১
উত্তর কলকাতার এই পাড়াতে সব বাড়িই
একশ-দেড়শ বছরের পুরোনো। অধিকাংশ বাড়িগুলোরই ওপরতলায় বাড়িওয়ালা নিজে থাকেন। নিচের
ঘরগুলোতে ভাড়াটে। ভাড়াটেরা অর্থ কৌলীন্য অনুযায়ী একঘর, দুঘর নিয়ে ভাড়া থাকে।
এজমালির পাইখানা, চানের ঘর। বারন্দায় তোলা উনুনে রান্না। টাইম কলে দিনে তিনবার জল
আসে। সেসময় জলের ভাগ নিয়ে ভাড়াটেদের মধ্যে নিত্য আকচাআকচি। ভাড়াটে মানেই যেন চালচুলোহীন,
গাঁঞি-গোত্রহীন কিছু মানুষ। এদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা উচিৎ নয়, মাসের শুরুতে
ভাড়ার টাকাটা হাতে এলে সংসারের কিছুটা সুসার হয় বলেই, বাধ্য হয়ে ভাড়াটে বসানো।
বনেদি উত্তর কলকাতার বাড়িওয়ালাদের মুখের উচ্চারণেও এই তাচ্ছিল্য ভাবটা বেশ বোঝা
যায়, “ভাড়াট্যে”। তাঁদের এই কথাতেই বোঝা যায় এক পাড়া এবং এক বাড়িতে থাকলেও ভাড়াটে
আর বাড়িওয়ালার সামাজিক অবস্থানে আসমান –জমিন ফারাক!
“ভাড়াট্যে” বসা এই বাড়িগুলির নিয়মিত
মেরামতি হয় বলে অবস্থা কিছুটা ভালই। কিছু বাড়ি আছে যাদের বহুদিন মেরামতি হয় না,
হানাবাড়ির দশা, সেই বাড়িগুলি মেস। গ্রাম –মফস্বল থেকে আসা মেসের বোর্ডাররা এই
বাড়িগুলিতে থাকে। শনি-রবিবার অথবা
ছুটির দিনগুলিতে ফাঁকা থাকলেও, সপ্তাহের অন্যদিনগুলিতে মেস বাড়িগুলোতে বেশ
চেঁচামেচি আর হৈচৈ শোনা যায়। মেসের ছোকরা চাকর, তাদের নাম কার্তিক, অথবা শ্যামল,
কিংবা ভোলা বা পচা। সন্ধেবেলা অফিস ফেরা বাবুদের বারবার হাঁক শোনা যায়।
“অ্যাই, ভোলা আমার ঘরে দুটো চা দিয়ে যা”। “কেতো, তোকে যে বললাম, ধনেরচাল
দেওয়া দুটো পান আনতে”! “অ্যাই হারামজাদা শ্যামলা, এক প্যাকেট কাঁচি আনতে কতবার
বললাম, কথা কানে যাচ্ছে না, নাকি?” তাদের উচ্চস্বরের উওরও শোনা যায়, “এই যাচ্ছি,
বাবু”।
অচ্যুত যে বাড়ির একতলায়, বাসা নিয়েছে, সেটার ওপর
তলাতেও ভাড়াটেই থাকে - বাড়িওয়ালা নয়। বাড়িওয়ালা থাকে এখান থেকে সামান্য দূরে অন্য
বাড়িতে। বাড়িওয়ালা নিজে ডাক্তার, বেশ বড়োলোক, নিজের গাড়ি আছে! বাড়িতে ফোন আছে!
তিনি কেন ভাড়াটেদের সঙ্গে থাকতে যাবেন? একবাড়িতে দুটো মাত্র ভাড়াটে পরিবার, সেদিক
থেকে ঝুট-ঝামেলা বেশ কম। যদিও উপরের ভাড়াটেরা বাঙাল! খাইসে বলে, ইসে বলে। এ পাড়ায়
ভাড়াটেদের মধ্যে আরো কয়েকটি বাঙাল পরিবার আছে। পাড়ায় সকলের সঙ্গে সকলের মেলামেশা,
আলাপ-পরিচয় আছে, কিন্তু তার মধ্যেও আছে অদ্ভূত কিছু গণ্ডি! ভাড়া না দেওয়া স্বচ্ছল
ঘটি বাড়িওয়ালা এবং ভাড়া দেওয়া হীনমন্য ঘটি বাড়িওয়ালা। দেশের গ্রামে জমিভিটেওয়ালা
ঘটি ভাড়াটে। শিকড় ছিঁড়ে আসা উদ্বাস্তু বাঙাল ভাড়াটে। প্রত্যেকের মনে মনে আর্থ
সামাজিক সূক্ষ্ম পর্দার একটা আড়াল রয়েই গেছে, যদিও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে সকলেই একে
অপরের পরিপূরক!
এসব সত্ত্বেও গ্রাম থেকে সদ্য আসা নতুন পাতা
সংসারের পক্ষে পাড়াটা মন্দ নয়, ভালোই। এখান থেকে পায়ে হাঁটা পথে অজস্র
স্কুল, কলেজ। মেডিক্যাল কলেজ, ইউনিভার্সিটি। শেয়ালদা স্টেশনও পায়ে হাঁটা দূরত্বে।
ট্রামে চড়লে হাওড়া স্টেশন পৌঁছোতে মিনিট কুড়ি লাগে। অচ্যুতের কলকাতার এই বাসায়
দুটো ঘর, আর ছোট্ট একটা রান্নার জায়গা। দক্ষিণে রাস্তার দিকে লম্বা বারান্দায় কোমর
ভর পাঁচিলের ওপর লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। স্নানঘর, পাইখানা একতলাতেই, ওপরের ভাড়াটের
সঙ্গে ভাগাভাগি। এই বাড়ির বাইরের দিকে আরেকটা ঘর আছে। সে ঘরের লাগোয়া পানের
দোকান। সেটা ভাড়া নিয়েছে শম্ভুচরণ, সেই পানের দোকানটা চালায়। দোকানের পিছনের ছোট্ট
ঘরটাতে সন্ধের পর বসে তাসের আড্ডা। একটু কান পাতলে তখন শোনা যায় “টু ক্লাব্স্”, “থ্রি
হার্ট্স্”-এর ডাক। সকাল আট-সাড়ে আটটা থেকে
বেলা দেড়টা কি দুটো, আবার বিকেল পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা অব্দি পানের দোকান খোলা
থাকে। শম্ভুদার দোকান খোলার সময় থেকে, রেডিও চলতে থাকে নিরন্তর। ভেসে আসে বাংলা গান,
হিন্দি গান। অনুরোধের আসর, রম্যগীতি, ভুলে বিসরে গীত...। দোকানে কত
লোকের যে আনাগোনা। কেউ পান-বিড়ি-সিগারেট কিনে চলে যায়। কেউ কেউ পান মুখে নিয়ে
সিগারেট টানতে টানতে, ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেয়। রাজনীতি, খেলাধুলো, সিনেমার
আলোচনা আর রেডিওর গানে, প্রায় সারাদিন জমজমাট পানের দোকান।
বেলা সাড়ে নটায় ভাত খেয়ে অচ্যুত অফিসে
বেরোনোর পর, সোনা পান্নাকে কোলে নিয়ে, হীরুকে পড়াতে বসেন। দিন পনের পর স্কুলের
অ্যাডমিশান টেস্ট। “অ্যাডমিশন”, “টেস্ট” এই শব্দগুলো সোনার কাছে একদম আনকোরা। দাদু
কিংবা জ্যাঠামশাই অথবা বাবা, কেউ গিয়ে হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে, ছেলে-মেয়েকে
ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে এলেই, ছেলে মেয়েদের স্কুল শুরু হয়ে যায়, এমনই তিনি দেখেছেন
বাপেরবাড়ি কিংবা শ্বশুরবাড়ির গ্রামে। বিশাল এই শহরের নিয়ম তেমন নয়। তিরিশজন ছেলে
নেবে, অ্যাডমিশন টেস্ট দেবে অন্ততঃ তিনশ জন। যে স্কুলের যত নাম, তত বেশি
কম্পিটিশান। এই “কম্পিটিশন” কথাটাও তাঁর কাছে নতুন। হীরুর ষোলো ঘর অব্দি মোটামুটি
মুখস্থ হয়েছে, কিন্তু সতের, আঠের আর ঊণিশের ঘরের নামতা প্রায় কিছুই পারছে না।
এরপরে আছে চার সংখ্যার যোগ। তিনসংখ্যার বিয়োগ। গুণ, ভাগ। এরপর আছে ভার্বের
প্রেজেন্ট, পাস্ট, পাস্টপারফেক্ট টেন্স্-এর চার্ট – গো ওয়েন্ট গন, ডু ডিড ডান,
রিড রেড রেড, টিচ টট টট। বাংলা বানান, বিভীষিকা, মুমূর্ষু, বিজীগিষা...। সোনা নিজেও
মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলেন, এইটুকু ছোট ছেলের পক্ষে এত কিছু মনে রাখা সম্ভব? আর
এখনই যদি সব শিখে ফেলে, তাহলে অ্যাডমিশন পাওয়ার পর স্কুলে কী পড়বে?
২
বঙ্কিম চাটুজ্জ্যে স্ট্রিটে
পাশাপাশি দুটো সরকারি স্কুলেরই খুব সুনাম। হিন্দুস্কুল আর সংস্কৃত স্কুল। তাদের
ঘিরে চারপাশেই বইয়ের দোকান, পরিবেশও ভালো। অচ্যুত ছেলে হীরুকে সঙ্গে নিয়ে এক
রোববার দুটো স্কুলেই নিয়ে গেছিলেন। তাঁদের বাসা থেকে স্কুলদুটো খুব দূরে নয়, পায়ে
হাঁটা পথে মিনিট দশেকের দূরত্ব। সেদিন রোববার, তাই স্কুলের ভেতরে
ঢুকতে পারেননি, কিন্তু স্কুলের উঠোন থেকে থেকে ঘাড় উঁচু করে স্কুলের বাড়ি দেখে
হীরু অবাক হয়েছিল খুব। এত্তো বড়ো বাড়ি! কত্তো জানালা, দরজা, লম্বা টানা বারান্দা,
সারি সারি ঘর। এইসব স্কুলে কতো ছেলে পড়ে?
গ্রামের একতলা বাড়ির ছোট্ট স্কুলে
দিন কয়েক যাওয়ার অভিজ্ঞতার সঙ্গে এই স্কুলকে কিছুতেই মেলাতে পারছিল না হীরু।
স্কুলের সামনে কোন মাঠ নেই। শান বাঁধানো উঠোনের ধারে ধারে কিছু গাছপালা আছে,
কিন্তু সে কেমন যেন সাজানো গোছানো। সোজা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সব গাছ। সে গাছের
ডালে ঝুলে দোল খাওয়া যাবে না, যেমন দোল খাওয়া যেত তাদের গ্রামের বটের ঝুড়ি ধরে,
কিংবা আম বা তেঁতুলের ডাল ধরে। স্কুলে জলখাবারের কিংবা ছুটির ঘন্টা পড়লে, ছেলেরা
ক্লাস ছেড়ে দৌড়ে মাঠে যাবে না? দৌড়োদৌড়ি করে খেলবে কোথায়?
হীরুর অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে
অচ্যুত খুব তৃপ্তি পান, পথ চলতে চলতে তিনি বলতে থাকেন, এই স্কুল থেকে পাশ করা অনেক
ছেলে বড়ো হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে...। হীরু শুনছে, কিন্তু সবটুকু তার
চেতনায় ঢুকছে না...তার নিজের গ্রাম, মামারবাড়ির গ্রাম, আর এই কিছুদিন আগে আসা
অদ্ভূত অচেনা এই শহর, এর বাইরে দেশ আবার কী বস্তু? সেটা কী এর থেকেও বড়ো কিছু? তার
মুখটা কেমন? তাদের বাসায় সে দেখেছে, কালো কালো গোল সুইচ, যার তলার দিকটা সাদা।
সুইচ টিপলেই আলো জ্বলে ওঠে, ঘর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে এই স্কুলে
পড়তে হবে কেন? দেশের কী বিজলি বাতি নেই? নাকি সুইচ নেই?
স্কুল দেখা হয়ে গেলে, অচ্যুত
ছেলেকে নিয়ে বাঁদিকে কলেজ স্ট্রিটের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “ওই দ্যাখ,
রাস্তার ওপারে প্রেসিডেন্সি কলেজ, আর ওইটা হল হেয়ার স্কুল। ডেভিড হেয়ার বলে একজন
সায়েব ছিলেন, তার কথা তোকে বাড়ি গিয়ে বলবো। ওই দ্যাখ, সেই হেয়ার সায়েবের মূর্তি।
ওই হেয়ার সায়েবই এই স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কত বিখ্যাত বিখ্যাত
মনীষীরা এই স্কুল থেকে আর ওই কলেজ থেকে লেখাপড়া করেছেন তার আর শেষ নেই”।
হীরু জিজ্ঞাসা করল, “মনীষী মানে?”
“মনীষী মানে...খুব বিদ্বান,
লেখাপড়া জানা মানুষ। তবে শুধু লেখাপড়া জানলেই মনীষী হয় না – সেই মানুষকে দেশের
ও দশের মঙ্গলের জন্যে কাজ করতে হয়। তবেই তাঁরা মনীষী হন। এই স্কুলে পড়তে হবে, হীরু। বড়ো হয়ে তোকেও ওই রকম
বিরাট মানুষ হতে হবে। লোকে দেখে বলবে, হ্যাঁ হীরু, সত্যিই হীরের টুকরো”।
হেয়ার স্কুলের উল্টোদিকের গেট
দিয়ে কলেজ স্কোয়ারে ঢুকলেন। জলের ধারে বুকভর লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। পার্কের
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অচ্যুত কলকাতা ইউনিভার্সিটির গুরুগম্ভীর বিশাল প্রাসাদ
দেখিয়ে বললেন, “স্কুল দেখলি, ওই প্রেসিডেন্সি কলেজ দেখলি আর এই হচ্ছে কলকাতা
ইউনিভার্সিটি। দেশের মধ্যে অন্যতম সেরা লেখাপড়ার জায়গা”।
কিছুটা হেঁটে যাওয়ার পর হীরু
দেখল, বড়ো একটা চত্বরে সাদা পাথরে বানানো একটি বসে থাকা মূর্তি। রেলিং ঘিরে সুন্দর
করে সাজানো। মূর্তিটি দেখিয়ে অচ্যুত পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, “চিনতে পারছিস? কে
বলতো?”
“বিদ্যাসাগর। বর্ণপরিচয়ে ছবি
দেখেছি”।
“গুড, ঠিক বলেছিস। ছোটদের জন্যে বর্ণপরিচয়
লিখেছেন, কিন্তু ওঁর মতো পণ্ডিত দেশে আর তেমন খুব একটা নেই। দেশের জন্যে, কত যে
বড়ো বড়ো কাজ করে গেছেন, সে সব বড়ো হয়ে জানতে পারবি। নমস্কার কর”। হীরুর সঙ্গে
অচ্যুত নিজেও জোড়হাতে নমস্কার করলেন। কথা বলতে বলতে জলের ধারের রাস্তা দিয়ে আরো
এগিয়ে গেলেন। গাছপালার আড়ালে আরেকটি দাঁড়ানো মূর্তি। মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
“এঁনাকে এখন চিনবি না, আরেকটু বড়ো হয়ে চিনবি। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। খুব বড়ো
বিজ্ঞানী ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছেন, কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন,
পড়িয়েছেন। ওঁদের মতো হতে হবে – অন্ততঃ চেষ্টা তো করতে হবে! নমস্কার কর”।
আরেকটু এগিয়ে ছোট্ট গেট দিয়ে
বেরিয়ে, কলেজস্কোয়ারের বাইরে এলেন অচ্যুত। সামনে মির্জাপুর স্ট্রিট। ওপারে
পুঁটিরামের মিষ্টির দোকান। ঠিক কোনায় ইস্ট বেঙ্গল এম্পোরিয়াম, কাপড়ের দোকান।
রাস্তা পার হয়ে, মির্জাপুর আর
কলেজস্ট্রীটের মোড় থেকে সোজা দক্ষিণে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “ওপারে ওই দ্যাখ, উঁচু
পাঁচিল ঘেরা ওই লাল রঙের বাড়িগুলো? ওটা মেডিকেল কলেজ। আমাদের দেশের প্রথম
মেডিকেল কলেজ। ওখানে ডাক্তারি পড়ানো হয়। খুব ভালো ভালো ছেলেরা ওখানে ডাক্তারি পড়ার
সুযোগ পায়। এখান থেকে পাশ করে তারা ডাক্তার হয়। সাধারণ মানুষ ডাক্তারকে ভগবান মনে
করে। অসুস্থ মানুষেরা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভরসা পায়। আমার স্বপ্ন তুইও ওই কলেজে পড়বি, বড়ো
ডাক্তার হবি। পারবি না? ঘাড়ে স্টেথিস্কোপ দুলিয়ে গটমট করে হেঁটে যাবি হাসপাতালের লম্বা
বারান্দা ধরে। গায়ে থাকবে
ধবধবে সাদা অ্যাপ্রন। রোগীর আত্মীয়-পরিজনেরা তোকে ঘিরে ধরবে, উৎকণ্ঠায় জিজ্ঞাসা
করবে, “ডাক্তারবাবু, রুগী সেরে উঠবে তো?” তুই তাদের আশ্বাস দিবি, ভারিক্কি গলায়
বলবি “ভাববেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে”“। নিজের
কল্পনার আনন্দে অচ্যুত নিজেই হাসতে হাসতে হীরুর মুখের দিকে তাকালেন। হীরু বাবার
সবকথা ঠিকঠাক না বুঝলেও, তার মধ্যে সঞ্চারিত হতে লাগল বাবার স্বপ্ন আর আবেগ।
অজস্র
কলপাইপ আর স্যানিটারি দোকান, আরপুলি লেনের মোড় পার হয়ে, প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের
মোড়ে এসে থামলেন, অচ্যুত। ছেলেকে বললেন, “ওপারে দেখ, সেই কোথায় শুরু হয়েছিল, আর এইখানে
ওই মেডিকেলের পাঁচিল শেষ হল। কত্তো বড়ো কলেজ দেখলি? এখানে ডাক্তারি পড়াও হয় আবার রুগীদের
চিকিৎসাও হয়। এখানে কিন্তু তোকে ঢুকতেই হবে, হীরু। তার জন্যে খুব মন দিয়ে পড়াশুনো
করতে হবে। চল, ওপারে অঞ্জনদার চেম্বারে যাই। উনিও ডাক্তার, ডাক্তার অঞ্জন সামন্ত,
এমবি। আমাদের
পাশের গাঁয়ের লোক। আমার থেকে বছর চার-পাঁচের বড়ো। জ্যাঠামশাই বলবি, কেমন?
জ্যাঠামশাই বললাম বলে হুট করে প্রণাম করতে যাস না যেন। ওরা আগুড়ি, আর আমরা বামুন”।
এপারে প্রেমচাঁদ
বড়াল স্ট্রিটের ঠিক কোনায় শিবমন্দির আর কলেজস্ট্রিট পার হয়ে, উল্টোদিকেই “বাঙালী
পাঁঠার দোকান”। দোকানের
মধ্যে মা কালীর প্রতিমা। তার দুটো তিনটে দোকান পরে আরোগ্য ফার্মেসি। কাঠের পাল্লা
ঠেলে ভেতরে ঢুকেই দুপাশে কাঠের বেঞ্চ।
বেঞ্চে দুজন বসে আছে, চেহারা দেখেই বোঝা যায়, তারা অসুস্থ। তার ওপাশে ওষুধের
আলমারি। অন্যপাশে
টেবিলের ওধারে চেয়ারে ডাক্তারবাবু বসে রয়েছেন। তাঁর চেয়ারের পেছনে পর্দা ঝোলানো
একটা ঘর। তাঁর পাশের চেয়ারে বসে আছে আরো একজন রোগী। ডাক্তারবাবু কানে স্টেথোস্কোপ
লাগিয়ে তার বুক পিঠ পরীক্ষা করতে করতে, দুবার বললেন, “নিঃশ্বাস, জোরে জোরে”। লোকটি জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল।
অচ্যুতকে দেখে ডাক্তারবাবু চোখ আর হাতের ইশারায় বললেন, বসো। বুকপিঠ দেখা হয়ে গেলে,
ডাক্তারবাবু গলার কাছে টিপে ধরে বললেন, “হাঁ করুন, অ্যা...”। ডাক্তারবাবুর দেখানো
মতো লোকটি জিভ বের করে “অ্যা...” করল। তারপর ডাক্তারবাবু লোকটির দু চোখের তলায় টান
দিয়ে দেখলেন, তারপর ঘুরে বসে হাতে পেন নিয়ে কাগজে খসখস করে লিখতে লিখতে জিজ্ঞাসা করলেন,
“সকাল থেকে কবার বমি হয়েছে?”
“আজ্ঞে
তিনবার, যা খাচ্ছি সবই বেরিয়ে যাচ্ছে। মাথায় যন্ত্রণা। কাশি হচ্ছে খুব”।
“পায়খানা
পরিষ্কার হয়েছে?”
“আজ্ঞে
না, বারবার বেগ আসছে, কিন্তু পুরো হচ্ছে না”।
“হুঁ।
নিতাই!” ডাক্তারবাবুর ডাক শুনে, পিছনের পর্দা সরিয়ে একজন লোক বেরিয়ে এল,
ডাক্তারবাবুর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে আবার চলে গেল পর্দার আড়ালে। ডাক্তারবাবু চেয়ারে
বসা রোগীকে বললেন, “যান, একটু অপেক্ষা করুন। নিতাই ওষুধ বানিয়ে, সব বুঝিয়ে দেবে।
তারপর কী খবর তোমার অচ্যুত? এটি কে, পুত্র? ভেরি গুড। কী নাম রে, তোর?”
অচ্যুত
ছেলেকে বললেন, “নাম বলো, জ্যাঠামশাইকে”।
“আজ্ঞে
হীরকরঞ্জন মুখার্জি” হীরু বলল, তার উত্তরের পর অচ্যুত একগাল হেসে বললেন, “বাড়িতে
আমরা হীরু বলে ডাকি”।
ডাক্তারবাবুও
একটু হাসলেন, ভুরু নাচিয়ে বললেন, “কলকাতা কেমন লাগছে রে, হীরু?” তারপর হীরুর
উত্তরের প্রতীক্ষা না করে অচ্যুতকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাসা গুছিয়ে ফেলেছো? একদিন
যাবো তোমার বাসা দেখতে, গোপাল মল্লিকের গলিতে তো?”
“আজ্ঞে
হ্যাঁ, দাদা। সময় করে একদিন এসে নিয়ে যাবো আপনাকে, আরেকটু গুছিয়ে নিই”।
“বেশ,
বেশ সেই ভালো। আর এদিকের কী খবর? ছেলেকে কোন স্কুলে ভর্তি করাচ্ছো”?
“দেখি। কোথায়
চান্স পায়। হিন্দু, সংস্কৃত, হেয়ার...”।
“খুব
শক্ত হে। শুনেছি ছেলেপুলেদের একেবারে নিংড়ে নেয়। যদি না পারে, একটা বছর নষ্ট হবে।
ও ছাড়াও অন্য দু একটা স্কুলেও চেষ্টা রেখো”।
“তা ঠিক”।
নিতাই
নামের লোকটি পর্দা সরিয়ে বের হয়ে এল, তার হাতে কাচের চ্যাপ্টা বোতল, গোলাপীরঙের
ওষুধ ভরা। তার গায়ে সাদা কাগজের খাঁজকাটা শেকল চিপকানো। বেঞ্চে বসে থাকা রোগীকে
ডেকে ওষুধ বুঝিয়ে দিল।
খাঁজকাটা শেকলের খাঁজে খাঁজে আঙুল রেখে সে বলল, “একদাগ সকালে, একদাগ দুপুরে আর
একদাগ রাত্রে, খাবার পর। সঙ্গে দিল কয়েকটা কাগজের পুরিয়া। দুপুরে একটা, রাত্রে
একটা। সামান্য খাবার জলে গুলে, ঢুক করে খেয়ে নিতে হবে। তিনদিন চলুক। তারপর কেমন
থাকেন জানাবেন। চারটাকা চল্লিশ পয়সা”। লোকটি
টাকাপয়সা গুনে দিয়ে, ওষুধ নিয়ে বেরিয়ে গেল দোকান থেকে। নিতাই পরের রোগীকে ডাকল, “পরাণ
মণ্ডল”। বেঞ্চ থেকে উঠে পরাণ ডাক্তারবাবুর পাশের চেয়ারে বসল। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা
করলেন, “কোথায় কষ্ট?”
অচ্যুত
উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি এখন তবে আসি দাদা, আপনি ব্যস্ত রয়েছেন”।
“ঠিক
আছে। মাঝে মাঝে এসো হে সময় করে, দেশ ঘরের গল্প করা যাবে!”
“আসবো
দাদা, নিশ্চয়ই আসবো”।
৩
“সব
দেখিয়ে আনলাম, জানো?” ঘরে ঢুকে গায়ের জামা ছাড়তে ছাড়তে অচ্যুত স্ত্রীকে বললেন। সোনা
ছেলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী সব দেখিয়ে আনলে, ছেলেকে?”
“ওদের
স্কুল, মেডিকেল কলেজ। কলকাতা ইউনিভার্সিটি। কলেজ স্কোয়ার। অঞ্জন ডাক্তারের চেম্বার”।
“ডাক্তারের
চেম্বার কেন?” সোনা অবাক হলেন, কিছুটা ভয়ও পেলেন।
“ওই যে
গো, তোমায় বলেছিলাম না, আমাদের পাশের গ্রামের অঞ্জনদা ডাক্তার। তার চেম্বার আছে
বউবাজারের কাছে। তার সঙ্গে দেখা করে এলাম একবার। হীরুর স্বচক্ষে একজন ডাক্তার দেখা
হল”।
“ডাক্তার
ডাক্তার করে অত উতলা হয়ো না তো? ওসব এখন ঢের দেরি। আগে তো স্কুলে ভর্তি হোক”।
“সে হোক
না, কিন্তু লক্ষ্যটা ঠিক করতে না পারলে সবটাই বৃথা। সেই পাখির চোখের মতো!”
“পাখির
চোখ কী, বাবা?”
হীরু
বাবার গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করল। অচ্যুত ছেলের পিঠে হাত রেখে আরো কাছে টেনে
নিয়ে বললেন, “এ সব হচ্ছে, মহাভারতের কথা। আচার্য দ্রোণ, হস্তিনাপুরের সব রাজপুত্রদের
অস্ত্রবিদ্যা শেখাতেন। অস্ত্রবিদ্যা মানে তির ছোঁড়া, তলোয়ার চালিয়ে যুদ্ধ করা এই
সব আর কি। সবাই শিখছে। বেশ কিছুদিন শেখার পর, একদিন গুরু দ্রোণাচার্য ঠিক করলেন,
তাঁর সব শিষ্যদের পরীক্ষা নেবেন। করলেন কী, বড়ো একটা গাছের অনেক উঁচু ডালে মাটির
একটা পাখি রেখে দিয়ে বললেন, ওটাকে তির দিয়ে বিঁধতে হবে। এক এক করে সবাইকে ডাকলেন,
বললেন মাটির ওই পাখিকে তিরে বিঁধতে হবে। তোমরা সবাই মনঃসংযোগ করো”।
“মনঃসংযোগ
মানে?” হীরু জিজ্ঞাসা করল।
অচ্যুত বললেন,
“মনঃসংযোগ মানে, ইয়ে...খুব মন দেওয়া...খুব মন দিয়ে কোন একটা কাজ করা। মনঃসংযোগ না
হলে কোন কাজই ঠিকঠাক করা যায় না। গুরু দ্রোণাচার্য বললেন, তোমরা মনঃসংযোগ করো,
তারপর তোমরা কে কী দেখছো বলো। কেউ বলল, পাখিতো দেখছিই, কিন্তু তার সঙ্গে আপনাকে
দেখছি। আমাদের সব ভাইদের দেখছি। আকাশ দেখছি, গাছপালা দেখছি। গাছের ডালপালা দেখছি,
পাতা দেখছি। তাদের উত্তরে দ্রোণাচার্য খুশি হলেন না। সবার শেষে এলেন অর্জুন। তাঁকে
গুরু দ্রোণাচার্য জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী দেখছো, অর্জুন? অর্জুন বললেন, পাখির চোখ
ছাড়া আর কিচ্ছু দেখছি না, গুরুদেব! দ্রোণাচার্য বললেন, সে কি? আর কিচ্ছু দেখতে
পাচ্ছো না? অর্জুন বললেন, আজ্ঞে না, গুরুদেব, কই আর তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
দ্রোণাচার্য বললেন, মাটির ওই পাখিটিকে তির মেরে নামিয়ে আনতে পারো? তাঁর কথা শেষ
হবার আগেই মাটির পাখিটি মাটিতে এসে পড়ল, তার চোখে বিঁধে আছে অর্জুনের তির।
দ্রোণাচার্য আনন্দে শিষ্য অর্জুনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তুমিই আমার শিক্ষাকে
সম্পূর্ণ করেছো, অর্জুন। সেই জন্যেই বলছিলাম, আসল কথাটা হচ্ছে লক্ষ্য - পাখির চোখ। প্রথম দিন থেকেই লক্ষ্য যদি স্থির
না করা যায়, পুরো কাজটাই এলোমেলো হয়ে যায়”।
এতক্ষণ
বাপ আর ছেলের কথা শুনছিলেন সোনা। তাঁর কোলে শুয়ে পান্নাও চুপ করে বাবা আর দাদার
কথা শুনছিল। ছেলেটা কী বোঝে কে জানে, কিন্তু চুপ করে সব কিছু শোনে। সোনা কোলে ছেলেকে নাচাতে নাচাতে
বললেন, “স্কুলটা কেমন দেখলি, হীরু? ভালো? তোদের সেই গাঁয়ের স্কুলের থেকে ভালো?”
