শুক্রবার, ২২ আগস্ট, ২০২৫

ধর্মাধর্ম - ১/৩

 

[এর আগের পর্ব পড়তে  হলে এই সুত্রে প্রবেশ করুন - ধর্মাধর্ম - ১/২]


প্রথম পর্ব (৭০,০০০ বিসিই থেকে ১২,০০০ বিসিই) - ৩য় পর্বাংশ

১.২.৩ আগুনই সভ্যতার মূল অনুঘটক

নৃতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, আদিম হোমো স্যাপিয়েন্স থেকে আধুনিক সভ্য মানুষ হয়ে ওঠার মূল অনুঘটক হল রান্নাতে আগুনের ব্যবহার। এ কথার তাৎপর্য স্পষ্ট হবে নিচের বিষয়গুলিতে নজর দিলে। 

ক. ভয়কে জয় ও আত্মবিশ্বাস

আগেই বলেছি কয়েক লক্ষ বছর ধরে ইরেক্টাস এবং নিয়াণ্ডারথাল প্রজাতির মানবেরা এবং আদিম মানুষেরাও আগুনের তিনটে ব্যবহার জানত। আলো, উত্তাপ আর রাতের অন্ধকারে হিংস্র পশুদের দূরে রাখা। আগুনের আলোয় রাতের অন্ধকার আর নিশ্ছিদ্র রহস্যময় এবং ভয়ংকর রইল না। জনসংখ্যা বেড়ে ওঠার সঙ্গে তাল রেখে যেহেতু প্রাকৃতিক গুহার সংখ্যা বেড়ে ওঠা সম্ভব নয়। অতএব পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা গুহার বাইরে, খোলা আকাশের নিচে ডালপালার কাঠামো আর পাতার ছাউনি বানিয়ে – সেটাকেই নিরাপদ আশ্রয় বানিয়ে তুলতে শিখে ফেলল। সে ছাউনি যতই দুর্বল হোক, রাতে আগুন জ্বাললে পশুদের সহজের ঠেকিয়ে রাখা যেত। তিন দেওয়ালে ঘেরা গুহায় শীতের বাতাসের প্রকোপ কম হত। সেই অভাবটুকুও অনেকটাই দূর করল আগুন। শীতের রাতেও খোলা আকাশের নিচে, আগুন ঘিরে গোল হয়ে বসে গা হাত-পা সেঁকে নিলে শীতের কামড়কে অনেকটাই হার মানানো যায়। অতএব আগুনের সামান্য এই তিনটে ব্যবহারই মানব প্রজাতি এবং মানুষকে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের অনুকূলে আনার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলল।

 

খ. দৈহিক পরিবর্তন

বিজ্ঞানীর বলেন আমাদের দেহে শক্তির (Calorie) উৎপাদন কেন্দ্র হল আমাদের উদর। আর এই উৎপন্ন শক্তির অধিকাংশই খরচ হয় আমাদের খাদ্য হজম করতে আর আমাদের মস্তিষ্কের ক্রিয়ায়। অতএব আমরা যত বেশি খাদ্য গ্রহণ করি, সেই খাদ্য হজম করতে আমাদের উদরকে তত বেশি শক্তি ক্ষয় করতে হয়।

ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধে হবে, আমাদের প্রত্যেকের জীবনে প্রায়শঃ যে ঘটনা ঘটে থাকে তেমনই একটি উদাহরণ দিলে। যেদিন কোন পার্টিতে বা নেমন্তন্নে গিয়ে আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য (একগাদা junk food) উদরস্থ করি, সেদিন আমরা পেটে আর শরীরে নানান অস্বস্তি অনুভব করি। আমাদের স্বাভাবিক ভাবনা চিন্তাগুলিও উদরকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে – “ইস, ছটা ভেটকির পাতুড়ি খাওয়ার পর অতটা মাংস না খেলেই হত! অথবা মাংস দিয়ে অতগুলো লুচির পর একগাদা রসগোল্লা খাওয়াটা উচিৎ হয়নি। এখন অম্বলের ওষুধ খাবো, নাকি হজমিগুলি খাবো, নাকি একটু জোয়ান চিবোবো”? এই সব চিন্তাতেই সেদিন বা তার পরদিন আমরা কাজে মন বসাতে পারি না। অর্থাৎ আমরা আমাদের মস্তিষ্ককে তার প্রয়োজনীয় শক্তি থেকে বঞ্চিত করি, উদরকে অতিরিক্ত শক্তি ব্যয়ে বাধ্য করে।

পৃথিবীতে সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে মানুষের শ্রেষ্ঠতার কারণ তার মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ক নিয়ে আমদের গর্বের শেষ নেই। কিন্তু সেই আদিমকালে এই মস্তিষ্কই ছিল মানুষের অন্যতম দুর্বলতার কারণ! অবাক লাগছে? একটু হিসেব করে দেখা যাক।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, একজন মানুষের দেহের ওজনের তুলনায় তার মস্তিষ্কের আয়তন, অত্যধিক বেশি। ষাট কিলো ওজনের অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মস্তিষ্কের গড় আয়তন হয় মাত্র ২০০ ঘন সেন্টিমিটার (সি.সি.)। সেখানে প্রাচীন মানবপ্রজাতিদের মস্তিষ্কের আয়তন ছিল প্রায় ৬০০ সি.সি.। আর আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন হয় ১২০০ থেকে ১৪০০ সি.সি.! এর ওপর আরও সংকটের বিষয় আমাদের দেহের ওজনের মাত্র ২ থেকে ৩% হল আমাদের মস্তিষ্কের ওজন। কিন্তু আমরা যখন ঘুমোই বা বিশ্রাম করি, তখনও আমাদের প্রাত্যহিক খাদ্যশক্তির প্রায় ২৫% একা মস্তিষ্কই শুষে নেয়! তুলনায় আমাদের ঘনিষ্ঠ পরিজন শিম্পাঞ্জির মস্তিষ্ক, বিশ্রামের সময় মাত্র ৮% শক্তি ব্যবহার করে।

অতএব মস্তিষ্কের এই বিপুল শক্তির চাহিদা মেটাতে আদিম মানুষকে একজন শিম্পাঞ্জির তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ খাদ্য খেতে হত। আর সেই খাদ্য যোগাড় করতে অনেক বেশি সময় – সূর্যোদয় থেকে প্রায় সূর্যাস্ত পর্যন্ত – ধরে জঙ্গলের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াতে হত।

একমাত্র পাকা ফল ছাড়া আগুনে পোড়ানো বা ঝলসানো যে কোন খাদ্য – সে মাংস হোক বা কন্দ-মূল – মানুষের খাদ্য হিসেবে অত্যন্ত সুপাচ্য হয়ে উঠল। মাংস বা কাঁচা আনাজ, কন্দ মানুষের পরিপাক তন্ত্রে সম্পূর্ণ হজম হওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। কিন্তু সামান্য আগুনের স্পর্শে এই খাদ্যগুলিতেই এমন কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে যায়, যাতে শুধু যে খেতে সুবিধে হয় তাই নয়, তার খাদ্যগুণও অনেক বেড়ে যায়। দু একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা খোলসা হবে।

কাঁচা আলু খেলে আমাদের আধুনিক উদর নিঃসন্দেহে বিদ্রোহ করবে, কিন্তু আলু পোড়া[1] বা আলু সেদ্ধ, আমাদের যে শুধু খেতে ভালো লাগে তাই নয়, অত্যন্ত পুষ্টিকরও বটে। কাঁচা বেগুন আমরা খাওয়ার কথা চিন্তাও করিনা, কিন্তু শীতকালে বেগুন-পোড়া অত্যন্ত সুখাদ্য হিসাবেই গণ্য হয়। একই ভাবে কাঁচা চাল, গম বা ভুট্টা আমাদের খাদ্যের মধ্যে আদৌ গণ্য হতে পারে না, কিন্তু আগুনের স্পর্শে এইগুলিই হয়ে উঠেছে আমাদের প্রধান খাদ্য (staple food)  – যা আমাদের আধুনিক শরীরে ক্যলোরির অধিকাংশ সরবরাহ করে। এর ওপর আগুন আমাদের খাদ্যশুদ্ধিও ঘটায়। যে কোন খাদ্যের গায়ে লেগে থাকা বীজাণু (bacteria), ছত্রাক (fungus) এবং আরো নানান অবাঞ্ছিত সংক্রমণ দূর করে, আমাদের পরিপাক তন্ত্রকে নিরাপদ রাখে।

সেই আদিম কাল থেকে আজ পর্যন্ত একটি আধুনিক শিম্পাঞ্জিকে তার প্রয়োজনীয় ক্যালোরি সংগ্রহ করতে সারাদিনে প্রায় পাঁচ থেকে ছ ঘন্টা খাদ্য চিবোতে হয়। সেখানে সারাদিনে তিন থেকে চারবার – সাকুল্যে ঘন্টাখানেক ‘চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়’ খাবার খেয়ে একজন আধুনিক মানুষ, শিম্পাঞ্জির থেকে অনেক বেশি ক্যলোরি সংগ্রহ করতে পারে[2]

অতএব এই অধ্যায়ের সারাংশ করলে দাঁড়ালো

    ১. আগুনের স্পর্শে আমাদের খাবারের খাদ্যগুণ বেড়ে গেল, ফলে কম খাদ্যে বেশি শক্তি পাওয়া সম্ভব হল।

২. কম খাদ্য মানেই, খাদ্য সংগ্রহের পরিশ্রম এবং সময় অনেকটাই কমে গেল। কমে গেল বেশিক্ষণ গভীর অরণ্যে ঘুরে বেড়ানোর ঝুঁকি।

৩. পরিমাণ কম হওয়াতে এবং খেতে সুবিধা হওয়াতে – খাওয়ার সময়টাও অনেকটাই কমে গেল। যার ফলে মানুষের হাতে দিনের অনেকটা সময় রয়ে গেল – অন্য কিছু ভাবার এবং অন্য কিছু করার।  

৪. খাদ্য হজম করা সহজ হয়ে যাওয়াতে, আমাদের বৃহদন্ত্র ও ক্ষুদ্রান্ত্রের (Large and small intestines) দৈর্ঘ্য অনেক ছোট হয়ে গেল, পরিপাক তন্ত্রের (Digestive system) শক্তির চাহিদাও কমে গেল।

৫. এই বাড়তি শক্তি আরো পুষ্ট করতে লাগল আমাদের মস্তিষ্ককে, আমাদের মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে জাগতে লাগল[3]

৬. খাদ্য গ্রহণ সহজ হয়ে যাওয়াতে, দ্রুত বদলে যেতে লাগল, আমাদের মুখমণ্ডল। আমাদের দাঁত, চোয়ালের হাড় হাল্কা হতে শুরু করল। সেই অনুপাতে কমে গেল মুখের, কপালের এবং রগের পেশীগুলি। এর ফলে আমাদের খুলির আকার কিছুটা বেড়ে ওঠার সুযোগ পেল, এবং মস্তিষ্কে আরো কয়েক ছটাক ঘিলু বেড়ে ওঠার জায়গা মিলল।

৭. খাদ্য গ্রহণ অনায়াস হওয়াতে, আমাদের ঠোঁট, জিভ ও তালু অনেক নরম ও মসৃণ হয়ে উঠল। কণ্ঠ, আলজিভ (epiglottis) ও স্বরতন্ত্রী (vocal cord) অনেক নমনীয় (Flexible) হয়ে উঠতে লাগল। অনর্গল কথা বলার জন্যে আমাদের মুখ প্রস্তুত হয়ে উঠল।

৮. বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীরই পরিবেশের (গ্রীষ্ম বা শীত) সঙ্গে তাল মিলিয়ে, দেহের উত্তাপ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের গায়ের রোম অথবা তাদের পুরু চামড়া। শীতের প্রকোপ কমাতে আগুনের নিয়মিত ব্যবহার - হোমো স্যাপিয়েন্সদের গায়ে রোমের ঘনত্ব কমিয়ে আনল!                       

আমাদের পূর্বপুরুষেরা এতগুলি সুবিধের কী কী সদ্ব্যবহার করেছিলেন, এবার সেই আলোচনায় আসি।  

১.৩.১ অবসরের ভাবনা, অবসরের ভাষা

আগের অধ্যায়ের সারাংশ খ/৫-এর বক্তব্য অনুযায়ী আমাদের মস্তিষ্ক পুষ্ট হওয়াতে সমগ্র মানুষ জাতির কতটা লাভ হয়েছে, সে বিষয়ে আলোচনা এখানে অর্থহীন। কারণ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন যদি মোটামুটি একই হয়, তাহলে ইতিহাসে মাত্র একজন করে নিউটন, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, বিটহোফেন[4] কেন? সে রহস্য ভেদ, বিজ্ঞানীরা আজও করে উঠতে পারেননি।

কাজেই ও বিষয়ে অনধিকার চর্চা ছেড়ে আমরা বরং খ/, /৬ আর খ/৭-এর বক্তব্য – মানুষের জীবনে কী কী পরিবর্তন আনল সেই নিয়ে আলোচনা করি।

খাবার সংগ্রহ এবং খাদ্য গ্রহণে সময় বেঁচে যাওয়ায়, প্রতিদিনে অলস অবসর কাটানোর মতো অনেকটা সময় মানুষের হাতে এসে গেল। মানুষ এই অবসরটুকুর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল, নিজেদের মধ্যে কথা বলে। এই আলাপের প্রচেষ্টাতেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে লাগল আমাদের ভাষা। যে ভাষায় আমরা নিজেদের মধ্যে সম্পূর্ণ তথ্য বিনিময় করতে পারি। যে ভাষায় বৃদ্ধরা তাঁদের দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা নবীন প্রজন্মকে হস্তান্তর করতে পারেন। যে ভাষায় আমরা মিথ্যা কথায় বিপক্ষকে বিভ্রান্ত করতে পারি। যে ভাষায় আমরা অজস্র কল্পনার জাল বুনতে পারি।

তাহলে তার আগে কী মানুষ কথা বলতে পারত না? আজ্ঞে হ্যাঁ, পারত। অন্যান্য সকল প্রাণীর মতো মানব প্রজাতিগুলি এবং মানুষও কথা বলতে পারত, সে কথার অধিকাংশই ছিল ধ্বনি, যাকে বলা যেতে পারে স্বরবর্ণ বা খুব জোর একাক্ষরী শব্দ। বিষয়টা আরেকটু খোলসা করা যাক।

পৃথিবীতে অধিকাংশ প্রাণীই নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে তথ্য আদানপ্রদানের জন্যে কিছু না কিছু ধ্বনি বা সংকেত ব্যবহার করে থাকে – সে পিঁপড়ে হোক বা হাতি। পিঁপড়ে তার পেছন থেকে ফেরোমন নামে একটি হরমোন ছিটিয়ে তার পেছনের সঙ্গীদের কখনো খাদ্যের কখনো বিপদের সংকেত দেয়। হাতিও তার নানান ডাকে তার সঙ্গীদের কখনো বিপদের, কখনো বেশ বড়োসড়ো কলা-বাগানের সন্ধান পেলে, আনন্দের সংকেত দেয়। আবার কখনো কখনো পুরুষ হাতি, মহিলা হাতিকে প্রেমও নিবেদন করে। হাতির সংকেতে বিপদ মানে বিপদই, সে বিপদ সিংহের দল, কিংবা শিকারী মানুষের দল সবই হতে পারে।

আদিম মানুষও তাই করত। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে সিংহের দল আর হাতির দলের বিপদে বিস্তর ফারাক। এখন সারাদিনের অবসর সময়ে তাদের মস্তিষ্ক তাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতাগুলিকে আলাদা আলাদা ভাবে চিহ্নিত (identify) করতে শুরু করল। তার সঙ্গে তাদের কথা বলার ইন্দ্রিয়গুলি – যেমন ওষ্ঠ, জিভ, তালু, কণ্ঠ ইত্যাদি এখন অনেক কমনীয় হয়ে ওঠাতে, চিহ্নিতকরণের (identification) এই প্রক্রিয়াটি খুব দ্রুত ঘটতে লাগল। তারা প্রত্যেকটি প্রাণী, গাছপালা এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে চিহ্নিত করে তাদের আলাদা আলাদা নাম দিতে শিখল। যেমন, হরিণ, শম্বর, বাঘ, ভালুক, হাতি, শুয়োর, সাপ ইত্যাদি। কিংবা পাহাড়, নদী, জঙ্গল, মেঘ, বৃষ্টি, বজ্র, বিদ্যুৎ, আগুন। তেমনি বট, অশ্বত্থ, আম, জাম, কাঁঠাল, নিম, কলা, নারকেল, তাল, বিছুটি, ধুতরো। এই বিষয়গুলির কারা কারা এবং কোনটি কোনটি তাদের পক্ষে বিপজ্জনক, কোনটি উপকারী, কোনটি খাদ্য, কোনটি অখাদ্য সেগুলিও সনাক্ত করে, বয়স্ক মানুষরা তাদের তরুণ প্রজন্মকে সেই তথ্য সরবরাহ করতে শুরু করে দিল।

অর্থাৎ যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে আদিম মানুষরা বৃদ্ধ হয়ে যেতেন, সেই বৃদ্ধ পিতামহরা এখন গল্পের ছলে, তাঁদের তরুণ প্রজন্মের মস্তিষ্কে, তাঁদের জীবনের সকল অভিজ্ঞতার পূর্ণ তথ্য, সরবরাহ করে দিতে সক্ষম হলেন। পিতামহর এই অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়ে, বিচক্ষণ তরুণরা নিজেদের আরও উন্নত করার ভাবনা চিন্তা এবং তার প্রয়োগ করার সময় পেলেন, তাঁদের নিজেদের বার্ধক্য কাল পর্যন্ত! এরপর এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে বেড়েই চলল, অভিজ্ঞতার তথ্য ভাণ্ডার এবং তথ্য সরবরাহের পরম্পরা। আশা করি, এবার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া গেল আদিম মানুষের ৬০০ সি.সি.র মস্তিষ্ক কেন পরবর্তী প্রজন্মে বেড়ে উঠতে শুরু করেছিল!   

অতএব মানুষ এখন পরিস্থিতি অনুযায়ী কথা বদলাতে পারে, কারণ তারা এখন আর শুধু শব্দ করে না।  অনেক শব্দ জুড়ে কথা, অর্থাৎ অর্থপূর্ণ বাক্য গঠন করতে পারে। যেমন তারা বলতে পারে, “বাঁদিকে সিংহের দলটাকে দেখেছিস, কেমন ঘাপটি দিয়ে বসে আছে? খুব সাবধান। চল আমরাও ঝোপের আড়ালে ঘাপটি দিয়ে বসি, তারপর একটু পরে সবাই মিলে একসঙ্গে হো হো চিৎকার করে লাফিয়ে ওদের তাড়া করব, সিংহ ব্যাটারা পালাবার পথ পাবে না”। অথবা “সামনেই হাতির দল, সাবধান। কোন ঝুঁকি না নিয়ে কেটে পড়াই ভালো। সবাই মিলে একদিকে না দৌড়ে, নানান দিকে ছুটতে থাক, হাতিরা কাকে ছেড়ে কাকে ধরবে, বুঝতে না পেরে, এক সময় হাল ছেড়ে দেবে”।

কাকাতুয়া, ময়না বা টিয়া পাখিও মানুষের কথা নকল করতে পারে, কিন্তু তারা নিজেরা কথা বানাতে পারে না। মানুষ পারে এবং পারে বলেই হাতির শরীরের তুলনায় অতি তুচ্ছ প্রাণী হয়েও, পরবর্তী কালে তারা হাতি শিকার করেছে এবং পোষও মানিয়েছে।

শব্দ করে মিথ্যা সংকেত দেওয়ার উদাহরণ প্রাণীজগতে একেবারেই যে নেই এমন নয়। বিজ্ঞানীরা বলেন দু-একটি প্রজাতির শিম্পাঞ্জি নিজের স্বার্থে মিথ্যা সংকেত দিতে পারে। কালাহারির মরুপ্রান্তরে ড্রংগো নামের ছোট্ট একটি পাখি, মিরক্যাটদের বন্ধু। মিরক্যাটদের পরমশত্রু ঈগল পাখির দেখা পেলেই তারা মিরক্যাটদের সতর্ক করে দেয়। আবার এই ড্রংগোই মিথ্যে সংকেত দিয়ে, মিরক্যাটদের চমকে দিয়ে, তার শিকার করা কাঁকড়া বিছে হাতিয়ে, নিজের উদরপূর্তি করে[5]। প্রকৃতিতে এরকম কয়েকটি উদাহরণকে ব্যতিক্রমই বলা উচিৎ। কারণ প্রাণী জগতের অধিকাংশই সত্যি কথা বলে এবং এটাই প্রকৃতির নিয়ম। দু-একটি ব্যতিক্রম যা দেখা যায়, সেগুলি এই নিয়মকেই প্রতিষ্ঠা করে।

কিন্তু মানুষ মিথ্যা কথা বলায় অত্যন্ত দক্ষ। তারা প্রায়শঃ মিথ্যা কথা বলতে ভালোবাসে। একজন মানুষ নিজেকে বীর প্রমাণ করার জন্যে জঙ্গলে কোন দিন না গিয়েও, অজস্র বাঘ বা সিংহ শিকারের নিখুঁত গল্প বানাতে পারে। সে যদি মিথ্যা বলায় দক্ষ হয় মানুষ তাকেই বীর বলে বিশ্বাস করে। আর যে হয়তো সত্যিই বীর কিন্তু তেমন দক্ষ কথক নয়, তার কথায় কেউ কানই দেয় না।

মানুষ কথা দিয়ে স্বপ্ন বুনতে পারে। অবাস্তবকে বাস্তব করে তুলতে পারে। অবাস্তবকে বাস্তব করে তোলা কিন্তু সর্বদাই নির্জলা মিথ্যা নয়। মিথ্যা কোন না কোন সময়ে ধরা পড়ে যায়। যাঁরা কথায় স্বপ্ন বুনতে পারেন, তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাই সেই স্বপ্নে বিভোর থাকেন এবং মানুষের মনে সেই স্বপ্ন সঞ্চার করেন। মানুষের এই বৈশিষ্ট্যটির ভূমিকা আলাদা গুরুত্বের দাবি রাখে।

মানুষের আরেকটি অন্যতম গুণ বিপদের কল্পনা আর দুশ্চিন্তা করার ক্ষমতা। কল্পনা আর দুশ্চিন্তার যোগসূত্র হল “যদি”। যদি আজ শিকারে কোন বড়ো প্রাণী শিকার না করা যায়? যদি আজ শিকার করতে গিয়ে দলের কিছু মানুষ আহত হয়, কিংবা যদি দু-একজন নিহত হয়? যদি অন্য কোন দল আমাদের আক্রমণ করে? যদি ঝড়ে গাছ ভেঙে আমাদের বাসার ওপর পড়ে এবং দু চারজন চাপা পড়ে? গভীর রাত্রে যদি হাতির দল কিংবা বাঘ এসে গ্রামে হানা দেয়? সন্তান প্রসব করতে গিয়ে যদি মায়ের মৃত্যু হয়? সারাদিনের এমন অজস্র “যদি” আমাদের জীবনকে কীভাবে বদলে দিয়েছে, আর তার জন্যে কত যে মন্ত্র বিভিন্ন শাস্ত্রে উচ্চারিত হয়েছে, সে কথা আলোচনা করা যাবে পরের অধ্যায়ে।   

অবসর বিনোদনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের এমনই নানান জটিল ভাবনা যখন ভাষায় রূপ পেল, তার জীবনও ততই জটিল হয়ে সভ্যতার দিকে এগোতে লাগল। অবশ্যই এর পিছনে রয়েছে মস্তিষ্কের প্রত্যক্ষ অবদান। কিন্তু একই পরিবারের এক ভাই (গিরীশ ঘোষের “প্রফুল্ল” নাটকের মেজভাই) কেন যে বজ্জাত আর কুচুটে হয়, এবং কেনই বা অন্য ভাই (ঐ নাটকের বড়ভাই) সাদাসিধে ভোলাভালা হয়, সেকথা মস্তিষ্কই জানে।

এবার আজ থেকে প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগের কোন এক সময়ে আমি কল্পনায় পৌঁছে যাবো। কিছুদিন একটি দলের সঙ্গেই আমি বাস করবো। দেখবো, আমাদের আগের দেখা মানুষগুলির তুলনায় এই মানুষগুলির জীবনে কী কী পরিবর্তন ঘটেছে।

 

১.৩.২ মনের ভাষা, প্রাণের ভাষা

গোটা কয়েক পর্ণ কুটির আর সামনে অনেকটা খোলা প্রাঙ্গণ নিয়ে একটি বসতি। এই বসতিতে বাস করে যে দলটি, তাদের সঙ্গেই আমি রয়েছি। সে দলটিতে সদস্য সংখ্যা - শিশু থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ধরে প্রায় পঞ্চাশ জন। তাদের মধ্যে গোটা দশ-বারো বিভিন্ন বয়সের ছোট ছেলেমেয়ে। তারা যথারীতি নিজেদের মধ্যে হুটোপুটি করছে, হৈচৈ করছে আর বয়স্কদের বিরক্ত করছে। দলের পাঁচজন বার্ধক্যের সীমা পেরিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে একজন এখনো বেশ ঋজু, সুঠাম। তিনি এই দলের পিতৃস্থানীয়, নাম ধরা যাক পশুপতি। বাকিরা বয়েসের ভারে কুঁজো, চলাফেরাতেও বেশ মন্থর, চোখেও তেমন স্পষ্ট দেখতে পান না। তাঁরা সকলেই ওই ছোট ছেলেমেয়েগুলিকে লক্ষ্য রাখছেন এবং স্নেহমাখা সুরে মাঝে মাঝে শাসনও করছেন। বাকিরা নানান বয়সের তরুণ-তরুণী এবং মধ্যবয়স্ক পুরুষ-মহিলা। তাদের মেদহীন চেহারা পেশিবহুল এবং টানটান। দেখেই বোঝা যায় তারা বলিষ্ঠ, ক্ষিপ্র এবং চনমনে।

এখন সদ্য সকাল, কিছু আগেই সূর্যোদয় হয়েছে। তরুণ ও মধ্যবয়স্কদের দলটি এখনই জঙ্গলে ঢুকবে। তারা সকলেই প্রস্তুত। তাদের সকলের কাঁধে ঝুলছে শুকনো লতা দিয়ে বোনা ঝোলা – কিছু ঝোলায় রয়েছে বেশ কিছু ধারালো পাথরের টুকরো, কিছু ঝোলা খালি। সকলেরই হাতে রয়েছে পাঁচ-সাড়েপাঁচ ফুট লম্বা পোক্ত লাঠি, যারা মাথাটা ছুঁচোলো। বেরোনর আগে তারা খোলা প্রাঙ্গণে এসে একত্রে দাঁড়াল গোল হয়ে।  পিতা পশুপতি সামনে এগিয়ে এলেন, ছোট্ট একটা গাছের ডাল হাতে নিয়ে। গোটা দলটিকে মাঝখানে রেখে, তিনি মাটিতে গোল একটা গণ্ডি আঁকলেন হাতের ডালটি দিয়ে, তারপর মুখ তুলে তাকালেন উপরের দিকে।

পিতা পশুপতি যেদিকে তাকালেন, সকলেই মুখ তুলে সেদিকে তাকাল। আমিও তাকিয়ে দেখলাম, সামনেই খুবই ছোট্ট একটি পাহাড়। তার চূড়ার কাছাকাছি রয়েছে বড়োসড়ো একটি পাথর। পিতা পশুপতি পাথরের দিকে জোড়হাতে প্রণাম করলেন, তারপর উচ্চস্বরে একঘেয়ে সুরে বললেন, “হে পিতা, আমাদের খাদ্য দাও। আমাদের শিকার দাও। আমাদের ছেলেমেয়েদের সুস্থ রাখো। তোমার জঙ্গলের পশুরা ওদের যেন কোন ক্ষতি না করে। তুমি ওদের সকলের সঙ্গে সর্বদা থেক। ওদের নিরাপদে ঘরে ফিরিয়ে এনো”। পাথরের কাছে তাঁর নিবেদন শেষ হতে, দলের সকলেই মাথা নীচু করে জোড় হাতে প্রণাম করল, তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেল জঙ্গলের পথে।

যতক্ষণ দলটিকে দেখা গেল, বয়স্ক মানুষগুলি ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। ওরা চোখের আড়ালে চলে যেতেপিতা পশুপতি এগিয়ে গেলেন, সামনের একটি বড়ো অশ্বত্থ গাছের দিকে। সেই গাছের তলাতেই তিনি বসবেন, দলের বাচ্চাদের লক্ষ্য রাখবেন। নানান চিন্তাভাবনাও করবেন। মনে মনে কথা বলবেন, ওই পাথরের সঙ্গে। তিনি বিশ্বাস করেন, ওই পাথরে আছে তাঁর প্রপিতামহের আত্মা। যিনি সর্বদাই এই দলের শুভাশুভের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখেন।

এক কিশোরী, দুই মধ্যবয়স্কা মহিলা ও এক পুরুষ অবিশ্যি জঙ্গলে যাননি। তাঁদের দায়িত্ব এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর ছেলে-মেয়েদের দেখা শোনা করা। তাঁরাই যে রোজ এমন থাকেন তা নয়, তবে দলের তিন-চারজনকে পালা করে এমন রোজই থাকতে হয়।

পিতা পশুপতি অশ্বত্থের ছায়ায় একটি মোটা শিকড়ের ওপর বসতেই, কিশোরী মেয়েটি দৌড়ে এসে তাঁর পাশে বসল, বলল, “এখন আমার কোন কাজ নেই, বড়োবাবা, কাকিমা বলল”।

পশুপতি মুখে প্রশ্রয়ের হাসি নিয়ে বললেন, “কাজ নেই তো ভাই-বোন, ভাইপো-বোনঝিদের সঙ্গে খেল গে যা। আমার সঙ্গে তোর কী দরকার?”

আদুরে গলায় মেয়েটি, যার নাম ঊষি, বলল, “আমি তোমার কাছেই থাকবো, তোমার কথা শুনবো”।

কি কথা?” মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন পিতা পশুপতি।

যদি রাগ না করো, তা হলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো”? কোন উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তিনি তাকিয়ে রইলেন, কিশোরী ঊষির চোখের দিকে, তারপর বললেন, “আচ্ছা, রাগ করবো না, কী জানতে চাস বল”।

বড়োবাবা রাগ করবেন না বলা সত্ত্বেও ঊষি একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “বড়োবাবা, তুমি ওই যে ওপরের ওই পাথরটার দিকে প্রায়ই তাকিয়ে থাক, বারবারই প্রণাম করো। ওই পাথরে কে আছে বলো তো? সকলে বলে ওই পাথরে নাকি কোন এক আত্মা আছেন। তিনিই তোমাকে পথ দেখান, এ কথা কি সত্যি, বড়োবাবা?”

পশুপতি হাসলেন, বললেন, “কেন ওই পাথরের বুকে তুই কি কিছুই দেখতে পাস না?” ঊষি এর আগে বহুদিন, বহুবার চেষ্টা করেছে, আজ আবারও নিরীক্ষণ করল কিছুক্ষণ, তারপর বড়োবাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে ঘাড় নাড়ল, না। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।

পিতা পশুপতি কিশোরী ঊষির মাথায় হাত রাখলেন। এই মেয়েটি তাঁর বড়ো কন্যার নাতনি, ওর বাবা, তাঁর এক ভাইপোর ছেলে, আর মা, ওঁর কন্যার মেয়ে। বেশ কিছুদিন হল ঊষিও জঙ্গলে যাচ্ছে, বড়োদের সঙ্গে। পাথর ছোঁড়া কিংবা কাঠের বর্শার ব্যবহারে রীতিমতো দক্ষ হয়ে উঠছে। যে কোন গাছে সে উঠে পড়তে পারে, কাঠবেড়ালির মতো। যেমন প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারে, তেমনই ওর অন্তরে আছে অত্যন্ত মায়া-দয়া। ছোটছোট ভাই-বোন, ভাইপো-ভাইঝিদের খেয়াল রাখে খুব, ভালওবাসে। আর ভীষণ ভালোবাসে তার বড়োবাবাকে। জঙ্গলে গেলে, একটা না একটা পাকা ফল সে আনবেই তার বড়োবাবার জন্যে। বড়োবাবার হাতে সেই ফল তুলে দিয়ে সে বলে, “বড়োবাবা এটা তোমার জন্যেই এনেছি, তুমি খাও”।

পিতা পশুপতি মুখ তুলে পাথরটার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, “তোরা দেখতে পাবি না। তোরা বুঝতে পারবি না। তোরা এখন ছোট্ট। তোদের মনে এখনও বিশ্বাস আসেনি। তোরা ভাবিস, সারাদিন তোরা যা করছিস, সব তোরাই করছিস। আরও বড়ো হলে বুঝবি, তোরা কিছুই না”।

ঊষি একটু অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “তুমি এমন কথা বলতে পারলে বড়োবাবা? আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না? আর সারাদিন আমরা যা কাজ করছি, সে সব আমরা না তো, কে করছে, শুনি?”

পাগলি মেয়ে, রাগ করছিস কেন? তুই যেমন আমাকে বিশ্বাস করিস, ভালোবাসিস, তেমনি আমিও ভালোবাসতাম, বিশ্বাস করতাম আমার বড়োবাবাকে। আমি তো তাঁকেই দেখি ওই পাথরের বুকে। সেই নাক, চোখ, মুখ, সব স্পষ্ট। তিনি যেমন আছেন আমার অন্তরে, তেমনই আছেন ওই পাথরে। তুই যখন অনেক বড়ো হবি, আমি আর থাকবো না তোর সামনে, দেখবি, তুইও অমনি করেই আমাকে দেখতে পাবি। তখন তুইও বুঝবি, সারাদিন তোরা যা কিছু করবি, তার পিছনে আমিই থাকবো, তোর সঙ্গে সারাক্ষণ। আমার দৃষ্টি এড়িয়ে তোরা কিছুই করতে পারবি না”।

বড়োবাবার কথায় ঊষি খুব অবাক হল, কিন্তু একটু রেগেও গেল, বলল, “তোমার সঙ্গে আর একটাও কথা বলব না, বড়োবাবা। সুযোগ পেলেই তুমি যখন “আমি আর থাকবো না” বলো না, তখনই আমার গা জ্বলে যায়...”। মুখ ঝামটা দিয়ে সে অন্য দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

পিতা পশুপতি কোন কথা না বলে নিবিড় স্নেহে ঊষির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। আর আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম, শুনছিলাম ওদের দুজনের কথা। লক্ষ্য করছিলাম, ওদের শরীরি ভাষাও। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করছিলাম, ওদের দুজনের দুই চোখ, ভ্রূ, গাল, নাক এবং ঠোঁটের ভাষাও – সে ভাষা অনুভবের নীরব ভাষা। অবাক হচ্ছিলাম রান্নায় আগুনের ব্যবহারের মাত্র পনের-বিশ হাজার বছরে কী বিপুল উন্নতিই না করেছে মানুষ। নিজের মনের কথা ও অনুভব, অন্যজনের কাছে এমন ভাবে প্রকাশ করতে পারে, এই পৃথিবীর আর কোন্‌ প্রাণী? শিম্পাঞ্জি কিংবা আদিম মানুষরাও, কিশোরী ওই মেয়েটির মতো, ঠোঁট উল্টে না বলতে পারত কি? অথবা পারত ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান দেখাতে

ঊষির দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর, পশুপতি বললেন, “আচ্ছা, আর কখনো অমন বলবো না, কিন্তু এবার মুখটা ঘোরা, পাগলি। তোর হাসি মুখখানি একবার দেখি”। ঊষি ছলোছলো চেখে আবার মুখ ফেরাল বড়োবাবার দিকে, একটু লাজুক হাসল। উদ্বেল স্নেহে পশুপতি আবারও বললেন, “তোর মা, বাবা, দাদু-ঠাকুমাকে আমি কত আদর করেছি, কত ভালোবেসেছি। আবার শাসনও করেছি কত। মনে নেই, এই তো সেদিন, তোদের সামনেই তোদের কাকাকে কম মারলাম? সে তো তোদেরই ভালোর জন্যে, বল? মানুষ তো চিরকাল থাকে না পাগলি, থাকে তার স্মৃতি। অনেক বড়ো হয়ে গেলে, যখনই তোরা খুব আনন্দ করবি, কিংবা দুঃখে-বিপদে জেরবার হবি। আমি না থাকলেও, দেখবি আমার কথাই তোদের সর্বদা মনে পড়বে। মনে মনে আমাকেই তোর পাশে অনুভব করবি, যেমন আমি করছি আমার বড়োবাবাকে”।

নাতনির সঙ্গে কী এত কথা হচ্ছে, বাবা?”

এই সময় অপরিচিতা এক মহিলার গলা শুনে দুজনেই মুখ ফেরাল। তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মধ্যবয়স্কা এক মহিলা আর সঙ্গে তাঁর পিতা। মহিলার নাম মিত্তিকা আর ওঁর বাবার নাম গিরিজ। পশুপতি ও ঊষি দুজনেই অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, জোড়হাতে নমস্কার করে পশুপতি বললেন, “আপনারা, হঠাৎ কোথা থেকে? আপনাদের দলের আর সকলে কোথায়?” মিত্তিকা ও গিরিজও জোড়হাতে নমস্কার করে বললেন, “একটু বসে জিরোতে দিন, বাবা, সেই কোন ভোরে বেরিয়েছি, আমাদের বসতি থেকে...”। বলতে বলতে অশ্বত্থের ছায়ায় দুজনেই বসলেন। কোন কথা না বলে পশুপতিও বসলেন তাঁদের মুখোমুখি, ঊষিকে ইশারা করলেন, একটু খাবার জল আনার জন্যে। ঊষি দৌড়ে গেল জলের ব্যবস্থা করতে।

...চলবে...       

[এর পরের পর্ব পড়তে  হলে এই সুত্রে প্রবেশ করুন - ]


[1] শহরের মানুষেরা আলুপোড়া খাওয়ার ব্যপারটা হয়তো জানেন না। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে আমাদের বাল্যে এবং কৈশোরে, শীতের শেষে ক্ষেতের থেকে কাঁচা আলু তুলে, ওই মাঠেই আগুনে পুড়িয়ে খাওয়াটা একটা দারুণ আনন্দময় অ্যাডভেঞ্চার ছিল। অবিশ্যি সঙ্গে থাকত একটু নুন-গোলমরিচের ছিটে – সেটুকু যোগাড় করতে আদিম মানুষদের আরও তিরিশ চল্লিশ হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল! অবিশ্যি এখানে বলে রাখা ভাল, ভারতীয় উপমহাদেশে আলু আমদানি করেছিল পোর্তুগিজ বণিকেরা, আজ থেকে পাঁচ-ছশ বছর আগে। অতএব আমাদের দেশের বেচারা আদিম মানুষরা আলুর স্বাদ চেখে যেতে পারেননি।  

[2] যাঁরা একটু অতিরিক্ত খাদ্যোৎসাহী মানুষ তাঁরা ওই সময়েই এত বেশি ক্যালোরি সংগ্রহ করে ফেলেন, যে তাঁদের আবার সেই অতিরিক্ত ক্যলোরি ঝরাতে অনেকটা সময় অপব্যয় করতে হয়! 

[3] স্তিষ্কের জেগে ওঠা কথাটাই আমার উপযুক্ত মনে হল, কারণ আগুনের ব্যবহার শিখেও মানব প্রজাতিগুলি কয়েক লক্ষ বছর ধরে, প্রাণী হিসেবে একেবারেই তাৎপর্যহীন হয়ে প্রকৃতিতে বাস করত। কিন্তু মানুষ রান্নার সূত্রপাত করেছে আজ থেকে হয়তো পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হাজার বছর আগে। মাত্র এই কটা বছরেই প্রাণী জগৎ তো বটেই, পৃথিবী নামের এই সুন্দর গ্রহটিকেও মানুষ “ত্রাহি মাম্‌” অবস্থায় দাঁড় করিয়ে ছেড়েছে!   

 [4] বিটহোফেন এই বানানটা সচরাচর চোখে পড়ে না। সঠিক নাম খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, কেউ বলেছেন, বিঠোভেন, বিটোফেন, বিঠোফেন...। শেষ অব্দি গুগ্‌লের জার্মান উচ্চারণের শরণাপন্ন হলাম।  

[5]  উৎসাহী পাঠক/পাঠিকা, ইউটিউবের এই লিংকটিতে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন ধূর্ত ড্রংগো পাখির দুষ্টুমি - https://www.youtube.com/watch?v=tEYCjJqr21A


২টি মন্তব্য:

  1. যদি - এই কথাটা যে এতো অপরিসীম অভিঘাতের জেনে অবাক হয়ে গেলাম- রইলাম আগামীর অপেক্ষায়।

    উত্তরমুছুন
  2. হ্যাঁ ভাই, "যদি" কথার ওপর অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ধর্মবিশ্বাস - "যদি" পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট না হয় - তাই বইয়ের ভেতরে গুঁজে রাখি, মা সরস্বতীর প্রসাদী ফুল...একটু চিন্তা করলে এমন অজস্র উদাহরণ মনে আসবে।

    উত্তরমুছুন

নতুন পোস্টগুলি

ধর্মাধর্ম - ১/৫

[এর আগের পর্ব পড়তে  হলে এই সুত্রে প্রবেশ করুন -  ধর্মাধর্ম - ১/৪ ]   প্রথম পর্ব  (৭০ , ০০০ বিসিই থেকে ১২ , ০০০ বিসিই) - ৫ম পর্বাংশ ১.৪.২ বিশ...