রবিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৫

রতনে রতন চেনে

 

বেকার যুবকের কথা বা গল্প অনেক হয়ে গেছে এরপরেও আরো হয়তো হতে থাকবে। কিন্তু বেকার বালকের কথা আমি অন্ততঃ কোনদিন শুনিনি তবে প্রায় মাস তিনেক বেকার জীবনের আস্বাদ উপভোগ করেছিলাম আমার বালক বয়সেই।

আমাদের স্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত মর্নিং সেসন ছিল - ক্লাস সিক্স থেকে ডে। কাজেই ক্লাস ফাইভের সিনিয়ার মোস্ট বাচ্চারা, ক্লাস সিক্সে উঠলেই হয়ে যেত জুনিয়ার-মোস্ট বড়। এই বড় হবার একটা আলাদা আমেজ সঞ্চারিত হচ্ছিল আমার মধ্যে। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে স্কুল ড্রেস পরে বাচ্চাদের মত বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া। স্কুল থেকে ফিরে সারাটা দিন বাচ্চাদের মত মায়ের সঙ্গে ঘুর ঘুর করা। আমার ঘুম না আসা দুপুরে মায়ের হাতের মিঠে চাপড়ি খেয়ে ঘুমের অভিনয় করা। মা ঘুমিয়ে পড়লেই সারাটা দুপুর চুপিচুপি বিস্তর উনখুটে কাজ সারা - হোমিওপ্যাথির মিষ্টি মিষ্টি গুলি, শুকনো হরলিকস, ডবল বিস্কুটের মাঝে মাখন চেপে বিস্কুটের ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে আসা মাখন লেহন... অর্থাৎ মকখন চোর, নন্দকিশোর হয়ে থাকাটা আর ভাল লাগছিল না।

ক্লাস সিক্সে উঠলে দাদার সঙ্গে একসঙ্গে বসে ভাত খেয়ে বড়দের মতো বেরিয়ে যাবো। যেমন বাবাও একটু আগে অফিস বেরোন। বিকেল বেলা বিদ্যের বোঝা নিয়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরব, যেমন বাবাও সারাদিনের কাজ সেরে ক্লান্ত হয়ে ফেরেন একটু সন্ধ্যের পর। মনে হত - বড় হতে এমন কি আর দেরি, কতটাই বা বাকি আর?

 সে স্বপ্নে বাদ সাধল, যেদিন আমরা ক্লাস ফাইভের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রুটিন নিতে স্কুলে গেলাম। সেটা সত্তর সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তা হবে। রুটিন নিয়েই আমাদের ছুটি হয়ে যাবে সাতদিনের জন্যে - পড়ার ছুটি। তারপর পরীক্ষা, আবার ছুটি, পরের বছর জানুয়ারির দশ এগারো করে রেজাল্ট বেরিয়ে গেলেই নতুন ক্লাস, নতুন বই আর নতুন ধরনের এক বড়সড়ো জীবনের সূত্রপাত।

 অন্যদিন স্কুলের বেশ কিছুদূর থেকেই ছেলেদের চেঁচামেচি আর হৈচৈতে স্কুলকে স্কুল বলে মনে হত। সেদিন একদম চুপচাপ - থমথমে ভাব। শোলে রিলিজ হতে তখনো অনেক দেরি, নাহলে বলা যেত ইতনা সন্নাটা কিঁউ হ্যায়, ভাইইই?  স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকেই সিঁড়ির মুখে একটা ব্ল্যাকবোর্ড – চার ঠ্যাং সাপোর্টে দাঁড় করানো, তাতে লেখা

বিশেষ বিজ্ঞপ্তি

এতদ্বারা সকল অভিভাবকবৃন্দ ও ছাত্রগণকে জানানো যাইতেছে যে অনিবার্য কারণবশতঃ এবং পঃ বঃ সরকারের মাননীয় শিক্ষা অধিকর্তার নির্দেশ অনুসারে বিদ্যালয়ের সকল শ্রেণীর পঠনপাঠন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকিবে। সকল শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষাও আপাততঃ স্থগিত থাকিবেবিদ্যালয়ের পঠনপাঠন শুরু হইবার তারিখ পঃ বঃ শিক্ষা দপ্তরকর্তৃক সংবাদপত্র ও বেতার মাধ্যমে পরিজ্ঞাত হইবে এবং তদনুসারে স্থগিত সকল বার্ষিক পরীক্ষার পরিবর্তিত সময়সূচী বিদ্যালয় হইতে সংগ্রহ করিতে হইবে।

অনুমত্যনুসারে

বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ

 

আমরা মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি করে নোটিসটা বেশ বার কয়েক পড়ে ফেললাম। যেটুকু বোধগম্য হতে বাকি ছিল অভিভাবকদের আলাপ আলোচনা ও কথাবার্তা থেকে সেটাও বুঝে ফেলা গেল। কিন্তু আমাদের হতভম্ব ভাবটা কাটাতে ভাস্করদার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সদাহাস্যমুখ উৎকলবাসী ভাস্করদার আমাদের স্কুলের মেন গেট সামলানোর দায়িত্ব ছিল। বছরের পর বছর আমাদের মতো ছেলেপুলেদের বেয়ারা বায়নাই হোক অথবা বাইরের লোকের উটকো হম্বিতম্বিই হোক ভাস্করদা সবকিছুই সামলাত হাসিমুখে এবং স্কুল চলাকালীন ভাস্করদা ছিল নিশ্ছিদ্র প্রহরী - হেডস্যারের বিনা অনুমতিতে ভেতরের জিনিষ বাইরে অথবা বাইরের জিনিষ ভেতরে আসতে পারত না।

 কিছুটা বাংলা আর অনেকটা ওড়িয়া ভাষায় ভাস্করদা বলেছিল গতকাল স্কুল ছুটির পর - প্রায় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ, কয়েকজন ছোকরা হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করতে চায়।  কি দরকার জিগ্যেস করাতে তারা কোন এক কলেজের নাম বলেছিল। এমন তো আসেই অনেকে - অন্য স্কুল থেকে, কলেজ থেকে ভাস্করদা গেট খুলে দিয়েছিল। ছেলেগুলো হেডস্যারের ঘরের দিকে না গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে উঠেছিল সিঁড়িতে। হতচকিত ভাস্করদা তাদেরকে ডেকে কিছু বলার আগেই তারা উঠে গেছে ওপরে। ভাস্করদার সন্দেহ হতে অন্য সবাইকে নিয়ে যখন ওপরে খুঁজতে যায় তাদের সে সময়ে ভিতরের উঠোনের দিক থেকে পর পর দুটো বোমা ফাটার বীভৎস আওয়াজ শুনতে পায়। ওরা বুঝতে পারে আমাদের স্কুল সত্তরের ছাত্র আন্দোলনে আক্রান্ত।

এতদিন আমরা জানতাম না, কোন ঘরে আমাদের পরীক্ষার কোয়েশ্চেন ছাপা হয়ে সংরক্ষিত হতো। সেদিন জানলাম। কারণ সেই ঘরের দরজাটা ভাঙা এক কব্জায় ঝুলছে। ঘরের ভিতরে বাইরে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে পোড়া কাগজের ছাই, আধপোড়া প্রশ্নপত্রের প্যাকেট। ঘরের ভিতরের দেওয়ালে, সিলিংয়ে আগুনের আঁচে কালো কালো ঝলসানো দাগ। ওপরের বারান্দা থেকে ছোঁড়া বোমা ফেটে উঠোনের ঝলসে যাওয়া দাগ দুটোও দেখলাম।

 রোজ স্কুলে এসে বা টিফিনের সময় আমরা ওই উঠোনে লেম-ম্যান খেলতাম। লেম-ম্যান এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আমাদেরকে ধরার চেষ্টা করবে। একটা গন্ডির মধ্যে সীমিত থাকত সেই খেলা। গন্ডির বাইরে চলে গেলে বা লেম-ম্যান ছুঁয়ে দিলে যে আউট  হতো সেই হতো পরবর্তী লেম-ম্যান। ছাত্র আন্দোলনের একটা বোমা ফেটেছে আমাদের সেই গন্ডির মাঝখানেই প্রায়।

বারান্দায় ঘরের বাইরের দেওয়ালে স্লোগান লিখে গিয়েছিল তারা। সেখানে বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার ছিল। ছিল চীনের চেয়ারম্যানকে আপন করে নেবার দায়িত্বপূর্ণ আব্দার। বন্দুকের নলই যে শক্তির একমাত্র উৎস আমাদের সে তথ্য দিতেও তারা ভুল করেনি সেখানে। বিপ্লবের দীর্ঘজীবনের প্রতিও সংশয়ের অবকাশ রাখেনি তারা। সবশেষে তারা লিখে গিয়েছিল একটি ধাঁধা – ‘রতনে রতন চেনে / বিড়লা চেনে জ্যোতি

 কলকাতায় তখন দারুণ টালমাটাল পরিস্থিতি। রোজ শেষ রাত্রে পাড়ায় পুলিশ আসে। তাদের পায়ের ভারি বুটের শব্দে ঘুম ভাঙা চোখে আর ঘুম আসে না। সকালে দুঃসংবাদ কানে আসে। কোন কোন তরুণ কোন কোন যুবক আন্দোলনে যুক্ত সন্দেহে ধৃত। অনেক সময়েই তাদের কোনভাবেই আর হদিশ মেলে না। আমার বাবা আর মা পরামর্শ করে ঠিক করলেন আমাদের বর্ধমানের গ্রামে মামারবাড়িতে পাঠিয়ে দেবার। মাও থাকবেন আমাদের সঙ্গে। বাবা আমাদের পৌঁছে দিয়ে কলকাতায় ফিরবেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাবা খবর দেবেন এবং আমাদের আবার নিয়ে আসবেন কলকাতায়।

 প্রায় মাস তিনেক থাকতে হয়েছিল মামার বাড়িতেবইখাতার বোঝা নিয়ে গিয়েছিলাম সঙ্গে, কিন্তু সমস্ত রকমের লেখাপড়াহীন এক বেকার জীবন কাটিয়েছিলাম গ্রাম বাংলায়।    

 একদিন খুব ভোরে আমরা হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ধরে রওনা দিলাম বর্ধমান। পিছনে পড়ে রইল তপ্ত কলকাতা আর শান্ত শীতল আমার স্কুল। হিন্দু স্কুল। স্থগিত হয়ে গেল আমার চটজলদি বেড়ে ওঠার স্বপ্ন


তখন বুঝিনি আজ বুঝি - অনেক বড়ো হয়ে যাচ্ছিলাম প্রতিদিন, প্রতিটি ঘটনায় ঋদ্ধ হচ্ছিল অভিজ্ঞতা। যে পাঠ কোন স্কুলের সিলেবাসে নেই, সেই পাঠ যেন নিজে এসে মেলে ধরছিল তার রহস্য রূপ, শব্দ আর গন্ধ দিয়ে। যে রতন নেই কোনো জহুরির ঘরে, সেই রতন চিনে নেবার দায় এসে পড়ল আমার ছোট্ট দুই কাঁধে।

  -০০-

 

২টি মন্তব্য:

  1. বেশ সুন্দর লিখেছিস। কিছুক্ষণের জন্য আবার সেই দিনগুলোয় ফিরে গেলাম।

    উত্তরমুছুন
  2. খুব ভালো লাগল তোর মন্তব্য পড়ে। সঙ্গে থাকিস - আরও অনেক লেখা পাবি এই ব্লগে।

    উত্তরমুছুন

নতুন পোস্টগুলি

ধর্মাধর্ম - ১/৫

[এর আগের পর্ব পড়তে  হলে এই সুত্রে প্রবেশ করুন -  ধর্মাধর্ম - ১/৪ ]   প্রথম পর্ব  (৭০ , ০০০ বিসিই থেকে ১২ , ০০০ বিসিই) - ৫ম পর্বাংশ ১.৪.২ বিশ...