হীরু এতক্ষণ বাবার উপদেশের চাপে কিছুটা ক্লান্তি অনুভব করছিল, এখন মায়ের প্রশ্নে
ভীষণ উত্তেজিত হয়ে, দু হাত ছড়িয়ে বলল, “বিরাআআআট স্কুলগো, মা। কত্তো ঘর। কত্তো লম্বা বারান্দা!
এক...দুই...তিন...চার তলা বাড়ি”। আঙুলের কড়গুণে সে তলার হিসেব দিল মাকে, বলল, “এই
এত্তো চওড়া সিঁড়ি। বারান্দার একধারে ধাপি বানানো, তার ওপর খাবার জলের কল। পরপর কত্তোগুলো
কল! ওমা, ছেলেরা কী সারাদিন জলই খায়, নাকি? তাহলে পড়ে কখন?”
সোনা
স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে হীরুর কথা শুনছিলেন, এখন হেসে ফেললেন, বললেন, “ভালো লাগল,
স্কুলটা?” বড়ো করে সম্মতির ঘাড় নাড়ল হীরু, তারপর বলল, “জানো তো মা, একজন লোক স্কুলের
উঠোনে বসে পেতলের ঘটি মাজছিল, তার এত্তোবড়ো ভুঁড়ি। আমাকে দেখে বলল, কী দেখছো খোখা?
খোখা কী মা?”
সোনা
একটু অবাক হলেন, অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে গো?”
“স্কুলের
দারোয়ান-টারোয়ান হবে, স্কুলের ভেতরেই ওরা থাকে তো। খোখা মানে খোকা, হিন্দুস্থানী তো,
ওরা ওইরকমই উচ্চারণ করে”। সোনা কিছুটা
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাবা, স্কুলে দারোয়ান আছে?”
“বা রে,
থাকবে না? অতবড়ো স্কুল। একজন নাকি, অনেক দারোয়ান আছে। তা নাহলে এতো ছেলেদের
সামলাবে কী করে? ওদের কত কাজ জানো? স্কুলের ঘন্টা দেওয়া, স্কুলের গেট সামলানো। আরো
কত কী!”
সোনা
ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যারে, তোর স্কুল পছন্দ হয়েছে?” বিশাল ঘাড় হেলিয়ে হীরু
বলল।
“হ্যাঁ”।
“ওই
স্কুলেই পড়বি?”
“হ্যাঁ”।
“খুব
শক্ত হবে নিশ্চয়ই, ভর্তি হতে পারবি?” মায়ের চোখে চোখ রেখে হীরু বলল, “পারবো, মা।”
তারপর মায়ের কাছে সরে গিয়ে ভাইয়ের পেটে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলল, “পান্নাও ওই স্কুলে
পড়বে, মা?”
সোনা
পান্নার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী রে, দাদার সঙ্গে একসঙ্গে স্কুলে
যাবি?” মায়ের কোলে শুয়ে থাকা পান্না কি বুঝলো কে জানে? দাদার সুড়সুড়ি আর মায়ের
কথায় হেসে উঠল কলকল করে।
অচ্যুত
মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তাঁর এই ছোট্ট পরিবারের দিকে। তাঁর দুচোখে এখন
স্বপ্ন, তাঁর স্থির লক্ষ্য এখন পাখির নির্দিষ্ট চোখে।
[এর আগের পর্ব - "বিদায় বেলার মালাখানি" - এই সূত্রে পড়া যাবে - বিদায়বেলার মালাখানি ]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন