পান্নার হাতের আঙুল এখন অনেকটাই ভালোর দিকে। ক্ষত শুকিয়ে আসছে। গতকাল অচ্যুত পান্নার ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়েই কলকাতা ফিরেছেন। কলকাতায় গিয়ে এবার তাঁকে বাসা ঠিক করতে হবে। শাশুড়িমায়ের পরামর্শে বানানো সোনার ফর্দ এখন তাঁর বুক পকেটে। বাসা ঠিক করে, সংসারের সব জিনিষপত্র কিনে, গুছিয়ে তিনি আবার ফিরে আসবেন, স্ত্রী ও পুত্রদের নিতে। ঠিক হয়েছে সঙ্গে যাবে সুভামাসি। সে মাস দেড় দুয়েক থাকলে, সোনার একটু সুবিধে হবে। নতুন সংসারে কোলের ছেলে সামলানো, আপিসের ভাত-জল, ঘরের সব কাজ, সোনা একা হাতে সামলাতে পারবেন কেন? দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে বড়দের প্রণাম করে, অচ্যুত যখন বিদায় নিলেন, তখন কথা বলার তো সুযোগ ছিল না। তবে চোখাচোখি হয়েছিল, বেশ কবার। দুজনার সেই দৃষ্টিতে ছিল নতুন এক জীবন যাপনের স্বপ্ন!
সব লক্ষণ শুনে তিনি খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না, বললেন, “কথাতেই আছে,
জামাইয়ের জন্যে মেরে হাঁস, বাড়িসুদ্ধ খায় মাস। জামাই এসেছিল, কদিন খাওয়া দাওয়ার
একটু অনিয়ম হয়ে গ্যাস, অম্বল। ও তেমন কিছু না, কদিন নাইতে খেতে ঠিক হয়ে যাবে।
দুপুরে খাওয়ার পর একটু জোয়ান আর নুন চিবিয়ে একগ্লাস জল খেয়ে নেবেন, দেখবেন অব্যর্থ
দাওয়াই”।
ডাক্তারের কথায় কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন অনাদি। কথাটা অন্যায্যও নয়, অচ্যুত
আসাতে কদিন একটু বেশি খাওয়া দাওয়া হয়েছে বৈকি! ছেলে ছোকরাদের যে গুরুভোজন সহ্য হয়,
তাঁর বয়সে আর কী সে সম্ভব? বাড়ি এসে বৌমাকে বললেন, “বৌমা, তোমার মাকে বলো তো, মা।
আজ দুপুরে মাছের পাৎলা ঝোল দিয়ে দুটো ভাত খাবো, আর কিছু না”।
বৌমা ঘোমটার আড়ালে চিন্তিত মুখে বললেন, “শরীর খারাপ নাকি, বাবা?”
“তেমন কিছু নয়, তবে বয়েস তো হচ্ছে, মা। তাই একটু সাবধান হওয়া”। বৌমার থেকে কথাটা চাউর
হতে দেরি হল না। প্রথমেই ষোড়শীবালা এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিগ্যেস করলেন। তাঁর
অস্বস্তির কথা রাত্রেই কেন তাঁকে বলা হল না, সে কথাও বললেন। তিনি জানলে, নারকেল
তেল আর কপ্পূর দিয়ে পেটে মালিশ করে দিতে পারতেন, তাতে নির্ঘাৎ আরাম হত। তবে করুণা
ডাক্তারের ওপর সকলেরই আস্থা আছে, তিন যখন বিধান দিয়েছেন, তেমন চিন্তার কোন কারণ
নেই। অনাদির বেশি কথা বলতেও ভালো লাগছিল না, নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় তিনি টানটান
হয়ে শুয়ে রইলেন।
ষোড়শীবালা মণিমাসিকে বললেন, “যা তো মা, বাবার পায়ে একটু হাত বুলিয়ে দে।
আর দেখিস, কেউ যেন তোর বাবাকে এখন বিরক্ত না করে”। মণিমাসি নিঃশব্দে পায়ের
কাছে গিয়ে বসে, বাবার পা টিপতে শুরু করলেন। অনাদি চোখ মেলে মেয়ের মুখের দিকে একবার
তাকালেন, কিছু বললেন না, মৃদু হাসলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যে অনাদি ঘুমিয়েও পড়লেন!
কিশোরী মণিমাসি জ্ঞান হয়ে থেকে, এই অসময়ে বাবাকে কোনদিন ঘুমোতে দেখেনি। তারা –
ছেলেমেয়েরা - অসুস্থ হলে, বাবা ও মায়ের দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, ব্যস্ততা সে অনেক
দেখেছে। কিন্তু বাবা অসুস্থ হলে, ঠিক কী যে করা উচিৎ, তার মাথায় এল না। সে
নিঃশব্দে বাবার পা টিপতেই লাগল, আর বারবার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা
করল, বাবা সুস্থ হয়ে উঠছেন তো?
প্রায় ঘন্টা খানেক পর, অতি সন্তর্পণে সোনা এসে ঢুকলেন। তাঁর হাতে কাচের
গেলাসে ভরা অর্ধস্বচ্ছ জল। মণিমাসি ফিসফিস করে বলল, “বাবা তো ঘুমোচ্ছে। ওটা কী রে,
ন’দি”?
“মৌরি ভেজানো মিছরির জল, মা পাঠালো, বাবাকে খাওয়ানোর জন্যে”। তারপর বাবার মাথায় হাত
বোলাতে বোলাতে পরম মমতায় সোনা ডাকতে লাগলেন, “বাবা, ও বাবা, বাবা?”
অনাদি চোখ মেলে তাকালেন। ঘুম ভাঙলেও ঘোর কাটতে একটু যেন সময় নিলেন। এই
অসময়ে তিনি শুয়ে আছেন! পায়ের কাছে তনু, মাথার কাছে জলের গেলাস নিয়ে বিকাশ। তিনি
স্বস্তি পেলেন না, কী হয়েছে তাঁর? তিনি বিছানায় উঠে বসলেন, মণির দিকে তাকিয়ে
বললেন, “আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, না রে তনু? শরীরটা ঠিক বাগে নেই, বুঝলি?
করুণাডাক্তার বলল বটে, কিছু নয়.. কিন্তু...”
“এটা খেয়ে নাও, বাবা। মৌরি ভেজানো মিছরির জল। পেটটা ঠাণ্ডা হবে। মা
পাঠালো”। সোনার হাত থেকে গেলাসটা নিয়ে অনাদি একটা চুমুক দিলেন। ভালই
লাগল, মৌরির সুঘ্রাণ আর মিছরির হালকা মিষ্টতায় তিনি তৃপ্তি পেলেন। বাকিটা লম্বা
চুমুকে ঢকঢক করে খেয়ে তৃপ্তির শ্বাস ফেললেন, আঃ।
“আরেকটু এনে দিই, বাবা?” সোনা জিগ্যেস করলেন।
হেসে ফেললেন অনাদি, “ধুর পাগলি। এ কী পেট ভরে খাবার জিনিষ নাকি”? খালি
গেলাসটা সোনার হাতে ফেরত দিয়ে বললেন, “আয়, আমার পাশে এসে বোস দেখি, মা। তনু, পায়ের
তলায় কতক্ষণ থাকবি, আয় তুইও এদিকে আয়”। সোনা বিছানার অন্য দিকে বসলেন,
মণিও উঠে এসে বসল দিদির পাশে। অনাদি কিছুক্ষণ বিছানার চাদরের ওপর আঙুলে আঁকিবুঁকি
কেটে বললেন, “বিকাশ, এই যে তুই আর অচ্যুত ঠিক করে ফেললি, কলকাতার বাসা নিয়ে আলাদা
থাকবি, সব দিক ভালো করে চিন্তা করে নিয়েছিস তো, মা?”
সোনা কোন উত্তর দিতে পারলেন না। চিন্তাভাবনার আছে নাকি কিছু? তাঁর
ছেলেদের বাবার স্বপ্ন, কলকাতায় ভালো স্কুলে ছেলেদের ভর্তি করে, তাদের মানুষ করে
তুলবেন। গ্রামে থেকে সেটা সম্ভব নয়। এর জন্যে ভাবনা-চিন্তার কী আছে?
অনাদি আবার বললেন, “সংসারটা বড়ো সহজ নয় রে, মা। খুব জটিল। অচ্যুত সকালে
নাকেমুখে গুঁজে আপিস বেরিয়ে যাবে। আর তুই সারাটা দিন একলা ঘরে, দুই ছেলে নিয়ে,
ঘরের কাজকর্ম সব সামলাতে পারবি তো? কলকাতার রাস্তাঘাট কিন্তু আমাদের এই গাঁ ঘরের
মতো নয়। গাড়ি, ঘোড়া, উটকো লোকজন, ধড়িবাজ, ফেরেব্বাজ। গাঁয়ে সব্বাই সবাইকে চেনে।
একে অন্যের খবর রাখে। কলকাতায় কেউ কাউকে চেনে না। কারো জন্যে কারো কোন মাথাব্যথা
নেই। সংসার তো শুধু সুখের হয় না, মা। সংসারে দুঃখ আসবে। দৈব দুর্বিপাক আসবে। ঝগড়া
মনকষাকষি আসবে। গাঁয়ে ঘরের বড়ো সংসারে, সকলে মিলে, অনেকের সঙ্গে, সে সব সহজে পার
করে দেওয়া যায়। কিন্তু একলাটি তুই, অতবড়ো শহরে সব দিক সামলাতে পারবি তো”?
বাবার কথায় সোনার বুকটা একটু কেঁপে উঠল। মণিমাসিও যেন ভয় পেয়েছে।
“পরশু দুপুরে অচ্যুত যখন সব কথা আমাকে বলল, আমি আপত্তি করিনি। এখনও
আপত্তি করছি না। কলকাতায় বাসা ভাড়া করে, লোকে কী সংসার করছে না? বিস্তর করছে! সে
ভাবেই নিজেকে তৈরি করতে হবে। ধৈর্য রাখতে হবে। একটুতেই ভেঙে পড়লে চলবে না”।
অনাদি সোনার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর আবার বললেন, “শুধু
যে বিপদ-আপদ আছে তাই নয়। কলকাতায় হাজার প্রলোভন, হাজার বিলাসিতা। কত বায়োস্কোপ, কত
থেটার, কতো ঝকঝকে দোকান। কত কী জিনিষপত্র, তার ইয়ত্তা নেই। বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে, আয়
বুঝে ব্যয় না করে, কতো যে সংসার, সর্বনাশে তলিয়ে গেছে – এ আমার নিজের চোখে দেখা...”।
অনাদি আবার কিছুক্ষণ বিরাম দিলেন, তারপর বললেন, “আমার কাছে কিচ্ছু
লুকোস না, মা। অচ্যুতকে তুই ঠিক মতো বুঝতে পেরেছিস তো? তোদের মধ্যে সেই বোঝাপড়া আর
বিশ্বাস রয়েছে তো? তুই নিজেকে যথেষ্ট ভরসা করিস তো? আমাদের মতো সংসারে অনেক কিছুরই
অভাব থাকবে, মা বিকাশ। এই অভাবকে যারা বড়ো করে দেখে, তারা কোনদিন বড়ো হতে পারে না।
কিন্তু এই অভাবকে জয় করা যাদের স্বভাব, তারা কেউ আর ছোট থাকে না। তোদের দুজনের মধ্যে
সেই স্বভাব রয়েছে তো? তা নাহলে কিন্তু সবটাই মাটি”।
বাবার প্রত্যেকটি কথা সোনার বুকের গভীরে বাজতে লাগল। তাঁর চোখের সামনে
থেকে স্বপ্নসর্বস্ব ভারি পর্দাটা সরে গিয়ে, তার আড়ালে থাকা বাস্তব জীবনটা পরিষ্কার
ধরা দিল। তাঁর মনে যেটুকু দ্বিধা আর সংশয় ছিল, সে সব কেটে গিয়ে তৈরি হল দৃঢ়
প্রত্যয়। মাটিতে গড় হয়ে বসে, সোনা প্রণাম করলেন বাবার পায়ে, বললেন, “আমি পারবো,
বাবা। আজ তুমি যে শিক্ষা দিলে, কোনদিন ভুল হবে না”।
প্রসন্ন হাসিমুখে, পরম স্নেহে অনাদি কন্যার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ
করলেন, বললেন, “এটুকু বলতে পারি, মা বিকাশ, তোর এই দুই সন্তান, তাদের পিতৃকুল এবং
মাতৃকুলের মুখ একদিন উজ্জ্বল করবেই। সেদিন আমি থাকবো না, কিন্তু থাকব তোর ওই দুই পুত্র
হয়ে! দেখে নিস”।
পরের পর্ব "বিদায় বেলার মালাখানি"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন