১২
বিতান “একান্ত সহায়ে” চলে গেছে দিন
কয়েক হল। এখন ছবির কাজ একদম কমে গেছে। বিতান চলে যাওয়ার পর এই বাড়িতে তার
প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? ঘরদোর সাফ করা, রান্নাবান্না করা, বাসন-কোসন ধোয়াধুয়ি, আর
কাচাকাচি। একজন মাত্র লোক এই সংসারে – শুভময়ীদেবী, কতটাই বা কাজের পরিমাণ? কাজেই
শুভময়ীদেবী কিছু বলার আগেই ছবি তার মাকে বলেছিল অন্য বাড়িতে কাজ যোগাড় করে নেবার
জন্যে। পাশের অ্যাপার্টমেন্টে মা কাজ পেয়ে গেছে, তাই আজ থেকে মা এ
বাড়িতে আর কাজের জন্যে আসবে না । এখন ছবি নিজে হাতেই সব কাজ করে
নিচ্ছে। সব কাজ। শুভময়ীদেবী ছবির উপরই যেন ছেড়ে দিয়েছেন তাঁর একক
সংসারের যাবতীয় দায়িত্বভার।
তাতেও আজকাল ছবি নিজেকে নিরাপদ
মনে করে না। যদি শুভময়ীদেবী কাল বলেন – “ছবি, তুই মাকে ছাড়িয়ে দিলি কেন? তুই অন্য
কোথাও কাজ দেখে নে। তোর মায়ের মাইনে ছিল মাত্র পনেরশ টাকা, আর তোর তো সাড়ে
পাঁচহাজার, প্লাস থাকা খাওয়া, জামাকাপড়? বিতান তো আর বাড়িতে নেই – এই বাড়তি
খরচের আর দরকার কি, বল? তখন? তখন ছবি কোথায় যাবে, সেও
কি তার মার মতো, দিদুর মতো বেরিয়ে পড়বে সাত বাড়ির এঁটোকাঁটা ঘাঁটতে? শেষমেষ হয়তো
হবেও তাই, কিন্তু যতদিন পারা যায় ছবি সেটাকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়। অলরেডি সে দিদুকেও বলে
রেখেছে কাজের খবর নিতে। “ঠিকা কাজের-মাসি” ধরনের নয়, একটু অন্যরকম কাজ, যত
তাড়াতাড়ি সম্ভব।
মিঠুদিদিও অনেকদিন যোগাযোগ করেনি।
শেষ এসেছিল প্রায় মাস তিনেক আগে। তখনো বিট্টুর “একান্ত সহায়ে” চলে যাবার কথা ছবির
জানা ছিল না। দুপুরে বিট্টু ঘুমিয়ে পড়ার পর, সেদিনও তারা মিলিত হয়েছিল যথারীতি। সব
কিছু হয়ে যাওয়ার পর, জামা কাপড় পড়তে পড়তে ছবি অনেক কথা বলেছিল মিঠুদিদিকে। সেই সব
কথাতেই কি মিঠুদিদি রাগ করল? ছবি বলেছিল, “এ
সব করে কী লাভ হচ্ছে, বলো তো,
মিঠুদিদি”?
“কোন সব”?
“আহাঃ। কিছুই বোঝো না যেন। এই সব
- এতক্ষণ যা অসভ্যতা করলাম আমরা দুজনে”।
“লাভ! ভালোবাসা কি লাভ লোকসানের
হিসেব কষে হয় নাকি, ছবি? আই লাভ ইউ – ব্যস্”।
“যাঃ, মেয়েতে মেয়েতে ভালোবাসা
আবার হয় নাকি? আর হলেই বা কি – সংসার তো হবে না”।
“ও, শুধু ছেলেতে আর মেয়েতেই সংসার
হয় বুঝি? তাহলে আমাদের সংসারে মায়ের সঙ্গে বাবার বনল না কেন? দিন রাত শুধু সন্দেহ
আর ঝগড়া? মাঝের থেকে আমি জন্মে গেলাম। শুভময়ী আন্টিকেও দেখ, স্বামীর
সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে? বিতান যেন আন্টির একলার, সব হ্যাপা তিনি সামলাচ্ছেন, আবার
স্কুলের কাজটাও চালাচ্ছেন ঠিকঠাক। আর ভদ্রলোক শুধুমাত্র অফিসের প্রবল চাপ
সামলাচ্ছেন দায়িত্ব নিয়ে। ওঁদের মধ্যে ভালোবাসা ছিল? এদিকে বিতান জন্মে গিয়েছে।
কিসের সংসার? এই জন্মগুলো কি তোর মনে হয় ভালোবাসার ফসল? নাকি স্রেফ যৌবনের ঘটনা”!
একটু থেমে মিঠুদিদি আবার বলল, “অ্যাকচুয়ালি,
প্রকৃতিতে এরকম কোন ক্রাইটেরিয়া যদি থাকত, যে প্রকৃত ভালোবাসা ছাড়া বাচ্চা হবে না,
সুস্থ স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রী হলেও না, তাহলে অন্ততঃ পঞ্চাশভাগ সংসারই নিঃসন্তান
থাকত, ছবি। কাজেই আমি তোকে যদি ভালোবেসে ফেলে থাকি এবং তুইও আমাকে,
আমরা যদি দুটি মেয়ে বিয়ে করে বা না করে একসঙ্গে থাকি। আমরা যদি পেয়ে যাই জীবনের সব
সুখ, সেটা কেন সংসার হবে না? হ্যাঁ, বাচ্চা হয়তো হবে না, নাই বা হোল। জঞ্জালের
ভ্যাটে ফেলে যাওয়া কোন “সুখী সংসারে”র বাচ্চাকে অ্যাডপ্ট করব, কিসে আটকাচ্ছে, ছবি?
আটকাচ্ছে তোর মনে, তোর চিন্তায়, তোর আজন্ম পাওয়া শিক্ষা থেকে। তোর মনে হচ্ছে এটা
অনাচার। মনেও করিস না, আমি তোর কাছে বারে বারে ফিরে আসি শুধুমাত্র ওইটুকুর জন্য,
আরো আরো অনেক কিছু পাই তোর থেকে। আর এটাই বাস্তব ঘটনা, ছবি, আমি তোকে ভালোবাসি আর
তোকে আমি খুব নিজের করে পেতে চাই, আজীবন”।
মিঠুদিদি একটানা এত কথা বলে থেমে
গেল। ছবি কোন উত্তর দিতে পারল না। তার যে পরিবেশে জন্ম, যে পরিবেশে
সে বড়ো হয়েছে, তাতে মিঠুদিদির সঙ্গে তর্ক করার সাধ্য তার নেই। তাই কিছুক্ষণ চিন্তা করে
খুব শান্ত স্বরে সে বলেছিল, “মিঠুদিদি, রাগ করো না, প্লিজ। তুমি যা বললে, সেটা ঠিক
না ভুল সে বিচার করার সাধ্যি আমার নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, তোমরা অনেক লেখাপড়া
শিখেছ, কলকাতার যে সমাজে তোমাদের ওঠবোস, তার সঙ্গে আমাদের সমাজের বিস্তর ফারাক।
তোমার আমার সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়ে গেলে, মাকে-দিদুকে হয়তো পাড়া ছাড়া করে দেবে
সেখানকার লোকেরা। তোমাদের মতো বাড়িতে কাজ করে আমরা যারা বেঁচেবর্তে আছি
কোনমতে, সেসব বাড়ি থেকেও দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে ওদের, দেখে নিও। আমরা যারা নেহাতই সমাজের নীচুতলার মানুষ তাদের এ
সাহস মানায় না, মিঠুদিদি। আমাদের বেঁচে থাকাটাই একটা মস্ত সমস্যা, কিভাবে নিজের
জীবন কাটাবো সে তো অনেক দূরের ব্যাপার। তুমি ভুল বুঝো না, রাগ করো না, তোমার
ভালোবাসায় আমার অন্ততঃ কোন দুশ্চিন্তা নেই। কিন্তু আমার ওপরে... ওই দ্যাকো, চললে কোথায়, চা বানাচ্ছি খেয়ে
যাও...”।
প্রতিষ্ঠা চলে গেল। একবারের
জন্যেও ফিরে তাকাল না। বললও না – “আসছি রে, ছবি”, যেমন বলত প্রত্যেকবার।
অনেকদিন করব করব করেও ফোন করতে
পারেনি ছবি। কে জানে মিঠুদিদি, রেগে আছে হয়তো। আজ ফোন লাগাল, রিং হচ্ছে, চারবার
রিং হবার পর মিঠুদিদি কথা বলল, “হ্যাঁ ছবি, বল। কি খবর? কেমন আছিস”?
“ভাল নেই গো। সেই তুমি চলে গেলে
রাগ করে, একবার ফোনও করলে না”।
বেশ কিছুক্ষণ কোন উত্তর দিল না
মিঠুদিদি। কানে আসছিল মিঠুদিদির নিশ্বাসের শব্দ। ছবি আবার বলল, “শুনছ, মিঠুদিদি”?
“শুনছি। সেদিন তোর কথায় রাগ করিনি
রে, ছবি। বরং চমকে উঠেছিলাম তোর বাস্তববুদ্ধি দেখে। কি স্পষ্ট করেই না সেদিন তুই
আমার চোখ খুলে দিয়েছিলি। সত্যি আমিও কি এক ঘোরের মধ্যে যেন চলছিলাম। তোর কথায় আমি
চিনতে পারলাম নিজেকে, তোকে, আমার মাকে, বাবাকে, মালতীমাসি, বিমলামাসিকে। একদম রাগ
করিনি তোর কথায়। তুই নিশ্চিন্ত থাক। তোকে ফোন করিনি, তোর সঙ্গে দেখা
করিনি, সে অন্য কারণ। তোকে দেখলে যদি আবার দুর্বল হয়ে পড়ি, যদি তোকে আবার কাছে
টেনে তোকে বিপদে ফেলি, তাই। সে যাক কেমন আছিস বল। বিট্টু কেমন আছে”?
“বিট্টু তো নেই, বাড়িতে থাকে না।
প্রায় দিন পনেরো হয়ে গেল”।
“তাই? কোথায় গেছে”?
““একান্ত সহায়” বলে একটা বোর্ডিংয়ে।
সেখানে আরো অনেকে আছে বিট্টুর মতো। সেখানে রেখে এসেছে মামী। মামী রোববার রোববার
যায়, আমিও গিয়েছিলাম গত রোববার”।
“ও। তাই বুঝি? তাহলে তোর তো অনেক
কাজ কমে গেল”।
“মিঠুদিদি, তোমার মাকে বলে
তোমাদের বাড়িতে আমাকে রাখবে। তোমার মায়ের সব কাজ করে দেব”?
“কেন রে? আন্টি কি তোকে বলেছে কাজ
থেকে ছাড়িয়ে দেবে”?
“না, তা বলেননি। কিন্তু কাজও তো
নেই তেমন। উনি সেই সকাল নটায় বেড়িয়ে যান, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে সাতটা।
সারাটা দিন কী করি বলো তো...আর আমাকে কেনই বা আর রাখবেন এত মাইনে দিয়ে”?
“কত দেয় রে তোকে, আন্টি”?
“সাড়ে পাঁচ। থাকা খাওয়া ছাড়া”।
“সাড়ে পাঁচ হাজার? বাপ রে। ঠিক
আছে, আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলে তোকে জানাবো। কিন্তু অত মাইনে তো হবে না”।
“অত মাইনে আমি চাই না, মিঠুদিদি।
আমি বাঁচতে চাই। সুস্থ স্বাভাবিক জীবন চাই...”।
“আচ্ছা, আচ্ছা, দেখছি কি করা যায়”।
মিঠুদিদি ফোনটা কেটে দিল। ছবির আরো কিছু বলার ছিল। বলা হল না। খুব ছোট্ট একটা
নিশ্বাস চেপে ছবি মনে মনে বলল – মিঠুদিদি, তুমি না আমায় ভালবাস?
ফোনটা আচমকা কেটে দিয়ে প্রতীক্ষাও স্বস্তি পেল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, ছবিকে সে সত্যিই ভালোবাসে এবং এখন সেটাই সব থেকে বড়ো সমস্যা। তার মাও ছবিকে যথেষ্ট স্নেহ করেন, সে বললে হয়তো তাদের বাড়িতেই ছবি কাজে লেগে যেতে পারে। কিন্তু সামনাসামনি এলেই প্রতীক্ষা আবার দুর্বল হয়ে পড়বে ছবির প্রতি। কারও পক্ষেই সেটা মঙ্গলজনক হবে না, প্রতীক্ষা বুঝে গিয়েছে। মনে মনে বলল, স্যরি রে ছবি, আমি তোর সঙ্গে আর জড়াতে চাই না।
...চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন