দ্বিতীয় অধ্যায়
দ্বিতীয় বল্লী
পুরমেকাদশদ্বারমজস্যাবক্রচেতসঃ। অনুষ্ঠায়
ন শোচতি বিমুক্তশ্চ বিমুচ্যতে। এতদ্বৈ
তৎ।। ২/২/১ |
পুরম্
একাদশদ্বারম্ অজস্য অবক্রচেতসঃ। অনুষ্ঠায়
ন শোচতি বিমুক্তঃ চ বিমুচ্যতে। এতৎ
বৈ তৎ।। |
জন্মরহিত ও শুদ্ধচেতন আত্মা, একাদশদ্বারবিশিষ্ট নগররূপ এই শরীরে অধিষ্ঠান
করেন। এই আত্মাকে উপলব্ধি করতে পারলে সাধক শোকমুক্ত হন, এই দেহ থেকে মুক্ত হয়ে
তাঁকে আর জন্মগ্রহণ করতে হয় না। ইনিই সেই
ব্রহ্ম।
[দুই
চোখ, দুই নাক, দুই কান, ব্রহ্মরন্ধ্র, মুখ, নাভি এবং মলমূত্র ত্যাগের দুই দ্বার –
এই একাদশ দ্বার বিশিষ্ট জীব শরীরকে পুর অর্থাৎ নগরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে,
জীবাত্মা এই নগরের রাজা।]
হংসঃ
শুচিষদ্ বসুরন্তরিক্ষসদ্ধোতা বেদিষদতিথির্দুরোণসৎ। নৃষদ্বরসদৃতসদ্ব্যোমসদব্জা
গোজা ঋতজা
অদ্রিজা ঋতং বহৎ।। ২/২/২ |
হংসঃ
শুচি-সৎ বসুঃ অন্তরিক্ষ-সৎ হোতা বেদি-সৎ
অতিথিঃ দুরোণ-সৎ। নৃ-সৎ
বর-সৎ ঋত-সৎ ব্যোম-সৎ অব্জাঃ গোজাঃ ঋতজাঃ
অদ্রিজাঃ ঋতম্ বহৎ।। |
এই আত্মা সর্বগামী সূর্য হয়ে দ্যুলোকে; বায়ু হয়ে অন্তরীক্ষে; অগ্নিরূপে
পৃথিবীতে; ব্রাহ্মণ অতিথি রূপে গৃহে অধিষ্ঠান করেন। তিনি সকল মানুষে, দেবতায়,
সত্যে, আকাশে, জলে বাস করা জীবে, মাটিতে উৎপন্ন শস্যে, যজ্ঞের সকল উপচারে, পর্বতে
উৎপন্ন সকল নদীতে পরম নিয়ন্ত্রকরূপে অধিষ্ঠান করেন, তিনি সর্বব্যাপী, মহান্।
ঊর্ধ্বং
প্রাণমুন্নয়ত্যপানং প্রত্যগস্যতি। মধ্যে
বামনামাসীনং বিশ্বে দেবা উপাসতে।। ২/২/৩ |
ঊর্ধ্বম্
প্রাণম্ উন্নয়তি অপানম্ প্রত্যক্ অস্যতি। মধ্যে
বামনম্ আসীনম্ বিশ্বে দেবাঃ উপাসতে।। |
তিনি প্রাণবায়ুকে ঊর্ধে চালিত করেন, অপানবায়ুকে নিম্নগামী করেন। হৃদয়ের
মধ্যে অধিষ্ঠানরত পূজনীয় আত্মাকে সকল ইন্দ্রিয়ই উপাসনা করে থাকে।
[জীবদেহের জীবনীশক্তিকে পাঁচটি বিভাগে ভাগ করে প্রাণবায়ু বলা হয়েছে। দেহে এই পাঁচটি বায়ুর নাম ও তাদের কর্মসমূহ হলঃ প্রাণবায়ু – শ্বাস-প্রশ্বাস, অপানবায়ু – মলমূত্র ত্যাগ, সমানবায়ু – ভুক্তদ্রব্য হজম করা, ব্যানবায়ু – কথা বলা, এবং উদানবায়ু – স্নায়ুতন্ত্র সমূহের অনুভূতি। এই সকল প্রাণবায়ুর নিজস্ব কোন শক্তি নেই – জীবদেহের আত্মার শক্তিই এই বায়ুগুলিকে চালিত করে এবং প্রয়োজন মত নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রাণ ও অপান বায়ুর মাঝখানে হৃদিপদ্মে এই আত্মার অবস্থান – সিদ্ধ যোগীগণ
তাঁদের হৃদাকাশেই আত্মাকে উপলব্ধি করেন। এই জীবাত্মা যেন রাজা – আর সকল প্রাণবায়ু এবং
জীবের ইন্দ্রিয়সমূহ যেন তাঁর প্রজা। প্রজারা যেমন উপহারসামগ্রী এনে রাজার উপাসনা
করে – তেমনি ইন্দ্রিয়সকলও বহির্জগতের সকল রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ ও অনুভব এনে আত্মাকে
উপহার দেয় – পূজা বা উপাসনা করে।
এই শ্লোক এবং পরবর্তী শ্লোকগুলিতেও দেহের সঙ্গে জীবাত্মার সম্পর্ক এবং এই
জীবাত্মা কী কী কাজ সম্পাদন করেন সেই কথাই বলা হয়েছে।]
অস্য
বিস্রংসমানস্য শরীরস্থস্য দেহিনঃ। দেহাদ্বিমুচ্যমানস্য
কিমত্র পরিশিষ্যতে।। এতদ্বৈ
তৎ।। ২/২/৪ |
অস্য
বিস্রংসমানস্য শরীরস্থস্য দেহিনঃ। দেহাৎ
বিমুচ্যমানস্য কিম্ অত্র পরিশিষ্যতে।। এতৎ
বৈ তৎ।। |
শরীরে অধিষ্ঠিত এই আত্মা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, এই দেহে অবশিষ্ট আর
কী থাকে? ইনিই সেই ব্রহ্ম।
ন
প্রাণেন নাপানেন মর্ত্যো জীবতি কশ্চন। ইতরেণ
তু জীবন্তি যস্মিন্নেতাবুপাশ্রিতৌ।। ২/২/৫ |
ন
প্রাণেন ন অপানেন মর্ত্যঃ জীবতি কঃ চন। ইতরেণ
তু জীবন্তি যস্মিন্ এতৌ উপাশ্রিতৌ।। |
মরণশীল কোন জীবই প্রাণ কিংবা অপান বায়ু দিয়ে বেঁচে থাকতে পারে না, বরং
প্রাণ ও অপান যাঁকে আশ্রয় করে থাকে, দেহ বিলগ্ন সেই আত্মার জন্যেই জীব জীবন ধারণ
করে।
হন্ত
ত ইদং প্রবক্ষ্যামি গুহ্যং ব্রহ্ম সনাতনম্। যথা
চ মরণং প্রাপ্য আত্মা ভবতি গৌতম।। ২/২/৬ |
হন্ত
ত ইদং প্রবক্ষ্যামি গুহ্যং ব্রহ্ম সনাতনম্। যথা
চ মরণং প্রাপ্য আত্মা ভবতি গৌতম।। |
হে গৌতম আমি তোমাকে এখন গূঢ় শাশ্বত ব্রহ্মতত্ত্বের কথা বলবো, ব্রহ্মকে না
জানলে, দেহের মৃত্যুর পর আত্মার কী অবস্থা হয়, সে কথাও বলবো।
যোনিমন্যে
প্রপদ্যন্তে শরীরত্বায় দেহিনঃ। স্থাণুমন্যেঽনুসংযন্তি
যথাকর্ম যথাশ্রুতম্।। ২/২/৭ |
যোনিম্
অন্যে প্রপদ্যন্তে শরীরত্বায় দেহিনঃ। স্থাণুম্
অন্যে অনুসংযন্তি যথাকর্ম যথাশ্রুতম্।। |
নিজ নিজ কর্ম ও জ্ঞান অনুসারে কোন কোন আত্মা শরীরধারণের জন্যে মাতৃগর্ভে
প্রবেশ করে, কেউ কেউ স্থাবর জন্ম লাভ করে।
[মানুষ, পশু, পাখি ইত্যাদি জীব মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করে, বৃক্ষ, লতা
ইত্যাদি স্থাবর দেহ লাভ করে।]
য
এষ সুপ্তেষু জাগর্তি কামং কামং পুরুষো নির্মিমাণঃ। তদেব
শুক্রং তদ্ব্রহ্ম তদেবামৃতমুচ্যতে। তস্মিঁল্লোকাঃ
শ্রিতাঃ সর্বে তদু নাত্যেতি কশ্চন। এতদ্বৈ
তৎ।। ২/২/৮ |
যঃ
এষঃ সুপ্তেষু জাগর্তি কামম্ কামম্ পুরুষঃ নির্মিমাণঃ। তৎ
এব শুক্রং তদ্ব্রহ্ম তৎ এব অমৃতম্ উচ্যতে। তস্মিন্
লোকাঃ শ্রিতাঃ সর্বে তৎ উ ন অত্যেতি কশ্চন। এতৎ
বৈ তৎ।। |
সমস্ত প্রাণীর নিদ্রিত অবস্থায় যে পুরুষ জাগ্রত থেকে একের পর এক কাম্য বিষয়
নির্মাণ করতে থাকেন, তিনি শুদ্ধ, তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই অমৃতরূপে অভিহিত হন। সকল লোক
তাঁরই আশ্রিত, তাঁকে কেউই অতিক্রম করতে পারে না।
অগ্নির্যথৈকো
ভুবনং প্রবিষ্টো রূপং
রূপং প্রতিরূপো বভূব। একস্তথা
সর্বভূতান্তরাত্মা রূপং
রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ।। ২/২/৯ |
অগ্নিঃ
যথা একঃ ভুবনম্ প্রবিষ্টঃ রূপম্
রূপম্ প্রতিরূপঃ বভূব। একঃ
তথা সর্ব-ভূত-অন্তঃ-আত্মা রূপং
রূপং প্রতিরূপঃ বহিঃ চ।। |
একই অগ্নি জগতে (বিভিন্ন দাহ্য বস্তুতে) নিহিত থেকে, যেমন (দাহ্য বস্তুর
ধর্ম অনুসারে) বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়, তেমনি একই ব্রহ্ম সকল ভূতের
অন্তরাত্মারূপে নানান রূপে নিহিত রয়েছেন, (কিন্তু তিনি নির্লিপ্ত)।
বায়ুর্যথৈকো
ভুবনং প্রবিষ্টো রূপং
রূপং প্রতিরূপো বভূব। একস্তথা
সর্বভূতান্তরাত্মা রূপং
রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ।। ২/২/১০ |
বায়ুঃ
যথা একঃ ভুবনম্ প্রবিষ্টঃ রূপম্
রূপম্ প্রতিরূপঃ বভূব। একঃ
তথা সর্ব-ভূত-অন্তঃ-আত্মা রূপম্
রূপম্ প্রতিরূপঃ বহিঃ চ।। |
জগতে একই বায়ু প্রাণরূপে নিহিত হয়েও, নানান জীবদেহ অনুযায়ী প্রতিরূপে
প্রকাশিত হন, তেমনি একই ব্রহ্ম সকল ভূতের অন্তরাত্মারূপে নানান রূপে নিহিত রয়েছেন,
(কিন্তু তিনি নির্লিপ্ত)।
সূর্যো
যথা সর্বলোকস্য চক্ষুর্ন লিপ্যতে
চাক্ষুষৈর্বাহ্যদোষৈঃ। একস্তথা
সর্বভূতান্তরাত্মা ন
লিপ্যতে লোকদুঃখেন বাহ্যঃ।। ২/২/১১ |
সূর্যঃ
যথা সর্বলোকস্য চক্ষুঃ ন লিপ্যতে
চাক্ষুষৈঃ বাহ্যদোষৈঃ। একঃ
তথা সর্বভূত-অন্তরাত্মা ন
লিপ্যতে লোকদুঃখেন বাহ্যঃ।। |
সূর্য যেমন সমস্ত জীবের চক্ষুস্বরূপ (দর্শনের কারণ), কিন্তু চাক্ষুষ বিষয়ের
দোষ-গুণ তাঁকে স্পর্শ করে না। তেমনি সর্বভূতের একই অন্তরাত্মা জীবের দুঃখসুখে
লিপ্ত হন না। নির্লিপ্ত থাকেন।
[সূর্যের কিরণ পবিত্র গঙ্গাজল স্পর্শ করে, আবার বদ্ধ জলাশয়ের পঙ্কিল জলও
স্পর্শ করে – কিন্তু তাতে সূর্য কিরণে কোন পুণ্য বা ক্লেদ যেমন অর্শায় না, তেমনি
জীবাত্মাও কোন পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হন না।]
একো
বশী সর্বভূতান্তরাত্মা একং
রূপং বহুধা যঃ করোতি। তমাত্মস্থং
যেঽনুপশ্যন্তি ধীরাস্তেষাং সুখং
শাশ্বতং নেতরেষাম্।। ২/২/১২ |
একঃ
বশী সর্বভূত-অন্তরাত্মা একম্
রূপম্ বহুধা যঃ করোতি। তম্
আত্মস্থং যে অনুপশ্যন্তি ধীরাঃ তেষাম্ সুখম্
শাশ্বতম্ ন ইতরেষাম্।। |
যিনি এক, যিনি সর্বজীবের অন্তরাত্মা, যিনি এক রূপকে বহুরূপে প্রকাশ করেছেন,
সেই ব্রহ্মকে যে জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের অন্তরে উপলব্ধি করতে পারেন, তিনি শাশ্বত
সুখের অধিকারী। কিন্তু অন্য বক্তিরা নয়।
নিত্যোঽনিত্যানাং
চেতনশ্চেতনানাম্ একো
বহূনাং যো বিদধাতি কামান্। তমাত্মস্থং
যেঽনুপশ্যন্তি ধীরাস্তেষাং শান্তিঃ
শাশ্বতী নেতরেষাম্। ২/২/১৩ |
নিত্যঃ
অনিত্যানাম্ চেতনঃ চেতনানাম্ একঃ
বহূনাম্ যঃ বিদধাতি কামান্। তম্
আত্মস্থং যে অনুপশ্যন্তি ধীরাঃ তেষাং শান্তিঃ
শাশ্বতী ন ইতরেষাম্। |
অনিত্য বিষয়ের যিনি নিত্য শক্তি, সকল চেতনার মধ্যে যিনি চৈতন্য, এক হয়েও যিনি সকলকে কাম্যবিষয় বিধান করেন, সেই ব্রহ্মকে যে জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের অন্তরে উপলব্ধি করতে পারেন, তিনি শাশ্বত সুখের অধিকারী। কিন্তু অন্য বক্তিরা নয়।
তদেতদিতি মন্যন্তেঽনির্দেশ্যং পরমং সুখম্। কথং নু তদ্বিজানীয়াং কিমু ভাতি বিভাতি বা।। ২/২/১৪ |
তৎ এতৎ ইতি মন্যন্তে অনির্দেশ্যং পরমম্ সুখম্। কথম্ নু তৎ বিজানীয়াং কিম্ উ ভাতি বিভাতি বা।। |
ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্যক্তিরা সেই অনির্দেশ্য পরম সুখকে “তৎ এতৎ” – “এই তিনিই সেই
ব্রহ্ম” এমন মনে করেন, কিন্তু এই ব্রহ্মকে আমি কীভাবে জানতে পারবো, তিনি কি নিজেই
প্রকাশিত হন, নাকি তাঁকে বিস্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়?
[ব্রহ্ম অবাঙ্মনসোগোচর – বাক্য ও মনের অতীত। ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্যক্তিরা সেই ব্রহ্মকে
উপলব্ধি করতে পারলে, অনির্দেশ্য পরম সুখ লাভ করতে পারেন কিন্তু সেই সুখের কথা অপরের কাছে
নির্দিষ্ট করে বর্ণনা করতে পারেন না। ]
ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোঽয়মগ্নি। তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।। ২/২/১৫ |
ন তত্র সূর্যঃ ভাতি ন চন্দ্রতারকং ন ইমাঃ বিদ্যুতঃ ভান্তি কুতঃ অয়ম্ অগ্নি। তম্ এব ভান্তম্ অনুভাতি সর্বম্ তস্য ভাসা সর্বম্ ইদং বিভাতি।। |
সেখানে সূর্যের কিংবা চন্দ্রতারকার দীপ্তি নেই, এই বিদ্যুতেরও দীপ্তি নেই,
সামান্য অগ্নির দীপ্তি সেখানে কোথায়? তিনি নিজে প্রকাশমান বলেই, সকল বস্তু দীপ্তি
লাভ করে, তাঁর প্রভায় এরা সকলেই উদ্ভাসিত হয়।
সমাপ্ত দ্বিতীয় অধ্যায় – দ্বিতীয়া বল্লী
...চলবে...
কৃতজ্ঞতাঃ
উপনিষদঃ শ্রীযুক্ত অতুলচন্দ্র সেন
উপনিষদ গ্রন্থাবলীঃ স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন