[এর আগের পর্ব পড়তে হলে এই সুত্রে প্রবেশ করুন - ধর্মাধর্ম -১/৩]
প্রথম পর্ব (৭০,০০০ বিসিই থেকে ১২,০০০ বিসিই) - ৪র্থ পর্বাংশ
১.৩.৩
সংঘাত – সংযোগ - মৈত্রী
ওঁদের বিশ্রামের ফাঁকে আর ঊষি খাবার জল আনার আগে, মিত্তিকা আর গিরিজের
পরিচয়টা সেরে ফেলা যাক।
মাস তিনেক আগে, পিতা পশুপতির দলটি যখন তাদের এই বসতির দিকেই আবার ফিরে
আসছিল, জঙ্গলের পথে এক নদীর ধারে
এই মিত্তিকার দলটির সঙ্গে তাঁদের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ও পরিচয় ঘটেছিল।
মানুষের এই বিচ্ছিন্ন পারিবারিক দলগুলি ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এক
জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। কারণ একই জঙ্গলে সারাবছর যথেষ্ট খাবার, শিকার ও জলের সংস্থান
থাকে না। বনের তৃণভোজী পশুরাও খাবার আর জলের সন্ধানে ঋতু অনুযায়ী এমনই জঙ্গল থেকে
জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। তাদের পিছনে ঘুরে বেড়ায় মাংসাশী পশুরা এবং মানুষ ও মানবের
গোষ্ঠীগুলিও। কোন ক্যালেণ্ডার নেই, কোন ট্র্যাভেল-গাইড নেই। তবুও জঙ্গলের সব অধিবাসীই টের
পেয়ে যায়,
কোন সময়
তাদের পরিচিত জঙ্গল ছেড়ে অন্য জঙ্গলে চলে যেতে হবে। আবার কখন ফিরে আসতে হবে তাদের
ছেড়ে যাওয়া পুরোনো বসতিতেই।
এমনই যাওয়া আসার পথে, মাঝে মাঝেই অন্য মানুষ এবং মানব গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের দেখা
হয়ে যায়। সাধারণতঃ তারা একে অপরকে এড়িয়ে চলে, তবে কখনো কখনো ভয়ংকর সংঘাতও ঘটে
যায়। সংঘাতটা ঘটে এলাকা দখলের বিবাদ থেকে। একই অঞ্চলে একাধিক দলের উপযোগী খাদ্যের
সংস্থান হওয়া দুঃসাধ্য, অতএব একদল অন্যদলকে তাড়িয়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার
জন্যেই সংঘাতের পথে যেতে বাধ্য হয়।
বছর পাঁচেক আগের প্রথম সাক্ষাতে মিত্তিকার দলটির সঙ্গে পিতা পশুপতির
দলের এমনই এক সংঘাত ঘটেছিল, এখান থেকে বহুদূরের এক জঙ্গলে। সেই সংঘাতে পিতা পশুপতির
দলেরই ক্ষতি হয়েছিল বেশি। তাঁর দলের তিনজন মারা গিয়েছিল, এবং আহত হয়েছিল আটজন। মিত্তিকাদের
দুর্দান্ত দলের হাতে পরাজিত হয়ে পিতা পশুপতির দল অন্য জঙ্গলে সরে যেতে বাধ্য
হয়েছিলেন।
এইবারের ঋতুকালীন পর্যটন সেরে পিতা পশুপতির দলটি যখন আবার এই বসতিতে
ফিরছিলেন,
তখন
মিত্তিকাদের দলটির সঙ্গে হঠাৎ সাক্ষাৎ হয়ে গেল, একটি নদীর ধারে। সে নদীতে সারা
বছরই জল থাকে,
যার ফলে তার
দুপাশেই রয়েছে গভীর সবুজ জঙ্গল আর সবুজ তৃণক্ষেত্র। অতীতের সংঘাতের কথা দু দলের
কেউই ভোলেনি। দূর থেকে দু দলই একে অপরকে সতর্ক লক্ষ্য করতে লাগল। পিতা পশুপতি
লক্ষ্য করলেন,
ওদের দলটির
লোকসংখ্যা বেশ কম, মাত্র
ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন, তার
মধ্যে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর বাচ্চাদের সংখ্যাই বেশি, যুবক-যুবতীরা সাকুল্যে আট-দশ জন।
তারাও কেমন যেন মনমরা, আগেকার
সেই সাহস বা শক্তির কিছুই যেন আর অবশিষ্ট নেই।
দুটো দিন সতর্ক লক্ষ্য রাখার পর পিতা পশুপতি তাঁর দলের সবাইকে এক সকালে
ডেকে বললেন,
“আমি ওই
দলের কাছে যাবো,
আমার সঙ্গে
কেউ একজন চল”। এ দলের সকলেই ভীষণ অবাক হল, জিগ্যেস করল, “কেন? আপনারা শুধু দুজন যাবেন, ওদের সঙ্গে লড়াই করতে? পাগল হয়েছেন?” পিতা পশুপতি বললেন, “লড়াই করতে নয়। দেখছিস না, ওদের দলে লোক কম, ওরা এখন দুর্বল, আমাদেরই ভয় পাচ্ছে। অন্য
কোন দলের খপ্পরে পড়লে তো ওরা শেষ হয়ে যাবে। কিংবা বাঘ, সিংহ বা হাতির কবলে পড়ে যদি আরও
কয়েকজন আহত হয়,
তাহলে ওদের
আর থাকবেটা কী?
আমি যাবো
ওদের সঙ্গে কথা বলতে, বর্শা
নিয়ে শুধু একজন চল আমার সঙ্গে, আর তোরা এখানেই থাক, গতিক সুবিধের নয় মনে হলে, তোরাও তাড়াতাড়ি চলে
আসবি”। এমন একটা প্রস্তাব দলের কারও ঠিক পছন্দ হল না। পিতা পশুপতি সকলের মুখের
দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার
মনে যে নির্দেশ এসেছে, আমি
তা পালন করছি মাত্র। আমাদের দু’দলেই রয়েছি যারা, তারা সবাই তো মানুষ। আমি বুঝতে
পারছি, ওরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় দিন
কাটাচ্ছে। এসময় ওদের পাশে দাঁড়ালে ভবিষ্যতে আমাদের দুপক্ষেরই মঙ্গল হতে পারে”।
পিতা পশুপতির দলের সকলেই জানে, তিনি তাঁর অন্তরে তাঁর বড়োবাবার নির্দেশ পান, সেই আত্মার নির্দেশেই
তিনি কঠিন সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
এরপর আর কিছু বলার ছিল না, পিতা পশুপতি একজন সশস্ত্র যুবককে সঙ্গে নিয়ে অন্য দলের
দিকে হাঁটা দিলেন। অন্য দলের লোকেরাও তাঁদের দেখছিল, যুবক-যুবতীরা সতর্ক হয়ে উঠল তাদের
বল্লম আর পাথরের অস্ত্র নিয়ে। ও দলের এক বৃদ্ধ তাদের সতর্ক থাকতে বললেন, কিন্তু উত্তেজিত হতে
নিষেধ করলেন। তাদের কাছে এ এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। একদলের ওপর অন্যদল আচমকা
হামলা করে,
এমন তারা
বেশ কয়েকবার দেখেছে। কিন্তু এভাবে একজন বৃদ্ধ একটিমাত্র যুবকের সঙ্গে শান্তভাবে, তাদের দিকেই হেঁটে আসছেন, এ দৃশ্য বিরল। তারা
কোনদিন দেখেনি। তাদেরও কৌতূহল বাড়তে লাগল।
বৃদ্ধ যে মানুষটিকে ওই দলের নেতা বলে মনে হচ্ছিল, পিতা পশুপতি তাঁকে
জোড়হাতে নমস্কার করলেন। ইশারা করলেন, তাঁর সঙ্গের যুবকটিকে।
যুবকটি অবাক হলেও, মেনে
নিল এবং জোড় হাতে নমস্কার করল। এতদিন সে এবং তার দলের সকলে পাথর-আত্মার সামনে
নমস্কার করেছে,
কিন্তু এখন
অজানা এই লোকগুলোকে সে কেন নমস্কার করল, বুঝল না। পিতা পশুপতির চোখে এবং অধরে হাল্কা হাসির ছোঁয়া।
তিনি ওই দলের নেতার সামনে মাটিতেই বসলেন। শান্ত দৃষ্টিতে দলের কৌতূহলী এবং
সন্দিগ্ধ সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তারপর দলনেতার চোখে চোখ রেখে
বললেন, “কবছর আগে আপনার এই দলের
সঙ্গে আমাদের যে লড়াই হয়েছিল, তাতে আমাদেরই হার হয়েছিল। মনে আছে? কিন্তু এবার আপনাদের দলটিকে বেশ
ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে যেন, এর কারণ বলবেন কি?”
তাঁর ভাষা অন্যদলের ভাষার থেকে অনেকটাই আলাদা। ও দলের বৃদ্ধ সব কথা না
বুঝলেও বক্তব্য বুঝতে অসুবিধে হল না। তিনি এতক্ষণ পিতা পশুপতির অভিনব ও অভূতপূর্ব
আচরণ মন দিয়ে লক্ষ্য করছিলেন। তিনি ভীষণ আশ্চর্য হচ্ছিলেন, কিন্তু এটাও বুঝতে পারছিলেন
আগন্তুক এই বৃদ্ধ এবং ওই যুবকের মনে কোন অশুভ উদ্দেশ্য নেই। তা যদি হত, ওদের শক্তিশালী দল নিয়ে
আচমকা আক্রমণ করতে পারত এবং গতবারের পরাজয়ের শোধ তুলতে পারত অনায়াসে।
কোন উত্তর না দিয়ে তিনি পিতা পশুপতির স্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন
কিছুক্ষণ,
তারপর
দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব শান্ত স্বরেই বললেন, “কয়েক মাস আগেই আমাদের দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছিল সে এক বৃদ্ধ
দাঁতাল হাতি – খ্যাপা, মনে
হয় নিজের দল থেকে সে ছিল বিতাড়িত। তার সারা গায়ে ছিল ভয়ানক লড়াইয়ের ক্ষত। সে
হাতিকে আমরা গভীর জঙ্গলে বেশ কয়েকবার দেখেছিলাম। দলছুট সেই হাতি গভীর এক রাত্রে
আমাদের বসতির কাছাকাছিই নিঃশব্দে লুকিয়েছিল। আমরা বুঝতেও পারিনি। আমাদের উঠোনে
যতক্ষণ আগুন জ্বলছিল, সবাই
কথাবার্তা বলছিলাম, খাওয়াদাওয়া
করছিলাম,
তখন সে
আসেনি। গভীর রাতে আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়েছি, কোন এক সময় নিভে গেছে চর্বির মশাল, চারিদিক নিবিড় অন্ধকার। সে
নিঃশব্দ মৃত্যুর মতো এগিয়ে এল আমাদের বাসার দিকে। উঠোনে যারা ঘুমোচ্ছিল – তাদের
সাতজনকে পিষে দিল পায়ের তলায়। বাকিরা যারা ঘুমভাঙা চোখে অন্ধকার পাহাড়ের মতো
হাতিটাকে বল্লম দিয়ে আঘাত করছিল বারবার। তাদের শুঁড়ে জড়িয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল
দূরে। তারপর আরও কিছুক্ষণ আমাদের উঠোনে দাঁড়িয়ে থেকে, যেমন নিঃশব্দে সে এসেছিল, তেমনই চলে গেল – গভীর
জঙ্গলের দিকে। আমরা কয়েকজন এবং বাচ্চারা নিরাপদেই ছিলাম, কিন্তু ভীষণ আতঙ্কে সেই রাতে মশাল
জ্বেলে বের হবার কথা মনেও হয়নি। সূর্যোদয়ের পর, আমরা আমাদের আহত মানুষগুলোকে তুলে
আনলাম, তাদের সেবা শুশ্রূষা শুরু
করলাম। কিন্তু তাদের মধ্যেও পাঁচজন, দুদিনের মধ্যে মারা গেল”।
দলের অধিকাংশ মানুষ মাথা নীচু করে শুনছিল। তাদের প্রত্যেকের চোখেই জল, একজন প্রৌঢ়া মহিলা পাথরের
মূর্তির মতো উদাসীন চোখে তাকিয়ে ছিলেন দূর জঙ্গলের দিকে। গিরিজ তাঁর দিকে তাকিয়ে
বললেন, “ও আমার মেয়ে, মিত্তিকা। হাতির পায়ের
তলায়, ও হারিয়েছে ওর দুই পুত্র
আর নিজের সঙ্গীকে...”। গভীর হতাশায় আর দুঃখে বৃদ্ধ মাথা নাড়তে লাগলেন বারবার, তাঁরও দুই চোখ ভরে উঠল
অশ্রুতে।
পিতা পশুপতি থমথমে মুখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বৃদ্ধের মুখের দিকে, তারপর উঠে গিয়ে হাত
রাখলেন তাঁর কাঁধে। অদ্ভূত এক অনুভূতি নিয়ে বৃদ্ধ মুখ তুলে তাকালেন পিতা পশুপতির
চোখে চোখ রাখলেন কিছুক্ষণ। তারপর দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরলেন পিতা পশুপতিকে, তাঁর কাঁধে মাথা রেখে
কান্নায় ভেঙে পড়লেন, বিকৃত
স্বরে বলতে লাগলেন, “আমার
সব গেল, সব...তিন ছেলে, দুই নাতি, দুই ভাইপো...যাদের ওপর
আমাদের ভরসা ছিল খুব। আমাদের বুকের পাঁজরগুলোও যেন ভেঙে দিয়ে গেল ওই শয়তান
দাঁতালটা...”।
দুঃখ ও শোকের ভারি বাতাবরণের মধ্যেও দলের সব্বাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল
দুই বৃদ্ধের দিকে, অভূতপূর্ব
এক দৃশ্য। অজানা, অচেনা, সম্পর্কহীন দুই বৃদ্ধের
এমন অন্তরঙ্গ দৃশ্য তাদের কেউ কখনও দেখেনি। নিজেদের দলের পুরুষ মহিলার মধ্যে এমন
আচরণ তারা বহুবার দেখেছে, সে দৃশ্যে তারা অভ্যস্ত, কিন্তু এমন দৃশ্য অভাবিত, তারা তাকিয়ে রইল দুই
বৃদ্ধের দিকে। তাঁদের আবেগ ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হতে লাগল সকলের মনে। এ আবেগ তারা
আগে কোনদিনই টের পায়নি, মানুষের ইতিহাসেও এই হয়তো প্রথম। এ আবেগ মৈত্রীর, এ আবেগ সখ্যতার।
একটু পরে বৃদ্ধ নিজেকে অনেকটা সামলে নিলেন, কর্কশ হাতে চোখের জল মুছে, পিতা পশুপতির চোখের দিকে
তাকিয়ে বললেন,
“আমি গিরিজ, এই দলের নেতা। আমরা সবাই
কৃতজ্ঞ আপনার কাছে, আপনার
দলের সবার কাছে। আমাদের দুর্বল বুঝেও আপনারা প্রতিশোধ নিলেন না। আপনার এমন আন্তরিক
ব্যবহার আমরা কল্পনাও করিনি”।
পিতা পশুপতি কিছু বললেন না, তাঁর গভীর বলিচিহ্নিত চোখের কোলে আস্থার হাসি, বৃদ্ধের দুই কাঁধে হাত
রাখলেন কিছুক্ষণ, তারপর
জিজ্ঞাসা করলেন,
“আপনাদের
দলের কোন একজন অথবা কয়েকজন মানুষের কৃতকর্মের জন্যে আপনি কখনও অনুশোচনা করেন কি? এমন কোন কাজ, যা করা উচিৎ হয়নি, এমন কি মনে হয়?” পিতা পশুপতি মাথা নীচু
করে অস্ফুট স্বরে আবার বললেন, “অকারণ কোন হত্যা, প্রকৃতির নিয়মে যার কোন প্রয়োজনই ছিল না – এমন কোন অপরাধ?”
এই কথা শুনে গিরিজ এবং সঙ্গী-পুত্র হারা মিত্তিকা শিউরে উঠলেন যেন।
অদ্ভূত আতঙ্কে তাঁরা তাকিয়ে রইলেন পিতা পশুপতির মুখের দিকে। এই বৃদ্ধ কি
অন্তর্যামী,
সব কিছু
দেখতে পান?
তা নাহলে
এমন প্রশ্ন করলেন কী করে?
বৃদ্ধ গিরিজ মুখ তুলে তাঁর অভাগী
কন্যার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আছে বৈ কি! এই শীতের আগের শীতে
আমরা তখন ফিরে গিয়েছি আমাদের পুরোনো এলাকায়। গিয়ে দেখি, সেখানে আমাদের আগেই অন্য একটি দল
আস্তানা গেড়েছে। তাদের সঙ্গে আমাদের বেধে গেল ভয়ংকর লড়াই, আমাদের একজন মারা গেল, আহত হল চার-পাঁচজন।
কিন্তু অন্য দলটির ক্ষতি হয়েছিল অনেক বেশি। তাদের পাঁচজন মাটি নিয়েছিল, আর অন্ততঃ আটজন গুরুতর
আহত হয়েছিল। ওরা হার স্বীকার করে নিয়েছিল। ওরা আমাদের এলাকা ছেড়ে আরও পশ্চিমের
জঙ্গলে চলে যাচ্ছিল। আমরাও জয়ের আনন্দে পুরোনো এলাকায় জাঁকিয়ে বসার তোড়জোড় শুরু
করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আহত মানুষদের জন্যে ওদের দলটা খুব দ্রুত পালাতে পারেনি।
তিনদিন পরেও আমাদের কয়েকজন তাদের দেখতে পেল, পশ্চিমে জঙ্গলের গভীরে। আমাদের
ছেলেরা, ওদের এতটুকুও সুযোগ না
দিয়ে, আবার আক্রমণ করল সেই
হীনবল দলটাকে। এবার সবাইকেই হত্যা করল নির্দ্বিধায়, মহিলাদের এমনকি বাচ্চাদেরও...”!
পিতা পশুপতি থমথমে গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লেন, অস্ফুট স্বরে বললেন, “এ যে অনর্থক গণহত্যা! এ
তো প্রকৃতির নিয়ম নয়, এ
যে মহা অপরাধ! পাপ!” তাঁর মুখের অজস্র বলিরেখায় এখন বিরক্তি!
পিতা পশুপতি হঠাৎই উঠে দাঁড়ালেন, সঙ্গের যুবকটিকেও ফেরার ইশারা
করলেন। গিরিজ উঠে দাঁড়িয়ে পিতা পশুপতির দুই হাত ধরে বললেন, “আপনি কী চলে যাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ”।
“আবার
আসবেন তো?”
“তার
কি কোন প্রয়োজন আছে?”
“নেই?” বৃদ্ধের স্বরে অদ্ভূত
আকুতি। পিতা পশুপতি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে
সঙ্গী যুবককে নিয়ে ফেরার পথে এগিয়ে চললেন দ্রুত। তিনি পিছন ফিরে আর তাকালেন না।
তাকালে দেখতে পেতেন, সেই
বৃদ্ধ এবং দলের অন্য সবাই, এমনকি সেই সঙ্গী-পুত্রহারা মিত্তিকাও জোড়হাতে দাঁড়িয়ে আছে
এবং একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তাঁর পথচলার দিকে।
পিতা পশুপতির দলটি পরের দিন সকালেই তাদের পুরোনো এলাকায় ফেরার জন্যে
প্রস্তুত হচ্ছিল। প্রস্তুত হবার ছিলটাই বা কী? শুকনো লতার ঝুলিতে পাথরের
অস্ত্রগুলো,
হাতে হাতে
কাঠের বা বাঁশের বল্লম, আর কিছু পশুর চামড়া – বুনো ছাগল, ভেড়া আর শুয়োরের। গতদিনের শিকার
করা কিছু খরগোশ,
মেঠো ইঁদুর
আর সংগ্রহ করা কিছু খাম-আলু ছিল, সেগুলো ঝলসে বা পুড়িয়ে খেয়ে দলটি যখন রওনা হতে যাচ্ছে, সে সময় পিতা পশুপতির কাছে
এসে উপস্থিত হলেন, গিরিজ
ও মিত্তিকা। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে দুজনেই জোড়হাতে নমস্কার করলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা কী আজই চলে যাচ্ছেন?”
নিজের দলের সবার দিকে একবার তাকিয়ে পিতা পশুপতি বললেন, “হ্যাঁ”।
এবার মিত্তিকা সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমরা কী আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি?”
পিতা পশুপতি মাথা নেড়ে দৃঢ়স্বরে বললেন, “না। আমাদের দলের সকলের
খাদ্য-সংস্থান করাই আমাদের কাছে কখনও কখনও দুরূহ হয়ে ওঠে, তার ওপর আপনাদের দলে প্রায়
পঁয়ত্রিশ জন। অসম্ভব। তাছাড়া আপনাদের দল অত্যন্ত উদ্ধত এবং নিষ্ঠুর। আমাদের দলকে
একবার পরাস্ত করেছিলেন, তারপরে আরও একটি দলকে আপনারা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন! অতএব, আমার উত্তর একটাই “না”।”
“কিন্তু
আপনি তো গতকাল নিজেই গিয়েছিলেন সহমর্মীতার বার্তা নিয়ে, তাহলে আজ আমাদের প্রত্যাখ্যান
করছেন কেন?”
স্মিত হাস্যে পিতা পশুপতি বললেন, “প্রত্যাখ্যান তো করিনি মা, যেটা সত্য সেটাই বললাম।
এখনকার দুর্বলতা থেকে তোমাদের দলকে বের করে আনতে হবে, তোমাকেই। আমরা তোমাদের বড়ো জোর
সাহায্য করতে পারি, কিন্তু
বহন তো করতে পারি না। তাছাড়া...”।
বৃদ্ধ গিরিজ অধীর আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাছাড়া?”
হাসিমুখে পিতা পশুপতি বললেন, “আমরা কোনদিন, কোনখানে আবার হয়তো মিলিত হব। কিন্তু সেই সাক্ষাতে আমরা
গণ-হত্যার লড়াইতে সামিল হব, নাকি মৈত্রীর গণ-আলিঙ্গনে আবদ্ধ হব - সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর
করবে আপনার দলের আচরণের ওপর”।
দলের সকলেই তখন রওনা হওয়ার অপেক্ষায়, পিতা পশুপতি ওঁদের দুজনকে নমস্কার
করে, দলের সঙ্গে যোগ দিলেন।
তাঁর দলের অন্য সকলেও জোড়হাতে নমস্কার করল তাঁদের দুজনকে। গিরিজ ও তাঁর কন্যা
জোড়হাতে তাকিয়ে রইলেন পিতা পশুপতির দিকে এবং তাঁর দলটির দিকে। মিত্তিকার দুই চোখ
ঝাপসা হয়ে এল অশ্রুতে, তিনি
অস্ফুটে বললেন,
“খুব শিগ্গিরি
আমাদের আবার দেখা হবে, বাবা, আমাদের বড়ো প্রয়োজন
আপনাকে”।
আজ সকালে সেই গিরিজ আর মিত্তিকা হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলেন? কী বলতে চান ওঁরা?
১.৪.১ বিশ্বাসের বার্তা
ঊষি খাবার জল, আর শালপাতায় মুড়ে কিছু শুকনো ফল এনে দিল দুই অতিথির জন্যে।
কিশোরী মেয়েটির আন্তরিক আতিথ্যে মুগ্ধ হলেন, গিরিজ ও মিত্তিকা।
কিছুক্ষণ পর গিরিজ বললেন, “আপনারা রওনা হওয়ার কিছুদিন পরেই আমরাও আপনাদের অনুসরণ করে
বেরিয়ে পড়লাম। মাসখানেক হল সামনের ওই পাহাড়ের উত্তরে আমরা স্থিতু হয়েছি। আমাদের
ছোট দল, তাই নিরিবিলি নিরাপদ ছোট
এলাকাই খাদ্য-সংস্থানের পক্ষে যথেষ্ট। আপনাদের এলাকা এপাশে, পাহাড়ের দক্ষিণে, কাজেই আপনাদের এলাকায়
আমাদের অনধিকার অনুপ্রবেশের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। আমাদের অভিপ্রায় ছিল, আপনাদের ওপর কোন উপদ্রব
না করেও,
আপনাদের
কাছাকাছি থাকা। কাছেই আছি, আমরা সূর্যোদয়ের আগেই রওনা হয়েছিলাম, পৌঁছলাম এখন”।
বৃদ্ধের কথায় পিতা পশুপতি মনে মনে খুশিই হলেন। তিনি হাসলেন, বললেন, “বেশ করেছেন। আজকাল আমি আর
দলের সঙ্গে জঙ্গলে যাই না। ছেলেমেয়েরা, নাতিনাতনিরাও যেতে দেয় না। সারাদিন অলস বসে থাকি। অন্যদিন
আমি এরকম সময়ে কাছাকাছির জঙ্গলে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই। গাছগাছড়া, লতাগুল্ম, শাকপাতা খুঁজি, দেখি। আজকে এই নাতনিটির
পাল্লায় পড়ে সেও আর হল না। এর মধ্যে আপনারা এসে পড়ায় ভালই হয়েছে। বাইরের অনেক কথাই
জানা যাবে,
শোনা যাবে।
আমারও সময় কাটবে”।
মিত্তিকা জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি জঙ্গলে একা একা ঘুরে বেড়ান? আপনার ভয় করে না?”
মিত্তিকার দিকে স্মিতমুখে তাকিয়ে পিতা পশুপতি বললেন, “ভয় তো করেই, সর্বদাই করে। দলের সঙ্গে
জঙ্গলে শিকার করতে ভয় করে। মাটি খুঁড়ে কন্দ বের করার সময় ভয় করে, পেছনে কেউ ওঁৎ পেতে বসে
নেই তো? রাত্রে গভীর ঘুমের মধ্যেও
অচেনা শব্দে ভয় করে। ভয়, আতঙ্ক, বিপদের আশঙ্কা এবং দুশ্চিন্তা নিয়েই আমাদের নিত্য জীবনধারণ
– জন্মের রোমাঞ্চ, জীবনের
দুঃখ-সুখ এবং অবশেষে উদাসীন মৃত্যু!”
মিত্তিকা এবং গিরিজ দুজনেই অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন পিতা পশুপতির মুখের
দিকে। অদ্ভূত আর আশ্চর্য কথা বলেন এই মানুষটি, মন দিয়ে শুনতেই হয়। ওঁর কথাবার্তা
এবং আচরণে রয়েছে আশ্চর্য এক প্রত্যয়, নিশ্চিন্ত এক ভরসা।
মিত্তিকা জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু আপনি একলা একলা ওই জঙ্গলে কী খোঁজেন?”
পিতা পশুপতি একটু লাজুক হাসলেন এবার, বললেন, “জঙ্গলে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই।
গাছগাছড়া খুঁজি। সন্ধের পর এই গাছতলাতেই বসে আকাশ-পাতাল ভাবি। আকাশ দেখি। চাঁদ আর
অজস্র তারা,
নক্ষত্রে
ভরা বিশাল আকাশ। সেখানেও খুঁজে বেড়াই, আমাকে, আমাদেরকে!” মিত্তিকা অদ্ভূত এই মানুষটির থেকে তাঁর নতুন
ভাবনার কথা শুনতে চাইছিলেন, খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কিছু কী খুঁজে পেলেন”?
“কিছু
কিছু পেয়েছি,
কিছু কিছু
পাচ্ছি, তবে বেশির ভাগই মনে হচ্ছে
না-পাওয়া থেকে যাবে, এক
জীবনে সবটা পেয়ে যাব, এমন
তো হতে পারে না,
মা। এই
গাছ-গাছড়ার কথাই ধর না। প্রত্যেকদিনের জীবনে আমাদের ছোটছোট চোট-আঘাত, রোগ-বালাই, লেগেই থাকে, অন্য পশুদেরও থাকে, কিন্তু তারা আমাদের মতো
চট করে কাহিল হয়ে যায় কি? যায় না। এই অরণ্যই লুকিয়ে রেখেছে তার উপশম, আমরা জানি না, কিন্তু পশুরা জানে। আমি
ওদের লক্ষ্য করি, ছোটখাটো
রোগভোগের আরোগ্য”।
গিরিজ বললেন, “ছোট-খাটো ক্ষত-আঘাতের উপশমে কোন কোন গাছের পাতা, গাছের রস তো আমরাও
ব্যবহার করি,
এমন আরও আছে
নাকি?”
পিতা পশুপতি বললেন, “আছে বৈকি, অনেক আছে, আপনারা কিছু জানেন, আমরা কিছু জানি, অন্যান্য দলের মানুষরাও
জানে। এই সব জানা যদি একত্র করা যায়! আমরা দেখা মাত্র বিবাদ না করে, আলাদা থেকেও যদি একে
অন্যকে সাহায্য করি, তাহলে
মঙ্গল সবার – আমার, আপনার, সকলের...”।
গিরিজ বললেন, “তা কী সম্ভব? আপনি কত মানুষকে বোঝাতে পারবেন, আর বুঝবেই বা কেন? আমরাই কী আপনার কথা
শুনতাম, ঘটনাচক্রে আমরা যদি
দুর্বল না হয়ে পড়তাম?”
পিতা পশুপতি বললেন, “ঠিক কথা, ক্ষমতার অহংকারে মানুষ উন্মত্ত হয়ে যায়। তখন সে ভাবে, সে যা করছে, ঠিকই করছে। আসলে সে যে
কিছুই করছে না,
পেছন থেকে
কেউ একজন তাকে চালনা করছে, সেটা সে ভুলে যায়। খুব বড়ো কোন মাশুল গুনে দেবার পর তার
ভুল ভাঙে”।
গিরিজ ভারি অবাক হলেন, বললেন, “সে আবার কী? আমাদের পেছনে কে আছেন, যিনি আমাদের চালনা করছেন? এই যে আমি এবং আমার মেয়ে
আপনার কাছে আজ এসেছি, অথবা
আপনি যে অসুস্থ মানুষের উপশম খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আকাশ দেখছেন। এসব অন্য কেউ করাচ্ছে? কে? কই আপনার পিছনে কাউকে
দেখছি না তো?”
পিতা পশুপতি স্মিত হাসলেন, বললেন, “তাঁকে তো দেখা যায় না। যাঁকে দেখা যায়, তাঁকে আমরা নিজের লোকের
মতো কখনো আদর করি, কখনো
রাগ করি,
কখনো বা
অবহেলা করি। আর যাঁকে দেখা যায় না, তাঁকে আমরা ভালবাসতে পারি, ভয় পেতে পারি কিংবা শ্রদ্ধা করতে
পারি। কিন্তু কখনও অবহেলা করতে পারি না”।
গিরিজ হতবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন, মিত্তিকা জিজ্ঞাসা করলেন, “যাঁকে দেখতেই পান না, তাঁকে আপনি ভয় বা শ্রদ্ধা
করবেন কী করে?
তিনি যে
আছেন সেটা বুঝছেন কী করে?”
পিতা পশুপতি শান্ত ধীর স্বরে বললেন, “তিনি আছেন, আমাদের অন্তরে, আমাদের চিন্তায়, তাঁকে শুধু অনুভবই করা
যায়”! গিরিজ এবং মিত্তিকা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন পিতা পশুপতির মুখের দিকে, এমন আশ্চর্য বার্তা তাঁরা
কেউ কোনদিন শোনেননি। তাঁদের সমস্ত শরীর শিউরে উঠল, তাঁদের মনের ভেতরে এমন কী কেউ
সত্যি বসে আছেন?
যাঁকে দেখা
না গেলেও,
তিনি সব
কিছু দেখছেন?
তিনিই
আমাদের হাসাচ্ছেন, কাঁদাচ্ছেন, সব কাজ করাচ্ছেন!
মিত্তিকা অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাঁকে শুধু অনুভবই করা যায়? কিন্তু কী ভাবে অনুভব করব?”
পিতা পশুপতি স্মিত মুখে বললেন, “বিশ্বাস। যে বিশ্বাস করে, তিনি তার ডাকে সাড়া না
দিয়ে পারেন না”!
ওঁনারা সকলেই এখন আলাপে মগ্ন রয়েছেন। ততক্ষণ আমরা, কোন পরিস্থিতিতে মানুষের
মনে অধরা এই ধারণা - যার নাম বিশ্বাস - সৃষ্টি হল, সেটা একটু ভেবে দেখা যাক।
...চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন