে ফিরতে পারবে তো? তারা দলের সকলের জন্যে
যথেষ্ট খাদ্যের যোগাড় করতে পারবে তো? যদি না হয়, তাহলে কী হবে? উপরন্তু, সফল শিকার এবং খাদ্য-সংগ্রহ নিয়ে ফেরার পরেও, বয়স্কা মহিলা ও পুরুষেদের
সঙ্গে তারাও আকুল শ্রদ্ধা এবং ব্যাকুল কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল, বড়ো ওই পাথরটির প্রতি। ওই পাথরের
কী এমন বিশেষত্ব ছিল?
ওই পাথরটা ছিল একটি আত্মা। আপনি এখন বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু এই
অধ্যায়ের শেষ অব্দি পড়ে, আপনিও মেনে নেবেন যে, হ্যাঁ, ওই পাথরের মধ্যে একটি আত্মা ছিল।
এবং পাথর ছাড়াও অনেক কিছুতেই আত্মা থাকতে পারে।
পাথর হল একটি নিষ্প্রাণ জড় বস্তু, যার সঙ্গে কারও কোন সংযোগ তৈরি
হতে পারে না। কোন জীবের সঙ্গে নয়, অথবা মানুষের সঙ্গেও নয়। কিন্তু পাথরকে স্পর্শ করা যায়, চোখে দেখা যায়, কখনো কখনো গন্ধও পাওয়া
যায়। আকাশের নিচে খোলা প্রান্তরে পড়ে থাকা, প্রচণ্ড দাবদাহে তপ্ত একটি পাথরের
ওপর যখন শীতল বৃষ্টিবিন্দু এসে পড়ে, তখন পাথরের গন্ধ পাওয়া যায়। অন্যদিকে আত্মা হল সম্পূর্ণ
বিপরীত একটি সত্ত্বা, যদি
আপনি বিশ্বাস করেন, তার
সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ করা যায়। তার সঙ্গে নানান অনুভূতি ভাগ করা যায়, যেমন, সুখ, আশীর্বাদ, কৃতজ্ঞতা, বিরক্তি, এমনকি ভয়ংকর ক্রোধও।
কিন্তু তাকে ছোঁয়া যায় না, দেখা যায় না, তার গন্ধ পাওয়া যায় না। অতএব, এখানে ওই পাথরটির সঙ্গে আত্মার
একটা অঙ্গাঙ্গী এবং পরিপূরক ভূমিকা তৈরি করা গেল।
তাই বলে এমন সিদ্ধান্ত নেবেন না যে, এই গ্রহের সব পাথরের মধ্যেই এমন
বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে, ব্যাপারটা
অতটা সহজ এবং সরল নয়। পাথরের আকার এবং আয়তনে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য থাকতেই হবে, যার জন্যে বিশ্বাসীরা
ভাবতে বাধ্য হবে যে, ওই
পাথরটিতেই তাদের আত্মা-অভিভাবক প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। একটু দূর থেকে দেখা, গায়ে কিছু চিড়, ফাটল, কিছু উঁচুনীচু, কিছু ছোপ-ছাপ, দাগ-টাগ নিয়ে একটা পাথর, আপনার উর্বর মস্তিষ্কের
প্রশ্রয়ে আপনার কোন প্রিয় অভিভাবকের মুখের আদলে ধরা দিতেই পারে। সেই অভিভাবক যিনি
বেশ কিছুদিন আগেই মারা গেছেন। কিন্তু তাও তিনি ভালোবাসতে পারেন, আশীর্বাদ করতে পারেন, প্রশ্রয় দিতে পারেন এবং
দোষ, অথবা বলা ভাল, পাপ করলে, শাস্তিও দিতে পারেন।
যেভাবে মিত্তিকার দলের কিছু মানুষের করা পাপকর্মের শাস্তি দিতে, তিনি রাতের অন্ধকারে
পাগলা দাঁতাল হাতিকে পাঠিয়েছিলেন! হয়তো তিনি আপনার ঠাকুরদাদা, অথবা দিদিমা, কিংবা আপনার অত্যন্ত
ভালোবাসার গুরুজন। যাঁর থেকে আপনি অনেক কিছু শিখেছেন, জেনেছেন। যিনি জীবিত অবস্থায়
আপনাকে নিয়ত উপদেশ দিয়েছেন। মৃত্যুর পরেও যাঁকে আপনি অহরহ স্মরণ করেন এবং যখনই
আপনি বিপদে অসহায় বোধ করেন, অন্ততঃ মনে মনে তাঁর সাহায্যের আশা করেন[2]।
সকল বড়ো পাথরেই যেমন আত্মার অধিষ্ঠান হয় না, তেমনি সকল আত্মাই শুধুমাত্র
পাথরেই স্থিতু হবেন, এমনও
নয়। আরও অনেক বস্তু আছে, যেখানে আত্মা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। যেমন কোন গাছ, কিছু কিছু পাহাড়, পর্বত, নদী। এমনকি কিছু বিশেষ
প্রাণীও,
যেমন সাপ, হনুমান, শূকর, ষাঁড়, পাখি, মাছ। এমনকি গৃহপোষ্য
নিরীহ বেড়ালও! আধুনিক হাইওয়েতে, দ্রুত দৌড়ে চলা অত্যাধুনিক গাড়ির সামনে “রাস্তা কেটে” দিয়ে
গৃহস্থ বিড়াল যখন দৌড়ে পার হয়ে যায়, তখন সেই বিড়ালের মধ্যে মন্দ-আত্মা আজও ভর করে! এই বঙ্গে, সকালে ঘুম থেকে উঠে এক
শালিক দেখতে পেলে, সেই
শালিকে মন্দ-আত্মা ভর করে। কিন্তু সেই শালিকই যখন যুগলে দেখা দেয়, তখন তারাই হয়ে ওঠে
শুভ-আত্মা! ভারতবর্ষ এবং বিশ্বের বহুদেশে আজও বিশ্বাস করা হয়, দাঁড়কাক অশুভ-আত্মা বহন
করতে পারে। যে বাড়িতে পরিবারের কেউ গুরুতর অসুস্থ রয়েছেন, সেই বাড়ির চালে বসে দাঁড়কাকের
কর্কশ ডাক যেন মৃত্যুকেই আহ্বান করে। এই কারণে আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা দাঁড়কাককে
“যমকাক”ও বলতেন। এই ধরনের আত্মা (পরবর্তী কালে দেবত্ব) আরোপিত পাথর, পশু, পাখি, সরীসৃপ, মাছ এমনকি পশু-মানবের
সঙ্গেও আমাদের সম্যক পরিচয় হবে, বহু বছর বাদে। সে কথা আসবে এই গ্রন্থের চতুর্থ এবং পঞ্চম
পর্বে।
বিশেষ কিছু মানুষ, পুরুষ ও মহিলার মধ্যেও আত্মা ভর করে। সর্বদা না হলেও, মাঝেমাঝে - যখনই কোন
বিশ্বাসীর তার থেকে কোন মানসিক আস্থা অথবা কোন পরামর্শের দরকার হয়। এই ধরনের
লোকেদের সাধারণতঃ ওঝা বা গুণিন কিংবা ভর-মাতা বলা হয়। আত্মার ভর হওয়া এই পুরুষ বা
মহিলারা সাধারণ পুরুষ বা মহিলাদের মতোই সন্তানাদি নিয়ে সংসারী জীবন যাপন করেন।
কিন্তু যখনই তাঁদের দেহে আত্মার ভর হয়, তাঁদের আচরণ বদলে যায়। অদ্ভূত এবং উদ্ভট কিছু অঙ্গভঙ্গী
করে তাঁরা বিশ্বাসীদের মনে এমনই এক অলৌকিক বাতাবরণ তৈরি করেন, যে বিশ্বাসীরা আগের থেকে
আরও বেশি বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং এটাই হল ওঝা, গুণিন ও ভর-মাতাদের একমাত্র USP।
বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে প্রধানতঃ চার শ্রেণীতে বিভক্ত করা
যায়। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ যাঁরা আত্মাকে সৃষ্টি করতে এবং তাকে ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ
করতে পারেন,
যেমন ওঝা আর
গুণিন। দ্বিতীয়,
দলের
অধিকাংশ সাধারণ বিশ্বাসী মানুষরা। তৃতীয় শ্রেণী হলেন তাঁরা - যাঁরা দোনামনা
গোত্রের - যাঁরা ঠিক করে উঠতে পারেন না, বিশ্বাস করবেন কী করবেন না। যখন খুব সম্পন্ন অবস্থায় থাকেন
তাঁরা আত্মায় বিশ্বাস করেন না। কিন্তু যখনই কোন বিপদে পড়েন, তখন ঝটপট সমাধানের
চেষ্টায় বিশ্বাস করতে শুরু করেন। চতুর্থ এক শ্রেণীও থাকতে পারেন, তাঁরা অবিশ্বাসী - যাঁরা
কোনভাবেই আত্মায় বিশ্বাস করেন না। তাঁদের পরবর্তী কালে নাস্তিকও বলা হয়েছে। তাঁদের
সংখ্যা প্রায় বিরল, দলে
তাঁদের গুরুত্বও নগণ্য। কোন দলে যদি কোন অবিশ্বাসী কিছুটা প্রভাব বিস্তার করতে
সক্ষম হতে থাকেন, ওঝা
ও গুণিনদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ প্রভাবে তাঁরা দলের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন
এবং এমনকি তাঁদের প্রাণহানির আশঙ্কাও তৈরি হতে পারে।
অতএব, আশঙ্কা
আর দুশ্চিন্তা থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পেতে, প্রকৃতির ওপর পূর্ণ নির্ভরতার
পরেও, মানুষ আত্মা নামক এক অলীক
বিষয়ে বিশ্বাস করতে শুরু করল।
১.৪.৩ হেডে জয় তোমার, টেলে আমার হার
এখন কৌতূহলের বিষয় হল, আত্মার ভূমিকাটা কী? এমন প্রশ্নের এক কথায় উত্তর হল, তাদের ভূমিকা অজস্র। যত
ধরনের ভূমিকা আমরা চিন্তা করতে পারি – এর কোন সীমা নেই। কিছু ভূমিকার উদাহরণে বলা
যায়, আপনাকে একটা ফলন্ত গাছের
সন্ধান দেওয়া। বাঁদররা খবর পাওয়ার অনেক আগেই আপনি যাতে ফল সহজেই সব আহরণ করতে
পারবেন। বেশ কিছু দুর্বল ছাগল সহ বুনো ছাগলের একটা দলের সন্ধান দেওয়া, বাঘের দল সন্ধান পাওয়ার
আগেই যাদের সহজে শিকার করা যায়। একটা প্রবল ঝড়ের তাণ্ডবকে বনের দূরতম প্রান্তে
ঠেলে দেওয়া। এভাবেই মানুষের প্রতিটা সাফল্যে এবং বিপদ এড়িয়ে যাওয়ার আকস্মিক ঘটনায়
আত্মার ভূমিকা বাড়তেই থাকবে। আপনি কৃতজ্ঞ হতে থাকবেন। শুধু আপনার বিশ্বাসের ভিতটা
শক্তপোক্ত হলেই হল।
আত্মারা কী সর্বদাই আমাদের সাহায্য করে থাকে? না কখনোই না, আত্মা যদি ক্রুদ্ধ হয়, বুনো ছাগলদের দলে
রামছাগলটাও খেপে উঠে তার শিং দিয়ে, দলের কয়েকজনকে ফেঁড়ে দিতে পারে। গাছের ফল পাড়তে গিয়ে, গাছের ডাল ভেঙে মাটিতে
পড়ে, আপনার হাত-পা ভাঙতে পারে।
ঝঞ্ঝার আঘাতে শেকড় ওপড়ান বড়ো বড়ো গাছ কিছু লোককে পিষে ফেলতে পারে। গভীর ঘুমের
রাত্রে, হাতির দল এসে তছনছ করে
দিতে পারে মানুষের দুর্বল কুঁড়েঘরগুলি, থেঁৎলে দিতে পারে বেশ কিছু মানুষকে। এমন অনেক অঘটনই ঘটতে
পারে! এগুলি সবই আত্মার অসন্তুষ্টির কারণ। তার জন্যে, আপনি ব্যাকুল হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা
করবেন। তবে এক্ষেত্রেও, আরেকবার বলি, আপনার বিশ্বাসের ভিতটা শক্তপোক্ত হলেই হল।
তাহলে কিছু কিছু উপকারের জন্যে কেনই বা আমরা আত্মায় ভরসা রাখব? এ রকম প্রশ্নের শেকড়, মন থেকে উপড়ে ফেলুন
অঙ্কুরেই। কারণ আপনাকে বিশ্বাস - বিনা প্রশ্নেই - করতে হবে। সফল একটা
শিকার-সংগ্রহের পর, অল্পস্বল্প
ঝড়ঝাপটার রাত সামলে পরেরদিনের রোদ ঝলমলে সকালে, বড়ো একটা সিংহের দলের থেকে
কোনভাবে পরিত্রাণ পেয়ে, আপনাকে আত্মার সামনে বিনীত শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞতা জানিয়ে
সন্তুষ্ট করতে হবে। কারণ এসবই ঘটেছে শুধুমাত্র আত্মার বদান্যতায়। আত্মার তৃপ্তির
জন্যে আপনাকে উৎসর্গ করতে হবে, বাছাই করা বেশ কিছু ফল এবং বড়ো একখণ্ড মাংস। যদিচ সেই ফল
এবং মাংস নিবেদনের পুরোটাই, প্রসাদ হয়ে আপনার কাছেই ফিরে আসবে। কারণ আত্মার অস্তিত্ব
আপনার কল্পনায়,
কল্পনার
দাঁত দিয়ে আর যাই হোক ফল বা মাংসের টুকরো কাটা যায় না!
কিন্তু আপনার দলের কোন সদস্যের দুর্ভাগ্যজনক কিছু ঘটলেও আপনি আত্মাকে
দোষারোপ করতে পারবেন না। কারণ আপনি অবশ্যই জানবেন, আত্মা ক্রুদ্ধ হলে এমন ঘটতেই
পারে। কিন্তু আত্মা এত অসন্তুষ্টই বা হয় কেন? তার কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে
আপনাকেই। আপনাকেই সাজিয়ে তুলতে হবে তার অসন্তোষের কারণগুলি। কারণগুলি কী হতে পারে?
কারণেরও কোন অন্ত নেই। যেমন, কিছুদিন আগেই, যুবক-যুবতীদের যে দলটা বড়োসড়ো শিকার ধরে আর বড়ো বড় কন্দ
সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছিল, তাদের মধ্যে দু-তিনজন ছিল উদ্ধত। তারা ওই প্রস্তর-আত্মার
সামনে মাথা নত করেনি, নিজেদের
দক্ষতার অহংকারে। কিন্তু যেদিন কোন একটা অঘটন ঘটবে, বয়স্ক মানুষ গম্ভীর হতাশার সুরে
বলবেন, “আমি জানতাম এমনটা ঘটবে।
ছেলেদের উদ্ধত ওই আচরণে আত্মা ক্রুদ্ধ হয়েছেন, আমরা অভিশপ্ত হয়েছি। আমরা এখনও
যদি আমাদের আচরণ সংযত না করি, এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে এবং আমরা ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাবো।
অতএব এই হল অপরাধ স্বীকার করে, অনুতপ্ত হওয়ার সময়। আমরা সকলে একসঙ্গে একমনে করজোড়ে তাঁর
কাছে ভিক্ষা করি, আমাদের
ক্ষমা করো,
পিতা, আমাদের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ো
না। আমরা যদি কোন ভুল করেই থাকি, আমাদের শাস্তি দাও, আমাদের শিক্ষা দাও। হে পিতা, আমাদের কৃপা কর। আমাদের
প্রচুর খাদ্য দাও, সকল
বিপর্যয় থেকে আমাদের রক্ষা কর...”।
এভাবেই মানুষের নিজেরই করা কোন না কোন ত্রুটি দিয়ে আড়াল করা যায় আত্মার
যে কোন ব্যর্থতাকে। সে ত্রুটি উপরে বলা ঘটনার মতো গুরুতর নাও হতে পারে, হতে পারে খুবই তুচ্ছ
কিছু। যেমন,
বনে ঢোকার
পথে ডানদিকে হঠাৎ শেয়াল দেখে ফেলা (মহিলাদের ক্ষেত্রে বাঁদিকে)। আত্মাকে কিছু
উৎসর্গ না করেই সমস্ত খাদ্য নিঃশেষ করে ফেলা। কিংবা যে পাহাড়ের চূড়ায়
প্রস্তর-আত্মার অধিষ্ঠান, আনমনে তার তলায় কারও থুথু ফেলা, প্রকৃতির ছোট ডাকে সাড়া দেওয়া, ইত্যাদি অনেক কিছুই হতে
পারে।
তাহলে আত্মার ওপর কেন এত বিশ্বাস করত মানুষ? উত্তরঃ বিপদের সম্ভাবনার
দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে।
একটু হিসেব কষা যাক। এক বছরে, আপনি কতদিন প্রবল বজ্র-ঝঞ্ঝার আশা করেন – সম্ভবতঃ পাঁচ
থেকে সাত দিন[3]? বছরে আপনি কতদিন বিপর্যয়
ঘটানো ভূমিকম্পের আশা করেন – সম্ভবতঃ প্রতি পাঁচ থেকে দশ বছরে একবার? মানুষ সিংহ কিংবা বাঘের
স্বাভাবিক শিকার নয়, তাও
বছরে কতদিন আপনি আশা করেন, বাঘ বা সিংহ আপনাকে আক্রমণ করবে – খুব বেশি হলে পাঁচ কিংবা
ছদিন?[4] হতে পারে এগুলো সবই অনুমান, এর পিছনে কোন সংখ্যাগত
তথ্য পাওয়া যাবে না, কিন্তু
তবুও বছরের তিনশ পঁয়ষট্টি দিনের তুলনায়, সমস্ত দুর্ঘটনার দিন যোগ করলে কুড়ি-পঁচিশ দিনের বেশি হতে
পারে না। আর এই হিসেবেই লুকিয়ে আছে আত্মার বিশ্বাসযোগ্যতা। আপনি যদি বিশ্বাস করেন
যে আত্মার অনুগ্রহে, বছরের
তিনশ চল্লিশটি (বছরের প্রায় ৯৩% দিন) শুভদিন আপনি উপভোগ করেছেন, সেক্ষেত্রে আপনার আত্মার
ওপর বিশ্বাস করা ছাড়া অন্য কোন পথ অবশিষ্ট থাকল কি? অন্যদিকে, আপনি যদি বছরে পঁচিশটি (বছরের
মাত্র ৭% দিন) অশুভ দিনের দুর্ভোগে কষ্ট পেয়ে থাকেন, এবং যদি বিশ্বাস করেন, তার কারণ হল আপনার বা
আপনার দলের কোন মানুষের ভুল বা অপরাধ, সেক্ষেত্রেও আত্মার ওপর আপনার বিশ্বাস এতটুকুও কমবে না।
বরং বহুগুণ বেড়ে উঠবে। অতএব সাধারণ মানুষের সঙ্গে আত্মার (পরবর্তী কালে, দেবতাদের ) সম্পর্কটা
নির্বিঘ্নে হয়ে উঠছিল – Head you win, tail I loose – অর্থাৎ “হে আত্মা, হেডে জয় তোমার, টেলে আমার হার”।
এইভাবেই বয়স্ক সেই মানুষটি, যাঁর নাম পশুপতি। যিনি আত্মার সঙ্গে সংযোগ রাখেন, তিনি দলের অন্য সবার
তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। তাঁর কর্তৃত্বে প্রশ্ন তোলার কারও সাহস
হবে না, দলের মধ্যে তিনিই হয়ে
উঠবেন আত্মার সঙ্গে নিবিড় সংযুক্ত অনন্য এক পুরুষ।
পিতা পশুপতি কিন্তু কোন দুর্বুদ্ধি বা নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে এমন
একটা “বিশ্বাস”-এ ভরসা করেছিলেন, একথাও ঠিক নয়। তিনি নিজেই অদ্ভূত এই কল্পনায় বাঁধা পড়ে
মানসিক স্বস্তি ও শান্তি পেয়েছিলেন। সেই উপলব্ধিই তিনি সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন
নিজের দলের সকলের মনে। এমনকি কন্যাসমা মিত্তিকা নামের অন্য দলনেত্রীর মনেও! এই
বিশ্বাসের বীজ ভবিষ্যতে আমাদের কোন মহীরূহের নিচে দাঁড় করিয়েছে, সে আলোচনা আসবে পরবর্তী
পর্বে।
এবং আরও পরবর্তী পর্যায়ে আমরা দেখবো, এই “বিশ্বাস” কিভাবে বিপণন যোগ্য
পণ্য হয়ে ওঠে। কিভাবেই বা এই “বিশ্বাস”
হয়ে উঠবে রাষ্ট্র ও সমাজপতিদের ক্ষমতার শীর্ষ জয়ের অন্যতম হাতিয়ার।
১.৪.৪
বৃহত্তর পরিবারের সূচনা
দুপুরের আহার সেরে, কিছুক্ষণ আগেই ওরা চলে গেল, গিরিজ আর মিত্তিকা। ওদের এগিয়ে
দেওয়ার জন্যে পিতা পশুপতি তাঁর দলের তিন সশস্ত্র যুবককে পাঠালেন। সূর্যাস্তের এখনও
দেরি আছে,
কিন্তু ওদের
বসতি পর্যন্ত যেতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে এবং সেক্ষেত্রে ওই তিন যুবকের আজ আর ফেরা হবে
না। ওখান থেকে আগামীকাল ভোরে রওনা হতে হবে।
এই প্রথম তাঁর দলের তিনজন সাহসী যুবক দলের বাইরে রাত্রিযাপন করবে, অজানা এক দলের সঙ্গে।
কাজটা কি তিনি ভাল করলেন? ওদের যদি কোন অসৎ উদ্দেশ্য থেকে থাকে? যদি ওরা ওই তিনজনকে
রাত্রে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে? তাঁর দলকে দুর্বল করে তোলার এ কোন ষড়যন্ত্র নয় তো? তাঁর মনে ভিড় করে এল, উদ্বেগ আর আশঙ্কা। তিনি
অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে বসে গভীর চিন্তায় ডুব দিলেন।
সকালে ওরা আসার পর থেকে, গিরিজ এবং মিত্তিকার সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে সে সব
পর্যালোচনা করতে লাগলেন। না, ওদের কথায় কিংবা আচরণে কোন মন্দ উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত তিনি
খুঁজে পেলেন না। এখানে এসে মিত্তিকা ও গিরিজ, তাঁর দলের অন্য সকলের সঙ্গেও যে
ভাবে কথা বললেন। বাচ্চাদের সঙ্গে, মেয়ে এবং পুরুষদের সঙ্গে যে আচরণ করলেন। সে কথা মনে করেও, তাঁর দলের প্রতি ওঁদের
দুজনের কোন ঈর্ষা বা বিদ্বেষের কোন লক্ষণ দেখতে পেলেন না। তবু তাঁর মনে এখন আশঙ্কা
ও দুশ্চিন্তা। আগামীকাল সকালে ওরা তিনজন সুস্থ না ফেরা পর্যন্ত, তাঁর এই উদ্বেগ কাটবে না।
যাবার কিছু আগে গিরিজের সামনেই মিত্তিকা তাঁকে একটি প্রস্তাব দিলেন। সে
প্রস্তাব যেমন অভিনব, তেমনই
অসম্ভব। মিত্তিকার অনুরোধ, তিনি যেন তাঁর দলের দুই কন্যাকে দান করেন। সেই দুই কন্যা, মিত্তিকার দুই তরুণ
পুত্রের জীবনসঙ্গিনী হবে। ওই দুই কন্যাকে তিনি, তাঁর পুত্রেরা এবং তাঁদের দল
সারাজীবন বহন করবেন, পালন
করবেন। এই অদ্ভূত প্রস্তাবের কারণ বোঝাতে মিত্তিকা আরও বললেন, তাঁদের পরিবারে এখন
ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা কম, যার ফলে বংশরক্ষা এবং প্রজননে, তিনি পশ্বাচার পরিস্থিতির আশঙ্কা
করছেন। পশ্বাচারে পরিবারের বাঁধনে ভাঙন ধরে। তাই পিতা পশুপতির কাছে তাঁর বিনীত
অনুরোধ,
“আপনাদের
দুটি কন্যা আমাকে দান করুন”।
পিতা পশুপতি তখনই গভীর আপত্তিতে বলেছেন, এ অসম্ভব। এমন অদ্ভূত প্রস্তাবে
সাড়া দেওয়ার কোন প্রশ্নই নেই। তবুও মিত্তিকা তাঁকে কর জোড়ে বার বার অনুরোধ করেছেন, “আপনি এভাবে অসম্মত হবেন
না, বাবা, আপনাকে যতটুকু চিনেছি, তাতে বুঝেছি আপনি
ভবিষ্যতদ্রষ্টা। জীবনকে আপনি অন্তর দিয়ে বিচার করেন। আমার এই প্রস্তাব অভিনব
কিন্তু অসম্ভব নয়। আমাদের দুই দলের এই সম্পর্ক হয়তো ভবিষ্যতের পথ দেখাবে। আপনি সময়
নিন, চিন্তা করুন। আজ চাঁদের
দশমদিন, আমরা দুজনে আবার আসব
পূর্ণচন্দ্রের দিন। আপনার সম্মতির আশায়, এ কটা দিন, আমি প্রতীক্ষায় থাকব”।
কিছুক্ষণ হল সূর্য অস্ত গেছে, মেয়েরা মশাল জ্বালিয়েছে দুটো, চর্বির পোড়া গন্ধ নাকে আসছে। দলের
সকলে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। পিতা পশুপতির কানে আসছে, গিরিজ আর মিত্তিকাই আজ তাদের
গল্পের বিষয়। দলের ছেলে-মেয়েরা সকলেই খুশি, গিরিজ আর মিত্তিকার ব্যবহারে।
কারও মনে কোন বিদ্বেষ নেই। পিতা পশুপতি একটু নিশ্চিন্ত হলেন। তবুও আগামীকাল সকালে
ওই তিনজনের না ফেরা পর্যন্ত তাঁর মনের কাঁটাটি রয়েই যাবে।
মিত্তিকার কন্যাদানের প্রস্তাবটাও পিতা পশুপতি স্বস্তি দিচ্ছে না। কোন
পরিবারভিত্তিক দলের সদস্য সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে গেলে, সে দলকে তিনি বহুবার ভেঙে যেতে
দেখেছেন। তাঁর নিজের দলেও এমন ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকবার। কারণ বিশেষজ্ঞরা বলেন, সদস্য সংখ্যার সঙ্গে
পারিবারিক বন্ধন প্রত্যক্ষভাবে নির্ভর করে। সেই ম্যাজিক সংখ্যাটি হল পঞ্চাশ থেকে
ষাট। সদস্য সংখ্যা তার থেকে যত বেশি হতে থাকে, পারিবারিক বন্ধন ততই আলগা হতে
থাকে। এর কারণ কোন সাধারণ মানুষই পঞ্চাশ বা ষাট জনের বেশি সংখ্যক ব্যক্তির সঙ্গে
ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে না। অসাধারণ মানুষ, যাঁরা সফল নেতৃত্ব দেওয়ার
অধিকারী,
তাঁরা
অবশ্যই ব্যতিক্রম। অতএব পরিবারের সদস্য সংখ্যা আশি-নব্বই হলেই, অবধারিতভাবে দলটি দুই
ভাগে ভেঙে যেত। নতুন দলটি নতুন অঞ্চলে বসতির সন্ধান দেখত।
দল ভেঙে নতুন দল গড়ার ব্যাপারটা পিতা পশুপতির কাছে নতুন না হলেও, পরিবারের দু একজন সদস্য –
সে ছেলে হোক বা মেয়ে - অন্য দলে চলে যাবে, এমন উদাহরণ তিনি কোনদিন দেখেননি
বা শোনেননি। এক পরিবারে আজন্ম লালিত-পালিত কোন ছেলে বা মেয়ের পক্ষে অন্য দল, অন্য পরিবারে মানিয়ে
নেওয়া সম্ভব?
আর কেনই বা
যাবে? আমাদের এই দল কী আমাদের
কোন মেয়ে বা ছেলেকে অযত্নে, অনাদরে রেখেছে? কত দুঃখ, সুখ, আনন্দ, বেদনার স্মৃতি বুকে নিয়ে তারা বড়ো হচ্ছে এই পরিবারে। আরো
বড়ো হবে,
পরিণত হবে, চিরপরিচিত এই দলের হাল
ধরবে হয়তো কোনদিন। এসব ছেড়ে কেন যাবে তারা, অপরিচিত, অজানা-অচেনা মানুষের পরিবারে? সেখানে কেমন হবে তাদের
ব্যবহার?
দূর থেকে
বেড়াতে আসা বৃদ্ধ গিরিজ এবং সঙ্গী-পুত্রহারা মিত্তিকার ব্যবহার বা তাঁদের আচরণ
দেখে গোটা একটা দলের প্রত্যেক মানুষকে বোঝা যায় নাকি?
তবে মিত্তিকা একটা কথা বলেছেন, চিন্তা করার মতো। একটি দলের, একই পরিবারের মধ্যে
মানুষের প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেড়ে ওঠা খুব ভাল কথা নয়। যদিও এমনই চলে আসছে হাজার
হাজার বছর ধরে। এই প্রথাটাকে একটা কোথাও থামানো দরকার। এক পরিবারের রক্তে অন্য
পরিবারের মিশ্রণ দরকার, তাতে নতুন প্রজন্ম ভিন্নতর হয়ে উঠতে পারবে। একটি
পরিবারভিত্তিক দলে, জন্ম
থেকেই একটি ছেলে বা মেয়ের, কে তার প্রজনন সঙ্গী হবে, সেটি নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এই
নিয়মের ব্যতিক্রম হয় তখনই, যখন কোন অঘটনে দলের অনেক ছেলে বা মেয়ের মৃত্যু হয়। যেমনটা
হয়েছে ওই দলের ক্ষেত্রে। সঙ্গিনীর অভাবে ছেলেরা কী তবে বীভৎস কোন সম্পর্কের দিকে
এগোবে? সেই কুৎসিত প্রজন্ম...না, পিতা পশুপতি জেনেশুনে এমন
হতে দিতে পারেন না।
মিত্তিকার প্রস্তাবিত দুই দলের এই সম্পর্কে আরেকটা খুব বড়ো মঙ্গলজনক
দিক আছে। তিনি যদি তাঁর পরিবারের দুই কন্যাকে ওঁদের পরিবারে দান করেন, দুই দলের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা
বাড়বে। যোগাযোগ বাড়বে, সহযোগিতা
বাড়বে, বিপদে-আপদে একে অপরের
পাশে থাকতে পারবে। এখন যে কোন দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেই সর্বদা যে বিদ্বেষের মনোভাব
থাকে, এই এলাকায় অন্ততঃ একটি
দলের সঙ্গে সেই মনোভাব দূর হয়ে সখ্যতা আসবে। পিতা পশুপতি আশা করেন, কয়েক বছরের মধ্যে ওই দল
তার হারানো শক্তি ফিরে পাবে। দুই দলের মিলিত শক্তি দিয়ে তখন অনেক বাধা সহজেই দূর
করা যাবে।
পিতা পশুপতি মনস্থির করতে পারছেন না। এই চিন্তা ছাড়াও, তিনি আরও ভাবছেন, কোন দুটি কন্যাকে তিনি
দান করতে পারেন?
যারা এই
দলের যোগ্য প্রতিনিধি হয়ে ওই দলে যাবে? তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠছে অতি প্রিয় চার-পাঁচটি মুখ।
তাদের কাছে এই প্রস্তাব রাখলে তারা সম্মত হবে তো? সম্মত না হওয়ারই সম্ভাবনা, সেক্ষেত্রে তিনি কী করবেন? জোর করবেন? আজন্ম যাদের তিনি পরম
স্নেহে লালন-পালন করেছেন, তাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি নিজের মত জোর করে চাপিয়ে
দেবেন? তাতে দলের অন্য
মেয়ে-পুরুষের মনে ক্ষোভ তৈরি হবে না? নিজের দলের মধ্যেই তিনি সৃষ্টি করবেন অবিশ্বাসের বাতাবরণ?
পিতা পশুপতি ন্যায়-অন্যায়, উচিৎ-অনুচিত, শুভ-অশুভ নানান চিন্তায় কিছুতেই ঘুমোতে পারলেন না। রাত পার
হয়ে গেল কখন,
ভোরের
স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে লাগতে, তিনি বেরিয়ে এলেন অঙ্গনে। মুখ তুলে তাকালেন পাথর-আত্মার
দিকে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ, তারপর নরম সূর্যের প্রথম আলো এসে
যখন পড়ল পাথর-আত্মার মুখে, তিনি জোড় হাতে অস্ফুটস্বরে বললেন, “পিতা, অনেকগুলি পথের মধ্যে সঠিক পথ
কোনটি আমি বুঝতে পারছি না। আপনি আমাকে সঠিক পথের দিক্নির্দেশ দিন। যে পথে আমাদের
সকলের মঙ্গল,
যে পথে অন্য
দলেরও মঙ্গল,
আমাকে সেই
পথ দেখান। আমার মন থেকে সমস্ত দ্বিধার অন্ধকার দূর করে, আমাকে ভবিষ্যতের আলো দেখান”। চোখ
বন্ধ করে একাগ্র মনে তিনি স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন।
“বড়োবাবা, তুমি কী সারারাত ঘুমোওনি? সেই কোন ভোর থেকে উঠে
তুমি এমন দাঁড়িয়ে রয়েছ?” কতক্ষণ পরে, নাতনি ঊষির ডাকে পিতা পশুপতি সচেতন হলেন। চোখ মেলে সকালের
আলোয় ঊষির পবিত্র মুখখানি দেখে বড়ো আনন্দ পেলেন। মুখে স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে বললেন, “বড়ো চিন্তায় ছিলাম রে, মা। তবে এখন চিন্তা দূর
হয়েছে। পিতা আমাকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন। তার ওপর সকালের আলোয় তোর ওই নির্মল
মুখ – আমার মনের সমস্ত দ্বিধা দূর করে দিয়েছে। আমি এখন নিশ্চিন্ত”।
...চলবে...
[1] প্রাণীজগৎ প্রকৃতির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করত বলেছি। তার মানে এখন কী আর
করে না? না করে না। তারা এখন মানুষের নির্দিষ্ট করে দেওয়া অভয়ারণ্যে প্রতিপালিত
হয়,
পরোক্ষে
মানুষই তাদের দেখভাল করে। আমরা টিকিট কেটে অভয়ারণ্যের গাড়িতে চেপে, জঙ্গলের
প্রাণীদের দেখতে যাই, মজা নিই, ফটো তুলি। যে কোন অভয়ারণ্য কি আসলে মানুষের বানানো
বৃহত্তর চিড়িয়াখানা নয়? এমনকি বনে কোন গাছ কতগুলো আছে, তার নথি বানিয়ে, তার মধ্যে কত
গাছ কেটে কত আয় হবে, তাও আমরাই হিসেব করি। জঙ্গল জঙ্গলের মতো থাকতে পারে কই? আমাদের বটানিস্ট
বিজ্ঞানীরা বলে দেন, কোন গাছের নতুন চারা বসাতে হবে, যাতে জঙ্গল নয়, বাড়বে কাঠের
উৎপাদন!
[2] ব্যাপারটা খুব আজগুবি মনে হচ্ছে কি? চিন্তা করে দেখুন তো, আমরা কাজে বেরোনোর সময়, কোন না কোন দেব বা দেবীর মূর্তি বা ফটো, কিংবা আমাদের পরলোকগত
বাবা-মায়ের বাঁধানো ফোটোর দিকে একবারও কি তাকাই না? প্রতিটি রাজনৈতিক দপ্তরে, নিজস্ব দলের
পরলোকগত নেতা-নেত্রীর বড়ো বড়ো ছবি বা ফোটো, সে মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ, বাবা আম্বেদকর, কার্ল মার্ক্স
প্রমুখ – যিনিই হোন, থাকে না? পিতা পশুপতির থেকে ভাবনা চিন্তায় আমরা সত্যিই কি
অনেকখানি এগোতে পেরেছি? আধুনিক বিজ্ঞানের প্রাচুর্যের মধ্যেও!
[3] এই হিসাব আমি বিগত বছর দশেকের আঞ্চলিক ভয়ানক সাইক্লোন, টাইফুন বা টর্নেডো ধরে বলছি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাপক হারে পরিবেশ দূষণের জন্যে এ ধরনের ঝড়-ঝঞ্ঝার সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। এর অর্থ মানুষ যখন প্রকৃতির গায়ে আঁচড়টুকুও কাটতে পারেনি, আজ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে, বছরে এমন তাণ্ডব ঝড়ের সংখ্যা নিশ্চয়ই আরও কম ছিল!
[4] ১৫.০৫.১৯২৬ সালের The Pioneer পত্রিকায় একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল, সেটি এরকমঃ- “The man-eating leopard, which has lately been widely known as the Rudraprayag pest, and has, during the past seven years, killed one hundred and twentyfive human beings in the western part of the Garhwal district, has at last been shot, having fallen to the rifle of Captain J. Corbett, of Gurney House, Nainital”. এই চিতাটির পায়ে শজারুর কাঁটা ফুটে যাওয়ায় এবং অদক্ষ শিকারির হাতে আহত হওয়ায় মানুষখেকো হয়ে উঠেছিল এবং সাত বছরে বিশাল গাড়োয়াল জেলার পশ্চিমাংশে ১২৫ জন (সংখ্যাটি কিছু বেশিও হতেই পারে, কারণ সব মৃত্যুই হয়তো নথিভুক্ত করা যায়নি), অর্থাৎ বছরে গড়ে সতের জন মানুষকে হত্যা করেছিল। কিন্তু আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখনকার জনসংখ্যা ১৯২৬ সালের জনসংখ্যার সঙ্গে কোনভাবেই তুলনীয় নয়। তাছাড়া মানুষ কোনদিনই চিতা, বাঘ বা সিংহের স্বাভাবিক শিকার ছিল না। অতএব, বাঘ বা সিংহের হাতে নিহত বা আহত হওয়ার ঘটনা সে সব দিনে আরও বিরল ছিল।