বেকার যুবকের কথা বা গল্প অনেক হয়ে গেছে – এরপরেও আরো হয়তো হতে থাকবে। কিন্তু বেকার বালকের কথা আমি অন্ততঃ কোনদিন শুনিনি – তবে প্রায় মাস তিনেক বেকার জীবনের আস্বাদ উপভোগ করেছিলাম আমার বালক বয়সেই।
আমাদের স্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত মর্নিং সেসন ছিল - ক্লাস সিক্স থেকে ডে। কাজেই ক্লাস ফাইভের সিনিয়ার মোস্ট বাচ্চারা, ক্লাস সিক্সে উঠলেই হয়ে যেত জুনিয়ার-মোস্ট বড়। এই বড় হবার একটা আলাদা আমেজ সঞ্চারিত হচ্ছিল আমার মধ্যে। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে স্কুল ড্রেস পরে বাচ্চাদের মত বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া। স্কুল থেকে ফিরে সারাটা দিন বাচ্চাদের মত মায়ের সঙ্গে ঘুর ঘুর করা। আমার ঘুম না আসা দুপুরে মায়ের হাতের মিঠে চাপড়ি খেয়ে ঘুমের অভিনয় করা। মা ঘুমিয়ে পড়লেই সারাটা দুপুর চুপিচুপি বিস্তর উনখুটে কাজ সারা - হোমিওপ্যাথির মিষ্টি মিষ্টি গুলি, শুকনো হরলিকস, ডবল বিস্কুটের মাঝে মাখন চেপে বিস্কুটের ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে আসা মাখন লেহন... অর্থাৎ মকখন চোর, নন্দকিশোর হয়ে থাকাটা আর ভাল লাগছিল না।
ক্লাস সিক্সে উঠলে দাদার সঙ্গে একসঙ্গে বসে ভাত খেয়ে বড়দের মতো বেরিয়ে যাবো। যেমন বাবাও একটু আগে অফিস বেরোন। বিকেল বেলা বিদ্যের বোঝা নিয়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরব, যেমন বাবাও সারাদিনের কাজ সেরে ক্লান্ত হয়ে ফেরেন একটু সন্ধ্যের পর। মনে হত - বড় হতে এমন কি আর দেরি, কতটাই বা বাকি আর?
“বিশেষ
বিজ্ঞপ্তি
এতদ্বারা
সকল অভিভাবকবৃন্দ ও ছাত্রগণকে জানানো যাইতেছে যে অনিবার্য কারণবশতঃ এবং পঃ বঃ
সরকারের মাননীয় শিক্ষা অধিকর্তার নির্দেশ অনুসারে বিদ্যালয়ের সকল শ্রেণীর পঠনপাঠন
অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকিবে। সকল শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষাও আপাততঃ স্থগিত
থাকিবে। বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন শুরু হইবার তারিখ পঃ বঃ শিক্ষা
দপ্তরকর্তৃক সংবাদপত্র ও বেতার মাধ্যমে পরিজ্ঞাত হইবে
এবং তদনুসারে স্থগিত সকল বার্ষিক পরীক্ষার পরিবর্তিত সময়সূচী বিদ্যালয় হইতে সংগ্রহ
করিতে হইবে।
অনুমত্যনুসারে
বিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষ”
আমরা
মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি করে নোটিসটা বেশ বার কয়েক পড়ে ফেললাম। যেটুকু বোধগম্য হতে
বাকি ছিল অভিভাবকদের আলাপ আলোচনা ও কথাবার্তা থেকে সেটাও বুঝে ফেলা গেল। কিন্তু
আমাদের হতভম্ব ভাবটা কাটাতে ভাস্করদার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সদাহাস্যমুখ উৎকলবাসী
ভাস্করদার আমাদের স্কুলের মেন গেট সামলানোর দায়িত্ব ছিল। বছরের পর বছর আমাদের মতো
ছেলেপুলেদের বেয়ারা বায়নাই হোক অথবা বাইরের লোকের উটকো হম্বিতম্বিই হোক ভাস্করদা
সবকিছুই সামলাত হাসিমুখে এবং স্কুল চলাকালীন ভাস্করদা ছিল নিশ্ছিদ্র প্রহরী -
হেডস্যারের বিনা অনুমতিতে ভেতরের জিনিষ বাইরে অথবা বাইরের জিনিষ ভেতরে আসতে পারত
না।
এতদিন আমরা জানতাম না, কোন ঘরে আমাদের পরীক্ষার কোয়েশ্চেন ছাপা হয়ে সংরক্ষিত হতো। সেদিন জানলাম। কারণ সেই ঘরের দরজাটা ভাঙা – এক কব্জায় ঝুলছে। ঘরের ভিতরে বাইরে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে পোড়া কাগজের ছাই, আধপোড়া প্রশ্নপত্রের প্যাকেট। ঘরের ভিতরের দেওয়ালে, সিলিংয়ে আগুনের আঁচে কালো কালো ঝলসানো দাগ। ওপরের বারান্দা থেকে ছোঁড়া বোমা ফেটে উঠোনের ঝলসে যাওয়া দাগ দুটোও দেখলাম।
বারান্দায় – ঘরের বাইরের দেওয়ালে স্লোগান লিখে গিয়েছিল তারা। সেখানে বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার ছিল। ছিল চীনের চেয়ারম্যানকে আপন করে নেবার দায়িত্বপূর্ণ আব্দার। বন্দুকের নলই যে শক্তির একমাত্র উৎস আমাদের সে তথ্য দিতেও তারা ভুল করেনি সেখানে। বিপ্লবের দীর্ঘজীবনের প্রতিও সংশয়ের অবকাশ রাখেনি তারা। সবশেষে তারা লিখে গিয়েছিল একটি ধাঁধা – ‘রতনে রতন চেনে / বিড়লা চেনে জ্যোতি’।
তখন বুঝিনি – আজ বুঝি - অনেক বড়ো হয়ে যাচ্ছিলাম প্রতিদিন, প্রতিটি ঘটনায় ঋদ্ধ হচ্ছিল অভিজ্ঞতা। যে পাঠ কোন স্কুলের সিলেবাসে নেই, সেই পাঠ যেন নিজে এসে মেলে ধরছিল তার রহস্য – রূপ, শব্দ আর গন্ধ দিয়ে। যে রতন নেই কোনো জহুরির ঘরে, সেই রতন চিনে নেবার দায় এসে পড়ল আমার ছোট্ট দুই কাঁধে।
বেশ সুন্দর লিখেছিস। কিছুক্ষণের জন্য আবার সেই দিনগুলোয় ফিরে গেলাম।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগল তোর মন্তব্য পড়ে। সঙ্গে থাকিস - আরও অনেক লেখা পাবি এই ব্লগে।
উত্তরমুছুন