[ এর আগের পর্ব এই সূত্রে পড়া যাবে - সনাতনীর সন্ধানে ]
আমাদের কলকাতার ছোট্ট বাসা বাড়ির ততোধিক ছোট পরিসরে মায়ের ভান্ডার থেকে হরলিক্স, মাখন এবং বিস্কুট চুরি করে ধরা না পড়াটাই আশ্চর্য ছিল। প্রায় প্রত্যেকবারই ধরা পড়তাম। প্রচুর বকাবকি এবং পিঠের ওপর মায়ের চড়টা চাপড়টা বরাদ্দ থাকত। চড়চাপড় খেয়ে মুখ গোমড়া করে ওঘরে চলে যেতাম আর দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকতাম বিছানায়। এর মানে আমি খুব রেগে গেছি মায়ের ওপর। একটু পরেই মা আসতেন পাশের ঘরে। বিছানার একপাশে বসতেন, পিঠে হাত রাখতেন। আমার রাগ আরো বেড়ে যেত, মায়ের হাত সরিয়ে দিতাম ঝটকা দিয়ে – মা মুখ টিপে হাসতেন, বলতেন –
-‘ইস, ফর্সা পিঠে কেমন লাল লাল
দাগ হয়ে গেছে। খুব লেগেছে না? ছি ছি, এমন ঘুনুসোনাকে কেউ এভাবে মারে’? আমার কণ্ঠ
তখন আবেগে রুদ্ধ, ভীষণ মমতায় মা আমার পিঠে হাত বোলাতেন। রুদ্ধ আবেগ কান্না হয়ে
উঠে আসত, আমি ফুঁপিয়ে উঠতাম, পিঠ ফুলে ফুলে উঠত। মা আবার বলতেন-
–‘কে মেরেছে, বাবা, তোমাকে? কে এত
কষ্ট দিল আমার ঘুনুসোনাকে?’ পিঠ ফিরিয়ে থেকেই শেষ অভিমানটুকু উজাড় করে দিয়ে
কান্নাভাঙা গলায় আমি চেঁচিয়ে উঠতাম –
-‘কে আবার, মা - আমার মা, তুমিই
তো মারলে আমাকে...’। ভারি গলায় মা বললেন-
-‘উঁহু, তাহলে ও তোমার মা নয়, ও
রাক্কুসী। মা এমন মারতেই পারে না ঘুনুসোনাকে...’। নিমেষের মধ্যে সমস্ত রাগ অভিমান
ভুলে যেতাম, আমি লাফিয়ে উঠে বসতাম মায়ের সামনাসামনি, বলতাম-
-‘মোটেও রাক্কুসি নয় - মা। আমার
মা...’। কান্না ভেজা চোখে তাকিয়ে দেখি মায়ের চোখেও জল। বুকের কাছে টেনে নিয়ে মা
বলতেন-
-‘কেন চুরি করিস বলতো? সব তো তোদেরই জন্যে। আমারও এমন রাগ হয়ে যায়...’।
কলকাতায় মায়ের ছোট্ট ভান্ডার পার হয়ে গিয়ে মামাবাড়িতে দিদিমার বৃহত্তর ভান্ডারের সন্ধান দিয়েছিল বন্নিদিদি। সেখানেও বন্নিদিদির পূর্ণসহযোগিতায় চৌর্যবৃত্তির হাতযশ বেড়ে উঠেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু এসবই ছিল নিজস্বাপহারণ - নিজের জিনিষই চুরি করা। কারণ এসব খাদ্যদ্রব্য মা কিংবা দিদিমা আমাদের মনোরঞ্জনের জন্যেই সংগ্রহে রাখতেন। দিদিমার ভান্ডারেও আমাদের চৌর্যবৃত্তি ধরা পড়ে দিদিমার থাবড়ি খেয়েছি অনেক, আর খেদোক্তি শুনেছি বিস্তর – ‘পোড়ারমুখো (আমাকে আর বন্নিদিদির ক্ষেত্রে পোড়ারমুখি), এসব তো তোদের জন্যেই বানানো। তা সে আকাচা কাপড়ে ছোঁয়াছুঁয়ি না করলে চলছিল না’? আচারের বয়াম আকাচা কাপড়ে ছুঁলে, আচার নাকি বিগড়ে যায়।
সে যাই হোক, এইবার ডাক এল পরস্বাপহরণের।
তখনকার দিনে সম্বৎসরে একবারই ধান
হতো। ধান কাটার পর শীতকালে বেবাক নেড়া পড়ে থাকত ধূসর মাঠ কে মাঠ। কেউ কেউ টুকটাক
চাষবাস করতেন সর্ষে, আলু, আখ, মুসুরডাল...। খাপছাড়া সবুজের দেখা মিলত এখানে
সেখানে। দেখবার মতো ছিল – সর্ষের ক্ষেতগুলি - সবুজ পশমিনার ওপর উজ্জ্বল হলুদের
অনবদ্য বুটির কাজ। হিমেল উত্তুরে হাওয়া এসে যখন দোলা দিয়ে যেত সর্ষে ফুলের বৃন্তে
- মুগ্ধ হয়ে দেখা ছাড়া অন্য কোন বর্ণনা আসত না মনে। বড়ো হয়ে সেই বর্ণনা শুনেছি
কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের মন্মোহিনী কণ্ঠে – ‘...আকাশের লাগে ধাঁধা, রোদের আলো ওই যে
বাঁধা। বুঝি ধরার কাছে আপনাকে সে মাগলো – সর্ষে ক্ষেতের ফুল হয়ে তাই জাগলো,
নীলদিগন্তে...’। এমন নিখুঁত রূপকল্প রচনা রবি ঠাকুরের পক্ষেই সম্ভব। যতবার গানটি
কানে আসে চোখের ওপর দুলতে থাকে উজ্জ্বল হলুদের সেই শামিয়ানা...।
আখের ক্ষেত ছিল মাঠে বেশ কয়েকটি। সবচেয়ে নিরাপদ, লোকালয় থেকে নির্জন দূরত্বে একটি আখের ক্ষেত নির্বাচন করে আমরা পাঁচজন রওনা হলাম এক মধ্যদ্বিপ্রহরে। আমরা দুইভাই, মামাতো দুইভাই, আর মামাতো বড়ো দাদার পাড়ার এক বন্ধু। আমাদের মধ্যে মামাতো বড়ো দাদা আর তার বন্ধু সবার বড়ো, আর আমি সবচেয়ে ছোট। আমি আর পিঠোপিঠি মামাতো দাদা হাফপ্যান্ট পড়া আর বাকিরা ডোরাকাটা পায়জামা। জানিনা কেন, এই পায়জামাগুলোকেই গ্রামে সবাই ফুলপ্যান্ট বলত, আর ফুলপ্যান্টকে বলত সুট। দাদারা ছোট ভাঁজ করা ছুরি নিয়েছিল, আমরা হাফপ্যান্টের বাচ্চা বলে আমাদের ছুরি মেলে নি।
ক্ষেত মালিকের নিশ্চয়ই ইচ্ছে ছিল বাড়িতেই আখের গুড় বানিয়ে নেওয়ার। যে গুড়ের থেকে আমাদের এই বঙ্গভূমির একাংশের প্রাচীন যুগেই নাম হয়েছিল গৌড় এবং গৌড়িয় মাধ্বীর সুখ্যাতি পৌঁছেছিল মহাভারতের সুরারসিকদের কাছেও। কিন্তু যেদিন তাঁর অন্তঃসারহীন আখের খেতের সম্যক হদিশ তিনি পেয়েছিলেন, তাঁর অন্তঃকরণে কি অনুভূতি হয়েছিল এবং আমাদের কি পরিমাণ শাপশাপান্ত করেছিলেন - সে চিন্তা করলে আজও মনের ভিতর অস্বস্তি হয় ভীষণ।
সে দিন রাতে ভাত খাবার সময় কোন তরকারিই মুখে রোচে নি - এমন ঝাল। আসলে ঝাল-টাল কিচ্ছু না আমার মুখের ভিতরে যা অবস্থা তাতে সামান্য নুনের স্পর্শেও জ্বলে উঠছিল। কেন এবং কি করে হল - মা ও মাসীমাদের জেরার চোটে আমার জেরবার হাল, অবশেষে বড়মামীমার হস্তক্ষেপে মীমাংসা হল দুধ ভাতের প্রেসক্রিপ্সনে। বন্নিদিদি কিন্তু ছাড়েনি - আমার পেট থেকে কথা বের করে নিয়েছিল সেই রাত্রেই এবং ‘বেশ হয়েছে, খুব ভালো হয়েছে, আর যাবি আমাকে না বলে?’ বলেও, আমাকে অনেকখানি মধু এনে দিয়েছিল লুকিয়ে – আঙুলে করে লাগিয়ে দিয়েছিল গালে আর ঠোঁটের ভিতরে।
এই ঘটনার পরে আমার মতো বাচ্চারা ব্রাত্য হয়ে গেলাম দাদাদের দল থেকে। বাস্তবিক আমার জন্যে প্রায় ধরা পড়ার উপক্রম হচ্ছিল সক্কলের। কিন্তু আমরাও হার মানলাম না। আমাদের আলাদা একটা দল তৈরি হয়ে গেল গোপনে এবং আমাদের প্রথম অ্যাকশন প্ল্যান হল আলুপোড়া খাওয়া। কচুপোড়া ব্যাপারটা তাও শুনেছিলাম – উত্তর কলকাতায় ‘কচু পোড়া খেলে যা’ লব্জটা তখন প্রায়ই শোনা যেত – কিন্তু আলুপোড়া কোনদিন শুনিনি। শোনা তো সামান্য কথা, একেবারে চেখে দেখার সুযোগ আসছে জেনে রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠলাম।
নির্দিষ্ট সময়ে আলাদা আলাদা ভাবে যার যার দায়িত্ব অনুযায়ী জিনিষপত্র নিয়ে আমরা রওনা হলাম। গ্রামের বাইরে একটা জায়গায় আমরা জড়ো হয়ে রওনা হলাম মাঠের দিকে। আমি এতক্ষণ লক্ষ্য করছিলাম কেউ আলু নেয় নি। আসার পথে এত দোকান গেল, সব দোকানেই আলু পাওয়া যায়, সে সব ছেড়ে এই মাঠে আলু নিয়ে কে বসে আছে কে জানে – টেরটি পাবে বাছাধনেরা।
চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা গিয়ে একটা মাঠে সবাই গিয়ে থেমে গেলাম। সে মাঠে আলুর কোন চিহ্ন নেই। গোটা মাঠে আধা সবজে আধা হলদে হয়ে যাওয়া চারাগাছে ভর্তি, আমার হাঁটুর হাইট হবে বড়ো জোর। একটাই বিশেষত্ব নজরে এল - এর মাটিটা। দুপাশে সামান্য নালি কেটে গাছের গোড়াগুলো উঁচু করে ঝুরো ঝুরো মাটিতে ঢাকা।
আমাদের দলের একজন একটা গাছ কে নিষ্ঠুর ভাবে টেনে তুলতেই শেকড়ের সঙ্গে বেরিয়ে এল বেশ একমুঠো আলু – ছোট বড় মাঝারি সাইজের। অবাক কান্ড – তার আগে শিব্রাম চকরবরতির লেখায় পড়েছিলাম, আলু হয় বড় বড় গাছে ...টুসকি দিয়ে খুব সাবধানে আলু পাড়তে হয়...আর এইখানে মাটির ভিতরে সেই আলু?
এহেন অবাক কান্ডে আমি যারপরনাই অভিভূত হলাম এবং আমাদের বাচ্চা দলের সাফল্য সম্পর্কে আমার আর সন্দেহের অবকাশ রইল না। সেই বিকেলে ঘুঁটে ও মাঠের শুকনো আগাছার কাঠকুটো জোগাড় করে আলু পোড়া বানানো হল। আধপোড়া, ঝামাপোড়া, আধকাঁচা, দরকচা আলুই ক্যাঁচক্যাঁচ করে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আমরা যখন ফেরার পথ ধরলাম, সূর্য তখন পাটে বসার আগে একটু থমকে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন - এই ছোঁড়াগুলো ফাঁকা মাঠে করছেটা কি?
আমাদের নিরাপদ ও সাকসেসফুল মেডেন মিশন আমাদের সাহস ও আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিল।
আমরা যখন বাড়ি পৌঁছলাম, বন্নিদিদি সদর দরজায় সন্ধ্যার প্রদীপ দেখাচ্ছিল। চালধোয়ার ধুচুনির মধ্যে প্রদীপ, তার অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে প্রদীপের বহুধা আলো ঠিকরে পড়ছে চারদিকে। কি একটা মন্ত্র পড়ছিল বিড়বিড় করে, মুখে কথা না বলে ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করল ‘কোন চুলোয় যাওয়া হয়েছিল শুনি’? আমি বললাম ‘এই তো বেড়াতে’। বন্নিদিদি তুলসীতলায় প্রদীপটা নামিয়ে মাথা নীচু করে নমস্কার করল তিনবার। আমি প্যান্টের পকেট থেকে দুটো আলুপোড়া বন্নিদিদির দিকে বাড়িয়ে দিতে, বন্নিদিদি বলল, ‘দাঁড়া, দাঁড়া, তোর আকাচা কাপড়, ছুঁয়ে দিস না। আলুপোড়া কোথায় পেলি? মাঠে আলু চুরি করতে গিয়েছিলি? সেদিন আখ চুরি, আজ আলু - কি শুরু করেছিস? তুই এই গ্রামের ছেলে নোস - কলকাতায় থাকিস। ভালো স্কুলে পড়িস। নপিসিমা-পিসেমশাই তোকে এইসব করার জন্যে এখানে নিয়ে এসেছে? তোর এই কাজের জন্যে তোর বাবা-মাকে কেউ যদি পাঁচকথা শোনায় - তোর ভাল লাগবে তো’?
সেই সন্ধ্যায় তুলসীমঞ্চের সামনে,
মুখের ওপর খেলা করা প্রদীপের স্নিগ্ধ আলোয় - বন্নিদিদির কথাগুলো আমাকে এমন এক
সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল যার ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। আজ পর্যন্ত জীবনের
প্রত্যেকটি বেপথু মুহূর্তে, দীপের সীমিত আলোয় বন্নিদিদির দীপ্ত মুখের সেই কথাগুলি
সঠিক পথের দিশারী হয়ে আমার কাছে ফিরে এসেছে বারবার।
-০০-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন