[এর আগের পর্ব এই সূত্র থেকে পড়া যাবে - রতনে রতন চেনে।]
এমন নয়
যে মামার বাড়ি বা গ্রাম বাংলা আমার কাছে নতুন জায়গা। এর আগেও গেছি। কিন্তু এইবারটা
একটু অন্যরকম। অন্যান্য বার আমাদের থাকার সময় হত সীমিত, সাতদিন বড়জোর দশদিন।
কলকাতার আবদ্ধ জীবনের থেকে মুক্তির রসাস্বাদন শুরু হবার আগেই যেন ফেরার আয়োজন চালু
হয়ে যেত। এবারে থাকাটা একদম আলাদা – সরকারি
নির্দেশ অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য।
পৌঁছোনোর
পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে টেনে তুলে দিল ছোটমাসিমা - হাতে
ধরিয়ে দিল একটা কাঁসার গেলাস – ধরে
দেখলাম সেটা
কনকনে ঠান্ডা। এমনিতেই কলকাতার চেয়ে অনেক বেশী ঠান্ডা
এখানে। গেলাসটা
হাতে ধরতে আমার হাড়গোড় পর্যন্ত কেঁপে উঠল ঠান্ডায়। ফিকে বাদামি রঙের,
সরস্বতীপুজোর পায়েসের গন্ধ মাখা পানীয় – সঠিক বললে - সার্ভড অ্যাজ চিল্ড। হাল্কা
চুমুক দিতেই দাঁতের গোড়া ঝাঁকিয়ে উঠল ঝনঝন করে, কিন্তু রসনার স্বাদকোরকগুলি রীতিমত
নড়েচড়ে বসল এমন একটি অনাস্বাদিত রসের অভূতপূর্ব আস্বাদ পেয়ে। পানীয়টি খেজুর গাছের
রস – আর এ জিনিষ যে আমাদের কলকাতায় মিলবে না সেটা গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করতেও ছাড়ল
না ছোটমাসিমা। বাবা আমার পাশেই বসেছিলেন, তিনিও মাসিমার কথায় কোন
প্রতিবাদ করলেন না। অথচ ওই বয়সেই অনেক বয়স্ক লোকের মুখেই শুনেছিলাম – ‘কি পাওয়া
যায় না, হে - পয়হা ফেললে বাঘের দুদও মেলে কলকেতায়’!
সেদিন সকালেই বাবা নিমের ডাল দিয়ে
দাঁতন করলেন। বিষাক্ত কেমিক্যালযুক্ত পেস্ট আর প্লাস্টিকের বুরুশের থেকে
অন্ততঃ একদিন প্রাকৃতিক মুক্তি পাবার জন্যে। বাবার দেখাদেখি বায়না ধরলাম আমিও।
ভাবলাম না জানি এও কোন অজানা জগৎ খুলে দেবে আমার সামনে। খেজুররসে সদ্যতৃপ্ত রসনা
সেদিন চমকে উঠেছিল আমার এ হেন অবিমৃষ্যকারিতায়, আর আমার অন্তরাত্মার হাতে পায়ে ধরে
বারবার বলেছিল ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’। বারবার মানা করা সত্ত্বেও শুনিনি
বলে, ছোটমাসিমা আমার কি অবস্থা দাঁড়ায় দেখতে সামনেই দাঁড়িয়েছিল। মাথার চুল থেকে
পায়ের নখ পর্যন্ত তিক্ত হয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু বাবার মতো গম্ভীরভাবে পায়চারি করতে
করতে নিমের ডালেই দাঁত মেজেছিলাম সেদিন এবং সেই বয়সেই বুঝে গিয়েছিলাম - ইগো বড়
বালাই।
সেদিন বিকেলেই বাবা ফিরে গেলেন
কলকাতায়। ছোটমামা বাবাকে এগিয়ে দিতে গেল। আমরা সদর দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম
যতক্ষণ বাবাকে দেখা যায়। দিদিমা, দুই মাসিমা, মামাতো দিদি এবং সবার পিছনে বড়োমামা
- সকলেই ছিলেন আমাদের সঙ্গে। বাবা যখন রাস্তার মোড়ে আড়ালে চলে গেলেন, দিদিমা হাত
জোড় করে নমস্কার করে বললেন ‘সব ভালো রেখো, মা বিপত্তারিণী’, ঘোমটা দেওয়া মায়ের
গম্ভীর মুখ আর চোখে জল টলটল করছিল। ভীষণ মন খারাপ করতে লাগল বাবার জন্যে।
আমি অচিরেই আমার মামাতো দিদির একান্ত
ভক্ত হয়ে উঠলাম। বহ্নি আমার উচ্চারণে হয়ে গেল বন্নিদিদি। কাজে অকাজে বন্নিদিদির
সঙ্গী হবার জন্যে আমি উদ্গ্রীব থাকতাম, আর বন্নিদিদিও আমার মতো একটি অনুরক্ত ভাই
পেয়ে যারপরনাই হ্লাদিতা হয়েছিল সন্দেহ নেই।
দুপুরে দিদিমা, মা-মাসিমার
দিবানিদ্রার অবসরে আমি বন্নিদিদির একান্ত সঙ্গী হিসেবে দিদিমার কড়ির বয়ামে
সুরক্ষিত কুলের আচার, আমের মিষ্টি ও টক আচার, আমচূর ইত্যাদির নিয়মিত অংশীদার হতে
পেরেছিলাম। মাঝে মাঝে কোথা থেকে কে জানে বন্নিদিদি কৎবেল জোগাড় করে আনত। সকালে
সর্ষের তেল, বিট নুন, গুড় দিয়ে মেখে রেখে দিত রোদ্দুরে - কিন্তু সকলের চোখের
আড়ালে। দুপুরে সেই জারিয়ে ওঠা কৎবেলের গন্ধেই মুখের ভিতরটা রসস্থ হয়ে উঠত। তর্জনীর
ডগায় অল্প একটু মাখা নিয়ে বন্নিদিদি টেষ্ট করত, তার চোখ ছোট্ট হয়ে যেত কুঁচকে, আর
জিভে টক করে আওয়াজ তুলে বলত –‘দারুউউণ’। তারপর আমার জিভেও একটু লাগিয়ে দিয়ে মুখের
দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করত - কেমন? অদ্ভূত স্বাদে আমার মোহিত রসনা তখন জবাবরহিত, তাই
ঘাড় নাড়িয়ে বন্নিদিদির রসবোধকে পূর্ণ সমর্থন করে বন্নিদিদির বাটির দিকে তাকাতে,
বন্নিদিদি আদ্দেকের বেশ কিছুটা কম আমার হাতে তুলে দিয়ে বলত-
– ‘বেশী খাসনি, বদহজম হবে। আর তোর
পেট খারাপ হলে মা আমার পিঠ ফাটাবে...’।
বন্নিদিদির মা মানে আমার মামিমা।
একদিন সকালবেলা নটা সাড়ে নটা
নাগাদ ছোট্ট একটি বালতি হাতে বন্নিদিদি আমাকে বলল ‘আমার সঙ্গে যাবি তো চ, গোয়ালে
যাব গাই দুইতে’। আমার বিশ্বাসই হয়নি। বন্নিদিদি কতো বড়ো আমার চেয়ে – মেরেকেটে বছর
তিন কি চারেকের হবে। সে ওই বড়ো বড়ো শিংওলা গরুগুলোকে সামলাতে পারবে? এই বুঝি পেটে
শিং দিয়ে গুঁতিয়ে দিল - এই ভয়েই তো আমি সারা!
বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেক দূরেই
মামাদের খামার বাড়ি, তার একধারে টালির চাল দেওয়া টানালম্বা গোয়াল ঘর। বুকসমান উঁচু
মাটির চাতালে ছটা পোড়ামাটির লাল রংয়ের ডাবা বসানো। মেঝেয় ছটা খোঁটা পোঁতা আছে, গরু
মোষ বাঁধার জন্যে। চারিদিক গোময় এবং গোমূত্রলিপ্ত অর্থাৎ হিন্দুশাস্ত্র মতে পবিত্র। দুধসাদা বাছুরটা গোয়ালের
বাইরে বাধাঁ ছিল, বড়ো বড়ো কালো চোখ মেলে দেখছিল তার মাকে আর ছটফট করছিল মায়ের কাছে
যাবার জন্যে। গোয়ালে খোঁটায় বাঁধা মা গাইটি - যার দিদিমা নাম রেখেছিলেন গৌরী -
বারবার ডেকে উঠছিল হাম মা...।
ভুবনমামা - মামাবাড়ির রাখাল -
লম্বা পাতবঁটিতে ঘস ঘস করে গরুমোষের খাবার ‘ছানি’ কুচোচ্ছিল খড়ের আঁটি কেটে কেটে।
সে মুখ তুলে তাকাল, বলল - ‘এতক্কনে এলে বন্নিদিদি, সেই থিকে তোমার গউরি ডেকে ডেকে
সারা -’। মামাবাড়ির বাসন মাজা, ঘর নিকোনো, ঘুঁটে দেওয়ার কাজ করে বিধবা ভামিমাসী -
সত্যভামা – আমাদের দেখে হাসল। তার দুহাতে গোবর লেগে, একটা ঝুড়িতে গোবর তুলে রাখছে
সে, দুপুরে ঘুঁটে দেবে বলে।
বন্নিদিদি খোঁটা থেকে বাছুরটাকে
খুলে দিতেই বাছুরটা ছুট্টে চলে গেল তার মায়ের কাছে। মাথার ঢুঁ দিয়ে দিয়ে মায়ের
পালান চুষতে শুরু করল আর গৌরী ঘাড় ঘুরিয়ে ধূসর রঙের লম্বা জিভ দিয়ে চাঁটতে লাগল
তার সন্তানের গা, পিঠ আর সদা চঞ্চল লেজটি। সেইসময় বা তার কিছুদিন পরে
কংগ্রেসের ভোটের সিম্বল ছিল ‘গাইবাছুর’ – অবিকল যেন এই গৌরী আর তার বাছুরের ছবি।
সেই সিম্বলকে প্রত্যক্ষ জেনেছিলাম বন্নিদিদির সঙ্গে মামাবাড়ির গোয়ালে।
মিনিট চারপাঁচেক পরেই বন্নিদিদি
বাছুরটাকে টেনে সরিয়ে আনল, আমাকে দড়িটা ধরিয়ে দিয়ে বলল –‘শক্ত করে ধরে রাখ, কাছে
আসতে দিস না’। বলেই উবু হয়ে বসে গেল গৌরীর নীচে বালতিটা রেখে। দুটি বাঁট
দুহাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে চেপে চেপে দুধ দুইতে শুরু করল। ফিনকি দিয়ে ঝরে পড়া সফেন
দুধে খালি বালতি আস্তে আস্তে ভরে উঠতে লাগল – এই দুধ আমাদের পুষ্টি দেবে, দেবে
লাবণ্য ও শক্তি। কারণ দিদিমার মুখে শুনেছি “দুধে লাবণ্য বৃদ্ধি, ঘৃতে
বৃদ্ধি বল। মাংসে মাংস বৃদ্ধি, শাকে বৃদ্ধি মল”। সমস্ত দুধ নিংড়ে নিয়ে
প্রায় পৌনে-বালতি ভরা দুধ নিয়ে বন্নিদিদি উঠে এল, আমাকে বলল বাছুরটাকে ছেড়ে দিতে -
ছেড়ে দিলাম। অবুঝ ক্ষুধার্ত বাছুরটা আবারও ছুটে গেল তার মায়ের কাছে। গৌরী তখন
নিঃস্ব – তার রিক্ত পালানে নিজের সন্তানের স্পর্শও তখন বিরক্তিকর।
এর আগে গরুর রচনা পড়েছি। সে
অনুযায়ী গুনে গুনে বুঝে নিয়েছি তার শিং, পা, ক্ষুর লেজের চুলচেরা হিসেব। আমাদের
পুষ্টিবিধানের জন্যে তার নিরলস দুগ্ধ সরবরাহের উপকারী প্রয়াসের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা
ও কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ছিল সেই সব রচনায়। বাড়িতে দেখেছি যে কোন যজ্ঞ অনুষ্ঠানে,
পঞ্চগব্য আবশ্যিক উপচার এবং শুনেছি বহুল প্রচলিত মন্ত্রে গোমাতার স্তব ও স্তুতি। সেদিন বুঝেছিলাম চরম এক
বঞ্চনাকে কি সুচারুভাবেই না ঢেকে রাখা হয়েছে মানবসভ্যতার উন্মেষ থেকে!
এই শোষণ, দোহন ও বঞ্চনার ইতিহাস
ততটাই প্রাচীন, যতটা প্রাচীন মানুষের সামাজিক ইতিহাস। সবল শোষণ করে অবলকে, সক্ষম
দোহন করে অক্ষমকে এবং একে আড়াল করার জন্যে আবহমানকাল ধরে চলে আসছে পাপ-পুণ্য,
পূর্বজন্মের সুকৃতি-দুষ্কৃতির খতিয়ান। নির্বলের হতাশা এবং সবলের সম্ভাব্য বিবেক
দংশন যদি কোনভাবেই ঢাকা না দেওয়া যায়, তাহলেও হাতে তো থাকছেই - কপালের লিখন –
‘নেকন, নেকন, বুয়েচ হে, সবই কপালের নেকন’!
এতটা স্পষ্ট উপলব্ধি সেদিনই আমার
ঘটে গিয়েছিল মোটেই তা নয়, কিন্তু চেতনায় এই রূপটা যে একটা অস্পষ্ট আকার নিচ্ছিল
এটা সত্যি। কলকাতার বাসায় আমাদের ছোট্ট সীমিত সংসারে, উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত
পাড়ায় এবং স্কুলের ছকবাঁধা নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে এই চেতনার আভাস আসাও – অন্ততঃ সেই
বয়সে – একপ্রকার অসম্ভবই ছিল আমার মনে হয়।
সে যাই হোক, বাড়ি এসে মাকে
বন্নিদিদি আর আমার কৃতিত্বের কথা সবিস্তারে জানাতে, মা বলল প্রাচীনকালে মেয়েরাই
নাকি গাই দুইত মানে দোহন করত আর সংস্কৃতের দোহন শব্দ থেকেই নাকি দুহিতা শব্দ এসেছে
– যার মানে কন্যা বা মেয়ে। তার মানে বন্নিদিদি ভারতবর্ষের এক কন্যার সনাতন
প্রতিরূপ এবং প্রতিভূ! আশ্চর্য!
এমন ভাবেই প্রত্যেকটি দিন - নিত্যনতুন
এবং অভিনব স্বাদ রূপ রস নিয়ে ধরা দিতে লাগল আমার কাছে। চিনে নিতে লাগলাম আমার
জীবনের ভিত্তি আর সম্পর্কের সব শিকড়গুলি। গোগ্রাসে আত্মসাৎ করছিলাম এর সবকিছু। গড়ে
উঠতে লাগল এক ভিন্ন মাত্রার জীবনবোধ। যে বোধ আমার চেনাশোনা শহরের জীবনযাপন পদ্ধতির
থেকে অনেকটাই আলাদা।
-০০-
ভালো লাগলো, নির্মম সত্য।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ। সঙ্গে থাকবেন।
উত্তরমুছুন